Sunday 4 December 2016

আরকান রাজ দরবারে বাংলা সাহিত্য চর্চা ।

আরকান রাজ দরবারে বাংলা সাহিত্য চর্চা ।

মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ।

আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা এ দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিজাতীয় ও ভিন্ন ভাষাভাষী মগরাজার আনুকূল্য অর্জন করে বাংলা ভাষাভাষী বেশ ক’জন প্রভাবশালী কবি এখানে সগৌরবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাদের শাণিত লেখনির বিচ্ছুরণে সমৃদ্ধি লাভ করে বাংলা সাহিত্য। মধ্যযুগের ধর্মনির্ভর সাহিত্যের অঙ্গনে তাদের অনবদ্য এবং জ্ঞানগর্ভ সাহিত্য চর্চার ফসল মানবীয় প্রণয় কাহিনী যুক্ত হয়ে সাহিত্যাঙ্গনে আসে অভিনবত্ব। উনিশ শতকের শেষভাগে হাতে লেখা পুঁথি সংগ্রহের ব্যাপক প্রচেষ্টায় ড. দীনেশচন্দ্র সেন প্রমূখ উদ্যোগী হলে সেখানেও মুসলমান কবিদের রচনা উপেক্ষিতই থেকে যায়। পরবর্তীতে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ উদ্যোগ গ্রহণ না করলে হয়তো বা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিগণের বিস্ময়কর অবদানের কথা আজও অনুদঘাটিতই থেকে যেতো। বলা যায় তিনিই প্রথম উদ্যোগী হয়ে মুসলমানদের রচিত বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার উদঘাটন করতে সক্ষম হন এবং বাংলাদেশের গবেষকদের আন্তরিক ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্বমহিমায় অধিষ্ঠত হন মুসলমান কবিগণ। রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক কারণে মগ রাজ্যের মুসলমানদের সংস্কৃতি বাংলাদেশের ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা হয়ে পড়া সত্ত্বেও এর মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ নতুন সাহিত্য সৃষ্টি ছিল পুরোপুরি স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। আরাকানকে বাংলা সাহিত্যে রোসাং বা রোসাঙ্গ নামে বলা হয়। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকগণ হলেন, দৌলত কাজী, আলাওল, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মরদন, আব্দুল করিম খোন্দকর। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি আলাওল কোথায় জন্মগ্রহন করেন ফতেহাবাদের জালালপুরে। মধ্যযুগে স্বাধীন রোসাঙ্গ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাগন ঠাকুর। সেই সময়ে কবি মরদন রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে “নসীহত নামা” ।

চিতোরের রানী পদ্মীনির কাহিনীর ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়ে কবি আলাওল নিয়ে “পদ্মাবতী ’’ নামক ঐতিহাসিক প্রণয় উপাখ্যান রচনা করেন।

 কবি আলাওলের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে তোহফা, সেকান্দারনামা, সঙ্গীতন শাস্ত্র (রাগতাল নামা), বাংলা ও ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণ রূপকে রচিত পদাবলী ইত্যাদি।

সপ্তদশ শতাব্দীতে শ্রী সুধর্ম রাজার আমলে তাঁর লঙ্কর উজির আশরাফ খানের আদেশে দৌলত কাজী সতি ময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করেন? হিন্দি ভাষার কবি সাধন এর মৈনাসত’কাব্য অবলম্বনে সতি ময়না ও লোরচন্দ্রানী’ রচনা করা হয়।


আরাকান অঞ্চলটি বর্তমানে মিয়ানমারের ‘রাখাইন স্টেট’ নামে পরিচিত একটি প্রদেশ। এটি এক সময়ের স্বাধীন রাজ্য এবং মুসলমানদের শান্তিময় বাসস্থান ছিল। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্মারাজা বোদাপায়া আরাকান দখল করে বার্মার অধীনে নেন। এর আগে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে আরাকানের স্বাধীন সত্তা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ইতিহাস পাওয়া যায়। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান কর্তৃক দখল করার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলও আরাকানের অধীনে ছিল। ফলে চট্টগ্রামে মুসলমানদের প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে আরাকানেও তা সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে। সময়ের ধারাবাহিকতায় মুসলমানরা এখানকার অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে একটি অভিনব এবং স্বতন্ত্র অধ্যায় বিনির্মাণে সক্ষম হয়েছিল। অদ্যাবধি এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ইসলামের অনুসারী। তাদের মধ্যে থাম্ভইক্যা, জেরবাদী, কামানচি, রোহিঙ্গা প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা তাদের মধ্যে বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী মূল ধারার সুন্নি মুসলমান। জন্মগতভাবেই তারা আরাকানের নাগরিক, তাদের হাতেই পরিপুষ্টি অর্জন করেছে আরাকানের ইতিহাস-ঐতিহ্য। এই সময় আরাকান যদিও মূলতঃ বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে ছিল—তবু এই রাজাদের ওপর মুসলমান ধর্মের প্রভাব অতটা তীব্ৰ হ’য়ে দেখা গিয়েছিল যে ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় । এমন কি র্তাদের নিজেদের বৌদ্ধ নামের পরিবর্তে স্বয়ং গ্রহণ করা মুসলমানী নাম ব্যবহার করতেই যেন তারা বেশী তৃপ্তি পেতেন । ৪৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দ থেকে ১৬৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দ পর্যন্ত ২০০ বৎসরেরও অধিক কাল স্বাধীন আরাকানের বৌদ্ধ রাজার মুসলমানী নাম ব্যবহার করেছেন। ( আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য-আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও ডাঃ এনামুল হক। পৃঃ-৬)

