Monday, 30 November 2015

ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব দুই ... বাংলার পাল বংশের সুশাসকগণের পূর্বপুরুষগণ বৌদ্ধ ছিলেন কিনা মতভেদ আছে??

ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব দুই ...
বাংলার পাল বংশের সুশাসকগণের পূর্বপুরুষগণ বৌদ্ধ ছিলেন কিনা মতভেদ আছে??




সূফি বরষণ
পাল প্রাচীন বাংলার একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজবংশ। এর প্রতিষ্ঠাতার নাম গোপাল। পাল বংশের বিস্তার ৭৫০-১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল।
প্রস্তর যুগে বাংলার জনবসতি কেমন ছিল তা জানা যায়নি৷ তবে ইদানীং কালে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মাটি খুঁড়ে প্রস্তরযুগের যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাতে এটা বোঝা যায় যে, প্রস্তর যুগেও জনপদের অস্তিত্ব ছিল৷ প্রাচীন যুগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন বাংলায় বিভিন্ন নামের প্রচুর জনপদ ছিল, যার মধ্যে একটির নাম ছিল “বঙ্গ”৷ সংস্কৃত সাহিত্যেও “বঙ্গ” শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে পর্যন্ত প্রস্তর যুগ অবশিষ্ট ছিল৷ ঠিক সেই সময়ই দ্রাবিড় গোষ্ঠী, তিব্বতি-বর্মী গোষ্ঠীর মানুষ ও অস্ট্র-এশিয়াটিক জাতির মানুষ বাংলায় তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করে৷
খ্রিষ্ট পূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বর্তমানের বিহার ও বাংলা এলাকা নিয়ে গঠিত হয় মগধ সাম্রাজ্য৷ ভারতের চারটি মূল সাম্রাজ্যের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম৷ বহু জনপদে বিভক্ত ছিল মগধ৷ ক্রমে ক্রমে মগধ সাম্রাজ্য প্রায় সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে৷ এরই ধারাবাহিকতায় আসে বাংলায় পাল শাসনের কথা॥
পাল শাসন আট শতকের মাঝামাঝি সময়ে গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ বিভিন্ন উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় চারশ’ বছর বাংলা শাসন করে। এ বংশের আঠারো জন রাজার দীর্ঘ শাসনামলে উত্থান-পতন লক্ষ করা গেলেও প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল শাসন যে একটা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাল রাজাদের ইতিহাসকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়: (১) ধর্মপাল (আ. ৭৮১-৮২১ খ্রি.) ও দেবপাল-এর (আ. ৮২১-৮৬১ খ্রি.) শাসনামল। এ আমল ছিল প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার যুগ;
(২) স্থবিরতার যুগ (আ. ৮৬১-৯৯৫ খ্রি.)। প্রথম মহীপাল (আ. ৯৯৫-১০৪২ খ্রি.) অবশ্য এ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে পাল বংশের গৌরব পুনরুদ্ধার করেন, যার জন্য তাঁকে পাল বংশের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়;
(৩) অবনতি ও অবক্ষয়ের যুগ। রামপাল (আ. ১০৮২-১১২৪ খ্রি.) তাঁর তেজোদ্দীপ্ত শাসন দ্বারা এ অবক্ষয়কে সাময়িকভাবে রোধ করার প্রয়াস পান। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য আর বেশি দিন টিকে থাকে নি। বারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেন বংশের উত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
রাজা গোপাল বৌদ্ধ ছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন_এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গোপালের পিতা-পিতামহ বৌদ্ধ ছিলেন কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিব্বতীয় গ্রন্থ থেকে জানা যায়, গোপাল নালন্দায় একটি বৌদ্ধবিহার এবং আরো অনেক বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ভারতের অন্যান্য জায়গায় যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব পড়তির দিকে, তখনো বাংলাদেশ ও বিহারে পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্মের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। গোপাল নিজে বৌদ্ধ হলেও তাঁর রাজসভায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রভাব বেশি ছিল।পাল বংশের কুলজি
এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে গোপালের আবির্ভাব একটি বড় অধ্যায়। এ অঞ্চলে গণতন্ত্রচর্চার শুরু হিসেবে গোপালের ক্ষমতারোহণ অনেকেই চিহ্নিত করেন। কিন্তু গোপালের বংশ পরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। রামচরিত কাব্যে বরেন্দ্রভূমি পাল রাজাদের জনকভু অর্থাৎ পিতৃভূমি বলে বর্ণিত হয়েছে। এ তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, গোপাল বরেন্দ্রর অধিবাসী ছিলেন। পাল রাজাদের তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, গোপালের পিতামহ দয়িতবিষ্ণু সর্ববিদ্যায় বিশুদ্ধ ছিলেন এবং গোপালের বাবা শত্রুর দমন এবং বিপুল কীর্তিকলাপে সসাগরা বসুন্ধরাকে ভূষিত করেছিলেন। সুতরাং গোপাল কোনো সামন্ত কিংবা রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর বাবা যুদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং গোপালও সম্ভবত বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রবীণ ও সুনিপুণ যোদ্ধা বলে পরিচিত হয়েছিলেন। অনেক পণ্ডিত গোপালের ছেলে ধর্মপালের সমসাময়িক একটি গ্রন্থে 'রাজভটাদি বংশ পতিত'-এর ব্যাখ্যায় মনে করেন, গোপাল খৰ বংশীয় রাজাভটের বংশধর।
'পাগ্ সাম্ জাং' নামের তিব্বতীয় গ্রন্থ, গুজরাটের কবি সোড্ঢলের 'উদয়সুন্দরী কথা' চম্পুকাব্যে এবং তৃতীয় বিগ্রহ পালের মন্ত্রী বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসনে পাল রাজাদের 'সূর্যবংশীয়' বলা হয়েছে। অন্যদিকে সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত 'রামচরিত' এ গোপালের ছেলে ধর্মপালকে 'সমুদ্রকূলদীপ' অর্থাৎ সমুদ্র বংশোদ্ভূত বলা হয়েছে। আবার রামচরিত কাব্যের প্রথম সর্গের সপ্তদশ শ্লোকের টীকায় তাঁদের 'ক্ষত্রিয়' বলা হয়েছে। রাষ্ট্রকূট ও কলচুরি বংশীয় রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধও পালদের ক্ষত্রীয় বংশে জন্ম সমর্থন করে। তিব্বতীয় লামা তারনাথ বলেন, 'রাজা গোপাল এবং বৃক্ষ দেবতার ঔরসে ক্ষত্রিয় রমণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তবে নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, পাল বংশের শাসকরা উচ্চ বংশের ছিলেন না।' আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পে পালদের দাসজীবী অর্থাৎ নিম্নজাতি বলা হয়েছে।
