আবদুস সামাদ_ এ সট্রিপ অব ল্যান্ড: টু ইয়াডস লং বই রিভিউ:
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে বিহারে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমানদের উপরে চালানো হয় বর্বর গণহত্যার। উঠে এসেছে বিহারী মুসলমানদের দূর্দশার এক অজানা অধ্যায় ।
সূফি বরষণ
আবদুস সামাদ-এর উর্দ্দু সংকলন নাম ‘দো গজ জমিন যে বইয়েতে উঠে এসেছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে বিহারে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমানদের উপরে চালানো বর্বর গণহত্যাগণর চিত্র । দেশভাগে পূর্ব ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালির কথা বলা হলেও উদ্বাস্তু বিহারির কথা বলা হয় না। যে ক্ষত আজও শুকায়নি, বিহারী মুসলমানদের মাঝে যুগ যুগ ধরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেই বর্বর গণহত্যার চিত্র দিনরাত । দেশভাগের জন্য উগ্র সাম্প্রদায়ীক হিন্দু সন্ত্রাসীরা কিভাবে মুসলমানদের উপরে গণহত্যা আর লুটপাট চালায় এই বই একটি প্রমাণ্য চিত্র সেই ভয়ংকর দাঙ্গার ঘটনার ।
ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে স্বাধীনতা তত নয়, স্বাধীনতার সঙ্গে জড়ানো দেশভাগটা যত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। যেন সমস্ত ইংরেজ আমল ধরে নানা জটিলতার গ্রন্থিবন্ধনের মধ্য দিয়ে চলছিল দেশভাগের প্রস্তুতি, আর ১৯৪৭ সালের পর থেকে যা-কিছু এই বিশাল ভূখণ্ডে ঘটছে, সবই ওই দেশভাগের পরিণাম। শ্রীনগরের পথে বিস্ফোরণ হয়ে দাঙ্গা বাধে, অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক শাণিত হয়, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়, ছিটমহল বিনিময় নিয়ে অফুরন্ত আলোচনা চলতেই থাকে, এখনও যে সমস্যা সমাধান হয়নি দেশভাগের ৬৮ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে । তখন ১৯৪৭-এ ঘটে যাওয়া দেশভাগ আর অতীত থাকে না, একেবারে ঘটমান বর্তমান হয়ে ওঠে আজও দাঙ্গা আর দেশভাগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে।
কলকাতা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংবাদপত্র নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক হত্যাকান্ডকে এত ফলাও করে এবং ঘটনারসাথে কাল্পনিক গল্প জুরে দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করে যে এর ফলে বিহারের পাটনায় হিন্দুদের দ্বারা ব্যাপক মুসলমানহত্যাকান্ডকে উস্কে দেয়। সোহরাওয়ার্দী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেন: ‘অমৃত বাজার পত্রিকা এবং কংগ্রেসের অন্যান্য পত্রিকাগুলো বঙ্গীয়প্রাদেশিক পরিষদের সম্পাদকের নামে অকস্মাত একটি বিবৃতি ছাপে যে, ৫০,০০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে এবং অগণিতনারীকে অপহরণ করা হয়েছে। এ খবরে উত্তেজিত হয়ে, যুক্ত প্রদেশের গারমুখতেশ্বারে হিন্দুরা মুসলিমদের লাঞ্ছিত করে এবংগণহত্যা চালায় এবং বিহার প্রদেশের সর্বত্র ১০০,০০০ মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে অবিশ্বাস্য বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করাহয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। চারদিন ধরে বিহারের পল্লী অঞ্চলে হিন্দু দাঙ্গাকারীরা হত্যা, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ, মানুষেরঅঙ্গহানি করার মাধ্যমে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল এবং স্পষ্টতই বেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এর পেছনে বিহার সরকার ও হিন্দুপুলিশ সদস্যদের মদদ ছিল’ [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার (সংকলন), মেমেয়ারস অব হোসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উইথ অ্যা ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্ক’, ইউনিভাসির্টি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১০৫]।
শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গান্ধী দিল্লী থেকে নোয়াখালীর উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করেছেন। কলকাতায় পৌঁছার পর তাঁকে বিহারের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত করে একদল মুসলিম যুবক আগে সেখানে পরিদর্শন করার আহবান জানায়। গান্ধী তাঁদের আহবান প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, ‘তিনি যখন দিল্লী থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, তখন বিহারে কোন দাঙ্গা ছিল না, সুতরাং মাঝপথে এসে তিনি পূর্বে মনঃস্থির করা গন্তব্য পরিবর্তন করতে পারবেন না’।
কামরুদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে লিখেন যে, বিহার
যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মুসলিম যুবকরা মনে করেছিল গান্ধী বিশ্বের দৃষ্টি বিহারের হত্যাযজ্ঞ থেকে সরিয়ে নোয়াখালীরদিকে নিতে চাচ্ছেন। ফলে তাঁরা পরোক্ষভাবে গান্ধীকে কপটতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। গান্ধী তাঁদের এই অভিযোগের উত্তরে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ‘ইতিহাস ওই যুবকদের নয়, বরং আমার পদক্ষেপকেই মূল্যায়ন করবে’। ১৯৪৬ সালের ১৪ নভেম্বর গান্ধী তাঁর সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই, নাতনী মুন্নি গান্ধী, এবং পালিত নাতনী আভা গান্ধীকে নিয়ে নোয়াখালীর দত্তপাড়ায় পৌঁছান। সেখানে তিনি ‘বাংলার প্রাদেশিক সরকারের অতিথি’ হিসেবে অবস্থান করেন।
আবুল হাশিম লিখেছেন, গান্ধী গ্রামে গ্রামে ঘুরে হিন্দুদের মনোবল পুনরুজ্জিবীত করেছিলেন। গান্ধী বিহার এবং পাটনা পরিদর্শন না করায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন। এই বিষয়ে তিনি নিদারুণ দুঃখের সাথে লিখেছেন: ‘গান্ধীজী নোয়াখালী পরিদর্শন করায় নোয়াখালীও কুমিল্লা জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলিমদের নৃশংসতার উপর বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। অপর দিকে, কলকাতা ওবিহারের দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি নৃশংসতার শিকার হয়েছিল মুসলিমরা। কিন্তু গান্ধী কলকাতা ও পাটনায় গেলেন না’ ’[আবুল হাশিম, ইন রেট্রোস্পেক্ট, বাংলাদেশ বুক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৫৬]।
পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জিও লিখেছেন, ‘কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক শাখাগুলোর মদদে পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ সালে বাঙলা ভাগ করে ভারতের অধীনে আলাদা একটি হিন্দু প্রদেশ সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায় [জয়া চ্যাটার্জি, ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কম্যুনালিজম এন্ড পার্টিশন: ১৯৩২-১৯৪৫’, ক্যামব্রিজ ইউনিভাসির্টি প্রেস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ২২৭]।
বিশেষ করে মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীরা যারা কলকাতা এবং পাটনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দুদের ক্ষোভ থেকে মুসলমানদের রক্ষায় বহু চেষ্টা করে গেছেন, তারা গান্ধীর উপর ক্ষুব্ধ হন। কারণ, দাঙ্গার সময় ওই দুই শহরে যেতে গান্ধী উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন। এমন ক্ষুব্ধ তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি পরবর্তীতে পূর্ব বাঙলা, এবং বর্তমানের বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করার মাধ্যমে এই ভূখন্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদে পরিণত হন।
যদিও ইতিহাসে দেখা যায়, গান্ধী সোহরাওয়ার্দীর সক্রিয় সমর্থনে দাঙ্গা পরবর্তী কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনে বেশ কিছু সফল চেষ্টা চালিয়েছেন। সেসময় এক ঈদের দিনে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু মিলে নাঙ্গলডাঙ্গায় অবস্থান করা গান্ধীকে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ একটি উপহার দিয়েছিলেন। উপহারটি ছিল একটি প্যাকেটে মোড়া অবস্থায় কলকাতা এবং পাটনায় হিন্দুদের নৃশংসতার শিকার কিছু মুসলমানের ছবি। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, সেসব ছবির মধ্যে কোনোটি ছিল স্তন কেটে দেয়া মুসলমান নারীর, মস্তক বিচ্ছিন্ন শিশুর, জ্বলন্ত মসজিদের, আবার কোনোটিতে দেখা যাচ্ছিল রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ। এরকম আরো অনেক নৃশংসতার দৃশ্য ছিল।’ গান্ধীকে এ ধরনের উপহার’ দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে শেখ তার স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন, আমরা মহাত্মাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, তার সম্প্রদায়ের লোকজন কী ধরনের অপরাধ করেছে এবং কিভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে [শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (অনুবাদ), ড. ফখরুল আলম, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৬]
এবার মূল আলোচনায় আসি, এখনও বহু মানুষের সত্তার মধ্যে উপস্থিত, তিন দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে নিত্য উপস্থিত এই দেশভাগের প্রচণ্ড অভিঘাত নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে। যত হওয়া উচিত ছিল, তত হয়নি, যে স্তরের হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্র, তেমনই বেসরকারি সমাজ, তেমনই সাহিত্য পরিকল্পিত নীরবতা পালন করেছে। পূর্ববাংলা থেকে হিন্দু বাঙালির উৎখাত হওয়া নিয়ে বাংলায় বেশ কিছু কথাসাহিত্য, নাটক লেখা হয়েছে, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পশ্চিম বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বাঙালি মুসলমানের পূর্ব পাকিস্তানে বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়া নিয়ে সাহিত্য তুলনায় কম লেখা হয়েছে। কলকাতা থেকে যে হাজার বাঙালি মুসলমান ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়ে উদ্বাস্ত হয়ে এসেছে ভিটে মাটি পৈত্রিক সম্পত্তি ছেড়ে এসে তা নিয়ে আমাদের তথাকথিত প্রগতীশীল বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকগণ তেমন কিছুই লিখেননি আর বিহারের মুসলমানদের উদ্বাস্তে ঘটনা তো পরের বিষয়!?
