Saturday 22 April 2017

আমাদের রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ??


আমাদের রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ??

০১.
"... রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা, দ্বারকানাথ ঠাকুরের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলকাতাতেই। এত উপার্জন করেও দ্বারকানাথ ঠাকুরের আশা মেটেনি। মদের ব্যবসা শুরু করলেন। প্রচুর অর্থ কামিয়েছিলেন তাতে। আবার নতুন ব্যবসা শুরু করলেন আফিমের্। আফিমে নেশাগ্রস্ত হয়ে দেশের লোকের সর্বনাশ হলেও তাতে কিছু এসে যেতনা তার। আর একটি রোজগারের বড় উৎস ছিল বিপদগ্রস্ত লোকদের হিতাকাঙ্খী সেজে মামলা মোকদ্দমার তদবির করা। চব্বিশ পর্গণার সল্ট এজেন্টও ছিলেন তিনি। তাতেও ভালো আয় হয় তার। তারপর হয়েছিলেন সেরেস্তাদার এবং পদোন্নতির ফলে হন দেওয়ান। এসবই ছিল তার সংসারে আর্থিক মধুবর্ষণ॥" -  আনন্দবাজার  / ২৮ শে কার্তিক, ১৪০৬

০২.
"... ধর্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্য শরীরে পাদুকা প্রহার - একথা আর গোপন করিতে পারিনা। ইত্যাদি নানা প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইল পুষ্করিনী প্রভৃতি জলাশয়স্থ মৎস্যের যেমন মা বাপ নাই, পশুপক্ষী ও মানুষ যে জন্তু যে প্রকারে পারে মৎস্য ধরিয়া ভক্ষণ করে, তদ্রুপ প্রজার স্বত্ত্ব হরণ করিতে সাধারণ মনুষ্য দূরে থাকুক যাহারা যোগী ঋষি ও মহা বৈষ্ঞ্চব বলিয়া সংবাদপত্র ও সভাসমিতিতে প্রসিদ্ধ, তাহারাও ক্ষুৎক্ষামোদর॥" - কাঙাল হরিনাথের "অপ্রকাশিত ডায়েরী"

০৩.
"... মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে জমিদার হিসেবে তিনি নির্বাচন করলেন চোদ্দ নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এও এক বিস্ময়। অত্যাচার, শোষণ, শাসন, চাবুক, চাতুরী প্রতারণা কলাকৌশলে কি রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তার পিতার বিবেচনায়? অনেকের মতে তার পিতৃদেব ভুল করেননি। প্রচন্ড বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা বহু বিষয়েই অনস্বীকার্য॥" - শ্রী স্বপন বসু / গণঅসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ

০৪.
 "... কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তার 'মিঠেকড়া'তে পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন যে, "রবীন্দ্রনাথ মোটেই লিখতে জানতেন না, স্রেফ টাকার জোরে ওর লেখার আদর হয়। কিন্তু বরাবর এতো নির্বোধের মতো লিখলে চলে কখনো? 'গীতাঞ্জলি' নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর জনরবের কি ধূম - রবীন্দ্রনাথ কোন বাউলের খাতা চুরি করে ছেপে দিয়েছেন। শেষে অবশ্যি নামও জানা গেল - স্বয়ং লালন ফকির মহাশয়ের বাউল গানের খাতা চুরি করেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। আজ অবিশ্বাস্য্য শোনালেও একথা কিন্তু সত্যি, সেদিন বহু ব্যক্তি শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন কর্তাকে বলেছেন এবং লিখেছেন - রবিবাবু বড় কবি স্বীকার করি। যাকগে, তা গীতাঞ্জলির খাতাটা এবার উনি ফিরিয়ে দিন। প্রাইজ তো পেয়েই গেছেন, অনেক টাকাও হাতে এসে গেছে, ওতো আর কেউ নিতে যাচ্ছে না, তা গান লেখা খাতাটা উনি দিয়ে দিন।"পাঁচকড়ি বাবু সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে, রবীন্দ্রনাথের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা একটা হুজুগ মাত্র। কারণ রবীন্দ্র সাহিত্য অনুরাগ বিশুদ্ধ ন্যাকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঁচকড়ির বাবু একথাও বহুবার স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন - রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করে অপহরণ॥" - সুজিত কুমার সেনগুপ্ত / জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল

০৫.
 "... রবীন্দ্রনাথের অখ্যাত দাদাদের মধ্যে সবচেয়ে গুণী সোমেন্দ্রনাথ। তিনি ছোটবেলায় ছোটভাইয়ের কবিতার সমঝদার বের করার জন্য আমলাদের মাঝখানে ঘুরে বেড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন - 'আমার দাদা এই সকল রচনায় গর্ব অনুভব করিয়া শ্রোতা সংগ্রহের উৎসাহে সংসারকে একেবারে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিলেন।

'রবীন্দ্রনাথ যেবার নোবেল প্রাইজ পেলেন সোমেন্দ্রনাথের কী আনন্দ। সারা বাড়িতে দৌড়ে বেড়ান আর চিৎকার করেন - 'রবি প্রাইজ পেয়েছে, রবি প্রাইজ পেয়েছে।' আবার নাতিরা যখন তার কাছে যায় তিনি ঘরের ভেতর ডেকে এনে ফিসফিস করে বলেন, 'জানিস তো গীতাঞ্জলির সবকটি কবিতা কিন্তু আমার লেখা। রবি আমার কাছ থেকেই তো নিয়েছে।' এই কথা শুনে নাতিরা যখন বলেন, 'তাহলে তুমি এত আনন্দ করছ কেন', সোমেন্দ্রনাথ তখন খেপে যান, চেঁচিয়ে বাড়ি মাৎ করে বলেন, 'তোদের এত হিংসে কেন রে, আমার ছোটভাই নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, আমি আনন্দ করব না তো কে করবে? কার লেখা তাতে কী?

