Tuesday 27 December 2016

অখন্ড ভারত বলতে কিছু নেই।


মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই  ব্রাহ্মণ্যবাদের দাসত্ব করতে চায় না।

যারা অখন্ড ভারতের কথা বলে তারা মুলত মুসলমানদেরকে ভারতীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের গোলাম বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ।

সূফি বরষণ ।

ভারত মূলত কোনো দেশের নাম নয়, এরা কোনো একক জাতিও নয়..।  ভারত হচ্ছে সিন্ধু ,গঙ্গা ও যমুনা  নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা একটি উপমহাদেশের নাম। নানান ধর্মের নানান জাতের নানা ভাষা-ভাষী মানুষের অঞ্চল, বৃটিশরাই সর্বপ্রথম ভারতীয় উপমহাদেশকে একসাথে করে, তবে সে সময়ও হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীরসহ অনেক স্বাধীন রাজ্য ছিল। অর্থাত আক্ষরিক অর্থে ব্রিটিশ ইন্ডিয়াও অখন্ড ছিল না। মুসলিম শাসনামলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাতে স্বাধীন সুলতানি শাসন ছিল। ভারত কোনো কালেই অখন্ড ছিলনা । তবে অধিকাংশ রাজ্য আকার ও আয়তনে ছোট হলেও হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর ছিল ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী।

মুঘলদের শাসনটা ছিল মূলত উত্তর ভারত ও পাকিস্তান কেন্দ্রিক। টিপু সুলতান দক্ষিন ভারত শাসন করেছে। গুজরাটে, আসামে আলাদা মুসলিম রাজ্য ছিল। মুসলমানদের আগমনের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশ নানা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল এবং আলাদা আলাদা রাজা দ্বারা শাসিত হত। মহারাষ্ট্র স্বাধীন দেশ ছিল তারা বাংলাতে লুটপাট করতে আসত। যেমন সেই লুটপাটের কাহিনী নিয়ে ছড়া আছে, খোকা ঘুমালো পাড়া জোরালো বর্গী এলো দেশে। এই বর্গী হলো অত্যাচারী হিন্দু ডাকাত মহারাষ্ট্র হিন্দুরা ।

 কেরালা-তামিল নাড়ু সবসময়ই স্বাধীন ছিল। মনিপুর-মিজোরাম এরাও স্বাধীন রাজ্য ছিল। মূলত অখন্ড ভারতের স্লোগান হচ্ছে প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশগুলোকে গ্রাস করার স্লোগান। আর ভারতের যেসব অঞ্চল স্বাধীন হতে চায় তাদেরকে ধরে রাখার একটা চেষ্টা। ঐতিহাসিকভাবে হাজার বছরের অখন্ড ভারত বলে কিছু নাই। ব্রিটিশদের অধীনস্ত ইন্ডিয়ার কথা বাদ দিলে অখন্ড ভারতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতেও অখন্ড ভারত বলে কিছু হবে না, মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় ব্রাহ্মণ্যবাদের দাসত্ব করতে চায় না।

অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছেন, “ভারত অবশ্যম্ভাবীভাবে তার আধিপত্য বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত হবে সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ছোট জাতি রাষ্ট্রগুলোর সর্বনাশ ঘটবে। তার সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকবে না।” থাকবে ভারত মাতার অধীনে।

মোটামুটি এটাই ছিল ভারতের স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর বহুল প্রচলিত ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’, যা নেহেরু ডকট্রিন নামেও পরিচিত।
Nehru’s India Doctrine says:

“India will inevitably exercise an important influence. India will also develop as the centre of economic and political activity in the Indian Ocean area. The small national state is doomed. It may survive as a culturally autonomous area but not as an independent political unit.” Now it makes sense of why and how Hydrabad, Kashmir, Goa, and Sikkim were made part of India. Why there has been deep Indian RAW involvement in Sri Lanka, Maldives, Nepal and in Bangladesh.?

 ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত তার ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইয়ে এর প্রথম আভাস পাওয়া যায়। মূলত ‘অখন্ড ভারত’ ধারণা থেকেই এর উদ্ভব, এবং একে একে কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, সিকিম এবং নেপালের মাওবাদ, শ্রীলংকার তামিল টাইগার বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের ১৯৭১ এর যুদ্ধ । এবং তার পর থেকে বাংলাদেশে অযাচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইন্ডিয়া ডকট্রিন তার স্বরূপ উন্মোচন করছে সবার সামনে; বছর কয়েক আগে নেপালের তরাই অঞ্চলের গণভোট এবং এর পরবর্তী জ্বালানী অবরোধও এর বাইরে নয়।

প্রাচীণ ভারতবর্ষের মহামতি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধাণ অমাত্য কৌটিল্য, যিনি চানক্য নামেই সুপরিচিত, তার একটি শিক্ষা ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের জন্য – “ক্ষমতা অর্জনের লোভ ও অন্য দেশ বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনও মন থেকে মুছে ফেল না। সব সীমান্তবর্তী রাজাকে শত্রু বলে মনে করবে।” হাজার বছর পর এসেও কি এই মূলনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত ? এখন সবার মনে একই প্রশ্ন?।

তার আগে আমাদেরকে জেনে নেয়া অতিজরুরী ব্রাহ্মণবাদকি? এরা নিজেদের পরিচয় দেয় সুপিরিয়র উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ? “শোষণের জন্যই শাসন-এই সনাতন মূলনীতির মূলাধার ব্রাহ্মণ্যবাদ । শোষণকে প্রচ্ছন্ন করতে হলে শাসনকে একটা আদর্শের নামে খাড়া করতে হয়”। –

এই শোষণের আদর্শের নামই ব্রাহ্মণধর্ম। তাই ব্রাহ্মণধর্ম কোন ধর্ম নয়, ব্রাহ্মণধর্ম হল আসলে একটি অপরাধের নাম, মানুষকে শোষণের হাতিয়ারের নাম। মানুষে মানুষে বিভাজন জাতপ্রথা বর্ণপ্রথা তৈরী করে মানুষদের শোষণের নাম, ব্রাহ্মণদের উচ্চ ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করার নাম। প্রশ্ন হলো যারা নিজের ধর্মের মানুষদেরকে জাতপ্রথা তৈরী করে শোষণ নির্যাতন অত্যাচার করে। তারা কিভাবে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ এবং জৈন ধর্মের মানুষকে আপন মনে করে বুকে জড়িয়ে নিবে? যারা নিজের ধর্মের মানুষকে ভাই হিসেবে বুকে জড়িয়ে নিতে পারে না?। ছুঁলেই যাদের জাত যায়!?

আমরা যে ভারতের কথা অহরহ উচ্চারণ করি সেই দেশটি সাংবিধানিকভাবে ভারত হিসাবে স্বীকৃত। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ইন্ডিয়া এলো কোথা থেকে। ইন্ডিয়া কখনো ভারতের নাম ছিল না। ইংরেজ আমলে দেশটির এ নাম দেয়া হয়। ইন্ডাস বা সিন্ধু থেকে ইন্ডিয়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। আবার সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দটি এসেছে। হিন্দুরা ইন্ডিয়া নামের কোনো দেশকে স্বীকার করে না। তাদেরকে এ নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্যদিকে মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ও বিষ্ণু পুরাণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত হওয়ায় ভারত বা ভারতবর্ষ নামটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আত্মার।

বর্তমান সময়ে ভারত বরবারই মতোই অখণ্ড ভারত কায়েম করতে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে । মৌর্য সম্রাট অশোক-পূর্ব ভারত কায়েম তাদের লক্ষ্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরং, শিব সেনা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করছে। অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অখণ্ড ভারতের ধারণা হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত আবেগময় এবং তাদের অস্তিত্বের অংশ। ভারত বিভক্তি তাদের কাছে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা।



নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে সংঘ পরিবারের ২০ হাজার স্কুলে পাঠ্য ভূগোল বইয়ের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয় এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।

শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে এক্সপ্লেইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে, "The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof."
অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে ততদিন শান্তি আসবে না।


অখণ্ড ভারত কায়েমের দূরভিসন্ধি থেকে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। অখন্ড ভারত গঠনের আদর্শ সাঙ্গাথান (হিন্দু ঐক্য) এবং শুদ্ধি (বিশুদ্ধিকরণ) ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। আরএসএস নেতা এইচভি সেশারদির দ্য ট্রাজিক স্টোরি অব পার্টিশন শিরোনামে গ্রন্থে অখন্ড ভারত গঠনের ধারণার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থে সে লিখেছে, “Whenthe new viceroy Lord Mountbatten announced on 3rd June, 1947 theplan of transfer of power, it came as a stunning blow to the people. For thatplan, approved by Nehru and Patel, had envisaged cutting up Bharat and creationof Pakistan.The great and trusted leaders of Congress had turned their back on the sacredoaths they had taken and the pledges they had administered to the people. Whattook place on August 15, 1947, was this gross betrayal of the nation’s faith,the betrayal of the dreams of countless fighters and martyrs who had plungedinto the fire of freedom struggle with the vision of Akhanda Bharat in theirhearts.”
অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৩ জুন নয়া ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। তার এ ঘোষণা জাতির কাছে একটি মারাত্মক আঘাত হিসাবে বিবেচিত হয়। নেহরু ও প্যাটেল অনুমোদিত এ পরিকল্পনায় ভারতকে দ্বিখন্ডিত এবং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব দেয়া হয়। কংগ্রেসের মহান ও বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ তাদের পবিত্র ওয়াদা এবং জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে পিঠটান দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনা ছিল জাতির বিশ্বাসের সঙ্গে একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং হৃদয়ে অখন্ড ভারত কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে যেসব অগণিত যোদ্ধা ও শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের স্বপ্নের সঙ্গে বেঈমানী।

