Saturday 30 April 2016

বঙ্কিম ও রাজসিংহ উপন্যাস নিয়ে কিছু পর্যালোচনা। পর্ব দুই:


উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।

সূফি বরষণ
পর্ব দুই:

 শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধের ২২ পৃষ্ঠায় আহমদ ছফা বলেন,  … উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র সত্যকে প্রকাশ করেন নি। দেবী চৌধুরানী আর আনন্দমঠে সেটা স্পষ্ট হয়। ইংরেজদের সাথে বিদ্রোহে মুসলমানদের অবদান পুরা অস্বীকার করলেন বঙ্কিম … সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভাবটি ছিল চমৎকার।কোনো কোনো সময়ে সন্ন্যাসী এবং ফকিরেরা মিলিতভাবে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তার ভুরি ভুরি লিখিত প্রমাণ রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেটি করলেন, ফকিরদের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে ছেটে বাদ দিয়ে সন্ন্যাসীদের লড়াইকে তাঁর রচনার বিষয়বস্তু করলেন। সত্যানন্দকে বীরের গৌরব দিলেন, কিন্তু মজনু শাহ্‌র নামটি উল্লেখ করার উদারতা পর্যন্ত দেখাতে পারলেন না। বঙ্কিম তো আসল ঘটনা জানতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের অপরাধ- তিনি বাস্তবতাকে খুন করেছেন।

 একই প্রবন্ধের ২৩_২৪  পৃষ্ঠায় তিনি বলেন,  …" হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত লড়াইকে একক হিন্দুর লড়াই দেখাতে গিয়ে ইতিহাসের এমন একটা বিকলাঙ্গ অগ্রগতির খাত খনন করেছেন, যা বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসকে একটা কানা গলির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাব এতো সুদূরপ্রসারী হয়েছে, ভারতের জাতীয় ইতিহাস অদ্যাবধি স্বাভাবিক পথটির সন্ধান করে নিতে পারেনি।  … হিন্দু-মুসলমানদের মিলনভূমি ভারতকে একটা সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসকে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন … হিন্দু সমাজের উত্থানের উন্মেষ পর্বে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মধ্যে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন এতোটা গাঢ়মূল হয়েছিলো যে, তার অভিঘাত মুসলমান সম্প্রদায়কে আরেকটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ঠেলে দিয়েছিল"।

বাংলা সাহিত্যে এসব হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা ও চরম বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন মুসলমানরা। বঙ্কিমচন্দ্র তার শেখা প্রায় সবকটি গালি ‘রাজসিংহ ’ উপন্যাসে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে। ‘ম্লেচ্ছ’ হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদের দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাকেও সে উহ্য রাখেনি। শুধু তাই নয়, তারা ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে ছাড়াও মুসলমানদের পাষ-, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর এ জাতীয় কোনো গালি দিতে বাদ দেয়নি।

এখানে বাংলা সাহিত্যের গবেষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বিগত ষাটের দশকে বাঙালীসত্তার দ্বিবিধ শৌর্যবর্তনী ‘হিন্দু-মুসলমান’-এর অন্তঃজ্যোতিরুদ্ভাসনার দায়িত্বে সুদৃঢ় হন। আধুনিক কাব্যায়তনিক পরিসরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের রূপশ্রী অন্বেষণে ব্রতী হন। তাঁর ধ্যানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক (১৮৫৭ খ্রি. -১৯২০ খ্রি.)’[ প্রথম প্রকাশ ; ঢাকা : বাংলা একাডেমী,
১৯৭০ খ্রি.]।

গ্রন্থের ‘অবতরণিকা’য় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ঋজু কথকতার সঞ্চারণা। ১৮৫৭ খ্রি. থেকে ১৯২০ খ্রি. পর্যন্ত আধুনিক বাংলা কাব্যে বর্ণিত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক সম্পর্কের  আনুপূর্বিক  চিত্রদীপ্তি ধারণ ক’রে আছে গ্রন্থটি। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান যথাযথই উল্লেখ ক’রেছেন : সমাজজীবনে এ-সম্পর্কে যেমন দ্বিধায় ও  দ্বন্দ্বে, সৌহার্দ্যে ও সন্দেহে চিহ্নিত, সাহিত্যেও তেমনি তা ঘৃণায়, বিদ্বেষে, প্রীতিতে ও প্রত্যাখ্যানে সমন্বিত। (‘অবতরণিকা’, পৃ. ৩)। রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৫, পঞ্চম পরিচ্ছেদ : উদিপুরী বেগম। এখানে বঙ্কিম লেখেন, "ঔরঙ্গজেব জগৎপ্রথিত বাদশাহ। তিনি জগৎপ্রথিত সাম্রাজ্যের অধিকারী হইয়াছিলেন। নিজেও বুদ্ধিমান, কর্মপদক্ষ, পরিশ্রমী এবং অন্যান্য রাজগুণে গুণবান ছিলেন। এই সকল অসাধারণ গুণ থাকিতেও সেই জগৎপ্রথিতনামা রাজাধিরাজ, আপনার জগৎপ্রথিত সাম্রাজ্য একপ্রকার ধ্বংস করিয়া মানবলীলা সংবরণ করিলেন।

ইহার একমাত্র কারণ, ঔরঙ্গজেব মহাপাপিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় ধূর্ত্, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর, পরপীড়ক, প্রজাপীড়ক দুই একজন মাত্র পাওয়া যায়। এই কপটাচারী সম্রাট জিতেন্দ্রিয়তার ভাণ করিতেন–কিন্তু অন্ত:পুর অসংখ্য সুন্দরীরাজিতে মধুমক্ষিকা পরিপূর্ণ মধুচক্রের ন্যায় দিবারাত্র আনন্দধ্বনিতে ধ্বনিত হইত।

তাঁহার মহিষীও অসংখ্য–আর সবার বিধানের সঙ্গে সম্বন্ধশূন্যা বেতনভাগিনী বিলাসিনীও অসংখ্য। এই পাপিষ্ঠাদিগের সঙ্গে এই গ্রন্থের সম্বন্ধ বড় অল্প। কিন্তু কোন কোন মহিষীর সঙ্গে এই উপাখ্যানের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে।

মোগল বাদশাহেরা যাঁহাকে প্রথম বিবাহ করিতেন, তিনিই প্রধানা মহিষী হইতেন। হিন্দুদ্বেষী ঔরঙ্গজেবের দুর্ভাগ্যক্রমে একজন হিন্দুকন্যা তাঁহার প্রধানা মহিষী। আকব্বর বাদশাহ রাজপুত রাজগণের কন্যা বিবাহ করা প্রথা প্রবর্তিিত করিয়াছিলেন। সেই নিয়ম অনুসারে, সকল বাদশাহেরই হিন্দুমহিষী ছিল। ঔরঙ্গজেবের প্রধানা মহিষী যোধপুরী বেগম।"

( উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম বলেন যে,  ঔরঙ্গজেব মহাপাপিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় ধূর্ত্, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর, পরপীড়ক, প্রজাপীড়ক দুই একজন মাত্র পাওয়া যায়। এই কপটাচারী সম্রাট জিতেন্দ্রিয়তার ভাণ করিতেন–কিন্তু অন্ত:পুর অসংখ্য সুন্দরীরাজিতে মধুমক্ষিকা পরিপূর্ণ মধুচক্রের ন্যায় দিবারাত্র আনন্দধ্বনিতে ধ্বনিত হইত। এইকথার মাধ্যমে পরিস্কার বুঝা যায় বঙ্কিম কতটা উগ্র সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষি লেখক ছিলেন । আর পাশাপাশি করেছেন ইতিহাসের মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি এবং ভারতের মুসলিম শাসনকে  কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করেছেন) ।

রাজসিংহ উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম ইচ্ছাকৃত ভাবে ইতিহাস বিকৃতির মুসলিম শাহজাদীর চরিত্রকে কঙ্কিত করেছেন । বঙ্কিম লিখেন,
"মবারক বুঝিলেন যে, একটা ঘটিলে দুইটাই ঘটিবে। তিনি যদি পাপিষ্ঠা বলিয়া জেব-উন্নিসাকে পরিত্যাগ করেন, তবে তাঁহাকে নিশ্চিত নিহত হইতে হইবে। কিন্তু সেজন্য মবারক দু:খিত নহেন। তাঁহার দু:খ এই যে, তিনি বাদশাহজাদীর রূপে মুগ্ধ, তাহাকে পরিত্যাগ করিবার কিছুমাত্র সাধ্য নাই; এই পাপপঙ্ক হইতে উদ্ধৃত হইবার তাঁহার শক্তি নাই।

অতএব মবারক বিনীত ভাবে বলিল, “আপনি ইচ্ছাক্রমে যতটুকু দয়া করিবেন, তাহাতেই আমার জীবন পবিত্র। আমি যে আরও দুরাকাঙ্ক্ষা রাখি,-তাহা দরিদ্রের ধর্ম বলিয়া জানিবেন। কোন্ দরিদ্র না দুনিয়ার বাদশাহী কামনা করে?”

তখন প্রসন্ন হইয়া শাহজাদী মবারককে আসব পুরস্কার করিলেন। মধুর প্রণয়সম্ভাষণের পর তাহাকে আতর ও পান দিয়া বিদায় করিলেন।

মবারক রঙময়হাল হইতে নির্গত হইবার পূর্বে ই, দরিয়া বিবি আসিয়া তাহাকে ধৃত করিল। অন্যের অশ্রাব্য স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন, রাজপুত্রীর সঙ্গে বিবাহ স্থির হইল?”

মবারক বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কে?”

দ। সেই দরিয়া!

ম। দুশমন! সয়তান! তুই এখানে কেন?

দ। জান না, আমি সংবাদ বেচি?

মবারক শিহরিল। দরিয়া বিবি বলিল, “রাজপুত্রীর সঙ্গে বিবাহ কি হইবে?”.........
দ। কি করিয়াছ? তুমি আমার কি না করিয়াছ? তুমি যাহা করিয়াছ, তার অপেক্ষা স্ত্রীলোকের অনিষ্ট কি আছে? ম। কেন পিয়ারি! আমার মত কত আছে। দ। এমন পাপিষ্ঠ আর নাই। ম। আমি পাপিষ্ঠ নই। কিন্তু এখানে দাঁড়াইয়া এত কথা চলিতে পারে না। স্থানান্তরে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও। আমি সব বুঝাইয়া দিব।
রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৩, তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ঐশ্বর্য-নরক। এখানে বঙ্কিম মিথ্যা চরিত্র সৃষ্টি করে মুসলমানদের পাপিষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ।

উপন্যাসের এই অংশে , রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, চতুর্থ পরিচ্ছেদ : সংবাদবিক্রয়। বঙ্কিম মুসলমানদের গালাগালির মাধ্যমে জাহান্নামে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন । বঙ্কিম লিখেন, “তোমাকেও চিনি, তোমার পরওয়ানাও চিনি। তা এত রাত্রিতে কি আর হজরৎ বেগম সাহেবা সুরমা কিনিবে? তুমি কাল সকালে এসো। এখন খসম থাকে, খসমের কাছে যাও–আর না থাকে যদি—” দ। তুই জাহান্নামে যা। তোর ঢাল-তরবার জাহান্নামে যাক–তোর ওড়নাা পায়জামা জাহান্নামে যাক–তুই কি মনে করিস, আমি রাত দুপুরের কাজ না থাকিলে, রাত দুপুরে এয়েছি?.... তখন দরিয়া, ওড়নাআর ভিতর হইতে এক শিশির সরাব বাহির করিল। প্রহরিণী হাঁ করিল–দরিয়া শিশি ভোর তার মুখে ঢালিয়া দিল–তাতারী শুষ্ক নদীর মত, এক নিশ্বাসে তাহা শুষিয়া লইল। বলিল, “বিস্ মেল্লা! তৌফা সরবৎ! আচ্ছা, তুমি খাড়া থাক, আমি এত্তেলা করিতেছি।” ( এখানে বঙ্কিম বিসমিল্লাহ শব্দের বিকৃত বানানে লেখার পাশাপাশি মুসলমানদের মাদকসেবী প্রতারক হিসেবে উপস্থাপন করেন)।


রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৫, পঞ্চম পরিচ্ছেদ : উদিপুরী বেগম। এখানে বঙ্কিম লেখেন, "এই শ্রেণীর একজন উড়িয়াকে আমি একদা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “তোমরা এমন দুষ্কর্ম্ম কেন কর?” সে ঝটিতি উত্তর করিল, “আজ্ঞে, ঘরের বৌ কি পরকে দিব?” ভারতেশ্বর ঔরঙ্গজেবও বোধ হয় সেইরূপ বিচার করিলেন। তিনি কোরাণের বচন উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, ইসলাঙম ধর্মাইনুসারে তিনি অগ্রজপত্নী বিবাহ করিতে বাধ্য। অতএব দারার দুইটি প্রধানা মহিষীকে স্বীয় অর্ধাইঙ্গের ভাগিনী হইতে আহূত করিলেন। একটি রাজপুতকন্যা; আর একজন এই উদিপুরী মহাশয়া। রাজপুতকন্যা এই আজ্ঞা পাইয়া যাহা করিল, হিন্দুকন্যা মাত্রেই সেই অবস্থায় তাহা করিবে, কিন্তু আর কোন জাতীয়া কন্যা তাহা পারিবে না;-সে বিষ খাইয়া মরিল। খ্রিষ্টিয়ানীটা সানন্দে ঔরঙ্গজেবের কণ্ঠলগ্না হইল। ইতিহাস এই গণিকার নাম কীর্তিুত করিয়া জন্ম সার্থক করিয়াছেন, আর যে ধর্মইরক্ষার জন্য বিষ পান করিল, তাহার নাম লিখিতে ঘৃণা বোধ করিয়াছেন। ইতিহাসের মূল্য এই।

উদিপুরীর যেমন অতুল্য রূপ, তেমনি অতুল্য মদ্যাসক্তি। দিল্লীর বাদশাহেরা মুসলমান হইয়াও অত্যন্ত মদ্যাসক্ত ছিলেন। তাঁহাদিগের পৌরবর্গ এ বিষয়ে তাঁহাদের দৃষ্টান্তনুগামী হইতেন। রঙমনহালেও এ রঙ্গের ছড়াছড়ি! এই নরকমধ্যেও উদিপুরী নাম জাহির করিয়া তুলিয়াছিল।

জেব-উন্নিসা হঠাৎ উদিপুরীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিতে পারিল না। কেন না, ভারতেশ্বরের প্রিয়তমা মদ্যপানে প্রায় বিলুপ্তচেতনা; বসনভূষণ কিছু বিপর্য্যস্ত, বাঁদীরা সজ্জা পুনর্বিন্যস্ত করিল; ডাকিয়া সচেতন ও সাবধান করিয়া দিল। জেব-উন্নিসা আসিয়া দেখিল, উদিপুরীর বাম হাতে সটকায়, নয়ন অর্ধিনিমীলিত, অধরবান্ধুলীর উপর মাছি উড়িতেছে; ঝটিকা বিভিন্ন ভূপতিত বৃষ্টিনিষিক্ত পুষ্পরাশির মত উদিপুরী বিছানায় পড়িয়া আছে।"

( উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম মুসলিম বাদশাহদের ও কন্যাদের মাদকসেবী এবং বাদশাহদের স্ত্রীদের পতিতা বেশ্যা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন ।)

রাজসিংহ : দ্বিতীয় খণ্ড : নন্দনে নরক, পৃষ্ঠা ৬, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : যোধপুরী বেগম। বঙ্কিম লিখেন, তাহারা জানিত যে, এ সম্বন্ধে মোগলদ্বেষিণী চঞ্চলকুমারীর সুখ নাই। সংবাদটা অবশ্য দিল্লীতেও প্রচার হইল। বাদশাহী রঙমাহালে প্রচারিত হইল। যোধপুরী বেগম শুনিয়া বড় নিরানন্দ হইলেন। তিনি হিন্দুর মেয়ে, মুসলমানের ঘরে পড়িয়া ভারতেশ্বরী হইয়াও তাঁহার সুখ ছিল না। তিনি ঔরঙ্গজেবের পুরীমধ্যেও আপনার হিন্দুয়ানী রাখিতেন। হিন্দু পরিচারিকা দ্বারা তিনি সেবিতা হইতেন; হিন্দুর পাক ভিন্ন ভোজন করিতেন না–এমন কি, ঔরঙ্গজেবের পুরীমধ্যে হিন্দু দেবতার মূর্তিজ স্থাপন করিয়া পূজা করিতেন। বিখ্যাত দেবদ্বেষী ঔরঙ্গজেব.......... ঔরঙ্গজেব তাঁহাকেও একটু অনুগ্রহ করিতেন।

রাজসিংহ : তৃতীয় খণ্ড : বিবাহে বিকল্প, প্রথম পরিচ্ছেদ : বক ও হংসীর কথা, পৃষ্ঠা ১॥ বিঙ্কিম মুসলিম বাদশাহকে বানর হিসেবে উপস্থাপন করে লিখেন, "রাজকুমারী ভ্রূভঙ্গী করিলেন–বলিলেন, “তুই কি মনে করেছিস যে, আমি দিল্লীতে গিয়া মুসলমান বানরের শয্যায় শয়ন করিব? হংসী কি বকের সেবা করে?” নির্মাল কিছুই বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি করিবে?”"।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ ইতিহাসগবেষক হিসেবে রোমিলা থাপার বলেন, এ উপমহাদেশে ইসলাম এসেছিল দু’ভাবে : মুসলমানদের আগমন ও বসতি স্থাপন এবং ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে। এখন এ বিষয়টিকে মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে, অভিযান চালিয়ে দখলদারি প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে। আসলে অনেক প্রক্রিয়ায় এখানে ইসলামের প্রসার ঘটেছে। যেমন- মুসলমান ব্যবসায়ী, অভিবাসী, সুফি প্রমুখ এ দেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
রোমিলা ইতিহাসের নানা তথ্য তুলে ধরে অতীতে মুসলমানদের ধর্মীয় উদারতার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তদানীন্তন ভারতের সিন্ধু থেকে কেরালা পর্যন্ত পশ্চিম উপকূলজুড়ে আরব ব্যবসায়ীরা বসতি গড়ে তোলার বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে কিছু আরব দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট রাজাদের অধীনে চাকরি করেছেন। তাদের অনেকে মন্দির ও ব্রাহ্মণদের জন্য ভূমি দান করেছিলেন। আরব ব্যবসায়ীরা এ দেশে বিয়ে করে নতুন নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছিলেন। যেমন- বোহরা, খোজা, নাবায়াৎ, মোপলা প্রভৃতি।
হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীদের ইতিহাস বিকৃতির বর্তমান প্রবণতার প্রেক্ষাপটে রোমিলা থাপার বলেন, মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে কিংবদন্তি বানানো হচ্ছে। বিগত হাজার বছরের এই ইতিহাসের সাথে ধর্মীয় চরমপন্থীরা এবং রাজনৈতিক নেতারা নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন।

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
 সূফি বরষণ

Friday 29 April 2016

বঙ্কিম ও রাজসিংহ উপন্যাস নিয়ে কিছু পর্যালোচনা। পর্ব এক:


উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।

সূফি বরষণ
পর্ব এক:  শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধের ১৯ পৃষ্ঠায় আহমদ ছফা বলেন, ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিম ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক। একটা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। আর সেটা মুসলমানদের পুরো অস্বীকার করে। ছফা শুরু করেছেন বাল্যকাল থেকে। বলেছেন তাঁর বঙ্কিম-অভিজ্ঞতার কথা। কেন বঙ্কিমের বইয়ের গায়ে অশ্রাব্য খিস্তি লেখা থাকে- এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে তিনি এই লেখকের রাষ্ট্রবেত্তা চরিত্র ভালো করে ফুটিয়েছেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিম ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক। একটা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। আর সেটা মুসলমানদের পুরো অস্বীকার করে। … বাঙালি সমাজে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব সর্বাধিক ক্রিয়াশীল হতে পেরেছে, তার মুখ্য কারণ বঙ্কিম রচিত সাহিত্য গ্রন্থের অনন্যতা নয়, বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা। মনে রাখতে হবে বঙ্কিমের মৃত্যুর প্রায় সত্তুর বছর পরে তাঁর রচিত ‘ সুজলং সুফলং মলয়জ শীতলং বন্দে মাতরম’ গানটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো।

ঠিক একই কথা বলেন রোমিলা থাপার। ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদদের একজন রোমিলা থাপার। বর্তমানে দিল্লির নেহরু ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। ইতিহাসের ওপর নোবেল প্রাইজ না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস যে পুরস্কার দিয়ে থাকে, রোমিলা ২০০৮ সালে তা-ও অর্জন করেছেন। তিনি অক্সফোর্ড, শিকাগো ও কলকাতা- এই তিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেয়েছেন অনারারি ডিলিট ডিগ্রি।

১৯ আগস্ট ২০১৫ সালে রোমিলা থাপার নয়া দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়াতে ‘আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার স্মারক বক্তৃতা’ দিয়েছেন।
রোমিলা থাপার সেই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বলেন, ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক দলগুলো নেহায়েত রাজনৈতিক স্লোগানে পর্যবসিত করেছে।
ইতিহাস অনুসন্ধান ও গবেষণার ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি বিশ্লেষণ করা এবং সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অভিমত দরকার। ইতিহাসবিদ রোমিলার ভাষায়- We should not allow history to be reduced to, or dismissed as political slogans of various kinds. ভারতে ইসলামের আগমন ও প্রচার, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি, মুসলিম শাসন প্রভৃতি বিষয়ে এখন সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীরা জোরালো অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মোড়কে তারা ইতিহাস বিকৃতির দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে অবতীর্ণ হয়েছে।

এবার তাহাদের কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলি, বঙ্কিমের রাজসিংহ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া �যাক, বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : চিত্রদলন পর্বে লিখেন, "এই বলিয়া বৃদ্ধা আর একখানি চিত্র বাহির করিয়া রাজপুত্রীর হাতে দিল। রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কাহার চেহারা?” বৃদ্ধা। বাদশাহ আলম্‍গীরের। রাজকুমারী। কিনিব।

এই বলিয়া একজন পরিচারিকাকে রাজপুত্রী ক্রীত চিত্রগুলির মূল্য আনিয়া বৃদ্ধাকে বিদায় করিয়া দিতে বলিলেন। পরিচারিকা মূল্য আনিতে গেল, ইত্যবসরে রাজপুত্রী সখীগণকে বলিলেন, “এসো, একটু আমোদ করা যাক৷”রঙ্গপ্রিয়া বয়স্যাগণ বলিল, “কি আমোদ বল! বল!”