'অন্যদিকে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর মনে হয় রবীন্দ্রনাথের উপর তিনি ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। সোমেন্দ্রনাথ পিছনে তাকে কেরাণী বলে তিরস্কার করতেন। তার অর্থ এও হতে পারে যে তার লেখাগুলোই কেরাণীর মত লিখে দিয়ে পেয়ে গেলেন নোবেল প্রাইজ। কিছুদিন এমন হযেছিল যে বাড়িতে কোন অতিথি এলেই তাকে নিয়ে গিয়ে বলতেন, 'চল আমার সঙ্গে। আমার বাড়ীতে একজন কেরাণী আছে। তাকে দেখবে চল।' তারপর আঙূল বাড়িয়ে দেখিয়ে বলতেন, 'ঐ দেখ কেরাণী, কলম পিষছে তো পিষছেই।' তার ধারনা ছিল তিনি যদি ঠিকমত লিখতেন, তাহলে ছোটভাইয়ের চেয়ে অনেক বড় লেখক হতে পারতেন॥" - অমিতাভ চৌধুরী / ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ

০৬.
 "... ঠাকুর নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির পূর্বে প্রায় অশিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতেন। আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্রে ঠাকুরের একটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সেটাকে বিশুদ্ধ ও সাধু বাংলায় লেখার নির্দেশ ছিল। এবং এটা ছিল ১৯১৪ সালে তার নোবেল পুরুস্কার প্রাপ্তির একবছর পরে॥" - জাস্টিস আব্দুল মওদুদ / মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রুপান্তর

০৭.
 "... রবীন্দ্রনাথের বই অনেক সময় বিক্রী করতে হযেছে অর্ধেক দামেও। তা নিয়ে সেকালে কম ঠাট্টা বিদ্রুপ হয়নি। ১৯০০ সালে কবির বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে তিনি লিখেছিলেন - 'ভাই, একটা কাজের ভার দেব? আমার গ্রন্থাবলী ও ক্ষণিকা পর্যন্ত সমস্ত কাব্যের কপিরাইট কোন ব্যক্তিকে ৬০০০ টাকায় কেনাতে পারো? শেষের বইগুলি বাজারে আছে, সে আমি সিকিমূল্যে তার কাছে বিক্রি করব - গ্রন্থাবলী যা আছে, সে এক তৃতীয়াংশ দামে দিতে পারব (কারণ এটাতে সত্যের অধিকার আছে, আমি স্বাধীন নই)। আমার নিজের দৃঢ় বিশ্বাস, যে লোক কিনবে সে ঠকবে না। আমার প্রস্তাবতা কি তোমার কাছে দু:সাধ্য ঠেকছে? যদি মনে কর ছোটগল্প এবং বউঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি কাব্য গ্রন্থাবলীর চেয়ে খরিদ্দারের কাছে বেশি সুবিধাজনক বলে প্রতিভাত হয় তাহলে তাতেও প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস কাব্য গ্রন্থগুলোই লাভজনক।'এইভাবে নানারকম ঝামেলার মধ্যে কবির বই প্রকাশ করতে হযেছে। পরে প্রকাশনার ভার নিল এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস। পরে প্রকাশনার দায়িত্ব এসে পড়ে বিশ্ব ভারতীর ওপর ১৯২৩ সালে॥"  -অমিতাভ চৌধুরী / ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ

তথ্যসূত্র : গোলাম আহমাদ মোর্তজা / এ এক অন্য ইতিহাস ॥ [ বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কলকাতা - ডিসেম্বর, ২০০০ । পৃ: ১৪২ - ১৮১ ]

#০২
বঙ্গভঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
=======================
"... ভারতে ধর্মরাজ্য স্থাপনের সহস্র বর্ষের সাধনায় আবিস্কৃত আহুতি মন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’ অর্থাৎ উৎকট ন্যাশনালিজমকে “মানবতাবাদী”, ‘উদারপন্থী’, বলে কথিতরাও অন্য সকলের মত করেই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দেমাতরম’ এর ‘ন্যাশনালিজম’কে শুধু সর্বান্তকরণে গ্রহণ করা নয়, ‘বন্দেমাতরম’ গানে সুরারোপ করেন। [‘অখন্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৭৭।] অথচ এই রবীন্দ্রনাথ এই নেশনবাদের বিরুদ্ধে কত শত ভাষায়ই না কথা বলেছিলেন, লিখেছিলেন।

... রবীন্দ্রনাথের মত এত তীব্র, এত শক্ত ও এত সুন্দর ভাবে জাতীয়তাবাদকে বাংলাভাষায় আর কেউ আক্রমণ করেছে বলে আমি জানি না। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ঐতিহ্যের খেলাফ বললেন, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসন বললেন, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ আত্মস্বার্থের পুজা, লোভ ও ঘৃণার উৎস বললেন এবং যে জাতীয়তাবাদ রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিবেশী জাতি সম্পর্কে অন্তহীন তথ্যবিকৃতি ও মিথ্যা কাহিনীর জন্মদাতা হিসেবে চিহ্নিত, সেই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে, আয়োজনকে এবং সে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছেন, তার সাথে একাত্ম হয়েছেন, এমনকি সে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার হিংস্রতার সাথেও তিনি নিজেকে শামিল করেছেন।

