Friday 13 January 2017

বড় পর্দায় সুলতান সুলেমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস। সূফি বরষণ

বড় পর্দায় সুলতান সুলেমান ও  অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস।

সূফি বরষণ
অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বহু ধর্ম, বর্ণ এবং বহু ভাষার। এই দিকে থেকে ইউরোপীয়ান স্কলাররাও একমত যে অটোমান জোড় পূর্বক কাউকে ধর্মান্তরিত করে নাই। কিন্তু বিধর্মীরা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য বিবেচিত হতো না এবং তাদের নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। ইউরোপীয়ান স্কলাররা এই দিকটাকে উল্লেখ করে থাকে ধর্মান্তরিত না করার কারন হিসেবে!১২৯৯ সালে অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রথম উসমান উত্তরপশ্চিম আনাতোলিয়ায় এই সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।

সুলতান সুলেমান ১৪৯৪ সালের ৬ নভেম্বর জনগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম আয়েশা হাফসা সুলতান; যিনি চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন বলে জানা যায়। সাত বছর বয়সে তিনি তোপকাপি প্রাসাদের স্কুলে বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য থিওলজি এং সামরিক বিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। শিল্পবিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই অটোমানের দুর্দিন শুরু হয়। নব্য সংগঠিত ও সমৃদ্ধের পথযাত্রী খ্রিস্টান ইউরোপীয়ানদের জন্য অটোমান ছিল চ্যালেঞ্জ। অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী খ্রিস্টানরা খুব দ্রুত রেঁনেসা পরবর্তী ইউরোপের শিল্প ও জ্ঞান সমৃদ্ধির পথে নিজেদের যুক্ত করে ফেলে।

ইতিহাসের প্রতি আগ্রহের কারণেই ভগবান এস গিদওয়ানির ‘সোর্ড অব টিপু সুলতান’ এখনো উপমহাদেশের সব ধর্মের মানুষকে নাড়া দেয়। নির্মাণশৈলীর কারণে ইতিহাসের প্রকৃত মহিশুরের হায়দার আলীর পুত্র টিপু সুলতান আর সোর্ড অব টিপু সুলতানের মধ্যে কিছু ফারাক সহজেই বোধগম্য। তবে গিদওয়ানি ইতিহাস বিকৃতির দায় নিতে চাননি। এই ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকে রচিত উপন্যাস বা সিরিয়ালে দেখা যায় ইতিহাস বিকৃতির ছড়াছড়ি । তাই শিল্পসৌন্দর্য রচনা ইতিহাসের সত্যকে আড়ালে করতে পারেনি । বাংলাদেশের মানুষ পলাশী ও নবাব সিরাজউদ্দৌলাহকে ইতিহাস পড়ে জানেনি।

খান আতার কালজয়ী সিনেমা দেখে চিনেছে ও জেনেছে। খান আতা ইতিহাসকে আশ্রয় করে শিল্পের আবেগকে সুনিপুণ হাতে কাজে লাগিয়েছেন। ইতিহাস সত্যের সাথে শিল্পের সৌন্দর্য একাকার করে নতুন এক সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। দস্যু বাহরাম, বনহুর প্রমুখ লেখক-কল্পনার বহিঃপ্রকাশ, রবিনহুড সার্বিক অর্থে তা নয়। ইতিহাস-আশ্রয়ী নাটক সিনেমা দর্শক প্রিয়তা পাওয়ার কারণও ইতিহাস প্রীতি। তাই বলা চলে ইতিহাসভিত্তিক সিনেমাগুলো দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছে। ইতিহাসের প্রতি মানুষের সহজাত মোহ অথবা পেছনে তাকাবার দায়বদ্ধতার এটাও একটা নজির। ইতোমধ্যে বিশ্বের সেরা মহানায়কদের নিয়ে সিনেমা নির্মাণের প্রচুর কাজ হয়েছে। ধর্মীয় নেতা, বিদ্রোহী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও ব্যতিক্রমী চরিত্রের প্রভাবক মানুষগুলোও এ তালিকা থেকে বাদ পড়েননি। আমাদের দেশে ফকির মজনু শাহ, শহীদ তিতুমীর একমাত্র উপমা নয়, গান্ধী থেকে ম্যান্ডেলা, আদম-ইভ থেকে মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্র কিংবা ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে।

