Saturday 22 April 2017

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কবিও বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে প্রার্থনা সঙ্গিত রচনা করেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণ হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে সভা ডাকা হয়, সে সভার সভাপতিত্ব করেন।
------------------------------------------------------------------------
দুই বাংলার পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন। পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন, যার রাজধানী ছিল ঢাকায়। লর্ড কার্জনের এ ঘোষণা হিন্দুদের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল এবং মুসলমানরা আনন্দ-উল্লাস করল। কারণ দুটি জাতি পাশাপাশি বসবাস করলেও তাদের স্বার্থ ছিল ভিন্ন। হিন্দু জমিদাররা দেখলেন বাংলা ভাগ হয়ে গেলে কলকাতায় বসে পূর্ব বাংলায় জমিদারী চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আর ঢাকা রাজধানী হওয়ার কারণে শিক্ষায় এবং চাকুরির ক্ষেত্রে মুসলমানরা এগিয়ে যাবে। আবার পূর্ব বাংলার হিন্দুরা মনে করল, বঙ্গ ভঙ্গের কারণে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। ফলে হিন্দুরা ঘোষণা করল কোনভাবেই বঙ্গ মাতার অঙ্গ ছেদন করা যাবে না। অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হবে। যার ফলে হিন্দুরা স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ আরম্ভ করল। একই সাথে তারা যে সমস্থ মুসলমানরা স্বদেশী আন্দোলনে আসতে চাইল না, তাদেরকে নাজেহাল করতে লাগল। এমনকি মুসলমানদের প্রাণহানি ঘটতে লাগল। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম বোমা হামলার মাধ্যমে ২জন শেতাঙ্গ মহিলাকে হত্যা করে। ফলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। (উৎস “একশ বছরের রাজনীতি”, আবুল আসাদ)

এই ক্ষুদিরাম আত্মত্যাগ করেছিলেন তার জাতি হিন্দুদের জন্য, মুসলমানদের জন্য নয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কবিও বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে প্রার্থনা সঙ্গিত রচনা করেন –

বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
--------------------------
বাংগালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান।

তার রচিত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” গান হিন্দু সন্ত্রাসিদের উৎসাহিত করে এবং বধ করতে মুসলমানদের প্রাণ। আবার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের বিপক্ষে চলে গেল, তখন খাঁটি ইংরেজ সমর্থক রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে নিরপেক্ষ হয়ে যান।

পাঠকরা একটু লক্ষ্য করবেন হিন্দুরা যে ইংরেজদের সহযোগীতা করেছিল, প্রশাসনিক কারণে সৃষ্ট বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের পক্ষে যাওয়ার কারণে সেই হিন্দুরা ইংরেজদের বিপক্ষে চলে যায়।

বঙ্গভঙ্গের কারণে বৃটিশদের মুসলমান প্রজারা অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণে তাদেরকে সাময়িক সান্তনা দেয়ার জন্য ১৯১২ সালের ৩১শে জানুয়ারি লর্ড হার্ডিণ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন।

কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী যে, বর্ণ হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের যেভাবে বিরোধিতা করেছিল, ঠিক সেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বিরোধীতা করেন। কারণ বর্ণ হিন্দুরা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিটা মুসলমানরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্তির মাধ্যমে কিছুটা পূরণ করতে পারবে। (“জীবনের স্মৃতি দ্বীপে” ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার)

কলকাতার জমিদার শ্রেণীর, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবি হিন্দুরা পূর্ব বাংলার মুসলমানকে কৃষিজীবির ঊর্ধ্বে চিন্তা করতে নারাজ। একারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই সাথে জমিদার শ্রেণীর (কারণ তিনি জমিদার শ্রেণীর লোক ছিলেন) এবং বর্ণ হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে সভা ডাকা হয়, সে সভার সভাপতিত্ব করেন। (“দি অটোবায়োগ্রাফী অব আননোন ইন্ডিয়ান”, নীরোদ চন্দ্র চৌধূরী, “একশ বছরের রাজনীতি”, আবুল আসাদ)

১৯১২ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি বড় লাটের সাথে দেখা করে বর্ধমানের স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষকরা উপকৃত হতে পারবে না বলে মত প্রকাশ করেন। (Report of the Calcutta University Commission Vol-iv, pt-ii-p-133, উৎসঃ আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়”, বাংলাপিডিয়া)

হিন্দুদের এতসব বিরোধীতা সত্ত্বেও লর্ড হার্ডিণ্জ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য স্যার আশুতোষ মুখার্জীকে বলে দেন, আপনাদের বিরোধীতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। (“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” বাংলাপিডিয়া)

এ ব্যাপারে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তার “জীবনের স্মৃতি দ্বীপে” একটি মজার ঘটনা বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক এর অধ্যাপক শ্রী দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকর এর বক্তব্য, যা হল, “কলিযুগে বৃদ্ধগঙ্গা নদীর তীরে হরতগ নামক একজন অসুর জন্ম গ্রহণ করবে। মূল গঙ্গার তীরে একটি পবিত্র আশ্রম আছে। সেখানে অনেক মুনি-ঋষি এবং তাদের শিষ্য বাস করেন। এই অসুর সেই আশ্রমটি নষ্ট করার জন্যে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে একে একে অনেক শিষ্যকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যাবে। যারা অর্থের লোভে পূর্বের আশ্রম ত্যাগ করে এই অসুরের আকর্ষণে বৃদ্ধগঙ্গার তীরে যাবে, তারাও ক্রমে অসুরত্ব প্রাপ্ত হবে এবং তারা অশেষ দুর্দশাগ্রস্ত হবে।” এখানে বৃদ্ধগঙ্গা বলতে বুড়িগঙ্গা, হরতগ বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর মিঃ ফিলিপ হরতগ এবং মূল গঙ্গার তীরে পবিত্র আশ্রম বলতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝানো হয়েছে।

এখন মূল বক্তব্যটি যদি আপনি আবার পড়েন, তবে বুঝতে পারবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অসুর তৈরি হয় এবং বর্ণ হিন্দুরা মনে করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আজ বড়ই পরিতাপের বিষয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র চর্চা হয়, চর্চা হয় হিন্দু সংস্কৃতির, জ্বালানো হয় মঙ্গল প্রদীপ, অনুষ্ঠান হয় রাখী বন্ধনের, স্মরণ করা হয় তাদের যারা এর প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, কিন্তু স্মরণ করা হয় না, নবাব সলিমুল্লাহকে, নওয়াব আলী, ওয়াজেদ আলী খান পন্নীকে।

--------------------------------------------------
"আমাদের স্বাধীনতাঃ পর্দার এপার ওপার" বিশেষ ভাবে পড়তে বলেছিলাম যেটি সম্পর্কে বলেছিলাম ব্রিটিশ আমল থেকে ৭১ পর্যন্ত অনেক অজানা ইতিহাস এখানে পাবেন (যারা মিস করেছেন তারা এখান থেকে ডাউনলোড করুন https://ia601502.us.archive.org/15/items/AmaderShadhinota/Amader%20Shadhinota.pdf

No comments:

Post a Comment