কিন্তু, পূর্ব ভারতবর্ষে আরও এক দল মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছিল, ১৯৪৬-’৪৭ সালে এবং তার পরে, বিহারি মুসলমানরা যে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, তাদের কথা অনুক্ত থেকে গেছে, যেমন ইতিহাসে, তেমনই সাহিত্যে। কী ভাবে তারা উৎখাত হল, কী হল তাদের উত্তরকালীন নিয়তি, তার উত্তর খোঁজেনি বাংলা বা হিন্দি সাহিত্য। এই মানুষগুলির ভাষা ছিল উর্দু, কিন্তু পশ্চিমের দেশভাগ নিয়ে উর্দু সাহিত্য মুখর হলেও, পূর্বের দেশভাগ নিয়ে নীরব রয়েছে বরাবরই । এদের নিয়ে একটি মাত্র উপন্যাস আমার নজরে এসেছে, আবদুস সামাদ-এর ‘দো গজ জমিন’। যার সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত বাংলা তর্জমার নাম ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’।
১৯৪৬ সালের অগস্টে মুসলিম লীগের ডাকা প্রতিবাদ দিবস পালনের সময় কলকাতার হিন্দুরা শুরু করে বর্বর গণহত্যার । কলকাতার প্রত্যাঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্যোগে এবং প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালিতে শুরু হয় হিন্দুবিরোধী দাঙ্গা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব আমরা বারে বারে পাব। শুধু সম্প্রতি কালের গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তত্ত্বের মুখোমুখি হই না আমরা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব চলে আসছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে। এইসবে মূলে ছিল উগ্র হিন্দুদের দেশভাগের পরিকল্পনা আর যেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতা ও বিহারে মুসলমানদের উপরে চালানো হয় বর্বর ভয়াবহ গণহত্যা আর লুট করা হয় মুসলমানদের জমিজমা ও সম্পত্তি। আর তাড়িয়ে পাঠানো হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দিক বিহারী মুসলমানদেরকে !?
কিন্তু, ক্রিয়াও যেমন নিজে নিজে ঘটে না, তাকে ঘটানো হয়, প্রতিক্রিয়াও তেমনই। বানানো ক্রিয়াকে অজুহাত করে সজ্ঞানে প্রতিক্রিয়া ঘটানো হয়। তার পরে সব পক্ষই মুখ মুছে বলতে চায়, যা ঘটেছে প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটে গেছে। এই ভাবে কলকাতার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালিতে দাঙ্গা বাধে। সেখানে হিন্দুর মনে আস্থা জাগাতে, মুসলমানদের মনে শুভবুদ্ধি জাগাতে হাজির হন খালি-পায়ের তীর্থযাত্রী, যাঁকে মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন One-man Boundary Force. নোয়াখালি যাত্রার আগে থেকেই গাঁধীজির কাছে খবর আসতে থাকে বিহারে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। সেখানে ভূমিকা বদলে গেছে, বিহারে আক্রমণকারী হিন্দু আর আক্রান্ত মুসলমান। এখানে রক্তপাত হচ্ছে মুসলমানের, পূর্ব পুরুষের ভিটে থেকে উৎখাত হচ্ছে মুসলমান। বিহারের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও মন্ত্রী ডা. সৈয়দ মাহমুদের লেখা বিবরণ থেকে মুসলমানদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের বৃত্তান্ত পড়ে গাঁধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। মনে হয়, ‘happenings of Noakhali seemed to pale into insignificance.’ মাহমুদ অনুরোধ করেন গাঁধীজি নোয়াখালি ছেড়ে এবার বিহারে চলে আসুন ও বিহারি মুসলমানদের বাঁচান।
খিলাফত আন্দোলনের সময় বিহারে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ভাল ছিল। পরে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়। ডা. সৈয়দ মাহমুদ, অধ্যাপক আবদুল বারির মতো নেতা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস ক্রমে হয়ে উঠছিল হিন্দুর পার্টি আর লিগ হচ্ছিল মুসলমানের পার্টি। শুকনো বারুদ যখন স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায়, তখনই কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গার খবর এসে পৌঁছয় বিহারের শহরে ও গ্রামে। বিহারের বহু মানুষ কলকাতায় কর্মরত ছিল, তারা কলকাতার দাঙ্গায় স্বজন ও সম্পত্তি হারায়। সেখানকার দাঙ্গার কাহিনি ‘gruesome, sometimes exaggerated’ হয়ে বিহারে ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করে। হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানায়। সংবাদপত্রগুলি দায়িত্বহীন ভাবে উত্তেজনা বাড়ায়। ১৯৪৬ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতা এবং পূর্ব বঙ্গের ঘটনার বিরুদ্ধে বিহারে প্রতিবাদ-সভার আয়োজন করা হয়।
কংগ্রেসের উদ্যোগে বিরাট বিরাট আক্রমণাত্মক মিছিল বেরোয়। বিহারে অন্ধকার দেওয়ালি পালন করা হয়; মসজিদে মসজিদে বলা হয়, ওদের শোক, আমাদের উৎসব। দাঙ্গা লেগে যায়, আর হাজার হাজার মুসলমান ধর্মের মানুষের মৃত্যু হয়। ডা. মাহমুদের বিবরণ থেকে জানা যায় হত্যাকাণ্ডে নির্যাতনে উৎখাত হয়ে সাড়ে তিন লক্ষ মুসলমান বাড়ি জমি গহনা নগণ্য দামে বেচে বিহার ছেড়েছে। তিনি নিজে একটি গ্রামে মৃত মানুষে ভরাট পাঁচটি কুয়ো দেখেন, অন্য গ্রামে এমন দশ-বারোটি কুয়ো। অনেক সময় আক্রান্ত মানুষেরা ‘with the courage of despair’ সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, সম্ভ্রমরক্ষায় মেয়েদের হত্যা করেছিল, কিন্তু দাঙ্গাবাজদের জোয়ার তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিল না তা নয়, তারা কিছু মানুষকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু দাঙ্গা প্রতিরোধের ক্ষমতা তাদের ছিল না। বহু কংগ্রেস নেতা, কংগ্রেসের ঘোষিত নীতির কথা ভুলে এই দাঙ্গায় অংশ নেয়। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেন, দুঃখজনক হলেও বিহারের দাঙ্গা বাংলার দাঙ্গাপীড়িত হিন্দুদের বাঁচিয়েছে। বিহারের দাঙ্গার পক্ষে কংগ্রেস নেতারা দিয়েছিলেন সেই প্রতিক্রিয়ার যুক্তি। কিন্তু, গাঁধীজি বা জওহরলাল এই প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব মানতে রাজি ছিলেন না।
এই দাঙ্গায় বিহারে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের অস্তিত্বের ভিত নড়ে যায়। তারা চলে আসে গ্রাম থেকে শহরে। আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে। পরে শুরু হয় দলে দলে বিহার-ত্যাগ। ছিন্নমূলদের মুসলিম লিগ উৎসাহ দেয় বাংলায় চলে যেতে, কেননা মুসলমান-শাসনাধীন বাংলাই হল তাদের পক্ষে ‘land of promise’. দেশভাগের পর পশ্চিম থেকে গণপ্রব্রজনের মাধ্যমে যারা পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, তাদের একটা বড় অংশ ছিল অবাঙালি উর্দুভাষী মুসলমান, বিহারি মুসলমান।
বিহারশরিফ থেকে কিছু দূরে বিন গ্রাম। সেই গ্রামের শেখ হলতাফ হোসেনের উত্তরপুরুষের কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছে আবদুস সামাদের ‘দো গজ জমিন’ আখ্যান। শেখ সাহেব খিলাফত ও পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর ঘরে যিনি বধূ হয়ে এসেছিলেন সেই বিবি সাহেবা ছিলেন খাঁটি সৈয়দ বংশের সন্তান। তাঁর উপস্থিতিতে সংসার শ্রীমন্ত হয়ে ওঠে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দিকে নজর দেওয়া হয়। চিকিৎসা ও লেখাপড়ার কথা ভেবে তাঁর সুপরামর্শে নিকটবর্তী বিহারশরিফে এক হাবেলি নির্মাণ করা হয়। বিন হাউস নামের এই হাবেলি হয়ে ওঠে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্র। নিজের সুশিক্ষিত বড় ছেলে সরোয়ারের সঙ্গে শেখ সাহেব বিয়ে দেন নিজের অনাথ ভাইঝির, আর ভাগনে আখতার হোসেনের সঙ্গে বিয়ে দেন নিজের বড় মেয়ের।
