বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভারতের গুপ্তচরসংস্থা র’এবং মার্কিনী সিআইয়ের গোপন ভূমিকা।
অশোক রায়না রচিত Inside R&AW ও বি. রমন রচিত The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane নামক দুটো বইয়ে বেশ খোলা মেলা আলোচনা আছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে । তবে বইয়ের মধ্যে অনেক ভুল তথ্য বা প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন দুজনেই তাই বইয়ের তথ্য ক্রসচেক করে পড়া জরুরী ।
পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা হয় ভারতে। এ ব্যাপারে শুধু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’এর কর্মকর্তারারই শুধু মুখ খুলেনি, মুখ খুলেছে বাংলাদেশের বহু নেতাও। যেমন এক কালের নেতা ও পরবর্তীতে জাতীয় লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ বলেন, “১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আব্দুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদী অবগত হই।
ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন।”-(অলি আহাদ)। ইতিহাসের নামে যে মিথ্যাচার ছড়ানো হয়েছে তা হল, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলতঃ মুক্তিবাহিনীর অবদান। ভারতের নাম তারা সহজে মুখে আনতে চায় না। ইতিহাসের পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারগণ কে কথায় লড়াই করেছেন সে বিবরণ থাকলেও ভারতীয় বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য কোথায় কি ভাবে যুদ্ধ করলো তার সামান্য বিবরণও নেই। বিবরণ নেই ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর ভূমিকার। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কোন উল্লেখ সে যুদ্ধে কতজন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর অবদান অবশ্যই আছে, তবে তারাই মূল নয়।
সত্য হলো, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৯ মাসে পুরা বাংলাদেশ দুরে থাক একটি জেলা, একটি মহকুমা বা একটি থানাও মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। মূল লড়াই লড়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনী। তবে ভারত শুরু থেকেই একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অপরাধ নিজ কাঁধে নিতে চায়নি। কারণ এটি আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। তাছাড়া এমন কাজ তখন অন্যদেরও বৈধতা দিবে ভারত-ভাঙ্গার কাজে অংশ নেওয়ার। ইতিহাসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এ ভয়ে নিজেদের অর্থ, অস্ত্র ও লোকবলদ্বারা পরিচালিত পাকিস্তান ভাঙ্গার এ যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে আগে । আর এখন সরাসরি বলছে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়নি বরং যুদ্ধ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে ১৯৯৭১ সালে!?? ভারত এমন একটি রাষ্ট্র যাদের মিথ্যাচার প্রতারণা ও মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মনোভাব রক্তে মিশে আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে র’এর কর্মকর্তাগণ কি ভাবেন সেটি দেখা দরকার।
ভারতীর গুপ্তচর সংস্থা র’এর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিষ্টার বি. রমন লিখেছেনঃ “The R&AW’s success in East Pakistan, which led to the birth of Bangladesh, would not have been possible without the leadership of Kao and the ideas of Nair,”- (B.Ramon, 2007)। মিষ্টার বি. রমন যা লিখেছেন তা থেকে একথা সুস্পষ্ট, র’এর সফলতাই জন্ম দেয় বাংলাদেশের। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে তৎকালীন র’এর দায়িত্বশীল মি. কাউ ও মি নায়ারের সফল নেতৃত্ব ও পরিকল্পণার কারণে। বাংলাদেশের সেকুলার পক্ষটি র’এর ভূমিকার কথা মুখে আনে না। কারণ তারা নিজেরাও জানে এ সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে আজ হোক কাল মুসলিম ইতিহাসে তারা কুলাঙ্গার রূপে চিত্রিত হবেই। কারণ ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশের গুপ্তচর সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টতা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্য সুনাম বয়ে আনে না।
এজন্য ইসলামের যেসব চিহ্নিত শত্রুরা ইরাক, আফগানিস্তানে ও কাশ্মীরে আজ উৎসব ভরে গণহত্যা চালাচ্ছে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকার কথা তারা মুখেই আনে না। অথচ তাদের ভুমিকাই ছিল চুড়ান্ত। এ ব্যাপারে মিষ্টার বি. রমন তার বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’–তে লিখেছেনঃ
“The IB (Intellegence Bureau) before 1968 & the R&AW thereafter had built up a network of relationship with many political leaders and government officials of East Pakistan. The networking enabled the R&AW and the leaders and officials of East Pakistan to quickly put in position the required infrastructure for a liberation struggle consisting of a parallel government with its own fighters trained by the Indian security forces and its own bureaucracy. .. The only sections of the local population, who were hostile to India and its agencies, were the Muslim migrants from Bihar.” -(B.Ramon, 2007)
