সূফি বরষণ
একটি গল্প বা চলচ্চিত্রের কল্পনার জগতের ঘটনা বাস্তব হয়ে ফিরে কি? মাঝেমধ্যে হয়তোবা আসে তার প্রমাণ বহন্নলা চলচ্চিত্র । আসলে এই বিতর্কের নেপথ্যে বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত্ ধ্বংস করে ভারতীয় ছবি আমদানির ষড়যন্ত্র । জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির পর থেকেই ‘বৃহন্নলা’ ছবিটির বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত নকলের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ? ‘বৃহন্নলা’ ছবি সংশ্লিষ্ট পুরস্কার বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কর্তৃপক্ষ। শুধু পুরস্কার বাতিল করা–ই নয়, পরিচালক মুরাদ পারভেজের বিরুদ্ধেও নাকি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি হচ্ছে বলেই জানিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র। আসলে প্রিয় পাঠক যে মিলের কথা বলা হচ্ছে তাতে তেমন মিল নেই। পরিচালককে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র হতে পারে এটা। আসলে ভালো বাংলা ছবির ভবিষ্যত্ নষ্ট করতে এটি একটি পরিষ্কার ষড়যন্ত্র । পৃথিবীর বহু কবি সাহিত্যিকের লেখা হুবহু মিল পাওয়া যায়। কিন্তু একে অপরের সাথে দেখা হয়নি বা ঐ ভাষা জানা না থাকার কারণে পড়ে নকল করা কোনো সুযোগ ছিলনা। মানুষের কল্পনার জগতের মিল রয়েছে, সেটা দেশ স্থান কাল আর ভাষার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও মানুষের মনোজগতের চিন্তার মিল এক এবং অভিন্ন । বিখ্যাত তরুণ মেধাবী ব্রিটিশ বাংলাদেশী গবেষক মনোচিকিত্সক ডাক্তার নাজমুল হোসাইন আমাকে এইকথা বলেন ।
সরকারি অনুদানে নির্মিত মুরাদ পারভেজের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘বৃহন্নলা’র মূল কাহিনি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্প ‘গাছটি বলেছিল’ থেকে নেওয়া বলে অভিযোগ উঠেছে । আমাদের সমস্যা হলো ঢাকার সিনেমায় ভালো ছবি দেখতে পায়না, তাই দীর্ঘকাল পর একটি ভালো ছবি বিখ্যাত হওয়ায় বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি। এবারও তাই হয়েছে। আমি মূল গল্পটা পড়েছি এবং ছবিটাও দেখেছি কিন্তু তাতে যে মিলের কথা বলা হচ্ছে তা খুবই সামান্য এবং বলতে গেলে কাকতালীয়। চলচ্চিত্রটি পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলে নানা সমালোচনা।
নো ম্যানস ল্যান্ডের বৃহন্নলা গাছ। ছবির প্রথম শট বুড়ি গিয়েছিল গাছটার তলায় পাতা কুড়াতে। গাছটা তাকে বলল, মর মর মর। বুড়ি চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলারা জামান। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘গাছটা বলেছিল’ গল্পের কিছুটা অনুকরণ করে তৈরী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ পাওয়া সেরা ছবি হিসেবে বৃহন্নলা। ছবির নাম বৃহন্নলা কেন? গল্পের ভাষায়, ‘গাছটা ছিল ফলহীন। কোনো ফুলও ফুটতে দেখা যায়নি তার ডালপালার ডগায়...নর নও, নারীও নও। তুমি কি বৃহন্নলা অর্জুন?’ ‘গাছটা বলেছিল’ গল্পে বৃহন্নলা শব্দটি অনেক বার আছে। বৃহন্নলা ছবির যে ডিভিডি প্রকাশিত হয়েছে, তার কভারে বৃহন্নলার নামাকরণ নিয়ে লেখা আছে, ‘প্রাচীন এই গাছটির কোনো ফল নেই, ফুল নেই। তাই এটি বৃহন্নলা গাছ।’
