Monday 30 November 2015

ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব দুই ... বাংলার পাল বংশের সুশাসকগণের পূর্বপুরুষগণ বৌদ্ধ ছিলেন কিনা মতভেদ আছে??

ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব দুই ...
বাংলার পাল বংশের সুশাসকগণের পূর্বপুরুষগণ বৌদ্ধ ছিলেন কিনা মতভেদ আছে??




সূফি বরষণ
পাল প্রাচীন বাংলার একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজবংশ। এর প্রতিষ্ঠাতার নাম গোপাল। পাল বংশের বিস্তার ৭৫০-১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল।
প্রস্তর যুগে বাংলার জনবসতি কেমন ছিল তা জানা যায়নি৷ তবে ইদানীং কালে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মাটি খুঁড়ে প্রস্তরযুগের যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাতে এটা বোঝা যায় যে, প্রস্তর যুগেও জনপদের অস্তিত্ব ছিল৷ প্রাচীন যুগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন বাংলায় বিভিন্ন নামের প্রচুর জনপদ ছিল, যার মধ্যে একটির নাম ছিল “বঙ্গ”৷ সংস্কৃত সাহিত্যেও “বঙ্গ” শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে পর্যন্ত প্রস্তর যুগ অবশিষ্ট ছিল৷ ঠিক সেই সময়ই দ্রাবিড় গোষ্ঠী, তিব্বতি-বর্মী গোষ্ঠীর মানুষ ও অস্ট্র-এশিয়াটিক জাতির মানুষ বাংলায় তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করে৷
খ্রিষ্ট পূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বর্তমানের বিহার ও বাংলা এলাকা নিয়ে গঠিত হয় মগধ সাম্রাজ্য৷ ভারতের চারটি মূল সাম্রাজ্যের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম৷ বহু জনপদে বিভক্ত ছিল মগধ৷ ক্রমে ক্রমে মগধ সাম্রাজ্য প্রায় সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে৷ এরই ধারাবাহিকতায় আসে বাংলায় পাল শাসনের কথা॥
পাল শাসন আট শতকের মাঝামাঝি সময়ে গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ বিভিন্ন উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় চারশ’ বছর বাংলা শাসন করে। এ বংশের আঠারো জন রাজার দীর্ঘ শাসনামলে উত্থান-পতন লক্ষ করা গেলেও প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল শাসন যে একটা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাল রাজাদের ইতিহাসকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়: (১) ধর্মপাল (আ. ৭৮১-৮২১ খ্রি.) ও দেবপাল-এর (আ. ৮২১-৮৬১ খ্রি.) শাসনামল। এ আমল ছিল প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার যুগ;
(২) স্থবিরতার যুগ (আ. ৮৬১-৯৯৫ খ্রি.)। প্রথম মহীপাল (আ. ৯৯৫-১০৪২ খ্রি.) অবশ্য এ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে পাল বংশের গৌরব পুনরুদ্ধার করেন, যার জন্য তাঁকে পাল বংশের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়;
(৩) অবনতি ও অবক্ষয়ের যুগ। রামপাল (আ. ১০৮২-১১২৪ খ্রি.) তাঁর তেজোদ্দীপ্ত শাসন দ্বারা এ অবক্ষয়কে সাময়িকভাবে রোধ করার প্রয়াস পান। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য আর বেশি দিন টিকে থাকে নি। বারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেন বংশের উত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
রাজা গোপাল বৌদ্ধ ছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন_এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গোপালের পিতা-পিতামহ বৌদ্ধ ছিলেন কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিব্বতীয় গ্রন্থ থেকে জানা যায়, গোপাল নালন্দায় একটি বৌদ্ধবিহার এবং আরো অনেক বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ভারতের অন্যান্য জায়গায় যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব পড়তির দিকে, তখনো বাংলাদেশ ও বিহারে পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্মের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। গোপাল নিজে বৌদ্ধ হলেও তাঁর রাজসভায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রভাব বেশি ছিল।পাল বংশের কুলজি
এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে গোপালের আবির্ভাব একটি বড় অধ্যায়। এ অঞ্চলে গণতন্ত্রচর্চার শুরু হিসেবে গোপালের ক্ষমতারোহণ অনেকেই চিহ্নিত করেন। কিন্তু গোপালের বংশ পরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। রামচরিত কাব্যে বরেন্দ্রভূমি পাল রাজাদের জনকভু অর্থাৎ পিতৃভূমি বলে বর্ণিত হয়েছে। এ তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, গোপাল বরেন্দ্রর অধিবাসী ছিলেন। পাল রাজাদের তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, গোপালের পিতামহ দয়িতবিষ্ণু সর্ববিদ্যায় বিশুদ্ধ ছিলেন এবং গোপালের বাবা শত্রুর দমন এবং বিপুল কীর্তিকলাপে সসাগরা বসুন্ধরাকে ভূষিত করেছিলেন। সুতরাং গোপাল কোনো সামন্ত কিংবা রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর বাবা যুদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং গোপালও সম্ভবত বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রবীণ ও সুনিপুণ যোদ্ধা বলে পরিচিত হয়েছিলেন। অনেক পণ্ডিত গোপালের ছেলে ধর্মপালের সমসাময়িক একটি গ্রন্থে 'রাজভটাদি বংশ পতিত'-এর ব্যাখ্যায় মনে করেন, গোপাল খৰ বংশীয় রাজাভটের বংশধর।
'পাগ্ সাম্ জাং' নামের তিব্বতীয় গ্রন্থ, গুজরাটের কবি সোড্ঢলের 'উদয়সুন্দরী কথা' চম্পুকাব্যে এবং তৃতীয় বিগ্রহ পালের মন্ত্রী বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসনে পাল রাজাদের 'সূর্যবংশীয়' বলা হয়েছে। অন্যদিকে সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত 'রামচরিত' এ গোপালের ছেলে ধর্মপালকে 'সমুদ্রকূলদীপ' অর্থাৎ সমুদ্র বংশোদ্ভূত বলা হয়েছে। আবার রামচরিত কাব্যের প্রথম সর্গের সপ্তদশ শ্লোকের টীকায় তাঁদের 'ক্ষত্রিয়' বলা হয়েছে। রাষ্ট্রকূট ও কলচুরি বংশীয় রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধও পালদের ক্ষত্রীয় বংশে জন্ম সমর্থন করে। তিব্বতীয় লামা তারনাথ বলেন, 'রাজা গোপাল এবং বৃক্ষ দেবতার ঔরসে ক্ষত্রিয় রমণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তবে নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, পাল বংশের শাসকরা উচ্চ বংশের ছিলেন না।' আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পে পালদের দাসজীবী অর্থাৎ নিম্নজাতি বলা হয়েছে।
আবুল ফজলের মতে, পাল রাজারা ছিল 'কায়স্থ'। রমেশচন্দ্র মজুমদার ওপরের মতবাদগুলোর বিরোধিতা করে বলেন, গোপাল পুণ্ড্রবর্ধননিবাসী এক ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরে ভঙ্গল অর্থাৎ বাঙাল বা বঙ্গদেশের রাজা নির্বাচিত হন। বস্তুত প্রথম মহীপালের বানগড় তাম্রলিপিতে যে রাজ্যম পিত্র্যমের উল্লেখ আছে, তা উত্তরবঙ্গ বলে মনে হয় অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ পাল বংশের বা গোপালের আদি বাসস্থান ছিল এবং এ অঞ্চলেই তারা প্রথম ক্ষমতা বিস্তার করেছিল।
একথা বলা যায়, পাল রাজারা বাংলার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন এবং গৌড়ে সুদীর্ঘ ৪০০ বছর রাজত্ব করেন। তবে পাল বংশের প্রথম শাসক গোপালের রাজ্যকাল সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। তারনাথের মতে, 'তিনি ৪৫ বছর এবং আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্প অনুসারে ২৭ বছর রাজত্ব করেন এবং ৮০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।'
বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে, 'আনুমানিক ৭৫৬ থেকে ৭৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৫ বছর তিনি শাসন করেন। সার্বিক অবস্থা ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে বলা যায়, এ ক্ষেত্রে রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতোই গ্রহণযোগ্য। তাঁর মতে, 'গোপাল ৭৪০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা নির্বাচিত হন এবং আনুমানিক ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মহারাজাধিরাজ গোপালের মৃত্যুর পর শুরু হয় প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ 'ধর্মমঙ্গলের' অন্যতম চরিত্র ধর্ম পালের যুগ।
শশাঙ্কের রাজধানীর নাম ছিল ‘কর্ণসুবর্ণ’ যা আধুনিক মুর্শিদাবাদ। শশাঙ্ক ছিলেন সমগ্র গৌড়ের রাজা, যাহার রাজ্য সীমা বাংলা ছাড়িয়ে দক্ষিণ পূর্বে উড়িষ্যা ও পূর্বে কামরূপের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজা শশাঙ্কের সময়ই বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রচলন হয়, যদিও বলা হয় এই ক্যালেন্ডার বানাইয়া ছিলেন সম্রাট আকবরের এক গনৎকার সভাসদ। সে অন্য কথা।
৭৫০ সালে প্রথম পাল রাজা মধ্যযুগীয় বাংলার প্রথম শাসকের শাসন কালের শুরু। রাজা গোপাল ৮০-বৎসর বয়সে মারা যান তাঁর ছেলে ধর্মপালের হাতে সমস্ত রাজ্যপাট সমর্পণ করিয়া। সেই সময়ে সমগ্র বাংলা তাঁহার রাজ্য ছিল, যা তাঁহার ছেলে পরে আরও বর্ধিত করে। পাল শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘যারা পালন করেন।’ এই পালেরা ইহার পরে প্রায় ৪৫০ বৎসর বাংলার রাজা হিসেবে ছিলেন (২১ জন রাজা হইয়াছেন বংশানুক্রমে, যদিও তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ও শক্তিশালী রাজা ছিলেন মাত্র তিন জনই)। সে কথায় ক্রমে আসিতেছি। পালবংশের আমলের কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত ‘রামচরিতম্‌’ কাব্যে বলা হইয়াছে পালেদের আদি নিবাস উত্তর বাংলার বরেন্দ্র নামক এলাকা যাহাকে ওনারা ওদের পিতৃভূমি (জনকাভু) বলিয়া মনে করিতেন। গোপাল ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধ-সৈনিক ভাপ্যতার সন্তান (খালিমপুর তাম্র পত্রের লেখনী)। গোপালের পিতা ভাপ্যতা ছিলেন মহান যোদ্ধা (যাহাকে ডাকা হতো খণ্ডিত’রতি অর্থাৎ সমস্ত শত্রু নাশক; তাম্র পত্রের উদ্ধৃতি) আর ঠাকুর দাদা ছিলেন দয়িতবিষ্ণু (যিনি বিখ্যাত ছিলেন সর্ব্ব-বিদ্যাভদাতা নামে, অর্থাৎ যিনি সমস্ত প্রকার জ্ঞানে পারদর্শী, তাম্রপত্রের উদ্ধৃতি)। খালিমপুর জায়গাটি অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত মাগুরা সদর, খুলনা ডিভিশনের ও ঝিনাইদহ জেলার মধ্যে পড়ে। খালিমপুর তাম্রপত্র রাজা গোপালকে সূর্য বংশীয় বলিয়াও দাবী করে, যদিও ঐতিহাসিকদের ধারনা ও বিশ্বাস যে পরবর্তী কালে তাঁহার সাধারণ বংশ পরম্পরাকে গৌরবান্বিত করা ছাড়া সূর্য বংশীয় হইবার কোন ঐতিহাসিক লিপি বা প্রমাণ পত্র নাই। মধ্যযুগীয় লেখক আবুল ফজল পালেদের ‘কায়স্থ’ বলিয়াছেন তাঁহাদের আচার, ব্যাবহার, বিবাহ ও সামাজিক নিয়ম কানুন দেখিবার পরে। কোন কোন ঐতিহাসিক পালেদের সমুদ্র বংশীয় বা শূদ্রও বলিয়াছেন। কিন্তু ইতিহাস এ কথা অবশ্যই স্বীকার করে যে সাধারণ অবস্থার মধ্যে থাকিয়াও, সেই সময়ে সকলের ব্যক্তিগত মনোনয়নে (তাঁর অসাধারণ যুদ্ধ নীতি আর সুশাসন করিবার সহজাত ক্ষমতা) রাজা গোপাল যে রাজ ঘরানার সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহা সমগ্র বাংলা ও তাহার জনপদবাসীর জন্য আগামী ৪৫০ বৎসর সফলতার ধ্বজাই উড়াইয়াছে। ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে আসিয়া সেনেদের নিকট পালেদের শেষ পরাজয় ঘটে ও পাল বংশের অস্ত ঘটিয়া যায়।
মাৎস্যন্যায়:
রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে (সাল ৬২৫), বাংলায় এক ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়। তখন কোন একজন রাজা বা গোষ্ঠী নেতার হাতে সমগ্র বাঙ্গালার ক্ষমতা ছিল না। তাই শাসন নামক সজ্জাটি বাংলার ভৌগোলিক শরীরটিকে শত্রু হাত হইতে যেমন অরক্ষিত রাখিয়াছিল, তেমনই দূরদর্শিতা ও অনুশাসনের অভাবে গোষ্ঠীগত কোন উন্নতি সাধনই করিতে পারে নাই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এই সমস্ত কিছুই প্রজা সকলের কাছে অলভ্য ছিল। তীব্র তিব্বতি বহিরাক্রমণ এই সময় বাংলার উপরে আছড়ে পড়ে। ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভাজিত হইয়া সকলেই নিজ নিজ গোষ্ঠীপতির পতাকাতলে আশ্রয় লয়। এই ভাবে, অনাচার ও অত্যাচারের চরম সীমায় পৌঁছাইয়া যায় বাংলা। কিছু ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের চারি পাশে হয়তো গোটা একটি জনপদ বা গ্রাম, আশ্রয় হেতু ভিড় করিয়া থাকিলেও থাকিতে পারে, ॥
কিন্তু সমগ্র বাংলা – বিহার–উড়িষ্যা এক নিদারুণ অশান্তি ও কষ্টের সহিত কালাতিপাত করিতেছিল। ৬২৫ সালের পরে ৭৫০ সাল পর্যন্ত (প্রায় ১২৫ বছর) এই এলাকাটি স্থানীয় শক্তিমান কিছু সমাজপতি (আজিকার গুণ্ডা সম্প্রদায়) এবং বহিরাগত তিব্বতি সম্প্রদায়, সেই প্রকার কিছু মানুষের হাতে ছিল। সকলেই নিজ নিজ মত ও শক্তি অনুযায়ী এলাকা দখলের সুবিধা লইয়া ছিলেন। জনসংখ্যার অপ্রতুলতা, অর্দ্ধশিক্ষা, কিন্তু ব্যবহারিক জীবন যাপনের কোনও অসুবিধা না থাকিবার কারণে (যেমন খাদ্যাদি, পণ্য, শস্য, গরু, মোষ, ফল ইত্যাদির অঢেল উৎপাদন) বাঁচিয়া থাকিবার কোনও যুদ্ধ তাহাদের করিতে হয় নাই। কিন্তু অগ্রগতিরও কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকেরা এই সময়কে বলেন ‘মাৎস্য ন্যায়’ রাজনীতির বাংলা। অর্থাৎ, বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে ভক্ষণ করিয়া থাকে, তাহার নিজের খেয়াল খুশী মতো, বাঙ্গালাতেও ঠিক তেমনই সামাজিক কাঠামোর মধ্যে জনপদ গুলি দিনাতিপাত করিতেছিল। বাংলায় শশাঙ্কের সমসাময়িক অন্য রাজারা হইলেন হর্ষবর্ধন (উত্তর ভারতবর্ষ) আর ভাস্কর বর্মণ (কামরূপ)।