রাজপুত্রী বলিলেন, “আমি এই আল‍মগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটিতে রাখিতেছি। সবাই উহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের নাতি মার। কার নাতিতে উহার নাক ভাঙ্গে দেখি৷”.........হাসিয়া রাজপুত্রী চিত্রখানি মাটিতে রাখিলেন, “কে নাতি মারিবি মার৷”........চঞ্চলকুমারী ধীরে ধীরে অলঙ্কারশোভিত বাম চরণখানি ঔরঙ্গজেবের চিত্রের উপরে সংস্থাপিত করিলেন–চিত্রের শোভা বুঝি বাড়িয়া গেল। চঞ্চলকুমারী একটু হেলিলেন–মড় মড় শব্দ হইল–ঔরঙ্গজেব বাদশাহের প্রতিমূর্‍তি রাজপুতকুমারীর চরণতলে ভাঙ্গিয়া গেল।

“কি সর্‍বনাশ! কি করিলে!” বলিয়া সখীগণ শিহরিল। রাজপুতকুমারী হাসিয়া বলিলেন, “যেমন ছেলেরা পুতুল খেলিয়া সংসারের সাধ মিটায়, আমি তেমনই মোগল বাদশাহের মুখে নাতি মারার সাধ মিটাইলাম৷” তার পর নির্‍মলের মুখ চাহিয়া বলিলেন, “সখি নির্‍মল! ছেলেদের সাধ মিটে; সময়ে তাহাদের সত্যের ঘর-সংসার হয়। আমার কি সাধ মিটিবে না? আমি কি কখন জীবন্ত ঔরঙ্গজেবের মুখে এইরূপ__”

নির্‍মল , রাজকুমারীর মুখ চাপিয়া ধরিলেন, কথাটা সমাপ্ত হইল না–কিন্তু সকলেই তাহার অর্থ বুঝিল। প্রাচীনার হৃদয় কম্পিত হইতে লাগিল–এমন প্রাণসংহারক কথাবার্‍তা যেখানে হয়, সেখান হইতে কতক্ষণে নিষ্কৃতি পাইবে! এই সময়ে তাহার বিক্রীত তসবিরের মূল্য আসিয়া পৌঁছিল। প্রাপ্তিমাত্র প্রাচীনা ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল"। রাজসিংহ : প্রথম খণ্ড : চিত্রে চরণ | পৃষ্ঠা ২ | বঙ্কিম রচনাবলি।

বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসের এই একটি উদ্ধৃতি থেকে পরিষ্কার যে,  বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে কোনো কারণ ছাড়াই জৈনক হিন্দু মহিলাদের দিয়ে মোগল বাদশাহের মুখে নাতি মারার ব্যবস্থার চিত্র হাস্যকর চিত্রের মাধ্যমে বিখ্যাত প্রজা দয়ালু বাদশার মুখে ও নাকে লাথি মেরে নাক মুখ ভাঙ্গা ব্যবস্থা করেছিলেন । এরচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষী লেখা আর কি হতে পারে??

এইবার আরও একটি বঙ্কিমের রাজসিংহ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া �যাক, বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসে লিখেন, "পরদিন চঞ্চলকুমারী ক্রীত চিত্রগুলি একা বসিয়া মনোযোগের সহিত দেখিতেছিলেন। নির্‍মলকুমারী আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া চঞ্চল বলিল, “নির্‍মল! ইহার মধ্যে কাহাকেও তোমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে?”

নির্‍মল বলিল, “যাহাকে আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তাহার চিত্র ত তুমি পা দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ৷” চ। ঔরঙ্গজেবকে! নি। আশ্চর্‍য হইলে যে?
চ। বদ্জাতের ধাড়ি যে? অমন পাষণ্ড যে আর পৃথিবীতে জন্মে নাই?

নি। বদ্জাতকে বশ করিতেই আমার আনন্দ। তোমার মনে নাই, আমি বাঘ পুষিতাম? আমি একদিন না একদিন ঔরঙ্গজেবকে বিবাহ করিব ইচ্ছা আছে। চ। মুসলমান যে? নি। আমার হাতে পড়িলে ঔরঙ্গজেবও হিন্দু হবে"। রাজসিংহ : প্রথম খণ্ড : চিত্রে চরণ, পৃষ্ঠা ৩ । তৃতীয় পরিচ্ছেদ : চিত্রবিচারণ।

উপন্যাসের এই অংশে বঙ্কিম ইতিহাস বিকৃতিসহ ইতিহাসের চরম মিথ্যাচার করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের মুঘল শাসনের ইতিহাসের বিখ্যাত শাসক আওরঙ্গজেবকে "বদ্জাতের ধাড়ি যে? অমন পাষণ্ড যে আর পৃথিবীতে জন্মে নাই?"" বলে উল্লেখ করেছেন । যার মাধ্যমে বঙ্কিম নিজেকে চরম সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষী এবং একজন ইতিহাস বিকৃতিকারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন । এই কথা প্রমাণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ইরফান হাবিবের টাইমস অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত তাঁর লেখায়।


উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ইরফান হাবিবের টাইমস অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত তাঁর লেখাটা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই হলো তাঁর লেখার লিংক ।
http://m.timesofindia.com/india/India-stronger-than-RSS-wont-allow-intolerance-Irfan-Habib/articleshow/50347682.cms

তিনি বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। ভারতের বিজেপির মোদি সরকারের মদদে সাম্প্রদায়িক শক্তির ইতিহাস বিকৃতি এবং মুসলিম বিদ্বেষী সহিংসতার প্রেক্ষাপটে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবীণ অধ্যাপক টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ইরফান হাবিব (৮৪) যে ক’টি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার একটি হলো The Agrarian System of Mughal India ১৫৫৬-১৭০৭ মুঘল যুগ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ইতিহাস শিক্ষার্থীরা গত অর্ধশতাব্দী যাবৎ নির্ভর করছেন এই ক্লাসিক গ্রন্থটির ওপর। ইরফান বহু বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিক্যাল রিসার্চের। ভূষিত হয়েছেন পদ্মভূষণ উপাধিতে।

ইরফান হাবিব সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এখনকার মোদি সরকারকে চালাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস। তাদের আদর্শিক গুরু এম এস গোলওয়ালকার হিটলার ও তার নাৎসি পার্টির ভক্ত ছিলেন। বর্তমান সরকার গোলওয়ালকারের স্বপ্ন পূরণ করছে। ওরা নাৎসিদের প্রপাগান্ডা টেকনিক ব্যবহার করে নির্যাতনের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাদের আদর্শ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার। আরএসএস সাম্প্রদায়িক সংগঠন।
ইরফান হাবিব নরেন্দ্র মোদির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী এমন অবৈজ্ঞানিক কথা বলেন যে, গণেশ দেবতার শুঁড় লাগানো হয়েছিল প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির অনেক ত্রুটি ছিল। তবে তিনিও এমন কথা বলেননি। মোদি আরো মন্দ লোক। তারা আওরঙ্গজের সড়কের নাম বদলে দিলেও মান সিংয়ের মতো রাজাদের নামে যেসব সড়ক আছে, সেগুলোর নাম তো বদলায়নি।

অথচ মান সিং তাদের চোখে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা। আওরঙ্গজেব ছিলেন মুসলমান। এ কারণে আরএসএস তাকে দানব হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। মুসলমানদের তারা বিদেশী মনে করে।
উল্লেখ্য, দিল্লির সুপরিচিত আওরঙ্গজেব সড়কের নাম রাখা হয়েছে এ পি জে আবদুল কালাম সড়ক। এটা মূলত মোদি সরকারের কৌশল। এতে এক দিকে ভারতের একজন সেরা মুঘল সম্রাটের নাম মুছে দেয়া হলো; অন্য দিকে দেখানো যাবে যে, বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িক হলে কোনো হিন্দুর নামে রাস্তাটির নামকরণ হতো, তা তো করা হয়নি। বরং এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় মুসলিম রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়েছে। অথচ তার নামে অন্য কোনো সড়ক বা স্থাপনার নাম রাখা মোটেও কঠিন নয়।

বহুলালোচিত বাদশাহ আওরঙ্গজেব সম্পর্কে ইতিহাসের আলোকে ইরফান হাবিব বলেছেন,  আওরঙ্গজেব হিন্দুতীর্থ বৃন্দাবনসহ বহু মন্দিরকে অর্থ মঞ্জুর করা অব্যাহত রেখেছিলেন; হিন্দুদের ধর্মকর্মের সুবিধার্থে আরো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বিদেশী পর্যটকেরা তার আমলে ভারত সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আওরঙ্গজেবের প্রশাসন পরধর্ম সহিষ্ণু বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ধর্মোন্মাদ ছিলেন বলা ভুল। তার বিশেষ অবদান হলো, পুরো ভারতকে তিনি একক রাজনৈতিক কেন্দ্রের আওতায় করেছিলেন ঐক্যবদ্ধ। হিন্দুস্তান আর মুঘল সাম্রাজ্য অভিন্ন হওয়ার এ চেতনা ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

অথচ এই সিপাহিদের বেশির ভাগই ব্রাহ্মণ। আওরঙ্গজেবের ৩০ শতাংশ সেনাপতিই হিন্দু রাজপুত-মারাঠা। জমিদারদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু।
মোদি সরকার ও তার দল বিজেপির পেছনে আদর্শিক চালিকাশক্তি হিসেবে আরএসএস যে কত ব্যাপক প্রভাবশালী, তা এখন নগ্নভাবে প্রতিভাত। এই আরএসএসের মারাঠা সদস্য, নাথুরাম গডসে ভারতের জাতির পিতা গান্ধীজিকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ মাস পরই। মোদির নেতৃত্বাধীন গুজরাটে ২০০২ সালে মুসলিম নিধনযজ্ঞের হোতাও তারা।

ইরফান হাবিব এ প্রসঙ্গে বলেন, মনে রাখতে হবে, এ যাবৎ সংঘটিত দাঙ্গাগুলোর যে তথ্য পাওয়া গেছে, এতে দেখা যাচ্ছে, আরএসএস এসব দাঙ্গায় জড়িত। ওরা এখন ক্ষমতাকাঠামোর কাছ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছে, আগে কোনো দিন তা পায়নি। গুজবকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামে মানুষ খুন হলেন, সেখানে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিয়ে যা বললেন, তা বেমানান। আরএসএসের এই শাসন ভারতে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।

অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবীরা মুসলিমবিরোধী সাম্প্রতিক সহিংসতার তাণ্ডবের যে সাহসী প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, মোদির অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তাকে ব্যঙ্গ করেছেন। ইরফান হাবিব এই সুন্দর চেহারার মানুষটির অসুন্দর কাজকর্মের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, ২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে তিনি ছিলেন বিজেপির মুখপাত্র। তখন থেকেই তার বক্তব্যের সাথে আমরা পরিচিত। তার কথাবার্তা তখনও ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন।

সঙ্ঘ পরিবার ভারতবর্ষে মুসলিম সুলতান ও সম্রাটদের শাসনকালকে বলছে ‘হাজার বছরের বিদেশী শাসন’। এ দিকে শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যসূচি বদলিয়ে সাম্প্রদায়িক, তথা বিকৃত বানোয়াট ইতিহাসের বটিকা গলাধঃকরণের জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের তোড়জোড়ের শেষ নেই। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ ইরফান হাবিব বলেছেন, বিজেপির প্রথম সরকার ইতিহাস রচনার নামে যা ঘটিয়েছিল, এখন তা চরমে পৌঁছবে কিংবদন্তি, কল্পকথা ও কুসংস্কার ইতিহাসের নামে তুলে ধরার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক বিতর্কের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তবে যত ভুলপন্থায় ইতিহাস উপস্থাপিত হোক, ইতিহাস বদলানো সম্ভব নয়।

ভারতের মুসলিম শাসকেরা কত বেশি উদার ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা তুলে ধরে ইতিহাসের গবেষক ইরফান হাবিব বলেন, মুসলিম আমলে বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যখন কৃষকদের বেশির ভাগ মুসলমান, তখনো জমিদারেরা ছিলেন কায়স্থ হিন্দু। মুসলিম শাসকেরা বিদেশে সম্পদ পাচার করেননি; এ দেশেই স্থায়ী হয়ে গেছেন। তখন ভূমিকরের পরিমাণ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ছিল একই। বেতন বা মজুরি হিসেবে মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে বেশি পেতেন না।

অথচ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রাজসিংহ উপন্যাসে উদ্দেশ্যপ্রনোধিত ভাবে কোনো কারণ ছাড়াই একজন সম্মানিত প্রজা দয়ালু মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে এইধরণের জঘন্য অশ্লীল অশোভন ভাষা মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে লিখে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছেন । আরও পরিস্কার করে বললে বলতে হয় বর্তমান ভারতের সরকার গুলো সাম্প্রদায়িকতা বা মুসলিম বিদ্বেষের নামে যা করছে তা বঙ্কিমের মতো কলকাতার উচ্চ বর্ণ হিন্দু সাম্প্রদায়িক লেখকদের কাছ থেকে শেখা। কারণ একসময়ের ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বা মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছেন উচ্চ বর্ণ হিন্দু সাম্প্রদায়িক লেখকরা ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা । সেই হিসেবে কলকাতাকে বলা যায় সাম্প্রদায়িক বা মুসলিম বিদ্বেষের তীর্থভূমি।

ঠিক একই রকমের কথা বলেন আহমদ ছফা। শতবর্ষের ফেরারিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধের ২০ পৃষ্ঠায় আহমদ ছফা আরও বলেন, … দেশ বিভাগের জন্য কাউকে সত্যি অর্থে দায়ী করতে চাইলে বঙ্কিমের নাম না এসে থাকবে না। আর কেনই বা বঙ্কিম? এর উত্তর খুঁজতে গেলে পেছনের আটশো বছরের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে।

সাম্প্রদায়িক মনোভাব এমনিতে জন্ম নেয় না। শোষণ বঞ্চনার কোন ট্রাজেডি এর পিছনে থাকে। তবে কারণ যাই হোক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমের উচিত ছিলো কালের চিত্রের যথাযথ বর্ণন। তিনি তা করেননি। সত্যকে এড়িয়ে এগোতে চেয়েছেন। ফলে তাঁর উপর দোষ চাপানো ছাড়া ছফার গতি থাকে না। বঙ্কিমের সেই আমলের রাষ্ট্রচিন্তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি এখনো… ভারতে বৃটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই ভারতের আত্মবিস্মৃত হিন্দুরা হিন্দুসত্তা তথা ভারতীয় সত্তা ফিরে পেতে আরম্ভ করেন, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে তার সূচনা এবং বাবরী মসজিদ ধবংসের মাধ্যমে হিন্দুসত্তা চূড়ান্ত সার্থকথার সাথে বিরাট একটা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পেরেছে। একটি হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন নির্মাণ করে ভারতীয় হিন্দুদের যথার্থ পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্কিম। দেখা যাচ্ছে, আজকের ভারতবর্ষেও বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা অসম্ভব রকম জীবন্ত। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের পক্ষেও বঙ্কিমের চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই ফলাফল দাঁড়ালো বঙ্কিম কোনো রকম কারণ ছাড়াই তাঁর বিভিন্ন লেখায় সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বা মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর পাশাপাশি করেছেন চরম ভাবে ইতিহাস বিকৃতি। চলবে

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
 সূফি বরষণ

Tuesday 26 April 2016

বঙ্কিম ও আনন্দ মঠ উপন্যাস নিয়ে কিছু পর্যালোচনা ।পর্ব দুই:


উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।

সূফি বরষণ
পর্ব দুই:
কলকাতা মার্কসবাদী লেখক সুপ্রকাশ রায় বলেন, বঙ্কিম বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, মুসলমান শাসনে হিন্দু ধর্ম বিনষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু ইংরেজ শাসন তাহা পুনরুদ্ধার করিবে এবং তাহা জয়যুক্ত হইবে । যে সময় মুসলমানরা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ব্যস্ত সেই সময় এইভাবে তিনি হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইয়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করিয়াছেন। ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০ ।

এম আর আখতার মুকুল তাঁর কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ের ২৫০ পৃষ্ঠায় বঙ্কিম ও আনন্দ মঠ সম্পর্কে আরও বলেন, যখন...... চরম প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদের একনিষ্ঠ সেবক ঋষি বঙ্কিম চন্দ্রের আবির্ভাব হলো , তখন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ছাড়াও কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণহিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণি অচিরেই বঙ্কিমের কর্মকান্ডকেই বাংলার রেনেঁসার পূর্ণ বিকাশের যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করলো । অথচ প্রকৃত সত্য ও স্বরূপ উদঘাটনের লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তি হওয়ার সত্ত্বেও সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে মহল বিশেষ কর্তৃক চিহ্নিত আনন্দ মঠ এর মূল্যায়ন এক্ষেত্রে অপরিহার্য মনে হয়। আনন্দ মঠ উপন্যাসে বঙ্কিম চন্দ্রের মন মানসিকতা ও বঙ্কিম দর্শনের প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বঙ্কিমের বক্তব্য হচ্ছে :

ক. ইংরেজ বহির্বিষয়ক জ্ঞানে অতি সুপণ্ডিত , লোক শিক্ষায় বড় সুপটু। সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব । আনন্দ মঠ

খ. ইংরেজরা এক্ষণে বণিক _ অর্থ সংগ্রহেই মন দিয়াছে , রাজ্য শাসনভার লইতে বাধ্য হইবে ..... ইংরেজ রাজ্য অভিষিক্ত হইবে বলিয়াই সন্তানবিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে । আনন্দ মঠ

গ. সত্যানন্দের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি বলিলেন , শত্রুশোণিত সিক্ত করিয়া মাতাকে শথ্বশালিনী করিব। মহাপুরুষ শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্র রাজা । আনন্দ মঠ

ঘ. কে কাহার হাত ধরিয়াছে ? জ্ঞান আসিয়া ভক্তিকে ধরিয়াছে , ধর্ম আসিয়া কর্মকে ধরিয়াছে । আনন্দ মঠ

ঙ. ইংরেজ বাংলাদেশকে অরাজকতার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছে । আনন্দ মঠ

চ. অতএব তোমরা দেশ উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর ফল যাহা হইবে ভালোই হইবে । ইংরেজ না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। আনন্দ মঠ ।

