বেগম রোকেয়ার অর্ধাঙ্গিনী প্রবন্ধ নারীর অধিকার খর্ব করেছে, যা আল কোরআনে উল্লিখিত নারীর মর্যাদা ও সম্মানের সাথে বিরোধপূর্ণ।
সূফি বরষণ
বেগম রোকেয়া অর্ধাঙ্গিনী প্রবন্ধের বলেছেন, ‘প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত।’
এখানে উল্লিখিত অর্ধাঙ্গিনী ও প্রভু শব্দ দুটোর নিয়ে আপত্তি আছে। বেগম রোকেয়া অর্ধাঙ্গিনী শব্দটি স্ত্রীর প্রতিশব্দ হিসেবে এবং স্বামীর প্রতিশব্দ হিসেবে প্রভু শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে । আল কোরআন ও আল হাদীসে নারীর যে সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান অধিকার বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে উল্লিখিত শব্দ দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত ও নারীর মর্যাদা ও অধিকার হরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।। বাঙালি বা বাংলাদেশের মুসলমানদের চিন্তাভাবনা জগতে বেগম রোকেয়া নারীকে নিচু ভাবে উপস্থাপন করেছেন । সেই কারণে সমাজের স্বামীরা তাদের স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী বলে সম্বোধন করে যেটা ইসলামের দেয়া নারীর সম্মান মর্যাদা ও অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে । এবার আসুন দেখি আল্লাহ তা‘আলা নারীদের কি সম্মান আল কোরআনে দিয়েছে ।
সূরা বাকারাহ'র ১৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ....... (187)
"রমজানের রাতে স্ত্রী-গমন তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে। তারা যেমন তোমাদের পোশাক,তোমরাও তাদের পোশাক। আল্লাহ জানতেন যে,তোমরা আত্ম-প্রতারণা করেছিলে (এ কাজ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তোমরা মাঝে মধ্যে তা করেছিলে)। এ জন্যে আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছেন, ......
এই আয়াতে দাম্পত্য জীবনের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে,স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের জন্য পোশাকস্বরূপ। মানে স্ত্রীলোকেরা পুরুষদের
অর্ধাঙ্গিনী নয় এবং স্বামীরা স্ত্রীলোকের প্রভুও নয় সেটা আল কোরআনে আল্লাহ তা‘আলা বক্তব্যের মাধ্যমে পরিষ্কার ।
একটু বিস্তারিত যদি বলি, পোশাক একদিকে মানুষের দোষত্রুটি ঢেকে রাখে অন্যদিকে পোশাক মানুষের সৌন্দর্য-চর্চারও মাধ্যম। স্বামী ও স্ত্রী একে অপরকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি পরস্পরের জন্য প্রশান্তি ও সৌন্দর্যেরও মাধ্যম হয়ে উঠে। পোশাক যেমন মানুষের শরীরকে উষ্ণ রাখে,তেমনি স্বামী ও স্ত্রী পরিবারকে প্রাণচঞ্চল ও বিষাদমুক্ত রাখে। আর লক্ষণীয় বিষয় হল, এক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা সমান এবং স্বামী ও স্ত্রী দুটি আলাদা কোনো স্বত্বা বরং একটি পবিত্র স্বত্বা হয়ে যায়।
নর' এবং 'নারী' মানবজাতির এই জীবনধারাকে প্রবাহমান গতি দিয়েছে সেই সৃষ্টির আদি মানব আদমের যুগ থেকে ৷ বর্তমান বিশ্বের ৬১০ কোটি মানুষ যুগ-যুগান্তের ধারাবাহিক উত্তরাধিকার এখন ৷ মানুষ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ একটি বক্তব্য প্রায় সবারই জানা, তাহলো-‘মানুষ হলো বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী' ৷ সত্যিই এই বিচারবোধই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে তুলেছে ৷ সেজন্যে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মত জীবন যাপন না করে আল্লাহ প্রদত্ত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গড়ে তুলেছে একটি সুশৃঙ্খল সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ৷ যুগে যুগে আল্লাহ প্রেরিত রাসূলগণই এই পরিবার গঠনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন ৷ সুশৃঙ্খল এই পারিবারিক কাঠামো থেকেই মানুষ পেয়েছে সভ্যতার আলো ৷ পরিবার কাঠামোর সাথে সভ্যতা যেন নিত্যসঙ্গী ৷ যেখানে পরিবার কাঠামো নেই, সেখানে সভ্যতা বলতে যা বোঝায়, তার সাথে অন্যান্য প্রাণীকূলের জীবনযাপন পদ্ধতির খুব বেশী পার্থক্য নেই ৷