বৃহন্নলা ছবির গল্পও ‘গাছটা বলেছিল’ গল্পের কিছুটা অনুকরণ লক্ষ্য করা যায়। দুই পাশে হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত দুটি গ্রাম এবং একটি গাছকে কেন্দ্র করে গল্পের ঘটনা শুরু হয়। ‘গাছটা বলেছিল’ গল্পটি লোকজ পুরাণ আশ্রিত একটি রাজনৈতিক গল্প। অতি প্রাকৃত রূপক দিয়ে এটি একটি ক্ষমতা দখল, গ্রামীণ মানুষের ধর্মকেন্দ্রিক কূটচালের গল্প। গল্পে গাঁয়ের সেরা অবিশ্বাসী, সতত উন্নাসিক আরসিনিক এক প্রৌঢ়, ছবির যুক্তিবাদী আরজ ডাক্তার (আজাদ আবুল কালাম)। গল্পে রসিক মনজুর হোসেন ছবির মাস্টারমশায় (মানস বন্দ্যোপাধ্যায়)। গল্পের পাচু চোর ছবিতে চোর চরিত্রে অভিনয় করে। গল্পের তরুণ ডাক্তার অসীম বোস ছবিতে মুসলিম ডাক্তার (ফেরদৌস)। কিন্তু মূল গল্পের ডাক্তার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে ।
গল্পের মধ্যে ডাক্তারের সাথে পাড়ার হিন্দু মহিলার প্রেম বা পালিয়ে যাওয়া আবার ফিরে আসা এইসব কিছুই নেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘গাছটা বলেছিল’ গল্পের মধ্যে । আবার এই দৃশ্যও গল্পের মধ্যে নেই যে গাছতলায় স্কুল হয়েছে এবং দীর্ঘকাল পরে ডাক্তার সেই স্কুলের মাস্টার হয়ে একই গ্রামে ফিরে এসেছেন । আবার গল্পের মধ্যে অদৃশ্য একটি চরিত্র আছে যেটা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের নিজের চরিত্র কিন্তু এই চরিত্র চলচ্চিত্রের মধ্যে নেই।
গল্পের হাজি ছবিতেও হাজি। গল্পে বুড়ির ছেলেবউ (সোহানা সাবা) কেঁদে কেঁদে চিড় খাওয়া কণ্ঠে কীভাবে তার শাশুড়ি হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ঢুকেছিল আর ধপ করে দাওয়ায় বসে জল চেয়েছিল—এ বর্ণনার অবিকল দৃশ্যায়ন রয়েছে ছবিতে। বৃহন্নলা গাছটির বর্ণনা দিতে গিয়ে গল্পে আছে, ‘তাকে বুড়ি করে খেলত সেই সব নিরক্ষুৎ কাতর বালক-বালিকারা।’ এই ছবির ডিভিডির কভারে রয়েছে, ‘একসময় গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা তাকে বুড়ি বানিয়ে বৌছি খেলত সেকথা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্পের মধ্যে নেই। এবং গল্পের মধ্যে বুড়ির ছেলেবউ শুরু পানি আনা পর্যন্তই শেষ । কিন্তু চলচ্চিত্রে ডাক্তারকে হিন্দুদের পক্ষে নেয়ার জন্য ছেলের বউকে লেলিয়ে দেয়া দীর্ঘ সংলাপ বা তাঁর স্বামীর চরিত্রের বর্ণনা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্পের মধ্যে নেই। আসলে পরিচালককে ফাঁসানো হয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র করে।
গল্পের শেষ হয় গাছকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা দিয়ে, আর ছবির শেষ গাছকে কেন্দ্র করে স্কুল গড়ে ওঠা দিয়ে মধ্যদিয়ে। বৃহন্নলা ছবিটি অবচেতন মিল, এটি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প ‘গাছটা বলেছিল’ থেকে পরিচালক ভাব ভাবনা, দর্শন, বিষয়, রূপ-রস, চরিত্র এবং নামটিও গ্রহণ বা গল্পটা পড়ে থাকতে পারেন আবার নাও পড়তে পারেন। পরিচালক এটা বলতে পারতেন যে কিছুটা মিল আছে ।'
অপরদিকে ‘বৃহন্নলা’ ছবির পুরস্কার বাতিল করায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মাসুদ পথিকের ‘নেক্কাবরের মহাপ্রয়াণ’ হতে যাচ্ছে সেরা চলচ্চিত্র। আর ‘মেঘমল্লার’ ছবির জন্য সেরা কাহিনিকার নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং একই ছবির জন্য জাহিদুর রহিম অঞ্জন পেতে যাচ্ছেন সেরা সংলাপ রচয়িতা পুরস্কার। তর্ক-বিতর্কের শুরু এই প্রথম নয়। ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৪’তে সমালোচকদের বিচারে সেরা সিনেমা হয় ‘বৃহন্নলা’। তখনও কেউ কথা বলেনি কেন ?? এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় জানানো হয়, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ বিভাগে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪’ গেছে মুরাদ পারভেজ পরিচালিত ‘বৃহন্নলা’ সিনেমাটির ঘরে। সরকারি অনুদানে নির্মিত সিনেমাটির প্রযোজকও তিনি।
এ
