Thursday 13 April 2017

জামায়াতের সংস্কার নিয়ে কামারুজ্জামানের প্রস্তাবনা (কারাগার থেকে চিঠি)


জামায়াতের সংস্কার নিয়ে কামারুজ্জামানের প্রস্তাবনা (কারাগার থেকে চিঠি)

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবী



১. বাংলাদেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ইতিহাসের একটি কঠিনতম সংকটকাল অতিক্রম করছে। ১৯৭১ সালে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর মাত্র দুই দশকের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন পুনর্গঠন ও পুনবিন্যাসের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার মাত্র নয় বছরের মাথায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বাংলাদেশে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। অর্ধ শতাব্দীর বেশীকাল যাবত মিসরের ইসলামী আন্দোলন আল-ইখওয়ানুল মুসলেমুন বা মুসলিম বাদারহুড এখনও পর্যন্ত নিষিদ্ধই রয়ে গিয়েছে। তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন অনেকবার নাম পরিবর্তন করে অনেকটা সেক্যুলার আদলে কাজ করছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরও বাস্তব কারণেই এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেছে।


২. এত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী স্বনামে আবির্ভূত হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হওয়ার পিছনের মূল কৃতিত্ব ঐ সব তরুণদের যারা অকপটে ইসলামের জন্য জীবন দান করেছে এবং শাহাদাত বরণ করেছে। শতাধিক শাহাদাতের ঘটনা ইসলামী আন্দোলনকে আধ্যাত্মিক শক্তি যুগিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বর্তমান পর্যায়ে আসার জন্য দ্বিতীয় যে শক্তি তাহলো সারাদেশে জামায়াত ও শিবিরের নিবেদিত প্রাণ সক্রিয় কর্মীগণ। শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র ইসলামের জন্যই তারা এই আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এতবড় মুখলেছ কর্মীবাহিনী পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। তৃতীয়তঃ জনগণের মধ্যে একটি বিপুল অংশ যাদের সংখ্যা কম করে হলেও ১০-১৫% ভাগ হবে তারা ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সমবেদনা পোষণ করেন।

৩. কিন্তু বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী তথা বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন যে সংকটের মুখোমুখি তা খুবই ব্যতিক্রমধর্মী। জামায়াতে ইসলামীকে দল হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী এবং উপরন্তু দলের বর্তমান নেতৃত্বকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে বিশেষ এক পরিস্থিতিতে একটি ইসলামী দল হিসাবে বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করার বিপক্ষে তথা পাকিস্তান নামক দেশটিকে এক রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল জামায়াত। তখনকার জামায়াত মনে করতো পাকিস্তান এক রেখে এখানে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব ও পশ্চিমের অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার অবসান হবে। জামায়াতের আরও আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ আলাদা হলে এখানে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু জামায়াতের এবং আরো যারা পাকিস্তানকে এক রাখার পক্ষে ছিলো তাদের ইচ্ছার বিপরীতে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের ৯৫ হাজার সৈন্য ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপতি জগজিত শিং অরোরার নিকট নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। জামায়াত যদিও বা পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে ছিল তথাপি বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়। বাংলাদেশের সরকার জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলসমূহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জামায়াত নিজস্ব নামে আত্মপ্রাকশের সুযোগ লাভ করে।

৪. ১৯৪৭ সালে বৃটিশ দখলদারিত্বের অবসানের সময় উপমহাদেশে রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল। অনেকেই ভারত বিভাগের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয় ভারতকে খণ্ডিত করে। যারা পাকিস্তান চেয়েছিলেন তাদের অনেকেই ভারতেই থেকে যান। কেউ তাদের স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যায়িত করেনি। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে সেই মুসলিম লীগ দেশ ভাগ হবার পর এক অংশ ভারতেই থেকে যায় এবং অদ্যাবধি ভারতে মুসলিম লীগ রয়েছে। তাদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী বলা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষকে নিয়ে এমনভাবে প্রচারণা চালানো হয় যার ফলে গোটা জাতিকেই বিভক্ত করে ফেলা হয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দাবী ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সবাইকে সাথে নিয়ে দুর্ভেদ্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। কিন্তু যে শক্তি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের তদানীন্তন নেতৃত্বকে আলোচনার টেবিলে বসে রাজনৈতিক মীমাংসার পথ অনুসরণ করতে দেয়নি সেই শক্তিই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পরিবর্তে অনৈক্য, বিভেদ এবং প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার পথে দেশকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভাজন ও বিভক্তি জিইয়ে রাখাটা হচ্ছ একটি আধিপত্যবাদী কৌশল। বাংলাদেশে যাতে স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি না হয় তার জন্যই জাতিকে বিভক্ত করে রাখার এই কৌশল গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ যদি রাজনৈতিক হানাহানি মুক্ত হয় তাহলে দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্বনির্ভরতা অর্জন করবে। বাংলাদেশের বিশাল বাজার যারা দখলে রাখতে চায় তারা কিন্তু এটা চায় না যে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ঐক্যবদ্ধ এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হোক বাংলাদেশ। সত্যিকথা বলতে কি আধিপত্যবাদী শক্তি এ ব্যাপারে শতকরা একশত ভাগ সাফল্য অর্জন করেছে।

আজ বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে আজ কল্পিত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আবিষ্কার করে দেশকে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ দুইভাগে বিভাজন করে রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং নতুন প্রজন্মকে সেভাবেই বোঝানো হচ্ছে। অথচ ভারতে তো দেশ বিভাগের বিরোধী এবং দেশবিভাগের পক্ষের শক্তি বলে কিছু নেই। বরং তারা জাতীয় ইস্যুতে নিজেরা ঠিকই ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি এবং কংগ্রেস নেতারা জাতীয় দিবসে একসাথে বসছে, মহাত্মা গান্ধীর প্রতি এলকে আদভানী ও কংগ্রেসের নেতারা হাত ধরাধরি করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করছে। অথচ আদভানীদের দলই গান্ধীকে হত্যা করে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। তারা তাদের জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করছেন যথারীতি। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭১ কে কেন্দ্র করে যে মত দ্বৈততা ছিল বা পক্ষ বিপক্ষ ছিল তা জিইয়ে রাখার জন্য সর্বাধিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতপন্থী এবং ভারত বান্ধব লোকেরা। সারা ভারতের মুসলমানদের সংগ্রামের ফসল পাকিস্তানের ব্যাপারে ইসলামী দলগুলোর একটা দুর্বললতা ছিল এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর সকল ইসলামী দল ও ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিয়ে গঠনমূলক কাজ করছে। আর তাছাড়া ১৯৪৭ সালে যদি পাকিস্তান না হতো তাহলে তো আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ হতো না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম না হলে আজকের বাংলাদেশ হয়তো বা একটি প্রদেশের অংশ হতো। ঢাকাও স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানীর মর্যাদা পেতো না।