তিনি কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ের ৩১ পৃষ্ঠায় আরও বলেন, বাংলার ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে শুরু করে পুরো উনবিংশ শতাব্দী ধরে কোলকাতা কেন্দ্রীক যে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে , তাদের কর্ণধারেরা বাঙালী জাতীয়তাবাদের দাবিদার হিসেবে যত কথাই বলে থাকুক না কেন, তা আসলে বাঙালী হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথাবার্তা । এজন্যই তো উপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্রের আনন্দ মঠের মূল সুরই হচ্ছে যবন (মুসলিম ) বিরোধী । সে আমলে এদের রচিত বাংলা সাহিত্যের সর্বত্রই হিন্দুয়ানীর ঢক্কানিনাদ।

তিনি কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠায় আরও লিখেন, রোমাঞ্চধর্মী উপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপাধ্যায় ১৮৬৫ সালে দুর্গেশ নন্দিনী উপন্যাস দিয়ে শুরু করে ১৮৮১ সালে রাজসিংহ পর্যন্ত বেশ কিছু সংখ্যক উপন্যাস লেখা সমাপ্ত করেছেন এবং বাঙালীত্বের নামে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বন্দেমাতরম শ্লোগান উচ্চারণ করেছেন । তাঁর শক্তিশালী লেখনী তখন সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণি বিদ্বেষে ভরপুর।

একই বইয়ের ১৪৭ পৃষ্ঠায় এম আর আখতার মুকুল বলেন, তাঁর লেখনীর প্রতিটি বর্ণ রাজনীতির মাদকতায় ভরপুর। তিনিই সার্থক ভাবে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অহিফেন সেবনে সক্ষম হলেন । ...... এজন্যই ১৮৮২ সালে প্রকাশিত আনন্দ মঠ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় বঙ্কিমের দাম্ভিক বক্তব্য হচ্ছে , সমাজ বিপ্লব সকল সময়েই আত্মপীড়ন মাত্র । বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী।

আনন্দ মঠ প্রসঙ্গে এখানে আমাদের বাঙালি মুসলমানদের লন্ডনের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলা যাক, লন্ডনে আসার পর থেকে আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু (?) রাষ্ট্র ভারতের অনেকের সাথে অনেক সময় আমার কথা হয়, দেখা হয়। আমি এদের মানসিকতা বুঝার চেষ্টা করি এরা বাংলাদেশকে কি চোখে দেখে, মুসলমানদেরকে কি চোখে দেখে। একটা জিনিস আমি খেয়াল করলাম এরা কেউ সরাসরি-কেউ ইশারা-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করে যে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা হচ্ছে বহিরাগত। আর চিন্তার মূলেই হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষী করে তুলেছে । আর বঙ্কিমের মতো সাহিত্যিকগণ তাদের লেখনীর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা (মুসলিম বিদ্বেষ ) আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিয়েছে ।

আমি তাদেরকে বলি ভারতীয় উপমহাদেশে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলিয়ান, শন, হুক কত জাতি এসেছে কাউকে নিয়ে তোমাদের মাথা ব্যথা নাই, শুধু মুসলমানদের নিয়েই তোমাদের মাথাব্যথা? সবাই থাকতে পারবে শুধু মুসলমানদেরকে কেন চলে যেতে হবে? সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যেই আর্য জাতি ভারতে এসে হিন্দু ধর্ম চালু করলো সেই আর্য জাতিই বহিরাগত। এরা কোনো ভালো উত্তর দিতে পারে না, আমতা আমতা করতে থাকে। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার মূল কারণ হচ্ছে হিন্দুরা মুসলমানদেরকে বহিরাগত মনে করে, আর কেউ কাউকে বহিরাগত মনে করলে সে তাকে আপন করে নিতে পারবে না, অধিকার দিতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক।

যেদিন ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুরা মুসলমানদেরকে বহিরাগত মনে করবে না সেদিন থেকেই সাম্প্রদায়িকতা (মুসলিম বিদ্বেষ ) চলে যাবে বলে আমি মনে করি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগে পাকিস্তান নামে কোনো রাষ্ট্র ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকার ইস্যু ছিল না, আল্লামা সফি হুজুর ছিল না কিন্তু পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় মুসলিম বিদ্ধেষ ছিল এবং কথা একটাই মুসলমানরা বহিরাগত। রবীন্দ্রনাথ-শরত-বঙ্কিম সবাই মুসলমানদেরকে বহিরাগত হিসেবেই দেখেছেন সারা জীবন তাদের রচনার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার শুরু করে দিয়ে গেছেন ।

মুসলমানদেরকে অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় গালি প্রদান এবং মুসলমানদের প্রতি মিথ্যা কালীমা লেপনের নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছে, বঙ্কিম, ঈশ্বরচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, দামোদর মুখোপাধ্যায়, থেকে খোদ রবীন্দ্রসহ বেশিরভাগ বর্ণহিন্দু লেখক।

বাংলা সাহিত্যে এসব হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা (মুসলিম বিদ্বেষ) ও চরম বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন মুসলমানরা। বঙ্কিম তার লেখা প্রায় সবকটি গালি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে। ‘মেচ্ছ’ হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদেরকে দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাকেও সে উহ্য রাখেনি।

শুধু তাই নয়; তারা ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে বলা ছাড়াও মুসলমানদেরকে
পাষ-আত্মা,
পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দূরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর- এ জাতীয় কোনো গালিই দিতে বাদ দেয়নি।
আনন্দমঠ, প্রথম খণ্ড, সপ্তম পরিচ্ছেদ, ১১ | বঙ্কিম লিখন," ১১৭৬ সালে বাঙ্গালা প্রদেশ ইংরেজের শাসনাধীন হয় নাই। ইংরেজ তখন বাঙ্গালার দেওয়ান। তাঁহারা খাজনার টাকা আদায় করিয়া লন, কিন্তু তখনও বাঙ্গালীর প্রাণ সম্পত্তি প্রভৃতি রক্ষণাবেক্ষণের কোন ভার লয়েন নাই। তখন টাকা লইবার ভার ইংরেজের, আর প্রাণ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের ভার পাপিষ্ঠ নরাধম বিশ্বাসহন্তা মনুষ্যকুলকলঙ্ক মীরজাফরের উপর। মীরজাফর আত্মরক্ষায় অক্ষম, বাঙ্গালা রক্ষা করিবে কি প্রকারে? মীরজাফর গুলি খায় ও ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেসপাচ লেখে। বাঙ্গালি কাঁদে আর উৎসন্ন যায়।

অতএব বাঙ্গালার কর ইংরেজের প্রাপ্য। কিন্তু শাসনের ভার নবাবের উপর। যেখানে যেখানে ইংরেজরা আপনাদের প্রাপ্য কর আপনারা আদায় করিতেন, সেখানে তাঁহারা এক এক কালেক্টর নিযুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু খাজনা আদায় হইয়া কলিকাতায় যায়।"

তন্মধ্যে যবন, ম্লেচ্ছ, ইসলাম মুসলিম বিদ্বেষী এবং বঙ্কিম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মুসলিম বিদ্বেষ ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে চাঙ্গা করার জন্য অনেক গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা রচনা করেছে। যবন, মেচ্ছ, ইসলাম মুসলিম বিদ্বেষী লেখা তার সমকালীন হিন্দুদেরকে চরম মুসলিম বিদ্বেষী হতে উৎসাহিত করেছিল।

আনন্দমঠ, চতুর্থ খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৯৩ | বঙ্কিম লিখন ইংরেজ আমাদের প্রভু তাদের হাতে রাজ্য ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া মঙ্গল!?,
" সত্যানন্দ বলিলেন, “হে মহাত্মন্! যদি ইংরেজকে রাজা করাই আপনাদের অভিপ্রায়, যদি এ সময়ে ইংরেজের রাজ্যই দেশের পক্ষে মঙ্গলকর, তবে আমাদিগকে এই নৃশংস যুদ্ধকার্যে কেন নিযুক্ত করিয়াছিলেন?”

মহাপুরুষ বলিলেন, “ইংরেজ এক্ষণে বণিক – অর্থসংগ্রহেই মন, রাজ্যশাসনের ভার লইতে চাহে না। এই সন্তানবিদ্রোহের কারণে, তাহারা রাজ্যশাসনের ভার লইতে বাধ্য হইবে ; কেন না, রাজ্যশাসন ব্যতীত অর্থসংগ্রহ হইবে না। ইংরেজ রাজ্যে অভিষিক্ত হইবে বলিয়াই সন্তানবিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে আইস–

জ্ঞানলাভ করিয়া তুমি স্বয়ং সকল কথা বুঝিতে পারিবে |”

স। হে মহাত্মন্! আমি জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা রাখি না – জ্ঞানে আমার কাজ নাই – আমি যে ব্রতে ব্রতী হইয়াছি, ইহাই পালন করিব। আশীর্বাদ করুন, আমার মাতৃভক্তি অচলা হউক।

মহাপুরুষ। ব্রত সফল হইয়াছে – মার মঙ্গল সাধন করিয়াছ – ইংরেজরাজ্য স্থাপন করিয়াছ। যুদ্ধবিগ্রহ পরিত্যাগ কর, লোকে কৃষিকার্যে নিযুক্ত হউক, পৃথিবী শস্যশালিনী হউন, লোকের শ্রীবৃদ্ধি হউক।

সত্যানন্দের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি বলিলেন, “শত্রুশোণিতে সিক্ত করিয়া মাতাকে শস্যশালিনী করিব |”

মহাপুরুষ। শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্ররাজা। আর ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে শেষ জয়ী হয়, এমন শক্তিও কাহারও নাই।
স। না থাকে, এইখানে মাতৃপ্রতিমাসম্মুখে দেহত্যাগ করিব।
মহাপুরুষ। অজ্ঞানে? চল, জ্ঞানলাভ করিবে চল। হিমালয়শিখরে মাতৃমন্দির আছে, সেইখান হইতে মাতৃমূর্তি দেখাইব।

এই বলিয়া মহাপুরুষ সত্যানন্দের হাত ধরিলেন। কি অপূর্ব শোভা! সেই গম্ভীর বিষ্ণুমন্দিরে প্রকাণ্ড চতুর্ভুজ মূর্তির সম্মুখে, ক্ষীণালোকে সেই মহাপ্রতিভাপূর্ণ দুই পুরুষ মূর্তি শোভিত – একে অন্যের হাত ধরিয়াছেন। কে কাহাকে ধরিয়াছে? জ্ঞান আসিয়া ভক্তিকে ধরিয়াছে – ধর্ম আসিয়া কর্মকে ধরিয়াছে ; বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে ধরিয়াছে ; কল্যাণী আসিয়া শান্তিকে ধরিয়াছে। এই সত্যানন্দ শান্তি ; এই মহাপুরুষ কল্যাণী। সত্যানন্দ প্রতিষ্ঠা, মহাপুরুষ বিসর্জন। বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গেল।"

কলকাতার তথাকথিত শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যিক, আর বাঙালী মুসলিম বিরোধী সাহিত্যিক যে একই কথা তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কলকাতার জনজীবনটিই আবর্তিত হচ্ছে হিন্দুয়ানিকে ঘিরে। উল্লেখ্য, হিন্দুয়ানিতে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস আবশ্যিক নয়, আবশ্যিক নয় আস্তিক হওয়াও। বরং মুসলিম বিদ্বেষ থাকাই হল হিন্দূয়ানি পালনের প্রধান শর্ত।

কলকাতার হিন্দুয়ানির এবং কলকাতার মুসলিম বিরোধী সাহিত্যের আলোচনায় অবধারিতভাবেই উঠে আসবে বাঙালী মুসলিমের সাথে কলকাতার বাঙালীর দ্বিচারিতার প্রসঙ্গ। হিন্দুনারীহরণ ব্যাপারে সংবাদপত্রওয়ালারা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন, মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাঁহাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃ পুনঃ এতবড় অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছেন না কিসের জন্য? মুখ বুঝিয়া নিঃশব্দে থাকার অর্থ কি? কিন্তু আমার ত মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাঁহারা শুধু অতি বিনয়বশতঃই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করব কি, সময় এবং সুযোগ পেলে ও-কাজে আমরাও লেগে যেতে পারি" ।

কলকাতার সমাজের ক্ষেত্রে আমরা যদি দ্বিচারিতাকেই সৌজন্য হিসাবে গণ্য করি, তবে বলতে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের সে সৌজন্যও ছিলো না। বঙ্কিম তার "আনন্দমঠ" উপন্যাসে ব্রিটিশদের সাথে হিন্দুদের "সন্তান দল" এর মানিয়ে চলার উপদেশ দিয়েছে এবং মুসলিমদের "নেড়ে" সম্বোধন করে লিখেছে।

" হিন্দুরা বলিতে বলিতে লাগিল, “আসুক, সন্ন্যাসীরা আসুক, মা দুর্গা করুন, হিন্দুর অদৃষ্টে সেই দিন হউক।” মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, “আল্লা আকবর! এত‍না রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ; মোরা যে পাঁচু ওয়াক্ত নমাজ করি, তা এই তেলককাটা হেঁদুর দল ফতে করতে নারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।” এইরূপে কেহ ক্রন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল।"

আনন্দমঠ চতুর্থ খণ্ড প্রথম পরিচ্ছেদ বঙ্কিম লিখন, "সেই রজনীতে হরিধ্বনিতে সে প্রদেশভূমি পরিপূর্ণা হইল। সন্তানেরা দলে দলে যেখানে সেখানে উচ্চৈ:স্বরে কেহ “বন্দে মাতরম্” কেহ “জগদীশ হরে” বলিয়া গাইয়া বেড়াইতে লাগিল। কেহ শত্রুসেনার অস্ত্র, কেহ বস্ত্র অপহরণ করিতে লাগিল। কেহ মৃতদেহের মুখে পদাঘাত, কেহ অন্য প্রকার উপদ্রব করিতে লাগিল। কেহ গ্রামাভিমুখে, কেহ নগরাভিমুখে ধাবমান হইয়া, পথিক বা গৃহস্থকে ধরিয়া বলে, “বল বন্দে মাতরম্, নহিলে মারিয়া ফেলিব |” কেহ ময়রার দোকান লুঠিয়া খায়, কেহ গোয়ালার বাড়ী গিয়া হাঁড়ি পাড়িয়া দধিতে চুমুক মারে, কেহ বলে, “আমরা বজ্রগোপ আসিয়াছি, গোপিনী কই?” সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে।"

পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ড. অরবিন্দ পোদ্দারের মতে, " বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদকে একটা ধর্মীয় আধ্যাত্মিক আলোকে মন্ডিত করে। ভারতবর্ষ নামক যে একটি ভৌগোলিক সত্তা, তাকে সে মাতৃরূপে উপলব্ধি করতে চেয়েছে, এই মাতৃভাবনা স্বর্গীয় দেবী ভাবনার সমতুল্য। ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতে সে দেশ জননীকে দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সঙ্গে একাত্ম বলে বর্ণনা করেছে।… অন্য কথায়, হিন্দু রাজত্ব স্থাপন এবং তারই অনুপ্রেরণায় ভবিষ্যৎ ভারতকে নির্মাণ করার আদর্শ সে প্রচার করেছিল
ওপারের আনন্দমঠীয় রাজনীতি।

১৯৮৩ সালে আনন্দ মঠ উপন্যাস নিয়ে সেসময় কলকাতার রাজনীতিকদের মধ্যে যে বিতর্কের সূচনা হয় তা নিয়ে সংবাদপত্র গুলো বিভিন্ন মজাদার সংবাদ পরিবেশন করে। তা নিম্নে তুলে ধরা হলো,
আনন্দমঠ নিয়ে মজার বিতর্ক শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৮৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটিতে আনন্দমঠের শতবার্ষিকী পালন করা হয়। উল্লেখ্য, ১৮৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বঙ্কিমের আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়। আনন্দমঠের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই এই বিতর্কের শুরু। এই বিতর্কের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সিপিএম সম্পাদক ও বামফ্রন্ট কমিটির চেয়ারম্যান সরোজ মুখার্জী, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব কুমার মুখার্জী, পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস (ই) সভাপতি আনন্দ গোপাল মুখার্জী, ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আইনমন্ত্রী সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ প্রমুখ।

সরোজ বাবু আনন্দমঠকে সাম্প্রদায়িক বলে সমালোচনা করেছিলেন। একে বঙ্কিম জীবনের একটি ত্রুটি বলে উল্লেখ করেন। সরোজ বাবুর এই কথায় তেড়ে উঠেছেন প্রণব মুখার্জী (প্রণব এখন ভারতের রাষ্ট্রপতি)। তিনি বলেন, কম্যুনিস্টরা কবিগুরুকে বুর্জোয়া আখ্যা দিয়েছিল এবং নেতাজী সুভাষ বসুকেও দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিলো। বিশেষ করে নেতাজী সম্পর্কে ওদের বিভ্রান্তি কাটাতে কম্যুনিস্টদের কুড়ি বছরের বেশি সময় লেগেছে। হয়ত আনন্দমঠকে বুঝতেও তাদের আরও কুড়ি বছর সময় লাগবে। এরপর প্রণব বাবু বলেছিলেন, আনন্দ মঠের বন্দে মাতরম মন্ত্রই ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা।

প্রণব বাবুর এই উক্তির ত্বরিৎ জবাব দেন সরোজ বাবু। তিনি প্রশ্ন তুলেন, ‘প্রণব মুখার্জী কে? সে আনন্দমঠের কি বুঝে? ওর বাবা বামদা মুখার্জী যদি আনন্দমঠ নিয়ে কথা বলতেন তাও না হয় বুঝা যেত।' প্রণব বাবু সরোজ বাবুর এই আক্রমণের জবাব দিয়ে ছিলেন কি না জানি না। তবে জবাব দিতে এগিয়ে আসেন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের (ই) সভাপতি আনন্দ গোপাল মুখার্জী। তিনি প্রথমেই প্রশ্ন তুলেন, সরোজ মুখার্জী আনন্দ মঠের কি বুঝে? প্রত্যেক বিপ্লবীর কাছেই আনন্দমঠ প্রেরণার বস্তু। আনন্দ গোপাল বাবুর সহায়তায় এসেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী ও ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর ভক্তিভূষণ ও ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ। ভক্তিভূষণ বাবু বলেন, ‘আমি থাকলে সরোজ বাবুকে যোগ্য জবাবই দিতাম।' উল্লেখ্য, সরোজ বাবু ফ্রন্ট কমিটির মিটিংয়ে আনন্দমঠের শতবর্ষ নিয়ে তার আপত্তি প্রকাশ করেন। ভক্তিভূষণের অপর সহযোগী অশোক ঘোষ আনন্দমঠকে সাম্প্রদায়িক প্রেরণাস্বরূপ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে আনন্দমঠ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার দাবি জানান। সর্বশেষে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আইনমন্ত্রী সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘‘যারা বলেন আনন্দমঠ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনারা একজন মুসলমানকে দেখান যিনি আনন্দমঠ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন? আনন্দমঠ কি সত্যিকার জাতীয়তাবোধের উদ্বোধক?... জনসংঘ নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে মনে করে। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানের জাতীয়তাবাদ আর জনসংঘের জাতীয়তাবাদ এক নয়। আনন্দ মঠের জাতীয়তাবাদ ঐ জাতীয়।’’

আনন্দমঠ নিয়ে উপরের বিতর্কে দু'টো পক্ষ দুই প্রান্তিক চিন্তার উপর দাঁড়ানো। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস (ই) এবং ফরোয়ার্ড ব্লকসহ অধিকাংশই বলেছেন, আনন্দমঠ স্বাধীনতা আন্দোলনের উদ্বোধক এবং আজকের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং আনন্দ মঠের জাতীয়তাবাদ একই। অন্যদিকে সিপিএম এবং মনসুর হাবিবুল্লাহ বলছেন, আনন্দমঠ সাম্প্রদায়িক এবং বর্তমান ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে এর কোন সামঞ্জস্য নেই।