এই ভাগনে এবং জামাই আখতার হোসেন ছিলেন শেখ সাহেবের মতোই স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক। শেখ সাহেবের অকালমৃত্যুর পর তিনিই এই সংসারের হাল ধরেন বিবি সাহেবার অনুরোধে। এ দিকে, শেখ সাহেবের সম্মতির অপেক্ষা না করে মেজো ছেলে আসগার হোসেনের বিয়ে দিয়ে দেন শেখসাহেবেরই মামা তাঁর পিতৃমাতৃহীন নাতনির সঙ্গে। এই মামা ছিলেন ইংরেজ-অনুগত। বাড়িতে লাটসাহেব এলে মাইলের পর মাইল লাল কার্পেট বিছিয়ে দিতেন। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে খানবাহাদুর পদবি পান তিনি। বিহারে যখন কংগ্রেসের মুসলমান নেতাদের প্রতিপত্তি মুসলমান এলাকায় দ্রুত কমতে থাকল এবং বাড়তে থাকল মুসলিম লিগের প্রভাব, তখন ইংরেজপ্রেমী দাদা শ্বশুরের প্রভাবে আসগার হোসেন হয়ে উঠলেন লিগের সমর্থক ও পরে আঞ্চলিক নেতা। তিনি বিন হাউসে এলে বাড়ি লিগ ও পাকিস্তানের জয়ধ্বনিতে, কংগ্রেসের ও গাঁধীজির মুর্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত হয়। খদ্দরের পোশাক পরা কংগ্রেস নেতা আখতার হোসেন সেই বাড়িতে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে থাকেন।
দুই আত্মীয়ের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় ছাড়া কোনও যোগ নেই। সর্বংসহা বিবিসাহেবা যেন ভারতবর্ষের প্রতীক, আর বিন হাউসের মানুষদের সম্পর্কের ভাঙনের মধ্যে যেন ভারত-ভাগের পূর্বাভাস। আখতার হোসেনের আদর্শে জমিদারির সমস্ত এলাকা স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্পিত ছিল। কিন্তু ভোট আসতেই পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে গেল। নির্বাচনে জয়ী হল লিগ। কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে, দ্বিতীয় স্থান পেল হিন্দু মহাসভা। আখতার হোসেন অন্তর্মুখী হয়ে গেলেন।
পঞ্জাবের ও বাংলার দাঙ্গার খবর বিহারে ছড়িয়ে পড়ছিল। লিগ মুসলমানদের মনে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছে। বলেছে, মুসলমানেরা শাসকের জাতি, তারা কোনও দিন হিন্দুর গোলামি করবে না। হিন্দুদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তীব্র হচ্ছিল। দাঙ্গা লাগতে পারে, এই আশঙ্কায় আখতার হোসেন গাঁধীজির অনুগামীদের সঙ্গে, প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। জনসভায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শপথ নেওয়ানো হল, কিন্তু দাঙ্গা থামানো গেল না। বাস্তুচ্যুত মানুষ বিহারশরিফে আসতে লাগল, স্টেশন, মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা উদ্বাস্তুতে ভরে গেল। উদভ্রান্ত আখতার সেবার কাজে, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি ফেরানোর কাজে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। অজাতশত্রু কংগ্রেস নেতা অধ্যাপক আইয়ুব আনসারি খুন হয়ে গেলেন। আখতার হোসেন পরিদর্শনে বেরিয়ে দেখলেন পাড়ার পর পাড়া উজাড়। ‘জনশূন্য এলাকা তার স্তব্ধতার ভাষা দিয়ে নিশ্চিহ্ন হবার কথা জানাচ্ছিল।’ জখমের চিকিৎসা নেই, এখানে ওখানে লাশ। আক্রান্ত পুরুষেরা একত্র হয়ে মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েছিল। আর, পঞ্জাবের কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া থোয়াখালসা-র শিখ রমণীদের মতো বিহারের মুসলমান মেয়েরাও কুয়োয় গণঝাঁপ দিয়ে সম্মান বাঁচিয়েছিল।
বিবিসাহেবার বাড়িতে এক ডিমওয়ালি ডিম দিয়ে যেত। নিজের মুরগিগুলি বাঁচাতে গিয়ে সেই ডিমওয়ালি ফুপু কুঁড়েঘর ছেড়ে বেরোতে পারেনি। মুরগিসহ সে পুড়ে মরেছে। বিবিসাহেবা শোকাতুরা। নিরাপত্তার খোঁজে উদ্বাস্তুরা পথে বেরিয়েছে। গাঁধীজির ও কংগ্রেসের তাদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ বিফলে গেল। লিগ স্বজনহারাদের বোঝাল, তাদের আত্মত্যাগে পাকিস্তান ত্বরান্বিত হবে। তারা ইন্শা আল্লা নতুন দেশের, স্বপ্নের দেশের নাগরিক হয়ে যাবে। গাঁধীজি বলেছিলেন দেশভাগ হতে দেবেন না কিন্তু তিনিই ছিলেন দেশভাগের অন্যতম নায়ক। লিগ বলেছিল পাকিস্তান
না হলে আর মুসলমানদের রক্ষা করা যাবে না। কারণ হিন্দুরা প্রস্তাব দিল মমুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে!? জিন্নাহ একরকম বাধ্য হয়েই মুসলমানদেরকে হিন্দু সাম্প্রদায়ীক সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেশ ভাগের দিকেই এগিয়ে গেলেন । দেশভাগ হলই। আসগার হোসেন উল্লসিত আর আখতার হোসেনের মতো কংগ্রেসি মুসলমান, চূড়ান্ত হতাশ আর পর্যুদস্ত।
পাকিস্তান হতেই আসগার হোসেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। যাওয়ার আগে আখতারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আখতার তাঁকে শুভেচ্ছা জানান, আর ‘তাঁর চোখের সামনে শুধু আসগার হোসেন ছিলেন না, অগণিত মুসলমান ভেসে উঠছিল যারা জায়গাজমি সম্পত্তি নানান জিনিসপত্র বিক্রি করে পাকিস্তান চলে যাচ্ছে।’ স্থির হল বড় সরোয়ার হোসেন পরে পাকিস্তান যাবে মেজো ভাই আসগার গুছিয়ে বসার পর। আপাতত ভারতবর্ষ দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়, আর বিবিসাহেবার সংসার ভেঙে যায়। অবস্থাপন্নরাও সবাই চলে গেল না, অনেকেই থেকে গেল, যারা দেশভাগের আগে লিগের সমর্থক ছিল। শুধু তাদের নয়, মুসলমান মাত্রকেই শুনতে হচ্ছে তারা পাকিস্তানের চর, বিশ্বাসঘাতক। তারা পাকিস্তান চেয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর এ দেশে থেকে যাচ্ছে কেন? ভয়ের ব্যাধি তাদের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছিল।
যারা থেকে গিয়েছিল, তারাও জীবিকার ক্ষেত্রে নাজেহাল হয়ে পাকিস্তানে চলে যাবার কথা ভাবত। কিন্তু, পাসপোর্ট-ভিসা প্রবর্তনের পর বৈধ ভাবে পাকিস্তানে যাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। বরং ‘ঘাড়ধাক্কা পাসপোর্টে’ পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়া ছিল সহজ। সেখানে চাকরিও সুলভ। অলস বাঙালিদের চেয়ে নিয়োগকর্তারা পরিশ্রমী বিহারিদের পছন্দ করত। ও দিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে সরোয়ার ভাল নেই। কিন্তু, বিবিসাহেবাকে তিনি জানান, অন্য দেশের নাগরিক বলে তিনি আর ভারতে স্থায়ী ভাবে চলে আসতে পারবেন না। তার বাড়ি এখানে, এখানে পূর্বপুরুষের কবর, সে কেন চলে আসতে পারবে না— বিবিসাহেবার মাথায় ঢোকে না। তাঁর স্বামী শেখসাহেব বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো পাকিস্তান হতে দিতেন, কিন্তু তাকে বিদেশ হতে দিতেন না।
এই আখ্যানের প্রথম অংশের নায়ক যদি আখতার হোসেন, তা হলে দ্বিতীয় অংশ তাঁর পুত্র হামিদকে কেন্দ্র করে লেখা। বাবা আজ উপমন্ত্রী, কিন্তু তিনি সুপারিশ করতে রাজি না হওয়ায় বি এ পাস করেও হামিদের চাকরি হয় না। অভিমানে জানায়, পাকিস্তানে চলে যাবে সে। বিবিসাহেবা সন্ত্রস্ত, ‘আল্লার নামে পাকিস্তান শব্দটা মুখে আনবে না। আরে ভাই, তুমি জানো না, পাকিস্তানে আমি কত কিছু খুইয়েছি।’ বাড়ির দাসীর ছেলে চামু, কলকাতাবাসী হয়ে দারুণ করিতকর্মা হয়েছে। সে ‘ঘাড়ধাক্কা পাসপোর্টে’ হামিদকে পাঠিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানে। বিবিসাহেবার সংসার ভেঙে উপমহাদেশের তিন ভাগে ছড়িয়ে পড়ে। চামুর বড় সম্বন্ধী বদরুল ইসলাম তাকে চাকরি জুটিয়ে দেয়, তার মেয়ে নাজিয়ার সঙ্গে বিয়েও হয় হামিদের পরে। এখানে চলে আসা বিহারিরা মনে করে বাঙালি মুসলমানেরা নামেই মুসলমান, তাদের আচার-আচরণ হিন্দুদের মতো। মেরে মেরে এদের ইসলামি আচরণ শেখানো উচিত। এরা রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে ঘৃণা করে। পারলে, এই নামে-মুসলমানেরা কোরানশরিফও বাংলায় পড়বে। বাঙালি বাড়ির জামাই হামিদ বাঙালিদের সমর্থনের বৃথা চেষ্টা করে।