নারী এবং পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে পরিবার ৷ এই 'সম্মিলিত' শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারী-পুরুষের পারস্পরিক অবদান এবং অধিকারের সূক্ষ্ম বিষয়৷ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই নারী-পুরুষের অধিকার এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্ম ও আদর্শগত মতবাদ বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছে ৷ সেসব দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী একমাত্র ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্ম ও মতবাদই নারীকে কখনো ভোগ্যপণ্যে কিংবা কখনো পুরুষ দেবতার সেবাদাসীতে পরিণত করেছে৷ সভ্যতার এই স্বর্ণযুগেও নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার নিয়ে এখনো চলছে বিচিত্র কৌণিক মতামত ৷ জ্ঞান-বিজ্ঞানে বা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মানদন্ডে পশ্চিমা জগত আধুনিক সভ্যতার দাবীদার হলেও ক্ষয়িষ্ণু পরিবার কাঠামোর ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতা বিশ্বব্যাপী অকল্যাণই বয়ে এনেছে ৷
তাদের ঐ কু-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাবে মুসলিম জাতির মধ্যেও তা এখন সংক্রমিত হচ্ছে ৷ এরফলে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ব্যাপক বেড়ে গেছে ৷ অথচ পরিবারের প্রধান যে দুটি স্তম্ভ অর্থাৎ বাবা-মা বা স্বামী-স্ত্রী-তাদের মধ্যে যদি পারস্পরিক কর্তব্যবোধ স্পষ্টভাবে জাগ্রত থাকতো, তাহলে এই সমস্যা হয়তো দেখাই দিত না ৷ বহু শিক্ষিত পরিবারেও যথার্থ ইসলামী শিক্ষার অভাবে এ ধরণের সমস্যা বিরাজ করছে ৷ শিক্ষিত এইসব পরিবার তাদের পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে চিন্তা করে থাকে পাশ্চাত্যের মানদন্ডে, যেখানে নারী-পুরুষ স্বাধীনভাবে যাপন করছে পশুর মত জীবন ৷ তাই মুসলিম দম্পতিদের উচিৎ তাদের নিজস্ব ধর্মাদর্শ সম্পর্কে সচেতন হয়ে পারস্পরিক কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত হওয়া এবং যথাযথভাবে তা মেনে চলা ৷
তাহলেই দেখা যাবে সংসার হয়ে উঠেছে শান্তির সোনালী নীড়। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, স্বামী-স্ত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন এবং পারস্পরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামই সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ স্থাপন করেছে ৷ ইসলাম পূর্বকালে নারীকে মানুষই মনে করা হতো না ৷ গ্রীকরা তাদেরকে মনে করতো শয়তানের চর ৷ জৈবিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনেই তাদের ব্যবহার করা হতো ৷ রোমানদের অবস্থাও ছিল তাই ৷
সেখানে কন্যাসন্তানকে বিক্রি করা হতো ৷ জাহেলিয়াতের যুগে আরবে কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার ইতিহাস সর্বজনবিদিত ৷ পারস্য সভ্যতায়ও কন্যাসন্তানকে ভীষণরকম অকল্যাণকর বলে মনে করা হতো ৷ চীনের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, কোন পরিবারে কন্যাসন্তানের জন্ম হলে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা দুঃখ ও সহানুভূতি জানাতো ৷ আর মেয়েদের পা ভেঙে ছোট করে রাখা হতো। অর্থাৎ নারী ছিল একটা ভোগ্যপণ্য ৷ তাদের ব্যক্তিগত কোন মানবিক সত্ত্বাই স্বীকার হতো না ৷ আর হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা মৃত ব্যক্তির সাথে তার স্ত্রীকেও জীবন্ত পুড়ে মারতো ৷ এরকম করুণ একটা ঘটনাকে তারা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা ও ত্যাগের নিদর্শন বলে মনে করতো ৷ কী আশ্চর্য, বিধবাকে সম্পত্তির অধিকার না দিয়ে, দিয়েছিল চিতার আগুনে জীবন্ত পোড়াবার নির্দেশ ! আর পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির কোনো অধিকার এখনও নাই।
এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিচিত্র উপায়ে নারীদের সত্ত্বাকে লাঞ্চিত করা হয়েছিল ৷ ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের ফলে নারী পেল তার মৌলিক মানবিক অধিকার । নবী করিম (সাঃ) ঘোষণা করেন, হে মুসলমানেরা! তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তাদের উপরও তোমাদের অধিকার রয়েছে ৷" আল্লাহ রাববুল আলামীন বললেন, নারীরা তোমাদের পোষাক এবং পুরুষরাও নারীদের পোষাকস্বরূপ ৷
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের পুরুষ হতেই সৃষ্ট করেছেন, যাতে তাদের পরষ্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও গভীর হয় এবং তাদের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা ও দয়া-অনুগ্রহ যেন হয়, অতীব সুন্দর ও মধুময়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا ﴿1﴾
অর্থ, হে মানুষ তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সূরা আন-নিসা: ১]
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ﴿21﴾
অর্থ, আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছ যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَةِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ ﴿72﴾
অর্থ, আর আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের জন্য পুত্র ও নাতিদের সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি তোমাদেরকে পবিত্র রিযিক দান করেছেন তারা কি বাতিলে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর নিআমতকে অস্বীকার করে?
আয়াত দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিসসালাম এর স্ত্রী হাওয়া আলাইহাসসালামকে তার থেকেই সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয় থেকে অসংখ্য নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন। আর এসব সৃষ্টি তিনি করেছেন, বিশেষ একটি পদ্ধতিতে যাকে আমরা বিবাহ বলে আখ্যায়িত করি।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মুহাব্বাত আল্লাহর একটি নিদর্শন:-
আল্লাহ তা‘আলা বিবাহ সম্পর্কে বলেন, বিবাহ হল, আল্লাহ তা‘আলার মহান নিদর্শন, যার মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মাঝে প্রেম, ভালোবাসা ও পারস্পরিক অনুগ্রহ তৈরি হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ﴿21﴾
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১]
স্ত্রীদের মোহরানা পরিশোধ করা ফরয:-
আল্লাহ তা‘আলা স্বামীদের উপর তাদের স্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত মোহরানা আদায় করাকে ফরয করে দিয়েছেন। তাদের নির্ধারিত মোহরানাতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করাকে আল্লাহ তা‘আলা অবৈধ বা হারাম করে দিয়েছেন। তবে যদি স্ত্রী তার নিজের পক্ষ হতে কিছু কমিয়ে দেয় বা ক্ষমা করে দেয় সেটা হল, ভিন্ন কথা। তখন তা হতে গ্রহণ করা স্বামীর জন্য অবশ্যই হালাল হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন
وَآَتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا ﴿4﴾
আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে তৃপ্তিসহকারে খাও। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪]
নারীদের জন্য মালিকানা প্রতিষ্ঠা:-
