Tuesday 23 August 2016

গুজরাট ফাইলস ও গোপন বিশ্লেষণ। পর্ব এক

গুজরাট ফাইলস ও গোপন বিশ্লেষণ 

রানা আয়ুব।  লেখক ভারতীয় খ্যাতিমান নারী সাংবাদিক 
ভারতের বিখ্যাত বামঘনার সংবাদ মাধ্যম তেহেলকায় কর্মরত রানা আয়ুব।  
বইয়ের লেখা তিনি যেভাবে শুরু করেন ।। 
২০১০এর গরমকাল নাগাদ আমি সাংবাদিকতাকে নতুন করে চিনছিলাম। এমনিতে আমি নিজেকে একজন খুব সাধারণ, পরিশ্রমী, মাঝারি মানের রিপোর্টার মনে করতাম, যার কাছে থাকার মধ্যে ছিল পুরনো আমলের একজন জার্নালিস্ট বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কিছু মূল্যবোধের সমষ্টি। কিন্তু এই সময় নাগাদ, আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম এমন এক সন্ধিক্ষণের মধ্যে, আমি প্রার্থনা করি আর কাউকে সেই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়।
কিছুদিনের মেডিকেল লিভ নেবার পর আমি তখন সদ্য তেহেলকায় আবার কাজকর্ম শুরু করেছি। শহরের সেরা ডাক্তাররা আমার অসুখ ধরতে পারেন নি। আমি তখন সদ্য নক্সাল অধ্যুষিত গড়চিরোলি থেকে ফিরেছি। সেখানে এমন কিছু ঘটেছিল যা আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায়। আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু, শাহিদ আজমির হত্যা। অপরাধ আইনের একজন তুখোড় বিশেষজ্ঞ, আজমি, আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এসেছিল। যেদিন সে মারা যায়, সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আমার ওর সাথে দেখা করবার ছিল, কিছু উপজাতি এবং বুদ্ধিজীবিকে নকশাল বলে দাগিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্র এবং তাদের জেলে পচতে হচ্ছিল, সেই ব্যাপারে আলোচনা করতে যাবার জন্য।
কিন্তু ভাগ্যের লিখন অন্য রকমের ছিল। আমার ভাইঝির উপরোধে আমি সেদিন ঘরেই থেকে গিয়েছিলাম, তার সপ্তম জন্মদিন ছিল সেদিন। আমার ফোনে অনেকগুলো মিসড কল আর মেসেজ এসে পড়ে ছিল, “শাহিদের কী হয়েছে” আমি জানি কিনা জানতে চেয়ে, আমি সেগুলো অনেক পরে দেখেছিলাম। বাকি খবর আমি জানতে পারি উপর্যুপরি আসা বন্ধুদের ফোন কল আর নিউজ চ্যানেলের ব্রেকিং স্টোরির মাধ্যমে। শাহিদকে ওর অফিসে গুলি করে মারে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী, কারণ সে “অ্যান্টি ন্যাশনাল”দের হয়ে কেস লড়ছিল। শাহিদের সওয়ালেই সম্প্রতি ৭/১১-তে মুম্বাই ট্রেন ব্লাস্টের ঘটনায় আটক নিরপরাধ লোকেরা ছাড়া পায়। তার মৃত্যুর পরে মুম্বাই হাইকোর্ট ২৬/১-র মামলায় আটক থাকা দুজন আরোপীকেও মুক্তি দেয়। জনতার চোখে শাহিদের মৃত্যু আজ পর্যন্ত একটা রহস্য হয়েই আছে, যার জট খোলা যায় নি।