শশাঙ্কের পর দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলনা। ফলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও আরজকতা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় শাসন শক্তভাবে ধরার মত কেউ ছিলনা। সামনত্ম রাজারা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে থাকেন। এ অরাজকতাপূর্ণ সময় (৭ম-৮ম শতক) কে পাল তাম্র শাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে। পুকুরে বড় মাছগুলো শক্তির দাপটে ছোট মাছ ধরে ধরে খেয়ে ফেলার বিশৃঙ্খল পরিসি'তিকে বলে ‘মাৎস্যন্যায়’। বাংলার সবল অধিপতিরা এমনি করে ছোট ছোট অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করেছিল।
গোপাল (৭৫৬-৭৮১ সাল) ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার অরাজকতা পরিস্থিতি অবসান ঘটে পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে। পাল বংশের প্রথম রাজা ছিলেন গোপাল। বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু হয় পাল বংশের রাজত্বকালে। পাল বংশের রাজারা একটানা চারশত বছর এদেশ শাসন করেছিলেন। এত দীর্ঘ সময় আর কোন রাজবংশ এদেশ শাসন করেনি। পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ সাল) পাল রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন গোপালের পুত্র ধর্মপাল। একজন শক্তিশালী রাজার প্রজাপালক এবং শাসক হিসেবে যা যা গুণ একজন রাজার মধ্যে থাকা উচিত তাহা পুরো মাত্রায় রাজা ধর্মপালের মধ্যে প্রাপ্ত ছিল। তিনি তাঁহার পিতার নিকট হইতে প্রাপ্ত যুদ্ধবিদ্যায় কুশলতো ছিলেনই, তাঁহার সহিত কূটবুদ্ধি রাজনীতিজ্ঞও ছিলেন। তিনি গুর্জর প্রতিহারদের নিকট দু-দুবার যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন ঠিকই (সম্পদ ও লোকক্ষয়), কিন্তু শত্রুর শত্রু যে মিত্র, তাহা চিনিয়া লইতে ভুল বা দেরী করেন নি, আর রাষ্ট্রকূটদের সাথে নিজের জীবন ও সাম্রাজ্যের সুরক্ষা সুনিশ্চিতকরণের জন্যে তাদের সাথে আত্মীয়তার সূত্রেও বাংলাকে বাঁধিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই তাঁহাকে অন্য পাল রাজাদের হইতে আলাদা প্রতীত করিয়া থাকে। ধর্মপাল যুগে তিনটি রাজবংশ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে। একটি বাংলার পাল বংশ আর অন্যটির রাজপুতানার গুর্জর প্রতীহার বংশ এবং তৃতীয়টি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকুট বংশ। ইতিহাসে এ যুদ্ধ পরিচিত হয়েছে ‘ত্রিশক্তির সংঘর্ষ’ (ঞৎরঢ়ধৎঃরঃব ডধৎ) নামে।
রামপাল (১০৮২-১১২৪ সাল) পাল বংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন রামপাল। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন' থেকে রামপালের রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। বরেন্দ্র এলাকায় পানিকষ্ট দূর করার জন্য তিনি অনেক দীঘি খনন করেন। দিনাজপুর শহরের নিকট যে ‘রামসাগর’ রয়েছে তা রামপালের কীর্তি।
পাল রাজাদের অমর সৃষ্টি :
সোমপুর মহাবিহার, অধুনা পাহাড়পুর, নওগাঁও জেলা, বাংলাদেশে অবস্থিত, (উপরের ছবিটি দেখুন) তখনকার মিলিত বাংলার সব থেকে বিরাট বৌদ্ধবিহারের স্থাপনা করেন রাজা ধর্মপাল তাঁহার রাজত্বকালের সময়। ১৯৮৫ সালে এই মহাবিহারটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত করা হয়েছে। এই সোমাপুরা বিহার ২১ একর জমির ওপরে বিস্তৃত ছিল (প্রায় ৮৫,০০০ বর্গমিটার)। যাহার মধ্যে ১৭৭ টি প্রকোষ্ঠ, অগুনিত স্তূপ, মন্দির ও আনুষঙ্গিক গৃহাদি ছিল। এ ছাড়া আরও নানা বৌদ্ধ বিহার পালেদের হাতে তৈরি হয়, যেমন বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী (গোপালের দ্বারা) এবং জগদ্দল-যেগুলি সবই ওই সময়কার স্থাপত্যের উন্নত শৈলীর সুচারু নিদর্শন ছিল। এই সব বৌদ্ধবিহারগুলি কেবল শাস্ত্রালোচনা, শিক্ষা, পুঁথি-রচনা ও ঈশ্বর সাধনারই স্থান ছিল না, এগুলি শিল্পের (যে কোন শিল্প যেমন, স্থাপত্য, অংকন, চিত্রাদি প্রকরণ) এক মেল-বন্ধন ছিল, যা পালেদের সময় এক সার্বিক উচ্চতা লাভ করিয়াছিল, এবং তাহাদের পরে সেনেদের সময়ও তা বজায় ছিল। দেশজ শিল্পীরা তাহাদের শিল্পের মধ্যে নেপাল, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, জাভা ইত্যাদি দেশের নিজস্বতাটুকুকে আয়ত্ত করিয়াছিলেন আর এই ভাবেই নানা দেশের কলাকৃতি ভারতের মধ্যে ও ভারত থেকে বাহিরে আসা যাওয়া করিয়াছিল। আজ যাহাকে আমরা সাংস্কৃতিক লেনদেন বলিয়া থাকি।
রাষ্ট্রকূটের সহায়তা দু দুবার পাইবার পরে, রাজা ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট দুহিতা ও রাজকন্যা রন্নাদেবীকে বিবাহ করেন আর দুই মহা শক্তির মধ্যে সখ্যতার বন্ধন আত্মীয়তার বাঁধনে অটুট হইয়া যায়। ধর্মপাল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে উত্তর-মধ্য ভারতে তাঁহার ক্ষমতা ও অধিকার বজায় রাখতে পারিয়াছিলেন তাহা এই মিলিত শক্তির দান হিসেবে। পূর্বে বাংলা থেকে উত্তর-মধ্য ভারতের কনৌজ পর্যন্ত আর দক্ষিণে রাষ্ট্রকূট রাজাদের সীমানা পর্যন্ত সে পাল রাজাদের মুদ্রা জনগণের কাছে গ্রহণীয় ছিল। এই মুদ্রা সোনা ও রৌপ্যের সাথে তামা মিশ্রণ করিয়া প্রস্তুত করা হইয়াছিল।
মুদ্রার ইতিহাস:
মুদ্রা গলায় লকেট-রূপে ব্যবহৃত হইত কেননা মুদ্রার শীর্ষদেশে ছিদ্র দৃশ্যমান, যাহার ভিতর দিয়ে সোনা বা রুপোর চেইন/সুতো পরাইয়া লওয়া হোতো, যাহাতে মুদ্রাটিকে বক্ষের নিকট ঝুলাইয়া রাখা যায়। মুদ্রার (বামদিকে) দেখা যাইতেছে, রাজা ঘোড়ার পৃষ্ঠে, দক্ষিণ হাতে বর্শা লইয়া, সিংহ বা শূকর জাতীয় কোন প্রাণী শিকার করিতেছেন যেটি তাঁহাকে বামপার্শ্ব হইতে আক্রমণ করিয়াছে। মুদ্রার (ডানধারে) ব্রাহ্মীলিপিতে কিছু লিপি লিখিত রইয়াছে... শ্রী/মান ধা/রমা পা/ লাহ, আবার ঘোড়ার সম্মুখ পায়ের কাছে লিখিত দুটি লাইন, কাই/লা, পেছনের পায়ের কাছে লিখিত ভো। মুদ্রার উল্টোদিকে মহালক্ষ্মী দেবী পদ্মাসনে বসা মূর্তি, যাহার দুই হাতে পদ্ম, তাঁহার দুধারে পবিত্র পাত্রদ্বয় (পূর্ণ ঘট), আর উপরে লিখিত বাম দিকে শ্রী।
পাল শাসন আমলে প্রশাসনিক
অবস্থা :
গুপ্ত তাম্রশাসনে ভূমি বিক্রয় পদ্ধতি সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে ক্রেতা সংশ্লিষ্ট অধিকরণে কি উদ্দেশ্যে, কোন্ জমি এবং কতখানি ক্রয়ে ইচ্ছুক তা উল্লেখ করে আবেদন করতেন। আবেদনকারীকে স্থানীয় প্রচলিত মূল্য অনুযায়ী উক্ত জমির মূল্যদানের স্বীকৃতি তার আবেদনে উল্লেখ করতে হতো। তাছাড়া প্রস্তাবিত জমির নির্ধারিত মূল্য প্রচলিত স্থানীয় মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এবং তা অহস্তান্তরযোগ্য কিনা তাও আবেদনে উল্লেখ করতে হতো। জমি ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তির নিকট থেকে আবেদন প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট অধিকরণ আবেদনপত্রটি দলিল-সংরক্ষকের (পুস্তপালের) দপ্তরে প্রেরণ করত। আবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবেদনকারী কর্তৃক উল্লিখিত শর্তে তাকে জমিটি দেওয়া যায় কিনা সে সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে হতো। ‘পুস্তপালে’র দপ্তর বিক্রয় অনুমোদন করলে এবং ভূমির মূল্য রাজকোষাগারে জমা হলেই কেবল ভূমি ক্রয়ে আগ্রহী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ভূমির অধিকার লাভ করতেন এবং বিক্রয়কার্য সম্পাদিত হতো। এরপর বিক্রয়কার্য সম্পাদন তাম্রশাসনে পট্টীকৃত হতো এবং বিক্রিত ভূমির উপর অধিকারের দলিল হিসেবে তাম্রশাসনটি ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হতো।
ভূমির মূল্য কিভাবে পরিশোধ করা হতো এ সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা গুপ্ত লিপিমালায় নেই। বিক্রিত ভূমির মূল্যের তারতম্য ছিল। ভূমির ধরন অথবা বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত দরের পার্থক্যের কারণে এ তারতম্য দেখা দিত। গুপ্ত আমলের লিপি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভূমি ক্রয়ের জন্য জেলা বা গ্রামের যে কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন পেশ করা হতো সেখানেই ভূমির পূর্বনির্ধারিত মূল্য জমা দিতে হতো। ভূমির মূল্য সরাসরি ‘বিষয়’ বা ‘গ্রাম’ কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করত কিনা বা অন্য কোন সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা করা হতো কিনা তা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে এ প্রসঙ্গে তাম্রশাসনসমূহে অন্য কোন সরকারি সংস্থার নামোল্লেখ না থাকায় এটি মনে করা যেতে পারে যে, ভূমি গ্রহীতাদের নিকট থেকে মূল্য সংগ্রহের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনকেই পালন করতে হতো।
লিপিমালা ভিত্তিক উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, পাল-পূর্ব যুগে বাংলার রাজ্যশাসন পদ্ধতি পুরোপুরি সুবিন্যস্ত না হলেও এক্ষেত্রে ঐ যুগে কিছু অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। সমসাময়িক শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এটি উল্লেখযোগ্য যে, পূর্বোল্লিখিত প্রশাসনিক কাঠামো আমাদের আলোচ্য সম্পূর্ণ সময়কালে প্রচলিত ছিল না। এটি ছিল প্রশাসনিক সংস্থার প্রাথমিক পর্যায়ের অবস্থা যা পরবর্তীকালে উন্নততর করা হয়েছিল।
পাল বংশের দীর্ঘ শাসনে বাংলায় প্রথমবারের মতো এক শক্তিশালী ও স্থায়ী রাষ্ট্রপ্রশাসন ব্যবস্থা সূচিত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এ যে, প্রাপ্ত উপাদানসমূহ থেকে পাল প্রশাসন-ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে প্রাপ্ত উপাদানের ভিত্তিতে প্রশাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের এক রূপরেখা প্রণয়ন করা সম্ভব। বাংলায় প্রচলিত গুপ্ত প্রাদেশিক শাসন কাঠামোর উপরই পাল রাজাদের আমলে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যুগেও পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘যুবরাজ’ নামে অভিহিত হতেন। যুবরাজের দায়-দায়িত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। গুপ্তযুগের মতো এ যুগেও রাজপুত্রকে ‘কুমার’ নামে অভিহিত করা হতো। ‘কুমার’ প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদের মতো উচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্ব পেতেন। এ পদে থাকাকালে কুমারগণ রাজার সামরিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
সাম্রাজ্য প্রশাসনে পাল রাজাদের বহুসংখ্যক কর্মচারী ছিলেন যাদের প্রধান ছিলেন ‘মন্ত্রী’ বা ‘সচিব’। পাল রাজাদের শাসনামলেই সর্বপ্রথম রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায় যার পদমর্যাদা প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ। দেবপালের বাদল স্তম্ভলিপি থেকে এ পদের ক্ষমতা ও মর্যাদার বিষয়টি জানা যায়। ধর্মপালের রাজত্বকালে গর্গ নামে একজন ব্রাহ্মণের পরিবারের সদস্যদের জন্য বংশানুক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদ সংরক্ষিত ছিল। গর্গের বংশধরগণ (দর্ভপাণি, সোমেশ্বর, কেদারমিশ্র ও গুরবমিশ্র) পরবর্তী এক শত বছর প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। তারা সকলেই পাল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সুদৃঢ়করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে এরূপ আর এক মন্ত্রী বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। যোগদেব ছিলেন তৃতীয় বিগ্রহপালের এবং তাঁর উত্তরাধিকারী বৈদ্যদেব ছিলেন কুমারপালের প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বংশানুক্রমিক নীতি পরবর্তী চন্দ্র ও যাদব রাজবংশের ক্ষেত্রেও প্রচলিত ছিল। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তি থেকে এর প্রমাণ মেলে।
পাল রাজাদের অধীনে অনেক সামন্ত রাজা ছিলেন। পাল তাম্রশাসনে তাদেরকে ‘রাজন’, ‘রাজন্যক’, ‘রণক’, ‘সামন্ত’ ও ‘মহাসামন্ত’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ সকল পদবির প্রকৃত অর্থ ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা কঠিন। তবে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, তারা ছিলেন শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন। কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগে এ সামন্ত রাজারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের জন্য রামপালের চৌদ্দ জন সামন্তের সহায়তা চাওয়ার ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কখনও কখনও সামন্ত প্রধানদের সাহায্যের উপর পাল রাজাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হতো।
পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় পাল যুগেও বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট যেমন ‘ভুক্তি’, ‘বিষয়’, ‘মন্ডল’সহ অন্যান্য ছোট ছোট বিভাগের প্রচলন ছিল। পাল যুগের লিপিমালায় বাংলায় পুন্ড্রবর্ধনভুক্তি, বর্ধমানভুক্তি ও দন্ডভুক্তি, উত্তর বিহারে তীরভুক্তি, দক্ষিণ বিহারে শ্রীনগরভুক্তি এবং আসামে প্রাগজ্যোতিষভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল লিপিমালা থেকে অনেক ‘বিষয়’ ও ‘মন্ডল’ এর নামও জানা যায়। এছাড়া ‘খন্ডল’, ‘আবৃত্তি’ ও ‘ভাগ’ নামে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ রয়েছে। ‘আবৃত্তি’সমূহ বিভিন্ন ‘চতুরকে’ এবং ‘চতুরক’গুলি সম্ভবত বিভিন্ন ‘পাটকে’ বিভক্ত ছিল। এ বিভাগগুলির যথার্থ প্রকৃতি নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। পাল শিলালিপিতে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মচারীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল ভূমিদান-লিপিতে প্রশাসনিক বিভাগগুলির দায়িত্বে নিয়োজিত রাজকর্মচারীদের সুদীর্ঘ তালিকা থেকে বোঝা যায় যে, এ বংশের শাসনামলে রাজ্যশাসন ব্যবস্থা দক্ষ ও খুবই বিশদ ছিল। তবে এ সকল রাজকর্মচারীর ক্ষমতা ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান সীমিত। রাজকর্মচারীদের এ সুদীর্ঘ তালিকা থেকে পাল প্রশাসনযন্ত্রের ব্যাপক পরিধিসহ বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করা যায়। একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, পাল লিপিমালায় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার উপর বেশ আলোকপাত করা হলেও সেগুলিতে সমসাময়িক প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ নেই। এ যুগে পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় বিভিন্ন ‘অধিকরণের’ প্রচলন অব্যাহত ছিল কিনা বা থাকলেও তাদের গঠন কেমন ছিল তা জানার কোন উপায়ই লিপিগুলিতে বা অন্যত্র কোথাও নেই। তবে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে হলেও এ অধিকরণগুলির অব্যাহত ব্যবহারের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পাল যুগের শাসনব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি প্রকৃতপক্ষে সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করতেন। রাজা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজ্যশাসনে ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করতেন। ‘যুবরাজ’ ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এ যুগে রাজ্যে আরও অনেক ‘মন্ত্রী’ ছিলেন। এদের মধ্যে ‘মহাসান্ধিবিগ্রহিক’, ‘রাজমাত্য’, ‘মহাকুমারমাত্য’ এবং ‘দূত’ ছিলেন প্রধান। ‘মহাসান্ধিবিগ্রহিক’ ছিলেন যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অর্থাৎ অনেকটা আজকের দিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর অনুরূপ। ‘রাজমাত্য’ বলতে সম্ভবত সাধারণভাবে কনিষ্ঠ মন্ত্রীদের বোঝাত। ‘মহাকুমারমাত্যে’র প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় করা যায় না। ‘দূত’ ছিলেন বিদেশি রাজ্যের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষাকারী রাষ্ট্রদূত। উপরিউক্ত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের পরেই এ যুগে ‘অমাত্য’ নামক পদস্থ রাজকর্মচারীর নাম পাওয়া যায়। অন্যান্য উচ্চ রাজকর্মচারীর মধ্যে ‘অঙ্গরক্ষ’ (সম্ভবত রাজার দেহরক্ষী দলের প্রধান) এবং ‘রাজস্থানীয়’র (সম্ভবত রাজ প্রতিনিধি বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা) নাম উল্লেখ করা যায়। ‘অধ্যক্ষ’ নামে কেন্দ্রীয় শাসনের সঙ্গে জড়িত আরও এক ধরনের রাজকর্মচারী থাকতেন যার দায়িত্ব ছিল সাধারণভাবে সামরিক প্রশাসন বিভাগের তত্ত্বাবধান করা। ‘প্রমাতৃ’ ও ‘ক্ষেত্রপ’ নামে আরও দুধরনের কর্মচারীর নাম পাওয়া যায় যারা কেন্দ্রীয় শাসনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সম্ভবত তাদের কার্যক্রম সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধে সীমাবদ্ধ ছিল অথবা তারা ছিলেন জমি জরিপ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। কোন কোন পন্ডিত মনে করেন যে, ‘প্রমাতৃ’ ছিলেন দীউয়ানি মামলার বিচারক।
রাজস্ব প্রশাসন রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, এ যুগে বিভিন্ন ধরনের রাজস্ব আদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। কৃষিভূমির রাজস্ব আদায় করতেন বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের প্রধানগণ যেমন ‘উপরিক’, ‘বিষয়পতি’, ‘দাশগ্রামিক’ ও ‘গ্রামপতি’। রাজস্বের খাত ছিল ‘ভাগ’, ‘ভোগ’, ‘কর’, ‘হিরণ্য’, ও ‘উপরিকর’ প্রভৃতি। এ সকল করের প্রকৃতি নির্ণয় করা কঠিন। তাম্রশাসনে ‘ষষ্ঠাধিকৃত’ নামে রাজস্ব কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি কৃষকদের নিকট থেকে রাজস্বের এক-ষষ্ঠাংশ রাজার প্রাপ্য হিসেবে আদায় করতেন। ‘ভোগ’ কর আদায়ের দায়িত্বে সম্ভবত নিয়োজিত ছিলেন ‘ভোগপতি’। খেয়া পারাপার ঘাট থেকে সম্ভবত রাষ্ট্রের আয় হতো এবং খেয়াঘাটের মাশুল সংগ্রহ করত ‘তরিকা’ নামক কর্মচারী। উপশুল্ক ও আবগারি কর আদায় বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ‘শৌল্কিক’। চোর-ডাকাতদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষার জন্য আরোপিত কর আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ‘চৌরোদ্ধরণিক’। ফৌজদারি অপরাধের জন্য আরোপিত অর্থদন্ড আদায় বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন ‘দশাপরাধিক’। শিলালিপিতে উল্লিখিত ‘মহাক্ষপটলিক’ নামীয় রাজস্ব কর্মকর্তা ‘জ্যেষ্ঠ কায়স্থ’ নামক কর্মচারীর সহযোগিতায় হিসাব বিভাগের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ‘মহাদন্ডনায়ক’ ছিলেন বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। ‘মহাপ্রতিহার’,’দন্ডিক’, ‘দন্ডপাশিক’ ও ‘দন্ডশক্তি’ উপাধিধারী কর্মকর্তারা পুলিশ বিভাগ পরিচালনা করতেন। ‘খোল’ সম্ভবত ছিলেন গুপ্তচর বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা।
সামরিক প্রশাসন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন ‘সেনাপতি’ বা ‘মহাসেনাপতি’। তিনি ছিলেন রাজার সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তি ও উষ্ট্র বাহিনী এবং নৌবাহিনীর জন্য মহাসেনাপতির অধীনে একজন করে স্বতন্ত্র কর্মকর্তা নিযুক্ত থাকতেন। পাল রাজাদের অধিকাংশ শিলালিপিতে ‘গৌড়-মালব-খাশ-হুণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট বাক্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের এ সকল উপজাতীয় লোকদের মধ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে পাল রাজারা রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী গঠন করতেন। শিলালিপিতে বিশেষ কর্মচারী হিসেবে দুর্গাধিপতি ‘কোট্টপাল’ এবং রাজ্যের সীমান্ত রক্ষক ‘প্রান্তপাল’- এর উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও পাল তাম্রশাসনে আরও অনেক রাজ কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ঐ সকল কর্মচারীর নামের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা কঠিন বিধায় তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় না।
মুক্ত বুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
তথ্যসূত্র
[1] ভারতবর্ষ আর বঙ্গালারদেশ কোন অর্থে’ই কোনকালেই এক ছিলোনা, কেননা বাঙ্গালারদেশ বরাবরের মত বাঙ্গালারদেশ’ই, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মত নয় । সম্ভবত সে কারনেই রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও বাঙ্গালার সাথে ভারতবর্ষের কোন মিল নেই। তাই বাঙলার ইতিহাস নিয়ে আমরা যে সব আলোচনা পাই তারমধ্যে একমাত্র নীহাররঞ্জন রায়ের গ্রন্থটিকেই তুলনামূলক ভাবে কম বিতর্কমূলক দলিল হিসেবে পেলেও তবুও অসম্পুর্ন। বাকি গ্রন্থগুলো সেই কলকাতা ঘরানা থেকে মুক্ত হতে পারে নি। তাই বাঙলার ইতিহাসে পুর্ববঙ্গের ইতিহাসকে নিয়ে যে ভাবে অবহেলা আমরা দেখতে পাই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের পরম নমস্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তাই বাঙলার ইতিহাস আজোঅবধি বিতর্কিতভাবে অসম্পুর্ন। এই ইতিহাস এখন নতুন করে লেখার ভার আমাদের নয়া প্রজন্মের।
[2] নির্মলকুমার বসু, “বঙ্গদেশের জাতি ব্যবস্থাঃ কয়েকটি প্রসঙ্গ,” জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ, আইসিবিএস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮,পৃষ্টাঃ ১০৫।
[3] এই আলোচনায় হিন্দু কে ধর্ম হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়নি তাই এই হিন্দু কে একটি সমাজ হিসেবে দেখা হয়েছে। এই আলোচনায় আমরা হিন্দুসমাজ হিসেবে গ্রহণ করবো।
[4] বিবেকান্দের এই বক্তব্যটি সিরাজুল ইসলামের “বাঙালীর জাতীয়তাবাদ” গ্রন্থের পৃষ্টা ১৯ থেকে সংকলিত হয়েছে।
[5] যদিও আওয়ামীলীগ ঘরানার বুদ্ধিজিবিদের অনেকের মতে বাঙ্গালার সুলতানি শাসনামলেই বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিকাশ আর অন্যদিকে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজিবিদের দাবি মধ্যযুগের শেষভাগের আরকান রাজার সভাকবি আলাওল’ই প্রথম বাঙ্গালারদেশি জাতিসত্তার আবিষ্কারক। তবে আরকান রাজার পৃষ্টপোষকতার বদৌলতে আজ বাঙ্গালা ভাষা এবং তার সাহিত্যে যে ব্যপকতা আসে সে সম্পর্কে বললে বেশী বলা হবে না।
[6] সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ-পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্কণ, ভাষার দায় ও দায়িত্ব, পৃঃ ২।
[7] ভারতে কোম্পানি আমলে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বাঙলায় হিন্দু-মুসলিম জাতি ব্যবস্থা শিতিল হয়েছে তা ঠিক নয়, বরং এই জাতিব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্টানগুলির প্রকৃতি নির্ধারনে এক তাৎপর্যপুর্ন ভুমিকাও পালন করেছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, হিন্দুবাদীতামনা বলে অভিযুক্ত করে কংগ্রেস থেকে মুসলিম সামাজ বের হয়ে এসে একটি মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ।
[8] এবনে গোলাম সামাদ, হাজার বছরের বাঙালী, অন্য এক দিগন্ত, জুন সংখ্যা-২০১৫, পৃষ্টাঃ ৫।
[9] ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরুধী আন্দোলন যখন স্বদেশী আনদলনে রূপ নেয় তখন কেবল মাত্র কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু সমাজ এর পেছনে নেতৃত্ব দেয়। পুর্ব বাঙলার কোন হিন্দু সমাজ এই স্বদেশী আনলনে যোগ দেয় নি। বরং পুর্ব বাঙলার হিন্দু সমাজ বাঙলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে ব্রিটিশ গভর্মেন্টের চিরস্থায়ীত্বের জন্যে পার্থনা করেন। এমনকি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেয়ার জন্যে দাক্ষিণ্য প্রাথনা করেন। (দেখুনঃ নির্মলকুমার বসু, “বঙ্গদেশের জাতি ব্যবস্থাঃ কয়েকটি প্রসঙ্গ,” জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ, আই, সি, বি, এস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮, পৃষ্টাঃ ১১৮)
[10] এই দুইজন মারা যায় ১৯০৮ সালে। তারা আসলে বাঙলা রক্ষার নামে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের স্বপক্ষে ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। যা আজ তাদেরকে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মী হিসেবে প্রতিষ্টা দিতে চাচ্ছে। এরা সবাই বঙ্কিমের বান্দেমাতারাম স্বদেশী আন্দোলন করেছিলেন। এরা এখন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের ভাষায় বাঙলা ভাষার জন্যে লড়াইয়ের সেনানী। এদিকে ভারতীয়রা দাবী করছে তারা নাকি ভারতের ফ্রিডম ফাইটার। তাহলে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মূল নায়করা সন্ত্রাসী হিসেবেই ইতিহাসে প্রতিষ্টা পায়। স্বদেশীআন্দোলনের বীজ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনেই নিহিত। তাই এই স্বদেশীআন্দোনের কর্মকাণ্ড ১৯১১ সালের পর সিতিল হয়ে যেতে দেখতে পাই।
[11] বঙ্গভঙ্গ, প্রমথনাথ বিশী, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শতবার্ষিকী সংস্করণ, ব্যাখ্য
[12] নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসঃ রাজন্য কাণ্ড, সম্পাদনাঃ কমল চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম দে’জ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃষ্টাঃ ২৬৮-২৭০।
[13] দেখুন রমাই পণ্ডিতের রচিত শূন্যপুরাণ। এটি একটি পুরাণ ইতিহাসের গুরুত্বপুর্ন দলিল।
[14] হিতেশরঞ্জন সান্যাল, “বাংলায় জাতি’র উতপত্তি”, জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, “জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ,” আইসিবিএস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮,পৃষ্টাঃ ২২-২৩।
[15] হাল বা লাঙ্গলের আদি শব্দ হলো ‘হল’, তাই এই প্রবন্ধে ‘হল’ এর স্থলে ‘হলো’ শব্দটি অধিক যুক্তিযুক্ত বলে গৃহীত হয়েছে।
[16] অনেক সময় অনেক পুরুষের রক্তের সংমিশ্রনে চুলের বাহ্যরূপ এবং বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে খণ্ডিত চুলের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা এই আলোচনায় সম্ভব নয়। উৎসাহীরা সাঁ-মার্তার (সেইন্ট মার্টিন) বই পড়ে নিতে পারেন।