*বৌদ্ধ নাম --মুসলমানী নাম-- রাজত্বকাল

১।মেনখরী---আলী খাঁ --১৪৩৪–১৪৫৯ খৃঃ

২।বচৌপিয়া(Basawpyu) -- কলিমা শাহ--১৪৫৯-১৪৮২খৃঃ

৩।মেঙ বেঙ—মিন বিন(Mengbeng–Min-bit)—সুলতান-১৫৩১-১৫৭১খৃঃ

৪।মেঙ-ফলৌঙ (Meng-Phalaung)--সিকান্দরশাহ—১৫৭১-১৫৯৩খৃঃ

৫। মেঙ-রাদ জা গ্যি(Meng-Radza-gyi)—সলীম শাহ--১৫৯৩-১৬১২খৃঃ

৬। মেঙ, খা মৌঙ(Meng-Kha-moung )—হুসয়ন শাহ—১৬১২-১৬২২ খৃঃ

৭।থিরী-থু-ধম্ম(Thiri-thu-dhamma)—দুষ্পাঠ্য ফরাসি নাম--১৬২২-১৬৩৮ খৃঃ

৮।নরপদিগ্যি (Narapadigyi) --দুষ্পাঠ্য ফরাসি নাম--১৬৩৮-১৬৪৫ খৃঃ

আরাকানে বাংলা সাহিত্য চর্চাকারীদের মধ্যে দৌলত কাজী অন্যতম। চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামের কাজি বংশের সন্তান কবি দৌলত কাজী আরাকানে বাংলা সাহিত্য চর্চা করেন। এমনকি তিনি আরাকানে রাজসভার কাজির পদেও নিযুক্ত ছিলেন। তিনি শুধু মধ্যযুগীয় বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ নন, প্রাচীন বাংলার শক্তিমান কবিদের মধ্যেও তিনি একজন শ্রেষ্ঠকবি। বাস্তববাদী এ কবি মধ্যযুগকে পেছনে ফেলে সমকালীন আধুনিকতা বিনির্মাণের জন্য সাহিত্যের গতানুগতিক পথ মাড়িয়ে বাস্তবতার নিরিখে মানবীয় প্রেমকে উপজীব্য করে সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী কাব্য করেন। তিনি আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মার রাজত্বকালের (১৬২২-১৬৩৮ খ্রি.) মধ্যেই তার লস্কর উজির আশরাফ খানের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার কাব্য সমাপ্ত করার আগেই মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মারা যান। তার কাব্যে বন্দনা, মহাম্মদের সিফত এবং রোসাঙ্গের রাজার প্রশস্তি অংশে কবি মূলত তার বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিই তুলেছেন। কবির ভাষায়-
শ্রী আশরফ খান / ধর্মশীল গুণবান
মুসলমান সবার প্রদীপ
সে রসুল-পরসাদে / গুরুজন আশীর্বাদে
রাজসখা ইউক চিরঞ্জীব ॥ (সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী)
মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠকবি মহাকবি আলাওল। তিনি আরাকানে অশ্বারোহী সৈন্য পদে চাকরি করলেও অচিরেই তিনি আরাকানের মুসলিম মন্ত্রীদের সুনজরে আসেন এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই তাঁর কাব্যগুলো রচনা করেন। তাঁর রচিত পদ্মাবতী যা আরাকানরাজ থদো মিংদারের (১৬৪৫-১৬৫২ খ্রি.) শাসনামলে রাজসভার প্রভাবশালী অমাত্য ও কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের অনুরোধে ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন। ‘সৎকীর্তি মাগনের প্রশংসা’ অংশে কবি আরাকানের অমাত্যসভা কর্তৃক মুসলমানদের জ্ঞান চর্চা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ইসলামের প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। কবির ভাষায়-
ওলামা সৈদ শেখ যত পরদেশী/পোষন্ত আদর করি বহু স্নেহবাসি ॥
কাহাকে খতিব কাকে করন্ত ইমাম/নানাবিধ দানে পুরায়ন্ত মনস্কাম ॥ (পদ্মাবতী)।