আবুল ফজলের মতে, পাল রাজারা ছিল 'কায়স্থ'। রমেশচন্দ্র মজুমদার ওপরের মতবাদগুলোর বিরোধিতা করে বলেন, গোপাল পুণ্ড্রবর্ধননিবাসী এক ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরে ভঙ্গল অর্থাৎ বাঙাল বা বঙ্গদেশের রাজা নির্বাচিত হন। বস্তুত প্রথম মহীপালের বানগড় তাম্রলিপিতে যে রাজ্যম পিত্র্যমের উল্লেখ আছে, তা উত্তরবঙ্গ বলে মনে হয় অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ পাল বংশের বা গোপালের আদি বাসস্থান ছিল এবং এ অঞ্চলেই তারা প্রথম ক্ষমতা বিস্তার করেছিল।
একথা বলা যায়, পাল রাজারা বাংলার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন এবং গৌড়ে সুদীর্ঘ ৪০০ বছর রাজত্ব করেন। তবে পাল বংশের প্রথম শাসক গোপালের রাজ্যকাল সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। তারনাথের মতে, 'তিনি ৪৫ বছর এবং আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্প অনুসারে ২৭ বছর রাজত্ব করেন এবং ৮০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।'
বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে, 'আনুমানিক ৭৫৬ থেকে ৭৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৫ বছর তিনি শাসন করেন। সার্বিক অবস্থা ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে বলা যায়, এ ক্ষেত্রে রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতোই গ্রহণযোগ্য। তাঁর মতে, 'গোপাল ৭৪০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা নির্বাচিত হন এবং আনুমানিক ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মহারাজাধিরাজ গোপালের মৃত্যুর পর শুরু হয় প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ 'ধর্মমঙ্গলের' অন্যতম চরিত্র ধর্ম পালের যুগ।
শশাঙ্কের রাজধানীর নাম ছিল ‘কর্ণসুবর্ণ’ যা আধুনিক মুর্শিদাবাদ। শশাঙ্ক ছিলেন সমগ্র গৌড়ের রাজা, যাহার রাজ্য সীমা বাংলা ছাড়িয়ে দক্ষিণ পূর্বে উড়িষ্যা ও পূর্বে কামরূপের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজা শশাঙ্কের সময়ই বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রচলন হয়, যদিও বলা হয় এই ক্যালেন্ডার বানাইয়া ছিলেন সম্রাট আকবরের এক গনৎকার সভাসদ। সে অন্য কথা।
৭৫০ সালে প্রথম পাল রাজা মধ্যযুগীয় বাংলার প্রথম শাসকের শাসন কালের শুরু। রাজা গোপাল ৮০-বৎসর বয়সে মারা যান তাঁর ছেলে ধর্মপালের হাতে সমস্ত রাজ্যপাট সমর্পণ করিয়া। সেই সময়ে সমগ্র বাংলা তাঁহার রাজ্য ছিল, যা তাঁহার ছেলে পরে আরও বর্ধিত করে। পাল শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘যারা পালন করেন।’ এই পালেরা ইহার পরে প্রায় ৪৫০ বৎসর বাংলার রাজা হিসেবে ছিলেন (২১ জন রাজা হইয়াছেন বংশানুক্রমে, যদিও তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ও শক্তিশালী রাজা ছিলেন মাত্র তিন জনই)। সে কথায় ক্রমে আসিতেছি। পালবংশের আমলের কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত ‘রামচরিতম্‌’ কাব্যে বলা হইয়াছে পালেদের আদি নিবাস উত্তর বাংলার বরেন্দ্র নামক এলাকা যাহাকে ওনারা ওদের পিতৃভূমি (জনকাভু) বলিয়া মনে করিতেন। গোপাল ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধ-সৈনিক ভাপ্যতার সন্তান (খালিমপুর তাম্র পত্রের লেখনী)। গোপালের পিতা ভাপ্যতা ছিলেন মহান যোদ্ধা (যাহাকে ডাকা হতো খণ্ডিত’রতি অর্থাৎ সমস্ত শত্রু নাশক; তাম্র পত্রের উদ্ধৃতি) আর ঠাকুর দাদা ছিলেন দয়িতবিষ্ণু (যিনি বিখ্যাত ছিলেন সর্ব্ব-বিদ্যাভদাতা নামে, অর্থাৎ যিনি সমস্ত প্রকার জ্ঞানে পারদর্শী, তাম্রপত্রের উদ্ধৃতি)। খালিমপুর জায়গাটি অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত মাগুরা সদর, খুলনা ডিভিশনের ও ঝিনাইদহ জেলার মধ্যে পড়ে। খালিমপুর তাম্রপত্র রাজা গোপালকে সূর্য বংশীয় বলিয়াও দাবী করে, যদিও ঐতিহাসিকদের ধারনা ও বিশ্বাস যে পরবর্তী কালে তাঁহার সাধারণ বংশ পরম্পরাকে গৌরবান্বিত করা ছাড়া সূর্য বংশীয় হইবার কোন ঐতিহাসিক লিপি বা প্রমাণ পত্র নাই। মধ্যযুগীয় লেখক আবুল ফজল পালেদের ‘কায়স্থ’ বলিয়াছেন তাঁহাদের আচার, ব্যাবহার, বিবাহ ও সামাজিক নিয়ম কানুন দেখিবার পরে। কোন কোন ঐতিহাসিক পালেদের সমুদ্র বংশীয় বা শূদ্রও বলিয়াছেন। কিন্তু ইতিহাস এ কথা অবশ্যই স্বীকার করে যে সাধারণ অবস্থার মধ্যে থাকিয়াও, সেই সময়ে সকলের ব্যক্তিগত মনোনয়নে (তাঁর অসাধারণ যুদ্ধ নীতি আর সুশাসন করিবার সহজাত ক্ষমতা) রাজা গোপাল যে রাজ ঘরানার সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহা সমগ্র বাংলা ও তাহার জনপদবাসীর জন্য আগামী ৪৫০ বৎসর সফলতার ধ্বজাই উড়াইয়াছে। ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে আসিয়া সেনেদের নিকট পালেদের শেষ পরাজয় ঘটে ও পাল বংশের অস্ত ঘটিয়া যায়।
মাৎস্যন্যায়:
রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে (সাল ৬২৫), বাংলায় এক ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়। তখন কোন একজন রাজা বা গোষ্ঠী নেতার হাতে সমগ্র বাঙ্গালার ক্ষমতা ছিল না। তাই শাসন নামক সজ্জাটি বাংলার ভৌগোলিক শরীরটিকে শত্রু হাত হইতে যেমন অরক্ষিত রাখিয়াছিল, তেমনই দূরদর্শিতা ও অনুশাসনের অভাবে গোষ্ঠীগত কোন উন্নতি সাধনই করিতে পারে নাই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এই সমস্ত কিছুই প্রজা সকলের কাছে অলভ্য ছিল। তীব্র তিব্বতি বহিরাক্রমণ এই সময় বাংলার উপরে আছড়ে পড়ে। ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভাজিত হইয়া সকলেই নিজ নিজ গোষ্ঠীপতির পতাকাতলে আশ্রয় লয়। এই ভাবে, অনাচার ও অত্যাচারের চরম সীমায় পৌঁছাইয়া যায় বাংলা। কিছু ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের চারি পাশে হয়তো গোটা একটি জনপদ বা গ্রাম, আশ্রয় হেতু ভিড় করিয়া থাকিলেও থাকিতে পারে, ॥
কিন্তু সমগ্র বাংলা – বিহার–উড়িষ্যা এক নিদারুণ অশান্তি ও কষ্টের সহিত কালাতিপাত করিতেছিল। ৬২৫ সালের পরে ৭৫০ সাল পর্যন্ত (প্রায় ১২৫ বছর) এই এলাকাটি স্থানীয় শক্তিমান কিছু সমাজপতি (আজিকার গুণ্ডা সম্প্রদায়) এবং বহিরাগত তিব্বতি সম্প্রদায়, সেই প্রকার কিছু মানুষের হাতে ছিল। সকলেই নিজ নিজ মত ও শক্তি অনুযায়ী এলাকা দখলের সুবিধা লইয়া ছিলেন। জনসংখ্যার অপ্রতুলতা, অর্দ্ধশিক্ষা, কিন্তু ব্যবহারিক জীবন যাপনের কোনও অসুবিধা না থাকিবার কারণে (যেমন খাদ্যাদি, পণ্য, শস্য, গরু, মোষ, ফল ইত্যাদির অঢেল উৎপাদন) বাঁচিয়া থাকিবার কোনও যুদ্ধ তাহাদের করিতে হয় নাই। কিন্তু অগ্রগতিরও কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকেরা এই সময়কে বলেন ‘মাৎস্য ন্যায়’ রাজনীতির বাংলা। অর্থাৎ, বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে ভক্ষণ করিয়া থাকে, তাহার নিজের খেয়াল খুশী মতো, বাঙ্গালাতেও ঠিক তেমনই সামাজিক কাঠামোর মধ্যে জনপদ গুলি দিনাতিপাত করিতেছিল। বাংলায় শশাঙ্কের সমসাময়িক অন্য রাজারা হইলেন হর্ষবর্ধন (উত্তর ভারতবর্ষ) আর ভাস্কর বর্মণ (কামরূপ)।