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের জন্য উত্তরাধিকারী সম্পত্তিতে অংশ নির্ধারণ করেন। ফলে তাদের মাতা-পিতা, সন্তানাদি বা নিকট আত্মীয় কেউ মারা গেলে তারাও পুরুষদের মত সম্পত্তির মালিক হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا ﴿7﴾
পুরুষদের জন্য মাতা পিতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ রয়েছে। আর নারীদের জন্য রয়েছে মাতা পিতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ তা থেকে কম হোক বা বেশি হোক নির্ধারিত হারে। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭]
ইমাম আহমদ রহ. বর্ণনা করেন, রাসুল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
من عال ابنتين أو ثلاث بنات، أو أختين، أو ثلاث أخوات، حتى يبلغن، أو يموت عنهنَّ، أنا وهو كهاتين وأشاربأصبعه السبابة
অর্থ, যে ব্যক্তি দুটি অথবা তিনটি কন্যা অথবা দুটি বোন বা তিনটি বোনকে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, অথবা তাদের মারা যাওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, জান্নাতে আমি ও সে দুটি আঙ্গুলের মত মিলে মিশে থাকবো। রাসূল তার শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা বৃদ্ধা আঙ্গুলের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দেন। [মুসনাদে আহমদ; ১৪৭/৩]
ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থে জাবের রা. হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
من كان له ثلاث بناتٍ يؤويهنَّ، ويكفيهنَّ، ويرحمهنَّ، فقد وجبت له الجنّة البتّة، فقال رجل من بعض القوم: وثنتين يا رسول الله؟ قال: وثنتين
অর্থ, যে লোকের তিন জন বাচ্চা থাকবে এবং সে তাদের যথাযত বরণ- পোষণ, লালন-পালন ও আদর-যত্ন সহকারে ঘড়ে তুলবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতকে ওয়াজিব করে দেবে। এ কথা শোনে এ লোক দাড়িয়ে বলল, যদি দুইজন কন্যা সন্তান থাকে, তা হলে কি বিধান হে আল্লাহর রাসূল? তখন রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলল, দুই জন হলেও একই বিধান। (অর্থাৎ সেও এ ফজিলতের অধিকারী হবে) [বুখারি আদাবুল মুফরিদ; ১৭৮]
নবিজি [সা.] বলেছেন, তোমাদের মধ্যে তারাই উৎকৃষ্ট, যারা তাদের স্ত্রীর কাছে উৎকৃষ্ট এবং আপন পরিবার-পরিজনের প্রতি স্নেনশীল। [তিরমিজি শরিফ] অপর এক হাদিসে রাসুল [সা.] বলেছেন, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করবে, মহান আল্লাহ তাকে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর সমান ‘সওয়াব’ দান করবেন। হজরত আবু হোরায়রা [রা.] থেকে বর্ণিত, রাসুল [সা.] বলেছেন, হে মানব জাতি! স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার ব্যাপারে আমার হুকুম মান্য কর। পাজরের হাড় থেকে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, স্বভাবতই তারা বাঁকা।
যদি তুমি বাঁকা হাড়কে শক্তির দ্বারা সোজা করতে যাও, তবে তা ভেঙে যাবে। তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দাও, সব সময় বাঁকাই থাকবে। এজন্য আমার শেষ নির্দেশ হিসেবে কবুল কর, স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। [বোখারী ও মুসলিম]
কুরান ও হাদিসে নারীদের সম্পর্কে যত আয়াত ও হাদিস আছে সবগুলি একত্রিত করেই তবে তিনি এসব মন্তব্য প্রদান করেছেন। আশা করি- এ উদ্ধৃতি থেকে নারীরা তাদেরকে ইসলামে যে বিপুল মান মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়েছে সে ব্যপারে সম্যক অবগত হবেন ও উপকৃত হবেন। অত:পর যে সব নারী জোর গলায় দাবী করে পর্দা করে বাইরে কাজে যাওয়া যাবে বা অন্যান্য কাজ করা যাবে , তাদের লম্বা গলাটা একটু খাট হবে। আর বস্তুত: ইসলামী নারীদের হুবহু এ ধরনের মর্যাদা ও অধিকার ই দেয়ার পক্ষে , এর বেশী নয়। যে সব নারী নিজেদেরকে খুব ধার্মিক মনে করে , তারা আশা করি একজন মুসলমান নারীর প্রকৃত মর্যাদাটা খুব ভাল মতো এখান থেকে উপলব্ধি করতে পারবে।
