ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস আজ।
মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ
লেখক লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক গবেষক।
আজ সোমবার ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়। আজ থেকে ৪০ বছর ও মৃত্যুর ছয় মাস আগে ৯৬ বছর বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ হয়। সারাদেশের লাখ লাখ জনতা রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে সে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে মারণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো মানুষের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে দিনটি ফারাক্কা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। http://en.prothom-alo.com/opinion/news/74091/Water-issues-must-be-resolved-politically
ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিল ঐ লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন ভারতীয় সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধটির নির্মাণকাজ। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত কিছু পানি ছাড়ে। আর ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয় দেশটি, সেবারই মূলত চাহিদা অনুযায়ী পানি পেয়েছিল বাংলাদেশ। তারপর ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে বাংলাদেশ। অথচ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শীতকালের শুষ্ক মৌসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ। ক্ষতি নিয়ে আর্টিকেল http://bandungjournal.springeropen.com/articles/10.1186/s40728-015-0027-5
ফারাক্কার অভিশাপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। এতে অগভীর নলকূপ থেকে বর্তমানে কোন পানি উঠছে না। সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে ১-২ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রদান করবে। শুষ্ক মৌসুমের সময়ে ভারত বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী পানি প্রদান করলে পদ্মায় অন্তত পানি প্রবাহ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ তার নায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। http://www.futuredirections.org.au/publication/india-bangladesh-farakka-barrage/
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত গঙ্গা তথা পদ্মায় যে অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে, ওই বাঁধ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য আজও মরণফাঁদ হিসেবেই রয়ে গেছে। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এবং গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে এদিন সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠে গোটা দেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায় বাংলাদেশের মানুষের এ ধ্বনি। তাই দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণার উত্স হয়ে আছে। দিবসটি উপলক্ষে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে প্রতি বছর সারাদেশে সেমিনার, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। তবে এ বছর এমন এক সময় দিবসটি পালিত হচ্ছে, যখন দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনে নিষ্পেষিত হয়ে এ দুঃশাসন থেকে মুক্তির প্রহর গুনছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশকে গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ । এখন দেশে অবৈধ অগণতান্ত্রিক সরকার ভারতের মদদতে ক্ষমতায় তাই এরা ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না। রাজনৈতিক সহিংসতায় গোটা দেশ আজ মহাসঙ্কটে নিমজ্জিত। দেশ মহাক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করায় দেশের মানুষ অনেকটা ভুলতেই বসেছে মওলানা ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের গুরুত্ব। http://www.thedailystar.net/op-ed/politics/why-does-bangladesh-need-the-ganges-barrage-104290
ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মায় আজ পানি নেই। ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধশত নদী বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে স্থানভেদে ২৫ ফুট থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তির প্রায় ১৯ বছর হতে চলল তবু পানি চুক্তি রিভিউ করা হয়নি। চুক্তি মতে ফারাক্কায় যে পানি জমছে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগাভাগির প্রসঙ্গ চুক্তিতে উল্লেখ নেই। তাই পদ্মা নদীতে চুক্তির পানি দিয়ে চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না।
যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দীর্ঘ দিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রপে নেই। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না। পালাক্রমে উভয় দেশের মধ্যে পানির ভাগ হয়ে থাকে। ১০ দিনের যেকোনো পালায় পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলে দুই দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে পানিবণ্টনে একটি সামঞ্জস্য বিধান করে থাকেন। ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক পায়। প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক হলে বা তার কম হলে উভয় দেশ সমান সমান ভাগে পানি পায়। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগ দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য মাসে সমস্যা না হলেও মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পানিসমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। পানির দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ হতে পারে এই নিউজ তাই বলছে। http://uk.reuters.com/article/uk-water-southasia-idUKBRE86M0CC20120723
তাই বর্তমান সরকারের কাছে পানি চুক্তি রিভিউ করার দাবি তুলছেন ভুক্তভোগী মানুষ। শুকনো মওসুমে হার্ড্রঞ্জি সেতুর উজান ও ভাটিতে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পদ্মা ও সব শাখা নদীর কঙ্কাল বেরিয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জেলে। বিঘ্ন ঘটেছে সেচকাজে। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে নৌপথ। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ আর্সেনিকসহ অজানা রোগে ভুগছেন। জলবায়ুতে সূচিত হয়েছে বড় ধরনের পরিবর্তন। বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা, বাড়ছে খরার আবহ। থেকে থেকে রাজশাহী ও পাবনায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। লাখ লাখ মানুষ বহুমুখী সঙ্কটে ডুবে যাচ্ছে। আর প্রতি বছর এই অবস্থায় কর্মহীন মানুষ ঢাকা মুখী হচ্ছে।
পদ্মা নদী তার স্বয়ংক্রিয় পরিশোধনমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফারাক্কার প্রভাবে শুধু পাবনা জেলাতেই ২০ নদীতে পানি নেই। এর মধ্যে বেশ কিছু নদী এখন বিলীন হয়ে গেছে। এসব বিলীন হওয়া নদীতে বিভিন্ন মওসুমি ফসল উৎপাদন হচ্ছে। অনেকে জবর দখল করে বাড়ি নির্মাণ করছেন।
পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বিশাল বালুচর পড়েছে। সেখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে, গরু-মহিষের গাড়ি চলছে। হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে। পদ্মার সেই অপরূপ যৌবন ও সৌন্দর্য আর নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মরুকরণ দেখা দেবে। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চলনবিল অঞ্চলের প্রবীণ লোকেরা জানান, চলনবিলসংলগ্ন ১৬টি ছোট নদী, ৩৯টি ছোট বিল ও ৩২টি খাল ছিল। এসব নদী ও খাল এখন শুধু প্রবীণ লোকদের স্মৃতিতে আছে। বাস্তবে এর বেশির ভাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফারাক্কা বাঁধের পর এসব নদী ও খাল শুকিয়ে গেছে। এখন এখানে হচ্ছে বিভিন্ন মওসুমি ফসলের চাষাবাদ। এসব নদী খাল শুকিয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার জেলে তাদের পেশা ছেড়েছেন। এদের কেউ রাজমিস্ত্রি হয়েছেন, কেউ সবজি বিক্রি করছেন আবার কেউবা রিকশা চালাচ্ছেন। আর যুগ যুগ ধরে সংসার চালানো এই পেশায় এখনো যারা রয়ে গেছেন, তাদের দিন কাটছে একবেলা খেয়ে না খেয়ে। পদ্মায় পানি না থাকায় কৃষিপ্রধান পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলে কৃষি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প নামে পরিচিত গঙ্গা-কপোতা (জি-কে) প্রজেক্টের সম্প্রসারণই শুধু বন্ধ হয়নি, যতটুকু চালু রয়েছে পানির অভাবে তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফারাক্কা করালগ্রাসের আরেক রূপ হলো নদীভাঙন। বছরের বেশির ভাগ সময় চর থাকায় পদ্মা ইতোমধ্যেই হারিয়েছে তার নাব্যতা। তাই শুকনো মওসুম শেষে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ার পর হঠাৎ নদীর প্রবাহ তীব্র হওয়ায় পুরো পদ্মাপাড়জুড়ে শুরু হয় নদীভাঙন। এর ফলে নদীতে হারিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। https://bn.m.wikipedia.org/wiki/ফারাক্কা_বাঁধ
প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ক’টি গুরুত্বপূর্ণ ও দিকনির্ধারণী হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে, তার মধ্যে মওলানা ভাসানীর ফারাক্ক মিছিল অন্যতম। ফারাক্কা মিছিল সে সময় জাতীয় স্বার্থে খুবই ফলপ্রসূ অবদান রেখেছিল। এখনও মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলের তাত্পর্য অনেক বেশি। কেননা যেসব কারণে তিনি এ প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিলেন, সে পানি আগ্রাসন এখনও অব্যাহত থাকার পাশাপাশি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারতীয় আগ্রাসন বর্তমানে ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
