Sunday 30 April 2017

ফারাক্কা ব্যারেজ, স্পাই-থ্রিলার ও দক্ষিণ এশিয়ায় আশু সংঘাত



ইনডিয়ার পানি আগ্রাসন ও নিরাপত্তা ঝুঁকি
মুসতাইন জহির

ফারাক্কা ব্যারেজ, স্পাই-থ্রিলার ও দক্ষিণ এশিয়ায় আশু সংঘাত

এক.

বাংলাদেশের এই জমিন তৈরি করেছে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে যাওয়া নদ-নদী, তারা জলের সাথে বয়ে এনেছে পলি, কণা কণা পলি জমে জমে তৈরি হয়েছে আমাদের পায়ের নীচের মাটি- বদ্বীপ বাংলাদেশ। এই দেশের বিশাল সবুজে যেই প্রকৃতি ও প্রাণের সমারোহ, সেই সমস্ত আয়োজন নিশ্চিত হয় জলের বিপুল প্রবাহে। পানি ও প্রাণের এক অবিচ্ছেদ্য মানিক-জোড়। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশ ও প্রাণব্যবস্থার টিকে থাকার অলঙ্ঘনীয় শর্ত হচ্ছে জলের এমন অবাধ প্রবাহ। অথচ বাংলাদেশের বেলায় জলের এই চলাচল আটকে দিচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র, ইনডিয়া। বাংলাদেশের মানুষ সহ সব প্রাণের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে- প্রাণব্যবস্থা, প্রাণবৈচিত্র বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। মরুকরণ ও লবনাক্ততার মতো বিভীষিকায় ফেলছে বাংলাদেশকে। সবচাইতে সরাসরি যেই ক্ষতি চোখের সামনে থেকে আড়াল হওয়ার উপায় নাই- তা হচ্ছে; সারা বছরজুড়ে মরা, আধমরা আর প্রায় মরে মরে দশার নদীগুলার- ভর বর্ষার প্রচুর পানি ধরে রাখতে অক্ষম নদীগুলার আশপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষের স্রোত। ভিটে-মাটি, জীবন-জীবিকা হারানোর কষ্ট ও ক্রোধ বুকের মধ্যে নিয়া নিরুপায় মানুষেরা ছড়িয়ে পড়ছে তারা, এখানে সেখানে।

বাংলাদেশের মতো ছোট রাষ্ট্রের সাথে এই ইনডিয়ার বৈরিভাব, অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলার নিজেদের অংশে বাধ, ড্যাম, ব্যারাজ সহ নদীসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে গায়ের জোরে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করতে থাকা- এসবের বুঝি আর কোনো শেষ নাই। দুশমনির এই ধারাবাহিকতা যদি ইনডিয়া বজায় রাখে, তবে এই সংকট যে কোনো সময় তুমুল প্রতিরোধের রূপ নিতে পারে। আর সেই তুমুল প্রতিরোধ কোনোভাবেই এতদিন ধরে চলে আসা বাংলাদেশ-ইনডিয়ার দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিশাবে থাকবে না। কিন্তু কেন থাকবে না? কেন এটা দুই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়বে? সমস্যার কী এমন গুণগত পরিবর্তন এবং চরিত্রগত ভিন্নতা তৈরি হয়েছে? কি কি নতুন উপাদান এসে যুক্ত হয়েছে এর মধ্যে? এসব বিষয়ে কথা-বার্তা বলা জরুরি। সেই চেষ্টা আমরা করবো নিশ্চয়ই।

তবে তার আগে ছোট্ট একটা খবর দেই। বিশ্লেষণ আকরে না হলেও, সাহিত্য আকারে সেই চেষ্টার নজির এর মধ্যেই আমাদের চোখে পড়েছে। এইসব বিষয়ের ইশারা-অনুমান কিম্বা বলা যায় সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতির আগাম একটা চিত্র ইতোমধ্যেই একজন একেছেন- যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক এক ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা-ডুয়ান ইভান্স (Duane Evans) । দুই হাজার সাত সালে সিআইয়ের দায়িত্ব থেকে অবসরে যাওয়া উচ্চপদস্থ এই আমেরিকান গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডুয়ান ইভান্স একটি স্পাই থ্রিলার লিখেছেন— নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা (North From Calcutta) ।

গেল বছর বইটি বের হওয়ার পরপরই বিশ্লেষকদের মনোযোগ কাড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান টানাপোড়েনগুলার মধ্যে একটার সাথে আরেকটার খায়খাতির কতো বিশাল পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তারই ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করেছেন ইভান্স তার এই উপন্যাসে- নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা’য়। উপন্যাসে লেখক ইনডিয়া ও পাকিস্তানকে কর্তার ভূমিকায় রাখলেও পুরা কাহীনি ঘুরে ফিরে বাংলাদেশেকেই ঘিরে থেকেছে। বাংলাদেশ, মানে ইনডিয়ার সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানা ও প্রধান সমস্যা- পানি সমস্যা ঘিরেই উপন্যাসের কাহীনি। বইয়ের প্লট হিসেবে লেখক ‘ফারাক্কা সমস্যা’কে বেছে নিয়েছেন। একটা ‘সন্ত্রাসী হামলায়’ ফারাক্কা ব্যারেজ উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনার সুতা ধরে একটু একটু করে আগাতে থাকে উপন্যাসের কাহিনী। বইটাকে শুধু ‘স্পাই থ্রিলার’ বললে সবটা বলা হয় না। এটা আসলে আর্ন্তজাতিক ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যের লড়াই- পানি ও প্রাণসম্পদের ওপরে কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত নিয়ন্ত্রণ কায়েমের রাজনীতি- ইত্যাদি বিষয়ে এমন একটা ‘ভাষ্য’ যার কাঠামোটা ‘উপন্যাসে’র, উপন্যাসের চরিত্র হচ্ছে ‘গোয়েন্দা-গল্পে’র । গল্পের চল বেশ টানটান, নানা মাত্রার আর সম্পর্কের যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে এই গোয়েন্দা ভাষ্যে।

farakka

......................

শুকনো মরুময়, পানি শূন্য নদীর বুক থেকে উঠে আসছে হাহাকার। আর নদীলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকার অনোন্যপায় সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্য লড়াইয়ের দৃশ্যমান বাস্তবতা।

.......................

পাকিস্তানের সামরিক ইন্টেলিজেন্সের একজন চৌকস- মানে সবকাজে পাকা অফিসার- তারেক দুররানি। তাকে সরকার ডেকে পাঠায় নবগঠিত একটি সংস্থা- আইআরই–এ, উদ্দেশ্য; ফারাক্কা ব্যারেজের ডিজাইন ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। ১৯৭১ সনে বানানো ২,২৫০ মিটার লম্বা ড্যাম এই ফারাক্কা, যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল, এই ফারাক্কা নিয়া বাংলাদেশ সালিশ চাইছে জাতিসংঘে । একই প্রকল্পের অংশ জঙ্গিপুর ক্যানেল, যেটা দিয়া গঙ্গা থেকে হুগলি নদীতে পানি সরানোর কাজ শুরু করে ইনডিয়া ১৯৭৫ সনে। একচল্লিশ দিন সময়ের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা বলে আজো এটা বন্ধ করে নাই ইনডিয়া। শুকনা মৌসুমে পানি সরিয়ে নেয়ার জন্য যা ব্যবহার করা হয়, সেই ব্যারেজ ব্যবহার করেই আবার বর্ষাকালে প্রচুর পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে বন্যায় ভাসানো হয়। এই ব্যারেজের প্রভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ, খরা, ফসলহানি হচ্ছে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন লবনাক্ততায় আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলছে। অথচ ইনডিয়ান ইউনিয়েনের কেন্দ্রীয় সরকার এসব স্বীকার করতে নারাজ। তাদের যুক্তি, এসবের জন্য তারা দায়ী না, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং নদীর পতিপথ সরে যাওয়ার ফলে এটা ঘটেছে। বাংলাদেশ নিরুপায় হয়ে ফোরাম জাতিসংঘকে সালিশ মানছে, সেখানে তারা এর একটা ফায়সালা চাচ্ছে। বাংলাদেশের দাবি শুকনো মৌসুমে ব্যারেজের গেট খুলে দিতে হবে। না হলে এই বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব। কিন্তু ইনডিয়া এই দাবির কানাকড়িও মানতে নারাজ। এই পটভূমিতে পিছন থেকে বাংলাদেশকে জোরালো দাবি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে চাচ্ছে ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস। পুরো কাজটি সমন্বয় করছে পাকিস্তানে নবগঠিত সংস্থা- আইআরই। সে জন্যই মেজর তারেক দুররানির ডাক পড়েছে।

অন্যদিকে, ফারাক্কা ব্যারেজের ২৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে একটি ব্যাপকমাত্রার উৎসবের আয়োজন করছে ইনডিয়া। সেখানে এই প্রকল্পের মূল স্থপতিকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হবে। তাছাড়া সারা দুনিয়ার দৃষ্টি এখন এই দিকে, কাজেই এর সুযোগ নেবে ইনডিয়া। একে উপলক্ষ করে স্থাপনা ও নির্মাণখাতে নিজেদের সাফল্য এবং শক্তি প্রদর্শনের জোর আয়োজনে ব্যস্ত দেশটি। বিভিন্নদেশের রাষ্ট্রদূত, ব্যবসায়ী ও বড় বড় বিনিয়াগকারীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। ফারাক্কা ব্যারেজের স্থপতি-কন্যা সাহার আদভানি’র কণ্ঠে ঝরে পড়ছে প্রবল উচ্ছ্বাস; ইতোমধ্যে ঘটনা চক্রে সে প্রেমে পড়েছে সেই মেজর তারেক দুররানির, তারেককে তাই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করছে প্রবল উৎসাহে, সাহার বলছে; ‘I think you would be impressed by Farakka Barrage. It is going to be a big event, with some senior government officials in attendance, as well as foreign dignitaries’’ । উচ্ছ্বাসের এই প্রাবল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নদ-নদী, কৃষি ও পরিবেশ বিধ্বংসী বাধ বহাল রাখার আগ্রাসী ক্ষমতায় সন্তুষ্ট ইনডিয়া একই সাথে কৌশল ঠিক করেছে- কিভাবে এই বিতর্ক থেকে ফায়দা তুলবে সে। অতিথিদের অভ্যর্থনায় নিয়োজিত সরকারি প্রটোকল অফিসার অনিলের কথায় সেই নিষ্ঠুরতা ও নিখুত কূটনীতিক কৌশলের উদযাপন লক্ষ্য করা যায়, ‘It’s actually a clever strategy, whether India wins or loses in the debate. A high-profile ceremony highliting the dam will emphasize the point that India bows to no one on internal issues. Oviously, that is why our deputy U.N. rep will be here’।

অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীতে বাধ দিয়ে আরেকটি দেশকে শুকিয়ে মরুভূমি বানানোর পরও কিভাবে এই ইস্যুটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার থাকে? অন্যকারো কাছে ‘নত’ না হওয়ার দম্ভ প্রকাশ করতে পারে দেশটি? পারে। কারণ, এর পরই আমরা উপন্যাসের নায়ক তারেকের মাধ্যমে জানতে পারি জাতিসংঘ ভোট দিয়েছে ইনডিয়ার পক্ষে। বাংলাদেশের অস্তিত্ত বিপন্ন হয়ে যাওয়ার মুখেও আন্তর্জাতিক কোনো উদ্বেগ তৈরি হয় নাই। প্রকল্পটি বন্ধ করার কোনো নির্দেশ জারি করা হয় নাই ইনডিয়ার প্রতি। বাংলাদেশের হতাশ প্রতিনিধি ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে বের হয়ে আসেন। চরম অসহায় অবস্থা, কূটনীতিকভাবে বাংলাদেশের আর কিছু্‌ই করার থাকল না।

বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকেরই এরকম পরিস্থিতে আতঙ্কিত হওয়ার কথা। কেউ অবশ্য হাফ ছেড়ে বাচতেও চাইতে পারেন; ইভান্সের কাল্পনিক এ ছবি হুবহু বাস্তবে না ঘটারই সম্ভাবনা- এ বলে যে কেউ নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারেন। কিম্বা সত্যি সত্যিই এই সমস্যা থেকে- সর্বোচ্চ আর্ন্তজাতিক ফোরাম জাতিসংঘের এমনভাবে ইনডিয়ার প্রতি সমর্থনের বিপদ থেকে, হয়তো বাংলাদেশ বেঁচেও যেতে পারতো। কিন্তু ইভান্সের এই কল্পভাষ্যের বাইরে আমরা সম্প্রতি অন্য ঘটনা দেখেছি। নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা উপন্যাসে বলা এই কল্প-বিপদকে বাস্তবে রুপ দিতে অনেক দূর এগিয়েছে স্বয়ং বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ সফরে তিনি ইনডিয়াকে আনুষ্ঠানিক ওয়াদা দিয়ে এসেছেন যে, জাতিসংঘে ইনডিয়ার স্থায়ী সদস্যপদ লাভে তিনি দেশটিকে সমর্থন দেবেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কার্যত বাংলাদেশের মৃত্যু পরোয়ানায় নিজের হাতে সই করে এসেছেন। ইনডিয়া যদি জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে, তবে পানি সমস্যা- ফারাক্কা সমস্যা- সীমান্ত বিরোধ ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার বিষয়ে সালিশ বা শুনানি তো দূরের কথা, এগুলো আলোচনার জন্য উঠানোর সুযোগই বন্ধ হয়ে যাবে। যেখানে নিরাপত্তার স্বার্থে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কূটনীতিক কার্যক্রম প্রসারিত করা দরকার, সেখানে বরং উল্টো আত্মঘাতী কবর রচনার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ আগ্রসর হচ্ছে। এতদূর পর্যন্ত কি অনুমান করতে পেরেছিলেন ডুয়ানে ইভান্স?

বিপদের ঘনঘটার ভেতর আচমকা জানা যায়, আইআরই নিজের কাজের পাশাপাশি অন্য এক ক্ষেত্রে এলটি’কে সহায়তা করছে। অ্যাটোমিক ডিমলিশার দিয়ে ‘ফারাক্কা ব্যারেজ ২৫ বছর পূর্তি’র জমকালো উৎসবের সময় ব্যারেজ উড়িয়ে দেবার কাজে আইএরআই সাহায্য করছে অন্য একটি সংগঠনকে- এলটি’কে। সেখানে এলটি বা আইআরই-এর কমন স্বার্থ হচ্ছে কাশ্মিরে সার্বক্ষণিক যুদ্ধে নিয়োজিত বিশাল ইনডিয়ান সেনাবাহিনীর ভারসাম্যের বদল ঘটানো। তাদের ক্ষমতা কমিয়ে শক্তির হিশাবে নিজেদের এগিয়ে থাকার শর্ত তৈরি করা। আবার অদ্ভুতভাবে, ইভান্স ইঙ্গিতে দেখাচ্ছেন যে, ব্যারেজ উড়িয়ে দেবার অপারেশনে নিয়োজিত বাহীনির সাতজন সদস্য বাংলায় কথা বলে। ব্যাস, এটুকুই তথ্য এবিষয়ে, আর বেশি কিছু নয়। ফারাক্কা ব্যারেজ উড়িয়ে দিতে অতি উচ্চমাত্রার এক ‘সন্ত্রাসী’ হামলায় রওয়ানা হয়েছে যারা, তাদের কাফেলার সাত জন বাংলায় কথা বলে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সব কূটনীতিক চেষ্টা যখন বিফল, বাংলাদেশে অস্তিত্বের প্রতি হুমকি যে ব্যারেজ- সে ব্যারেজ বিষয়ে জাতিসংঘও যখন কিছু করছে না। তখন সেই ব্যারেজ উড়িয়ে দেবে লস্কর-ই-তাইয়েবার একদল লোক! এরা কারা? তারা কি মরুপ্রায় শুকনো নদীর চরে জীবন-জীবিকার শর্ত হারানো উন্মুল কেউ? তারা কি এমন কেউ যারা ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু? ফারাক্কা ব্যারেজে এই হামলার পাশাপাশি, বারো ঘন্টার মধ্যেই আবার উত্তর-পূর্ব ইনডিয়ার স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরাও যুদ্ধ শুরু করবে। চারদিক থেকে কোনঠাসা করে যাদেরকেও এই সমীকরণে ঠেলে দিয়েছে ইনডিয়া, তারা যুক্ত হয়েছে এই সমস্যার সাথে অনিবার্যভাবে। কি হতে যাচ্ছে তাহলে? কি করবে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের মানুষ? কল্পনা আর নিরাপত্তা ঝুকির অনুমান নির্ভর এক গোয়েন্দাভাষ্যে সম্ভব-অসম্ভবের মানচিত্র ফুটে উঠছে। সেখানে বঞ্চনা ও ক্রোধ, অসহায়ত্ব ও প্রতিশোধের বারুদে কি অগ্নিশিখা জ্বলে উঠবে? তাছাড়া যেভাবে বাস্তব ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে তাতে করে কি ঘটবে ইভান্সের উপন্যাসের বাইরে?



দুই.

north from calcutta

...........................

ডুয়ান ইভান্স নিউ মেক্সিকো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। তারপর, সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রাগ-এ ৮২ এয়ারব্রোন ডিভিশনে নিয়োজিত হন। স্পেশাল ফোর্স অফিসার প্রশিক্ষণ সহ রেঞ্জার স্কুল করেন। এবং সেনাবাহিনীতে প্যারাশুটিঙে মাস্টার রেটিংও পান।

ছয় বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর, ১৯৮৩ সনে সিআই-এ যোগদান করেন। বিদেশে ইভান্স অপারশেন অফিসারের দায়িত্ব পালন করতেন। মাঠপর্যায়ের সর্বোচ্চ পদ স্টেশন চিফ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ইন্টেলিজেন্স স্টার খেতাব পান। দীর্ঘদিন দিল্লীতে কর্মরত ছিলেন। চারটি মহাদেশ কাজেরসূত্রে বিচরণ করেছেন। সিআইএ থেকে অবসরে যান ২০০৭ সনে। এটা তার পয়লা উপন্যাস—যা লেখার পরিকল্পনা করছিলেন সেই ১৯৯৫ থেকে। অবশেষে গতবছর শেষ হয়ে তা বই আকারে বের হয়।

..........................

উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী এই লড়াইয়ে হঠাৎ যুক্ত হতে গেল কেনো? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সর্বশেষ ইনডিয়া সফরে যেমনতরো ‘নিরাপত্তা’ চুক্তি করে এসেছেন- সফর শেষে ঘোষিত সমঝোতা ইশতেহারে যেমন সাফসাফ ইশারা পাওয়া যায়- বাংলাদেশকে একটা সম্প্রসারিত যুদ্ধের পক্ষভূক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; তাতে মনে হচ্ছে ইভান্সের ইঙ্গিত বাস্তবায়নের পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, হয়তো সহসাই।

বাংলাদেশ ও ইনডিয়ার দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক শেষে, দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত ওই যৌথ ইশতেহারে মোট একান্নটি দফা আছে। প্রথম বারোটি দফায় কূটনীতিক রেওয়াজ পালন করা হয়েছে- বৈঠকের প্রেক্ষাপট, উপস্থিত প্রতিনিধিদলের সদস্য ইত্যাদি বিষয়ের গতানুগতিক বর্ণনা। তবে সেখানে ইনডিয়ার প্রতিনিধি দলে একজন ব্যক্তির উপস্থিতি ঠিক ‘গতানুগতিক’ বলে ধরে নেয়া যাচ্ছেনা। ইনডিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা- শ্রী টি.কে.এ. নায়ারের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। কারণ, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কোনো নীতিনির্ধারক সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

সফরের আগে থেকেই তিনটা চুক্তিনির্দিষ্ট করা ছিল। এসব চুক্তির সব বিশয়াষয় ‘নিরাপত্তা বিষয়ক সহযোগিতা’ বলে সফরের মাসখানেক আগে থেকে তুমুল প্রচার চালানো হয়। আসলে এই নিরাপত্তা কার জন্য এবং বাংলাদেশ কেন এটাকে নিজের রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে জায়গা দেবে, এই বিষয়ে ঝুকিপূর্ণ রাজনৈতিক অবন্থান নেবে, এই নিয়ে নাগরিকেদের মত-অমত ও সামাজিক সমর্থন যাচাই করা তো দূরের কথা- কোনো ধরনের জাতীয় সংলাপ বা আলোচনা তোলা হয়নি। জাতীয় পরিসরে সে ধরনের আলোচনা অবশ্য দুই সরকারের জন্যই অসুবিধে তৈরি করতে পারতো, কারণ চুক্তিগুলার আসল উদ্দেশ্যটাই আড়াল করে হাজির করা হয়েছে মানুষের সামনে।

পরাশক্তির চালু করা জিনিশ- ‘সন্ত্রাস’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’ ঠিক কি জিনিশ সেই বিষয়ে দুনিয়ার মানুষ একমত না- তবু ‘সন্ত্রাস’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ প্রতিরোধের নামে দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এই সুযোগে ইনডিয়া তার নিজের দেশের ভেতরের বা আঞ্চলিক সমস্যাকে ওই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র কাতারে ফেলে একই কায়দায় সমাধানের রাস্তা খুঁজছে। সেই বিপজ্জনক রাস্তায় দেশটি বাংলাদেশকে টেনে নিতে চাইছিল বহুদিন ধরে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের টুইন-টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর থেকে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির মওকা পেয়ে জব্বর চাপাচাপিতে ফেলে দিয়েছিল । কিন্তু এবার চাপাচাপি করে নিজের শক্তি খরচ করা তো লাগলোই না, বরং একদম অনায়াসে-- একেবারে আয়েশ করে নিজের যুদ্ধাভিযানের সারথি বানিয়ে নিলো। এই যুদ্ধ ইনডিয়ান ইউনিয়নের নানা রাজ্যভূক্ত নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইউনিয়নভূক্ত নানা অঞ্চলে দখলদারি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-নির্যাতন, বলপ্রয়োগ ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মুক্তির লড়াই নির্মূল করার এই যুদ্ধে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে শামিল করলেন।

দমন-নির্যাতন ও রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনগণের ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভ ও বিদ্রোহকে নিরাপত্তার সমস্যা হিসেবে দেখার নীতি ইনডিয়া নিতেই পারে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের কেন একইভাবে শামিল হতে যাবে? নিজের রাষ্ট্রীয় নীতির-নিরাপত্তার বিবেচনা ছাড়া, বিনা প্রশ্ন ও বাক্য ব্যয়ে বাংলাদেশ কেন ইনডিয়ার যুদ্ধযাত্রায় সঙ্গী হবে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নাই সরকারের কাছে। অবশ্য কখনো সখনো এটা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, এসব চুক্তির ফলে ইনডিয়ায় পালিয়ে যাওয়া সুব্রত বাইনদের মতো অপরাধী- চাঁদাবাজ আর ভাড়াটে খুনিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। একদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনের মধ্যে সাধারন অপরাধী, অন্যদিকে ইনডিয়ার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইরত গেরিলা বাহীনিগুলার সদস্যদের এক কাতারে ফেলে বিবেচনা করছেন তারা; এতে করে পুরা পরিস্থিতেকে তারা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক করে তুলছেন- বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত করে তুলছেন। দেশের আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সহায় হবে- একথা বলে বাংলাদেশে যেভাবে একটা দীর্ঘমেয়াদী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাভিযানে পক্ষ নিচ্ছে এটা রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে মস্ত ঝুকির মধ্যে ফেলে দেবে। পররাষ্ট্রনীতির জায়গা থেকে নিদেনপক্ষে নিরপেক্ষ না থেকে এই যুদ্ধে সরাসরি ইনডিয়ার পক্ষ নেয়ার ফল কি হবে সেটা বোঝার সময়ও বাংলাদেশ পাবে কি না, সন্দেহ আছে। ইনডিয়াও যে পার পেয়ে যাবে সেই সুযোগ নাই, খেসারত ইনডিয়াকেও কড়ায়গন্ডায় গুণতে হবে- যদি ইভান্স ঠিক ঠিক বুঝে থাকেন। সেই প্রসঙ্গে খানিক পরে আসছি।

যদি বাংলাদেশে আসলেই নিজেদের নিরাপত্তা সংহত করতে নতুন কোনো উদ্যোগ দরকার আছে বলে ধার্য করে, তবে সেটা ইনডিয়া-ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাস বিরোধী প্রকল্পে’র বাইরে থেকেও করা সম্ভব। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-নৈতিক ভিত্তি ও কৌশলকে ভিত্তিকে করেই সেটা সম্ভব। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের এটা এক দিক থেকে সুবিধেরও ছিল। কিন্তু সে দিকে না গিয়ে সরকার নিজেই বিপদের দিকে পা বাড়িয়েছে। নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের নৈতিক ও ঐতিহাসিক সংবেদনার যে ভিত্তি আছে, সেই ভিত্তি থেকেই ইনডিয়ার পূর্বাঞ্চলের সাতবোন থেকে কাশ্মির পর্যন্ত চলমান আত্মনিয়ন্ত্রণ কায়েমের লড়াইকে বিবেচনা করতে পারতো বাংলাদেশ। এই বিবেচনা থাকা উচিত নিজেদের রাষ্ট্রীয় শক্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থেই; কোনে ভাবাবেগ বা সংকীর্ণ বিদ্বেষ পোষণের মামলা এটা নয়। একটি স্বীকৃত ও বৈধ রাজনৈতিক লড়াইকেও ইনডিয়ার সাথে সাথে শেখ হাসিনা যেভাবে একাকার করে ফেলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়িই ইভান্সের কল্পিত ছক মাফিক যুদ্ধের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে এই অঞ্চল।

যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে: ''activities inimical to the other and resolved not to allow their respective territory to be used for training, sanctuary and other operations by domestic or foreign terrorist/militant and insurgent organizations and their operatives''. অন্যদেশের ইনসারজেন্সি দমন করা বাংলাদেশের কর্তব্য? তার ওপর, লক্ষণীয় হচ্ছে, বিদ্রোহী সংগঠন বলেই থামছে না ইশতেহার, বলছে অপরাপর ‘‌‌কর্মকাণ্ড’ এবং তাদের সংশ্লিষ্ট যে কেউ। এর আওতা এতটাই সীমানা ছাড়া ও লম্বা আছে যে ননকম্ব্যাটেন্ট বা যোদ্ধা ছাড়াও যে কোনো বেসামরিক সহমর্মী, সহানুভূতিসম্পন্ন লোক কিম্বা প্রাণভয়ে পালানো পরিবারের সদস্য অথবা আক্রান্তদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কিম্বা আক্রান্তদের পক্ষে জনমত তৈরিতে ব্যস্ত লোকেদেরও অনায়াসে এই ‘সন্ত্রাসে’র মধ্যে ফেলা যাবে। মানবাধিকার তো দূরে থাক, কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সর্বাত্মক শকুনে যুদ্ধ (অল আউট ওয়ার) চালানোর সাফসাফ ইশতেহার এটা। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে বাংলাদেশের সক্ষমতা যাচাই করার কোনো দরকারই মনে করেন নাই শেখ হাসিনা। কি পরিমাণ ঝুকি থাকতে পারে এতে, সেটা নির্ধারণ করার কোনো আগ্রহও দেখান নাই। দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে তিনি এক ভয়াবহ আসন্ন যুদ্ধের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছেন। ইভান্সের, অর্থাৎ পরাশক্তির কৌশলবিদদের তৈরি করা সমীকরণের দুই মাথার অংকটা শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে গিয়ে মিলিয়ে দিয়ে আসলেন। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে একটা ব্যাপক মাত্রার মেরুকরণ আসন্ন; আর যুদ্ধ সম্ভবত শুরু হলো শেখ হাসিনার রাজি-খুশিতেই। উত্তর-পূর্বভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গলাটিপে ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। আর এত এত কাজে তার একমাত্র উপস্থিত পরামর্শক হলেন শ্রী নায়ার—দিল্লির সাউথব্লকই তার ভরসা।

অবশ্য নয়াদিল্লির সাউথব্লকের কর্তাব্যক্তিরা- ইনডিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সরকারও ইনডিয়াবাসীর জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনছেন এর মাধ্যমে। শুধু বাংলাদেশ না, বরং এই যুদ্ধে ইনডিয়ারও দুর্দশা পাকাপোক্ত হবে। অন্তত ইভান্সের মূল্যায়ন তো সেই ছবিই আঁকছে। সাতকন্যার অবস্থান থেকে বাংলাদেশ খুব একটা দূরে না। বাংলাদেশ যদি ইনডিয়ার হিংস্র থাবা ও নখর বিস্তারের জায়গা তৈরি করে দেয় তবে সাতকন্যার স্বাধীনতাকামীরাও এর বদলা নিতে বাংলাদেশের ওপর তাদের সমস্ত শক্তি খরচ করবে। খুঁজে নেবে আপন আপন মিত্রজোট। সেই দিকে এবার ফেরা যাক। পাকিস্তানের একজন সেনাকর্মকর্তা তার উপরওয়ালাকে, যাকে ডুয়ানে ইভান্স চিত্রিত করেছেন ঘটনাচক্রের একজন মূখ্য প্রযোজক হিসেবে, অপারেশনের শেষ মুহূর্তের খুটিনাটি জানাচ্ছেন। ``We have cordinated two indigenous insurgent groups. Within the next 12 hourse, they will begin to step up their operations here and here. Haq pointed to areas in Nagalnd and Manipur. ``I might mention that this is the first time that they have cooperated oparationally, and nither group is Islamic, they are ethnic minorities with long-standing grievancec against India’’।

দেখা যাচ্ছে, ফারাক্কার অপারেশনটি চালানো যখন, তখন এর সাথে একই সময়ে শামিল হবে ইনডিয়ান ইউনিয়নের থেকে স্বাধীনতাকামী দুটো বাহিনী, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরের। যারা কেউ নিশ্চয়ই ‘ইসলামী’ দল নয়। দীর্ঘদিনের দখলদারি ও বঞ্চনা তাদের ক্ষোভের কারণ, বিদ্রোহ তাদের দীর্ঘদিনের, কিন্তু এই প্রথম তারা পাশাপাশি এসে একসূত্রে একটা অপারেশনে কাজ করছে, সমন্বিতভাবে। যেটা আগে কখনো ঘটে নাই। এখানে বুঝতে হবে আলাদা করে ‘ইসলামী’ কথাটা বলার একটা কারণ আছে। একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সূচনা হয়েছে—ইসলামী একটা দলের অপারেশনের সাথে একযোগে যুক্ত হয়ে কাজ করছে ভারতের দুটি জাতীগোষ্ঠীর সংগঠন। সেই দলটির নাম লস্কর-ই-তাইয়েবা, এলইটি! এতদিন পরে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার কারণ কি- সেটার কোনো ব্যাখ্যা ইভান্স দেন নাই। কিন্ত আমরা বুঝতে পারি; যে বই ইভান্স বের করেছেন তার সাবেক কর্মস্থল- সিআইএর অনুমোদন নিয়ে- তাদের পুরো কাহিনী দেখিয়ে- সেই বইয়ে তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারেন না। সেই ‘বেশি কিছু’টা কি হতে পারে? আকলমন্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি! চীনকে যখন ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা সমানে চলছে, তখন চীনও নিশ্চয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।

তো, এলইটি যেই হামলার দায়িত্বে থাকবে সেটার লক্ষ্যস্থল ফারাক্কা ব্যারেজ কেন? তীক্ষ-পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ইভান্সের কাহিনীতে- এই অঞ্চলের সামগ্রিক সংঘাতের চরিত্র তিনি তুলে ধরেছেন নানা প্রতীকের মাধ্যমে। যেসব বিষয় পুরো সংঘাতের মধ্যে এখন কেন্দ্রে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে, তার একটা অবশ্যই ‘পানির বিরোধ’, অন্যতম প্রধান বিরোধ। ইনডিয়ার সাথে অভিন্নআন্তর্জাতিক নদীর পানিবন্টন নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘকালীন সমস্যায় আটকে আছে। যৌথ ৫৪টি নদীর উপরই ইনডিয়া কোনো না কোনো প্রকার বাধ বানিয়েছে- ব্যারাজ কিম্বা ড্যাম- কিম্বা সেচ প্রকল্পের নামে গায়ের জোরে পানি প্রত্যাহার করছে। সবমিলিয়ে পানি প্রত্যাহারের জন্য ইনডিয়ার গ্রহণ করা নানামুখি প্রকল্পগুলা সংঘাতের দিকে এই অঞ্চলকে ঠেলে দিচ্ছে, ক্রমাগত। সর্বশেষ টিপাইমুখ প্রকল্প- সম্ভাব্য সংঘাতের তীব্রতাকে আরো আরেক ধাপ ওপরে উঠিয়েছে। পানির পর্যাপ্ত ও যথাযথ প্রবাহ শুধু বাংলাদেশের কৃষি, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষার জন্যই একান্ত আবশ্যক নয়, সাথে নদী বিধৌত পলিস্তরে গড়ে ওঠা ভূ-ভাগের অস্তিত্ব বজায় থাকার সম্পর্কও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। শুধু পানি, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থাকলে- বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটির প্রাণের বিকাশ-ধারা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সকল শর্তের উপস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে, যাচ্ছে।

কথা হলো; নিজের একার রাষ্ট্রীয় তৎপরতায়,আন্তর্জাতিক ফোরামে দেনদরবার করে, আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের সমর্থন নিয়ে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা করে, বাংলাদেশে কি সেই ‘শুকিয়ে মরা’র সম্ভাবনা ঠেকাতে পারবে? এমন কি ক্ষমতা বা শক্তির ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করতে পারে বাংলাদেশ, যাতে করে সে আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে নিজের ন্যায্য অধিকারটুকু আদায় করে আনতে পারবে? সেই প্রশ্নে কিছুটা এগিয়ে, সেই প্রশ্ন সামনে রেখে ইভান্স আভাস দিচ্ছেন; ইনডিয়ার একরোখা মনোভাব আর আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের অদূরদর্শিতার যোগফলে কেমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এই অঞ্চলে। বাংলাদেশের নদীগুলা শুকিয়ে মেরে, পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে ইনডিয়া কোনোভাবেই নিজের নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখতে পারবেনা। কিভাবে ইনডিয়ান ইউনিয়নের নিরপাত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে, সেই ঘটনা পরম্পরা কিভাবে অগ্রসর হতে পারে, সেই ইশারা খানিকটা আমরা পেলাম নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা উপন্যাস থেকে।

যদিও ইভান্স সমাপ্তি টেনেছেন এইভাবে যে, খোদ আইএসআই অফিসার মেজর তারেক দুররানির জীবনবাজি প্রচেষ্টায় শেষ মুহূর্তে বানচাল হয়ে যায় অপারেশন ফারাক্কা। কিন্তু সে চেষ্টা একবার ব্যর্থ হলেই কি থেমে যাবে? তাছাড়া, শুধু তো গোয়েন্দা গল্পের মধ্যেই আর বিষয়টি সীমিত নাই। এই যেমন সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে ফিলিপ বাওরিং লিখেছেন- ‘India's opening with Bangladesh’, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একজন ভাষ্যকার ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শক হচ্ছেন বাউরিং। এবছরের বারোই জানুয়ারি প্রকাশিত লেখায় বাউরিং বলছেন, ইনডিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি, সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ কিংবা ট্রানজিটের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ইস্যু হচ্ছে পানি। ইনডিয়া যেভাবে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করছে, তাতে করে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়া খুবই ‘সঙ্গত’,, পানি বাংলাদেশের প্রাণরক্ষার জন্য ‘রক্ত সঞ্চালন’র মতো। অভিন্ন নদ-নদীসমূহের পানি পাওয়া না পাওয়া আর বাংলাদেশের টিকে থাকা না থাকা, জনগণের বাঁচা-মরা একই সূত্রে গাথা। এটা অনিবার্যভাবে সম্পর্কিত। তবু বাংলাদেশকে মরুভূমি বানাবার পথ ছেড়ে সরে আসছে না ভারত। তাহলে, যে কাঁটায় জলপ্রবাহের শরীর আর বাংলাদেশের প্রাণ ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে সেটা সরাবে কে? ইভান্স যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সেদিকেই কি এগুতে থাকবে অবশেষে!

 http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showAerticle/98/bangla#sthash.4dUw15K6.dpuf

http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showAerticle/98/bangla

শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক



শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক
মো. এমরান জাহান |


আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা কে?