৫. জামায়াতে ইসলামীর জন্য সংকটটি সৃষ্টি হয়েছে এই জায়গায় যে, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ নতুনভাবে একটি দল হিসাবে আত্মপ্রাকাশের পরও আধিপত্যবাদী শক্তি এবং ইসলামের দুশমন অধার্মিক ও ধর্মহীন শক্তি এই সংগঠনকে বাংলাদেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বলে চিত্রায়িত করে দেশের জনগণের এক বিপুল অংশের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী দল হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। সাহিত্যে, নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতায়, সিনেমায়, টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকায় অব্যাহতভাবে অনেকটা একতরফা জামায়াত বিরোধী প্রচারণা চলে এবং জামায়াতের নেতৃবৃন্দের চরিত্রহনন করা হয়। স্বাধীনতা বিরোধিতার অভিযোগ বা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ খুবই গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অভিযোগ। বাংলাদেশে জামায়াত অত্যন্ত সততার সাথে সৎ ও যোগ্য লোকদের সমন্বয়ে নিয়মতান্ত্রিক ও গঠনমুখী কার্যক্রম আন্তরিকতার সাথে পরিচালনা সত্ত্বেও জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসাবে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ শক্তি পুরোপুরি সফলকাম হয়েছে। সাধারণ জনগণের নিকট বিষয়টির খুব একটা আবেদন না থাকলেও কিংবা জনগণ এসব নিয়ে না ভাবলেও সমাজের রাজনীতি সচেতন এবং এলিট শ্রেণী যারা আসলেই দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সক্রিয় রাজনীতি চর্চা করেন তাদের একটি বিপুল অংশই জামায়াতের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।

৬. দেশপ্রেমিক এবং সমাজের তুলনামূলকভাবে সৎ মানুষদের এই দলটির দুর্ভাগ্য বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি রং সাইডে পড়ে গিয়েছে। মিসরের ইখওয়ানের এই সমস্যা নেই বরং মিসরের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে দলটি অংশগ্রহণ করেছে। তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ইয়েমেনে সেখানকার ইসলামী আন্দোলন দুই ইয়েমেনকে একত্রিত করে আধুনিক গণতান্ত্রিক ইয়েমেন প্রতিষ্ঠায় সরাসরি অবদান রেখেছেন। নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া ও সুদানে সেখানকার ইসলামী আন্দোলনসমূহ স্বাধীনতা অর্জনে ইতিবাচক অবদান রেখেছেন। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ইসলামী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। পৃথিবীর সর্বত্রই ইসলাম স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তানের এটা একটা ট্রাজিডি যে দেশটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে ইসলামের দোহাই দিয়ে ইসলামকেই কলংকিত করেছে এবং আন্তরিকভাবে যারা দেশটার সংহতি রক্ষার পক্ষ অবলম্বন করেছে তারাও নিজেদের গায়ে কলংক লেপন করেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন তারা ১৯৭১ সালে জামায়াতের নেতৃত্বে ছিলেন না এবং অধিকাংশই জামায়াতের সদস্যও ছিলেন না তথাপি তারা স্বাধীনতা বিরোধিতার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং তাদেরকেই যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।

৭. একথা ঠিক যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি একটি মীমাংসিত ইস্যু। মরহুম শেখ মুজিব নিজেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করে গিয়েছেন। পাকিস্তানের ১৯৫ জন সামরিক কর্মকর্তার বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট পাস করা হলেও ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত এই ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর আগে দালাল আইনে স্থানীয় সহযোগীদের যে বিচার হচ্ছিল বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এতে আটক সাতত্রিশ হাজারের মধ্যে  পঁচিশ হাজার যাদের নামে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না তাদের মুক্তি দেয়া হয়। ২৮০০ এর বিচার হয় এবং এতে ৭৫২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়। আটক অন্যান্যদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় যখন মামলা চলছিল না এরকম একটি পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম ১৯৭৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর কথিত দালাল আইনটি বাতিল করেন। ফলে দালাল আইনে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু এরপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ ইস্যু সামনে আনেনি। ৩৯ বছর পর কেন এবার যুদ্ধাপরাধের মত একটি মীমাংসিত এবং স্পর্শকাতর ইস্যু এতটা গুরুত্বের সাথে সামনে আনা হলো? বিষয়টি খুবই পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে প্রতিহিংসা জাগিয়ে তোলার জন্য এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই সামনে আনা হয়।

৮. ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির ঐক্যের ফলে চারদলীয় জোটের বিজয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক তাৎপর্যময় ঘটনা। এই ঐক্য যদি অব্যাহত থাকে এবং আরো সম্প্রসারিত হয় তাহলে ভারত বান্ধব ধর্মহীন বা অধার্মিক সরকার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হয়ে যায়। ভারতীয় লবী এই বিষয়ে এখানে নানা কৌশল গ্রহণ করে। একদিকে তারা জামায়াতকে বলে যে, “আপনাদের মত একটি সৎলোকের দল বিএনপির মত একটি দুর্নীতবাজদের দলের সাথে জোট গঠন করে আপনাদের ভবিষ্যৎ কেন ধ্বংস করছেন। আপনাদের উচিত বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের হয়ে আসা। অন্যদিকে তারা বিএনপিকে বলতে থাকে ‘আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একটি দল’ আপনাদের দলে আছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতকে সাথে নিয়ে আপনারা কেন বদনামের ভাগী হচ্ছেন। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করে আপনারা জনসমর্থন হারাচ্ছেন। তাদের এই প্রচারণার ফলে চারদীয় জোটের ঐক্যের সমস্যা না হলেও বিএনপির কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠন পর্যায়ে কিন্তু বিএনপি-জামায়াত ঐক্যের মত ঐক্য গড়ে উঠে নাই।

ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে ঐক্য যতটা সুদৃঢ় হওয়া উচিত ছিল তার অভাব ছিল। যেহেতু জামায়াত ও বিএনপির ঐক্য সুদুঢ় হলে রাজনীতিতে বিএনপি হবে বিনিফিশিয়ারী এবং ক্ষমতার লড়াইটা বর্তমানে যেহেতু বিএনপির সাথে তাই একাত্তরের ইস্যুতে জামায়াতকে ঘায়েল করা সম্ভব হলে তা কার্যত: বিএনপিকে কোণঠাসা করতেই সহায়ক হবে।
৯. ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠনের পরও আওয়ামী লীগ খুবই রাজনৈতিক পরিপক্কতার সাথে এক পর্যায়ে জামায়াতের সাথে রাজনৈতিক সখ্যতা গড়ে তুলে। জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠনের পরও বিএনপি জামায়াতকে সাথে ধরে না রেখে আওয়ামী লীগের দিকেই ঠেলে দেয়। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে জামায়াত ও জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলে এবং রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ফলে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির মধ্যে কোন ধরনের সমঝোতা হতে পারেনি।
জামায়াত ৩০০ আসনেই নির্বাচন করে। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেণে দেখা যায় খুবই অল্প ভোটের ব্যবধানে বিএনপি ও জামায়াত ৫৮টি আসনে পরাজিত হয়। যদি কোন সমঝোতা হতো এবং বিএনপি ও জামায়াতের ভোট ভাগাভাগি না হতো তাহলে কোনক্রমেই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করতে পারতো না। ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট হবার ফলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই আওয়ামী থিংকট্যাঙ্ক এবং তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা রাজনৈতিক বিবেচনায় যুদ্ধাপরাধী ইস্যু সামনে নিয়ে আসে।