এবার ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অখন্ড ভারত' প্রতিষ্ঠার লালসা নিয়ে কিছু কথা: আমরা যদি গত চার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব সব সময় ব্রাহ্মনরা বৌদ্ধদের জৈনদের নানা অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আর্য-ব্রাহ্মনরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসে এবং হিন্দুধর্ম চালু করে। হিন্দুধর্ম চালু করলেও কর্তিত্বটা আর্য-ব্রাহ্মণদের হাতে রেখে দেয়া হয়, নিয়ম করা হয় স্বর্গে যেতে হলে ব্রাহ্মণদের আনুগত্য করতে হবে। বৌদ্ধরা এবং জৈনরা আর্যদের তৈরী করা এই ধর্মের সমালোচনা শুরু করে, নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। শুরু হয় বৌদ্ধদের-জৈনদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন, লাখ লাখ বৌদ্ধ এবং জৈনকে হত্যা করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের ক্ষমতা গ্রহনের আগ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের লোকদের উপর জৈন ধর্মের লোকদের উপর এই অত্যাচার-নির্যাতন চলতে থাকে।
রাজা অশোক উড়িষ্যাতে এক লাখ (মিলিয়ন নয়) বৌদ্ধকে হত্যা করেছিল, পরবর্তিতে রাজা অশোক এই অনুশোচনায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। রাজা শশাঙ্ক তার শাসনামলে ঘোষণা করেছিল যেখানে বৌদ্ধ পাবে সেখানেই হত্যা করবে। সেন শাসনামলে বৌদ্ধদের উপর আবার অত্যাচার-নির্যাতন নেমে আসে।

সেন শাসনামলের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে বৌদ্ধরা মুসলমানদের সাহায্য চায় ফলে বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয়ে এগিয়ে আসে। উত্তর ভারতীয় অঞ্চল, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা যেখানেই মুসলমানরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছে বৌদ্ধরা এবং জৈনরা মুসলমানদেরকে সহযোগিতা করেছে। মুসলমানদের ক্ষমতা গ্রহনের মধ্য দিয়ে আর্য-ব্রাহ্মনদের অত্যাচার-নির্যাতন, জোর করে বৌদ্ধদেরকে হিন্দু বানানোর প্রচেষ্টা বন্ধ হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনে যেভাবে বৌদ্ধরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তেমনিভাবে ব্রিটিশদের আগমনে ব্রাহ্মণরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণদেব নবাব সিরাজ উদ দৌলা থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে সমগ্র ভারতবর্ষই মুসলমানদের থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। শুরু হয় গোলামির জীবন, বৌদ্ধদের মুক্তিদাতা মুসলমানরা এবার নির্যাতিত হতে থাকে। একদিকে ব্রিটিশ একদিকে ব্রাহ্মণ দুয়ে মিলে মুসলমানদের উপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন চলে সেটা থেকে আজাদী আসে ১৯৪৭ সালে।

কিন্তু মুসলমানরা বৌদ্ধদের মত হারিয়ে যায়নি, ধর্মও পরিবর্তন করেনি কিংবা অন্য দেশেও চলে যায়নি- বরং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, একশত বছর ভারতীয় উপমহাদের বীর মুসলিমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ১৯৪৭ আগে পাকিস্তান আন্দোলনের সফলতার মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয়। সেই পরাজয়ের ব্যাথায় আর মুসলমানদের শোষণ করা নেশায় এখনও শুকুনের বাংলাদেশের উপরে নজর দিয়ে রেখেছে।
 



দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো ভারতীয়দের চক্ষুশূল। ভারতের কংগ্রেস পার্টি কখনো দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন কংগ্রেস এক প্রস্তাবে বলেছিল, ”Geographyand mountains and sea fashioned India as she is and no human agency can changethat shape or come in the way of her final destiny. Once present passions hadsubsided the false doctrine of two nations will be discredited and discarded byall.”
অর্থাৎ ভূখন্ড, পর্বত ও সমুদ্র ভারতকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে এবং কোনো মানবীয় শক্তি ভারতের এ আকৃতি পরিবর্তন অথবা তার চূড়ান্ত ভাগ্যের পথে অন্তরায় হতে পারে না। বর্তমানে বিরাজিত মিথ্যা দ্বিজাতি তত্ত্বের আবেগ একদিন থিতিয়ে আসবে এবং সবাই তা পরিত্যাগ করবে।

কংগ্রেস ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা করেছে। মুসলিম লীগের মতো সংখ্যালঘু  মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করলে তারাও দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক হতো। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করার অর্থ ভারতে একটি মাত্র জাতি ছাড়া আর কোনো জাতির বসবাসের অধিকার নেই। এ ধরনের মানসিকতা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও অস্তিত্ব অস্বীকার করার শামিল।      
   
ভারতীয় উপমহাদেশ পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর বসতিস্থল হলেও এখানে একটি মাত্র জাতির শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্যণীয়। বিশুদ্ধ আর্য জাতির দাবিদার এ জাতি ভারতের তিন-চতুর্থাংশের ওপর নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং উপমহাদেশের বাদবাকি অংশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের অশুভ চক্রান্তে নিয়োজিত রয়েছে। ভারতীয়দের কাছে ভারত হলো মায়ের মতো অবিভাজ্য। ব্রিটিশদের বিদায় করার স্বার্থে তারা সাময়িকভাবে ভারত বিভক্তি মেনে নিয়েছিল। পরবর্তী কার্যকলাপে ধরা পড়ে যে, অখন্ড ভারত কায়েম করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে এক জাতিতে বিশ্বাসী এ শক্তি ধীরে ধীরে উপমহাদেশকে গ্রাস করছে। তাদের আগ্রাসী থাবায় দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর ভবিষ্যৎ বিপন্ন। সুদূর অতীতকাল থেকে তারা অখন্ড ভারত কায়েমের স্বপ্ন লালন করছে। বিগত ও চলতি শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার অশান্তির মূলে রয়েছে ভারত।

দেশটি প্রতিটি প্রতিবেশি বিশেষ করে ক্ষুদ্র প্রতিবেশিদের জন্য বরাবরই নিজেকে একটি হুমকি হিসাবে প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলেও বুঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই সব। অন্য দেশগুলো তার ইচ্ছার কাছে জিম্মি। দক্ষিণ এশিয়াকে পদানত করতে ভারত প্রাচীন চানক্য নীতি অনুসরণ করছে। ভৌগোলিক সম্প্রসারণ হচ্ছে চানক্য নীতির মূল লক্ষ্য। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিদায় লগ্ন থেকে অখন্ড ভারত কায়েমে ভারতের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ শুরু হয়। ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের। তাছাড়া উদ্ধৃতিতে তিনটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক, কেন কেবল উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করল? তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে কারণে হিন্দু শাসনামলের অবসান হয়ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্টিত হয়েছিল, সেই একই কারণে দেশ বিভক্তির সাথে সাথে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল।

,দেশ বিভক্তির ফলে ভারত হতে প্রচুর সংখ্যক মুসলমান পাকিস্তানে চলে এসেছিল, সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবার কারণ কী? তাতে কি এটা স্পষ্ট হয় না ব্রিটিশদের উস্কানীতে মুসলিম নিধনের যে বেগ হিন্দুদের মধ্যে তৈরী হয়েছিল সেখানে মুসলমনরা নিরাপদ নয়? কারণ অবিভক্ত ভারতে হিন্দুদের প্রাধান্য। ফলে মুসলমানরা কি সেখানে কখনো নিরাপদ হত? যেমন ১৯৮৪ সালে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ত্রাস; ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (প্রতিচিন্তা:১০৮) এবং ২০০৬ সালে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলিম হত্যা কি প্রমান করেনা ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তি ঠিক ছিল?