 নিঃসন্দেহে শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। যিনি নিজেই ‘গ্রেট বাঙালি রেস’-এর প্রতিভূ বলে দাবি করতেন। শেরেবাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু। দুই মহান বাঙালি। একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, অন্যজন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমন্বিত করে একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন।

শেরেবাংলাকে আমরা কমই স্মরণ করছি। বাঙালির মধ্যযুগের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমল (১৪৯৩-১৫১৯)। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারের লেখক আবুল ফজলের ন্যায় তেমন কেউ ছিল না। তাই বাঙালির কাছে আজ আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বিস্মৃত। আধুনিক যুগেও এমন কথা বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ন্যায় শেরেবাংলার এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যারা আজ বলবে কীভাবে বরিশালের চাখারের আবুল কাশেম বাঙালির কাছে শেরেবাংলা বা বাংলার বাঘ হয়ে উঠলেন।

হিন্দু মুসলিম বিভক্ত রাজনীতির মধ্যে কীভাবে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রথম সূত্রপাত করেন এ কে ফজলুল হক।
১৮৭৩ সালে ফজলুল হকের জন্ম এক মুসলমান মধ্যবিত্ত জোতদার পরিবারে। বাবা ছিলেন বরিশাল বারের একজন জনপ্রিয় আইনজীবী। টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারের শেখ মুজিব আর বরিশালের চাখারের ফজলুল হকের পরিবার বিত্তে এবং চিন্তাচেতনায় ছিল প্রায় কাছাকাছি। তবে শেরেবাংলা ছিলেন মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এমএ ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি এবং অঙ্কশাস্ত্রে। তার এ শিক্ষা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা পালনে সহায়ক হয়। একই সঙ্গে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে রাজনীতির কলকাঠি চালাতেও সক্ষম হয়। বিয়ে করেছিলেন আরেক আধুনিক বাঙালি নেতা নবাব আব্দুল লতিফের নাতনি ঢাকার এক সৈয়দ পরিবারের কন্যা খুরশীদ তালাতকে।

ফজলুল হকের রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত হয় ছাত্রজীবনেই। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী কলকাতায়। তখন ঢাকা বিস্মৃত এক শহর। প্রথম পর্যায়ে তিনি ১৮৮৯ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। শিক্ষাজীবন এবং আইন ব্যবসার সূত্রপাত হয় ওই সময়কালেই। কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন, কংগ্রেসের রাজনীতি, আলীগড়কেন্দ্রিক মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ রাজনীতির ধারা, নবাব আব্দুল লতিফ এবং স্যার সৈয়দ আমীর আলীর নেতৃত্বে মুসলিম পুনর্জাগরণ কর্মকাণ্ড ইত্যাদি যুবক ফজলুল হককে আলোড়িত করে।

বাবার মৃত্যুর পর ফজলুল হক বিশ শতকের শুরুতে কলকাতা ছেড়ে বরিশালে চলে আসেন। যোগদান করেন বরিশাল বারে। বরিশালে তখন অশ্বিনী কুমার দত্তের নেতৃত্বে চলছে সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ফজলুল হক বরিশাল থাকাকালীন পৈতৃক ক্ষুদ্র জমিদারিও পরিচালনা করেন। কোর্ট-কাচারিতে বিচার বঞ্চিত প্রজাদের আর্তনাত এবং জমিদারদের প্রজাপীড়ন ও মহাজনদের শোষণ-অত্যাচার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। এসব প্রজাপীড়ন তাঁর মানসিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল, যা পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ করি। সেই থেকেই কৃষক প্রজা মুক্তি আন্দোলনে নিজেকে সমর্পণ করেন। গড়ে তোলেন কৃষক প্রজা সংগঠন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘ফজলুল হককে বই পড়ে কৃষক প্রজার দুঃখ দুর্দশার কথা জানতে হয়নি।’

১৯০৫ সালে অবহেলিত ঢাকাকে রাজধানী করে গঠিত হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ। কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে ঢাকা ও পূর্ব বাংলার জনজীবনে। ফজলুল হক সঠিক সিদ্ধান্ত নেন। স্যার সলিমুল্লাহর সঙ্গে বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সেই থেকে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর রাজনীতির সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় যখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত হয়, তখন সাংগঠনিক তত্পরতায় তিনি সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। এখান থেকেই রাজনীতির পাঠ শুরু। ফজলুল হক কিছুদিন সরকারি চাকরিও করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা ফজলুল হকের ইংরেজ সরকারের গোলামি বেশি দিন সহ্য হয়নি। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি ইংরেজ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং কিছুদিন মাদারীপুরের এসডিও ছিলেন।

১৯১১ সালে ঢাকা আর রাজধানী থাকল না। পূর্ব বাংলার মানুষের আশা ভঙ্গ হলো। বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা সরকার ধরে রাখতে পারল না। কলকাতার হিন্দু সমাজপতি ও রাজনীতিবিদদের চাপে সরকার পিছু হটল। ফজলুল হকও ১৯১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন এবং একই সঙ্গে রাজনীতিকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগে যোগদান করে সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ফজলুল হক ঢাকার নবাব ও রাজনীতিবিদ সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে সাক্ষাত্ করেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে। এবার তাদের দাবি পূর্ব বাংলার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ১৯১৫ সালে সলিমুল্লাহ মারা যান।

ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনার ভার পড়ে ধনবাড়ীর নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং এ কে ফজলুল হকের কাঁধে। দুজনই পূর্ব বাংলার স্বার্থ আদায়ের বিষয়ে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। এবারো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল ইংরেজ সরকার নয়, বরং প্রতিবেশী ধনী এলিট উচ্চ হিন্দু নেতারা। নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং ফজলুল হকের কর্মপ্রচেষ্টার সফলতা আসে ১৯২১ সালে। কাঙ্ক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আত্মবিকাশ ঘটে। এই জাগ্রত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটিই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউ তোলে।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এ কে ফজলুল হক তিন প্রজন্মের সঙ্গে রাজনীতি করেন। তিন প্রজন্মের রাজনৈতিক সহযাত্রী নবাব সলিমুল্লাহ, মওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান। ফজলুল হকসহ শেষের দুজন ছিলেন খাটি বাঙালি, মাটির মানুষ, নদী ও হাওড়-বাঁওড়ের মানুষ এবং লুঙ্গিপরা রাজনীতিবিদ। একই সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কিন্তু আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। শেখ মুজিবুরের রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠার পেছনে এ দুজন নেতার প্রভাব অধিক। রাজনীতির মঞ্চে শেখ মুজিব ছিলেন ফজলুল হকের নাতি, আর ভাসানীর পুত্রসমতুল্য।

যে কৃষক প্রজাকুলের মুক্তির পণ নিয়ে বাংলার উদীয়মান নেতা এ কে ফজলুল হক রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হলেন, তাকে কংগ্রেস কিংবা নবাব জমিদারদের সংগঠন মুসলিম লীগ আকৃষ্ট করতে পারল না। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তৃতীয় ধারার সংগঠন নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি। শক্তিশালী ও জনপ্রিয় দুটি রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে এককভাবে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করা সহজ কর্ম ছিল না। বর্তমান দু’ধারার রাজনৈতিক বলয় থেকে আন্দাজ করা যায়। কিন্তু ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং সততার বলে বাংলার রাজনীতিতে একক হয়ে ওঠেন।

 ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে ১৯৩৭ সালে ইংরেজ সরকার প্রাদেশিক নির্বাচনের আয়োজন করে। এবার রাজনৈতিক নির্বাচনী প্রতিষ্ঠার খেলা। ফজলুল হক তাঁর নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতিকে ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’তে রূপান্তর করেন। কংগ্রেস হিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করে, আর মুসলিম লীগ মুসলমানের। আবার উভয় সংগঠনই সর্বভারতীয়। বাংলা বাঙালির মনের কথা কেউ বলে না। ফজলুল হক এই মানসিক জায়গাটা ধরতে পারলেন। কৃষক প্রজা সমিতি ছিল অসাম্প্রদায়িক। আবার এ প্রতিষ্ঠান বাংলার উদীয়মান মুসলিম মধ্যবিত্তের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনও হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত অবাঙালি এবং নবাব-জমিদারদের রাজনৈতিক আশ্রয়স্থল ছিল। মুসলিম লীগ বাংলার মুসলিম জনতার কাছে জনপ্রিয় এবং সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে চল্লিশের দশকে, যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাসিমরা এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

যাহোক, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা সমিতি নিপীড়ত কৃষক প্রজার দল হয়ে ওঠে। তিনি কৃষক প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে ১৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেন। ইশতেহারে দেখা যায়, বাংলাদেশের পূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্ত শাসন আদায়ই ছিল এর মূল লক্ষ্য। ফজলুল হক হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা। নির্বাচনে রাজনৈতিক স্লোগান ওঠে, ‘লাঙ্গল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার’। বাংলাদেশে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষই কৃষক। আর অধিকাংশই বাঙালি মুসলমান। তবু হক সাহেব ঘোষণা করেন, ‘কৃষক আন্দোলন শুধু কৃষকদেরই আন্দোলন, কৃষকেরা কোন ধর্মাবলম্বী আমাদের জানবার বিষয় নয়।’ নির্বাচনে কৃষক প্রজা সমিতি বিজয়ী হয়। নির্বাচনে বরিশাল এবং পটুয়াখালী আসনে একটি আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটে।

এ কে ফজলুল হক বরিশালের নিজের আসন
ছাড়াও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পটুয়াখালীর একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ আসনের মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন প্রভাবশালী নেতা এবং ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য স্যার খাজা নাজিমউদ্দীন। এটি ছিল খাজার জমিদারি এলাকা এবং এই আসন থেকে তিনি আগেও দুবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফজলুল হক তার ভাষণে চমত্কার গল্প করতে পারতেন। মানুষের মনের ভাষা বুঝতেন। পটুয়াখালী জনসভায় তিনি হাজির হলেন ধুতি শার্ট আর মাথায় রুমি টুপি পরে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথমেই বললেন, ‘ভাইয়েরা, মাত্র চারটি যুদ্ধের কথা আমি আপনাদের সামনে আজ বলব, প্রথম যুদ্ধ হয়েছে রয় রয়, দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছে ক-য় ক-য়, তৃতীয় যুদ্ধ হয়েছে গ-য় গ-য়, আর এবার যুদ্ধ হবে, হ-য় ন-য়।’ তার পর উত্সুক জনতা এই কথার মানে জানতে চাইল। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, প্রথম যুদ্ধ রাম রাবণে, দ্বিতীয় যুদ্ধ কংস কৃষ্ণের, তৃতীয় যুদ্ধ গান্ধী আর গভর্নমেন্টে, আর এবার হবে হক নাজিমউদ্দীনে। জনতা হু হু করে হেসে উঠলেন।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে খাজার পটুয়াখালীর কৃষক প্রজারা তাদের হক সাহেবকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। সকলের হক সাহেব বরিশালে নিজের আসন থেকেও বিজয়ী হন। তিনিই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। হক সাহেব ১৯৩৭ সালে প্রথম সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার পরিচালনা করেন। ফজলুল হক সরকারের আমলেই বাংলাদেশে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। কারণ কিছু প্রতিক্রিয়াশীল মধ্যবিত্ত হিন্দু এবং জমিদার মহাজনের প্রভাবে বাঙালি মুসলমানের দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৩৮ সালে ঋণ সালিশি বোর্ড, ১৯৩৯ সালে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪০ সালে মহাজনি আইনের কারণে বাঙালি কৃষক প্রজা কখনো তাদের প্রিয় হক সাহেবকে ভুলতে পারেনি। বিশ-চল্লিশের দশকের বাংলার হিন্দু মুসলমান সমাজ ও রাজনীতির ব্যবধান রেখার বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করতে পারলে ফজলুল হকের সে সময়ের ভূমিকা মূল্যায়নে সহজ হবে।

১৯৪০-এর দিকে কৃষক প্রজার নেতা ফজলুল হক হয়ে ওঠেন শেরেবাংলা, বাংলার বাঘ। রাজনীতির বাস্তবতা তাকে ঠেলে দেয় মুসলিম লীগের দিকে। যোগদান করেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ২৭তম বার্ষিক অধিবেশনে। মঞ্চে হাজার হাজার জনতা ধ্বনি দিয়ে ওঠেন— শের-ই-বাঙ্গাল, জিন্দাবাদ। মঞ্চে বক্তৃতারত লীগের সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর বক্তৃতা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন কিছু সময়ের জন্য। ফজলুল হক আসন গ্রহণ করেন। মঞ্চে থেকে জিন্নাহ সাহেব বলেন, ‘বাঘকে খাঁচায় পোরা হয়েছে, এবার শান্ত হোন।’ লাহোরের অধিবেশনে হক সাহেব ভারতের ভবিষ্যত্ শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা কী হবে, তা মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করেন। সেদিন ছিল ২৩ মার্চ। তিনি ঘোষণা করেন, ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল (আজকের বাংলাদেশ) নিয়ে গঠিত হবে আলাদা স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। তার এই ভাষণে বাংলার বাস্তবতা চিন্তা করে ভবিষ্যত্ একটি রূপরেখাও প্রদান করেন।

তিনি বলেন, এ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বা অঞ্চল অবশ্যই সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম হবে। অর্থাত্ এই ঘোষণার মধ্যেই ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ ভবিষ্যত্ রূপরেখা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ প্রস্তাব অধিবেশনে গৃহীত হলেও লীগের সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলার নেতা শেরেবাংলার প্রভাব এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল নিয়ে আলাদা স্বাধীন দেশ গঠনের পরিকল্পনায় প্রমাদ গুনলেন। ছয় বছর পর দিল্লিতে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সদস্যদের অধিবেশন বসে। সেখানে জিন্নাহর চতুরতায় পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে যে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রর কথা বলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে একটি মাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার আগেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা হক সাহেবের সঙ্গে জিন্নাহর চরম মতবিরোধ শুরু হয়ে যায় এবং ফজলুল হককে লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। জিন্নাহপন্থী গোষ্ঠীটি জানতেন যে, শেরেবাংলাকে লীগ থেকে বহিষ্কার না করলে লাহোর প্রস্তাবের ওই অংশটি বাতিল করা যাবে না।

 ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হয়। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব আর বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘ ২৩ বছর বাঙালি লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রাম করেছে। দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের যুক্তফ্রন্ট জোট যে ২১ দফা দাবিসংবলিত ইশতেহার ঘোষণা করেন, সেখানে ১৯ নং দফায় বলা হয়, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হইবে।’ একযুগ পর ১৯৬৬ সালে বাঙালির আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেন। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার প্রথম দফাই ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। শেরেবাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু। লাহোর প্রস্তাব থেকে ছয় দফা। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ। এটাই বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস।

চল্লিশের দশকের শেষে পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলনকে মুক্তি আন্দোলন হিসেবে মনে করে। গোটা বাংলার মুসলমান পাকিস্তান দাবির আবেগে প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত। হক সাহেব মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত এবং বিচ্ছিন্ন। সফল হন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তানের ‘কায়েদে আযম’ হয়ে ওঠেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁর বাঙালি অনুসারীরা প্রচার করতে থাকেন, ফজলুল হক পাকিস্তান চান না। তার মানে দাঁড়ায় ভয়ঙ্কর। তিনি কংগ্রেস বা হিন্দুদের পক্ষে। বহুল প্রচারিত আজাদ পত্রিকা হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনবরত প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কৃষক প্রজার বন্ধু হক সাহেবের বিরুদ্ধে প্রচার খুব একটা গ্রহণ করেনি মানুষ। তারা পকিস্তান চাচ্ছে, কিন্তু হক সাহেবকে ভুলে যায়নি। ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ১৯৪৫-৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মাঠে-হাটে দাপটে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন, আর হক সাহেবের সমালোচনা করে যাচ্ছেন।

কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম কি হয়েছিল, সে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি চমত্কার উদারতার সঙ্গে স্মৃতিচারণ করে গেলেন। শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে।’ একদিন আমার মা’ও আমাকে বলছিলেন, ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলিও না। শেরেবাংলা মিছামিছিই শেরেবাংলা হন নাই।’ বাংলার মাটিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে— একটা সভা করছিলাম আমার ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? ..., হঠাত্ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার ভক্ত, ...দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাইব না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরীবের বন্ধু হক সাহেব।’ শুধু তা-ই না, এক বঙ্গবন্ধু আর এক শেরেবাংলার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলেন, পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তারা যেখানেই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গেছি, সেখানেই জনসাধারণ তাদের মার দিয়েছে। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ.২২)

পাকিস্তান হাসিল হলো। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠল পাকিস্তানিরা বাঙালিকে স্বায়ত্তশাসন দেবে না। শুরু হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। হক সাহেব প্রতিবাদ করলেন। ঢাকা হাইকোর্টে পুলিশ ঢুকে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলার ওপর লাঠিচার্জ করা হলো। পুলিশের লাঠির আঘাতে তিনি পায়ে ভীষণ আঘাত পান। এ পায়ের ব্যথা তাকে বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এদিকে মুসলিম লীগের বিদ্বেষমূলক শাসনে একসময়ের পাকিস্তান আন্দোলনকারীরা শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী অবস্থান নিল। ১৯৫৪ সালে ঘোষিত হলো প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচন। এবার এগিয়ে এলেন শেরেবাংলা। এরই মধ্যে মুসলিম লীগ ভেঙে সৃষ্টি হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। এবার একত্রিত হলেন শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী আর জননেতা ভাসানী।