পশ্চিমবঙ্গে আনন্দমঠ নিয়ে এই ঝগড়ার ইতিটা কিভাবে আমি বলতে পারি না। তবে আনন্দমঠ দিয়ে আনন্দমঠকে যতটা চিনি, আনন্দ মঠের পরের ইতিহাস যা বলে, তার বিচারে সরোজ বাবু ও মনসুর সাহেবদের অবস্থানটা বড়ই দুর্বল। কংগ্রেস রাজনীতির যে দর্শন ছিল এবং এখনো যা আছে তার সাথে হিন্দু মহাসভা এবং জনসংঘীদের কোনই পার্থক্য নেই। পার্থক্য যেটা সেটা বহিরাবরণের। আনন্দমঠ যে তখন হিন্দুদের মধ্যে কোনই বিতর্কের সৃষ্টি করেনি, সবাই একে লুফে নিয়েছিল এ কথা আমি বলি না। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই আনন্দমঠের মূলমন্ত্রের লেখক কালি প্রসন্ন ঘোষকে লিখেছিলেন, ‘আমি আনন্দমঠ লিখিয়া কি করিব আর আপনি বা তাহার মূলমন্ত্র বুঝাইয়া কি করিবেন? এ ঈর্ষাপর আত্মোদরপরায়ণ জাতির উন্নতি নাই।' কিন্তু এই সাথে তিনি একথাও বলেছিলেন, একদিন দেখিবে- বিশ-ত্রিশ বছর পর এই গান লইয়া বাংলা উন্মত্ত হইয়াছে। বঙ্কিমের এই কথাটিই অরবিন্দ যেভাবে তুলে ধরেছেন তা এই : ‘‘বঙ্কিম ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন একদিন আসবে যেদিন আনন্দমঠের বন্দে মাতরম ধ্বনিতে গোটা ভারত উচ্চকিত হবে। বিস্ময়করভাবে তার ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছে।’’

অরবিন্দের সাথে আমরাও একমত। আনন্দমঠ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। আর নিখিল ভারত কংগ্রেসের প্রথম সম্মেলন বসে কোলকাতায় ১৮৮৬ সালে। এই সম্মেলনে কি হেমচন্দ্র ‘রাখি বন্ধন' নামে একটি কবিতা পাঠ করেন। এই কবিতায় কবি হেমচন্দ্র আনন্দমঠের ‘বন্দে মাতরম'কে জাগরণের স্লোগান হিসেবে উদ্ধৃত করেন। এভাবেই আনন্দমঠের বন্দে মাতরম সর্বভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করল। বিপিন চন্দ্র পালের সম্পাদনায় বাংলা থেকে যখন ‘বন্দে মাতরম' নামে পত্রিকা বের হলো, সেই সময় ভারতের অপর প্রান্ত থেকে লালা লাজপত রায়ের সম্পাদনায় আরেকটি পত্রিকা বের হলো। হিন্দুদের পত্র-পত্রিকা, প্রবন্ধ-গল্পে আনন্দমঠ ও আনন্দমঠের বন্দে মাতরম হলো অত্যন্ত পবিত্র আলোচনার এক বিষয়। ১৯০৫ সালে জনৈক যোগীনাথ সরকারের হাত দিয়ে ‘বন্দে মাতরম' নামে সংগীতের একটা সংলকন বের হলো।

ভারতের এক প্রান্তের এ সংকলনটির ভূমিকা লিখলেন আরেক প্রান্তের (মহারাষ্ট্রের) সখারাম গণেশ দেউকর। মাত্র ২৩ দিনে পুস্তিকাটির তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সময়টা হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণ আন্দোলনের সময়। মুসলিম স্বার্থবিরোধী এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই হিন্দুদের দ্বারা সৃষ্টি হলো স্বদেশী আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আনন্দ মঠের স্রষ্টা বাবু বঙ্কিম চন্দ্রের মুসলিম নিধনে নিয়োজিত সন্তান সেনাদের বন্দে মাতরমকে স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ কথায় বলতে চাই, সরোজ বাবু যাকে সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন, সেই ‘বন্দে মাতরম', সেই ‘আনন্দমঠ', ভারতীয় হিন্দুদের উত্থান-চিন্তার সাথে ছিল একাত্ম। স্বয়ং সরোজবাবুও এটা অস্বীকার করতে পারেন না। তিনি কংগ্রেসী হিসেবে ১৯৩০ সালে জেলে যান।

‘বন্দে মাতরম' ধ্বনি দেয়ার জন্য জেলে সরোজ বাবু বেত খেয়েছিলেন। আর ঐ সালেই সরোজ বাবু ও তার সঙ্গীরা দমদম জেলে ‘আনন্দমঠ' মঞ্চস্থ করেছিলেন- যে আনন্দমঠে আছে ‘ধর্ম' গেল জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন তো প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’’ এখন সরোজ বাবু বলছেন, এগুলো তারা করেছেন না বুঝে। এটা সরোজ বাবুর একান্তই ব্যক্তিগত মত। আর একটা জিনিস ভুল মনে হওয়া এবং বাস্তবতা দু'টো সম্পূর্ণই স্বতন্ত্র জিনিস। তার একার এক উপলব্ধি দিয়ে তার জাতির বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারেন না, পারলেও তা আরেক ভুল হবে। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় হিন্দুদের উত্থান চিন্তা থেকে এবং তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আনন্দমঠীয় আদর্শকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থ বলেছেন, ‘বঙ্কিম বাবু যাহা কিছু করিয়াছেন... সব গিয়া একপথে দাঁড়িয়াছে। সে পথ জন্মভূমিকে উপাসনা- জন্ম ভূমিকে মা বলা- জন্মভূমিকে ভালোবাসা- জন্মভূমিকে ভক্তি করা। তিনি এই কার্য করিয়াছেন, ইহা ভারতবর্ষের আর কেহ করে নাই। তিনি আমাদের অন্তঃদ্রষ্টা। সে মন্ত্র বন্দে মাতরম।'

সুতরাং আনন্দ মঠ নিয়ে বিতর্কে প্রণব বাবুরাই জিতে যাচ্ছেন। তাই বলে সরোজ বাবু ও মনসুর সাহেবদের সব কথাই বেঠিক তা বলি না। বর্তমান ভারতের শাসনতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ আনন্দমঠীয় জাতীয়তাবাদ থেকে ভিন্ন- সরোজ বাবু ও মনসুর সাহেবদের এই কথা বহিরাবরণের দিক দিয়ে পুরোটাই ঠিক, কিন্তু অন্তর্গত দিক দিয়ে পুরোটাই বেঠিক। অন্তত ভারতীয় সংখ্যালঘুদের আজ কোনই সন্দেহ নেই যে, ধর্ম নিরপেক্ষতার পোশাক ভারতের শাসনতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ আরএসএস ও জনসংঘ, অন্যকথায় আনন্দমঠীয় দর্শনকেই বাস্তব রূপ দেবার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রমাণ তালাশের প্রয়োজন নেই। ভারতের হরিজন, খৃস্টান, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘুদের কথাগুলো কান পেতে শুনলেই সব স্বকর্ণে শোনা যাবে। এরপর সরোজ বাবু ও মনসুর সাহেবরা যেখানে আনন্দ মঠ ও বন্দে মাতরমকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, বক্তব্যের সে অংশটা তাদের ষোল আনাই ঠিক। আনন্দ মঠ ও বন্দে মাতরম  সব অর্থ সব দিকের বিচারেই সাম্প্রদায়িক-একান্তভাবেই হিন্দু সম্প্রদায়ের নিজস্ব মর্মকথা। তাইতো দেখি, স্বাধীনতা আন্দোলনের যৌথ মঞ্চে যখন হিন্দুরা বন্দে মাতারম স্লোগান দিয়েছে, তখনই মুসলমানদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহ্ আকবর ধ্বনি। বৃটিশ ভারতে যৌথ আন্দোলনের দ্বিধা-বিভক্তির এখান থেকেই শুরু, শেষ হয়েছে ভারত বিভাগের মধ্যদিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আনন্দ মঠের ‘নেড়েদের তাড়াইয়া হিন্দুয়ানী' রক্ষার স্লোগান শুধু হিন্দুদের জাগায়নি মুসলমানদেরও জাগিয়ে তুলেছিল। এই জাগারই উত্তর ফল তাদের স্বতন্ত্র আবাস-ভূমি এবং আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। সুতরাং আনন্দ মঠ ইতিহাসের একটা মাইলস্টোন। সরোজ বাবুরা যাই বলুন এর শতবার্ষিকী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই যুক্তিযুক্ত হয়েছে। আমরা এপারে বাংলাদেশীরা বুঝি কি না সেটাই প্রশ্ন। উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়। তার ফল সরূপ আমাদের আজকের বাংলাদেশ এবং ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ ।

Sunday 24 April 2016

উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।

বঙ্কিম ও আনন্দ মঠ উপন্যাস নিয়ে কিছু পর্যালোচনা ।

উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।

সূফি বরষণ
পর্ব এক:
কলকাতার মার্কসবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় তাঁর লেখা  ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০ বইতে লিখেছেন, যে সময় মুসলমানরা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ব্যস্ত সেই সময় এইভাবে তিনি(বঙ্কিম)  হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইয়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করিয়াছেন।

এবং এইকথার সমর্থন পাওয়া যায় আহমদ ছফার বাঙালী মুসলমানের মন লেখায়। তিনি বলেন, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস। কেউ কেউ অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সাম্প্রদায়িকতার জনয়িতা মনে করেন। তাঁরা ভারতীয় ইতিহাসের অতীতকে শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের দুশো বছরের মধ্যে সীমিত রাখেন বলেই এই ভুলটা করে থাকেন।

ঠিক একই রকম কথা বলেন, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বইয়ের ২৮  পৃষ্ঠায় কমরেড মুজাফফর আহমদের মতে,  বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের আনন্দ মঠ হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ । এর মূল মন্ত্র ছিল বন্দেমাতরম গান।

কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ের ২৫১ পৃষ্ঠায় এম আর আখতার মুকুল বলেন, কোনো রকম লুকোচুরি না করে বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর রচিত আনন্দ মঠ উপন্যাসে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এদেশ সম্পূর্ণ ভাবে ইংরেজদের পদানত হওয়ার ফল শুভ হতে বাধ্য । কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইংরেজরা এদেশে না আসলে সনাতন ধর্মের ( হিন্দু ধর্ম ) বিজয় কেতন উড্ডীন সম্ভব হতো না ।

বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এ মর্মে বিশেষ করে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণহিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মধ্যশ্রেণি সম্প্রদায়কে বুঝাতে চেয়েছেন যে, মুসলমানদের শাসনে হিন্দু ধর্ম নিমজ্জিত হয়েছিল !?, কিন্তু ইংরেজ শাসনে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে । তাহলে বঙ্কিম প্রতিভার প্রকৃত মূল্যায়নের পর এ ধরনের মন্তব্য করলে অন্যায় হবে না যে, বাংলার রেনেঁসার পূর্ণ বিকাশের হোতা হিসাবে বর্ণিত বঙ্কিম চন্দ্র ছিলেন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নির্ভেজাল সমর্থক। অবশ্য তিনি ইংরেজদের ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিক্রিয়াশীল সনাতন হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু শৌর্য বীর্যের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ইংরেজদের দালালীর পথকে সহজতর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । এজন্যই বঙ্কিমের মন মানসিকতা কৃষক (মুসলিম) বিদ্বেষ , নিন্মশ্রেণী বিদ্বেষ এবং যবন (মুসলিম) বিদ্বেষ_এ ভরপুর। (এখানে যবন বলতে মুসলমানদেরকে গালি বাচক শব্দ হিসেবে হিন্দুরা ব্যবহার করতো!?। )

এইভাবে উপরে উল্লিখিত বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আনন্দ মঠ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক। আনন্দমঠ, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, ৭৯ | বঙ্কিম চন্দ্র বলেন, সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল |” গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মুই হেঁদু |”

দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল। চারি দিকে রাজপুরুষেরা ছুটিল, অবশিষ্ট সিপাহী সুসজ্জিত হইয়া নগররক্ষার্থে শ্রেণীবদ্ধ হইল। নগরের গড়ের ঘাটে ঘাটে প্রকোষ্ঠসকলে রক্ষকবর্গ সশস্ত্রে অতি সাবধানে দ্বাররক্ষায় নিযুক্ত হইল। সমস্ত লোক সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি হয় কি হয় চিন্তা করিতে লাগিল। হিন্দুরা বলিতে বলিতে লাগিল, “আসুক, সন্ন্যাসীরা আসুক, মা দুর্গা করুন, হিন্দুর অদৃষ্টে সেই দিন হউক।” মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, “আল্লা আকবর! এত‍না রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ; মোরা যে পাঁচু ওয়াক্ত নমাজ করি, তা এই তেলককাটা হেঁদুর দল ফতে করতে নারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।” এইরূপে কেহ ক্রন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল।

 উপন্যাসের এই অংশে মুসলমানদের কে যবন বলে গালাগালি করা ছাড়াও “মুই হেঁদু ” অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে হাস্যকর বস্তুতে পরিণত করার পাশাপাশি পবিত্র কুরআন শরীফকের নিয়েও  হাস্যকরা বাদ দেয়নি !?  যেমন “আল্লা আকবর! এত‍না রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো ;

আনন্দমঠ, তৃতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৬৯ | বঙ্কিম আরও লিখন,  ” তখন বড় কোলাহল হইতে লাগিল। কেহ চীৎকার করিতে লাগিল, “মার, মার, নেড়ে মার |” কেহ বলিল, “জয় জয়! মহারাজকি জয়।” কেহ গায়িল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে!” কেহ গায়িল, “বন্দে মাতরম্!” কেহ বলে–“ভাই, এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালি হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীরপাত করিব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, আপনার ধন আপনি খাইব?” দশ সহস্র নরকণ্ঠের কল কল রব, মধুর বায়ুসন্তাড়িত বৃক্ষপত্ররাশির মর্মর, সৈকতবাহিনী তরঙ্গিণীর মৃদু মৃদু তর তর রব, নীল আকাশে চন্দ্র, তারা শ্বেত মেঘরাশি, শ্যামল ধরণীতলে হরিৎ কানন, স্বচ্ছ নদী, শ্বেত সৈকত, ফুল্ল কুসুমদাম। আর মধ্যে মধ্যে সেই সর্বজনমনোরম “বন্দে মাতরম্!” ।

উপন্যাসের এই অংশে নেড়ে মার বলতে মুসলমানদের হত্যা করার কথা বুঝিয়েছেন। বাঙালি মুসলমানদের তুচ্ছ বাঙালি সম্মোধন করে যুদ্ধে হত্যা করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় এবং মসজিদ ভাঙ্গে রাধামাধবের মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রবল আক্রমণাক্ত ইচ্ছে প্রকাশ করে হয়!?।


এইসব কথা বলার ও লিখার পরও কি আপনি কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) হিন্দুদেরকে কি বলে স্বম্মোধন করবেন?? আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে না তখন মুসলমানরা শাসক ছিলনা, ছিল সাধারন প্রজা তখন ক্ষমতায় ছিল ইংরেজরা !? তারপরও কেন এতো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ( মুসলিম বিদ্বেষের) পরিচয় দেয় হিন্দুরা তাদের আচার আচরণ ও সাহিত্যের মাধ্যমে!?। এর মূলে ছিল ভারত ভাগ করে হিন্দুদের জন্য আলাদা আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠা । তাই বলা যায় এইসব লিখা পরবর্তীতে দেশ ভাগের পটভূমি হিসেবে কাজ করে। উপরে লেখার সূত্র ধরে সাংবাদিক সূফি বরষণ যদি বলে যে, উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা জন্মগতভাবেই মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে।  আর  বঙ্কিমের মতো মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিকরা লেখার মাধ্যমে সমাজে আরও বেশি করে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয় তার প্রমাণ আপনারা ইতিমধ্যেই পেয়েছেন ।


ভারতীয় উপমহাদেশে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের কোলকাতা হলো সাম্প্রদায়িকতার ( মুসলিম বিদ্বেষের ) আবাদ ভূমি যেখান থেকে সারা ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয় হিন্দুরা । এবং ফলাফল হিসেবে ভারত ভাগ হয়। হিন্দুরা যে অতি উচ্চমাত্রার চরম সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) তার প্রমাণ হলো, ভারত ভাগের আজ ৬৯ বছর পর দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সংখ্যা ২৮% আর সরকারি চাকুরীতে মুসলমানদের পরিমাণ হলো ২.১% !???।  গত ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু কমিউনিস্টরা শাসন করে, _'মুখে এরা সাম্যবাদে কথা বললেও আসলে এরাও সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষী) দোষে দুষ্ট। আসলে মুসলিম বিদ্বেষের বেলায় কংগ্রেস, বিজিবি, আরএসএস আর তথাকথিত হিন্দু কমিউনিস্টরাও এক এবং অভিন্ন । এই কথার কেউ উত্তর দিতে পারেনা পশ্চিমবঙ্গের ২৮% মুসলমানদের মধ্যে সরকারি চাকরিতে ২.১% কেন ।  কলকাতার উচ্চ বর্ণ  সাম্প্রদায়িক ( মুসলিম বিদ্বেষ) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বড়ো প্রমাণ এখন আপনাদের সামনে।

বঙ্কিমের কৃষক আন্দোলনের ঘোর বিরোধী উপন্যাস আনন্দ মঠ সম্পর্কে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ ও বঙ্কিমভক্ত ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের মত হচ্ছে, .... উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী হাঙ্গামার মতো একটা লুটতরাজের বিশৃঙ্খল ঘটনাকে জ্যোতির্ময় দেশ প্রেম ও বলিষ্ঠ আত্মত্যাগের আধারে পরিবেন করাতে কাহিনীটির বস্তুগত যথার্থ কিছু ক্ষুণ্ন হয়েছে । কারণ ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে একদল উপদ্রবকারী সন্ন্যাসী ( উত্তর প্রদেশের অধিবাসী ) বাংলাদেশে কিছুকাল ধরে যে,  নির্যাতন লুটতরাজ ও আরও নানা ধরনের অত্যাচার চালিয়ে ছিল , তার সঙ্গে দেশ প্রেম কেন ,  কোনও প্রকার মহৎ বৃত্তির কিছু মাত্র সম্পর্ক ছিল না। বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত পৃষ্ঠা ৫৪২ সংশোধিত চতুর্থ সংকলন কলকাতা ১৯৭৮।

অবশ্য আরও গভীর ভাবে বঙ্কিম রচিত আনন্দ মঠ উপন্যাস আলোচনার লক্ষ্যে কলকাতার মার্কসবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ইংরেজদের হস্তের ক্রীড়নক মীরজাফরের শাসনের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষক জনসাধারণের সংগ্রামকে তিনি এরূপ ভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন যেন তাহারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুর সংগ্রাম এবং মুসলমান শাসনের কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্যই প্রয়োজন ইংরেজ প্রভুত্বকে বরণ করা ।

সংগ্রামের শেষ পর্যন্ত জয়ী হইয়াও সংগ্রামের নায়কগণ স্বাধীন রাজ্য স্থাপন না করিয়া ইংরেজের হস্তে রাজ্যভার ত্যাগ করিয়া তীর্থ দর্শন করিতে গেলেন । দেশ ইংরেজের হস্তে পতিত হইবে শুনিয়া বিদ্রোহীদের নায়ক সত্যানন্দ আক্ষেপ করিলে বঙ্কিম চন্দ্র চিকিত্সকের মুখ দিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিয়াছেন:  চিকিৎসক বলিলেন, “সত্যানন্দ, কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর যাহা হইবে, তাহা ভালই হইবে। ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। মহাপুরুষেরা যেরূপ বুঝিয়াছেন, এ কথা আমি তোমাকে সেইরূপ বুঝাই। মনোযোগ দিয়া শুন। তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা সনাতনধর্ম নহে, সে একটা লৌকিক অপকৃষ্ট ধর্ম; তাহার প্রভাবে প্রকৃত সনাতনধর্ম – ম্লেচ্ছেরা যাহাকে হিন্দুধর্ম বলে – তাহা লোপ পাইয়াছে। প্রকৃত হিন্দুধর্ম জ্ঞানাত্মক, কর্মাত্মক নহে। (আনন্দমঠ, অষ্টম পরিচ্ছেদ, ৯২ পৃষ্ঠা)  ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তৃতীয় সংকলন কলকাতা ১৯৮০  । চলবে

Friday 22 April 2016

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে বিহারে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমানদের উপরে চালানো হয় বর্বর গণহত্যার। উঠে এসেছে বিহারী মুসলমানদের দূর্দশার এক অজানা অধ্যায় ।

আবদুস সামাদ_ এ সট্রিপ অব ল্যান্ড: টু ইয়াডস লং বই রিভিউ:
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে বিহারে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমানদের উপরে চালানো হয় বর্বর গণহত্যার। উঠে এসেছে বিহারী মুসলমানদের দূর্দশার এক অজানা অধ্যায় ।

