Saturday 22 April 2017

বঙ্গভঙ্গ রদ থেকে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা আন্দোলন -মনসুর আহমদ।


বঙ্গভঙ্গ রদ থেকে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা আন্দোলন -মনসুর আহমদ।



পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা সময়ের ব্যবধানে পাওয়া যায়। এমন একটি ঘটনা বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন। ১৮৯৮ সনে লর্ড কার্জন উপযুক্ত শিক্ষা, কর্মদক্ষতা, দায়িত্বজ্ঞান এবং সর্বোপরি এ দেশের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে বড় লাট হিসাবে ভারতে আগমন করেন। তৎকালে সমগ্র বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে ছিল বাংলাদেশ বা বাংলা প্রেসিডেন্সি। এই প্রদেশের লোক সংখ্যা ছিল সমগ্র উপমহাদেশের সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ।

 কার্জন শুরু থেকে এত বড় প্রদেশকে একটি মাত্র প্রশাসনিক ইউনিটের অধীনে রাখা অনুচিত মনে করেন। কারণ সুদূর কলকাতা থেকে পূর্বাঞ্চলের প্রশাসন চালানো এবং জনগণের প্রতি সুবিচার চালানো অসম্ভব ছিল। তাই প্রধানতঃ প্রশাসনিক কারণেই তিনি ১৯০৩ সনে এই বিরাট প্রদেশকে দু'ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কার্জনের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বেই এ প্রদেশ বিভক্তিকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয়েছিল। ১৮৫৩ সালে স্যার চার্লস গ্রান্ট প্রশাসনিক সুবিধার জন্যে প্রদেশটিকে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

১৮৯৬ সনে আসামের চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড বাংলা হতে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামকে আসামের সাথে যুক্ত করে নতুন প্রদেশ গঠনের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাব বাংলার জনসাধারণের বিরোধিতার জন্য নাকচ হয়ে যায়, কারণ অনুন্নত আসামের সাথে যুক্ত হলে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা নানাদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

১৯০৩ সালে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার উড়িয়া ভাষাভাষী সম্বলপুরকে বাংলা প্রেসিডেন্সির সাথে সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব করলে নতুন প্রদেশ গঠনের বিষয়টি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। অবশেষে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে সংযুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং তা অনুমোদনের জন্য ভারত সচিবের নিকট প্রেরণ করেন। ভারত সচিব ব্রডারিক এ পরিকল্পনা অনুমোদন করেন এবং তা ১৯০৫ সালের ১০ই জুলাই প্রকাশিত হয়। নুতন প্রদেশের রাজধানী ঢাকা এবং বিকল্প রাজধানী হিসাবে চট্রগ্রাম নির্বাচিত হয়।

এই গঠিত প্রদেশের নামকরণ হল পূর্ব বাংলা ও আসাম। অন্য দিকে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা সম্মিলিত হয়ে আরেকটি প্রদেশ হয় এর নাম হল বাংলা প্রদেশ। এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে কার্জনের এই সিদ্ধান্ত এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। শুধু কি প্রশাসনিক বৈষম্য দূর করার জন্যই লর্ড কার্জন নতুন প্রদেশ গঠনে এগিয়ে এসেছিলেন? না, প্রশাসনিক বৈষম্য দূর করা ছাড়াও পূর্ববঙ্গ যাতে শিক্ষা সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে সেই দিকে তাঁর লক্ষ্য ছিল। কার্জন আশা পোষণ করেছিলেন যে যথারীতি সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে পূর্ববঙ্গ ও আসামের জনগণের শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতি ঘটবে।

এ ছাড়াও দেশ বিভাগের পেছনে কার্জনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। লর্ড কার্জন বাঙ্গালীদের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের ইংরেজ বিরোধী ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি কংগ্রেসের প্রতিপত্তি ও উহার সমাধি রচনা ও নতুন জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করতে মনস্থ করেন। অনেকে মনে করেন বাংলা বিভাগ তাঁর সুপরিকল্পিত ভেদ নীতির বহিঃপ্রকাশ। একথা ঠিক নয়। বরং ভবিষ্যৎ বাঙ্গালী জাতির উন্নতির লক্ষ্যে কার্জন বাংলাদেশ বিভাগ করেছিলেন। কিন্তু কলকাতার সংবাদপত্রগুলো তাঁর উদ্দেশ্যের ভুল ব্যাখ্যা করে এবং তাঁকে মুসলমানদের পক্ষপাতিত্বের দোষারোপ করে। তারা আরও প্রচার চালায় যে, লর্ড কার্জনের এই বিভেদনীতির ফলে মুসলমানদের মনে উচ্চাকাক্মখা জেগেছে এবং এর ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

