Saturday, 20 August 2016

ভারতীয় সিরিয়ালের আগ্রাসনে সামাজিক অবক্ষয় চরমে পৌঁছেছে





মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ

বাংলাদেশের কৃষ্টি  ও সামাজিক ঐতিহ্য আজ চরম ভাবে হুমকির মুখে পড়েছে ভারতীয় অশ্লীল টিভি সিরিয়ালের কারণে । আর কত সমাজের অবক্ষয় হওয়ার পরে ভারতের নষ্ট সিরিয়াল, ভারতীয় চ্যানেল গুলো বন্ধ হবে বাংলাদেশে সম্প্রচার ? চরম মস্তিষ্ক বিকৃতি মূলক সিরিয়ালের একটি উদাহরণ দিচ্ছি এখানে , স্টার প্লাস সিরিয়াল,গোপি বাহূ নামক নাটক,সাথ নিভানা সাথীয়া,বিদ্যা মীরা,বিয়ে করলো,একই পরিবারের দুজনকে,নিজের বোনের শ্বশুরকে বিয়ে করলো মীরা যা দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী।  সিরিয়ালের পরিচালকের কি জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক লোপ পেয়েছে,এধরনের দৃশ্য আমাদের সমাজের কি ক্ষতি করবে তাঁর কোনো ধারণা আছে? মানে আপন দুই বোন একজন বিয়ে করেছে ছেলেকে আর অন্য বোন বিয়ে করেছে নিজের আপন বোনের স্বামীর পিতাকে!?? একই সংসারে এক বোন অপর বোনের শ্বাশুরি!?? এইসব সিরিয়ালের কারণে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ, সিরিয়ালের কারণে শিশু পানিতে পড়ে মৃত্যু বা ঘরে আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই, সিরিয়ালের পোশাকের জন্য আত্মহত্যা ইত্যকার ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে।

 আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টিতে যেভাবে বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় অশ্লীল বিকৃত সংস্কৃতির মোড়কে বাস্তবতা বিবর্জিত কাল্পনিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টিকারী সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় বাকী আছে বলে মনে হয়না । বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ সংস্কৃতি বলতে শুধু টেলিভিশন ইঙ্গিত করে এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বলতে ভারতীয় সিরিয়াল ছাড়া অন্য কিছু নয় । দেশের মোট টিভি দর্শনার্থীর ৮০ ভাগ নারী এবং নারীদের ৯০ ভাগেরও বেশি টিভি অনুষ্ঠান বলতে কেবল ভারতীয় সিরিয়ালে সীমাবদ্ধ । ভারতীয় এসব সিরিয়াল থেকে তবুও যদি ইতিবাচক কিছু শেখা যেত ! এসকল ভারতীয় সিরিয়াল যেমন পারিবারিক শান্তি কেড়ে নিয়ে কুটনামি, পরকীয়া তথা নষ্ট সংস্কৃতির চর্চায় উদ্ভূদ্ধ করছে তেমনি খুঁটিনাটি কারনে ডিভোর্সের মত সর্বনিম্ন বৈধতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে । সিরিয়ালের নেতিবাচক প্রভাব সমাজের সর্বত্র । দেশীয় ঐতিহ্যের ধারক যৌথ পরিবারগুলোকে ভেঙ্গে একক ও অনু পরিবারের রূপ নিচ্ছে । নষ্ট সংস্কৃতির চর্চায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার অমূল্য সম্পর্কে দিন দিন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে । মা-মেয়ে এবং বাবা-ছেলেদের মধ্যে টিভি-রিমোট দখলের প্রতিযোগীতায় সাংসারিক অশান্তি নিত্যকার ব্যাপার । পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের অন্তরায় হিসেবে পারিবারিক কলহ নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে ।

