Monday 30 January 2017

ঘান্নুশি দর্শন: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সেকুলার হওয়ার প্রয়োজন নেই ।


মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ, লন্ডন থেকে।

প্রগ্রেসিভ ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট ইউকের উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে সমকালীন ব্রিটিশ বাংলাদেশী মুসলিম স্কলার, বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ কামরুল হাসান বলেন, তিউনিশিয়ার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ দার্শনিক রাশিদ ঘান্নুশি ছিলেন সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের একজন মেধাবী ও সৃজনশীল চিন্তাবিদ। তিউনিশিয়া মূল ধারার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ঘান্নুশি মনে করেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে সেকুলার হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের, আইন শাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে, আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য সেকুলার, বাম, জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামপন্থীদের সাথে সমন্বয় করা খুবই জরুরী ।


স্থানীয় সময় রোববার রাতে লন্ডন মুসলিম সেন্টারে আয়োজিত এক সেমিনারে মুসলিম চিন্তাবিদ ও দার্শনিক রাশিদ ঘান্নুশির চিন্তার দর্শনের উপর গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন ।


প্রগ্রেসিভ ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট ইউকের সম্বনয়কারী সাংবাদিক নূরে আলম বরষণের পরিচালনায় সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন, আব্দুল হান্নান মিয়াজী, দ্যা গ্লোবাল নিউজের সম্পাদক নাজমুল হোসাইন, সাংবাদিক মাহবুব আলী খানশূর, মানবাধিকার কর্মী মনিরুল হক, সাইদ মুহম্মদ বাকী, মাহমুদ আহমদ, জাবেদ হোসাইন, আব্দুল আউয়াল তারেক, আদিল মিয়া প্রমুখ।


বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ কামরুল হাসান বলেন, মুসলিম বিশ্বের অবিসাংবাদিত নেতা এবং তিউনিশিয়া বিরোধীদলীয় "আন নাহাদা পার্টির কো প্রতিষ্ঠা দার্শনিক রাশিদ ঘান্নুশি গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রে ইসলাম ও জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন। তাঁর যৌথ প্রতিষ্ঠিত দল ১৯৭২ সালে ‘ইসলামী দল’ (আল জামায়াহ আল ইসলামিয়্যাহ) নাম দিয়ে তিউনিশিয়ায় প্রথম ইসলামী আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর ১৯৮১ সালে এটি ‘ইসলামী ধারার আন্দোলনে’ (হারাকাত আল ইতিজাহ আল ইসলামী) পরিণত হয়। সর্বশেষ, ১৯৮৯ সালে এটি ‘রেনেসাঁ আন্দোলনে’ (হারাকাত আন নাহদা) পরিণত হয়।


মোটাদাগে, এই তিনটি সংগঠন ইসলামী আদর্শের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনকে ধারণ করে। প্রথম দলটি ছিল পুরোপুরি একটি ধর্মীয় আন্দোলন। তারা মসজিদগুলোতে ইসলামী আদর্শের প্রচার করতো। ‘আল মারিফা’ (জ্ঞান) নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করতো। পরিবার ও শিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়গুলো ছিল এর বিষয়বস্তু। এছাড়া আন্দোলনটি তরুণদেরকে ইসলামী নৈতিকতা শিক্ষা দিতো। এইসব পরিবর্তনে প্রজ্ঞ দার্শনিক রাশিদ ঘান্নুশির সুদুর প্রসারি চিন্তার ছাপ প্রমাণিত হয় আন নাহাদা ক্ষমতায় আসার মধ্যে।


ড. কামরুল হাসান বলেন, ১৯৮৯ সালে ‘আন নাহদা মুভমেন্ট পার্টি’ নাম নিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু করে। এর পেছনে একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগিবাকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হঠিয়ে ক্ষমতায় আসেন যাইন আল আবেদিন বেন আলী। তার সময়ের গণমুখী রাজনীতির সুযোগ গ্রহণ করা ছিল এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য। বেন আলী শুরুর দিকে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং একটি বহুত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নিজের ক্ষমতার বৈধতাকে আরো শক্তপোক্ত করা। পরবর্তীতে তিনি এই প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করেননি। নয়া সরকারকে আশ্বস্ত রাখা এবং রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত তিউনিশিয়ার নতুন আইন অনুযায়ী (যে আইনে ধর্মীয় দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে) নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা তখন প্রয়োজনীয় ছিল। তাই দার্শনিক রাজনৈতিক নেতা ঘান্নুশি এবং ইসলামপন্থী অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সংগঠনের নাম পরিবর্তন, নাম থেকে ‘ইসলামী’ শব্দটি বাদ দেয়া এবং সংগঠনের আদর্শের পুনর্মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে নতুন নাম হয় ‘আন নাহদা মুভমেন্ট’। এই প্রেক্ষাপটে দাবি করা হয়েছিল, রাজনৈতিক ইসলাম সম্পর্কে ক্লাসিকাল ইসলামী আন্দোলনগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে তিউনিশিয়ার ইসলামী আন্দোলনের জন্য আন নাহদা নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছে।


ড. কামরুল হাসান বলেন, সর্বশেষ কংগ্রেসে ঘান্নুশি তার বক্তব্যে বলেছেন, “নিছক মতাদর্শ, বড় বড় শ্লোগান আর রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদ দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র চলে না। বাস্তব কর্মসূচির আলোকেই রাষ্ট্র চালাতে হয়। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনগুলোর প্রচলিত প্ল্যান-ইসলামিক এজেন্ডা থেকে আন নাহদা সরে এসে শুধু জাতীয় এজেন্ডা অর্থাৎ তিউনিশিয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োজিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


কাঠামোগত অর্থে এই সিদ্ধান্তের মানে হলো, আন্দোলনটি একটি গতানুগতিক দলে পরিণত হবে এবং ধর্মীয় দাওয়াতী কার্যক্রম থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করে ঘান্নশি বলেন, “আমরা ধর্মকে রাজনৈতিক বিবাদ থেকে দূরে রাখতে চাই। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, দলীয়করণ থেকে মুক্ত রেখে মসজিদগুলোর পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য আমরা আহ্বান জানাই।


ড. কামরুল হাসান তাঁর প্রবন্ধে আরও বলেন, আজ থেকে তিরিশ বছর পূর্বে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুরগিবা বিরোধী দলের একজন শীর্ষনেতাকে পুনরায় বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। ওই নেতার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বুরগিবা যথেষ্ট মনে করেননি। তাই তিনি তাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষমান এই ব্যক্তিটি ছিলেন শায়খ রশিদ ঘানুশী। আরব বসন্তের আধ্যাত্মিক নেতা। বিপ্লবোত্তর তিউনিশিয়ার জনক বলে অনেকে যাকে সম্মান করে থাকেন। বুরগিবারের পর ক্ষমতায় আসেন আরেক স্বৈরশাসক বেন আলী।


ড. কামরুল হাসান আরও বলেন, ১৯৮১ সালের ৬ জুন এটি ‘ইসলামী ধারার আন্দোলন’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। নতুন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন দলিলপত্র অনুযায়ী এর মধ্যে রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলন গুলোর চারটি গতানুগতিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়: এক. সংগঠনটি ধর্ম ও রাজনীতিকে অবিচ্ছেদ্য দুটি সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করে। ইসলামের সামগ্রিক রূপকে গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়। সেক্যুলারিজম এবং প্রাগম্যাটিজম হতে মুক্ত থেকে রাজনীতি করার ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের চিন্তাকে তারা খ্রিস্টীয় ধারণার অনুপ্রবেশ এবং ‘আধুনিকতা’র নেতিবাচক প্রবণতা হিসেবে সাব্যস্ত করে।


দুই. এই সংগঠন আত্মপরিচয়ের রাজনীতির উপর গুরুত্বারোপ করে। এ জন্য তারা দুটি কাজকে প্রাধান্য দেয়: তিউনিশীয় ইসলামী ব্যক্তিত্বদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং ইসলামী চিন্তার সংস্কার।


তিন. স্থানীয়, আঞ্চলিক, আরব বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক অর্থাৎ সকল পর্যায়ে ইসলামের রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলোকে ফিরিয়ে আনার তৎপরতা’য় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা স্পষ্টতই প্যান-ইসলামী ভাবাদর্শকে গ্রহণ করেছে।


চার. লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগঠনটি ধর্ম ও রাজনীতির এক ধরনের মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করে। এরমধ্যে রয়েছে ‘ইবাদত ও জনসমাগমের কেন্দ্র হিসেবে’ মসজিদের প্রকৃত ভূমিকা ফিরিয়ে আনা, ইসলামী ভাবধারাসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূচনা করা, স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিরোধ করা, ইসলামী সরকারব্যবস্থার আধুনিক মডেল উপস্থাপন এবং এর উন্নয়ন সাধন করা, ইসলামের সামাজিক মূলনীতিগুলোর উন্নয়ন ও প্রয়োগ ইত্যাদি।


তিউনিশিয়া হচ্ছে আরব বসন্তের আঁতুড়ঘর। দেশটি আবারো আরব বিশ্বকে এক নতুন পথ দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এ প্রচেষ্টা কি সফল হবে? তিউনিশীয় গণতন্ত্র এখনো বেশ নাজুক। পর্যটন শহর সুসা’য় গতবছর সংঘটিত ব্রিটিশ পর্যটকদের উপর আইএসপন্থীদের নির্বিচার গুলিবর্ষণের ঘটনা থেকে এটি স্পষ্ট প্রমাণিত।


ড. কামরুল হাসান তাঁর প্রবন্ধে আরও বলেন, রাজধানী তিউনিসে ঘান্নুশির সিদ্ধান্তকে বেশ সাদরেই গ্রহণ করা হয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এ বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি, যখন রাজধানী থেকে ২’শ কিলোমিটার দক্ষিণে দেশটির কেন্দ্রে অবস্থিত শহর সিদি বুজিদে পৌঁছি। এখানেই পাঁচ বছর আগে হতাশাগ্রস্ত ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বুআজিজি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে মৃত্যুবরণ করার মাধ্যমে আরব বসন্তের সূচনা করে যান।


তিউনিশিয়ার জনগণ বার বার জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছে যে, তাঁরা কট্টরপন্থা ও সহিংসতাকে সমর্থন করে না। আন-নাহদার রাজনীতিবিদ সাইয়্যেদ ফেরজানিসহ অনেকেই মনে করেন যে, মধ্যপন্থী মালিকি মাজহাবের প্রসারের ফলে ঐতিহাসিকভাবে তাঁরা চরমপন্থাকে পরিহার করেছেন।


উল্লেখ্য, তিউনিশিয়ার ৯৮ শতাংশ মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে মালিকি মাজহাবের অনুসারী। এ ধরনের মধ্যপন্থী জাতীয়-মানস গঠনের পিছনে কেউ কেউ তিউনিশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরগিবার শাসনামল (১৯৫৭-১৯৮৭) এবং তাঁর আধুনিকায়ন প্রকল্পের সাংস্কৃতিক প্রভাবের কথা বলেন। এছাড়া তিউনিশিয়ায় তেমন কোনো জাতিগত, উপজাতীয় কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্মীয় বিভেদ নেই বললেই চলে, যা অন্যান্য দেশে অনেক প্রকটভাবে দেখা যায়।


তিনি বলেন, আন-নাহদার নেতৃবৃন্দও বেন আলীর সময় বছরের পর বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আন-নাহদার নেতা রশিদ আল-ঘানুসী লন্ডনে নির্বাসিত ছিলেন। দলটির অন্যান্য শীর্ষনেতাদের অবস্থাও একই। এইসব অভিজ্ঞতার ফলে আন-নাহদার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উপর এক ধরনের আধুনিকায়নের প্রভাব পড়ে। ফলে তাঁরা সমন্বয়মূলক আদর্শ ধারণ ও লালন করার সুযোগ পায়। তিউনিশিয়ার সেক্যুলাররা স্থিতিশীল নয় এবং আরব বিশ্বে তারা অতুলনীয়। বরগিবা এবং বেন আলীর অধীনে তিউনিশিয়া ছিল একমাত্র দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ ছিল। রশিদ আল-ঘানুসীর মতামত ছিল আমরা নিষিদ্ধ বা জোর করার পক্ষে নয় বরং এটা নারীর নিজস্ব স্বাধীনতার ব্যাপার ।
- See more at: http://www.timenewsbd.com/news/detail/98660#sthash.T39qp8FB.dpuf

Sunday 29 January 2017

জিন্নাহ কেন এক পাকিস্তান চেয়ে ছিলেন??