দি মেসেজ ও মেসেঞ্জার ছাড়াও রয়েছে অনেক দৃষ্টান্ত।  এরই ধারাবাহিকতায় অটোমান বা উসমানিয়া খিলাফত সাম্রাজ্যের অন্যতম দিকপাল মহান সুলতান সুলেমানকে নিয়েও কাজ হয়েছে। আরবের স্বাধীনতাকামী নেতা ওমর মোখতার নিয়ে যে সিনেমা তৈরি হয়েছে, তা স্বাধীনতাকামী যেকোনো মানুষকে আলোড়িত করে। তবে সিনেমা তৈরির সময় রচনাকারী, প্রযোজক, পরিচালক ভুলে যান না এর মধ্যে বিনোদন এবং কাহিনী কাব্যের রসদ না দিলে দর্শক টানবে না। মেরাল ওকেয় রচিত সুলতান সুলেমান নির্মাণের সময় ইয়ামুর তাইলানরা সেই বাস্তবতাটি ভুলে যাননি।

বিনোদন উপস্থাপন করতে গিয়ে শাসক সুলতান সুলেমানকে কিছুটা আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হেরেমের কূটকচাল, দাস-দাসীদের দৈনন্দিন জীবনাচার এবং সুলতানাদের স্নায়ুযুদ্ধ বিনোদন জোগান দেয়ার স্বার্থে প্রাধান্য পেয়ে গেছে। হেরেমের ড্রেস কোড খোলামেলাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সিরিজজুড়ে অন্দরমহলের প্রাধান্যের কারণে একজন সুশাসক, তুখোড় কূটনীতিক ও বিচক্ষণ সুলতানের পরিচিতি তুলনামূলক কম গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। সিরিজগুলো ‘আকর্ষণীয়’ ও আদিরসাত্মক করার জন্য যত গোঁজামিলই দেয়া হোক, কোনো জননন্দিত সুশাসক রমণীকাতর কামিনীবল্লভ হন না। এ ব্যাপারে সুলতান সুলেমানও ইতিহাসের কাছে অভিযুক্ত নন।

সম্প্রতি সুলতান সুলেমানের ওপর নির্মিত আলোচিত-সমালোচিত কাহিনী নাটকটি একটি বেসরকারি চ্যানেল দেখাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত সিরিজ প্রদর্শিতও হয়ে গেছে। সিরিয়ালের আরেক নায়ক ইব্রাহীম পাশাকে নির্মম ভাবে হত্যার পর অনেক ফেইস বুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে । এই প্রজন্মের কাছে ইতিহাসখ্যাত সুলতান সুলাইমান বা সুলেমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস আকর্ষণীয় কিছু নয়। তবে নির্মাণশৈলী ও বিনোদনের রসদ দিয়ে হেরেমের কাহিনীগুলো যেভাবে রগরগে করে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে এ যুগে ‘দর্শকপ্রিয়তা’ পাওয়ারই কথা। নতুন চ্যানেলটি সুলতান সুলেমান দেখিয়েই কিছু পরিচিতি পেয়েছে।

অটোমান সাম্রাজ্যের পতন যেভাবে শুরু : প্রায় ৭০০ বছর ধরে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল পৃথিবীজুড়ে। এ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। ক্ষমতার টানাপড়েনে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই হত্যা, সন্তান হত্যা এবং দাসপ্রথার অন্তরালের কাহিনী নিয়ে নির্মিত মেগা সিরিয়ালে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হুররাম সুলতান।

এই অপরূপ সুন্দরী রানীর কারণেই ধীরে ধীরে সুলতানের প্রাসাদে দানা বাঁধতে থাকে বিদ্বেষ। পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে অটোম্যানরা।

 অটোমান সাম্রাজ্যের বাসিন্দা হলেও পশ্চিমের সাহায্যে একটি নিজস্ব শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা সমৃদ্ধ করে ফেলে। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের শরিয়া আইন, বিধর্মী ট্যাক্স এবং রাজনৈতিক আইসোলেশন তাদের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক রূপে দেখা দেয়।

ফরাসী বিপ্লবের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এবং ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন এলাকার সুলতানী শাষনে বসবাসরত এসব এলাকায় খুবই দ্রুত জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রসার এবং প্রথম টার্গেটই হয় অটোমান সাম্রাজ্য!

