Saturday 14 November 2015

নবীন কুয়াশার শিশির বিন্দু ঘাস ও পাকা আমনের ডাগায় ভর দিয়ে বাংলায় চলছে হেমন্ত ঋতু  নবান্নের উৎসব যোগ করেছে নতুনমাত্রা

নবীন কুয়াশার শিশির বিন্দু ঘাস ও পাকা আমনের ডাগায় ভর দিয়ে বাংলায় চলছে হেমন্ত ঋতু
নবান্নের উৎসব যোগ করেছে নতুনমাত্রা

সূফি বরষণ
বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপ বিচিত্র। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ভাণ্ডারে যোগ হয়েছে হেমন্ত ঋতু । ধান ও ঘাসের ডগায় আলগোছে পা ফেলে নামছে কুয়াশা চাদর । প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে হেমন্ত। শিশির বিন্দু ঝরার টুপটাপ শব্দ আর মৃদু শীতলতা জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের খবর। নব+অন্ন=নবান্ন। নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে বাংলার কৃষকরা যে উৎসব করে থাকে তাই নবান্ন উৎসব। বাংলার ঘরে ঘরে চলছে নবান্নের উৎসব আর �নতুন ধানের চালের পিঠা পায়েশ বানানোর ধূম ॥
বাংলার আদি ভূমিপুত্র ও আমাদের পূর্ব পুরুষ দ্রাবিড় জাতির মাধ্যমে শুরু , প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো এ উৎসব বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদরে পালিত হয়ে আসছে আজও ।

পঞ্জিকার পাতা ঘুরে প্রাকৃতিক নিয়মে ফিরে এলো হেমন্ত ঋতু । বাংলার মাঠ ঘাট আর গ্রামীণ জনপদে এখন হেমন্তের আবেশ ॥ কার্তিকের শেষের দিকেই ধান কাটা শুরু হয়। কৃষকের চোখের স্বপ্ন একেকটি ধানের গোছা পাকা ধানের ভারে যেন নুয়ে পড়ে। তখন প্রকৃতির শোভা অপরূপ সুন্দর দেখায়। তাই তো আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে খুঁজে পাই হেমন্তের উল্লেখ" ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে, আমি কী দেখেছি মধুর হাসি! হিম থেকে এসেছে হেমন্ত। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তের শিশির ঝরা নিশিতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি আর কামিনী। হেমন্তেই দীঘির জলে, বিলে-ঝিলে ফোটে কত না রঙের পদ্ম! এই কিছুদিন আগেও শরতের শুভ্রতায় ছেয়ে ছিল চারপাশ।

তার হেমন্তের শুরুতেই গ্রামবাংলায় পড়তে শুরু করেছে শীত, আর সঙ্গে নতুন ধান তোলার উৎসব তো রয়েছেই। ক্ষেত-খামারে রাশি রাশি সোনার ধান উঠছে, ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। ঋতুসন্ধির এই কালে একদিকে রাতের আকাশে জ্বলে উজ্জ্বল তারা, দিনে ঝলমলে রোদ। ভোরে বা রাতের বাতাসে টের পাওয়া যায় হিমেল পরশ। এই হিমেল বাতাসই আসলে বলে দেয় হেমন্ত ঋতু এসে গেছে। যদিও উষ্ণায়নের এই সময়ে ঋতুর এই পালাবদল অনেক সময়ই অনুভব করা কঠিন হয়ে পড়ে।

শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্না ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকালকে যেন আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে; প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা। হেমন্তের এই মৌনতাকে ছাপিয়ে বাংলার মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরণের গান হয়ে, মানুষের জীবনে এনে দেয় সার্বজনীন উৎসবের ছোঁয়া। নবান্ন মানেই চারিদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তে এই ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি । গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে হেমন্তের এ শাশ্বত রূপ চিরকালীন।

নগরজীবন থেকে আর সব ঋতুর মতো হেমন্তও হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস না হলে ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে দেখুন, আজ শনিবার  (১৪ নভেম্বর ) ৩০ কার্তিক, হেমন্তের মাঝামাঝি সময় । অথচ শহুরে রোদে চাঁপা ফুলের রং ধরেনি বরং ধুলো আর ধোঁয়ায় মলিন।

কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস মিলে ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্ত। শরৎকালের পর এই ঋতুর আগমন। এর পরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। কৃত্তিকা ও আর্দ্রা এ দুটি তারার নাম অনুসারে মাস দুটির নাম রাখা হয় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। ‘মরা’ কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মওসুম’। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।

 কার্তিক আর অগ্রহায়ণ এই দুই মাসের ভেতর দিয়ে যায় বয়ে হেমন্তের বাঁকফেরা নদী। নদীর স্বর্ণালি চরে চরে কিশোরের দঙ্গল, ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছনে উন্মাতাল দৌড়। নদীর কোল ঘেঁষে সবুজ বুনো ঝোপে ঝোপে পতঙ্গের খুনসুটি। একটি কি দু’টি ফুলও যায় ঝরে- টুপ করে ঘাসের কার্পেটে। আর যায় ভেসে ডিঙি নাও, বেদেনৌকোর বহর। বর্ষার ঘোর শরতেও থাকে লেগে। তারপর হেমন্তের রেশমি দুপুর এসে সেই লেগে থাকা বর্ষা ও শরতের রুপালি জলের চিবুকে রাখে তার রৌদ্রাঙ্কিত মরমি আঙুল।

চার পাশে হেমন্তের এই হুলস্থূল করা আবেশ এই বাংলা ছাড়া আর কোথাও কি দেখা মেলে। নদীর বাঁধানো ঘাটের থুঁত্নিতে ঝরন্ত শিশির কুয়াশা থাকে বসে ভেজা সন্ধ্যায়। রাত্রিকালীন  বনে-বাদাড়ে জ্যোৎস্নার ঘেরাটোপ ফুঁড়ে উড়ে যায় রাতভর নিশুতি পাখির ধূ-ধূ গা ছমছম করা ভুতুড়ে শব্দরাজি। তারপর ঝাপসা আকাশে খুব ভোরবেলা ছড়ায় হেমন্ত সোনামুখী রোদ। আর রোদের টাওয়েলে থাকে জড়িয়ে সেগুন, দেবদারু, শিরীষের গলার ভাঁজের মায়াবী শবনম।

মাঠে-মাঠে হেমন্তের বাওকুড়ানি ঘূর্ণির পলকা টানে থামে চঞ্চল কিশোরীর মতো উচ্ছ্বল দিনের মসলিন। হেমন্তের রূপৈশ্বর্য্যরে খ্যাতি সব ঋতুকে যায় ছাপিয়ে। যেন কোনো নবীনা কনে �বউয়ের নতুন মুখের মতো উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে কানে ঝুমকো, নাকে নাকফুল, গলায় নীলাম্বরী হাড়, মাথায় সিঁথিপাটি, কোমরে বিছার ঝলকানি, বাহুতে বাজুবন্ধ আর পদযুগলে পরে সোনার নূপুর হেমন্ত নাইওর এসেছে। আর এসেই রাঙিয়ে দিয়েছে বাংলার মন তার বর্ণোজ্জ্বল রঙে। পথে পথে দমকা বাতাসে ভাসে হেমন্তের ধুলো। কিছু ফুলও থাকে পড়ে হেমন্তের নির্জন ব্যালকনিতে। কিছু ঝরাপাতা। কাঁঠালিচাঁপার গন্ধে যায় ডুবে সারাটা দুপুর। ঘুঘু ডাকা নিঝুম বিকেল। সন্ধ্যার ঘন কালো পনিটেল থেকে দু-একটা তারাও যায় খসে।

চাঁদের আলোর মিহি রিমুভারে ঘষে কখনোই যায় না মোছা হেমন্তের দাগ। 
প্রকৃতিতে যেমন হেমন্তের রয়েছে প্রবল প্রভাব। তেমনি বাংলা সাহিত্য, কবিতা গল্প, কথাশিল্প, চিত্রকলা, নাটক, সিনেমা, গানেও হেমন্তের স্বর্ণোজ্জ্বল প্রভাবের ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। অনন্তকাল ধরে বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষিপ্রধান এই বাংলার মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, নদী, বিল, হাওর, বাঁওড়, বন-অরণ্য গ্রামে ও শহরে হেমন্তের ছোঁয়া রচনা করে এক অনাবিল সৌন্দর্যমুগ্ধ চিত্রবীথি। রচিত হয় শব্দ, অক্ষরপুঞ্জে হৃদয়স্পর্শী অজস্র পঙ্ক্তিমালা।