 কিন্তু এই সকল উক্তি ছিল খুবই বিভ্রান্তিকর ও ফাঁকা। কারণ এই বিভাগ দ্বারা পূর্বাঞ্চলের নিপীড়িত জনসাধারণের শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হলে তারাও পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সমপর্যায়ে উন্নতি হবে। কাজেই বঙ্গবিভাগের দ্বারা হিন্দু-মুসলমান বিরোধের জন্য তাঁকে দায়ী করা যায় না। বঙ্গ ভঙ্গের প্রস্তাব প্রথম থেকেই হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চয় করে। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা কার্যকরি হবে, এ সংবাদ হিন্দু নেতাদেরকে প্রবল উত্তেজিত করে।

 নতুন প্রদেশ বাস্তবায়ন যাতে কার্যকর না হতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তারা পত্রপত্রিকায়, বক্তৃতামঞ্চে একে ‘বাঙ্গালী বিরোধী, জাতীয়তা বিরোধী এবং বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ প্রভৃতি বিশেষণে আখ্যায়িত করে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে বাংলার সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষিত হওয়ার পরদিনই বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে ভূপেন্দ্রনাথ বসু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। সুরেন্দ্রনাথ পরিচালিত ‘বেঙ্গলী' পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গকে এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয় বলে মন্তব্য করা হয় এবং সরকারকে ভারতব্যাপী এক জাতীয় সংগ্রামের জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। কৃষ্ণ কুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী' পত্রিকায় ১৯০৫ সালের ১৩ই জুলাই সম্পাদকীয় নিবন্ধে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ‘বয়কট' যুদ্ধ ঘোষণা করে।

 ‘হিতবাদী' পত্রিকায় বলা হয়, বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙালী জাতির সামনে এরূপ বিপর্যয় কখনও আসেনি। সন্ধ্যা পত্রিকায় বলা হয়, বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই বঙ্গভঙ্গেরই সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। এভাবে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সমকালীন পত্রিকাগুলো উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা প্রচারে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে মুসলিম পত্রপত্রিকাগুলো নুতন প্রদেশ গঠনে আনন্দ প্রকাশ করে। কলকাতার মুসলিম সাহিত্য সংসদ একে আশীর্বাদ রূপে বর্ণনা করে এবং মুসলিম জনগণকে এর সাথে পূর্ণ সহযোগিতার আহবান জানায়। বাংলার তফশিল সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুরা বাংলা বিভাগকে পূর্ণ সমর্থন দান করে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গকে মেনে নিতে পারলনা।

 পূর্ব বাঙলায় তাই তারা কলকাতাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গভঙ্গ দিবসে কলকাতার টাউন হলে বর্ণ হিন্দুদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লাল মোহন ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ প্রভাবশালী হিন্দু নেতা যোগ দিয়ে ঘোষণা করেন যে বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তারা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু উৎসর্গ করবেন। বঙ্গভঙ্গ বানচাল করার জন্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...' গানটি।

এ যাবৎ কংগ্রেস সর্বভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজেকে প্রচার করতো। কিন্তু বাংলা বিভাগে তার সে মুখোস খসে পড়ে। কংগ্রেসপন্থী হিন্দুরা কলকাতা টাউন হলে প্রতিবাদ সভা ডাকলো কবি রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে। এ সভায় যে সব উত্তপ্ত বক্তৃতা হয়, তাতে মুসলমানদের চক্ষুরুম্মীলন হয় এবং তারা পৃথক রাজনৈতিক সংস্থা স্থাপনের চিন্তা করে। যার পরিণতিতে জন্মলাভ করে মুসলিম লীগ। এ আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষাতার দাবীদার কংগ্রেস দেশব্যাপী শোকদিবস পালন করে। কবি রবীন্দ্রনাথ সে দিন রাখী বন্ধন উৎসবের প্রচলন করেন।

 রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ‘আরন্ধন' পালন করার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। শোক প্রকাশের চিহ্নস্বরূপ সকলে উপবাস করে, দোকান পাট ও অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ রাখে। আত্মশুদ্ধির জন্য সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠে সকলে ‘বন্দে মাতরম' গান গাইতে গাইতে গঙ্গাস্নানে যায়। স্বদেশ বন্দনার নামে আন্দোলনকারীরা বিদ্বেষমূলক এই ‘বন্দে মাতরম' গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে চালু করে। ১৯০৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন এবং তাদের নেতৃত্বেই আন্দোলন পরিচালিত হয়।

কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে চরমপন্থী নেতা বিপিন চন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ বলেন ‘‘বাংলা বিভাগ কার্যকরি হলে বাঙ্গালী হিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায় বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ বলে বিভাগটায় ধর্মীয় রূপ দেওয়া হলো এবং সমগ্র হিন্দু বাংলা আন্দোলনে মেতে উঠলো।’’ কংগ্রেসের মারাঠি নেতা বালগঙ্গাধর তিলকও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তা সুসংহত করার জন্য মারাঠাদের নায়ক শিবাজীকে ভারতের সকল হিন্দুদের জাতীয় বীরের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার আয়োজন করেন। এদের চাপে তৎকালিন কংগ্রেস সভাপতি গোখেলের মতো উদারপন্থী নেতাও শেষ পর্যন্ত পূর্ববাংলার স্বার্থবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করেন।

 ১৯০৫ সালে কংগ্রেসের বারাণসির অধিবেশনে গোখেল তীব্র ভাষায় সরকারি নীতি ও সরকারি কর্মচারীদের কার্যকলাপের নিন্দা করেন এবং ভারতীয় জনগণের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার সুপারিশ করে। মোট কথা এই অধিবেশনে চরমপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় এবং চরমপন্থীরা কংগ্রেসকে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণে প্ররোচিত করে। ইতিমধ্যে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন পদত্যাগ করেন। লর্ড মিন্টো নতুন ভাইসরয় হয়ে এলেন এরং তার কাছে ভারত সভার পক্ষ থেকে প্রদেশ বিভক্তিকরণের একটি স্মারক লিপি পেশ করা হয়। কিন্তু মিন্টোর জওয়াব বাঙ্গালী নেতা এবং দেশীয় সংবাদপত্রগুলিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ফলে কংগ্রেস সমর্থক পার্লামেন্টের সদস্যরা ইংল্যান্ডে হেনরী কটনের নেতৃত্বে তোড়জোড় শুরু করে এবং বৃটিশ সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করবার জন্য চাপ দিতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কেবলমাত্র প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রতিবাদে যখন বৃটিশ সরকারের টনক নড়াতে পারলো না তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বৃটিশের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে রূপ নেয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সরকারের উপর ফলপ্রসূ চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে সৃষ্ট স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শকে রাজনৈতিক অভিষ্ঠ অর্জনে ব্যবহার করে। ১৯০৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিনে কলকাতা কালিঘাটের কালিমন্দিরে এক বিরাট সংখ্যক লোক সমবেত হয়ে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গকে স্বৈরাচারী, অন্যায়মূলক এবং অপ্রয়োজনীয় কুর্কীতি বলে নিন্দাবাদ করে এবং ‘বয়কট' আন্দোলনকে সমর্থনের শপথ গ্রহণ করে।

 বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন-প্রসূত স্বদেশী আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বোম্বাই, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ প্রভৃতি ভারতের বিভিন্নাংশে এ আন্দোলন প্রসারিত হয়ে এক সর্বভারতীয় গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং তা ক্রমশ স্বরাজ আন্দোলনে পরিণত হয়। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বৃটিশ সরকার তাদের বঙ্গ বিভাগ সিদ্ধান্তে অটল রইল। উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য আন্দোলনকারীরা চরমপন্থী নেতাদের প্ররোচনায় নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করলো। বিপ্লবীরা গোটা দেশে অগ্নিমন্ত্র ছড়াতে লাগলো। দেশে সন্ত্রাসবাদী কাজ শুরু হলো এবং দেশজুড়ে নানা গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হলো। এই সমস্ত সমিতিতে শারীরিক কসরত ছাড়াও যুবকদের মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে শিক্ষা দেয়া হতো। দেশময় অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ এবং রাজনৈতিক হত্যা চলতে থাকে। ১৯০৮ সালে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি বঙ্গভঙ্গ রদ করতে এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন করতে গিয়েই জীবন দেয়।

 স্বদেশী আন্দোলন এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বৃটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন করতে পারলো না। বরঞ্চ সন্ত্রাসবাদ সরকারি দমননীতির কঠোরতা ও অত্যাচার আর, বৃদ্ধি করে দিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নাশ এবং সভা-সমিতি প্রভৃতি দমনের প্রয়োজনীয় আইন পাস করা হয়। এদিকে নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের জনগণ এ সময় শিক্ষা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করতে শুরু করে। কিন্তু অচিরেই নতুন প্রদেশের ভাগ্যে নেমে আসে এক প্রচন্ড আঘাত। অবশেষে বৃটিশ সরকার কংগ্রেস নেতা ও বৃটিশ বণিকদের চাপে বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।

 ১৯১০ সাল নাগাদ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়লেও বৃটিশ সরকার বর্ণ হিন্দুদের দাবির নিকট নতি স্বীকার করে। ১৯১১ সালের নবেম্বর মাসে ভারত সচিব বঙ্গদেশ পুনর্গঠনের নতুন পরিকল্পনা অনুমোদন করেন এবং ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ ঐতিহাসিক দিল্লী দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা করেন। বঙ্গভঙ্গ রদ করায় কংগ্রেস ও হিন্দু সমাজ খুব উল্লসিত হয়। কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার বৃটিশ শাসকদের রাজনীতিবেত্তার তারিফ করেন। কংগ্রেসের ইতিহাস লেখক পট্টভি সীতারাময় লিখেছেন, ‘‘১৯১১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হয়, বঙ্গভঙ্গ রদ করে বৃটিশ সরকার ভারত শাসনে ন্যায়নীতির পরিচয় দেয়।

’’ এই উপমহাদেশের পরাধীনতা যাদের চক্রান্তে ১৭৫৭ সালে সম্ভব হয়েছিল তাদেরই বংশধররা শিক্ষিত বর্ণ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে সংগঠিত হয়ে ১৯০৫ সালে বাংলা বিভাগ রোধ করেছিল। আবার ১৯৪৭ সালে তাদেরই সাহায্যে উপমহাদেশে আযাদী লাভ করেছে এবং তার সঙ্গে বাংলাও বিভাগ হয়ে গেছে তাদেরই সাধনায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এ বিচিত্র অবদান অনস্বীকার্য।

 বঙ্গদেশকে ভাগ করার কোন ইচ্ছা মুসলমান নেতাদের ছিল না। বঙ্গদেশকে ঐক্যবদ্ধ রেখে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে এক বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, খাজা নাজিম উদ্দিন ও প্রাদেশিক রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান। তারা সবাই মতামত পেশ করেন যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনই বঙ্গদেশের মুসলমান এবং অমুসলমান সকল সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে এবং তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে বঙ্গদেশকে ভাগ করা হলে বাঙালিদের স্বার্থে চরম আঘাত হানা হবে।