১০. মিডিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটিকে এতটাই সামনে এনেছে যে, আওয়ামী লীগের পক্ষে এই ইস্যুকে পিছে ঠেলে দেয়ারও কোন উপায় নেই। প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেই ফেলেছিলেন যে, বিচার তো জনগণই করে দিয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু ভারতীয় লবী, বামপন্থী ধর্মহীন গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থক মিডিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটিকে এমনভাবে হাইলাইট করেছে যে, সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। মেনিফেস্টোতে এটা ছিল। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব হিসাবে সরকারের শীর্ষ মহলের অনাগ্রহ সত্ত্বেও সংসদে প্রস্তাব পাস করা এবং ভারতীয় অর্থে লালিত বিভিন্ন সংস্থার প্রচারণার ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইন্যুনাল আইনটি সংশোধন করা, ট্রাইব্যুনালের বিচারক, তদন্ত টিম, প্রসিকিউটর ইত্যাদি নিয়োগ দান এবং সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে এই ইস্যুটিকে এমন এক পর্যায়ে আনা হয়েছে যাতে যে কোনভাবেই হোক যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সরকারের জন্য এক অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

১১. জামায়াতের বর্তমান নেতারা ১৯৭১ সালে ২/৪ জন ছাড়া কেউই জামায়াতের সদস্য ছিলেন না, তারা সশস্ত্রবাহিনীতে ছিলেন না, সরকারের কোন পর্যায়েরও দায়িত্বশীল লোক ছিলেন না, বা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধেও অংশ নেননি। এসব বিষয় আওয়ামী লীগ নেতারাও জানেন। কিন্তু রাজনীতি এমনি এক জিনিস যাতে ক্ষমতার স্বার্থে অনেক কিছুই করতে হয়। জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে প্রচারণা চালিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। মিথ্যা প্রতিবেদন ছেপে তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের মিথ্যা মামলা সাজানো হচ্ছে। বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করার পর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বেআইনীভাবে জামায়াতের পাঁচজন শীর্ষ নেতাকে আটক রাখার কথা ঘোষণা করেছে। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করার পর ৭৩-এর তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এক্টের বিধি নতুন করে সংশোধন করেছে। ১৯৭০-এর এই তথাকথিত আইনটি একটি কালো আইন। এই আইনে সাক্ষ্য প্রমাণের কোন প্রয়োজন নেই। বিবাদীর মৌলিক অধিকার এই আইনে সংরক্ষণ করা হয়নি। সংবিধানের মৌলিক অধিকার খর্ব করে আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে (সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে) সরকার যে কোন লোককে গ্রেফতার করে বিচারের নামে প্রহসন করে শাস্তি দিয়ে দিতে পারে।

১২. ইতোমধ্যেই সরকার দলীয় লোকদেরকে ট্রাইব্যুনালের বিচারক, প্রসিকিউটর এবং তদন্তকারী সংস্থার সদস্য হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। এসব লোক ইতোমধ্যেই জামায়াতের গ্রেফতারকৃত কয়েক নেতার জেলা এবং নির্বাচনী এলাকা ঘুরে এসে মিডিয়ায় মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে বলেছে যে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী পাওয়া গিয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল গঠনই করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য। তাছাড়া সরকার যে সব নির্বাচনী অঙ্গিকার করেছিল তার কোনটাই পূরণ করতে পারেনি। সন্ত্রাস-হত্যা, ধর্ষণ অপরাধ ও দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। সরকার দলীয়দের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাকরি বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, দুর্নীতি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে। ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয় ও ছত্রছায়ায় ইভটিজিং সামাজিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। সরকারী দল নিজেরাই খুনাখুনি করছে এবং ক্ষমতার দাপটে বিরোধী দলকে অনেক জায়গায় হামলা করছে এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে। সরকার সমর্থক সন্ত্রাসীদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে মুক্তি দিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা আখ্যায়িত করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১০ হাজারের অধিক মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। দেশের জন্য কিছু করতে না পারলেও ট্রানজিট, বন্দরসহ প্রতিবেশী দেশকে সকল সুযোগ-সুবিধা দান করার ব্যবস্থা করেছে এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি সম্পাদন করেছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এমতাবস্থায় জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এবং দেশে যাতে কার্যকর আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে সে জন্য জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রহসন করছে। ফলে জামায়াত একটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

১৩. এই পরিস্থিতিতে কি হতে পারে? জামায়াতের করণীয় কি?

এক. সরকারের আরো তিনবছর সময় আছে। এই সময়ের মধ্যেই যে কোনভাবে প্রহসনের বিচার করে জামায়াতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে পারে। জামায়াতের কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের ঘাবড়ে দেয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারে এবং অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারে। আবার সম্ভাবনাময় জামায়াত নেতাদের নির্বিাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করতে পারে এবং এমনকি তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। আদালতের রায়ের অযুহাতে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে অথবা রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে পারে।

দুই. বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে তাদের ভাবমর্যাদা খতম করে নির্বাচনী রাজনীতিতে জামায়াতকে একটি অকার্যকর দলে পরিণত করতে পারে।

তিন. একটা পর্যায়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলে এবং বঙ্গবন্ধু যেহেতু ক্ষমা করেছিলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমা করতে জানে বলে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমা করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারে।

চার. জামায়াতকে বিএনপি জোট ত্যাগ করার জন্য চাপ দিতে পারে এবং এর বিনিময়ে বিচারের বিষয়টি শিথিল করার প্রস্তাব দিতে পারে।

মোদ্দাকথা হলো বিষয়টি যেভাবেই উপসংহার টানা হোক না কেন তাতে জামায়াত রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এতে কোন সন্দেহ নেই।যদি সরকারের বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী বিচারকার্য চলে তাহলে জামায়াত  যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসাবে দেশেবিদেশে চিহ্নিত হয়ে যাবে। মিডিয়া ইতোমধ্যেই জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বানিয়ে ফেলেছে। বিচার না করে সরকার যদি মুক্তি দান করেও দেয় তার পরও স্বাধীনতা বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীহিসাবে যে কালিমা লেপন করে দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যেই সে কারণে দেশের জনগণ কি স্বাচ্ছন্দে জামায়াতের প্রতি আস্থা আনবে? কিংবা বিশাল ধর্মহীন শক্তি তারা জামায়াতকে মেনে নিবে বা জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করুক অথবা রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আসুক এটা কি তারা চাইবে? নতুন প্রজন্মের সামনে জামায়াতকে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে তাতে জামায়াত কি বৃহত্তর জনতার আস্থা অর্জন করতে পারবে?