শশাঙ্কের পর দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলনা। ফলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও আরজকতা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় শাসন শক্তভাবে ধরার মত কেউ ছিলনা। সামনত্ম রাজারা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে থাকেন। এ অরাজকতাপূর্ণ সময় (৭ম-৮ম শতক) কে পাল তাম্র শাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে। পুকুরে বড় মাছগুলো শক্তির দাপটে ছোট মাছ ধরে ধরে খেয়ে ফেলার বিশৃঙ্খল পরিসি'তিকে বলে ‘মাৎস্যন্যায়’। বাংলার সবল অধিপতিরা এমনি করে ছোট ছোট অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করেছিল।
গোপাল (৭৫৬-৭৮১ সাল) ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার অরাজকতা পরিস্থিতি অবসান ঘটে পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে। পাল বংশের প্রথম রাজা ছিলেন গোপাল। বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু হয় পাল বংশের রাজত্বকালে। পাল বংশের রাজারা একটানা চারশত বছর এদেশ শাসন করেছিলেন। এত দীর্ঘ সময় আর কোন রাজবংশ এদেশ শাসন করেনি। পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ সাল) পাল রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন গোপালের পুত্র ধর্মপাল। একজন শক্তিশালী রাজার প্রজাপালক এবং শাসক হিসেবে যা যা গুণ একজন রাজার মধ্যে থাকা উচিত তাহা পুরো মাত্রায় রাজা ধর্মপালের মধ্যে প্রাপ্ত ছিল। তিনি তাঁহার পিতার নিকট হইতে প্রাপ্ত যুদ্ধবিদ্যায় কুশলতো ছিলেনই, তাঁহার সহিত কূটবুদ্ধি রাজনীতিজ্ঞও ছিলেন। তিনি গুর্জর প্রতিহারদের নিকট দু-দুবার যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন ঠিকই (সম্পদ ও লোকক্ষয়), কিন্তু শত্রুর শত্রু যে মিত্র, তাহা চিনিয়া লইতে ভুল বা দেরী করেন নি, আর রাষ্ট্রকূটদের সাথে নিজের জীবন ও সাম্রাজ্যের সুরক্ষা সুনিশ্চিতকরণের জন্যে তাদের সাথে আত্মীয়তার সূত্রেও বাংলাকে বাঁধিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই তাঁহাকে অন্য পাল রাজাদের হইতে আলাদা প্রতীত করিয়া থাকে। ধর্মপাল যুগে তিনটি রাজবংশ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে। একটি বাংলার পাল বংশ আর অন্যটির রাজপুতানার গুর্জর প্রতীহার বংশ এবং তৃতীয়টি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকুট বংশ। ইতিহাসে এ যুদ্ধ পরিচিত হয়েছে ‘ত্রিশক্তির সংঘর্ষ’ (ঞৎরঢ়ধৎঃরঃব ডধৎ) নামে।
রামপাল (১০৮২-১১২৪ সাল) পাল বংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন রামপাল। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন' থেকে রামপালের রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। বরেন্দ্র এলাকায় পানিকষ্ট দূর করার জন্য তিনি অনেক দীঘি খনন করেন। দিনাজপুর শহরের নিকট যে ‘রামসাগর’ রয়েছে তা রামপালের কীর্তি।
পাল রাজাদের অমর সৃষ্টি :
সোমপুর মহাবিহার, অধুনা পাহাড়পুর, নওগাঁও জেলা, বাংলাদেশে অবস্থিত, (উপরের ছবিটি দেখুন) তখনকার মিলিত বাংলার সব থেকে বিরাট বৌদ্ধবিহারের স্থাপনা করেন রাজা ধর্মপাল তাঁহার রাজত্বকালের সময়। ১৯৮৫ সালে এই মহাবিহারটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত করা হয়েছে। এই সোমাপুরা বিহার ২১ একর জমির ওপরে বিস্তৃত ছিল (প্রায় ৮৫,০০০ বর্গমিটার)। যাহার মধ্যে ১৭৭ টি প্রকোষ্ঠ, অগুনিত স্তূপ, মন্দির ও আনুষঙ্গিক গৃহাদি ছিল। এ ছাড়া আরও নানা বৌদ্ধ বিহার পালেদের হাতে তৈরি হয়, যেমন বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী (গোপালের দ্বারা) এবং জগদ্দল-যেগুলি সবই ওই সময়কার স্থাপত্যের উন্নত শৈলীর সুচারু নিদর্শন ছিল। এই সব বৌদ্ধবিহারগুলি কেবল শাস্ত্রালোচনা, শিক্ষা, পুঁথি-রচনা ও ঈশ্বর সাধনারই স্থান ছিল না, এগুলি শিল্পের (যে কোন শিল্প যেমন, স্থাপত্য, অংকন, চিত্রাদি প্রকরণ) এক মেল-বন্ধন ছিল, যা পালেদের সময় এক সার্বিক উচ্চতা লাভ করিয়াছিল, এবং তাহাদের পরে সেনেদের সময়ও তা বজায় ছিল। দেশজ শিল্পীরা তাহাদের শিল্পের মধ্যে নেপাল, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, জাভা ইত্যাদি দেশের নিজস্বতাটুকুকে আয়ত্ত করিয়াছিলেন আর এই ভাবেই নানা দেশের কলাকৃতি ভারতের মধ্যে ও ভারত থেকে বাহিরে আসা যাওয়া করিয়াছিল। আজ যাহাকে আমরা সাংস্কৃতিক লেনদেন বলিয়া থাকি।
রাষ্ট্রকূটের সহায়তা দু দুবার পাইবার পরে, রাজা ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট দুহিতা ও রাজকন্যা রন্নাদেবীকে বিবাহ করেন আর দুই মহা শক্তির মধ্যে সখ্যতার বন্ধন আত্মীয়তার বাঁধনে অটুট হইয়া যায়। ধর্মপাল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে উত্তর-মধ্য ভারতে তাঁহার ক্ষমতা ও অধিকার বজায় রাখতে পারিয়াছিলেন তাহা এই মিলিত শক্তির দান হিসেবে। পূর্বে বাংলা থেকে উত্তর-মধ্য ভারতের কনৌজ পর্যন্ত আর দক্ষিণে রাষ্ট্রকূট রাজাদের সীমানা পর্যন্ত সে পাল রাজাদের মুদ্রা জনগণের কাছে গ্রহণীয় ছিল। এই মুদ্রা সোনা ও রৌপ্যের সাথে তামা মিশ্রণ করিয়া প্রস্তুত করা হইয়াছিল।
মুদ্রার ইতিহাস:
মুদ্রা গলায় লকেট-রূপে ব্যবহৃত হইত কেননা মুদ্রার শীর্ষদেশে ছিদ্র দৃশ্যমান, যাহার ভিতর দিয়ে সোনা বা রুপোর চেইন/সুতো পরাইয়া লওয়া হোতো, যাহাতে মুদ্রাটিকে বক্ষের নিকট ঝুলাইয়া রাখা যায়। মুদ্রার (বামদিকে) দেখা যাইতেছে, রাজা ঘোড়ার পৃষ্ঠে, দক্ষিণ হাতে বর্শা লইয়া, সিংহ বা শূকর জাতীয় কোন প্রাণী শিকার করিতেছেন যেটি তাঁহাকে বামপার্শ্ব হইতে আক্রমণ করিয়াছে। মুদ্রার (ডানধারে) ব্রাহ্মীলিপিতে কিছু লিপি লিখিত রইয়াছে... শ্রী/মান ধা/রমা পা/ লাহ, আবার ঘোড়ার সম্মুখ পায়ের কাছে লিখিত দুটি লাইন, কাই/লা, পেছনের পায়ের কাছে লিখিত ভো। মুদ্রার উল্টোদিকে মহালক্ষ্মী দেবী পদ্মাসনে বসা মূর্তি, যাহার দুই হাতে পদ্ম, তাঁহার দুধারে পবিত্র পাত্রদ্বয় (পূর্ণ ঘট), আর উপরে লিখিত বাম দিকে শ্রী।
পাল শাসন আমলে প্রশাসনিক
অবস্থা :