 হিন্দী সিরিয়াল বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। হিন্দি সিরিয়ালের শিক্ষনীয় কোন বিষয় না থাকলেও এর দর্শক দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাবারের মতো টেনে-হিঁচড়ে এসব সিরিয়াল এমনভাবে লম্বা করা হয় যে, এর শেষ পর্ব কবে প্রচারিত হবে তা কেউ যেমন জানে না তেমনি আন্দাজও করতে পারে না। হিন্দি সিরিয়ালের মধ্যে যে সব ম্যাসেজ বা বার্তা থাকে তা একটি পরিবার তথা সমাজ কে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। হিন্দি সিরিয়াল দেখার ফলে সমাজ থেকে যেমন সামাজিক মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে তেমনি সামাজিক, মানসিক সবক্ষেত্রেই দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা। অনৈতিক ও ঘৃণ্য অশ্লীলতা ছাড়া শিক্ষণীয় তেমন কিছুই পাওয়া যায় না বলেই এমনটি হচ্ছে। ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালে যে সব দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-অসম প্রেম, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া, পারিবারিক ভাঙ্গন, বহু বিবাহ, বউ-শ্বাশুড়ীর ঝগড়া, সম্পত্তির কারণে ভাই-ভাই ঝগড়া, স্ত্রীর কূটনৈতিক চাল, ভুল বোঝাবুঝি, হিংসা, সন্দেহ, অশ্লীলতা, আত্মীয়দের ছোট করা, অন্যকে বিপদে ফেলা, চুরি শিক্ষা, অপরাধ শিক্ষা এসব বিষয়ই হিন্দি সিরিয়ালের মূল বিষয়বস্তু।

 শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ণের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে । আত্মহত্যার মত ঘৃণিত ঘটনার সূত্রপাতেও ভারতীয় সিরিয়াগুলো সরাসরি প্রভাব ফেলছে । বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম আলোচিত নক্ষত্র, জনপ্রিয় বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপস্থাপক ও পরিচালক হানিফ সংকেত আমাদের জীবনে ভারতীয় সিরিয়ালের কূফল উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘হিন্দি টিভি সিরিয়াল দেখছি আর শিখছি কুটনামির কুট সম্ভ্রম লুট কলহ-দাঙ্গা সংসার ভাঙ্গা পরকীয়া প্রীতি নষ্ট সংস্কৃতি’ । সংস্কৃতিমনা জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে । তবে সে সুনাম হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই দুর্নামে রূপ লাভ করবে । কেননা প্রতিটি জাতির জাতীয় সংস্কৃতি সে জাতির মানসিকতা ও ভৌগলিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উদ্ভব হয় ।

 ভারতীয় সংস্কৃতির যে আগ্রাসন আমাদের সমাজের ওপর চলছে সে সংস্কৃতি ভারতীয় জাতিসত্ত্বার জন্য মানানসই কিন্তু বাংলাদেশের মত স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার ধারকদেরকে কেন ভিন্ন জাতির সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে তা সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখা আবশ্যক । বিশ্বয়ানের প্রভাবে আকাশ সংস্কৃতির দ্বার উম্মুক্ত হওয়ায় যে কোন দেশের সংস্কৃতি দেশের ভৌগলিক সীমা পাড়ি দিয়ে নিমিষেই অন্য ভূখন্ডে বসবাসরত জাতির কাছে পৌঁছে যায় । তাই বলে সে সংস্কৃতি গ্রহনের পূর্বে আমদের বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত নয় ? যে সংস্কৃতি সামাজিক পেক্ষাপটে বাঙালি মনন ধ্বংস করছে এবং বাংলাদেশীদের মাঝে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় তৈরি করছে তা গ্রহনের পূর্বে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা অত্যাবশ্যক ।

এ দাবী শুধু পুরুষের জন্য বরং সচেতন নারীদের একাংশের । এদেশের নারীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, কোন জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্থাণ-পতনে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য । যারা বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে সামান্য চিন্তা করে, যারা চায় আমাদের প্রজন্ম বিকৃত মানসিকতার পরিবর্তে সুস্থ মানসিকতায় গড়ে উঠুক, যারা বাংলাদেশে সুস্থ ভাবধারার দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতে বদ্ধপরিকর তাদের সকলের দাবী; অবিলম্বে যেন আমাদের সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরুপ ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধের মাধ্যমে আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে রক্ষা করা হয় এবং নতুন প্রজন্মের জন্য সুস্থ-স্বাভাবিক মানবিক গুনাবলী বিকাশের পথ উম্মুক্ত রাখা হয় । যে অধিক সংখ্যক সাধারণ মানুষ, মিডিয়াকর্মী এবং সচেতন মহলের গুনীজন এ সকল ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের দাবীতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক মানুষের আন্দোলনে সরকার অসংখ্য দাবী পূরণ করেছে অথচ কোন এক রহস্যজনক কারনে সরকার দেশের জন্য অমঙ্গলজনক এ চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি অথচ অত্যাবশ্যকভাবে করা উচিত
ছিল ।

