Wednesday 31 August 2016

হৃদয়ে বাংলাদেশ হৃদয়ে শহীদ জিয়া ভালোবাসায় জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম মূল্যবোধ । শুভ জন্মদিন বিএনপি ।।

হৃদয়ে বাংলাদেশ হৃদয়ে শহীদ জিয়া ভালোবাসায় জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম মূল্যবোধ ।

শুভ জন্মদিন বিএনপি ।। 

সূফি বরষণ
বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত, আইনশৃঙ্খলা বিপর্যস্ত, জাতীয় জীবনে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা নির্বাসিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার সৈনিকদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে সুযোগসন্ধানীদের। জনগণকে সাথে নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জিয়াউর রহমান রাজনীতিকে গ্রহণ করেছিলেন জীবনধারারূপে। তার কাছে- politics is not a profession or job, it is a way of life. এই দর্শন ও বিশ্বাসই তাকে নিয়ে গিয়েছিল গণমানুষের কাছাকাছি।

দেশের ক্রান্তিকালে ‘বাকশাল’ সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই দিন যদি বিএনপি প্রতিষ্ঠিত না হতো তবে আজকের বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন ভাবে �লেখা হতো। স্বাধীন দেশের সংবিধানে চার মূলনীতির মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শুধু ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা, সমাজতন্ত্রের নামে লুটপাটের অর্থনীতি এবং ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার কর্মকাণ্ডে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। দেশের সর্বত্র তখন চলে মুজিবের গঠিত সন্ত্রাসী বাহিনী রক্ষীবাহিনী  ব্যাংক ডাকাতি, খুন ধর্ষণ লুটপাট। চার মূলনীতির অন্যতম উপাদান গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল শেখ মুজিবের ব্যর্থ শাসনে । আশাহত যুব সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে সর্বহারা পার্টি, গণবাহিনীসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি করে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শেখ মুজিবের তৎকালীন দুঃশাসন আর বর্তমান সময়ে শেখ হাসিনার দুঃশাসন কোনো অংশে কম নয়।

তৎকালীন সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ ও বহুমুখী ব্যর্থতার কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে এবং দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির ফলে ১৯৭৪-এ দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন সরকার আইনশৃঙ্খলাসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দেশে ‘রক্ষীবাহিনী’ নামে একটি বিশেষ বাহিনী সৃষ্টি করে। বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনী দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ২০ হাজার মানুষ হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে জনবিরোধী বাহিনীরূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং জনরোষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তৎকালীন সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। সরকার মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রকে পদদলিত করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করে।

শেখ মুজিব ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে । শেখ মুজিব বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যা করে। বাকশাল সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনীর গুম, খুন ও নির্যাতন চরম আকার ধারণ করে। সমগ্র জাতি শঙ্কিত ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনায় মগ্ন থাকে। বিভীষিকাময় এমনি এক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ও বিশৃঙ্খলার ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় জীবনে এক মর্মান্তিক ও কলঙ্কময় ঘটনার মাধ্যমে বাকশালের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগের অপর এক নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তার সহযোগীরা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এবং দেশে সামরিক আইন ঘোষণা করে। সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে ১৯৭৫ সালের ১ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে অনিশ্চয়তা ও চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে    সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতির ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাক আহমেদ সরকারের পতন হয়। অতঃপর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দেশের    রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২১ এপ্রিল, ১৯৭৭ তারিখে লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৩৬ সালের এমনই একটি দিনে বগুড়ার গাবতলীর বাগবাড়ীতে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল, তখন কে জানত এ শিশু বড় হয়ে তার প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন, বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রপতি হবেন? বিশ্ব ইতিহাসে শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। শহীদ জিয়া বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধকে রূপদান করেছিলেন একটি সমন্বিত মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা থেকে শুরু করে বাংলাদেশী জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান ও বিনির্মাণে তিনি কালজয়ী অবদান রেখে গেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেউলিয়াপনায় সমাজে চলছিল অস্থিরতা, সৃষ্টি হয়েছিল বৈষম্য। সামন্ত সমাজের নকল নবাবীর পরিণতিতে আমরা দেখেছি একদলীয় শাসন, দুর্নীতি ও দুঃশাসন। জিয়াউর রহমান বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে বটবৃক্ষের মতো বৃহৎ রাষ্ট্রের পাশে তালতরুর মতো শির উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যখন বিরোধী দলের ওপর সরকারি দলের দমন-নির্যাতন শুরু হয় তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আদর্শবিহীন সুযোগসন্ধানীরা।

শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মপরিকল্পনাকে সামনে রেখে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোকে এগিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিয়া বলতেন, ‘আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, তা না হলে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যাবে না। তাই সংগঠনে যারা থাকবেন, তাদেরকে পার্টির আদর্শ অবশ্যই জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং সেটা বিশ্বাস করতে হবে এবং সেই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে হবে।

আজ গণতন্ত্র রক্তাক্ত। সেই গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। জিয়ার প্রদর্শিত পথেই জনগণ বেগম জিয়ার পাশে রয়েছেন। চলমান সঙ্কটে তার সাথে বিদেশ থেকে পাশে দাঁড়িয়েছেন তারেক রহমান। জাতীয় সঙ্কটে গণতান্ত্রিক উত্তরণে তাদের প্রতি অবিচল আস্থা রাখার মধ্য দিয়েই জিয়ার আদর্শের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের নাম জিয়া। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে জাতীয় ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তাকে এ পথে আসতে হয়েছিল। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, এ জাতি তাকে হারিয়েছে এমন একসময়ে যখন তারই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। জিয়া আজো বেঁচে আছেন তার কর্মের মাধ্যমে, গণতন্ত্রের দিশারীরূপে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় শহীদ জিয়ার সততা, অনন্যসাধারণ বক্তিত্ব ও ন্যায়বোধ জাতির মানসলোকে ধ্রুবতারার মতো ভাস্বর হয়ে আছে, থাকবে চিরদিন।
শহীদ জিয়ার আদর্শকে সামনে রেখে দেশনেত্রী বেগম জিয়া বিএনপিকে সংগঠিত করে বিরাজমান সঙ্কটাবস্থা কাটিয়ে উঠবেন, এ দেশের মানুষ তা বিশ্বাস করে।

শহীদ জিয়ার রৌদ্রকরোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রতি অবশ্যই আমার দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক যে দর্শন রেখে গেছেন, তা আনাগত দিনগুলোতে নতুন প্রজন্মের পাথেয়।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ‘বাকশাল’ পূর্ব ও পরবর্তী সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশে এখন গণতন্ত্র অনুপস্থিত, বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত এবং দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি। জঙ্গি ভীতিতে আতঙ্কিত জনপদ। দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আজ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। শেয়ার মার্কেট ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটের মহোৎসব চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভও ডাকাতি হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশের রিজার্ভ ব্যাংকে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার নজির নেই। সমাজের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি স্থায়ী বাসা বেঁধে বসেছে।

 অর্থমন্ত্রীর ভাষায় প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে ‘পুকুর চুরি হয় না, সাগর চুরি’ হয়। সরকার বর্তমানে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করেছে। দেশে চলছে অলিখিত ‘বাকশালী’ শাসনব্যবস্থা। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ‘বাকশালী’ শাসনব্যবস্থা যেভাবে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল এবং দেশে একটি ক্রান্তিকাল সৃষ্টি করেছিল, আজ ঠিক একই অবস্থা বিরাজ করছে। বাকশাল সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে যে দলটি শহীদ জিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বর্তমান রাজনৈতিক শূন্যতা ও সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র শহীদ জিয়ার আদর্শের দল বিএনপি। এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই বর্তমান অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীর কোনো দেশে স্বৈরাচার, একনায়কত্ব এবং ফ্যাসিবাদী সরকার বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশেও তার কোনো ব্যতিক্রম হবে না।