গুপ্ত তাম্রশাসনে ভূমি বিক্রয় পদ্ধতি সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে ক্রেতা সংশ্লিষ্ট অধিকরণে কি উদ্দেশ্যে, কোন্ জমি এবং কতখানি ক্রয়ে ইচ্ছুক তা উল্লেখ করে আবেদন করতেন। আবেদনকারীকে স্থানীয় প্রচলিত মূল্য অনুযায়ী উক্ত জমির মূল্যদানের স্বীকৃতি তার আবেদনে উল্লেখ করতে হতো। তাছাড়া প্রস্তাবিত জমির নির্ধারিত মূল্য প্রচলিত স্থানীয় মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এবং তা অহস্তান্তরযোগ্য কিনা তাও আবেদনে উল্লেখ করতে হতো। জমি ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তির নিকট থেকে আবেদন প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট অধিকরণ আবেদনপত্রটি দলিল-সংরক্ষকের (পুস্তপালের) দপ্তরে প্রেরণ করত। আবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবেদনকারী কর্তৃক উল্লিখিত শর্তে তাকে জমিটি দেওয়া যায় কিনা সে সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে হতো। ‘পুস্তপালে’র দপ্তর বিক্রয় অনুমোদন করলে এবং ভূমির মূল্য রাজকোষাগারে জমা হলেই কেবল ভূমি ক্রয়ে আগ্রহী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ভূমির অধিকার লাভ করতেন এবং বিক্রয়কার্য সম্পাদিত হতো। এরপর বিক্রয়কার্য সম্পাদন তাম্রশাসনে পট্টীকৃত হতো এবং বিক্রিত ভূমির উপর অধিকারের দলিল হিসেবে তাম্রশাসনটি ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হতো।
ভূমির মূল্য কিভাবে পরিশোধ করা হতো এ সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা গুপ্ত লিপিমালায় নেই। বিক্রিত ভূমির মূল্যের তারতম্য ছিল। ভূমির ধরন অথবা বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত দরের পার্থক্যের কারণে এ তারতম্য দেখা দিত। গুপ্ত আমলের লিপি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভূমি ক্রয়ের জন্য জেলা বা গ্রামের যে কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন পেশ করা হতো সেখানেই ভূমির পূর্বনির্ধারিত মূল্য জমা দিতে হতো। ভূমির মূল্য সরাসরি ‘বিষয়’ বা ‘গ্রাম’ কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করত কিনা বা অন্য কোন সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা করা হতো কিনা তা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে এ প্রসঙ্গে তাম্রশাসনসমূহে অন্য কোন সরকারি সংস্থার নামোল্লেখ না থাকায় এটি মনে করা যেতে পারে যে, ভূমি গ্রহীতাদের নিকট থেকে মূল্য সংগ্রহের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনকেই পালন করতে হতো।
লিপিমালা ভিত্তিক উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, পাল-পূর্ব যুগে বাংলার রাজ্যশাসন পদ্ধতি পুরোপুরি সুবিন্যস্ত না হলেও এক্ষেত্রে ঐ যুগে কিছু অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। সমসাময়িক শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এটি উল্লেখযোগ্য যে, পূর্বোল্লিখিত প্রশাসনিক কাঠামো আমাদের আলোচ্য সম্পূর্ণ সময়কালে প্রচলিত ছিল না। এটি ছিল প্রশাসনিক সংস্থার প্রাথমিক পর্যায়ের অবস্থা যা পরবর্তীকালে উন্নততর করা হয়েছিল।
পাল বংশের দীর্ঘ শাসনে বাংলায় প্রথমবারের মতো এক শক্তিশালী ও স্থায়ী রাষ্ট্রপ্রশাসন ব্যবস্থা সূচিত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এ যে, প্রাপ্ত উপাদানসমূহ থেকে পাল প্রশাসন-ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে প্রাপ্ত উপাদানের ভিত্তিতে প্রশাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের এক রূপরেখা প্রণয়ন করা সম্ভব। বাংলায় প্রচলিত গুপ্ত প্রাদেশিক শাসন কাঠামোর উপরই পাল রাজাদের আমলে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যুগেও পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘যুবরাজ’ নামে অভিহিত হতেন। যুবরাজের দায়-দায়িত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। গুপ্তযুগের মতো এ যুগেও রাজপুত্রকে ‘কুমার’ নামে অভিহিত করা হতো। ‘কুমার’ প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদের মতো উচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্ব পেতেন। এ পদে থাকাকালে কুমারগণ রাজার সামরিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
সাম্রাজ্য প্রশাসনে পাল রাজাদের বহুসংখ্যক কর্মচারী ছিলেন যাদের প্রধান ছিলেন ‘মন্ত্রী’ বা ‘সচিব’। পাল রাজাদের শাসনামলেই সর্বপ্রথম রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায় যার পদমর্যাদা প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ। দেবপালের বাদল স্তম্ভলিপি থেকে এ পদের ক্ষমতা ও মর্যাদার বিষয়টি জানা যায়। ধর্মপালের রাজত্বকালে গর্গ নামে একজন ব্রাহ্মণের পরিবারের সদস্যদের জন্য বংশানুক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদ সংরক্ষিত ছিল। গর্গের বংশধরগণ (দর্ভপাণি, সোমেশ্বর, কেদারমিশ্র ও গুরবমিশ্র) পরবর্তী এক শত বছর প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। তারা সকলেই পাল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সুদৃঢ়করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে এরূপ আর এক মন্ত্রী বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। যোগদেব ছিলেন তৃতীয় বিগ্রহপালের এবং তাঁর উত্তরাধিকারী বৈদ্যদেব ছিলেন কুমারপালের প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বংশানুক্রমিক নীতি পরবর্তী চন্দ্র ও যাদব রাজবংশের ক্ষেত্রেও প্রচলিত ছিল। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তি থেকে এর প্রমাণ মেলে।
পাল রাজাদের অধীনে অনেক সামন্ত রাজা ছিলেন। পাল তাম্রশাসনে তাদেরকে ‘রাজন’, ‘রাজন্যক’, ‘রণক’, ‘সামন্ত’ ও ‘মহাসামন্ত’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ সকল পদবির প্রকৃত অর্থ ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা কঠিন। তবে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, তারা ছিলেন শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন। কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগে এ সামন্ত রাজারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের জন্য রামপালের চৌদ্দ জন সামন্তের সহায়তা চাওয়ার ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কখনও কখনও সামন্ত প্রধানদের সাহায্যের উপর পাল রাজাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হতো।
পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় পাল যুগেও বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট যেমন ‘ভুক্তি’, ‘বিষয়’, ‘মন্ডল’সহ অন্যান্য ছোট ছোট বিভাগের প্রচলন ছিল। পাল যুগের লিপিমালায় বাংলায় পুন্ড্রবর্ধনভুক্তি, বর্ধমানভুক্তি ও দন্ডভুক্তি, উত্তর বিহারে তীরভুক্তি, দক্ষিণ বিহারে শ্রীনগরভুক্তি এবং আসামে প্রাগজ্যোতিষভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল লিপিমালা থেকে অনেক ‘বিষয়’ ও ‘মন্ডল’ এর নামও জানা যায়। এছাড়া ‘খন্ডল’, ‘আবৃত্তি’ ও ‘ভাগ’ নামে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ রয়েছে। ‘আবৃত্তি’সমূহ বিভিন্ন ‘চতুরকে’ এবং ‘চতুরক’গুলি সম্ভবত বিভিন্ন ‘পাটকে’ বিভক্ত ছিল। এ বিভাগগুলির যথার্থ প্রকৃতি নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। পাল শিলালিপিতে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মচারীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল ভূমিদান-লিপিতে প্রশাসনিক বিভাগগুলির দায়িত্বে নিয়োজিত রাজকর্মচারীদের সুদীর্ঘ তালিকা থেকে বোঝা যায় যে, এ বংশের শাসনামলে রাজ্যশাসন ব্যবস্থা দক্ষ ও খুবই বিশদ ছিল। তবে এ সকল রাজকর্মচারীর ক্ষমতা ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান সীমিত। রাজকর্মচারীদের এ সুদীর্ঘ তালিকা থেকে পাল প্রশাসনযন্ত্রের ব্যাপক পরিধিসহ বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করা যায়। একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, পাল লিপিমালায় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার উপর বেশ আলোকপাত করা হলেও সেগুলিতে সমসাময়িক প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ নেই। এ যুগে পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় বিভিন্ন ‘অধিকরণের’ প্রচলন অব্যাহত ছিল কিনা বা থাকলেও তাদের গঠন কেমন ছিল তা জানার কোন উপায়ই লিপিগুলিতে বা অন্যত্র কোথাও নেই। তবে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে হলেও এ অধিকরণগুলির অব্যাহত ব্যবহারের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পাল যুগের শাসনব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি প্রকৃতপক্ষে সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করতেন। রাজা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজ্যশাসনে ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করতেন। ‘যুবরাজ’ ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এ যুগে রাজ্যে আরও অনেক ‘মন্ত্রী’ ছিলেন। এদের মধ্যে ‘মহাসান্ধিবিগ্রহিক’, ‘রাজমাত্য’, ‘মহাকুমারমাত্য’ এবং ‘দূত’ ছিলেন প্রধান। ‘মহাসান্ধিবিগ্রহিক’ ছিলেন যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অর্থাৎ অনেকটা আজকের দিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর অনুরূপ। ‘রাজমাত্য’ বলতে সম্ভবত সাধারণভাবে কনিষ্ঠ মন্ত্রীদের বোঝাত। ‘মহাকুমারমাত্যে’র প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় করা যায় না। ‘দূত’ ছিলেন বিদেশি রাজ্যের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষাকারী রাষ্ট্রদূত। উপরিউক্ত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের পরেই এ যুগে ‘অমাত্য’ নামক পদস্থ রাজকর্মচারীর নাম পাওয়া যায়। অন্যান্য উচ্চ রাজকর্মচারীর মধ্যে ‘অঙ্গরক্ষ’ (সম্ভবত রাজার দেহরক্ষী দলের প্রধান) এবং ‘রাজস্থানীয়’র (সম্ভবত রাজ প্রতিনিধি বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা) নাম উল্লেখ করা যায়। ‘অধ্যক্ষ’ নামে কেন্দ্রীয় শাসনের সঙ্গে জড়িত আরও এক ধরনের রাজকর্মচারী থাকতেন যার দায়িত্ব ছিল সাধারণভাবে সামরিক প্রশাসন বিভাগের তত্ত্বাবধান করা। ‘প্রমাতৃ’ ও ‘ক্ষেত্রপ’ নামে আরও দুধরনের কর্মচারীর নাম পাওয়া যায় যারা কেন্দ্রীয় শাসনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সম্ভবত তাদের কার্যক্রম সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধে সীমাবদ্ধ ছিল অথবা তারা ছিলেন জমি জরিপ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। কোন কোন পন্ডিত মনে করেন যে, ‘প্রমাতৃ’ ছিলেন দীউয়ানি মামলার বিচারক।
রাজস্ব প্রশাসন রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, এ যুগে বিভিন্ন ধরনের রাজস্ব আদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। কৃষিভূমির রাজস্ব আদায় করতেন বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের প্রধানগণ যেমন ‘উপরিক’, ‘বিষয়পতি’, ‘দাশগ্রামিক’ ও ‘গ্রামপতি’। রাজস্বের খাত ছিল ‘ভাগ’, ‘ভোগ’, ‘কর’, ‘হিরণ্য’, ও ‘উপরিকর’ প্রভৃতি। এ সকল করের প্রকৃতি নির্ণয় করা কঠিন। তাম্রশাসনে ‘ষষ্ঠাধিকৃত’ নামে রাজস্ব কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি কৃষকদের নিকট থেকে রাজস্বের এক-ষষ্ঠাংশ রাজার প্রাপ্য হিসেবে আদায় করতেন। ‘ভোগ’ কর আদায়ের দায়িত্বে সম্ভবত নিয়োজিত ছিলেন ‘ভোগপতি’। খেয়া পারাপার ঘাট থেকে সম্ভবত রাষ্ট্রের আয় হতো এবং খেয়াঘাটের মাশুল সংগ্রহ করত ‘তরিকা’ নামক কর্মচারী। উপশুল্ক ও আবগারি কর আদায় বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ‘শৌল্কিক’। চোর-ডাকাতদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষার জন্য আরোপিত কর আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ‘চৌরোদ্ধরণিক’। ফৌজদারি অপরাধের জন্য আরোপিত অর্থদন্ড আদায় বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন ‘দশাপরাধিক’। শিলালিপিতে উল্লিখিত ‘মহাক্ষপটলিক’ নামীয় রাজস্ব কর্মকর্তা ‘জ্যেষ্ঠ কায়স্থ’ নামক কর্মচারীর সহযোগিতায় হিসাব বিভাগের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ‘মহাদন্ডনায়ক’ ছিলেন বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। ‘মহাপ্রতিহার’,’দন্ডিক’, ‘দন্ডপাশিক’ ও ‘দন্ডশক্তি’ উপাধিধারী কর্মকর্তারা পুলিশ বিভাগ পরিচালনা করতেন। ‘খোল’ সম্ভবত ছিলেন গুপ্তচর বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা।
সামরিক প্রশাসন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন ‘সেনাপতি’ বা ‘মহাসেনাপতি’। তিনি ছিলেন রাজার সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তি ও উষ্ট্র বাহিনী এবং নৌবাহিনীর জন্য মহাসেনাপতির অধীনে একজন করে স্বতন্ত্র কর্মকর্তা নিযুক্ত থাকতেন। পাল রাজাদের অধিকাংশ শিলালিপিতে ‘গৌড়-মালব-খাশ-হুণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট বাক্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের এ সকল উপজাতীয় লোকদের মধ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে পাল রাজারা রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী গঠন করতেন। শিলালিপিতে বিশেষ কর্মচারী হিসেবে দুর্গাধিপতি ‘কোট্টপাল’ এবং রাজ্যের সীমান্ত রক্ষক ‘প্রান্তপাল’- এর উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও পাল তাম্রশাসনে আরও অনেক রাজ কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ঐ সকল কর্মচারীর নামের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা কঠিন বিধায় তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় না।
মুক্ত বুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
তথ্যসূত্র