কবিদের চোখে হেমন্ত:  হেমন্ত বাংলা সাহিত্যেরও বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থান নিয়ে আছে সুদীর্ঘকাল ধরে কবিতা, কথাসাহিত্য, গল্প, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, সাজসজ্জা, ফ্যাশন তথা জীবনধারার প্রতিটি ছন্দে স্পন্দনে হেমন্তের সুরমাধুর্য বেজে-বেজে যায়। কবিতায় হেমন্তকে জীবনানন্দ লালন করেছেন এমন করে যেন হেমন্ত শুধুই জীবনানন্দের ঋতু। তার কবিতায় কার্তিক, অগ্রহায়ণ, ধান, পেঁচা, শালিক, চিলের উপস্থিতি সেই সত্যটিই মনে করিয়ে দেয়। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ যেমন এক অপরিহার্য ভূখণ্ড, তেমনি তার কবিতায় হেমন্তের ফিরে ফিরে আসাটাও এক অমিয় বিষয়। পাশাপাশি বাংলা কবিতাঞ্চলে হেমন্তের আনাগোনা নেহায়েত কম নয়। যুগে-যুগে কবিতার পঙক্তিতে-পঙক্তিতে হেমন্তের রূপ-ঐশ্বর্য পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা ধরা দিয়েছে নানা রঙে, নানা আঙ্গিকে।

আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে
আমার হৃদয়মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে।
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,/জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’ _ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত?/নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।/‘বিন্নি পলাশ’ চালের ফিরনি/ তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।/শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত। ¬_ কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রথম ফসল গেছে ঘরে,/হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে/বাঁশ-পাতা মরা ঘাস আকাশের তারা!/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা! _ জীবনানন্দ দাশ।

সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে? _ সুফিয়া কামাল।

রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে
আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর
বসায় মর্চের দাগ, লাল কালো
কটু ও কথায়।
(অঘ্রাণ/আল মাহমুদ)

বাংলা সাহিত্যের  কবিগণ এভাবেই হেমন্তকে কবিতার আর্শিতে প্রতিবিম্বিত করেছেন এক অনন্য রূপকল্প আর স্বপ্ন ও বাস্তব জগতের বিচিত্র বর্ণের মনোলোভা রূপে। কবিতার বাইরে যে হেমন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে উদ্ভাসিত তাকে কল্পনায় সেভাবে ছুঁয়ে দেয়া যায় তার থেকেও মনোহর আবেশে উপলব্ধি করা যায় খুব ভোরে যখন দূরদিগন্তে ধূ-ধূ কুয়াশার নেকাব সরিয়ে আরক্ত সূর্যের আভা নীলিমার জংশনে এসে দাঁড়ায় গহিন দীর্ঘ এক লাল ট্রেনের মতো- তখন।
শিশির আর ধুলোডোবা পথে চাষি আর রাখালের গরুর পাল নিয়ে ক্ষেত আর মাঠে যাওয়ার যে দৃশ্য হেমন্তের রৌদ্রাঙ্কিত সকালের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে তা কেবল এই ষড়ঋতুময় বাংলায়ই প্রত্যক্ষ করা যায়।

কার্তিক কিংবা অঘ্রাণের দুপুরে হেমন্ত যেরূপে আবির্ভূত হয়- অপরাহ্ণে তার রূপটা যেন আরো মোহনীয় আর মায়াবী মুগ্ধতায় স্ফুরিত হয়ে ওঠে। আর সন্ধ্যায় নারিকেল পাতার ঝালরের ফিনকি গলিয়ে হেমন্তের গোল-চাঁদের মণিরত্ন এসে ছড়িয়ে পড়ে এই মৃত্তিকায়, ঘাসে, পথের ধুলোয়। রাত যত গভীর হয়- হিম হিম মৃদু বাতাসের আঙুল যেন পিয়ানোর রিডের মতো মেঘশিরিষের সবুজ খাঁজকাটা পত্রপল্লবে তোলে এক অপূর্ব গুঞ্জরণ- সোনারঙ চাঁদের কিরণ আরো ঘন আর গাঢ় হয়ে নিসর্গকে রাঙিয়ে তোলে, যা শুধুই এই হেমন্তের রাত্রিকালেই অনুভব করা যায়। আর নিশুতি রাতের গভীর স্তব্ধতা ছিন্ন করে দিয়ে ডেকে ওঠা পেঁচার ডাক, বাদুড়ের ডানা ঝাপটানির শব্দ গ্রাম বাংলার আদি হৈমন্তি আবহটাকেই ফুটিয়ে তোলে নিগূঢ়ভাবে। একই অঙ্গে অনেক রূপের বর্ণ ধারণ করে হেমন্ত বাংলার গ্রামে-গ্রামে যে রঙ ছড়িয়ে দেয় তার তুলনা কেবল হেমন্তের সাথেই চলে।
‘বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান তার আঁকা অসংখ্য ছবিতে বাংলার এই কৃষক, হেমন্ত, অঘ্রাণের রূপটাকেই মহিমান্বিত রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর মমতায়।