৪০ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একটি অংশকে মরুভূমিকরণের যে প্রচেষ্টা ভারত করেছিল, মওলানা ভাসানী তা অনুধাবন করে ফারাক্কা মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। তার ৩৪ বছর পর ভারতের মদতপুষ্ট ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থনে ভারত ফের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করে আরেক অংশকে মরুকরণের যে অপপ্রয়াস শুরু করেছিল, তার প্রতিবাদে মওলানা ভাসানীর পর ২০১০ সালে রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবসেই বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে হুঙ্কার দিয়েছিলেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ওই সমাবেশের পরই গ্রেফতার করা হয়েছিল তাকে।
পানিসঙ্কট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে রাজশাহীসহ সারা দেশের পানিসঙ্কট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সুপেয় ও সেচকাজে ব্যবহৃত পানির গভীর সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সঙ্কট আরো চরম আকার ধারণ করবে।
মরণ বাঁধ ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগুচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাঁধের কারণে একদিকে প্রমত্তা পদ্মা যেমন নাব্যতা হারিয়েছে তেমনি দেড় যুগ ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক নদীভাঙন চলছে। এক সময়ের ভয়াল পদ্মা এখন পানিশূন্য। এসব কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। বাংলাদেশ যে একদিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে ৪০ বছর আগেই তা উপলব্ধি করেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ফারাক্কার ক্ষতির কথা চিন্তা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধবিরোধী লংমার্চ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে এসেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের ঠুঠাপাড়া গ্রাম। এই এলাকা দিয়েই প্রমত্তা পদ্মা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ওপাড়ে ভারতের মালদহ জেলার আড়ঙ্গাবাদ ও শোভাপুর এলাকা। বাংলাদেশের ঠুঠাপাড়া পয়েন্ট থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সন্ধ্যার পর নদীপাড়ে দাঁড়ালে ফারাক্কা বাঁধের ঝলমলে আলো অনায়াসেই দেখা যায় বলে জানান স্থানীয়রা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের এতো কাছাকাছি এসেও পদ্মা নদীতে তেমন একটা পানি দেখা গেল না। নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বালুচর। অনেকটা দূরে জীর্ণশীর্ণ পদ্মার স্রোতহীন পানিপ্রবাহ দেখা যায়।
শুধু ঠুঠাপাড়ায় নয় ফরাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার চিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অঞ্চলজুড়ে। গত দেড় যুগ ধরে সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে ভয়াবহ নদী ভাঙন। এই দুই উপজেলার নারায়নপুর, সুন্দরপুর, পাঁকা ও উজির পুর এই চার ইউনিয়ন প্রায় পুরোটায় বিলীন হয়ে গেছে নদী গর্ভে। এছাড়াও দেবীনগর, আলাতুলি, শাহজাহানপুর, ইসলামপুর, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নেও অব্যাহত রয়েছে নদী ভাঙন। এসব ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ভূমিহীন এ মানুষগুলোর করুণ আর্তনাতে প্রায় প্রতিদিনই শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয় পদ্মাপাড়ের গ্রামগুলোতে। ফারাক্কার কারণে পরিবেশের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য মতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ২৫ হাজার হস্ত চলিত নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরের তথ্য থেকে জানান, ফারাক্কার কারণে অতিরিক্ত খরা প্রবণ হয়ে উঠেছে জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। নদীগুলোতে শুকিয়ে যাওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে ক্ষতির মুখের পড়েছে কৃষি।
ভারতের পানি রাজনীতির কাছে বাংলাদেশ অসহায় হয়ে পড়েছে। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, চিকনাই, মরাপদ্মাসহ প্রায় ৫৪ নদ-নদীতে পানি নেই। যে টুকু পানির প্রবাহ ছিল তাও চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের এই সময় পর্যন্ত টানা তাপদাহে শুকিয়ে গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বহুস্থানে হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে অগভীর নলকূপ দিয়ে সেচ কার্য ব্যাহত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি শূন্যতার কারণে কোন স্থানে মাটি ফেটে চৌঁচিড় হয়ে গেছে। পানির জন্য উত্তরের জেলাসমূহে এখন হাহাকার শুরু হয়েছে। গঙ্গার পানি ৩০ সাল মেয়াদি পানি চুক্তির ২০ বছর চলছে।
