উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।
সূফি বরষণ
পর্ব দুই:
শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধের ২২ পৃষ্ঠায় আহমদ ছফা বলেন, … উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র সত্যকে প্রকাশ করেন নি। দেবী চৌধুরানী আর আনন্দমঠে সেটা স্পষ্ট হয়। ইংরেজদের সাথে বিদ্রোহে মুসলমানদের অবদান পুরা অস্বীকার করলেন বঙ্কিম … সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভাবটি ছিল চমৎকার।কোনো কোনো সময়ে সন্ন্যাসী এবং ফকিরেরা মিলিতভাবে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তার ভুরি ভুরি লিখিত প্রমাণ রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেটি করলেন, ফকিরদের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে ছেটে বাদ দিয়ে সন্ন্যাসীদের লড়াইকে তাঁর রচনার বিষয়বস্তু করলেন। সত্যানন্দকে বীরের গৌরব দিলেন, কিন্তু মজনু শাহ্র নামটি উল্লেখ করার উদারতা পর্যন্ত দেখাতে পারলেন না। বঙ্কিম তো আসল ঘটনা জানতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের অপরাধ- তিনি বাস্তবতাকে খুন করেছেন।
একই প্রবন্ধের ২৩_২৪ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন, …" হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত লড়াইকে একক হিন্দুর লড়াই দেখাতে গিয়ে ইতিহাসের এমন একটা বিকলাঙ্গ অগ্রগতির খাত খনন করেছেন, যা বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসকে একটা কানা গলির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাব এতো সুদূরপ্রসারী হয়েছে, ভারতের জাতীয় ইতিহাস অদ্যাবধি স্বাভাবিক পথটির সন্ধান করে নিতে পারেনি। … হিন্দু-মুসলমানদের মিলনভূমি ভারতকে একটা সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসকে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন … হিন্দু সমাজের উত্থানের উন্মেষ পর্বে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মধ্যে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন এতোটা গাঢ়মূল হয়েছিলো যে, তার অভিঘাত মুসলমান সম্প্রদায়কে আরেকটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ঠেলে দিয়েছিল"।
বাংলা সাহিত্যে এসব হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা ও চরম বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন মুসলমানরা। বঙ্কিমচন্দ্র তার শেখা প্রায় সবকটি গালি ‘রাজসিংহ ’ উপন্যাসে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে। ‘ম্লেচ্ছ’ হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদের দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাকেও সে উহ্য রাখেনি। শুধু তাই নয়, তারা ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে ছাড়াও মুসলমানদের পাষ-, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর এ জাতীয় কোনো গালি দিতে বাদ দেয়নি।
এখানে বাংলা সাহিত্যের গবেষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বিগত ষাটের দশকে বাঙালীসত্তার দ্বিবিধ শৌর্যবর্তনী ‘হিন্দু-মুসলমান’-এর অন্তঃজ্যোতিরুদ্ভাসনার দায়িত্বে সুদৃঢ় হন। আধুনিক কাব্যায়তনিক পরিসরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের রূপশ্রী অন্বেষণে ব্রতী হন। তাঁর ধ্যানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক (১৮৫৭ খ্রি. -১৯২০ খ্রি.)’[ প্রথম প্রকাশ ; ঢাকা : বাংলা একাডেমী,
১৯৭০ খ্রি.]।