কাউকে হারানোর বেদনা সইয়ে নেবার অনেক রকমের রাস্তা হয়। হয় খুব কাঁদো, বিলাপ করো, তারপরে জীবনের পথে এগিয়ে যাও। অথবা পালাও, পালিয়ে সান্ত্বনা খোঁজো অন্যকিছুতে, নিজের কাজকর্মে। আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছিলাম। শাহিদের মৃত্যুর তিনদিন পরে, আমি নাগপুর যাচ্ছিলাম, তখনও জানতাম না যে জন্য যাচ্ছি তা আমার সাংবাদিকতার কেরিয়ারের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টোরির জন্ম দেবে। স্টোরিটা ছিল কয়েকজন অন্ত্যজ জাতের ছাত্রকে নকশাল সন্দেহে গ্রেফতার করা নিয়ে। তাদের বিরুদ্ধে যা সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করা হয়েছিল তা পড়লে হাসি পাবে। তাদের কাছে পাওয়া গেছিল ভগত সিং আর চন্দ্রশেখর আজাদের লেখা লিটারেচার। আমার মনে হচ্ছিল, বন্ধুর ঋণ শোধ করার এই হয় তো রাস্তা, কারণ শাহিদ মারা গেছিল ঠিক এই ধরণের কেস লড়তে গিয়েই, মনে হচ্ছিল, এই কেস লড়ার মধ্যে দিয়ে আমি ওর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে পারব। কিন্তু ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল আমার। আমাকে শিগগিরই বাড়ি ফিরে আসতে হল এক অবর্ণনীয় সমস্যা নিয়ে, যার নাম পরে জানা গেল, ডিপ্রেশন।
জানা গেল, আমার বাবা-মা পাগলের মত আমার বিভিন্ন রকমের টেস্ট করাবার পর – ব্রঙ্কোস্কোপি থেকে এমআরআই। আরেকজন ডাক্তার বললেন, যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু করতে – কিন্তু তখনই ভাগ্যক্রমে আমি সাউথ বম্বে হসপিটালের একজন নামকরা ফিজিসিস্টের কাছে গিয়ে পৌঁছই। ডক্টর চিটনিস আমার সমস্ত রিপোর্ট দেখে আমাকে কটা প্রশ্ন করেছিলেন। তার পরে, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী নিয়ে কষ্ট পাচ্ছো?” মনে হচ্ছিল যেন অনেকদিনের ঘুম ভেঙে আমি জেগে উঠলাম। “জানি না ডক্টর, সবসময়ে আমার নিজেকে খুব পরিশ্রান্ত আর দুর্বল লাগে, বুঝতে পারছি না আমার কী হয়েছে।”
মুখে একটা হালকা হাসি ঝুলিয়ে তিনি বলেছিলেন, “এই পুতু-পুতু ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে এসো, নিজের সমস্যাকে এই সব ব্লাড টেস্ট রিপোর্টের মধ্যে দিয়ে বিশাল করে দেখার চেষ্টাটা ছাড়ো, তুমি একদম ঠিক আছো। কাজে যোগ দাও, সেটাই তোমার ওষুধ। বাকি সব অসুখ তোমার মনে।”

“এটা কি হাইপোকন্ড্রিয়া?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। নিজেই নিজের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে এই টার্মটা আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে সদ্য শিখেছিলাম। ডক্টর চিটনিস সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “না, তুমি স্রেফ অলস হয়ে যাচ্ছো আর নিজের দায়িত্ব থেকে পালাবার চেষ্টা করছো।”
পরের কয়েকদিন ধরে আমি ডক্টর চিটনিসের উপদেশগুলো হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করতে থাকলাম। সেই সব অলস দিনগুলোতে মা আমার প্রধান সহায় হলেন। আম্মা, আমি মা-কে এই নামেই ডাকি, আমার এক বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠলেন। আম্মা কখনও আধুনিক স্কুলে যান নি, আব্বাই ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তিনি বললেন, তিনি আমার মধ্যে দিয়ে তাঁর বাস্তব-না-হয়ে-ওঠা স্বপ্নগুলোকে রূপ দিতে চান। আমি বিদ্রোহী হলে তিনি ঝগড়া করতেন, এবং ধীরে ধীরে বাড়ির সবাইকে এই বাদানুবাদে যুক্ত করে নিতেন। সেদিন আমায় কফি বানিয়ে দেবার সময়ে আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে তুই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিস?”
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম, যেন সেই মুহুর্তে কফির কাপটা ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আম্মাকে তো আমি চিনি – তিনি আমার পাশে বিছানায় এসে বসে ইনকিলাব (একটা নামকরা উর্দু খবরের কাগজ) পড়তে শুরু করলেন। দশ মিনিট পড়বার পর আম্মা আমায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, আমি তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আম্মা, যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু থেকে থাকে এই খবরের কাগজটায়, আমাকে বোলো না। আমি এসব ছাড়াই ভালো আছি।”
“আরে নেহি, তুই এই সোহরাবুদ্দিনের ঘটনাটা পড়েছিস?” আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আম্মা। কেন জানি না, নামটাতে আমি কান পাতলাম। অবশ্যই আমি সোহরাবুদ্দিনের ঘটনাটা জানি, আমি মনে মনে বললাম। এই লোকটির কারণেই আমাকে আমাদের এই সময়ের একজন সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রের সাথে বার্তালাপ করতে হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী।