কিছু দিন পরে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন উত্তেজনা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হলেও এত দিন ক্ষমতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। এ বারের নির্বাচনে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিল। বিহারিরা বাঙালিদের আপন মনে করেনি। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী পুব বাংলায় নির্যাতন ও হত্যা শুরু করলে সেনাদের সাহায্য করে অনেক বিহারি। ‘স্থায়ী বাসিন্দা আর শরণার্থীদের মধ্যে বিভেদ ভয়ানক সত্যের চেহারায় বেরিয়ে পড়ল।’ সৈন্যরা বাঙালিদের উপর যেমন গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনই পাকিস্তান-সমর্থক বিহারিদের উপর শুরু হল মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ। যেমন পাক সেনা, তেমনই মুক্তিবাহিনী অপরাধী-নিরপরাধ নির্বিচারে মানুষের রক্তে হোলি খেলছে।
মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েও চামুমামার দক্ষতায় হামিদ সপরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসতে পারে। বিহারি শরণার্থীদের জন্য ভারতবর্ষে কারও মনে স্নিগ্ধ ভাব নেই, তাদের সবাইকে মনে করা হয় পাকিস্তানের চর। হামিদ বিহারশরিফে এলে দাদিমা বিবিসাহেবা হারানো নাতিকে আলিঙ্গন করেন এবং জানতে চান মামাকে সে সঙ্গে আনেনি কেন। হামিদ জানায়, মামা থাকেন শ্চিম পাকিস্তানে, আর সে এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। বিবিসাহেবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কতগুলো পাকিস্তান হয়েছে?’ তিনি পাকিস্তানকে গালি দেন, সে তাঁর ছেলেদের হরণ করেছে। পর মুহূর্তেই তিনি পাকিস্তানকে আশীর্বাদ করেন, সেখানেই তাঁর বড় ছেলে সরোয়ার মাটি নিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বিবিসাহেবার অবস্থা পাগলের মতো, কখনও ভারতের জয় চান, কখনও পাকিস্তানের। বিবিসাহেবার মেয়ে, হামিদের মা’র মৃত্যু হয়। মেয়ের মৃত্যুর খবর তাঁকে না জানানো হলেও বিবিসাহেবা তার অনুপস্থিতি টের পেয়ে যান। তিনি জানতে চান, ‘তাকে পাকিস্তান নিয়ে চলে যায়নি তো?’ তিনি হাতজোড় করে পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেন, ‘রে পাকিস্তান, এখন আমার পেছন ছাড়, আমি তোর কোনো ক্ষতি করিনি, কোন অপরাধে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস, পাকিস্তান, ও পাকিস্তান।’
হামিদের বউ বাঙালি জানলে গোলমাল হতে পারে, তা ছাড়া তারা এখন পাকিস্তানের নাগরিক। এখানে অবৈধ তাদের অবস্থান। হামিদের ছোট ভাই সাজিদ সরকারের বড় চাকুরে। হামিদের সংস্রবে তার অস্বস্তি হতে পারে। অঘটনঘটনপটীয়সন চামুর দৌলতে হামিদ সপরিবার নেপাল হয়ে উড়োজাহাজে অবশিষ্ট-পাকিস্তানে চলে যেতে পারে। হামিদ চলে যেতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে থেকে যায় বহু বহু বিহারি। পাকিস্তান পরে অনুগ্রহ করে তাদের কিছু সংখ্যককে নিতে রাজি হয়। কিন্তু, হাজার হাজার বিহারি ক্যাম্পে এক পুরুষ ধরে থেকে যায়, আন্তর্জাতিক কৃপার উপর নির্ভর করে। তারা সবাই তো গণহত্যায় অংশ নেয়নি, বহু মানুষ নিরপরাধ ছিল।
এদের কথা আবদুস সামাদের উপন্যাসে আসেনি। এই forgotten minority-র কথা কথাসাহিত্যেও এল না! হামিদ করাচিতে এসে আশ্রয় নেয় মামা আসগার হোসেনের কাছে। হামিদের স্ত্রী বাঙালি জেনে মামা খুবই বিরক্ত। মৃত সরোয়ারের পরিবারের সঙ্গে আসগারের পরিবারের কোনও যোগ নেই। ‘দেশটা ভাগ হতে-হতে তিন টুকরো হয়ে গেল। তাতে আমাদের পরিবার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ এখানেও আগন্তুকদের সঙ্গে স্থায়ী বাসিন্দাদের সম্পর্ক ভাল নয়। যে-কোনও সময় মোহাজিরদের সঙ্গে সিন্ধিদের দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। হামিদ চলে যায় আরবে। এই উপমহাদেশ আদম রফতানি করেই চলেছে; হামিদ সেই অজস্র মানুষের এক জন, যারা বিদেশে উপমহাদেশের ডায়াস্পোরা গড়ে চলেছে, স্বেচ্ছায় বা বাধ্যত। ‘হে সময়, কোথাও তো থামবে।’ সময় থামে না, কিন্তু একটা সময়খণ্ডকে নিয়ে লেখা উপন্যাসকে এক সময় থামিয়ে দিতেই হয়।
‘মানুষ মেরেছি আমি’ অথবা দাঙ্গার দিনে নরহত্যাকালে প্রতিরোধ করিনি, তাই হত মানুষের রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে। মুসলমান যখন হত্যা করেছে হিন্দুকে, হিন্দু যখন হত্যা করেছে মুসলমানকে, শিখ যখন হত্যা করেছে মুসলমানকে, হিন্দু বা মুসলমান যখন হত্যা করেছে শিখকে, সিন্ধি যখন হত্যা করেছে বিহারি মোহাজিরকে, বাংলাদেশে পঞ্জাবি আর বিহারি যখন হত্যা করেছে বাঙালিকে, আবার বাংলাদেশে বাঙাল যখন হত্যা করেছে বিহারিকে, তখন প্রত্যেক ক্ষেত্রে ‘মানুষ মেরেছি আমি’। পৃথিবীর পথে পথে নিহত ভ্রাতাদের ভাই আমি। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অনর্গল শৃঙ্খলে, এই পাপচক্রে আমিই হত, আমিই হন্তা।
সেই পাপের কোন কথা সাহিত্য বলবে, আর কোন কথা বলা থেকে বিরত থাকবে, তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে গূঢ় রাজনীতি। তাই দেশভাগে পূর্ব ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালিদের কথা কিছু বলা হয়, কিন্তু উদ্বাস্তু বিহারিদের কথা বলা হয় না।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে বিহারে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমানদের উপরে চালানো হয় বর্বর গণহত্যার। উঠে এসেছে বিহারী মুসলমানদের দূর্দশার এক অজানা অধ্যায় ।
সূফি বরষণ
আবদুস সামাদ-এর উর্দ্দু সংকলন নাম ‘দো গজ জমিন যে বইয়েতে উঠে এসেছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে বিহারে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমানদের উপরে চালানো বর্বর গণহত্যাগণর চিত্র । দেশভাগে পূর্ব ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালির কথা বলা হলেও উদ্বাস্তু বিহারির কথা বলা হয় না। যে ক্ষত আজও শুকায়নি, বিহারী মুসলমানদের মাঝে যুগ যুগ ধরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেই বর্বর গণহত্যার চিত্র দিনরাত । দেশভাগের জন্য উগ্র সাম্প্রদায়ীক হিন্দু সন্ত্রাসীরা কিভাবে মুসলমানদের উপরে গণহত্যা আর লুটপাট চালায় এই বই একটি প্রমাণ্য চিত্র সেই ভয়ংকর দাঙ্গার ঘটনার ।
ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে স্বাধীনতা তত নয়, স্বাধীনতার সঙ্গে জড়ানো দেশভাগটা যত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। যেন সমস্ত ইংরেজ আমল ধরে নানা জটিলতার গ্রন্থিবন্ধনের মধ্য দিয়ে চলছিল দেশভাগের প্রস্তুতি, আর ১৯৪৭ সালের পর থেকে যা-কিছু এই বিশাল ভূখণ্ডে ঘটছে, সবই ওই দেশভাগের পরিণাম। শ্রীনগরের পথে বিস্ফোরণ হয়ে দাঙ্গা বাধে, অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক শাণিত হয়, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়, ছিটমহল বিনিময় নিয়ে অফুরন্ত আলোচনা চলতেই থাকে, এখনও যে সমস্যা সমাধান হয়নি দেশভাগের ৬৮ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে । তখন ১৯৪৭-এ ঘটে যাওয়া দেশভাগ আর অতীত থাকে না, একেবারে ঘটমান বর্তমান হয়ে ওঠে আজও দাঙ্গা আর দেশভাগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে।
