Saturday, 21 May 2016

কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে।

পর্ব এক।

সূফি বরষণ
১৭৯৩ সালে ভূমি-ব্যবস্থার সংস্কারের নামে বাংলার মুসলিম কৃষকদেরকে  শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ব্যবহার করে কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের নব্য হিন্দু জমিদাররা। ব্রিটিশরা আসার আগে জমিদাররা জমির মালিক ছিল না, শুধু খাজনা তুলে সরকারী কোষাগারে জমা দিত। তারপর ১৭৯৩সালে ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলো, জমিদারদের জমির মালিকানা দেয়া হলো, জমিদাররা জমির চিরস্থায়ী মালিক হলো, জমিদারদের বলা হলো তারা সরকারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমান খাজনা আদায় ছাড়াও আরো যতভাবে খুশি টাকা আদায় করতে পারবে। তবে কোনো কৃষক ও সাধারণ নাগরিক যেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে না পারে। অর্থাত জমিদাররা হয়ে গেল ব্রিটিশ সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী ও কৃষক নির্যাতন অত্যাচারকারী বর্ণ হিন্দু নব্য জমিদাররা গড়ে তুললে সম্পদের পাহাড়।

১৭৯৩ সালে লর্ড  কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার জমি মালিকদের (সকল শ্রেণীর জমিদার ও স্বতন্ত্র তালুকদারদের) মধ্যে সম্পাদিত একটি যুগান্তকারী চুক্তির নাম। এই চুক্তির আওতায় জমিদার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বে জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন। চুক্তির আওতায় জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্ব-দাবি বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও জমিদারদের তরফ থেকে প্রজাদের ওপর রাজস্বের দাবি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। জমিদারদের জমি বিক্রয়, বন্ধক, দান ইত্যাদি উপায়ে অবাধে হস্তান্তরের অধিকার থাকলেও তাদের প্রজা বা রায়তদের সে অধিকার দেওয়া হয়নি। নিয়মিত খাজনা পরিশোধ সাপেক্ষে উত্তরাধিকারক্রমে জমির মালিক থাকার প্রথাগত অধিকার রায়তদের বা কৃষকদের থাকলেও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিল না। সরকারের বেলায় জমিদারদের অবশ্য একটি দায়দায়িত্ব কঠোরভাবে পালনীয় ছিল। সেটি হচ্ছে নিয়মিত সরকারের রাজস্ব দাবি পরিশোধ করা।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে উচ্চ বর্ণ হিন্দু জমিদার ও ইংরেজদের লুণ্ঠন সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ “নবাবের সিংহাসন নিয়ে চক্রান্ত করে, জমিদারী বন্দোবস্ত ও রাজস্ব আদায়ের নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, ব্যক্তিগত ও অবৈধ বাণিজ্য থেকে প্রচুর মুনাফা লুণ্ঠন করে এবং আরও নানা উপায়ে উৎকোচ-উপঢৌকন নিয়ে চার্ণক-হেজেস-ক্লাইভ-হেষ্টিংস-কর্নওয়ালিসের আমলের কোম্পানির কর্মচারীরা যে কি পরিমাণ বিত্ত সঞ্চায় করেছিলেন তা কল্পনা করা যায় না। …. দেখতে দেখতে প্রচুর অর্থ ও নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে কোম্পানি সাহেবরা সত্যি সত্যি নবাব বনে গেলেন। তাদের মেজাজ ও চালচলন সবই দিন দিন নবাবের মতো হয়ে উঠতে লাগল”। ( বিনয় ঘোষ_কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, পৃষ্ঠা ৪৪৫)।

আর ইংরেজদের কাছ থেকে উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের হঠাৎ করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদারির মালিক হওয়ার প্রসঙ্গে ডক্টর আহমদ শরীফ বলেন,
 স্বল্প বেতনভূক’ বণিক নাবিক আর লোফার’ ইংরেজ কর্মচারীরা’ বেঙ্গল নেবুব’- এ পরিণত হলো। আর তাদের এ দেশীয় লুণ্ঠন-সহচর দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দীরা দালালীর মাহত্ম্যে রাতারাতি পরিণত হলো রাজা-মহারাজারয়। এই সম্মিলিত লুটেরা চক্রটি সম্পর্কেই ডক্টর আহমদ শরীফ লিখেছেনঃ “প্রথমে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে কতগুলো ভাগ্যবিতাড়িত, চরিত্রভ্রষ্ট, ধুর্ত, পলাতক, অল্প শিক্ষিত লোক বেনিয়া-মুৎসুদ্দী-গোমস্তা-কেরানী-ফড়িয়া দালালরূপে অবাধে অঢেল অজস্র কাঁচা টাকা অর্জন ও সঞ্চয়ের দেদার সুযোগ পেয়ে ইংরেজদের এ দেশে উপস্থিতিকে ভগবানের আশীর্বাদরূপে জানল ও মানল”। ( ডক্টর আহমদ শরীফ_বঙ্কিম বীক্ষা-অন্য নিরিখে, ভাষা-সাহিত্যপত্র,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী সংখ্যা, ১৩৮২)।