[1] ভারতবর্ষ আর বঙ্গালারদেশ কোন অর্থে’ই কোনকালেই এক ছিলোনা, কেননা বাঙ্গালারদেশ বরাবরের মত বাঙ্গালারদেশ’ই, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মত নয় । সম্ভবত সে কারনেই রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও বাঙ্গালার সাথে ভারতবর্ষের কোন মিল নেই। তাই বাঙলার ইতিহাস নিয়ে আমরা যে সব আলোচনা পাই তারমধ্যে একমাত্র নীহাররঞ্জন রায়ের গ্রন্থটিকেই তুলনামূলক ভাবে কম বিতর্কমূলক দলিল হিসেবে পেলেও তবুও অসম্পুর্ন। বাকি গ্রন্থগুলো সেই কলকাতা ঘরানা থেকে মুক্ত হতে পারে নি। তাই বাঙলার ইতিহাসে পুর্ববঙ্গের ইতিহাসকে নিয়ে যে ভাবে অবহেলা আমরা দেখতে পাই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের পরম নমস্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তাই বাঙলার ইতিহাস আজোঅবধি বিতর্কিতভাবে অসম্পুর্ন। এই ইতিহাস এখন নতুন করে লেখার ভার আমাদের নয়া প্রজন্মের।
[2] নির্মলকুমার বসু, “বঙ্গদেশের জাতি ব্যবস্থাঃ কয়েকটি প্রসঙ্গ,” জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ, আইসিবিএস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮,পৃষ্টাঃ ১০৫।
[3] এই আলোচনায় হিন্দু কে ধর্ম হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়নি তাই এই হিন্দু কে একটি সমাজ হিসেবে দেখা হয়েছে। এই আলোচনায় আমরা হিন্দুসমাজ হিসেবে গ্রহণ করবো।
[4] বিবেকান্দের এই বক্তব্যটি সিরাজুল ইসলামের “বাঙালীর জাতীয়তাবাদ” গ্রন্থের পৃষ্টা ১৯ থেকে সংকলিত হয়েছে।
[5] যদিও আওয়ামীলীগ ঘরানার বুদ্ধিজিবিদের অনেকের মতে বাঙ্গালার সুলতানি শাসনামলেই বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিকাশ আর অন্যদিকে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজিবিদের দাবি মধ্যযুগের শেষভাগের আরকান রাজার সভাকবি আলাওল’ই প্রথম বাঙ্গালারদেশি জাতিসত্তার আবিষ্কারক। তবে আরকান রাজার পৃষ্টপোষকতার বদৌলতে আজ বাঙ্গালা ভাষা এবং তার সাহিত্যে যে ব্যপকতা আসে সে সম্পর্কে বললে বেশী বলা হবে না।
[6] সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ-পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্কণ, ভাষার দায় ও দায়িত্ব, পৃঃ ২।
[7] ভারতে কোম্পানি আমলে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বাঙলায় হিন্দু-মুসলিম জাতি ব্যবস্থা শিতিল হয়েছে তা ঠিক নয়, বরং এই জাতিব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্টানগুলির প্রকৃতি নির্ধারনে এক তাৎপর্যপুর্ন ভুমিকাও পালন করেছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, হিন্দুবাদীতামনা বলে অভিযুক্ত করে কংগ্রেস থেকে মুসলিম সামাজ বের হয়ে এসে একটি মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ।
[8] এবনে গোলাম সামাদ, হাজার বছরের বাঙালী, অন্য এক দিগন্ত, জুন সংখ্যা-২০১৫, পৃষ্টাঃ ৫।
[9] ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরুধী আন্দোলন যখন স্বদেশী আনদলনে রূপ নেয় তখন কেবল মাত্র কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু সমাজ এর পেছনে নেতৃত্ব দেয়। পুর্ব বাঙলার কোন হিন্দু সমাজ এই স্বদেশী আনলনে যোগ দেয় নি। বরং পুর্ব বাঙলার হিন্দু সমাজ বাঙলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে ব্রিটিশ গভর্মেন্টের চিরস্থায়ীত্বের জন্যে পার্থনা করেন। এমনকি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেয়ার জন্যে দাক্ষিণ্য প্রাথনা করেন। (দেখুনঃ নির্মলকুমার বসু, “বঙ্গদেশের জাতি ব্যবস্থাঃ কয়েকটি প্রসঙ্গ,” জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ, আই, সি, বি, এস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮, পৃষ্টাঃ ১১৮)
[10] এই দুইজন মারা যায় ১৯০৮ সালে। তারা আসলে বাঙলা রক্ষার নামে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের স্বপক্ষে ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। যা আজ তাদেরকে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মী হিসেবে প্রতিষ্টা দিতে চাচ্ছে। এরা সবাই বঙ্কিমের বান্দেমাতারাম স্বদেশী আন্দোলন করেছিলেন। এরা এখন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের ভাষায় বাঙলা ভাষার জন্যে লড়াইয়ের সেনানী। এদিকে ভারতীয়রা দাবী করছে তারা নাকি ভারতের ফ্রিডম ফাইটার। তাহলে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মূল নায়করা সন্ত্রাসী হিসেবেই ইতিহাসে প্রতিষ্টা পায়। স্বদেশীআন্দোলনের বীজ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনেই নিহিত। তাই এই স্বদেশীআন্দোনের কর্মকাণ্ড ১৯১১ সালের পর সিতিল হয়ে যেতে দেখতে পাই।
[11] বঙ্গভঙ্গ, প্রমথনাথ বিশী, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শতবার্ষিকী সংস্করণ, ব্যাখ্য
[12] নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসঃ রাজন্য কাণ্ড, সম্পাদনাঃ কমল চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম দে’জ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃষ্টাঃ ২৬৮-২৭০।
[13] দেখুন রমাই পণ্ডিতের রচিত শূন্যপুরাণ। এটি একটি পুরাণ ইতিহাসের গুরুত্বপুর্ন দলিল।
[14] হিতেশরঞ্জন সান্যাল, “বাংলায় জাতি’র উতপত্তি”, জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, “জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ,” আইসিবিএস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮,পৃষ্টাঃ ২২-২৩।
[15] হাল বা লাঙ্গলের আদি শব্দ হলো ‘হল’, তাই এই প্রবন্ধে ‘হল’ এর স্থলে ‘হলো’ শব্দটি অধিক যুক্তিযুক্ত বলে গৃহীত হয়েছে।
[16] অনেক সময় অনেক পুরুষের রক্তের সংমিশ্রনে চুলের বাহ্যরূপ এবং বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে খণ্ডিত চুলের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা এই আলোচনায় সম্ভব নয়। উৎসাহীরা সাঁ-মার্তার (সেইন্ট মার্টিন) বই পড়ে নিতে পারেন।
[17] পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের অধিকাংশ জনবাসিগনের মধ্যে এই বিশিষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
[18] বৈদিক সাবল্টার্ন বা নিম্নবর্গ তত্বের বিবেচনায় এরা নিচু শ্রেণির।
[19] আল্পস পর্বতমালা বিষয়ক।
[20] বৈদিক সাবল্টার্ন বা নিম্নবর্গ তত্বের বিবেচনায় এরা উচু শ্রেণির বা ব্রাহ্মণ। এরা উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণদের নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত।
[21] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২২, ২৪ এবং ২৫।
