Friday 29 April 2016

বঙ্কিম ও রাজসিংহ উপন্যাস নিয়ে কিছু পর্যালোচনা। পর্ব এক:


উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।

সূফি বরষণ
পর্ব এক:  শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধের ১৯ পৃষ্ঠায় আহমদ ছফা বলেন, ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিম ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক। একটা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। আর সেটা মুসলমানদের পুরো অস্বীকার করে। ছফা শুরু করেছেন বাল্যকাল থেকে। বলেছেন তাঁর বঙ্কিম-অভিজ্ঞতার কথা। কেন বঙ্কিমের বইয়ের গায়ে অশ্রাব্য খিস্তি লেখা থাকে- এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে তিনি এই লেখকের রাষ্ট্রবেত্তা চরিত্র ভালো করে ফুটিয়েছেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিম ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক। একটা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। আর সেটা মুসলমানদের পুরো অস্বীকার করে। … বাঙালি সমাজে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব সর্বাধিক ক্রিয়াশীল হতে পেরেছে, তার মুখ্য কারণ বঙ্কিম রচিত সাহিত্য গ্রন্থের অনন্যতা নয়, বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা। মনে রাখতে হবে বঙ্কিমের মৃত্যুর প্রায় সত্তুর বছর পরে তাঁর রচিত ‘ সুজলং সুফলং মলয়জ শীতলং বন্দে মাতরম’ গানটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো।

ঠিক একই কথা বলেন রোমিলা থাপার। ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদদের একজন রোমিলা থাপার। বর্তমানে দিল্লির নেহরু ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। ইতিহাসের ওপর নোবেল প্রাইজ না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস যে পুরস্কার দিয়ে থাকে, রোমিলা ২০০৮ সালে তা-ও অর্জন করেছেন। তিনি অক্সফোর্ড, শিকাগো ও কলকাতা- এই তিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেয়েছেন অনারারি ডিলিট ডিগ্রি।

১৯ আগস্ট ২০১৫ সালে রোমিলা থাপার নয়া দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়াতে ‘আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার স্মারক বক্তৃতা’ দিয়েছেন।
রোমিলা থাপার সেই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বলেন, ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক দলগুলো নেহায়েত রাজনৈতিক স্লোগানে পর্যবসিত করেছে।
ইতিহাস অনুসন্ধান ও গবেষণার ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি বিশ্লেষণ করা এবং সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অভিমত দরকার। ইতিহাসবিদ রোমিলার ভাষায়- We should not allow history to be reduced to, or dismissed as political slogans of various kinds. ভারতে ইসলামের আগমন ও প্রচার, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি, মুসলিম শাসন প্রভৃতি বিষয়ে এখন সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীরা জোরালো অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মোড়কে তারা ইতিহাস বিকৃতির দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে অবতীর্ণ হয়েছে।

এবার তাহাদের কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলি, বঙ্কিমের রাজসিংহ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া �যাক, বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : চিত্রদলন পর্বে লিখেন, "এই বলিয়া বৃদ্ধা আর একখানি চিত্র বাহির করিয়া রাজপুত্রীর হাতে দিল। রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কাহার চেহারা?” বৃদ্ধা। বাদশাহ আলম্‍গীরের। রাজকুমারী। কিনিব।

এই বলিয়া একজন পরিচারিকাকে রাজপুত্রী ক্রীত চিত্রগুলির মূল্য আনিয়া বৃদ্ধাকে বিদায় করিয়া দিতে বলিলেন। পরিচারিকা মূল্য আনিতে গেল, ইত্যবসরে রাজপুত্রী সখীগণকে বলিলেন, “এসো, একটু আমোদ করা যাক৷”রঙ্গপ্রিয়া বয়স্যাগণ বলিল, “কি আমোদ বল! বল!”