দলের ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সবগুলো পুরনো কমিটি নিয়ে কাজ করছে। এরমধ্যে কৃষক দলের কমিটি ১৯ বছরের পুরনো। জাতীয়তাবাদী যুব দলে ৮ বছর, স্বেচ্ছাসেবক দল ৭ বছর, মহিলা দল ৫ বছর, মৎস্যজীবী দল ৬ বছর, উলামা দল ১২ বছর, ছাত্রদল ৩ বছরের পুরনো। সব কমিটি তামাদি হয়ে আছে। চেয়ারপার্সন ও মহাসচিবের বাণী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো বাণীতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আজকের দিনটি আমাদের সবার জন্য আনন্দ ও প্রেরণার। ১৯৭৮ সালের এই দিনে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাকশালী একদলীয় দুঃশাসনের জের ধরে সে সময়ে দেশে বিরাজমান চরম জাতীয় সংকটের কারণে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণ করতে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 তিনি বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপি বিগত ৩৮ বছরে বার বার সকলের অংশগ্রহণমূলক জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে এবং দেশ ও জনগণের সমৃদ্ধি ও কল্যাণে কাজ করে গেছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের এই প্রিয় দল অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশের নিজস্ব স্বকীয়তা, স্বাধীনতা রক্ষায় বিএনপি তার ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিএনপি প্রধান বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে বিএনপি ১৯৯১ সালে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালনকালে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশসহ দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিএনপির বলিষ্ঠ ভূমিকা জনগণ কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। এই কারণেই বিএনপি দেশবাসীর কাছে এখন সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অক্ষুণ্ন রেখে দেশ ও জনগণের সেবায় বিএনপি আগামী দিনগুলোতেও বলিষ্ঠ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ। অপর এক বার্তায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং দেশবাসীকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।

দেশের জনগণকে এ সরকারের জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার ঐতিহাসিক দায়িত্ব জনগণের বিশ্বস্ত ও জাতীয়তাবাদী শক্তির সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের। বর্তমান ক্রান্তিকালে দলকে আরও সুসংগঠিত, সাংগঠনিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী এবং দেশের সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে অনির্বাচিত, ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা আজ সময়ের দাবি। ‘স্বৈরাচার হঠাও, দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ স্লোগানকে ধারণ করে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

Wednesday 24 August 2016

গুজরাট ফাইলস ও মুসলিম গণহত্যার গোপন বিশ্লেষণ। পর্ব দুই।


গুজরাট ফাইলস ও মুসলিম গণহত্যার গোপন বিশ্লেষণ। পর্ব  দুই।



রানা আয়ুব।  লেখক ভারতীয় খ্যাতিমান নারী সাংবাদিক

ভারতের বিখ্যাত বামঘনার সংবাদ মাধ্যম তেহেলকায় কর্মরত রানা আয়ুব।

২. গভীরে ঢুকে তদন্ত করার প্ল্যান সম্বন্ধে বিস্তারিত জানিয়ে সিনিয়রদের মেল করার সাথে সাথেই উৎসাহব্যঞ্জক উত্তর এসে গেল – আমাকেও ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিতে হল। গুজরাতে তিন মাস থেকে যে পরিস্থিতিতে বিভিন্ন লোকেদের কাছ থেকে আমি খবরাখবর এবং তথ্যাবলী পাবার প্রতিশ্রুতি পেয়েছি, তাতে করে এটা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল যে, সামনের রাস্তা খুবই কঠিন। ক্ষমতার বিভিন্ন অলিন্দে থাকা একেকজন লোকের কাছ থেকে সত্যটাকে ছেঁকে বের করে নেওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না, বিশেষত যারা সত্যিটাকে জেনেবুঝে চেপে রেখেছে। আমার সহকর্মী আশিস খৈতান এই ধরণের কিছু হাড়হিম করা ঘটনা এক্সপোজ করেছিলেন বাবু বজরঙ্গী এবং স্থানীয় কিছু বিজেপি আর ভিএইচপি নেতাদের মুখ থেকে, তারা নিজের মুখে জানিয়েছিল ২০০২-এর দাঙ্গায় তাদের ঠাণ্ডা মাথায় ঘটানো কার্যকলাপের কথা। কিন্তু আমি তো ঠিক সেই ধরণের দাঙ্গাকারীদের সাথে কথা বলতে যাচ্ছিলাম না, যাদের সামান্য উসকে দিলেই গড়গড় করে নিজের বীরত্বের কথা ফলাও করে বলে যাবে;  আমি যাচ্ছিলাম খুব সীজনড, সিনিয়র আইপিএস অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে, যাদের অনেকেই র এবং আইবির সঙ্গে যুক্ত।

এরা সব মোটা চামড়ার ডিপ্লোম্যাট, এদের সাথে কথা চালাবার জন্য বিশেষ স্কিল এবং ব্যক্তিত্ব লাগে, সঙ্গে লাগে ক্ষমতা আর অথরিটি। এর কোনওটাই আমার ছিল না। প্ল্যানিং-এর পাশাপাশি পুরো স্টিংটা করবার দায়িত্বও ছিল একা আমার ওপরে। এটুকু আমি জানতাম যে এই কাজে আমি আমার অফিস থেকে কোনও জুনিয়রকে নিতে পারব না, তাতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল অফিস থেকে যে আমার এডিটররা আমার গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখবেন, কিন্তু বাকি সমস্তই আমাকে নিজেকে করতে হবে। প্রতিবার আমি ট্র্যান্সক্রিপ্ট পাঠাতাম আর বদলে সোমা আর তরুণের কাছ থেকে উৎসাহব্যঞ্জক রিপ্লাই পেতাম – ‘এক্সেলেন্ট, কীপ অ্যাট ইট’ কিংবা ‘স্টানিং রিভিলিশন’। উৎসাহ আমি পেতাম ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে এটাও জানতাম যে এই ময়দানে আমি একলা সৈন্য। আমাকে নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হত, তার সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হত আমি যা জোগাড় করতে চলেছি তা হতে হবে সৎ, নিখুঁত আর তথ্যনির্ভর প্রমাণ।

এমন কিছু লোক ছিলেন যাঁরা সত্যিটাকে জানতেন এবং সেগুলোকে নিজের মধ্যেই চেপে রেখে এমনভাবে জীবন কাটিয়ে চলেছিলেন, যেন ২০০২ সালে যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এখানে চলেছিল, তা কখনোই তাঁদের কেরিয়ারের অংশ ছিল না। তেহেলকার মত একটা ইনভেস্টিগেটিং অর্গানাইজেশনের জার্নালিস্ট হিসেবে আমি জানতাম, যে যে দরজাগুলোয় ধাক্কা দিলে আমার সাহায্য পাবার সম্ভাবনা আছে, সেই সমস্ত দরজা আমার জন্য বন্ধ। একটাই রাস্তা আমার কাছে খোলা ছিল, যা সত্য উদ্ঘাটনের শেষ উপায় হিসেবে যে কোনও সাংবাদিক বেছে নেবেন। গো আন্ডারকভার। আমি ছাব্বিশ বছরের একটা মেয়ে, বিশেষত একটা মুসলিম মেয়ে। আমি কখনও আমার এইসব পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাই নি, কিন্তু ধর্মের নামে মেরুকরণ ঘটে যাওয়া একটা রাজ্যে এই ধরণের কাজে নামতে গেলে এই পরিচয়গুলোকে নিয়ে সচেতনে মাথা ঘামাতেই হয়। আমার বাড়ির লোককে জানাতে হবে, আমি কী করতে চলেছি, কী হতে চলেছি।

আমি একটা নামকরা মাস কমিউনিকেশনের কোর্স করেছিলাম, সেইটা এবার কাজে এল। আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে একজন উঠতি নায়িকাও ছিল যে ইদানিং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ নাম করে ফেলেছে। রিচা চাড্ডা এখন একজন নামকরা হিরোইন, সম্প্রতি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিল যে, সে আমার কেরিয়ার গ্রাফ আর অভিজ্ঞতা দেখেই নাকি একটা ফিল্মে রিপোর্টারের রোল করবার অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। এই রকম আরেকজন প্রিয় বন্ধুকেও ফোন করে ফেললাম, যার সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ করা হয়ে ওঠে নি। বন্ধুর সাহায্যে আমি তার মেক-আপ ম্যানের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করলাম। পরের দিন, আমি মুম্বাই শহরতলীর একটা স্টুডিওতে বসে চা খেতে খেতে সঠিক পরচুলা পছন্দ করার টেকনিকালিটির ব্যাপারে জ্ঞান আহরণ করছিলাম। মেক-আপ আর্টিস্টের অভিজ্ঞতা অনেকদিনের, তিনি আমাকে তাঁর স্টকের পরচুলা দেখালেন। পরচুলা পরে আলাদা লাগছিল আমাকে, কিন্তু ঠিক যেন খাপ খাচ্ছিল না, বড় বেশি নকল নকল লাগছিল। পরচুলা আমার ঠিক কাজে এল না।

তখন মাথায় বুদ্ধিটা এল, চুল না বদলে, নিজের পুরো পরিচয়টাই বদলে ফেললে কেমন হয়? …ভাগ্যক্রমে এই সময়েই আমি একটা গ্রুপ আইডিতে একটা মেল পেলাম, পাঠিয়েছিল আমার এক সময়ের কলেজের ক্লাসমেট যে পরে লস অ্যাঞ্জেলসের নামকরা আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিট্যুট কনসার্ভেটরি জয়েন করেছিল। আমার মাথায় বুদ্ধি খেলল, এ-ই হবে আমার আইডেন্টিটি। আমেরিকা থেকে আসা একজন ফিল্মমেকার, যে গুজরাতে এসেছে কিছু একটা ফিল্ম বানাতে। আইডিয়াটা মারাত্মক, কিন্তু রূপায়ণ করা খুব অসম্ভব ছিল না।