এ প্রসঙ্গে আবদুল মওদুদ লিখেছেন: “আঠার শতকের মধ্যভাগে কলকাতা ছিল নিঃসন্দেহে বেনিয়ানের শহর-যতো দালাল, মুৎসুদ্দী, বেনিয়ান ও দেওয়ান ইংরেজদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যবর্তীর দল। এই শ্রেণীর লোকেরাই কলকাতাতে সংগঠিত হয়েছিল ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট ও বশংবদ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে”। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৮২, পৃষ্ঠা ২৮২)।

আর এইসব উচ্চ বর্ণ হিন্দু দালাল, মুৎসুদ্দী, বেনিয়ান ও দেওয়ান সম্পর্কে কলকাতা মার্কসবাদী গবেষক বিনয় ঘোষ দেখিয়েছেন, কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল ‘নাবিক, সৈনিক ও লোফার’- এই তিন শ্রেণীর ইংরেজের হাতে। তাদের দেওয়ান, বেনিয়ান ও দালালরূপে এদেশীয় একটি নতুন শ্রেণী রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়ে ইংরেজদের জুনিয়র পার্টনাররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

টাউন কলকাতার কড়টা’ বইয়ে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ“………. ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠার শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতি ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে।…… এক পুরুষের দেওয়ানি করে তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক যুগিয়ে এসেছে………। বেনিয়ানরা ……. ছিলেন বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা।…….. আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা এ দেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ত করেন, তখন দেশ ও দেশের মানুষ সম্বন্ধে তাদেঁর কোন ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তাঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ-প্রায় সমস্ত ব্যপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হতো তাঁরাই হলে বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথম যুগের ইংরজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন,হিসেব রক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে”। (টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)।

এখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পিছনে ইতিহাস সম্পর্কে একটু বলা যাক। এই বাঙালি বেনিয়ানরা প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ,বাণিজ্য প্রতিনিধি আর মহাজন শুধু ছিল না, তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও সহচর। ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক হুগলী নদীর উজান বেয়ে যখন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তখন থেকেই এই শ্রেণীর সাথে তাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগর সুবাদে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের রাজনৈতিক গাঁটছাড়া। আঠার শতকের শুরু থেকে সে সম্পর্কে আরো জোদার হয়। এ জন্যই দেখা যায় ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় যে ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করে, তারা সকলেই ছিল একটি বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোক। ১৭৩৯ সালে কোম্পানি কাসিমবাজারে যে পঁচিশ জন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে তাদেরও অভিন্ন পরিচয়। এভাবেই গড়ে ওঠে ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্রমূলক মৈত্রী। মুসলিম শাসনের অবসানই ছিল এই মৈত্রীজোটের উদ্দেশ্য। (এস. সি. হিল তাঁর গ্রন্হ ‘বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-১৭৫৭’-এর ২৩, ১০২, ১১৬ ও ১৫৯ পৃষ্ঠায় প্রমাণপঞ্জীসহ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।)

এই শ্রেণীর লোকেরাই বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ব্যক্তিস্বার্থ ও সংকীর্ণ মোহাচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবশত এই শ্রেণীর লোকেরাই স্বাধীনতার পরিবর্তে পরাধীনতাকে স্বাগত জানিয়েছিল।আর যার ফলাফলচিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
 বিষয়টি খোলামেলা তুলে ধরে এম. এন. রায় লিখেছেনঃ “It is historical fact that a large section of Hindu community welcomed the advent of the English power.” (India In Transition)

আার রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেনঃ “British could winover political authority without any opposition from the Hindus.” (British Paramountcy and Indian Renaissance. Part-II, P-4)