রাজপুত্রী বলিলেন, “আমি এই আল‍মগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটিতে রাখিতেছি। সবাই উহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের নাতি মার। কার নাতিতে উহার নাক ভাঙ্গে দেখি৷”.........হাসিয়া রাজপুত্রী চিত্রখানি মাটিতে রাখিলেন, “কে নাতি মারিবি মার৷”........চঞ্চলকুমারী ধীরে ধীরে অলঙ্কারশোভিত বাম চরণখানি ঔরঙ্গজেবের চিত্রের উপরে সংস্থাপিত করিলেন–চিত্রের শোভা বুঝি বাড়িয়া গেল। চঞ্চলকুমারী একটু হেলিলেন–মড় মড় শব্দ হইল–ঔরঙ্গজেব বাদশাহের প্রতিমূর্‍তি রাজপুতকুমারীর চরণতলে ভাঙ্গিয়া গেল।

“কি সর্‍বনাশ! কি করিলে!” বলিয়া সখীগণ শিহরিল। রাজপুতকুমারী হাসিয়া বলিলেন, “যেমন ছেলেরা পুতুল খেলিয়া সংসারের সাধ মিটায়, আমি তেমনই মোগল বাদশাহের মুখে নাতি মারার সাধ মিটাইলাম৷” তার পর নির্‍মলের মুখ চাহিয়া বলিলেন, “সখি নির্‍মল! ছেলেদের সাধ মিটে; সময়ে তাহাদের সত্যের ঘর-সংসার হয়। আমার কি সাধ মিটিবে না? আমি কি কখন জীবন্ত ঔরঙ্গজেবের মুখে এইরূপ__”

নির্‍মল , রাজকুমারীর মুখ চাপিয়া ধরিলেন, কথাটা সমাপ্ত হইল না–কিন্তু সকলেই তাহার অর্থ বুঝিল। প্রাচীনার হৃদয় কম্পিত হইতে লাগিল–এমন প্রাণসংহারক কথাবার্‍তা যেখানে হয়, সেখান হইতে কতক্ষণে নিষ্কৃতি পাইবে! এই সময়ে তাহার বিক্রীত তসবিরের মূল্য আসিয়া পৌঁছিল। প্রাপ্তিমাত্র প্রাচীনা ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল"। রাজসিংহ : প্রথম খণ্ড : চিত্রে চরণ | পৃষ্ঠা ২ | বঙ্কিম রচনাবলি।

বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসের এই একটি উদ্ধৃতি থেকে পরিষ্কার যে,  বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে কোনো কারণ ছাড়াই জৈনক হিন্দু মহিলাদের দিয়ে মোগল বাদশাহের মুখে নাতি মারার ব্যবস্থার চিত্র হাস্যকর চিত্রের মাধ্যমে বিখ্যাত প্রজা দয়ালু বাদশার মুখে ও নাকে লাথি মেরে নাক মুখ ভাঙ্গা ব্যবস্থা করেছিলেন । এরচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষী লেখা আর কি হতে পারে??

এইবার আরও একটি বঙ্কিমের রাজসিংহ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া �যাক, বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসে লিখেন, "পরদিন চঞ্চলকুমারী ক্রীত চিত্রগুলি একা বসিয়া মনোযোগের সহিত দেখিতেছিলেন। নির্‍মলকুমারী আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া চঞ্চল বলিল, “নির্‍মল! ইহার মধ্যে কাহাকেও তোমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে?”

নির্‍মল বলিল, “যাহাকে আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তাহার চিত্র ত তুমি পা দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ৷” চ। ঔরঙ্গজেবকে! নি। আশ্চর্‍য হইলে যে?
চ। বদ্জাতের ধাড়ি যে? অমন পাষণ্ড যে আর পৃথিবীতে জন্মে নাই?