আর এদিকে প্রাচীন টেকনোলজী এবং ট্যাক্স নির্ভর অর্থনীতির ধারক অটোমান তুলনামূলকভাবে দিন দিন শক্তি হারাতে থাকে।

আর দুর্বল হতে থাকা অটোমান সাম্রাজ্যের উপর সংস্কারের জন্য বহিঃশক্তি মানে, ফ্রান্স , ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, রাশিয়ার চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এবং নিজ বর্ডারের ভেতরের ভিন্ন ধর্ম ও ভাষার জনগণও সংস্কারের জন্য চাপ দিতে থাকে।

কিন্তু ইসলামীক খেলাফতের ভেতর সেক্যুলার সংস্কার করার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না তৎকালীন অটোমান সুলতান!

এসবের ফলাফলে দীর্ঘ সময় ও শক্তি হারিয়ে ১৮৩৯ থেকে অটোমানরা বাধ্য হয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। "তাঞ্জিমাত" ও এর ধারাবাহিকতায় "ইসলাহাত" নামে দিন বদল শুরু হয়।

বিধর্মী ও মুসলিমদের সামাজিক অবস্থান সমান করা হয়, বিধর্মী ও মুসলিমদের ট্যাক্স সমান করা হয়।

কিন্তু স্বাধীনতার ডাক শুনতে পাওয়া জনগণ এসবে সন্তুষ্ট না! তার উপর সুলতানের আমলাদের দুর্নীতি এবং প্রাচীন সামরিক সরঞ্জামও শাষনের কঠোরতা ধরে রাখার পথে বাধা ছিল।

আর ইউরোপ থেকে মুসলিম অটোমান বিতাড়িত করার ৫০০ বছরের লালিত স্বপ্নতো তৎকালীন পরাশক্তিদের ছিলই!

ইতিহাসের সুলেমান-১:

বাস্তবে বা ইতিহাসের সুলেমান-১ হেরেমের নায়ক নন। ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়ক। প্রথম সুলেমান অটোমান বা তুর্কি খলিফাদের মধ্যে সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি একটানা ৪৬ বছর (১৫২০-১৫৬৬) সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি সময় মেপে পথ চলেননি, সময় যেন তাকে অনুসরণ করেছে। ইউরোপীয় ইতিহাসবেত্তারা তাকে ‘গ্রেট’ এবং ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মিলিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের তখনকার বিস্তৃতি ছিল তিন মহাদেশের বিরাট অংশজুড়ে।

সুলেমান-১ জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল। তার পিতা সুলতান সেলিম-১, মা হাফছা সুলতান সন্তানের চরিত্র গঠন ও গুণগত লেখাপড়ার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। দাদী গুলবাহার খাতুনই ছিলেন কার্যত সুলেমানের প্রথম শিক্ষক এবং গাইড। মাত্র সাত বছর বয়সে সুলেমান তার দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর কাছে ইস্তাম্বুলে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন।

পৃথিবী বিখ্যাত জ্ঞানতাপস খিজির ইফিন্দি বা আফেন্দি ছিলেন তার ওস্তাদদের মধ্যে অন্যতম। তার কাছেই সুলেমান ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশল নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। তারপর সুলেমান ১৫ বছর বয়স হওয়া অবধি ট্রাবজনে তার পিতার সাথে অবস্থান করেন। এই ট্রাবজনই ছিল তার জন্মস্থান। নেতৃত্বের যোগ্যতা, সততা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রতিভার গুণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুলেমান গভর্নর নিযুক্ত হন।

তাকে প্রথমে সরকি প্রদেশে, তারপর কারা হিসর, বলু এবং অল্প সময়ের জন্য কিফিতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুলতান সেলিম-১ ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে জিতে ১৫১২ সালে ক্ষমতায় বসেন। তখন পিতার ইচ্ছানুযায়ী সুলেমান ইস্তাম্বুলে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান এবং তার বাবার পক্ষ থেকে চাচাদের মধ্যে বিরোধ মেটানোর জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তখনো শাহজাদা সুলেমান সরুহান প্রদেশের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পিতা সুলতান সেলিম-১ মারা গেলে সুলেমান ১৫২০ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে সর্বসম্মতভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফা বা সুলতান মনোনীত হন। সুলেমানের খলিফা বা সুলতান হওয়ার বিষয়টি কিংবদন্তি হয়ে আছে।

সবাই জানত, সুলেমান একজন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী ও ধার্মিক মানুষ। তিনি কখনো তার কমান্ড নষ্ট হতে দিতেন না। সুলতান সুলেমান তার জনগণের কাছ থেকে বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য পাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাহীন ছিলেন। সুলতান এতটাই ধীমান ছিলেন, তার প্রতিটি বক্তব্য হতো শিক্ষণীয় ও নির্দেশনামূলক। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভাবতেন; শৈথিল্য মানতেন না। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে এবং ক্রান্তিকালে কখনো ধৈর্য হারাতেন না।