১৪. পরিস্থিতি যাই হোক বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জামায়াতের গ্রেফতারকৃত নেতৃবৃন্দ মুক্তি পাবেন না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। সামনেও নির্বাচনে যে সরকার পরিবর্তন হবেই এমনটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। যদি সরকার পরিবর্তন হয় তবুও নতুন সরকার জামায়াতের সাথে কি আচরণ করবে তা নিশ্চিত নয়। বর্তমান সরকার তো জামায়াতকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রেখেছে। জামায়াতকে স্বস্তির সাথে কোন কর্মসূচী পালন করতে দিচ্ছে না। রাজপথে নামতে দিচ্ছে না। ছাত্রশিবিরকে নির্বিঘে কাজ করতে দিচ্ছে না। কয়েকশত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী এখনও কারাগারে। জামায়াত বা শিবির কোথাও ঘরোয়া বৈঠক করলেও পুলিশ সেই বৈঠককে গোপন বৈঠক আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে।

ইসলামী বইপুস্তককে জিহাদী ও জঙ্গি বই বলে পত্রপত্রিকায় খবর দিচ্ছে। জেএমবি, হারকাতুল জেহাদ ও  লস্করে তৈয়্যেবার সাথে জামায়াতের সম্পর্ক এবং জামায়াত দেশব্যাপী সন্ত্রাসীতৎপরতাচালানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এমনসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন খবর অহরহ প্রচার করছে মিডিয়ার একটি অংশ। সরকারের মন্ত্রীরাও জামায়াতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতায় মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক বিবৃতি প্রদান করছে এবং বিটিভিসহ সংবাদপত্রেও তা ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। প্রকাশ্যেই জামায়াতকে নির্র্মূল ও খতম করার হুংকার দেয়া হচ্ছে। সরকার ও তার মিত্ররা বাস্তবেই জামায়াতকে খতম করতে চায়।

১৫. এই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জামায়াতের সামনে কি পথ বা কৌশল থাকতে পারে তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে।

 এক. একটি কর্মপন্থা এই হতে পারে যে, দেখি শেষ পর্যন্ত কি হয় বা জামায়াতের ভাগ্যে কি ঘটে। যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থাতেই অপেক্ষা করতে থাকি। যদি জামায়াতের নামে কাজ করা সরকার বন্ধ করে দেয় তাহলে তখন দেখা যাবে কি করা যায়। সরকার বন্ধ করে দেয়ার আগে নিজেরা বন্ধ করা ঠিক নয়।

 দুই. যেহেতু রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তি জামায়াতকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে, যেহেতু জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসাবে চিহ্নিত করে দলটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, যেহেতু একশ্রেণীর লোকের মধ্যে জামায়াত সম্পর্কে রিজার্ভেশন আছে, ভুল ধারণা আছে, নেতিবাচক ধারণা আছে, যেহেতু বর্তমান জামায়াতের নেতৃবৃন্দ দলের লোকদের নিকট জনপ্রিয় ও নির্দোষ হলেও তাদের ভাবমর্যাদাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে এবং যেহেতু এক ধরনের লোকের মাঝে জামায়াত নামাটার প্রতিই এলার্জি আছে এবং পক্ষান্তরে জামায়াতের প্রতি আস্থা রাখে এবং জামায়াতের সততা ও আন্তরিকতার কারণে জামায়াতকে ভালোবাসে এমন একটি জনগোষ্ঠীও দেশে আছে যাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়-এইসব সামগ্রিক বিবেচনায় রেখে জামায়াতের আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করা সময়ের দাবী।

জামায়াত যেভাবেই আছে থাকুক তবে একটি নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলা এবং ধর্মহীনতার যে সয়লাব আসছে তার বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ব্যাপক ভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। জামায়াতের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছনে থেকে একটি সংগঠন গড়ে তোলা। অন্যথায় জামায়াতের লোকদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।

তৃতীয় বিকল্প হচ্ছে-জামায়াতের যেসব নেতৃবৃন্দকে ১৯৭১ সালের সাথে সম্পৃক্ত করে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে তাদের সকলেরই সরে দাঁড়ানো এবং সম্পূর্ণ নিউ জেনারেশন নিয়ে জামায়াত গঠন করা। নতুন  নেতৃত্বের হাতে জামায়াতকে তুলে দেয়া এবং যেহেতু ১৯৭১ সালের ভূমিকার কারণে অন্যায়ভাবে জামায়াতের উপর জুলুম করা হচ্ছে তাই এদেশে ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা এবং গতিশীল করার স্বার্থে বর্তমান নেতৃত্ব যদি সরে দাঁড়ান তাহলে ইসলামের দুশমনদের বলার কি থাকবে? তবে ইসলামের জন্য যারাই কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে অধার্মিক ও ধর্মহীন শক্তির অভিযোগের কোন অভাব হবে না।

১৬. এখানে উল্লেখ্য যে ইসলামী ছাত্রশিবির নতুন সংগঠন হবার কারণেই এতদূর অগ্রসর হতে পেরেছে। পুরনো কোন সংগঠন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেকাজ করারই সুযোগ পেতো না। ছাত্রশিবির যেহেতু ইসলামী আন্দোলনের প্রধান রিক্রুটিং সেন্টার তাই শিবিরকেও বিতর্কিত করেছে ধর্মহীন শক্তি। শিবিরের অগ্রযাত্রায় আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী বেশী আতঙ্কিত। শিবিরের নামেও চলছে লাগামহীন মিথ্যাচার। ছাত্রদের মধ্যে আর যেসব সংগঠন আছে তাদের হাতে কোন আদর্শ নেই। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী দলের ও ব্যক্তিবিশেষের লেজুড়বৃত্তি ছাড়া ওসব ছাত্র সংগঠনের জাতিকে দেবার মত কিছু নেই। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য ওসব সংগঠনের জীবনী শক্তি। উন্মুত্ত ব্যক্তি পূজার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে তা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে আদর্শিক রাজনীতির কোন বিকল্প নেই।

রাজনৈতিক বিকল্পের সন্ধানের পাশাপাশি ছাত্র অংগনেও পরিবর্তনের চিন্তা করতে হবে। ছাত্রদের রাজনীতিমুখী  সভা ও রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি থেকে বের করে আনতে হবে। জ্ঞান চর্চা, মেধার বিকাশ, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উন্নত নৈতিকতা ও চরিত্রগঠনের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। লেজুরবৃত্তির রাজনীতি, নেশা ও মাদককে ‘নো’ বলতে হবে।