হেমন্তের আবহে যেমন স্নিগ্ধ পেলবতার রেশ প্রবহমান, তেমনি হেমন্ত তার অবয়বে গহন উজ্জ্বলতাও বহন করে আসছে অনন্তকাল ধরে। মনকে প্রফুল্ল করে তোলা যেন হেমন্তের এক নিবিড় বৈশিষ্ট্য। যে বৈশিষ্ট্য জীবন যাপনে প্রবলভাবে ছায়া ফেলে। শালিকের খয়েরি রোঁয়ার মতো এক ধরনের বিষণতাও দানা বাঁধে মর্মে। আর ওই মর্ম থেকেই নিঃসৃত হয় নির্জন অরণ্য স্তব্ধতা। বিজন দ্বিপ্রহরে হেমন্ত-তালচড়ুইয়ের ছায়ার মতো কখনো লাফায় জানলার কার্নিশে, রেলিংয়ে আর দোলনচাঁপার ডালে, জ্যোৎস্নাঙ্কিত সন্ধ্যায় ফেব্রিকোর নরম তোয়ালের মতো হেমন্ত যেন পুরনো ভাঙা পুকুর ঘাটের সিঁড়ির শ্যাওলা বিজড়িত সবুজ গালিচায় এসে গড়িয়ে যায় জ্যোৎস্নাধারার মতো যেন ঝাউয়ের চূড়োয় একগুচ্ছ কুয়াশার মতো ফুটে আছে হেমন্ত। কখনো-কখনো হেমন্ত ঠিক মেঘের ড্রেসিং টেবিল হয়ে যায়। আর ওই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় �ভেসে আসে সুন্দরী নারীর হাত ভরতি বাসন্তি রঙের চুড়ি বাসন্তি শাড়ি সমেত সবুজ টিপ পড়া  মায়াবী মুখ ।

আর এক নিঃসঙ্গ মাঠ খুব সন্তর্পণে কেবল হেমন্তে বসে বাজায় তার ধুলো আর ঘাসের পাখোয়াজ। হেমন্ত কি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে পড়তে সেতার বাজায় কিংবা ভায়োলিন! কাঠের বাড়ির ছায়ার গহনে হেমন্ত বসে রোজকার গল্প বলে! বনে-বনে যেমন হেমন্ত আসে। হেমন্ত আসে এই নগরজীবনেও। কিন্তু নাগরিক জীবনের অপার ব্যস্ততায় হেমন্ত যে কখন এসে মিলিয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। শিউলিফোটা শরতের প্রহর অতিক্রান্ত হতে-না-হতেই হেমন্ত এসে প্রকৃতির ডোরবেলে তার গুঞ্জরিত আঙুল রাখে। শীতের আগে আগে হেমন্তে অনেকেই একা অথবা সপরিবারে বেড়ানোর ছকও কেটে ফেলে। কেউ-কেউ লংড্রাইভে চলে যায় শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে। গ্রামে তখনো কাশফুলের মৃদু হাতছানি, ধবল বকের ওড়াউড়ি, হলুদ ধানের ক্ষেত, ঝাঁক ঝাঁক রৌদ্র বোঝাই গরু আর মোষের গাড়ির সারবন্দী হেমন্তের ছবি- ঝুটিঅলা টিয়া আর কাকাতুয়ার দলে দলে উড়ে যাওয়ার নয়নাভিরাম বিমুগ্ধ দৃশ্যপট মনকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করে, উচ্ছ্বসিত করে।