বহু মুসলমান সব রোসাঙ্গে বৈসেন্ত/সদাচারী কুলীন পণ্ডিত গুণবন্ত ॥ (পদ্মাবতী)। এ ক্ষেত্রে গবেষক ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেন যে, আঞ্চলিকভাবে উচ্চারণগত পাথর্ক্যরে কারণে হ অক্ষরটি স হিসেবে উচ্চারিত হয়ে রোহাঙ শব্দটি রোসাঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে। আরাকানের রাজসভায় জ্ঞানীদের ব্যাপক কদর ছিল। উলামা, সৈয়দ, শেখ সবাইকে সম্মান দিয়ে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন করা হতো। এভাবেই আরাকানে মুসলমানদের বিস্তৃতি ঘটেছে।

মহাকবি আলাওল আরাকানের রাজা সান্দা থু ধম্মার (১৬৫২-১৬৮৪ খ্রি.) শাসনামলে আরাকানের সৈন্যমন্ত্রী মুহাম্মদ সোলায়মানের পৃষ্ঠপোষকতায় দৌলত কাজী রচিত অসমাপ্ত সতী ময়না-লোর চন্দ্রানী কাব্যটি সমাপ্ত করেন। তিনি আরাকানের রাজা সান্দা থু ধম্মার শাসনামলে স্বীয় প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল রচনা শুরু করেন। কবির রচিত হামদ-নাত অংশের চরণগুলোতে কবির অন্তরাত্মার লালিত ইসলামের সুমহান আদর্শ, বিশ্বাস অনুভূতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও ভাবৈশ্বর্য ফুটে উঠেছে। আলাওল ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের মুখ্য সেনাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ খানের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সপ্তপয়কর কাব্যটি রচনা করেন।
তোহফা মহাকবি আলাওলের একটি অন্যতম বিখ্যাত ও উপদেশমূলক কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি ১৬৬৩-৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কবি আলাওল আরাকানের মহামাত্য মুহম্মদ সোলায়মানের আদেশে এর কাব্যানুবাদ সম্পন্ন করেন। কাব্যটি আলাওলের অনূদিত কাব্য হলেও অন্যান্য কাব্যের মতো এখানেও তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রক্ষা করেছেন। এছাড়াও সিকান্দরনামা আলাওলের শেষ কাব্যগ্রন্থ। কবি আলাওল আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মার (১৬৫২-৮৪ খ্রি.) প্রধান অমাত্য নবরাজ মজলিশের আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬৭১ থেকে ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এটি রচনা করেন। অনূদিত কাব্য হলেও এটি যেমন ছিল স্বাধীন ও ভাবানুবাদ তেমনি কাব্যের বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব রচনাও বিদ্যমান।
কোরেশী মাগন ঠাকুরও মধ্যযুগের একজন মৌলিক কবি। মৌলিক রচনার সঙ্কটকালে কোরেশী মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবতী কাব্য একটি বিরল উদাহরণ। কবির উদ্ধারকৃত চন্দ্রাবতী’র ভণিতা অংশ উদ্ধার না হওয়ায় তার ব্যক্তিগত পরিচয়ের বিষয়টি প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে। তবে যেহেতু কবি আলাওল কোরেশী মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬৪৬-১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পদ্মাবতী কাব্যটি রচনা করেছেন এবং তখন তাঁকে আরবি-ফার্সি ভাষায় পারদর্শী, বর্মি ও সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত, ভেষজ ও যাদু বিদ্যায় দক্ষ এবং কাব্য ও নাট্যকলায় অনুরাগী বলে উল্লেখ করেছেন। হয়তো আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য রচনার পরে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্তে তিনি এ কাব্য রচনা করেন।

কবি দৌলত কাজীর সমসাময়িক কালের কবি ছিলেন মরদন। ঐতিহাসিক আবদুল করিম তাঁর নাম মরদন নুরুদ্দিন বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরাকানের রাজা থিরি থু ধম্মা ওরফে সিকান্দার শাহ দ্বিতীয়ের শাসনামলে (১৬২২-১৬৩৮ খ্রি.) কাব্য চর্চা করেন। কবি মরদন কর্তৃক উপস্থাপিত আরাকানের কাঞ্চি নগরে মুসলিম ও হিন্দু বসতির পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষত মুসলমান প্রভাব খুব বেশি লক্ষ্যণীয়।