পরের কয়েকদিন ধরে আমি সেই কনসার্ভেটরি, তার কাজকর্ম, অ্যালামনি, তাদের বানানো ফিল্ম এইসব নিয়ে পড়াশোনা করলাম, পাশাপাশি গুজরাত নিয়ে কী কী ধরণের ফিল্ম বানানো হয়েছে আজ পর্যন্ত, এবং তাতে গুজরাতের কীসে কীসে বেশি ফোকাস রাখা হয়েছে, তা নিয়েও খোঁজাখুঁজি করলাম। অবশেষে, আমি ঠিক করলাম আমার ফিল্মের বিষয় নির্দিষ্ট কিছু থাকবে না, যে চরিত্রের সঙ্গে আমি দেখা করতে যাব, তাদের কে কেমন ব্যবহার করে তার ওপর ভিত্তি করে আমি আমার ফিল্মের স্ক্রিপ্ট বা বিষয় বদলে দেব। আমাকে একটা নাম বাছতে হবে, ঘরোয়া, কনজার্ভেটিভ কিন্তু এমন নাম যা দিয়ে আমার কাজ চলে যাবে।

এখানে একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আমি সিনেমার পোকা, এবং সেটা আমাকে বিশালভাবে সাহায্য করেছিল। হিন্দি ফিল্ম দেখতে আমি খুব ভালোবাসি আর যদ্দূর মনে পড়ছে, ওই সময়ে আমি যে হিন্দি ফিল্মটা দেখেছিলাম, সেটা ছিল রাজকুমার সন্তোষীর “লজ্জা”। দিল্লি থেকে মুম্বাই আসার পথে একটা ফ্লাইটে বসে আমি সিনেমাটা দেখেছিলাম। সিনেমাটার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তার বলিষ্ঠ মহিলা চরিত্রগুলো, যা দুর্দান্তভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন মাধুরী দীক্ষিত আর মনীষা কৈরালা। সেখানে মনীষার অভিনীত চরিত্রটির নাম ছিল ‘মৈথিলী’, ভারতীয় মেয়েদের জাত আর লিঙ্গপরিচয়ের ভিত্তিতে যে বৈষম্য সহ্য করে যেতে হয়, সেটাই এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মৈথিলী,  শ্রীরামচন্দ্রের ধর্মপত্নী সীতার আর এক নাম। নামটার মধ্যে কিছু একটা জিনিস ছিল যেটা আমার মনে বসে গেল। সেই জন্য আমি যখন নিজের জন্য দ্বিতীয় একটা নাম খুঁজছিলাম, যেটা পদবীর ভারে ভারাক্রান্ত থাকবে না, আর নামটাও ব্রাহ্মণ বা দলিত-ঘেঁষা হবে না, ‘মৈথিলী ত্যাগী’ নামটা আমি ফাইনালি পছন্দ করলাম। আমার ভিজিটিং কার্ড তৈরি হলঃ মৈথিলী ত্যাগী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার, অ্যামেরিকান ফিল্ম ইনস্টিট্যুট কনজার্ভেটরি।

কিন্তু, দ্বিতীয়বার গুজরাত যাবার প্রস্তুতি শুরু করবার আগে আমার দরকার একজন সহকারী, যাকে আমি পেয়েও গেলাম খুব তাড়াতাড়ি এবং যার অস্তিত্ব আমার জীবনে এক গভীর ছাপ রেখে গেছে। মাইক (নাম পরিবর্তিত) ছিল ফ্রান্সের এক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, সে ভারতে এসেছিল কোনও স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে। মাইক চাইছিল কোনও ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে থেকে ভারতে কাজ করতে। আমি তাকে একটা ইমেল লিখলাম, আমার ইনভেস্টিগেশনের বিষয়-লক্ষ্য সম্বন্ধে খুব বিশদ বিবরণ ছাড়াই, যদিও আমি যতটুকু লিখেছিলাম, তাতে আমি কোনও অসত্য কথা লিখি নি।

আমি জানিয়েছিলাম আমি একজন অ-ভারতীয় সহকারী চাইছি, যে আমার সাথে একটা ফিল্ম শুট করার কাজে সাহায্য করবার অভিনয় করতে পারবে। আমি তাকে আরও জানিয়েছিলাম যে, এটা একটা অনেক বড়, খুবই স্পর্শকাতর ইনভেস্টিগেশনের অংশ হিসেবে জরুরি, কিন্তু মাইক কখনওই সেই স্পর্শকাতর বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চেষ্টা করবে না। আর এটাও জানিয়েছিলাম, তাকে আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে আমার একজন “ফিরঙ্গ্‌, সাদা-চামড়া” সহকারীর মুখ হয়ে, যাতে আমার পরিচয়ে কেউ কখনও কোনও সন্দেহ না করে।

এর পর, ভিজিটিং কার্ড ব্যাগে ভরে, চোখে ছাই-ধূসর রঙের লেন্স লাগিয়ে, হেয়ার স্ট্রেটনার আর রঙবেরঙের বাঁধনী নিয়ে, আর কিছু রেকর্ডিং ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে আমি আহমেদাবাদে ল্যান্ড করলাম। মাইকের আসার কথা আরও দিন দুয়েক বাদে। পৌঁছনোর সাথে সাথেই আমি মৈথিলী ত্যাগী নামে একটা সিম কার্ড কিনলাম। আমার আহমেদাবাদের তথাকথিত “গার্জিয়ান ফ্যামিলি”র দেওয়া ডকুমেন্ট দিয়ে ব্যাপারটা এত সহজে হয়ে গেল, দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এই ইনভেস্টিগেশন অনেক লম্বা সময় ধরে চলবে। আমি বা আমার সংস্থা, কেউই অত দিন ধরে কোনও নামীদামী হোটেলে আমার থাকাখাওয়ার খরচ বইতে সক্ষম নয়। তার ওপর আমি অভিনয় করছি একজন স্ট্রাগলিং ফিল্মমেকারের, যার খুব অঢেল টাকাপয়সা নেই। এই রকমের একটা চরিত্রের জন্য থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে পারে একমাত্র স্থানীয় কনট্যাক্ট। এইবারে আমাকে সাহায্য করলেন আমার এক শিল্পী বন্ধু, যাঁর আহমেদাবাদের সাহিত্যিক এবং শৈল্পিক মহলে খুব ভালো জানাশোনা আছে। ভাগ্য ভালো তিনি আমাকে খুব বেশি কোনও প্রশ্ন করেন নি। আমিই সেই জার্নালিস্ট যার জন্য গুজরাতের হোম মিনিস্টারকে জেলে যেতে হয়েছে, এই তথ্যটুকুই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল, তিনি সহজেই তাঁর প্রভাব খাটিয়ে নেহরু ইনস্টিট্যুশন নামে একটা এডুকেশনাল ইনস্টিট্যুটে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।

হস্টেল ওয়ার্ডেনের কাছে আমার পরিচয় দেওয়া হল একজন ফিল্মমেকার হিসেবে, উনি আমার দিকে তাকিয়েও দেখলেন না, কেবল খুব হাত পা নাড়িয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করে গেলেন। হস্টেলের একটা ২৫০ স্কোয়্যার ফিটের একটা ঘরে, ওয়াশরুম সংলগ্ন, আমার খুব সহজেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল, দৈনিক আড়াইশো টাকার কড়ারে। এর সাথে সাথে, আমার আশেপাশের ঘরের বোর্ডাররাও আমার ইনভেস্টিগেশনের কাজে খুব সাহায্যে এসেছিল। এরা ছিল ইওরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীর দল – জার্মানি, গ্রীনল্যান্ড, লন্ডন।

হস্টেলে আমার প্রথম পরিচিতি ছিলেন মানিক ভাই (নাম পরিবর্তিত), হস্টেলের ডীন বা ম্যানেজার। “ম্যাডাম এখানে গুজরাত নিয়ে একটা ফিল্ম বানাতে এসেছেন” বলে আমার বন্ধু তাঁর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। “বাঃ, দারুণ”, বলেছিলেন মানিক ভাই, “আমার শহর আর আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা বলবেন কিন্তু। আমাদের আহমেদাবাদ কিন্তু সত্যিই একটা সুন্দর শহর।” একনিশ্বাসে কথাগুলো বলেই উনি আমাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আমার ছোট্ট ঘরে একটা খাট, একটা টেবিল আর একটা বইয়ের স্ট্যান্ড ধরে যাবার মত জায়গা ছিল। কিন্তু জায়গার অভাব পুষিয়ে দিয়েছিল হস্টেলের লোকেশনটা। গুজরাতের অন্যতম একটা কর্মব্যস্ত শহরের ঠিক মধ্যিখানে এই হস্টেলটা পরের ছ মাসের জন্য আমার ঘর হয়ে গেছিল।