২০০৭ সালে গুজরাতের তিনজন সিনিয়র পুলিশ অফিসারকে নিয়ে খবর তৈরি হয়েছিল, এঁদের গ্রেফতার করেছিলেন এঁদেরই একজন নিকটতম সহকর্মী, রজনীশ রাই, সোহরাবুদ্দিন নামক একটি ছোটোখাটো অপরাধীকে ফেক এনকাউন্টার ঘটিয়ে হত্যার অপরাধে।
ডি জি বানজারা আর রাজকুমার পাণ্ডিয়ানকে জেলে পাঠানো হয়। এই দুজন ছিলেন মোদীর নিজস্ব বৃত্তে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অফিসার, এবং ততদিন পর্যন্ত এঁরা বেশ একটা ঝলমলে জীবন যাপন করছিলেন, প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে এঁদের ছবি আর রিপোর্ট বেরোত কোনও না কোনও প্রেস কনফারেন্স থেকে। ২০০৪ সালের শুরুর দিকে এঁরাই সফলভাবে ট্র্যাক করে মেরেছিলেন কয়েকজন জিহাদীকে, যারা নাকি এসেছিল হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র মোদীকে খুন করবার চক্রান্ত নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই এঁদের গ্রেফতারের খবরে জাতীয় স্তরে আলোড়ন উঠেছিল।
একজন পলিটিকাল জার্নালিস্ট হিসেবে একটা টেলিভিশন চ্যানেলে জয়েন করে, আমার প্রথম টাস্ক ছিল ২০০৭এর গুজরাত নির্বাচন কভার করা। গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বেশির ভাগ অ্যানালিস্টদের ভবিষ্যদ্বাণীকে সফল করে আরেকবার বিশাল ব্যবধানে জয়ী হতে চলেছিলেন। তার কয়েক বছর আগেই ২০০২এর দাঙ্গা সমগ্র গুজরাতি সমাজকে রাতারাতি পোলারাইজড করে দিয়েছিল আর মোদীকে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হিরো বানিয়ে দিয়েছিল। এই অবস্থান থেকে ২০০৭এ সুবিশাল বিজয় হাসিল করা তাঁর পক্ষে খুব দুরূহ ব্যাপার ছিল না।
একজন ক্যামেরাপার্সনকে সঙ্গে নিয়ে আমি মোদীর নির্বাচনী প্রচারসভায় উপস্থিত হলাম। খুব ভালো করে মনে নেই, কিন্তু যদ্দূর মনে পড়ছে সেই সভাটা আয়োজন করা হয়েছিল গুজরাত চেম্বার অফ কমার্সের তরফে। নরেন্দ্র মোদী, তাঁর ডানহাত অমিত শাহের পাশে বসেছিলেন মঞ্চে, অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে।
কাছাকাছি একই সময়ে আরও কএকটা রাজনৈতিক প্রচারসভা হচ্ছিল – আপাতভাবে মোদীর প্রচারসভার সঙ্গে সেগুলো খুব একটা আলাদা হবার কথা ছিল না। কিন্তু দিল্লিতে আমার প্রোডিউসাররা আমাকে জানিয়ে রেখেছিলেন, মোদীর একটা অভ্যেস আছে মঞ্চে দাঁড়িয়ে উস্কানিমূলক ভাষণ দেবার, এবং মোদী সেদিন আমায় হতাশ করেন নি। 

“সোহরাবুদ্দিন, ওরা আমাকে প্রশ্ন করে সোহরাবুদ্দিনের মত সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে কী করা হয়”, ভিড় গর্জন করে ওঠে উল্লাসে। সামনের সারিতে মহিলার দল হাততালি দেন; সামনের সারিগুলো সবসময়েই মহিলাদের জন্য রিজার্ভড থাকত কারণ এটা বিশ্বাস করা হত যে মোদীর জনপ্রিয়তা গুজরাতের মহিলাদের মধ্যে বেশি। কলামনিস্ট আকর প্যাটেল একবার একটা নিবন্ধে লিখেছিলেন যে গুজরাতি মহিলাদের কাছে মোদী একজন সেক্স সিম্বল।
ভিড়ের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই ছিল, “মার ডালো, মার ডালো”। আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে বসে আছি। ভাষণ চলতে লাগল টুকরো টাকরা “মিয়াঁ মুশারফ” আর “দিল্লি সুলতানত”-এর উদ্ধৃতিকে সঙ্গে নিয়ে। ভাষণ শেষ হবার পরে, মোদী ডায়াস থেকে নেমে এলেন এবং গুজরাত চেম্বার অফ কমার্সের সদস্যরা তাঁকে মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁর চারপাশে ভিড় জমে গেল। সিকিওরিটির কর্ডন ঠেলে আমি কোনওরকমে ভিড়ের মধ্যে ঢুকলাম আমার ক্যামেরাপার্সনকে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে – সে তখনও ভিড়ের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