 কবির ভাষায়-
ভুবনে বিখ্যাত আছে রোসাঙ্গ নগরী/ রাবনের যেহেন কনক লঙ্কাপুরী ॥
সে রাজ্যেত আছে এক কাঞ্চি নামে পুরী/ মুমীন মুসলমান বৈসে সে নগরী ॥
আলিম মৌলানা বৈসে কিতাব কারণ/ কায়স্থগণ বৈসে সব লেখন পড়ন ॥
(নসিবনামা আহমদ শরীফ সম্পাদিত)
কাব্যাংশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, রোসাঙ্গ নগরী অর্থাৎ আরাকানের রাজধানী ম্রোহংয়ের কাছাকাছি কোনো পুরী বা নগর ‘কাঞ্চিপুর’; এখানে মুসলমান ও হিন্দুদের মিলনমেলা। মুমিন-মুসলমান, আলিম মাওলানা মজলিশে মিলিত হয়ে পবিত্র কুরান-হাদিস আলোচনা করে থাকেন। সেই সাথে হিন্দু কায়স্থরাও মিলিত হয়ে লেখাপড়া করে থাকেন।

আরাকান প্রশাসন প্রভাবিত কবিদের মধ্যে সপ্তদশ শতাব্দীর শক্তিশালী মুসলিম কবি নসরুল্লাহ খোন্দকার। এ কবির তিনটি প্রধান কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় যথা জঙ্গনামা, মুসার সওয়াল ও শরীয়তনামা। আরাকানের অমাত্য সভার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত কবি আবদুল করিম খোন্দকার। তিনি আরাকানেই জন্ম গ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ রসুল মিয়া আরাকানের রাজার ‘ট্যাক্স-কালেক্টর’ হিসেবে কাজ করেন। পিতামহ মদন আলী আরাকানের রাজার দোভাষী বা ইন্টারপ্রেটর হিসেবে রাজা ও বিদেশী বণিকদের মধ্যে পারস্পরিক কথোপকথনের অনুবাদকের কাজ করতেন। তিনি তিনটি কাব্য রচনা করেছেন যথা ‘দুল্লাহ মজলিশ’, হাজার মাসায়েল এবং তমিম আনসারী। শুজা কাজী নামে পরিচিত আরাকানের সরদার পাড়ার অধিবাসী কবি আবদুল করিম অন্যতম কবি ছিলেন। তিনি ‘রোসাঙ্গ পাঞ্চালা’ নামে আরাকানের ইতিহাস সংবলিত কাব্যটি রচনা করেন। সেই সাথে ম্রোহংয়ের কবি আবুল ফজলের আদমের লড়াই; আরাকানের কাইমের অধিবাসী কাজী আবদুল করিমের রাহাতুল কুলুব, আবদুল্লাহর হাজার সওয়াল, নুরনামা, মধুমালতী, দরীগে মজলিশ; কাইমের অধিবাসী ইসমাইল সাকেব এর ‘বিলকিসনামা’; কাজী মোহাম্মদ হোসেনের আমির হামজা, দেওলাল মতি ও হায়দরজঙ্গ; আরাকানের উল্লেখযোগ্য কবি ও কাব্যগ্রন্থ।