১৫৬৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে সুলতান সুলেমান অভিযানে থাকা অবস্থায় হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরে নিজ তাঁবুতে ইন্তেকাল করেন। তার এই মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক এবং বার্ধক্যজনিত। তাকে দাফন করা হয়েছিল অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বা আজকের ইস্তাম্বুলে। তার সমাধিস্থলেই বিখ্যাত সুলেমানি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কালজয়ী ভ্রমণ সাহিত্য প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’ যারা পড়ে থাকবেন, তারা তুরস্ক ও ইস্তাম্বুল সম্পর্কে ধারণা পাবেন। হালে প্রচার করা হচ্ছে, একটি লোককাহিনী। কথিত আছে, সুলতান সুলেমানের মূল কবর তুরস্কে হলেও তার হৃৎপিণ্ডটি হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরের আঙ্গুর কুঞ্জে কবর দেয়া হয়েছিল। এটি কোনো প্রতিষ্ঠিত মত নয়। তার পরও সুলেমানের ‘হৃদয়ের খোঁজে’ বহুজাতিক বিশেষজ্ঞ দল এখনো সক্রিয় রয়েছে।

ইতিহাসে সুলেমান আইনপ্রণেতা বা ‘কানুনি’ হিসেবে বিশেষভাবে ছিলেন পরিচিত। সুলেমানের আইন গবেষণার ফসল তিন শ’ বছর ধরে কার্যকর ছিল। ইউরোপও এর মাধ্যমে লাভবান হয়েছে। তিনি ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সৎ এবং সাহসী শাসক। সেটা ছিল সাম্রাজ্যের সোনালি যুগ, তখন সৌভাগ্যের সূর্য ছিল মধ্যগগনে। কখনো তার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা ও প্রজা নিপীড়নের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। একবার মিসর থেকে অতিরিক্ত খাজনা জমা হওয়ার পর তিনি তথ্য-উপাত্ত নিয়ে অনুসন্ধান করে বের করলেন- প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের কারণেই অর্থভাণ্ডারে করের আয় বেড়েছে এবং মিসরের সেই গভর্নর নিপীড়ক ছিলেন। সুলতান দ্রুত সেই গভর্নর পরিবর্তন করেছিলেন। ইসলাম নিয়ে সুলতান সুলেমানের কবিতা বিশ্বের উৎকৃষ্ট কবিতাগুলোর কাতারে স্থান পেয়েছে। সুলেমান তার পরামর্শকদের মধ্যে শিল্পী, চিন্তাবিদ, ধর্মবেত্তা ও দার্শনিকদের বেশি ঠাঁই দিয়েছিলেন এবং তাদের কদর করতেন।

এ কারণে ইউরোপের তুলনায় তার বিচারব্যবস্থা, আদালত ও শাসনব্যবস্থা ছিল অনেক বেশি উন্নত, নিরপেক্ষ, মানবিক, ন্যায়ানুগ এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। ওই সময়কার ইউরোপীয় রাজনীতি-অর্থনীতি সুলতানের নখদর্পণে ছিল। মার্টিন লুথার, প্রটেস্টান্ট ধর্ম ও ভ্যাটিকানের ব্যাপারে তার গভীর উৎসাহ ছিল। তাদের সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞানও তার ছিল। সুলতান মিথ্যা বলা পছন্দ করতেন না। কর্তব্যে অবহেলা মেনে নিতেন না, বাহুল্য কথা বর্জন করতেন, হালাল হারাম মেনে চলতেন। তার নির্দেশনা ও বক্তব্য হতো নীতিবাক্যের মতো। সহজেই শত্রু-মিত্র চিনতে পারতেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ব্যাপারে সুলতান এতটাই আমানতদার ছিলেন যে, তার ওপর নির্ভরতায় কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের ছাপ কখনো ম্লান হতো না। অপরাধী কোনোভাবেই পেত না প্রশ্রয়।

দেখতে সুলেমান ছিলেন সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, ফর্সা এবং গাঢ় বাদামি ছিল তার চোখ, নাক ছিল খাড়া ও সরু। চোখের ভ্রু ছিল জোড়া লাগানো। দীর্ঘ ছিল তার গোঁফ, দাড়ি ছিল সুন্দর, ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর ও অসাধারণ। তার কণ্ঠস্বর ছিল স্পষ্ট ও ভরাট। তাকে দেখলেই মনে হতো আত্মবিশ্বাসী, বীর, দৃঢ়চেতা ও শক্তিধর। সৌভাগ্য ও অনুকূল পরিবেশ যেন সব সময় তার চার পাশে ঘিরে থাকত।