গড়ে তোলেন মুসলিম লীগবিরোধী নির্বাচনী ঐক্যজোট। নাম দেয়া হলো যুক্তফ্রন্ট। চারটি দলের মিলিত যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলেও তা ‘হক সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী জোট’ বলেই পরিচিতি লাভ করে। আবারো ক্ষমতাসীন লীগের বিরুদ্ধে হক সাহেবের জয়। এবার ঢাকার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন শেরেবাংলা। বাংলা ভাষার আন্দোলনের কষ্ট তিনি ভুলতে পারেননি। এ কথা হয়তো অনেকের ভুলে গেছেন যে, দায়িত্ব নেয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক প্রাদেশিক আইনসভায় প্রথম অধিবেশনেই বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন। নিয়ম অনুযায়ী আইনসভায় ইংরেজি কিংবা উর্দু ভাষায় বক্তৃতা করতে হতো।
যুক্তফ্রন্ট সরকার অল্প দিন ক্ষমতায় ছিল। হক সাহেব ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, সমবায় ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হন। হক সাহেব তখন বৃদ্ধ, বয়স ৮১, আর শেখ মুজিব কনিষ্ঠ, বয়স ৩৪।

হক সাহেব শেখ মুজিবকে স্নেহ করতেন। বলতেন, ‘আমি বুড়া, তুই গুঁড়া। তাই আমি নানা, তুই নাতি’। যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে শাসকগোষ্ঠী এবং অবাঙালি আমলারা গ্রহণ করতে পারেনি। এরা এ বিজয়কে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান বলে আতঙ্কবোধ করে। যেদিন সরকার শপথ নেয়, ওইদিনই আদমজী জুট মিলে বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়া হয়। শেরেবাংলাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দোষারোপ করে। ষাটের দশকের শেষার্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে, তখন শেখ মুজিবকেও বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আঘাত করেছিল। একই সালের ৩১ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারা জারি করে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দেন। সে আরেক ষড়যন্ত্র, আরেক প্রহসন। যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে শাসকগোষ্ঠী ভালোভাবে নিতে পারেনি। যুক্তফ্রন্ট সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। এই সর্বপ্রথম ১ বৈশাখ দিনটিকেও ঘোষণা করেন ছুটির দিন হিসেবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি সংস্কৃতির লালন ও প্রতিষ্ঠা তা তো রাষ্ট্রবিরোধী বটেই।

শেরেবাংলা সর্বশেষ গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পালনকালে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সংবিধান প্রণীত হয়। কিন্তু সাংবিধানিক সুখ পাকিস্তানের কপালে বেশি দিন সইল না। সামরিক বেসামরিক আমলানির্ভর রাষ্ট্র গণতন্ত্র ও সংবিধান মানে না। দুই বছর পরই সারা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হয়। ১৯৬১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ছাত্র-শিক্ষক এ মহান নেতাকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জানান। সেটাই ছিল হক সাহেবের সর্বশেষ কোনো সভায় যোগদান। ১৯৬২ সালের মার্চে বাংলার বাঘ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক মাস ঢাকা মেডিকেলে চিকিত্সাধীন থেকে ২৭ এপ্রিল শেরেবাংলা আবুল হক কাশেম ফজলুল হক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘ রাজনীতির জীবনে শেরেবাংলা বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করে যান, তা বাস্তবে রূপ দেন তার ‘গুঁড়া নাতি’ বঙ্গবন্ধু।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/106/শেরেবাংলা-আবুল-কাশেম-ফজলুল-হক--/

রবীন্দ্রনাথ শ্যাষ, এহন কাসেম্মার যুগ _আফসান চৌধুরী



রবীন্দ্রনাথ শ্যাষ, এহন কাসেম্মার যুগ
আফসান চৌধুরী
২৯ এপ্রিল ২০১৭, ২০:২৫

ভদ্দরলোক ভাই ও বোনেরা, আপনাগো বই কেউ পড়ে না। আপনারা নিজেরাও পড়েন না, কেনা তো দূরের কথা। আপনারা পয়সা দিয়া সমালোচনা লেখান। উপসচিবরে তেল মাইরা পুরস্কার নেওয়ার চেষ্টা করেন। রেস্টুরেন্টে বইয়া আড্ডা দেন, মদ খান, প্রেম আর পরকীয়া করেন। আর শেখ হাসিনারে প্রশংসা কইরা ভাবেন যে উনিই আপনাগো রক্ষা করব। সেই শেখ হাসিনা চইলা গেছে আপনাগো ফালায় দিয়া। তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড এখন হেফাজত।
সেই হেফাজত আর কওমি মাদ্রাসারে তাই সমানে গালি দিতাছেন। অবশ্য রইয়া-সইয়া। কারণ আপা যদি চেইত্যা যায়, সেই ভয়ও আছে। আপনাগো কেউ পাত্তা দেয় না, যহন নিজেদের লোক নিজেগো পাত্তা দেয় না, তহন শেখ হাসিনার কি ঠ্যাহা পড়ছে আপনাগো পাত্তা দেওয়ার? আপা ঠিকই বুঝছে আপনাগো দিয়া কাম হইব না।

২. চাকরি, সুবিধা, ফ্ল্যাট, অনুষ্ঠানে দাওয়াত, সফর, বিভিন্ন পুরস্কারের পেছনে দৌড়াইতে দৌড়াইতে ভুইল্লাই গেছিলেন যে আপনাগো পায়ের নিচে কোনো মাটি নাই। যেইডা ভাসে পানিতে, হেইডারে কচুরিপানা কয়। কাসেম বিন আবুবাকাররে এত যে গালি দিতাছেন দরজা-জানালা খুইলা, একবার কি ভাবছেন, আপনারা হগলে মিল্লা যত বই লিখছেন তার বিক্রি কাসেম্মার একখান বইয়ের থন কম বিক্রি। পালান ভাইসাবরা। আপনাগো দিন শ্যাষ। মাইন্না লন, বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হইতাছে কাসেম বিন আবুবাকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে সাধারণ মানুষগো কাছে তাঁর দাম বেশি। হুঁশ কইরা হিসাব কইরেন।
৩. এই কাসেম্মা বুইড়া নাকি চটি লেহে, বোরকা পইরা যৌনকর্ম করে! আবার ধর্মের কথা কয়। এইডা দেইখা আপনাগো বুক জ্বইলা যাইতাছে। কারণ আপনারা করেন এই সব কু-কাম, লেখেনও মাঝে-মধ্যে। কিন্তু তাও কেউ পাত্তা দেয় না। যতক্ষণ না শাহাবুদ্দীন নাগরী কিসিমের পাবলিক ধরা পইড়া যায়। তা ভাই ভদ্দর লোকগণ, একটা কাসেম বিন আবুবাকারের লাহান বই লিখা দ্যাখেন তো, একশ বই বিক্রি করতে পারবেন কি না। আপনারা তো পুলিশের পাহারা না হইলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে পারেন না। আপনারা বুড়া কাসেমের সাথে লইড়া একবার দেহান পাবলিকরে।
৪. আসল কথা হইল, আপনারা হইতাছেন শহরের মধ্যবিত্ত ভদ্দরনোক। রবীন্দ্র-জীবনানন্দ শ্রেণির পার্টি। আপনাগো লেহায় যেই সব উহ! আহ! আহে হেগুলা গাও-গ্রামের মুরখ্য মানুষ পড়তে চায় না। যেহানে আপনারা নিজেরাই পড়তে চান না, হেরা পড়ব ক্যান? কাসেম্মা হেই মানুষগো জন্য লিখতাছে, হেগো ভাষায়, হেগো চিন্তায়, হেগো সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা লইয়া। হেরা পড়ছে, খুশি হইছে। আপনাগো এত লাগে ক্যান?
কাসেম্মা কইছে কখনো, আমারে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেন? আপনারা কন, আপনারা চান, হেয় চায় না। হের পাবলিক আছে, আপনাগো নাই। এই জন্য এত কষ্ট হইতাছে? এককাঠি মাইরা তারে কেউ কেউ জামাতি বানাইছেন, হেফাজতি বানাইছেন। ফেসবুকে সুবহানাল্লা প্রচুর কিছু লিখছেন গালি দিয়া। হেয় লিখছে? ফেসবুকের বাইরেও যে দুনিয়া, যেমন ধরেন গার্মেন্টসের আপারা। যারা তার বই পড়ে, তাগো কিছু আসে-যায় না আপনার পোস্টে। আপনারা তো ফ্রেন্ড-আনফ্রেন্ড লইয়াই আছেন। যতজন আপনাগো লাইক দেয় একটা পোস্টে, তার চেয়ে বেশি লোক আপনাগো বই পড়ে?
৫. এই দেশের অর্থনীতিতে গাও-গ্রামের মানুষের উন্নতি হইছে। বিশেষ কইরা ১৯৯০ সালের পরে। বর্তমান সরকারের টাইমে হেইডা আরো বাড়ছে। হেরা হাতে কিছু পয়সা পাইছে, লেহাপড়া শিখছে, বই পড়ে আপনাগো চেয়ে বেশি। এতে তো খুশি হওনের কথা আপনাগো। অসুবিধা হইল, আপনারা আপনাগো লাইগাই লেখেন, পাবলিকের জন্য না। পাবলিক বইলা যে কিছু আছে, এটাই মানতে চান না। আপনাগোর সিলসিলা কলকাতার ভদ্দরনোকের সিলসিলা, সুনীল-হুমায়ূনের সিলসিলা, শহরের মানুষগো সিলসিলা। ওই সিলসিলার এহন জানাজা হইতাছে। শুনতে পাইতাছেন? আর যেই মানুষটা ওই জানাজায় ইমামতি করতাছে, হের নাম কাসেম বিন আবুবাকার।
শেষ কথা চটি লইয়া। আমগো দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিশেষ কইরা ভদ্দর লোকেরা ইন্টারনেটে গিয়া কী দ্যাখেন হেইডা জানেন না? হের নাম পর্নো, আপনারা কাসেম্মার একটা কিস সহ্য করতে পারেন না। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর্নো দ্যাহেন, তাতে কোনো অসুবিধা নাই? আপনাগো কী নামে ডাকুম। রবীন্দ্রনাথের যুগের শেষ হইছে। এহন কাসেম্মার যুগ। সালাম দেন।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিকhttp://m.ntvbd.com/opinion/127223/রবীন্দ্রনাথ-শ্যাষ-এহন-কাসেম্মার-যুগ

Saturday 22 April 2017

দিল্লির টাকাই কখনোই কোলকাতা চলে না বরং বাংলাদেশের টাকায় কোলকাতা চলে।



দিল্লির টাকাই কখনোই  কোলকাতা চলে না বরং বাংলাদেশের টাকায় কোলকাতা চলে।

 বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা চোরাই পথে পাঠানো অর্থে চলে কোলকাতা। এটাই সত্য কথা আপনি মানেন আর নাই মানেন। সেই ব্রিটিশ আমলে থেকে বাংলাদেশের টাকায় কোলকাতার নগর গড়ে উঠে । পশ্চিমাদেশের বিভিন্ন রির্সাস বলছে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে যে কোন ইউরোপীয় দেশ থেকে অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে। বর্তমানে এদেশের একজন রিক্সাওয়ালা গোল্ডলিফ সিগারেট পান করে, ট্যাক্সি ড্রাইভার  ব্যানসন হেজেজ আর ডেইলি লেবার প্রখর রোদে বসে একাই এক লিটার ফ্রিজের ঠান্ডা আরসি কোলা পান করে। এটাই অর্থনৈতিক সক্ষমতা কথা বলে এমনকি বিদেশী রেমিটেন্সে আরও বেশি ঘুরছে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাঁকা।

বাংলাদেশের কোন নেংটা পোলাপান যখন কোলকাতায় ঘুরতে গিয়ে ব্যানসন হেজেজ সিগারেট পান করে তখন লোকেরা বলে - দাঁদা দাদা ব্যানসন খাঁচ্চেন? আমাদের এখানে শুধু মিঠুন দাঁদাই ব্যানসন খায়!?।

কোলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের কেউ যদি ১ কেজি আঙ্গুর কিনে খায় কোলকাতার লোকেরা বলে- দেঁক দেঁক আঙ্গুর খাঁচ্চে। কারণ এরা অর্ধেকটা ডিম আদা কাপ চা খেয়ে অভ্যস্ত। এমনকি একমাত্র বাংলাদেশে বেড়াতে এলে পেট পুরো খায় ফ্রীতে কিন্তু কোলকাতায় কোনো দিন পেট পুরে খায় না সবসময়ই আদা পেট খেয়ে দিন যাপন করে।

হলিউডের নায়কেরা যে ধরনের পোশাক পরে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ছেলেরা সেই মানের পোশাক পরে। প্রায় ৪০ বছর প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। বাংলাদেশে এমন কোনো হিন্দু পরিবার পাওয়া যাবে না যারা সারা জীবন আয় করে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ না করে।

 প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে অবৈধ ভাবে বাংলাদেশের টাকা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে জমি কেনে, বাড়িঘর বানায়, দোকানপাট কেনে অথবা ব্যংকে টাকা জমায়। আর এদেশের মুচি মেথর নিম্নবর্নের হিন্দুলোকেরা বাড়িঘর জমিজমা সব বেচে ইন্ডিয়ায় যায় আর এক বছর পরে নিঃস্ব হাতে ফিরে এসে বলে- ‘‘দাদা, এই নাকে খত দিলাম আর কোনদিন কাজের উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়া যাবো না’’। কারণ ওখানে মানুষ বসবাস করে না বরং মানুষ নামের যতো সব জানোয়ারের বসবাস । এজন্যই  শেখ হাসিনা এক জনসভায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন :- আপনাদের এক পা থাকে বাংলাদেশে আর এক পা থাকে ইন্ডিয়ায়।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি কোন বৈষম্য নেই। সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার নির্যাতন শধু কাগজে কলমে, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচার । তবে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন যখন ভারতে যায় তখন অত্যাচার, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়। তার বড় প্রমাণ ছিটমহলের হিন্দুরা ভারতে গিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে।

বাংলাদেশি হিন্দুরা ভারতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়, তাদের পুরো টাকাই মার যায়। দুঃখের বিষয় এরা না যেতে পারে ভারতীয় পুলিশের কাছে, না পারে বাংলাদেশি পুলিশের কাছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু রপ্তানী বন্ধ হলেও বন্ধ হয়নি ২টি জিনিস।

১. সন্ত্রাস, সন্ত্রাসে ব্যবহৃত অস্ত্র। গুলসান হলি অটিজনে সন্ত্রাসী হমলায় ব্যবহৃত সব অস্ত্র আসে ভারত থেকে। আরও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসী জঙ্গী হামলার অস্ত্র ভারত থেকে এসেছিল তা প্রমাণিত হয়।

২. ফেনসিডিল, বিভিন্ন মাদক। পশ্চিমবঙ্গ কিভাবে চলে ???উত্তর বাংলাদেশে মাদক চোরাচালানে পাঠানো বিক্রির টাকায় কোলকাতা চলে। পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ জেলা এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের ৩৫টির বেশি কারখানা আছে যার উৎপাদিত সব মাদক চোরাই পথে বাংলাদেশে বিক্রি করে ।

বাংলাদেশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষের বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের চোরাই পথে পাঠানো অর্থে। দিল্লির টাকাই কখনই চলে না কোলকাতা।

এই হচ্ছে বাংলাদেশ যা ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়নি। এদেশে প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, উচ্চপদসহ সকল সম্প্রদায়ের লোক সম্মানীত কাজে পেশায় কর্মরত আছে। সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতি সহ বিশ্ব মানচিত্রে এক অনন্য অর্থনৈতিক টাইগার বাংলাদেশ। এটা সম্পূর্ন কনসেপ্ট ও ফিলোসফির ব্যাপার যে পশ্চিমবঙ্গ মাদার তেরেসার রোগ শোক ভুখা নাংগা বেলেগাছী মার্কা হয়ে দিল্লীর কলোনী থাকবে না পূর্ব জার্মানীর মতো অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ঢাকার সাথে থাকবে? সময় এসেছে দিল্লির গোলামী করবে নাকি বাংলাদেশের সাথে এসে স্বাধীন হবে। এটা কোলকাতার ঘটির দেশে নিচু ইতর হিন্দুরা পারবে বলে মনে হয় না কারণ এদের মানসিকতায় খারাপ ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কবিও বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে প্রার্থনা সঙ্গিত রচনা করেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণ হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে সভা ডাকা হয়, সে সভার সভাপতিত্ব করেন।
------------------------------------------------------------------------
দুই বাংলার পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন। পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন, যার রাজধানী ছিল ঢাকায়। লর্ড কার্জনের এ ঘোষণা হিন্দুদের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল এবং মুসলমানরা আনন্দ-উল্লাস করল। কারণ দুটি জাতি পাশাপাশি বসবাস করলেও তাদের স্বার্থ ছিল ভিন্ন। হিন্দু জমিদাররা দেখলেন বাংলা ভাগ হয়ে গেলে কলকাতায় বসে পূর্ব বাংলায় জমিদারী চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আর ঢাকা রাজধানী হওয়ার কারণে শিক্ষায় এবং চাকুরির ক্ষেত্রে মুসলমানরা এগিয়ে যাবে। আবার পূর্ব বাংলার হিন্দুরা মনে করল, বঙ্গ ভঙ্গের কারণে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। ফলে হিন্দুরা ঘোষণা করল কোনভাবেই বঙ্গ মাতার অঙ্গ ছেদন করা যাবে না। অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হবে। যার ফলে হিন্দুরা স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ আরম্ভ করল। একই সাথে তারা যে সমস্থ মুসলমানরা স্বদেশী আন্দোলনে আসতে চাইল না, তাদেরকে নাজেহাল করতে লাগল। এমনকি মুসলমানদের প্রাণহানি ঘটতে লাগল। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম বোমা হামলার মাধ্যমে ২জন শেতাঙ্গ মহিলাকে হত্যা করে। ফলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। (উৎস “একশ বছরের রাজনীতি”, আবুল আসাদ)