মূলত আরাকানের রাজধানীতে হাজারো কুলীন পণ্ডিত ও গুণী ব্যক্তিদের ভিড় লক্ষ্যণীয় ছিল। তাদের মধ্যে ওলামা, সৈয়দ, শেখ প্রভৃতি যারা বিদেশী ছিলেন কিংবা স্বদেশী ছিলেন সবাইকে মুসলিম অমাত্যরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে রাজ্যের উন্নতি যেমন নিশ্চিত করেছেন, তেমনি আরাকানী প্রশাসনে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদাকে নিশ্চিত করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে আরাকান রাজসভায় বিদেশী মুসলিম-অমুসলিম লোক আরাকানে একত্রিত হয়ে আরাকানী সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিশেষত আরাকানে ইসলামের প্রসার ও প্রভাব বিস্তারে তাদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। কবি আলাওলের ভাষায়-
নানা দেশী নানা লোক/শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ/আইসন্ত নৃপ ছায়াতল; আরবী মিশরী শামী/তুরকী হাবশী রুমী/ খোরাসানী উজবেগী সকল॥ লাহরী মুলতানী হিন্দি/কাশ্মীরী দক্ষিণী সিন্ধী/ কামরূপী আর বঙ্গদেশী; ভূপালী কুদংসরী/ কান্নাই মনল আবারী/আচি কোচী কর্ণাটকবাসী॥ বহু সৈদ শেখজাদা/ মোগল পাঠান যোদ্ধা/ রাজপুত হিন্দু নানা জাতি; আভাই বরমা শাম/ ত্রিপুরা কুকির নাম/ কতেক কহিমু জাতি ভাঁতি॥ (আলাওল, পদ্মাবতী, সৈয়দ আলী আহসান সম্পাদিত)।
এভাবে মধ্যযুগ কিংবা তারও আগে থেকে আরাকানে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ বর্তমানে সেখানকার মুসলমানদের ভিনদেশী বলে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটা শুধু অমানবিকই নয়, বরং জবরদখলের চরম মাত্রা। মগের মুলুকের সেই প্রবাদ যেন আজো সেখানে বাস্তাবায়ন করা হচ্ছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সর্বজনীন এক সংস্কৃতির অধিকার অর্জন করেছিলেন আরাকানরাজারা, আর সে সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ছিল মুসলমানদের। মেঙৎ-চৌ-মৌন-এর সময়ে ১৪৩০-১৪৩৪ সাল পর্যন্ত রোসাঙ্গ ছিল গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহর করদরাজ্য হিসেবে। বার্মারাজার ভয়ে আরাকানরাজ নরমিখলা ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম অঞ্চলের রামু কিংবা টেকনাফের শতমাইলের মধ্যে ‘ম্রোহঙ’ নামক স্থানে স্থাপন করেন রাজধানী। তখন থেকে এই ‘ম্রোহঙ’ ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩‘শ বছর ধরে ছিল আরাকানের রাজধানী। অনেকেরই ধারণা রোসাঙ্গ নামের উৎপত্তি এই ‘ম্রোহঙ’ শব্দ থেকেই। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রোসাঙ্গ রাজারা ওই সময় থেকে একটি মুসলমানি নাম ব্যবহার করতেন বৌদ্ধ নামের পাশাপাশি। প্রচলিত হয়েছিল তাদের মুদ্রার একপীঠে ফারসি হরফে কলেমা ও মুসলমানি নাম লেখার রীতি। তাদের ব্যবহৃত ইসলামি নামগুলো হচ্ছেঃ কলিমা শাহ্, সুলতান, সিকান্দর শাহ্, সলীম শাহ্, হুসেইন শাহ্ প্রভৃতি। আরাকান রাজাগণ ১৪৩৪ থেকে ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দু’শতাধিক বছর পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছিলেন মুসলমানদের ব্যাপক প্রভাব। ড. মুহম্মদ এনামুল হক তার ‘মুসলিম বাঙলা সাহিত্য’ গ্রন্থে এই সময়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেন ‘এই শত বৎসর ধরিয়া বঙ্গের (মোগল-পাঠান) মুসলিম রাজশক্তির সহিত স্বাধীন আরাকান রাজগনের মোটেই সদ্ভাব ছিল না, অথচ তাঁহারা দেশে মুসলিম রীতি ও আচার মানিয়া আসিতেছিলেন। ইহার কারণ খুঁজিতে গেলে মনে হয়,আরাকানি মঘসভ্যতা, রাষ্ট্রনীতি ও আচার ব্যবহার হইতে বঙ্গের মুসলিম-সভ্যতা রাষ্ট্রনীতি ও আচার ব্যবহার অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত ছিল বলিয়া আরাকানে রাজাগণ বঙ্গের মুসলিম প্রভাব হইতে মুক্ত হইতে পারেন নাই।’

