Sunday 30 April 2017

শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক



শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক
মো. এমরান জাহান |


আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা কে?

 নিঃসন্দেহে শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। যিনি নিজেই ‘গ্রেট বাঙালি রেস’-এর প্রতিভূ বলে দাবি করতেন। শেরেবাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু। দুই মহান বাঙালি। একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, অন্যজন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমন্বিত করে একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন।

শেরেবাংলাকে আমরা কমই স্মরণ করছি। বাঙালির মধ্যযুগের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমল (১৪৯৩-১৫১৯)। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারের লেখক আবুল ফজলের ন্যায় তেমন কেউ ছিল না। তাই বাঙালির কাছে আজ আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বিস্মৃত। আধুনিক যুগেও এমন কথা বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ন্যায় শেরেবাংলার এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যারা আজ বলবে কীভাবে বরিশালের চাখারের আবুল কাশেম বাঙালির কাছে শেরেবাংলা বা বাংলার বাঘ হয়ে উঠলেন।

হিন্দু মুসলিম বিভক্ত রাজনীতির মধ্যে কীভাবে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রথম সূত্রপাত করেন এ কে ফজলুল হক।
১৮৭৩ সালে ফজলুল হকের জন্ম এক মুসলমান মধ্যবিত্ত জোতদার পরিবারে। বাবা ছিলেন বরিশাল বারের একজন জনপ্রিয় আইনজীবী। টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারের শেখ মুজিব আর বরিশালের চাখারের ফজলুল হকের পরিবার বিত্তে এবং চিন্তাচেতনায় ছিল প্রায় কাছাকাছি। তবে শেরেবাংলা ছিলেন মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এমএ ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি এবং অঙ্কশাস্ত্রে। তার এ শিক্ষা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা পালনে সহায়ক হয়। একই সঙ্গে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে রাজনীতির কলকাঠি চালাতেও সক্ষম হয়। বিয়ে করেছিলেন আরেক আধুনিক বাঙালি নেতা নবাব আব্দুল লতিফের নাতনি ঢাকার এক সৈয়দ পরিবারের কন্যা খুরশীদ তালাতকে।

ফজলুল হকের রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত হয় ছাত্রজীবনেই। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী কলকাতায়। তখন ঢাকা বিস্মৃত এক শহর। প্রথম পর্যায়ে তিনি ১৮৮৯ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। শিক্ষাজীবন এবং আইন ব্যবসার সূত্রপাত হয় ওই সময়কালেই। কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন, কংগ্রেসের রাজনীতি, আলীগড়কেন্দ্রিক মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ রাজনীতির ধারা, নবাব আব্দুল লতিফ এবং স্যার সৈয়দ আমীর আলীর নেতৃত্বে মুসলিম পুনর্জাগরণ কর্মকাণ্ড ইত্যাদি যুবক ফজলুল হককে আলোড়িত করে।

বাবার মৃত্যুর পর ফজলুল হক বিশ শতকের শুরুতে কলকাতা ছেড়ে বরিশালে চলে আসেন। যোগদান করেন বরিশাল বারে। বরিশালে তখন অশ্বিনী কুমার দত্তের নেতৃত্বে চলছে সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ফজলুল হক বরিশাল থাকাকালীন পৈতৃক ক্ষুদ্র জমিদারিও পরিচালনা করেন। কোর্ট-কাচারিতে বিচার বঞ্চিত প্রজাদের আর্তনাত এবং জমিদারদের প্রজাপীড়ন ও মহাজনদের শোষণ-অত্যাচার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। এসব প্রজাপীড়ন তাঁর মানসিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল, যা পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ করি। সেই থেকেই কৃষক প্রজা মুক্তি আন্দোলনে নিজেকে সমর্পণ করেন। গড়ে তোলেন কৃষক প্রজা সংগঠন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘ফজলুল হককে বই পড়ে কৃষক প্রজার দুঃখ দুর্দশার কথা জানতে হয়নি।’