সরকারের সামন্য কিছু দোষ-ত্রুটি প্রকাশের কারনে কিংবা সরকারের বিরোধিতা করায় দেশীয় অনেক জনপ্রিয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল অথচ দেশের সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ ভারতীয় যে চ্যানেলগুলো প্রত্যহ দেশের মানুষের শান্তি গ্রাস করছে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক তা নতুন করে ভেবে দেখা উচিত । দেশীয় যে চ্যানেগুলোর সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে সেগুলো সরকার ও সরকার সমর্থক শ্রেণীর জন্য হুমকি হলেও সেগুলো রাষ্ট্রের অস্থায়ী ক্ষতি করছিল কিন্তু ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘকালীন ক্ষতির কারণ হবে । যে ক্ষতির মাত্রা এখনও সম্পূর্নভাবে অনুমিত না হলেও নিকট ভবিষ্যতে বর্তমান প্রজন্ম যখন জাতির নেতৃত্ব দিবে তখন পুরোপুরিভাবে মাত্রা টের পাওয়া যাবে । সুতরাং সাবধান হওয়ার এটাই বোধহয় সর্বোত্তম সময় । তথ্যমন্ত্রী বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোকে ধারাবাহিকভাবে প্রথম রেখে অন্য দেশের চ্যানেলগুলোকে শেষে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো খুঁজে পেতে রিমোটের সবগুলো বাটন চাপতে হয় ! সরকারের দায়িত্বশীলরা এসব ক্ষতিকর চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করলেও অন্তত জাতীয় স্বার্থে আমাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে ।

অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপণ প্রচারের জন্য নীতিমালা থাকা আবশ্যক । বিরামহীন বিজ্ঞাপন প্রচারের কারনে উচ্চমানের অনুষ্ঠানও নিম্নমানে পরিণত করে । দেশীয় চ্যানেলগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বেশি বেশি খবর প্রচার । এত খবর যে তারা কোথায় পায় তা তারাই জানে ! বিশ্বের সকল দেশের খবর প্রচারের জন্য আলাদা চ্যানেল রয়েছে এবং তারা তাদের বিনোদেনের চ্যানেলে ক্ষুদ্র পরিসরে খবর পরিবেশন করে কিংবা কোথাও কোথাও খবর প্রচার থেকে বিরত থাকে । অথব বাংলাদেশের বিনোদনমূলক চ্যানেলগুলোতে বিদেশী রাষ্ট্রের সংবাদ প্রধান্য চ্যানেলগুলোর চেয়েও বেশি খবর প্রচার করে । যা দেশের টিভি দর্শক বিশেষ করে নারী দর্শকদের জন্য বিরক্তির অন্যতম কারণ । সুতরাং প্রতিদিন সর্বোচ্চ তিনবার খবর প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা-তা টিভিগুলোর ভেবে দেখা উচিত । ভারতীয় সিরিয়াল আসক্তদের মনে রাখা উচিত, ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত ১২টি সিরিয়াল আমাদের জাতীয় জীবনের ৬টি মূল্যবান ঘন্টা নষ্ট করে । কোন জাতির যদি উন্নতির স্বপ্ন থাকে তবে তারা ৬ ঘন্টা সময় অর্থহীনভাবে নষ্ট করার মত বোকামী করতে পারে না ।

বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ঘরের ভিতর যেমন বন্দি হয়ে থাকতে চাই না তেমনি চাই না অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধ আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক। ভারতীয় চ্যানেল, সিনেমার অবাধ বিচরণ আমাদের দেশে। আর তাই ইচ্ছে করলেও এই অবাধ বিচরণ থামাতে পারবো না। আমাদের সবকিছু্র সানিদ্ধ্যে আসতে হয়। কিন্তু এখান থেকেই আমাদের বুদ্ধি-বিবেক আর শক্তি দিয়ে খারাপ সংষ্কতি বর্জন করতে হবে। আমরা বাঙ্গালী। আর বাঙ্গালীদের রয়েছে গর্ব করার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংষ্কতি। আমাদের সাহিত্য- সংষ্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। তাই এ সমৃদ্ধ সংষ্কৃতির চর্চা করলে, বাংলা নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা দেখলে নিঃসন্দেহে কমে আসবে হিন্দি সিরিয়াল দেখার প্রবণতা। হিন্দি সিরিয়ালের এই অপসংষ্কৃতি রোধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি তরুণদেরকেও এই সংষ্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত করতে হবে।






No comments:

Post a Comment