বিজেপি শাসিত গুজরাটে ও মহারাষ্টে গত ছয় মাসে শতাধিক দাঙ্গায় অসংখ্য মুসলমান হিন্দুদের হাতে নিহত হয়॥
মোদীর বক্তব্যের পর ভারতের মুসলমানরা কতটা নিরাপদ ???
সূফি বরষণ
প্রথমেই আসি দাঙ্গা কি? দাঙ্গা হল কতিপয় বিশৃঙ্খল নাগরিক দ্বারা হঠাৎ সৃষ্ট জনজীবনের বিশৃঙ্খল এবং হিংস্র রূপ যা সমাজের কল্যাণের বিপরীত, যার উদ্দেশ্য হয় ভীতি সৃষ্টি করা এবং যেখানে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। এই তাত্ত্বিক সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি, দাঙ্গা সাধারণতঃ দুই বা ততধিক পক্ষের অমিমাংসিত বিরোধ নিয়ে ঘটে। দাঙ্গার পিছনে ইস্যূ থাকে –কখনো তা সামাজিক, কখনো রাজনৈতিক, কখনো ধর্মীয় এবং কখনো অন্য কিছু হতে পারে। Wikipedia তে ‘দাঙ্গা’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “A riot is a form of civil disorder characterized often by what is thought of as disorganized groups lashing out in a sudden and intense rash of violence against authority, property or people”।
দাঙ্গা বা রায়টস প্রায়ই একটি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বা অন্যায়-নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় ঘটে। ঐতিহাসিকভাবে, দাঙ্গার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়ঃ দারিদ্রতা, বেকারত্ব, সরকারি জুলুম, করারোপণ প্রভৃতির প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ; জাতিগত গোষ্ঠী, ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব হলে প্রভৃতি। যখন মানুষ আইনি প্রক্রিয়ায় কোন সমস্যার সমাধান খুঁজে না পেয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তখনই দাঙ্গা দেখা দেয়। বিভিন্ন রকমের দাঙ্গা হতে পারে যেমনঃ police riot, prison riot, race riot, religious riot, Student riots, Urban riots, Sports riots, Food and bread riots প্রভৃতি।
ভারত বর্ষকে মুসলমানরা ৮ শত বছর শাসন করেছে কিন্তু একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়নি॥ কিন্তু ইংরেজদের শাসনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ১৭ হাজারের বেশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়॥ আর এসব দাঙ্গায় বলির পাঠার মতো মুসলমানদের হত্যা করে হিন্দু উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা॥
ভারতে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা বেড়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৩৩০টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী- ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৩০টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দাঙ্গার ঘটনা ছিল ২৫২ টি।
চলতি বছরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৫১ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ১,০৯২ জন আহত হয়েছে। গতবছর প্রথম ছয় মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৩৩ জন নিহত হয়। ২০১৪-তে অবশ্য ৬৪৪ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৯৫ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ১,৯২১ জন আহত হয়েছিল।
বিজেপি শাসিত গুজরাটে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৫ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় ৭ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ৭৯ জন আহত হয়। ২০১৪ সালে এই সময়ের মধ্যে ৭৪ টি দাঙ্গার ঘটনায় ৭ জন নিহত এবং ২১৫ জন আহত হয়েছিল।
বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫৯ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় ৪ জন নিহত এবং ১৯৬ জন আহত হয়। ২০১৪ সালে এই সময়ের মধ্যে ৯৭ টি দাঙ্গার ঘটনায় ১২ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ১৯৮ জন আহত হয়েছিল।
ভারতে সাম্প্রতিক সময়ের বিতর্কিত ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কিছু ঘটনা নিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক সাংবাদিকের কাছে এই প্রথমবারের মত করা এক মন্তব্যে বলেছেন এসব ঘটনা তাঁর ভাষায় দুঃখজনক হলেও এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই।
উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামে গরুর মাংস খাওয়ার গুজব ছড়িয়ে মুসলিম এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারা বা পাকিস্তানি গায়ক গুলাম আলিকে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠান করতে না দেওয়া এসব ঘটনা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে সারা দেশে যে বিতর্ক উঠেছে মি: মোদী এর জন্য মেরুকরণের রাজনীতিকে দায়ী করেছেন।
আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের সঙ্গে আলাপকালে মি: মোদী একথা বলেন।
জয়ন্ত ঘোষাল বিবিসিকে বলছিলেন, এখনো সরকারিভাবে, বা টুইটারে বা আনুষ্ঠানিকভাবে মি. মোদী কোন প্রতিক্রিয়া জানাননি।
নরেন্দ্র মোদী বলছেন, দেশের সব ঘটনার জবাবে প্রতিক্রিয়া জানানোই সরকারের কাজ নয়। কিন্তু যেসব ঘটনা ঘটে, সেটার তদন্ত হচ্ছে কিনা, সেটার বিষয়ে ব্যবস্থা হচ্ছে কিনা, সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়। এখানে অসহিষ্ণুতার কিছু নেই।
এদিকে ভারতের মুসলমানদের গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে মারার কারণে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ভারতে সাহিত্যের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক ফিরিয়ে দিয়েছে অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিক ॥
ভারতের আরও কয়েকজন সাহিত্যিক দেশটির সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। এঁরা বলছেন, সেদেশে যেভাবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়িয়ে চলেছে হিন্দুত্ববাদীরা আর প্রধানমন্ত্রী এইসব ঘটনায় মুখে কুলুপ এঁটেছেন, তারই প্রতিবাদ এই সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া।
গতকাল ১৬ জন তামিল সাহিত্যক আর কয়েকদিন আগে একঝাঁক কন্নড় সাহিত্যিক ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁদের রাজ্য সরকারগুলির দেওয়া পুরস্কার।
সম্প্রতি এক মুসলমান ব্যক্তিকে গরুর মাংস খাওয়ার গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা বা হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য এক লেখককে হত্যা করার ঘটনার প্রতিবাদ করছেন এই কবি-সাহিত্যিকরা। সেই হিসেবে ভারতের সাহিত্যিকদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায়॥ কিন্তু তারপরেও কি ভারতের মুসলমানরা হিন্দু উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে নিরাপদ থাকবে কি??
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
No comments:
Post a Comment