ঘাসফড়িং, গঙ্গাফড়িং আর বর্ণিল প্রজাপতির দল হেমন্তের চিবুক ছুঁয়ে যেন উড়ে গিয়ে বাংলার গ্রামীণ-লোকজ প্রতিটি মুহূর্তকে স্মরণীয় করে দেয়। হেমন্তের অপরিসীম রূপোজ্জ্বলতা যেমন প্রকৃতির এক অনিঃশেষ সম্পদ॥

হেমন্ত এলেই এই বাংলার মাঠে-প্রান্তরে এক হলুদ রঙের বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপট তার অমোঘ বিশালতায় রেশমি পালক ছড়িয়ে দেয়। হলদে ধানের ক্ষেতে হাওয়ার দাপাদাপি এক চিরায়ত নৃত্যপরা বাংলার কৃষি ঐতিহ্যকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে। তারপর শুরু হয় ধান কাটা। ধানের আঁটি গরু আর মোষের গাড়িতে কৃষকের বাড়ি বয়ে নিয়ে যেতে যেতে গাড়োয়ানের কণ্ঠে উৎসারিত হয় যে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত আর বাঁশির সুরের এক পাগল করা, হৃদয় নিংড়ানো সুরমূর্ছনা; তার ছবিটা এই বাংলা ছাড়া কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যায়! উঠোনের এক পাশে ধানের আঁটির স্তূপ থেকে থোকা-থোকা ধানের আঁটি খুলে ধান খসিয়ে নিয়ে রাতভর উনুনে সিদ্ধ করার যে দৃশ্যাবলি, কৃষাণীদের অবিশ্রান্ত ব্যস্ততা আর নতুন ধানের ম-ম গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠার নৈসর্গিক পরিবেশকে হেমন্তের এক অনাবিল অবগাহন ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়!

ধান শুকিয়ে ঢেঁকি অথবা কলে ধান ভাঙানোর পর নতুন চালের সুমিষ্ট-স্নিগ্ধ ঘ্রাণ শরীরে মেখে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি প্রহরে বাংলার চিরন্তন প্রতিচ্ছায়াটা ঘুর ঘুর করে বেড়ায় যেন এই বাংলারই জল, হাওয়া আর মাটির মনোভূমে। 
এ ছাড়া নতুন চাল ঘরে এলেই কৃষকের মুখে যে হাসি অবারিত হয়-তাতে যে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া যায় তাকে ফ্রেমে ধরে রাখলেও যেন সেই স্পন্দনের শব্দ অনুরণিত হবে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। নতুন চালের ভাত, পাশাপাশি ‘আগুনি’ চালের ক্ষির পায়েস পিঠা কৃষকের ঘরে ঘরে তৈরি হবে- যার সাথে মিশে থাকবে কোমল এক আনন্দোচ্ছ্বাস।

নবান্ন: 
গ্রামবাংলার মাঠে-খেতে চলছে আমন ধান কাটার মহোৎসব নবান্ন। যা  বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। গ্রামীণ একটি বচন আছে- ‘ঠেলা যায় হাত্তিকে. ঠেলা যায় না কার্তিককে’। কৃষকের ঘরে এই সময় ফসলের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে দেখা দেয় নানান অভাব, একটি হাতি ঠেলে নেওয়া কঠিন হলেও আরও ভয়াবহ অভাবের মাস কার্তিক মাসকে মোকাবেলা করা, কিন্তু আড়ালে চলে মাঠে ক্ষেতে ফসল উৎপাদনের আয়োজন আর যা সুখের আর আনান্দের মুখ দেখায় নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়। নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়। প্রকৃতি মনে হয় তার অবর্ণনীয় এই সৌন্দর্য বেশিক্ষণ রাখতে চায় না। তাই হেমন্তও বেশি দিন থাকে না এই বাংলার বুকে। নীল আকাশের বুকে স্বপ্নের ওড়াউড়ি শুরু না হতেই আস্তে আস্তে শীত চলে আশে কুয়াশার চাদরে; নরম রোদের সূর্যটাকে আরও নরম করে দিয়ে। শীতবস্ত্রের বেচাকেনা শুরু না হলেও লেপ, তোষক ও জাজিম বানানোর ভিড় লেগে গেছে।

ধুনকারেরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। তারা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। শীতকে চুপি চুপি ডেকে আনতেই বুঝি হেমন্তের মৌন তাপস ভূমিকা। এক সময় শীতকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হেমন্ত স্বেচ্ছায় নির্বাসনে চলে যাবে যথাসময়ে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কথা থেকে যায়, আশ্বিনের ‘আইতানি’ হলো না, কার্তিকের ‘কাইতানি’ হবে কি? এর উত্তর পেতে হলে যে অপেক্ষা করতেই হবে।

এদিকে, কার্তিক মাসটি বিষ্ণুপ্রিয় মণিপুরীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের  শুক্ল পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব মহারাসলীলা। মহারাস উৎসবের আগে পুরো কার্তিক মাস জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ। গ্রাম ও শহরতলর মণিপুরী লেইসাং বা মন্দিরগুলো ঢাক, করতাল, মইবুঙ ও সেলবুঙের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। এছাড়া হিন্দুদের কাছে কার্তিক মাস শ্রীহরির সেবার মাস। কার্তিক মাস বা দামোদর মাস ভক্তগণের কাছে অতীব মাহাত্ম্যপূর্ণ একটি মাস। কেননা এই মাসে হরিভক্তির অনুকূল যে কোন কার্যই সহস্রগুণ অধিক ফলদান করে। ভক্তিভরে স্বল্প পরিমাণ ভগবদ্ সেবা সম্পাদন করলেও ভগবান শ্রীহরি অতিশয় প্রীত হন। বিশেষ করে কার্তিক মাসের অন্যতম একটি ভগবৎ সেবা হচ্ছে ভগবানের মন্দিরে বা গৃহমন্দিরে ভগবানের উদ্দেশ্যে দীপদান। এই সম্বন্ধে বিভিন্ন শাস্ত্রে বলা হয়েছে, এই মাসে শ্রীহরি মন্দিরে দীপ দান করলে তাকে আর এই জন্ম মৃত্যুময় জগতে ফিরে আসতে হয় না। লোকশিল্পে গলা মিলিয়ে সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

নবান্ন উৎসব শুধু আমাদের দেশে উদযাপিত হয় না। বিশ্বের নানা দেশে নবান্ন উৎসব ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচে পালিত হয়। চীনারা হিমেল ঠাণ্ডা হাওয়ায় চাঁদনী রাতে নবান্ন উৎসব পালন করে। তারা নিজস্ব ভাষায় এর নাম দিয়েছে ‘চুপচুয়ে’। ব্রিটিশরা এর গালভরা নাম দিয়েছে ‘আগস্ট মুন হিস্টিভল’। গ্রিকেরা তিন দিন ধরে নবান্ন উৎসব পালন করে। তারা শখ করে এর নাম রেখেছে ‘থ্রেসনু ফুরিয়া’। দিবতীরা নাচ-গান, ঘোড়দৌড়, ফসলের ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে উদযাপন করে নবান্ন। রোমানরা ফসলের দেবতা সেরেসের নামের সাথে মিলিয়ে নবান্ন উৎসবের নাম দিয়েছে ‘সেরেলিয়া’। নবান্ন উৎসব উদযাপনের মিছিলে পিছিয়ে থাকেনি আমেরিকা। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার আমেরিকায় ঘোষণা দেয় নবান্ন উৎসবের। তারা নিজস্ব শৈলীতে এর নাম দেয় ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’। এ ছাড়া পৃথিবীর বহু দেশে উদযাপিত হয় নবান্ন উৎসব।

আমাদের দেশের নবান্ন উৎসবের আয়োজন আনন্দ সব দেশকে ছাড়িয়ে। নবান্ন উৎসব আমাদের উৎসব। 
আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। স্বকীয়তা। এটা বাঙালি জাতির চিরচেনা। নবান্ন উৎসবের ভেতর আমি খোঁজে পাই বাঙালিমনা। আমি প্রাচীন বাঙালি। আমি সংস্কৃতিমনা বাঙালি। আজো আমি নবান্ন উৎসবে বাঙালি সংস্কৃতি খুঁজে বেড়াই। বারবার খুঁজি। বাঙালি উৎসবে ফের খুঁজি আমি
বাঙালিমনা ॥

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ

No comments:

Post a Comment