বিষয়ে ভারতীয় পত্রিকায়ও প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত হয়, ‘বাংলা ডিরেক্টর লিফটেড ফাদারস স্টোরি : মুস্তাফা সিরাজস সন’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন। এতে সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ছোট ছেলে অমিতাভ সিরাজ দাবি করেন তার বাবার গল্প নিজের নামে ব্যবহার করেছেন মুরাদ পারভেজ। Bangla director lifted father’s
story: Mustafa Siraj’s son http://timesofindia.indiatimes.com/…/articlesh…/48795964.cms
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় ‘বৃহন্নলা’। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের ‘জয়পুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার (মুরাদ পারভেজ) ও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (সোহানা সাবা) বিভাগে পুরস্কার পায় সিনেমাটি। এর পরপরই বিষয়টি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের পরিবারের গোচরে আসে। ২০০৮ সালে মুক্তি পায় সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ‘রানীরঘাটের বৃত্তান্ত’ অবলম্বনে নির্মিত মুরাদের প্রথম সিনেমা ‘চন্দ্রগ্রহণ’। ওই সিনেমাটিও বেশ কয়েকটি শাখার জাতীয় পুরস্কার জেতে। এর আগে একই গল্পে কলকাতায় নির্মিত হয় ‘ফালতু’। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্প ‘গাছটি বলেছিল’ মূল গল্পের লিংক এখানে ।
http://www.galpopath.com/2014/12/blog-post_71.html?m=1
দুই.
গাছটা বলেছিল’ অসাধারণ ছোটগল্প! গল্পের শুরু - বুড়ি গিয়েছিল গাছটার তলায় পাতা কুড়োতে। গাছটা তাকে বলল, মর্ মর্ মর্। ভয় পেয়ে বুড়ি বাড়ি পালিয়ে এলো, আর মরে গেল।
তারপর তদন্ত শুরু। গ্রামের মানুষ - মোড়ল, শিক্ষক, যুক্তিবাদী সবাই মিলে বলল - হার্ট অ্যাটাকেই বুড়ি মারা গেছে। অথচ ডাক্তার অসীম বোস বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখতে চান। গ্রামবাসীদের বিশ্বাসে - কথা-বলা-গাছটিকে তিনি চাক্ষুষ করতে ইচ্ছুক। তারপর তিনি গাছের কাছে গিয়ে ‘হ্যাল্লো’ বলতেই শুনতে পান, গাছটা তাকে বলছে - মর্ মর্ মর্!
পরদিন সকালে ডাক্তার অসীম বোসের মৃত্যুসংবাদ আসে। যদিও তাঁর বিছানার পাশে একটুকরো কাগজে লেখা ছিল - আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তিনি নাকি সায়ানাইড খেয়েছেন। কিন্তু কেন? তার উত্তর মেলে না। তার ফলে গাছটিকে বিপজ্জনক মনে করা হয়।
মূল গল্পের উদ্ধৃতি "
গতকাল দিনশেষে গাছটার কাছে একা এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আজ আমার সঙ্গে এক সুশিক্ষিত ডাক্তার নাগরিক। গাছটার কাছে গিয়ে তিনি সকৌতুকে বললেন, হ্যাল্লো বৃহন্নলা! হোয়াট ডু ইউ স্যে? হোয়াট এ্যাবাউট মি? ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইংলিশ? ওক্কে। বাংলা বোঝো। বলো, কী বলতে চাও। ওর কাঁধ ধরে বললাম, অসীম! অসীম! তুমি যে নোলেদার মতো পাগলামি শুরু করলে!
সহসা তরুন ডাক্তার চিতকার করে উঠলেন, শুনছ, শুনতে পাচ্ছ? বলছে মর্ মর্ মর্।
এই
বলে তিনি ঝোঁপঝাঁড় ঠেলে প্রায় দৌড়ে গেলেন। অন্ধকারে তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। ডাকাডাকি করে গলা ভেঙ্গে গেল। এিই সময় ঝোড়ো হাওয়ায় বৃক্ষলতা তুমুল আলোড়িত হচ্ছিল।
ভয়
পেয়ে আমিও পালিয়ে এলাম। সারটি রাত ঘুমোতে পারিনি। সকালে ডাক্তার অসীম বোসের মৃত্যুর খবরে গ্রামে হইচই পড়ে যায়। এই মৃত্যু একটু অন্যরকম। কারণ বিছানার পাশে স্যুইসাইড্যাল চিরকূট ছিল : ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’।
তিনি ডাক্তার। সাইনাইড খেয়েছিলেন।......"
