Friday, 6 May 2016

বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার জনক বঙ্কিম ও তাঁর সাহিত্য নিয়ে কিছু পর্যালোচনা। শেষ পর্ব:

উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।



সূফি বরষণ
শেষ পর্ব ক:

কারও অজানা নয়, বঙ্কিম সাহিত্য হিন্দুদের হিংস্র জাতীয়তাবাদ এবং খুনে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মূল উৎস। [অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন লিখিত ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’, গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকার ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়’ শীর্ষক নিবন্ধ দ্রষ্টব্য।]
বঙ্কিম “রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মনের প্রতিভূ হিসাবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদগাতা ঋষি হিসাবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবহ্নি তিনি ছড়িয়েছিলেন লেখনি মুখে, জগতের ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নজীর নেই। তিনি মানবতার যে অকল্যাণ ও অসম্মান করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তারও তুলনা নেই। ‘রাজ সিংহ’ ও ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস দুটিতে তিনি মুসলিম বিদ্বেষের যে বিষবহ্নি উদগীরণ করেছেন, সে বিষ জ্বালায় এই বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, তা নিঃশেষ শুষ্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র অস্বীকার করে তাদের বিতাড়িত করে সদাশয় বৃটিশ জাতির আবাহনে ও প্রতিষ্ঠায় বার বার মুখর হয়ে উঠেছিলেন”। [‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ’, সংস্কৃতির রূপান্তর’, আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ৩৩৯।]

বঙ্কিমের এই সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং একে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলে অভিহিত করে মুসলমানদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা”। [‘মুসলিম জননেতা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী একটি বক্তৃতায় মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য বন্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করলে, “ভারতী পত্রিকা’য় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন।]

খ.
এইবার আসুন আমরা জেনে সাম্প্রদায়িকতা কি? সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। যেসময় থেকে মানুষ জাতি-গোষ্ঠীতে এবং ধর্মীয় কারনে ধর্মে ধর্মে বিভক্ত হয়েছে সেই থেকে সম্প্রদায় , সাম্প্রদায়িক, সাম্প্রদায়িকতা শব্দগুলো এসেছে। একেবারে আদিতে মানুষ যখন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল না, তখন সাম্প্রদায়িকতাও ছিল না।

সাম্প্রদায়িকতাঃমুক্ত নন রবীন্দ্রনাথও নামক এক প্রবন্ধে বামপন্থী গবেষক সলিমুল্লাহ খান বলেন, "সংখ্যাগুরু মুসলমান সবাই সাম্প্রদায়িক নহে, সাম্রাজ্যবাদীও নহে। নিজের বাসভূমে নিজের অধিকার দাবি করা সাম্প্রদায়িকতা নহে, অন্যের অধিকার অস্বীকার করাই সাম্প্রদায়িকতা।"

১৫ মার্চ রোববার ২০১৫ সালে দৈনিক আজাদী পত্রিকায় সাম্প্রদায়িকতা কি ও কেন এক প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সাম্প্রদায়িকতা কি সে তো আমরা অবশ্যই জানি। দেখিও। আমরা ভুক্তভোগীও বটে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে আমাদের এই দেশে দাঙ্গা হয়েছে। দাঙ্গার পরিণতিতে এক সময়ে অবিভক্ত বঙ্গ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, এক খণ্ড যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্যখণ্ড ভারতের। কিন্তু তারপরেও দাঙ্গা থেমেছে কি? দুই বঙ্গের কোনো বঙ্গেই থামেনি। সাম্প্রদায়িকতারও অবসান হয়নি। ....... কেবল যে মানসিক সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে তা নয়, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনও ঘটেছে।

দৈনিক যুগান্তর ১৮ মে ২০১৪ সালে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার জয়জয়কার এক প্রবন্ধে বামপন্থী গবেষক বরুদ্দীন উমর বলেন, অখণ্ড ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের আড়ালে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে এগিয়ে নেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়েছিল। কিন্তু তিরিশের দশকে সেই আড়াল বজায় রাখা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
দশকের প্রথমদিকে জাতীয় আন্দোলনের নামে অনেক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি কংগ্রেসের কাঠামোর অন্তর্গত হয়েছিল। ...... অবশ্য এখানে বলা দরকার যে, মুহম্মদ আলী জিন্নাহর মতো একজন প্রসিদ্ধ অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসির সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া এবং মুসলিম লীগের মতো একটি সাম্প্রদায়িক দলের নেতৃত্বে আসার মূল কারণ ছিল ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের পতন ঘটতে থাকার প্রক্রিয়া। ....................শুধু তাই নয়, সেখানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুসলমানসহ অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের উদ্ধার করার বিন্দুমাত্র কোনো চেষ্টা তারাও করেনি।