১৯৪৭ সালের ১১ জুলাই প্রণীত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি পায়নি বহু দেশীয় রাজ্য। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টে বলা হয়েছিল, দেশীয় রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো হয়তো ভারত নয়তো পাকিস্তানে যোগদান করতে পারবে। অথবা স্বাধীন থাকতে পারবে। কিন্তু এ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গোয়ালিয়রে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে নেহরু ঘোষণা করে যে, যেসব দেশীয় রাজ্য ভারতের গণপরিষদে যোগদানে অস্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে বৈরি হিসাবে ঘোষণা করা হবে। সে এ ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত একটির পর একটি দেশীয় রাজ্য গ্রাস করে। এসব দেশীয় রাজ্য গ্রাসে ভারত যখন যেমন তখন তেমন নীতি অনুসরণ করে নিজের সীমানা সম্প্রসারিত করেছে।

১৯৪৭ সালের ২৫ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশীয় রাজাদের এক সমাবেশে বলে, তাদের রাজ্যগুলো টেকনিক্যালি ও আইনগতভাবে স্বাধীন হলেও কিছু ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে রাজাদের নিজস্ব শাসন বজায় রাখতে ভারত ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরে তাদের পরামর্শ দেয়। মাউন্টব্যাটেন ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা বলতে আসলে ভারত সংলগ্ন দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিল। সে দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছিল। অধিকাংশ রাজ্য আকার ও আয়তনে ছোট হলেও হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর ছিল ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী।

শক্তিপ্রয়োগ করা না হলে কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতো। নয়তো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭ সালে চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে এসব রাজ্য সফর করে পরিস্থিতিতে ঘৃতাহুতি দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ গোলযোগপূর্ণ রাজ্যগুলো সফর করা থেকে বিরত থেকে নিজেদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনে।

দুর্বল দেশীয় রাজ্যগুলো গ্রাসে ভারত কোনো ন্যায়নীতির তোয়াক্কা করেনি। শক্তি ও কূটকৌশল ছিল দেশটির বিজয়ের একমাত্র চাবিকাঠি। ভারত শুধু অন্যায়ভাবে দেশীয় রাজ্য গ্রাস করেছে তাই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোতেও দেশটি বারবার হস্তক্ষেপ করেছে এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে গলাটিপে হত্যা করেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ভারতকে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, পাকিস্তান একটি সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশদের সৃষ্ট কৃত্রিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান নয় বরং ভারতই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলে সে দেশে গুজরাট স্টাইলের দাঙ্গা হওয়ার কথা ছিল হাজারে হাজার। কিন্তু শিয়া-সুন্নিতে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হলেও আজ পর্যন্ত দেশটিতে হিন্দু বিরোধী একটি দাঙ্গাও হয়নি। ব্রিটিশরা পক্ষপাতিত্ব করে থাকলে করেছে ভারতের প্রতি। পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হলে জন্মু ও কাশ্মীর, পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতের ত্রিরঙ্গা পতাকা উড়তো না। তাছাড়া ৪৭ এ দেশ বিভক্তির সময় পশ্চিম ও পূর্ব বঙ্গের মানুষেরা নিজস্ব সং¯কৃতির জন্যই দেশ বিভক্তির পক্ষে রায় দিয়েছিল। এই দীর্ঘ দিন পরেও একত্র করার পক্ষে কোন প্রস্তাব উঠেনি জোরালো ভাবে। তাছাড়া পশ্চিম বঙ্গের মানুষ বাঙালি পরিচয় দিয়ে সুখ বোধ কওে না, ভারতীয় পরিচয়ে স্বাছন্দে বোধ করে। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা প্রতিবাদ করেনি কাটা তারের বেড়ার। প্রবেশ করতে দেয় নি বাংলাদেশী কোন টিভি চ্যানেল। একই হৃদয়ের মানুষ হলে প্রতিবাদ করত বিভিন্ন নদীতে যে বাঁধ নির্মিত হচ্ছে তার। কিন্তু কিছুই হয়নি। মনে রাখা ভাল সিংহ হয়ে জন্মে চিড়িয়াখানায় থাকার চেয়ে ইঁদুর হয়ে স্বার্ধীন ভাবে মাথা উচু করে আত্মমর্যদাশীল হয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভাল। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করেই নয় তা হচ্ছে ইতিহাস সংগ্রহের মাধ্যম দেখে। আমরা যদি পশ্চিমাদের লিখিত ইতিহাস পাঠ ও তাদের নির্দেশনায় লিখিত ইতিহাসের উপর নির্ভর করি, তবে আমরা কোন দিন নিজস্ব পরিচয় খুঁজে পাব না। পরিশেষে একথা বলতে চাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর, সংস্কৃতির, ঐতিহ্যের এবং শাসনামলের প্রকৃত ইতিহাস নিজেরাই রচনা করে স্বাধীন বাংলাদেশকে পরাধীন না করে সত্যিকারের স্বার্থক স্বাধীনতা অর্জন ও উপভোগের প্রয়াস চালাব। এই হউক আমাদের দ্বীপ্ত শপথ।

No comments:

Post a Comment