মাহিজিবরান, খুররম, গুলফাম ও ফুলেন ছিলেন তার স্ত্রী চতুষ্টয়। সেলিম-২, বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির, মোস্তাফা- এই আট পুত্রসন্তানের জনক। সুলেমানের ছিল দুই কন্যা মিহরিমান ও রেজায়ি।

তুর্কি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ পাল্টে যায়- যেমন খাতুন হয়ে যায় হাতুন, খুররম হয়ে যায় হুররম। আমাদের জানা অনেক শব্দ তুর্কি উচ্চারণে ভিন্নভাবে ধ্বনিত হয়। বাংলাদেশে যে সিরিজটি প্রদর্শিত হচ্ছে, এটি সম্ভবত ইংরেজি থেকে ডাবিং করা। তবে বাংলা ডাবিং মন্দ নয়, ডাবিংবিচ্যুতিও কম। শব্দচয়নে সতর্কতা লক্ষণীয়- যা ডাবিংয়ের প্রাণ। সন্দেহ নেই, সুলতান সুলেমান একটি প্রাণবন্ত সিরিজ। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে দায়বোধের জায়গা থেকে একটা কথা বলে রাখার গরজ বোধ করছি, এ সিনেমায় সুলেমান হেরেম ও সাম্রাজ্যের নায়ক। ইতিহাসের সুলেমান আরো বেশি বর্ণাঢ্য, সুশাসক, বিজয়ী ও মহানায়ক।

১৯২১ সাল পর্যন্ত অটোমান বা তুর্কি খেলাফত ব্যবস্থা টিকে ছিল। আমরা তুর্কি খেলাফতকে নিজেদের ভেবেছি। তার অংশ হওয়াকে গৌরবের বিষয় জেনেছি। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। কামাল আতাতুর্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্তির ঘোষণা দিলে উপমহাদেশজুড়ে খেলাফত পুনরুদ্ধার আন্দোলন শুরু হয়। সেটাই ইংরেজবিরোধী আজাদি আন্দোলনের মাত্রা পায়। গান্ধীজীও আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জুগিয়েছেন।

পুরো ইউরোপ সুলতান সুলেমানকে সমীহ করে চলত। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শ্রদ্ধাভরে তার আনুগত্য করাকে দায়িত্ব ভেবেছেন। সেই দিনগুলোতে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকেরা ধর্মীয় নেতা এবং উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতেন। আমাদের ইংরেজ শাসনবিরোধী আজাদি আন্দোলনের শুরুর দিকে শায়খুল হিন্দসহ সবাই তুর্কি খলিফাদের সাহায্য নিয়েছেন। রুটি ও রেশমি রুমাল আন্দোলনে তুর্কি পাশা ও খলিফাদের সমর্থন ইতিহাসস্বীকৃত বিষয়। বিশ্বাস ও নাড়ির টান সুলেমানকে আমাদের কাছাকাছি এনে দেয়। সেটি বিনোদনের সুড়সুড়ি এবং বাঁধহীন ব্যত্যয় বিচ্যুতির কারণে নষ্ট হলে আমরা ইতিহাসের মূলধারা থেকে ছিটকে পড়তে পারি- সেই সতর্কতার জন্যই এই বিষয়ে কলম ধরা। চলমান সিরিজের সমালোচনা করার কোনো দায় আমাদের নেই। ইতিহাসকে কাছাকাছি টেনে আনার উদ্যোগটুকু তো সমর্থনযোগ্য। যা হয়নি তা না হয় আগামী দিনে হওয়ার প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখল।

শাসনকালের সূচনালগ্নে সুলতান সুলেমান মহামতি আলেক্সান্ডারের থেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে অটোমান জাতিকে অপরাজেয় জাতি হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্প করেন।
 যুবরাজ থাকার সময় তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তখনই তার সততা ও যোগ্যতার কথা সবখানে আলোচিত হত। তিনি খলিফা হওয়ার পর সারা শে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রথম সুলেমান ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। দৈনন্দিন জীবনে তিনি ইসলামের অনুশাসনগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করতেন। সকল মুসলিম নাগরিক যাতে নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন করে সেই দিকে তার সজাগ দৃষ্টি ছিল।
তার শাসনকালে ধর্মীয় কোন্দলের কারণে বিপদাপন্ন হয়ে খ্রিস্টান দেশগুলো থেকে বহু প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক তার পরিচালিত রাষ্ট্রে এসে নিরাপদে বসবাস করতে থাকে। ইতিহাসবিদ লর্ড ক্রেজি বলেন, খ্রিস্টান জগতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের অত্যাচার-অবিচারের যুগে সমসাময়িক অন্য কোনো নরপতি সুলাইমানের ন্যায় প্রশংসা অর্জন করতে পারেনি’।
সাহসিকতা, মহানুভবতা, ন্যাপরায়ণতা এবং বদান্যতা তার চরিত্রের ভূষণ ছিল। তিনি নাগরিকদের করভার লাঘব করেন।