সূফি বরষণ
বেগম রোকেয়া অর্ধাঙ্গিনী প্রবন্ধের বলেছেন, ‘প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত।’
এখানে উল্লিখিত অর্ধাঙ্গিনী ও প্রভু শব্দ দুটোর নিয়ে আপত্তি আছে। বেগম রোকেয়া অর্ধাঙ্গিনী শব্দটি স্ত্রীর প্রতিশব্দ হিসেবে এবং স্বামীর প্রতিশব্দ হিসেবে প্রভু শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে । আল কোরআন ও আল হাদীসে নারীর যে সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান অধিকার বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে উল্লিখিত শব্দ দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত ও নারীর মর্যাদা ও অধিকার হরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।। বাঙালি বা বাংলাদেশের মুসলমানদের চিন্তাভাবনা জগতে বেগম রোকেয়া নারীকে নিচু ভাবে উপস্থাপন করেছেন । সেই কারণে সমাজের স্বামীরা তাদের স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী বলে সম্বোধন করে যেটা ইসলামের দেয়া নারীর সম্মান মর্যাদা ও অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে । এবার আসুন দেখি আল্লাহ তা‘আলা নারীদের কি সম্মান আল কোরআনে দিয়েছে ।
সূরা বাকারাহ'র ১৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ....... (187)
"রমজানের রাতে স্ত্রী-গমন তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে। তারা যেমন তোমাদের পোশাক,তোমরাও তাদের পোশাক। আল্লাহ জানতেন যে,তোমরা আত্ম-প্রতারণা করেছিলে (এ কাজ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তোমরা মাঝে মধ্যে তা করেছিলে)। এ জন্যে আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছেন, ......
এই আয়াতে দাম্পত্য জীবনের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে,স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের জন্য পোশাকস্বরূপ। মানে স্ত্রীলোকেরা পুরুষদের
অর্ধাঙ্গিনী নয় এবং স্বামীরা স্ত্রীলোকের প্রভুও নয় সেটা আল কোরআনে আল্লাহ তা‘আলা বক্তব্যের মাধ্যমে পরিষ্কার ।
একটু বিস্তারিত যদি বলি, পোশাক একদিকে মানুষের দোষত্রুটি ঢেকে রাখে অন্যদিকে পোশাক মানুষের সৌন্দর্য-চর্চারও মাধ্যম। স্বামী ও স্ত্রী একে অপরকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি পরস্পরের জন্য প্রশান্তি ও সৌন্দর্যেরও মাধ্যম হয়ে উঠে। পোশাক যেমন মানুষের শরীরকে উষ্ণ রাখে,তেমনি স্বামী ও স্ত্রী পরিবারকে প্রাণচঞ্চল ও বিষাদমুক্ত রাখে। আর লক্ষণীয় বিষয় হল, এক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা সমান এবং স্বামী ও স্ত্রী দুটি আলাদা কোনো স্বত্বা বরং একটি পবিত্র স্বত্বা হয়ে যায়।
নর' এবং 'নারী' মানবজাতির এই জীবনধারাকে প্রবাহমান গতি দিয়েছে সেই সৃষ্টির আদি মানব আদমের যুগ থেকে ৷ বর্তমান বিশ্বের ৬১০ কোটি মানুষ যুগ-যুগান্তের ধারাবাহিক উত্তরাধিকার এখন ৷ মানুষ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ একটি বক্তব্য প্রায় সবারই জানা, তাহলো-‘মানুষ হলো বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী' ৷ সত্যিই এই বিচারবোধই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে তুলেছে ৷ সেজন্যে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মত জীবন যাপন না করে আল্লাহ প্রদত্ত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গড়ে তুলেছে একটি সুশৃঙ্খল সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ৷ যুগে যুগে আল্লাহ প্রেরিত রাসূলগণই এই পরিবার গঠনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন ৷ সুশৃঙ্খল এই পারিবারিক কাঠামো থেকেই মানুষ পেয়েছে সভ্যতার আলো ৷ পরিবার কাঠামোর সাথে সভ্যতা যেন নিত্যসঙ্গী ৷ যেখানে পরিবার কাঠামো নেই, সেখানে সভ্যতা বলতে যা বোঝায়, তার সাথে অন্যান্য প্রাণীকূলের জীবনযাপন পদ্ধতির খুব বেশী পার্থক্য নেই ৷