গ্রন্থের ‘অবতরণিকা’য় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ঋজু কথকতার সঞ্চারণা। ১৮৫৭ খ্রি. থেকে ১৯২০ খ্রি. পর্যন্ত আধুনিক বাংলা কাব্যে বর্ণিত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক সম্পর্কের আনুপূর্বিক চিত্রদীপ্তি ধারণ ক’রে আছে গ্রন্থটি। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান যথাযথই উল্লেখ ক’রেছেন : সমাজজীবনে এ-সম্পর্কে যেমন দ্বিধায় ও দ্বন্দ্বে, সৌহার্দ্যে ও সন্দেহে চিহ্নিত, সাহিত্যেও তেমনি তা ঘৃণায়, বিদ্বেষে, প্রীতিতে ও প্রত্যাখ্যানে সমন্বিত। (‘অবতরণিকা’, পৃ. ৩)। রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৫, পঞ্চম পরিচ্ছেদ : উদিপুরী বেগম। এখানে বঙ্কিম লেখেন, "ঔরঙ্গজেব জগৎপ্রথিত বাদশাহ। তিনি জগৎপ্রথিত সাম্রাজ্যের অধিকারী হইয়াছিলেন। নিজেও বুদ্ধিমান, কর্মপদক্ষ, পরিশ্রমী এবং অন্যান্য রাজগুণে গুণবান ছিলেন। এই সকল অসাধারণ গুণ থাকিতেও সেই জগৎপ্রথিতনামা রাজাধিরাজ, আপনার জগৎপ্রথিত সাম্রাজ্য একপ্রকার ধ্বংস করিয়া মানবলীলা সংবরণ করিলেন।
ইহার একমাত্র কারণ, ঔরঙ্গজেব মহাপাপিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় ধূর্ত্, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর, পরপীড়ক, প্রজাপীড়ক দুই একজন মাত্র পাওয়া যায়। এই কপটাচারী সম্রাট জিতেন্দ্রিয়তার ভাণ করিতেন–কিন্তু অন্ত:পুর অসংখ্য সুন্দরীরাজিতে মধুমক্ষিকা পরিপূর্ণ মধুচক্রের ন্যায় দিবারাত্র আনন্দধ্বনিতে ধ্বনিত হইত।
তাঁহার মহিষীও অসংখ্য–আর সবার বিধানের সঙ্গে সম্বন্ধশূন্যা বেতনভাগিনী বিলাসিনীও অসংখ্য। এই পাপিষ্ঠাদিগের সঙ্গে এই গ্রন্থের সম্বন্ধ বড় অল্প। কিন্তু কোন কোন মহিষীর সঙ্গে এই উপাখ্যানের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে।
মোগল বাদশাহেরা যাঁহাকে প্রথম বিবাহ করিতেন, তিনিই প্রধানা মহিষী হইতেন। হিন্দুদ্বেষী ঔরঙ্গজেবের দুর্ভাগ্যক্রমে একজন হিন্দুকন্যা তাঁহার প্রধানা মহিষী। আকব্বর বাদশাহ রাজপুত রাজগণের কন্যা বিবাহ করা প্রথা প্রবর্তিিত করিয়াছিলেন। সেই নিয়ম অনুসারে, সকল বাদশাহেরই হিন্দুমহিষী ছিল। ঔরঙ্গজেবের প্রধানা মহিষী যোধপুরী বেগম।"
( উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম বলেন যে, ঔরঙ্গজেব মহাপাপিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় ধূর্ত্, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর, পরপীড়ক, প্রজাপীড়ক দুই একজন মাত্র পাওয়া যায়। এই কপটাচারী সম্রাট জিতেন্দ্রিয়তার ভাণ করিতেন–কিন্তু অন্ত:পুর অসংখ্য সুন্দরীরাজিতে মধুমক্ষিকা পরিপূর্ণ মধুচক্রের ন্যায় দিবারাত্র আনন্দধ্বনিতে ধ্বনিত হইত। এইকথার মাধ্যমে পরিস্কার বুঝা যায় বঙ্কিম কতটা উগ্র সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষি লেখক ছিলেন । আর পাশাপাশি করেছেন ইতিহাসের মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি এবং ভারতের মুসলিম শাসনকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করেছেন) ।
রাজসিংহ উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম ইচ্ছাকৃত ভাবে ইতিহাস বিকৃতির মুসলিম শাহজাদীর চরিত্রকে কঙ্কিত করেছেন । বঙ্কিম লিখেন,
"মবারক বুঝিলেন যে, একটা ঘটিলে দুইটাই ঘটিবে। তিনি যদি পাপিষ্ঠা বলিয়া জেব-উন্নিসাকে পরিত্যাগ করেন, তবে তাঁহাকে নিশ্চিত নিহত হইতে হইবে। কিন্তু সেজন্য মবারক দু:খিত নহেন। তাঁহার দু:খ এই যে, তিনি বাদশাহজাদীর রূপে মুগ্ধ, তাহাকে পরিত্যাগ করিবার কিছুমাত্র সাধ্য নাই; এই পাপপঙ্ক হইতে উদ্ধৃত হইবার তাঁহার শক্তি নাই।
অতএব মবারক বিনীত ভাবে বলিল, “আপনি ইচ্ছাক্রমে যতটুকু দয়া করিবেন, তাহাতেই আমার জীবন পবিত্র। আমি যে আরও দুরাকাঙ্ক্ষা রাখি,-তাহা দরিদ্রের ধর্ম বলিয়া জানিবেন। কোন্ দরিদ্র না দুনিয়ার বাদশাহী কামনা করে?”
তখন প্রসন্ন হইয়া শাহজাদী মবারককে আসব পুরস্কার করিলেন। মধুর প্রণয়সম্ভাষণের পর তাহাকে আতর ও পান দিয়া বিদায় করিলেন।
মবারক রঙময়হাল হইতে নির্গত হইবার পূর্বে ই, দরিয়া বিবি আসিয়া তাহাকে ধৃত করিল। অন্যের অশ্রাব্য স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন, রাজপুত্রীর সঙ্গে বিবাহ স্থির হইল?”
মবারক বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কে?”
দ। সেই দরিয়া!
ম। দুশমন! সয়তান! তুই এখানে কেন?