মগ বা আরাকান রাজাদের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদসহ রাজপদেও নিযুক্তি লাভ করেছেন বাঙালি মুসলমানেরা। ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায় রাজাদের সৈন্য বিভাগের প্রধান কর্মচারী থেকে শুরু করে শাসন বিভাগের বিভিন্ন শাখা প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন মুসলমানগণ। মুসলমানেরাই নিযুক্তি পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী (মহাপাত্র, মুখ্যপাত্র বা মহামাত্য), অমাত্য (পাত্র), সমরসচিব (লস্কর উজির), কাজী কিংবা বিচারক প্রভৃতি উচ্চপদে। বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাজারা তাদের অভিষেক সম্পন্ন করতেন মুসলমান প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমেই। ক্রমে মুসলমানদের এই প্রভাব বৃদ্ধি পেয়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। এক সময়ে মেঙৎ-চৌ-মৌন, থিরী-থু-ধুম্মা (শ্রীসুধর্মা), নরপদিগ্যি (নৃপতিগিরি বা নৃপগিরি), সান্দ সুধম্মা (চন্দ্র সুধর্মা), থদো মিন্তার (সাদ উমাদার) প্রভৃতি আরাকান রাজাদের সভায় বিশেষ প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হন মুসলমানেরা। এই বিশেষ প্রভাবের কারণে বহুসংখ্যাক মুসলমান জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিত্ব আরাকান রাজ্যে মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আরাকান রাজ্যে মুসলমানদের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে দৌলত কাজী লস্কর উজির আশরাফ খানের প্রসঙ্গ টেনে এনে লিখেছেনঃ
মসজিদ পুস্কর্ণী ছিল বহুবিদ দান।
মক্কা মদিনাতে গেল প্রতিষ্ঠা বাখান।
সৈয়দ,কাজী,সেক, মোল্লা,আলিম,ফকীর।
পূজেন্ত সেসবে যেন আপন শরীর ॥
বৈদেশী,আরবী, রুমী, মোগল,পাঠান।
পালেন্ত সে সবে যেন শরীর সমান ॥
আরাকানে ইসলামি প্রভাবের সূচনা হয়েছিল আরবীয় বণিকদের মাধ্যমে। কিন্তু এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরাই, আরবিয়রা নয়। আরাকান ছিল ব্রহ্মদেশ থেকে আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী। এর কারণ, একদিকে বার্মার মূল ভূখন্ড থেকে দূরতিক্রম্য পর্বত দ্বারা বিচ্ছেদ্য অপরদিকে চট্টগ্রামের সাথে ধর্মীয় ও ভৌগলিকভাবে এর নৈকট্য ও একই রাজ্যভূক্ত হওয়ায় বৃহত্তর বঙ্গদেশ থেকে এটি ছিল স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন সত্ত্বায় সমৃদ্ধ। এ কারণেই এখানে ছিল বঙ্গীয় মুসলমানদের প্রভাব, আর মুসলমানদের প্রভাবেই আরাকানে গড়ে উঠেছিল বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার পরিবেশ। বাংলা ভাষায় কতটুকু শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন মগরাজারা তা নিশ্চিত করে জানা কিংবা বলা না গেলেও এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, মুসলমান কবিগণ কাব্য চর্চায় আত্মনিয়োগের পিছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে মগরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা। আর তাদের এই পৃষ্ঠপোষকতায় কোন কার্পণ্য কিংবা কপটতা কিংবা উদারতার অভাব ছিলনা। এরই ফলশ্র“তি হিসেবে বাংলা সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করে মুসলমান কবিগণ সাহিত্যঙ্গনে তাদের প্রতিভার যথার্থ স্ফূরণ ঘটিয়ে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন এক অনন্য নজীর। এই একই কারণে রোসাঙ্গে বসবাসরত বাঙালি ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, রাজনীতিক, প্রভৃতি নানা পেশায় নিয়োজিতদের জন্যে সেখানে গড়ে উঠেছিল একটি প্রবাসী বাঙালি সমাজ। এ প্রসঙ্গে ড.আহমদ শরীফ লিখেছেন ‘তাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রয়োজন পূর্তির জন্য, মানস চাহিদা পূরণের জন্য, মনের রসতৃষ্ণা মিটানোর জন্য, সেখানে গুণীজন দিয়ে গান-গাঁথা-রূপকথা-প্রেমকথা জানানোর, রসকথা শুনানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে, সৃজনশীল কেউ কেউ নতুন সৃষ্টি দিয়ে তাদের রসতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেছে।’
মগরাজারা প্রতিভাবান মুসলমানদের প্রতিভা মূল্যায়নের মাধ্যমে নিজেদের রাজকার্যের গতিশীলতা, জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতার পরিধি প্রসারের লক্ষ্যে সহজভাবেই গ্রহণ করেছিলেন মুসলমান প্রভাবকে। তাই তাদের সভাসদবর্গও বাঙালি মুসলমান কবিদের বাংলা সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল উদারভাবে। এরই ধারাবাহিকতায় সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজা শ্রীসুধর্মার রাজত্বকালে তার লস্কর উজির বা সমরসচিব আশরাফ খানের নির্দেশে কবি দৌলত কাজী রচনা করেছিলেন ‘সতীময়না’ কাব্য। একই সময়ে কবি মরদন রচনা করেছিলেন ‘নসীরানামা’। রাজা সাদউমাদারের সময়ে তার প্রধানমন্ত্রী কোরেশী মাগনঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি আলাওল রচনা করেন তার ‘পদ্মাবতী ’ কাব্য। রাজা চন্দ্র সুধর্মার লস্কর উজির সৈয়দ মুহম্মদের নির্দেশে কবি আলাওল রচনা করেন ‘সপ্তপয়কর’, এ ছাড়াও নবরাজ মজলিসের পরামর্শে ‘সেকন্দর নামা’ এবং সৈয়দ মুসার নির্দেশে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান’ কাব্য রচনা করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টির মাধ্যমে দখল করে নেন কৃতিত্বপূর্ণ আসন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য চর্চায় মগরাজা এবং তাদের সভাসদবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার সুযোগ হতো কি না,আর তা না হলে বাংলা সাহিত্য বিকাশ ধারার অগ্রগতি কতটা সম্ভব হতো সে সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিন। এ কারণেই তখনকার কবিগণ মগরাজা এবং তাদের সভাসদবর্গের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আজকের এই সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকার অর্জনের মূল কাজটি করেছেন সেদিনের সেই আরাকান শাসক ও তাদের সভাসদবর্গ। সেদিন তাদের সাহিত্যানুরাগ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কবিগণের প্রতি সহানুভূতির ফল্গুধারায় অপরিসীম প্রেরণার উৎস্য রূপে অবারিত ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাজা শ্রসুধর্মার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে কবি দৌলত কাজী লিখেছেনঃ
কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী।
রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ-অবতরী।
তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে বুদ্ধাচার।
নাম শ্রীসুধর্মা রাজা ধর্ম অবতার ॥
প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভুবন।
পুত্রের সমান করে প্রজার পালন ॥
দেবগুরু পুজএ ধর্মেত তার মন।
সে পদ দর্শনে হএ পাপের মোচন ॥
পূণ্য ফলে দেখে যদি রাজার বদন।
নীরকিহ স্বর্গ পাএ সাফল্য জীবন ॥
সে সময়ের অপরাপর প্রায় সকল কবির লেখনীতেই রূপ লাভ করেছে মগরাজা ও তাদের সভাসদবর্গের এ ধরণের প্রশংসা। মগরাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে কাব্য চর্চায় নিয়োজিত কবিগণ তাদের রচনায় বিচিত্রমুখী বৈশিষ্টের পরিচয় দিয়েছেন। ড. সুকুমার সেনের মতে ওই কবিরা ছিলেন ‘ফারসি সাহিত্যের মধুকর এবং ভারতীয় সাহিত্যের রসসন্ধানী।’ এসব কবি ভারতীয় সাহিত্যের জীবন রস উৎসের সাথে ফারসি সাহিত্যের সৌন্দর্য-মধুর্য মিশিয়ে সাহিত্যে এক অভিনব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এনে একে সমৃদ্ধ করে তোলেন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের ধারায় তাদের এই প্রয়াশই প্রসিদ্ধি এনে দেয় তৎকালীন মগরাজসভাবেষ্টিত বাঙালি মুসলমান কবিদের। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা পায় তার নতুন পথে চলার গতি। কাব্য রচনায় তারা ফারসি ও হিন্দি উৎস থেকে উদ্বুদ্ধ হলেও তারা ছিলেন হিন্দু যোগদর্শন সম্পর্কে অবহিত এবং সংস্কৃত, হিন্দি ও বাংলা ভাষায়ও ছিল তাদের দখল। সম্ভবত এ কারণেই তাদের ব্যবহৃত ভাষায় আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার পরিমিত। স্বভাবতই ইসলাম ধর্ম ও তার রীতি নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন রচনায় কিংবা কবিতায় তারা আরবি ফারসি শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার করলেও অপরাপর বিষয়ে রচনার ক্ষেত্রে তারা বিশুদ্ধ সংস্কৃতগন্ধী বাকরীতি প্রয়োগ অত্যন্ত সচেতনতার সাথেই করেছেন। ওই সময়ে কবিগণের সাহিত্য সৃষ্টি ছিল প্রধানত অনুবাদভিত্তিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের স্বীয় কবি প্রতিভার স্বক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মগরাজসভা কেন্দ্রিক সেসব কবি সাহিত্যিক পণ্ডিত তাদের অনুবাদমূলক রচনাগুলোকেও হুবহু আক্ষরিক অনুবাদ না করে অনুবাদেও সুযোগমত গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে নিজস্ব কবি প্রতিভার পরিচয় যুক্ত করে বৈচিত্র এনেছেন। রেখেছেন মৌলিক কবি প্রতিভার স্বাক্ষর। বিশেষ করে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে মানবীয় প্রণয় কাহিনী বা প্রণয়কাব্য রচনার মাধ্যমে মগরাজসভার পৃষ্টপোষকতা পুষ্ট বাঙালি মুসলমান কবিগণ তাদের কবি স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে সক্ষম হয়েছেন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিশাল অঙ্গনে নিজেদের বিশিষ্ট স্থানে অধিষ্ঠিত করতে।
মোগল পাঠান সংঘর্ষে বাংলাদেশে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বহু অভিজাত মুসলমান দেশ ত্যাগ করে আশ্রয় গ্রহণ করে মগরাজ্যে, আশ্রয় গ্রহণকারী এসব মুসলমানের বেশিরভাগই ছিলেন সূফী মতবাদে বিশ্বাসী। পরবর্তীকালে তাদেরই সহযোগিতায় মগরাজ্যে আরাকান রাজসভায় আরবি-ফারসি বিদগ্ধ ও সুফী মতানুসারী কবিদের আবির্ভাব ও উত্থান ঘটে। এখানে আবির্ভূত কবিগণের মধ্যে যাদের নাম বিশেষভাবে ঊল্লেখযোগ্য তারা হলেন, দৌলত কাজী, আলাওল, মরদন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আবদুল করীম খোন্দকার প্রমুখ। মগরাজ্যে বাংলা সাহিত্যে দুটি বিশেষ ধারা ছিল লক্ষণীয় বিষয়, এর একটি হচ্ছে ধর্মীয় বিষয় অবলম্বনে রচিত সাহিত্য, অপরটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারার রোমান্টিক প্রণয়কাব্য বা প্রণয়োপাখ্যান। সে সময় ইসলাম ধর্মের ব্যাপক সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপট ও এর উপলব্ধির কারণসমূহ ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এক ধরনের ধর্মীয় কাব্য রচিত ও প্রসার লাভ করেছিল বাঙালি মুসলিম কবিদের হাতে। অন্যদিকে সামাজিক মানুষের দুঃখ, কষ্ট,বেদন, প্রেম-ভালবাসা, প্রণয়গাঁথা তথা মানবিক প্রণয়ের মর্মস্পর্শী কাহিনী বর্ণিত রোমান্টিক প্রণয়কাব্য। এ ধারায় আবার আধ্যাত্মিকতার অনুপ্রবেশ ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিশেষ করে হিন্দি ভাষায় রচিত প্রণয় কাব্যসমূহ সূফী মতবাদের প্রভাব পুষ্ট হয়ে তাতে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া আছে বলেই অনুভূত হয়।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য যখন ছিল শুধুই দেবদেবী নির্ভর,সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক মানুষের কথা যখন সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে ভাবা ছিল প্রায় অকল্পনীয়। সে সময়ে আরাকানে আশ্রিত বাঙালি মুসলমান কবিগণ রাজা এবং তাদের সভাসদবর্গের সহায়তায় বাংলা সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করে দূরহ সে বিষয়ে কাব্য রচনা করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। অর্থাৎ কয়েকজন বাঙালি মুসলমান কবি তাদের মেধা, মনন, চিন্তাশক্তি, অভিজ্ঞতার সাথে সামাজিক মানুষের জীবনকাহিনীর নানা দিকের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কাব্যের কাহিনী বিনির্মাণ করেন। দেশের বাইরে সুদূর আরাকানে বৌদ্ধ রাজাদের সভায় বাংলা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত হয়ে তাদের নির্দেশে সাহিত্য রচনা করেও তাতে চিরাচরিত প্রথা ভেঙ্গে বাংলা সাহিত্যে মানবিক প্রণয়কাহিনী রচনার মাধ্যমে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নবদিগন্তের সূচনা করেন। এ কাজটি করার মধ্যদিয়ে একদিকে বাঙালি মুসলমান কবিরা নিজেদের প্রতিভার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন কবি হিসেবে অপরদিকে বাংলা সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতায় মগরাজাদের সর্বোপরি মগরাজ্যের বিশেষ অবদানেরই স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। পরিশেষে বলা যায় মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে আরাকান রাজসভা তথা মগেরমুল্লুকের অবদান অবশ্য স্বীকার্য।