কলকাতা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংবাদপত্র নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক হত্যাকান্ডকে এত ফলাও করে এবং ঘটনারসাথে কাল্পনিক গল্প জুরে দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করে যে এর ফলে বিহারের পাটনায় হিন্দুদের দ্বারা ব্যাপক মুসলমানহত্যাকান্ডকে উস্কে দেয়। সোহরাওয়ার্দী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেন: ‘অমৃত বাজার পত্রিকা এবং কংগ্রেসের অন্যান্য পত্রিকাগুলো বঙ্গীয়প্রাদেশিক পরিষদের সম্পাদকের নামে অকস্মাত একটি বিবৃতি ছাপে যে, ৫০,০০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে এবং অগণিতনারীকে অপহরণ করা হয়েছে। এ খবরে উত্তেজিত হয়ে, যুক্ত প্রদেশের গারমুখতেশ্বারে হিন্দুরা মুসলিমদের লাঞ্ছিত করে এবংগণহত্যা চালায় এবং বিহার প্রদেশের সর্বত্র ১০০,০০০ মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে অবিশ্বাস্য বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করাহয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। চারদিন ধরে বিহারের পল্লী অঞ্চলে হিন্দু দাঙ্গাকারীরা হত্যা, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ, মানুষেরঅঙ্গহানি করার মাধ্যমে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল এবং স্পষ্টতই বেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এর পেছনে বিহার সরকার ও হিন্দুপুলিশ সদস্যদের মদদ ছিল’ [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার (সংকলন), মেমেয়ারস অব হোসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উইথ অ্যা ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্ক’, ইউনিভাসির্টি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১০৫]।
শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গান্ধী দিল্লী থেকে নোয়াখালীর উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করেছেন। কলকাতায় পৌঁছার পর তাঁকে বিহারের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত করে একদল মুসলিম যুবক আগে সেখানে পরিদর্শন করার আহবান জানায়। গান্ধী তাঁদের আহবান প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, ‘তিনি যখন দিল্লী থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, তখন বিহারে কোন দাঙ্গা ছিল না, সুতরাং মাঝপথে এসে তিনি পূর্বে মনঃস্থির করা গন্তব্য পরিবর্তন করতে পারবেন না’।
কামরুদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে লিখেন যে, বিহার
যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মুসলিম যুবকরা মনে করেছিল গান্ধী বিশ্বের দৃষ্টি বিহারের হত্যাযজ্ঞ থেকে সরিয়ে নোয়াখালীরদিকে নিতে চাচ্ছেন। ফলে তাঁরা পরোক্ষভাবে গান্ধীকে কপটতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। গান্ধী তাঁদের এই অভিযোগের উত্তরে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ‘ইতিহাস ওই যুবকদের নয়, বরং আমার পদক্ষেপকেই মূল্যায়ন করবে’। ১৯৪৬ সালের ১৪ নভেম্বর গান্ধী তাঁর সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই, নাতনী মুন্নি গান্ধী, এবং পালিত নাতনী আভা গান্ধীকে নিয়ে নোয়াখালীর দত্তপাড়ায় পৌঁছান। সেখানে তিনি ‘বাংলার প্রাদেশিক সরকারের অতিথি’ হিসেবে অবস্থান করেন।
আবুল হাশিম লিখেছেন, গান্ধী গ্রামে গ্রামে ঘুরে হিন্দুদের মনোবল পুনরুজ্জিবীত করেছিলেন। গান্ধী বিহার এবং পাটনা পরিদর্শন না করায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন। এই বিষয়ে তিনি নিদারুণ দুঃখের সাথে লিখেছেন: ‘গান্ধীজী নোয়াখালী পরিদর্শন করায় নোয়াখালীও কুমিল্লা জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলিমদের নৃশংসতার উপর বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। অপর দিকে, কলকাতা ওবিহারের দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি নৃশংসতার শিকার হয়েছিল মুসলিমরা। কিন্তু গান্ধী কলকাতা ও পাটনায় গেলেন না’ ’[আবুল হাশিম, ইন রেট্রোস্পেক্ট, বাংলাদেশ বুক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৫৬]।
পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জিও লিখেছেন, ‘কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক শাখাগুলোর মদদে পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ সালে বাঙলা ভাগ করে ভারতের অধীনে আলাদা একটি হিন্দু প্রদেশ সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায় [জয়া চ্যাটার্জি, ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কম্যুনালিজম এন্ড পার্টিশন: ১৯৩২-১৯৪৫’, ক্যামব্রিজ ইউনিভাসির্টি প্রেস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ২২৭]।
বিশেষ করে মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীরা যারা কলকাতা এবং পাটনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দুদের ক্ষোভ থেকে মুসলমানদের রক্ষায় বহু চেষ্টা করে গেছেন, তারা গান্ধীর উপর ক্ষুব্ধ হন। কারণ, দাঙ্গার সময় ওই দুই শহরে যেতে গান্ধী উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন। এমন ক্ষুব্ধ তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি পরবর্তীতে পূর্ব বাঙলা, এবং বর্তমানের বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করার মাধ্যমে এই ভূখন্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদে পরিণত হন।
যদিও ইতিহাসে দেখা যায়, গান্ধী সোহরাওয়ার্দীর সক্রিয় সমর্থনে দাঙ্গা পরবর্তী কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনে বেশ কিছু সফল চেষ্টা চালিয়েছেন। সেসময় এক ঈদের দিনে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু মিলে নাঙ্গলডাঙ্গায় অবস্থান করা গান্ধীকে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ একটি উপহার দিয়েছিলেন। উপহারটি ছিল একটি প্যাকেটে মোড়া অবস্থায় কলকাতা এবং পাটনায় হিন্দুদের নৃশংসতার শিকার কিছু মুসলমানের ছবি। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, সেসব ছবির মধ্যে কোনোটি ছিল স্তন কেটে দেয়া মুসলমান নারীর, মস্তক বিচ্ছিন্ন শিশুর, জ্বলন্ত মসজিদের, আবার কোনোটিতে দেখা যাচ্ছিল রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ। এরকম আরো অনেক নৃশংসতার দৃশ্য ছিল।’ গান্ধীকে এ ধরনের উপহার’ দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে শেখ তার স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন, আমরা মহাত্মাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, তার সম্প্রদায়ের লোকজন কী ধরনের অপরাধ করেছে এবং কিভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে [শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (অনুবাদ), ড. ফখরুল আলম, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৬]
এবার মূল আলোচনায় আসি, এখনও বহু মানুষের সত্তার মধ্যে উপস্থিত, তিন দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে নিত্য উপস্থিত এই দেশভাগের প্রচণ্ড অভিঘাত নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে। যত হওয়া উচিত ছিল, তত হয়নি, যে স্তরের হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্র, তেমনই বেসরকারি সমাজ, তেমনই সাহিত্য পরিকল্পিত নীরবতা পালন করেছে। পূর্ববাংলা থেকে হিন্দু বাঙালির উৎখাত হওয়া নিয়ে বাংলায় বেশ কিছু কথাসাহিত্য, নাটক লেখা হয়েছে, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পশ্চিম বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বাঙালি মুসলমানের পূর্ব পাকিস্তানে বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়া নিয়ে সাহিত্য তুলনায় কম লেখা হয়েছে। কলকাতা থেকে যে হাজার বাঙালি মুসলমান ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়ে উদ্বাস্ত হয়ে এসেছে ভিটে মাটি পৈত্রিক সম্পত্তি ছেড়ে এসে তা নিয়ে আমাদের তথাকথিত প্রগতীশীল বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকগণ তেমন কিছুই লিখেননি আর বিহারের মুসলমানদের উদ্বাস্তে ঘটনা তো পরের বিষয়!?