কারও অজানা নয়, বঙ্কিম সাহিত্য হিন্দুদের হিংস্র জাতীয়তাবাদ এবং খুনে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মূল উৎস। [অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন লিখিত ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’, গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকার ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়’ শীর্ষক নিবন্ধ দ্রষ্টব্য।] বঙ্কিম “রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মনের প্রতিভূ হিসাবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদগাতা ঋষি হিসাবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবহ্নি তিনি ছড়িয়েছিলেন লেখনি মুখে, জগতের ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নজীর নেই। তিনি মানবতার যে অকল্যাণ ও অসম্মান করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তারও তুলনা নেই। ‘রাজ সিংহ’ ও ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস দুটিতে তিনি মুসলিম বিদ্বেষের যে বিষবহ্নি উদগীরণ করেছেন, সে বিষ জ্বালায় এই বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, তা নিঃশেষ শুষ্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র অস্বীকার করে তাদের বিতাড়িত করে সদাশয় বৃটিশ জাতির আবাহনে ও প্রতিষ্ঠায় বার বার মুখর হয়ে উঠেছিলেন”। [‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ’, সংস্কৃতির রূপান্তর’, আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ৩৩৯।]

বঙ্কিমের এই সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং একে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলে অভিহিত করে মুসলমানদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা”। [‘মুসলিম জননেতা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী একটি বক্তৃতায় মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য বন্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করলে, “ভারতী পত্রিকা’য় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন।]

মুসলমানদের সংহারকামী হিংস্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের জনক “শিবাজী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব আরও দুঃখজনক। বাংলাদেশের জন-মানুষের কাছে শিবাজী এবং শিবাজী বাহিনী ‘বর্গীদস্যু’ হিসাবে পরিচিত। যেহেতু ‘শিবাজী মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তাই শিবাজীবাদের প্রবক্তারা লুণ্ঠনকারী এক দস্যূকে জাতীয় বীর হিসাবে চিত্রিত করার উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে বিকৃত করেছিলেন।" [‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ, সিদ্ধিকী বার এট ল, পৃষ্ঠা ৯৩ (উদ্ধৃতি)।] ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারও এই কথাই বলেছেন। তাঁর মতে “সেকালে বাংলায় আমাদের মহৎ বীরদের সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় রাজপুত, মারাঠা ও শিখ বীরদের জীবনী আমদানি করতে হয়েছে। জাতীয়তাবাদী নেতাগণ রাজনৈতিক গরজে সামগ্রিকভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে জনমনকে বিভ্রান্ত করতেন। এমনকি ‘শিবাজী উৎসবে’ মুসলমানকে টেনে আনার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করে ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা করতেন এবং ব্যাখ্যা দিতেন।" [ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দিকী বার এট ল, পৃষ্ঠা ৯৩ (উদ্ধৃতি)।]

ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা এবং ইতিহাসকে বিকৃত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করেছেন। শিবাজীর স্তুতিগান করে তিনি লিখেছেন,

“হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি—
এক ধর্ম রাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতে
বেঁধে দিব আমি। তারপর একদিন মারাঠার প্রান্তর হইতে
তব বজ্র শিখা
আঁকি দিল দিগ-দিগন্তে যুগান্তরে বিদ্যুত বহ্নিতে
মহামন্ত্র লিখা।
মোগল উষ্ণীয় প্রস্ফুরিল প্রলয় প্রদোষে
পুষ্প পত্র যথা
সেদিনও শোনেনি বঙ্গ মারাঠার সে বজ্রনির্ঘোষে
কি ছিল বারতা।"

শিবাজীর শুধু স্তুতি নয়, ইতিহাস বিকৃতির পক্ষ নিয়ে শিবাজীর পক্ষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত ইতিহাসকারদের বিদ্রুপ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

“বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলে করে পরিহাস
অট্টহাস্য রবে—
তব পূণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিস্ফল প্রয়াস
এই জানে সবে।
অয়ি ইতিবৃত্ত কথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ
ওগো মিথ্যাময়ী,
তোমার লিখন-‘পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হবে আজি জয়ী।
যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে
তব ব্যঙ্গ বাণী
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে
নিশ্চয় সে জানি।"

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের উৎকট ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তার প্রকাশ ঘটেছিল। স্বদেশ-জাতীয়তাকে আরাধ্য দেবীতে পরিণত করা হয়েছিল এবং এই আরাধ্য দেবীর জন্য প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার সব পণ করা হয়েছিল।

... এই হিন্দু-জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সাথে রবীন্দ্রনাথও পুরাপুরি একাত্ম হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দুটি সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং বঙ্গ-ভঙ্গ বাস্তবায়নের দিনকে তিনি ‘রাখি বন্ধন’ দিবস ঘোষণা করেন। ‘রাখি বন্ধন’ এর দিন সকালে গঙ্গাস্নানের মিছলের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ একটা প্রার্থনা সংগীত গাইলেন। সে প্রার্থনা সংগীতে তিনি বললেন—

বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক।
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর বাংলার হাট
বাংলার বন বাংলার মাঠ
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর পণ বাংগালীর আশা
বাংগালীর কাজ বাংগালীর ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক
সত্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর প্রাণ বাংগালীর মন
বাংগালীর ঘর যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান।

এক সংগীত শেষে বীডন উদ্যানে ও অন্যান্য জায়গায় রাখবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পার্শী বাগান মাঠে অখণ্ড বাংলার ‘বঙ্গভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক ভাবে ‘ফেডারেশন হলের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। এখানেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অভিভাষণ পাঠ করেন। বজ্রদীপ্ত কণ্ঠে উল্লেখ করেন, “যেহেতু বাঙ্গালী জাতির সার্বজনীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ করিয়াছেন সেহেতু আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙ্গালী জাতির একতা সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙ্গালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব”। (অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৮২, ৮৩)

রবীন্দ্রনাথের এ কথা মিথ্যা হয়নি। ‘বন্দেমাতরম’ এর খন্ডিত মা’কে অখন্ড করার জন্যে ‘প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার’কে পণ করে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল। “১৯০২ সালে তিনি (শ্রী অরবিন্দ) মারাঠী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে তার ছোট ভাই শ্রী যতীন মুখার্জীকে কলকাতায় পাঠান। এ সময়ে যোগেন্দ্র বিদ্যাভুষণ, জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত হন”। [‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ পুর্নেন্দু দস্তিদার।] রবীন্দ্রনাথ নিজেও একথা বলেছেন, “আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল, তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয়নি, বিরুদ্ধে ছিল”। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩)