সূফি বরষণ
আবদুস সামাদ-এর উর্দ্দু সংকলন নাম ‘দো গজ জমিন যে বইয়েতে উঠে এসেছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে বিহারে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমানদের উপরে চালানো বর্বর গণহত্যাগণর চিত্র । দেশভাগে পূর্ব ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালির কথা বলা হলেও উদ্বাস্তু বিহারির কথা বলা হয় না। যে ক্ষত আজও শুকায়নি, বিহারী মুসলমানদের মাঝে যুগ যুগ ধরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেই বর্বর গণহত্যার চিত্র দিনরাত । দেশভাগের জন্য উগ্র সাম্প্রদায়ীক হিন্দু সন্ত্রাসীরা কিভাবে মুসলমানদের উপরে গণহত্যা আর লুটপাট চালায় এই বই একটি প্রমাণ্য চিত্র সেই ভয়ংকর দাঙ্গার ঘটনার ।

ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে স্বাধীনতা তত নয়, স্বাধীনতার সঙ্গে জড়ানো দেশভাগটা যত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। যেন সমস্ত ইংরেজ আমল ধরে নানা জটিলতার গ্রন্থিবন্ধনের মধ্য দিয়ে চলছিল দেশভাগের প্রস্তুতি, আর ১৯৪৭ সালের পর থেকে যা-কিছু এই বিশাল ভূখণ্ডে ঘটছে, সবই ওই দেশভাগের পরিণাম। শ্রীনগরের পথে বিস্ফোরণ হয়ে দাঙ্গা বাধে, অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক শাণিত হয়, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়, ছিটমহল বিনিময় নিয়ে অফুরন্ত আলোচনা চলতেই থাকে, এখনও যে সমস্যা সমাধান হয়নি দেশভাগের ৬৮ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে । তখন ১৯৪৭-এ ঘটে যাওয়া দেশভাগ আর অতীত থাকে না, একেবারে ঘটমান বর্তমান হয়ে ওঠে আজও দাঙ্গা আর দেশভাগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে।

কলকাতা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংবাদপত্র নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক হত্যাকান্ডকে এত ফলাও করে এবং ঘটনারসাথে কাল্পনিক গল্প জুরে দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করে যে এর ফলে বিহারের পাটনায়  হিন্দুদের দ্বারা ব্যাপক মুসলমানহত্যাকান্ডকে উস্কে দেয়। সোহরাওয়ার্দী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেন: ‘অমৃত বাজার পত্রিকা এবং কংগ্রেসের অন্যান্য পত্রিকাগুলো বঙ্গীয়প্রাদেশিক পরিষদের সম্পাদকের নামে অকস্মাত একটি বিবৃতি ছাপে যে, ৫০,০০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে এবং অগণিতনারীকে অপহরণ করা হয়েছে। এ খবরে উত্তেজিত হয়ে, যুক্ত প্রদেশের গারমুখতেশ্বারে হিন্দুরা মুসলিমদের লাঞ্ছিত করে এবংগণহত্যা চালায় এবং বিহার প্রদেশের সর্বত্র ১০০,০০০ মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে অবিশ্বাস্য বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করাহয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। চারদিন ধরে বিহারের পল্লী অঞ্চলে হিন্দু দাঙ্গাকারীরা হত্যা, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ, মানুষেরঅঙ্গহানি করার মাধ্যমে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল এবং স্পষ্টতই বেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এর পেছনে বিহার সরকার ও হিন্দুপুলিশ সদস্যদের মদদ ছিল’ [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার (সংকলন), মেমেয়ারস অব হোসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উইথ অ্যা ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্ক’, ইউনিভাসির্টি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১০৫]।

শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গান্ধী দিল্লী থেকে নোয়াখালীর উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করেছেন। কলকাতায় পৌঁছার পর তাঁকে বিহারের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত করে একদল মুসলিম যুবক আগে সেখানে পরিদর্শন করার আহবান জানায়। গান্ধী তাঁদের আহবান প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, ‘তিনি যখন দিল্লী থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, তখন বিহারে কোন দাঙ্গা ছিল না, সুতরাং মাঝপথে এসে তিনি পূর্বে মনঃস্থির করা গন্তব্য পরিবর্তন করতে পারবেন না’।

কামরুদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে লিখেন যে, বিহার
যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মুসলিম যুবকরা মনে করেছিল গান্ধী বিশ্বের দৃষ্টি বিহারের হত্যাযজ্ঞ থেকে সরিয়ে নোয়াখালীরদিকে নিতে চাচ্ছেন। ফলে তাঁরা পরোক্ষভাবে গান্ধীকে কপটতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। গান্ধী তাঁদের এই অভিযোগের উত্তরে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ‘ইতিহাস ওই যুবকদের নয়, বরং আমার পদক্ষেপকেই মূল্যায়ন করবে’। ১৯৪৬ সালের ১৪ নভেম্বর গান্ধী তাঁর সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই, নাতনী মুন্নি গান্ধী, এবং পালিত নাতনী আভা গান্ধীকে নিয়ে নোয়াখালীর দত্তপাড়ায় পৌঁছান। সেখানে তিনি ‘বাংলার প্রাদেশিক সরকারের অতিথি’ হিসেবে অবস্থান করেন।

আবুল হাশিম লিখেছেন, গান্ধী গ্রামে গ্রামে ঘুরে হিন্দুদের মনোবল পুনরুজ্জিবীত করেছিলেন। গান্ধী বিহার এবং পাটনা পরিদর্শন না করায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন। এই বিষয়ে তিনি নিদারুণ দুঃখের সাথে লিখেছেন: ‘গান্ধীজী নোয়াখালী পরিদর্শন করায় নোয়াখালীও কুমিল্লা জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলিমদের নৃশংসতার উপর বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। অপর দিকে, কলকাতা ওবিহারের দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি নৃশংসতার শিকার হয়েছিল মুসলিমরা। কিন্তু গান্ধী কলকাতা ও পাটনায় গেলেন না’ ’[আবুল হাশিম, ইন রেট্রোস্পেক্ট, বাংলাদেশ বুক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৫৬]।

পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জিও লিখেছেন, ‘কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক শাখাগুলোর মদদে পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ সালে বাঙলা ভাগ করে ভারতের অধীনে আলাদা একটি হিন্দু প্রদেশ সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায় [জয়া চ্যাটার্জি, ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কম্যুনালিজম এন্ড পার্টিশন: ১৯৩২-১৯৪৫’, ক্যামব্রিজ ইউনিভাসির্টি প্রেস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ২২৭]।

বিশেষ করে মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীরা যারা কলকাতা এবং পাটনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দুদের ক্ষোভ থেকে মুসলমানদের রক্ষায় বহু চেষ্টা করে গেছেন, তারা গান্ধীর উপর ক্ষুব্ধ হন। কারণ, দাঙ্গার সময় ওই দুই শহরে যেতে গান্ধী উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন। এমন ক্ষুব্ধ তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি পরবর্তীতে পূর্ব বাঙলা, এবং বর্তমানের বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করার মাধ্যমে এই ভূখন্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদে পরিণত হন।

যদিও ইতিহাসে দেখা যায়, গান্ধী সোহরাওয়ার্দীর সক্রিয় সমর্থনে দাঙ্গা পরবর্তী কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনে বেশ কিছু সফল চেষ্টা চালিয়েছেন। সেসময় এক ঈদের দিনে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু মিলে নাঙ্গলডাঙ্গায় অবস্থান করা গান্ধীকে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ একটি উপহার দিয়েছিলেন। উপহারটি ছিল একটি প্যাকেটে মোড়া অবস্থায় কলকাতা এবং পাটনায় হিন্দুদের নৃশংসতার শিকার কিছু মুসলমানের ছবি। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, সেসব ছবির মধ্যে কোনোটি ছিল স্তন কেটে দেয়া মুসলমান নারীর, মস্তক বিচ্ছিন্ন শিশুর, জ্বলন্ত মসজিদের, আবার কোনোটিতে দেখা যাচ্ছিল রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ। এরকম আরো অনেক নৃশংসতার দৃশ্য ছিল।’ গান্ধীকে এ ধরনের উপহার’ দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে শেখ তার স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন, আমরা মহাত্মাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, তার সম্প্রদায়ের লোকজন কী ধরনের অপরাধ করেছে এবং কিভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে  [শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (অনুবাদ), ড. ফখরুল আলম, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৬]

এবার মূল আলোচনায় আসি, এখনও বহু মানুষের সত্তার মধ্যে উপস্থিত, তিন দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে নিত্য উপস্থিত এই দেশভাগের প্রচণ্ড অভিঘাত নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে। যত হওয়া উচিত ছিল, তত হয়নি, যে স্তরের হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্র, তেমনই বেসরকারি সমাজ, তেমনই সাহিত্য পরিকল্পিত নীরবতা পালন করেছে। পূর্ববাংলা থেকে হিন্দু বাঙালির উৎখাত হওয়া নিয়ে বাংলায় বেশ কিছু কথাসাহিত্য, নাটক লেখা হয়েছে, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পশ্চিম বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বাঙালি মুসলমানের পূর্ব পাকিস্তানে বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়া নিয়ে সাহিত্য তুলনায় কম লেখা হয়েছে। কলকাতা থেকে যে হাজার বাঙালি মুসলমান ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়ে উদ্বাস্ত হয়ে এসেছে ভিটে মাটি পৈত্রিক সম্পত্তি ছেড়ে এসে তা নিয়ে আমাদের তথাকথিত প্রগতীশীল বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকগণ তেমন কিছুই লিখেননি আর বিহারের মুসলমানদের উদ্বাস্তে ঘটনা তো পরের বিষয়!?

কিন্তু, পূর্ব ভারতবর্ষে আরও এক দল মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছিল, ১৯৪৬-’৪৭ সালে এবং তার পরে, বিহারি মুসলমানরা যে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, তাদের কথা অনুক্ত থেকে গেছে, যেমন ইতিহাসে, তেমনই সাহিত্যে। কী ভাবে তারা উৎখাত হল, কী হল তাদের উত্তরকালীন নিয়তি, তার উত্তর খোঁজেনি বাংলা বা হিন্দি সাহিত্য। এই মানুষগুলির ভাষা ছিল উর্দু, কিন্তু পশ্চিমের দেশভাগ নিয়ে উর্দু সাহিত্য মুখর হলেও, পূর্বের দেশভাগ নিয়ে নীরব রয়েছে বরাবরই । এদের নিয়ে একটি মাত্র উপন্যাস আমার নজরে এসেছে, আবদুস সামাদ-এর ‘দো গজ জমিন’। যার সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত বাংলা তর্জমার নাম ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’।

১৯৪৬ সালের অগস্টে মুসলিম লীগের ডাকা প্রতিবাদ দিবস পালনের সময় কলকাতার হিন্দুরা শুরু করে বর্বর গণহত্যার । কলকাতার প্রত্যাঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্যোগে এবং প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালিতে শুরু হয় হিন্দুবিরোধী দাঙ্গা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব আমরা বারে বারে পাব। শুধু সম্প্রতি কালের গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তত্ত্বের মুখোমুখি হই না আমরা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব চলে আসছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে। এইসবে মূলে ছিল উগ্র হিন্দুদের দেশভাগের পরিকল্পনা আর যেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতা ও বিহারে মুসলমানদের উপরে চালানো হয় বর্বর ভয়াবহ গণহত্যা আর লুট করা হয় মুসলমানদের জমিজমা ও সম্পত্তি। আর তাড়িয়ে পাঠানো হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দিক বিহারী মুসলমানদেরকে !?

কিন্তু, ক্রিয়াও যেমন নিজে নিজে ঘটে না, তাকে ঘটানো হয়, প্রতিক্রিয়াও তেমনই। বানানো ক্রিয়াকে অজুহাত করে সজ্ঞানে প্রতিক্রিয়া ঘটানো হয়। তার পরে সব পক্ষই মুখ মুছে বলতে চায়, যা ঘটেছে প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটে গেছে। এই ভাবে কলকাতার প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালিতে দাঙ্গা বাধে। সেখানে হিন্দুর মনে আস্থা জাগাতে, মুসলমানদের মনে শুভবুদ্ধি জাগাতে হাজির হন খালি-পায়ের তীর্থযাত্রী, যাঁকে মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন One-man Boundary Force. নোয়াখালি যাত্রার আগে থেকেই গাঁধীজির কাছে খবর আসতে থাকে বিহারে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। সেখানে ভূমিকা বদলে গেছে, বিহারে আক্রমণকারী হিন্দু আর আক্রান্ত মুসলমান। এখানে রক্তপাত হচ্ছে মুসলমানের, পূর্ব পুরুষের ভিটে থেকে উৎখাত হচ্ছে মুসলমান। বিহারের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও মন্ত্রী ডা. সৈয়দ মাহমুদের লেখা বিবরণ থেকে মুসলমানদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের বৃত্তান্ত পড়ে গাঁধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। মনে হয়, ‘happenings of Noakhali seemed to pale into insignificance.’ মাহমুদ অনুরোধ করেন গাঁধীজি নোয়াখালি ছেড়ে এবার বিহারে চলে আসুন ও বিহারি মুসলমানদের বাঁচান।

খিলাফত আন্দোলনের সময় বিহারে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ভাল ছিল। পরে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়। ডা. সৈয়দ মাহমুদ, অধ্যাপক আবদুল বারির মতো নেতা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস ক্রমে হয়ে উঠছিল হিন্দুর পার্টি আর লিগ হচ্ছিল মুসলমানের পার্টি। শুকনো বারুদ যখন স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায়, তখনই কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গার খবর এসে পৌঁছয় বিহারের শহরে ও গ্রামে। বিহারের বহু মানুষ কলকাতায় কর্মরত ছিল, তারা কলকাতার দাঙ্গায় স্বজন ও সম্পত্তি হারায়। সেখানকার দাঙ্গার কাহিনি ‘gruesome, sometimes exaggerated’ হয়ে বিহারে ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করে। হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানায়। সংবাদপত্রগুলি দায়িত্বহীন ভাবে উত্তেজনা বাড়ায়। ১৯৪৬ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতা এবং পূর্ব বঙ্গের ঘটনার বিরুদ্ধে বিহারে প্রতিবাদ-সভার আয়োজন করা হয়।

কংগ্রেসের উদ্যোগে বিরাট বিরাট আক্রমণাত্মক মিছিল বেরোয়। বিহারে অন্ধকার দেওয়ালি পালন করা হয়; মসজিদে মসজিদে বলা হয়, ওদের শোক, আমাদের উৎসব। দাঙ্গা লেগে যায়, আর হাজার হাজার মুসলমান ধর্মের মানুষের মৃত্যু হয়। ডা. মাহমুদের বিবরণ থেকে জানা যায় হত্যাকাণ্ডে নির্যাতনে উৎখাত হয়ে সাড়ে তিন লক্ষ মুসলমান বাড়ি জমি গহনা নগণ্য দামে বেচে বিহার ছেড়েছে। তিনি নিজে একটি গ্রামে মৃত মানুষে ভরাট পাঁচটি কুয়ো দেখেন, অন্য গ্রামে এমন দশ-বারোটি কুয়ো। অনেক সময় আক্রান্ত মানুষেরা ‘with the courage of despair’ সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, সম্ভ্রমরক্ষায় মেয়েদের হত্যা করেছিল, কিন্তু দাঙ্গাবাজদের জোয়ার তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিল না তা নয়, তারা কিছু মানুষকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু দাঙ্গা প্রতিরোধের ক্ষমতা তাদের ছিল না। বহু কংগ্রেস নেতা, কংগ্রেসের ঘোষিত নীতির কথা ভুলে এই দাঙ্গায় অংশ নেয়। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেন, দুঃখজনক হলেও বিহারের দাঙ্গা বাংলার দাঙ্গাপীড়িত হিন্দুদের বাঁচিয়েছে। বিহারের দাঙ্গার পক্ষে কংগ্রেস নেতারা দিয়েছিলেন সেই প্রতিক্রিয়ার যুক্তি। কিন্তু, গাঁধীজি বা জওহরলাল এই প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব মানতে রাজি ছিলেন না।

এই দাঙ্গায় বিহারে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের অস্তিত্বের ভিত নড়ে যায়। তারা চলে আসে গ্রাম থেকে শহরে। আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে। পরে শুরু হয় দলে দলে বিহার-ত্যাগ। ছিন্নমূলদের মুসলিম লিগ উৎসাহ দেয় বাংলায় চলে যেতে, কেননা মুসলমান-শাসনাধীন বাংলাই হল তাদের পক্ষে ‘land of promise’. দেশভাগের পর পশ্চিম থেকে গণপ্রব্রজনের মাধ্যমে যারা পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, তাদের একটা বড় অংশ ছিল অবাঙালি উর্দুভাষী মুসলমান, বিহারি মুসলমান।

বিহারশরিফ থেকে কিছু দূরে বিন গ্রাম। সেই গ্রামের শেখ হলতাফ হোসেনের উত্তরপুরুষের কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছে আবদুস সামাদের ‘দো গজ জমিন’ আখ্যান। শেখ সাহেব খিলাফত ও পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর ঘরে যিনি বধূ হয়ে এসেছিলেন সেই বিবি সাহেবা ছিলেন খাঁটি সৈয়দ বংশের সন্তান। তাঁর উপস্থিতিতে সংসার শ্রীমন্ত হয়ে ওঠে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দিকে নজর দেওয়া হয়। চিকিৎসা ও লেখাপড়ার কথা ভেবে তাঁর সুপরামর্শে নিকটবর্তী বিহারশরিফে এক হাবেলি নির্মাণ করা হয়। বিন হাউস নামের এই হাবেলি হয়ে ওঠে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্র। নিজের সুশিক্ষিত বড় ছেলে সরোয়ারের সঙ্গে শেখ সাহেব বিয়ে দেন নিজের অনাথ ভাইঝির, আর ভাগনে আখতার হোসেনের সঙ্গে বিয়ে দেন নিজের বড় মেয়ের।

এই ভাগনে এবং জামাই আখতার হোসেন ছিলেন শেখ সাহেবের মতোই স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক। শেখ সাহেবের অকালমৃত্যুর পর তিনিই এই সংসারের হাল ধরেন বিবি সাহেবার অনুরোধে। এ দিকে, শেখ সাহেবের সম্মতির অপেক্ষা না করে মেজো ছেলে আসগার হোসেনের বিয়ে দিয়ে দেন শেখসাহেবেরই মামা তাঁর পিতৃমাতৃহীন নাতনির সঙ্গে। এই মামা ছিলেন ইংরেজ-অনুগত। বাড়িতে লাটসাহেব এলে মাইলের পর মাইল লাল কার্পেট বিছিয়ে দিতেন। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে খানবাহাদুর পদবি পান তিনি। বিহারে যখন কংগ্রেসের মুসলমান নেতাদের প্রতিপত্তি মুসলমান এলাকায় দ্রুত কমতে থাকল এবং বাড়তে থাকল মুসলিম লিগের প্রভাব, তখন ইংরেজপ্রেমী দাদা শ্বশুরের প্রভাবে আসগার হোসেন হয়ে উঠলেন লিগের সমর্থক ও পরে আঞ্চলিক নেতা। তিনি বিন হাউসে এলে বাড়ি লিগ ও পাকিস্তানের জয়ধ্বনিতে, কংগ্রেসের ও গাঁধীজির মুর্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত হয়। খদ্দরের পোশাক পরা কংগ্রেস নেতা আখতার হোসেন সেই বাড়িতে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে থাকেন।

দুই আত্মীয়ের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় ছাড়া কোনও যোগ নেই। সর্বংসহা বিবিসাহেবা যেন ভারতবর্ষের প্রতীক, আর বিন হাউসের মানুষদের সম্পর্কের ভাঙনের মধ্যে যেন ভারত-ভাগের পূর্বাভাস। আখতার হোসেনের আদর্শে জমিদারির সমস্ত এলাকা স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্পিত ছিল। কিন্তু ভোট আসতেই পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে গেল। নির্বাচনে জয়ী হল লিগ। কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে, দ্বিতীয় স্থান পেল হিন্দু মহাসভা। আখতার হোসেন অন্তর্মুখী হয়ে গেলেন।