মিষ্টার বি. রমনের কথায় এটি সুস্পষ্ট, একাত্তরে যা ঘটেছে তার পরিকল্পনা একাত্তরে হয়নি। হয়েছে অনেক আগে। পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা আইবি এবং ১৯৬৮এর পর র’ ষাটের দশকের শুরু থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মচারিদের দিয়ে তারা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং অবকাঠামো গড়ে তোলে। এমনকি ট্রেনিং দেওয়ার কাজও শুরু করে। একাত্তরে নয়, বরং তার আগে ১৯৬২ সালেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা Director of Intelelligence Bureau (DIB) জানতে পারে যে কোলকাতার ভবানীপুর এলাকার একটি বাড়ীতে - যা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনাল সদর দফতর,সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। -(মাসুদুল হক)।
মিষ্টার বি. রমনের লেখা থেকে এটি প্রমাণিত হয়, পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট আদৌ মিথ্যা ছিল না। এ গোপন পরিকল্পনা মোতাবেক মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি রূপে দেখা ভারতের কাম্য ছিল না। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের পিছনে তারা যে পুঁজি বিণিয়োগ করেছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা, শেখ মুজিবকে অখন্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা নয়। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলে মিষ্টার বি. রমনের কথা মত র’ যেভাবে পূর্বপাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা এঁটেছিল তা কি সফল হত? তখন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার পক্ষ থেকে মুজিব ময়দানে একা খেলছিলেন না,খেলছিল আর অনেকেই। ছাত্রলীগের নেতৃপর্যায়ে এদের পাল্লাই ছিল ভারি। তাদের দায়িত্ব ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে তিনি র’এর সে পরিকল্পনা থেকে যেন একটুও বিচ্যুত না হন। বস্তুতঃ শেখ মুজিব তখন চলে গিয়েছিলেন তাদেরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
তখন তার পক্ষে র’এর কাছে কৃত ওয়াদা থেকে পিছূটান দেওয়ার সামান্য সুযোগও ছিল না। বহু আগেই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল। মুজিবের কাজ ছিল বিনা প্রতিবাদে তাদের অনুসরণ করা। মুজিব সেটি করেছিলেনও। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আপোষে শেখ মুজিবের আদৌ কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ এতে আগ্রহ ছিল না ভারতের। আর ভারতের যাতে আগ্রহ নেই তাতে মুজিবেরই বা আগ্রহ সৃষ্টি হয় কি করে? ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সাথে মুজিবের আলোচনা এজন্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। এমন আলোচনাকে তারা স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী মনে করে।
এনিয়ে আওয়ামী-বাকশালী শিবিরে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু এ বিষয়ে অতিশয় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্গতি হলো তাদের, যারা মনে করে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে স্বৈরাচারি ইয়াহিয়ার ভূলের কারণে। যেন মুজিব ও তার আওয়ামী-বাকশালী চক্র পাকিস্তান রক্ষার জন্য দু’পায়ে খাড়া ছিল!
স্বৈরাচারি ব্যক্তির ক্ষমতায় আসা বা গণতন্ত্র-দুষমন দুর্বৃত্তদের রাজনীতির কর্ণধার হওয়া কোন দেশেই অসম্ভব নয়। বিশ্বের বহু দেশেই সেটি হয়।একাত্তরের পর বাংলাদেশে সেটি বার বার হয়েছে। কিন্তু সে জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ সে দেশের মানচিত্র কর্তনে হাত দেয় না। এমন কাজ একমাত্র বিদেশী দুষমনদের হাতেই হতে পারে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র-বিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু হয় দেশটির প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এরপরও ধৈর্যের সাথে দেশ গড়ার চেষ্ঠা করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন, জনাব মোহম্মদ আলী বগুড়া ও জনাব সোহরাওয়ার্দ্দী অপসারিত হয়েছেন, সামরিক আইন জারি হয়েছে এবং দেশের শাসনতন্ত্রও রহিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুরা, সোহরাওয়ার্দি বা অন্য কোন নেতাই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে নামেন নি। এমনকি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ও নয়।
কিন্তু একাত্তরে দেশের রাজনীতি আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে নি। সেটি দখলে চলে যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর হাতে। বি. রমনের বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’ বা অশোক রায়না রচিত Inside R&AW সে কিচ্ছাতেই ভরপুর। ভারতের স্ট্রাটেজিক লক্ষ্য হল, বিশ্বের দরবারে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ। সে কথার স্বীকারোক্তি এসেছে মি. রমনের বইতে। তিনি এক্ষেত্রে র’এর ভূমিকার কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
An emerging power such as India, which is aspiring to take its place by 2020 among the leading powers of the world, has to have an external intelligence agency which has the ability to see, hear, smell and feel far and near. (B.Ramon, 2007).