[22] ডঃ অতুল সুর তার গ্রন্থ “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” এবং “বাঙালীর নৃতত্বে” কেবল কিছু সাহিত্যিক এবং ইতিহাসগত পুরাতাত্ত্বিক আলোচনা ছাড়া খুব বেশি বৈজ্ঞানিক আলোচনা করেন নি। বাঙালীর ডিএনএ টেস্ট নিয়ে অনলাইন এ বিস্তর বৈজ্ঞানিক জার্নাল আছে। পাঠক চাইলে পড়ে নিতে পারেন। ডিএনএ টেস্ট দাবী করছে অধিকাংশ বাঙালীর নৃতত্ত্ব বিশিষ্টটা পায় টিবেতো- মোঙ্গলয়েড পর্যায়ভুক্ত। তবে ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা রীজলির নিম্ন শ্রেণির বাঙালীদের প্রাক দ্রাবিড়-মোঙ্গলয়েড অভিমতকে গ্রহণ করেছেন।
[23] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২৫।
[24] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২৫।
[25] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ২।
[26] ড অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, সাহিত্যলোক, কলকাতা, এপ্রিল ২০১২, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৯। ভারতে আর্য-ভাষাভাষীর দুই বিভিন্ন নরগোষ্টিতে বিভক্ত-(১) অলপীয়, (২) নর্ডিক। তাদের পার্থক্য কেবল মাথার আঁকার এবং কপালে। দেখুনঃ ড অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, সাহিত্যলোক, কলকাতা, এপ্রিল ২০১২, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৪২।
[27] বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, রাঙামাটি, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০১৮, ঢাকা পৃষ্টাঃ ৪৩।
[28] পবিত্র সরকার, ভূমিকা আলোচনা, হরপ্রশাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত “বৌদ্ধ গান ও দোহা”,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, পুনঃমুদ্রণ, মাঘ ১৮১৯।
[29] খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশশ্তিতে সমতট নামটি প্রথম জানা যায়। নামটির মাজেজা হচ্ছে ভুভাগে সমতল নদীতট, উচু নিচু নয়। ফলে নিম্ন গঙ্গেয় ভূমি এবং তার পুর্ব ও দক্ষিণ ভূমিকে বিবেচনা করলে সমতটের সংলগ্ন ভূমিকে বঙ্গাল (প্রচুর জলাভুমি অথবা তুলা উৎপাদনকারী অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পরে এই বঙ্গাল থেকেই বাঙ্গাল, বাঙ্গালা শব্দ এসেছে।
[30] পদ্মা আদিতে কোন নদী ছিলো না। এমনকি সে সময় তার কোন অস্থিত্ব ছিল কিনা ইতিহাসে পাওয়া যায় নি। ডঃ ওল্ডহ্যাম ১৮৭০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে উল্লেখ করেন যে, গঙ্গা নদীর মূলশ্রোত রাজমহলের পাহাড়ে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে গতি পরিবর্তন করে প্রথমে ছোট খনন করা খাল ভগীরথী হয়ে এবং পরে হুগলী নামে কলকাতার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। অনেক পরে ভু-আন্দোলন (সম্ভত বখতিয়ারের দিনাজপুর অবস্থানের ২০০ বছর আগে।) এবং ভগীরথীর তলদেশ পলিবালিতে ভরাট হয়ে পদ্মাদিয়ে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়। সুতরাং পদ্মা নদী হিসেবে তার রূপ আমরা দেখি না। বরং খাল হিসেবেই আমরা ইতিহাসে উল্লেখ পাই।
[31] চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়, পত্রাঙ্ক ৭৩। হরপ্রশাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত বৌদ্ধ গান ও দোহা থেকে সঙ্কলিত।
[32] অশোক বিশ্বাস,বাংলাদেশের রাজবংশীঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠাঃ ১৫-১৭।
[33] অশোক বিশ্বাস,বাংলাদেশের রাজবংশীঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠাঃ ১৯।
[34] পুর্নচন্দ্রদেব বর্মা চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত, প্রথম সংস্করণ-১৯২০, পৃষ্টাঃ ২১৩।
[35] বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন, টি এইচ লিউইন, উয়িলিয়াম হান্টার এবং পিইয়ারের বার্মা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক ইতিহাস গ্রন্থসমূহ।
[36] চট্টগ্রামের মানুষদেরকে চাটগাইয়া বলে।
[37] খন্দকার মুজাম্মিল হক সম্পাদিত সৈয়দ নুরুদ্দিনঃ জীবন ও গ্রন্থাবলী, বাঙলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৭। সৈয়দ নুরুদ্দিন চকরিয়া বাসী মধ্যযুগের কবি (১৭২৫-১৮০০)। তার লেখা ‘রাহাতুল কুলুব’ গ্রন্থের বংশলতিকায় উল্লেখ করেন তার পুর্ব পুরুষ গৌড়ের মহামারীতে জীবীকার খোঁজে চট্টগ্রামে চলে আসেন। মধ্যযুগের অনেক কবিদের বংশলতিকায় এ ধরণের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
[38] যে সমস্ত পূজা-পার্বন এখন আমরা রূপান্তরিত ব্রাহ্মণ্য হিন্দু বাঙালীদের পালন করতে দেখি তা মধ্যযুগের শুরুতেও প্রাক-দ্রাবিড়ীয়-আদি-অস্ট্রিক জনগোষ্টির গৃহের অভ্যন্তরে অন্ধকারে পড়ে ছিলো। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বাঙ্গালার পূজা পার্বন নিয়ে লেখা অনেক বিখ্যাত গবেষকদের বই বাজারে পাওয়া যায়। বিনয় ঘোষ, রেবতী বর্মন, ওয়াকিল আহমেদ, কাজী আব্দুল অদুদের অনেক বই এখনো পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষে স্থানীয় অনার্যদের দেবীদের (যেমন দুর্গা,কালি) সাথে আর্যদের দেবতার (শিব) বিয়ে-সংসারের (মনসা,কারতিক,গনেশ) মধ্য দিয়েই মূলত আর্যদের ভারতবাসস্থায়ীকরন এবং সম্ভত এখান থেকেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শুরু বলে অনেক ঐতিহাসিকদের অভিমত।
[39] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ১।
[40] গঙ্গা শব্দ থেকে গাং শব্দটি উতগত হয়েছে। এই গাং ইউরুপে পৌঁছে হয়ে গেলো বণিক পথ। সুতরাং নদী বিজ্ঞানের কাছে গঙ্গা একটি বণিক পথ মাত্র। প্রাচীন কালে বণিকদের যাতায়াত সুবিধার জন্যেই এই নদীকে খনন করা হয়েছিলো।
[41] পুরাণ মতে, রাজা সাগরের ৬০ হাজার পুত্র ছিল। রাজা সাগরের যজ্ঞের ঘোড়া ইন্দ্র চুরি করে পালিয়ে গিয়ে কলকাতার দক্ষিণে এসে পড়ে। এদিকে রাজা তার ৬০ হাজার পুত্রদেরকে ঘোড়া উদ্ধারের জন্যে মাটি কুঁড়ার নির্দেশ দেন। পুত্ররা মাটি খুঁড়ে কলকাতার দক্ষিণে কপিলমুনির আস্তানায় এসে ঘোড়া খুঁজে পান। মুনিকে চোর মনে করলে কপিলমুনি হুঙ্কার দিয়ে সকলে আগুনে দগ্ধ করেন। এরপর সাগর রাজা ভগিরথ সাগরদ্বীপের দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এসে সাগর রাজার ছেলেদের উদ্ধার করেন।
[42] পুরাণের যুগ যখন শুরু হয় তখন, এক দল দেব-উপাসনা শুরু করে এবং আরেক দল অসুর-উপাসনা শুরু করে। এর পর এই ভুখণ্ডে দুই গোষ্টিতে বিভক্ত হয়ে পড়লো অসুর আর দেব উপাসনার মধ্য দিয়ে।
[43] কৃত্তিবাস, লাইনগুলো কলিম খানের “ঝর্নাধারা থেকে সৃষ্টিধারা” প্রবন্ধ থেকে সংকলিত হয়েছে।
[44] The colonial British surveyors in India from the late 1700’s, in their quest for the origin of the Ganga River, have done extensive survey of the Himalayan region. Some of the illustrious surveyors were Captain Herbert, Rennel and Sir William Willcocks.