নি। বদ্জাতকে বশ করিতেই আমার আনন্দ। তোমার মনে নাই, আমি বাঘ পুষিতাম? আমি একদিন না একদিন ঔরঙ্গজেবকে বিবাহ করিব ইচ্ছা আছে। চ। মুসলমান যে? নি। আমার হাতে পড়িলে ঔরঙ্গজেবও হিন্দু হবে"। রাজসিংহ : প্রথম খণ্ড : চিত্রে চরণ, পৃষ্ঠা ৩ । তৃতীয় পরিচ্ছেদ : চিত্রবিচারণ।

উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম ইতিহাস বিকৃতিসহ ইতিহাসের চরম মিথ্যাচার করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের মুঘল শাসনের ইতিহাসের বিখ্যাত শাসক আওরঙ্গজেবকে "বদ্জাতের ধাড়ি যে? অমন পাষণ্ড যে আর পৃথিবীতে জন্মে নাই?"" বলে উল্লেখ করেছেন । যার মাধ্যমে বঙ্কিম নিজেকে চরম সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষী এবং একজন ইতিহাস বিকৃতিকারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন । এই কথা প্রমাণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ইরফান হাবিবের টাইমস অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত তাঁর লেখায়।


উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ইরফান হাবিবের টাইমস অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত তাঁর লেখাটা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই হলো তাঁর লেখার লিংক ।
http://m.timesofindia.com/india/India-stronger-than-RSS-wont-allow-intolerance-Irfan-Habib/articleshow/50347682.cms

তিনি বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। ভারতের বিজেপির মোদি সরকারের মদদে সাম্প্রদায়িক শক্তির ইতিহাস বিকৃতি এবং মুসলিম বিদ্বেষী সহিংসতার প্রেক্ষাপটে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবীণ অধ্যাপক টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ইরফান হাবিব (৮৪) যে ক’টি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার একটি হলো The Agrarian System of Mughal India ১৫৫৬-১৭০৭ মুঘল যুগ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ইতিহাস শিক্ষার্থীরা গত অর্ধশতাব্দী যাবৎ নির্ভর করছেন এই ক্লাসিক গ্রন্থটির ওপর। ইরফান বহু বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিক্যাল রিসার্চের। ভূষিত হয়েছেন পদ্মভূষণ উপাধিতে।

ইরফান হাবিব সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এখনকার মোদি সরকারকে চালাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস। তাদের আদর্শিক গুরু এম এস গোলওয়ালকার হিটলার ও তার নাৎসি পার্টির ভক্ত ছিলেন। বর্তমান সরকার গোলওয়ালকারের স্বপ্ন পূরণ করছে। ওরা নাৎসিদের প্রপাগান্ডা টেকনিক ব্যবহার করে নির্যাতনের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাদের আদর্শ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার। আরএসএস সাম্প্রদায়িক সংগঠন।
ইরফান হাবিব নরেন্দ্র মোদির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী এমন অবৈজ্ঞানিক কথা বলেন যে, গণেশ দেবতার শুঁড় লাগানো হয়েছিল প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির অনেক ত্রুটি ছিল। তবে তিনিও এমন কথা বলেননি। মোদি আরো মন্দ লোক। তারা আওরঙ্গজের সড়কের নাম বদলে দিলেও মান সিংয়ের মতো রাজাদের নামে যেসব সড়ক আছে, সেগুলোর নাম তো বদলায়নি।

অথচ মান সিং তাদের চোখে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা। আওরঙ্গজেব ছিলেন মুসলমান। এ কারণে আরএসএস তাকে দানব হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। মুসলমানদের তারা বিদেশী মনে করে।
উল্লেখ্য, দিল্লির সুপরিচিত আওরঙ্গজেব সড়কের নাম রাখা হয়েছে এ পি জে আবদুল কালাম সড়ক। এটা মূলত মোদি সরকারের কৌশল। এতে এক দিকে ভারতের একজন সেরা মুঘল সম্রাটের নাম মুছে দেয়া হলো; অন্য দিকে দেখানো যাবে যে, বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িক হলে কোনো হিন্দুর নামে রাস্তাটির নামকরণ হতো, তা তো করা হয়নি। বরং এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় মুসলিম রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়েছে। অথচ তার নামে অন্য কোনো সড়ক বা স্থাপনার নাম রাখা মোটেও কঠিন নয়।