... স্বদেশীদের সাহায্য পুষ্ট হয়ে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। এই চাপই ইংরেজ সরকারকে বাধ্য করল বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। স্বয়ং বৃটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের বক্তব্যেই এর নিশ্চিত প্রমাণ মিলে। সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতের ভাইসরয়, লর্ড হার্ডিঞ্জকে লিখেন, “আমি আশা করি আপনি ভারতের বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করে সম্রাটের প্রথম ভারত সফরকে কিভাবে অবিস্মরণীয় করে রাখা যায় সে সর্বাত্মক কর্মসূচী প্রণয়ন ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে যত্নবান হবেন। বাঙালীদের (বাংগালী হিন্দু) সন্তুষ্ট করার জন্যে বোম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর মত উভয় বাংলাকে একত্র করা যায় কিনা সে বিষয়েও বিচার বিবেচনা করবেন। ... বাংলার বিরাজমান অসন্তোষ, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ উপশম এবং দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার লাঘবে এই পদক্ষেপ একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি”।" [ভাইসরয়ের প্রতি সম্রাট, ডিসেম্বর ১৬, ১৯১০, HP. ১০৪ (‘বঙ্গভঙ্গ’, মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা ৭৭, ৭৮)।]

হিন্দুদের চাপই অবশেষে কার্যকরী হয়েছিল। সম্রাট যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ভাইসরয়-এর কাছে, তা-ই তিনি কার্যকরী করেছিলেন ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর তাঁর দিল্লী দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দানের মাধ্যমে। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের চাপ ও অসন্তোষের কথা বিবেচনা করা হলো, কিন্তু মুসলমানদের হৃদয় যে ভেংগে গেল তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হলো না। এইভাবে হিন্দুদের হিংসারই জয় হলো। [‘বাঙালী হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করায় প্রধান কারণ ছিল, পূর্ব বঙ্গে বাঙালী মুসলমানরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে, সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন’। (পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’, আম্বেদকর, পৃষ্ঠা ১১০)।]

কিন্তু এই হিংসা দুই জাতিকে দুই প্রান্তে ঠেলে দিল। ‘১৯০৫-এর বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতবর্ষে সৃষ্টি করলো দুটি জাতীয়তাবাদ -একটি হিন্দু, অপরটি মুসলমান’।[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল’ হিন্দুস্তান বুক সার্ভিস, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৪।] শুধু তাই নয় ডঃ আম্বেদকরের মতে বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করে এবং সেই সঙ্গে স্বরাজলাভের দাবী করে তারা (হিন্দুরা) একদিন মুসলমানদের পূর্ব ও পশ্চিম উত্তর ভারতের শাসক করে তুলবেন।[‘পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, ‘ডঃ আম্বেদকর, পৃষ্ঠা ১১০। সিলেবাস বিতর্ক এবং অতীত ষড়যন্ত্রের কাহিনী’ শীর্ষক নিবন্ধে উদ্ধৃত করেছেন। তার নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় দৈনিক সংগ্রামের ২৬শে এপ্রিল, ১৯৯৩ সংখ্যায়।] ডঃ আম্বেদকরের এই উক্তির অর্ধেকটা সত্যে পরিণত হয়েছে ইতিমধ্যেই।

সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হিংসা এবং মুসলমানদের সর্বনাশ দেখার জেদ বঙ্গভঙ্গ রদ করেই শেষ হয়ে গেলনা এবং মর্লি-মিণ্টো সংস্কারের পৃথক নির্বাচন ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব-সুযোগের বিরোধিতা অব্যাহত রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলোনা, মুসলিম বিরোধী তাদের সহিংস মন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তও মেনে নিতে পারলো না। উল্লেখ্য, বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলমানদের স্বান্তনা দেবার জন্যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ভারত সরকার ১৯১২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ঘোষণা করেন।

এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ল হিন্দুরা। ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তারা সভা করল। এই সভায় সভাপতিত্ব করলেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ। বিস্ময়ের ব্যাপার, পূর্ববঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের বিশাল জমিদারি চিল, সে রবীন্দ্রনাথও তার মুসলিম প্রজারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হোক তা চাননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেদিন একাট্টা হয়ে প্রচারে নেমেছিল হিন্দু সংবাদপত্রগুলো। হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন শহরে মিটিং করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করে পাঠাতে লাগলেন বৃটিশ সরকারের কাছে। [দ্রষ্টব্যঃ Calcutta University Commission report. Vol. IV পৃষ্ঠা ১১২, ১৫১।]

‘এভাবে বাবু গিরীশচন্দ্র ব্যানার্জী, ডঃ স্যার রাসবিহারী ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলার এলিটগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারক লিপি সহকারে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর উপর চাপ সৃষ্টি করলেন। ডঃ স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে হিন্দু প্রতিনিধিগণ বড় লাটের কাছে এই বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করলেন যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ অধিকাংশই কৃষক। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে তাদের কোন উপকার হবে না।–[দ্রষ্টব্যঃ Calcutta University Commission report. Vol. IV পৃষ্ঠা ১১৩।]

বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে সব হিন্দু যেমন এক হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ক্ষেত্রেও তাই হলো। পূর্ববঙ্গের, এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে বাধা দেবার জন্যে এগিয়ে এল। ‘A History of Freedom Movement’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, The Controversy that started on the Proposal for founding a university at Dacca, throws interesting on the attitude of the Hindis and Muslims. About two hundred prominent Hindis of East Bengal, headed by Babu Ananda Chandra Ray, the leading pleder of Dacca, submitted a memorial to the Viceroy vehemently against the establishment of a University at Dacca For a long time afterwards. They tauntingly termed this University as ‘Mecca University’.[‘A History of the Freedom Movement’, গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের Dacca University; Its role in Freedom Movement’ শীর্ষক অধ্যায়, পৃষ্ঠা ১০ (Published in 1970).] অর্থাৎ ‘ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব যে বিতর্কের সৃষ্টি করল তাতে হিন্দু ও মুসলমানদের ভূমিকা সম্পর্কে মজার তথ্য প্রকাশ পেল। পূর্ব বাংলার প্রায় দুই’শ গণ্যমান্য হিন্দু ঢাকার প্রখ্যাত উকিল বাবু আনন্দ চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করে ভাইসরয়কে একটি স্মারক লিপি দিয়েছিল। পরে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে বিদ্রুপ করা হতো’।

হিন্দুদের এই সর্বাত্মক বিরোধিতা সত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের বিরোধিতা ও ঘৃণা তারা অব্যাহতই রাখল। এর একটা সুন্দর প্রমাণ পাই আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি অধ্যাপক শ্রী দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর’ এর বক্তব্যে। শ্রীভাণ্ডারকর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তার এক বক্তৃতায় বলেন “কলিযুগে বৃদ্ধগঙ্গা নদীর তীরে হরতগ নামক একজন অসুর জন্ম গ্রহণ করবে। মূল গঙ্গার তীরে একটি পবিত্র আশ্রম আছে। সেখানে অনেক মুনি-ঋষি এবং তাদের শিষ্যগণ বাস করে। এই অসুর সেই আশ্রমটি নষ্ট করার জন্যে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে একে একে অনেক শিষ্যকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যাবে। যারা অর্থ লোভে পূর্বের আশ্রম ত্যাগ করে এই অসুরের আকর্ষণে বৃদ্ধ গঙ্গার তীরে যাবে, তারাও ক্রমে অসুরত্ব প্রাপ্ত হবে এবং তারা অশেষ দুর্দশাগ্রস্ত হবে’। [শ্রী ভাণ্ডারকর এই উক্তিটি ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার স্মৃতিকথা ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ উল্লেখ করেছেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সভায় শ্রী ভাণ্ডারকরের এ উক্তি করেন, সে সভায় ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।]

পরিস্কার যে, শ্রী ভাণ্ডারকর এই বক্তব্যে ‘হরতগ’ বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর মিঃ ফিলিপ ‘হরতগ’ কে বুঝিয়েছেন। মিঃ হরতগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। শ্রী ভাণ্ডারকরের বক্তব্যে হরতগ-এর ‘আশ্রম’ বলতে বুঝানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আমাদের ‘বুড়িগঙ্গা’ হয়েছে শ্রী ভাণ্ডারকরের বক্তব্যে ‘বৃদ্ধাগঙ্গা’। আর মূল গঙ্গা-তীরের ‘পবিত্র আশ্রম’ বলতে শ্রী ভাণ্ডারকর বুঝিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে। শ্রী ভাণ্ডারকরের কথায় ঢাকা অর্থাৎ পূর্ববাংলা অসুরদের স্থান। পবিত্র স্থান কলকাতা থেকে যেসব ঋষি শিষ্য ঢাকায় চাকুরী করতে আসবেন তারাও অসুর হয়ে যাবে। এ থেকেই বুঝা যায়, মুসলমানদর প্রতি শ্রী ভাণ্ডারকরদের বৈরিতা কত তীব্র, ঘৃণা কত গভীর।

তাদের এ বৈরিতার কারণে উপযুক্ত বরাদ্দের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভীষণ অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয় এবং অঙ্গহানিও হয়েছিল। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর ভাষায় “(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়) মুসলমানরা খুবই খুশী হলেন বটে, কিন্তু হিন্দুদের মনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। সাধারণত যারা রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকতেন, তারাও এবার এই প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাস বিহারী ঘোষ ও গুরুদাস বন্দোপাধ্যয়। তাদের প্রধান যুক্তি হলো এই যে, প্রশাসন ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এখন একটি সাংস্কৃতিক বিভাগ করা হচ্ছে। ফলে, এতে গুরুতর বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রমে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ হিন্দুদের এই বলে আশ্বাস দিলেন যে, তাদের এমন আশংকার কোন কারণ নেই। ঢাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় হবে তার ক্ষমতা ও অধিকার ঢাকা শহরের দশ মাইল পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে”। [‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার।]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও এই ভাবে হিন্দুরা একে ‘ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সিন্ডিকেটে হিন্দু যারা নির্বাচিত হয়ে আসতেন তারাও বিশ্ব-বিদ্যালয়ের বৈরিতা ত্যাগ করতেন না, তাদের ভোট বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করারই চেষ্টা করত। ডক্টর রমেশচন্দ্র লিখছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (সিনেটর) সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক ছিলো মুসলমান এবং অর্ধেক ছিলেন হিন্দু। প্রফেসররা কোর্টের সদস্য ছিলেন। বার লাইব্রেরীর অনেক উকিল রেজিষ্টার্ড গ্রাজুয়েটদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে এর সভ্য হতেন। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকে হিন্দুরা ভাল চোখে দেখেনি, একথা পূর্বেই বলেছি। কারণ হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল বঙ্গভঙ্গ রহিত রকায় মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে, অনেকটা তা পূরণ করার জন্যই এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রীতির চোখে দেখেননি। বাইরে এ বিষয়ে যে আলোচনা হত কোর্টের সভায় হিন্দু সভ্যতের বক্তৃতায় তা প্রতিফলিত হত। অবশ্য ভোটের সময় জয়লাভের ব্যাপারে আমরা অনেকটা নিশ্চিত ছিলাম। মুসলমান সদস্য এবং হিন্দু শিক্ষক সদস্যরা একত্রে হিন্দু সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশী ছিলেন”। [‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার।]