ইংরেজরা বাংলার সাবেক শাসক জাতির ব্যাপারে একদিনের জন্যও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। লর্ড ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “মুসলমানরা সব সময়ই বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত। সাফল্যের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে জানলেই তারা সাথে সাথে তা সংঘটিত করবে”। (Selections from Unpublished Reords of Govt……1784-67; James Long, 1973, P-202)

বিদ্রোহের এ আশঙ্কার কারণেই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা হয়।, তা কর্ণওয়ালিসের যবানি থেকেই খোলাসাভাবে জানা যায়। তার ভাষায়ঃ
“আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ভূস্বামীদেরকের আমাদের সহযোগী করে নিতে হবে। যে ভূস্বাশী একটি লাভজনক ভূসম্পত্তি নিশ্চিন্তে ও সুখে-শান্তিতে ভোগ করতে পারে তার মনে তার কোনরূপ পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগতেই পারে না”। ( বদরুদ্দীন উমর : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংলাদেশের কৃষক, পৃষ্ঠা ২২)


চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজদের জন্য ধারণাতীত সাফল্য বয়ে এনেছিল। তাই, ইংরেজদের ওপর চরম আক্রোশ নিয়ে বাংলাদেশের নির্যাতিত কৃষকরা যখন যুদ্ধরত, ‘মুসলমান মাত্রই রাণীর বিদ্রোহী প্রজা’- রূপে  চিহ্নিত করা হতো। আর অপরদিকে কলকাতার সদ্য বিকশিত উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের এই শ্রেণীটি প্রকাশ্যে ইংরেজদের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণার মাধ্যমে প্রভূর শক্তি বৃদ্ধি করেছিলঃ

ইংরেজদের চরম দুর্দিনে ১৮৯৮ সালের ২১ আগস্ট বাংলার জমিদারগোষ্ঠীর প্রতিভূরূপে কলকাতার সেরা ধনী গৌরচণ মল্লিখ, নিমাইচরণ মল্লিক, গোপিমোহন ঠাকুর, কালীচরণ হালদার, রসিকলাল দত্ত, গোকুলচন্দ্র দত্ত প্রভৃতিরা এক সভা অনুষ্ঠান করে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতি তাঁদের আনুগত্যের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। (সিলেকশন ফ্রম ক্যালকাটা গেজেটস, ভল্যুম-৩, ডব্লিউ এস সিটনকার, পৃষ্ঠা ৫২৫, উদ্ধৃত স্বপন বসু : বাংলার নব চেতনার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৮৩)।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে কলকাতার বর্ণহিন্দু অভিজাত শ্রেণীটির আত্মপ্রতিষ্ঠার সে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীকে পাওয়া যায় তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিৎপুর-বিরাজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলির ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে টাউন কলকাতার দ্রুত বেড়ে ওঠার কারণ এবং ইংরেজদের দ্বারা নব্য-সৃষ্ঠ শ্রেণীটির অবাক উত্থানর কারণ সম্পর্কে এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়।

সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন: “বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকগণের মুৎসদ্দিগিরি, লবণের ইজারা, প্রভৃতির মারফত যাহারা প্রভূত ধন-সম্পদ আহরণ করিয়াছিল, তাহারা এবং মার্ক্সের ভাষায় ‘শহরের চুতর ফড়িয়া ব্যবসায়ীগণ’ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে….. নতুন জমিদার শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হইয়াছিল। এই নতুন জমিদার শ্রেণীটির বৈশিষ্ট্য ছিল- ইংরেজ শাসকগণের প্রতি অচলা ভক্তি…. এবং কৃষির ক্ষেত্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া শহরের অবস্থিত, গ্রামাঞ্চলের ভূসম্পত্তি হইতে ইজারা মারফত অনায়াস-লব্ধ অর্থবিলাস-ব্যসনে জীবন যাপন এবং ‘বেনিয়ান’ লবণের ইজারাদার প্রভৃতি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বগ্রাসী ব্যবসায়ের সহিত ঘনিষ্ট সহযোগিতা। ইংরেজ-সৃষ্ট এই নতুন বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীটি আবির্ভূত হয়। দ্বারাকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রভৃতি ছিলেন এই অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগণ্য।….. সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেছিল, তখন ……. (এই শ্রেণীটি) সংগ্রামরত কৃষকের সহিত যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য কৃষকের সহিত ধনবল ও জনবল নিয়োগ করিয়াছিল”। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯)।

