ইতিহাসের আলোকে দেশবিভাগ ও কায়েদে আজম জিন্নাহ । বইয়ের ভূমিকা:
লেখক :: এম এ মোহাইমেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর ।
জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে দুই সার্বভৌম স্টেটসকে এক স্টেটে রূপান্তর করেন। ৪০ সালের মূল লাহোর প্রস্তাবে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে দুইটি সার্বভৌম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠন হবে। ৪৬ সালে তিনি দুই রাষ্টের জায়গায় এক রাষ্ট্র করে বাংলার মুসলমানদের পশ্চিম পাকিস্তানীদের অধীন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন । আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা জিন্নাহর ৪৬ সালের এই পরিবর্তনকে বাঙালী জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে বাঙালীর শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রয়াস চালিয়ে আসছিল ।
জিন্নাহ সাহেবের গণতন্ত্রের চেতনা, তাঁর নির্লোভ চরিত্র ও যুক্তিবাদী চিন্তার সঙ্গে যারা পরিচিত তাদেরকে তাঁর শেষ মুহূর্তের এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন তাগিদ ছিল কিনা এ ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। জিন্নাহ সাহেব জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের লোক ছিলেন না । তাঁর মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। ধন দৌলতের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না । খ্যাতনামা ব্যারিস্টার হিসেবে বিপুল অর্থ উপার্জনের মারফত যে অগাধ সম্পত্তির মালিক তিনি হয়েছিলেন সে অর্থ নিজের একমাত্র কন্যাকে দান না করে দেশের জন্য তিনি দান করে গিয়েছিলেন । এহেন ব্যক্তির কাছে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থকে আলাদা চোখে দেখার কোন কারণ ছিল বলে মনে হয় না। দুই অঞ্চলের লোকের স্বার্থকে তাঁর মত সচ্চরিত্র ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির সমান দৃষ্টিতে দেখাই ছিল স্বাভাবিক । এই সম্পর্কে গভীরভাবে যারা চিন্তা করেছেন তাদের কাছে তাই মনে হয়েছে পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের স্বার্থেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
১৯৪৫সালে কেবিনেট মিশন প্লানের আলোচনার বিভিন্ন স্তরে এবং শেষ পর্যন্ত যখন কেবিনেট মিশন প্লান প্রত্যাখ্যান হয় তখন জিন্নাহ সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর কল্পিত পুরো পাকিস্তান তিনি হয়ত পাবেন না । কংগ্রেসের চাপে ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করে ফেলতে পারে এবং আসামের অধিকাংশ অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় খণ্ডিত বাংলা ও আসামের যেটুকু পাওয়া যেতে পারে তা দিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র হলে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ । পূর্বাঞ্চলে এই ক্ষুদ্র দুর্বল রাষ্ট্রটিকে পশ্চিমাঞ্চলের বৃহৎ অংশের সংঙ্গে একত্র করে এক রাষ্ট্র করাই পূর্বাঞ্চলের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করা সর্বোত্তম উপায় বলে তিনি বিবেচনা করলেন । এ কারণেই ৪৬ এর মার্চে দিল্লিতে লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ডেকে দুই রাষ্টের পরিবর্তে এক রাষ্ট্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । পূর্বাঞ্চলে যে ক্ষুদ্র এলাকা নিয়ে সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হত সে রাষ্ট্রকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে সব সম্ভাব্য প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো সে সম্পর্কে নিম্নোক্ত আলোচনা থেকে এক রাষ্ট্র করার জিন্নাহ সিদ্ধান্ত কতখানি বাস্তবধর্মী ছিল তা প্রতীয়মান হয়।