সংখ্যাগুরু হিন্দুরা মুসলমানদের কোন ভালই সহ্য করতে পারেনি। মুসলিম লীগ গঠন তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিল, মর্লি-মিণ্টোর শাসন-সংস্কারে মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তারা বরদাশত করেনি, বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানদের যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে তারা সহ্য করতে পারেনি এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের সহ্য হলোনা। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু মনোভাব সবচেয়ে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে ‘গুরুতর বিপদ’ অবলোকন করেছে। এই ‘গুরুতর বিপদ’টা কি? সেটা মুসলমানদের উন্নতি ও উত্থান। অর্থাৎ হিন্দুরা হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের অস্তিত্বের বিরোধী, যা মাথা তুলেছিল শিবাজী, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, শ্রী অরবিন্দের আন্দোলনে। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের উত্থিত এই সংহার মূর্তিই সেদিন মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের আত্মরক্ষার সংগ্রামকেই অপরিহার্য করে তুলেছিল॥"

- আবুল আসাদ / একশ' বছরের রাজনীতি ॥ [ বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি - মে, ২০১৪ । পৃ: ৬০-৭৪ ]

৩.
রবীন্দ্রনাথ ও শিবাজী.:
"... ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর কার্যকরী হওয়ার দিন থেকে কলকাতায় হিন্দু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই সময়ে এই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তখন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক মর্যাদায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার কলকাতা তথা বাংলার হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির জগতের প্রধান পাদপীঠ। অর্থনৈতিকভাবে এই পরিবার জমিদারকুলের শিরোমণি। ফলে খুবই স্বাভাবিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান ছিল কলকাতা কেন্দ্রীক হিন্দু সংস্কৃতির নেতৃত্বের আসনে। সামাজিক শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তথা বাঙালি মুসলিম বিরোধী আন্দোলনে। এরই চরম বহি:প্রকাশ "শিবাজী উৎসব" কবিতা রচনা ও প্রকাশ।

... উনিশ শতকের আশির দশকে হিন্দুদের গো-রক্ষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর 'গোকরুণানিধি' প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। ১৮৮২ সালে এই সংগঠনের জন্য কলকাতা থেকে সংগৃহীত হয় ছয়-সাত লক্ষ টাকা। এটা বলাই বাহুল্য যে কলকাতা থেকে এই বিপুল অর্থের যোগান দিয়েছিল হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর আর্য সমাজ ও গো-রক্ষা আন্দোলন বাংলা এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলেও সে সময়ে দেশে কয়েকটি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠে। এইরূপ একটি সংগঠন হলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠিত 'সঞ্জীবনী সভা'। ১৮৮৬ সালে রাজনারায়ণ বসুর প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনরুদ্ধারে নিবেদিত ছিল। এই সংগঠনের কর্মকান্ডে বাংলার মুসলিম সমাজ সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক বক্তব্য স্থান পায়নি। বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান এবং সমাজে তাদের বাস্তব উপস্থিতি এই সংগঠন উপলব্ধি করতে পারেনি। এই সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত উনিশ শতকের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনে আন্দোলিত ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার।

... হেমলতা দেবী প্রণীত গ্রন্থ 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেন বাংলা ১৩০৫ সালের ভারতী পত্রিকার জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়। এই গ্রন্থ সমালোচনার অনুষঙ্গে ভারতে মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। লেখিকা হেমলতা দেবী সম্ভবত তার ইতিহাস গ্রন্থে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে বিচার করেছেন। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে,"মোঘল রাজত্বের পূর্বে তিনশত বছরব্যাপী কালরাত্রে ভারত সিংহাসনে দাস বংশ থেকে লোদী বংশ পর্যন্ত পাঠান রাজণ্যবর্গের যে রক্তবর্ণ উল্কা বৃষ্টি হয়েছে গ্রন্থে তার একটা বিবরণ থাকলে ভাল হতো।"

এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানী শাসনামলকে রবীন্দ্রনাথ ভারত ইতিহাসের কাল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ভারতীয় ইতিহাসের সুলতানী যুগের সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী সময়কালকে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করার রবীন্দ্রনাথের এই প্রয়াস অনৈতিহাসিক, সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষপ্রসূত। সুলতানী আমলে ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুল উন্নতি সাধিত হয়। এই সময়কালে ভারতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শাসন কাঠামো গড়ে উঠে। শিক্ষা ও শিল্পকলায় নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটে। বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ ব্রাহ্মণদের সামাজিক অত্যাচার থেকে রেহাই পায়। বাংলার ইতিহাসে সুলতানী আমল একটি স্বর্ণোজ্জল অধ্যায়। মুসলিম সুলতানদের হাতেই বাংলা ভাষার পূর্ণ সমৃদ্ধি ঘটে। মুসলিম শাসকেরা বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে এবং এই ভাষার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এই সময়কালটি বাংলা ভাষা বিকাশের সোনালী যুগ। আরবী ও ফারসী ভাষার সংস্পর্শে এসে সমৃদ্ধ হয় বাংলা ভাষা। বাংলা সাহিত্যে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ এই সুলতানী আমলকে বলেছেন ইতিহাসের কালো অধ্যায়। এখানে তিনি মুসলিম বিদ্বেষ থেকে ইতিহাস বিকৃতিতে অবতীর্ণ।

... ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্যে এটা স্বীকৃত যে পলাশী পূর্ববর্তী সুবে বাংলার অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হযে পড়েছিল মারাঠা দস্যু আর সন্ত্রাসীদের হামলা, লুন্ঠন, হত্যা ও আক্রমণে। নবাব আলীবর্দী খান মারাঠা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে তার শাসনামলের প্রায় পুরো সময়কালটি ব্যাপৃত থাকেন। উনিশ শতকের হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই ঐতিহাসিক সত্য ভুলে সন্ত্রাসী মারাঠাদের আক্রমণ, লুটপাট আর কর্মকান্ডকে মুসলিম বিরোধী অভিহিত করে হিন্দুদের গৌরব চিহ্নিত করতে থাকে। প্রধানত: এই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলার হিন্দুসমাজ বিজাতীয় মারাঠাদের গুণকীর্তন আর বন্দনা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই ধারারই শক্তিশালী প্রবক্তা।