 ইতিহাসের আলোকে দেশবিভাগ ও কায়েদে আজম জিন্নাহ । বইয়ের ভূমিকা:
 লেখক :: এম এ মোহাইমেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর ।

জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে দুই সার্বভৌম স্টেটসকে এক স্টেটে রূপান্তর করেন। ৪০ সালের মূল লাহোর প্রস্তাবে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে দুইটি সার্বভৌম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠন হবে। ৪৬ সালে তিনি দুই রাষ্টের জায়গায় এক রাষ্ট্র করে বাংলার মুসলমানদের পশ্চিম পাকিস্তানীদের অধীন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন । আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা জিন্নাহর ৪৬ সালের এই পরিবর্তনকে বাঙালী জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে বাঙালীর শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রয়াস চালিয়ে আসছিল ।

জিন্নাহ সাহেবের গণতন্ত্রের চেতনা, তাঁর নির্লোভ চরিত্র ও যুক্তিবাদী চিন্তার সঙ্গে যারা পরিচিত তাদেরকে তাঁর শেষ মুহূর্তের এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন তাগিদ ছিল কিনা এ ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। জিন্নাহ সাহেব জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের লোক ছিলেন না । তাঁর মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। ধন দৌলতের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না । খ্যাতনামা ব্যারিস্টার হিসেবে বিপুল অর্থ উপার্জনের মারফত যে অগাধ সম্পত্তির মালিক তিনি হয়েছিলেন সে অর্থ নিজের একমাত্র কন্যাকে দান না করে দেশের জন্য তিনি দান করে গিয়েছিলেন । এহেন ব্যক্তির কাছে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থকে আলাদা চোখে দেখার কোন কারণ ছিল বলে মনে হয় না। দুই অঞ্চলের লোকের স্বার্থকে তাঁর মত সচ্চরিত্র ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির সমান দৃষ্টিতে দেখাই ছিল স্বাভাবিক । এই সম্পর্কে গভীরভাবে যারা চিন্তা করেছেন তাদের কাছে তাই মনে হয়েছে পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের স্বার্থেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

১৯৪৫সালে কেবিনেট মিশন প্লানের আলোচনার বিভিন্ন স্তরে এবং শেষ পর্যন্ত যখন কেবিনেট মিশন প্লান প্রত্যাখ্যান হয় তখন জিন্নাহ সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর কল্পিত পুরো পাকিস্তান তিনি হয়ত পাবেন না । কংগ্রেসের চাপে ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করে ফেলতে পারে এবং আসামের অধিকাংশ অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় খণ্ডিত বাংলা ও আসামের যেটুকু পাওয়া যেতে পারে তা দিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র হলে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ । পূর্বাঞ্চলে এই ক্ষুদ্র দুর্বল রাষ্ট্রটিকে পশ্চিমাঞ্চলের বৃহৎ অংশের সংঙ্গে একত্র করে এক রাষ্ট্র করাই পূর্বাঞ্চলের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করা সর্বোত্তম উপায় বলে তিনি বিবেচনা করলেন । এ কারণেই ৪৬ এর মার্চে দিল্লিতে লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ডেকে দুই রাষ্টের পরিবর্তে এক রাষ্ট্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । পূর্বাঞ্চলে যে ক্ষুদ্র এলাকা নিয়ে সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হত সে রাষ্ট্রকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে সব সম্ভাব্য প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো সে সম্পর্কে নিম্নোক্ত আলোচনা থেকে এক রাষ্ট্র করার জিন্নাহ সিদ্ধান্ত কতখানি বাস্তবধর্মী ছিল তা প্রতীয়মান হয়।

মাউন্টব্যাটেনের চক্রান্তের ফলে আমরা গোটা আসাম ও অখণ্ড বাংলার অর্ধেকের মতো শেষ পর্যন্ত হারিয়ে পূর্বাঞ্চলের যে অংশটুকুর মালিক হয়েছিলাম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে আমরা সক্ষম হতাম না নিম্নোক্ত কারণগুলোর জন্য :
যেহেতু ব্রিটিশ আর্মিতে বাঙালীদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য তাই যে সময় দেশ ভাগ হয় সেই সময় নব্য স্বাধীন দেশটিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কোন সেনাবাহিনী গঠন করার মতো আমাদের কোন লোক ছিল না। সবশুদ্ধ মিলে ওই সময় ৪/৫ জন বাঙালী কিংস কমিশন অফিসার ও ৫০/৬০ জন জে সি ও এবং শ' দুয়েক সিপাহী আমাদের হাতে ছিল যাদের দিয়ে দু' চার / ছয়মাস তো দূরের কথা দু' এক বছরের মধ্যেও কোন সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি লোকের ১৯টি জেলায় পুলিশ প্রশাসন আমরা গড়ে তুলতাম কিভাবে ?? ১৯টি জেলায় কম করে হলেও দু'শত থানায় ৫০ জন করে অফিসার ও সিপাহী কনস্টেবলের দরকার ছিল । এতো গুলো অফিসার ও সিপাহী কনস্টেবল যেখানে প্রয়োজন সেখানে দেশ ভাগের সময় উর্ধে শ' খানেক অফিসার ও ৩/৪ শত কনস্টেবল ও সিপাহী আমাদের হাতে ছিল । প্রয়োজনীয় সংখ্যক এই ৫/৭ শত অফিসার ও ৮/৯  হাজার কনস্টেবল সিপাহী রাতারাতি তৈরী করে পুলিশ প্রশাসন চালু করা আমাদের পক্ষে তখন সম্ভব ছিলনা কিন্তু এক পাকিস্তান হবার ফলে ভারতের বিভিন্ন অংশের পুলিশ বিভাগের কয়েক হাজার লোক এসে হাজির হওয়ায় পুলিশ প্রশাসন গড়ে তুলতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি ।

তৎকালে দেশ শাসনের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। জেলা প্রশা�সক হিসেবে কাজ করার মতো দক্ষ লোক আমাদের একজনও ছিল কিনা সন্দেহ । ব্রিটিশ আমলে জেলার কর্তা হতেন অভিজ্ঞ আইসিএস অফিসাররা। দেশ বিভাগের সময় আমাদের হাতে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় পাস করা কোনো আইসিএস অফিসারইক ছিলনা ।
দেশ বিভাগের পূর্বে পাস করা আইসিএস বাঙালীদের মধ্যে একজনই হয়েছিল, যার নাম আখতারুজ্জামান। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোক, দেশ বিভাগের সময় তিনি পাকিস্তানে না এসে ভারতে থেকে যান। সে সময় অবিভক্ত বাংলায়  দু'জন মাত্র বাঙালী মুসলিম আইসিএস ছিলেন । তারা হলেন নূরনবী চৌধুরী ও মি: মোর্শেদ। তবে দুজনেই ছিলেন নমিনেটেড আইসিএস । এ দুজনের মধ্যে নূরন্নবী সাহেব এদেশে এসেছিলেন । মোর্শেদ সাহেব পশ্চিমবঙ্গে রয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯টি জেলা ও ৬০/৭০টি সাবডিভিশনে প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলবার মত লোক আমরা কোথায় পেতাম ? বাঙালী আইসিএস একজনও ছিলনা । ডেপুটি সাব ডেপুটি আমাদের হাতে তখন ২০/২৫ জনের বেশি ছিল কিনা সন্দেহ । এ অবস্থায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন যন্ত্র গড়ে তোলা ছিল প্রায় সম্পূর্ণ অসম্ভব এবং উপযুক্ত প্রশাসন যন্ত্র ছাড়া দেশ একদিনও চলতে পারতো না । এ অবস্থায় অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা বলে জিন্নাহ সাহেব খণ্ডিত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ভবিষ্যতে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হবে তা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই এক পাকিস্তান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে মনে হয়।

এক পাকিস্তান হওয়ার ফলেই বিহার , উড়িষ্যা , যুক্ত প্রদেশ , আসাম থেকে মুসলমান রেলওয়ে অফিসার ও কর্মচারী ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এসে হাজির হয়েছিল বলেই আমরা আমাদের কয়েকশশ মাইল রেলওয়েকে তখন চালু রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। রেলওয়ে চালু রাখার জন্য আমাদের যেখানে কয়েক হাজার দক্ষ লোকের প্রয়োজন ছিল সেখানে বাঙালী টিটি,  স্টেশন মাস্টার , ট্রেন চালক ও কর্মচারী ছিল সর্বসাকুল্যে কয়েকশত । তাই এক পাকিস্তান হওয়াতেই বিহার , উড়িষ্যা , যুক্ত প্রদেশ , আসামের দক্ষ রেলওয়ের কর্মীদের সাহায্য সহযোগীতা আমরা পেয়েছিলাম , নচেৎ অবাঙালী সবাই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। এক পাকিস্তান হওয়াতেই বিহার , যুক্ত প্রদেশ , মধ্য প্রদেশ থেকে বহু পুলিশ অফিসার , প্রশাসনের দক্ষ আইসিএস ও অন্যান্য বিভাগের অবাঙালী অফিসার পূর্ব পাকিস্তানে এসে হাজির হয়েছিল বলেই আমরা বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। সকল সমস্যার মধ্যে সামরিক বিভাগের দুর্বলতা কথাই বোধহয় জিন্নাহ সাহেব সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন । কাজেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের কোন উপযুক্ত সৈন্য বাহিনী না থাকলে পার্শ্ববর্তী ভারত যে কোন অজুহাতে যে কোন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করে নিতে পারে এবং একবার কোনভাবে নিতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তানের যত আপত্তি ও সমবেদনাই থাকুক না কেন শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের প্রস্তাব পাস করানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান যেহেতু আলাদা রাষ্ট্র তাই পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে নামা মোটেই সম্ভব হবে না। কিন্তু এক পাকিস্তান হলে পূর্ব অঞ্চলে আক্রান্ত হলে পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধে নামতে বাধ্য এবং ভারত এটা বুঝবে বলে সহজে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করতে সাহস করবে না।
জিন্নাহ  সাহেব সিদ্ধান্ত ও ধারণা যে সঠিক ছিল পরবর্তী ঘটনা থেকে তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। বিভিন্ন অছিলায় ভারত যখন পর পর ( স্বাধীন রাষ্ট্র ) জুনাগড় , মান্ডাভার ও হায়দারাবাদ দখল করে নিল তখন পাকিস্তানের অসহায়ের মত শুধু তাকিয়েই রইল, কিছুই করতে পারলনা। এর পূর্বে কাশ্মীরেরও দুই তৃতীয়াংশ যখন দখল করে নিল পাকিস্তান যুদ্ধে নেমেও আজ পর্যন্ত তার কোন ফয়সালা করতে পারেনি । উপরোক্ত ঘটনা গুলোর প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে পরিষ্কার মনে হয় ১৯৪৬ সালে এক পাকিস্তান করার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন সেটা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানীদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই নিয়েছিলেন। এ সিদ্ধান্ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বার্থে নেয়া হয়নি । এখানে স্মরণযোগ্য ২৫ বছর পর যখন আমরা স্বাধীন হয়ে আলাদা হয়ে গেলাম তখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল । এ ২৫ বছরে আমরা প্রশাসন , পুলিশ ও অন্যান্য বিভাগ গড়ে তুলেছি। আমাদের সৈন্য বাহিনীও ততোদিনে গড়ে উঠেছে । তাই নতুন রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের কোন বেগ পেতে হয়নি ।
উপরোক্ত বিষয়গুলো একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায় পূর্বাঞ্চলের সম্ভাব্য ভবিষ্যত্ অবস্থার কথা চিন্তা করেই জিন্নাহ সাহেব states থেকে s বাদ দিয়ে state করেছিলেন আমাদের ভবিষ্যত্ মঙ্গল ও নিরাপত্তার জন্য , পশ্চিম পাকিস্তানের সুবিধার জন্য নয়।