কিন্তু, পূর্ব ভারতবর্ষে আরও এক দল মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছিল, ১৯৪৬-’৪৭ সালে এবং তার পরে, বিহারি মুসলমানরা যে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, তাদের কথা অনুক্ত থেকে গেছে, যেমন ইতিহাসে, তেমনই সাহিত্যে। কী ভাবে তারা উৎখাত হল, কী হল তাদের উত্তরকালীন নিয়তি, তার উত্তর খোঁজেনি বাংলা বা হিন্দি সাহিত্য। এই মানুষগুলির ভাষা ছিল উর্দু, কিন্তু পশ্চিমের দেশভাগ নিয়ে উর্দু সাহিত্য মুখর হলেও, পূর্বের দেশভাগ নিয়ে নীরব রয়েছে বরাবরই । এদের নিয়ে একটি মাত্র উপন্যাস আমার নজরে এসেছে, আবদুস সামাদ-এর ‘দো গজ জমিন’। যার সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত বাংলা তর্জমার নাম ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’।
১৯৪৬ সালের অগস্টে মুসলিম লীগের ডাকা প্রতিবাদ দিবস পালনের সময় কলকাতার হিন্দুরা শুরু করে বর্বর গণহত্যার । কলকাতার প্রত্যাঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্যোগে এবং প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালিতে শুরু হয় হিন্দুবিরোধী দাঙ্গা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব আমরা বারে বারে পাব। শুধু সম্প্রতি কালের গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তত্ত্বের মুখোমুখি হই না আমরা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব চলে আসছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে। এইসবে মূলে ছিল উগ্র হিন্দুদের দেশভাগের পরিকল্পনা আর যেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতা ও বিহারে মুসলমানদের উপরে চালানো হয় বর্বর ভয়াবহ গণহত্যা আর লুট করা হয় মুসলমানদের জমিজমা ও সম্পত্তি। আর তাড়িয়ে পাঠানো হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দিক বিহারী মুসলমানদেরকে !?
কিন্তু, ক্রিয়াও যেমন নিজে নিজে ঘটে না, তাকে ঘটানো হয়, প্রতিক্রিয়াও তেমনই। বানানো ক্রিয়াকে অজুহাত করে সজ্ঞানে প্রতিক্রিয়া ঘটানো হয়। তার পরে সব পক্ষই মুখ মুছে বলতে চায়, যা ঘটেছে প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটে গেছে। এই ভাবে কলকাতার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালিতে দাঙ্গা বাধে। সেখানে হিন্দুর মনে আস্থা জাগাতে, মুসলমানদের মনে শুভবুদ্ধি জাগাতে হাজির হন খালি-পায়ের তীর্থযাত্রী, যাঁকে মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন One-man Boundary Force. নোয়াখালি যাত্রার আগে থেকেই গাঁধীজির কাছে খবর আসতে থাকে বিহারে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। সেখানে ভূমিকা বদলে গেছে, বিহারে আক্রমণকারী হিন্দু আর আক্রান্ত মুসলমান। এখানে রক্তপাত হচ্ছে মুসলমানের, পূর্ব পুরুষের ভিটে থেকে উৎখাত হচ্ছে মুসলমান। বিহারের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও মন্ত্রী ডা. সৈয়দ মাহমুদের লেখা বিবরণ থেকে মুসলমানদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের বৃত্তান্ত পড়ে গাঁধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। মনে হয়, ‘happenings of Noakhali seemed to pale into insignificance.’ মাহমুদ অনুরোধ করেন গাঁধীজি নোয়াখালি ছেড়ে এবার বিহারে চলে আসুন ও বিহারি মুসলমানদের বাঁচান।
খিলাফত আন্দোলনের সময় বিহারে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ভাল ছিল। পরে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়। ডা. সৈয়দ মাহমুদ, অধ্যাপক আবদুল বারির মতো নেতা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস ক্রমে হয়ে উঠছিল হিন্দুর পার্টি আর লিগ হচ্ছিল মুসলমানের পার্টি। শুকনো বারুদ যখন স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায়, তখনই কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গার খবর এসে পৌঁছয় বিহারের শহরে ও গ্রামে। বিহারের বহু মানুষ কলকাতায় কর্মরত ছিল, তারা কলকাতার দাঙ্গায় স্বজন ও সম্পত্তি হারায়। সেখানকার দাঙ্গার কাহিনি ‘gruesome, sometimes exaggerated’ হয়ে বিহারে ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করে। হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানায়। সংবাদপত্রগুলি দায়িত্বহীন ভাবে উত্তেজনা বাড়ায়। ১৯৪৬ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতা এবং পূর্ব বঙ্গের ঘটনার বিরুদ্ধে বিহারে প্রতিবাদ-সভার আয়োজন করা হয়।
কংগ্রেসের উদ্যোগে বিরাট বিরাট আক্রমণাত্মক মিছিল বেরোয়। বিহারে অন্ধকার দেওয়ালি পালন করা হয়; মসজিদে মসজিদে বলা হয়, ওদের শোক, আমাদের উৎসব। দাঙ্গা লেগে যায়, আর হাজার হাজার মুসলমান ধর্মের মানুষের মৃত্যু হয়। ডা. মাহমুদের বিবরণ থেকে জানা যায় হত্যাকাণ্ডে নির্যাতনে উৎখাত হয়ে সাড়ে তিন লক্ষ মুসলমান বাড়ি জমি গহনা নগণ্য দামে বেচে বিহার ছেড়েছে। তিনি নিজে একটি গ্রামে মৃত মানুষে ভরাট পাঁচটি কুয়ো দেখেন, অন্য গ্রামে এমন দশ-বারোটি কুয়ো। অনেক সময় আক্রান্ত মানুষেরা ‘with the courage of despair’ সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, সম্ভ্রমরক্ষায় মেয়েদের হত্যা করেছিল, কিন্তু দাঙ্গাবাজদের জোয়ার তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিল না তা নয়, তারা কিছু মানুষকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু দাঙ্গা প্রতিরোধের ক্ষমতা তাদের ছিল না। বহু কংগ্রেস নেতা, কংগ্রেসের ঘোষিত নীতির কথা ভুলে এই দাঙ্গায় অংশ নেয়। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেন, দুঃখজনক হলেও বিহারের দাঙ্গা বাংলার দাঙ্গাপীড়িত হিন্দুদের বাঁচিয়েছে। বিহারের দাঙ্গার পক্ষে কংগ্রেস নেতারা দিয়েছিলেন সেই প্রতিক্রিয়ার যুক্তি। কিন্তু, গাঁধীজি বা জওহরলাল এই প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব মানতে রাজি ছিলেন না।
এই দাঙ্গায় বিহারে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের অস্তিত্বের ভিত নড়ে যায়। তারা চলে আসে গ্রাম থেকে শহরে। আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে। পরে শুরু হয় দলে দলে বিহার-ত্যাগ। ছিন্নমূলদের মুসলিম লিগ উৎসাহ দেয় বাংলায় চলে যেতে, কেননা মুসলমান-শাসনাধীন বাংলাই হল তাদের পক্ষে ‘land of promise’. দেশভাগের পর পশ্চিম থেকে গণপ্রব্রজনের মাধ্যমে যারা পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, তাদের একটা বড় অংশ ছিল অবাঙালি উর্দুভাষী মুসলমান, বিহারি মুসলমান।