১৯৬২ সালে চীনের হাতে অপমানজনক পরাজয়ের পর সে স্বপ্নে ভাটা পড়ে। এরপর ১৯৬৫এ পাকিস্তান পরাজিত করতে না পারায় সে পুরোন অপমান থেকেও পরিত্রাণ মেলেনি। এরপর মনযোগী হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে। শেখ মুজিব মূলতঃ ব্যবহৃত হয়েছে সে লক্ষ্য পূরণে। তবে ভারতের লক্ষ্য নিছক পাকিস্তানের শক্তিহানী নয়, সেটি উপমহাদেশে মুসলমানদের শক্তিহানী। এজন্যই একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বাংলাদেশের আর্মির হাতে পোঁছতে দেয়নি।
সব কিছু কুড়িয়ে তারা নিজ দেশে নিয়ে যায়। তাদের ভয়, পাকিস্তানের ন্যায় বাংলাদেশেরও যদি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায় তবে সে খড়গ তাদের ঘাড়ে পড়বে। তাই তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই সতর্ক।ভারত চায় নিঃশর্ত আনুগত্য। তাই ভারতীয় আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হওয়াটাই অপরাধ। মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ সেটি ভাল করেই বোঝে। একারণেই, আওয়ামী লীগ ভারতে মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করে না। তারা নিশ্চুপ কাশ্মীরে ভারতীয় অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অধিকৃত কাশ্মীরকে বিতর্কিত এলাকা বললে কি হবে, আওয়ামী-বাকশালী মহল সেখানে ভারতীয় আধিপত্যবাদকেই জায়েজ বলে মেনে নেয়।
১৯৬২এর ১৩ অক্টোবর চীন ভারতকে কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্ত থেকে তার সৈন্য অপসারণের দাবী করে। ভারত সে দাবী মেনে না নেওয়ায় ১৯৬২ এর ২০ই অক্টোবরে হামলা করে। ২০শে নবেম্বরের মধ্যে লাদাখ এলাকার দুই হাজার বর্গমাইল এবং তিব্বত সীমান্তের NEFA এলাকার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দখল করে নেয়। ২৮ শে অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আইউব খানকে ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বলে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, চীন তখনও মার্কিন বিরোধীতার কারণে জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি। পাকিস্তান সদস্য পদ লাভে চীনকে জোড়ালো সমর্থণ করে। পেশোয়ারের কাছে ছিল সিআইয়ের গোপন ঘাটি, সেখান থেকে CIA U-2 গোয়েন্দা বিমান পাঠাতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে। পাকিস্তান সে ঘাঁটিও বন্ধ করে দেয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচন্ড ক্রোধ চাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। অপর দিকে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্তে যুদ্ধে চীনের হাতে পরাজয়ের পর ভারতও প্রতিশোধের পরিকল্পনা নেয়। এবং সেটি যতটা না চীনের বিরুদ্ধে তার চেয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। পরিকল্পনা নেয় পাকিস্তানের অঙ্গহানির। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা নেয় আইয়ুব খানের অপসারণের ও পাকিস্তানকে দূর্বল করার।-(মাসুদুল হক)
তখন র’ এবং সিআইএ –উভয়েরই প্রয়োজন পড়ে রাজনীতির ময়দানে খেলোয়াড়ের। আর সে শূন্যতা পূরণ করে শেখ মুজিব। তখন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পাকিস্তানের রাজনীতির ময়দানে তাকে খেলোয়াড় রূপে বেছে নেয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রেয়ারিতে লাহোরে আইয়ুব বিরোধী দলসমুহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জনাব নুরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন এনডিএফ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগ সে সম্মেলনে যোগ দেয়। তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের নবাবজাদা জনাব নাসরুল্লাহ খান। এ সভায় শেখ মুজিব হঠাৎ করেই ৬ দফা পেশ করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছের বিষয়টি বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সাংবাদিক মাসুদুল হকের কাছে এক সাক্ষাতকারে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরি বলেন, ”লাহোর যাত্রার প্রাক্কালে এমনকি লাহোরে গিয়েও এ সম্পর্কে মুজিব আমাদের সঙ্গে আলাপ করেননি। আমরা জানতাম না মুজিব এ ধরনের প্রস্তাব তুলবে।” -(মাসুদুল হক)
এর পর আওয়ামী লীগ ৬ দফাপন্থি এবং ৬ দফা বিরোধী দুই খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৭ জেলার মধ্যে ১৪ জেলা সভাপতি ৬ দফার বিরোধীতা করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে। কিন্তু কে এবং কিভাবে ৬ দফা রচনা সে রহস্যের আজও সমাধা হয়নি। পাকিস্তানের গোয়ান্দা বিভাগ ডিআইবি এটিকে সিআইয়ের চাল হিসাবে মনে করে। ভাষানীপন্থি ন্যাপও সেটিই মনে করে। সে সময় ঢাকায় মার্কিন কনস্যাল জেনারেল ছিলেন মিষ্টার ব্রাউন। তিনি একই সাথে সিআইয়ের ষ্টেশন চীফেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সাথে শেখ মুজিব ও ছাত্রলীগের একাংশের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। সে সময় মার্কিন কনসালে আরেক কর্মকর্তা ছিলেন কর্নেল চিশহোস। চিশহোসের বাসায় মাঝে মাঝে পার্টি দেওয়া হত। এসব পার্টিতে বাছাই করা রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা ও পদস্থ বাঙ্গালী কর্মকর্তাদেও দাওয়াত দেওয়া হত। এভাবে একদিনে ভারতীয় র’এর তৎপরতা যেমন চরম আকার ধারণা করেছিল তেমনি তৎপরতা বেড়েছিল মার্কিন সিআইয়ের। পরে পাকিস্তান সরকার কর্নেল চিশহোসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং দেশ থেকে বহিস্কার করে দেয়। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা এ,টি,এস,সফদর জানান,
শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন তেজগাঁও বিমান বন্দরে লাহোরগামী বিমানে উঠার আগে ৬ দফা প্রস্তাবের একটি টাইপ করা কপি রুহুল কুদ্দুস নামে একজন সিএসপি অফিসার তার হাতে তুলে দেন। উল্লেখ্য যে রুহুল কুদ্দুস ছিলেন আগড়তলা মামলার একজন আসামী এবং শেখ মুজিবের ইনার সার্কেলের লোক।-(মাসুদুল হক)।
সাপ্তাহিক মেঘনার (১৬/১২/৮৫) সাথে এক সাক্ষাতকারে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল মালেক উকিল বলেন, ৬ দফা তিনি প্রথম দেখেন একটি টাইপকরা কাগজে শেখ মুজিবের পকেটে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কনভেনশনে যাওয়ার পথে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা হলো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একাত্তরের ঘটনাবলী, পাকিস্তান ভাঙ্গা ও বাংলাদেশের সৃষ্টি - এসবের শুরু হয় মূলতঃ ৬ দফা থেকে। অথচ এটির প্রণয়নে শেখ মুজিব নিজদলের নেতাদের সাথেও কোনরূপ পরামর্শ করেননি। এটি প্রণয়নের প্রাক্কালে কোন দলীয় সম্মেলন বা পরামর্শ সভাও হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সেটিই প্রথাসিদ্ধ রীতি। কিন্তু সেটি প্রণিত হয় রুহুল কুদ্দুসের ন্যায় একজন সন্দেহভাজন চরিত্রের মানুষের দ্বারা যিনি বিদেশী শক্তির বিশ্বস্থ বন্ধুরূপে বহু পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন।
কোন পরিকল্পনা যখন বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ রূপে আগায় তখন সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমুহ আর প্রকাশ্যে নেওয়া হয় না। দেশবাসীকে ও দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সে প্রক্রিয়ায় জড়িত করা হয় না। এবং সেটি ৬ দফা প্রণয়নের সময় যেমন হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার সময়ও হয়নি। অথচ পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহিত হয়েছিল প্রকাশ্য জনসভায়। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে এ কথাগুলো নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। কোন প্রশ্নও তোলা হয়নি। অথচ ইতিহাস রচয়িতাদের দায়িত্ব হল, এসব সিদ্ধান্তসমূহের গুঢ় রহস্যগুলি উদঘাটন করা। কারা ছিল নেপথ্যের নায়ক বা ভিলেন তাদের খুঁজে বের করা এবং সত্য থেকে মিথ্যাগুলোকে অতি সতর্কতার সাথে আলাদা করা।
বাংলাদেশের ইতিহাসের লেখকদের দ্বারা একাজটিই হয়নি। তারা অতি পরিচিত মিথ্যাগুলোকেও বিনা প্রতিবাদে পাঠ্যতালিকাভূক্ত করেছেন। রক্তক্ষয়ী একটি লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে র’এর কি ভূমিকা ছিল সে বিষয়ে আরো কিছু তথ্য দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার “Inside” বইতে। সেটি এরকমঃ...কিন্তু ততদিনে ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের মুজিবপন্থী একটি অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগরতলায় ১৯৬২-৬৩ সালে ভারতীয় এজেন্ট মুজিবপন্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরবর্তী গৃহিত কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কর্নেল মেনন ( ইনি হলেন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’এর দিল্লিস্থ পাকিস্তান ডেস্কের দায়িত্বশীল। তার আসল নাম কর্নেল শংকর নায়ার। মেনন তার ছদ্দ নাম) যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ও মুজিবপন্থী অংশের যোগাযোগ রক্ষাকারী ছিলেন।
তিনি আগরতলা বৈঠকেরপর ইঙ্গিত পান যে, মুজিবপন্থী গ্রুপ আন্দোলন শুরু করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব। কর্নেল মেনন তাদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে,তার সঠিক ফলদায়ক সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো হয়নি।.. তারা অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং ঢাকাস্থ ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস অস্ত্রাগারে হামালা চালায়। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আসলে এই পদক্ষেপ একটি ধ্বংসাত্মক ফলাফল ডেকে আনে, ঠিক যেরূপ কর্নেল মেনন ধারণা করেছিলেন। এর কয়েকমাস পর ৬ই জানুয়ারী ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার চক্রান্ত করার জন্য ২৮ জন পাকিস্তানীর বিচার করা হবে। শেখ মুজিবকেও বারদিন পর একজন দোষী হিসাবে জড়িত করা হয়। এই মামলাই পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসাবে পরিচিত পায়।-(অশোকা রায়না, ১৯৯৬)
২৫শে মার্চের বহু পূর্ব থেকেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’ মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। তাই যারা মনে করে পাকিস্তান আর্মির মিলিটারি এ্যাকশনের পরই মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তাদের ধারণা আদৌ সত্য নয়। অশোক রায়না লিখেছেন, “কর্নেল মেননের অবিরাম ভ্রমন ও যোগাযোগের জন্য সীমান্তব্যাপী র’এর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং কর্নেল মেননের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের নিরিড় যোগাযোগ ঐ সমস্ত তরুণ,অবিশ্রান্ত ও উৎসর্গীকৃত গুপ্ত যোদ্ধাদের মনোবল দারুনভাবে বৃদ্ধি করে। ... ইতিমধ্যে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন শেষ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের এজেন্টদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়,তখনই সেই ভয়াবহ “কালো রাত্রী”(২৫ শে মার্চ)র পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে।- (অশোক রায়না, ১৯৯৬)
