বঙ্কিম ও আনন্দ মঠ উপন্যাস নিয়ে কিছু পর্যালোচনা ।
উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।
সূফি বরষণ
পর্ব এক:
কলকাতার মার্কসবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় তাঁর লেখা ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০ বইতে লিখেছেন, যে সময় মুসলমানরা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ব্যস্ত সেই সময় এইভাবে তিনি(বঙ্কিম) হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইয়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করিয়াছেন।
এবং এইকথার সমর্থন পাওয়া যায় আহমদ ছফার বাঙালী মুসলমানের মন লেখায়। তিনি বলেন, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস। কেউ কেউ অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সাম্প্রদায়িকতার জনয়িতা মনে করেন। তাঁরা ভারতীয় ইতিহাসের অতীতকে শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের দুশো বছরের মধ্যে সীমিত রাখেন বলেই এই ভুলটা করে থাকেন।
ঠিক একই রকম কথা বলেন, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় কমরেড মুজাফফর আহমদের মতে, বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের আনন্দ মঠ হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ । এর মূল মন্ত্র ছিল বন্দেমাতরম গান।
কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ের ২৫১ পৃষ্ঠায় এম আর আখতার মুকুল বলেন, কোনো রকম লুকোচুরি না করে বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর রচিত আনন্দ মঠ উপন্যাসে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এদেশ সম্পূর্ণ ভাবে ইংরেজদের পদানত হওয়ার ফল শুভ হতে বাধ্য । কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইংরেজরা এদেশে না আসলে সনাতন ধর্মের ( হিন্দু ধর্ম ) বিজয় কেতন উড্ডীন সম্ভব হতো না ।
বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এ মর্মে বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণহিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণি সম্প্রদায়কে বুঝাতে চেয়েছেন যে, মুসলমানদের শাসনে হিন্দু ধর্ম নিমজ্জিত হয়েছিল !?, কিন্তু ইংরেজ শাসনে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে । তাহলে বঙ্কিম প্রতিভার প্রকৃত মূল্যায়নের পর এ ধরনের মন্তব্য করলে অন্যায় হবে না যে, বাংলার রেনেঁসার পূর্ণ বিকাশের হোতা হিসাবে বর্ণিত বঙ্কিম চন্দ্র ছিলেন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নির্ভেজাল সমর্থক। অবশ্য তিনি ইংরেজদের ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিক্রিয়াশীল সনাতন হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু শৌর্য বীর্যের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ইংরেজদের দালালীর পথকে সহজতর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । এজন্যই বঙ্কিমের মন মানসিকতা কৃষক (মুসলিম) বিদ্বেষ , নিন্মশ্রেণী বিদ্বেষ এবং যবন (মুসলিম) বিদ্বেষ_এ ভরপুর। (এখানে যবন বলতে মুসলমানদেরকে গালি বাচক শব্দ হিসেবে হিন্দুরা ব্যবহার করতো!?। )
এইভাবে উপরে উল্লিখিত বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আনন্দ মঠ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক। আনন্দমঠ, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, ৭৯ | বঙ্কিম চন্দ্র বলেন, সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল |” গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মুই হেঁদু |”
দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল। চারি দিকে রাজপুরুষেরা ছুটিল, অবশিষ্ট সিপাহী সুসজ্জিত হইয়া নগররক্ষার্থে শ্রেণীবদ্ধ হইল। নগরের গড়ের ঘাটে ঘাটে প্রকোষ্ঠসকলে রক্ষকবর্গ সশস্ত্রে অতি সাবধানে দ্বাররক্ষায় নিযুক্ত হইল। সমস্ত লোক সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি হয় কি হয় চিন্তা করিতে লাগিল। হিন্দুরা বলিতে বলিতে লাগিল, “আসুক, সন্ন্যাসীরা আসুক, মা দুর্গা করুন, হিন্দুর অদৃষ্টে সেই দিন হউক।” মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, “আল্লা আকবর! এতনা রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ; মোরা যে পাঁচু ওয়াক্ত নমাজ করি, তা এই তেলককাটা হেঁদুর দল ফতে করতে নারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।” এইরূপে কেহ ক্রন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল।
উপন্যাসের এই অংশে মুসলমানদের কে যবন বলে গালাগালি করা ছাড়াও “মুই হেঁদু ” অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে হাস্যকর বস্তুতে পরিণত করার পাশাপাশি পবিত্র কুরআন শরীফকের নিয়েও হাস্যকরা বাদ দেয়নি !? যেমন “আল্লা আকবর! এতনা রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ;
আনন্দমঠ, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৬৯ | বঙ্কিম আরও লিখন, ” তখন বড় কোলাহল হইতে লাগিল। কেহ চীৎকার করিতে লাগিল, “মার, মার, নেড়ে মার |” কেহ বলিল, “জয় জয়! মহারাজকি জয়।” কেহ গায়িল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে!” কেহ গায়িল, “বন্দে মাতরম্!” কেহ বলে–“ভাই, এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালি হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীরপাত করিব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, আপনার ধন আপনি খাইব?” দশ সহস্র নরকণ্ঠের কল কল রব, মধুর বায়ুসন্তাড়িত বৃক্ষপত্ররাশির মর্মর, সৈকতবাহিনী তরঙ্গিণীর মৃদু মৃদু তর তর রব, নীল আকাশে চন্দ্র, তারা শ্বেত মেঘরাশি, শ্যামল ধরণীতলে হরিৎ কানন, স্বচ্ছ নদী, শ্বেত সৈকত, ফুল্ল কুসুমদাম। আর মধ্যে মধ্যে সেই সর্বজনমনোরম “বন্দে মাতরম্!” ।
উপন্যাসের এই অংশে নেড়ে মার বলতে মুসলমানদের হত্যা করার কথা বুঝিয়েছেন। বাঙালি মুসলমানদের তুচ্ছ বাঙালি সম্মোধন করে যুদ্ধে হত্যা করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় এবং মসজিদ ভাঙ্গে রাধামাধবের মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রবল আক্রমণাক্ত ইচ্ছে প্রকাশ করে হয়!?।
এইসব কথা বলার ও লিখার পরও কি আপনি কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) হিন্দুদেরকে কি বলে স্বম্মোধন করবেন?? আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে না তখন মুসলমানরা শাসক ছিলনা, ছিল সাধারন প্রজা তখন ক্ষমতায় ছিল ইংরেজরা !? তারপরও কেন এতো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ( মুসলিম বিদ্বেষের) পরিচয় দেয় হিন্দুরা তাদের আচার আচরণ ও সাহিত্যের মাধ্যমে!?। এর মূলে ছিল ভারত ভাগ করে হিন্দুদের জন্য আলাদা আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠা । তাই বলা যায় এইসব লিখা পরবর্তীতে দেশ ভাগের পটভূমি হিসেবে কাজ করে। উপরে লেখার সূত্র ধরে সাংবাদিক সূফি বরষণ যদি বলে যে, উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা জন্মগতভাবেই মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। আর বঙ্কিমের মতো মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিকরা লেখার মাধ্যমে সমাজে আরও বেশি করে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয় তার প্রমাণ আপনারা ইতিমধ্যেই পেয়েছেন ।