দ। জান না, আমি সংবাদ বেচি?
মবারক শিহরিল। দরিয়া বিবি বলিল, “রাজপুত্রীর সঙ্গে বিবাহ কি হইবে?”.........
দ। কি করিয়াছ? তুমি আমার কি না করিয়াছ? তুমি যাহা করিয়াছ, তার অপেক্ষা স্ত্রীলোকের অনিষ্ট কি আছে? ম। কেন পিয়ারি! আমার মত কত আছে। দ। এমন পাপিষ্ঠ আর নাই। ম। আমি পাপিষ্ঠ নই। কিন্তু এখানে দাঁড়াইয়া এত কথা চলিতে পারে না। স্থানান্তরে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও। আমি সব বুঝাইয়া দিব।
রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৩, তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ঐশ্বর্য-নরক। এখানে বঙ্কিম মিথ্যা চরিত্র সৃষ্টি করে মুসলমানদের পাপিষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ।
উপন্যাসের এই অংশে , রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, চতুর্থ পরিচ্ছেদ : সংবাদবিক্রয়। বঙ্কিম মুসলমানদের গালাগালির মাধ্যমে জাহান্নামে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন । বঙ্কিম লিখেন, “তোমাকেও চিনি, তোমার পরওয়ানাও চিনি। তা এত রাত্রিতে কি আর হজরৎ বেগম সাহেবা সুরমা কিনিবে? তুমি কাল সকালে এসো। এখন খসম থাকে, খসমের কাছে যাও–আর না থাকে যদি—” দ। তুই জাহান্নামে যা। তোর ঢাল-তরবার জাহান্নামে যাক–তোর ওড়নাা পায়জামা জাহান্নামে যাক–তুই কি মনে করিস, আমি রাত দুপুরের কাজ না থাকিলে, রাত দুপুরে এয়েছি?.... তখন দরিয়া, ওড়নাআর ভিতর হইতে এক শিশির সরাব বাহির করিল। প্রহরিণী হাঁ করিল–দরিয়া শিশি ভোর তার মুখে ঢালিয়া দিল–তাতারী শুষ্ক নদীর মত, এক নিশ্বাসে তাহা শুষিয়া লইল। বলিল, “বিস্ মেল্লা! তৌফা সরবৎ! আচ্ছা, তুমি খাড়া থাক, আমি এত্তেলা করিতেছি।” ( এখানে বঙ্কিম বিসমিল্লাহ শব্দের বিকৃত বানানে লেখার পাশাপাশি মুসলমানদের মাদকসেবী প্রতারক হিসেবে উপস্থাপন করেন)।
রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৫, পঞ্চম পরিচ্ছেদ : উদিপুরী বেগম। এখানে বঙ্কিম লেখেন, "এই শ্রেণীর একজন উড়িয়াকে আমি একদা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “তোমরা এমন দুষ্কর্ম্ম কেন কর?” সে ঝটিতি উত্তর করিল, “আজ্ঞে, ঘরের বৌ কি পরকে দিব?” ভারতেশ্বর ঔরঙ্গজেবও বোধ হয় সেইরূপ বিচার করিলেন। তিনি কোরাণের বচন উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, ইসলাঙম ধর্মাইনুসারে তিনি অগ্রজপত্নী বিবাহ করিতে বাধ্য। অতএব দারার দুইটি প্রধানা মহিষীকে স্বীয় অর্ধাইঙ্গের ভাগিনী হইতে আহূত করিলেন। একটি রাজপুতকন্যা; আর একজন এই উদিপুরী মহাশয়া। রাজপুতকন্যা এই আজ্ঞা পাইয়া যাহা করিল, হিন্দুকন্যা মাত্রেই সেই অবস্থায় তাহা করিবে, কিন্তু আর কোন জাতীয়া কন্যা তাহা পারিবে না;-সে বিষ খাইয়া মরিল। খ্রিষ্টিয়ানীটা সানন্দে ঔরঙ্গজেবের কণ্ঠলগ্না হইল। ইতিহাস এই গণিকার নাম কীর্তিুত করিয়া জন্ম সার্থক করিয়াছেন, আর যে ধর্মইরক্ষার জন্য বিষ পান করিল, তাহার নাম লিখিতে ঘৃণা বোধ করিয়াছেন। ইতিহাসের মূল্য এই।
উদিপুরীর যেমন অতুল্য রূপ, তেমনি অতুল্য মদ্যাসক্তি। দিল্লীর বাদশাহেরা মুসলমান হইয়াও অত্যন্ত মদ্যাসক্ত ছিলেন। তাঁহাদিগের পৌরবর্গ এ বিষয়ে তাঁহাদের দৃষ্টান্তনুগামী হইতেন। রঙমনহালেও এ রঙ্গের ছড়াছড়ি! এই নরকমধ্যেও উদিপুরী নাম জাহির করিয়া তুলিয়াছিল।
জেব-উন্নিসা হঠাৎ উদিপুরীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিতে পারিল না। কেন না, ভারতেশ্বরের প্রিয়তমা মদ্যপানে প্রায় বিলুপ্তচেতনা; বসনভূষণ কিছু বিপর্য্যস্ত, বাঁদীরা সজ্জা পুনর্বিন্যস্ত করিল; ডাকিয়া সচেতন ও সাবধান করিয়া দিল। জেব-উন্নিসা আসিয়া দেখিল, উদিপুরীর বাম হাতে সটকায়, নয়ন অর্ধিনিমীলিত, অধরবান্ধুলীর উপর মাছি উড়িতেছে; ঝটিকা বিভিন্ন ভূপতিত বৃষ্টিনিষিক্ত পুষ্পরাশির মত উদিপুরী বিছানায় পড়িয়া আছে।"
( উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম মুসলিম বাদশাহদের ও কন্যাদের মাদকসেবী এবং বাদশাহদের স্ত্রীদের পতিতা বেশ্যা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন ।)
রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৬, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : যোধপুরী বেগম। বঙ্কিম লিখেন, তাহারা জানিত যে, এ সম্বন্ধে মোগলদ্বেষিণী চঞ্চলকুমারীর সুখ নাই। সংবাদটা অবশ্য দিল্লীতেও প্রচার হইল। বাদশাহী রঙমাহালে প্রচারিত হইল। যোধপুরী বেগম শুনিয়া বড় নিরানন্দ হইলেন। তিনি হিন্দুর মেয়ে, মুসলমানের ঘরে পড়িয়া ভারতেশ্বরী হইয়াও তাঁহার সুখ ছিল না। তিনি ঔরঙ্গজেবের পুরীমধ্যেও আপনার হিন্দুয়ানী রাখিতেন। হিন্দু পরিচারিকা দ্বারা তিনি সেবিতা হইতেন; হিন্দুর পাক ভিন্ন ভোজন করিতেন না–এমন কি, ঔরঙ্গজেবের পুরীমধ্যে হিন্দু দেবতার মূর্তিজ স্থাপন করিয়া পূজা করিতেন। বিখ্যাত দেবদ্বেষী ঔরঙ্গজেব.......... ঔরঙ্গজেব তাঁহাকেও একটু অনুগ্রহ করিতেন।
রাজসিংহ : তৃতীয় খণ্ড : বিবাহে বিকল্প, প্রথম পরিচ্ছেদ : বক ও হংসীর কথা, পৃষ্ঠা ১॥ বিঙ্কিম মুসলিম বাদশাহকে বানর হিসেবে উপস্থাপন করে লিখেন, "রাজকুমারী ভ্রূভঙ্গী করিলেন–বলিলেন, “তুই কি মনে করেছিস যে, আমি দিল্লীতে গিয়া মুসলমান বানরের শয্যায় শয়ন করিব? হংসী কি বকের সেবা করে?” নির্মাল কিছুই বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি করিবে?”"।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ ইতিহাসগবেষক হিসেবে রোমিলা থাপার বলেন, এ উপমহাদেশে ইসলাম এসেছিল দু’ভাবে : মুসলমানদের আগমন ও বসতি স্থাপন এবং ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে। এখন এ বিষয়টিকে মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে, অভিযান চালিয়ে দখলদারি প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে। আসলে অনেক প্রক্রিয়ায় এখানে ইসলামের প্রসার ঘটেছে। যেমন- মুসলমান ব্যবসায়ী, অভিবাসী, সুফি প্রমুখ এ দেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
রোমিলা ইতিহাসের নানা তথ্য তুলে ধরে অতীতে মুসলমানদের ধর্মীয় উদারতার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তদানীন্তন ভারতের সিন্ধু থেকে কেরালা পর্যন্ত পশ্চিম উপকূলজুড়ে আরব ব্যবসায়ীরা বসতি গড়ে তোলার বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে কিছু আরব দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজাদের অধীনে চাকরি করেছেন। তাদের অনেকে মন্দির ও ব্রাহ্মণদের জন্য ভূমি দান করেছিলেন। আরব ব্যবসায়ীরা এ দেশে বিয়ে করে নতুন নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছিলেন। যেমন- বোহরা, খোজা, নাবায়াৎ, মোপলা প্রভৃতি।
হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীদের ইতিহাস বিকৃতির বর্তমান প্রবণতার প্রেক্ষাপটে রোমিলা থাপার বলেন, মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে কিংবদন্তি বানানো হচ্ছে। বিগত হাজার বছরের এই ইতিহাসের সাথে ধর্মীয় চরমপন্থীরা এবং রাজনৈতিক নেতারা নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন।
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
No comments:
Post a Comment