এ কারণে দেখা যাবে যে, পশ্চিমবঙ্গে এখন মুসলমান জনসংখ্যা ৩০ শতাংশের ওপর হলেও চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অংশ ২ শতাংশেরও কম! সেই ভারত সরকারের দ্বারা গঠিত সাচার কমিশন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মুসলমানদের অবস্থা দলিতদের অবস্থা থেকে খারাপ। মুসলমানদের এ অবস্থার উন্নতির জন্য সাচার কমিশন রিপোর্টে অনেক সুপারিশ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার কিছুই কার্যকর করা হয়নি। .....এসবের দিকে তাকিয়ে কেউ যদি বলে, জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বই সঠিক ছিল, তাহলে তাকে কি দোষ দেয়া যায়? অন্তত কংগ্রেসিরা কি দোষ দিতে পারে?


গ.
এইবার আসি মূল আলোচনায় বঙ্কিমের সাহিত্য পর্যালোচনায়। মৃণালিনী উপন্যাসে ব্রাক্ষ্মণ মাধবাচার্য হেমচন্দ্রকে ডেকে বলছেন , "তুমি দেবকার্য না সাধিলে কে সাধিবে ? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে ? যবন নিপাত তোমার একমাত্র ধ্যান হওয়া উচিত্‍ ।"

মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিম লিখেছেন, হেমচন্দ্র বিনীতভাবে কহিলেন, “অপরাধ গ্রহণ করিবেন না, দিল্লীতে কার্য হয় নাই। পরন্তু যবন আমার পশ্চাদগামী হইয়াছিল; এই জন্য কিছু সতর্ক হইয়া আসিতে হইয়াছিল। তদ্ধেতু বিলম্ব হইয়াছে |” ব্রাহ্মণ কহিলেন, “দিল্লীর সংবাদ আমি সকল শুনিয়াছি। বখ্ই‍তিয়ার খিলিজিকে হাতীতে মারিত, ভালই হইত, দেবতার শত্রু পশুহস্তে নিপাত হইত। তুমি কেন তার প্রাণ বাঁচাইতে গেলে!”
হে। তাহাকে স্বহস্তে যুদ্ধে মারিব বলিয়া। সে আমার পিতৃশত্রু, আমার পিতার রাজ্যচোর। আমারই সে বধ্য। ” মৃণালিনী, প্রথম খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ ,‍ ২, পৃষ্ঠা ৮৯  | বঙ্কিম রচনাবলী।

মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিম আরও লিখেছেন, এই দেশে যবনের পরম শত্রু হেমচন্দ্র বাস করিতেছে। আজ রাত্রেই তাহার মুণ্ড যবন-শিবিরে প্রেরণ করিতে হইবে। মৃণালিনী: দ্বিতীয় খণ্ড। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : পশুপতি।

হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমি যে হই না কেন?” শা। আপনি এখানে কি করিতেছেন? হে। আমি এখানে যবনানুসন্ধান করিতেছি। শান্তশীল চমকিত হইয়া কহিল, “যবন কোথায়?” হে। এই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। শান্তশীল ভীত ব্যক্তির ন্যায় স্বরে কহিল, “এ গৃহে কেন?” হে। তাহা আমি জানি না। শা। এ গৃহ কাহার? হে। তাহা জানি না। শা। তবে আপনি কি প্রকারে জানিলেন যে, এই গৃহে যবন প্রবেশ করিয়াছে? হে। তা তোমার শুনিয়া কি হইবে?

শা। এই গৃহ আমার। যদি যবন হইতে প্রবেশ করিয়া থাকে, তবে কোন অনিষ্টকামনা করিয়া গিয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনি যোদ্ধা এবং যবনদ্বেষী দেখিতেছি। যদি ইচ্ছা থাকে তবে আমার সঙ্গে আসুন-উভয়ে চোরকে ধৃত করিব। মৃণালিনী: দ্বিতীয় খণ্ড। দশম পরিচ্ছেদ।