 ১৭. জামায়াতের সামনে যে তিনটি বিকল্পের কথা আমি উল্লেখ করেছি আমার মতে প্রজ্ঞার পরিচয় হবে যদি দ্বিতীয় বিকল্পটি গ্রহণ করা হয়। জামায়াত যেহেতু ৬০ বছরের অধিককাল থেকে এদেশে কাজ করছে এবং দেশের কমপক্ষে ১০% ভাগ জনগণের একটি সমর্থন জামায়াতের প্রতি আছে তাই এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে জামায়াতের অবমূল্যায়ন করা হয়। কারণ বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির যে একটা অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে তা জামায়াতের আন্দোলনেরই ফসল। জামায়াতের সাথে অনেক মানুষের একটা আবেগের সম্পর্ক রয়েছে এবং জামায়াতের প্রবীণ নেতা-কর্মীরাই জামায়াতকে এই পর্যায়ে আনার ব্যাপারে একটা অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের আন্তরিকতা এবং সততার ফলেই জামায়াত বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ইসলামী দলের মর্যাদা লাভ করেছে। জামায়াত যদি একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার পিছনে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োজিত করে এবং সেই সাথে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে যত্নবান হয় তাহলে সেই প্লাটফর্মকে রাজনৈতিকভাবে সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না কেউ।

১৮. জামায়াতের যত বদনামই ধর্মহীন শক্তি করুক না কেন জামায়াতকে অগ্রহ্যা করে কোন কিছু করা সঠিক হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৌশল অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত জামায়াতকেই নিতে হবে। চিন্তার বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না। ১৯৪১ সালে পাকিস্তান আন্দোলন যখন বলতে গেলে তুঙ্গে উঠেছে, লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে গোটা ভারতবর্ষের মুসলমানরা একটি স্বাধীন আবাসভূমির দাবীতে ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার সেই সময় নতুন একটি দল জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের আগে কয়েকটি আঞ্চলিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিভক্ত ভারতে জামায়াতের কর্মপন্থা কি হবে সে ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নিজে কিছুসংখ্যক সদস্যসহ পাকিস্তান চলে আসলেও জামায়াতের একটি বড় অংশ ভারতেই থেকে যান। তারা সেখানে এক ধরনের কর্মসূচী নিয়ে কাজ করে যান। কিন্তু পাকিস্তানে জামায়াত তার কর্মসূচীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। জামায়াত রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ জামায়াতের কর্মপন্থায় বিরাট পরিবর্তন আনা হয়।(see; the historical development of Jamaat Islami)

এক সময় জামায়াত আইনজীবদেরকে সদস্য করতো না। কিন্তু কৌশল বদলানো হয় এবং বাস্তবতার দাবী মেনে নিয়েই আইনজীবীদের দলের সদস্য করা হয়। প্রচলিত নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতো না এমনকি ভোটও দিত না।

ভারতীয় জামায়াত এখনও নির্বাচনে অংশ নেয় না। শুধুমাত্র ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক জরুরী অবস্থা জারীর জাতীয় প্রেক্ষিতে জামায়াতের সদস্যদের ভোট দেয়ার অনুমতি দান করা হয়েছিল। কাশ্মীর জামায়াত হিন্দুস্থান জামায়াত থেকে আলাদা অর্থাৎ স্বাধীন জামায়াত হওয়ায় তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। এক সময় জামায়াত তার রুকন ছাড়া কাউকে নির্বাচনে মনোনয়ন দিত না। এখন এই নীতির পরিবর্তন করা হয়েছে। রুকন ছাড়াও মনোনয়ন দেয়া হয় এখন। মহিলাদেরকে সংসদে পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে। এমনকি নির্বাচনে মহিলাদেরও মনোনয়ন দান করেছে। বিগত উপজেলা নির্বাচনে ২৪ জন মহিলা প্রার্থী ছিল জামায়াতের এর মধ্যে ১২ জন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জামায়াত নির্বাচনী প্রচারণা সাথে প্রার্থীর ছবি ব্যবহার করতো না। এখন ছবি ব্যবহার করছে। গঠনতন্ত্র সংশোধন করে অমুসলিমদের জামায়াতের সদস্য হবার পথে বাধা দূর করা হয়েছে। এখন একজন অমুসলিমও চাইলে জামায়াতের সদস্য হতে পারবেন। জামায়াতের মহিলা সদস্যদের মজলিশে শূরার সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে। এসবই করা হয়েছে প্রয়েজন, সময়ের দাবী এবং বাস্তবতার আলোকেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।

 ১৯. জামায়াত বর্তমান সময়ে যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে গিয়েছে তাতে গা ছেড়ে বসে না থেকে বিকল্প পথের সন্ধান করা হিকমত ও দূরদৃষ্টির দাবী। এটা কোন ধরনের বিচ্যুতি নয়। বরং আন্দোলনের ক্রম বিকাশের ধারাতেই নতুন কৌশল অবলম্বন করা। এক্ষেত্রে মিসরের ইখওয়ানের কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে ইখওয়ান পুনরুজ্জীবিত না করেও তারা অন্যদল বা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। ইখওয়ান নাই অথচ ইখওয়ান আছে। ধৈর্যের সাথেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন এবং নির্বাচনও করছেন। জর্দানে ইখওয়ান প্রশাসনের সাথে মোটামুটি সহনশীলতা বজায় রেখে সেখানকার রাজনীতি ও নির্বাচনে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এককথায় তারা কোয়ালিশন সরকারেও অংশ নিয়েছিলেন।

আলজেরিয়ায় ইখওয়ানের নেতৃত্ব মূল ইখওয়ান থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ইসলামিক ফ্রন্ট গঠন করে কাজ করছেন। ইয়েমেনে ট্রাডিশনাল ইসলামপন্থীদের সাথে নিয়ে আল-ইসলাহ পার্টি গঠন করে সেখানে কাজ করছেন। এককথায় কোয়ালিশন সরকারেও ছিলেন। কিছুদিন আগে কোয়ালিশন থেকে বের হয়ে এসেছেন। মরক্কোতে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপম্যান্ট পার্টি নাম দিয়ে কাজ করছেন। এখন প্রধান বিরোধী দল হিসাবে আছেন। সামনের নির্বাচনে আরও ভালো করার কথা। সুদানে ইসলামিক মুভমেন্ট অব সুদান নামে জেনারেল হাসান আল বশিরের সাথে জোট গঠন করে সরকার পরিচালনা করছেন। অবশ্য একজন সিনিয়র  নেতার সাথে তাদের মতদ্বৈততা রয়েছে এবং তিনি সরকারের বাইরে আছেন। তিনি হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. হাসান তুরাবী।

