সূফি বরষণ
গতকাল সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডমারা এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা ভেঙে স্থানীয়দের করা মিছিলে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। গুলিতে অন্তত ৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় সাতপুলিশ সদস্যসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডমারায় ৬০০ একর জমির উপর বেসরকারিখাতে নির্মিত হচ্ছে এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র । কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পরিবেশ বিপর্যয় হবে এবং পৈতৃক বসতভিটা হারাবেন অনেকে—এমন শঙ্কা থেকে বসতভিটা রক্ষা সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন স্থানীয়রা। আন্দোলন ঠেকাতে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন।
এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য গণ্ডামারা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমি কেনা হয়েছে। এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশের মালিকানা থাকবে এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের মধ্যে সেপকো ২০ শতাংশ এবং চীনের অপর প্রতিষ্ঠান এইচটিজি ১০ শতাংশের মালিক হবে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে এমন আশঙ্কার কথা জেনেও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সব উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে সরকার । উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতরের অনাপত্তিপত্রের জন্য আবেদন না করেই চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ ও নৌবাহিনীরও আপত্তি সত্ত্বেও এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি আনোয়ারায় স্থাপনে বদ্ধপরিকর সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন অনেকটা ভারতের ফাঁদে পড়েই সরকার এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন থেকে পিছ পা হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদফতরের জানিয়েছে, পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে সারা বিশ্ব যেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে, তখন পার্শ্ববর্তী একটি দেশের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার।
কর্ণফুলীর মোহনায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের সামনে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হলে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। প্রকল্প এলাকার মাত্র সাত কিলোমিটারের মধ্যে থাকা শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামাও হুমকির মধ্যে পড়বে। পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দূষিত কয়লাধোয়া পানি ও ডাস্ট কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ার কারণে নদীর পানি দূষিত হবে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম সমুদ্রসৈকত আনোয়ারার পারকি বিচ, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ বেইসসহ চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন কর্ণফুলীর মোহনায় প্রায় অর্ধ লাখ পরিবারের বসতি উচ্ছেদ করে ব্যয়বহুল এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় শুরুতেই আইনগত জটিলতায় পড়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবি। কিন্তু নিয়মনীতি, আইনকানুন, স্থানীয় জনতা ও পরিবেশবাদীদের আপত্তির তোয়াক্কা না করেই পরিবেশের জন্য হমুকিস্বরূপ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বেসরকারি এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বেসরকারি ভাবে । এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠা ও দেশের সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তিও চূড়ান্ত করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য চট্টগ্রাম বাঁশখালী এলাকার ৩ হাজার ১৮৮ একর জায়গায় নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে। বিপুল পরিমাণ এলাকায় দীর্ঘদিনের বসতি থাকা প্রায় অর্ধ লাখ মানুষের সঙ্গে বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানও উচ্ছেদের শিকার হবে।
প্রকল্পের শুরু থেকেই কর্ণফুলীর মোহনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করে আসছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগ-বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদফতর। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আপত্তিসহ সমুদ্রবন্দর সন্নিহিত এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়েছে তেল-গ্যাস-বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটি। এছাড়া একটি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতে রিট পর্যন্ত করা হয়েছে। আদালত কেন্দ্রটি স্থাপনের আগে বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিনামা ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পিডিবি সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, আদালতের নির্দেশনা না মেনেই সরকার কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু করেছে।
পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে সারা বিশ্ব যেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে, তখন পার্শ্ববর্তী একটি দেশের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম বন্দরসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসংলগ্ন এলাকায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। তিনি বিদেশি একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেন, কয়লা পোড়ানোর পর এর উপজাতগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পরিবেশ দূষণের জন্য যে ক’টি প্রতিষ্ঠান দায়ী তার অগ্রভাগে রয়েছে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ থেকে এক-তৃতীয়াংশ কার্বনডাই-অক্সাইড, ৪০ শতাংশ মার্কারি (পারদ), এক-চতুর্থাংশ নাইট্রোজেন অক্সাইড ও দুই-তৃতীয়াংশ সালফার ডাই-অক্সাইড উত্পন্ন হয়। সালফার ডাই-অক্সাইডের কারণে হৃদরোগ ও অ্যাজমা এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের কারণে ফুসফুসের টিস্যুর মৃত্যু হয়। গবেষণায় বলা হয়, কয়লাচালিত বিদ্যুেকন্দ্র থেকে উপজাত হিসেবে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, লেড (তামা), ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, রেডিওনিউক্লাইড (তেজস্ক্রিয় পদার্থ) প্রভৃতি উত্পন্ন হয়। সব ধরনের কয়লা থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে এসব দূষিত পদার্থ উত্পন্ন করা হয়। এছাড়া গড়ে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে ২৫ পাউন্ড মার্কারির নির্গমন হয়। সে হিসেবে আনোয়ারায় ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন ৩২৫ পাউন্ড পারদ নির্গত হবে। এগুলোর সবই পরিবেশ, মানবদেহ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
দেশের এত ক্ষয়ক্ষতি শিকার করেও সরকার পিডিবির মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ জোরেশোরে এগিয়ে নিচ্ছে। অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র, বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো অনাপত্তিনামা নেয়া হয়নি।
সংবাদপত্র সূত্র, পিডিবি এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেনি। তাদের কাছ থেকে আবেদনপত্র পাওয়ার পর আমরা প্রকল্প স্থানের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে এলাকা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্থান নির্ধারণ করার এখতিয়ার পিডিবির নেই বলেও জানায় সূত্রটি।
তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ অন্য বিষেশজ্ঞদের মতে আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে দেশের বৃহত্তর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে।
চট্টগ্রামের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন সাধারণ মানুষ। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে ভূমি অধিগ্রহণ হলে পৈতৃক ভিটেমাটি, ফসলি জমি হারিয়ে বাঁশখালীর বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন হবে বলে আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে বাঁশখালী এলাকার মানুষ রাজনৈতিক মতপার্থক্য, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। শনিবার বিকেলে স্থানীয় জনসাধারণের পক্ষ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে এ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার জন্য সমাবেশ আহ্বান করা হয়।
কিন্তু প্রশাসনের নির্দেশের কথা বলে স্থানীয় জনসাধারণের ডাকা এ সমাবেশে বাধা দেয় পুলিশ। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধ কমিটির নেতারা বলছেন, ``আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে নই। আমরা চাই বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক। কিন্তু সাধারণ মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র আমরা চাই না। আমরা এ কথাটি বলার জন্য সভা ডেকেছিলাম। পুলিশ আমাদের সভা করতে দেয়নি। আমরা ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে সমাবেশ করব।``
জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে অনুমতির প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ``তাদের কমিটি আছে। কমিটির পক্ষ থেকে আমাদের অবহিত করা প্রয়োজন ছিল। তখন আমরা বাধা না দিয়ে বরং নিরাপত্তা দিতাম।``
এদিকে সমাবেশস্থলের বাইরে এসে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আতংকিত ও ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের কমপক্ষে দু’লাখ মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন হবে।
সরকার বলছে, তারা খাস জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে। কিন্তু সেটা যদি আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করে তো সে বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে আমরা কি করব? সরকার লাখ লাখ অসহায় মানুষের কথা কি একবারও ভাববে না?``
বাঁশখালীতে শঙ্খ নদীর ধারে হাজার হাজার একর জমি পড়ে আছে। সরকার চাইলে সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে পারে। আমাদের ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কবরস্থানের দিকে কেন চোখ পড়ল সেটা আমরা বুঝতে পারছি না।
No comments:
Post a Comment