মৃণালিনী  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় উপন্যাস। প্রকাশকাল ১৮৬৯। তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা আক্রমণ ও বিজয়ের পটভূমিতে রচিত। যেখানে বখতিয়ার খলজীকে এবং মুসলমানদের গালাগালি মূলক শব্দ যবন, বানর, অরন্যনর ও চোর হিসেবে উল্লেখ করে লিখেন।  এই অভিযানের প্রাক্কালে, বখতিয়ার খলজী সে সময়ের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুরক্ষিত দূর্গ মনে করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় এবং ভিক্ষু বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে হত্যা করে বলে মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন  ৷ মৃণালিনী একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।  এই দুটি লিংকে আপনি জানতে পারবেন যে, বখতিয়ার খলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করেননি বরং বঙ্কিম তাঁর সাহিত্যে ঐতিহাসিক সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন।  http://sufiborshan.blogspot.co.uk/2015/12/blog-post.html
এবং http://www.muldharabd.com/?p=698

মৃণালিনী\’ উপন্যাসে বখতিয়ার খিলজীকে বলেছেন \’বানর\’,\’অরন্যনর\’ ইত্যাদি। তিনি স্পষ্টতই বলতেন,\”পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া সাত্বমঙ্গল সাধিত হয় তাহাও করিব।\”এভাবে তিনি কেবল \’করিব\’ বলে ক্ষান্ত হন নি। সুযোগ পেলে করেছেনও। তাইতো তার বিশ্বাস থেকেই তিনি লিখেছেন,\”আসে আসুক না আরবী বানর/আসে আসুক না পারসী পামর।\”আমদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যখন শুনি একজন সাহিত্য সম্রাট কত নগ্নভাবে বলেছেন,\”ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকের নয়ন পথের পথিক হইবে, কাক, কুকুর ও মুসলমান। এই তিনটি সমানভাবেই কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়।\” এরপর আর বঙ্কিমবাবু সম্পর্কে বলার কিছু থাকে না। (আনন্দমঠ,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ,তৃতীয় মুদ্রণ ১৩৬৪,পৃ ২৩)। (সংক্ষিপ্ত সংকলন)।

দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে বঙ্কিম লিখেছেন, তথায় অবস্থিতিকালে লোকমুখে রাজা সংবাদ পাইলেন যে, কতলু খাঁ তাঁহার আলস্য দেখিয়া সাহসিক হইয়াছে, সেই সাহসে মান্দারণের অনতিদূর মধ্যে সসৈন্য আসিয়া দেশ লুঠ করিতেছে। রাজা উদ্বিগ্নচিত্ত হইয়া, শত্রুবল কোথায়, কি অভিপ্রায়ে আসিয়াছে, কি করিতেছে, এই সকল সংবাদ নিশ্চয় জানিবার জন্য তাঁহার একজন প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষকে প্রেরণ করা উচিত বিবেচনা করিলেন। দূর্গেশনন্দিনী : প্রথম খণ্ড। তৃতীয় পরিচ্ছেদ : মোগল পাঠান।

দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে বঙ্কিম আরও লিখেন, মহারাজ মানসিংহ পুত্রমুখাৎ অবগত হইলেন যে, প্রায় পঞ্চাশৎ সহস্র পাঠান সেনা ধরপুর গ্রামের নিকট শিবির সংস্থাপন করিয়া নিকটস্থ গ্রামসকল লুঠ করিতেছে, এবং স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ বা অধিকার করিয়া তদাশ্রয়ে এক প্রকার নির্বিঘ্নে আছে। মানসিংহ দেখিলেন যে, পাঠানদিগের দুবৃত্তির আশু দমন নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে, কিন্তু এ কার্য অতি দুঃসাধ্য। কর্তব্যাকর্তব্য নিরুপণ জন্য সমভিব্যাহারী সেনাপতিকে একত্র করিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিবৃত করিলেন এবং কহিলেন, “দিনে দিনে গ্রাম গ্রাম, পরগণা পরগণা দিল্লীশ্বরের হস্তস্খলিত হইতেছে, এক্ষণে পাঠানদিগকে শাসিত না করিলেই নয়, । দূর্গেশনন্দিনী : প্রথম খণ্ড। চতুর্থ পরিচ্ছেদ : নবীন সেনাপতি। এখানের পাঠান বলতে মুসলমানদের বুঝানো হয়েছে আর মুসলমানদের দেখানো হয়েছে ডাকাত ও অত্যাচারি হিসেবে । এখানে ইতিহাসের মিথ্যাচার করেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায তাঁর দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে। আসলে ইতিহাসের সত্য হলো বাংলায় বর্গীদের লুটপাট ডাকাতি কথা সবাই জানে আর বর্গীরা ছিল হিন্দু ধর্মের অনুসরণকারী।

দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস। ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্রের চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সের রচনা। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মোঘল ও পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত হয়। তবে এটিকে সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক উপন্যাস মনে করা হয় না। কোনো কোনো সমালোচক এই উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো উপন্যাসের ছায়া লক্ষ্য করেছেন।

‘সীতারাম’ উপন্যাস শুরু করেন হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাড়িয়ে দিতে। তিনি  লিখন, লঙ্ঘন করিবার সময় গঙ্গারামের পা ফকিরের গায়ে ঠেকিয়াছিল; বোধ হয়, সেটুকু ফকিরের নষ্টামি। গঙ্গারাম বড় ব্যস্ত, কিছু না বলিয়া কবিরাজের বাড়ীর দিকে চলিয়া গেল। ......সৎকার করিয়া অপরাহ্নে শ্রীনাম্নী ভগিনী এবং প্রতিবাসিগণ সঙ্গে গঙ্গারাম বাটী ফিরিয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে দুই জন পাইক, ঢাল-সড়কি-বাঁধা-আসিয়া গঙ্গারামকে ধরিল। পাইকেরা জাতিতে ডোম, গঙ্গারাম তাহাদিগের স্পর্শে বিষণ্ণ হইল। সভয়ে দেখিল, পাইকদিগের সঙ্গে সেই শাহ সাহেব। গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাইতে হইবে? কেন ধর?-আমি কি করিয়াছি? শাহ সাহেব বলিলেন, “কাফের! বদ্ ‍বখ‍‍ত! বেত্স‍‍মিজ! চল্৷”
পাইকেরা বলিল, “চল্৷”

একজন পাইক ধাক্কা মারিয়া গঙ্গারামকে ফেলিয়া দিল। আর একজন তাহাকে দুই চারিটা লাথি মারিল। একজন গঙ্গারামকে বাঁধিতে লাগিল, আর একজন তাহার ভগিনীকে ধরিতে গেল। সে ঊর্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। যে প্রতিবাসীরা সঙ্গে ছিল, তাহারা কে কোথা পলাইল, কেহ দেখিতে পাইল না। পাইকেরা গঙ্গারামকে বাঁধিয়া মারিতে মারিতে কাজির কাছে লইয়া গেল। ফকির মহাশয় দাড়ি নাড়িতে নাড়িতে হিন্দুদিগের দুর্নীতি সম্বন্ধে অতি দুর্বোধ্য ফারসী ও আরবী শব্দ সকল সংযুক্ত নানাবিধ বক্তৃতা করিতে করিতে সঙ্গে গেলেন।

গঙ্গারাম কাজি সাহেবের কাছে আনীত হইলে, তাহার বিচার আরম্ভ হইল। ফরিয়াদী শাহ সাহেব–সাক্ষীও শাহ এবং বিচারকর্তাও শাহ সাহেব। কাজি মহাশয় তাঁহাকে আসন ছাড়িয়া দিয়া দাঁড়াইলেন, এবং ফকিরের বক্তৃতা সমাপ্ত হইলে, কোরাণ ও নিজের চশমা এবং শাহ সাহেবের দীর্ঘবিলম্বিত শুভ্র শ্মশ্রুর সম্যক সমালোচনা করিয়া, পরিশেষে আজ্ঞা প্রচার করিলেন যে, ইহাকে জীয়ন্ত পুঁতিয়া ফেল। যে যে হুকুম শুনিল, সকলেই শিহরিয়া উঠিল। গঙ্গারাম বলিল, “যা হইবার তা ত হইল, তবে আর মনের আক্ষেপ রাখি কেন?”