পঞ্জাবের ও বাংলার দাঙ্গার খবর বিহারে ছড়িয়ে পড়ছিল। লিগ মুসলমানদের মনে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছে। বলেছে, মুসলমানেরা শাসকের জাতি, তারা কোনও দিন হিন্দুর গোলামি করবে না। হিন্দুদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব তীব্র হচ্ছিল। দাঙ্গা লাগতে পারে, এই আশঙ্কায় আখতার হোসেন গাঁধীজির অনুগামীদের সঙ্গে, প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। জনসভায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শপথ নেওয়ানো হল, কিন্তু দাঙ্গা থামানো গেল না। বাস্তুচ্যুত মানুষ বিহারশরিফে আসতে লাগল, স্টেশন, মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা উদ্বাস্তুতে ভরে গেল। উদভ্রান্ত আখতার সেবার কাজে, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি ফেরানোর কাজে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। অজাতশত্রু কংগ্রেস নেতা অধ্যাপক আইয়ুব আনসারি খুন হয়ে গেলেন। আখতার হোসেন পরিদর্শনে বেরিয়ে দেখলেন পাড়ার পর পাড়া উজাড়। ‘জনশূন্য এলাকা তার স্তব্ধতার ভাষা দিয়ে নিশ্চিহ্ন হবার কথা জানাচ্ছিল।’ জখমের চিকিৎসা নেই, এখানে ওখানে লাশ। আক্রান্ত পুরুষেরা একত্র হয়ে মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েছিল। আর, পঞ্জাবের কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া থোয়াখালসা-র শিখ রমণীদের মতো বিহারের মুসলমান মেয়েরাও কুয়োয় গণঝাঁপ দিয়ে সম্মান বাঁচিয়েছিল।

বিবিসাহেবার বাড়িতে এক ডিমওয়ালি ডিম দিয়ে যেত। নিজের মুরগিগুলি বাঁচাতে গিয়ে সেই ডিমওয়ালি ফুপু কুঁড়েঘর ছেড়ে বেরোতে পারেনি। মুরগিসহ সে পুড়ে মরেছে। বিবিসাহেবা শোকাতুরা। নিরাপত্তার খোঁজে উদ্বাস্তুরা পথে বেরিয়েছে। গাঁধীজির ও কংগ্রেসের তাদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ বিফলে গেল। লিগ স্বজনহারাদের বোঝাল, তাদের আত্মত্যাগে পাকিস্তান ত্বরান্বিত হবে। তারা ইন্শা আল্লা নতুন দেশের, স্বপ্নের দেশের নাগরিক হয়ে যাবে। গাঁধীজি বলেছিলেন দেশভাগ হতে দেবেন না কিন্তু তিনিই ছিলেন দেশভাগের অন্যতম নায়ক। লিগ বলেছিল পাকিস্তান
না হলে আর মুসলমানদের রক্ষা করা যাবে না। কারণ হিন্দুরা প্রস্তাব দিল মমুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে!? জিন্নাহ একরকম বাধ্য হয়েই মুসলমানদেরকে হিন্দু সাম্প্রদায়ীক সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেশ ভাগের দিকেই এগিয়ে গেলেন । দেশভাগ হলই। আসগার হোসেন উল্লসিত আর আখতার হোসেনের মতো কংগ্রেসি মুসলমান, চূড়ান্ত হতাশ আর পর্যুদস্ত।

পাকিস্তান হতেই আসগার হোসেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। যাওয়ার আগে আখতারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আখতার তাঁকে শুভেচ্ছা জানান, আর ‘তাঁর চোখের সামনে শুধু আসগার হোসেন ছিলেন না, অগণিত মুসলমান ভেসে উঠছিল যারা জায়গাজমি সম্পত্তি নানান জিনিসপত্র বিক্রি করে পাকিস্তান চলে যাচ্ছে।’ স্থির হল বড় সরোয়ার হোসেন পরে পাকিস্তান যাবে মেজো ভাই আসগার গুছিয়ে বসার পর। আপাতত ভারতবর্ষ দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়, আর বিবিসাহেবার সংসার ভেঙে যায়। অবস্থাপন্নরাও সবাই চলে গেল না, অনেকেই থেকে গেল, যারা দেশভাগের আগে লিগের সমর্থক ছিল। শুধু তাদের নয়, মুসলমান মাত্রকেই শুনতে হচ্ছে তারা পাকিস্তানের চর, বিশ্বাসঘাতক। তারা পাকিস্তান চেয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর এ দেশে থেকে যাচ্ছে কেন? ভয়ের ব্যাধি তাদের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছিল।

যারা থেকে গিয়েছিল, তারাও জীবিকার ক্ষেত্রে নাজেহাল হয়ে পাকিস্তানে চলে যাবার কথা ভাবত। কিন্তু, পাসপোর্ট-ভিসা প্রবর্তনের পর বৈধ ভাবে পাকিস্তানে যাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। বরং ‘ঘাড়ধাক্কা পাসপোর্টে’ পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়া ছিল সহজ। সেখানে চাকরিও সুলভ। অলস বাঙালিদের চেয়ে নিয়োগকর্তারা পরিশ্রমী বিহারিদের পছন্দ করত। ও দিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে সরোয়ার ভাল নেই। কিন্তু, বিবিসাহেবাকে তিনি জানান, অন্য দেশের নাগরিক বলে তিনি আর ভারতে স্থায়ী ভাবে চলে আসতে পারবেন না। তার বাড়ি এখানে, এখানে পূর্বপুরুষের কবর, সে কেন চলে আসতে পারবে না— বিবিসাহেবার মাথায় ঢোকে না। তাঁর স্বামী শেখসাহেব বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো পাকিস্তান হতে দিতেন, কিন্তু তাকে বিদেশ হতে দিতেন না।

এই আখ্যানের প্রথম অংশের নায়ক যদি আখতার হোসেন, তা হলে দ্বিতীয় অংশ তাঁর পুত্র হামিদকে কেন্দ্র করে লেখা। বাবা আজ উপমন্ত্রী, কিন্তু তিনি সুপারিশ করতে রাজি না হওয়ায় বি এ পাস করেও হামিদের চাকরি হয় না। অভিমানে জানায়, পাকিস্তানে চলে যাবে সে। বিবিসাহেবা সন্ত্রস্ত, ‘আল্লার নামে পাকিস্তান শব্দটা মুখে আনবে না। আরে ভাই, তুমি জানো না, পাকিস্তানে আমি কত কিছু খুইয়েছি।’ বাড়ির দাসীর ছেলে চামু, কলকাতাবাসী হয়ে দারুণ করিতকর্মা হয়েছে। সে ‘ঘাড়ধাক্কা পাসপোর্টে’ হামিদকে পাঠিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানে। বিবিসাহেবার সংসার ভেঙে উপমহাদেশের তিন ভাগে ছড়িয়ে পড়ে। চামুর বড় সম্বন্ধী বদরুল ইসলাম তাকে চাকরি জুটিয়ে দেয়, তার মেয়ে নাজিয়ার সঙ্গে বিয়েও হয় হামিদের পরে। এখানে চলে আসা বিহারিরা মনে করে বাঙালি মুসলমানেরা নামেই মুসলমান, তাদের আচার-আচরণ হিন্দুদের মতো। মেরে মেরে এদের ইসলামি আচরণ শেখানো উচিত। এরা রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে ঘৃণা করে। পারলে, এই নামে-মুসলমানেরা কোরানশরিফও বাংলায় পড়বে। বাঙালি বাড়ির জামাই হামিদ বাঙালিদের সমর্থনের বৃথা চেষ্টা করে।

কিছু দিন পরে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন উত্তেজনা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হলেও এত দিন ক্ষমতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। এ বারের নির্বাচনে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিল। বিহারিরা বাঙালিদের আপন মনে করেনি। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী পুব বাংলায় নির্যাতন ও হত্যা শুরু করলে সেনাদের সাহায্য করে অনেক বিহারি। ‘স্থায়ী বাসিন্দা আর শরণার্থীদের মধ্যে বিভেদ ভয়ানক সত্যের চেহারায় বেরিয়ে পড়ল।’ সৈন্যরা বাঙালিদের উপর যেমন গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনই পাকিস্তান-সমর্থক বিহারিদের উপর শুরু হল মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ। যেমন পাক সেনা, তেমনই মুক্তিবাহিনী অপরাধী-নিরপরাধ নির্বিচারে মানুষের রক্তে হোলি খেলছে।

মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েও চামুমামার দক্ষতায় হামিদ সপরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসতে পারে। বিহারি শরণার্থীদের জন্য ভারতবর্ষে কারও মনে স্নিগ্ধ ভাব নেই, তাদের সবাইকে মনে করা হয় পাকিস্তানের চর। হামিদ বিহারশরিফে এলে দাদিমা বিবিসাহেবা হারানো নাতিকে আলিঙ্গন করেন এবং জানতে চান মামাকে সে সঙ্গে আনেনি কেন। হামিদ জানায়, মামা থাকেন শ্চিম পাকিস্তানে, আর সে এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। বিবিসাহেবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কতগুলো পাকিস্তান হয়েছে?’ তিনি পাকিস্তানকে গালি দেন, সে তাঁর ছেলেদের হরণ করেছে। পর মুহূর্তেই তিনি পাকিস্তানকে আশীর্বাদ করেন, সেখানেই তাঁর বড় ছেলে সরোয়ার মাটি নিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বিবিসাহেবার অবস্থা পাগলের মতো, কখনও ভারতের জয় চান, কখনও পাকিস্তানের। বিবিসাহেবার মেয়ে, হামিদের মা’র মৃত্যু হয়। মেয়ের মৃত্যুর খবর তাঁকে না জানানো হলেও বিবিসাহেবা তার অনুপস্থিতি টের পেয়ে যান। তিনি জানতে চান, ‘তাকে পাকিস্তান নিয়ে চলে যায়নি তো?’ তিনি হাতজোড় করে পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেন, ‘রে পাকিস্তান, এখন আমার পেছন ছাড়, আমি তোর কোনো ক্ষতি করিনি, কোন অপরাধে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস, পাকিস্তান, ও পাকিস্তান।’

হামিদের বউ বাঙালি জানলে গোলমাল হতে পারে, তা ছাড়া তারা এখন পাকিস্তানের নাগরিক। এখানে অবৈধ তাদের অবস্থান। হামিদের ছোট ভাই সাজিদ সরকারের বড় চাকুরে। হামিদের সংস্রবে তার অস্বস্তি হতে পারে। অঘটনঘটনপটীয়সন চামুর দৌলতে হামিদ সপরিবার নেপাল হয়ে উড়োজাহাজে অবশিষ্ট-পাকিস্তানে চলে যেতে পারে। হামিদ চলে যেতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে থেকে যায় বহু বহু বিহারি। পাকিস্তান পরে অনুগ্রহ করে তাদের কিছু সংখ্যককে নিতে রাজি হয়। কিন্তু, হাজার হাজার বিহারি ক্যাম্পে এক পুরুষ ধরে থেকে যায়, আন্তর্জাতিক কৃপার উপর নির্ভর করে। তারা সবাই তো গণহত্যায় অংশ নেয়নি, বহু মানুষ নিরপরাধ ছিল।

এদের কথা আবদুস সামাদের উপন্যাসে আসেনি। এই forgotten minority-র কথা কথাসাহিত্যেও এল না! হামিদ করাচিতে এসে আশ্রয় নেয় মামা আসগার হোসেনের কাছে। হামিদের স্ত্রী বাঙালি জেনে মামা খুবই বিরক্ত। মৃত সরোয়ারের পরিবারের সঙ্গে আসগারের পরিবারের কোনও যোগ নেই। ‘দেশটা ভাগ হতে-হতে তিন টুকরো হয়ে গেল। তাতে আমাদের পরিবার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ এখানেও আগন্তুকদের সঙ্গে স্থায়ী বাসিন্দাদের সম্পর্ক ভাল নয়। যে-কোনও সময় মোহাজিরদের সঙ্গে সিন্ধিদের দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। হামিদ চলে যায় আরবে। এই উপমহাদেশ আদম রফতানি করেই চলেছে; হামিদ সেই অজস্র মানুষের এক জন, যারা বিদেশে উপমহাদেশের ডায়াস্পোরা গড়ে চলেছে, স্বেচ্ছায় বা বাধ্যত। ‘হে সময়, কোথাও তো থামবে।’ সময় থামে না, কিন্তু একটা সময়খণ্ডকে নিয়ে লেখা উপন্যাসকে এক সময় থামিয়ে দিতেই হয়।

‘মানুষ মেরেছি আমি’ অথবা দাঙ্গার দিনে নরহত্যাকালে প্রতিরোধ করিনি, তাই হত মানুষের রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে। মুসলমান যখন হত্যা করেছে হিন্দুকে, হিন্দু যখন হত্যা করেছে মুসলমানকে, শিখ যখন হত্যা করেছে মুসলমানকে, হিন্দু বা মুসলমান যখন হত্যা করেছে শিখকে, সিন্ধি যখন হত্যা করেছে বিহারি মোহাজিরকে, বাংলাদেশে পঞ্জাবি আর বিহারি যখন হত্যা করেছে বাঙালিকে, আবার বাংলাদেশে বাঙাল যখন হত্যা করেছে বিহারিকে, তখন প্রত্যেক ক্ষেত্রে ‘মানুষ মেরেছি আমি’। পৃথিবীর পথে পথে নিহত ভ্রাতাদের ভাই আমি। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অনর্গল শৃঙ্খলে, এই পাপচক্রে আমিই হত, আমিই হন্তা।

সেই পাপের কোন কথা সাহিত্য বলবে, আর কোন কথা বলা থেকে বিরত থাকবে, তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে গূঢ় রাজনীতি। তাই দেশভাগে পূর্ব ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালিদের কথা কিছু বলা হয়, কিন্তু উদ্বাস্তু বিহারিদের কথা বলা হয় না।

Tuesday 19 April 2016

মুক্তমনার নামে ব্লগারদের লেখাকে পর্ন ও যৌনতায় ভরপুর বললেন হাসিনা ।


হাসিনার ঘোষিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ থাবা বাবা এখন পর্ন ব্লগার !?

সূফি বরষণ

মুক্তমনার নামে ব্লগারদের লেখা পর্ণ ও যৌনতায় ভরপুর সেই কথাই বললেন হাসিনা আর ব্লগারদের এইসব অশ্লীল কুচিন্তা এসেছে হিন্দুদের নানান ধর্ম গ্রন্হাদি ও দেবদেবীর নানান উপাখ্যান থেকে । পৃথিবীতে একটি মাত্র দর্শন আছে যেটা অশ্লীল যৌনতা ও পর্ন নোংরা লেখায় পরিপূর্ণ সেই দর্শনের নাম ব্রাহ্মণ্য দর্শন বা আর্য দর্শন বা সনাতন ধর্ম বা বর্তমান হিন্দু ধর্ম । এই ধর্মের অশ্লীল যৌন কাহিনী থেকেই ব্লগারদের নোংরা সাম্প্রদায়ীক কুত্সিত অরুচি অশুভ অশোভন লেখার সূত্রপাত ঘটে।

হিন্দুধর্ম ভয়াবহ সব অসংখ্য ভয়ংকর রীতি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের বিশাল সংকলন। কালের বিবর্তনে ধর্মীয় বর্বরতার সামান্য কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও গোঁড়ামি আর অশ্লীলতা হিন্দুদের মাঝে এখনও যথেষ্ট পরিমাণেই বিদ্যমান। তাই ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার জন্য অসংখ্য হিন্দু তরুণ তরুণী মুসলিম নামে ব্লগে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইক আইডি খুলে অপপ্রচার চালাচ্ছে দিনরাত । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নবযুগ ব্লগ , ইশ্টিশন ব্লগ , অচল সিকি ব্লগ , , ধর্মকারী ব্লগ , আমার ব্লগ , বাঙালী হিন্দু বার্তা , আমি হিন্দু , সনাতন ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইত্যাদি ।

ইসলাম ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় ব্লগে লেখালেখি ব্যাপারে অবশেষে মুখ খুলেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন “কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা এটা কক্ষনো গ্রহনযোগ্য না। এখন একটা ফেশন দাঁড়িয়ে গেছে যে ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তারা হয়ে গেল মুক্তচিন্তা। আমি তো এখানে মুক্তচিন্তা দেখি না। আমি এখানে দেখি নোংরামি। আমি এখানে দেখি পর্ণ। পর্ণ লেখা লেখে। এত নোংরা নোংরা কথা কেন লিখবে?” পহেলা বৈশাখ গণভবনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে ধর্মবিদ্বেষী ব্লগারদের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন তিনি। এ ইস্যুতে গত প্রায় একবছর ধরেই প্রধানমন্ত্রী তার অবস্থান বদলে সুসংহত করতে চাইছেন। যদিও এবারই প্রথম তিনি সরাসরি ‘মুক্তচিন্তা’ শব্দ ও ভাবটাকে সরাসরি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন। তার সেই বক্তব্যের কথাগুলো অবিকল বা পুরোপুরি প্রকাশ করেনি বেশিরভাগ পত্রিকা/টেলিভিশন। যে যার মতো সুবিধাজনক অংশ প্রচার বা প্রকাশ করেছে।

বক্তব্যে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ অংশ “যাকে আমি নবী মানি তার সম্পর্কে নোংরা কথা কেউ যদি লেখে তো সেটা কক্ষনো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। ঠিক তেমনি অন্য ধর্মেরও যারা তাদের সম্পর্কেও কেউ কিছু যদি লেখে তাহলে এটা কক্ষনো গ্রহণযোগ হবে না।”

শেখ হাসিনা একজন ধার্মিক মানুষ। তাকে ধর্মীয় দিক থেকে একজন লিবারেল মানসিকতা পোষণকারী ব্যক্তি হিসেবেই অনুমান করি। এখন একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রধানমন্ত্রী যেসব লেখালেখিকে ‘পর্ণ’ ‘নোংরা’ ‘বিকৃত মানসিকতা’র বলছেন সেগুলো কি আসলেই এমন? লেখাগুলোকে এসব অভিধায় অভিহিত করা কি আসলেই সঠিক বা উপযুক্ত? প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় সেগুলো পর্ণ বা নোংরা লেখা- ঐ বক্তব্যের যৌক্তিকতা বুঝতে ওইসব লেখালেখিকে সামনে এনে যাচাই করাটাই উত্তম উপায় হতে পারত। কিন্তু নোংরা আবর্জনা নিয়ে ঘাটাঘাটিও খুব ভাল কাজ নয়।

নোংরা ব্লগ লেখার জন্য সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিদের একজন হচ্ছেন ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়া রাজীব হায়দার শোভন। তিনি ব্লগে ‘থাবা বাবা’ নামে পরিচিত ছিলেন। এটা সর্বজন স্বীকৃত তথ্য। অনেকের কাছে এ সংক্রান্ত ক্রীনশট-ভিডিও ইত্যাদি ডকুমেন্ট সংরক্ষিত আছে। তার নোংরা ভাষার ইসলামবিদ্বেষী কিছু লেখা নিয়ে খুনের পরপরই প্রথম দিন ইনকিলাবে এবং পরের দিন দৈনিক আমার দেশ-এ বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেসব রেকর্ড আছে। অবশ্য ব্লগে ও ফেইসবুকে সর্বাধিক সমালোচিত লেখাগুলোর ‘লিংক’ এখনো বিদ্যমান থাকলেও সেগুলো আর কার্যকর না। ব্লগ/ফেসবুক বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ থেকে সেগুলোতে প্রবেশ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

তবে বিভিন্ন ব্লগে অন্যদের পোস্টে করা ‘থাবা বাবা’র নানা মন্তব্য এখনো পড়া যায়। সামহোয়ারইন ব্লগের “বাঙালি মুসলমানের মন” শিরোনামে এই লিংকের পোস্টটিতে (http://www.somewhereinblog.net/blog/omio_ujjal/29488000 ) ২০১১ সালের ২২ শে নভেম্বর দুপুর ১টা ৯ মিনিটে একটি মন্তব্য করেন থাবা বাবা।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ এর ইনকিলাব এবং পরদিনের  আমার দেশ পত্রিকার কপিগুলোও দেখা যেতে পারে। আগ্রহীরা স্বচক্ষে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ওই লেখাগুলোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহৃত অভিধাগুলো সঠিক কিনা।

আরেকটা কথা, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু নিজেই ওই লেখাগুলোকে ‘নোংরা’ ‘পর্ণ’ বলছেন, ফলে আর সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে তা ‘নোংরা’ জিনিস হিসেবে প্রমাণ করার প্রয়োজনীয়তা থাকে না।

এখন প্রশ্ন হলো এই যৌনতা বা পর্ণ শিক্ষা এলো কোথায় থেকে ?