[17] পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের অধিকাংশ জনবাসিগনের মধ্যে এই বিশিষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
[18] বৈদিক সাবল্টার্ন বা নিম্নবর্গ তত্বের বিবেচনায় এরা নিচু শ্রেণির।
[19] আল্পস পর্বতমালা বিষয়ক।
[20] বৈদিক সাবল্টার্ন বা নিম্নবর্গ তত্বের বিবেচনায় এরা উচু শ্রেণির বা ব্রাহ্মণ। এরা উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণদের নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত।
[21] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২২, ২৪ এবং ২৫।
[22] ডঃ অতুল সুর তার গ্রন্থ “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” এবং “বাঙালীর নৃতত্বে” কেবল কিছু সাহিত্যিক এবং ইতিহাসগত পুরাতাত্ত্বিক আলোচনা ছাড়া খুব বেশি বৈজ্ঞানিক আলোচনা করেন নি। বাঙালীর ডিএনএ টেস্ট নিয়ে অনলাইন এ বিস্তর বৈজ্ঞানিক জার্নাল আছে। পাঠক চাইলে পড়ে নিতে পারেন। ডিএনএ টেস্ট দাবী করছে অধিকাংশ বাঙালীর নৃতত্ত্ব বিশিষ্টটা পায় টিবেতো- মোঙ্গলয়েড পর্যায়ভুক্ত। তবে ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা রীজলির নিম্ন শ্রেণির বাঙালীদের প্রাক দ্রাবিড়-মোঙ্গলয়েড অভিমতকে গ্রহণ করেছেন।
[23] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২৫।
[24] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২৫।
[25] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ২।
[26] ড অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, সাহিত্যলোক, কলকাতা, এপ্রিল ২০১২, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৯। ভারতে আর্য-ভাষাভাষীর দুই বিভিন্ন নরগোষ্টিতে বিভক্ত-(১) অলপীয়, (২) নর্ডিক। তাদের পার্থক্য কেবল মাথার আঁকার এবং কপালে। দেখুনঃ ড অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, সাহিত্যলোক, কলকাতা, এপ্রিল ২০১২, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৪২।
[27] বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, রাঙামাটি, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০১৮, ঢাকা পৃষ্টাঃ ৪৩।
[28] পবিত্র সরকার, ভূমিকা আলোচনা, হরপ্রশাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত “বৌদ্ধ গান ও দোহা”,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, পুনঃমুদ্রণ, মাঘ ১৮১৯।
[29] খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশশ্তিতে সমতট নামটি প্রথম জানা যায়। নামটির মাজেজা হচ্ছে ভুভাগে সমতল নদীতট, উচু নিচু নয়। ফলে নিম্ন গঙ্গেয় ভূমি এবং তার পুর্ব ও দক্ষিণ ভূমিকে বিবেচনা করলে সমতটের সংলগ্ন ভূমিকে বঙ্গাল (প্রচুর জলাভুমি অথবা তুলা উৎপাদনকারী অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পরে এই বঙ্গাল থেকেই বাঙ্গাল, বাঙ্গালা শব্দ এসেছে।
[30] পদ্মা আদিতে কোন নদী ছিলো না। এমনকি সে সময় তার কোন অস্থিত্ব ছিল কিনা ইতিহাসে পাওয়া যায় নি। ডঃ ওল্ডহ্যাম ১৮৭০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে উল্লেখ করেন যে, গঙ্গা নদীর মূলশ্রোত রাজমহলের পাহাড়ে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে গতি পরিবর্তন করে প্রথমে ছোট খনন করা খাল ভগীরথী হয়ে এবং পরে হুগলী নামে কলকাতার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। অনেক পরে ভু-আন্দোলন (সম্ভত বখতিয়ারের দিনাজপুর অবস্থানের ২০০ বছর আগে।) এবং ভগীরথীর তলদেশ পলিবালিতে ভরাট হয়ে পদ্মাদিয়ে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়। সুতরাং পদ্মা নদী হিসেবে তার রূপ আমরা দেখি না। বরং খাল হিসেবেই আমরা ইতিহাসে উল্লেখ পাই।
[31] চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়, পত্রাঙ্ক ৭৩। হরপ্রশাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত বৌদ্ধ গান ও দোহা থেকে সঙ্কলিত।
[32] অশোক বিশ্বাস,বাংলাদেশের রাজবংশীঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠাঃ ১৫-১৭।
[33] অশোক বিশ্বাস,বাংলাদেশের রাজবংশীঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠাঃ ১৯।
[34] পুর্নচন্দ্রদেব বর্মা চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত, প্রথম সংস্করণ-১৯২০, পৃষ্টাঃ ২১৩।
[35] বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন, টি এইচ লিউইন, উয়িলিয়াম হান্টার এবং পিইয়ারের বার্মা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক ইতিহাস গ্রন্থসমূহ।
[36] চট্টগ্রামের মানুষদেরকে চাটগাইয়া বলে।
[37] খন্দকার মুজাম্মিল হক সম্পাদিত সৈয়দ নুরুদ্দিনঃ জীবন ও গ্রন্থাবলী, বাঙলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৭। সৈয়দ নুরুদ্দিন চকরিয়া বাসী মধ্যযুগের কবি (১৭২৫-১৮০০)। তার লেখা ‘রাহাতুল কুলুব’ গ্রন্থের বংশলতিকায় উল্লেখ করেন তার পুর্ব পুরুষ গৌড়ের মহামারীতে জীবীকার খোঁজে চট্টগ্রামে চলে আসেন। মধ্যযুগের অনেক কবিদের বংশলতিকায় এ ধরণের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
[38] যে সমস্ত পূজা-পার্বন এখন আমরা রূপান্তরিত ব্রাহ্মণ্য হিন্দু বাঙালীদের পালন করতে দেখি তা মধ্যযুগের শুরুতেও প্রাক-দ্রাবিড়ীয়-আদি-অস্ট্রিক জনগোষ্টির গৃহের অভ্যন্তরে অন্ধকারে পড়ে ছিলো। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বাঙ্গালার পূজা পার্বন নিয়ে লেখা অনেক বিখ্যাত গবেষকদের বই বাজারে পাওয়া যায়। বিনয় ঘোষ, রেবতী বর্মন, ওয়াকিল আহমেদ, কাজী আব্দুল অদুদের অনেক বই এখনো পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষে স্থানীয় অনার্যদের দেবীদের (যেমন দুর্গা,কালি) সাথে আর্যদের দেবতার (শিব) বিয়ে-সংসারের (মনসা,কারতিক,গনেশ) মধ্য দিয়েই মূলত আর্যদের ভারতবাসস্থায়ীকরন এবং সম্ভত এখান থেকেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শুরু বলে অনেক ঐতিহাসিকদের অভিমত।
[39] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ১।
[40] গঙ্গা শব্দ থেকে গাং শব্দটি উতগত হয়েছে। এই গাং ইউরুপে পৌঁছে হয়ে গেলো বণিক পথ। সুতরাং নদী বিজ্ঞানের কাছে গঙ্গা একটি বণিক পথ মাত্র। প্রাচীন কালে বণিকদের যাতায়াত সুবিধার জন্যেই এই নদীকে খনন করা হয়েছিলো।
[41] পুরাণ মতে, রাজা সাগরের ৬০ হাজার পুত্র ছিল। রাজা সাগরের যজ্ঞের ঘোড়া ইন্দ্র চুরি করে পালিয়ে গিয়ে কলকাতার দক্ষিণে এসে পড়ে। এদিকে রাজা তার ৬০ হাজার পুত্রদেরকে ঘোড়া উদ্ধারের জন্যে মাটি কুঁড়ার নির্দেশ দেন। পুত্ররা মাটি খুঁড়ে কলকাতার দক্ষিণে কপিলমুনির আস্তানায় এসে ঘোড়া খুঁজে পান। মুনিকে চোর মনে করলে কপিলমুনি হুঙ্কার দিয়ে সকলে আগুনে দগ্ধ করেন। এরপর সাগর রাজা ভগিরথ সাগরদ্বীপের দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এসে সাগর রাজার ছেলেদের উদ্ধার করেন।
[42] পুরাণের যুগ যখন শুরু হয় তখন, এক দল দেব-উপাসনা শুরু করে এবং আরেক দল অসুর-উপাসনা শুরু করে। এর পর এই ভুখণ্ডে দুই গোষ্টিতে বিভক্ত হয়ে পড়লো অসুর আর দেব উপাসনার মধ্য দিয়ে।
[43] কৃত্তিবাস, লাইনগুলো কলিম খানের “ঝর্নাধারা থেকে সৃষ্টিধারা” প্রবন্ধ থেকে সংকলিত হয়েছে।
[44] The colonial British surveyors in India from the late 1700’s, in their quest for the origin of the Ganga River, have done extensive survey of the Himalayan region. Some of the illustrious surveyors were Captain Herbert, Rennel and Sir William Willcocks.
They and the other surveyors have recorded their findings in journals and book of their times. In these records, they emphatically and unambiguously state that the Ganga is not a natural river, but a man made river by the ancients of India. It started as a canal along with many other canals dug by the ancients. (See-Ganga: The Sign of Great Endeavour by Parvathy Menon)
[45] The Asiatic Annual Register: Or, a View of the History of Hindustan, and of the Politics, Commerce and Literature of Asia, Volume 3. Page 26-27, edited by Lawrence Dundas Campbell, E. Samuel.
[46] শহীদুল্লাহ মৃধা, বাংলাদেশের নদ-নদী গুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা, নদী সংখ্যা, ১৯৯৯-২০০০, পৃষ্টাঃ ৪১।
[47] চীনা পরিব্রাজক এবং ভিক্ষু হিউয়েন সাং (৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) কামরূপ গমনের সময় করতো নদীর বিরাট প্রবাহের কথা তিনি বলে গেছেন। এমনকি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি (১২০৪/১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) আসাম হয়ে তিব্বত গমনের সময় বিশাল করতয়ার ভীষণ রূপ দেখে বিশ্মিত হন। সে সময়ও করতোয়া গঙ্গার চেয়ে তিনগুন বড় ছিলো।
[48] বাঙলাকে ঘিরে আমরা পুরাণ থেকে যে সব তথ্য পাই তার বড় একটি অংশ লিখিত হয়েছিলো খ্রিষ্টিয় ১৪০০ শতক থেকে ১৭০০ শতকের। অল্প কিছু লিখিতি হয়েছিলো পাল আমলে। যার অধিকাংশই সেন আমলে প্রিতিলিপিত হয়ে নিজের করে নিয়ে হিন্দু পুরাণে রূপান্তরিত করেছে এমন প্রমাণ আমাদের অনেক ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং ভাষাত্বাত্ত্বিকরা করেছেন। পাল আমলের শেষের দিকে রচিত বৌদ্ধদের মৌলিক পুরাণগুলোর একটি বড়অংশ চৈতন্য দেবের উত্তানের ফলে হিন্দু পুরাণ নাম দিয়ে অনেক অধ্যায় সংযোজিত এবং প্রক্ষেপিত করেছে তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ বৌদ্ধদের রচিত শূন্যপুরাণ কে নকল করে অনেক পুরাণ হিন্দুদের নিজের করে নিয়েছে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড ইনামুল হক, ড মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ড সুকুমার সেন, আলী আহসান, ড আহমদ শরীফ)
[49] ময়মনসিংহের মধুপুর বনাঞ্চল এবং ঢাকার সাভারের লাল শক্ত মাটি এসেছে উপর থেকে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতের ঢলে। এই মাটির উৎস পুর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চল থেকে।
[50] শহীদুল্লাহ মৃধা, বাংলাদেশের নদ-নদী গুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা, নদী সংখ্যা, ১৯৯৯-২০০০, পৃষ্টাঃ ৩৮।
[51] গুঁড়ের দেশ গৌড় বলতে মূলত পশ্চিম বঙ্গের মালদাহ মুর্শিদাবাদকেই বুজায়। বাঙলাকে নয়।
[52] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ২-৩।
[53] মহাভারতে বর্নিত ভগীরথ-গঙ্গা-পদ্মাবতীর পৌরানিক কাহিনী মূলত খনের ইতিহাস। ষাট হাজার শ্রমিকের নিরলস খননের ফলে এই প্রবাহ তৈরি হয়েছিলো তা আজ বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত। সমুদ্র যাত্রা আরও যেন সহজ হয় তার জন্যে ভগীরথী খালটি গঙ্গার ধারা থেকে কেটে দিয়ে ছোটনাগপুর উপত্যকায় উৎপন্ন নদীর মজাখাতগুলোকে অবলম্বন করে সমুদ্রের খাড়ির সঙ্গে যুক্ত করেছিলো রাজা ভগীরথ। বৈদিকমত ধারার রাজা ভগীরথ (ইতিহাস যাদেরকে আর্য বলে) বর্তমানের চব্বিশ পর্গনা, হাওড়া, মেদিনীপুর এবং কপিলমুনি রাজ্যে যাতায়াতের সুভিধার জন্যে লোকজদের (ইতিহাস যাদেরকে অনার্য বলে) সাথে এক ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের ফলে এই খাল কাটা কাজ করেন, ফলে এই কাজের মহাত্ন্য কীর্তিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। (দেখুনঃ শহীদুল্লাহ মৃধা, বাংলাদেশের নদ-নদী গুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা, নদী সংখ্যা, ১৯৯৯-২০০০, পৃষ্টাঃ ৪৪।)
[54] পৌরানিকদের দাবী হচ্ছে এই নদী নাকি দেবী পার্বতির বক্ষদেশ থেকে এই নদী প্রসারিত হয়েছে। পুরাণের ভাষ্য মেনে নিলে, এ তথ্য দাঁড়ায় যে, তিস্তার এই রূপ ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের। যেহেতু এই সময়কালকে অনেক বিতর্ক বাদ দিলে সাহিত্যকরা এটাকে পৌরানিক কাল হিসেবে দেখেছে। আজকের তিস্তার রূপ পাল্টেছে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের খরা, প্লাবন এবং ভু-আন্দোলনের ফলে।
[55] সর্বভারতীয় মুসলিমলীগরা কংগ্রেসীদের হিন্দু পক্ষপাতিত্বতার কারণে তাদেরকে সাম্প্রদায়িক দল বলতো। কংগ্রেস মূলত হিন্দুদের স্বার্থকেই বড় করে দেখার ফলে বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মুসলিম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
[56] গোটা ভারতবর্ষ শিব পত্নীর ৫২ টি অঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেখানে পড়েছে সেখানেই শিব লিঙ্গ প্রতিষ্টার মধ্য দিয়ে মঠ নির্মান তথা সীমানা তৈরি হবে। এবং এটাই হচ্ছে হিন্দু ভূমি।
[57] এবনে গোলাম সামাদ, বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, অন্য এক দিগন্ত, মে ২০১৫ সংখ্যা, পৃষ্টা-১১।
[58] রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহসা।
[59] জয়া চ্যঠারজি, ২০০২, বাঙলা ভাগ হল, হিন্দু সাম্প্রদায়কিতা ও দেশ বিভাগ, ১৯৩২-১৯৪৭, পৃঃ ১।
[60] অল-ইন্ডিয়া কেনসাস ১৯৩২।
[61] আবুল মোমেন, ১৯৯৬, সাংস্কৃতিক শঙ্কট এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদ। পৃঃ ৯।