সুলাইমানিয়া মসজিদ তার অমর কীর্তি। রাষ্ট্রের সর্বত্র বহু মসজিদ, ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গোসলখানা, সেতু ইত্যাদি তৈরি করেন। তিনি দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের বরখাস্ত করে সৎ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনি আপন জামাতাকেও গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে দেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র খিলাফতকে ২১টি প্রদেশ এবং ২৫০টি জেলায় বিভক্ত করেন।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিস্তারকালে, সুলতান সুলেমান ব্যক্তিগতভাবে তার সাম্রাজ্যের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, খাজনা ব্যবস্থা ও অপরাধের শাস্তি ব্যবস্থার বিষয়গুলোতে আইন প্রণয়নসংক্রান্ত পরিবর্তন আনার আদেশ দেন। সুলতান সুলেমান যে শুধু একজন মহান রাজা ছিলেন তা নয়, তিনি একজন মহান কবিও ছিলেন। তার শাসনামলে উসমানীয় সংস্কৃতির অনেক উন্নতি হয়। সুলতান সুলেমান উসমানীয় তুর্কি ভাষাসহ আরো পাঁচটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারতেন: আরবি ভাষা, সার্বীয় ভাষা, ফার্সি ভাষা, উর্দু ভাষা এবং চাগাতাই ভাষা (একটি বিলুপ্ত তুর্কি ভাষা)। তার সমসাময়িক প্রখ্যাত শাসক ছিলেন জার্মানির পঞ্চম চার্লস, ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিস, ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ, রাশিয়ার জার আইভানোভিচ, পোল্যান্ডের সিজিসম্যান্ড, ইরানের শাহ ইসমাইল এবং ভারতের সম্রাট আকবর।

প্রথম দিকে উসমানী শাসকগণ নিজেদের ইসলামী আইন-কানুনের প্রতিভূ মনে করতেন। ১৬ শতকের মধ্যভাগ থেকে শাইখুল ইসলামের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। তার পদমর্যাদা প্রায় উজিরে আজমের পদমর্যাদার সমকক্ষ ছিল। কোনো আইন ধর্মীয় বিধান সম্মত কিনা সেই সম্মন্ধে অভিমত দেয়াই ছিল শাইখুল ইসলামের প্রধান কাজ। সকল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার দফতরের অধীন ছিল।

সিরিয়াল নিয়ে কিছু কথা :
প্রায় ৭০০ বছর ধরে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল পৃথিবীজুড়ে। এ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। ক্ষমতার টানাপড়েনে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই হত্যা, সন্তান হত্যা এবং দাসপ্রথার অন্তরালের কাহিনী নিয়ে নির্মিত মেগা সিরিয়ালে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হুররাম সুলতান।

এই অপরূপ সুন্দরী রানীর কারণেই ধীরে ধীরে সুলতানের প্রাসাদে দানা বাঁধতে থাকে বিদ্বেষ। পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে অটোম্যানরা।

মজার ব্যাপার হল, অটোম্যান সাম্রাজ্যের ওই রানী বলতে এখন বিশ্বের সবাই মারিয়াম উজারলিকে চিনে থাকেন। চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই মিশে গিয়েছিলেন তিনি। জার্মান এ মডেলকে এ চরিত্রে নেয়াটা হুট করেই যেন হয়েছে। ইতিহাসনির্ভর এ হুররাম চরিত্রের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় আট মাস ধরে চলে ‘হুররাম’-এর খোঁজ। এরপর ২০ হাজারের বেশি প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ওই চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হন মারিয়াম।