They and the other surveyors have recorded their findings in journals and book of their times. In these records, they emphatically and unambiguously state that the Ganga is not a natural river, but a man made river by the ancients of India. It started as a canal along with many other canals dug by the ancients. (See-Ganga: The Sign of Great Endeavour by Parvathy Menon)
[45] The Asiatic Annual Register: Or, a View of the History of Hindustan, and of the Politics, Commerce and Literature of Asia, Volume 3. Page 26-27, edited by Lawrence Dundas Campbell, E. Samuel.
[46] শহীদুল্লাহ মৃধা, বাংলাদেশের নদ-নদী গুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা, নদী সংখ্যা, ১৯৯৯-২০০০, পৃষ্টাঃ ৪১।
[47] চীনা পরিব্রাজক এবং ভিক্ষু হিউয়েন সাং (৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) কামরূপ গমনের সময় করতো নদীর বিরাট প্রবাহের কথা তিনি বলে গেছেন। এমনকি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি (১২০৪/১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) আসাম হয়ে তিব্বত গমনের সময় বিশাল করতয়ার ভীষণ রূপ দেখে বিশ্মিত হন। সে সময়ও করতোয়া গঙ্গার চেয়ে তিনগুন বড় ছিলো।
[48] বাঙলাকে ঘিরে আমরা পুরাণ থেকে যে সব তথ্য পাই তার বড় একটি অংশ লিখিত হয়েছিলো খ্রিষ্টিয় ১৪০০ শতক থেকে ১৭০০ শতকের। অল্প কিছু লিখিতি হয়েছিলো পাল আমলে। যার অধিকাংশই সেন আমলে প্রিতিলিপিত হয়ে নিজের করে নিয়ে হিন্দু পুরাণে রূপান্তরিত করেছে এমন প্রমাণ আমাদের অনেক ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং ভাষাত্বাত্ত্বিকরা করেছেন। পাল আমলের শেষের দিকে রচিত বৌদ্ধদের মৌলিক পুরাণগুলোর একটি বড়অংশ চৈতন্য দেবের উত্তানের ফলে হিন্দু পুরাণ নাম দিয়ে অনেক অধ্যায় সংযোজিত এবং প্রক্ষেপিত করেছে তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ বৌদ্ধদের রচিত শূন্যপুরাণ কে নকল করে অনেক পুরাণ হিন্দুদের নিজের করে নিয়েছে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড ইনামুল হক, ড মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ড সুকুমার সেন, আলী আহসান, ড আহমদ শরীফ)
[49] ময়মনসিংহের মধুপুর বনাঞ্চল এবং ঢাকার সাভারের লাল শক্ত মাটি এসেছে উপর থেকে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতের ঢলে। এই মাটির উৎস পুর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চল থেকে।
[50] শহীদুল্লাহ মৃধা, বাংলাদেশের নদ-নদী গুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা, নদী সংখ্যা, ১৯৯৯-২০০০, পৃষ্টাঃ ৩৮।
[51] গুঁড়ের দেশ গৌড় বলতে মূলত পশ্চিম বঙ্গের মালদাহ মুর্শিদাবাদকেই বুজায়। বাঙলাকে নয়।
[52] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ২-৩।
[53] মহাভারতে বর্নিত ভগীরথ-গঙ্গা-পদ্মাবতীর পৌরানিক কাহিনী মূলত খনের ইতিহাস। ষাট হাজার শ্রমিকের নিরলস খননের ফলে এই প্রবাহ তৈরি হয়েছিলো তা আজ বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত। সমুদ্র যাত্রা আরও যেন সহজ হয় তার জন্যে ভগীরথী খালটি গঙ্গার ধারা থেকে কেটে দিয়ে ছোটনাগপুর উপত্যকায় উৎপন্ন নদীর মজাখাতগুলোকে অবলম্বন করে সমুদ্রের খাড়ির সঙ্গে যুক্ত করেছিলো রাজা ভগীরথ। বৈদিকমত ধারার রাজা ভগীরথ (ইতিহাস যাদেরকে আর্য বলে) বর্তমানের চব্বিশ পর্গনা, হাওড়া, মেদিনীপুর এবং কপিলমুনি রাজ্যে যাতায়াতের সুভিধার জন্যে লোকজদের (ইতিহাস যাদেরকে অনার্য বলে) সাথে এক ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের ফলে এই খাল কাটা কাজ করেন, ফলে এই কাজের মহাত্ন্য কীর্তিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। (দেখুনঃ শহীদুল্লাহ মৃধা, বাংলাদেশের নদ-নদী গুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা, নদী সংখ্যা, ১৯৯৯-২০০০, পৃষ্টাঃ ৪৪।)
[54] পৌরানিকদের দাবী হচ্ছে এই নদী নাকি দেবী পার্বতির বক্ষদেশ থেকে এই নদী প্রসারিত হয়েছে। পুরাণের ভাষ্য মেনে নিলে, এ তথ্য দাঁড়ায় যে, তিস্তার এই রূপ ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের। যেহেতু এই সময়কালকে অনেক বিতর্ক বাদ দিলে সাহিত্যকরা এটাকে পৌরানিক কাল হিসেবে দেখেছে। আজকের তিস্তার রূপ পাল্টেছে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের খরা, প্লাবন এবং ভু-আন্দোলনের ফলে।
[55] সর্বভারতীয় মুসলিমলীগরা কংগ্রেসীদের হিন্দু পক্ষপাতিত্বতার কারণে তাদেরকে সাম্প্রদায়িক দল বলতো। কংগ্রেস মূলত হিন্দুদের স্বার্থকেই বড় করে দেখার ফলে বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মুসলিম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
[56] গোটা ভারতবর্ষ শিব পত্নীর ৫২ টি অঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেখানে পড়েছে সেখানেই শিব লিঙ্গ প্রতিষ্টার মধ্য দিয়ে মঠ নির্মান তথা সীমানা তৈরি হবে। এবং এটাই হচ্ছে হিন্দু ভূমি।
[57] এবনে গোলাম সামাদ, বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, অন্য এক দিগন্ত, মে ২০১৫ সংখ্যা, পৃষ্টা-১১।
[58] রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহসা।
[59] জয়া চ্যঠারজি, ২০০২, বাঙলা ভাগ হল, হিন্দু সাম্প্রদায়কিতা ও দেশ বিভাগ, ১৯৩২-১৯৪৭, পৃঃ ১।
[60] অল-ইন্ডিয়া কেনসাস ১৯৩২।
[61] আবুল মোমেন, ১৯৯৬, সাংস্কৃতিক শঙ্কট এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদ। পৃঃ ৯।

No comments:

Post a Comment