বহুলালোচিত বাদশাহ আওরঙ্গজেব সম্পর্কে ইতিহাসের আলোকে ইরফান হাবিব বলেছেন,  আওরঙ্গজেব হিন্দুতীর্থ বৃন্দাবনসহ বহু মন্দিরকে অর্থ মঞ্জুর করা অব্যাহত রেখেছিলেন; হিন্দুদের ধর্মকর্মের সুবিধার্থে আরো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বিদেশী পর্যটকেরা তার আমলে ভারত সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আওরঙ্গজেবের প্রশাসন পরধর্ম সহিষ্ণু বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ধর্মোন্মাদ ছিলেন বলা ভুল। তার বিশেষ অবদান হলো, পুরো ভারতকে তিনি একক রাজনৈতিক কেন্দ্রের আওতায় করেছিলেন ঐক্যবদ্ধ। হিন্দুস্তান আর মুঘল সাম্রাজ্য অভিন্ন হওয়ার এ চেতনা ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

অথচ এই সিপাহিদের বেশির ভাগই ব্রাহ্মণ। আওরঙ্গজেবের ৩০ শতাংশ সেনাপতিই হিন্দু রাজপুত-মারাঠা। জমিদারদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু।
মোদি সরকার ও তার দল বিজেপির পেছনে আদর্শিক চালিকাশক্তি হিসেবে আরএসএস যে কত ব্যাপক প্রভাবশালী, তা এখন নগ্নভাবে প্রতিভাত। এই আরএসএসের মারাঠা সদস্য, নাথুরাম গডসে ভারতের জাতির পিতা গান্ধীজিকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ মাস পরই। মোদির নেতৃত্বাধীন গুজরাটে ২০০২ সালে মুসলিম নিধনযজ্ঞের হোতাও তারা।

ইরফান হাবিব এ প্রসঙ্গে বলেন, মনে রাখতে হবে, এ যাবৎ সংঘটিত দাঙ্গাগুলোর যে তথ্য পাওয়া গেছে, এতে দেখা যাচ্ছে, আরএসএস এসব দাঙ্গায় জড়িত। ওরা এখন ক্ষমতাকাঠামোর কাছ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছে, আগে কোনো দিন তা পায়নি। গুজবকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামে মানুষ খুন হলেন, সেখানে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিয়ে যা বললেন, তা বেমানান। আরএসএসের এই শাসন ভারতে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।

অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবীরা মুসলিমবিরোধী সাম্প্রতিক সহিংসতার তাণ্ডবের যে সাহসী প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, মোদির অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তাকে ব্যঙ্গ করেছেন। ইরফান হাবিব এই সুন্দর চেহারার মানুষটির অসুন্দর কাজকর্মের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, ২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে তিনি ছিলেন বিজেপির মুখপাত্র। তখন থেকেই তার বক্তব্যের সাথে আমরা পরিচিত। তার কথাবার্তা তখনও ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন।

সঙ্ঘ পরিবার ভারতবর্ষে মুসলিম সুলতান ও সম্রাটদের শাসনকালকে বলছে ‘হাজার বছরের বিদেশী শাসন’। এ দিকে শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যসূচি বদলিয়ে সাম্প্রদায়িক, তথা বিকৃত বানোয়াট ইতিহাসের বটিকা গলাধঃকরণের জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের তোড়জোড়ের শেষ নেই। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ ইরফান হাবিব বলেছেন, বিজেপির প্রথম সরকার ইতিহাস রচনার নামে যা ঘটিয়েছিল, এখন তা চরমে পৌঁছবে কিংবদন্তি, কল্পকথা ও কুসংস্কার ইতিহাসের নামে তুলে ধরার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক বিতর্কের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তবে যত ভুলপন্থায় ইতিহাস উপস্থাপিত হোক, ইতিহাস বদলানো সম্ভব নয়।