মাইক এল পরদিন সকালে, ফর্সা দীর্ঘকায় এক ফরাসী কিশোর, উনিশ বছর বয়স্ক, একমাথা এলোমেলো চুল। ওকে হস্টেলে নিয়ে আসার আগে আমি ওর সাথে দেখা করলাম এক বন্ধুর বাড়িতে, ওকে মোটামুটি ওর রোল সম্বন্ধে বোঝালাম।

মানিক ভাইয়ের অশেষ দয়ার শরীর, উনি আমার পাশের ঘরেই পরের এক মাসের জন্য মাইকের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। অবশ্য মাইক যে তার আগেই “কেম ছো” বলে তাঁর মন জিতে নিয়েছিল, সেটাও এখানে বলে রাখা উচিত। মাইক ছিল একজন শিক্ষার্থী, নিজে নিজেই সংস্কৃতি শিখে নেবার এক অদম্য প্রচেষ্টা তার মধ্যে কাজ করত, যদিও তার বিশেষ নজর ছিল খাওয়াদাওয়ার প্রতি। আমরা প্রথম সন্ধ্যেয় ডিনার সারলাম পাকওয়ান নামে আহমেদাবাদের বিখ্যাত থালি জয়েন্টে। বেশ মনে আছে, মাইক প্রায় দু ডজন পুরি আর ছ বাটি হালুয়া খেয়েছিল একসঙ্গে, আমি হাঁ করে দেখেছিলাম।

খেয়েদেয়ে আমরা হস্টেলের সিঁড়ি দিয়ে যখন উঠছিলাম, মাইক আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘তো – আশেপাশে যখন আর কেউ থাকবে না, তখন কি আমি তোমায় রাণা বলে ডাকতে পারি?’

‘না। আমার নাম মৈথিলী, যতক্ষণ তুমি এই দেশে আছো।’

মাইক কথা রেখেছিল। যেদিন সে শেষবারের মত প্যারিস চলে গেল, তার একদিন আগে আমার জন্য হিন্দিতে একটা ছোট্ট নোট লিখে রেখে গেছিল, ‘প্রিয় মৈথিলী, ভালো থেকো – মাইক।’

নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য প্রথম কয়েকদিন আমরা নেহরু ফাউন্ডেশনের ভেতরেই কাটালাম। মাইক তার ঘরে বসে একটা ফ্রেঞ্চ-হিন্দি ট্রানস্লেশনের বই নিয়ে বসে আমাকে পরের পর প্রশ্ন করে চলত, আর তার সাথে সাথেই মার্ক টালির একটা বই পড়ত। বয়েসের তুলনায় মাইক ছিল খুব পড়ুয়া, নিজস্ব মতবাদ তৈরি হওয়া, খোলা এবং যুক্তিপূর্ণ মননের একজন মানুষ। খুব দ্রুত সে কোনও বিষয়ে বিস্তারিত পড়ে ফেলতে পারত। আমাদের ফাউন্ডেশনে একটা ক্যান্টিন ছিল যেখানে লাঞ্চের থালি পাওয়া যেত ২৫ টাকায়। তার সামনেই ছিল একটা বাঁকানো সিঁড়ি, আর সেই সিঁড়ির প্রান্তে ছিল ইনস্টিট্যুটের টেরেস, সেই টেরেসের অন্যপ্রান্তে ছিল ছবির মত একটা জঙ্গল। প্রত্যেকদিন দুপুরে মাইক আর আমি টেরেসে চলে যেতাম ল্যাপটপ নিয়ে, লাঞ্চ করতে করতে কাজ করতাম। মাইক আমায় প্রায়ই প্রশ্ন করত, ‘তো মৈথিলী, এবার আমাদের প্ল্যান কী? কার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে?’ আর আমি জবাব দিতাম, ‘সঠিক সময় এলেই আমি তোমায় জানাবো।’

সন্ধ্যের দিকে মাইক আর আমি ক্যামেরা নিয়ে পুরনো সিটিতে ঘুরতে বেরোতাম, ফটো তুলতাম। আমাদের দুজনেরই ফটোগ্রাফিতে শখ ছিল, আর আমাদের দুজনেরই একই মডেলের এসএলআর ক্যামেরা ছিল। আমাদের এই ফটো তুলতে ঘোরার সাথে যদিও আমাদের প্যাশনের কোনও সরাসরি সম্পর্ক ছিল না, আমরা শুধু যে পরিচয়ে অভিনয় করছি, সেই পরিচয়টাকেই পোক্ত করার তাগিদ ছিল, যাতে, যদি আমাদের কেউ লুকিয়ে ওয়াচ করে থাকে, সে বা তারা কোনওভাবেই আমাদের সন্দেহ না করে। যদি কখনও কোনও উঁচু পদের অফিশিয়ালের সাথে আমাদের দেখা করতে হয়, তখন তার আগে তো আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেকিং হবেই – বিশেষত আমরা যে এলাকায় রয়েছি, সেই এলাকায় আমাদের নামে খোঁজখবর নেওয়া হবেই। আমরা চাইছিলাম আহমেদাবাদে আমাদের নিজেদের একটা সামাজিক পরিচয় তৈরি করতে – যেটা পরে আমাদের নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করবে।

আমদাবাদ নি গুফা – বিখ্যাত চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেনের প্রতিষ্ঠিত এই বিখ্যাত আর্ট মিউজিয়ামটা এই ব্যাপারে আমাদের খুব কাজে এল। মিউজিয়ামটার চারপাশে ঘিরে আছে একটা বিশাল পার্ক, একপ্রান্তে একটা ক্যাফে যেখানে মূলত আর্টিস্ট আর ফোটোগ্রাফাররা ভিড় জমায়। কেউ হয় তো গীটার বাজাচ্ছে, কেউ তার কাজের প্রোমোশন করছে। এ ছাড়াও কিছু উঠতি ফিল্মমেকার, ফোটোগ্রাফার আর থিয়েটার আর্টিস্ট সেখানে আসা-যাওয়া করে। সন্ধ্যেবেলায় সেখানে গিয়ে মৈথিলী হিসেবে আমি, আর মাইক খুব এনজয় করতাম।

লাল দরওয়াজা, পুরনো গুজরাতের খুব নামকরা একটা জায়গা, মাইকের খুব পছন্দ ছিল। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সেখানে হাট বসে। নানা ধরণের ঘুড়ি আর মাটির জিনিস নিয়ে লোকজন বসে সেখানে। সারাদিন সেখানে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যেবেলায় ফিরে এসে মাইক কিছু দারুণ দারুণ শট দেখাত, আর তারপরেই তার চিরাচরিত প্রশ্ন হত, ‘আজ রাতে আমরা কোথায় খেতে যাচ্ছি?’ মাইক খেতে কিছু ভালোবাসত, আর এই বিষয়ে গুজরাত তার জন্য ছিল আদর্শ জায়গা।

এই সময়ে এক অ্যাক্টিভিস্ট বন্ধুর ইমেলের মাধ্যমে প্রথম সাহায্য এল। আমি কয়েকজন বড় বড় অফিসারের সাথে কনট্যাক্ট বানাবার চেষ্টা করছিলাম, তাঁদের মধ্যে প্রথম নামটা ছিল জি এস সিঙ্ঘল-এর; তিনি তখন গুজরাত এটিএস-এর সর্বেসর্বা। সিঙ্ঘলের বিরুদ্ধে তখন তদন্ত চলছিল, ইশরাত জাহান ফেক এনকাউন্টারের ঘটনায় তাঁর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে। আমার সাংবাদিক আর অফিসার বন্ধুদের দেওয়া খবরের ভিত্তিতে আমি শুধু এটুকুই জানতে পেরেছিলাম, উনি নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছেন, বন্ধুর সংখ্যাও কমিয়ে দিয়েছেন, আর মিডিয়াকে একেবারেই এন্টারটেইন করেন না। জানতে পেরেছিলাম, এখন উনি প্রায় সকলকেই সন্দেহের তালিকায় রাখেন। ওনার কাছে পৌঁছবার তা হলে উপায় কী?