১৯০৫ সালে অবহেলিত ঢাকাকে রাজধানী করে গঠিত হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ। কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে ঢাকা ও পূর্ব বাংলার জনজীবনে। ফজলুল হক সঠিক সিদ্ধান্ত নেন। স্যার সলিমুল্লাহর সঙ্গে বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সেই থেকে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর রাজনীতির সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় যখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত হয়, তখন সাংগঠনিক তত্পরতায় তিনি সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। এখান থেকেই রাজনীতির পাঠ শুরু। ফজলুল হক কিছুদিন সরকারি চাকরিও করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা ফজলুল হকের ইংরেজ সরকারের গোলামি বেশি দিন সহ্য হয়নি। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি ইংরেজ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং কিছুদিন মাদারীপুরের এসডিও ছিলেন।

১৯১১ সালে ঢাকা আর রাজধানী থাকল না। পূর্ব বাংলার মানুষের আশা ভঙ্গ হলো। বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা সরকার ধরে রাখতে পারল না। কলকাতার হিন্দু সমাজপতি ও রাজনীতিবিদদের চাপে সরকার পিছু হটল। ফজলুল হকও ১৯১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন এবং একই সঙ্গে রাজনীতিকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগে যোগদান করে সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ফজলুল হক ঢাকার নবাব ও রাজনীতিবিদ সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে সাক্ষাত্ করেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে। এবার তাদের দাবি পূর্ব বাংলার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ১৯১৫ সালে সলিমুল্লাহ মারা যান।

ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনার ভার পড়ে ধনবাড়ীর নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং এ কে ফজলুল হকের কাঁধে। দুজনই পূর্ব বাংলার স্বার্থ আদায়ের বিষয়ে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। এবারো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল ইংরেজ সরকার নয়, বরং প্রতিবেশী ধনী এলিট উচ্চ হিন্দু নেতারা। নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং ফজলুল হকের কর্মপ্রচেষ্টার সফলতা আসে ১৯২১ সালে। কাঙ্ক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আত্মবিকাশ ঘটে। এই জাগ্রত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটিই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউ তোলে।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এ কে ফজলুল হক তিন প্রজন্মের সঙ্গে রাজনীতি করেন। তিন প্রজন্মের রাজনৈতিক সহযাত্রী নবাব সলিমুল্লাহ, মওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান। ফজলুল হকসহ শেষের দুজন ছিলেন খাটি বাঙালি, মাটির মানুষ, নদী ও হাওড়-বাঁওড়ের মানুষ এবং লুঙ্গিপরা রাজনীতিবিদ। একই সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কিন্তু আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। শেখ মুজিবুরের রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠার পেছনে এ দুজন নেতার প্রভাব অধিক। রাজনীতির মঞ্চে শেখ মুজিব ছিলেন ফজলুল হকের নাতি, আর ভাসানীর পুত্রসমতুল্য।

যে কৃষক প্রজাকুলের মুক্তির পণ নিয়ে বাংলার উদীয়মান নেতা এ কে ফজলুল হক রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হলেন, তাকে কংগ্রেস কিংবা নবাব জমিদারদের সংগঠন মুসলিম লীগ আকৃষ্ট করতে পারল না। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তৃতীয় ধারার সংগঠন নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি। শক্তিশালী ও জনপ্রিয় দুটি রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে এককভাবে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করা সহজ কর্ম ছিল না। বর্তমান দু’ধারার রাজনৈতিক বলয় থেকে আন্দাজ করা যায়। কিন্তু ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং সততার বলে বাংলার রাজনীতিতে একক হয়ে ওঠেন।

 ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে ১৯৩৭ সালে ইংরেজ সরকার প্রাদেশিক নির্বাচনের আয়োজন করে। এবার রাজনৈতিক নির্বাচনী প্রতিষ্ঠার খেলা। ফজলুল হক তাঁর নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতিকে ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’তে রূপান্তর করেন। কংগ্রেস হিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করে, আর মুসলিম লীগ মুসলমানের। আবার উভয় সংগঠনই সর্বভারতীয়। বাংলা বাঙালির মনের কথা কেউ বলে না। ফজলুল হক এই মানসিক জায়গাটা ধরতে পারলেন। কৃষক প্রজা সমিতি ছিল অসাম্প্রদায়িক। আবার এ প্রতিষ্ঠান বাংলার উদীয়মান মুসলিম মধ্যবিত্তের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনও হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত অবাঙালি এবং নবাব-জমিদারদের রাজনৈতিক আশ্রয়স্থল ছিল। মুসলিম লীগ বাংলার মুসলিম জনতার কাছে জনপ্রিয় এবং সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে চল্লিশের দশকে, যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাসিমরা এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