বিহারশরিফ থেকে কিছু দূরে বিন গ্রাম। সেই গ্রামের শেখ হলতাফ হোসেনের উত্তরপুরুষের কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছে আবদুস সামাদের ‘দো গজ জমিন’ আখ্যান। শেখ সাহেব খিলাফত ও পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর ঘরে যিনি বধূ হয়ে এসেছিলেন সেই বিবি সাহেবা ছিলেন খাঁটি সৈয়দ বংশের সন্তান। তাঁর উপস্থিতিতে সংসার শ্রীমন্ত হয়ে ওঠে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দিকে নজর দেওয়া হয়। চিকিৎসা ও লেখাপড়ার কথা ভেবে তাঁর সুপরামর্শে নিকটবর্তী বিহারশরিফে এক হাবেলি নির্মাণ করা হয়। বিন হাউস নামের এই হাবেলি হয়ে ওঠে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্র। নিজের সুশিক্ষিত বড় ছেলে সরোয়ারের সঙ্গে শেখ সাহেব বিয়ে দেন নিজের অনাথ ভাইঝির, আর ভাগনে আখতার হোসেনের সঙ্গে বিয়ে দেন নিজের বড় মেয়ের।
এই ভাগনে এবং জামাই আখতার হোসেন ছিলেন শেখ সাহেবের মতোই স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক। শেখ সাহেবের অকালমৃত্যুর পর তিনিই এই সংসারের হাল ধরেন বিবি সাহেবার অনুরোধে। এ দিকে, শেখ সাহেবের সম্মতির অপেক্ষা না করে মেজো ছেলে আসগার হোসেনের বিয়ে দিয়ে দেন শেখসাহেবেরই মামা তাঁর পিতৃমাতৃহীন নাতনির সঙ্গে। এই মামা ছিলেন ইংরেজ-অনুগত। বাড়িতে লাটসাহেব এলে মাইলের পর মাইল লাল কার্পেট বিছিয়ে দিতেন। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে খানবাহাদুর পদবি পান তিনি। বিহারে যখন কংগ্রেসের মুসলমান নেতাদের প্রতিপত্তি মুসলমান এলাকায় দ্রুত কমতে থাকল এবং বাড়তে থাকল মুসলিম লিগের প্রভাব, তখন ইংরেজপ্রেমী দাদা শ্বশুরের প্রভাবে আসগার হোসেন হয়ে উঠলেন লিগের সমর্থক ও পরে আঞ্চলিক নেতা। তিনি বিন হাউসে এলে বাড়ি লিগ ও পাকিস্তানের জয়ধ্বনিতে, কংগ্রেসের ও গাঁধীজির মুর্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত হয়। খদ্দরের পোশাক পরা কংগ্রেস নেতা আখতার হোসেন সেই বাড়িতে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে থাকেন।
দুই আত্মীয়ের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় ছাড়া কোনও যোগ নেই। সর্বংসহা বিবিসাহেবা যেন ভারতবর্ষের প্রতীক, আর বিন হাউসের মানুষদের সম্পর্কের ভাঙনের মধ্যে যেন ভারত-ভাগের পূর্বাভাস। আখতার হোসেনের আদর্শে জমিদারির সমস্ত এলাকা স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্পিত ছিল। কিন্তু ভোট আসতেই পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে গেল। নির্বাচনে জয়ী হল লিগ। কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে, দ্বিতীয় স্থান পেল হিন্দু মহাসভা। আখতার হোসেন অন্তর্মুখী হয়ে গেলেন।
পঞ্জাবের ও বাংলার দাঙ্গার খবর বিহারে ছড়িয়ে পড়ছিল। লিগ মুসলমানদের মনে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছে। বলেছে, মুসলমানেরা শাসকের জাতি, তারা কোনও দিন হিন্দুর গোলামি করবে না। হিন্দুদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তীব্র হচ্ছিল। দাঙ্গা লাগতে পারে, এই আশঙ্কায় আখতার হোসেন গাঁধীজির অনুগামীদের সঙ্গে, প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। জনসভায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শপথ নেওয়ানো হল, কিন্তু দাঙ্গা থামানো গেল না। বাস্তুচ্যুত মানুষ বিহারশরিফে আসতে লাগল, স্টেশন, মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা উদ্বাস্তুতে ভরে গেল। উদভ্রান্ত আখতার সেবার কাজে, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি ফেরানোর কাজে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। অজাতশত্রু কংগ্রেস নেতা অধ্যাপক আইয়ুব আনসারি খুন হয়ে গেলেন। আখতার হোসেন পরিদর্শনে বেরিয়ে দেখলেন পাড়ার পর পাড়া উজাড়। ‘জনশূন্য এলাকা তার স্তব্ধতার ভাষা দিয়ে নিশ্চিহ্ন হবার কথা জানাচ্ছিল।’ জখমের চিকিৎসা নেই, এখানে ওখানে লাশ। আক্রান্ত পুরুষেরা একত্র হয়ে মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েছিল। আর, পঞ্জাবের কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া থোয়াখালসা-র শিখ রমণীদের মতো বিহারের মুসলমান মেয়েরাও কুয়োয় গণঝাঁপ দিয়ে সম্মান বাঁচিয়েছিল।
বিবিসাহেবার বাড়িতে এক ডিমওয়ালি ডিম দিয়ে যেত। নিজের মুরগিগুলি বাঁচাতে গিয়ে সেই ডিমওয়ালি ফুপু কুঁড়েঘর ছেড়ে বেরোতে পারেনি। মুরগিসহ সে পুড়ে মরেছে। বিবিসাহেবা শোকাতুরা। নিরাপত্তার খোঁজে উদ্বাস্তুরা পথে বেরিয়েছে। গাঁধীজির ও কংগ্রেসের তাদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ বিফলে গেল। লিগ স্বজনহারাদের বোঝাল, তাদের আত্মত্যাগে পাকিস্তান ত্বরান্বিত হবে। তারা ইন্শা আল্লা নতুন দেশের, স্বপ্নের দেশের নাগরিক হয়ে যাবে। গাঁধীজি বলেছিলেন দেশভাগ হতে দেবেন না কিন্তু তিনিই ছিলেন দেশভাগের অন্যতম নায়ক। লিগ বলেছিল পাকিস্তান
না হলে আর মুসলমানদের রক্ষা করা যাবে না। কারণ হিন্দুরা প্রস্তাব দিল মমুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে!? জিন্নাহ একরকম বাধ্য হয়েই মুসলমানদেরকে হিন্দু সাম্প্রদায়ীক সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেশ ভাগের দিকেই এগিয়ে গেলেন । দেশভাগ হলই। আসগার হোসেন উল্লসিত আর আখতার হোসেনের মতো কংগ্রেসি মুসলমান, চূড়ান্ত হতাশ আর পর্যুদস্ত।
পাকিস্তান হতেই আসগার হোসেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। যাওয়ার আগে আখতারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আখতার তাঁকে শুভেচ্ছা জানান, আর ‘তাঁর চোখের সামনে শুধু আসগার হোসেন ছিলেন না, অগণিত মুসলমান ভেসে উঠছিল যারা জায়গাজমি সম্পত্তি নানান জিনিসপত্র বিক্রি করে পাকিস্তান চলে যাচ্ছে।’ স্থির হল বড় সরোয়ার হোসেন পরে পাকিস্তান যাবে মেজো ভাই আসগার গুছিয়ে বসার পর। আপাতত ভারতবর্ষ দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়, আর বিবিসাহেবার সংসার ভেঙে যায়। অবস্থাপন্নরাও সবাই চলে গেল না, অনেকেই থেকে গেল, যারা দেশভাগের আগে লিগের সমর্থক ছিল। শুধু তাদের নয়, মুসলমান মাত্রকেই শুনতে হচ্ছে তারা পাকিস্তানের চর, বিশ্বাসঘাতক। তারা পাকিস্তান চেয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর এ দেশে থেকে যাচ্ছে কেন? ভয়ের ব্যাধি তাদের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছিল।
যারা থেকে গিয়েছিল, তারাও জীবিকার ক্ষেত্রে নাজেহাল হয়ে পাকিস্তানে চলে যাবার কথা ভাবত। কিন্তু, পাসপোর্ট-ভিসা প্রবর্তনের পর বৈধ ভাবে পাকিস্তানে যাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। বরং ‘ঘাড়ধাক্কা পাসপোর্টে’ পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়া ছিল সহজ। সেখানে চাকরিও সুলভ। অলস বাঙালিদের চেয়ে নিয়োগকর্তারা পরিশ্রমী বিহারিদের পছন্দ করত। ও দিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে সরোয়ার ভাল নেই। কিন্তু, বিবিসাহেবাকে তিনি জানান, অন্য দেশের নাগরিক বলে তিনি আর ভারতে স্থায়ী ভাবে চলে আসতে পারবেন না। তার বাড়ি এখানে, এখানে পূর্বপুরুষের কবর, সে কেন চলে আসতে পারবে না— বিবিসাহেবার মাথায় ঢোকে না। তাঁর স্বামী শেখসাহেব বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো পাকিস্তান হতে দিতেন, কিন্তু তাকে বিদেশ হতে দিতেন না।