“মোদীজি, মোদীজি, এক সওয়াল”। আমার ভাগ্য ভালো ছিল, অত ভক্ত এবং নিরাপত্তাবলয়ের ভিড়ের মধ্যে থেকেও তিনি আমার কথা শুনতে পেয়ে ফিরলেন এবং প্রশ্ন করার অনুমতি দিলেন। “মোদীজি, তিনজন অফিসার গ্রেফতার হয়েছেন সোহরাবুদ্দিনের ফেক এনকাউন্টারের ঘটনায়। আপনি কি এখনও আপনার ভাষণে যা বলেছেন, সেটাই বলতে চাইবেন?” উত্তরের আশায় আমি তাঁর দিকে মাইক এগিয়ে দিলাম। কিন্তু এবারে ভাগ্য বোধ হয় ভালো ছিল ক্যামেরাপার্সনের। টানা দশ সেকেন্ড নরেন্দ্র মোদী আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এবং তার পরে উত্তর না দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গের মন্ত্রীরা আমার দিকে একটা ঘেন্না আর অবজ্ঞা মেশানো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন। এটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি এখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

সোহরাবুদ্দিনের গল্পটা বলবার দরকার হয়ে উঠেছিল। আর সেই প্রয়োজনীয়তাটা আমি অনুভব করলাম আমার আম্মা যখন ইনকিলাবের পাতায় সোহরাবুদ্দিনের খবরটা পড়ছিলেন। সময় নষ্ট না করে আমি স্থানীয় সাইবারক্যাফেতে গেলাম।
যতগুলো লিঙ্ক পেলাম, সবই জানাচ্ছে একটা সিবিআই তদন্তের কথা, আর গুজরাতের একজন শীর্ষস্তরের আইপিএস অফিসার অভয় চুড়াসমার গ্রেফতারির কথা। আমি চুড়াসমাকে চিনতাম, বছরখানেক আগে উনি আমাকে ফোনে হুমকি দিয়েছিলেন, কারণ আমি তাঁর মামলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর জবানবন্দী পাবলিশ করেছিলাম। চুড়াসমা গুজরাত বিস্ফোরণ কাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন, যে ঘটনার সাথে পরে ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন নামে একটা দলের যোগসূত্র পাওয়া যায়। একজন নিখুঁত মিডিয়া-স্যাভি রাজ্যস্তরের অফিসার হিসেবে চুড়াসমা তৎকালীন গুজরাতের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহর খুব কাছের লোক ছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু সেই সময়ে যে যে শীর্ষ অফিসাররা খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন, তাদের সবার থেকে চুড়াসমা ছিলেন আলাদা। 

পরে জানা গেছিল ওঁর মুখ্য পছন্দের বিষয় ছিল ছোটখাটো অপরাধী আর হাওয়ালা অ্যাকাউন্ট। সোহরাবুদ্দিন ছিল এই দুটো ব্যাপারেই পারদর্শী, ফলে চুড়াসমার চোখে পড়তে সোহরাবুদ্দিনের দেরি হয় নি।
আমার প্রিন্ট আউট আর নোটস রেডি করে আমি আমার দিল্লির এডিটর সোমা চৌধুরি আর তরুণ তেজপালকে একটা নোট লিখলাম, কেন এই কেসটা রিপোর্ট হওয়া উচিত। মাথার মধ্যে আরেকটা চিন্তাও খেলা করছিল, এই কেসটা হয় তো আমার ডিপ্রেশন আর একাকীত্ব থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র রাস্তা হবে। আমার দুই এডিটরই খুবই উৎসাহ দিলেন, এবং আমি তৈরি হলাম আহমেদাবাদ যাবার জন্য। এবারের যাত্রা আমার জীবনের গতি বদলে দিল।