যাহোক, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা সমিতি নিপীড়ত কৃষক প্রজার দল হয়ে ওঠে। তিনি কৃষক প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে ১৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেন। ইশতেহারে দেখা যায়, বাংলাদেশের পূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্ত শাসন আদায়ই ছিল এর মূল লক্ষ্য। ফজলুল হক হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা। নির্বাচনে রাজনৈতিক স্লোগান ওঠে, ‘লাঙ্গল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার’। বাংলাদেশে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষই কৃষক। আর অধিকাংশই বাঙালি মুসলমান। তবু হক সাহেব ঘোষণা করেন, ‘কৃষক আন্দোলন শুধু কৃষকদেরই আন্দোলন, কৃষকেরা কোন ধর্মাবলম্বী আমাদের জানবার বিষয় নয়।’ নির্বাচনে কৃষক প্রজা সমিতি বিজয়ী হয়। নির্বাচনে বরিশাল এবং পটুয়াখালী আসনে একটি আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটে।

এ কে ফজলুল হক বরিশালের নিজের আসন
ছাড়াও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পটুয়াখালীর একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ আসনের মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন প্রভাবশালী নেতা এবং ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য স্যার খাজা নাজিমউদ্দীন। এটি ছিল খাজার জমিদারি এলাকা এবং এই আসন থেকে তিনি আগেও দুবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফজলুল হক তার ভাষণে চমত্কার গল্প করতে পারতেন। মানুষের মনের ভাষা বুঝতেন। পটুয়াখালী জনসভায় তিনি হাজির হলেন ধুতি শার্ট আর মাথায় রুমি টুপি পরে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথমেই বললেন, ‘ভাইয়েরা, মাত্র চারটি যুদ্ধের কথা আমি আপনাদের সামনে আজ বলব, প্রথম যুদ্ধ হয়েছে রয় রয়, দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছে ক-য় ক-য়, তৃতীয় যুদ্ধ হয়েছে গ-য় গ-য়, আর এবার যুদ্ধ হবে, হ-য় ন-য়।’ তার পর উত্সুক জনতা এই কথার মানে জানতে চাইল। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, প্রথম যুদ্ধ রাম রাবণে, দ্বিতীয় যুদ্ধ কংস কৃষ্ণের, তৃতীয় যুদ্ধ গান্ধী আর গভর্নমেন্টে, আর এবার হবে হক নাজিমউদ্দীনে। জনতা হু হু করে হেসে উঠলেন।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে খাজার পটুয়াখালীর কৃষক প্রজারা তাদের হক সাহেবকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। সকলের হক সাহেব বরিশালে নিজের আসন থেকেও বিজয়ী হন। তিনিই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। হক সাহেব ১৯৩৭ সালে প্রথম সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার পরিচালনা করেন। ফজলুল হক সরকারের আমলেই বাংলাদেশে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। কারণ কিছু প্রতিক্রিয়াশীল মধ্যবিত্ত হিন্দু এবং জমিদার মহাজনের প্রভাবে বাঙালি মুসলমানের দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৩৮ সালে ঋণ সালিশি বোর্ড, ১৯৩৯ সালে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪০ সালে মহাজনি আইনের কারণে বাঙালি কৃষক প্রজা কখনো তাদের প্রিয় হক সাহেবকে ভুলতে পারেনি। বিশ-চল্লিশের দশকের বাংলার হিন্দু মুসলমান সমাজ ও রাজনীতির ব্যবধান রেখার বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করতে পারলে ফজলুল হকের সে সময়ের ভূমিকা মূল্যায়নে সহজ হবে।

১৯৪০-এর দিকে কৃষক প্রজার নেতা ফজলুল হক হয়ে ওঠেন শেরেবাংলা, বাংলার বাঘ। রাজনীতির বাস্তবতা তাকে ঠেলে দেয় মুসলিম লীগের দিকে। যোগদান করেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ২৭তম বার্ষিক অধিবেশনে। মঞ্চে হাজার হাজার জনতা ধ্বনি দিয়ে ওঠেন— শের-ই-বাঙ্গাল, জিন্দাবাদ। মঞ্চে বক্তৃতারত লীগের সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর বক্তৃতা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন কিছু সময়ের জন্য। ফজলুল হক আসন গ্রহণ করেন। মঞ্চে থেকে জিন্নাহ সাহেব বলেন, ‘বাঘকে খাঁচায় পোরা হয়েছে, এবার শান্ত হোন।’ লাহোরের অধিবেশনে হক সাহেব ভারতের ভবিষ্যত্ শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা কী হবে, তা মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করেন। সেদিন ছিল ২৩ মার্চ। তিনি ঘোষণা করেন, ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল (আজকের বাংলাদেশ) নিয়ে গঠিত হবে আলাদা স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। তার এই ভাষণে বাংলার বাস্তবতা চিন্তা করে ভবিষ্যত্ একটি রূপরেখাও প্রদান করেন।