তুরস্কে ইসলামী আন্দোলন বার বার নাম পরিবর্তন করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন আরবাকানের সাথে মত পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ায় দ্বিধাবিভক্তি আসার পরও জাস্টিস এন্ড ডেভেলপম্যান্ট পার্টি যাকে বলা হয় একে পার্টি তারা সরকার গঠন করে সাফল্যের সাথে দেশ চালাচ্ছেন। আব্দুল্লাহ গুল এবং রিসেপ তাইয়েপ এরদুগানের (রজব তৈয়ব এরদুগান) নেতৃত্বে। কিন্তু পিছন থেকে শক্তি ও সমর্থন যোগন দিয়ে যাচ্ছে সাঈদ বদিউজজ্জামান নুরসীর নূর জামায়াতের লোকেরা। সাম্প্রতিক রেফারেন্ডামে একে পার্টি জয়লাভ করার পর প্রধানমন্ত্রী এরদুগান ফতেহ উল্লাহ গুলেনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এই ফতেহউল্লাহ গুলেন হলেন সাঈদ নুরসীর প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনের নেতা। বলতে গেলে পর্দার অন্তরাল থেকে তুরস্কের ইসলামী আন্দোনকে এগিয়ে দিচ্ছেন। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতেও ইসলিামী আন্দোলনে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তাদের কর্মপন্থা ও কৌশল গ্রহণ করেই এগিয়ে চলছে। সুতরাং বর্তমান সংকট সন্ধিক্ষণে এসে বাংলাদেশের জন্যও একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে আন্দোলনকে একটি নতুন অধ্যায়ে নিয়ে যাওয়া।


২০. যেহেতু স্বাধীনতার বিরোধিতা ও যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ এনে সম্ভাবনাময় একটি ইসলামী আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে এবং যেহেতু বিষয়টি আমরা মিটমাট করতে পারিনি অথবা এই রাজনৈতিক বিরোধটি নিরসন করতে পারিনি, যেহেতু আমরা অনেকেই মনে করেছিলাম এটা এক সময় এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে, যেহেতু আমাদের অনেকের চিন্তার গন্ডি অতিক্রম করে এটাকে একটি জ্বলন্ত ইস্যু হিসাবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেহেতু সরকারও এ বিষয়ে অবশ্যই একটা কিছু করতে বদ্ধপরিকর এবং যেহেতু কিছু না হলেও দল ও নেতৃত্বের ভাবমর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে এবং জনমনে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু সামগ্রিক বিবেচনায় নতুন কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা সময়ের অনিবার্য দাবী।
আমরা যদি নতুন কর্মকৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হই ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না এবং আমরা ইতিহাসের কাছে দায়ী হয়ে যাবো। কারণ এক বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে আমরা আশাবাদ জাগিয়েছিলাম। আমাদের আন্দোলনের সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আমাদের ছাত্র তরুণদের বিরাট এক কাফেলা জীবন দিয়েছে, শহীদ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, অনেকে তাদের জীবন ও যৌবন এই পথে নিঃশেষ করে দিয়েছে।
সুতরাং এক নম্বর যে বিকল্প উল্লেখ করা হয়ছে সেভাবে হাল ছেড়ে দিলে আমরা অথর্ব প্রমাণিত হবো। তখন সময় চলে যাবে। সুতরাং সময় থাকতেই আমাদের সতর্ক হতে হবে। তিন নম্বর যে বিকল্পের উল্লেখ করেছি সেটাও সমাধান নয়। শুধু স্থানীয় অধার্মিক শক্তি নয় বরং আন্তর্জাতিক ধর্মহীন শক্তিও আমাদের জন্য বড় অন্তরায়। তারাও উৎ পেতে আছে কিভাবে আমাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়া যায়। আর এ কারণেই এই বিকল্প পন্থা এখন আমাদের জন্য খুব সহায়ক হবে না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনের দিকটা সামনে রেখেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

২১. পরিস্থতি খুব নাজুক। নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আপাতঃ দৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই। বরং হেকমতের খাতিরে তেমন একটা কিছু করে হলেও নতুন আন্দোলন দাঁড় করানোর ঝুকি গ্রহণ করা উচিত।

এক : বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোন প্রশ্ন থাকবে না সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার এবং সুশাসন কায়েমকে অবলম্বন করতে হবে। একে পার্টির গঠনতন্ত্র এবং মেনিফেস্টোর দৃষ্টান্ত সামনে রেখে দলের গঠনতন্ত্র তৈরি করতে হবে। তবে তাদের গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টোতে অনেক কিছু পুনরাবৃত্তি আছে এবং বেশ দীর্ঘও বটে। ওটাকে সংক্ষেপ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সামনে এনে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত ও চুম্বক বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করতে হবে। জনগণের অতি প্রয়োজনীয় কিছু ইস্যুকে হাইলাইট করতে হবে।

দুই : ছায়া মন্ত্রীসভার কনসেপ্ট গ্রহণ করতে হবে। যতটা মন্ত্রণালয় আছে ততটি ডিপার্টম্যান্ট করে প্রতি ডিপার্টমেন্টে কমপক্ষে দুইজন সদস্যকে দায়িত্ব দিতে হবে। একজন প্রধান দায়িত্বশীল হবেন এবং অপরজন হবেন তার সহকারী দায়িত্বশীল। এদেরকে নিয়েই কেন্দ্রীয় কমিটি হতে হবে। এক ব্যক্তিকে একাধিক দায়িত্ব দেয়া পরিহার করতে হবে। ব্যাপক কেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

তিনি : একটি অভিভাবক পরিষদ বা উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে। সিনিয়র সিটিজেন, বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ এর সদস্য থাকবেন।

চার : একটি ওলামা কাউন্সিল বা শরীয়াবোর্ড থাকবে। নানা বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালাবে এবং নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি হলে তা নিরসন করবেন। যে কোন মূল্যে ইসলামী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।

পাঁচ : তিন টার্মের বেশী কেউ একাধারে কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জিলা  সভাপতি থাকতে পারবেন না। পদ পদবী বা দায়িত্বের ব্যাপারে বাংলা পরিভাষাই ব্যবহৃত হবে। সংগঠনের সকল পর্যায়ে আইটি-এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

 ছয় : কেন্দ্রীয় কমিটিতে সকল পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে জনশক্তি পরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিবছর কোন ক্ষেত্রে কি পরিমাণ প্রোডাক্ট চাই তা নির্ধারণ করতে হবে।

সাত : একটি সেক্রেটারিয়েট থাকবে যারা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করবেন না। সমম্বয় করবেন কিন্তু কোন কিছু চাপিয়ে দিবেন না।

আট : সকল ডিপার্টমেন্টের কমিটি থাকবে এবং ওসব কমিটি অনেকটা স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সকল ডিপার্টমেন্ট সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে।

নয় : একটি লিগেল এইড কমিটি থাকবে। আইনগত সহযোগিতা ছাড়াও সংগঠনের অভ্যন্তরে কোন সমস্যা দেখা দিলে  হলে এই কমিটি দ্রুততার সাথে তার নিরসন করবে এবং কেন্দ্রের পক্ষ থেকে শালিস হিসাবে কাজ করবে।

 দশ : অগ্রাধিকার দিতে হবে :- (১) শিক্ষা, (২) সমাজসেবা, (৩) স্বাস্থ্য, (৪) মিডিয়া, (৫) ব্যবসা-বাণিজ্য ও (৬) ছাত্র আন্দোলন।