এই ক্ষুদিরাম আত্মত্যাগ করেছিলেন তার জাতি হিন্দুদের জন্য, মুসলমানদের জন্য নয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কবিও বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে প্রার্থনা সঙ্গিত রচনা করেন –

বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
--------------------------
বাংগালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান।

তার রচিত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” গান হিন্দু সন্ত্রাসিদের উৎসাহিত করে এবং বধ করতে মুসলমানদের প্রাণ। আবার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের বিপক্ষে চলে গেল, তখন খাঁটি ইংরেজ সমর্থক রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে নিরপেক্ষ হয়ে যান।

পাঠকরা একটু লক্ষ্য করবেন হিন্দুরা যে ইংরেজদের সহযোগীতা করেছিল, প্রশাসনিক কারণে সৃষ্ট বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের পক্ষে যাওয়ার কারণে সেই হিন্দুরা ইংরেজদের বিপক্ষে চলে যায়।

বঙ্গভঙ্গের কারণে বৃটিশদের মুসলমান প্রজারা অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণে তাদেরকে সাময়িক সান্তনা দেয়ার জন্য ১৯১২ সালের ৩১শে জানুয়ারি লর্ড হার্ডিণ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন।

কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী যে, বর্ণ হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের যেভাবে বিরোধিতা করেছিল, ঠিক সেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বিরোধীতা করেন। কারণ বর্ণ হিন্দুরা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিটা মুসলমানরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্তির মাধ্যমে কিছুটা পূরণ করতে পারবে। (“জীবনের স্মৃতি দ্বীপে” ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার)

কলকাতার জমিদার শ্রেণীর, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবি হিন্দুরা পূর্ব বাংলার মুসলমানকে কৃষিজীবির ঊর্ধ্বে চিন্তা করতে নারাজ। একারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই সাথে জমিদার শ্রেণীর (কারণ তিনি জমিদার শ্রেণীর লোক ছিলেন) এবং বর্ণ হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে সভা ডাকা হয়, সে সভার সভাপতিত্ব করেন। (“দি অটোবায়োগ্রাফী অব আননোন ইন্ডিয়ান”, নীরোদ চন্দ্র চৌধূরী, “একশ বছরের রাজনীতি”, আবুল আসাদ)

১৯১২ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি বড় লাটের সাথে দেখা করে বর্ধমানের স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষকরা উপকৃত হতে পারবে না বলে মত প্রকাশ করেন। (Report of the Calcutta University Commission Vol-iv, pt-ii-p-133, উৎসঃ আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়”, বাংলাপিডিয়া)

হিন্দুদের এতসব বিরোধীতা সত্ত্বেও লর্ড হার্ডিণ্জ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য স্যার আশুতোষ মুখার্জীকে বলে দেন, আপনাদের বিরোধীতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। (“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” বাংলাপিডিয়া)

এ ব্যাপারে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তার “জীবনের স্মৃতি দ্বীপে” একটি মজার ঘটনা বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক এর অধ্যাপক শ্রী দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকর এর বক্তব্য, যা হল, “কলিযুগে বৃদ্ধগঙ্গা নদীর তীরে হরতগ নামক একজন অসুর জন্ম গ্রহণ করবে। মূল গঙ্গার তীরে একটি পবিত্র আশ্রম আছে। সেখানে অনেক মুনি-ঋষি এবং তাদের শিষ্য বাস করেন। এই অসুর সেই আশ্রমটি নষ্ট করার জন্যে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে একে একে অনেক শিষ্যকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যাবে। যারা অর্থের লোভে পূর্বের আশ্রম ত্যাগ করে এই অসুরের আকর্ষণে বৃদ্ধগঙ্গার তীরে যাবে, তারাও ক্রমে অসুরত্ব প্রাপ্ত হবে এবং তারা অশেষ দুর্দশাগ্রস্ত হবে।” এখানে বৃদ্ধগঙ্গা বলতে বুড়িগঙ্গা, হরতগ বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর মিঃ ফিলিপ হরতগ এবং মূল গঙ্গার তীরে পবিত্র আশ্রম বলতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝানো হয়েছে।

এখন মূল বক্তব্যটি যদি আপনি আবার পড়েন, তবে বুঝতে পারবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অসুর তৈরি হয় এবং বর্ণ হিন্দুরা মনে করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আজ বড়ই পরিতাপের বিষয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র চর্চা হয়, চর্চা হয় হিন্দু সংস্কৃতির, জ্বালানো হয় মঙ্গল প্রদীপ, অনুষ্ঠান হয় রাখী বন্ধনের, স্মরণ করা হয় তাদের যারা এর প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, কিন্তু স্মরণ করা হয় না, নবাব সলিমুল্লাহকে, নওয়াব আলী, ওয়াজেদ আলী খান পন্নীকে।

--------------------------------------------------
"আমাদের স্বাধীনতাঃ পর্দার এপার ওপার" বিশেষ ভাবে পড়তে বলেছিলাম যেটি সম্পর্কে বলেছিলাম ব্রিটিশ আমল থেকে ৭১ পর্যন্ত অনেক অজানা ইতিহাস এখানে পাবেন (যারা মিস করেছেন তারা এখান থেকে ডাউনলোড করুন https://ia601502.us.archive.org/15/items/AmaderShadhinota/Amader%20Shadhinota.pdf

বঙ্গভঙ্গ রদ থেকে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা আন্দোলন -মনসুর আহমদ।


বঙ্গভঙ্গ রদ থেকে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা আন্দোলন -মনসুর আহমদ।



পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা সময়ের ব্যবধানে পাওয়া যায়। এমন একটি ঘটনা বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন। ১৮৯৮ সনে লর্ড কার্জন উপযুক্ত শিক্ষা, কর্মদক্ষতা, দায়িত্বজ্ঞান এবং সর্বোপরি এ দেশের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে বড় লাট হিসাবে ভারতে আগমন করেন। তৎকালে সমগ্র বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে ছিল বাংলাদেশ বা বাংলা প্রেসিডেন্সি। এই প্রদেশের লোক সংখ্যা ছিল সমগ্র উপমহাদেশের সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ।

 কার্জন শুরু থেকে এত বড় প্রদেশকে একটি মাত্র প্রশাসনিক ইউনিটের অধীনে রাখা অনুচিত মনে করেন। কারণ সুদূর কলকাতা থেকে পূর্বাঞ্চলের প্রশাসন চালানো এবং জনগণের প্রতি সুবিচার চালানো অসম্ভব ছিল। তাই প্রধানতঃ প্রশাসনিক কারণেই তিনি ১৯০৩ সনে এই বিরাট প্রদেশকে দু'ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কার্জনের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বেই এ প্রদেশ বিভক্তিকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয়েছিল। ১৮৫৩ সালে স্যার চার্লস গ্রান্ট প্রশাসনিক সুবিধার জন্যে প্রদেশটিকে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

১৮৯৬ সনে আসামের চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড বাংলা হতে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামকে আসামের সাথে যুক্ত করে নতুন প্রদেশ গঠনের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাব বাংলার জনসাধারণের বিরোধিতার জন্য নাকচ হয়ে যায়, কারণ অনুন্নত আসামের সাথে যুক্ত হলে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা নানাদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

১৯০৩ সালে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার উড়িয়া ভাষাভাষী সম্বলপুরকে বাংলা প্রেসিডেন্সির সাথে সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব করলে নতুন প্রদেশ গঠনের বিষয়টি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। অবশেষে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে সংযুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং তা অনুমোদনের জন্য ভারত সচিবের নিকট প্রেরণ করেন। ভারত সচিব ব্রডারিক এ পরিকল্পনা অনুমোদন করেন এবং তা ১৯০৫ সালের ১০ই জুলাই প্রকাশিত হয়। নুতন প্রদেশের রাজধানী ঢাকা এবং বিকল্প রাজধানী হিসাবে চট্রগ্রাম নির্বাচিত হয়।

এই গঠিত প্রদেশের নামকরণ হল পূর্ব বাংলা ও আসাম। অন্য দিকে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা সম্মিলিত হয়ে আরেকটি প্রদেশ হয় এর নাম হল বাংলা প্রদেশ। এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে কার্জনের এই সিদ্ধান্ত এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। শুধু কি প্রশাসনিক বৈষম্য দূর করার জন্যই লর্ড কার্জন নতুন প্রদেশ গঠনে এগিয়ে এসেছিলেন? না, প্রশাসনিক বৈষম্য দূর করা ছাড়াও পূর্ববঙ্গ যাতে শিক্ষা সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে সেই দিকে তাঁর লক্ষ্য ছিল। কার্জন আশা পোষণ করেছিলেন যে যথারীতি সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে পূর্ববঙ্গ ও আসামের জনগণের শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতি ঘটবে।

এ ছাড়াও দেশ বিভাগের পেছনে কার্জনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। লর্ড কার্জন বাঙ্গালীদের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের ইংরেজ বিরোধী ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি কংগ্রেসের প্রতিপত্তি ও উহার সমাধি রচনা ও নতুন জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করতে মনস্থ করেন। অনেকে মনে করেন বাংলা বিভাগ তাঁর সুপরিকল্পিত ভেদ নীতির বহিঃপ্রকাশ। একথা ঠিক নয়। বরং ভবিষ্যৎ বাঙ্গালী জাতির উন্নতির লক্ষ্যে কার্জন বাংলাদেশ বিভাগ করেছিলেন। কিন্তু কলকাতার সংবাদপত্রগুলো তাঁর উদ্দেশ্যের ভুল ব্যাখ্যা করে এবং তাঁকে মুসলমানদের পক্ষপাতিত্বের দোষারোপ করে। তারা আরও প্রচার চালায় যে, লর্ড কার্জনের এই বিভেদনীতির ফলে মুসলমানদের মনে উচ্চাকাক্মখা জেগেছে এবং এর ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

 কিন্তু এই সকল উক্তি ছিল খুবই বিভ্রান্তিকর ও ফাঁকা। কারণ এই বিভাগ দ্বারা পূর্বাঞ্চলের নিপীড়িত জনসাধারণের শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হলে তারাও পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সমপর্যায়ে উন্নতি হবে। কাজেই বঙ্গবিভাগের দ্বারা হিন্দু-মুসলমান বিরোধের জন্য তাঁকে দায়ী করা যায় না। বঙ্গ ভঙ্গের প্রস্তাব প্রথম থেকেই হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চয় করে। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা কার্যকরি হবে, এ সংবাদ হিন্দু নেতাদেরকে প্রবল উত্তেজিত করে।

 নতুন প্রদেশ বাস্তবায়ন যাতে কার্যকর না হতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তারা পত্রপত্রিকায়, বক্তৃতামঞ্চে একে ‘বাঙ্গালী বিরোধী, জাতীয়তা বিরোধী এবং বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ প্রভৃতি বিশেষণে আখ্যায়িত করে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে বাংলার সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষিত হওয়ার পরদিনই বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে ভূপেন্দ্রনাথ বসু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। সুরেন্দ্রনাথ পরিচালিত ‘বেঙ্গলী' পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গকে এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয় বলে মন্তব্য করা হয় এবং সরকারকে ভারতব্যাপী এক জাতীয় সংগ্রামের জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। কৃষ্ণ কুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী' পত্রিকায় ১৯০৫ সালের ১৩ই জুলাই সম্পাদকীয় নিবন্ধে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ‘বয়কট' যুদ্ধ ঘোষণা করে।

 ‘হিতবাদী' পত্রিকায় বলা হয়, বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙালী জাতির সামনে এরূপ বিপর্যয় কখনও আসেনি। সন্ধ্যা পত্রিকায় বলা হয়, বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই বঙ্গভঙ্গেরই সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। এভাবে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সমকালীন পত্রিকাগুলো উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা প্রচারে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে মুসলিম পত্রপত্রিকাগুলো নুতন প্রদেশ গঠনে আনন্দ প্রকাশ করে। কলকাতার মুসলিম সাহিত্য সংসদ একে আশীর্বাদ রূপে বর্ণনা করে এবং মুসলিম জনগণকে এর সাথে পূর্ণ সহযোগিতার আহবান জানায়। বাংলার তফশিল সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুরা বাংলা বিভাগকে পূর্ণ সমর্থন দান করে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গকে মেনে নিতে পারলনা।

 পূর্ব বাঙলায় তাই তারা কলকাতাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গভঙ্গ দিবসে কলকাতার টাউন হলে বর্ণ হিন্দুদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লাল মোহন ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ প্রভাবশালী হিন্দু নেতা যোগ দিয়ে ঘোষণা করেন যে বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তারা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু উৎসর্গ করবেন। বঙ্গভঙ্গ বানচাল করার জন্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...' গানটি।

এ যাবৎ কংগ্রেস সর্বভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজেকে প্রচার করতো। কিন্তু বাংলা বিভাগে তার সে মুখোস খসে পড়ে। কংগ্রেসপন্থী হিন্দুরা কলকাতা টাউন হলে প্রতিবাদ সভা ডাকলো কবি রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে। এ সভায় যে সব উত্তপ্ত বক্তৃতা হয়, তাতে মুসলমানদের চক্ষুরুম্মীলন হয় এবং তারা পৃথক রাজনৈতিক সংস্থা স্থাপনের চিন্তা করে। যার পরিণতিতে জন্মলাভ করে মুসলিম লীগ। এ আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষাতার দাবীদার কংগ্রেস দেশব্যাপী শোকদিবস পালন করে। কবি রবীন্দ্রনাথ সে দিন রাখী বন্ধন উৎসবের প্রচলন করেন।

 রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ‘আরন্ধন' পালন করার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। শোক প্রকাশের চিহ্নস্বরূপ সকলে উপবাস করে, দোকান পাট ও অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ রাখে। আত্মশুদ্ধির জন্য সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠে সকলে ‘বন্দে মাতরম' গান গাইতে গাইতে গঙ্গাস্নানে যায়। স্বদেশ বন্দনার নামে আন্দোলনকারীরা বিদ্বেষমূলক এই ‘বন্দে মাতরম' গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে চালু করে। ১৯০৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন এবং তাদের নেতৃত্বেই আন্দোলন পরিচালিত হয়।

কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে চরমপন্থী নেতা বিপিন চন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ বলেন ‘‘বাংলা বিভাগ কার্যকরি হলে বাঙ্গালী হিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায় বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ বলে বিভাগটায় ধর্মীয় রূপ দেওয়া হলো এবং সমগ্র হিন্দু বাংলা আন্দোলনে মেতে উঠলো।’’ কংগ্রেসের মারাঠি নেতা বালগঙ্গাধর তিলকও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তা সুসংহত করার জন্য মারাঠাদের নায়ক শিবাজীকে ভারতের সকল হিন্দুদের জাতীয় বীরের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার আয়োজন করেন। এদের চাপে তৎকালিন কংগ্রেস সভাপতি গোখেলের মতো উদারপন্থী নেতাও শেষ পর্যন্ত পূর্ববাংলার স্বার্থবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করেন।

 ১৯০৫ সালে কংগ্রেসের বারাণসির অধিবেশনে গোখেল তীব্র ভাষায় সরকারি নীতি ও সরকারি কর্মচারীদের কার্যকলাপের নিন্দা করেন এবং ভারতীয় জনগণের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার সুপারিশ করে। মোট কথা এই অধিবেশনে চরমপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় এবং চরমপন্থীরা কংগ্রেসকে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণে প্ররোচিত করে। ইতিমধ্যে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন পদত্যাগ করেন। লর্ড মিন্টো নতুন ভাইসরয় হয়ে এলেন এরং তার কাছে ভারত সভার পক্ষ থেকে প্রদেশ বিভক্তিকরণের একটি স্মারক লিপি পেশ করা হয়। কিন্তু মিন্টোর জওয়াব বাঙ্গালী নেতা এবং দেশীয় সংবাদপত্রগুলিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ফলে কংগ্রেস সমর্থক পার্লামেন্টের সদস্যরা ইংল্যান্ডে হেনরী কটনের নেতৃত্বে তোড়জোড় শুরু করে এবং বৃটিশ সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করবার জন্য চাপ দিতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কেবলমাত্র প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রতিবাদে যখন বৃটিশ সরকারের টনক নড়াতে পারলো না তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বৃটিশের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে রূপ নেয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সরকারের উপর ফলপ্রসূ চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে সৃষ্ট স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শকে রাজনৈতিক অভিষ্ঠ অর্জনে ব্যবহার করে। ১৯০৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিনে কলকাতা কালিঘাটের কালিমন্দিরে এক বিরাট সংখ্যক লোক সমবেত হয়ে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গকে স্বৈরাচারী, অন্যায়মূলক এবং অপ্রয়োজনীয় কুর্কীতি বলে নিন্দাবাদ করে এবং ‘বয়কট' আন্দোলনকে সমর্থনের শপথ গ্রহণ করে।

 বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন-প্রসূত স্বদেশী আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বোম্বাই, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ প্রভৃতি ভারতের বিভিন্নাংশে এ আন্দোলন প্রসারিত হয়ে এক সর্বভারতীয় গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং তা ক্রমশ স্বরাজ আন্দোলনে পরিণত হয়। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বৃটিশ সরকার তাদের বঙ্গ বিভাগ সিদ্ধান্তে অটল রইল। উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য আন্দোলনকারীরা চরমপন্থী নেতাদের প্ররোচনায় নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করলো। বিপ্লবীরা গোটা দেশে অগ্নিমন্ত্র ছড়াতে লাগলো। দেশে সন্ত্রাসবাদী কাজ শুরু হলো এবং দেশজুড়ে নানা গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হলো। এই সমস্ত সমিতিতে শারীরিক কসরত ছাড়াও যুবকদের মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে শিক্ষা দেয়া হতো। দেশময় অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ এবং রাজনৈতিক হত্যা চলতে থাকে। ১৯০৮ সালে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি বঙ্গভঙ্গ রদ করতে এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন করতে গিয়েই জীবন দেয়।