নারী এবং পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে পরিবার ৷ এই 'সম্মিলিত' শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারী-পুরুষের পারস্পরিক অবদান এবং অধিকারের সূক্ষ্ম বিষয়৷ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই নারী-পুরুষের অধিকার এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্ম ও আদর্শগত মতবাদ বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছে ৷ সেসব দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী একমাত্র ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্ম ও মতবাদই নারীকে কখনো ভোগ্যপণ্যে কিংবা কখনো পুরুষ দেবতার সেবাদাসীতে পরিণত করেছে৷ সভ্যতার এই স্বর্ণযুগেও নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার নিয়ে এখনো চলছে বিচিত্র কৌণিক মতামত ৷ জ্ঞান-বিজ্ঞানে বা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মানদন্ডে পশ্চিমা জগত আধুনিক সভ্যতার দাবীদার হলেও ক্ষয়িষ্ণু পরিবার কাঠামোর ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতা বিশ্বব্যাপী অকল্যাণই বয়ে এনেছে ৷
তাদের ঐ কু-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাবে মুসলিম জাতির মধ্যেও তা এখন সংক্রমিত হচ্ছে ৷ এরফলে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ব্যাপক বেড়ে গেছে ৷ অথচ পরিবারের প্রধান যে দুটি স্তম্ভ অর্থাৎ বাবা-মা বা স্বামী-স্ত্রী-তাদের মধ্যে যদি পারস্পরিক কর্তব্যবোধ স্পষ্টভাবে জাগ্রত থাকতো, তাহলে এই সমস্যা হয়তো দেখাই দিত না ৷ বহু শিক্ষিত পরিবারেও যথার্থ ইসলামী শিক্ষার অভাবে এ ধরণের সমস্যা বিরাজ করছে ৷ শিক্ষিত এইসব পরিবার তাদের পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে চিন্তা করে থাকে পাশ্চাত্যের মানদন্ডে, যেখানে নারী-পুরুষ স্বাধীনভাবে যাপন করছে পশুর মত জীবন ৷ তাই মুসলিম দম্পতিদের উচিৎ তাদের নিজস্ব ধর্মাদর্শ সম্পর্কে সচেতন হয়ে পারস্পরিক কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত হওয়া এবং যথাযথভাবে তা মেনে চলা ৷
তাহলেই দেখা যাবে সংসার হয়ে উঠেছে শান্তির সোনালী নীড়। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, স্বামী-স্ত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন এবং পারস্পরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামই সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ স্থাপন করেছে ৷ ইসলাম পূর্বকালে নারীকে মানুষই মনে করা হতো না ৷ গ্রীকরা তাদেরকে মনে করতো শয়তানের চর ৷ জৈবিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনেই তাদের ব্যবহার করা হতো ৷ রোমানদের অবস্থাও ছিল তাই ৷
সেখানে কন্যাসন্তানকে বিক্রি করা হতো ৷ জাহেলিয়াতের যুগে আরবে কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার ইতিহাস সর্বজনবিদিত ৷ পারস্য সভ্যতায়ও কন্যাসন্তানকে ভীষণরকম অকল্যাণকর বলে মনে করা হতো ৷ চীনের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, কোন পরিবারে কন্যাসন্তানের জন্ম হলে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা দুঃখ ও সহানুভূতি জানাতো ৷ আর মেয়েদের পা ভেঙে ছোট করে রাখা হতো। অর্থাৎ নারী ছিল একটা ভোগ্যপণ্য ৷ তাদের ব্যক্তিগত কোন মানবিক সত্ত্বাই স্বীকার হতো না ৷ আর হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা মৃত ব্যক্তির সাথে তার স্ত্রীকেও জীবন্ত পুড়ে মারতো ৷ এরকম করুণ একটা ঘটনাকে তারা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা ও ত্যাগের নিদর্শন বলে মনে করতো ৷ কী আশ্চর্য, বিধবাকে সম্পত্তির অধিকার না দিয়ে, দিয়েছিল চিতার আগুনে জীবন্ত পোড়াবার নির্দেশ ! আর পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির কোনো অধিকার এখনও নাই।
এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিচিত্র উপায়ে নারীদের সত্ত্বাকে লাঞ্চিত করা হয়েছিল ৷ ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের ফলে নারী পেল তার মৌলিক মানবিক অধিকার । নবী করিম (সাঃ) ঘোষণা করেন, হে মুসলমানেরা! তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তাদের উপরও তোমাদের অধিকার রয়েছে ৷" আল্লাহ রাববুল আলামীন বললেন, নারীরা তোমাদের পোষাক এবং পুরুষরাও নারীদের পোষাকস্বরূপ ৷
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের পুরুষ হতেই সৃষ্ট করেছেন, যাতে তাদের পরষ্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও গভীর হয় এবং তাদের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা ও দয়া-অনুগ্রহ যেন হয়, অতীব সুন্দর ও মধুময়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا ﴿1﴾
অর্থ, হে মানুষ তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সূরা আন-নিসা: ১]
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ﴿21﴾
অর্থ, আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছ যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَةِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ ﴿72﴾
অর্থ, আর আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের জন্য পুত্র ও নাতিদের সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি তোমাদেরকে পবিত্র রিযিক দান করেছেন তারা কি বাতিলে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর নিআমতকে অস্বীকার করে?
আয়াত দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিসসালাম এর স্ত্রী হাওয়া আলাইহাসসালামকে তার থেকেই সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয় থেকে অসংখ্য নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন। আর এসব সৃষ্টি তিনি করেছেন, বিশেষ একটি পদ্ধতিতে যাকে আমরা বিবাহ বলে আখ্যায়িত করি।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মুহাব্বাত আল্লাহর একটি নিদর্শন:-
আল্লাহ তা‘আলা বিবাহ সম্পর্কে বলেন, বিবাহ হল, আল্লাহ তা‘আলার মহান নিদর্শন, যার মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মাঝে প্রেম, ভালোবাসা ও পারস্পরিক অনুগ্রহ তৈরি হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ﴿21﴾
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১]
স্ত্রীদের মোহরানা পরিশোধ করা ফরয:-
আল্লাহ তা‘আলা স্বামীদের উপর তাদের স্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত মোহরানা আদায় করাকে ফরয করে দিয়েছেন। তাদের নির্ধারিত মোহরানাতে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করাকে আল্লাহ তা‘আলা অবৈধ বা হারাম করে দিয়েছেন। তবে যদি স্ত্রী তার নিজের পক্ষ হতে কিছু কমিয়ে দেয় বা ক্ষমা করে দেয় সেটা হল, ভিন্ন কথা। তখন তা হতে গ্রহণ করা স্বামীর জন্য অবশ্যই হালাল হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন
وَآَتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا ﴿4﴾
আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে তৃপ্তিসহকারে খাও। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪]
নারীদের জন্য মালিকানা প্রতিষ্ঠা:-
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের জন্য উত্তরাধিকারী সম্পত্তিতে অংশ নির্ধারণ করেন। ফলে তাদের মাতা-পিতা, সন্তানাদি বা নিকট আত্মীয় কেউ মারা গেলে তারাও পুরুষদের মত সম্পত্তির মালিক হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا ﴿7﴾