চলতি বছর জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বাস্তবে চুক্তি মাফিক পানির প্রবাহ আসেনি। নদীপাড়ের মানুষ চোখে পানি প্রবাহ দেখছেন না। পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় এর মূল শাখা নদী গড়াই, আত্রাই এবং এই সকল নদীর সম্পর্কিত অন্যান্য নদীতেও পানির প্রবাহ কমে যায়। তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রক্ষপুত্র নদে পানির প্রবাহ থেমে গেছে। ফলে যমুনা নদীও শুকিয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া গরমের বৃদ্ধি মেয়ে এপ্রিল মাসে প্রায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পৌঁছে গেছে। জেলার ঈশ্বরদী, পাবনা, রাজশাহীতে গড়ে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা চলছে। এই তাপদাহ আরও বাড়তে পারে। নদ-নদীতে পানি না থাকার কারণে তাপদাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। প্রবীণ লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিগত সময়ে এই রকম তাপদাহ এপ্রিল মাসে তারা অনুভব করেননি।
দেশের নদ-নদী বাঁচাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে ৩০ সাল মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি করেন। চুক্তি মাফিক এপ্রিল-মে মাসকে চুক্তির শর্তে পিক শুষ্ক মওসুম ধরে ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ যাই থাক তা কোনভাবেই বাংলাদেশের পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩৪ হাজার কিউসেকের নিচে নামবে না। বাস্তবচিত্র ভিন্ন। ২০ বছরে পদ্মা নদীর এই পয়েন্টে ১৮ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়েছে কি না তা এক বড় প্রশ্ন। এখনও পদ্মায় যে পানি আছে সেটা নালার মত প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে আর বেশী দিন লাগবে না। জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পতিত হয়েছে অনেক আগেই। পদ্মা পাড়ে এখন দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। মাঝে মধ্যে কবতুর দেখা যায়। আর কোন পাখি নেই। পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এই নদীসহ অন্যান্য নদীতে মাছের টান পড়েছে।
আন্তর্জাতিক নদী পদ্মা (গঙ্গা) উজানে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশ ক্রমেই তীব্র পানি সংকটে নিপতিত হয়। কালক্রমে প্রমত্তা পদ্মা নদীর সাথে প্রধান শাখা নদী আত্রাই, গড়াইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে পানির টান পড়তে শুরু করে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। ফলে নদী ও ভূ-গর্ভের পানি দিয়ে সেচ কার্যব্যাহত হয়ে পড়ে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পদ্মা নদীর বুকে চুক্তি মাফিক পানি আসেনি। এখনও পানি পাওয়া যায় না। যদিও হাইড্রোলজি (বর্তমান নাম ভূ-পরিস্থি পানি জরিপ দপ্তর যা উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন) পাবনার অফিস চুক্তি পর থেকে পানি প্রবাহের কোন তথ্য সাংবাদিকদের প্রদান করা হয় না। জিজ্ঞেস করলে সাংবাদিকদের বলা হয় যৌথ নদী কমিশন দিতে পারবে।
পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী গড়াই ও আত্রাইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে এখন পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে। গড়াই নদীর কুষ্টিয়া কয়ারা ব্রিজের নীচেও বালু চর। জিকে প্রজেক্ট কার্যত: অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাইসহ পদ্মার ৫৪টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। কোন কোন স্থানে বালু স্থায়ী মুত্তিকায় রূপ নেয়ায় নদী বক্ষে ফসলের চাষ করে আসছেন কৃষক বহুদিন ধরে। কিন্তু যে ফসলের জন্য সেচের প্রয়োজন সেই ফসল বুনন করে সেচ নদীর পানি দিয়ে সেচ কার্য করতে পারছেন না। পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে সেতু (ব্রিটিশ আমলে নির্মিত) আর লালন শাহ সড়ক সেতু স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের সময় চালু হয়েছে। তিস্তায় পানির প্রবাহ না থাকা আর বর্ষা মওসুমে ফারাক্কার গেট খুলে দিলে দেশে মানুষ ভাসে বানের জলে। নদীতে ড্রেজিং করে গভীরত্ব বাড়িয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হলে বর্ষা মওসুমে আসা পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে সমস্যা হলো নদী ড্রেজিং-এর ফলে উত্তোলিত বালুর স্তূপ কোথায় রাখা যাবে? সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইউরেনিয়াম চুল্লি চালু হলে শুধু এর তাপমাত্রা ঠা-া করতে বার্ষিক ৮১ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানির প্রয়োজন হবে। পানির অর্ধেক রিসাইক্লিং মাধ্যমে পুনরায় ব্যহহৃত হবে। পানির উৎস হিসেবে পদ্মা নদী আর প্রকল্প এলাকায় পাম্প হাউজের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ হবে। যদি পদ্মা নদী থেকে পানির সরবরাহ নেয়া হয় তাহলে এই নদীর দশা আরও করুণ হবে কি? সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।
আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ফারাক্কার বিষয়টি তুলে ধরেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণা হয়ে কাজ করে।
মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ
লেখক লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক গবেষক।
আজ সোমবার ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়। আজ থেকে ৪০ বছর ও মৃত্যুর ছয় মাস আগে ৯৬ বছর বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ হয়। সারাদেশের লাখ লাখ জনতা রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে সে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে মারণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো মানুষের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে দিনটি ফারাক্কা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। http://en.prothom-alo.com/opinion/news/74091/Water-issues-must-be-resolved-politically
ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিল ঐ লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন ভারতীয় সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধটির নির্মাণকাজ। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত কিছু পানি ছাড়ে। আর ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয় দেশটি, সেবারই মূলত চাহিদা অনুযায়ী পানি পেয়েছিল বাংলাদেশ। তারপর ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে বাংলাদেশ। অথচ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শীতকালের শুষ্ক মৌসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ। ক্ষতি নিয়ে আর্টিকেল http://bandungjournal.springeropen.com/articles/10.1186/s40728-015-0027-5
ফারাক্কার অভিশাপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। এতে অগভীর নলকূপ থেকে বর্তমানে কোন পানি উঠছে না। সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে ১-২ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রদান করবে। শুষ্ক মৌসুমের সময়ে ভারত বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী পানি প্রদান করলে পদ্মায় অন্তত পানি প্রবাহ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ তার নায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। http://www.futuredirections.org.au/publication/india-bangladesh-farakka-barrage/
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত গঙ্গা তথা পদ্মায় যে অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে, ওই বাঁধ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য আজও মরণফাঁদ হিসেবেই রয়ে গেছে। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এবং গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে এদিন সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠে গোটা দেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায় বাংলাদেশের মানুষের এ ধ্বনি। তাই দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণার উত্স হয়ে আছে। দিবসটি উপলক্ষে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে প্রতি বছর সারাদেশে সেমিনার, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। তবে এ বছর এমন এক সময় দিবসটি পালিত হচ্ছে, যখন দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনে নিষ্পেষিত হয়ে এ দুঃশাসন থেকে মুক্তির প্রহর গুনছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশকে গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ । এখন দেশে অবৈধ অগণতান্ত্রিক সরকার ভারতের মদদতে ক্ষমতায় তাই এরা ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না। রাজনৈতিক সহিংসতায় গোটা দেশ আজ মহাসঙ্কটে নিমজ্জিত। দেশ মহাক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করায় দেশের মানুষ অনেকটা ভুলতেই বসেছে মওলানা ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের গুরুত্ব। http://www.thedailystar.net/op-ed/politics/why-does-bangladesh-need-the-ganges-barrage-104290
ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মায় আজ পানি নেই। ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধশত নদী বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে স্থানভেদে ২৫ ফুট থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তির প্রায় ১৯ বছর হতে চলল তবু পানি চুক্তি রিভিউ করা হয়নি। চুক্তি মতে ফারাক্কায় যে পানি জমছে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগাভাগির প্রসঙ্গ চুক্তিতে উল্লেখ নেই। তাই পদ্মা নদীতে চুক্তির পানি দিয়ে চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না।
যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দীর্ঘ দিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রপে নেই। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না। পালাক্রমে উভয় দেশের মধ্যে পানির ভাগ হয়ে থাকে। ১০ দিনের যেকোনো পালায় পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলে দুই দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে পানিবণ্টনে একটি সামঞ্জস্য বিধান করে থাকেন। ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক পায়। প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক হলে বা তার কম হলে উভয় দেশ সমান সমান ভাগে পানি পায়। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগ দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য মাসে সমস্যা না হলেও মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পানিসমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। পানির দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ হতে পারে এই নিউজ তাই বলছে। http://uk.reuters.com/article/uk-water-southasia-idUKBRE86M0CC20120723
তাই বর্তমান সরকারের কাছে পানি চুক্তি রিভিউ করার দাবি তুলছেন ভুক্তভোগী মানুষ। শুকনো মওসুমে হার্ড্রঞ্জি সেতুর উজান ও ভাটিতে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পদ্মা ও সব শাখা নদীর কঙ্কাল বেরিয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জেলে। বিঘ্ন ঘটেছে সেচকাজে। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে নৌপথ। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ আর্সেনিকসহ অজানা রোগে ভুগছেন। জলবায়ুতে সূচিত হয়েছে বড় ধরনের পরিবর্তন। বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা, বাড়ছে খরার আবহ। থেকে থেকে রাজশাহী ও পাবনায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। লাখ লাখ মানুষ বহুমুখী সঙ্কটে ডুবে যাচ্ছে। আর প্রতি বছর এই অবস্থায় কর্মহীন মানুষ ঢাকা মুখী হচ্ছে।
পদ্মা নদী তার স্বয়ংক্রিয় পরিশোধনমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফারাক্কার প্রভাবে শুধু পাবনা জেলাতেই ২০ নদীতে পানি নেই। এর মধ্যে বেশ কিছু নদী এখন বিলীন হয়ে গেছে। এসব বিলীন হওয়া নদীতে বিভিন্ন মওসুমি ফসল উৎপাদন হচ্ছে। অনেকে জবর দখল করে বাড়ি নির্মাণ করছেন।
পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বিশাল বালুচর পড়েছে। সেখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে, গরু-মহিষের গাড়ি চলছে। হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে। পদ্মার সেই অপরূপ যৌবন ও সৌন্দর্য আর নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মরুকরণ দেখা দেবে। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চলনবিল অঞ্চলের প্রবীণ লোকেরা জানান, চলনবিলসংলগ্ন ১৬টি ছোট নদী, ৩৯টি ছোট বিল ও ৩২টি খাল ছিল। এসব নদী ও খাল এখন শুধু প্রবীণ লোকদের স্মৃতিতে আছে। বাস্তবে এর বেশির ভাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফারাক্কা বাঁধের পর এসব নদী ও খাল শুকিয়ে গেছে। এখন এখানে হচ্ছে বিভিন্ন মওসুমি ফসলের চাষাবাদ। এসব নদী খাল শুকিয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার জেলে তাদের পেশা ছেড়েছেন। এদের কেউ রাজমিস্ত্রি হয়েছেন, কেউ সবজি বিক্রি করছেন আবার কেউবা রিকশা চালাচ্ছেন। আর যুগ যুগ ধরে সংসার চালানো এই পেশায় এখনো যারা রয়ে গেছেন, তাদের দিন কাটছে একবেলা খেয়ে না খেয়ে। পদ্মায় পানি না থাকায় কৃষিপ্রধান পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলে কৃষি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প নামে পরিচিত গঙ্গা-কপোতা (জি-কে) প্রজেক্টের সম্প্রসারণই শুধু বন্ধ হয়নি, যতটুকু চালু রয়েছে পানির অভাবে তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফারাক্কা করালগ্রাসের আরেক রূপ হলো নদীভাঙন। বছরের বেশির ভাগ সময় চর থাকায় পদ্মা ইতোমধ্যেই হারিয়েছে তার নাব্যতা। তাই শুকনো মওসুম শেষে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ার পর হঠাৎ নদীর প্রবাহ তীব্র হওয়ায় পুরো পদ্মাপাড়জুড়ে শুরু হয় নদীভাঙন। এর ফলে নদীতে হারিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। https://bn.m.wikipedia.org/wiki/ফারাক্কা_বাঁধ
প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ক’টি গুরুত্বপূর্ণ ও দিকনির্ধারণী হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে, তার মধ্যে মওলানা ভাসানীর ফারাক্ক মিছিল অন্যতম। ফারাক্কা মিছিল সে সময় জাতীয় স্বার্থে খুবই ফলপ্রসূ অবদান রেখেছিল। এখনও মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলের তাত্পর্য অনেক বেশি। কেননা যেসব কারণে তিনি এ প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিলেন, সে পানি আগ্রাসন এখনও অব্যাহত থাকার পাশাপাশি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারতীয় আগ্রাসন বর্তমানে ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