বইয়ের ভূমিকা : ইতিহাসের আলোকে দেশবিভাগ ও কায়েদে আজম জিন্নাহ ।
 লেখক :: এম এ মোহাইমেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর ।

Monday 16 January 2017

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আগাগোড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।



রবীন্দ্রনাথ জম্মগত ভাবে মুসলিম বিদ্বেষী এবং বাংলাদেশের বিদ্বেষী হলেও এই রবীর লিখা এবং চুরি করা সুরের গাওয়া গান আমাদের জাতীয় সংগীত। খোদ ভারতের জাতীয় সংগীত নিয়েও আছে সাংঘাতিক রকমের জোচ্চুরি।

যাক আজকে এই জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে না লিখে বাংলাদেশের পাঠক যারা এখনো রবীদা বলতে অজ্ঞান তাদের জন্য ৪৩টি পতিতালয়ের মালিক রবীদার কিছু লিখার অংশ নিয়ে এলামঃ


১। মোতাহার হোসেন চৌধুরী শান্তি নিকেতনে কবিগরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার লেখায় ইসলাম ও বিশ্বনবী সম্পর্কে কোনো কথা লেখা নেই কেন? উত্তরে কবি বলেছিলেন, 'কোরআন পড়তে শুরু করেছিলুম কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি আর তোমাদের রসুলের জীবন চরিতও ভালো লাগেনি।
[ তথ্যসূত্র: বিতণ্ডা,লেখক সৈয়দ মুজিবুল্লা, পৃ -২২৯ ]"


২। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আগাগোড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। এজন্যই উগ্রহিন্দুরা তাকে জাতীয় কবি হিসেবে মেনে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় মারাঠা দুস্য শিবাজীর প্রসংশা করেছেন।
কবির ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নামক নাটকে প্রতাপাদিত্যের উক্তি- ‘খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।’
 এই দুস্য শিবাজী সম্পর্কে জানতে পড়ুন আমার এই পোস্ট - http://is.gd/LZrgeL

৩।  বঙ্গভঙ্গ হলে আসাম ও বাংলার রাজধানী হবে ঢাকা। আর ঐ বঙ্গে মুসলমানরা হবে সংখ্যাগুরু এবং হিন্দুরা হবে সংখ্যালঘু। তাই নবাব সলিমুল্লাহ’র নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের এবং ভারতের বহু মুসলিম নেতাই বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করলেন। কিন্তু হিন্দু নেতা ও বুদ্ধিজীবিরা একত্রে আন্দোলন শুরু করে এই কবিগরূর নেতৃত্বেই।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ১৯০৫ সালের ২৪ ও ২৭শে সেপ্টেম্বর দুটো সমাবেশের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং ১৬ই অক্টোরব ‘রাখীবন্ধন’ নামক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য হিন্দুদের কি স্বার্থ ছিলো ??? এর উত্তরে বিমলানন্দ শাসমল ‘ভারত কী করে ভাগ হলো’ নামক বইয়ে লিখেছে-
“ডঃ আম্বেদকর লিখেছেন: বাঙালী হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধীতা করার প্রধান কারণ ছিলো, পূর্ববঙ্গে বাঙালী মুসলমানরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে”
[সূত্র: বই-‘ভারত কী করে ভাগ হলো’, পৃ:২৫; এ এক অন্য ইতিহাস-১৫৮]



৪।  রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ বিরোধীতার মূল কারণ ছিলো এ অঞ্চলে ছিলো তার বেশিরভাগ জমিদারি। বঙ্গভঙ্গ হলে ঠাকুর পরিবারে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। যেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সে। এ অঞ্চলের মানুষের রক্তচুষে খেয়ে বেচে থাকতো ঠাকুরপরিবারের মত জমিদাররা। তারা নানান ছুঁতোয় প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করতেন।

যেমন:
- গরুর গাড়ি করে মাল নিলে ধূলো উড়তো, তখন ‘ধূলট’ নামক কর দিতে হতো।
- প্রজারা নিজের যায়গায় গাছ লাগলেও এক প্রকার কর দিয়ে গাছ লাগাতে হতো। সেই করের নাম ‘চৌথ'।
- প্রজাদের গরু-মহিষ মরে গেলে ভাগাড়ে ফেলতে হলে কর দিতে হতো। তার নাম ‘ভাগাড় কর’। - নৌকায় মাল উঠালে বা নামালে দিতে হতো ‘কয়ালী’ নামক কর।
- ঘাটে নৌকা ভিড়লে যে কর দিতে হতো তার নাম ‘খোটাগাড়ি কর" ।
- জমিদার সাথে দেখা করলে দিতে হতো ‘নজরানা’।
- জমিদার কখন জেলে গেলে তাকে ছাড়িয়ে আনতে উল্টো প্রজাদের দিতে হতো ‘গারদ সেলামি’।
[সূত্র: বই-গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, লেখক: স্বপন বসু]



৫। রবীন্দ্রনাথের জমিদারি সম্পর্কে অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন:
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। তার দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর জবরদস্তি করে আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোল্লার নেতৃত্বে শিলাইদহে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিলো।
[সূত্র: জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ ১৪৮২ শারদীয় সংখ্যা, অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী]



 ৬। চারিদিকে নিষ্ঠুরতা ও দুর্নামের প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূল করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাইভেট সেক্রেটারী অমিয় চক্রবর্তী একবার বিশাল জমিদারীর একটি ক্ষুদ্র অংশ দরিদ্র প্রজাসাধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেনঠাকুরমশাই ইজিচেয়ারে আধাশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বলেছিলেন, “বল কিহে অমিয়। আমার রথীন (কবির একমাত্র পুত্রের নাম) তাহলে খাবে কী?
[সুত্র: অন্নদাশঙ্কর রায়ের রচনা থেকে উদ্ধৃত পুস্তকরবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা: আবু জাফর]


৭। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, “জমিদার হিসেবে ঠাকুর পরিবার ছিল অত্যাচারী। গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলবুট পরে প্রজাকে লাথি মেরেছেনপায়ে দলেছেন দেবেন ঠাকুর। এটাই রেকর্ড করেছিল হরিনাথ মজুমদার। যিনি মহর্ষি বলে পরিচিততিনি একইরকমভাবে মানুষকে পদাঘাতে দলিত করেন। গ্রাম জ্বালাবার কথাও আছে। আবুল আহসান চৌধুরীর কাছে এর সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। সমগ্র ঠাকুর পরিবার কখনো প্রজার কোন উপকার করে নাই। স্কুল করা,দীঘি কাটানো এসব কখনো করে নাই। মুসলমান প্রজাদের টিট করার জন্য নমশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই এসেছিলকাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার গ্রাম্যবার্তা প্রকাশিকাপত্রিকায় ঠাকুর পরিবারের প্রজাপীড়নের কথা লিখে ঠাকুর পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন” 
[সুত্রঃ দৈনিক বাংলাবাজার১৪.০৪.১৯৯৭ এবং ১.৫.১৯৯৭ সংখ্যা]



৮। জমিদারদের বড়দেবতা হলো অর্থ আর স্বার্থ। অর্থ আর স্বার্থলাভ করতে ঠাকুর পরিবারের জমিদার হিসেবে দুর্নামের কালো দিক আড়াল করে রাখলেও প্রকৃত ইতিহাসের পাতা থেকে তা মোছা যাবে না। ঠাকুর পরিবারের এই মহর্ষি জমিদারদের প্রতি কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন, “ধর্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্যশরীরে পাদুকাপ্রহারএকথা আর গোপন করিতে পারি না
[সুত্রঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়, প্রাক বৃটিশ ভারতীয় সমাজপৃষ্ঠা ১২৭১৯৮৮]

৯। সিরাজগঞ্জে প্রজা নির্যাতনের দলিলও ইতিহাসে পাওয়া যায়। এর প্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বদলির আদেশ হয়েছিল এবং যে যে জমিদার উপরের আবরণের গুণে তপস্বী বলিয়া গভর্নমেন্টে পরিচিত ছিলেনতাহারা যে বিড়াল তপস্বী তা প্রমাণিত হয়েছিল। এসবের ফলশ্রুতিতে হরিনাথকে ঐ জমিদারের বিষনজনে পড়তে হয়েছিল” 
[ সুত্রঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়প্রাক বৃটিশ ভারতীয় সমাজপৃ ১২৮]
১০।  রবীন্দ্রনাথ তার ‘কণ্ঠরোধ’ নামক প্রবন্ধে বলে, "কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রন্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে- উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষ রূপে ইংরেজদেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে- ইটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ (মুসলমান) ইটটি মারিয়া পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল।"
[সুত্রঃ ভারতী, বৈশাখ-১৩০৫]

১২। বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখেছে, "মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা। 
[তথ্যসূত্র: ভারতী পত্রিকা, একশ বছরের রাজনীতি, লেখক,আবুল আসাদ]

  


১৩। রবীন্দ্রনাথ কী রকম ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী ছিল, তা একটা প্রমাণেই বুঝা যাবে। তার ‘রীতিমত নভেল’ নামক ছোটগল্পে সে লিখেছে -
@ আল্লাহো আকবর শব্দে বনভূমি প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। 
একদিকে তিন লক্ষ যবন (মুসলিম) সেনা অন্য দিকে তিন সহস্র আর্য (হিন্দু) সৈন্য। 
... পাঠক, বলিতে পার ... কাহার বজ্রমতি ‘হর হর বোম বোম’ শব্দে
তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ কণ্ঠের ‘আল্লাহো আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হয়ে গেলো। 
ইনিই সেই ললিতসিংহ। কাঞ্চীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধ্রুব নক্ষত্র। @

শুধু ‘রীতিমত নভেল’ই নয়। রবীন্দ্রনাথ তার ‘সমস্যাপুরণ’, ‘দুরাশা’ ও ‘কাবুলীওয়ালা’ গল্পে মুসলমানদের জারজ, চোর, খুনি ও অবৈধ সম্পর্ক কারী হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যেখানে সে নিজেই ছিল পতিতালয়ের মালিক !! 
তাছাড়া ‘সমস্যাপুরণ’ গল্পে দেখিয়েছে, মুসলিম নারীর গর্ভে পিতা কৃষ্ণগোপালের ঔরষে জন্ম নেয়া ভাইয়ের পরিচয় পিতার মুখ থেকে শুনে ছেলে বিপিনচন্দ্র বিস্ময়ে উচ্চারণ করে ‘যবনীর গর্ভে?’ কৃষ্ণগোপাল বলে, ‘হ্যাঁ বাপু।’
মুসলিমরা আজ ইতিহাস নিয়ে না পড়ালেখা করার কারণে তাদের যা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তাই  তারা গিলে খাচ্ছে, কিন্তু একটু যাচাই করার দরকার ও তারা করে না। করলে তারা কবেই এই রবীগরুকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করত। 

তবি রবী গরুকে তাদের ভালো না লেগে উপায় নেই যারা পতিতালয় এবং নিজের বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে লুচ্চামি করতে পারে। 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ইসলাম বিরোধী যত কর্ম কান্ড আছে, তাঁর পুরোধা এই রবীন্দ্রনাথ ! হালের রাস্ট্রধর্ম মামলার ১৫ জন বাদীই ছিল খাঁটি রবীন্দ্র পুজারী। এছাড়া আমি দেখেছি যারাই মাদ্রাসাকে জঙ্গীবাদের আখড়া বলেছে তারা প্রত্যেকেই একেকজন রবীন্দ্র পুজারী।

পরিশেষে রবি গরুর বাংলাদেশীদের প্রতি মুগ্ধতা দেখিয়ে তার একটা মহান (!) বানী দিয়ে শেষ করব !

“ সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙ্গালী করে মানুষ করনি” ।

সুতরাং আমরা বা আপনারা কবি গরুর চোখে মানুষ নই। 
ধন্যবাদ , ধন্যবাদ সবাইকে !http://www.animeshraiarko.com/2016/05/blog-post_5.html?m=1

ইসলাম ও বাংলার মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের অগ্রদূত রবীন্দ্রনাথ ।


উগ্র সাম্প্রদায়িকতায় রবীন্দ্রনাথ ছিলো শীর্ষে, সে শুধু নিজেই মুসলিম বিদ্বেষী ছিলো না, উপরন্তু কথিত সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে সে হিন্দুদের চরমশ্রেণীর মুসলিম বিদ্বেষী হতে সাহায্য করতো। তাই বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পেছনে এই রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব কম নয়।
রবীন্দ্রনাথের এই অতি সাম্প্রদায়িকতার দলিল তার রচনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান। আসুন রবীন্দ্রনাথের ইসলাম বিদ্বেষী সাহিত্যের কিছু নমুনা দেখি:

(১)
রবীন্দ্রনাথ তার ‘রীতিমত নভেল’ নামক ছোটগল্পে মুসলিম চরিত্র হরণ করেছে এভাবে-
“আল্লাহো আকবর শব্দে বনভূমি প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে।
একদিকে তিন লক্ষ যবন (অসভ্য) সেনা অন্য দিকে তিন সহস্র আর্য সৈন্য।
... পাঠক, বলিতে পার ...
কাহার বজ্রমন্ডিত ‘হর হর বোম বোম’ শব্দে
তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ (অপবিত্র) কণ্ঠের ‘আল্লাহো আকবর’ ধ্বনি
নিমগ্ন হয়ে গেলো।
ইনিই সেই ললিতসিংহ।
কাঞ্চীর সেনাপতি।
ভারত-ইতিহাসের ধ্রুব নক্ষত্র।”

(২)
রবীন্দ্রনাথ তার ‘সমস্যা’ ‘পুরান’, ‘দুরাশা’ ও ‘কাবুলীওয়ালা’ গল্পে মুসলমানদের জারজ, চোর, খুনি ও অবৈধ প্রণয় আকাঙ্খিণী হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
বিশেষ করে ‘দুরাশা’ গল্পের কাহিনীটি আরো স্পর্শকাতর। এখানে দেখানো হয়েছে, একজন মুসলিম নারীর হিন্দু ধর্ম তথা ব্রাহ্মণদের প্রতি কি দুর্নিবার আকর্ষণ এবং এই মুসলিম নারীর ব্রাহ্মণ হবার প্রাণান্তকর কোশেশের চিত্র।

(৩)
রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তি যে ভারতবর্ষব্যাপী শুধুমাত্র হিন্দুদের নিয়ে একক ও ঐক্যবদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা পোষণ করতো। মহারাষ্ট্রের ‘বালগঙ্গাধর তিলক’ ১৮৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল ‘শিবাজী উৎসব’ প্রতিষ্ঠা করেছিল উগ্র হিন্দু জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার ও প্রসারের জন্য।

‘সঞ্চয়িতা’ কাব্যগ্রন্থে ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এ আকাঙ্খা করে বলে-
“এক ধর্ম কাব্য খ-ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি .......
........ ‘এক ধর্ম রাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন করিব সম্বল।”

‘শিবাজী-উৎসব’ নামক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছে শিবাজী চেয়েছে হিন্দুত্বের ভিত্তিতে ভারতজুড়ে এক ধর্ম রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাঙালিরা সেটা বোঝেনি। না বুঝে করেছে ভুল।

(৪)
মুসলমান সমাজের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় ‘কণ্ঠরোধ’ (ভারতী, বৈশাখ-১৩০৫) নামক প্রবন্ধে। সিডিশন বিল পাস হওয়ার পূর্বদিনে কলকাতা টাউন হলে এই প্রবন্ধটি সে পাঠ করে। এই প্রবন্ধে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী রবীন্দ্রনাথ একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলে-
“কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রন্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে- উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষরূপে ইংরেজদেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে- ইটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ (মুসলমান) ইটটি মারিয়া পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল। অপরাধ করিল, দ- পাইল; কিন্তু ব্যাপারটি কি আজ পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝা গেল না।
এই নিম্নশ্রেণীর মুসলমানগণ সংবাদপত্র পড়েও না, সংবাদপত্রে লেখেও না। একটা ছোট বড়ো কা- হইয়া গেল অথচ এই মূঢ় (মুসলমান) নির্বাক প্রজা সম্প্রদায়ের মনের কথা কিছুই বোঝা গেল না। ব্যাপারটি রহস্যাবৃত রহিল বলিয়াই সাধারণের নিকট তাহার একটা অযথা এবং কৃত্রিম গৌরব জন্মিল। কৌতুহলী কল্পনা হ্যারিসন রোডের প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া তুরস্কের অর্ধচন্দ্র শিখরী রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সম্ভব ও অসম্ভব অনুমানকে শাখা পল্লবায়িত করিয়া চলিল।
ব্যাপারটি রহস্যাবৃত রহিল বলিয়াই আতঙ্কচকিত ইংরেজি কাগজ কেহ বলিল, ইহা কংগ্রেসের সহিত যোগবদ্ধ রাষ্ট্র বিপ্লবের সূচনা; কেহ বলিল মুসলমানদের বস্তিগুলো একেবারে উড়াইয়া পুড়াইয়া দেয়া যাক, কেহ বলিল এমন নিদারুণ বিপৎপাতের সময় তুহিনাবৃত শৈলশিখরের উপর বড়লাট সাহেবের এতটা সুশীতল হইয়া বসিয়া থাকা উচিত হয় না।”
এই প্রবন্ধে উল্লিখিত বক্তব্যের পাশাপাশি শব্দ প্রয়োগ লক্ষ্য করলে মুসলমান সমাজের প্রতি উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির একটা সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে বলা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথের পরিবারের জমিদারী ছিল পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া, শিলাইদহ, পাবনার শাহজাদপুর, রাজশাহী প্রভৃতি অঞ্চলে। আর এইসব অঞ্চল ছিল মুসলমান প্রধান। এই উন্মাসিক মানসিকতা ও বক্তব্য তার জমিদারীতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমানদের প্রতি উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির একটা উজ্জ্বল উদাহরণ।

(৫)
‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে প্রতাপাদিত্যের উক্তি- খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মুসলিম বিদ্বেষ এবং বিরোধিতার অবস্থান চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। এখানেও সে সাম্প্রদায়িক ভূমিকায় অবতীর্ণ। তার নাটকের এই বক্তব্য হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটায় এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভূমি তৈরি করে দেয়। তাই ঐতিহাসিকভাবে বলা হয়- বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে শুরু হওয়া হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার দায়ভার রবীন্দ্রনাথ কোনো ক্রমেই এড়াতে পারে না।

(৬)
রবীন্দ্রনাথের উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীর অন্যতম দলিল তার শিবাজী উৎসব কবিতা ।
এই কবিতা এবং ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মুসলিম বিরোধিতার অবস্থানটি চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতের ইতিহাসে বিশেষত মুঘল ভারতের ইতিহাসে হিন্দুত্ববাদী শিবাজী একজন ধূর্ত, শঠ, বিশ্বাস ভঙ্গকারী, চতুর সন্ত্রাসী মারাঠা আঞ্চলিক নেতা হিসাবে কুখ্যাত। তার সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালিত হয়েছিল ন্যায়পরায়ণ মুঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেব বিরুদ্ধে।
উনিশ শতকের বাংলা পুনরুত্থানপন্থীরা শিবাজীকে ভারতের বীর হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। এমনকি আঠারো শতকের বাংলার জনজীবন মারাঠা দস্যুদের পুনঃপুনঃ আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
তাদের লুটপাট, হত্যা, রাহাজানি, আর আক্রমণের কবল থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে রক্ষার জন্য নবাব আলীবর্দী খান প্রাণপণ লড়াই করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদী মারাঠারা এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো। বাংলার পশ্চিমাঞ্চল, বিহার ও উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিরাণভুমিতে পরিণত করেছিল মারাঠারা।

বাংলায় মারাঠা বর্গীদের এই হামলার প্রামাণ্য চিত্র উপস্থাপন করেছে কবি গঙ্গারাম। তার লেখা পুঁথির নাম ‘মহারাষ্ট্র পূরাণ’। পুঁথিটি ঘটনার সমসাময়িককালে অর্থাৎ ১৭৫১ সালে রচিত। এই পুঁথিটি আবিষ্কৃত হয়েছে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা থেকে।
ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্যে এটা স্বীকৃত যে পলাশী পূর্ববর্তী সুবে বাংলার অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল হিন্দুত্ববাদী মারাঠা দস্যুদের সন্ত্রাসী হামলা, লুণ্ঠন, হত্যা ও আক্রমণে।
নবাব আলীবর্দী খান মারাঠা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে তার শাসনামলের প্রায় পুরো সময়কালটি ব্যাপৃত থাকেন।
উনিশ শতকের কথিত হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী উল্টো সন্ত্রাসী মারাঠাদের আক্রমণ, লুটপাট আর কর্মকা-কে মুসলিম বিরোধী অভিহিত করে হিন্দুদের কথিত গৌরব হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। প্রধানত এই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলার হিন্দু সমাজ বিজাতীয় মারাঠাদের গুণকীর্তন আর বন্দনা শুরু করে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী রবীন্দ্রনাথ ছিলো এই ধারারই শক্তিশালী প্রবক্তা।

রবীন্দ্রনাথকে তাই উগ্রহিন্দুত্ববাদী লুটেরা শিবাজীকে হিরো রূপে পেশ করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “শিবাজী উৎসব” কবিতায় শিবাজীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে লিখেছে,
“হে রাজ-তপস্বী বীর, তোমার সে উদার ভাবনা
বিধর ভা-ারে
সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা
পারে হরিবারে?
তোমার সে প্রাণোৎসর্গ, স্বদেশ-লক্ষ্মীর পূজাঘরে
সে সত্য সাধন,
কে জানিত, হয়ে গেছে চির যুগ-যুগান্তর ওরে
ভারতের ধন।”

ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে লিখেছেঃ “হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও স্বজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনই এর উপস্থিতি স্বীকার করবে না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ভারতের রবীন্দ্রনাথ যাঁর পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবিকতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তার কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে, কোনও মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনও একচ্ছত্রও লেখেননি। যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছেন। এ থেকেএ প্রমাণিত হয় উনিশ শতকী বাংলার জাতীয়তা জ্ঞানের উৎসমূল কোথায় ছিল।” (সূত্রঃ Dr. Romesh Chandra Majumder, History of Bengal, p 203.)