ভারতের মুসলিম শাসকেরা কত বেশি উদার ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা তুলে ধরে ইতিহাসের গবেষক ইরফান হাবিব বলেন, মুসলিম আমলে বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যখন কৃষকদের বেশির ভাগ মুসলমান, তখনো জমিদারেরা ছিলেন কায়স্থ হিন্দু। মুসলিম শাসকেরা বিদেশে সম্পদ পাচার করেননি; এ দেশেই স্থায়ী হয়ে গেছেন। তখন ভূমিকরের পরিমাণ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ছিল একই। বেতন বা মজুরি হিসেবে মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে বেশি পেতেন না।

অথচ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রাজসিংহ উপন্যাসে উদ্দেশ্যপ্রনোধিত ভাবে কোনো কারণ ছাড়াই একজন সম্মানিত প্রজা দয়ালু মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে এইধরণের জঘন্য অশ্লীল অশোভন ভাষা মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে লিখে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছেন । আরও পরিস্কার করে বললে বলতে হয় বর্তমান ভারতের সরকার গুলো সাম্প্রদায়িকতা বা মুসলিম বিদ্বেষের নামে যা করছে তা বঙ্কিমের মতো কলকাতার উচ্চ বর্ণ হিন্দু সাম্প্রদায়িক লেখকদের কাছ থেকে শেখা। কারণ একসময়ের ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বা মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছেন উচ্চ বর্ণ হিন্দু সাম্প্রদায়িক লেখকরা ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা । সেই হিসেবে কলকাতাকে বলা যায় সাম্প্রদায়িক বা মুসলিম বিদ্বেষের তীর্থভূমি।

ঠিক একই রকমের কথা বলেন আহমদ ছফা। শতবর্ষের ফেরারিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধের ২০ পৃষ্ঠায় আহমদ ছফা আরও বলেন, … দেশ বিভাগের জন্য কাউকে সত্যি অর্থে দায়ী করতে চাইলে বঙ্কিমের নাম না এসে থাকবে না। আর কেনই বা বঙ্কিম? এর উত্তর খুঁজতে গেলে পেছনের আটশো বছরের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে।

সাম্প্রদায়িক মনোভাব এমনিতে জন্ম নেয় না। শোষণ বঞ্চনার কোন ট্রাজেডি এর পিছনে থাকে। তবে কারণ যাই হোক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমের উচিত ছিলো কালের চিত্রের যথাযথ বর্ণন। তিনি তা করেননি। সত্যকে এড়িয়ে এগোতে চেয়েছেন। ফলে তাঁর উপর দোষ চাপানো ছাড়া ছফার গতি থাকে না। বঙ্কিমের সেই আমলের রাষ্ট্রচিন্তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি এখনো… ভারতে বৃটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই ভারতের আত্মবিস্মৃত হিন্দুরা হিন্দুসত্তা তথা ভারতীয় সত্তা ফিরে পেতে আরম্ভ করেন, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে তার সূচনা এবং বাবরী মসজিদ ধবংসের মাধ্যমে হিন্দুসত্তা চূড়ান্ত সার্থকথার সাথে বিরাট একটা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পেরেছে। একটি হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন নির্মাণ করে ভারতীয় হিন্দুদের যথার্থ পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্কিম। দেখা যাচ্ছে, আজকের ভারতবর্ষেও বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা অসম্ভব রকম জীবন্ত। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের পক্ষেও বঙ্কিমের চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই ফলাফল দাঁড়ালো বঙ্কিম কোনো রকম কারণ ছাড়াই তাঁর বিভিন্ন লেখায় সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বা মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর পাশাপাশি করেছেন চরম ভাবে ইতিহাস বিকৃতি। চলবে

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
 সূফি বরষণ

No comments:

Post a Comment