আহমেদাবাদ যাবার এক মাসের মধ্যেই আমি কল রেকর্ডস ঘেঁটে এবং কিছু অফিসারের সহায়তায়, যাদের নাম গোপন রাখতে চাই, কিছু ইন্টার্নাল নোটস পেয়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ এক্সপোজ ঘটালাম। খুব সাবধানতার সঙ্গে তাদের সাথে দেখা করতে হয়েছিল, কারণ আমি জানতাম, এরাই আমার একমাত্র আশা। কিন্তু গুজরাতের মত রাজ্যে বিশ্বাস জন্মানো এত সহজ কাজ নয়, বিশেষত সেইসব অফিসারদের কাছে যাঁরা নিজেদের সার্ভিসের প্রতিদায়বদ্ধ এবং কোনওভাবেই সরকারের কুনজরে পড়তে চান না। এঁদের বেশির ভাগের সাথেই আমার প্রথম বার সাক্ষাৎ হচ্ছিল। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো ছিল কারণ, যেহেতু আমি তেহেলকার একজন সাংবাদিক, তাই এটা ধরে নেওয়াই যায় যে যে কোনও সময়ে আমার সাথে সাথে থাকত গোপন স্টিং ক্যামেরা।
অবশ্য গুজরাতে আমি যা নিয়ে কাজ করছিলাম তা ঠিক গুজরাত ভিত্তিক ইস্যু ছিল না।

 সৎ পুলিশ অফিসারদের ফাঁসানোর সংস্কৃতি উত্তর প্রদেশ আর মণিপুরেও আছে, আমি দু জায়গা থেকেই প্রচুর রিপোর্ট করেছি এর ওপরে। আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে এই প্রসিকিউশন ফ্যাক্টরটা ঘুরপথে আমার পক্ষে কাজ করে ফেলতে পারে। এবং যেমনটি ভেবেছিলাম, এ রকম একজন অফিসার যিনি আমাকে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ নথি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তিনি ছিলেন এই রকম একজন সৎ পুলিশ অফিসারের ব্যাচমেট যাঁকে নিয়ে আমি একসময়ে রিপোর্ট করেছিলাম। আলাপ জমাতে সেইটা সাহায্য করল। হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টদের সাহায্যে এবং এইসব অফিসারদের সাহায্যে আমি সে বছর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক্সপোজ ঘটালাম। আমি সেইসমস্ত কল রেকর্ড হাতে পেয়েছিলাম যেগুলোতে ছিল তৎকালীন গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ আর শীর্ষ অফিসারদের মধ্যে কথোপকথন, এনকাউন্টারের সময়ে। এর সঙ্গে ছিল একটা আভ্যন্তরীণ সিক্রেট অ্যাক্টস নোট। গৃহমন্ত্রীর সমস্ত চালচলন রাজ্য সিআইডি খুব মন দিয়ে মনিটর করছিল এবং এই নোট অনুযায়ী এই এনকাউন্টার একজন সাধারণ মানুষকে খুন করে তাকে টেররিস্ট বলে চালানোর প্ল্যান করে ঘটানো হয়েছিল।