মাউন্টব্যাটেনের চক্রান্তের ফলে আমরা গোটা আসাম ও অখণ্ড বাংলার অর্ধেকের মতো শেষ পর্যন্ত হারিয়ে পূর্বাঞ্চলের যে অংশটুকুর মালিক হয়েছিলাম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে আমরা সক্ষম হতাম না নিম্নোক্ত কারণগুলোর জন্য :
যেহেতু ব্রিটিশ আর্মিতে বাঙালীদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য তাই যে সময় দেশ ভাগ হয় সেই সময় নব্য স্বাধীন দেশটিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কোন সেনাবাহিনী গঠন করার মতো আমাদের কোন লোক ছিল না। সবশুদ্ধ মিলে ওই সময় ৪/৫ জন বাঙালী কিংস কমিশন অফিসার ও ৫০/৬০ জন জে সি ও এবং শ' দুয়েক সিপাহী আমাদের হাতে ছিল যাদের দিয়ে দু' চার / ছয়মাস তো দূরের কথা দু' এক বছরের মধ্যেও কোন সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি লোকের ১৯টি জেলায় পুলিশ প্রশাসন আমরা গড়ে তুলতাম কিভাবে ?? ১৯টি জেলায় কম করে হলেও দু'শত থানায় ৫০ জন করে অফিসার ও সিপাহী কনস্টেবলের দরকার ছিল । এতো গুলো অফিসার ও সিপাহী কনস্টেবল যেখানে প্রয়োজন সেখানে দেশ ভাগের সময় উর্ধে শ' খানেক অফিসার ও ৩/৪ শত কনস্টেবল ও সিপাহী আমাদের হাতে ছিল । প্রয়োজনীয় সংখ্যক এই ৫/৭ শত অফিসার ও ৮/৯ হাজার কনস্টেবল সিপাহী রাতারাতি তৈরী করে পুলিশ প্রশাসন চালু করা আমাদের পক্ষে তখন সম্ভব ছিলনা কিন্তু এক পাকিস্তান হবার ফলে ভারতের বিভিন্ন অংশের পুলিশ বিভাগের কয়েক হাজার লোক এসে হাজির হওয়ায় পুলিশ প্রশাসন গড়ে তুলতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি ।
তৎকালে দেশ শাসনের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। জেলা প্রশা�সক হিসেবে কাজ করার মতো দক্ষ লোক আমাদের একজনও ছিল কিনা সন্দেহ । ব্রিটিশ আমলে জেলার কর্তা হতেন অভিজ্ঞ আইসিএস অফিসাররা। দেশ বিভাগের সময় আমাদের হাতে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় পাস করা কোনো আইসিএস অফিসারইক ছিলনা ।
দেশ বিভাগের পূর্বে পাস করা আইসিএস বাঙালীদের মধ্যে একজনই হয়েছিল, যার নাম আখতারুজ্জামান। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোক, দেশ বিভাগের সময় তিনি পাকিস্তানে না এসে ভারতে থেকে যান। সে সময় অবিভক্ত বাংলায় দু'জন মাত্র বাঙালী মুসলিম আইসিএস ছিলেন । তারা হলেন নূরনবী চৌধুরী ও মি: মোর্শেদ। তবে দুজনেই ছিলেন নমিনেটেড আইসিএস । এ দুজনের মধ্যে নূরন্নবী সাহেব এদেশে এসেছিলেন । মোর্শেদ সাহেব পশ্চিমবঙ্গে রয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯টি জেলা ও ৬০/৭০টি সাবডিভিশনে প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলবার মত লোক আমরা কোথায় পেতাম ? বাঙালী আইসিএস একজনও ছিলনা । ডেপুটি সাব ডেপুটি আমাদের হাতে তখন ২০/২৫ জনের বেশি ছিল কিনা সন্দেহ । এ অবস্থায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন যন্ত্র গড়ে তোলা ছিল প্রায় সম্পূর্ণ অসম্ভব এবং উপযুক্ত প্রশাসন যন্ত্র ছাড়া দেশ একদিনও চলতে পারতো না । এ অবস্থায় অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা বলে জিন্নাহ সাহেব খণ্ডিত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ভবিষ্যতে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হবে তা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই এক পাকিস্তান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে মনে হয়।