ইমেলে ছিল নরেশ আর হিতু কানোদিয়ার নাম, গুজরাত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দুই নামকরা অভিনেতা। নরেশ কানোদিয়াকে বলা হয় গুজরাতের অমিতাভ বচ্চন। হিতু এঁরই ছেলে, দক্ষিণ মুম্বাইতে পড়াশোনা করার পরে বাবার রাস্তাই বেছে নিয়েছেন, কারণ হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সফল হতে গেলে অনেক বেশি সময় লেগে যেতে পারত।

ইমেলে লেখা ছিল এই দুই কানোদিয়া দলিত সম্প্রদায়ের এবং সিঙ্ঘল সমেত বিভিন্ন অফিশিয়ালের সঙ্গে এঁদের ওঠাবসা আছে। ঘটনাচক্রে সিঙ্ঘল নিজেও একজন দলিত। আমি সাথে সাথে নরেশ কানোদিয়াকে ফোন করলাম এবং উনি আমাকে পরদিন সকালে আহমেদাবাদ জিমখানায় দেখা করতে বললেন। যদিও দেখা করে বিশেষ কিছুই লাভ হল না। আমি এত কায়দা করে ইংরেজিতে অ্যাকসেন্ট এনে কথা বলতে লাগলাম, আর উনি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইলেন। এওবার উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, চুলে একবার চিরুনি চালালেন আর তার পরে খুব নিস্পৃহ গলায় আমাকে বললেন, ‘বেন, হিন্দি মে বোলো না, আর একটু আস্তে বলো, বহুত ফাস্ট হো তুম।’

আমার হোমওয়ার্ক ঠিক ছিল না। পরবর্তী এক ঘণ্টা ধরে আমি আমার ফিল্মের বিষয় নিয়ে তাঁকে বিস্তারিত বোঝালাম – গুজরাতের যে সব বিষয় নিয়ে লোকে কম জানে, যেমন, গুজরাতি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, আর গুজরাতের দলিত বর্গের সাফল্যের কাহিনি,সেইগুলো আমি তুলে ধরতে চাই আমার ফিল্মে। মনে হয় কথাগুলো ওনার মনে দাগ কাটল, চোখে ঝিলিক দেখতে পেলাম। একজন লোক যে নিজেকে ‘স্টার’ মনে করে, কিন্তু হিন্দি সিনেমার দাপটে যার জনপ্রিয়তা নিজের রাজ্যেও খুব বড়মাপের কিছু নয়, তার কাজের স্বীকৃতি দিচ্ছে একজন ‘বিলায়েতি’ ফিল্মমেকার, এর একটা প্রতিফলন তো পড়বেই তার চোখের দৃষ্টিতে।

কানোদিয়া আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন, পরদিন ১০০ কিলোমিটার দূরের একটা গ্রামে যেতে, ফিল্মের সেটে তাঁর কেরামতি দেখবার জন্য। সেদিন কথা শেষ করে আমি যখন ঘরে ফিরেছিলাম, বিছানায় বসে বসে কেবল ভাবছিলাম, কেন এই নিষ্ফল কাজকর্মে জড়াচ্ছি নিজেকে। যে সম্ভাবনার পেছনে দৌড়চ্ছি, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু এ ছাড়া তো আমার আর কোনও উপায়ও নেই। … আমার এসএলআর ক্যামেরা আর নোটবুক নিয়ে আমি পরদিন সকালে বেরোতেই মাইক আমাকে আটকাল। ‘তুমি লেন্স নিতে ভুলে গেছো।’ … আমি অভিনয়ে এখনও অতটা দক্ষ হয়ে উঠি নি।

ফিল্মের সেট সাজানো হয়েছে শহরের একদম বাইরে একটা গ্রামে, হাজারো মানুষ ভিড় করে শুটিং দেখতে এসেছে। কানোদিয়ার ছেলে হিতু, দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ঝকঝকে গ্রাজুয়েট একটা কয়েদীর পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে, আর বাবার পরণে পুলিশের পোশাক।

আমাকে একটা চেয়ার দেওয়া হল, বসে বসে শুটিং দেখবার জন্য। আমি মন দিয়ে নোট নিতে থাকলাম আর শুটিংয়ের বিভিন্ন সিকোয়েন্সের ফটো তুলতে লাগলাম। অবশ্য আমি একলা ছিলাম না – একজন সদ্য তিরিশ ছোঁয়া যুবককে দেখলাম, ট্রাইপড আর লেন্স নিয়ে কিছু সিকোয়েন্সের দুর্দান্ত সব শট নিচ্ছে। হাবভাবে তো মনে হল না সে এই শুটিং ইউনিটের কেউ। কানোদিয়া মাঝে একবার এসে আলাপ করিয়ে দিয়ে গেলেন যুবকটির সাথে, ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার হিসেবে, সে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে একবার আমার আর মাইকের দিকে তাকিয়ে দেখল শুধু। তার নাম অজয় পঞ্জওয়ানি (নাম পরিবর্তিত), যার সাথে পরের কয়েক মাসে আমার এক অদ্ভূত সখ্যতা হল, এক এমন গভীর বন্ধুত্ব যা হয় তো আমি আমার আসল পরিচয় নিয়ে করতে পারতাম না। কিন্তু মৈথিলী পারল, হয়তো মৈথিলীর এই বন্ধুত্বটা দরকার ছিল।

পরের কয়েকদিন আমার এইভাবেই কাটল, কানোদিয়ার ফিল্মের সেটে যাওয়া, গল্পগুজব করা, ফিল্ম জগতের বিষয়ে কিছু আলোচনা করা, আর ‘ইউনিট কি চায়’তে চুমুক দেওয়া।

অজয়ও রোজ আসত ফিল্মের সেটে, গুজরাতি ফিল্মের ওপর ডকুমেন্টারি বানানোর কাজে, সে খুব মার্জিত ব্যবহার করত আমাদের সাথে, সময়মত জানিয়েও দিয়েছিল কোনও সাহায্যের প্রয়োজন হলে তাকে জানাতে। এই রকমই একদিন আলোচনার মধ্যে আমি আসল কথাটা পাড়লাম, যে আমি গুজরাতের কয়েকজন নামকরা পুলিশকর্তার সাথে দেখা করতে চাই, বিশেষত যাঁরা দলিত সম্প্রদায়ের থেকে উঠে এসেছেন। আমি কানোদিয়াকে বলেছিলাম, যদি এই রকমের কোনও অফিসার খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদে আসীন থাকেন, যেখানে খুব সাহসিকতার প্রয়োজন হয়, যাঁর কাজকর্মের মাধ্যমে গুজরাতের সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদের একটা আভাস পাওয়া যায়, তা হলে তিনি আমার খুব কাজে আসবেন।

শেষ লাইনে ম্যাজিকের মত কাজ হল। ‘আপনার তো তা হলে মিস্টার সিঙ্ঘলের সাথে দেখা করা উচিত, অন্যতম সেরা অফিসার, প্রচুর সন্ত্রাসবাদীকে উনি মেরেছেন।’ আমি প্রাণপণ চেষ্টা করলাম নিজের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রাখতে, এমন ভাব দেখালাম যেন নামটা আমি এই প্রথম শুনছি।

‘তো এই অফিসার সিঙ্ঘল কী করেন স্যর, মানে কী ধরণের কাজ করেন?’ অত্যন্ত নিরীহ মুখে আমি প্রশ্নটা করলাম। আমার ফিল্মি বন্ধুদের কাছ থেকে এটাই তো আমি চাইছিলাম, একটা এন্ট্রি পয়েন্ট, এমন একটা রেফারেন্স যেটা কোনও সন্দেহের উদ্রেক ঘটাবে না, সিঙ্ঘল আর যাই হোক, একজন টপমোস্ট রিজিওনাল ফিল্মমেকারের রেফারেন্সে আসা আরেকজন ফিল্মমেকারকে কোনওভাবেই সন্দেহ করবেন না।

প্রায় একই সময়ে আমার আহমেদাবাদের সোর্স, যাকে আমি আমার সাহায্যের ধরণ সম্বন্ধে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম, আমাকে আরেকটা ইমেল পাঠালেন। তাতে ছিল আরেকটা কনট্যাক্ট, শহরের এক অন্যতম একজন খ্যাতনামা স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ, যাঁর নাম আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই না।