সুলতান সুলেমানে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ৩২ বছর বয়সী এ অভিনেত্রী বলেন, ‘হঠাৎ শুটিংয়ের জন্য তুরস্কে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুটিংয়ের জন্য পাক্কা দুই বছর হোটেলেই থাকতে হয়েছে আমাকে।’ সুলতান সুলেমানের আগেও জার্মান প্রোডাকশনে টেলিভিশন সিরিজ নটরুফ হাফেনকান্তে, আইন ফাল ফ্যুয়ের সোয়াই ছাড়াও জার্নি অব নো রিটার্ন, ইয়েটস আবের বালেট ছবিতে অভিনয় করেন মারিয়াম। কিন্তু ২০১১ সালের সুলতান সুলেমানে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই সর্বাধিক খ্যাতির দেখা পান এ তারকা।

সিরিয়ালে ব্যতিক্রমধর্মী অভিনয়ের জন্য ২০১২ সালে তিনি পেয়ে যান গোল্ডেন বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড। নিউইয়র্কভিত্তিক ম্যান’স ম্যাগাজিন জিকিউয়ের দৃষ্টিতে নির্বাচিত হন ‘ওম্যান অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০১৩ সালে এ মেগা সিরিয়ালে আর অভিনয় করতে পারেননি মারিয়াম। সিরিয়ালের ১০৩ পর্ব থেকে ক্ষমতার বদলে হুররাম হিসেবে পর্দায় আসেন ভেহিদ পারসিন। ব্যক্তিজীবনে মারিয়াম এক সন্তানের জননী। মডেলিং বা অভিনয়ের বাইরে এখনও দিব্যি সংসার করে ফিরছেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের এ প্রতীকী রানী।

সুলেমান-১ জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল। তার পিতা সুলতান সেলিম-১, মা হাফছা সুলতান সনৱানের চরিত্র গঠন ও গুণগত লেখাপড়ার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। দাদী গুলবাহার খাতুনই ছিলেন কার্যত সুলেমানের প্রথম শিক্ষক এবং গাইড। মাত্র সাত বছর বয়সে সুলেমান তার দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর কাছে ইসৱাম্বুলে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন। পৃথিবী বিখ্যাত জ্ঞানতাপস খিজির ইফিন্দি বা আফেন্দি ছিলেন তার ওসৱাদদের মধ্যে অন্যতম। তার কাছেই সুলেমান ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশল নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। তারপর সুলেমান ১৫ বছর বয়স হওয়া অবধি ট্রাবজনে তার পিতার সাথে অবস্থান করেন। এই ট্রাবজনই ছিল তার জন্মস্থান। নেতৃত্বের যোগ্যতা, সততা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রতিভার গুণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুলেমান গভর্নর নিযুক্ত হন। তাকে প্রথমে সরকি প্রদেশে, তারপর কারা হিসর, বলু এবং অল্প সময়ের জন্য কিফিতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সেলিম-২,:' বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির, মোসৱাফা- এই আট পুত্র সনৱানের জনক। সুলেমানের ছিল দুই কন্যা মিহরিমা ও রেজায়ি।

সিরিজে তুর্কি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ পাল্টে যায়- যেমন খাতুন হয়ে যায় হাতুন, খুররম হয়ে যায় হুররম। আমাদের জানা অনেক শব্দ তুর্কি উচ্চারণে ভিন্নভাবে ধ্বনিত হয়। বাংলাদেশে সুলতান সুলেমান নামে দীপ্ত টিভিতে যে সিরিজটি প্রদর্শিত হচ্ছে তা ইংরেজি থেকে বাংলায় ডাবিং করা। পৃথিবীব্যাপী টিভি নাটকের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত এই সিরিজের মূলভাষা তুর্কি।

 ইব্রাহিম পাশা:

সুলতান সুলেমানের উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশা। সম্রাটের বিশ্বস্থ সহচর। আসল নাম ওকান এলবিক। তুরস্কের ইসৱাম্বুলে জন্ম ১৯৭৮ সালে। পেশায় অভিনেতা। এ পর্যন্ত ২০টির বেশি সিরিয়ালে কাজ করেছেন। চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এই সিরিজের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র ইব্রাহিম পাশা। অত্যন্ত তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন উজিরের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। কিন্তু জীবনে খুবই অসুখী একজন মানুষ।

হেতিজা সুলতানা:

জার্মানির হাম শহরে জন্ম সেলমা এরগেজ ওরফে হেতিজা সুলতানার। পড়াশোনা করেছেন মেডিসিন বিষয়ে। এছাড়া সাইকোলজি ও ফিলোসফি নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। তিনি জার্মান ও তুর্কি নাগরিক। মডেলিং ও অভিনয় তার নেশা। অনেকগুলো ভাষা জানেন তিনি। তার মধ্যে আছে জার্মান, তুর্কি, ইটালিয়ান, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ। তিনি বিবাহিত। তার স্বামীর নাম কেনওজ। ২০০০ সাল থেকে মডেলিং ও অভিনয় করছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৭টি ছবিতে এবং ৭টি টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সুলতান সুলেমান সিরিজে তিনি অভিনয় করেছেন সম্রাটের বোনের চরিত্রে। এই সিরিজে তাকে হাবা গোবা দেখালেও ব্যক্তি জীবনে অনেক স্মার্ট এবং তুরস্কের নামকরা মডেল তারকা।

বেগম সুলতানা:

আসল নাম নেবাহাত চেহরে। জন্ম কৃষ্ণসাগরের কাছে উত্তর তুরস্কে ১৯৪৪ সালে। বর্তমানে তার বয়স ৭২। পেশা অভিনয়। ১৯৫০ সাল থেকে অভিনয় করছেন। এ পর্যন্ত বহু চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি গোল্ডেন অরেঞ্জ বিজয়ী তুর্কি অভিনেত্রী। এক সময় মডেলিং করেছেন ও গানও গেয়েছেন। ১৯৬০ সালে হয়েছিলেন মিস টার্কি। ১৯৬০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ডেও অংশ নেন তিনি এবং ১৯৬৫ সালে মিস ইউনিভার্সে তুরস্কের প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্যক্তি জীবনেও সুকঠিন ও সত্যবাদী একজন মানুষ। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করেন না। এই সিরিজেও তার চরিত্রে সেই বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

মাহিদেব্রান:

জার্মান ও তুরস্কের নাগরিক নূর ফাত্তাহগুলু। সুলতান সুলেমান সিরিজে তিনি অভিনয় করেছেন সম্রাট সুলেমানের প্রথম স্ত্রী মাহিদেব্রান এবং শাহাজাদা মোস্তফার মায়ের চরিত্রে। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সদালাপি ও সজ্জন ব্যক্তি নূর মডেলিংও করেছেন। পেশা অভিনয়। টিভি প্রেজেন্টার ও ফ্যাশন ডিজাইনারের উপর পড়াশোনা করেছেন। প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেটাও ভেঙেছে ২০১৫ সালে। এ পর্যন্ত ৬টি টিভি সিরিজ ও দুটি ফিল্মে অভিনয় করেছেন। তার জন্ম ১৯৮০ সালে।

নীগার কালফা:

আসল নাম ফেলিজ এহমেদ। তিনি ম্যাসোডোনিয়া ও তুর্কি নাগরিক। অভিনয় তার পেশা। তুরস্কে তিনি একনামে পরিচিত ফেয়ারওয়েল রুমেশিয়া টিভি সিরিজের মাধ্যমে। তার দাদা একজন বিখ্যাত অভিনেতা ছিলেন। ম্যাসোডোনিয়া ও তুরস্ক থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তুলতান সুলেমান-এ নীগার কালফা চরিত্রে অভিনয় করে ইউরোপ, আমেরিকায় ও এশিয়ায় সমাদৃত হয়েছেন। তিনি ম্যাসোডোনিয়া আলেবিনিয়া, সুইডেন, টার্কিস, ইংলিশ, সার্বিয়ান ও বুলগেরিয়ান ভাষায় অভিনয় করেছেন। এবং এই ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। তিনি গ্রাজুয়েশন করেছেন সুইডেনে মেডিক্যাল স্কুলে এবং ম্যাসোডোনিয়ায় গ্রাজুয়েশন করেছেন ফাইন আর্টস-এ। তার একটি মাত্র সনৱান।

শাহজাদা মোস্তফা:

আসল নাম মেহমেত গানসুর। জন্ম তুরস্কে ১৯৭৫ সালে। পেশায় অভিনেতা মডেল ও প্রযোজক। গানসুর গ্রাজুয়েশন করেছেন ইটালিয়ান হাইস্কুলে। তুর্কি, ইটালিয়ান ও আমেরিকান চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন। প্রথম জীবনে একটি রেস্টুরেন্টে বারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সালে আস্কার ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রমেজিং অ্যাকটর-এর সেরা পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পান গোল্ডেন অরেঞ্জ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এ পর্যন্ত ১৮টি সিরিজ ও ফিল্মে অভিনয় করেছেন তিনি। গানসুর একজন মুসলিম। বিয়ে করেছেন ১৯৮৯ সালে।

No comments:

Post a Comment