৪০ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একটি অংশকে মরুভূমিকরণের যে প্রচেষ্টা ভারত করেছিল, মওলানা ভাসানী তা অনুধাবন করে ফারাক্কা মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। তার ৩৪ বছর পর ভারতের মদতপুষ্ট ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থনে ভারত ফের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করে আরেক অংশকে মরুকরণের যে অপপ্রয়াস শুরু করেছিল, তার প্রতিবাদে মওলানা ভাসানীর পর ২০১০ সালে রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবসেই বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে হুঙ্কার দিয়েছিলেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ওই সমাবেশের পরই গ্রেফতার করা হয়েছিল তাকে।
পানিসঙ্কট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে রাজশাহীসহ সারা দেশের পানিসঙ্কট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সুপেয় ও সেচকাজে ব্যবহৃত পানির গভীর সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সঙ্কট আরো চরম আকার ধারণ করবে।
মরণ বাঁধ ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগুচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাঁধের কারণে একদিকে প্রমত্তা পদ্মা যেমন নাব্যতা হারিয়েছে তেমনি দেড় যুগ ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক নদীভাঙন চলছে। এক সময়ের ভয়াল পদ্মা এখন পানিশূন্য। এসব কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। বাংলাদেশ যে একদিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে ৪০ বছর আগেই তা উপলব্ধি করেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ফারাক্কার ক্ষতির কথা চিন্তা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধবিরোধী লংমার্চ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে এসেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের ঠুঠাপাড়া গ্রাম। এই এলাকা দিয়েই প্রমত্তা পদ্মা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ওপাড়ে ভারতের মালদহ জেলার আড়ঙ্গাবাদ ও শোভাপুর এলাকা। বাংলাদেশের ঠুঠাপাড়া পয়েন্ট থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সন্ধ্যার পর নদীপাড়ে দাঁড়ালে ফারাক্কা বাঁধের ঝলমলে আলো অনায়াসেই দেখা যায় বলে জানান স্থানীয়রা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের এতো কাছাকাছি এসেও পদ্মা নদীতে তেমন একটা পানি দেখা গেল না। নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বালুচর। অনেকটা দূরে জীর্ণশীর্ণ পদ্মার স্রোতহীন পানিপ্রবাহ দেখা যায়।
শুধু ঠুঠাপাড়ায় নয় ফরাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার চিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অঞ্চলজুড়ে। গত দেড় যুগ ধরে সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে ভয়াবহ নদী ভাঙন। এই দুই উপজেলার নারায়নপুর, সুন্দরপুর, পাঁকা ও উজির পুর এই চার ইউনিয়ন প্রায় পুরোটায় বিলীন হয়ে গেছে নদী গর্ভে। এছাড়াও দেবীনগর, আলাতুলি, শাহজাহানপুর, ইসলামপুর, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নেও অব্যাহত রয়েছে নদী ভাঙন। এসব ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ভূমিহীন এ মানুষগুলোর করুণ আর্তনাতে প্রায় প্রতিদিনই শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয় পদ্মাপাড়ের গ্রামগুলোতে। ফারাক্কার কারণে পরিবেশের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য মতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ২৫ হাজার হস্ত চলিত নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরের তথ্য থেকে জানান, ফারাক্কার কারণে অতিরিক্ত খরা প্রবণ হয়ে উঠেছে জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। নদীগুলোতে শুকিয়ে যাওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে ক্ষতির মুখের পড়েছে কৃষি।
ভারতের পানি রাজনীতির কাছে বাংলাদেশ অসহায় হয়ে পড়েছে। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, চিকনাই, মরাপদ্মাসহ প্রায় ৫৪ নদ-নদীতে পানি নেই। যে টুকু পানির প্রবাহ ছিল তাও চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের এই সময় পর্যন্ত টানা তাপদাহে শুকিয়ে গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বহুস্থানে হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে অগভীর নলকূপ দিয়ে সেচ কার্য ব্যাহত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি শূন্যতার কারণে কোন স্থানে মাটি ফেটে চৌঁচিড় হয়ে গেছে। পানির জন্য উত্তরের জেলাসমূহে এখন হাহাকার শুরু হয়েছে। গঙ্গার পানি ৩০ সাল মেয়াদি পানি চুক্তির ২০ বছর চলছে।