পঞ্চায়েত থেকে গাছটিকে কেটে ফেলার কথা ভাবে অথচ কিছু মানুষ গাছটিকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতে থাকে। হিন্দুপাড়া ও মুসলমানপাড়ার মাঝে নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে মাথা-তুলে-দাঁড়ানো গাছটিকে নিয়ে গাঁয়ে রণক্ষেত্রের পরিবেশ তৈরি হয়। এ থেকে বোঝা যায় - কুসংস্কার জিনিসটা একশ্রেণির ভাইরাস, যা মহামারি বাধায়।
গল্পের শেষ অংশের উদ্ধৃতি "এরপর গাছটি বিপজ্জনক ঘোষিত হয় পঞ্চায়েত অফিস থেকে। গাছটি কেটে ফেলার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু স্থানীয় কোনও কাঠুরিয়া ঝুকি নিতে চাইল না। দুরে সদরের কাঠগোলার করাতিদের ডেকে আনা হয়েছিল সে কারণে। তারা সবে এসে পৌঁছেছে, পঞ্চায়েত প্রধানরা খাতির করে তাদের নিয়ে আসছেন, সহসা গাছটার তলায় ঢাকঢোলের শব্দ! কাসির শব্দ। বেতো নরেনবাবু ছড়ি নেড়ে বললেন, পুঁজো হচ্ছে। দেবতা কাঁটা চলবে না।
স্কুলশিক্ষক মনজুর হোসেন চ্যাচামেচি করে বললেন, রেজোলিউশন! আনঅ্যানিমাসলি অ্যাক্সেপ্টেড রেজোলিউশন। লাটুবাবুও সই করেছেন। লাটুবাবু বেগতিক দেখে কেটে পড়েছেন। ঢাকঢোল কাসিওলারা হাত থামিয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছিল। আমি সেই কেয়াঝোপের অাঁড়ালে। চূড়ান্ত মুহুর্তের জন্য কাউন্ট-ডাউন শুরু। তিন....দুই...এক....
বৃহন্নলা! তুমি কথা বলো! বৃহন্নলা! এই সব দ্বিপদ প্রাণীগুলির তড়পানি কেন সহ্য করছ তুমি? তুমি স্বয়ং প্রকৃতি এ দৌরাত্ম অসহ্য। বৃহন্নলা! মুখ খোলো! আর প্রত্যাশিত বাতাসটা এল। বৃক্ষলতা জুড়ে নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে বিশাল স্লোগান। মার, মার শালাদের। মার, মার, মার....
আচম্বিত একটি বোমা ফাঁটল। আবার বোমা ফাঁটল। হল্লা, রণহুঙ্কার, ক্রমাগত বোমা বারুদের কটু গন্ধ। ধোঁয়া। গাছটা নিশ্চয় বলছিল, মর্ মর্ মর্। আর লোকগুলি মরছিল। গাছটা বার বার বলে থাকবে, মর্ মর্ মর্। কারণ লোকগুলি বারবার মরছিল। চাপ চাপ রক্ত। নো-ম্যান্স-ল্যান্ড রক্তে লাল হচ্ছিল। প্রকৃতিতে তখন বসন্তকাল। এ সময় মৃত্যুও রক্তিম সৌন্দর্য হয়।" পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্প ‘গাছটি বলেছিল’ মূল গল্পের লিংক এখানে ।
http://www.galpopath.com/2014/12/blog-post_71.html?m=1
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রায় আড়াইশো বই লিখেছেন। সে-সব বই মূলত উপন্যাস, ছোটগল্প, কিশোরদের রহস্য উপন্যাস। তিনি ব্যতিক্রমী ধারার সার্থক উপন্যাসলেখক। পূর্বোক্ত উপন্যাসের সঙ্গে বন্যা, নিশিমৃগয়া, নিষিদ্ধ প্রান্তর, প্রেম ঘৃণা দাহ, কামনার সুখ-দুঃখ, আসমানতারা, সীমান্ত বাঘিনী, কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি, হেমন্তের বর্ণমালা, বসন্ততৃষ্ণা, নিষিদ্ধ অরণ্য, নটী নয়নতারা, প্রেমের নিষাদ, হিজলকন্যা প্রভৃতি অনেক উপন্যাস আলোচনার অপেক্ষা রাখে।
সিরাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস অলীক মানুষ। এই উপন্যাস লেখার প্রস্ত্ততিপর্বে ইতিহাস দর্শন, সাহিত্য, নানা ধর্মের ধর্মশাস্ত্র, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর তিনি গভীর পড়াশোনা করেছেন। চতুরঙ্গ পত্রিকার আমন্ত্রণে অলীক মানুষ উপন্যাস লেখা শুরু করেন। আটটি পরিচ্ছেদ লেখার পর তিনি চতুরঙ্গ সম্পাদককে লেখায় বিরতি টানার কথা জানান। আত্মকথায় সিরাজ স্পষ্ট করে লিখেছেন, ‘আমার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তোমার শরীরে পবিত্র পুরুষ হজরত মুহম্মদের রক্তধারা আছে। আমরা সৈয়দ বংশীয়। তিনি বলেন ছোটবেলায় দেখেছি - ভারতীয় কম্যুনিস্ট দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজঃফর আহমদকে আমাদের মাটির বাড়ির দোতলায় লুকিয়ে থাকতে। তখন উনি ছিলেন আন্ডার গ্রাউন্ডে। সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী ও আনোয়ারা বেগমের বড় ছেলে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। ১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর জন্ম। ন-বছর বয়সে সিরাজ মাতৃহারা। নির্বাসিত বৃক্ষে ফুটে আছে শীর্ষক আত্মকথায় সিরাজ লিখেছেন, ‘জন্মেছিলাম মুর্শিদাবাদ জেলার রাঢ় অঞ্চলের পাড়াগাঁয়ে।
সিরাজের প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নীলঘরের নটী (১৯৬৬)। তারপর হিজলকন্যা (১৯৬৭), তৃণভূমি (১৯৭০), মায়ামৃদঙ্গ (১৯৭২), উত্তর জাহ্নবী (১৯৭৪), নিলয় না জানি (১৯৭৬) প্রভৃতি উপন্যাসে রাঢ়-বাংলার নিসর্গপ্রকৃতির উদ্দাম বন্যভাব এবং প্রান্তিক মানুষের বিচিত্র জীবনধারা লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোয় উজ্জ্বল। তাঁর দেখা দুরন্ত গেছোমেয়ে হিজলকন্যা - যাদের দুরন্ত ভালোবাসার আবেগে ছিল লজ্জা-দ্বিধাহীন প্রকাশ। হিজরোল, ময়নাডাঙা, মরাডুংরি, ধুলোউড়ি, সোনাটিকুরির বিস্তীর্ণ প্রান্তিক জীবন ও নিসর্গ প্রকৃতির সজীবতা তৃণভূমি উপন্যাসে চিত্রিত। নিশানাথের চোখে - ‘সারা তৃণভূমিকে মনে হয় জীবন্ত - কোষে কোষে তাজা রক্তমাংসের মতো অনুভূতি... সজীব সতর্ক সব কিছু। পশুপাখি, কীটপতঙ্গের জীবজগত সেই বিস্তৃত আর সজীব কোষে কোষে বিন্যস্ত সত্তার অংশমাত্র - গাছের ফুল-ফলের মতো একটা প্রস্ফুটিত পরিণতি।’
http://www.kaliokalam.com/…/%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0…/
তিন.
ঢাকার চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রগ্রহণ’ (২০০৮)। কলকাতার চলচ্চিত্র ‘ফালতু’ (২০০৬)। এই দুটো চলচ্চিত্রেরই কাহিনীসূত্র পশ্চিমবঙ্গের লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প, শিরোনাম ‘রানীর ঘাটের বৃত্তান্ত’। সেই গল্প অবশ্য আমার পড়া ছিল না। ফালতু চরিত্রটি নদীর ঘাটে গড়ে ওঠা বাজারের এক পাগলীর ছেলে। জন্ম দিয়ে মা মারা গেলে, ‘জারজ’ শিশুটিকে আদরযত্নে বড় করতে থাকে, বাজারের সবাই — দোকানি,পুরোহিত, টাউট আর যারা যারা থাকে। কারণ সবাই মনে করতে থাকে এই সন্তানটি তারই হবে। দারুণ গল্প। চন্দ্রগ্রহণ-এ সন্তানটি ছেলে না হয়ে মেয়ে,এই পার্থক্য। চন্দ্রগ্রহণ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। ভালো গল্প, ভালো চলচ্চিত্র। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু মুরাদ বলছেন,কাহিনীতে কিছু মিল থাকতে পারে, কিন্তু গল্পটা তার নিজেরই।