আমার ইউনিনর মোবাইলের নেটওয়ার্ক ঘরের মধ্যে সবসময়ে কাজ করত না, তাই বেশির ভাগ সময়েই আমাকে বাইরে টেরেসে এসে কথা বলতে হত, যেখানে হস্টেলের বাসিন্দারা চা সিগারেট নিয়ে সবসময়েই ঘোরাফেরা করত। মাইকও তাদের মধ্যে একজন ছিল। সেদিন আমি টেরেসে দাঁড়িয়ে সেই গাইনিকোলজিস্টকে ফোন করলাম, নিজের পরিচয় দিলাম ফিল্মমেকার হিসেবে, বললাম আমি গুজরাতের ওপর ফিল্ম বানাতে চাই এবং তাতে গুজরাতের হেলথ সেক্টরও দেখাতে চাই। ডাক্তারটি সহৃদয় ব্যক্তি, আমাকে সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই তাঁর হাসপাতালে আসতে বললেন। আমিও তো সেটাই চাইছিলাম। আমি বেরোবার প্রস্তুতি নিতেই মাইক দৌড়ে এল, ‘মৈথিলী, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’ ও বলে চলল, ‘মৈথিলী, এইভাবে তো কাজ করা যায় না। তুমি যার সাথেই দেখা করছো তাকেই বলছো তুমি নাকি একটা ফিল্ম বানাচ্ছো, কিন্তু অন্তত আমাকে তো সত্যি কথাটা বলো!’ আমি চেষ্টা করলাম মাইকের কৌতূহলকে পাশ কাটাতে, কিন্তু মাইক অত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়, সে যেন আমার পাশ কাটানোতে আহত হল। ‘আমি তো বাচ্চা ছেলে নই, আমি প্রচুর পড়াশোনা করি, জীবনে কিছু একটা করেছি আমি। তুমি আমাকে বলো, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো? নাকি আমি তোমার কাছে স্রেফ একটা বিদেশী মুখ, যাকে তুমি একটা অ্যাকসেসরি হিসেবে জায়গায় জায়গায় দেখিয়ে বেড়াচ্ছো?’ আমি প্রথমে ভাবলাম, এগুলো বোধ হয় ও অনেকবার ঝালিয়ে এসে তবে আমাকে বলছে, কিন্তু ওর এই ফেটে পড়া ভাবে এমন একটা কিছু ছিল, যে আমাকে ওর বিশ্বাস ধরে রাখবার জন্য আমার আসল তদন্তের ব্যাপারে ওকে কিছু জানাতে হল। মিটিংয়ে বেরোবার আগে আমি ওকে কিছু লিঙ্ক ফরোয়ার্ড করে পড়তে বলে গেলাম যাতে আমি ফিরে আসতে আসতে ও আমার তদন্তের বিষয়বস্তুর পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটা বুঝে ফেলতে পারে।

ডাক্তারের সাথে দেখা করাটা আমার খুব কাজে এল। উনি আমাকে সাহায্য করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আগ্রহী ছিলেন। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম যদি কোনও মহিলা ডাক্তারের সাথে উনি যোগাযোগ করিয়ে দেন; এমন কেউ যিনি গুজরাতে বেশ জনপ্রিয়, যাঁকে আমি আমার ফিল্মের জন্য শুট করতে পারি। আমি উত্তরটা আন্দাজ করেছিলাম, এমনি এমনি কি আর আমি একজন গাইনিকোলজিস্টের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম? ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে একটা দগদগে ঘা হয়ে আছে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ উস্কানিদাতাদের মধ্যে একজন ছিলেন মায়া কোদনানি, আহমেদাবাদের একজন এমএলএ, দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের জবানবন্দীতে যাঁর নাম বার বার উঠে এসেছে। কোদনানি আমার জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন, কারণ আমি আশা করেছিলাম যে স্টোরির খোঁজে আমি এসেছি, তার গভীর পর্যন্ত আমাকে যেতে সাহায্য করতে পারেন ইনি।

সেদিন সন্ধ্যেতেই আমার উপস্থিতিতে ডাক্তার মায়া কোদনানিকে কল করে জানালেন, ইউএসএ থেকে আসা, দারুণ প্রোফাইলের একজন ফিল্মমেকার এসেছেন তাঁর ইন্টারভিউ নিতে এবং তিনি নিজে এর প্রতিভা সম্বন্ধে সংশয়হীন। আমার অভিনয় নিখুঁতভাবে বজায় রাখবার জন্য আমি এর পরেও সপ্তাহে একদিন করে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে আসতাম, আমার ‘রিসার্চ ওয়ার্ক’এর জন্য।

সেদিন সন্ধ্যেয় আমি যখন হস্টেলে ফিরে এলাম, দেখি মাইক ততক্ষণে একটা কাগজে আমার জন্য অনেক প্রশ্ন টুকে রেখেছে, সব পড়ার পরে ওর যাদের “ক্রিমিনাল” মনে হয়েছে, তাদের নাম সমেত। মাইকের কথাই ঠিক, ওকে যে স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের এ দেশে নিয়ে আসা হয়েছে, তার কারণ আছে। সেই সন্ধ্যেয় ও আমার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনল, সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্ন রাখল, আর সঠিক তথ্য নথিবদ্ধ করল। আমি ওকে জানালাম আমি কীভাবে আমার প্ল্যান দরকার মত পাল্টাবো যদি আগের প্ল্যান ঠিকমত কাজে না আসে। ও জিজ্ঞেস করল, কীভাবে প্ল্যান করা হবে। আমি বললাম, “কালকে, কালকে আমরা বসব আমাদের প্রথম প্ল্যান টেস্ট করতে।’

পরের দিন আমাদের মায়া কোদনানির সাথে দেখা করার ছিল। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট হবার সুবাদে আমার এটা জানা ছিল যে, কোনও জায়গা থেকে তথ্য প্রথম থেকেই বেরোতে শুরু করে না, আর যখন তা বেরোয়, তখন খুব বেশি আগ্রহ প্রকাশ করতে নেই। আমি মাইককে প্রস্তুত করলাম সেইমত। ‘আজ আমাদের ফিল্মমেকার সাজতে হবে, জাস্ট ফিল্মমেকার।’ নারোদার মেন রাস্তার ওপরে মায়াবেনের ক্লিনিক। নারোদা-পাটিয়ার কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছিল এই তিনবার এমএলএ হওয়া ডাক্তারের ক্লিনিক থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে – যে হত্যাকাণ্ডে একশোরও বেশি লোককে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল। এঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এটাই, যে হত্যাকারীরা সেদিন প্ররোচনামূলক শ্লোগান দিতে দিতে মুসলিমদের কচুকাটা করছিল, সেই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইনিই।

মাইক আর আমি কোদনানির ক্লিনিকে গিয়ে দেখলাম স্থানীয় মহিলারা তাঁর কেবিনের বাইরে, সরু সরু বেঞ্চের ওপর বসে অপেক্ষা করছেন। ঢোকার মুখে হাট্টাকাট্টা চেহারার দুজন লোক দাঁড়িয়ে, একজনের হাতে বন্দুক। আমাদের দেখে বন্দুকধারী দাঁড় করাল, মোবাইলে বসের সাথে কথা বলে নিঃসন্দেহ হল, তার পরে আমাদের ভেতরে যেতে দিল। ইনি মায়া কোদনানির দেহরক্ষী, এসআইটি (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম) মায়া কোদনানির পেছনে পড়ার দিন থেকে যিনি এই ক্লিনিকটিকে সুরক্ষা প্রদান করে আসছেন। বিল্ডিংটি দোতলা, আরও নানা ডাক্তারের ক্লিনিক রয়েছে সেখানে। কোদনানির ক্লিনিকের পাশেই রয়েছে একটা অপারেশন থিয়েটার।

প্রতি বৃহস্পতিবারে এখানে নিম্নবিত্ত ঘর থেকে আসা রোগীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। একটা ডিসপ্লে প্লেটে লেখা আছে, ‘বৃহস্পতিবারের ফী পঞ্চাশ টাকা মাত্র’। কম্পাউন্ডার আমাদের খুব সন্দেহের চোখে দেখল, তার পরে ব্জানাল এই ক্লিনিকে শুধু স্থানীয় মানুষদেরই চিকিৎসা করা হয়। আমি বললাম, আমরা ফিল্মমেকার, ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছি।

আমি নোটবুকে কিছু লেখালিখির চেষ্টা করতে থাকলাম, ততক্ষণ মাইক একমনে বসে টিভিতে সংস্কার চ্যানেল দেখতে থাকল। এক বয়স্কা মহিলা তাঁর পুত্রবধূকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, তিনি সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত হয়ে টিভিতে দৃশ্যমান বাবাকে শ্রদ্ধা জানালেন। মাইক পুরো হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি ওর দিকে মুচকি হেসে নোটবুকের ওপর নজর সরিয়ে আনলাম আবার।

ঠিক সেই সময়েই, ‘মৈথিলী কৌন ছে’ বলে হাঁকলেন কোদনানির অ্যাসিসট্যান্ট, আর কোদনানি স্বয়ং কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। হাত নেড়ে আমাকে আর মাইককে ভেতরে ডাকলেন। আমি খাঁটি আমেরিকান উচ্চারণে নিজের আর মাইকের পরিচয় দিলাম। অতঃপর একটি উষ্ণ করমর্দন।