নেহেরুর সাথে পরামর্শক্রমে ভিটি মেনন রচিত ভারত বিভাগের যে প্রস্তাব বৃটিশ মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেন তাতে পাঞ্জাব এবং বঙ্গদেশ হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিভক্ত করার প্রস্তাব ছিল। এ সময় মিঃ জিন্নাহ স্বতন্ত্র বঙ্গদেশ রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে সেখানে রেফারেন্ডামের প্রস্তাব করেন। কিন্তু ভাইসরয় তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখন্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অখন্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব প্রকাশিত হলে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন ‘হিন্দু মহাসভা' এবং কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল ও অবাঙালি নেতাগণ এর বিরোধিতা শুরু করেন। তাদের বিরোধিতার কারণে অখন্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারতের ভাইসরয় ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কে ঘোষণা দেন। এতে বলা হয় প্রদেশ বিভক্ত হবে কিনা সে সম্পর্কে উভয় প্রদেশের আইন পরিষদে পৃথকভাবে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিরা মতামত দিবেন। বিভক্ত ব্যবস্থায় পরিষদের কোন একটি অংশ ভোটাধিক্যে প্রদেশ বিভাগের অনুকূলে মত প্রকাশ করলে প্রদেশ বিভক্ত হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাদি অবলম্বন করা হবে। ২১ জুন মুসলিম সদস্যগণ অখন্ড বঙ্গ দেশের পক্ষে রায় দেয় কিন্তু হিন্দু সদস্যগণ বিভক্তি চায়। ফরে বঙ্গদেশ বিভক্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। বৃটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। সেই উদ্দেশ্যে লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন শেষ বড় লাট হয়ে আসেন। দিল্লীতে পদার্পণ করেই তিনি ঘোষণা করেন যে, বৃটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং কংগ্রেসের দাবির প্রেক্ষিতে অখন্ড ভারত রক্ষার্থে যথেষ্ট চেষ্টা করেন।

 কিন্তু আপোসের কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না। জিন্নাহ এবং লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান দাবিতে অটল থাকেন। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস লীগের দাবি অনুসারে ভারত বিভাগকরণে রাজি হয়। কিন্তু লীগকে এবং পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য কংগ্রেস এক নতুন দাবি উত্থাপন করলো যে, বাংলা ও পাঞ্জাব হিন্দু-মুসলমান অধিবাসী এলাকা হিসেবে ভাগ করতে হবে। জিন্নাহ, পাঞ্জাবের গবর্নর স্যার জেনকিল, বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং গবর্নর ফ্রেডারিক বারোজ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো, কিন্তু জিন্নাহ পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগে রাজি হতে চান না।

 তখন মাউন্ট ব্যাটেন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিলেন : প্রদেশ দু'টির বিভাগ সম্ভাবনায় তাঁর (জিন্নাহর) অন্তরে যে অনুভূতি জেগেছিল, তেমনি অনুভূতি আমার অন্তরে ও কংগ্রেসের অন্তরে জেগেছিল ভারত বিভাগ প্রসঙ্গে। লর্ড ইজমে ভাইস রয়ের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেন যে, 'if India was to be divided, Bengal and the Punjab would also have to be split in two, according to the will of the people.' Jinnah's answer was, 'better a moth-eaten Pakistan that no Pakistan at all'. যে হিন্দু নেতৃবৃন্দ ১৯০৫ সালে বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ হবে-ই যুক্তিতে বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য দেশময় তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তারাই সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সেই বাংলাকে বিভক্ত করবার জন্য নতুন আন্দোলন শুরু করে। ইতিহাস সত্যই বিচিত্র। ১৯০৫ সালে বৃটিশ সরকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ করলে তা রদের জন্য যারা দেশময় প্রচন্ড গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তারাই সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বাংলা বিভক্ত করার আন্দোলন শুরু করে। এ সম্পর্কে নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, ‘যে হিন্দুরা লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল তারাই আবার নিজেদের স্বার্থে বাংলার বিভক্তি সম্পন্ন করলো।

 এই স্বার্থটি কি? বিভিন্ন স্বার্থের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্বার্থটির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মিঃ নেহেরুর এক চিঠিতে। তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা কুমিল্লার আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর এক পত্রের জবাবে ১৯৪৭ সালের মে মাসে নেহেরু তাঁকে যে চিঠি লিখেন, তাতে তিনি বলেন : ‘অখন্ড ভারতের নীতিকে আমরা জলাঞ্জলি দিয়েছি, একথা সত্য নয়। তবে আমরা কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। ভারত বিভাগ মেনে নেব একটি শর্তে যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করতে হবে। কারণ একমাত্র এই পথেই অখন্ড ভারত পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে।'শনিবার ২১ মে ২০১১ | দৈনিক সংগ্রাম

No comments:

Post a Comment