অশোক রায়না রচিত Inside R&AW ও বি. রমন রচিত The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane নামক দুটো বইয়ে বেশ খোলা মেলা আলোচনা আছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে । তবে বইয়ের মধ্যে অনেক ভুল তথ্য বা প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন দুজনেই তাই বইয়ের তথ্য ক্রসচেক করে পড়া জরুরী ।
পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা হয় ভারতে। এ ব্যাপারে শুধু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’এর কর্মকর্তারারই শুধু মুখ খুলেনি, মুখ খুলেছে বাংলাদেশের বহু নেতাও। যেমন এক কালের নেতা ও পরবর্তীতে জাতীয় লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ বলেন, “১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আব্দুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদী অবগত হই।
ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন।”-(অলি আহাদ)। ইতিহাসের নামে যে মিথ্যাচার ছড়ানো হয়েছে তা হল, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলতঃ মুক্তিবাহিনীর অবদান। ভারতের নাম তারা সহজে মুখে আনতে চায় না। ইতিহাসের পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারগণ কে কথায় লড়াই করেছেন সে বিবরণ থাকলেও ভারতীয় বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য কোথায় কি ভাবে যুদ্ধ করলো তার সামান্য বিবরণও নেই। বিবরণ নেই ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর ভূমিকার। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কোন উল্লেখ সে যুদ্ধে কতজন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর অবদান অবশ্যই আছে, তবে তারাই মূল নয়।
সত্য হলো, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৯ মাসে পুরা বাংলাদেশ দুরে থাক একটি জেলা, একটি মহকুমা বা একটি থানাও মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। মূল লড়াই লড়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনী। তবে ভারত শুরু থেকেই একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অপরাধ নিজ কাঁধে নিতে চায়নি। কারণ এটি আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। তাছাড়া এমন কাজ তখন অন্যদেরও বৈধতা দিবে ভারত-ভাঙ্গার কাজে অংশ নেওয়ার। ইতিহাসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এ ভয়ে নিজেদের অর্থ, অস্ত্র ও লোকবলদ্বারা পরিচালিত পাকিস্তান ভাঙ্গার এ যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে আগে । আর এখন সরাসরি বলছে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়নি বরং যুদ্ধ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে ১৯৯৭১ সালে!?? ভারত এমন একটি রাষ্ট্র যাদের মিথ্যাচার প্রতারণা ও মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মনোভাব রক্তে মিশে আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে র’এর কর্মকর্তাগণ কি ভাবেন সেটি দেখা দরকার।
ভারতীর গুপ্তচর সংস্থা র’এর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিষ্টার বি. রমন লিখেছেনঃ “The R&AW’s success in East Pakistan, which led to the birth of Bangladesh, would not have been possible without the leadership of Kao and the ideas of Nair,”- (B.Ramon, 2007)। মিষ্টার বি. রমন যা লিখেছেন তা থেকে একথা সুস্পষ্ট, র’এর সফলতাই জন্ম দেয় বাংলাদেশের। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে তৎকালীন র’এর দায়িত্বশীল মি. কাউ ও মি নায়ারের সফল নেতৃত্ব ও পরিকল্পণার কারণে। বাংলাদেশের সেকুলার পক্ষটি র’এর ভূমিকার কথা মুখে আনে না। কারণ তারা নিজেরাও জানে এ সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে আজ হোক কাল মুসলিম ইতিহাসে তারা কুলাঙ্গার রূপে চিত্রিত হবেই। কারণ ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশের গুপ্তচর সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টতা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্য সুনাম বয়ে আনে না।
এজন্য ইসলামের যেসব চিহ্নিত শত্রুরা ইরাক, আফগানিস্তানে ও কাশ্মীরে আজ উৎসব ভরে গণহত্যা চালাচ্ছে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকার কথা তারা মুখেই আনে না। অথচ তাদের ভুমিকাই ছিল চুড়ান্ত। এ ব্যাপারে মিষ্টার বি. রমন তার বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’–তে লিখেছেনঃ
“The IB (Intellegence Bureau) before 1968 & the R&AW thereafter had built up a network of relationship with many political leaders and government officials of East Pakistan. The networking enabled the R&AW and the leaders and officials of East Pakistan to quickly put in position the required infrastructure for a liberation struggle consisting of a parallel government with its own fighters trained by the Indian security forces and its own bureaucracy. .. The only sections of the local population, who were hostile to India and its agencies, were the Muslim migrants from Bihar.” -(B.Ramon, 2007)