‘তোমার নামটা খুব সুন্দর, জানো, এটা সীতাজির নাম’, কোদনানিকে দেখেই মনে হচ্ছিল তিনি খুব উচ্ছ্বসিত। ‘ওহ্‌ ইয়েস ম্যাম, আমার বাবা সংস্কৃতের শিক্ষক, তাই আমাদের বাড়িতে সকলেরই এমন সুন্দর সুন্দর নাম।’ এ কথায় কোদনানি এতটাই আশ্বস্ত হলেন যে মাইকের দিকে উনি আর দ্বিতীয়বার ফিরেই তাকালেন না, যদিও মাইক তাতে খুবই বিরক্ত হয়েছিল। কোদনানির ডেস্কে রাখা আছে কিছু মেডিসিন আর গাইনিকোলজির বই, কিছু বিজেপির প্যামফ্লেট আর কিছু গুজরাতের সিন্ধী কমিউনিটির প্যামফ্লেট। তার পাশেই ছেলে আর তার বউয়ের ছবি, তারা এখন আমেরিকায় স্থায়ী বাসিন্দা। আমরা তাঁর কেরিয়ার নিয়ে আলোচনা চালালাম, উনি ওঁর পরিবার সম্বন্ধে কিছু বললেন, মাঝে কোল্ডড্রিঙ্কস এল।

মায়াবেন কিছুদিন স্বাস্থ্য ও শিশুবিকাশ মন্ত্রী ছিলেন এ রাজ্যে, সেই প্রসঙ্গ তুলে আমি খুব খানিক প্রশংসা করলাম, মহিলাদের ভালো করার জন্য তাঁর অবদানের কথা বললাম। ‘তো বলো, কী দরকার আমার সাথে?’ অবশেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ‘আমি জাস্ট আপনার সম্বন্ধে আরও জানতে চাই ম্যাম, আমরা আপনাকে আমাদের ফিল্মের একজন প্রোফাইল বানাতে চাই, গুজরাতের একজন অ্যাচিভার হিসেবে।’ সাধারণ ভাবে সুস্থ কোনও মানুষই নিজের সম্পর্কে ভালো ভালো, মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনতে বা নিজেদের মহান হিসেবে দেখতে একেবারে অপছন্দ করেন না, রাজনীতির সাথে যুক্ত মানুষরা তো আরোই না। উনি সাথে সাথে আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন, এবং আমরা পরের রবিবার ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে দুপুরে লাঞ্চের নেমন্তন্ন পেলাম। ‘দ্যাট উড বি পা-ফেক্ট’ – প্রাণপণে “আর”-গুলোকে জিভ গুটিয়ে উচ্চারণ করে বললাম।

কেবিন থেকে বেরোবার আগে আমি মনে করে কোদনানির শাড়ি আর গয়নার উচ্চ প্রশংসা করলাম। বেরোবার সময়ে সিকিওরিটির লোকটিকে দেখে মনে হল না সে খুব একটা খুশি হয়েছে। আমরা একটা অটো ধরে সোজা পাকওয়ানে পৌঁছলাম। মাইক দৃশ্যতই খুব অসন্তুষ্ট, ‘দেখলে, উনি আমার দিকে একবার তাকালেন না পর্যন্ত’। আমি ওকে সান্ত্বনা দেবার আগেই হালওয়া আর রাবড়ি এসে গেল। গুজরাতে থালি অর্ডার করলে, ডেজার্ট সবার প্রথমে দেওয়া হয়। মাইক কোদনানির কথা ভুলে গিয়ে খাবারে মন দিল, আর পাকওয়ানের মহারাজ মাইককে শিখিয়ে দিতে থাকলেন কোন খাবারের কী নাম, কী রকম উচ্চারণ। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

রাত প্রায় দশটার সময়ে আমরা হস্টেলে পৌঁছলাম। ঘরে পা দিতেই কী রকম একটা যেন লাগল, কিছু যেন একটা ঘটেছে ঘরে। আমি বিছানা পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু এখন বেডশীটটা কোঁচকানো, আমার ল্যাপটপ অন করা। সুটকেস আর ড্রয়ারে যদিও মনে হল কেউ হাত দেয় নি, কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছিল আমার অবর্তমানে কেউ এ ঘরে ঢুকেছিল। আমি অবাক হই নি, আমি আন্দাজ করেছিলাম এ রকম কিছু একটা ঘটবে, আর এই আন্দাজের ভিত্তিতেই আমি গুজরাতে আসার আগে আমার ল্যাপটপ রি-ফর্ম্যাট করেছিলাম, আর অ্যাডমিন নেম সেট করেছিলাম মৈথিলী ত্যাগী। ডেস্কটপে রাখা রয়েছে ফিল্মমেকিং-এর ওপরে কিছু ফাইল আর গুজরাত মিউজিয়ামের ওপরে কিছু রিসার্চ পেপার। ডেস্কটপের ওয়ালপেপার হিসেবে রেখেছি ভগবান কৃষ্ণের ছবি। পরিষ্কার বোঝা গেল কেউ এসে আমার ঘরে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, এবং অভাবনীয় কিছুই তারা শেষমেশ খুঁজে পায় নি। খেলা তো সবে শুরু!

পরদিন সকালে জি এল সিঙ্ঘলের সঙ্গে একটা টেলিকন্‌ ছিল। মোবাইলে দেখলাম অজয়, আমার সেই ফোটোগ্রাফার বন্ধু,  একটা মেসেজ পাঠিয়েছে, আমি আমদাবাদ নি গুফায় একটা ফোটোগ্রাফি এক্সিবিশন দেখতে যেতে রাজি আছি কিনা জানতে চেয়ে। আমি ফোনটা পাশে রেখে দিলাম।

মাইক দরজায় টোকা দিল। ও ফাউন্ডেশনের রাস্তায় একটা চক্কর মারতে বেরোচ্ছিল, আমি যেতে চাই কিনা জানতে এসেছিল।

গুজরাতে ডিসেম্বরের সন্ধ্যেগুলো খুব সুন্দর আর ঠাণ্ডা হয়। যদিও ২০১০এর শীত গুজরাতে খুব জাঁকিয়েই পড়েছিল, তার ওপরে আমাদের হস্টেল ছিল একদম ফাঁকা, জঙ্গল এলাকায়।

হস্টেলে আমাদের শুধু একটাই ব্ল্যাঙ্কেট দেওয়া হত। রাতের দিকে আমাদের সুটকেস খুলে, টি-শার্ট, শার্ট, সোয়েটার, জিনস, সমস্ত পরিধেয় গায়ে চাপিয়ে গরম থাকতে হত।

সেদিন রাতে গায়ে একটা বাড়তি জ্যাকেট চড়িয়ে, মাইক আর আমি ফাউন্ডেশন বিল্ডিং-এর পাশে জঙ্গলের ধার ধরে হাঁটতে বেরোলাম। আমি মাইকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওর মুখ চিন্তামগ্ন। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার অভিনয় কি ঠিকঠাক হচ্ছে, মৈথিলী?’ ‘অবশ্যই’, আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম, ‘তুমি একদম কনফিডেন্ট দেখাচ্ছিলে, মিসেস কোদনানির ব্যবহার নিয়ে চিন্তা কোরো না, উনি আসলে কথাবার্তা আর ওনার প্রশংসায় একেবারে ডুবে গেছিলেন। ’

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অজয়কে টেক্সট করে দিলাম, ‘কাল এক্সিবিশনে দেখা হচ্ছে।’

পরদিন সকালবেলায় ক্যান্টিন বসে উপমা খেতে খেতে আমি জি এল সিঙ্ঘলকে ফোনটা করেই ফেললাম। উনি তখন খুবই টালটামাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছেন। হাইকোর্টের অ্যাপয়েন্ট করা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) তখন ইশরাত জাহান এনকাউন্টারের তদন্ত করছে এবং সমস্ত তদন্তকারীর নজরের কেন্দ্রে ছিলেন সিঙ্ঘল। আরও দুই অফিসারের সঙ্গে ইনিই ইশরাত জাহানকে* গুলি করে মেরেছিলেন ‘এনকাউন্টারে’। এনকাউন্টারের পরের দিন গুজরাতের পুলিশ সুপার এবং এটিএসের চীফ ডিজি বানজারা একটা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন। খবরটা বিশালভাবে চর্চিত হয়েছিল সেই সময়ে, ইশরাতের রক্তমাখা মৃতদেহ, বাকি তিনজনের সাথে শোয়ানো ছিল রাস্তাতে। বলা হয়েছিল, সে ছিল একজন মহিলা ফিদায়েঁ, ভারতে প্রথম, যে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুন করতে এসেছিল এলইটির তরফে।