(৭)
ভারতে সতিদাহ প্রথাকে আইন করে বিলুপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার। বিধবা হিন্দু রমনীদের বাঁচানো নিয়ে কবিতা বা প্রবন্ধ না লিখলেও রবীন্দ্রনাথের নজর পরে তাদের গো’ দেবতা বাঁচানোর দিকে। তখন সে গো’ দেবতা বাঁচানোর মিশন নিয়ে ময়দানে নামে শিবাজীর অন্ধভক্ত মহারাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক নেতা ‘বালগঙ্গাধর তিলক’। সে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করে “গোরক্ষিণী সভা”। গরু বাঁচাতে গিয়ে তখন ভারত জুড়ে শুরু হয় মুসলিম হত্যা। রবীন্দ্রনাথ, তিলকের এ মিশনে একাত্ম হয় এবং তার জমিদারী এলাকায় গরু কোরবানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই হল, হিন্দু বাঙালী রবীন্দ্রনাথের রেনেসাঁ চেতনা।
ঐতিহাসিক নীরদ চৌধুরী তাই লিখেছে, “রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই জীবনব্যাপী সাধনা করেছে একটি মাত্র সমন্বয় সাধনের, আর সে সমন্বয়টি হিন্দু ও ইউরোপীয় চিন্তাধারার। ইসলামী ভাবধারা ও ট্রাডিশন তাঁদের চেতনাবৃত্তকে কখনও স্পর্শ করেনি। -(সূত্র, Nirod Chandra Chowdhury, Autobiography of an Unknown Indian, p 196.)

(৮)
রবীন্দ্র-সাহিত্যের মধ্যে যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু মানস সেটি মুসলমানদের কাছে স্বভাবতই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সেটিকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য পরিকল্পিতভাবে সুগারকোট লাগানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে এই বলে যে রবীন্দ্রনাথ ছিলো অসাম্প্রদায়িক। বলা হচ্ছে সে উভয় বাংলার কবি, সে বিশ্বকবি ইত্যাদি বহুকিছু।
প্রশ্ন হল, রবীন্দ্রনাথ যে জন্মভূমির স্বপ্ন দেখতো বা কথা বলতো সেটি কি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের? যে চেতনা ও যে ধর্মবিশ্বাসের কথা বলতো সেটিও কি উভয়ের?
অস্পৃশ্য রবীন্দ্রনাথ তার ‘জন্মভূমি’ প্রবন্ধে যে জন্মভূমির কথা আলোচনা করেছে সেখানে আছে মায়ের পূজা, মায়ের প্রতিষ্ঠা, আছে অধিষ্ঠাত্রী দেবী ও ভারতীয় ভারতীয় বীণাধ্বনি। সে যে মনে প্রাণে মূর্তিপূজারী হিন্দু ছিলো তার পরিচয় রেখেছে তার পূজারিনী কবিতায়। সেখানে লিখেছে,
“বেদব্রাহ্মণ-রাজা ছাড়া আর কিছু
কিছু নাই ভবে পূজা করিবার।”

(৯)
তার ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসে সে প্রতাব চরিত্রের মুখ দিয়ে ম্লেচ্ছদের (অপবিত্র মুসলমানদের) দূর করে আর্য ধর্মকে রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত করার সংকল্প করে। ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরার মুখ দিয়ে ইসলাম বিরোধী জঘন্য উক্তি করিয়েছে। ‘সমস্যাপূরণ’ গল্পে অছিমদ্দিনকে হিন্দু জমিদারের জারজ সন্তান বানিয়েছে।
রবীন্দ্র-মানস বা রবীন্দ্র চেতনা কতটুকু মুসলিম বিদ্বেষী ছিলো সে রবীন্দ্র-চেতনার পরিচয় তুলে ধরেছে আবুল মনসুর আহমদ। সে লিখেছে, “হাজার বছর মুসলমানরা হিন্দুর সাথে একদেশে একত্রে বাস করিয়াছে। হিন্দুদের রাজা হিসেবেও, প্রজা হিসেবেও। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক ঐক্য হয় নাই। হয় নাই এই জন্য যে, হিন্দুরা চাহিত ‘আর্য-অনার্য, শক, হুন’ যেভাবে ‘মহাভারতের সাগর তীরে’ লীন হইয়াছিল মুসলমানেরাও তেমনি মহান হিন্দু সমাজে লীন হইয়া যাউক। তাদের শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, হিন্দু মুসলমান’ হইতে হইবে। এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দু সভার জনতার মত ছিল না, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মত ছিল। -(সূত্র: আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা ১৫৮-১৫৯।

(১০)
‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ (রচনাকাল বাংলা ১৩০০ সাল) এবং ‘সুবিচারের অধিকার’ (রচনাকাল বাংলা ১৩০১ সাল) নামক প্রবন্ধ দুটিতে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলিম সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেছে। এখানেও মুসলিম বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসেনি রবীন্দ্রনাথ। সুবিচারের অধিকার (রচনাকাল বাংলা ১৩০১ সাল) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ইংরাজ সরকারকে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্য অভিযোগ করে বলে:
অনেক হিন্দুর বিশ্বাস, বিরোধ মিটাইয়া দেয়া গভর্মেন্টের আন্তরিক অভিপ্রায় নহে। পাচ্ছে কংগ্রেস প্রভৃতির চেষ্টায় হিন্দু মুসলমানগণ ক্রমশ ঐক্যপথে অগ্রসর হয় এই জন্য তারা উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মবিদ্বেষ জাগাইয়া রাখতে চায় এবং মুসলমানদের দ্বারা হিন্দুরা দর্প পূর্ণ করিয়া মুসলমানকে সন্তুষ্ট ও হিন্দুকে অভিভূত করিতে ইচ্ছা করে। সর্বদাই দেখতে পাই দুই পক্ষে যখন বিরোধ ঘটে এবং শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা উপস্থিত হয় তখন ম্যাজিস্ট্রেট সূক্ষ্মবিচারের দিকে না গিয়ে উভয়পক্ষকেই সমানভাবে দমন করিয়া রাখিতে চেষ্টা করে। কারণ সাধারণ নিয়ম এই যে এক হাতে শব্দ হয় না।
কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিরোধে সাধারণের বিশ্বাস দৃঢ়বদ্ধমূল হইয়াছে যে দমনটা অধিকাংশ হিন্দুর উপর দিয়া চলিতেছে এবং প্রশ্রয়টা অধিকাংশ মুসলমানেরাই লাভ করিতেছে। এরূপ বিশ্বাস জন্মিয়া যাওয়াতে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈর্ষানল আরো অধিক করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে এবং যেখানে কোনোকালে বিরোধ ঘটে নাই সেখানেও কর্তৃপক্ষ আগেভাগে অমূলক আশঙ্কার অবতারণা করিয়া একপক্ষের চিরাগত অধিকার কাড়িয়া লওয়াতে অন্যপক্ষের সাহস ও স্পর্ধা বাড়িতেছে এবং চির বিরোধের বীজ বপন করা হইতেছে। কেবল রাগাদ্বেষের দ্বারা পক্ষপাত এবং অবিচার ঘটিতে পারে তাহা নহে, ভয়েতে করিয়াও ন্যায়পরায়ণতার নিক্তির কাঁটা অনেকটা পরিমাণে কম্পিত বিচলিত হইয়া উঠে। আমাদের এমন সন্দেহ হয় যে ইংরাজ মুসলমানকে মনে মনে কিছু ভয় করিয়া থাকেন। এই জন্য রাজদন্ডটা মুসলমানের পা ঘেঁষিয়া ঠিক হিন্দুর মাথার উপরে কিছু জোরের সহিত পড়িতেছে।”
যদিও মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের মনোভাব সবসময়ই ছিলো বৈষম্যমূলক ও দমন-নিপীড়নের উপর নির্ভরশীল তারপরও ঊনিশ শতকের শেষ দশকে দাঁড়িয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধে দেখা যায় মুসলিম সমাজের প্রতি ইংরেজদের কথিত সমানাধিকার প্রদান বা কথিত ন্যায় বিচার করাও রবীন্দ্রনাথের বরদাশতের বাইরে ছিলো । এ প্রবন্ধে তার বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির একটি স্পষ্ট অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। অথচ এটা অবশ্যই স্মরণীয় যে ঊনিশ শতকের হিন্দু জমিদার, মহাজন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সকলেই ছিল ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের পদলেহী দালাল।

(১১)
সারা ঊনিশ শতকে ব্রিটিশরা সহায়তা করেছে বাংলার হিন্দু সমাজকে। তবে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে নওয়াব আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩), সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) প্রমুখরা বাঙালি মুসলমান সমাজকে ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্ঠা চালায়।
বাঙালি মুসলমান সমাজের সাথে ব্রিটিশ শক্তির গড়ে উঠা এই সম্পর্ককে যবন রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেনি। অথচ রবীন্দ্রনাথের ‘ঠাকুর পরিবার’ ব্রিটিশ শক্তির প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে, আনুকূল্যে সাধারণ অবস্থা থেকে জমিদার পরিবারে উন্নীত হয়। অন্যান্য হিন্দু জমিদারদের বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। বলা যায় হিন্দু জমিদার শ্রেণীর পুরোটাই ছিল ব্রিটিশের দালাল। অথচ পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের কৌশলগত অনুকূল অবস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিল বিক্ষুব্ধ। এখানে সে একদিকে তার শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা, স্বার্থের সংঘাত এবং অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক মনোভাব দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
ঊনিশ শতকের শেষ দশকে লেখা পাঁচটি গল্পে রবীন্দ্রনাথ মুসলিম প্রসঙ্গে অবতারণা করেছে। এগুলো হলো ডালিয়া (১৮৯১), রীতিমত নভেল (১৮৯২), কাবুলিওয়ালা (১৮৯২), সমস্যা পূরণ (১৮৯৩) এবং ক্ষুধিত পাষাণ (১৮৯৫)।

(১২)
বাংলা ১৩০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কিত তিনটি গ্রন্থ সমালোচনা করে। এই তিনটি গ্রন্থ হলো আবদুল করিম বিএ রচিত ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত (সমালোচনা প্রকাশ ভারতীয়, শ্রাবণ-১৩০৫, নিখিল নাথ রায়ের মুর্শিদাবাদ কাহিনী, (সমালোচনা প্রকাশ ভারতীয়, শ্রাবণ ১৩০৫), নিখিল নাথ রায়ের মুর্শিদাবাদ কাহিনী (সমালোচনা প্রকাশ ভারতয় শ্রাবণ-১৩০৫) অক্ষয়কুমার মৈত্রের লিখিত সিরাজদ্দৌলা (সমালোচনা প্রকাশ ভারতীয়, জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫ এবং (শ্রাবণ ১৩০৫)। হেমলতা দেবী প্রণীত গ্রন্থ ভারতবর্ষের ইতিহাস রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করে বাংলা ১৩০৫ সালের ভারতীয় পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়।
এই গ্রন্থ সমালোচনার অনুষঙ্গে ভারতে মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। লেখিকা হেমলতা রচিত গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলে, যে মোঘল রাজত্বের পূর্বে তিনশত বছরব্যাপী কালরাত্রে ভারত সিংহাসনে দাস বংশ থেকে লোদী বংশ পর্যন্ত পাঠান রাজন্যবর্গের যে রক্তবর্ণ উল্কা বৃষ্টি হয়েছে গ্রন্থে তার একটা বিবরণ থাকলে ভাল হতো।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানী শাসনামলকে রবীন্দ্রনাথ ভারত ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসের সুলতানী যুগের সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী সময়কালকে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত রবীন্দ্রনাথের এই প্রয়াস অনৈতিক, সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষপ্রসূত।
অথচ সুলতানী আমলে ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুল উন্নতি সাধিত হয়। এই সময়কালে ভারতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক শাসন কাঠামো গড়ে উঠে। শিক্ষা ও শিল্পকলায় নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটে। বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ ব্রাহ্মণদের সামাজিক অত্যাচার ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ ব্রাহ্মণদের সামাজিক অত্যাচার থেকে রেহাই পায়।

http://www.somewhereinblog.net/blog/sayeed_ovi/29936142

Friday 13 January 2017

বড় পর্দায় সুলতান সুলেমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস। সূফি বরষণ