পুরুষদের জন্য মাতা পিতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ রয়েছে। আর নারীদের জন্য রয়েছে মাতা পিতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ তা থেকে কম হোক বা বেশি হোক নির্ধারিত হারে। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭]
ইমাম আহমদ রহ. বর্ণনা করেন, রাসুল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
من عال ابنتين أو ثلاث بنات، أو أختين، أو ثلاث أخوات، حتى يبلغن، أو يموت عنهنَّ، أنا وهو كهاتين وأشاربأصبعه السبابة
অর্থ, যে ব্যক্তি দুটি অথবা তিনটি কন্যা অথবা দুটি বোন বা তিনটি বোনকে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, অথবা তাদের মারা যাওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, জান্নাতে আমি ও সে দুটি আঙ্গুলের মত মিলে মিশে থাকবো। রাসূল তার শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা বৃদ্ধা আঙ্গুলের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দেন। [মুসনাদে আহমদ; ১৪৭/৩]
ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থে জাবের রা. হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
من كان له ثلاث بناتٍ يؤويهنَّ، ويكفيهنَّ، ويرحمهنَّ، فقد وجبت له الجنّة البتّة، فقال رجل من بعض القوم: وثنتين يا رسول الله؟ قال: وثنتين
অর্থ, যে লোকের তিন জন বাচ্চা থাকবে এবং সে তাদের যথাযত বরণ- পোষণ, লালন-পালন ও আদর-যত্ন সহকারে ঘড়ে তুলবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতকে ওয়াজিব করে দেবে। এ কথা শোনে এ লোক দাড়িয়ে বলল, যদি দুইজন কন্যা সন্তান থাকে, তা হলে কি বিধান হে আল্লাহর রাসূল? তখন রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলল, দুই জন হলেও একই বিধান। (অর্থাৎ সেও এ ফজিলতের অধিকারী হবে) [বুখারি আদাবুল মুফরিদ; ১৭৮]
নবিজি [সা.] বলেছেন, তোমাদের মধ্যে তারাই উৎকৃষ্ট, যারা তাদের স্ত্রীর কাছে উৎকৃষ্ট এবং আপন পরিবার-পরিজনের প্রতি স্নেনশীল। [তিরমিজি শরিফ] অপর এক হাদিসে রাসুল [সা.] বলেছেন, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর কষ্টদায়ক আচরণে ধৈর্য ধারণ করবে, মহান আল্লাহ তাকে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর সমান ‘সওয়াব’ দান করবেন। হজরত আবু হোরায়রা [রা.] থেকে বর্ণিত, রাসুল [সা.] বলেছেন, হে মানব জাতি! স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার ব্যাপারে আমার হুকুম মান্য কর। পাজরের হাড় থেকে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, স্বভাবতই তারা বাঁকা।
যদি তুমি বাঁকা হাড়কে শক্তির দ্বারা সোজা করতে যাও, তবে তা ভেঙে যাবে। তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দাও, সব সময় বাঁকাই থাকবে। এজন্য আমার শেষ নির্দেশ হিসেবে কবুল কর, স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। [বোখারী ও মুসলিম]
কুরান ও হাদিসে নারীদের সম্পর্কে যত আয়াত ও হাদিস আছে সবগুলি একত্রিত করেই তবে তিনি এসব মন্তব্য প্রদান করেছেন। আশা করি- এ উদ্ধৃতি থেকে নারীরা তাদেরকে ইসলামে যে বিপুল মান মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়েছে সে ব্যপারে সম্যক অবগত হবেন ও উপকৃত হবেন। অত:পর যে সব নারী জোর গলায় দাবী করে পর্দা করে বাইরে কাজে যাওয়া যাবে বা অন্যান্য কাজ করা যাবে , তাদের লম্বা গলাটা একটু খাট হবে। আর বস্তুত: ইসলামী নারীদের হুবহু এ ধরনের মর্যাদা ও অধিকার ই দেয়ার পক্ষে , এর বেশী নয়। যে সব নারী নিজেদেরকে খুব ধার্মিক মনে করে , তারা আশা করি একজন মুসলমান নারীর প্রকৃত মর্যাদাটা খুব ভাল মতো এখান থেকে উপলব্ধি করতে পারবে।
No comments:
Post a Comment