এই বলিয়া গঙ্গারাম শাহ সাহেবের মুখে এক লাথি মারিল। তোবা তোবা বলিতে বলিতে শাহ সাহেব মুখে হাত দিয়া ধরাশায়ী হইলেন। এ বয়সে তাঁর যে দুই চারিটি দাঁত অবশিষ্ট ছিল, গঙ্গারামের পাদস্পর্শে তাহার মধ্যে অনেকগুলিই মুক্তিলাভ করিল। তখন হামরাহি পাইকেরা ছুটিয়া আসিয়া গঙ্গারামকে ধরিল এবং কাজি সাহেবের আজ্ঞানুসারে তাহার হাতে হাতকড়ি ও পায়ে বেড়ি দিল এবং যে সকল কথার অর্থ হয় না, এরূপ শব্দ প্রয়োগপূর্বক তাহাকে গালি দিতে দিতে এবং ঘুষি, কিল ও লাথি মারিতে মারিতে কারাগারে লইয়া গেল। সে দিন সন্ধ্যা হইয়াছিল; সে দিন আর কিছু হয় না–পরদিন তাহার জীয়ন্তে কবর হইবে। সীতারাম : প্রথম খণ্ড : দিবা-গৃহিণী। প্রথম পরিচ্ছেদ। “সীতারাম’-এর ক্ষমতা ছিল, হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা বঙ্কিমের প্রিয় স্বপ্ন। সীতারাম তাতে সমর্থও ছিল। উপরে উপন্যাসের ঘটনাটা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মিথ্যা ঘটনার মাধ্যমে যেভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছেন তা এক বিরল ঘটনা বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে। আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে ওস্তাদজী দানেশ খাঁ কে দিয়ে মুসলমানদের \’শুয়োর\’ বলে গালি দিয়েছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস গুলো হলো, দূর্গেশনন্দিনী, কপাল কুণ্ডলা,  মৃণালিনী,  বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়,  চন্দ্রশেখর,  রাধারাণী, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী, সীতারাম। এই সবগুলো উপন্যাস ছাড়াও বঙ্কিমের অন্যান্য রচনায় সাম্প্রদায়িকতা তথা মুসলিম বিদ্বেষে ভরপুর।

ঘ.
ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় কারনে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপকতা লক্ষনীয়। সুচতুর  বৃটিশরা এর বীজ বপন করে যায় । বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমান বড় দুই ধর্মের  মানুষের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে দিয়ে কলহের পথ তৈরি  করে দিয়ে যায় । ভারতীয় উপমহাদেশে বৃহৎ হিন্দু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক লোকজন  কারনে অকারনে সংখ্যালঘু মুসলমান এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার নির্যাতন  করেছে এখনো।

কাজেই সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা যে কেমন নির্মম, কদর্য ও ক্ষতিকারক সেটা আমরা অবশ্যই জানি। না-জানবার কারণ নেই।  কিন্তু আমাদের দেশে তো বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে একত্রে বসবাস করেও এসেছে। হিন্দু কৃষক ও মুসলমান কৃষকের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে নি। তারা একে অপরকে উৎখাত করতে চায় নি। নদীতে হিন্দু জেলে ও মুসলমান জেলে এক সাথে মাছ ধরেছে। তাঁতিরা তাঁত বুনেছে। সাধারণ মানুষ একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি ও মসজিদের আজান এক সাথে মিশে গেছে। মানুষ একই পথ ধরে হেঁটেছে, একই বাজার হাটে গিয়ে কেনাবেচা করেছে, থেকেছে একই আকাশের নিচে। কে হিন্দু কে মুসলমান তা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করেনি, নাক সিঁটকায়নি। তাহলে? সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করলো কারা? তৈরি হলো কি ভাবে? কেন? আসলে এই মুসলিম বিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িকতা তৈরী করেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো চরম উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চ বর্ণের হিন্দু লেখক সাহিত্যিকরা গত আড়াই শতো বছর ধরে।

শুধু করলো দুই দিকের দুই মধ্যবিত্ত? হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত। ব্রিটিশ যুগেই এই ঘটনার সূচনা। তার আগে সম্প্রদায় ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। আর সাম্প্রদায়িকতা বাড়লে ব্রিটিশের সুবিধা, কেন না ঝগড়াটা তখন শাসক-শাসিতের থাকবে না, হয়ে দাঁড়াবে হিন্দু-মুসলমানের।

ভারতে এখন মুসলিম বিদ্বেষী উৎকট সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস তাণ্ডব। কংগ্রেসি আমলে সরকার উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ অপশক্তিকে প্রশ্রয় দিত অনেক ক্ষেত্রে। এখনকার বিজেপি সরকার আরো আগবাড়িয়ে তাদের দিচ্ছে আশ্রয়। এমনকি সেই সঙ্ঘবদ্ধ মৌলবাদী, সঙ্ঘ পরিবারের বিশেষ করে স্বয়ংসেবকেরা (আরএসএস) বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের চালিকাশক্তির কেন্দ্র বলে ব্যাপক ও প্রামাণ্য অভিযোগ উঠেছে।

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ

No comments:

Post a Comment