Sunday 29 November 2015

ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব এক আর্যদের বাংলায় আগমন এবং বাংলার আদি অধিবাসী সুসভ্য দ্রাবিড় জাতির উপরে চালিয়ে ছিল নির্মম বর্বর গণহত্যা


ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব এক
আর্যদের বাংলায় আগমন এবং বাংলার আদি অধিবাসী সুসভ্য দ্রাবিড় জাতির উপরে চালিয়ে ছিল নির্মম বর্বর গণহত্যা
সূফি বরষণ
দ্রাবিড় নামক প্রধান সুসভ্য জাতি বাস করিত। এই দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের ভূমি সন্তান। এদেশে বহিরাগত আর্যদের আগমনের পর হতেই দ্রাবিড়দের সাথে আর্যদের সংঘাত শুরু হয়। পর দেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আর্যদের সংগ্রাম শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের সংঘাত অব্যাহত থাকে ॥ আর্যরা বাংলাদেশ জয়ের জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। প্রতিবারই তারা পরাজিত হয় গাঙ্গেয় বদ্বীপের বীর জাতির কাছে। যে কারণে আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদে বাঙালি জাতি সম্পর্কে রয়েছে নানা ধরনের অবজ্ঞাপ্রসূত উক্তি॥ পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম গ্রন্থে এমন জঘন্য ভাষায় বর্ণনা করা হয় নাই কোনো সুসভ্য জাতির বিরুদ্ধে ???!!॥
যারা যুগ যুগ ধরে অসভ্য আর্যদের দ্বারা অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে ॥ আর উল্টো ঐ সময়ে রচিত আর্যদের ধর্ম গ্রন্থ বেদ এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় দ্রাবিড় জাতির বিরুদ্ধে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা হেয় আর ছোট জাত হিসেবে বর্ণনা করে॥ কেউ বেদ পড়ে দেখতে পারেন দ্রাবিড় জাতিকে নিয়ে কেমন জঘন্য ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে ॥
রবীন্দ্রনাথের লেখা ভারতের জাতীয় সংগীতে দ্রাবিড় জাতির উল্লেখ আছে॥
"দ্রাবিড় উৎ‍‌কল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা
উচ্ছল জলধি তরঙ্গ"
তথ্যের স্বল্পতার কারণে প্রাক-মুসলিম যুগের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠন করা শ্রমসাধ্য ও কষ্টকর। এ অসুবিধা আরও বেশি করে অনুভূত হয় প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনায়- অর্থাৎ প্রাচীনতমকাল থেকে খ্রিস্টীয় চার শতকে বাংলায় গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত। এ সময়ের ইতিহাসের উপাদানের জন্য নির্ভর করতে হয় বৈদিক, মহাকাব্যিক ও পৌরাণিক সাহিত্যের অপর্যাপ্ত তথ্য ও প্রাপ্তিসাধ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনাদির ওপর। গুপ্তযুগ থেকে পরবর্তী সময়ের জন্য আমরা প্রস্তরাদিতে উৎকীর্ণ লিপি ও সাহিত্যাকারে লিখিত তথ্যাদি পাই। এসব তথ্যে বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়।
ব্রাহ্মণজনগোষ্ঠী আর্যরা ভারতের ভূমি সন্তান নয়॥ এরা বহিরাগত।॥ আর্যরা অভাব দারিদ্র্য খাদ্য সংকট প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা যুদ্ধজনিত কারণে বিতাড়িত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দিকে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে আসে।
পটভূমি জানা যায় যে, সর্বপ্রাচীনকালে বাংলায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোক বসবাস করত এবং যে অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করত সে অঞ্চল সেই জনগোষ্ঠীর নামে পরিচিত হতো। এভাবে বঙ্গ, পুন্ড্র,রাঢ় ও গৌড় নামক প্রাচীন জনপদসমূহ অনার্য জনগোষ্ঠীর দ্বারা এ সব নামের অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে মেঘনার ওপারে সমতট (কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল) ছিলো একটা গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। এ জনপদের নাম পুরোপুরি বর্ণনাত্মক এবং জনগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা বর্জিত। চট্টগ্রাম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলহরিকেল নামে পরিচিত ছিলো। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে অনার্য জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে এ সকল জনপদের কথা জানা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্যভাগে প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আর্য-প্রভাব অনুভূত হয়।
আর্যদের আগমনের পূর্বে এদেশে অনার্যদের বসবাস ছিল। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অষ্টিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয় এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল।
অষ্ট্রিক জাতির সমসাময়িক বা কিছু পরে আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে এবং দ্রাবিড় সভ্যতা উন্নত বলে অষ্ট্রিক জাতি এদের মধ্যে মিলে যায় ॥ অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রনেই সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী। এদের রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহমান। ভারত উপমহাদেশে আর্যকরণ শুরু হয় প্রায় ১৫০০ খ্রি. পূর্বাব্দ থেকে। ইউরোপ থেকে আগত আর্যরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত পারস্য পেরিয়ে ভারতে আগমন করে। এ ব্যাপারে শ্রী অমিত কুমার বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘খৃস্টের জন্মের দেড় বা দুই হাজার বৎসর পূর্বে অর্থাৎ আজ হইতে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে ভারত বর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কাছে আর্য জাতির এক শাখা পশ্চিম পাঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয়। তাহাদের পূর্বে এদেশে কোল ভিল সাওতাল প্রভৃতি অসভ্য জাতি এবং দ্রাবিড় নামক প্রধান সুসভ্য জাতি বাস করিত।’
এই দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের ভূমি সন্তান। এদেশে আগমনের পর দ্রাবিড়দের সাথে আর্যদের সংঘাত শুরু হয়। পর দেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আর্যদের সংগ্রাম শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের সংঘাত অব্যাহত থাকে। দূর দেশ থেকে ভয়সংকুল পথ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে সংকটের মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখার কৌশল অর্জন করে আর্যরা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জাতিগত সংকটের কারণে তারা দক্ষতার সাথে দ্রাবিড়দের মুকাবিলা করতে সক্ষম হয়। এক পর্যায়ে তারা ভূমি সন্তান দ্রাবিড়দের উপর বিজয়ী হয়। কালক্রমে দ্রাবিড়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর্যরা রপ্ত করে নেয়। দুই সভ্যতার মিশ্রণে নতুন সাংস্কৃতিক ধারা এবং ধর্মীয় অনুভবের সূচনা হয়। ওদিকে পরাজিত দ্রাবিড়রা বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয় অথবা আর্যদের অধীনে লাঞ্ছিত হতে থাকে। আর্যরা পরাজিত দ্রাবিড়দের ওপর তাদের নির্দেশনা চাপিয়ে দেয়। আর্যদের প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ প্রথার সর্বনিম্ন স্তরে দ্রাবিড়দের স্থান দেয়া হয়। পিরামিডের শীর্ষে স্থান নেয় আর্যরা। সর্ব নিম্নে অবস্থান হয় দ্রাবিড়দের। পিরামিডের স্তর বিন্যাস হয় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ দিয়ে। পুরো পিরামিডের ভার বহন করতে হয়- দ্রাবিড়দের। পর্যায়ক্রমে দ্রাবিড়রা আর্যদের বিন্যস্ত সমাজে হারিয়ে যায়। রুশ ঐতিহাসিক এ জেড ম্যানফ্রেডের মতে, সে যুগে ব্রাহ্মণদের কোন কর দিতে হত না। ক্ষত্রিয় শুদ্র প্রভৃতি জাতিকে ছোট লোক শ্রেণীর ধরা হত। নব্বই বছরের বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়কে নয় বছরের ব্রাহ্মণের পদ সেবা করতে হতো। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতির কাছে তাদের উৎপাদনের ৫ অথবা ৬ ভাগের এক ভাগ কর আদায় করা হত। নর হত্যা করলে শিরোশেদ হতো বটে কিন্তু কোন ব্রাহ্মণ যদি শুদ্রকে হত্যা করতো তাহলে শুধু মাত্র সামান্য জরিমানা দিলেই চলতো। যেমন পোষা কুকুর মেরে ফেলার শাস্তিস্বরূপ কিছু জরিমানা হয়।
এইভাবে নিম্নস্তরে অবস্থানকারী সমগ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আর্যরা সমকালীন সমাজ বিন্যস্ত করে ধর্মীয় আবেশ সৃষ্টি করে। সে সময় বিবেক বহির্ভূত অন্ধ আবেগের দ্যোতনা সৃষ্টি করে নিত্য নবনব নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয় সাধারণ মানুষের ওপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাধারণ মানুষকে ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। অন্ধকারের পর যেমন আলো দেখা যায়, গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে অনুরূপ নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা সম্বলিত সমাজে নির্যাতন বিরোধী প্রতিরোধ শক্তির অভ্যুদয় হয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ধারক ব্রাহ্মণ্য সমাজে জন্ম নেয় গৌতম বুদ্ধ। রাজকীয় সুখ সাচ্ছন্দ এবং প্রভুত্বের ব্যঞ্জনা তাকে আটকে রাখতে পারল না। যুগ যুগান্তর ব্যাপী দক্ষিণ এশিয়ায় মানবতার লাঞ্ছনা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যকার পুঞ্জিভূত দুঃখ ক্লেশ অসম্মান ও অবমাননা তার মধ্যে ভাবান্তরের সূচনা করে। তিনি রাজকীয় সুখ সম্ভোগের মোহ পরিত্যাগ করে দেশান্তরিত হন এবং প্রচলিত নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন কোন ব্যবস্থার ছক অর্জন না হওয়া পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে চিন্তার গভীরে ডুব দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন নতুন ব্যবস্থার সূত্রসমূহের আবিষ্কার তার সন্তুষ্টির সীমায় এসে পড়ে তখন তিনি তার মত প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সমকালীন ঘুণে ধরা বির্তনমূলক সমাজ কাঠামোর বিপরীতে তার নতুন চিন্তা শোষিত বঞ্চিত নির্যাতীত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নবতর এক বিপ্লবের বার্তা হয়ে অনুরণিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে বৌদ্ধবাদ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে শোষণ ও বিবর্তনমূলক সমাজ কাঠামোর ধারক কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি তাদের প্রভুত্ব হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মানবিক বিপ্লব প্রতিহত করার জন্য বৌদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। বৌদ্ধদের ধর্মবিরোধী নাস্তিক এবং বিদ্রোহী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে বৌদ্ধ বিরোধী উম্মাদনা সৃষ্টি করে বৌদ্ধদের উৎখাতে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা।
ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক। বৌদ্ধগ্রন্থে এদের নাম আছে। মহাভারতে এদের নাম হেতুবাদী। তারা আসলে নাস্তিক। তারা বলতেন, পরকাল আত্মা ইত্যাদি বড় বড় কথা বেদে আছে কারণ ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোকরাই বেদ সৃষ্টি করেছে, ভগবান নয়। বেদের সার কথা হল পশুবলি। যজ্ঞের নিহত জীবন নাকি স্বর্গে যায়। চার্বাকরা বলেন, যদি তাই হয় তাহলে যজ্ঞকর্তা বা জজমান তার নিজের পিতাকে হত্যা করে স্বর্গে পাঠান না কেন...
‘... এই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে বেদ ভক্তদের সংগে বৌদ্ধদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঝাপ দিতে হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে নাস্তিক, চার্বাকদের উক্তিতেই প্রমাণ রয়েছে। অতএব বৌদ্ধরা মূর্তিপূজা যজ্ঞবলি বা ধর্মাচার নিষিদ্ধ করে প্রচার করছিল পরকাল নেই, জীব হত্যা মহাপাপ প্রভৃতি। মোটকথা হিন্দু ধর্ম বা বৈদিক ধর্মের বিপরীতে জাতি ভেদ ছিল না।
রাইন নদী থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে আর্যজাতির বাস ছিল।অনেকে মনে করেন হিন্দুকুশ পর্বত বেয়ে যারা উপমহাদেশে আগমণ করে তারাই ভারতীয় আর্য। ইরানী প্রাচীণ শাসকরাও নিজেদেরকে আর্যবংশ সম্ভূত বলে দাবী করতেন। আর্যরা ছিল সভ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতির দিক দিয়ে যতটা না উন্নত তার চেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল যোদ্ধা বা যুদ্ধবাজ হিসেবে॥ ঋগবেদ আর্যজাতির সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ। খ্রীস্টপূর্ব ১৭০০ থেকে খ্রীস্টপূর্ব ১১০০ সালের মধ্যে ঋগবেদ রচিত হয।ঋগবেদ মূলত দেবতাদের উদ্দ্যেশ্যে লিখিত। ঋগবেদের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবতা ইন্দ্র আর ইন্দ্রের প্রধান শত্র 'বৃত্তাসুর॥৭ম শতকে আর্যরা বঙ্গ সহ উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। পর্যায়ক্রমে অত্যাচারি আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক। দ্রাবিড়দের নগরগুলো ধ্বংস সাধনের সময় আর্যরা যে গণহত্যার আশ্রয় নেয় তা, ঐসব নগর সমুহের গণকবর বা বৈধ্যভূমি আবিস্কারের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন॥ আর্যরা যাযাবর হওয়ায় তাদের কাছে নগর জীবন উপেক্ষিত ছিল। গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবপূর্ব কালে উপমহাদেশে আর্যজাতি বিভিন্ন জন বা উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। এসব জনদের বসতিকে জনপদ বলা হত। এসব জনপদ গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পুবের্বই রাজ্যে পরিণত হয়। মুঘলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিলো না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠি ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও চালিয়েছিলো ব্যাপক আক্রমণ। আর্যদের ধর্মই বৈদিক ধর্ম যা কালক্রমে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিতি পায়। প্রাচীন কালে চীনা পরিব্রাজক যখন বাংলাদেশ ভ্রমন করেন তখন সারা বাংলায় আর্য ভাষার প্রচলন হয়। সিংহলী ও বেদিয়া মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা হতে উৎপন্ন হয়েছে। আর্যদের আগমনের পর বাংলা ও বিহার অঞ্চল জুড়ে মগধ রাজ্য সংগঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে। বাংলায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে। বৈদিক ধর্মের ধারক-বাহকদের বলে আর্য জাতি। বাংলায় এ আর্য জাতির আগমন মূলত খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত॥ বাংলার আর্যদের আগমন হয়েছিল প্রাচীন পারস্য থেকে। সে সময় পারস্যে বৈদিক ধর্ম চালু ছিল। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে মূলত আর্য-পূর্ব বাঙালি জনগোষ্ঠীর।
ভারতীয় এই আর্য জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে যা জানা যায় তার অধিকাংশ তাদের শাস্ত্র বেদ (Vedas) এর মাধ্যমে, যার মানে জ্ঞানশাস্ত্র (Books of Knowledge)। এটি স্বর্গীয় প্রশংসাগাঁথা (hymns), মন্ত্র (spells) ও ধর্মাচারের (rituals) সমাহার, বিভক্ত চারটি উপভেদে:
১। রিগবেদ (Rig Veda), যাতে আছে স্বর্গীয় প্রশংসাগাঁথা, আবৃত্তি করবেন প্রধান পুরোহিত।
২। যজুর্বেদ (Yajur Veda), যাতে আছে উৎসর্গ বা যজ্ঞনীতি, পাঠ করবেন তদারককারী পুরোহিত।
৩। সামবেদ (Sama Veda), যাতে আছে মন্ত্রপুত সূত্র, গাইবেন মন্ত্রোচ্চারক পুরোহিত।
চতুর্থটি হচ্ছে অথর্ববেদ (Atharva Veda), যা মূলত বিভিন্ন যাদু-মন্ত্র, গাঁথা, ভবিষ্যতবাণী ও বিপদতাড়িণী মন্ত্রের সমাহার।
বেদ প্রথমে মৌখিকভাবে (oral tradition) সংরক্ষিত ছিল, পরে ১৫০০ থেকে ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে সংস্কৃতের একটি প্রাচীনরূপে এটি লিখিত হয়। বেদের নাম থেকেই নামকরণ হয় ভারতীয় ইতিহাসের বৈদিক যুগ (Vedic Age), বিস্তারকাল আনুমানিক ১৫০০-২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ।
আগন্তুকরা নিয়ে আসে যুদ্ধরথ (war chariots), লৌহাস্ত্র (iron weapons) এবং গরুর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যা তার লালন পালন করত; আর নিয়ে আসে তাদের বিভিন্ন প্রকৃতি দেব-দেবী (pantheon of gods), যেমন বজ্র ও তুফানদেবতা ইন্দ্র (Indra), ভোরের দেবী ঊষা (Usha)। ইন্দ্রের পিতা আকাশ দেবতা দ্যায়ুস পিতার (Dyaus Pitar) ও মনুষ্য মাতা পৃথিবী (Mata Prithivi)। দ্যায়ুসের উৎপত্তি প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান আকাশ দেবতা *Dyeus এর সাথে সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা যায়, গ্রীসে যার পরিচিতি Zeus patēr (কর্মকারকে Día, সম্মন্ধ পদে Diós), রোমে Jupiter (প্রাচীন লাতিন Iove pater বা 'Sky father' থেকে উদ্ভূত), স্লাভিক (Slavic) পুরাণে Div, এবং জার্মানিক ও স্ক্যান্ডিনেভীয় (Norse) পুরাণে Thor, Tyr বা Ziu.
ভারতীয় আর্যরা প্রথমদিকে পিতৃতান্ত্রিক বিভিন্ন গোত্র-পরিবারে একজন যুদ্ধনেতার (warrior-chieftain, সংস্কৃতে রাজাচ) অধীনে বসবাস করত; গোত্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হত সভার মাধ্যমে। পুরোহিতগন (priest) দেবতাদের সম্মানার্থে, সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে এবং গোত্রনেতাদের শাসনের বৈধতা দিতে পালন করতেন উৎসর্গ বা যজ্ঞ (yajna, yagya)। ধীরে ধীরে গড়ে উঠে একটি কঠোর সামজিক বিভাজন রেখা যা পরে জন্ম দেয় দীর্ঘমেয়াদি বর্ণপ্রথার (caste system)।