ভারতীয় উপমহাদেশে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের কোলকাতা হলো সাম্প্রদায়িকতার ( মুসলিম বিদ্বেষের ) আবাদ ভূমি যেখান থেকে সারা ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয় হিন্দুরা । এবং ফলাফল হিসেবে ভারত ভাগ হয়। হিন্দুরা যে অতি উচ্চমাত্রার চরম সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) তার প্রমাণ হলো, ভারত ভাগের আজ ৬৯ বছর পর দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সংখ্যা ২৮% আর সরকারি চাকুরীতে মুসলমানদের পরিমাণ হলো ২.১% !???। গত ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু কমিউনিস্টরা শাসন করে, _'মুখে এরা সাম্যবাদে কথা বললেও আসলে এরাও সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) দোষে দুষ্ট। আসলে মুসলিম বিদ্বেষের বেলায় কংগ্রেস, বিজিবি, আরএসএস আর তথাকথিত হিন্দু কমিউনিস্টরাও এক এবং অভিন্ন । এই কথার কেউ উত্তর দিতে পারেনা পশ্চিমবঙ্গের ২৮% মুসলমানদের মধ্যে সরকারি চাকরিতে ২.১% কেন । কলকাতার উচ্চ বর্ণ সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষ) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বড়ো প্রমাণ এখন আপনাদের সামনে।
বঙ্কিমের কৃষক আন্দোলনের ঘোর বিরোধী উপন্যাস আনন্দ মঠ সম্পর্কে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ ও বঙ্কিমভক্ত ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের মত হচ্ছে, .... উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী হাঙ্গামার মতো একটা লুটতরাজের বিশৃঙ্খল ঘটনাকে জ্যোতির্ময় দেশ প্রেম ও বলিষ্ঠ আত্মত্যাগের আধারে পরিবেন করাতে কাহিনীটির বস্তুগত যথার্থ কিছু ক্ষুণ্ন হয়েছে । কারণ ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে একদল উপদ্রবকারী সন্ন্যাসী ( উত্তর প্রদেশের অধিবাসী ) বাংলাদেশে কিছুকাল ধরে যে, নির্যাতন লুটতরাজ ও আরও নানা ধরনের অত্যাচার চালিয়ে ছিল , তার সঙ্গে দেশ প্রেম কেন , কোনও প্রকার মহৎ বৃত্তির কিছু মাত্র সম্পর্ক ছিল না। বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত পৃষ্ঠা ৫৪২ সংশোধিত চতুর্থ সংকলন কলকাতা ১৯৭৮।
অবশ্য আরও গভীর ভাবে বঙ্কিম রচিত আনন্দ মঠ উপন্যাস আলোচনার লক্ষ্যে কলকাতার মার্কসবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ইংরেজদের হস্তের ক্রীড়নক মীরজাফরের শাসনের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষক জনসাধারণের সংগ্রামকে তিনি এরূপ ভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন যেন তাহারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুর সংগ্রাম এবং মুসলমান শাসনের কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্যই প্রয়োজন ইংরেজ প্রভুত্বকে বরণ করা ।
সংগ্রামের শেষ পর্যন্ত জয়ী হইয়াও সংগ্রামের নায়কগণ স্বাধীন রাজ্য স্থাপন না করিয়া ইংরেজের হস্তে রাজ্যভার ত্যাগ করিয়া তীর্থ দর্শন করিতে গেলেন । দেশ ইংরেজের হস্তে পতিত হইবে শুনিয়া বিদ্রোহীদের নায়ক সত্যানন্দ আক্ষেপ করিলে বঙ্কিম চন্দ্র চিকিত্সকের মুখ দিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিয়াছেন: চিকিৎসক বলিলেন, “সত্যানন্দ, কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর যাহা হইবে, তাহা ভালই হইবে। ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। মহাপুরুষেরা যেরূপ বুঝিয়াছেন, এ কথা আমি তোমাকে সেইরূপ বুঝাই। মনোযোগ দিয়া শুন। তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা সনাতনধর্ম নহে, সে একটা লৌকিক অপকৃষ্ট ধর্ম; তাহার প্রভাবে প্রকৃত সনাতনধর্ম – ম্লেচ্ছেরা যাহাকে হিন্দুধর্ম বলে – তাহা লোপ পাইয়াছে। প্রকৃত হিন্দুধর্ম জ্ঞানাত্মক, কর্মাত্মক নহে। (আনন্দমঠ, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৯২ পৃষ্ঠা) ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০ । চলবে
উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।
সূফি বরষণ
পর্ব এক:
কলকাতার মার্কসবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় তাঁর লেখা ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০ বইতে লিখেছেন, যে সময় মুসলমানরা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ব্যস্ত সেই সময় এইভাবে তিনি(বঙ্কিম) হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইয়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করিয়াছেন।
এবং এইকথার সমর্থন পাওয়া যায় আহমদ ছফার বাঙালী মুসলমানের মন লেখায়। তিনি বলেন, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস। কেউ কেউ অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সাম্প্রদায়িকতার জনয়িতা মনে করেন। তাঁরা ভারতীয় ইতিহাসের অতীতকে শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের দুশো বছরের মধ্যে সীমিত রাখেন বলেই এই ভুলটা করে থাকেন।
ঠিক একই রকম কথা বলেন, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় কমরেড মুজাফফর আহমদের মতে, বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের আনন্দ মঠ হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ । এর মূল মন্ত্র ছিল বন্দেমাতরম গান।
কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ের ২৫১ পৃষ্ঠায় এম আর আখতার মুকুল বলেন, কোনো রকম লুকোচুরি না করে বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর রচিত আনন্দ মঠ উপন্যাসে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এদেশ সম্পূর্ণ ভাবে ইংরেজদের পদানত হওয়ার ফল শুভ হতে বাধ্য । কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইংরেজরা এদেশে না আসলে সনাতন ধর্মের ( হিন্দু ধর্ম ) বিজয় কেতন উড্ডীন সম্ভব হতো না ।
বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এ মর্মে বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণহিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণি সম্প্রদায়কে বুঝাতে চেয়েছেন যে, মুসলমানদের শাসনে হিন্দু ধর্ম নিমজ্জিত হয়েছিল !?, কিন্তু ইংরেজ শাসনে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে । তাহলে বঙ্কিম প্রতিভার প্রকৃত মূল্যায়নের পর এ ধরনের মন্তব্য করলে অন্যায় হবে না যে, বাংলার রেনেঁসার পূর্ণ বিকাশের হোতা হিসাবে বর্ণিত বঙ্কিম চন্দ্র ছিলেন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নির্ভেজাল সমর্থক। অবশ্য তিনি ইংরেজদের ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিক্রিয়াশীল সনাতন হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু শৌর্য বীর্যের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ইংরেজদের দালালীর পথকে সহজতর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । এজন্যই বঙ্কিমের মন মানসিকতা কৃষক (মুসলিম) বিদ্বেষ , নিন্মশ্রেণী বিদ্বেষ এবং যবন (মুসলিম) বিদ্বেষ_এ ভরপুর। (এখানে যবন বলতে মুসলমানদেরকে গালি বাচক শব্দ হিসেবে হিন্দুরা ব্যবহার করতো!?। )
এইভাবে উপরে উল্লিখিত বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আনন্দ মঠ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক। আনন্দমঠ, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, ৭৯ | বঙ্কিম চন্দ্র বলেন, সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল |” গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মুই হেঁদু |”
দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল। চারি দিকে রাজপুরুষেরা ছুটিল, অবশিষ্ট সিপাহী সুসজ্জিত হইয়া নগররক্ষার্থে শ্রেণীবদ্ধ হইল। নগরের গড়ের ঘাটে ঘাটে প্রকোষ্ঠসকলে রক্ষকবর্গ সশস্ত্রে অতি সাবধানে দ্বাররক্ষায় নিযুক্ত হইল। সমস্ত লোক সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি হয় কি হয় চিন্তা করিতে লাগিল। হিন্দুরা বলিতে বলিতে লাগিল, “আসুক, সন্ন্যাসীরা আসুক, মা দুর্গা করুন, হিন্দুর অদৃষ্টে সেই দিন হউক।” মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, “আল্লা আকবর! এতনা রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ; মোরা যে পাঁচু ওয়াক্ত নমাজ করি, তা এই তেলককাটা হেঁদুর দল ফতে করতে নারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।” এইরূপে কেহ ক্রন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল।
উপন্যাসের এই অংশে মুসলমানদের কে যবন বলে গালাগালি করা ছাড়াও “মুই হেঁদু ” অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে হাস্যকর বস্তুতে পরিণত করার পাশাপাশি পবিত্র কুরআন শরীফকের নিয়েও হাস্যকরা বাদ দেয়নি !? যেমন “আল্লা আকবর! এতনা রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ;
আনন্দমঠ, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৬৯ | বঙ্কিম আরও লিখন, ” তখন বড় কোলাহল হইতে লাগিল। কেহ চীৎকার করিতে লাগিল, “মার, মার, নেড়ে মার |” কেহ বলিল, “জয় জয়! মহারাজকি জয়।” কেহ গায়িল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে!” কেহ গায়িল, “বন্দে মাতরম্!” কেহ বলে–“ভাই, এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালি হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীরপাত করিব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, আপনার ধন আপনি খাইব?” দশ সহস্র নরকণ্ঠের কল কল রব, মধুর বায়ুসন্তাড়িত বৃক্ষপত্ররাশির মর্মর, সৈকতবাহিনী তরঙ্গিণীর মৃদু মৃদু তর তর রব, নীল আকাশে চন্দ্র, তারা শ্বেত মেঘরাশি, শ্যামল ধরণীতলে হরিৎ কানন, স্বচ্ছ নদী, শ্বেত সৈকত, ফুল্ল কুসুমদাম। আর মধ্যে মধ্যে সেই সর্বজনমনোরম “বন্দে মাতরম্!” ।
উপন্যাসের এই অংশে নেড়ে মার বলতে মুসলমানদের হত্যা করার কথা বুঝিয়েছেন। বাঙালি মুসলমানদের তুচ্ছ বাঙালি সম্মোধন করে যুদ্ধে হত্যা করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় এবং মসজিদ ভাঙ্গে রাধামাধবের মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রবল আক্রমণাক্ত ইচ্ছে প্রকাশ করে হয়!?।
এইসব কথা বলার ও লিখার পরও কি আপনি কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) হিন্দুদেরকে কি বলে স্বম্মোধন করবেন?? আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে না তখন মুসলমানরা শাসক ছিলনা, ছিল সাধারন প্রজা তখন ক্ষমতায় ছিল ইংরেজরা !? তারপরও কেন এতো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ( মুসলিম বিদ্বেষের) পরিচয় দেয় হিন্দুরা তাদের আচার আচরণ ও সাহিত্যের মাধ্যমে!?। এর মূলে ছিল ভারত ভাগ করে হিন্দুদের জন্য আলাদা আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠা । তাই বলা যায় এইসব লিখা পরবর্তীতে দেশ ভাগের পটভূমি হিসেবে কাজ করে। উপরে লেখার সূত্র ধরে সাংবাদিক সূফি বরষণ যদি বলে যে, উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা জন্মগতভাবেই মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। আর বঙ্কিমের মতো মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিকরা লেখার মাধ্যমে সমাজে আরও বেশি করে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয় তার প্রমাণ আপনারা ইতিমধ্যেই পেয়েছেন ।