১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ভূমি পরিণত হলো পণ্যে। বহু বনেদী পরিবার রাতারাতি হলো পথের ভিখারী। অন্যদিকে ইংরেজ দেবতার পূজা-আর্চনা করে দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দী গোমস্তা শ্রেণীর লোকেরা জমিদারী কিনে হলো সামন্ত-অভিজাত। ১৮২৯ সালে বাজেয়াফত হলো লাখোরাজ সম্পত্তি। এই সব নিষ্কর জমির আয়ে পরিচালিত মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো। সব দিক থেকেই নেমে এলো অন্ধকার। এরপর এলা রাজ-ভাষার ওপর আঘাত। ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি হলো অফিস-আদালতের ভাষা।হিন্দুরা নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিল পুরোনো নিয়মে। কিন্তু লুণ্ঠিত, বঞ্চিত, অবদমিত, ক্ষুব্ধ, হাতাশা-বিহ্বল, অভিমানাহত মুসলমানরা তখন সারা দেশে সুযোগ পেলেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। বাঙালি হিন্দুঘরের ছেলেরা যখন ইংরেজি শেখার জন্য হেয়ার সাহেবের পাল্কির সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। তখনকার মুসলমান মাত্রই ছিল লর্ড ক্যানিং-এর ভাষায়- ‘মহারানীর বিদ্রোহী প্রজা’। কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু নব্য বিকশিত বাবুশ্রেণী যখন লর্ড ক্লাইভকে দেবতা-জ্ঞানে পূজা করছে, পল্লী বাংলায় জনগণের মধ্যে তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্রমে পুঞ্জিভূত হচ্ছিল চাপা ক্ষোভ আর ঘৃণাৰ। রামেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেনঃ “সারা বাংলায় ইংরেজদের অখ্যাতি এমন রটেছিল যে, একজন ইংরেজ কোন গ্রামে এলে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত, জনসাধারণও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পালিয়ে বাঁচত”। (দি ইকনোমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ১১২)।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও  বাঙালি মুসলমানদের দু:সময়ের চাঞ্চল্যকর আরও অনেক তথ্য দিয়েছেন কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি বইয়ের পৃষ্ঠা ২৭ লেখক এম আর আখতার মুকুল বলেন," চিরস্থায়ী হিসেবে জমিদারির বন্দোবস্ত দেওয়ার প্রস্তাব করে ১৭৯৩ সালের ৬ই মার্চ লর্ড কর্ণওয়ালিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনস্থ ডিরেক্টরদের কাছে লেখা চিঠিতে বললেন, “বেশ কিছু সংখ্যক নেটিভদের হাতে যে বিপুল পরিমাণে মূলধন রয়েছে, তা বিনিয়োগ করার আর কোনও পথ নেই। ….. তাই জমিদারির বন্দোবস্ত নিশ্চিত (চিরস্থায়ী) করা হলে শিগগির উল্লেখিত সঞ্চিত মূলধন জমিদারি ক্রয়ে বিনিয়োগ হবে।”

লর্ড কর্ণওয়ালিস –এর চিন্তাধারা ইংরেজদের দৃষ্টিকোন থেকে সময়োপযোগী ও সঠিক ছিল। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ানী, মুৎসুদ্দিগিরি, বেনিয়ানি এবং ব্যবসার মাধ্যমে কোলকাতার সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে যে বিপুল পরিমাণ মূলধন সঞ্চিত হয়েছিল, অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তা জমিদারি ক্রয়ে বিনিয়োগ হতে শুরু করল। এই নব্য ধনীরা দলে দলে নতুন জমিদার শ্রেণীতে পরিনত হলো।

লর্ড কর্নওয়ালিস এ সময় আর একটা অর্থসহ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তিনি জানতেন যে, প্রাচীন বনেদী জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রাজকোষে প্রাপ্য টাকা জমা দিতে অভ্যস্ত নয়। তাই সামান্যতম গাফিলতির দরুন এবং নতুন বন্দোবস্তের কড়া আইনের দরুন এসব জমিদারি একে একে নীলামে উঠতে লাগল। আর কোলকাতার নব্য ধনী মুৎসুদ্দি বেনিয়ানরা নীলাম থেকে এসব জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হলেন।," চলবে



No comments:

Post a Comment