আমার ব্যক্তিগত প্রশ্ন হলো জাতীয় পুরস্কারের আগে, মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কারও পেয়েছে ‘বৃহন্নলা’,শ্রেষ্ঠ ছবি ক্যাটাগরিতে। এই চলচ্চিত্রটির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ও ‘মেঘমল্লার’। আমার চলচ্চিত্রটি ভালো লেগেছে , শেষের গোঁজা মিলটুকু ছাড়া। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির পর অনেকে বলা শুরু করেছেন,জুরিরা কি সাহিত্যের কোনো খবর রাখেন না, চুরি করা গল্পকে পুরস্কার দিয়ে দিলেন? বেশ লজ্জার এক ব্যাপার,সেই লজ্জায় এখন আমরা পড়লাম কিনা সেটা এখন প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হয়ে রইল, নাকি পরিচালককে বিতর্কের মধ্যে ফেলে আমাদের সুনাম নষ্ট করে ভারতীয় চলচ্চিত্র বাংলাদেশে আমদানির ষড়যন্ত্র সেটাও ভেবে দেখতে হবে ।
এই
ঘটনার পর গল্পটা পড়ার সুযোগ হলো। থিমাটিকালি কিছুটা মিল। যেমন কাহিনীর কেন্দ্রে বৃক্ষ একটি চরিত্র (মূল গল্পের নাম ‘গাছটি বলেছিল’)। গাছটির নিচে রহস্যজনকভাবে মানুষ মারা যায়। গাছটির এই রহস্যময় ক্ষমতাকে ঘিরে গ্রামের হিন্দুরা গাছটিকে পূজা করা শুরু করে এবং মুসলমানরাও সচেষ্ট হয়ে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় (গল্পে প্রসঙ্গটি এতদূর আসে নি)। গল্পে আছে গ্রামের নতুন ডাক্তার প্রত্যেকটি মৃত্যুর চিকিৎসাবিজ্ঞানীয় ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু নিজেই একদিন গাছের কাছ থেকে ফিরে এসে আত্মহত্যা করে। গল্পকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী দুই সম্প্রদায়ের বসবাস গ্রামের দুই অংশে এবং দুই অংশের মাঝে নোম্যান্সল্যান্ডের বৃহন্নলা (না পুরুষ, না নারী) গাছটি। এখন গল্পের এই তিন প্রধান অনুষঙ্গ গাছ চরিত্র, সাম্প্রদায়িকতা ও বৃহন্নলার ধারণা – মুরাদ পারভেজ তার চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন (চলচ্চিত্রের নামটাই তো বৃহন্নলা)। কোনো সন্দেহ নেই মুরাদ পারভেজ এই গল্পটা পড়েছেন, চলচ্চিত্রের থিম হিসেবে নির্বাচন করেছেন। যদিও তিনি চলচ্চিত্রের কাহিনী আরও জটিল করেছেন। কারণ সেই গ্রামে উভয় পক্ষ মিলে একটা লিবারেল সিভিল সোসাইটি আমরা দেখি (কবিরাজ, শিক্ষক মিলে) কিন্তু উভয় ধর্মের প্রধানদের দাপটে তারা জোর অবস্থান নিতে পারে না। গ্রামে ডাক্তার চরিত্রটি এলে পরিস্থিতি বেশ খানিকটা পাল্টায়। তিনি বিজ্ঞানের প্রতিভূ হয়ে বিষয়গুলোকে কুসংস্কার হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলছিলেন। এর মধ্যে একজন হিন্দু গৃহবধূকে হিন্দু প্রধান ডাক্তারের পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয়। গৃহবধূটি ডাক্তারকে প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হয়। ডাক্তার তার প্রেমে পড়ে, মেয়েটিও তার প্রেমে পড়ে (যা পরিকল্পনার বাইরে ছিল)। কিন্তু তাদের এই অবৈধ প্রেমের বরাতেই ডাক্তারকে গ্রামছাড়া করা হয়। গৃহবধূ ফিরে আসে স্বামীর কাছে। শেষে দেখা যায় গাছটির নিচে স্বামী-স্ত্রী বাচ্চাদের স্কুল খুলেছে। বিস্ময়করভাবে, এক পর্যায়ে ডাক্তারও ফিরে এসে সেই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে।
গল্পকারের থিমকে চলচ্চিত্রকার ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। চরিত্রগুলোর ব্যাপ্তিও বেড়েছে। চিত্রায়ণ বিশ্বস্ত হয়েছে, অভিনয়ও ভালো হয়েছে। এক গ্রামের মধ্য দিয়ে পুরো বাংলার ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক বৃহত্তর চিত্রও আমরা পেয়ে যাই। কিন্তু গাছ, সাম্প্রদায়িকতা এবং বৃহন্নলা ধারণাটি – এরকম তিনটি বিষয় ধার করার পর, বলা প্রয়োজন ছিল সৈদয় মুস্তাফা সিরাজের ‘গাছটি