ভারতীয় উপমহাদেশে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের কোলকাতা হলো সাম্প্রদায়িকতার ( মুসলিম বিদ্বেষের ) আবাদ ভূমি যেখান থেকে সারা ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয় হিন্দুরা । এবং ফলাফল হিসেবে ভারত ভাগ হয়। হিন্দুরা যে অতি উচ্চমাত্রার চরম সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) তার প্রমাণ হলো, ভারত ভাগের আজ ৬৯ বছর পর দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সংখ্যা ২৮% আর সরকারি চাকুরীতে মুসলমানদের পরিমাণ হলো ২.১% !???। গত ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু কমিউনিস্টরা শাসন করে, _'মুখে এরা সাম্যবাদে কথা বললেও আসলে এরাও সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) দোষে দুষ্ট। আসলে মুসলিম বিদ্বেষের বেলায় কংগ্রেস, বিজিবি, আরএসএস আর তথাকথিত হিন্দু কমিউনিস্টরাও এক এবং অভিন্ন । এই কথার কেউ উত্তর দিতে পারেনা পশ্চিমবঙ্গের ২৮% মুসলমানদের মধ্যে সরকারি চাকরিতে ২.১% কেন । কলকাতার উচ্চ বর্ণ সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষ) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বড়ো প্রমাণ এখন আপনাদের সামনে।
বঙ্কিমের কৃষক আন্দোলনের ঘোর বিরোধী উপন্যাস আনন্দ মঠ সম্পর্কে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ ও বঙ্কিমভক্ত ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের মত হচ্ছে, .... উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী হাঙ্গামার মতো একটা লুটতরাজের বিশৃঙ্খল ঘটনাকে জ্যোতির্ময় দেশ প্রেম ও বলিষ্ঠ আত্মত্যাগের আধারে পরিবেন করাতে কাহিনীটির বস্তুগত যথার্থ কিছু ক্ষুণ্ন হয়েছে । কারণ ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে একদল উপদ্রবকারী সন্ন্যাসী ( উত্তর প্রদেশের অধিবাসী ) বাংলাদেশে কিছুকাল ধরে যে, নির্যাতন লুটতরাজ ও আরও নানা ধরনের অত্যাচার চালিয়ে ছিল , তার সঙ্গে দেশ প্রেম কেন , কোনও প্রকার মহৎ বৃত্তির কিছু মাত্র সম্পর্ক ছিল না। বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত পৃষ্ঠা ৫৪২ সংশোধিত চতুর্থ সংকলন কলকাতা ১৯৭৮।
অবশ্য আরও গভীর ভাবে বঙ্কিম রচিত আনন্দ মঠ উপন্যাস আলোচনার লক্ষ্যে কলকাতার মার্কসবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ইংরেজদের হস্তের ক্রীড়নক মীরজাফরের শাসনের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষক জনসাধারণের সংগ্রামকে তিনি এরূপ ভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন যেন তাহারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুর সংগ্রাম এবং মুসলমান শাসনের কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্যই প্রয়োজন ইংরেজ প্রভুত্বকে বরণ করা ।
সংগ্রামের শেষ পর্যন্ত জয়ী হইয়াও সংগ্রামের নায়কগণ স্বাধীন রাজ্য স্থাপন না করিয়া ইংরেজের হস্তে রাজ্যভার ত্যাগ করিয়া তীর্থ দর্শন করিতে গেলেন । দেশ ইংরেজের হস্তে পতিত হইবে শুনিয়া বিদ্রোহীদের নায়ক সত্যানন্দ আক্ষেপ করিলে বঙ্কিম চন্দ্র চিকিত্সকের মুখ দিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিয়াছেন: চিকিৎসক বলিলেন, “সত্যানন্দ, কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর যাহা হইবে, তাহা ভালই হইবে। ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। মহাপুরুষেরা যেরূপ বুঝিয়াছেন, এ কথা আমি তোমাকে সেইরূপ বুঝাই। মনোযোগ দিয়া শুন। তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা সনাতনধর্ম নহে, সে একটা লৌকিক অপকৃষ্ট ধর্ম; তাহার প্রভাবে প্রকৃত সনাতনধর্ম – ম্লেচ্ছেরা যাহাকে হিন্দুধর্ম বলে – তাহা লোপ পাইয়াছে। প্রকৃত হিন্দুধর্ম জ্ঞানাত্মক, কর্মাত্মক নহে। (আনন্দমঠ, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৯২ পৃষ্ঠা) ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০ । চলবে
No comments:
Post a Comment