 স্বদেশী আন্দোলন এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বৃটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন করতে পারলো না। বরঞ্চ সন্ত্রাসবাদ সরকারি দমননীতির কঠোরতা ও অত্যাচার আর, বৃদ্ধি করে দিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নাশ এবং সভা-সমিতি প্রভৃতি দমনের প্রয়োজনীয় আইন পাস করা হয়। এদিকে নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের জনগণ এ সময় শিক্ষা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করতে শুরু করে। কিন্তু অচিরেই নতুন প্রদেশের ভাগ্যে নেমে আসে এক প্রচন্ড আঘাত। অবশেষে বৃটিশ সরকার কংগ্রেস নেতা ও বৃটিশ বণিকদের চাপে বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।

 ১৯১০ সাল নাগাদ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়লেও বৃটিশ সরকার বর্ণ হিন্দুদের দাবির নিকট নতি স্বীকার করে। ১৯১১ সালের নবেম্বর মাসে ভারত সচিব বঙ্গদেশ পুনর্গঠনের নতুন পরিকল্পনা অনুমোদন করেন এবং ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ ঐতিহাসিক দিল্লী দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা করেন। বঙ্গভঙ্গ রদ করায় কংগ্রেস ও হিন্দু সমাজ খুব উল্লসিত হয়। কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার বৃটিশ শাসকদের রাজনীতিবেত্তার তারিফ করেন। কংগ্রেসের ইতিহাস লেখক পট্টভি সীতারাময় লিখেছেন, ‘‘১৯১১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হয়, বঙ্গভঙ্গ রদ করে বৃটিশ সরকার ভারত শাসনে ন্যায়নীতির পরিচয় দেয়।

’’ এই উপমহাদেশের পরাধীনতা যাদের চক্রান্তে ১৭৫৭ সালে সম্ভব হয়েছিল তাদেরই বংশধররা শিক্ষিত বর্ণ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে সংগঠিত হয়ে ১৯০৫ সালে বাংলা বিভাগ রোধ করেছিল। আবার ১৯৪৭ সালে তাদেরই সাহায্যে উপমহাদেশে আযাদী লাভ করেছে এবং তার সঙ্গে বাংলাও বিভাগ হয়ে গেছে তাদেরই সাধনায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এ বিচিত্র অবদান অনস্বীকার্য।

 বঙ্গদেশকে ভাগ করার কোন ইচ্ছা মুসলমান নেতাদের ছিল না। বঙ্গদেশকে ঐক্যবদ্ধ রেখে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে এক বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, খাজা নাজিম উদ্দিন ও প্রাদেশিক রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান। তারা সবাই মতামত পেশ করেন যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনই বঙ্গদেশের মুসলমান এবং অমুসলমান সকল সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে এবং তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে বঙ্গদেশকে ভাগ করা হলে বাঙালিদের স্বার্থে চরম আঘাত হানা হবে।

নেহেরুর সাথে পরামর্শক্রমে ভিটি মেনন রচিত ভারত বিভাগের যে প্রস্তাব বৃটিশ মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেন তাতে পাঞ্জাব এবং বঙ্গদেশ হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিভক্ত করার প্রস্তাব ছিল। এ সময় মিঃ জিন্নাহ স্বতন্ত্র বঙ্গদেশ রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে সেখানে রেফারেন্ডামের প্রস্তাব করেন। কিন্তু ভাইসরয় তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখন্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অখন্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব প্রকাশিত হলে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন ‘হিন্দু মহাসভা' এবং কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল ও অবাঙালি নেতাগণ এর বিরোধিতা শুরু করেন। তাদের বিরোধিতার কারণে অখন্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারতের ভাইসরয় ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কে ঘোষণা দেন। এতে বলা হয় প্রদেশ বিভক্ত হবে কিনা সে সম্পর্কে উভয় প্রদেশের আইন পরিষদে পৃথকভাবে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিরা মতামত দিবেন। বিভক্ত ব্যবস্থায় পরিষদের কোন একটি অংশ ভোটাধিক্যে প্রদেশ বিভাগের অনুকূলে মত প্রকাশ করলে প্রদেশ বিভক্ত হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাদি অবলম্বন করা হবে। ২১ জুন মুসলিম সদস্যগণ অখন্ড বঙ্গ দেশের পক্ষে রায় দেয় কিন্তু হিন্দু সদস্যগণ বিভক্তি চায়। ফরে বঙ্গদেশ বিভক্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। বৃটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। সেই উদ্দেশ্যে লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন শেষ বড় লাট হয়ে আসেন। দিল্লীতে পদার্পণ করেই তিনি ঘোষণা করেন যে, বৃটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং কংগ্রেসের দাবির প্রেক্ষিতে অখন্ড ভারত রক্ষার্থে যথেষ্ট চেষ্টা করেন।

 কিন্তু আপোসের কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না। জিন্নাহ এবং লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান দাবিতে অটল থাকেন। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস লীগের দাবি অনুসারে ভারত বিভাগকরণে রাজি হয়। কিন্তু লীগকে এবং পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য কংগ্রেস এক নতুন দাবি উত্থাপন করলো যে, বাংলা ও পাঞ্জাব হিন্দু-মুসলমান অধিবাসী এলাকা হিসেবে ভাগ করতে হবে। জিন্নাহ, পাঞ্জাবের গবর্নর স্যার জেনকিল, বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং গবর্নর ফ্রেডারিক বারোজ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো, কিন্তু জিন্নাহ পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগে রাজি হতে চান না।

 তখন মাউন্ট ব্যাটেন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিলেন : প্রদেশ দু'টির বিভাগ সম্ভাবনায় তাঁর (জিন্নাহর) অন্তরে যে অনুভূতি জেগেছিল, তেমনি অনুভূতি আমার অন্তরে ও কংগ্রেসের অন্তরে জেগেছিল ভারত বিভাগ প্রসঙ্গে। লর্ড ইজমে ভাইস রয়ের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেন যে, 'if India was to be divided, Bengal and the Punjab would also have to be split in two, according to the will of the people.' Jinnah's answer was, 'better a moth-eaten Pakistan that no Pakistan at all'. যে হিন্দু নেতৃবৃন্দ ১৯০৫ সালে বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ হবে-ই যুক্তিতে বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য দেশময় তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তারাই সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সেই বাংলাকে বিভক্ত করবার জন্য নতুন আন্দোলন শুরু করে। ইতিহাস সত্যই বিচিত্র। ১৯০৫ সালে বৃটিশ সরকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ করলে তা রদের জন্য যারা দেশময় প্রচন্ড গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তারাই সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বাংলা বিভক্ত করার আন্দোলন শুরু করে। এ সম্পর্কে নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, ‘যে হিন্দুরা লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল তারাই আবার নিজেদের স্বার্থে বাংলার বিভক্তি সম্পন্ন করলো।

 এই স্বার্থটি কি? বিভিন্ন স্বার্থের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্বার্থটির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মিঃ নেহেরুর এক চিঠিতে। তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা কুমিল্লার আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর এক পত্রের জবাবে ১৯৪৭ সালের মে মাসে নেহেরু তাঁকে যে চিঠি লিখেন, তাতে তিনি বলেন : ‘অখন্ড ভারতের নীতিকে আমরা জলাঞ্জলি দিয়েছি, একথা সত্য নয়। তবে আমরা কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। ভারত বিভাগ মেনে নেব একটি শর্তে যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করতে হবে। কারণ একমাত্র এই পথেই অখন্ড ভারত পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে।'শনিবার ২১ মে ২০১১ | দৈনিক সংগ্রাম

আমাদের রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ??


আমাদের রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ??

০১.
"... রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা, দ্বারকানাথ ঠাকুরের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলকাতাতেই। এত উপার্জন করেও দ্বারকানাথ ঠাকুরের আশা মেটেনি। মদের ব্যবসা শুরু করলেন। প্রচুর অর্থ কামিয়েছিলেন তাতে। আবার নতুন ব্যবসা শুরু করলেন আফিমের্। আফিমে নেশাগ্রস্ত হয়ে দেশের লোকের সর্বনাশ হলেও তাতে কিছু এসে যেতনা তার। আর একটি রোজগারের বড় উৎস ছিল বিপদগ্রস্ত লোকদের হিতাকাঙ্খী সেজে মামলা মোকদ্দমার তদবির করা। চব্বিশ পর্গণার সল্ট এজেন্টও ছিলেন তিনি। তাতেও ভালো আয় হয় তার। তারপর হয়েছিলেন সেরেস্তাদার এবং পদোন্নতির ফলে হন দেওয়ান। এসবই ছিল তার সংসারে আর্থিক মধুবর্ষণ॥" -  আনন্দবাজার  / ২৮ শে কার্তিক, ১৪০৬

০২.
"... ধর্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্য শরীরে পাদুকা প্রহার - একথা আর গোপন করিতে পারিনা। ইত্যাদি নানা প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইল পুষ্করিনী প্রভৃতি জলাশয়স্থ মৎস্যের যেমন মা বাপ নাই, পশুপক্ষী ও মানুষ যে জন্তু যে প্রকারে পারে মৎস্য ধরিয়া ভক্ষণ করে, তদ্রুপ প্রজার স্বত্ত্ব হরণ করিতে সাধারণ মনুষ্য দূরে থাকুক যাহারা যোগী ঋষি ও মহা বৈষ্ঞ্চব বলিয়া সংবাদপত্র ও সভাসমিতিতে প্রসিদ্ধ, তাহারাও ক্ষুৎক্ষামোদর॥" - কাঙাল হরিনাথের "অপ্রকাশিত ডায়েরী"

০৩.
"... মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে জমিদার হিসেবে তিনি নির্বাচন করলেন চোদ্দ নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এও এক বিস্ময়। অত্যাচার, শোষণ, শাসন, চাবুক, চাতুরী প্রতারণা কলাকৌশলে কি রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তার পিতার বিবেচনায়? অনেকের মতে তার পিতৃদেব ভুল করেননি। প্রচন্ড বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা বহু বিষয়েই অনস্বীকার্য॥" - শ্রী স্বপন বসু / গণঅসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ

০৪.
 "... কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তার 'মিঠেকড়া'তে পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন যে, "রবীন্দ্রনাথ মোটেই লিখতে জানতেন না, স্রেফ টাকার জোরে ওর লেখার আদর হয়। কিন্তু বরাবর এতো নির্বোধের মতো লিখলে চলে কখনো? 'গীতাঞ্জলি' নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর জনরবের কি ধূম - রবীন্দ্রনাথ কোন বাউলের খাতা চুরি করে ছেপে দিয়েছেন। শেষে অবশ্যি নামও জানা গেল - স্বয়ং লালন ফকির মহাশয়ের বাউল গানের খাতা চুরি করেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। আজ অবিশ্বাস্য্য শোনালেও একথা কিন্তু সত্যি, সেদিন বহু ব্যক্তি শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন কর্তাকে বলেছেন এবং লিখেছেন - রবিবাবু বড় কবি স্বীকার করি। যাকগে, তা গীতাঞ্জলির খাতাটা এবার উনি ফিরিয়ে দিন। প্রাইজ তো পেয়েই গেছেন, অনেক টাকাও হাতে এসে গেছে, ওতো আর কেউ নিতে যাচ্ছে না, তা গান লেখা খাতাটা উনি দিয়ে দিন।"পাঁচকড়ি বাবু সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে, রবীন্দ্রনাথের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা একটা হুজুগ মাত্র। কারণ রবীন্দ্র সাহিত্য অনুরাগ বিশুদ্ধ ন্যাকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঁচকড়ির বাবু একথাও বহুবার স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন - রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করে অপহরণ॥" - সুজিত কুমার সেনগুপ্ত / জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল

০৫.
 "... রবীন্দ্রনাথের অখ্যাত দাদাদের মধ্যে সবচেয়ে গুণী সোমেন্দ্রনাথ। তিনি ছোটবেলায় ছোটভাইয়ের কবিতার সমঝদার বের করার জন্য আমলাদের মাঝখানে ঘুরে বেড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন - 'আমার দাদা এই সকল রচনায় গর্ব অনুভব করিয়া শ্রোতা সংগ্রহের উৎসাহে সংসারকে একেবারে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিলেন।

'রবীন্দ্রনাথ যেবার নোবেল প্রাইজ পেলেন সোমেন্দ্রনাথের কী আনন্দ। সারা বাড়িতে দৌড়ে বেড়ান আর চিৎকার করেন - 'রবি প্রাইজ পেয়েছে, রবি প্রাইজ পেয়েছে।' আবার নাতিরা যখন তার কাছে যায় তিনি ঘরের ভেতর ডেকে এনে ফিসফিস করে বলেন, 'জানিস তো গীতাঞ্জলির সবকটি কবিতা কিন্তু আমার লেখা। রবি আমার কাছ থেকেই তো নিয়েছে।' এই কথা শুনে নাতিরা যখন বলেন, 'তাহলে তুমি এত আনন্দ করছ কেন', সোমেন্দ্রনাথ তখন খেপে যান, চেঁচিয়ে বাড়ি মাৎ করে বলেন, 'তোদের এত হিংসে কেন রে, আমার ছোটভাই নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, আমি আনন্দ করব না তো কে করবে? কার লেখা তাতে কী?

'অন্যদিকে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর মনে হয় রবীন্দ্রনাথের উপর তিনি ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। সোমেন্দ্রনাথ পিছনে তাকে কেরাণী বলে তিরস্কার করতেন। তার অর্থ এও হতে পারে যে তার লেখাগুলোই কেরাণীর মত লিখে দিয়ে পেয়ে গেলেন নোবেল প্রাইজ। কিছুদিন এমন হযেছিল যে বাড়িতে কোন অতিথি এলেই তাকে নিয়ে গিয়ে বলতেন, 'চল আমার সঙ্গে। আমার বাড়ীতে একজন কেরাণী আছে। তাকে দেখবে চল।' তারপর আঙূল বাড়িয়ে দেখিয়ে বলতেন, 'ঐ দেখ কেরাণী, কলম পিষছে তো পিষছেই।' তার ধারনা ছিল তিনি যদি ঠিকমত লিখতেন, তাহলে ছোটভাইয়ের চেয়ে অনেক বড় লেখক হতে পারতেন॥" - অমিতাভ চৌধুরী / ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ

০৬.
 "... ঠাকুর নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির পূর্বে প্রায় অশিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতেন। আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্রে ঠাকুরের একটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সেটাকে বিশুদ্ধ ও সাধু বাংলায় লেখার নির্দেশ ছিল। এবং এটা ছিল ১৯১৪ সালে তার নোবেল পুরুস্কার প্রাপ্তির একবছর পরে॥" - জাস্টিস আব্দুল মওদুদ / মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রুপান্তর

০৭.
 "... রবীন্দ্রনাথের বই অনেক সময় বিক্রী করতে হযেছে অর্ধেক দামেও। তা নিয়ে সেকালে কম ঠাট্টা বিদ্রুপ হয়নি। ১৯০০ সালে কবির বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে তিনি লিখেছিলেন - 'ভাই, একটা কাজের ভার দেব? আমার গ্রন্থাবলী ও ক্ষণিকা পর্যন্ত সমস্ত কাব্যের কপিরাইট কোন ব্যক্তিকে ৬০০০ টাকায় কেনাতে পারো? শেষের বইগুলি বাজারে আছে, সে আমি সিকিমূল্যে তার কাছে বিক্রি করব - গ্রন্থাবলী যা আছে, সে এক তৃতীয়াংশ দামে দিতে পারব (কারণ এটাতে সত্যের অধিকার আছে, আমি স্বাধীন নই)। আমার নিজের দৃঢ় বিশ্বাস, যে লোক কিনবে সে ঠকবে না। আমার প্রস্তাবতা কি তোমার কাছে দু:সাধ্য ঠেকছে? যদি মনে কর ছোটগল্প এবং বউঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি কাব্য গ্রন্থাবলীর চেয়ে খরিদ্দারের কাছে বেশি সুবিধাজনক বলে প্রতিভাত হয় তাহলে তাতেও প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস কাব্য গ্রন্থগুলোই লাভজনক।'এইভাবে নানারকম ঝামেলার মধ্যে কবির বই প্রকাশ করতে হযেছে। পরে প্রকাশনার ভার নিল এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস। পরে প্রকাশনার দায়িত্ব এসে পড়ে বিশ্ব ভারতীর ওপর ১৯২৩ সালে॥"  -অমিতাভ চৌধুরী / ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ

তথ্যসূত্র : গোলাম আহমাদ মোর্তজা / এ এক অন্য ইতিহাস ॥ [ বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কলকাতা - ডিসেম্বর, ২০০০ । পৃ: ১৪২ - ১৮১ ]

#০২
বঙ্গভঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
=======================
"... ভারতে ধর্মরাজ্য স্থাপনের সহস্র বর্ষের সাধনায় আবিস্কৃত আহুতি মন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’ অর্থাৎ উৎকট ন্যাশনালিজমকে “মানবতাবাদী”, ‘উদারপন্থী’, বলে কথিতরাও অন্য সকলের মত করেই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দেমাতরম’ এর ‘ন্যাশনালিজম’কে শুধু সর্বান্তকরণে গ্রহণ করা নয়, ‘বন্দেমাতরম’ গানে সুরারোপ করেন। [‘অখন্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৭৭।] অথচ এই রবীন্দ্রনাথ এই নেশনবাদের বিরুদ্ধে কত শত ভাষায়ই না কথা বলেছিলেন, লিখেছিলেন।