বলেছিল’ গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত (অথবা ছায়া অবলম্বনে নির্মিত)। মুরাদ পারভেজ এই ঋণটুকু স্বীকার না করে অন্যায় করেছেন। আর এটা কেবল অসততার বিষয় নয়, বোকামিও বটে। কারণ প্রথম চলচ্চিত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে যার গল্প নির্বাচন করা হয়েছে, ঠিক পরবর্তী কাজে একই লেখকের গল্পের যেকোনো ধরনের অ্যাডাপ্টেশন (অনুপ্রেরণা, ছায়া অবলম্বন), গল্পকার বেঁচে না থাকলেও তার পরিবার ও তার পাঠক ঠিকই ধরে ফেলবেন। এইটার জন্য পরিচালককেই দোষ খুব একটা দেয়া যায় না। কিন্তু খেয়াল না করলে তাদের লজ্জা দেওয়া চলে না। কারণ তাদের বাংলা সাহিত্যের সব গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা নাও থাকতে পারে। অপরদিকে একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞান লেখক ? জাফর ইকবালের চুরির একটি নমুনা দিচ্ছি ,জাফর ইকবালের সব চেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন সফল চোর সাহিত্যিক । বাংলা সাহিত্য তার আজগুবি চুরির লেখার কাছে অনেক ঋণী। বিশেষ করে সাইন্স ফিকশান গুলো সারা বিশ্বে এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে???!!! বিভিন্ন দেশের নামি দামী লেখক্গণের লেখা চুরি করে নিজের নামে অনুবাদ করে চালিয়ে দিয়েছেন । নিচে কিছু তার উদাহরণ দিচ্ছি। চোর জাফর " অবনীল " নামক একটি বই প্রকাশ করেন ২০০৪ সালে। আর বইটি হুবহু নকল করা হয় ২০০০ সালে জিম হুইট আর কেন হুইট নামে দুই ভাই মিলে " পিচ ব্লাক " নামে বানানো একটি হলিউডের সিনেমা থেকে॥ ১৯৯৯ সালে আরেকটি বই লেখেন চোর জাফর " নিতু তার বন্ধুরা " স্যার এই বইটা নকল করেন দানি দেভিতো নামে এক ভদ্র লোকের " ম্যাটিল্ডা নামে ১৯৯৪ সালে বানানো এক হলিউডের সিনেমা থেকে ॥ ছবিটি বাজেটের চেয়ে ৬৫ কোটি ডলার বেশি নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন অথচ স্যারকে একটি টাকাও দিলেন না॥???!!!!!। ঠিক তেমনি চোর স্যারের ২০০৫ সালে বের হওয়া " আমি তপু " ১০ বছর আগে লেখা ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ডেবিড পেলজার নামে আমিরিকান এক সাহিত্যকের নকল করা " আ চাইল্ড কল্ড ইট বই থেকে ॥ " চোর স্যারের ২০০০ সালে বের হওয়া " মেকু কাহিনী " বইটি নকল করেন ১৯৯৪ সালে প্যাট্রিক রিড জনসন নামে এক হলিউডের পরিচালকের বানানো বিশ্ব বিখ্যাত শিশুতোষ ছবি " বেবিজ ডে আউট " থেকে॥ একই ভাবে চোর স্যারের ১৯৮৮ সালে ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম বইটি নকল করে ১৯৭৯ সালে বের করা হয় " এলিয়ন " নামক বিখ্যাত বই থেকে ॥
সারা বিশ্বই চোর স্যারের বই নকল করে প্রকাশ করে!!!??? ॥ এ জন্য স্যার তিন তিন বার সাহিত্যে নোবেল পেলেও তিনি তা প্রত্যাখান করে। ২০১৬ সাল একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বাংলাদেশের জন্য ॥ জয়তু চোর লেখক জয়তু চোর জাফর???! যেহেতু সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ ভারতের একটি ধনী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং উচ্চ শিক্ষিত আর আনন্দ বাজার পত্রিকায় চাকুরীর সুবাদে অনেক ইংরেজি বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাই এই গল্পটা তিনিও হয়তো বা কোনো বিদেশী গল্পের অনুকরণে লিখে থাকে পারেন।
চার.
সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ‘গাছটি বলেছিল’র গল্প চুরি করে ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিযোগে ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও দেবেশ রায়। এছাড়া সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ একাডেমির সচিব সৈয়দ হাসমত জালালও একটি চিঠি দিয়েছেন । ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এবং সদ্য ঘোষিত ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৪’ তে সেরা ছবি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ‘বৃহন্নলা’র বিরুদ্ধে গল্প চুরির অভিযোগ উঠে। যার প্রেক্ষিতে ছবির পরিচালক মুরাদ পারভেজকে শোকজ নোটিশ পাঠায় তথ্য মন্ত্রণালয়। তারপর সবকিছুই যেন থেমে যায়। কিন্তু নতুন করে বিষয়টি আবারো আলোচনা শুরু হয়েছে।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও দেবেশ রায়ের স্বাক্ষরকৃত একটি চিঠিতে অভিযোগ করে লেখা হয়, ‘আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের কাহিনীটি পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ‘গাছটি বলেছিল’ গল্প থেকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এমন কী ‘বৃহন্নলা’ নামটিও নেয়া হয়েছে ওই গল্প থেকেই। অথচ চলচ্চিত্রের মূল কাহিনীটি যে সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের লেখা, সে কথা উল্লেখ করা হয়নি বা কোনও ঋণ স্বীকার করা হয়নি। তাই বিষয়টি আপনার (তথ্য মন্ত্রীর) নজরে আনার জন্যই আমাদের এই চিঠি।’ চিঠিতে আরো লেখা হয়, ‘আমরা মনে করি, এ ধরণের কুম্ভীলকবৃত্তিকে জাতীয় পর্যায়ে সম্মানিত করা হলে তা যেমন বাংলাদেশের পক্ষে গৌরবের বিষয় হবে না, তেমনই দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও তা অনভিপ্রেত।’
চিঠির শেষাংশে তথ্য মন্ত্রীর প্রতি দাবি জানিয়ে লেখা হয়, ‘পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক-কবি-চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অন্যান্য সৃজনশীল মানুষের পক্ষে আমরা চাই, ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের প্রকৃত কাহিনীকার সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, এই তথ্যটি ওই চলচ্চিত্রে উল্লেখ করা হোক এবং কাহিনী স্বত্ব হিসেবে প্রয়াত সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের পরিবারকে ভারতীয় দেড় লাখ রূপি দেয়া হোক।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ:
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মুর্শিদাবাদ খোশবাসপুর গ্রামে ১৯৩০ সালে অক্টোবর মাসে জন্মগ্রহণ করেন ৷ প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পলাতক কিশোরের জীবন অতিবাহিত করেছেন ৷ রাঢ় বাংলার লোকনাট্য "আলকাপের" সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে নিমজ্জিত হয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন ৷ তিনি ছিলেন 'আলকাপ' দলের "ওস্তাদ" (গুরু) । নাচ-গানের প্রশিক্ষক । তাঁর জ্ঞান ও অধীত বিদ্যাসমূহ তাঁকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে ৷ইতিহাস,সমাজতত্ত্ব , নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব - সব বিষয়েই তাঁর জ্ঞান ও বিদ্যার গভীরতা তাঁকে পন্ডিতমহলে পরিচিত করে তুলেছে৷
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ছিল প্রবল । সংবাদপত্রে চাকরি করলেও কোনও মালিকানাগোষ্ঠীর কাছে মাথা নিচু করেন নি । 'অলীক মানুষ' উপন্যাস ছাপা হয় ধারাবাহিকভাবে 'চতুরঙ্গ' নামে একটি লিট্ল ম্যাগাজিনে । "তৃণভূমি" ছাপা হয় অধুনালুপ্ত 'ধ্বনি' নামক এক ছোট পত্রিকায় । বড় পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর সেরা উপন্যাসগুলি ছাপা হয়েছে ছোট পত্রিকায় । লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের প্রতি ছিল তাঁর সস্নেহ পক্ষপাত । মিডিয়ার আলো ও প্রচারের প্রতি তাঁর আকুলতা ছিল না । নিজের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রায় একা উন্নত গ্রীবায় ছোট ফ্ল্যাটে জীবনকে কাটিয়ে গেছেন । মাথা উঁচু করে থাকার দর্পী মনোভাবের জন্য তাঁকে অনেক মনোকষ্ট পেতে হলেও তিনি দমে যাননি । তবে তাঁর পাঠকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর । তাঁর ব্যবহারে ও আচরণে ছিল পরিশীলিত ভদ্রতা ও
আন্তরিকতা ।
http://m.prothom-alo.com/entertainment/article/832273
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'অলীক মানুষ' উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার - এসব ছাড়াও ভুয়ালকা পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত । তাঁর 'অমর্ত্য প্রেমকথা' বইয়ের জন্য জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার । এই স্কুল পালানো মানুষটিই পেয়েছিলেন সাম্মানিক
ডক্টরেট । http://www.kolkatanews24.com/…/%E0%A6%B8%E0%A7%88%E0%A7%9F…/
মুক্ত বুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
No comments:
Post a Comment