এ ছাড়া ১৭৩৬ খ্ৰীষ্টাব্দ থেকে ১৬৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দুই শতাধিক বৎসর আরাকানের স্বাধীন বৌদ্ধ রাজারা তাদের মুদ্রায় মুসলমানী নাম ব্যবহার করে এসেছে। আরো আশ্চর্য হই আমরা তখন, যখন লক্ষ্য করি যে বৌদ্ধ আরাকানী রাজার মুসলমানী নাম গ্রহণ করলেও তৎকালীন বাংলা দেশের মুসলমান রাজাদের সঙ্গে এদের বিন্দুমাত্রও সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু তবু সর্বশ্রেষ্ট ইসলাম ধর্ম এবং তার জীবন-ব্যবস্থার প্রতি তাদের অশেষ শ্রদ্ধা ছিল এবং এরই জন্যে সেনাধ্যক্ষ থেকে শুরু করে রাজ শাসনের প্রতিক্ষেত্রে তারা মুসলমান কর্মচারী নিঃসঙ্কোচে নিয়োগ করতেন। আরাকান রাজসভায় এই মুসলমান প্রভাব পরিপূর্ণ রূপ নেয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। এরই ফলে সাহিত্যে এবং সংস্কৃতি বিস্তারের প্রতিক্ষেত্রে সপ্তদশ শতাব্দীর আরাকানের ইতিহাস —মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের বাংলা সাহিত্য প্রীতির ইতিহাস হয়ে দেখা দিয়েছে এবং আলাওলই এই আরাকানী কবিদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ । আরাকানী রাজাদের পৃষ্ঠ-পোষকতায় মুসলমান কবি সাহিত্যিকগণ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। তাদের হাতে কাব্যে নূতন আদর্শ দেখা দিল । প্রাচীন কাব্যাদর্শের পরিবতন করে মুসলমান কবি অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। আর তার নির্দেশন “দৌলত কাযী তার সতী ময়ণা । ময়নাবতীর সতীত্ব, লোরের যৌবন চাঞ্চল্য ও কামনা, চন্দ্রানীর মটিপন এবং অসংযম, ছাভনের লাম্পট্য, রওনা মালিনীর ধূতত, চতুর্য ছোট ছোট ঘটনা প্রবাহে ফুটিয়ে তুলেছেন কাব্য ধারার নতুন এক দিক।

সূত্রঃ বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি ও কাব্য—অধ্যাপক এ,কে,এম,আমিনুল ইসলাম।

No comments:

Post a Comment