তিনি বলেন, এ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বা অঞ্চল অবশ্যই সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম হবে। অর্থাত্ এই ঘোষণার মধ্যেই ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ ভবিষ্যত্ রূপরেখা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ প্রস্তাব অধিবেশনে গৃহীত হলেও লীগের সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলার নেতা শেরেবাংলার প্রভাব এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল নিয়ে আলাদা স্বাধীন দেশ গঠনের পরিকল্পনায় প্রমাদ গুনলেন। ছয় বছর পর দিল্লিতে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সদস্যদের অধিবেশন বসে। সেখানে জিন্নাহর চতুরতায় পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে যে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রর কথা বলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে একটি মাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার আগেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা হক সাহেবের সঙ্গে জিন্নাহর চরম মতবিরোধ শুরু হয়ে যায় এবং ফজলুল হককে লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। জিন্নাহপন্থী গোষ্ঠীটি জানতেন যে, শেরেবাংলাকে লীগ থেকে বহিষ্কার না করলে লাহোর প্রস্তাবের ওই অংশটি বাতিল করা যাবে না।

 ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হয়। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব আর বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘ ২৩ বছর বাঙালি লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রাম করেছে। দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের যুক্তফ্রন্ট জোট যে ২১ দফা দাবিসংবলিত ইশতেহার ঘোষণা করেন, সেখানে ১৯ নং দফায় বলা হয়, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হইবে।’ একযুগ পর ১৯৬৬ সালে বাঙালির আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেন। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার প্রথম দফাই ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। শেরেবাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু। লাহোর প্রস্তাব থেকে ছয় দফা। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ। এটাই বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস।

চল্লিশের দশকের শেষে পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলনকে মুক্তি আন্দোলন হিসেবে মনে করে। গোটা বাংলার মুসলমান পাকিস্তান দাবির আবেগে প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত। হক সাহেব মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত এবং বিচ্ছিন্ন। সফল হন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তানের ‘কায়েদে আযম’ হয়ে ওঠেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁর বাঙালি অনুসারীরা প্রচার করতে থাকেন, ফজলুল হক পাকিস্তান চান না। তার মানে দাঁড়ায় ভয়ঙ্কর। তিনি কংগ্রেস বা হিন্দুদের পক্ষে। বহুল প্রচারিত আজাদ পত্রিকা হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনবরত প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কৃষক প্রজার বন্ধু হক সাহেবের বিরুদ্ধে প্রচার খুব একটা গ্রহণ করেনি মানুষ। তারা পকিস্তান চাচ্ছে, কিন্তু হক সাহেবকে ভুলে যায়নি। ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ১৯৪৫-৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মাঠে-হাটে দাপটে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন, আর হক সাহেবের সমালোচনা করে যাচ্ছেন।

কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম কি হয়েছিল, সে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি চমত্কার উদারতার সঙ্গে স্মৃতিচারণ করে গেলেন। শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে।’ একদিন আমার মা’ও আমাকে বলছিলেন, ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলিও না। শেরেবাংলা মিছামিছিই শেরেবাংলা হন নাই।’ বাংলার মাটিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে— একটা সভা করছিলাম আমার ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? ..., হঠাত্ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার ভক্ত, ...দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাইব না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরীবের বন্ধু হক সাহেব।’ শুধু তা-ই না, এক বঙ্গবন্ধু আর এক শেরেবাংলার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলেন, পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তারা যেখানেই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গেছি, সেখানেই জনসাধারণ তাদের মার দিয়েছে। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ.২২)