এক পাকিস্তান হওয়ার ফলেই বিহার , উড়িষ্যা , যুক্ত প্রদেশ , আসাম থেকে মুসলমান রেলওয়ে অফিসার ও কর্মচারী ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এসে হাজির হয়েছিল বলেই আমরা আমাদের কয়েকশশ মাইল রেলওয়েকে তখন চালু রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। রেলওয়ে চালু রাখার জন্য আমাদের যেখানে কয়েক হাজার দক্ষ লোকের প্রয়োজন ছিল সেখানে বাঙালী টিটি, স্টেশন মাস্টার , ট্রেন চালক ও কর্মচারী ছিল সর্বসাকুল্যে কয়েকশত । তাই এক পাকিস্তান হওয়াতেই বিহার , উড়িষ্যা , যুক্ত প্রদেশ , আসামের দক্ষ রেলওয়ের কর্মীদের সাহায্য সহযোগীতা আমরা পেয়েছিলাম , নচেৎ অবাঙালী সবাই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। এক পাকিস্তান হওয়াতেই বিহার , যুক্ত প্রদেশ , মধ্য প্রদেশ থেকে বহু পুলিশ অফিসার , প্রশাসনের দক্ষ আইসিএস ও অন্যান্য বিভাগের অবাঙালী অফিসার পূর্ব পাকিস্তানে এসে হাজির হয়েছিল বলেই আমরা বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। সকল সমস্যার মধ্যে সামরিক বিভাগের দুর্বলতা কথাই বোধহয় জিন্নাহ সাহেব সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন । কাজেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের কোন উপযুক্ত সৈন্য বাহিনী না থাকলে পার্শ্ববর্তী ভারত যে কোন অজুহাতে যে কোন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করে নিতে পারে এবং একবার কোনভাবে নিতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তানের যত আপত্তি ও সমবেদনাই থাকুক না কেন শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের প্রস্তাব পাস করানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান যেহেতু আলাদা রাষ্ট্র তাই পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে নামা মোটেই সম্ভব হবে না। কিন্তু এক পাকিস্তান হলে পূর্ব অঞ্চলে আক্রান্ত হলে পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধে নামতে বাধ্য এবং ভারত এটা বুঝবে বলে সহজে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করতে সাহস করবে না।
জিন্নাহ সাহেব সিদ্ধান্ত ও ধারণা যে সঠিক ছিল পরবর্তী ঘটনা থেকে তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। বিভিন্ন অছিলায় ভারত যখন পর পর ( স্বাধীন রাষ্ট্র ) জুনাগড় , মান্ডাভার ও হায়দারাবাদ দখল করে নিল তখন পাকিস্তানের অসহায়ের মত শুধু তাকিয়েই রইল, কিছুই করতে পারলনা। এর পূর্বে কাশ্মীরেরও দুই তৃতীয়াংশ যখন দখল করে নিল পাকিস্তান যুদ্ধে নেমেও আজ পর্যন্ত তার কোন ফয়সালা করতে পারেনি । উপরোক্ত ঘটনা গুলোর প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে পরিষ্কার মনে হয় ১৯৪৬ সালে এক পাকিস্তান করার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন সেটা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানীদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই নিয়েছিলেন। এ সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বার্থে নেয়া হয়নি । এখানে স্মরণযোগ্য ২৫ বছর পর যখন আমরা স্বাধীন হয়ে আলাদা হয়ে গেলাম তখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল । এ ২৫ বছরে আমরা প্রশাসন , পুলিশ ও অন্যান্য বিভাগ গড়ে তুলেছি। আমাদের সৈন্য বাহিনীও ততোদিনে গড়ে উঠেছে । তাই নতুন রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের কোন বেগ পেতে হয়নি ।
উপরোক্ত বিষয়গুলো একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায় পূর্বাঞ্চলের সম্ভাব্য ভবিষ্যত্ অবস্থার কথা চিন্তা করেই জিন্নাহ সাহেব states থেকে s বাদ দিয়ে state করেছিলেন আমাদের ভবিষ্যত্ মঙ্গল ও নিরাপত্তার জন্য , পশ্চিম পাকিস্তানের সুবিধার জন্য নয়।
বইয়ের ভূমিকা : ইতিহাসের আলোকে দেশবিভাগ ও কায়েদে আজম জিন্নাহ ।
লেখক :: এম এ মোহাইমেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর ।
No comments:
Post a Comment