... রবীন্দ্রনাথের মত এত তীব্র, এত শক্ত ও এত সুন্দর ভাবে জাতীয়তাবাদকে বাংলাভাষায় আর কেউ আক্রমণ করেছে বলে আমি জানি না। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ঐতিহ্যের খেলাফ বললেন, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসন বললেন, যে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ আত্মস্বার্থের পুজা, লোভ ও ঘৃণার উৎস বললেন এবং যে জাতীয়তাবাদ রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিবেশী জাতি সম্পর্কে অন্তহীন তথ্যবিকৃতি ও মিথ্যা কাহিনীর জন্মদাতা হিসেবে চিহ্নিত, সেই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে, আয়োজনকে এবং সে জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছেন, তার সাথে একাত্ম হয়েছেন, এমনকি সে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার হিংস্রতার সাথেও তিনি নিজেকে শামিল করেছেন।

কারও অজানা নয়, বঙ্কিম সাহিত্য হিন্দুদের হিংস্র জাতীয়তাবাদ এবং খুনে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মূল উৎস। [অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন লিখিত ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’, গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকার ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়’ শীর্ষক নিবন্ধ দ্রষ্টব্য।] বঙ্কিম “রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মনের প্রতিভূ হিসাবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদগাতা ঋষি হিসাবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবহ্নি তিনি ছড়িয়েছিলেন লেখনি মুখে, জগতের ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নজীর নেই। তিনি মানবতার যে অকল্যাণ ও অসম্মান করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তারও তুলনা নেই। ‘রাজ সিংহ’ ও ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস দুটিতে তিনি মুসলিম বিদ্বেষের যে বিষবহ্নি উদগীরণ করেছেন, সে বিষ জ্বালায় এই বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, তা নিঃশেষ শুষ্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র অস্বীকার করে তাদের বিতাড়িত করে সদাশয় বৃটিশ জাতির আবাহনে ও প্রতিষ্ঠায় বার বার মুখর হয়ে উঠেছিলেন”। [‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ’, সংস্কৃতির রূপান্তর’, আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ৩৩৯।]

বঙ্কিমের এই সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং একে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলে অভিহিত করে মুসলমানদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা”। [‘মুসলিম জননেতা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী একটি বক্তৃতায় মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য বন্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করলে, “ভারতী পত্রিকা’য় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন।]

মুসলমানদের সংহারকামী হিংস্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের জনক “শিবাজী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব আরও দুঃখজনক। বাংলাদেশের জন-মানুষের কাছে শিবাজী এবং শিবাজী বাহিনী ‘বর্গীদস্যু’ হিসাবে পরিচিত। যেহেতু ‘শিবাজী মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তাই শিবাজীবাদের প্রবক্তারা লুণ্ঠনকারী এক দস্যূকে জাতীয় বীর হিসাবে চিত্রিত করার উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে বিকৃত করেছিলেন।" [‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ, সিদ্ধিকী বার এট ল, পৃষ্ঠা ৯৩ (উদ্ধৃতি)।] ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারও এই কথাই বলেছেন। তাঁর মতে “সেকালে বাংলায় আমাদের মহৎ বীরদের সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় রাজপুত, মারাঠা ও শিখ বীরদের জীবনী আমদানি করতে হয়েছে। জাতীয়তাবাদী নেতাগণ রাজনৈতিক গরজে সামগ্রিকভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে জনমনকে বিভ্রান্ত করতেন। এমনকি ‘শিবাজী উৎসবে’ মুসলমানকে টেনে আনার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করে ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা করতেন এবং ব্যাখ্যা দিতেন।" [ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, এস, এ সিদ্দিকী বার এট ল, পৃষ্ঠা ৯৩ (উদ্ধৃতি)।]

ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা এবং ইতিহাসকে বিকৃত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করেছেন। শিবাজীর স্তুতিগান করে তিনি লিখেছেন,

“হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি—
এক ধর্ম রাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতে
বেঁধে দিব আমি। তারপর একদিন মারাঠার প্রান্তর হইতে
তব বজ্র শিখা
আঁকি দিল দিগ-দিগন্তে যুগান্তরে বিদ্যুত বহ্নিতে
মহামন্ত্র লিখা।
মোগল উষ্ণীয় প্রস্ফুরিল প্রলয় প্রদোষে
পুষ্প পত্র যথা
সেদিনও শোনেনি বঙ্গ মারাঠার সে বজ্রনির্ঘোষে
কি ছিল বারতা।"

শিবাজীর শুধু স্তুতি নয়, ইতিহাস বিকৃতির পক্ষ নিয়ে শিবাজীর পক্ষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত ইতিহাসকারদের বিদ্রুপ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

“বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলে করে পরিহাস
অট্টহাস্য রবে—
তব পূণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিস্ফল প্রয়াস
এই জানে সবে।
অয়ি ইতিবৃত্ত কথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ
ওগো মিথ্যাময়ী,
তোমার লিখন-‘পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হবে আজি জয়ী।
যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে
তব ব্যঙ্গ বাণী
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে
নিশ্চয় সে জানি।"

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের উৎকট ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তার প্রকাশ ঘটেছিল। স্বদেশ-জাতীয়তাকে আরাধ্য দেবীতে পরিণত করা হয়েছিল এবং এই আরাধ্য দেবীর জন্য প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার সব পণ করা হয়েছিল।

... এই হিন্দু-জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সাথে রবীন্দ্রনাথও পুরাপুরি একাত্ম হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দুটি সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং বঙ্গ-ভঙ্গ বাস্তবায়নের দিনকে তিনি ‘রাখি বন্ধন’ দিবস ঘোষণা করেন। ‘রাখি বন্ধন’ এর দিন সকালে গঙ্গাস্নানের মিছলের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ একটা প্রার্থনা সংগীত গাইলেন। সে প্রার্থনা সংগীতে তিনি বললেন—

বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক।
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর বাংলার হাট
বাংলার বন বাংলার মাঠ
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর পণ বাংগালীর আশা
বাংগালীর কাজ বাংগালীর ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক
সত্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর প্রাণ বাংগালীর মন
বাংগালীর ঘর যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান।

এক সংগীত শেষে বীডন উদ্যানে ও অন্যান্য জায়গায় রাখবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পার্শী বাগান মাঠে অখণ্ড বাংলার ‘বঙ্গভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক ভাবে ‘ফেডারেশন হলের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। এখানেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অভিভাষণ পাঠ করেন। বজ্রদীপ্ত কণ্ঠে উল্লেখ করেন, “যেহেতু বাঙ্গালী জাতির সার্বজনীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ করিয়াছেন সেহেতু আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙ্গালী জাতির একতা সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙ্গালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব”। (অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৮২, ৮৩)

রবীন্দ্রনাথের এ কথা মিথ্যা হয়নি। ‘বন্দেমাতরম’ এর খন্ডিত মা’কে অখন্ড করার জন্যে ‘প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার’কে পণ করে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল। “১৯০২ সালে তিনি (শ্রী অরবিন্দ) মারাঠী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে তার ছোট ভাই শ্রী যতীন মুখার্জীকে কলকাতায় পাঠান। এ সময়ে যোগেন্দ্র বিদ্যাভুষণ, জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত হন”। [‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ পুর্নেন্দু দস্তিদার।] রবীন্দ্রনাথ নিজেও একথা বলেছেন, “আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল, তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয়নি, বিরুদ্ধে ছিল”। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩)

... স্বদেশীদের সাহায্য পুষ্ট হয়ে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। এই চাপই ইংরেজ সরকারকে বাধ্য করল বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। স্বয়ং বৃটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের বক্তব্যেই এর নিশ্চিত প্রমাণ মিলে। সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতের ভাইসরয়, লর্ড হার্ডিঞ্জকে লিখেন, “আমি আশা করি আপনি ভারতের বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করে সম্রাটের প্রথম ভারত সফরকে কিভাবে অবিস্মরণীয় করে রাখা যায় সে সর্বাত্মক কর্মসূচী প্রণয়ন ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে যত্নবান হবেন। বাঙালীদের (বাংগালী হিন্দু) সন্তুষ্ট করার জন্যে বোম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর মত উভয় বাংলাকে একত্র করা যায় কিনা সে বিষয়েও বিচার বিবেচনা করবেন। ... বাংলার বিরাজমান অসন্তোষ, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ উপশম এবং দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার লাঘবে এই পদক্ষেপ একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি”।" [ভাইসরয়ের প্রতি সম্রাট, ডিসেম্বর ১৬, ১৯১০, HP. ১০৪ (‘বঙ্গভঙ্গ’, মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা ৭৭, ৭৮)।]

হিন্দুদের চাপই অবশেষে কার্যকরী হয়েছিল। সম্রাট যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ভাইসরয়-এর কাছে, তা-ই তিনি কার্যকরী করেছিলেন ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর তাঁর দিল্লী দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দানের মাধ্যমে। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের চাপ ও অসন্তোষের কথা বিবেচনা করা হলো, কিন্তু মুসলমানদের হৃদয় যে ভেংগে গেল তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হলো না। এইভাবে হিন্দুদের হিংসারই জয় হলো। [‘বাঙালী হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করায় প্রধান কারণ ছিল, পূর্ব বঙ্গে বাঙালী মুসলমানরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে, সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন’। (পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’, আম্বেদকর, পৃষ্ঠা ১১০)।]

কিন্তু এই হিংসা দুই জাতিকে দুই প্রান্তে ঠেলে দিল। ‘১৯০৫-এর বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতবর্ষে সৃষ্টি করলো দুটি জাতীয়তাবাদ -একটি হিন্দু, অপরটি মুসলমান’।[‘ভারত কি করে ভাগ হলো’, বিমলানন্দ শাসমল’ হিন্দুস্তান বুক সার্ভিস, কলিকাতা, পৃষ্ঠা ২৪।] শুধু তাই নয় ডঃ আম্বেদকরের মতে বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করে এবং সেই সঙ্গে স্বরাজলাভের দাবী করে তারা (হিন্দুরা) একদিন মুসলমানদের পূর্ব ও পশ্চিম উত্তর ভারতের শাসক করে তুলবেন।[‘পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, ‘ডঃ আম্বেদকর, পৃষ্ঠা ১১০। সিলেবাস বিতর্ক এবং অতীত ষড়যন্ত্রের কাহিনী’ শীর্ষক নিবন্ধে উদ্ধৃত করেছেন। তার নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় দৈনিক সংগ্রামের ২৬শে এপ্রিল, ১৯৯৩ সংখ্যায়।] ডঃ আম্বেদকরের এই উক্তির অর্ধেকটা সত্যে পরিণত হয়েছে ইতিমধ্যেই।

সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হিংসা এবং মুসলমানদের সর্বনাশ দেখার জেদ বঙ্গভঙ্গ রদ করেই শেষ হয়ে গেলনা এবং মর্লি-মিণ্টো সংস্কারের পৃথক নির্বাচন ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব-সুযোগের বিরোধিতা অব্যাহত রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলোনা, মুসলিম বিরোধী তাদের সহিংস মন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তও মেনে নিতে পারলো না। উল্লেখ্য, বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলমানদের স্বান্তনা দেবার জন্যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ভারত সরকার ১৯১২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ঘোষণা করেন।

এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ল হিন্দুরা। ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তারা সভা করল। এই সভায় সভাপতিত্ব করলেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ। বিস্ময়ের ব্যাপার, পূর্ববঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের বিশাল জমিদারি চিল, সে রবীন্দ্রনাথও তার মুসলিম প্রজারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হোক তা চাননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেদিন একাট্টা হয়ে প্রচারে নেমেছিল হিন্দু সংবাদপত্রগুলো। হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন শহরে মিটিং করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করে পাঠাতে লাগলেন বৃটিশ সরকারের কাছে। [দ্রষ্টব্যঃ Calcutta University Commission report. Vol. IV পৃষ্ঠা ১১২, ১৫১।]

‘এভাবে বাবু গিরীশচন্দ্র ব্যানার্জী, ডঃ স্যার রাসবিহারী ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলার এলিটগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারক লিপি সহকারে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর উপর চাপ সৃষ্টি করলেন। ডঃ স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে হিন্দু প্রতিনিধিগণ বড় লাটের কাছে এই বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করলেন যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ অধিকাংশই কৃষক। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে তাদের কোন উপকার হবে না।–[দ্রষ্টব্যঃ Calcutta University Commission report. Vol. IV পৃষ্ঠা ১১৩।]

বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে সব হিন্দু যেমন এক হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ক্ষেত্রেও তাই হলো। পূর্ববঙ্গের, এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে বাধা দেবার জন্যে এগিয়ে এল। ‘A History of Freedom Movement’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, The Controversy that started on the Proposal for founding a university at Dacca, throws interesting on the attitude of the Hindis and Muslims. About two hundred prominent Hindis of East Bengal, headed by Babu Ananda Chandra Ray, the leading pleder of Dacca, submitted a memorial to the Viceroy vehemently against the establishment of a University at Dacca For a long time afterwards. They tauntingly termed this University as ‘Mecca University’.[‘A History of the Freedom Movement’, গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের Dacca University; Its role in Freedom Movement’ শীর্ষক অধ্যায়, পৃষ্ঠা ১০ (Published in 1970).] অর্থাৎ ‘ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব যে বিতর্কের সৃষ্টি করল তাতে হিন্দু ও মুসলমানদের ভূমিকা সম্পর্কে মজার তথ্য প্রকাশ পেল। পূর্ব বাংলার প্রায় দুই’শ গণ্যমান্য হিন্দু ঢাকার প্রখ্যাত উকিল বাবু আনন্দ চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করে ভাইসরয়কে একটি স্মারক লিপি দিয়েছিল। পরে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে বিদ্রুপ করা হতো’।

হিন্দুদের এই সর্বাত্মক বিরোধিতা সত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের বিরোধিতা ও ঘৃণা তারা অব্যাহতই রাখল। এর একটা সুন্দর প্রমাণ পাই আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি অধ্যাপক শ্রী দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর’ এর বক্তব্যে। শ্রীভাণ্ডারকর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তার এক বক্তৃতায় বলেন “কলিযুগে বৃদ্ধগঙ্গা নদীর তীরে হরতগ নামক একজন অসুর জন্ম গ্রহণ করবে। মূল গঙ্গার তীরে একটি পবিত্র আশ্রম আছে। সেখানে অনেক মুনি-ঋষি এবং তাদের শিষ্যগণ বাস করে। এই অসুর সেই আশ্রমটি নষ্ট করার জন্যে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে একে একে অনেক শিষ্যকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যাবে। যারা অর্থ লোভে পূর্বের আশ্রম ত্যাগ করে এই অসুরের আকর্ষণে বৃদ্ধ গঙ্গার তীরে যাবে, তারাও ক্রমে অসুরত্ব প্রাপ্ত হবে এবং তারা অশেষ দুর্দশাগ্রস্ত হবে’। [শ্রী ভাণ্ডারকর এই উক্তিটি ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার স্মৃতিকথা ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ উল্লেখ করেছেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সভায় শ্রী ভাণ্ডারকরের এ উক্তি করেন, সে সভায় ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।]

পরিস্কার যে, শ্রী ভাণ্ডারকর এই বক্তব্যে ‘হরতগ’ বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর মিঃ ফিলিপ ‘হরতগ’ কে বুঝিয়েছেন। মিঃ হরতগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। শ্রী ভাণ্ডারকরের বক্তব্যে হরতগ-এর ‘আশ্রম’ বলতে বুঝানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আমাদের ‘বুড়িগঙ্গা’ হয়েছে শ্রী ভাণ্ডারকরের বক্তব্যে ‘বৃদ্ধাগঙ্গা’। আর মূল গঙ্গা-তীরের ‘পবিত্র আশ্রম’ বলতে শ্রী ভাণ্ডারকর বুঝিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে। শ্রী ভাণ্ডারকরের কথায় ঢাকা অর্থাৎ পূর্ববাংলা অসুরদের স্থান। পবিত্র স্থান কলকাতা থেকে যেসব ঋষি শিষ্য ঢাকায় চাকুরী করতে আসবেন তারাও অসুর হয়ে যাবে। এ থেকেই বুঝা যায়, মুসলমানদর প্রতি শ্রী ভাণ্ডারকরদের বৈরিতা কত তীব্র, ঘৃণা কত গভীর।

তাদের এ বৈরিতার কারণে উপযুক্ত বরাদ্দের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভীষণ অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয় এবং অঙ্গহানিও হয়েছিল। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর ভাষায় “(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়) মুসলমানরা খুবই খুশী হলেন বটে, কিন্তু হিন্দুদের মনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। সাধারণত যারা রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকতেন, তারাও এবার এই প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাস বিহারী ঘোষ ও গুরুদাস বন্দোপাধ্যয়। তাদের প্রধান যুক্তি হলো এই যে, প্রশাসন ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এখন একটি সাংস্কৃতিক বিভাগ করা হচ্ছে। ফলে, এতে গুরুতর বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ক্রমে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ হিন্দুদের এই বলে আশ্বাস দিলেন যে, তাদের এমন আশংকার কোন কারণ নেই। ঢাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় হবে তার ক্ষমতা ও অধিকার ঢাকা শহরের দশ মাইল পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে”। [‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার।]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও এই ভাবে হিন্দুরা একে ‘ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সিন্ডিকেটে হিন্দু যারা নির্বাচিত হয়ে আসতেন তারাও বিশ্ব-বিদ্যালয়ের বৈরিতা ত্যাগ করতেন না, তাদের ভোট বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করারই চেষ্টা করত। ডক্টর রমেশচন্দ্র লিখছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (সিনেটর) সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক ছিলো মুসলমান এবং অর্ধেক ছিলেন হিন্দু। প্রফেসররা কোর্টের সদস্য ছিলেন। বার লাইব্রেরীর অনেক উকিল রেজিষ্টার্ড গ্রাজুয়েটদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে এর সভ্য হতেন। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকে হিন্দুরা ভাল চোখে দেখেনি, একথা পূর্বেই বলেছি। কারণ হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল বঙ্গভঙ্গ রহিত রকায় মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে, অনেকটা তা পূরণ করার জন্যই এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রীতির চোখে দেখেননি। বাইরে এ বিষয়ে যে আলোচনা হত কোর্টের সভায় হিন্দু সভ্যতের বক্তৃতায় তা প্রতিফলিত হত। অবশ্য ভোটের সময় জয়লাভের ব্যাপারে আমরা অনেকটা নিশ্চিত ছিলাম। মুসলমান সদস্য এবং হিন্দু শিক্ষক সদস্যরা একত্রে হিন্দু সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশী ছিলেন”। [‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার।]