এক্সপোজটি ঘটবার সাথে সাথে রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে গেল। সিবিআই থেকে তেহেলকার দপ্তরে পরের পর ফোন আসতে লাগল সেই কল রেকর্ডগুলো চেয়ে, যেগুলো পরে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছিল। আমি থাকতাম আহমেদাবাদের হোটেল অ্যাম্বাসাডরে, যা ততদিনে আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছিল। হোটেলটা ছিল খানপুর নামে একটা মুসলিম মহল্লাতে, যেখানে আমার থাকবার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। আমি পরে আবিষ্কার করেছিলাম যে ঐ হোটেল থেকে রাজ্য বিজেপির অফিস মাত্রই কয়েকটা ব্লক দূরে। আমার হঠাত করে খুব নাম হয়ে গেল। বিজেপি নেতারা আয়ুব নামে একটা ছোকরার ব্যাপারে খুব আলোচনা করতে লাগলেন, যে নাকি এই এক্সপোজটা ঘটিয়েছে। যে কারণেই হোক তারা এই নামে কোনও মেয়ে ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিস্টকে আশা করে নি। অবশ্য তাই নিয়ে আমার কোনও অভিযোগও নেই, আমি খুব গোপনেই চলাফেরা করতে পারছিলাম এই কারণে। এক্সপোজটি ঘটাবার কিছুদিন পর আমার ফোনে একটা টেক্সট মেসেজ এল, “আমরা জানি তুমি কোথায় আছো”।
জীবন বদলে গেল। সেদিন থেকে প্রতি তিন দিনে আমি আমার বাসস্থান বদলাতাম। আইআইএম ক্যাম্পাস থেকে গেস্টহাউস, হস্টেল, জিমখানা। আমি একজন আন্ডারকভার এজেন্টের মত জীবন কাটাতে লাগলাম। এই সময়ে ল্যান্ডলাইনের বদলে মোবাইল ফোন আমার কাছে যোগাযোগের মুখ্য মাধ্যম হয়ে উঠল। অবশেষে, সমস্ত তথ্যপ্রমাণ একত্র করে, সিবিআইয়ের হাতে জমা করে, ফলো-আপ রিপোর্ট তৈরি করে আমি মুম্বাইতে পৌঁছলাম, আর জীবনের স্বাভাবিক রুটিনে ফিরলাম।
কিন্তু আমার গল্প অন্যদিকে গড়াচ্ছিল। এক্সপোজটি ঘটাবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সিবিআই অমিত শাহকে গ্রেফতার করল, স্বাধীন ভারতের প্রথম গৃহমন্ত্রী যিনি মন্ত্রী থাকাকালীন গ্রেফতার হলেন। রাতারাতি খবর ছড়িয়ে পড়ল। গান্ধীনগরের সিবিআই হেডকোয়ার্টারের সামনে মিডিয়ার গাড়িদের লাইন লেগে গেল। প্রত্যাশামতই আমাকে আবার গুজরাত ফিরতে হল এই পুরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ডেভেলপমেন্টের রিপোর্ট জোগাড় করার জন্য।

অমিত শাহর গ্রেফতারিতে আশার আলো দেখলেন সেই সমস্ত পুলিশ অফিসাররা, যাঁদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল তাঁর জমানায়। অফিসাররা আমার কাছে নোট পাঠাতে লাগলেন আমার সাথে কথা বলবার জন্য। যাঁরা আগে সাংবাদিকদের অ্যাভয়েড করতেন, তাঁদের অনেকেই এখন প্রকাশ্যে কথা বলবার সাহস সঞ্চয় করলেন। বেশির ভাগ কথোপকথনই ছিল অফ-দ্য-রেকর্ড, কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে এই এনকাউন্টারের ঘটনা আসলে হিমশৈলের চূড়া মাত্র। গুজরাতের বিভিন্ন কেস ফাইলে এর থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা কেউই সত্যের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারি নি। অনুমান করা গেছিল গত প্রায় এক দশক ধরে বিচারপদ্ধতির একটা বড় রকমের অবনমন ঘটানো হয়েছিল। জনগণের রক্ষার দায়িত্বে যাদের থাকার কথা, তাদের কিনে নেওয়া হয়েছিল। দাঙ্গা থেকে এনকাউন্টার থেকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড – প্রচুর অপ্রিয় সত্য লুকিয়ে রয়েছিল ওই সব ফাইলের মধ্যে। কিন্তু কীভাবে সেগুলো প্রমাণ করা যাবে?
জার্নালিজমের প্রধান শক্তি হচ্ছে প্রমাণ – এভিডেন্স, আর আমার কাছে কোনও তথ্যপ্রমাণ ছিল না। ছিল শুধুই কথোপকথন, অফলাইন স্বীকারোক্তি আর শোনা-কথার সম্ভার। আমি এ সমস্ত প্রমাণ কীভাবে করব? তখন আমার মাথায় এমন একটা চিন্তা এল যেটা আমার জীবনকে আমূল বদলে দিল, ব্যক্তিগত স্তরে এবং প্রফেশনাল স্তরে। রাণা আয়ুবের বদলে জন্ম নেবে মৈথিলী ত্যাগী, কানপুরের একটি কায়স্থ মেয়ে, আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিট্যুট কনসার্ভেটরির ছাত্রী যে গুজরাতে এসেছে এখানকার ডেভেলপমেন্ট মডেল আর বিশ্বজুড়ে এনআরআইদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার ওপর একটা ফিল্ম বানাতে।

No comments:

Post a Comment