চলতি বছর জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বাস্তবে চুক্তি মাফিক পানির প্রবাহ আসেনি। নদীপাড়ের মানুষ চোখে পানি প্রবাহ দেখছেন না। পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় এর মূল শাখা নদী গড়াই, আত্রাই এবং এই সকল নদীর সম্পর্কিত অন্যান্য নদীতেও পানির প্রবাহ কমে যায়। তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রক্ষপুত্র নদে পানির প্রবাহ থেমে গেছে। ফলে যমুনা নদীও শুকিয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া গরমের বৃদ্ধি মেয়ে এপ্রিল মাসে প্রায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পৌঁছে গেছে। জেলার ঈশ্বরদী, পাবনা, রাজশাহীতে গড়ে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা চলছে। এই তাপদাহ আরও বাড়তে পারে। নদ-নদীতে পানি না থাকার কারণে তাপদাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। প্রবীণ লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিগত সময়ে এই রকম তাপদাহ এপ্রিল মাসে তারা অনুভব করেননি।
দেশের নদ-নদী বাঁচাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে ৩০ সাল মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি করেন। চুক্তি মাফিক এপ্রিল-মে মাসকে চুক্তির শর্তে পিক শুষ্ক মওসুম ধরে ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ যাই থাক তা কোনভাবেই বাংলাদেশের পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩৪ হাজার কিউসেকের নিচে নামবে না। বাস্তবচিত্র ভিন্ন। ২০ বছরে পদ্মা নদীর এই পয়েন্টে ১৮ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়েছে কি না তা এক বড় প্রশ্ন। এখনও পদ্মায় যে পানি আছে সেটা নালার মত প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে আর বেশী দিন লাগবে না। জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পতিত হয়েছে অনেক আগেই। পদ্মা পাড়ে এখন দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। মাঝে মধ্যে কবতুর দেখা যায়। আর কোন পাখি নেই। পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এই নদীসহ অন্যান্য নদীতে মাছের টান পড়েছে।
আন্তর্জাতিক নদী পদ্মা (গঙ্গা) উজানে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশ ক্রমেই তীব্র পানি সংকটে নিপতিত হয়। কালক্রমে প্রমত্তা পদ্মা নদীর সাথে প্রধান শাখা নদী আত্রাই, গড়াইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে পানির টান পড়তে শুরু করে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। ফলে নদী ও ভূ-গর্ভের পানি দিয়ে সেচ কার্যব্যাহত হয়ে পড়ে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পদ্মা নদীর বুকে চুক্তি মাফিক পানি আসেনি। এখনও পানি পাওয়া যায় না। যদিও হাইড্রোলজি (বর্তমান নাম ভূ-পরিস্থি পানি জরিপ দপ্তর যা উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন) পাবনার অফিস চুক্তি পর থেকে পানি প্রবাহের কোন তথ্য সাংবাদিকদের প্রদান করা হয় না। জিজ্ঞেস করলে সাংবাদিকদের বলা হয় যৌথ নদী কমিশন দিতে পারবে।
পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী গড়াই ও আত্রাইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে এখন পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে। গড়াই নদীর কুষ্টিয়া কয়ারা ব্রিজের নীচেও বালু চর। জিকে প্রজেক্ট কার্যত: অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাইসহ পদ্মার ৫৪টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। কোন কোন স্থানে বালু স্থায়ী মুত্তিকায় রূপ নেয়ায় নদী বক্ষে ফসলের চাষ করে আসছেন কৃষক বহুদিন ধরে। কিন্তু যে ফসলের জন্য সেচের প্রয়োজন সেই ফসল বুনন করে সেচ নদীর পানি দিয়ে সেচ কার্য করতে পারছেন না। পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে সেতু (ব্রিটিশ আমলে নির্মিত) আর লালন শাহ সড়ক সেতু স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের সময় চালু হয়েছে। তিস্তায় পানির প্রবাহ না থাকা আর বর্ষা মওসুমে ফারাক্কার গেট খুলে দিলে দেশে মানুষ ভাসে বানের জলে। নদীতে ড্রেজিং করে গভীরত্ব বাড়িয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হলে বর্ষা মওসুমে আসা পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে সমস্যা হলো নদী ড্রেজিং-এর ফলে উত্তোলিত বালুর স্তূপ কোথায় রাখা যাবে? সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইউরেনিয়াম চুল্লি চালু হলে শুধু এর তাপমাত্রা ঠা-া করতে বার্ষিক ৮১ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানির প্রয়োজন হবে। পানির অর্ধেক রিসাইক্লিং মাধ্যমে পুনরায় ব্যহহৃত হবে। পানির উৎস হিসেবে পদ্মা নদী আর প্রকল্প এলাকায় পাম্প হাউজের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ হবে। যদি পদ্মা নদী থেকে পানির সরবরাহ নেয়া হয় তাহলে এই নদীর দশা আরও করুণ হবে কি? সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।
আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ফারাক্কার বিষয়টি তুলে ধরেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণা হয়ে কাজ করে।
No comments:
Post a Comment