আর্যদের আগে এ দেশে অন্যান্য জাতির ধর্ম পালনের নজির রয়েছে। তবে আর্যদের মাধ্যমে বৈদিক ধর্ম এ দেশের জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। আর্যদের ধর্মগ্রন্থ- বেদ বেদের অংশ- ৪টি (ঋক, সাম, যজু, অথর্ব) বেদের রচয়িতা- ঈশ্বর মহাভারতের রচয়িতা- দেবব্যাস রামায়ণের রচয়িতা- বাল্মিকী আর্যসাহিত্যকে বলা হয়- বৈদিক সাহিত্য আর্যসমাজ- ৪ ভাগে বিভক্ত (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য, শূদ্র) আর্য বিশ্বাস অনুযায়ী যুগ ৪টি- সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা, কলি (এখন কলিকাল) আর্যগণ প্রথমে পশু পালন করে জীবিকানির্বাহ করতেন। প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড়রা ধান চাষ করত। ধান ছাড়াও দ্রাবিড়রা গম ও যবের আবাদও করত। দ্রাবিড়রা অস্ট্রিকভাষী আদি অস্ট্রেলীয়দের মতোই মাছ খেত। মাছ ধরা ছাড়াও তারা নদীতে কিংবা সমুদ্রের ধারে মুক্তা ও প্রবাল আহরণ করত। সংস্কৃত ভাষায় মুক্তা, নীর (পানি), মীন (মাছ) এসব শব্দের মূলে রয়েছে দ্রাবিড় শব্দ। আর্যরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে হানা দেয়, তখন তাদের হাতে পতন হয় একের পর এক জনপদের। সুসভ্য সিন্ধু উপত্যকার মানুষ যাযাবর যুদ্ধবাজ আর্যদের সঙ্গে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। শুধু ভারতবর্ষ নয়, শ্রীলঙ্কায়ও আগ্রাসন চালায় তারা। আর্যরা বাংলাদেশ জয়ের জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। প্রতিবারই তারা পরাজিত হয় গাঙ্গেয় বদ্বীপের বীর জাতির কাছে। যে কারণে আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদে বাঙালি জাতি সম্পর্কে রয়েছে নানা ধরনের অবজ্ঞাপ্রসূত উক্তি। অনেকেই মনে করেন আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণকর্তা । সিন্ধুবাসীরা শিব ও মাতৃকা দেবীর আরাধনা করলেও আর্যদের প্রধান দেবতা ছিল পুরুষ (ইন্দ্র) । আর্যরা মৃতদেহ দাহ করত । সিন্ধুবাসীরা কবর দিত । বিদেশ থেকে আগত বহিরাগত আর্যরাই ভারতকে অনার্য মুক্ত করেছে, মানে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংস লীলা চালায় দ্রাবিড় জাতির উপরে । শিব, মহাদেব, রাবণ ও মহীষাসুর ছিলেন অনার্য দেবতা ও রাজা মহারাজা। কিছুটা সমঝোতা, কিছুটা দমন করেই আর্যরা সারা ভারত দখল করে নেয়। আর্যরা ভারতে প্রবেশের পর ব্রহ্মাবর্ত নামক একটি স্থানে প্রথম বসতী স্থাপন করেছিলেন। সেই স্থানের একটি নদীকে আর্যরা সরস্বতী নামে আখ্যায়িত করেন। এই নদীটি ক্রমে ক্রমে পবিত্র নদী হিসাবে আর্যদের কাছে সম্মানিতা হয়ে উঠে। বেদে সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে।
দ্রাবিড় অধ্যুষিত সিন্ধু, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারত আর্যদের দখলে চলে যাওয়ার পর এই যাযাবরদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে অধিকাংশ দ্রাবিড় দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর্যরা তাদের দখল বাড়াতে আরো পুবদিকে অগ্রসর হয়। সামরিক বিজয়ের সাথে সাথে বৈদিক আর্যরা তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির বিজয় অর্জনেও সকল শক্তি নিয়োগ করে। প্রায় সম্পর্ণ উত্তর ভারত আর্যদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। কিন্তু স্বাধীন মনোভাব ও নিজ কৃষ্টির গর্বে গর্বিত বঙ্গবাসীরা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুকে দাঁড়ায়। ফলে করতোয়ার তীর পর্যন্ত এসে আর্যদের সামরিক অভিযান থমকে দাঁড়ায়।
আমাদের সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের এই প্রতিরোধ-যুদ্ধ সম্পর্কে অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু লিখেনঃ
“প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত যখন বিজয়ী আর্য জাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াচিল, বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়াছিল। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই”। (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ২১)
সামরিক অভিযান ব্যাহত হওয়ার পর আর্যরা অগ্রসর হয় ঘোর পথে। তারা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিযান পরিচালনা করে। তাই দেখা যায়, আর্য সামাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা এ দেশে প্রথম আসেনি, আগে এসেছে ব্রাহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। কেননা, ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতার বিজয় সম্পন্ন হয়ে গেলে সামরিক বিজয় সহজেই হয়ে যাবে। এ এলাকার জনগণ ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম পরিচালনা করেন, তা ছিল মূলত তাদের ধর্ম-কৃষ্টি-সভ্যতা হেফাযত করার লড়াই। তাদের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম শত শত বছর স্থায়ী হয়। ‘স্বর্গ রাজ্যে’ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রামের যে অসংখ্য কাহিনী ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ প্রভৃতি আর্য সাহিত্যে ছড়িযে আছে, সেগুলো আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রামেরই কাহিনী। আমাদের পূর্ব পুরুষদের গৌরবদীপ্ত সংগ্রামের কাহিনীকে এসব আর্য সাহিত্যে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ধর্মশাস্ত্রে কোন মানবগোষ্ঠীকে এমন নোংরা ভাষায় চিহ্নিত করার নযীর পাওয়া যাবে না। উইলিয়াম হান্টার তার ‘এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ বইয়ে ও প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
“সংস্কৃত সাহিত্যে বিবৃত প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা হলো আদিম অধিবাসীদের সাথে আর্যদের বিরোধ। এই বিরোধজনিত আবেগ সমানভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঋষিদের স্তবগানে, ধর্মগুরুদের অনুশাসনে এবং মহাকবিদের কিংবদন্তীতে। ……… যুগ যুগ ধরে সংস্কৃত প্রবক্তারা আদিবাসীদেরকে প্রতিটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার হতে বঞ্চিত করে তাদের থেকে ঘৃণাভরে দূরে থেকেছে”।
সাংস্কৃতিক সংঘাত
কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ‘এর সোশ্যাল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ বইয়ে দেখিয়েছেনঃ তিন স্তরে বিভক্ত আর্য সমাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা প্রথমে বাংলায় আসেনি। এদেশে প্রথমে এসেছে ব্রহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। বাংলা ও বিহারের জনগণ আর্য-অধিকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালনা করেন, তাও ছিল ধর্মভিত্তিক তথা সাংস্কৃতিক।
আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ধর্ম তথা সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে জেগে ওঠা এই এলাকার সেমিটিক ঐতিহ্যের অধিকারী জনগণের সংক্ষোভের তোড়ে উত্তরাপথের পূর্বপ্রান্তবর্তী প্রদেশগুলোর আর্য রাজত্ব ভেসে গিয়েছিল।
বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব চার শতক পর্যন্ত এদেশে আর্য-প্রভাব রুখে দেওয়া সম্ভব হয়। খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে মৌর্য এবং তার পর গুপ্ত রাজবংশ প্রতিষ্ঠার আগে বাংলায় আর্য ধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হয়নি। মৌর্যদের বিজয়কাল থেকেই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বাড়তে থাকে। তারপর চার ও পাঁচ খ্রিস্টাব্দের গুপ্ত শাসনামলে আর্য ধম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে।
মৌর্য বংশের শাসনকাল পর্যন্ত বৌদ্ধ-ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। আশোকের যুগ পর্যন্ত এই ধর্মে মূর্তির প্রচলন ছিল না। কিন্তু তারপর তথাকথিত সমন্বয়ের নামে বৌদ্ধ ধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু তান্ত্রিকতার প্রবেশ ঘটে। হিন্দু দেব-দেবীরা বৌদ্ধ মূর্তির রূপ ধারণ করে বৌদ্ধদের পূজা লাভ করতে শুরু করে। বৌদ্ধ ধর্মের এই বিকৃতি সম্পর্কে মাইকেল এডওয়ার্ডট ‘এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেনঃ
“Buddhism had, for a variety of reasons, declined and many of its ideas and forms had been absorbed into Hinduism. The Hinduization of the simple teachings of Gautama was reflected in the elevation of th Buddha into a Divine being surrounded, in sculptural representations, by the gods of the Hindu partheon. The Buddha later came to be shown as an incarnation of Vishnu.”
সতিশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্হে লিখেছেনঃ
“যোগীরা এখন হিন্দুর মত শবদেহ পোড়াইয়া থাকেন, পূর্বে ইহা পুঁতিয়া রাখিতেন। …….. উপবিষ্ট অবস্থায় পুঁতিয়া রাখা হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগিত, তাঁহারা মনে করিতেন, উহাতে যেন শবদেহ কষ্ট পায়”।
অর্থাৎ হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগার কারণে এভাবে বৌদ্ধদেরকে পর্যায়ক্রমে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি তথা জীবনাচরণের অনেক বৈশিষ্ট্যই মুছে ফেলতে হয়েছিল। অশোকের সময় পর্যন্ত বুদ্ধের প্রতিমা-পূজা চালু ছিল না। পরে বুদ্ধের শূন্য আসনে শোভা পেল নিলোফার বা পদ্ম ফুল। তারপর বুদ্ধের চরণ দেখা গেল। শেষে বুদ্ধের গোটা দেহটাই পূজার মণ্ডপে জেঁকে বসল। এভাবে ধীরে ধীরে এমন সময় আসল, যখন বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ লোপ পেতে থাকল।
গুপ্ত আমলে বাংলাদেশে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দোর্দন্ড প্রতাপ শুরু হয়। আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোত প্রবল আছড়ে পড়ে এখানে। এর মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালিত হয় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মকে আশ্রয় করে। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি বাংলা ও বিহারের জনগণের আত্মরক্ষার সংগ্রামে এ সময় প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর জনগণের আর্য-আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ শক্তিকে অবলম্বন করেই বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিন এ এলাকার প্রধান ধর্ম ও সংস্কৃতিরূপে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতে ঐতিহাসিকও স্বীকার করেছেনঃ
“আর্যরাজগণের অধঃপতনের পূর্বে উত্তরাপথের পূর্বাঞ্চলে আর্য ধর্মের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন উপি্থি হইয়াছিল। জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম এই আন্দোলনের ফলাফল”।(বাঙ্গালার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৭-২৮)
এ আন্দোলনের তোড়ে বাংলা ও বিহারে আর্য রাজত্ব ভেসে গিয়েছিল। আর্য-দখল থেকে এ সময় উত্তরাপথের পুব-সীমানার রাজ্যগুলো শুধু মুক্তই হয়নি, শতদ্র নদী পর্যন্ত সমস্ত এলাকা অনার্য রাজাদরে অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ও সংস্কৃতির অনাচারের বিরুদ্ধে সমুত্থিত জনজাগরণের শক্তিতেই শিশুনাগবাংশীয় মহানন্দের শূদ্র-পুত্র মাহপদ্মনন্দ ভারত-ভূমিকে নিঃক্ষত্রিয় করার শপথ নিয়েছিলেন এবং ক্ষত্রিয় রাজকুল নির্মূল করে সমগ্র আর্যবার্ত অনার্য অধিকারে এনে ‘একরাট’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।
বাংলাদেশেই আর্যবিরোধী সংগ্রাম সবচে প্রবল হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে আবদুল মান্নান তালিব লিখিছেনঃ
“সেমিটিক ধর্ম অনুসারীদের উত্তর পুরুষ হিসেবে এ এলাকার মানুষের তৌহিদবাদ ও আসমানী কিতাব সম্পর্কে ধারণা থাকাই স্বাভাবিক এবং সম্ভাবত তাদের একটি অংশ আর্য আগমনকালে তৌহীদবাদের সাথে জাড়িত ছিল। এ কারণেই শের্কবাদী ও পৌত্তলিক আর্যদের সাথে তাদের বিরোধ চলতে থাকে”। (বাংলাদেশে ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৪)
জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতমের জীবনধারা এবং তাদের সত্য-সন্ধানের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করে মওলানা আবুল কালাম আযাদসহ অনেক গবেষক মনে করেন যে, তারা হয়তো বিশুদ্ধ সত্য ধর্মই প্রচার করেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ও বিকৃতি তাদের সে সত্য ধর্মকে পৃথিবীর বুক থেকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে যে, তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া আজ অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে মান্নান তালিব লিখেছেনঃ
“জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করলে এ ষড়যন্ত্রের বহু ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। এ উভয় ধর্মই আর্যদের ধর্মীয় গ্রন্হ বেদকে ঐশী গ্রন্হ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তপস্যা, যাগযজ্ঞ ও পশুবলিকে অর্থহীন গণ্য করে। ব্রাহ্মণদের পবিত্রাত্মা ও নরশ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণাকে সমাজ থেকে নির্মূল করে দেয়। ফলে বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি নড়ে উঠে। স্বাভাবিকভাবে জনসাধারণ এ ধর্মদ্বয়ের আহ্বানে বিপুলভাবে সাড়া দেয়। দ্রাবিড় ও অন্যান্য অনার্য ছাড়া বিপুল সংখ্যক আর্যও এ ধর্ম গ্রহণ করে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মদ্বয়কে প্রথমে নাস্তিক্যবাদের অন্তর্ভুক্ত করে। নাস্তিক্যবাদের সংজ্ঞা তারা এভাবেই নিরুপণ করে যে, বেদবিরোধী মাত্রই নাস্তিক। কাজেই জৈন ও বৌদ্ধরাও নাস্তিক। অতঃপর উভয় ধর্মীয়দের নিরীশ্বরবাদী প্রবণতা প্রমাণ করার চেষ্টা চলে”। (বাংলাদেশে ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)
মওলানা আবুল কালাম আযাদ দেখিয়েছেন যে, বুদ্ধ কখনো নিজেকে ভগবাদ দাবি করেননি। অশোকের যুগ পর্যন্ত বুদ্ধ-মূর্তির প্রচলনও কোথাও ছিল না। প্রতিমা পূজাকে সত্যের পথে এক বিরাট বাধা গণ্য করে সেই অজস্র খোদার খপ্পর থেকে বুদ্ধ মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি ব্রাহ্মণ্য খোদাকে অস্বীকার করে দিব্যজ্ঞানলাভ ও সত্য-সাধনায় মুক্তি নিহিত বলে ঘোষণা করেছিলেন।
বাংলায় দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে দীর্ঘ দিন আর্য-প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এরপর খ্রিস্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্ত শাসনে আর্য ধর্ম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্য বৈদিক হিন্দু ধর্মের কিছুই প্রসার হয়নি। ষষ্ঠ শতকের আগে বঙ্গ বা বাংলার পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ঢুকতেই পারেনি। উত্তর-পূর্ববাংলায় ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে ওঠে। পঞ্চম ও অষ্টম শতকের মধ্যে ব্যক্তি ও জায়াগার সংস্কৃতি নাম পাওয়া যায়। তা থেকে ড. নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, তখন বাংলার আর্যয়করণ দ্রুত এগিয়ে চলছিল। বাঙালি সমাজ উত্তর ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হচ্ছিল। অযোধ্যাবাসী ভিণ প্রদেশী বাহ্মণ, শর্মা বা স্বামী, বন্দ্য, চট্ট, ভট্ট, গাঙি নামে ব্রাহ্মণেরা জেঁকে বসেছিলঃ
“বাংলাদেশের নানা জায়গায় ব্রাহ্মণেরা এসে স্থায়ী বাসিন্দা হতে লাগলেন, এরা কেই ঋগ্বেদীয়, কেই বাজসনেয়ী, কেউ শাখাব্যয়ী, যাজুর্বেদীয়, কেই বা সামবেদীয়, কারও গোত্র কান্ব বা ভার্গব, বা কাশ্বপ, কারও ভরদ্বাজ বা অগস্ত্য বা বাৎসা বা কৌন্ডিন্য। এমনি করে ষষ্ঠ শতকে আর্যদের বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার পূর্বতম প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল”। (ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ঃ বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব, পৃষ্ঠা ১৩২)
সাত শতকের একেবারে শুরুতে গুপ্ত রাজাদের মহাসামন্ত ব্রাহ্মণ্য-শৈবধর্মের অনুসারী শশাংক রাঢ়ের রাজা হয়ে পুন্ড্রবর্ধন অধিকার করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে রাজধানী স্থাপন করে তিনি বৌদ্ধ নির্মূলের নিষ্ঠুর অভিযান পরিচালনা করেন। রাজা শশাংক গয়ায় বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন। তিনি আদেশ জারি করেনঃ
“সেতুবন্ধ হইতে হিমালয় পর্যন্ত যেখানে যত বৌদ্ধ আছে, তাহাদের বুদ্ধ হইতে বালক পর্যন্ত যে না হত্যা করিবে, সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইবে”। (রামাই পণ্ডিতের শূন্য পুরাণ, পৃষ্ঠা ১২৪)
এই দীর্ঘ আলোচনা হতে পরিষ্কার বুঝা যায় দ্রাবিড় জাতি আমাদের পূর্ব
পুরুষ ॥ এবং বহিরাগত আর্যদের দ্বারা অত্যাচারি দ্রাবিড় জাতি ইসলামের সাম্যের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মুসলিম হয়॥ এরাই আমাদের পূর্ব পুরুষ ঐ বহিরাগত আর্যারা নয়॥
তথ্য সূত্র:
মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস- মাওলানা আকরম খাঁ।
বাংলাদেশে ইসলাম- আব্দুল মান্নান তালিব।
বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা- কে.এম. রইসউদ্দীন খান।
ফিনিসিয়া থেকে ফিলিপাইন- মোহাম্মাদ কাসেম।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা (মুসলিম বিশ্ব সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৮৪)।
ভারতবর্ষের ইতিহাস- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান।
ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমদ মর্তুজা।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ- আই. এইচ. কোরেশী।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব- ড. তারা চাঁদ।
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস- ড. আব্দুল করীম।
বরেন্দ্র অঞ্চলে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য- ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী।
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ

Friday 27 November 2015

একজন কিংবদন্তি মহানায়ক জিয়াউর রহমান কেবল ‘রাষ্ট্রপতি’ই নন; তিনি আমাদের ‘রাষ্ট্রপিতা

একজন কিংবদন্তি মহানায়ক জিয়াউর রহমান কেবল ‘রাষ্ট্রপতি’ই নন; তিনি আমাদের ‘রাষ্ট্রপিতা।

সূফি বরষণ
দলীয় কার্যনির্বাহী সভায় অবৈধ  হাসিনা বলেছে, ‘জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি বলা যাবে না!! এর  প্রতিক্রিয়া হিসেবে  আজকের এই লেখা ॥ যে অবৈধ খুনী হাসিনা দেশকে একটি মৃত্যুপুরী বানিয়ে রেখেছে আর এক স্বৈরাচার এরশাদকে সাথে নিয়ে ॥ সে এখন ক্ষমতার দম্ভে বড় বড় বুলি আওরায়!!??? বড়ই বেশারাম মহিলা হাসিনা ভুলে গেছে যে জিয়াউর রহমানের কারণেই বাকশালীরা আবারও দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাই॥

মূষিক-সভার এক বৈঠকে অবৈধ ডিক্টেটর হাসিনা বলেছে, ‘জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি বলা যাবে না।’

যিনি মহান স্বাধীনতার ঘোষক, যিনি বাংলাদেশের স্থপতি, যিনি একটি জাতির স্রষ্টা, যিনি আধুনিক বাংলার রূপকার তাঁকে শুধু রাষ্ট্রপতি বলে সম্বোধন করলে কেবল তাঁর কীর্তিকেই খাটো করা হয় না বরং বক্তার মূর্খতাও প্রকাশ পায়॥

জিয়াউর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এক রাষ্ট্রনায়কের নাম। তিনি একজন অকুতোভয় শহীদ দেশ গড়তে গিয়ে যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি ছিলেন বঞ্চিত-ক্ষুধাতাড়িত-দিশেহারা এক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনের সফল কারিগর। যিনি  খোদা প্রদত্ত সেরা নেয়ামত বাংলাদেশের জনগণের জন্য ॥
সুতরাং শহীদ জিয়াউর রহমান কেবল ‘রাষ্ট্রপতি’ই নন, তিনি আমাদের রাষ্ট্রপিতা।

আসলে জিয়াউর রহমানের নামটির মধ্যেই অবৈধ হাসিনা সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন॥  কারণ জিয়া নামটি শুনলেই মনে হয়:

১. বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক
২. জেড ফোর্সের অধিনায়ক
৩. বীর উত্তম
৪. বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি
৫. বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা
৬: সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাদাতা
৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতাদাতা
৮. বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোর স্থপতি
৯. ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা বাংলার রাখাল রাজা
১০. সমগ্র মুসলিম বিশ্বের একতার প্রতীক
১১. প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাতা
১২. শিশু একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা
১৩. শিশুদের মেধা বিকাশে নতুন কুঁডি অনুষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা
১৪. ভারতীয় পানি আগ্রাস রোধে এবং পরিবেশ জীব বৈচিত্র রক্ষা বিনাশ্রমে বিনা অর্থ ব্যয়ে অসংখ্য খাল নদী খনন ও সংস্কার করেন॥ ১৫. সারা দেশের পরিত্যক্ত পুকুর ডোবা জলাশয় সংস্কার করেন॥
১৬. ধর্ম ভিত্তিক দলসহ সকল দলের রাজনীতি করার স্বাধীনতা দান করেন যা শেখ মুজিব বাকশালের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল॥
১৭. জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট নিমকো প্রতিষ্ঠাতা॥
জানালেন প্রধানমন্ত্রী
১৮. সত্যোজ্জ্বল অতীত, যোগ্য নেতৃত্ব, সততা ও স্বচ্ছতা
১৯. অসহায়, দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা, তার নেতৃত্বে খুঁজে পায় তাদের স্বপ্নের ভবিষ্যত্
২০.তার যোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-বাকশালের একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে রক্ষা পায় দেশ
২১. তিনি উপহার দিয়েছিলেন জাতিসত্তার নতুন এক বিনির্মাণ— বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, যা ছিল আধুনিক ও হাজার বছরের ইতিহাস নির্ভর
২২. জাতীয় জীবনে যে হতাশা ও নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছিল তা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে দেশবাসীকে তিনি নতুন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে জাগিয়ে তুলেছিলেন উন্নয়নের রাজনীতিতে
২৩. প্রতিটি ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ খুঁজে পেয়েছিল তাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ। ফলে কর্ম ও উত্পাদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল
২৪. তার নেতৃত্বে ফিরে আসে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার
২৫. সর্বোপরি শহীদ জিয়ার যোগ্যতা, দেশপ্রেম, সততা ও স্বচ্ছতায় আকৃষ্ট হয়ে দেশের মেধাসম্পন্ন গুণী মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে। তারই আদর্শ ও অনুপ্রেরণা লালন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বার বার দেশ পরিচালনা করে এসেছে। এখনো বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে তার প্রতিষ্ঠিত দল বহুদলীয় গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম করে যাচ্ছে॥
জিয়াউর রহমান, এরশাদকে সাবেক রাষ্ট্রপতি বললে আদালত অবমাননা হবে অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন॥ পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের পর জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের নামের আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি বলে অভিহিত করলে তা আদালত অবমাননা হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড ও নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের এক যৌথসভায় অবৈধ  প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

অবৈধ প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমানকে আর রাষ্ট্রপতি বা সাবেক রাষ্ট্রপতি বলা যাবে না। যদি রাষ্ট্রপতি বলা হয়, তবে সেটা হাইকোর্টের রায়কে লঙ্ঘন করা হবে। কারণ তাঁর ক্ষমতা অবৈধ। সেটা ঘোষণা হয়ে গেছে এবং তাঁর মাধ্যমে যে মার্শাল অর্ডিন্যান্স, অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা বা যেসব আইন যা কিছু হয়েছিল সব কিন্তু বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই এখন সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ বা জিয়াউর রহমান কেউ কিন্তু আর সাবেক প্রেসিডেন্ট না। সেটা বলা যাবে না। কারণ তাঁরা অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী।
 ১৬ কোটি জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে হাসিনা-রওশন-এরশাদ-ইনু-রাশেদ খানগংরা ভারতীয় অপ-শক্তির ইন্ধনে নির্বিচারে হত্যা,গুম, জেল,জুলুম,নির্যাতন,হামলা,মামলা ও গন গ্রেফতার চালিয়ে বাংলাদেশকে দুঃশাসন ও স্বৈরাচারের স্বর্গরাজ্যে পরিনত করেছে।

 এমতাবস্থায় দেশে পুনরায় সুশাসন, গনতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গন-আন্দোলনের মাধ্যমে এ স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানোর জন্য মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লক্ষ লক্ষ সৈনিক তৈরি আজ॥ যুগ যুগ ধরে জিয়া থাকবে কোটি মানুষের হূদয়ে  শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ধন হয়ে ॥ আর হাসিনার মতো নর্দমার কীটবিশেষ কে মানুষ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জালিম হিসেবে ঘৃণার সাথে স্মরণ করবে॥

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ

Thursday 26 November 2015

একজন কিংবদন্তির অভিনেতা আমির খান এবং সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠন শিবসেনাকে নিয়ে কিছু পর্যালোচনা ॥