সংখ্যাগুরু হিন্দুরা মুসলমানদের কোন ভালই সহ্য করতে পারেনি। মুসলিম লীগ গঠন তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিল, মর্লি-মিণ্টোর শাসন-সংস্কারে মুসলমানদের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তারা বরদাশত করেনি, বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানদের যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে তারা সহ্য করতে পারেনি এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের সহ্য হলোনা। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু মনোভাব সবচেয়ে নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে ‘গুরুতর বিপদ’ অবলোকন করেছে। এই ‘গুরুতর বিপদ’টা কি? সেটা মুসলমানদের উন্নতি ও উত্থান। অর্থাৎ হিন্দুরা হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের অস্তিত্বের বিরোধী, যা মাথা তুলেছিল শিবাজী, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, শ্রী অরবিন্দের আন্দোলনে। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের উত্থিত এই সংহার মূর্তিই সেদিন মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের আত্মরক্ষার সংগ্রামকেই অপরিহার্য করে তুলেছিল॥"

- আবুল আসাদ / একশ' বছরের রাজনীতি ॥ [ বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি - মে, ২০১৪ । পৃ: ৬০-৭৪ ]

৩.
রবীন্দ্রনাথ ও শিবাজী.:
"... ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর কার্যকরী হওয়ার দিন থেকে কলকাতায় হিন্দু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই সময়ে এই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তখন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক মর্যাদায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার কলকাতা তথা বাংলার হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির জগতের প্রধান পাদপীঠ। অর্থনৈতিকভাবে এই পরিবার জমিদারকুলের শিরোমণি। ফলে খুবই স্বাভাবিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান ছিল কলকাতা কেন্দ্রীক হিন্দু সংস্কৃতির নেতৃত্বের আসনে। সামাজিক শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তথা বাঙালি মুসলিম বিরোধী আন্দোলনে। এরই চরম বহি:প্রকাশ "শিবাজী উৎসব" কবিতা রচনা ও প্রকাশ।

... উনিশ শতকের আশির দশকে হিন্দুদের গো-রক্ষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর 'গোকরুণানিধি' প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। ১৮৮২ সালে এই সংগঠনের জন্য কলকাতা থেকে সংগৃহীত হয় ছয়-সাত লক্ষ টাকা। এটা বলাই বাহুল্য যে কলকাতা থেকে এই বিপুল অর্থের যোগান দিয়েছিল হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর আর্য সমাজ ও গো-রক্ষা আন্দোলন বাংলা এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলেও সে সময়ে দেশে কয়েকটি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠে। এইরূপ একটি সংগঠন হলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠিত 'সঞ্জীবনী সভা'। ১৮৮৬ সালে রাজনারায়ণ বসুর প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনরুদ্ধারে নিবেদিত ছিল। এই সংগঠনের কর্মকান্ডে বাংলার মুসলিম সমাজ সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক বক্তব্য স্থান পায়নি। বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান এবং সমাজে তাদের বাস্তব উপস্থিতি এই সংগঠন উপলব্ধি করতে পারেনি। এই সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত উনিশ শতকের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনে আন্দোলিত ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার।

... হেমলতা দেবী প্রণীত গ্রন্থ 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেন বাংলা ১৩০৫ সালের ভারতী পত্রিকার জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়। এই গ্রন্থ সমালোচনার অনুষঙ্গে ভারতে মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। লেখিকা হেমলতা দেবী সম্ভবত তার ইতিহাস গ্রন্থে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে বিচার করেছেন। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে,"মোঘল রাজত্বের পূর্বে তিনশত বছরব্যাপী কালরাত্রে ভারত সিংহাসনে দাস বংশ থেকে লোদী বংশ পর্যন্ত পাঠান রাজণ্যবর্গের যে রক্তবর্ণ উল্কা বৃষ্টি হয়েছে গ্রন্থে তার একটা বিবরণ থাকলে ভাল হতো।"

এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানী শাসনামলকে রবীন্দ্রনাথ ভারত ইতিহাসের কাল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ভারতীয় ইতিহাসের সুলতানী যুগের সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী সময়কালকে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করার রবীন্দ্রনাথের এই প্রয়াস অনৈতিহাসিক, সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষপ্রসূত। সুলতানী আমলে ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুল উন্নতি সাধিত হয়। এই সময়কালে ভারতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শাসন কাঠামো গড়ে উঠে। শিক্ষা ও শিল্পকলায় নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটে। বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ ব্রাহ্মণদের সামাজিক অত্যাচার থেকে রেহাই পায়। বাংলার ইতিহাসে সুলতানী আমল একটি স্বর্ণোজ্জল অধ্যায়। মুসলিম সুলতানদের হাতেই বাংলা ভাষার পূর্ণ সমৃদ্ধি ঘটে। মুসলিম শাসকেরা বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে এবং এই ভাষার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এই সময়কালটি বাংলা ভাষা বিকাশের সোনালী যুগ। আরবী ও ফারসী ভাষার সংস্পর্শে এসে সমৃদ্ধ হয় বাংলা ভাষা। বাংলা সাহিত্যে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ এই সুলতানী আমলকে বলেছেন ইতিহাসের কালো অধ্যায়। এখানে তিনি মুসলিম বিদ্বেষ থেকে ইতিহাস বিকৃতিতে অবতীর্ণ।

... ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্যে এটা স্বীকৃত যে পলাশী পূর্ববর্তী সুবে বাংলার অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হযে পড়েছিল মারাঠা দস্যু আর সন্ত্রাসীদের হামলা, লুন্ঠন, হত্যা ও আক্রমণে। নবাব আলীবর্দী খান মারাঠা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে তার শাসনামলের প্রায় পুরো সময়কালটি ব্যাপৃত থাকেন। উনিশ শতকের হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই ঐতিহাসিক সত্য ভুলে সন্ত্রাসী মারাঠাদের আক্রমণ, লুটপাট আর কর্মকান্ডকে মুসলিম বিরোধী অভিহিত করে হিন্দুদের গৌরব চিহ্নিত করতে থাকে। প্রধানত: এই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলার হিন্দুসমাজ বিজাতীয় মারাঠাদের গুণকীর্তন আর বন্দনা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই ধারারই শক্তিশালী প্রবক্তা।

... 'শিবাজী উৎসব্' (১৯০৪) কবিতাটি যখন রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তখন তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। একই সঙ্গে কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলেও তিনি সম্মানের সাথে সমাদৃত। পারিবারিক এবং আর্থিক কারণে তিনি কলকাতার অভিজাত মহলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান করছেন। বয়েসের পরিসীমায়ও তিনি পরিণত। বলা যেতে পারে উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর পর্বের রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মের ধারাবাহিকতার সাথে কবিতাটির মর্মার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল সেখানে শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেন। তিলক শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উগ্র হিন্দু জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার ও প্রসারের জন্য। ক্রমে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে চালু হয় গণপতি পূজা। ইতিপূর্বে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গো-রক্ষিণী সভা ঐ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। মহারাষ্টের শিবাজী উৎসবের অনুকরণে সখারাম গণেশ দেউস্করের প্রচেষ্টায় কলকাতায় শিবাজী উৎসব প্রচলিত হয় ১৯০২ সালের ২১ জুন তারিখে। সরলা দেবী ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে বীরাষ্টমী উৎসব প্রচলন করেন। তিনি ১৯০৩ সালের ১০ মে শিবাজী উৎসবের অনুকরণে প্রতাপাদিত্য উৎসব প্রচলন করেন এবং একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রবর্তন করেন উদয়াদিত্য উৎসব। কলকাতার বাইরে থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ এই তিনটি উৎসবে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে দূর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে ২৬ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে জানকীনাথ ঘোষালের বাড়িতে যে বীরাষ্টমী উৎসব অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথ তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন।

... শিবাজী উৎসবের মূল মন্ত্র ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষ, সন্ত্রাস এবং সাম্প্রদায়িকতা। বস্তুত এই শিবাজী উৎসবের সূত্র ধরেই বাংলায় সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান পরস্পর বিপরীত পথে ধাবিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটা স্বীকার্য যে এই সন্ত্রাস আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দায়ভাগ পুরোপুরি বর্তায় হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর্। 'শিবাজী উৎসব' পালনের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাংলায় যখন মুসলিম বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজনীতির ভূমি নির্মিত হচ্ছে তখন বাঙালি মুসলিম সমাজ অর্থে, বিত্তে, শিক্ষায় একটি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। আর পূর্ববাংলায় বাঙালি মুসলিম জসংখ্যার সিংহভাগ জমিদারদের রায়ত বা প্রজা। বাংলার হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করলেও হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠার শক্তি বা অবস্থা বাঙালি মুসলমানের ছিল না। কিন্তু বাস্তব ইতিহাস হলো বিশ শতকের শুরুতে এই সাম্প্রদায়িক 'শিবাজী উৎসব' বাংলায় চালু হয়েছিল মুসলিম বিরোধীতা এবং মুসলিম বিদ্বেষকে পুঁজি করে।

কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর কর্মকান্ড ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন :

কোন দূর শতাব্দের এক অখ্যাত দিবসে
নাহি জানি আজ
মারাঠার কোন শৈল অরণ্যের অন্ধকারে ব'সে
হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসয়া এ ভাবনা তরিৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি
'একরাজ্যধর্ম পাশে খন্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেধে দিব আমি'।

এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীকে ভারতের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে খন্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল শিবাজীর জীবনের উদ্দেশ্য। মহারাষ্ট্রে শিবাজী উৎসবের প্রচলন, পরবর্তী সময়ে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিবাজী উৎসব প্রচলনের এবং এই উৎসবকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য নিবেদিত প্রাণ বালগঙ্গাধর তিলক এবং সখারাম দেউস্করের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিবাজীর আদর্শে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা। এখানে এটা স্পষ্টত:ই লক্ষ্যণীয় যে তিলক, দেউস্কর আর রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সম্পূর্ণ অভিন্ন।

... মুসলিম শাসকেরা কখনোই ইসলাম ধর্মকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়নি কিংবা ইসলাম গ্রহণের জন্য কোন প্রকার জোর জবরদস্তি করেনি। জাত-পাত আর বহুবর্ণে বিভক্ত এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি অংশ স্বেচ্ছায় ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইতিহাসে এটাও স্বীকার্য যে সমগ্র ভারতবর্ষকে মুসলিম শক্তিই প্রথম এককেন্দ্রীক শাসনের আওতায় নিয়ে এসেছে। আর ভারতের ঐক্য স্থাপন কখনোই ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি। মুসলিম রাজনৈতিক পতাকাতলে ভারতবর্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সতেরো শতকের ভারত ইতিহাসে শিবাজী একজন মুসলিল বিরোধী, সন্ত্রাসী, লুন্ঠনকারী ও বিশ্বাসভঙ্গকারী আঞ্চলিক দলনেতা। শিবাজীর আদর্শ হলো একমাত্র মুসলিম শাসনের বিরোধিতা। এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর হিন্দুধর্ম আর সন্ত্রাসের আদর্শে ভারতকে এক করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। শিবাজীর আদর্শে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক, মুসলিম বিদ্বেষী এবং আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাংলা ও ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতি ধারার বিরোধী।

... ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পটভূমিতে একদিকে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় এবং অন্যদিকে বাংলায় সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। যেহেতু রাজশক্তি মুসলমানদের কাছ থেকে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল তাই তাদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বাংলার মুসলমান সমাজ। ইংরেজ শক্তি বাংলার মুসলমান সমাজের উপর শুরু করে শোষণ, নিপীড়ন আর নির্যাতন। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজ শুরু করে বৃটিশ শক্তির পদলেহন ও দালালী। তারা ইংরেজ কোম্পানির দালালী, মুৎসুদ্দী আর বেনিয়াগিরী করে প্রভুত অর্থের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাকে গ্রহণ করে। অন্যদিকে মুসলমান সমাজ তাদের ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার ভয়ে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। ক্রমে রাজক্ষমতা, প্রশাসনিক কর্তৃৃত্ব মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উপরন্তু রাজভাষা ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজি চালু হলে মুসলমান সমাজ যুগপৎ ভূমি ও সরকারী চাকুরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে একটি দরিদ্র শ্রেণীতে পরিণত হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আর্থিক সামর্থ্য মুসলমানদের ছিল না। এই পটভূমিতে ইংরেজদের পদলেহী হিন্দু সমাজের একাংশ দালালী আর বেনিয়াগিরী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পটভূমিতে এই সকল দালাল-বেনিয়ারা অর্থ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে জমিদার শ্রেণীতে পরিণত হয়।

এই ইংরেজদের দালালদেরই একজন রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই দালাল শ্রেণীর কাছে ইংরেজ শাসন ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। অন্যদিকে বাংলার মুসলমান সমাজ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালনা করে একটানা আন্দোলন সংগ্রাম। আঠারো ও উনিশ শতকের বাংলার কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল বাংলার মুসলমান সমাজ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে বাংলার মুসলমান সমাজ কখনোই মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজের বেলায় পরিস্থিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু জমিদার, মহাজন, বেনিয়া আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী শক্তি। ঐতিহাসিকভাবে এটা বলা যায় বাংলার তথা ভারতীয় মুসলমান সমাজকে যুগপৎ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের সহযোগী হিন্দু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। আর এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম স্থায়ী বিভাজন রেখা।

... মুঘল তথা মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে গুপ্ত হামলা পরিচালনা, হত্যা, খুন এবং গোপন আস্তানায় থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লুন্ঠন পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শিবাজী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি আরও বলেন যে শিবাজীর ইতিহাস চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শিবাজীর তপস্যা সত্য ছিল বলে তাকে ইতিহাসে চাপা দেয়া যায়নি। মুসলিম ও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে শিবাজী একজন লুন্ঠনকারী, হত্যাকারী, আত্মগোপনকারী, সন্ত্রাসী মারাঠা দলনেতা। তার কার্যক্রম সীমিত ছিল বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অঞ্চলে। সতেরো শতকের ভারতীয় ইতিহাসে একটি প্রমাণিত ও সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থান প্রমাণ করে তিনি মুসলিম বিরোধী হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ও আর্য সংস্কৃৃতির ডামাডোলে কতটা নিমজ্জিত ছিলেন। সামাজিক ও শ্রেণীগত অবস্থানে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসনের মহিমায় মুখর। তিনিই পরবর্তীকালে সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লি আগমন উপলক্ষ্যে রচনা করেন 'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা' সঙ্গীত। এটা এখন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের এই ভাগ্যবিধাতা আল্লাহ বা ঈশ্বর নয়, খোদ বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ।

... রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, মুঘলবিরোধী, লুন্ঠনকারী আর সন্ত্রাসী শিবাজী কর্মকান্ড ভারতের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আর এই ঐতিহ্য হলো মুসলিম বিরোধীতা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস পরিচালনা এবং মুসলমানদেরকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার সঙ্কল্প। বাঙালি হিন্দুদের মাঝে বিশেষত: ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধোত্তরকালে নব উত্থিত হিন্দু বেনিয়া, দালাল, মহাজন, জমিদার শ্রেণী বাংলা ও ভারতের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। উনিশ শতকের বিকশিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বড় অংশই ছিল মুসলিম বিদ্বেষী এবং বাংলার মুসলমান সমাজ সম্পর্কে উন্নাসিক মনোভাবাপন্ন। বিশ শতকের হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের প্রধান অংশই হলো এই ধারার বাহক। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, দুই সম্প্রদায়ের মাঝে দাঙ্গা হানাহানি এবং পরিশেষে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবে বর্তায় এই হিন্দু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের উপর।

... বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে বাঙালি শিবাজীকে নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়। শিবাজীর মহৎ নাম বাঙালি আর মারাঠা জাতিকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়। রবীন্দ্রনাথের এই এক সূত্রে গাঁথার মূল সূত্রটি হলো মুসলিম বিরোধীতা। শিবাজী মুসলিম বিদ্বেষী তাই আসন্ন বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে মুসলমানদের উপর সামাজিক প্রভাব বহাল রাখা এবং সামাজিক শোষণ করার পথ বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্ত সমাজ মুসলিম বিরোধীতায় অবতীর্ণ। এখানেই মুসলিম বিরোধীতার হাতিয়ার হিসেবে মুসলিম বিদ্বেষী মারাঠী সন্ত্রাসী শিবাজীকে বাঙালি হিন্দু সমাজ বরণ করে নিয়েছে, আপন করে নিয়েছে। মুসলিম বিরোধী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে শিবাজী বাঙালি হিন্দুদের কাছে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শিবাজীর পথ ধরেই এগিয়ে যাওয়ার পথের সন্ধান পেয়েছিল বাঙালি হিন্দু সমাজ। শিবাজী মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে আর বাঙালি হিন্দু সমাজ প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। এখানেই শিবাজীর সাথে বাঙালি হিন্দুদের আদর্শিক ও স্বার্থগত সম্পর্কের মিল॥"

- ড. নুরুল ইসলাম মনজুর / শতবর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস : বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগ ॥ [ গতিধারা - জুলাই, ২০১০ । পৃ: ৫২-৮৬ ]