বড় পর্দায় সুলতান সুলেমান ও  অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস।

সূফি বরষণ
অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বহু ধর্ম, বর্ণ এবং বহু ভাষার। এই দিকে থেকে ইউরোপীয়ান স্কলাররাও একমত যে অটোমান জোড় পূর্বক কাউকে ধর্মান্তরিত করে নাই। কিন্তু বিধর্মীরা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য বিবেচিত হতো না এবং তাদের নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। ইউরোপীয়ান স্কলাররা এই দিকটাকে উল্লেখ করে থাকে ধর্মান্তরিত না করার কারন হিসেবে!১২৯৯ সালে অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রথম উসমান উত্তরপশ্চিম আনাতোলিয়ায় এই সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।

সুলতান সুলেমান ১৪৯৪ সালের ৬ নভেম্বর জনগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম আয়েশা হাফসা সুলতান; যিনি চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন বলে জানা যায়। সাত বছর বয়সে তিনি তোপকাপি প্রাসাদের স্কুলে বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য থিওলজি এং সামরিক বিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। শিল্পবিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই অটোমানের দুর্দিন শুরু হয়। নব্য সংগঠিত ও সমৃদ্ধের পথযাত্রী খ্রিস্টান ইউরোপীয়ানদের জন্য অটোমান ছিল চ্যালেঞ্জ। অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী খ্রিস্টানরা খুব দ্রুত রেঁনেসা পরবর্তী ইউরোপের শিল্প ও জ্ঞান সমৃদ্ধির পথে নিজেদের যুক্ত করে ফেলে।

ইতিহাসের প্রতি আগ্রহের কারণেই ভগবান এস গিদওয়ানির ‘সোর্ড অব টিপু সুলতান’ এখনো উপমহাদেশের সব ধর্মের মানুষকে নাড়া দেয়। নির্মাণশৈলীর কারণে ইতিহাসের প্রকৃত মহিশুরের হায়দার আলীর পুত্র টিপু সুলতান আর সোর্ড অব টিপু সুলতানের মধ্যে কিছু ফারাক সহজেই বোধগম্য। তবে গিদওয়ানি ইতিহাস বিকৃতির দায় নিতে চাননি। এই ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকে রচিত উপন্যাস বা সিরিয়ালে দেখা যায় ইতিহাস বিকৃতির ছড়াছড়ি । তাই শিল্পসৌন্দর্য রচনা ইতিহাসের সত্যকে আড়ালে করতে পারেনি । বাংলাদেশের মানুষ পলাশী ও নবাব সিরাজউদ্দৌলাহকে ইতিহাস পড়ে জানেনি।

খান আতার কালজয়ী সিনেমা দেখে চিনেছে ও জেনেছে। খান আতা ইতিহাসকে আশ্রয় করে শিল্পের আবেগকে সুনিপুণ হাতে কাজে লাগিয়েছেন। ইতিহাস সত্যের সাথে শিল্পের সৌন্দর্য একাকার করে নতুন এক সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। দস্যু বাহরাম, বনহুর প্রমুখ লেখক-কল্পনার বহিঃপ্রকাশ, রবিনহুড সার্বিক অর্থে তা নয়। ইতিহাস-আশ্রয়ী নাটক সিনেমা দর্শক প্রিয়তা পাওয়ার কারণও ইতিহাস প্রীতি। তাই বলা চলে ইতিহাসভিত্তিক সিনেমাগুলো দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছে। ইতিহাসের প্রতি মানুষের সহজাত মোহ অথবা পেছনে তাকাবার দায়বদ্ধতার এটাও একটা নজির। ইতোমধ্যে বিশ্বের সেরা মহানায়কদের নিয়ে সিনেমা নির্মাণের প্রচুর কাজ হয়েছে। ধর্মীয় নেতা, বিদ্রোহী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও ব্যতিক্রমী চরিত্রের প্রভাবক মানুষগুলোও এ তালিকা থেকে বাদ পড়েননি। আমাদের দেশে ফকির মজনু শাহ, শহীদ তিতুমীর একমাত্র উপমা নয়, গান্ধী থেকে ম্যান্ডেলা, আদম-ইভ থেকে মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্র কিংবা ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে।

দি মেসেজ ও মেসেঞ্জার ছাড়াও রয়েছে অনেক দৃষ্টান্ত।  এরই ধারাবাহিকতায় অটোমান বা উসমানিয়া খিলাফত সাম্রাজ্যের অন্যতম দিকপাল মহান সুলতান সুলেমানকে নিয়েও কাজ হয়েছে। আরবের স্বাধীনতাকামী নেতা ওমর মোখতার নিয়ে যে সিনেমা তৈরি হয়েছে, তা স্বাধীনতাকামী যেকোনো মানুষকে আলোড়িত করে। তবে সিনেমা তৈরির সময় রচনাকারী, প্রযোজক, পরিচালক ভুলে যান না এর মধ্যে বিনোদন এবং কাহিনী কাব্যের রসদ না দিলে দর্শক টানবে না। মেরাল ওকেয় রচিত সুলতান সুলেমান নির্মাণের সময় ইয়ামুর তাইলানরা সেই বাস্তবতাটি ভুলে যাননি।

বিনোদন উপস্থাপন করতে গিয়ে শাসক সুলতান সুলেমানকে কিছুটা আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হেরেমের কূটকচাল, দাস-দাসীদের দৈনন্দিন জীবনাচার এবং সুলতানাদের স্নায়ুযুদ্ধ বিনোদন জোগান দেয়ার স্বার্থে প্রাধান্য পেয়ে গেছে। হেরেমের ড্রেস কোড খোলামেলাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সিরিজজুড়ে অন্দরমহলের প্রাধান্যের কারণে একজন সুশাসক, তুখোড় কূটনীতিক ও বিচক্ষণ সুলতানের পরিচিতি তুলনামূলক কম গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। সিরিজগুলো ‘আকর্ষণীয়’ ও আদিরসাত্মক করার জন্য যত গোঁজামিলই দেয়া হোক, কোনো জননন্দিত সুশাসক রমণীকাতর কামিনীবল্লভ হন না। এ ব্যাপারে সুলতান সুলেমানও ইতিহাসের কাছে অভিযুক্ত নন।

সম্প্রতি সুলতান সুলেমানের ওপর নির্মিত আলোচিত-সমালোচিত কাহিনী নাটকটি একটি বেসরকারি চ্যানেল দেখাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত সিরিজ প্রদর্শিতও হয়ে গেছে। সিরিয়ালের আরেক নায়ক ইব্রাহীম পাশাকে নির্মম ভাবে হত্যার পর অনেক ফেইস বুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে । এই প্রজন্মের কাছে ইতিহাসখ্যাত সুলতান সুলাইমান বা সুলেমান ও অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস আকর্ষণীয় কিছু নয়। তবে নির্মাণশৈলী ও বিনোদনের রসদ দিয়ে হেরেমের কাহিনীগুলো যেভাবে রগরগে করে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে এ যুগে ‘দর্শকপ্রিয়তা’ পাওয়ারই কথা। নতুন চ্যানেলটি সুলতান সুলেমান দেখিয়েই কিছু পরিচিতি পেয়েছে।

অটোমান সাম্রাজ্যের পতন যেভাবে শুরু : প্রায় ৭০০ বছর ধরে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল পৃথিবীজুড়ে। এ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। ক্ষমতার টানাপড়েনে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই হত্যা, সন্তান হত্যা এবং দাসপ্রথার অন্তরালের কাহিনী নিয়ে নির্মিত মেগা সিরিয়ালে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হুররাম সুলতান।

এই অপরূপ সুন্দরী রানীর কারণেই ধীরে ধীরে সুলতানের প্রাসাদে দানা বাঁধতে থাকে বিদ্বেষ। পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে অটোম্যানরা।

 অটোমান সাম্রাজ্যের বাসিন্দা হলেও পশ্চিমের সাহায্যে একটি নিজস্ব শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা সমৃদ্ধ করে ফেলে। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের শরিয়া আইন, বিধর্মী ট্যাক্স এবং রাজনৈতিক আইসোলেশন তাদের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক রূপে দেখা দেয়।

ফরাসী বিপ্লবের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এবং ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন এলাকার সুলতানী শাষনে বসবাসরত এসব এলাকায় খুবই দ্রুত জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রসার এবং প্রথম টার্গেটই হয় অটোমান সাম্রাজ্য!

আর এদিকে প্রাচীন টেকনোলজী এবং ট্যাক্স নির্ভর অর্থনীতির ধারক অটোমান তুলনামূলকভাবে দিন দিন শক্তি হারাতে থাকে।

আর দুর্বল হতে থাকা অটোমান সাম্রাজ্যের উপর সংস্কারের জন্য বহিঃশক্তি মানে, ফ্রান্স , ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, রাশিয়ার চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এবং নিজ বর্ডারের ভেতরের ভিন্ন ধর্ম ও ভাষার জনগণও সংস্কারের জন্য চাপ দিতে থাকে।

কিন্তু ইসলামীক খেলাফতের ভেতর সেক্যুলার সংস্কার করার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না তৎকালীন অটোমান সুলতান!

এসবের ফলাফলে দীর্ঘ সময় ও শক্তি হারিয়ে ১৮৩৯ থেকে অটোমানরা বাধ্য হয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। "তাঞ্জিমাত" ও এর ধারাবাহিকতায় "ইসলাহাত" নামে দিন বদল শুরু হয়।

বিধর্মী ও মুসলিমদের সামাজিক অবস্থান সমান করা হয়, বিধর্মী ও মুসলিমদের ট্যাক্স সমান করা হয়।

কিন্তু স্বাধীনতার ডাক শুনতে পাওয়া জনগণ এসবে সন্তুষ্ট না! তার উপর সুলতানের আমলাদের দুর্নীতি এবং প্রাচীন সামরিক সরঞ্জামও শাষনের কঠোরতা ধরে রাখার পথে বাধা ছিল।

আর ইউরোপ থেকে মুসলিম অটোমান বিতাড়িত করার ৫০০ বছরের লালিত স্বপ্নতো তৎকালীন পরাশক্তিদের ছিলই!