একজন কিংবদন্তির অভিনেতা আমির খান এবং সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠন শিবসেনাকে নিয়ে কিছু পর্যালোচনা ॥
সূফি বরষণ
আমির খানের পুরো নাম মোহাম্মদ আমির হোসেন খান ॥ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালের ১৪ মার্চ ॥ তিনি একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্য লেখক এবং টেলিভিশন উপস্থাপক। হিন্দি চলচ্চিত্রে সফল কর্মজীবনের মাধ্যমে, খান ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী অভিনেতা এক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি চারটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং সাতটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার এবং মনোনয়নঅর্জন করেছেন, এবং ভারত সরকার কর্তৃক ২০০৩ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০১০ সালেপদ্মভূষণ পদকে সম্মানিত করা হয়। এছাড়া তিনি মাঝে মাঝে গান গেয়ে থাকেন। তিনি নিজস্ব উদ্যোগে চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থাআমির খান প্রোডাকশন্‌স প্রতিষ্ঠা করেছেন।
চাচা নাসির হুসেনের ‘ইয়াদোঁ কি বারাত’ (১৯৭৩) ছবিতে একজন শিশুশিল্পী হিসাবে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয়। তবে পেশাগতভাবে তাঁর অভিনয় জীবনের সূচনা হোলি (১৯৮৪) ছবির মাধ্যমে। প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবি চাচাতো ভাই মনসুর খানের কেয়ামত সে কেয়ামত তক। এই ছবির জন্য তিনি ‘শ্রেষ্ঠ নবাগত অভিনেতা’ হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোট সাতবার মনোনয়ন পেলেও তিনি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার জেতেননি। অবশেষে ১৯৯৬ সালে “রাজা হিন্দুস্তানি” ছবির জন্য তিনি ফিল্ম ফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান।
ভারত সরকারের তাকে শিল্পকলার প্রতি তার অবদানসমূহের জন্য ২০০৩ সালে পদ্মশ্রী পদক এবং ২০১০ সালে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে, টাইম ম্যাগাজিনের তালিকার তিনি বিশ্বের ১০০ সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন।
আমির খান ভারতের মুম্বাইয়ে বান্দ্রা হলি ফ্যামিলী হাসপাতালে একটি মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যিনি সক্রিয়ভাবে কয়েক দশক ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িত। তাঁর পিতা তাহির হুসেন একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক ছিলেন যখন তার চাচা নাসির হোসেন একটি চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে একটি পরিচালননা এবং অভিনয়ও করেছিলেন। আমির খান এর মায়ের নাম হল জিনাত হোসেন। তার ভাই বোনেরা হলেন “ফয়সাল খান”, “ফরহাত খান” এবং “নিখাত খান”। ইমরান খান হলেন আমির খানের ভাগ্নে।
তাঁর পরিবার ভারতীয় চলচ্চিত্রের সাথে কয়েক দশক ধরে জড়িত। তাঁর বাবা তাহির হুসেন ছিলেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক এবং তাঁর চাচা নাসির হুসেন ছিলেন একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা। আমির খানের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আফগানিস্তানের অধিবাসী। আমির খান ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা আন্দোলনর নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বংশধর।
অভিনয় সাফল্যের ইতিহাস
আমিন খান মাত্র আট বছর বয়েসে ইয়াদুন কি বারাত(১৯৭৩) এবং মাদহোশ (১৯৭৪) শিশু অভিনেতা হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১১ বছর পর প্রাপ্তবয়স্ক অভিনেতা হিসাবে কেতন মেহতারহোলি (১৯৮৪) ছবিতে কাজ করেন, যদিও ছবিটি তেমন সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়নি। প্রথম উল্লেখযোগ্য ছবি হিসেবে ১৯৮৮ সালে কেয়ামত সে কেয়ামত তক মুক্তি পায়, যেটি মনসুর খান নির্দেশনা করেন | ছবিটি বিরাট সাফল্য পায় এবং মুখ্য ভূমিকায় আমির খান জনপ্রিয় হয়ে যান। আমিরের চকোলেট হিরো লুক এর জন্য তিনি “টিন আইডল” হিসাবে পরিচিতি পান।রাখ ছবির জন্য আমির জাতীয় পুরস্কার পান, স্পেশাল জুরি শ্রেণীতে| ৮০ দশকের শেষে এবং ৯০ দশকের শুরুতে আমির বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন,যেমন দিল (১৯৯০),দিল কে মানতা নেহি (১৯৯১), জো জিতা ওহি সিকান্দার (১৯৯২), হাম হ্যাঁ রাহি পেয়ার ম্যাঁয়(১৯৯৩) (যার চিত্রনাট্যও তিনি লেখেন), এবংরঙ্গিলা (১৯৯৫)| সব কটি ছবি সমালোচক কর্তৃক ও বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পায় | আমির বছরে ১টি কি ২টি ছবিতে অভিনয় করতে শুরু করলেন। ১৯৯৬ সালে দারমেশ দর্শন-এর রাজা হিন্দুস্তানি ছবিতে করীশমা কপূর-এর বিপরীতে অভিনয় করেন | রাজা হিন্দুস্তানি এর জন্য আমির প্রথম টাইম ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান, সাতবার মনোনীত হওয়ার পর| রাজা হিন্দুস্তানি ৯০-এর দশকের বড় হিট ছবিগুলোর মধ্যে একটি ছিল| ১৯৯৭ এ অজয় দেবগন, জুহি চাওলা ও কাজলের সাথে ইশক নামের একটি কমেডি ছবিতে অভিনয় করেন ,যেটি বেশ ভালো সাফল্য পায়| বেশ কিছু ছবি, যেমন:সারফারোশ, ১৯৪৭ আর্থ এ দারুণ অভিনয় করার জন্য তিনি সমালোচক কর্তৃক প্রশংসিত হন| ২০০১ এ ‘লগান’ ছবিতে ‘ভুবন’ এর চরিত্রে অভিনয় করে অসাধারন একটি গল্প আমাদেরকে উপহার দেন, যে ছবিটি ভারতীয় ক্রিকেট দলকে অনুপ্রাণিত করে ২০০১ এর ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ ও ২০০৩-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপে। ‘লগান’ বাণিজ্যিক সাফল্য পায় এবং সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে ৭৪তম একাডেমী অ্যাওয়ার্ডে মনোনিত হয়।দিল চাহ্‌তা হ্যাঁয় (২০০১) ছবিতে একজন আধুনিক যুবকের ভূমিকায় অভিনয় করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। চার বছর কোনো ছবিতে কাজ না করার পর ২০০৫ এ কেতন মেহতার মঙ্গল পাণ্ডে: দ্য রাইজিং ছবিতে ছবির নামভূমিকায় অভিনয় করেন। ২০০৬ সালে রঙ দে বাসন্তী ছবির জন্য আমির সেরা অভিনেতা’ (সমালোচকদের পছন্দ) ফিল্মফেয়ার এর পুরস্কার পান। ছবিটি ২০০৬ এর শ্রেষ্ঠ বানিজ্যিক সাফল্য পায় এবং বৈদেশিক ছবির শ্রেণীতেতে অস্কারের জন্য মননীত হয়। ২০০৭ এ আমির ছবির প্রযোজক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং একটি ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চার গল্প আমাদের সামনে তুলে ধরেন, ছবির নাম তারে জমিন পার। ২০০৮ এ নিজেকে পুরোপুরি বদল করে আমির গজনী নামের দক্ষিণী পুনঃনির্মিত ছবিতে অভিনয় করেন, যেটি বিরাট সাফল্য পায়। ২০০৯ এ আমির থ্রি ইডিয়টস ছবিতে ‘র‍্যাঞ্চো’ চরিত্রে অভিনয় করেন,যেটি এখন পর্যন্ত বলিউড এর ইতিহাসে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছবি | আমিরের পরের ছবিতালাশ ৩০ নভেম্বর, ২০১২-তে মুক্তি পেয়েছে। ২০১৪ তে মুক্তি পায় আমির অভিনীত পিকে মুভিটি। এ পর্যন্ত বলিউডের সবচেয়ে বেশি আয় করা ছবির তালিকায় রয়েছে আমিরের পিকে। প্রথম ছবি হিসেবে শুধু ভারতেই ৩০০ কোটি রুপি আয়ের মাইলফলক স্পর্শ করা ‘পিকে’ এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কোটি রুপি আয় করে তার এই সিনেমাটি বলিউডের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমার শীর্ষে অবস্থান করছে। আমির সামাজিক সমস্যা গুলো নিয়ে সত্যমেব জয়তে নামে একটি নতুন টক-শো পরিবেশনা করছেন, যেটি মানুষকে নতুন ভাবে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য করছে সামাজিক বিষয়গুলোকে নিয়ে এবং তার প্রতিকার নিয়ে। এই শোটিও ভারত ও এর বাইরে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে॥
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Aamir_Khan
এবার সন্ত্রাসী সংগঠন শিবসেনাকে নিয়ে কিছু বলি॥
শিবসেনার ওয়েবসাইট http://www. shivsena.org
শিব সেনা হল মহারাষ্ট্র কেন্দ্রিক উগ্র সন্ত্রাসী জঙ্গী হিন্দু জাতিয়তাবাদী রাজনীতিক দল। ১৯ শে জুন ১৯৬৬ সালে বাল ঠাকরে এই দলের পত্ত্ন করেন। তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসি ছিলেন ও হয়ে উঠেছিলেন মারাঠিদের হূদয়ের সম্রাট। তার মূল রাজনৈতিক কর্মকান্ড মূলত পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট রাজ্যের মারাঠি ভাষীদের মধ্যে ছিল। দলটির সদ্যস্যরা শিবের সৈনিক হিসাবে পরিচিত। এই দলকে ভারতের ফ্যাসিবাদী দল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অনেকে এই দলকে সত্রাসবাদী দল হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং এটি সরাসরিভাবে ১৯৭০ সালের ভিওয়াদি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথে জড়িত।
শিবসেনা ১৯৭০ সালের ভিওয়াদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে অসংখ্য মুসলমানদের হত্যা করে॥
২০১২ সালের ১৭ নভেম্বর ভারতের কুখ্যাত হিন্দু সন্ত্রাসী, জঙ্গী উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বালঠাকরে মারা যায়। তার মৃত্যুতে শিবসেনার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মহারাষ্ট্রের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। ভারতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তার শেষকৃত্যে যোগ দেয়। মুম্বাইয়ের সিনেমা অভিনেতাদেরকেও দেখা যায় সেখানে। এদেশে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ফাঁসি হয়, আর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের সর্বাপেক্ষা রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ‘মুম্বাই দাঙ্গা’র ইন্ধনদাতা বালঠাকরে পায় রাষ্ট্রীয় সম্মান!
সেখানে শাহীন ধানধা নামক মহিলা ভারতের এই সাম্প্রদায়িকতাসর্বস্ব হিন্দু সমাজের দিকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে লিখেছিল, “বালঠাকরের মতো মানুষ প্রতিদিন জন্মায় এবং মারা যায়। তার জন্য সব বন্ধ করে দিতে হবে কেন”, ফেসবুকে মন্তব্য করে সে। তার এই ফেসবুক মন্তব্যে ‘লাইক’ দিয়েছিল ২০ বছর বয়সী রেণু শ্রীনিবাসন নামের আরেক তরুণী। এরপরই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। (সূত্র: বিবিসি)
১৯৭০ ভিওয়াদি দাঙ্গা হল মুসলিম বিরোধী সহিংসতার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত যা ৭ এবং ৮ ই মে ভারতের ভিওয়াদি, জালগাঁও, মাহাদেস্ংগঠিত হয়। বিশাল পরিমাণ অগ্নিসংযোগ ও মুসলিম মালিকানাধীন সম্পত্তি ভাংচুর করা হয় এবং ২ দুই হাজার ৫ শতের অধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই দাঙ্গা শিব সেনা দ্বারা পূর্ব পরিকল্পিত নিয়মে সংগঠিত হয়।
স্বাধীনতার পর ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেচিত যেখানে একাধিক উগ্র হিন্দু জাতিয়তাবাদি সংঘঠন যথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, জন স্ংঘ ও শিব সেনা জড়িত ছিল।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে আরএসএস, জন সংঘ ও শিব সেনা এবং মুসলিম দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ, ভারতীয় ইউনিয়ন মুসলিম লীগ ও মজলিস তামির-ই-মিল্লাত এর মধ্যে চাপা উত্তেজনা দীর্ঘায়িত সময়ের পর্যন্ত বিদ্যমান
ছিল।
‘ভারত ছেড়ে চলে যাবেন কিনা’ – ভাবছেন আমির খান
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় শঙ্কা প্রকাশ করে মন্তব্যের জন্য বিজেপির তোপের মুখে পড়েছেন আমির
ভারতে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক চলছে, তাতে নিজের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত উদ্বেগ ব্যক্ত করার পর সরকারের তোপের মুখে পড়েছেন বলিউড অভিনেতা আমির খান।
তিনি বলেছিলেন, দেশের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত কি না, তা নিয়েও স্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে।
এর পরই অভিনেতা-শিল্পীদের একাংশ আমির খানের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছেন – তাতে যোগ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারাও।
গত সোমবার রাতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার একটি অনুষ্ঠানে একই বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ালেন বলিউডের আর এক বিগ খান – আমির।
আমির সেখানে বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী কিরণ সারা জীবন ভারতে থেকেছি, কিন্তু সম্প্রতি কিরণ আমায় প্রশ্ন করেছে, আমাদের কি ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত? এটা ওর জন্য একটা সাঙ্ঘাতিক কথা – কিন্তু ও ওর সন্তানকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে, আমাদের চারিদিকে যে ধরনের পরিবেশ তাতে ভয় পাচ্ছে। রোজ সকালে ও খবরের কাগজ খুলতেও ভয় পাচ্ছে।’
ভয়ংকর বিপদে আমির খান, জিডি
২৫ নভেম্বর ২০১৫
অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খোলায় বলিউড সুপারস্টার আমির খানের বিরুদ্ধে জিডি দায়ের করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বলিউডে তাঁর একদল সহকর্মী যেমন মিস্টার পারফেকশনিস্টের মন্তব্যের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন, তেমনই কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি-সহ অনেকেই PK স্টারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
পরিবার নিয়ে ভারতে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়ে আমির খান উদ্বেগ প্রকাশ করায় তাকে ভয়ংকর আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। দিল্লির নিউ অশোকনগর থানায় বলিউডের এই মেগাস্টারের বিরুদ্ধে FIR দায়ের করা হয়েছে। দিল্লির রাস্তায় অভিনেতার পোস্টার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেছেন বিজেপি-র কর্মী সমর্থকরা।
শাহরুখের বিরুদ্ধে শিবসেনার প্রতিবাদকে ঘিরে বিতর্ক বাড়ছে
বেকায়দায় দুটোই৷ একদিকে বলিউড, অন্যদিকে ক্রিকেট৷ ভারতীয় তারকা শাহরুখের ওপর ক্ষিপ্ত ধর্মীয় মৌলবাদী দল শিবসেনা৷
ভারতে মুসলিমদের ভোটাধিকার কাড়ার প্রস্তাব দিয়েছে শিবসেনার সিনিয়র নেতা সঞ্জয় রাউত ॥
ভারতে মহারাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনা তাদের দলীয় মুখপত্র ‘সামনা’-তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রস্তাব দিয়েছে, ভারতে মুসলিমদের স্বার্থেই তাদের ভোটাধিকার প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত।
শিবসেনার মতে, এতে মুসলিমদের নিয়ে ভারতে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি বন্ধ হবে।
সামনা-তে এই বিতর্কিত নিবন্ধটি লিখেছেন শিবসেনার সিনিয়র নেতা, রাজ্যসভা এমপি ও দলের অন্যতম মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত। আর নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি শিবসেনার প্রয়াত সুপ্রিমো বাল ঠাকরের মন্তব্যকেও টেনে এনেছেন।
বাল ঠাকরেকে উদ্ধৃত করে মি রাউত লিখেছেন, ‘‘বালাসাহেব বলেছিলেন মুসলিমদের যতদিন ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করা হবে ততদিন তাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ফলে যেদিন মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে তখন ভারতে যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে থাকেন, তাদের মুখোশ ফাঁস হয়ে যাবে!’’॥ সূত্র বিবিসি
http://www.bbc.com/…/20…/04/150412_sg_shivsena_muslim_voting
খুরশিদ কাসুরির বই প্রকাশ অনুষ্ঠান বাতিলের দাবিতে হুমকি দিল শিবসেনার
পাকিস্তানের প্রখ্যাত গজল শিল্পী গুলাম আলীর অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পর এবার সাবেক পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরির বই প্রকাশ অনুষ্ঠান বন্ধ করার দাবি জানিয়ে হুমকি দিল শিবসেনা। অনুষ্ঠান বন্ধ করা না হলে তাতে বাধা দেয়ার হুমকি দিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ওই দলটি।
শিবসেনার দাবি, পাকিস্তান ভারতে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে নিরীহদের হত্যা করছে। এজন্য এই অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া যায় না। আগামীকাল ১২ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে ‘Neither a hawk nor a Dove : An insider’s Account of pakistan’s Foreign policy’ নামে বই প্রকাশ করার কথা রয়েছে।
দলের সেনা বিভাগের প্রধান আশীষ চেম্বুরকর এজন্য নেহেরু তারামণ্ডলের পরিচালককে চিঠি লিখে নির্ধারিত ওই অনুষ্ঠান বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। চেম্বুরকর বলেছেন, নেহরু তারামণ্ডলের পক্ষ থেকে তাদের দাবি অনুযায়ী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় স্পষ্ট জানিয়েছেন, যদি তা না করা হয় তাহলে এই অনুষ্ঠানে বাধা দিতে তারা মোটেও পিছপা হবে না।
অনুষ্ঠান বাতিল করা না হলে শিবসেনা এই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেবে এবং এজন্য যাবতীয় ক্ষতির দায়ভার নেহেরু কেন্দ্রের কর্মকর্তার উপরে বর্তাবে বলেও হুমকি দেয়া হয়েছে।
রেডিও তেহরানhttp://bangla.irib.ir/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%…
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