মিষ্টার বি. রমনের কথায় এটি সুস্পষ্ট, একাত্তরে যা ঘটেছে তার পরিকল্পনা একাত্তরে হয়নি। হয়েছে অনেক আগে। পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা আইবি এবং ১৯৬৮এর পর র’ ষাটের দশকের শুরু থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মচারিদের দিয়ে তারা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং অবকাঠামো গড়ে তোলে। এমনকি ট্রেনিং দেওয়ার কাজও শুরু করে। একাত্তরে নয়, বরং তার আগে ১৯৬২ সালেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা Director of Intelelligence Bureau (DIB) জানতে পারে যে কোলকাতার ভবানীপুর এলাকার একটি বাড়ীতে - যা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনাল সদর দফতর,সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। -(মাসুদুল হক)।
মিষ্টার বি. রমনের লেখা থেকে এটি প্রমাণিত হয়, পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট আদৌ মিথ্যা ছিল না। এ গোপন পরিকল্পনা মোতাবেক মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি রূপে দেখা ভারতের কাম্য ছিল না। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের পিছনে তারা যে পুঁজি বিণিয়োগ করেছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা, শেখ মুজিবকে অখন্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা নয়। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলে মিষ্টার বি. রমনের কথা মত র’ যেভাবে পূর্বপাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা এঁটেছিল তা কি সফল হত? তখন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার পক্ষ থেকে মুজিব ময়দানে একা খেলছিলেন না,খেলছিল আর অনেকেই। ছাত্রলীগের নেতৃপর্যায়ে এদের পাল্লাই ছিল ভারি। তাদের দায়িত্ব ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে তিনি র’এর সে পরিকল্পনা থেকে যেন একটুও বিচ্যুত না হন। বস্তুতঃ শেখ মুজিব তখন চলে গিয়েছিলেন তাদেরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
তখন তার পক্ষে র’এর কাছে কৃত ওয়াদা থেকে পিছূটান দেওয়ার সামান্য সুযোগও ছিল না। বহু আগেই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল। মুজিবের কাজ ছিল বিনা প্রতিবাদে তাদের অনুসরণ করা। মুজিব সেটি করেছিলেনও। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আপোষে শেখ মুজিবের আদৌ কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ এতে আগ্রহ ছিল না ভারতের। আর ভারতের যাতে আগ্রহ নেই তাতে মুজিবেরই বা আগ্রহ সৃষ্টি হয় কি করে? ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সাথে মুজিবের আলোচনা এজন্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। এমন আলোচনাকে তারা স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী মনে করে।
এনিয়ে আওয়ামী-বাকশালী শিবিরে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু এ বিষয়ে অতিশয় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্গতি হলো তাদের, যারা মনে করে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে স্বৈরাচারি ইয়াহিয়ার ভূলের কারণে। যেন মুজিব ও তার আওয়ামী-বাকশালী চক্র পাকিস্তান রক্ষার জন্য দু’পায়ে খাড়া ছিল!
স্বৈরাচারি ব্যক্তির ক্ষমতায় আসা বা গণতন্ত্র-দুষমন দুর্বৃত্তদের রাজনীতির কর্ণধার হওয়া কোন দেশেই অসম্ভব নয়। বিশ্বের বহু দেশেই সেটি হয়।একাত্তরের পর বাংলাদেশে সেটি বার বার হয়েছে। কিন্তু সে জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ সে দেশের মানচিত্র কর্তনে হাত দেয় না। এমন কাজ একমাত্র বিদেশী দুষমনদের হাতেই হতে পারে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র-বিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু হয় দেশটির প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এরপরও ধৈর্যের সাথে দেশ গড়ার চেষ্ঠা করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন, জনাব মোহম্মদ আলী বগুড়া ও জনাব সোহরাওয়ার্দ্দী অপসারিত হয়েছেন, সামরিক আইন জারি হয়েছে এবং দেশের শাসনতন্ত্রও রহিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুরা, সোহরাওয়ার্দি বা অন্য কোন নেতাই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে নামেন নি। এমনকি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ও নয়।
কিন্তু একাত্তরে দেশের রাজনীতি আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে নি। সেটি দখলে চলে যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর হাতে। বি. রমনের বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’ বা অশোক রায়না রচিত Inside R&AW সে কিচ্ছাতেই ভরপুর। ভারতের স্ট্রাটেজিক লক্ষ্য হল, বিশ্বের দরবারে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ। সে কথার স্বীকারোক্তি এসেছে মি. রমনের বইতে। তিনি এক্ষেত্রে র’এর ভূমিকার কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
An emerging power such as India, which is aspiring to take its place by 2020 among the leading powers of the world, has to have an external intelligence agency which has the ability to see, hear, smell and feel far and near. (B.Ramon, 2007).