ইতিহাসের সুলেমান-১:

বাস্তবে বা ইতিহাসের সুলেমান-১ হেরেমের নায়ক নন। ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়ক। প্রথম সুলেমান অটোমান বা তুর্কি খলিফাদের মধ্যে সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি একটানা ৪৬ বছর (১৫২০-১৫৬৬) সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি সময় মেপে পথ চলেননি, সময় যেন তাকে অনুসরণ করেছে। ইউরোপীয় ইতিহাসবেত্তারা তাকে ‘গ্রেট’ এবং ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মিলিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের তখনকার বিস্তৃতি ছিল তিন মহাদেশের বিরাট অংশজুড়ে।

সুলেমান-১ জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল। তার পিতা সুলতান সেলিম-১, মা হাফছা সুলতান সন্তানের চরিত্র গঠন ও গুণগত লেখাপড়ার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। দাদী গুলবাহার খাতুনই ছিলেন কার্যত সুলেমানের প্রথম শিক্ষক এবং গাইড। মাত্র সাত বছর বয়সে সুলেমান তার দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর কাছে ইস্তাম্বুলে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন।

পৃথিবী বিখ্যাত জ্ঞানতাপস খিজির ইফিন্দি বা আফেন্দি ছিলেন তার ওস্তাদদের মধ্যে অন্যতম। তার কাছেই সুলেমান ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশল নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। তারপর সুলেমান ১৫ বছর বয়স হওয়া অবধি ট্রাবজনে তার পিতার সাথে অবস্থান করেন। এই ট্রাবজনই ছিল তার জন্মস্থান। নেতৃত্বের যোগ্যতা, সততা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রতিভার গুণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুলেমান গভর্নর নিযুক্ত হন।

তাকে প্রথমে সরকি প্রদেশে, তারপর কারা হিসর, বলু এবং অল্প সময়ের জন্য কিফিতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুলতান সেলিম-১ ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে জিতে ১৫১২ সালে ক্ষমতায় বসেন। তখন পিতার ইচ্ছানুযায়ী সুলেমান ইস্তাম্বুলে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান এবং তার বাবার পক্ষ থেকে চাচাদের মধ্যে বিরোধ মেটানোর জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তখনো শাহজাদা সুলেমান সরুহান প্রদেশের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পিতা সুলতান সেলিম-১ মারা গেলে সুলেমান ১৫২০ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে সর্বসম্মতভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফা বা সুলতান মনোনীত হন। সুলেমানের খলিফা বা সুলতান হওয়ার বিষয়টি কিংবদন্তি হয়ে আছে।

সবাই জানত, সুলেমান একজন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী ও ধার্মিক মানুষ। তিনি কখনো তার কমান্ড নষ্ট হতে দিতেন না। সুলতান সুলেমান তার জনগণের কাছ থেকে বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য পাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাহীন ছিলেন। সুলতান এতটাই ধীমান ছিলেন, তার প্রতিটি বক্তব্য হতো শিক্ষণীয় ও নির্দেশনামূলক। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভাবতেন; শৈথিল্য মানতেন না। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে এবং ক্রান্তিকালে কখনো ধৈর্য হারাতেন না।

১৫৬৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে সুলতান সুলেমান অভিযানে থাকা অবস্থায় হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরে নিজ তাঁবুতে ইন্তেকাল করেন। তার এই মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক এবং বার্ধক্যজনিত। তাকে দাফন করা হয়েছিল অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বা আজকের ইস্তাম্বুলে। তার সমাধিস্থলেই বিখ্যাত সুলেমানি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কালজয়ী ভ্রমণ সাহিত্য প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’ যারা পড়ে থাকবেন, তারা তুরস্ক ও ইস্তাম্বুল সম্পর্কে ধারণা পাবেন। হালে প্রচার করা হচ্ছে, একটি লোককাহিনী। কথিত আছে, সুলতান সুলেমানের মূল কবর তুরস্কে হলেও তার হৃৎপিণ্ডটি হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরের আঙ্গুর কুঞ্জে কবর দেয়া হয়েছিল। এটি কোনো প্রতিষ্ঠিত মত নয়। তার পরও সুলেমানের ‘হৃদয়ের খোঁজে’ বহুজাতিক বিশেষজ্ঞ দল এখনো সক্রিয় রয়েছে।

ইতিহাসে সুলেমান আইনপ্রণেতা বা ‘কানুনি’ হিসেবে বিশেষভাবে ছিলেন পরিচিত। সুলেমানের আইন গবেষণার ফসল তিন শ’ বছর ধরে কার্যকর ছিল। ইউরোপও এর মাধ্যমে লাভবান হয়েছে। তিনি ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সৎ এবং সাহসী শাসক। সেটা ছিল সাম্রাজ্যের সোনালি যুগ, তখন সৌভাগ্যের সূর্য ছিল মধ্যগগনে। কখনো তার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা ও প্রজা নিপীড়নের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। একবার মিসর থেকে অতিরিক্ত খাজনা জমা হওয়ার পর তিনি তথ্য-উপাত্ত নিয়ে অনুসন্ধান করে বের করলেন- প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের কারণেই অর্থভাণ্ডারে করের আয় বেড়েছে এবং মিসরের সেই গভর্নর নিপীড়ক ছিলেন। সুলতান দ্রুত সেই গভর্নর পরিবর্তন করেছিলেন। ইসলাম নিয়ে সুলতান সুলেমানের কবিতা বিশ্বের উৎকৃষ্ট কবিতাগুলোর কাতারে স্থান পেয়েছে। সুলেমান তার পরামর্শকদের মধ্যে শিল্পী, চিন্তাবিদ, ধর্মবেত্তা ও দার্শনিকদের বেশি ঠাঁই দিয়েছিলেন এবং তাদের কদর করতেন।

এ কারণে ইউরোপের তুলনায় তার বিচারব্যবস্থা, আদালত ও শাসনব্যবস্থা ছিল অনেক বেশি উন্নত, নিরপেক্ষ, মানবিক, ন্যায়ানুগ এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। ওই সময়কার ইউরোপীয় রাজনীতি-অর্থনীতি সুলতানের নখদর্পণে ছিল। মার্টিন লুথার, প্রটেস্টান্ট ধর্ম ও ভ্যাটিকানের ব্যাপারে তার গভীর উৎসাহ ছিল। তাদের সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞানও তার ছিল। সুলতান মিথ্যা বলা পছন্দ করতেন না। কর্তব্যে অবহেলা মেনে নিতেন না, বাহুল্য কথা বর্জন করতেন, হালাল হারাম মেনে চলতেন। তার নির্দেশনা ও বক্তব্য হতো নীতিবাক্যের মতো। সহজেই শত্রু-মিত্র চিনতে পারতেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ব্যাপারে সুলতান এতটাই আমানতদার ছিলেন যে, তার ওপর নির্ভরতায় কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের ছাপ কখনো ম্লান হতো না। অপরাধী কোনোভাবেই পেত না প্রশ্রয়।

দেখতে সুলেমান ছিলেন সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, ফর্সা এবং গাঢ় বাদামি ছিল তার চোখ, নাক ছিল খাড়া ও সরু। চোখের ভ্রু ছিল জোড়া লাগানো। দীর্ঘ ছিল তার গোঁফ, দাড়ি ছিল সুন্দর, ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর ও অসাধারণ। তার কণ্ঠস্বর ছিল স্পষ্ট ও ভরাট। তাকে দেখলেই মনে হতো আত্মবিশ্বাসী, বীর, দৃঢ়চেতা ও শক্তিধর। সৌভাগ্য ও অনুকূল পরিবেশ যেন সব সময় তার চার পাশে ঘিরে থাকত।

মাহিজিবরান, খুররম, গুলফাম ও ফুলেন ছিলেন তার স্ত্রী চতুষ্টয়। সেলিম-২, বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির, মোস্তাফা- এই আট পুত্রসন্তানের জনক। সুলেমানের ছিল দুই কন্যা মিহরিমান ও রেজায়ি।

তুর্কি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ পাল্টে যায়- যেমন খাতুন হয়ে যায় হাতুন, খুররম হয়ে যায় হুররম। আমাদের জানা অনেক শব্দ তুর্কি উচ্চারণে ভিন্নভাবে ধ্বনিত হয়। বাংলাদেশে যে সিরিজটি প্রদর্শিত হচ্ছে, এটি সম্ভবত ইংরেজি থেকে ডাবিং করা। তবে বাংলা ডাবিং মন্দ নয়, ডাবিংবিচ্যুতিও কম। শব্দচয়নে সতর্কতা লক্ষণীয়- যা ডাবিংয়ের প্রাণ। সন্দেহ নেই, সুলতান সুলেমান একটি প্রাণবন্ত সিরিজ। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে দায়বোধের জায়গা থেকে একটা কথা বলে রাখার গরজ বোধ করছি, এ সিনেমায় সুলেমান হেরেম ও সাম্রাজ্যের নায়ক। ইতিহাসের সুলেমান আরো বেশি বর্ণাঢ্য, সুশাসক, বিজয়ী ও মহানায়ক।

১৯২১ সাল পর্যন্ত অটোমান বা তুর্কি খেলাফত ব্যবস্থা টিকে ছিল। আমরা তুর্কি খেলাফতকে নিজেদের ভেবেছি। তার অংশ হওয়াকে গৌরবের বিষয় জেনেছি। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। কামাল আতাতুর্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্তির ঘোষণা দিলে উপমহাদেশজুড়ে খেলাফত পুনরুদ্ধার আন্দোলন শুরু হয়। সেটাই ইংরেজবিরোধী আজাদি আন্দোলনের মাত্রা পায়। গান্ধীজীও আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জুগিয়েছেন।

পুরো ইউরোপ সুলতান সুলেমানকে সমীহ করে চলত। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শ্রদ্ধাভরে তার আনুগত্য করাকে দায়িত্ব ভেবেছেন। সেই দিনগুলোতে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকেরা ধর্মীয় নেতা এবং উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতেন। আমাদের ইংরেজ শাসনবিরোধী আজাদি আন্দোলনের শুরুর দিকে শায়খুল হিন্দসহ সবাই তুর্কি খলিফাদের সাহায্য নিয়েছেন। রুটি ও রেশমি রুমাল আন্দোলনে তুর্কি পাশা ও খলিফাদের সমর্থন ইতিহাসস্বীকৃত বিষয়। বিশ্বাস ও নাড়ির টান সুলেমানকে আমাদের কাছাকাছি এনে দেয়। সেটি বিনোদনের সুড়সুড়ি এবং বাঁধহীন ব্যত্যয় বিচ্যুতির কারণে নষ্ট হলে আমরা ইতিহাসের মূলধারা থেকে ছিটকে পড়তে পারি- সেই সতর্কতার জন্যই এই বিষয়ে কলম ধরা। চলমান সিরিজের সমালোচনা করার কোনো দায় আমাদের নেই। ইতিহাসকে কাছাকাছি টেনে আনার উদ্যোগটুকু তো সমর্থনযোগ্য। যা হয়নি তা না হয় আগামী দিনে হওয়ার প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখল।

শাসনকালের সূচনালগ্নে সুলতান সুলেমান মহামতি আলেক্সান্ডারের থেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে অটোমান জাতিকে অপরাজেয় জাতি হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্প করেন।
 যুবরাজ থাকার সময় তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তখনই তার সততা ও যোগ্যতার কথা সবখানে আলোচিত হত। তিনি খলিফা হওয়ার পর সারা শে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রথম সুলেমান ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। দৈনন্দিন জীবনে তিনি ইসলামের অনুশাসনগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করতেন। সকল মুসলিম নাগরিক যাতে নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন করে সেই দিকে তার সজাগ দৃষ্টি ছিল।
তার শাসনকালে ধর্মীয় কোন্দলের কারণে বিপদাপন্ন হয়ে খ্রিস্টান দেশগুলো থেকে বহু প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক তার পরিচালিত রাষ্ট্রে এসে নিরাপদে বসবাস করতে থাকে। ইতিহাসবিদ লর্ড ক্রেজি বলেন, খ্রিস্টান জগতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের অত্যাচার-অবিচারের যুগে সমসাময়িক অন্য কোনো নরপতি সুলাইমানের ন্যায় প্রশংসা অর্জন করতে পারেনি’।
সাহসিকতা, মহানুভবতা, ন্যাপরায়ণতা এবং বদান্যতা তার চরিত্রের ভূষণ ছিল। তিনি নাগরিকদের করভার লাঘব করেন।