... 'শিবাজী উৎসব্' (১৯০৪) কবিতাটি যখন রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তখন তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। একই সঙ্গে কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলেও তিনি সম্মানের সাথে সমাদৃত। পারিবারিক এবং আর্থিক কারণে তিনি কলকাতার অভিজাত মহলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান করছেন। বয়েসের পরিসীমায়ও তিনি পরিণত। বলা যেতে পারে উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর পর্বের রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মের ধারাবাহিকতার সাথে কবিতাটির মর্মার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল সেখানে শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেন। তিলক শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উগ্র হিন্দু জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার ও প্রসারের জন্য। ক্রমে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে চালু হয় গণপতি পূজা। ইতিপূর্বে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গো-রক্ষিণী সভা ঐ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। মহারাষ্টের শিবাজী উৎসবের অনুকরণে সখারাম গণেশ দেউস্করের প্রচেষ্টায় কলকাতায় শিবাজী উৎসব প্রচলিত হয় ১৯০২ সালের ২১ জুন তারিখে। সরলা দেবী ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে বীরাষ্টমী উৎসব প্রচলন করেন। তিনি ১৯০৩ সালের ১০ মে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে প্রতাপাদিত্য উৎসব প্রচলন করেন এবং একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রবর্তন করেন উদয়াদিত্য উৎসব। কলকাতার বাইরে থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ এই তিনটি উৎসবে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে ২৬ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে জানকীনাথ ঘোষালের বাড়িতে যে বীরাষ্টমী উৎসব অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথ তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন।

... শিবাজী উৎসবের মূল মন্ত্র ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষ, সন্ত্রাস এবং সাম্প্রদায়িকতা। বস্তুত এই শিবাজী উৎসবের সূত্র ধরেই বাংলায় সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান পরস্পর বিপরীত পথে ধাবিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটা স্বীকার্য যে এই সন্ত্রাস আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দায়ভাগ পুরোপুরি বর্তায় হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর্। 'শিবাজী উৎসব' পালনের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাংলায় যখন মুসলিম বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজনীতির ভূমি নির্মিত হচ্ছে তখন বাঙালি মুসলিম সমাজ অর্থে, বিত্তে, শিক্ষায় একটি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। আর পূর্ববাংলায় বাঙালি মুসলিম জসংখ্যার সিংহভাগ জমিদারদের রায়ত বা প্রজা। বাংলার হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করলেও হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠার শক্তি বা অবস্থা বাঙালি মুসলমানের ছিল না। কিন্তু বাস্তব ইতিহাস হলো বিশ শতকের শুরুতে এই সাম্প্রদায়িক 'শিবাজী উৎসব' বাংলায় চালু হয়েছিল মুসলিম বিরোধীতা এবং মুসলিম বিদ্বেষকে পুঁজি করে।

কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর কর্মকান্ড ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন :

কোন দূর শতাব্দের এক অখ্যাত দিবসে
নাহি জানি আজ
মারাঠার কোন শৈল অরণ্যের অন্ধকারে ব'সে
হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসয়া এ ভাবনা তরিৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি
'একরাজ্যধর্ম পাশে খন্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেধে দিব আমি'।

এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীকে ভারতের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে খন্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল শিবাজীর জীবনের উদ্দেশ্য। মহারাষ্ট্রে শিবাজী উৎসবের প্রচলন, পরবর্তী সময়ে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিবাজী উৎসব প্রচলনের এবং এই উৎসবকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য নিবেদিত প্রাণ বালগঙ্গাধর তিলক এবং সখারাম দেউস্করের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিবাজীর আদর্শে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা। এখানে এটা স্পষ্টত:ই লক্ষ্যণীয় যে তিলক, দেউস্কর আর রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সম্পূর্ণ অভিন্ন।

... মুসলিম শাসকেরা কখনোই ইসলাম ধর্মকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়নি কিংবা ইসলাম গ্রহণের জন্য কোন প্রকার জোর জবরদস্তি করেনি। জাত-পাত আর বহুবর্ণে বিভক্ত এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি অংশ স্বেচ্ছায় ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইতিহাসে এটাও স্বীকার্য যে সমগ্র ভারতবর্ষকে মুসলিম শক্তিই প্রথম এককেন্দ্রীক শাসনের আওতায় নিয়ে এসেছে। আর ভারতের ঐক্য স্থাপন কখনোই ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি। মুসলিম রাজনৈতিক পতাকাতলে ভারতবর্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সতেরো শতকের ভারত ইতিহাসে শিবাজী একজন মুসলিল বিরোধী, সন্ত্রাসী, লুন্ঠনকারী ও বিশ্বাসভঙ্গকারী আঞ্চলিক দলনেতা। শিবাজীর আদর্শ হলো একমাত্র মুসলিম শাসনের বিরোধিতা। এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর হিন্দুধর্ম আর সন্ত্রাসের আদর্শে ভারতকে এক করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। শিবাজীর আদর্শে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক, মুসলিম বিদ্বেষী এবং আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাংলা ও ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতি ধারার বিরোধী।

... ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পটভূমিতে একদিকে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় এবং অন্যদিকে বাংলায় সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। যেহেতু রাজশক্তি মুসলমানদের কাছ থেকে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল তাই তাদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বাংলার মুসলমান সমাজ। ইংরেজ শক্তি বাংলার মুসলমান সমাজের উপর শুরু করে শোষণ, নিপীড়ন আর নির্যাতন। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজ শুরু করে বৃটিশ শক্তির পদলেহন ও দালালী। তারা ইংরেজ কোম্পানির দালালী, মুৎসুদ্দী আর বেনিয়াগিরী করে প্রভুত অর্থের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাকে গ্রহণ করে। অন্যদিকে মুসলমান সমাজ তাদের ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার ভয়ে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। ক্রমে রাজক্ষমতা, প্রশাসনিক কর্তৃৃত্ব মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উপরন্তু রাজভাষা ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজি চালু হলে মুসলমান সমাজ যুগপৎ ভূমি ও সরকারী চাকুরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে একটি দরিদ্র শ্রেণীতে পরিণত হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আর্থিক সামর্থ্য মুসলমানদের ছিল না। এই পটভূমিতে ইংরেজদের পদলেহী হিন্দু সমাজের একাংশ দালালী আর বেনিয়াগিরী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পটভূমিতে এই সকল দালাল-বেনিয়ারা অর্থ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে জমিদার শ্রেণীতে পরিণত হয়।

এই ইংরেজদের দালালদেরই একজন রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই দালাল শ্রেণীর কাছে ইংরেজ শাসন ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। অন্যদিকে বাংলার মুসলমান সমাজ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালনা করে একটানা আন্দোলন সংগ্রাম। আঠারো ও উনিশ শতকের বাংলার কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল বাংলার মুসলমান সমাজ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে বাংলার মুসলমান সমাজ কখনোই মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজের বেলায় পরিস্থিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু জমিদার, মহাজন, বেনিয়া আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী শক্তি। ঐতিহাসিকভাবে এটা বলা যায় বাংলার তথা ভারতীয় মুসলমান সমাজকে যুগপৎ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের সহযোগী হিন্দু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। আর এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম স্থায়ী বিভাজন রেখা।

... মুঘল তথা মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে গুপ্ত হামলা পরিচালনা, হত্যা, খুন এবং গোপন আস্তানায় থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লুন্ঠন পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শিবাজী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি আরও বলেন যে শিবাজীর ইতিহাস চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শিবাজীর তপস্যা সত্য ছিল বলে তাকে ইতিহাসে চাপা দেয়া যায়নি। মুসলিম ও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে শিবাজী একজন লুন্ঠনকারী, হত্যাকারী, আত্মগোপনকারী, সন্ত্রাসী মারাঠা দলনেতা। তার কার্যক্রম সীমিত ছিল বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অঞ্চলে। সতেরো শতকের ভারতীয় ইতিহাসে একটি প্রমাণিত ও সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থান প্রমাণ করে তিনি মুসলিম বিরোধী হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ও আর্য সংস্কৃৃতির ডামাডোলে কতটা নিমজ্জিত ছিলেন। সামাজিক ও শ্রেণীগত অবস্থানে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসনের মহিমায় মুখর। তিনিই পরবর্তীকালে সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লি আগমন উপলক্ষ্যে রচনা করেন 'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা' সঙ্গীত। এটা এখন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের এই ভাগ্যবিধাতা আল্লাহ বা ঈশ্বর নয়, খোদ বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ।

... রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, মুঘলবিরোধী, লুন্ঠনকারী আর সন্ত্রাসী শিবাজী কর্মকান্ড ভারতের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আর এই ঐতিহ্য হলো মুসলিম বিরোধীতা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস পরিচালনা এবং মুসলমানদেরকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার সঙ্কল্প। বাঙালি হিন্দুদের মাঝে বিশেষত: ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধোত্তরকালে নব উত্থিত হিন্দু বেনিয়া, দালাল, মহাজন, জমিদার শ্রেণী বাংলা ও ভারতের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। উনিশ শতকের বিকশিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বড় অংশই ছিল মুসলিম বিদ্বেষী এবং বাংলার মুসলমান সমাজ সম্পর্কে উন্নাসিক মনোভাবাপন্ন। বিশ শতকের হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের প্রধান অংশই হলো এই ধারার বাহক। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, দুই সম্প্রদায়ের মাঝে দাঙ্গা হানাহানি এবং পরিশেষে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবে বর্তায় এই হিন্দু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের উপর।

... বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে বাঙালি শিবাজীকে নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়। শিবাজীর মহৎ নাম বাঙালি আর মারাঠা জাতিকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়। রবীন্দ্রনাথের এই এক সূত্রে গাঁথার মূল সূত্রটি হলো মুসলিম বিরোধীতা। শিবাজী মুসলিম বিদ্বেষী তাই আসন্ন বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে মুসলমানদের উপর সামাজিক প্রভাব বহাল রাখা এবং সামাজিক শোষণ করার পথ বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্ত সমাজ মুসলিম বিরোধীতায় অবতীর্ণ। এখানেই মুসলিম বিরোধীতার হাতিয়ার হিসেবে মুসলিম বিদ্বেষী মারাঠী সন্ত্রাসী শিবাজীকে বাঙালি হিন্দু সমাজ বরণ করে নিয়েছে, আপন করে নিয়েছে। মুসলিম বিরোধী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে শিবাজী বাঙালি হিন্দুদের কাছে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শিবাজীর পথ ধরেই এগিয়ে যাওয়ার পথের সন্ধান পেয়েছিল বাঙালি হিন্দু সমাজ। শিবাজী মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে আর বাঙালি হিন্দু সমাজ প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। এখানেই শিবাজীর সাথে বাঙালি হিন্দুদের আদর্শিক ও স্বার্থগত সম্পর্কের মিল॥"

- ড. নুরুল ইসলাম মনজুর / শতবর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস : বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগ ॥ [ গতিধারা - জুলাই, ২০১০ । পৃ: ৫২-৮৬ ]

No comments:

Post a Comment