১৯৬২ সালে চীনের হাতে অপমানজনক পরাজয়ের পর সে স্বপ্নে ভাটা পড়ে। এরপর ১৯৬৫এ পাকিস্তান পরাজিত করতে না পারায় সে পুরোন অপমান থেকেও পরিত্রাণ মেলেনি। এরপর মনযোগী হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে। শেখ মুজিব মূলতঃ ব্যবহৃত হয়েছে সে লক্ষ্য পূরণে। তবে ভারতের লক্ষ্য নিছক পাকিস্তানের শক্তিহানী নয়, সেটি উপমহাদেশে মুসলমানদের শক্তিহানী। এজন্যই একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বাংলাদেশের আর্মির হাতে পোঁছতে দেয়নি।
সব কিছু কুড়িয়ে তারা নিজ দেশে নিয়ে যায়। তাদের ভয়, পাকিস্তানের ন্যায় বাংলাদেশেরও যদি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায় তবে সে খড়গ তাদের ঘাড়ে পড়বে। তাই তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই সতর্ক।ভারত চায় নিঃশর্ত আনুগত্য। তাই ভারতীয় আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হওয়াটাই অপরাধ। মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ সেটি ভাল করেই বোঝে। একারণেই, আওয়ামী লীগ ভারতে মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করে না। তারা নিশ্চুপ কাশ্মীরে ভারতীয় অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অধিকৃত কাশ্মীরকে বিতর্কিত এলাকা বললে কি হবে, আওয়ামী-বাকশালী মহল সেখানে ভারতীয় আধিপত্যবাদকেই জায়েজ বলে মেনে নেয়।
১৯৬২এর ১৩ অক্টোবর চীন ভারতকে কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্ত থেকে তার সৈন্য অপসারণের দাবী করে। ভারত সে দাবী মেনে না নেওয়ায় ১৯৬২ এর ২০ই অক্টোবরে হামলা করে। ২০শে নবেম্বরের মধ্যে লাদাখ এলাকার দুই হাজার বর্গমাইল এবং তিব্বত সীমান্তের NEFA এলাকার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দখল করে নেয়। ২৮ শে অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আইউব খানকে ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বলে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, চীন তখনও মার্কিন বিরোধীতার কারণে জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি। পাকিস্তান সদস্য পদ লাভে চীনকে জোড়ালো সমর্থণ করে। পেশোয়ারের কাছে ছিল সিআইয়ের গোপন ঘাটি, সেখান থেকে CIA U-2 গোয়েন্দা বিমান পাঠাতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে। পাকিস্তান সে ঘাঁটিও বন্ধ করে দেয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচন্ড ক্রোধ চাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। অপর দিকে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্তে যুদ্ধে চীনের হাতে পরাজয়ের পর ভারতও প্রতিশোধের পরিকল্পনা নেয়। এবং সেটি যতটা না চীনের বিরুদ্ধে তার চেয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। পরিকল্পনা নেয় পাকিস্তানের অঙ্গহানির। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা নেয় আইয়ুব খানের অপসারণের ও পাকিস্তানকে দূর্বল করার।-(মাসুদুল হক)
তখন র’ এবং সিআইএ –উভয়েরই প্রয়োজন পড়ে রাজনীতির ময়দানে খেলোয়াড়ের। আর সে শূন্যতা পূরণ করে শেখ মুজিব। তখন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পাকিস্তানের রাজনীতির ময়দানে তাকে খেলোয়াড় রূপে বেছে নেয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রেয়ারিতে লাহোরে আইয়ুব বিরোধী দলসমুহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জনাব নুরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন এনডিএফ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগ সে সম্মেলনে যোগ দেয়। তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের নবাবজাদা জনাব নাসরুল্লাহ খান। এ সভায় শেখ মুজিব হঠাৎ করেই ৬ দফা পেশ করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছের বিষয়টি বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সাংবাদিক মাসুদুল হকের কাছে এক সাক্ষাতকারে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরি বলেন, ”লাহোর যাত্রার প্রাক্কালে এমনকি লাহোরে গিয়েও এ সম্পর্কে মুজিব আমাদের সঙ্গে আলাপ করেননি। আমরা জানতাম না মুজিব এ ধরনের প্রস্তাব তুলবে।” -(মাসুদুল হক)
এর পর আওয়ামী লীগ ৬ দফাপন্থি এবং ৬ দফা বিরোধী দুই খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৭ জেলার মধ্যে ১৪ জেলা সভাপতি ৬ দফার বিরোধীতা করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে। কিন্তু কে এবং কিভাবে ৬ দফা রচনা সে রহস্যের আজও সমাধা হয়নি। পাকিস্তানের গোয়ান্দা বিভাগ ডিআইবি এটিকে সিআইয়ের চাল হিসাবে মনে করে। ভাষানীপন্থি ন্যাপও সেটিই মনে করে। সে সময় ঢাকায় মার্কিন কনস্যাল জেনারেল ছিলেন মিষ্টার ব্রাউন। তিনি একই সাথে সিআইয়ের ষ্টেশন চীফেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সাথে শেখ মুজিব ও ছাত্রলীগের একাংশের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। সে সময় মার্কিন কনসালে আরেক কর্মকর্তা ছিলেন কর্নেল চিশহোস। চিশহোসের বাসায় মাঝে মাঝে পার্টি দেওয়া হত। এসব পার্টিতে বাছাই করা রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা ও পদস্থ বাঙ্গালী কর্মকর্তাদেও দাওয়াত দেওয়া হত। এভাবে একদিনে ভারতীয় র’এর তৎপরতা যেমন চরম আকার ধারণা করেছিল তেমনি তৎপরতা বেড়েছিল মার্কিন সিআইয়ের। পরে পাকিস্তান সরকার কর্নেল চিশহোসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং দেশ থেকে বহিস্কার করে দেয়। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা এ,টি,এস,সফদর জানান,
শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন তেজগাঁও বিমান বন্দরে লাহোরগামী বিমানে উঠার আগে ৬ দফা প্রস্তাবের একটি টাইপ করা কপি রুহুল কুদ্দুস নামে একজন সিএসপি অফিসার তার হাতে তুলে দেন। উল্লেখ্য যে রুহুল কুদ্দুস ছিলেন আগড়তলা মামলার একজন আসামী এবং শেখ মুজিবের ইনার সার্কেলের লোক।-(মাসুদুল হক)।
সাপ্তাহিক মেঘনার (১৬/১২/৮৫) সাথে এক সাক্ষাতকারে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল মালেক উকিল বলেন, ৬ দফা তিনি প্রথম দেখেন একটি টাইপকরা কাগজে শেখ মুজিবের পকেটে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কনভেনশনে যাওয়ার পথে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা হলো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একাত্তরের ঘটনাবলী, পাকিস্তান ভাঙ্গা ও বাংলাদেশের সৃষ্টি - এসবের শুরু হয় মূলতঃ ৬ দফা থেকে। অথচ এটির প্রণয়নে শেখ মুজিব নিজদলের নেতাদের সাথেও কোনরূপ পরামর্শ করেননি। এটি প্রণয়নের প্রাক্কালে কোন দলীয় সম্মেলন বা পরামর্শ সভাও হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সেটিই প্রথাসিদ্ধ রীতি। কিন্তু সেটি প্রণিত হয় রুহুল কুদ্দুসের ন্যায় একজন সন্দেহভাজন চরিত্রের মানুষের দ্বারা যিনি বিদেশী শক্তির বিশ্বস্থ বন্ধুরূপে বহু পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন।
কোন পরিকল্পনা যখন বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ রূপে আগায় তখন সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমুহ আর প্রকাশ্যে নেওয়া হয় না। দেশবাসীকে ও দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সে প্রক্রিয়ায় জড়িত করা হয় না। এবং সেটি ৬ দফা প্রণয়নের সময় যেমন হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার সময়ও হয়নি। অথচ পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহিত হয়েছিল প্রকাশ্য জনসভায়। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে এ কথাগুলো নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। কোন প্রশ্নও তোলা হয়নি। অথচ ইতিহাস রচয়িতাদের দায়িত্ব হল, এসব সিদ্ধান্তসমূহের গুঢ় রহস্যগুলি উদঘাটন করা। কারা ছিল নেপথ্যের নায়ক বা ভিলেন তাদের খুঁজে বের করা এবং সত্য থেকে মিথ্যাগুলোকে অতি সতর্কতার সাথে আলাদা করা।
বাংলাদেশের ইতিহাসের লেখকদের দ্বারা একাজটিই হয়নি। তারা অতি পরিচিত মিথ্যাগুলোকেও বিনা প্রতিবাদে পাঠ্যতালিকাভূক্ত করেছেন। রক্তক্ষয়ী একটি লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে র’এর কি ভূমিকা ছিল সে বিষয়ে আরো কিছু তথ্য দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার “Inside” বইতে। সেটি এরকমঃ...কিন্তু ততদিনে ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের মুজিবপন্থী একটি অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগরতলায় ১৯৬২-৬৩ সালে ভারতীয় এজেন্ট মুজিবপন্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরবর্তী গৃহিত কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কর্নেল মেনন ( ইনি হলেন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’এর দিল্লিস্থ পাকিস্তান ডেস্কের দায়িত্বশীল। তার আসল নাম কর্নেল শংকর নায়ার। মেনন তার ছদ্দ নাম) যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ও মুজিবপন্থী অংশের যোগাযোগ রক্ষাকারী ছিলেন।
তিনি আগরতলা বৈঠকেরপর ইঙ্গিত পান যে, মুজিবপন্থী গ্রুপ আন্দোলন শুরু করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব। কর্নেল মেনন তাদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে,তার সঠিক ফলদায়ক সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো হয়নি।.. তারা অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং ঢাকাস্থ ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস অস্ত্রাগারে হামালা চালায়। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আসলে এই পদক্ষেপ একটি ধ্বংসাত্মক ফলাফল ডেকে আনে, ঠিক যেরূপ কর্নেল মেনন ধারণা করেছিলেন। এর কয়েকমাস পর ৬ই জানুয়ারী ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার চক্রান্ত করার জন্য ২৮ জন পাকিস্তানীর বিচার করা হবে। শেখ মুজিবকেও বারদিন পর একজন দোষী হিসাবে জড়িত করা হয়। এই মামলাই পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসাবে পরিচিত পায়।-(অশোকা রায়না, ১৯৯৬)
২৫শে মার্চের বহু পূর্ব থেকেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’ মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। তাই যারা মনে করে পাকিস্তান আর্মির মিলিটারি এ্যাকশনের পরই মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তাদের ধারণা আদৌ সত্য নয়। অশোক রায়না লিখেছেন, “কর্নেল মেননের অবিরাম ভ্রমন ও যোগাযোগের জন্য সীমান্তব্যাপী র’এর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং কর্নেল মেননের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের নিরিড় যোগাযোগ ঐ সমস্ত তরুণ,অবিশ্রান্ত ও উৎসর্গীকৃত গুপ্ত যোদ্ধাদের মনোবল দারুনভাবে বৃদ্ধি করে। ... ইতিমধ্যে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন শেষ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের এজেন্টদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়,তখনই সেই ভয়াবহ “কালো রাত্রী”(২৫ শে মার্চ)র পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে।- (অশোক রায়না, ১৯৯৬)
No comments:
Post a Comment