এগার : নির্বাচনের জন্য প্রথমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য সম্ভাবনাময় লোকদের এখন থেকে তৎপরতা চালাতে হবে।

বার : জেলা পর্যায়ে স্বাধীন পেশা-ব্যবসা, ওকালতি, শিক্ষকতা ইত্যাদির ব্যাপারে লোকদের পরামর্শ দিতে হবে। দায়িত্বশীলের সামাজিক পরিচিতি থাকতেহবে-শুধুমাত্র দলীয় পরিচিতি নয়।

তের : জামায়াত একটি অবকাঠামো করেই রেখেছে বিশেষ করে অনেকগুলো সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোকেও যথাযথভাবে গতিশীল করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান ঝিমিয়ে আছে এবং পরিবর্তন অনিবার্য। যেমন-মসজিদ মিশন, ইসলাম প্রচার সমিতি, এডুকেশন সোসাইটি, আধুনিক, দারুল আরাবিয়া ও দারুল ইফতা, চাষী কল্যাণ সমিতি, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন, চাষী কল্যাণ সমিতি, মওদুদী একাডেমী, সোনার বাংলা প্রকাশনী, আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্ট, মারুফ একডেমী, ফয়সল ইন্সটিটিউট, মানারাত স্কুল এন্ড কলেজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইবনে সিনা ট্রাস্ট এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান, বিআইসির কথা উল্লেখ করলাম না কারণ এখানে যিনি আছেন তিনি পরিবর্তনে বিশ্বাসী নন। এ সকল প্রতিষ্ঠানেই সম্পদ আছে। ক্রমান্বয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন আনতে হবে এবং গতিশীল করতে হবে। জেলা পর্যায়েও অনেক ট্রাস্ট ও প্রতিষ্ঠান আছে যা কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। মানারাত ও বাদশাহ ফয়সল স্কুল এন্ড কলেজ অথবা তামিরুল মিল্লাত টঙ্গিকে কেন্দ্র করেও বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান করা যায়, সফিপুরে ওয়ামীর একটা জায়গা পড়ে আছে সেখানেও বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব। তাছাড়া বিভাগীয় হেডকোয়ার্টারগুলোতে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে ওসব প্রতিষ্ঠানকে আরো সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। প্রত্যেক জেলায় প্রথম শ্রেণীর স্কুল ও ইন্টারমেডিয়েট কলেজ গড়ে তোলার মাধ্যমে মেধাবীদের রিক্রুট করা সম্ভব।
মোদ্দাকথা আমাদের যে শক্তি, অর্থ, মেধা রয়েছে তা উল্লেখিত অগ্রাধিকার খাতসমূহে ব্যয় করার মাধ্যমে পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যেই আমরা একটা পর্যায়েপৌঁছে যেতে পারি। বাইরে অবস্থানরত জনশক্তিকে প্রয়োজনে দেশে ফেরত আনতে হবে। আবার উচ্চতর শিক্ষা ও আন্দোলনের প্রয়োজনে জনশক্তি বাইরে রফতানি করতে হবে।
চৌদ্দ : ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি টিম গঠন করতে হবে ইয়ুথ ডিপার্টমেন্টের অধীনে অথবা ছাত্রদের সহায়তায়। এ জন্য প্রয়োজনে ক্লাব স্থাপন করা যেতে পারে।

পনর : একটি আন্তর্জাতিক ভাষা ইন্সটিটিউট করা যেতে পারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। স্পোকেন ইংলিশ, আরবী, ফ্রেন্স, জার্মান, ম্যান্ডারিন, জাপানী, কোরিয়ান, বাহাসামালয়া ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু করা যেতে পারে।

ষোল :  সর্বাবস্থায় ইউনিভার্সিটি অব থট-এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে, এটাকে সম্প্রসারিত ও গতিশীল করতে হবে।

সতের : ভোরের ডাক, পত্রিকাটি কিনে নিয়ে একটি রাজধানী কেন্দ্রিক ৪ পৃষ্ঠার সফল কাগজ করা যায়। সাংবাদিক (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক) তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায়, চ্যানেলে ঢুকাতে হবে। এ ব্যাপারে নিবিড় তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। একাধিক থিংক ট্যাংক গড়ে তুলতে হবে।

আঠার : শিশু কল্যাণ ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বর্তমান কাঠামো রেখেই আরো গতিশীল ও সম্প্রসারিত করতে হবে। নারী-সমাজের উন্নয়ন, মানবাধিকার সংরক্ষণ ও পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সুস্পষ্ট কার্যক্রম থাকতে হবে।

উনিশ : অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সামাজিক ও একটি ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য কিছু লোককে নিবেদিত প্রাণ হয়ে ঐ সেক্টরে কাজ করতে হবে। উপজাতীয়দের মধ্যে কিছু লোক নিয়োজত করতে হবে।

বিশ : তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের মাঝে এবং ব্যবস্থাপনায় জরুরী ভিত্তিতে একটি সেল করে কাজ করতে হবে। এখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভাল কর্মসংস্থান হতে পারে তার সুযোগ নিতে হবে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম লাইফ লাইন হিসাবে বিবেচিত হবে এবং ভূমিকা পালন করবে। ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা খুব সহজ। কিন্তু আমরা কোন মনোযোগ দেইনি।

একুশ : আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন চালু করার প্রশ্নে জনমত গঠন করা উচিত। বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে সরকারের কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরী। সাড়ে ষোল কোটি মানুষের দেশে সবকিছু রাজধানী মুখী যা টহসধহধমধনষব। সামাজিক শক্তি অর্জন করতে হবে। প্রচার মুখীতার পরিবর্তে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও বিভিন্ন স্তরের চালিকা শক্তির উপর আদর্শিক ও নৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে হবে। রাজনীতি প্রবণতার পরিবর্তে আন্দোলনের প্রকৃতি হতে হবে সামাজিক ধাচের ও মানবকল্যাণধর্মী।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই নতুন কর্মকৌশল গ্রহণের ব্যাপারে জনশক্তির মাঝে আলোচনা ও মতবিনিময় হওয়া উচিত। একটা ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য সার্বিক প্রয়াস চালানো দরকার।
জামায়াত আমাদেরকে অসাধারণ শৃঙ্খলা শিক্ষা দিয়েছে সেই সাংগঠনিক শৃংখলার মধ্যে আমাদের থাকতে হবে। শৃংখলার মধ্যে থেকে সংগঠনের অভ্যন্তরে পরিবর্তন আনতে হবে। জনশক্তি বিকল্প পথের সন্ধান করছে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে নতুন চিন্তাধারাকে দারুণভাবে অভিনন্দন জানাবে।
দুরের চিন্তা যারা করেন না কিংবা স্থিতাবস্থা বজায় রাখাটাই যারা ভাল মনে করেন তারা হয়তো বা বিরোধিতা করতে পারেন। তবে তাদেরও আন্তরিকতার অভাব নেই। ধৈর্যের সাথে সবাইকে বুঝাতে হবে এবং ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে অথবা কমপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ইতিহাসের এই সংকট সন্ধিক্ষণে আন্দোলনের জন্য নতুন কৌশল নির্ধারণ এক ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।
আমি বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন।