এই আখ্যানের প্রথম অংশের নায়ক যদি আখতার হোসেন, তা হলে দ্বিতীয় অংশ তাঁর পুত্র হামিদকে কেন্দ্র করে লেখা। বাবা আজ উপমন্ত্রী, কিন্তু তিনি সুপারিশ করতে রাজি না হওয়ায় বি এ পাস করেও হামিদের চাকরি হয় না। অভিমানে জানায়, পাকিস্তানে চলে যাবে সে। বিবিসাহেবা সন্ত্রস্ত, ‘আল্লার নামে পাকিস্তান শব্দটা মুখে আনবে না। আরে ভাই, তুমি জানো না, পাকিস্তানে আমি কত কিছু খুইয়েছি।’ বাড়ির দাসীর ছেলে চামু, কলকাতাবাসী হয়ে দারুণ করিতকর্মা হয়েছে। সে ‘ঘাড়ধাক্কা পাসপোর্টে’ হামিদকে পাঠিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানে। বিবিসাহেবার সংসার ভেঙে উপমহাদেশের তিন ভাগে ছড়িয়ে পড়ে। চামুর বড় সম্বন্ধী বদরুল ইসলাম তাকে চাকরি জুটিয়ে দেয়, তার মেয়ে নাজিয়ার সঙ্গে বিয়েও হয় হামিদের পরে। এখানে চলে আসা বিহারিরা মনে করে বাঙালি মুসলমানেরা নামেই মুসলমান, তাদের আচার-আচরণ হিন্দুদের মতো। মেরে মেরে এদের ইসলামি আচরণ শেখানো উচিত। এরা রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে ঘৃণা করে। পারলে, এই নামে-মুসলমানেরা কোরানশরিফও বাংলায় পড়বে। বাঙালি বাড়ির জামাই হামিদ বাঙালিদের সমর্থনের বৃথা চেষ্টা করে।
কিছু দিন পরে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন উত্তেজনা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হলেও এত দিন ক্ষমতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। এ বারের নির্বাচনে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিল। বিহারিরা বাঙালিদের আপন মনে করেনি। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী পুব বাংলায় নির্যাতন ও হত্যা শুরু করলে সেনাদের সাহায্য করে অনেক বিহারি। ‘স্থায়ী বাসিন্দা আর শরণার্থীদের মধ্যে বিভেদ ভয়ানক সত্যের চেহারায় বেরিয়ে পড়ল।’ সৈন্যরা বাঙালিদের উপর যেমন গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনই পাকিস্তান-সমর্থক বিহারিদের উপর শুরু হল মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ। যেমন পাক সেনা, তেমনই মুক্তিবাহিনী অপরাধী-নিরপরাধ নির্বিচারে মানুষের রক্তে হোলি খেলছে।
মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েও চামুমামার দক্ষতায় হামিদ সপরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসতে পারে। বিহারি শরণার্থীদের জন্য ভারতবর্ষে কারও মনে স্নিগ্ধ ভাব নেই, তাদের সবাইকে মনে করা হয় পাকিস্তানের চর। হামিদ বিহারশরিফে এলে দাদিমা বিবিসাহেবা হারানো নাতিকে আলিঙ্গন করেন এবং জানতে চান মামাকে সে সঙ্গে আনেনি কেন। হামিদ জানায়, মামা থাকেন শ্চিম পাকিস্তানে, আর সে এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। বিবিসাহেবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কতগুলো পাকিস্তান হয়েছে?’ তিনি পাকিস্তানকে গালি দেন, সে তাঁর ছেলেদের হরণ করেছে। পর মুহূর্তেই তিনি পাকিস্তানকে আশীর্বাদ করেন, সেখানেই তাঁর বড় ছেলে সরোয়ার মাটি নিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বিবিসাহেবার অবস্থা পাগলের মতো, কখনও ভারতের জয় চান, কখনও পাকিস্তানের। বিবিসাহেবার মেয়ে, হামিদের মা’র মৃত্যু হয়। মেয়ের মৃত্যুর খবর তাঁকে না জানানো হলেও বিবিসাহেবা তার অনুপস্থিতি টের পেয়ে যান। তিনি জানতে চান, ‘তাকে পাকিস্তান নিয়ে চলে যায়নি তো?’ তিনি হাতজোড় করে পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেন, ‘রে পাকিস্তান, এখন আমার পেছন ছাড়, আমি তোর কোনো ক্ষতি করিনি, কোন অপরাধে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস, পাকিস্তান, ও পাকিস্তান।’
হামিদের বউ বাঙালি জানলে গোলমাল হতে পারে, তা ছাড়া তারা এখন পাকিস্তানের নাগরিক। এখানে অবৈধ তাদের অবস্থান। হামিদের ছোট ভাই সাজিদ সরকারের বড় চাকুরে। হামিদের সংস্রবে তার অস্বস্তি হতে পারে। অঘটনঘটনপটীয়সন চামুর দৌলতে হামিদ সপরিবার নেপাল হয়ে উড়োজাহাজে অবশিষ্ট-পাকিস্তানে চলে যেতে পারে। হামিদ চলে যেতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে থেকে যায় বহু বহু বিহারি। পাকিস্তান পরে অনুগ্রহ করে তাদের কিছু সংখ্যককে নিতে রাজি হয়। কিন্তু, হাজার হাজার বিহারি ক্যাম্পে এক পুরুষ ধরে থেকে যায়, আন্তর্জাতিক কৃপার উপর নির্ভর করে। তারা সবাই তো গণহত্যায় অংশ নেয়নি, বহু মানুষ নিরপরাধ ছিল।
এদের কথা আবদুস সামাদের উপন্যাসে আসেনি। এই forgotten minority-র কথা কথাসাহিত্যেও এল না! হামিদ করাচিতে এসে আশ্রয় নেয় মামা আসগার হোসেনের কাছে। হামিদের স্ত্রী বাঙালি জেনে মামা খুবই বিরক্ত। মৃত সরোয়ারের পরিবারের সঙ্গে আসগারের পরিবারের কোনও যোগ নেই। ‘দেশটা ভাগ হতে-হতে তিন টুকরো হয়ে গেল। তাতে আমাদের পরিবার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ এখানেও আগন্তুকদের সঙ্গে স্থায়ী বাসিন্দাদের সম্পর্ক ভাল নয়। যে-কোনও সময় মোহাজিরদের সঙ্গে সিন্ধিদের দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। হামিদ চলে যায় আরবে। এই উপমহাদেশ আদম রফতানি করেই চলেছে; হামিদ সেই অজস্র মানুষের এক জন, যারা বিদেশে উপমহাদেশের ডায়াস্পোরা গড়ে চলেছে, স্বেচ্ছায় বা বাধ্যত। ‘হে সময়, কোথাও তো থামবে।’ সময় থামে না, কিন্তু একটা সময়খণ্ডকে নিয়ে লেখা উপন্যাসকে এক সময় থামিয়ে দিতেই হয়।
‘মানুষ মেরেছি আমি’ অথবা দাঙ্গার দিনে নরহত্যাকালে প্রতিরোধ করিনি, তাই হত মানুষের রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে। মুসলমান যখন হত্যা করেছে হিন্দুকে, হিন্দু যখন হত্যা করেছে মুসলমানকে, শিখ যখন হত্যা করেছে মুসলমানকে, হিন্দু বা মুসলমান যখন হত্যা করেছে শিখকে, সিন্ধি যখন হত্যা করেছে বিহারি মোহাজিরকে, বাংলাদেশে পঞ্জাবি আর বিহারি যখন হত্যা করেছে বাঙালিকে, আবার বাংলাদেশে বাঙাল যখন হত্যা করেছে বিহারিকে, তখন প্রত্যেক ক্ষেত্রে ‘মানুষ মেরেছি আমি’। পৃথিবীর পথে পথে নিহত ভ্রাতাদের ভাই আমি। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অনর্গল শৃঙ্খলে, এই পাপচক্রে আমিই হত, আমিই হন্তা।
সেই পাপের কোন কথা সাহিত্য বলবে, আর কোন কথা বলা থেকে বিরত থাকবে, তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে গূঢ় রাজনীতি। তাই দেশভাগে পূর্ব ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালিদের কথা কিছু বলা হয়, কিন্তু উদ্বাস্তু বিহারিদের কথা বলা হয় না।
No comments:
Post a Comment