সুলাইমানিয়া মসজিদ তার অমর কীর্তি। রাষ্ট্রের সর্বত্র বহু মসজিদ, ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গোসলখানা, সেতু ইত্যাদি তৈরি করেন। তিনি দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের বরখাস্ত করে সৎ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনি আপন জামাতাকেও গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে দেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র খিলাফতকে ২১টি প্রদেশ এবং ২৫০টি জেলায় বিভক্ত করেন।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিস্তারকালে, সুলতান সুলেমান ব্যক্তিগতভাবে তার সাম্রাজ্যের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, খাজনা ব্যবস্থা ও অপরাধের শাস্তি ব্যবস্থার বিষয়গুলোতে আইন প্রণয়নসংক্রান্ত পরিবর্তন আনার আদেশ দেন। সুলতান সুলেমান যে শুধু একজন মহান রাজা ছিলেন তা নয়, তিনি একজন মহান কবিও ছিলেন। তার শাসনামলে উসমানীয় সংস্কৃতির অনেক উন্নতি হয়। সুলতান সুলেমান উসমানীয় তুর্কি ভাষাসহ আরো পাঁচটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারতেন: আরবি ভাষা, সার্বীয় ভাষা, ফার্সি ভাষা, উর্দু ভাষা এবং চাগাতাই ভাষা (একটি বিলুপ্ত তুর্কি ভাষা)। তার সমসাময়িক প্রখ্যাত শাসক ছিলেন জার্মানির পঞ্চম চার্লস, ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিস, ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ, রাশিয়ার জার আইভানোভিচ, পোল্যান্ডের সিজিসম্যান্ড, ইরানের শাহ ইসমাইল এবং ভারতের সম্রাট আকবর।

প্রথম দিকে উসমানী শাসকগণ নিজেদের ইসলামী আইন-কানুনের প্রতিভূ মনে করতেন। ১৬ শতকের মধ্যভাগ থেকে শাইখুল ইসলামের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। তার পদমর্যাদা প্রায় উজিরে আজমের পদমর্যাদার সমকক্ষ ছিল। কোনো আইন ধর্মীয় বিধান সম্মত কিনা সেই সম্মন্ধে অভিমত দেয়াই ছিল শাইখুল ইসলামের প্রধান কাজ। সকল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার দফতরের অধীন ছিল।

সিরিয়াল নিয়ে কিছু কথা :
প্রায় ৭০০ বছর ধরে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল পৃথিবীজুড়ে। এ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। ক্ষমতার টানাপড়েনে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই হত্যা, সন্তান হত্যা এবং দাসপ্রথার অন্তরালের কাহিনী নিয়ে নির্মিত মেগা সিরিয়ালে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হুররাম সুলতান।

এই অপরূপ সুন্দরী রানীর কারণেই ধীরে ধীরে সুলতানের প্রাসাদে দানা বাঁধতে থাকে বিদ্বেষ। পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে অটোম্যানরা।

মজার ব্যাপার হল, অটোম্যান সাম্রাজ্যের ওই রানী বলতে এখন বিশ্বের সবাই মারিয়াম উজারলিকে চিনে থাকেন। চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই মিশে গিয়েছিলেন তিনি। জার্মান এ মডেলকে এ চরিত্রে নেয়াটা হুট করেই যেন হয়েছে। ইতিহাসনির্ভর এ হুররাম চরিত্রের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় আট মাস ধরে চলে ‘হুররাম’-এর খোঁজ। এরপর ২০ হাজারের বেশি প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ওই চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হন মারিয়াম।

সুলতান সুলেমানে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ৩২ বছর বয়সী এ অভিনেত্রী বলেন, ‘হঠাৎ শুটিংয়ের জন্য তুরস্কে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুটিংয়ের জন্য পাক্কা দুই বছর হোটেলেই থাকতে হয়েছে আমাকে।’ সুলতান সুলেমানের আগেও জার্মান প্রোডাকশনে টেলিভিশন সিরিজ নটরুফ হাফেনকান্তে, আইন ফাল ফ্যুয়ের সোয়াই ছাড়াও জার্নি অব নো রিটার্ন, ইয়েটস আবের বালেট ছবিতে অভিনয় করেন মারিয়াম। কিন্তু ২০১১ সালের সুলতান সুলেমানে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই সর্বাধিক খ্যাতির দেখা পান এ তারকা।

সিরিয়ালে ব্যতিক্রমধর্মী অভিনয়ের জন্য ২০১২ সালে তিনি পেয়ে যান গোল্ডেন বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড। নিউইয়র্কভিত্তিক ম্যান’স ম্যাগাজিন জিকিউয়ের দৃষ্টিতে নির্বাচিত হন ‘ওম্যান অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০১৩ সালে এ মেগা সিরিয়ালে আর অভিনয় করতে পারেননি মারিয়াম। সিরিয়ালের ১০৩ পর্ব থেকে ক্ষমতার বদলে হুররাম হিসেবে পর্দায় আসেন ভেহিদ পারসিন। ব্যক্তিজীবনে মারিয়াম এক সন্তানের জননী। মডেলিং বা অভিনয়ের বাইরে এখনও দিব্যি সংসার করে ফিরছেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের এ প্রতীকী রানী।

সুলেমান-১ জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল। তার পিতা সুলতান সেলিম-১, মা হাফছা সুলতান সনৱানের চরিত্র গঠন ও গুণগত লেখাপড়ার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। দাদী গুলবাহার খাতুনই ছিলেন কার্যত সুলেমানের প্রথম শিক্ষক এবং গাইড। মাত্র সাত বছর বয়সে সুলেমান তার দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর কাছে ইসৱাম্বুলে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন। পৃথিবী বিখ্যাত জ্ঞানতাপস খিজির ইফিন্দি বা আফেন্দি ছিলেন তার ওসৱাদদের মধ্যে অন্যতম। তার কাছেই সুলেমান ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশল নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। তারপর সুলেমান ১৫ বছর বয়স হওয়া অবধি ট্রাবজনে তার পিতার সাথে অবস্থান করেন। এই ট্রাবজনই ছিল তার জন্মস্থান। নেতৃত্বের যোগ্যতা, সততা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রতিভার গুণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুলেমান গভর্নর নিযুক্ত হন। তাকে প্রথমে সরকি প্রদেশে, তারপর কারা হিসর, বলু এবং অল্প সময়ের জন্য কিফিতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সেলিম-২,:' বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির, মোসৱাফা- এই আট পুত্র সনৱানের জনক। সুলেমানের ছিল দুই কন্যা মিহরিমা ও রেজায়ি।

সিরিজে তুর্কি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ পাল্টে যায়- যেমন খাতুন হয়ে যায় হাতুন, খুররম হয়ে যায় হুররম। আমাদের জানা অনেক শব্দ তুর্কি উচ্চারণে ভিন্নভাবে ধ্বনিত হয়। বাংলাদেশে সুলতান সুলেমান নামে দীপ্ত টিভিতে যে সিরিজটি প্রদর্শিত হচ্ছে তা ইংরেজি থেকে বাংলায় ডাবিং করা। পৃথিবীব্যাপী টিভি নাটকের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত এই সিরিজের মূলভাষা তুর্কি।

 ইব্রাহিম পাশা:

সুলতান সুলেমানের উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশা। সম্রাটের বিশ্বস্থ সহচর। আসল নাম ওকান এলবিক। তুরস্কের ইসৱাম্বুলে জন্ম ১৯৭৮ সালে। পেশায় অভিনেতা। এ পর্যন্ত ২০টির বেশি সিরিয়ালে কাজ করেছেন। চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এই সিরিজের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র ইব্রাহিম পাশা। অত্যন্ত তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন উজিরের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। কিন্তু জীবনে খুবই অসুখী একজন মানুষ।

হেতিজা সুলতানা:

জার্মানির হাম শহরে জন্ম সেলমা এরগেজ ওরফে হেতিজা সুলতানার। পড়াশোনা করেছেন মেডিসিন বিষয়ে। এছাড়া সাইকোলজি ও ফিলোসফি নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। তিনি জার্মান ও তুর্কি নাগরিক। মডেলিং ও অভিনয় তার নেশা। অনেকগুলো ভাষা জানেন তিনি। তার মধ্যে আছে জার্মান, তুর্কি, ইটালিয়ান, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ। তিনি বিবাহিত। তার স্বামীর নাম কেনওজ। ২০০০ সাল থেকে মডেলিং ও অভিনয় করছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৭টি ছবিতে এবং ৭টি টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সুলতান সুলেমান সিরিজে তিনি অভিনয় করেছেন সম্রাটের বোনের চরিত্রে। এই সিরিজে তাকে হাবা গোবা দেখালেও ব্যক্তি জীবনে অনেক স্মার্ট এবং তুরস্কের নামকরা মডেল তারকা।

বেগম সুলতানা:

আসল নাম নেবাহাত চেহরে। জন্ম কৃষ্ণসাগরের কাছে উত্তর তুরস্কে ১৯৪৪ সালে। বর্তমানে তার বয়স ৭২। পেশা অভিনয়। ১৯৫০ সাল থেকে অভিনয় করছেন। এ পর্যন্ত বহু চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি গোল্ডেন অরেঞ্জ বিজয়ী তুর্কি অভিনেত্রী। এক সময় মডেলিং করেছেন ও গানও গেয়েছেন। ১৯৬০ সালে হয়েছিলেন মিস টার্কি। ১৯৬০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ডেও অংশ নেন তিনি এবং ১৯৬৫ সালে মিস ইউনিভার্সে তুরস্কের প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্যক্তি জীবনেও সুকঠিন ও সত্যবাদী একজন মানুষ। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করেন না। এই সিরিজেও তার চরিত্রে সেই বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

মাহিদেব্রান:

জার্মান ও তুরস্কের নাগরিক নূর ফাত্তাহগুলু। সুলতান সুলেমান সিরিজে তিনি অভিনয় করেছেন সম্রাট সুলেমানের প্রথম স্ত্রী মাহিদেব্রান এবং শাহাজাদা মোস্তফার মায়ের চরিত্রে। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সদালাপি ও সজ্জন ব্যক্তি নূর মডেলিংও করেছেন। পেশা অভিনয়। টিভি প্রেজেন্টার ও ফ্যাশন ডিজাইনারের উপর পড়াশোনা করেছেন। প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেটাও ভেঙেছে ২০১৫ সালে। এ পর্যন্ত ৬টি টিভি সিরিজ ও দুটি ফিল্মে অভিনয় করেছেন। তার জন্ম ১৯৮০ সালে।

নীগার কালফা:

আসল নাম ফেলিজ এহমেদ। তিনি ম্যাসোডোনিয়া ও তুর্কি নাগরিক। অভিনয় তার পেশা। তুরস্কে তিনি একনামে পরিচিত ফেয়ারওয়েল রুমেশিয়া টিভি সিরিজের মাধ্যমে। তার দাদা একজন বিখ্যাত অভিনেতা ছিলেন। ম্যাসোডোনিয়া ও তুরস্ক থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তুলতান সুলেমান-এ নীগার কালফা চরিত্রে অভিনয় করে ইউরোপ, আমেরিকায় ও এশিয়ায় সমাদৃত হয়েছেন। তিনি ম্যাসোডোনিয়া আলেবিনিয়া, সুইডেন, টার্কিস, ইংলিশ, সার্বিয়ান ও বুলগেরিয়ান ভাষায় অভিনয় করেছেন। এবং এই ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। তিনি গ্রাজুয়েশন করেছেন সুইডেনে মেডিক্যাল স্কুলে এবং ম্যাসোডোনিয়ায় গ্রাজুয়েশন করেছেন ফাইন আর্টস-এ। তার একটি মাত্র সনৱান।

শাহজাদা মোস্তফা:

আসল নাম মেহমেত গানসুর। জন্ম তুরস্কে ১৯৭৫ সালে। পেশায় অভিনেতা মডেল ও প্রযোজক। গানসুর গ্রাজুয়েশন করেছেন ইটালিয়ান হাইস্কুলে। তুর্কি, ইটালিয়ান ও আমেরিকান চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন। প্রথম জীবনে একটি রেস্টুরেন্টে বারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সালে আস্কার ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রমেজিং অ্যাকটর-এর সেরা পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পান গোল্ডেন অরেঞ্জ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এ পর্যন্ত ১৮টি সিরিজ ও ফিল্মে অভিনয় করেছেন তিনি। গানসুর একজন মুসলিম। বিয়ে করেছেন ১৯৮৯ সালে।