পাকিস্তান হাসিল হলো। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠল পাকিস্তানিরা বাঙালিকে স্বায়ত্তশাসন দেবে না। শুরু হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। হক সাহেব প্রতিবাদ করলেন। ঢাকা হাইকোর্টে পুলিশ ঢুকে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলার ওপর লাঠিচার্জ করা হলো। পুলিশের লাঠির আঘাতে তিনি পায়ে ভীষণ আঘাত পান। এ পায়ের ব্যথা তাকে বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এদিকে মুসলিম লীগের বিদ্বেষমূলক শাসনে একসময়ের পাকিস্তান আন্দোলনকারীরা শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী অবস্থান নিল। ১৯৫৪ সালে ঘোষিত হলো প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচন। এবার এগিয়ে এলেন শেরেবাংলা। এরই মধ্যে মুসলিম লীগ ভেঙে সৃষ্টি হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। এবার একত্রিত হলেন শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী আর জননেতা ভাসানী।

গড়ে তোলেন মুসলিম লীগবিরোধী নির্বাচনী ঐক্যজোট। নাম দেয়া হলো যুক্তফ্রন্ট। চারটি দলের মিলিত যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলেও তা ‘হক সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী জোট’ বলেই পরিচিতি লাভ করে। আবারো ক্ষমতাসীন লীগের বিরুদ্ধে হক সাহেবের জয়। এবার ঢাকার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন শেরেবাংলা। বাংলা ভাষার আন্দোলনের কষ্ট তিনি ভুলতে পারেননি। এ কথা হয়তো অনেকের ভুলে গেছেন যে, দায়িত্ব নেয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক প্রাদেশিক আইনসভায় প্রথম অধিবেশনেই বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন। নিয়ম অনুযায়ী আইনসভায় ইংরেজি কিংবা উর্দু ভাষায় বক্তৃতা করতে হতো।
যুক্তফ্রন্ট সরকার অল্প দিন ক্ষমতায় ছিল। হক সাহেব ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, সমবায় ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হন। হক সাহেব তখন বৃদ্ধ, বয়স ৮১, আর শেখ মুজিব কনিষ্ঠ, বয়স ৩৪।

হক সাহেব শেখ মুজিবকে স্নেহ করতেন। বলতেন, ‘আমি বুড়া, তুই গুঁড়া। তাই আমি নানা, তুই নাতি’। যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে শাসকগোষ্ঠী এবং অবাঙালি আমলারা গ্রহণ করতে পারেনি। এরা এ বিজয়কে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান বলে আতঙ্কবোধ করে। যেদিন সরকার শপথ নেয়, ওইদিনই আদমজী জুট মিলে বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়া হয়। শেরেবাংলাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দোষারোপ করে। ষাটের দশকের শেষার্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে, তখন শেখ মুজিবকেও বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আঘাত করেছিল। একই সালের ৩১ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারা জারি করে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দেন। সে আরেক ষড়যন্ত্র, আরেক প্রহসন। যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে শাসকগোষ্ঠী ভালোভাবে নিতে পারেনি। যুক্তফ্রন্ট সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। এই সর্বপ্রথম ১ বৈশাখ দিনটিকেও ঘোষণা করেন ছুটির দিন হিসেবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি সংস্কৃতির লালন ও প্রতিষ্ঠা তা তো রাষ্ট্রবিরোধী বটেই।

শেরেবাংলা সর্বশেষ গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পালনকালে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সংবিধান প্রণীত হয়। কিন্তু সাংবিধানিক সুখ পাকিস্তানের কপালে বেশি দিন সইল না। সামরিক বেসামরিক আমলানির্ভর রাষ্ট্র গণতন্ত্র ও সংবিধান মানে না। দুই বছর পরই সারা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হয়। ১৯৬১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ছাত্র-শিক্ষক এ মহান নেতাকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জানান। সেটাই ছিল হক সাহেবের সর্বশেষ কোনো সভায় যোগদান। ১৯৬২ সালের মার্চে বাংলার বাঘ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক মাস ঢাকা মেডিকেলে চিকিত্সাধীন থেকে ২৭ এপ্রিল শেরেবাংলা আবুল হক কাশেম ফজলুল হক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘ রাজনীতির জীবনে শেরেবাংলা বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করে যান, তা বাস্তবে রূপ দেন তার ‘গুঁড়া নাতি’ বঙ্গবন্ধু।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/106/শেরেবাংলা-আবুল-কাশেম-ফজলুল-হক--/

No comments:

Post a Comment