ক্ষমতার রাজনীতি, ধর্মহীনতার রাজনীতির মিথ্যার অভিযোগের নির্মম শিকার হয়ে আমার বন্দী জীবনের অনুভূতি সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করছি :

১. বর্তমান সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে আমাদের মুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই। সহসা সরকার পরিবর্তনেরও কোন সম্ভাবনা নেই।

২. আন্দোলন করে আমাদের মুক্ত করা হবে এমন কোন সম্ভাবনাও নেই। আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটার কোন আশংকাও নেই। পুরো মেয়াদ পর্যন্তই সরকার ক্ষমতায় থাকবে।

৩. বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই আমাদের কিছু সংখ্যকের বিচারের নামে প্রহসন হবে। কারণ ইস্যুটাকে এমন পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে।

৪. তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কাছে কোন ন্যায় বিচার আমরা পাবো না। আইনটা একটা কালো আইন হওয়ার কারণে সরকার যা চাইবে তাই করা বা তাদের কাক্সিক্ষত রায় দেবারই সুযোগ রয়েছে।

৫. জামায়াতের উপর এবং জামায়াতের নেতা হিসাবে আমাদের উপর সুস্পষ্ট জুলুম হচ্ছে এ জন্য অনেকে দুঃখ প্রকাশ বা নিন্দা করলেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কার্যকরভাবে আমাদের তথা জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করবে না।

৬. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিচার কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মৌখিক সৌজন্য প্রকাশ করলেও একটি ইসলামী দলের নেতাদের শাস্তি হলে (তা যতোঅন্যায়ভাবেই হোক না কেন) ভিতরে ভিতরে তারা অখুশী হবে না।

৭. জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মত স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিচার করার পর জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ না করলেও জামায়াতের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ হবে। দেশের ভিতরে ও বাইরে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধীদের দল হিসাবে চিত্রিত করবে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। জামায়াতের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

৮. জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলেও সরকার জামায়াতকে স্বস্তির সাথে কোন কাজ করতে দিবে না। সর্বদা চাপের মুখে রাখবে।

৯. এহেন পরিস্থিতিতে জামায়াতের পক্ষে গণসংগঠনে পরিণত হওয়া বা নির্বাচনে জনগণের বিপুল সমর্থন লাভের যোগ্যতা অর্জন কখনো সম্ভব হবে না।

১০. বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে যে নির্বাচন হবে তাতেও জামায়াত ভাল করতে পারবে এমন কোন সম্ভাবনাও দেখছি না।

১১. জামায়াতের প্রতি আমাদের যে আবেগ, ভালোবাসা ও মহব্বত তাতে জামায়াত ছাড়া আমরা অন্য কিছু ভাবতেও পারি না। জামায়াতকে উপেক্ষা করে কিছু করতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি অনিবার্য এবং কিছু করলেও তা সফল ও জনশক্তির নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।

এই জায়গায় এসে আমরা এখন থমকে দাঁড়িয়েছি। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ কি?

এক. যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকবো। (বর্তমানে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে)।

দুই : পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছনে থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সাথে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে।

তিন : আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবো এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেবো। অর্থাৎ একটা New generation Jamaat হবে এটি।
আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় উপরোক্ত তিন অবস্থায় প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।
তৃতীয় যে পন্থা নতুন নেতৃত্বের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া এটা বিবেচনা করা যেতে যদি ১৯৭১ সালের বিষয়টার একটা রাজনৈতিক মীমাংসা বা মিটমাট আমরা করতে পারতাম। জামায়াতের ভাবমর্যাদা যেভাবে ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছে, জামায়াত সম্পর্কে যে এলার্জি তৈরি করা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক, মিডিয়ায় এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় যেভাবে জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী বাংলাদেশ বিরোধী দল হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে তাতে নতুন নেতৃত্ব হলেও দেশের সাধারণ মানুষ, নতুন প্রজন্ম এবং রাজনৈতিক মহল জামায়াতকে সহজে গ্রহণ করে নিতে পারবে না।

দ্বিতীয় যে পন্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আমার মনে সামগ্রিক বিবেচনায় এই বিকল্প পন্থাটির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইসলামী আন্দোলন এই কৌশল অবলম্বন করে ভাল ফল লাভ করেছে। আমাদের সামনে তুরস্ক, মিসর, আলজেরিয়া, সুদান, ইয়ামেন, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জর্দানসহ পৃথিবীর প্রায় সকল ইসলামী আন্দোলন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কৌশল অবলম্বন করেই এগিয়ে চলেছে।
তাছাড়া আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য।
পৃথিবীর অন্য কোন দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনেবিরোধিতা করার মত অতি স্পর্শকাতর কোন অভিযোগ নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন খুবই সম্ভাবনাময় আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ও স্পর্শকাতর অভিযোগ আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার পথে বড় বাধার সৃষ্টি করে আছে। ইসলামী আন্দোলনের দুশমনরা আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় ও কৌশলে আপাতত সফল হয়ে গিয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মিটমাট করতে না পারার কারণে আজ বাস্তবেই মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে আমরা বিচারের কাঠগড়ায়। আমরা ১৯৭১ সালে জামায়াতের নেতৃত্ব দেইনি, জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করলেও তখনকার দলীয় নেতারাও যুদ্ধে শরীক ছিলেন না, নেতৃত্ব দেয়া তো দূরের কথা, আমাদের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা কেউই যুদ্ধ করিনি বা কোন বাহিনীরও সদস্য ছিলাম না। আমাদের দ্বারা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বা লুটতরাজের প্রশ্নই উঠে না। আজ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হবার কারণেই রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার শিকার আমরা বা জামায়াত। আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ সাজানো এবং সবৈব মিথ্যা। আমাদেরকে নিয়ে সরকার ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
আমরা নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ালাম যাতে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ না থাকে।
এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের অনেকের তো বয়সও হয়েছে। সরাসরি আন্দোলনে থাকলেই বা আমরা আর কতটা অবদান রাখতে পারবো?
সুতরাং সবাই মিলে দ্বিতীয় যে বিকল্পটির কথা উল্লেখ করেছি তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে কাক্সিক্ষত এবং যুক্তিযুক্ত। দোয়া করি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালা আমাদেরকে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তওফিক দান করুন। আমিন!



মুহাম্মদ কামারুজ্জামান

২৬শে নভেম্বর, ২০১০

৭ সেল (বকুল), ২ নং কক্ষ

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা।http://priyoboi.blogspot.co.uk/2010/04/blog-post_14.html?m=1


No comments:

Post a Comment