হিন্দুদের কথিত বড় ধরনের পূজা তথা নগ্নতা প্রদর্শণের মোক্ষম অনুষ্ঠান দূর্গা পুজা।দূর্গা পুজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয় । তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য । বলা হয় বেশ্যারা নাকি পুরুষদের কাম (যৌনতা) নীলকন্ঠের মতো ধারন করে সমাজকে নির্মল রাখে বলে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা অবশ্য প্রয়োজনীয়।"

যৌনতার  প্রথমত হিন্দু ধর্ম গ্রন্হাদির ভাষা সংস্কৃত সাহিত্যচর্চারমাধ্যমেই ভারত যৌনতার ইতিহাসে অবদান রেখেছে, যেখানে যৌনসঙ্গমকেবিবেচনা করা হয়েছে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে; যা নতুন প্রজন্মের যৌন মনোভাবের দর্শন ভিত্তিকতার কেন্দ্রবিন্দু। এটা বেলা যেতে পারে যে, ভারতেরশিল্প এবং সাহিত্যের মাধ্যমেই যৌনশিক্ষার প্রবর্তন ঘটেছে। ভারতের প্রায় সব হিন্দু সমাজে, সাধারণ মানুষ এবং শক্তিশালী শাসক গোষ্ঠির মধ্যে যৌনচর্চার পার্থক্য বিদ্যমান ছিলো। ভোগসর্বস্ব জীবনধারায় ক্ষমতাশীল ব্যাক্তিদের এক্ষেত্রে কোনো সাধারণ নৈতিক মনোভাব ছিলো না।

এ তথ্যের উৎস হল : সানন্দা ১৮ এপ্রিল ১৯৯১ দেহোপজীবিনী সংখ্যা, শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "গণিকাবৃত্তি : সমাজ, সংস্কার এবং সমীক্ষা" প্রচ্ছদ প্রতিবেদন , পৃস্ঠা: ১৯, হাতের ডান দিকের কলাম ।
অর্থাৎ বেশ্যার অনুপস্থিতিতে দুর্গাপুজা সম্ভব নয়। অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা মাত্রই জানে, ওই দিন মন্ডপে মন্ডপে মদ্যপান এবং অশ্লীল গানবাজনা কি পরিমাণে হয়ে থাকে। কারণ দুর্গাপুজা হল ব্রিটিশআমলের সংস্কৃতি। এ পূজা আগে হতো বসন্তকালে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলাকে হটানোর হিন্দু ষড়যন্ত্র যখন সফল হয়, হিন্দুরা তাদের প্রভু ব্রিটিশদের সাথে তাদের বিজয় উদযাপনের জন্য পুজাকে শরৎকালে এগিয়ে নিয়ে আসে।

এবার দেখি পুরাণ কি বলে যৌনতা নিয়ে:
ব্রহ্মা তার কন্যা স্বরস্বতির রুপে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে সঙ্গম ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। স্বরস্বতি তার পিতার হাত থেকে বাচার জন্য ভুমির চারদিকে ছুটে বেড়াতে লাগলেন কিন্তু ব্রহ্মার হাত থেকে বাচতে পারলেন না। তারা স্বামী-স্ত্রী রুপে ১০০ বছর বাস করলেন এবং সয়ম্ভুমারু ও শতরুপা নামক এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম দিলেন। সয়ম্ভুমারু ও শতরুপাও স্বামী স্ত্রী রুপে বসবাস করতে লাগলেন। Aitreay Brahman III : 33 // Satapatha Brahman 1 : 4 : 7 : 1ff // Matsy Puran III : 32ff // Bhagabati Puran III : 12 : 28ff

আবার,অহল্যা,গৌতম মুনরি স্ত্রী,সদ্য সড়বাতা (গোসল) এবং আদ্র (ভেজা) বস্ত্র পরিহিতা অবস্থায় আশ্রমে প্রত্যাবর্তন কালে পথিমধ্যে গৌতম শিষ্য দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে তার সাক্ষাত ঘটে। আদ্র বস্ত্রের মিথ্যা আবরণকে ভেদ করে উদগত যৌবনা অহল্যার রূপ লাবণ্য বিশেষ আকর্ষণীয় হযে় ফুটে উঠায় ইন্দ্রদেবের পক্ষে ধৈর্য ধারণ করা অসম্ভব হযে় পডে়,তিনি গুরুপত্নী অহল্যার সতীত্ব হরণ করেন। ত্রিকালজ্ঞ গৌতম মুনির কাছে একথা অজ্ঞাত থাকে না। তার অভিশাপে অহল্যা প্রস্তরে পরিণত হয়। আর ইন্দ্রদেবের সারা দেহে সহস্র যোনির উদ্ভব ঘটে। সুদীর্ঘকাল পরে ত্রেতাযুগে ঈশ্বরের অবতার রূপে শ্রীরাম চন্দ্র আবির্ভূত হন,তার পদ স্পশে অহল্যার পাষাণত্বঅপনোদিত হয়। (পঞ্চ পুরাণ,ষষ্ঠ খণ্ড,৬৯০ পৃষ্ঠা,মহাভারত,কৃত্তীবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ডের ৬৫১ পৃষ্ঠা) এবার আরও কিছু দেব দেবীর যৌনতার বর্ণনা  ॥

১।
যম ও যমী, যমজ ভাই-বোন। সূর্যদেবের ঔরসে ও উষাদেবীর গর্ভে তারা জন্মলাভ করে। যমী একদিন যমকে বলে- "তোমার সহবাসের জন্য আ অভিলাষিনী, গর্ভাবস্থা হতে তুমি আমার সহচর। বিধাতা মনে মনে চিন্তা করে রেখেছেন যে, তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদের পিতার এক নাতি জন্মাবে। তুমি পুত্রজন্মদাতা পতির ন্যায় আমার শরীরে প্রবেশ কর।" (ঋকবেদ মন্ডল-৯, সুক্ত ১০)
সেই ঘটনাকে স্মরনীয় করে রাখতে হিন্দুরা প্রতিবছর 'ভাইফোঁটা' নামক এক উৎসব পালন করে। ঐদিন যম আর যমীর অনুপ্রেরণায় হিন্দু ছেলেরা তাদের আপন বোনকে নিয়ে কল্পনা করে আর ভাবে- "ঈশ! আমার বোনটাও যদি যমীর মত হত..."

২।
রাম ও সীতাকে আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই জানি। কিন্তু বৌদ্ধ দশরথ জাতক অনুযায়ী- রাম ও সীতা হল ভাই-বোন, পরে তাদের মধ্যে বিবাহ হয়। "দশরথ জাতক" অনুযায়ী রামের জনক রাজা দশরথ ও জননী রানী কৌশল্যার মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল, তথাপি তাদের মধ্যে বিয়ে হয়েছিল। ঋগ্বেদ- এ দেখা যায় দম্ভ নিজ বোন মায়াকে, লোভ নিজ বোন নিবৃত্তিকে, কলি নিজ বোন নিরুক্তিকে বিয়ে করেছিল।

৩।
শুধু ভাইবোন নয়, হিন্দু ধর্মে এমনকি মা-ছেলে, পিতা-কন্যার বিয়েতেও কোন নিষেধ নেই। ঋগ্বেদ-এ উল্লেখ আছে- পূষণ তার বিধবা মাকে বিয়ে করে দ্বিধিষূ অর্থ্যাৎ বিধবার স্বামী হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র মৎস পুরাণে বর্ণিত আছে- ইশ্বর ব্রক্ষ্মা নিজ কণ্যা শতরুপার প্রতি প্রণয়াশক্ত হন এবং হিন্দুদের আদি মানব মনুর জন্ম হয় তাদের মিলন থেকেই।

৪।
পঞ্চপান্ডবের নোংরামি সবাই জানেন, তারপরও মনে করিয়ে দেই। পঞ্চপান্ডব ছিল পাঁচ ভাই। এক বাজিতে জিতে পাঁচ ভাইয়ের একজন (অর্জুন) দ্রৌপদীকে লাভ করেছিল। দ্রৌপদীকে বাড়ি এনে পাঁচ ভাই মাতা কুন্তিকে আহবান করে বলল- এসো দেখে যাও কি এনেছি। মাতা কুন্তি না দেখেই উত্তর করল-" যা এনেছিস পাঁচ ভাই মিলে ভাগ করে খা"। মাতার আদেশ মোতাবেক পাঁচ ভ্রাতাই দ্রৌপদীকে বিয়ে করে ভাগ করে খেয়েছিল...

৫।
হিন্দু মেয়েদের আদর্শ হল সীতা। সীতা নাকি সতি নারীর আদর্শ। সেই আদর্শের আসল রুপ দেখুন- "“সীতা স্বইচ্ছায় রাবন কে করলেন দেহ দান, আর রাবন সীতাকে করলেন বীর্য দান। তাই সীতার গর্ভে রাবনের বীর্যে দুজন জমজ সন্তানের জন্ম হয় যাদের নাম হলঃ ‘লব’ আর ‘কুশ’। [রামায়ন ২:১৯-২১]

৬।
ইসলামে ৪টা বিয়ে জায়েজ- আর এটা নিয়ে হিন্দুদের সে কি আস্ফালন। অথচ হিন্দুদের দেবতা কৃষ্ণ ১৩০০০ মতান্তরে ১৬০০০ টা বিয়ে করছিলো!! এত্তগুলা বিয়ে করেও তার খায়েস মেটেনি তাই সে মামী রাধিকার দিকেও হাত বাড়িয়েছিল। রাধিকা ধর্ষণের সেই ঘটনাকে স্মরন করেই আজ গাওয়া হয় "কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে"...

৭। '
'অপবিত্র নারীর উচিত শান্তচিত্তে শিবের (কামরূপের) উপাসনা করা। অতঃপর তার উচিত কোন ব্রাহ্মণের নিকট নিজেকে সমর্পণ করা এরূপ ভেবে যে 'ইনিই কামরূপে যৌনতৃপ্তি লাভের উদ্দেশ্যে এসেছেন।' এবং ঐ আবেদনময়ী নারীর উচিত ব্রাহ্মণের সকল মনঃকামনা পূর্ণ করা।তের মাস যাবৎ তার এই পন্থাতেই ঘরে আগত (যৌনতৃপ্তি লাভের নিমিত্তে) যেকোনো ব্রাহ্মণকে সম্মান দেখানো উচিত আর এতে সম্ভ্রান্ত নারী এমনকি বেশ্যাদের জন্যও কোন পাপ নেই।'' (সূত্রঃ মৎস্য পুরাণ ৭০:৪০-৬০, মহাভারত ৩:২:২৩)

৮।
সরস্বতী-পুরাণ বলে, ঊর্বশীকে দেখে স্বমেহন (কবিরাজি বাংলায় হস্তমৈথুন) করতেন ব্রহ্মা। তাঁর শুক্রাণু জমা হত একটি পাত্রে সেই পাত্রে জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্য এবং অগস্ত্য জন্ম দেন সরস্বতীর। এই সূত্র অনুযায়ী সরস্বতী ব্রহ্মার নাতনি আবার অন্য সূত্র বলে, ব্রহ্মার শুক্রাণু থেকে সরাসরি জন্ম হয় সরস্বতীর। কিন্তু আত্মজার রূপ দেখে মুগ্ধ হন প্রজাপতি। তিনি তাঁর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করতে চান। জন্মদাতার কামনা থেকে বাঁচতে পালিয়ে যান সরস্বতী। কিন্তু শেষ অবধি হার মানতে হয় ব্রহ্মার কামনার কাছে। ব্রহ্মা এবং সরস্বতী স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকেন পদ্ম ফুলে। প্রায় ১০০ বছর ধরে। তাঁদের পুত্রের নাম 'স্বায়ম্ভুব মনু' এবং কন্যা 'শতরূপা'। কিন্তু এরপরেও ব্রহ্মার বিকৃত যৌন কামনা কমেনি। এতে বিদ্যা এবং জ্ঞানের দেবী সরস্বতী অভিশাপ দেন ব্রহ্মাকে। বলেন, দেবতাদের মূলস্রোতে থাকবেন না প্রজাপতি ব্রহ্মা। অর্থাৎ তিনি পূজিত হবেন না। সত্যি হিন্দু দেবতাদের মূলধারার মধ্যে পড়েন না ব্রহ্মা। তাঁর রাজস্থানের পুষ্কর ছাড়া তাঁর মন্দির এবং অর্চনা বিরল। কুপিত হয়ে সরস্বতী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। দেবী থেকে রূপান্তরিত হন নদীতে।
অতঃপর তারাও দুজন দুজনের সাথে সহবাস করে এবং তাদের মিলনের ফলে ব্রহ্মা দুজন দৌহিত্র ও দুজন দৌহিত্রা লাভ করেন। (মৎস্য পুরাণ ৩ঃ৩২; ভগবত পুরাণ্ ৩ঃ১২-২৮)

ভেবে দেখুন হিন্দুদের ধর্মের দেবতা/ভগবান/অবতাররাই যদি এমন চরিত্রের হয়, তাহলে হিন্দুরা নিজেরা ভাল হবে কেমন করে??? প্রশ্ন জাগে মনে, হিন্দুরা কি তাদের এসব ধর্মগ্রন্থগুলো পড়ে না? যদি পড়ে তাহলে কি তারা এসব নোংরামি দেখে না? যদি দেখে তাহলে কি তাদের কাছে মনে হয় না এটা ধর্মের নামে আসলে একটা অধর্ম?উত্তরটা হল কিছু হিন্দু আসলে এগুলা ভয়েই পড়ে না, কারন পড়লে তো বাপ-দাদাদের পুরাতন ধ্যান-ধারনা আচার-প্রথা হুমকির সম্মুখীন হবে। আর যারা পড়ে তারা শেষমেষ উপায় না পেয়ে নাস্তিক হয়ে যায়, নাস্তিক হয়ে গেলেও দেবতাদের কর্মকান্ড তাদের মনের মধ্যে রয়েই যায়। যার দরুন তারা মনের অজান্তেই দেবতাদেরকে অনুসরন করতে থাকে।

এজন্যই আমরা দেখতে পাই- হিন্দুরা কিভাবে নিজের আপন মা-বোনদের সাথে যৌন সম্পর্ক কল্পনা করে চটি গল্প লিখে ইন্টারনেট ভরিয়ে ফেলেছে। আর এর ভয়ংকর কুপ্রভাব আমরা আজ আমাদের সমাজ জীবনে দেখতে পাচ্ছি ॥ যার নির্মম করুণ চিত্র সংবাদ আকারে এসেছে কলকাতার এক ইনস্টেস পরিবার  ॥ যারা এক সময়ে এসে নিজের মানবিক মূল্যবোধ আর নৈতিক অবক্ষয়ের কথা ভেবে হয়ে যায় সাইকো বা করে আত্মহত্যা॥ মনোবিজ্ঞানীরা বলছে এসব ইনস্টেস অবাস্তব কল্প কাহিনি নতুন প্রজন্মের মনোজগতে কুপ্রভাব ফেলতে পারে॥ যা সমাজ জীবন যা সভ্যতার জন্যে ভয়ংকর হুমকি হয়ে দেখা দিয়ে পারে॥ তাই মানবিক মূল্যবোধ জাগানো অতি জরুরী ॥ হিন্দু ধর্ম ও সমাজ পতনের মূলে এবং দুই থেকে আড়াই হাজার বৎসর ধরে দলে দলে হিন্দুরা অন্য ধর্মে যাবার পিছনে যৌনতা পর্ণ বিশেষ ধর্ম গ্রন্হাদির অবদান আছে।

এবার মূল আলোচনায় আসি। বলা হয়ে থাকে হিন্দুধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ। এজন্য অনেকে হিন্দুধর্মকে বৈদিক ধর্ম হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। হিন্দুধর্মের বেদ চারটি; যথা ঋগে¦দ, সামবেদ, অথর্ববেদ ও যজুর্বেদ। এই যজুর্বেদ দুই ভাগে বিভক্ত—একটি হচ্ছে কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তরীয় সংহিতা অন্যটি শুক্লযজুর্বেদ; এই শুক্লযজুর্বেদ আবার দুই ভাগে বিভক্ত, একটি শতপথ ব্রাহ্মণ এবং বৃহদারণ্যকোপনিষদ। শুক্লযজুর্বেদের অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে তুলনা করা হয়েছে এভাবে, “সে ব্যক্তিই ভাগ্যবান, যার পশুসংখ্যা স্ত্রীর সংখ্যার চেয়ে বেশি” (২/৩/২/৮)। শতপথ ব্রাহ্মণের এ বক্তব্যকে হয়তো দরদী ধর্মবাদীরা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে যৌক্তিকতা দিতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু পরের আরেকটি শ্লোকে পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিতে নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান; “বজ্র বা লাঠি দিয়ে নারীকে দুর্বল করা উচিৎ, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার না থাকতে পারে” (৪/৪/২/১৩)। এর থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্যের আর প্রয়োজন আছে? বৃহদারণ্যকোপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবাল্ক্য বলেন, “স্ত্রী স্বামীর সম্ভোগকামনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হলে প্রথমে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে ‘কেনবার’ চেষ্টা করবে, তাতেও অসম্মত হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে” (৬/৪/৭, ১/৯/২/১৪)। দেবীভাগবত-এ নারীর চরিত্র সম্পর্কে বলা আছে (৯:১): “নারীরা জোঁকের মত, সতত পুরুষের রক্তপান করে থাকে। মুর্খ পুরুষ তা বুঝতে পারে না, কেননা তারা নারীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। পুরুষ যাকে পতœী মনে করে, সেই পতœী সুখসম্ভোগ দিয়ে বীর্য এবং কুটিল প্রেমালাপে ধন ও মন সবই হরণ করে।”

বাহ্! হিন্দুরা না-কি মাতৃজ্ঞানে দেবীর (দূর্গা, কালি, মনসা, স্বরসতী, লক্ষী) পূজা করে? ‘নারী’ সম্পর্কে যাদের ধর্মীয় বিধানে এমন হীন বক্তব্য রয়েছে, তারা দেবীর পূজা করলেই কী আর না-করলেই কী? (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে রচিত) বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায়, খ্যাতনামা ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এবং অন্যান্য ঋষিদের সাথে এক সভায় ঋষি বাচাক্লুর কন্যা গার্গী ব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়ে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। একসময় যাজ্ঞবল্ক্য ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠেন, “হে গার্গী, আর বেশি প্রশ্ন করো না, তাহলে তোমার মাথা খসে পড়ে যাবে!” (৩/৬/১); যাজ্ঞবল্ক্যের বক্তব্যে গার্গী থেমে গেলেন পরবর্তীতে স্বীকার করলেন, ব্রহ্মবিদ্যায় যাজ্ঞবল্ক্যকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না (৩/৮/১-১১)। আবার যে নারীরা বেদের-উপনিষদের শ্লোক-মন্ত্র রচনা করেছেন, সেই নারীদের উত্তরসূরীদের জন্য মনু বেদসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, “নারীরা ধর্মজ্ঞ নয়, এরা মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ)এই শাস্ত্রীয় নিয়ম” (মনুসংহিতা, ৯/১৮)।

হিন্দুধর্মের ইতিহাসে সেই কুখ্যাত সতীদাহ বা সহমরণের কথা প্রথম জানা যায় অথর্ববেদে, “... জীবিত নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতের বধু হতে” (১৮/৩/৩); “এই নারী পতিলোকে যাচ্ছে, এ প্রাচীন রীতি অনুসরণ করছে...” (১৮/৩/৩/১)। এ প্রাচীন রীতি কত পুরানো? এটি আর্য না প্রাগার্য সংস্কৃতি? কারণ আমরা ইন্দো-ইয়রোপীয় অন্য সভ্যতাগুলিতে আমরা সহমরণের কথা তো পাই না। উত্তরগুলো আমার জানা নেই। তবে পাঠক, আপনারা হয়তো ইতিহাস পাঠের কারণে জানেন, এই বাংলায় ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তের বছরে ব্রাহ্মণ্যবাদীর দল পুণ্যলাভের আশায় আর নারীর সতীত্ব (?) রক্ষার ধুয়া তুলে ৮১৩৫ জন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে সতী বানিয়েছিল! একটু ভাবুন তো, একটি নিরাপরাধ মেয়েকে টেনে-হিচড়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলছে, পাশে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সক্কলে দাঁড়িয়ে ‘বল হরি বল’ কীর্তন গেয়ে নিজেদের স্বর্গে যাবার আয়োজন করছে, ভাবতেই তো গা গুলিয়ে উঠে! মানুষ কী পরিমাণ পাষণ্ড-হারামি-ধর্মান্ধ হলে এরকম কাজ করতে পারে? ‘ধর্ম’ নামক আফিমীয় মাদক মানুষকে কতটুকু নিবোর্ধ-মানবিকতাশূণ্য বানিয়ে দেয়, তারই উদাহরণ হতে পারে উপমহাদেশের এই সতীদাহ প্রথা।

মনুসংহিতা এবং নারী : হিন্দু আইনের মূল উৎস হচ্ছে এই ‘মনুসংহিতা’ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছেও এটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচ্য। এই ধর্মগ্রন্থে নারীর কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,“বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ/পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিক্রিয়া॥” (২:৬৭), অর্থাৎস্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহেবাস এবং গৃহকর্ম তাদের (হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা; আবারও বলে দেয়া হয়েছে নারীর কর্তব্যগৃহকর্ম এবং সন্তান উৎপাদন (৯:২৬)। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই নারী এবং সন্তান উৎপাদনার্থে পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে (৯:৯৬)।

সাধ্বী নারী কখনো জীবিত অথবা মৃত স্বামীর অপ্রিয় কিছু করবেন না (৫:১৫৬)। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীদের কি করতে হবে“কামন্তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুস্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ/ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু॥” (৫:১৫৭), সহজ ভাষায় বাংলা করলে হয়, স্ত্রী সারা জীবন ফলমূল খেয়ে দেহ ক্ষয় করবেন, কিন্তু অন্য পুরুষের নামোচ্চারণ করবেন না। কিন্তু স্ত্রী মারা গেলে স্বামী কি করবেন, “ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি/পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ॥” (৫:১৬৮), এই শ্লোকেরও বাংলা শুনুন, দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করে স্বামী আবার বিয়ে এবং অগ্ন্যাধ্যান করবেন। সত্যি! নারী-পুরুষের মধ্যে কী চমৎকার সমতা!! কেহ কেহ বলেন, ‘মনুবাদ’ থেকেই না-কি ‘মানবতাবাদ’ এসেছে! দারুন! ধন্য মোরা মনুর প্রতি! আবার এই ‘মনুবাদ’ না-কী হিন্দু আইনের উৎস! নারীর গুণাবলী নিয়ে মনু বলেন, নারীর কোনো গুণ নেই, নদী যেমন সমুদ্রের সাথে মিশে লবনাক্ত (সমুদ্রের গুণপ্রাপ্ত) হয়, তেমনই নারী বিয়ের পর স্বামীর গুণযুক্ত হন (৯:২২)। নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে মনুর সংহিতাতে বলা আছে : “অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্য্যাঃ পুরুষৈঃ স্বৈর্দ্দিবানিশম্/ বিষয়েষু চ সজ্জন্ত্যঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে॥” (৯:২), অর্থাৎ স্ত্রীলোকদের স্বামীসহ প্রভৃতি ব্যক্তিগণ দিনরাত পরাধীন রাখবেন, নিজের বশে রাখবেন...; আবার এর পরেই আছে বিখ্যাত সেই শ্লোক : “পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে/রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি॥” (৯:৩)

অর্থাৎ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়। এখন যারা (সনাতনবাদীরা) নারীমুক্তির বিষয়ে নিজ ধর্মের পক্ষে সাফাই গান, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই শ্লোক দেখে তারা কী ব্যাখ্যা দেবেন? নিশ্চয়ই আমতা আমতা করে ছলনা-শঠতার মাধ্যমে যৌক্তিকতা (বাস্তব উপযোগিতা) দানের চেষ্টা করবেন, কিংবা অস্বীকার করে বসবেন, আদৌ এ ধরনের কোনো শ্লোক কোথাও নেই! নারী সম্পর্কে ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে আছে সমগ্র মনুসংহিতা জুড়েই; নারীনিন্দায় মনুসংহিতা শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে গেছে। মনুর দৃষ্টিতে নারী স্বভাবব্যভিচারিণী, কামপরায়ণা; কাম, ক্রোধ, পরহিংসা, কুটিলতা ইত্যাদি যত খারাপ দোষ আছে, সবই নারীর বৈশিষ্ট্য, এসবই দিয়ে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে! তবু সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এসব কিছুই নজরে আসে না, তাঁরা উদয়-অস্ত খুঁজে বেড়ান ইসলামধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম, বৌদ্ধধর্ম নারীদের কোন্ অধিকার দিয়েছে, আর কোন্ অধিকার দেয়নি!

ধর্মগুরু, ঈশ্বরতুল্য মনু ঠিক কী পরিমাণ নারী-বিদ্বেষী হলে বলতে পারেন : “নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ/সুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে॥“ (৯:১৪), অর্থাৎ “যৌবনকালে নারী রূপ বিচার করে না, রূপবান বা কুরূপ পুরুষ মাত্রেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে।” (বাহ্! মনে হয় তাদের নিজেদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র!); আসুন, একই রকম আরেকটি মনুর শ্লোক দেখি“স্বভাব এস নারীনাং নরাণামিহ দূষণম্/অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ॥” (২:২১৩) অর্থাৎ “নারীর স্বভাবই হলো পুরুষদের দূষিত করা...”!

মহাভারত এবং নারী : সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে আরেকটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে মহাভারত; যদিও ইদানীং অনেকে একে মহাকাব্য হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে বেশিরভাগ ধর্মাবলম্বীদের কাছে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ‘মহাভারতের কথা অমৃতসমান’ বিবেচিত হয়। পণ্ডিতেরা বলেন মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ চতুর্থ শতকের মধ্যে এবং কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের কাল (যদি বাস্তবে কখনো সে যুদ্ধ ঘটে থাকে) মোটের উপর খ্রিস্টপূর্ব নবম শতক। মহাভারতেও নারী সম্পর্কে মনুসংহিতার প্রভাব পড়েছে তীব্রভাবে, এসেছে নারী সম্পর্কে অনেক হীন বক্তব্য; যার সামান্য কয়েকটি আগ্রহীদের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে : মহাভারতের অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে ভীষ্ম, তাঁর মধ্যেও স্পষ্টরূপে মনুর ছায়া পরিলক্ষিত হয়, তিনি বলেন (১৩/৩৮), “উহাদের (স্ত্রীলোকদের) মত কামোন্মত্ত আর কেহই নাই। ... কাষ্ঠরশি যেমন অগ্নির, অসংখ্য নদীর দ্বারা যেমন সমুদ্রের ও সর্বভূত সংহার দ্বারা অন্তকের তৃপ্তি হয় না, তদ্রুপ অসংখ্য পুরুষ সংসর্গ করিলেও স্ত্রীলোকের তৃপ্তি হয় না।”। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও গুরু ভীষ্মের মতোই, তাঁর মুখেও শোনা যায় তীব্র নারীনিন্দা, “উহারা (নারীরা) ক্রিয়া-কৌতুক দ্বারা পুরুষদিগকে বিমোহিত করে।

উহাদিগের হস্তগত হইলে প্রায় কোনো পুরুষই পরিত্রাণ লাভ করিতে পারে না। গাভী যেমন নূতন নূতন তৃণভক্ষণ করিতে অভিলাষ করে, তদ্রুপ উহারা নূতন নূতন পুরুষের সহিত সংসর্গ করিতে বাসনা করিয়া থাকে” (১৩/৩৯)। আবারো পঞ্চপাণ্ডবের মহাজ্ঞানী পিতামহ ভীষ্মের উপলব্ধি, “মানুষের চরিত্রে যত দোষ থাকতে পারে, সব দোষই নারী ও শূদ্রের চরিত্রে আছে। জন্মান্তরীয় পাপের ফলে জীব স্ত্রীরূপে (শূদ্ররূপেও) জন্মগ্রহণ করে” (ভীষ্মপর্ব ৩৩/৩২); “স্ত্রীগণের প্রতি কোন কার্য বা ধর্ম নেই। (কারণ) তারা বীর্যশূণ্য, শাস্ত্রজ্ঞানহীন।” (অনু, ১৩/৩৯) এরপরেও নাকি মহাভারতের কথা অমৃতসমান! (সূত্র : মনুসংহিতা ও নারী, পৃষ্ঠা ৭২-৭৬) “তুলাদণ্ডের একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, দাবানল, ক্ষুরধার বিষ, সর্প ও বহ্নিকে রেখে অপরদিকে নারীকে স্থাপন করিলে ভয়ানকত্বে উভয়ে সমান-সমান হবে” (অনুশাসনপর্ব ৩৮)। ব্রাহ্মণ্যধর্মের ‘সম্পূর্ণ ধর্মগ্রন্থ’ রূপেই এখন গীতার স্থান; এবং কারো কারো কাছে আধুনিক ধর্মগ্রন্থ! গীতাকে বলা হয়, শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী, ভগবদগীতা। কিন্তু এই গীতাতেও দেখি ভগবানের কণ্ঠে মনুর বক্তব্য! শ্রীমদ্ভগবদগীতায় পঞ্চপাণ্ডবের শ্রেষ্ঠ বীর শ্রীমান অজুর্নের মুখে শুনি—“অধর্মাভিভাবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ/স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ॥” (গীতা, ১:৪০) অর্থাৎ “হে কৃষ্ণ, অধর্মের আবির্ভাব হলে কুলস্ত্রীরা ব্যভিচারিণী হয়। হে বার্ষ্ণেয়, কুলনারীগণ ব্যভিচারিণী হলে বর্ণসংকরের সৃষ্টি হয়”। এর পরেই বর্ণসঙ্কর সৃষ্টি হলে কি হয়, তারও উত্তর রয়েছে : “সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘœানাং কুলস্য চ/পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ॥” (গীতা, ১:৪১) অর্থাৎ বর্ণসঙ্কর, কুলনাশকারীদের এবং কুলের নরকের কারণ হয়। শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি ক্রিয়ার লোপ হওয়াতে ইহাদের পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হয়।”

এই উক্তিগুলো পঞ্চপাণ্ডবের এক ভাই অর্জুনের; মেনে নিচ্ছি ভগবদগীতায় শ্রী ভগবানের উক্তিই প্রামাণ্য, অর্জুনের নয়। কিন্তু এ প্রসঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের বক্তব্য খণ্ডন তো করেনই নি, বরঞ্চ সে বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করে এবং অর্জুনকেও ছাড়িয়ে গিয়ে নারীদের ‘পাপযোনি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন : “মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহ্যপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ/স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেপি যান্তি পরাং গতিম্॥” (গীতা, ৯:৩২) অর্থাৎ “আমাকে আশ্রয় করে স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্র এসব পাপযোনিরাও পরম গতি লাভ করে থাকে”। এরপরই দয়ময় ভগবান ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিদের ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলেন : “কিং পুনর্ব্রাহ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা/অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্॥” (৯:৩৩) অর্থ হচ্ছে “পুণ্যশীল ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিগণ যে পরম গতি লাভ করিবেন তাহাতে আর কথা কি আছে? অতএব আমার আরাধনা কর। কারণ এই মর্তলোক অনিত্য এবং সুখশূণ্য।”

পাঠক, বত্রিশ নম্বর শ্লোকে লক্ষণীয় যে, নারীর সাথে বৈশ্য ও শূদ্ররা পাপযোনিভুক্ত, শুধু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বাদে! কিন্তু নারী যদি কোনো ব্রাহ্মণের মেয়ে হয় তবুও সে ভগবানের দৃষ্টিতে পাপযোনিভুক্ত। বুঝা যাচ্ছে, ভগবানের কাছে নারীর আলাদা কোনো জাত বা বর্ণ নেই; সব নারীই পাপযোনিভুক্ত। কিন্তু খটকা লাগে, কোনো ব্যক্তির নিজের জন্মের উপর নিজের কি কোনো হাত থাকতে পারে? যদি হাত নাই থাকে, তবে নারী, বৈশ্য, শূদ্ররা পাপযোনিভুক্ত হয় কী করে? তাছাড়া এ ধরনের নোংরা বক্তব্য কী কোনো ধর্মগ্রন্থে থাকতে পারে? এ ধরনের নোংরা বাণী এখানেই শেষ নয়, আরো আছে; প্রচুর পরিমাণে আছে। নারীদের নিয়ে হিন্দু ভগবান থেকে শুরু করে মুনি-ঋষি, ঠাকুর-পুরোহিত, রাজন্যবর্গ কারোর-ই চিন্তার শেষ নেই। নারী অমুক, নারী তমুক! অনেকেই ভাবতে পারেন, হিন্দুধর্মের দৃষ্টিতে নারী বোধহয় কখনোই ভালো নয়? না, না। এরকমটি নয়। হিন্দু মুনি-ঋষিরা ভালো নারী-ধর্মচারী নারীর বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দিয়েছেন! তাদের দৃষ্টিতে সতী-সাধ্বী-ধর্মচারিণী হচ্ছে—“ন চন্দ্রসূর্যৌ ন তরুং পুন্নাুো যা নিরীক্ষতে/ভর্তৃবর্জং বরারোহা সা ভবেদ্ধর্মচারিণী॥ (মহাভারত, ১২/১৪৬/৮৮) অর্থাৎ “যে নারী স্বামী ব্যতীত কোনো পুংলিঙ্গান্ত (নামের বস্তু), চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষও দর্শন কওে না, সে-ই ধর্মচারিণী।” ওরেবাব্বা! দেখলেন তো!

ধর্মচারিণী হতে হলে কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন? এতো দেখি পর্দাপ্রথা থেকেও চূড়ান্ত ও উন্মত্ত সংস্করণ! সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এরপরেও কোন মুখে দাবি করেন, তাদের ধর্ম প্রগতিশীল, তাদের ধর্মে নারী সম্পর্কে কোনো বাজে ধারণা নেই? না জেনে দাবি করে বসলে আমার কিছু বলার নেই? কিন্তু জেনে-শুনে যারা এগুলো গোপন করে নিজেদের ধর্ম যুগোপযুগী, নারী-মুক্তির পক্ষে কিংবা নারী-মুক্তি হিন্দু ধর্মেই রয়েছে বলে সাফাই গান, তাদের জন্য বাংলা ভাষায় একটা ভদ্র শব্দ প্রচলিত আছে, তা হল ‘চশমখোর’! হিন্দুধর্ম নারীকে বিন্দুমাত্র মানুষের মূল্য দেয় না; নারী শুধুমাত্র পণ্য, নারীর নিজস্ব কোনো অধিকার নেই, নেই স্বাধীনতা; এখনো হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিয়ের সময় কন্যাদান করা হয় পুরুষের (স্বামী/প্রভু) কাছে যজ্ঞ-মন্ত্র ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা মেনেই। বৈদিকযুগ থেকেই বিয়ের সময়ই কন্যাদান নয়, অহরহই যে কোনো অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ক্ষত্রিয় রাজা বা ঠাকুর-পুরোহিত-ব্রাহ্মণদের মনোরঞ্জনের জন্য নারীদের দান করা হতো, দেখুন পবিত্র মহাভারতের কিছু নমুনা : মহাভারতের কথিত শ্রেষ্ঠ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির নিজেও যজ্ঞে-দানে-দক্ষিণায় বহুশত নারীকে দান করে দিতেন অবলীলায় অতিথিরাজাদের আপ্যায়নে (আশ্বমেধিকপর্ব ৮০/৩২, ৮৫/১৮)! রাজাদের লালসার তো শেষ নেই! শুধু ক্ষত্রিয় রাজারা ভোগের জন্য নারী পেলে তো হবে না, অমৃতের সন্তান ব্রাহ্মণেরা কী দোষ করলো তবে! চিন্তার কিছু নেই, ওদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। শ্রাদ্ধের-দক্ষিণার তালিকাতে পুরোহিত ব্রাহ্মণদের নারী দান করার বিধান রয়েছে, দেখুন : আশ্রমবাসিকপর্ব ১৪/৪, ৩৯/২০, মহাপ্রস্থানপর্ব ১/৪, স্বর্গরোহণপর্ব ৬/১২,১৩।

যাহোক, এই ইহজগতে না হয় দুদর্মনীয় কামভোগের একটা ব্যবস্থা করা গেল, কিন্তু মৃত্যুর পর কী হবে? মরণের পরেও তো সুখ-শান্তির ব্যবস্থা থাকা চাই। চিন্তা নেই, তারও রেডিমেড ব্যবস্থা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো যুদ্ধ করে মারা গেলে স্বর্গে পাওয়া যাবে অসংখ্য সুন্দরী নারী। প্রমাণ চাই তো নিশ্চয়ই! দেখুন : বনপর্ব ১৮৬-১৮৭, কর্ণপর্ব ৪৯/৭৬-৭৮, শান্তিপর্ব ৬৪/১৭, ৩০; ৯৬/১৮, ১৯, ৮৩, ৮৫, ৮৬, ৮৮, ১০৬; রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড ৭১/২২, ২৫, ২৬, সুন্দরকাণ্ড ২০/১৩। (সূত্র : প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা ৬৩)।

ব্লগার ইস্যুতে হাসিনার আগের মন্তব্য:

উপরে আমরা দেখলাম ‘পর্ন’ ‘নোংরা’ ও ‘বিকৃত মানসিকতা’ নিয়ে লেখা ধর্মবিদ্বেষী ব্লগগুলোর ব্যাপারে শেখ হাসিনার বর্তমান অবস্থান। তিনি তাতে বলেছেন যে এ ধরনের লেখায় তিনি নিজেই কষ্ট পান।

এখন আমরা দেখবো এসব ‘পর্ণ’র অন্যতম নেতৃস্থানীয় লেখক রাজীব হায়দার ওরফে থাবা বাবা ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তার সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছিলেন?

১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর প্রিংন্ট সংস্করণে প্রকাশিত “জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির অধিকার নেই: প্রধানমন্ত্রী” শিরোনামের সংবাদটিতে অনলাইনে একটি ভিডিও যোগ করে দেয়া হয়। রাজীব হায়দারের বাসায় তার মাকে সান্তনা দিতে যাওয়া শেখ হাসিনা রাজীব ওরফে থাবা বাবা সম্পর্কে যা বলেছেন চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত সেই ভিডিও ক্লিপটি থেকে তার বক্তব্যের শেষাংশটি তুলে ধরা হল-

“এই যে তরুণ সমাজ তারা মনে হল একাত্তরের পর আবার সমগ্র বাঙালী জাতির চেতনায় এতটা উন্মেষ ঘটাতে পেরেছে। আর সেই চেতনা যখন তারা এমন জাগ্রত করলো সে সময় প্রথম শহীদ সে। এবং এটা সবাই ধরেই নিতে পারে কারা করছে। তবে এটুকু কথা দিতে পারি এদের ছাড়বো না।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আরো কিছু বলার আগে ওইদিনের প্রথম আলোর আরেকটি সংবাদের উদ্ধৃতি দিতে চাই। “রাজীব দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ: তোফায়েল” শিরোনামের ওই সংবাদটিতে লেখা হয়েছে, “আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ব্লগার রাজীব দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ। রাজীব চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর রক্ত দিয়ে উজ্জীবিত করে গেছেন তরুণ প্রজন্মকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল থেকে শাহবাগের কর্মসূচি আবারও লাগাতার করা হয়েছে।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (ভূমিকা, অনুবাদ, টীকা), ২০০২, মনুসংহিতা, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

২.   শ্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ (সম্পাদিত), ১৯৯৭, শ্রীমদ্ভগবদগীতা, প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী, কলকাতা।

৩. কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯৮, ধর্ম ও নারী, এলাইড পাবলিশার্স, কলকাতা।

৪. কঙ্কর সিংহ, ২০০৫, মনুসংহিতা ও নারী, র‌্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা।

৫. সুকুমারী ভট্টাচার্য, ২০০২, প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

৬. সা’দ উল্লাহ্, ২০০২, নারী অধিকার ও আইন, সময় প্রকাশন, ঢাকা।

৭.  মাহমুদ শামসুল হক, ১৯৯৬, নারীকোষ, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা।

৮.   প্রবীর ঘোষ, ১৯৯৪, যুক্তিবাদের চোখে নারী-মুক্তি, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

৯. ধর্ম ও নারী - সৈয়দ শাহজাহান

১০. ধর্ম ও নারী প্রাচীন ভারত : কঙ্কর সিংহ

১১. ধর্ম, নারী ও যৌনতা : শামসুদ্দোহা শোয়েব
প্রকাশক: শুদ্ধস্বর

১২. ধর্ম ও সমাজে নারী: মাসউদ আহমদ

১৩. নারী : হুমায়ুন আজাদ

১৪. সমাজ ও ধর্ম : মাহমুদা ইসলাম

১৫. ধর্ম ও নারীর অধিকার: মমতাজ দৌলতানা

১৬. মহাবিশ্বে মানুষ ও ধর্ম: নরেন্দ্র কুমার মন্ডল

১৭. ধর্ম ও যুবক জীবন: ডাঃ লুৎফর রহমান

১৮. ধর্ম ও প্রগতি : জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯. শ্রীকৃষ্ণ ও ভাগবত ধর্ম: জগদীশ চন্দ্র ঘোষ

২০. সনাতন ধর্ম : মত ও মতান্তর: রণজিৎ কর
২১. sufiborshan.blogspot.co.uk
http://sufiborshan.blogspot.co.uk/2015/06/blog-post_8.html
২২. ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন আর্টিকেল এবং নিউজ