ইশরাতের গল্প তখন সবার মুখে, কাহিনি লেখা হচ্ছে কীভাবে জিহাদী মৌলবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে, ২০০২ দাঙ্গার বদলা নেবার উদ্দেশ্যে। ডিজি বানজারা পাচ্ছেন নায়কের মর্যাদা, রাতারাতি তিনি তখন বিখ্যাত। তাঁর সাথে খ্যাতির রোশনাই ভাগ করে নিচ্ছেন আরও তিনজন অফিসার, এন কে আমিন, তরুণ বারোট, আর গিরিশ সিঙ্ঘল, যাঁর কাছে আমি এখন পৌঁছতে চাইছি।

*ইশরাত জাহান নামে একটি ১৯ বছরের মেয়েকে আরও তিনজন লোকের সাথে ১৫ই জুন ২০০৪ সালে আহমেদাবাদ শহরের কাছে কয়েকজন পুলিশ অফিসার গুলি করে মারেন। স্থানীয় আহমেদাবাদ পুলিশ সেই সময়ে দাবি করেছিল নিহতদের সকলেই নিষিদ্ধ পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদী সংস্থা লশকর-এ-তোইবার সদস্য ছিল, এবং গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল। নিহত বাকি তিনজনকার নাম ছিল জীশান জোহর, আমজাদ আলি আর জাভেদ শেখ।

ইতিমধ্যে ইশরাতের পরিবার তাদের মেয়ে ইশরাতের হত্যার বিচার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করেছে। গুজরাত হাই কোর্ট জুডিশিয়াল কমিটি গঠন করেছে যারা তাদের তদন্তের ফল প্রকাশ করেছে ২০০৮ সালে। হাইকোর্টের একজন প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে জাস্টিস তামাং কমিটি সারা দেশকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে এই বলে, ‘ইশরাত জাহানের হত্যা একটি ফেক এনকাউন্টার। এর আরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

মানবাধিকার কর্মীরা আর আইনজ্ঞরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ক্ষমতার এই অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে, যা নিরপরাধের প্রাণ নেয়। এর পরেও কেস খুব বেশি এগোয় নি যতদিন না ইশরাতের পরিবার তদন্ত চালিয়ে যাবার অনুরোধ করে গুজরাত হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করেছিল। এর পরে তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ তৈরি হয় এই এনকাউন্টারের তদন্ত করার জন্য। পরে, ২০১৩ সালে, গুজরাত হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই এই ঘটনার তদন্ত করে এবং তারাও জানায় যে এটা ফেক এনকাউন্টার ছিল, আর গুজরাত পুলিশের এই শীর্ষস্তরের অফিসারদের দোষী সাব্যস্ত করে।

এরই মধ্যে ২০১০ সালে, যখন সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এসআইটি এই ঘটনার তদন্ত চালাচ্ছে, সেই সময়ে আমি আহমেদাবাদে বসে সিঙ্ঘলের সাথে দেখা করবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফোন বাজল, আমি আমেরিকান অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিলাম। খুব একটা উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম না। সিঙ্ঘল আমাকে পরে ফোন করতে বললেন। আমার সমস্ত আশা ভরসা এই লোকটিকে ঘিরে। এঁকে দিয়েই আমি আমার অনুসন্ধান শুরু করতে চাইছিলাম। সমানে চিন্তা করে যাচ্ছিলাম, কীভাবে এগনো যায়। সেদিন সকালের খবরের কাগজেই এসআইটির হাতে সিঙ্ঘলের সম্ভাব্য গ্রেফতারির খবর বেরিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, এই রকমের পরিস্থিতিতে সিঙ্ঘল নিজেকে বাঁচানোর সবরকমের আইনি পদ্ধতির সদ্ব্যবহারেই ব্যস্ত থাকবেন, কোনও আমেরিকা-ফেরত ফিল্মমেকারের সাথে কথা বলার বদলে।

আমি মাইককে জানালাম যে আজ সারাদিনের জন্য আমার আর ওকে দরকার নেই। মাইক অবশ্য এর মধ্যেই হস্টেলের বাকিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে, তাদের মধ্যে একজন ছিল পারনাঙ্গুয়াক লিঞ্জে, গ্রীনল্যান্ডের নাগরিক একটা মিষ্টি মেয়ে যাকে আমরা আদর করে পানি বলে ডাকতাম। আমার মনে হচ্ছিল মাইক বোধ হয় একটু বেশিই অনুরক্ত হয়ে পড়ছিল ওর প্রতি। সেদিন সারাদিনের জন্য আমার ওকে দরকার ছিল না বলে মাইক পানিকে নিয়ে ফোটোগ্রাফি ট্রিপে বেরিয়ে পড়ার অফার দিল, আর পানিও দিব্যি এক কথায় রাজি হয়ে গেল!

আমার সেদিন নিজের একলা একটা ফোটোগ্রাফি ট্রিপে যাবার ছিল, সন্ধ্যেবেলায়। সেই মুহূর্তে আমার বিশেষ কিছু করার ছিল না বলে আমি নিজের ঘরে বসে নোটবুকে গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী লিখে রাখতে বসলাম।

সন্ধ্যেবেলায় আমি যখন অজয়ের এক্সিবিশনে পৌঁছলাম, অজয় অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল। ও আমাকে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিল, আমেরিকা থেকে আসা একজন ফিল্মমেকার হিসেবে। সাথে সাথে আমার দিকে ছুটে এল একগাদা টেকনিকাল প্রশ্ন, “কে তোমার ক্যামেরা এডিট করছে, কোন ক্যামেরা ইউজ করছো, শুটিং কবে শুরু করবে?” আমি এই ধরণের প্রশ্ন আসতে পারে আশা করে আগেই উত্তর তৈরি করে রেখেছিলাম, এবং খুব শান্তভাবে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে গেলাম। অজয়কে দেখে মনে হল ও বেজায় ইমপ্রেসড। ও আমাকে আমদাবাদ নি গুফা ঘুরিয়ে দেখাল, আর অল্প কথায় আমাকে শোনাল এই জায়গাটার ইতিহাস। এর পরে আমরা এক জায়গায় বসে কফি আর সামোসা খেলাম।

আমাদের পাশেই কলেজের একটা গ্রুপ বসে ছিল, ওদের মধ্যে একজন গীটারে সুর তুলছিল। আরেকটু দূরে একজন তার প্রেমিকার সাথে নিমগ্ন বসে ছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, এইটুকু দৃশ্যের জন্য বাকি সব ভুলে যাওয়া যায়, ওই পুলিশ অফিসারদের, আমার এই ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা, আর যে কাজ নিয়ে আমি এসেছি, সেই সংক্রান্ত নার্ভাসনেস। এই সময়টুকুর জন্য আমিও ওদের মতই একজন ছাত্রী। আমার আব্বু-আম্মির কথা মনে পড়ল, তাদের সঙ্গে অনেকদিন কথা বলা হয় নি, তারা হয় তো খুব উদ্বেগে আছে আমার এই ব্যবহারের পরিবর্তন লক্ষ্য করে, আমার সেলফোন সুইচ অফ পেয়ে। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতাম কাছের সাইবারক্যাফেতে গিয়ে – মেল করে, তাও খুব নিয়মিত করা হয়ে উঠছিল না। যেদিন থেকে আমি অমিত শাহের কীর্তিকলাপ ফাঁস করেছি, তারা ভীষণ, ভীষণ চিন্তিত ছিল আমার নিরাপত্তা, আমার ভালো-থাকা নিয়ে।

ফেরার পথে অজয়কে বললাম আমাকে হস্টেলের কাছাকাছি কোনও একটা বাজার এলাকায় ছেড়ে আসতে, আমার কিছু কেনাকাটা করার আছে। অজয় আমাকে স্যাটেলাইট রোডের শপিং এরিয়াতে ড্রপ করে দিল। কেনাকাটার অজুহাতে বাজারে ঘোরাঘুরি করলে অভিনয়টা এরও গ্রহণযোগ্য হয়। আমি একটা সুপারমার্কেটের ভেতর ঢুকলাম, কিছু কেনাকাটা সেরে পাশেই একটা পিসিও বুথে ঢুকলাম। এটাই বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখার সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বর ডায়াল করলাম। আমার মা, আমার সমস্ত শক্তির উৎস, যার থেকে আমি লড়বার শক্তি পেয়েছি, ফোনটা তুলল। মা চাইছিল আমি সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি ফিরে আসি। যে কাজ বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ রাখার রাস্তাও বন্ধ করে দেয়, চুলোয় যাক সেই জার্নালিজম। আমি মাকে যতটা সম্ভব বোঝালাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা শেষ করে ফোনটা ছাড়লাম, আর বুঝতে পারলাম, আমি ভেতর থেকে রিক্ত, দীর্ণ হয়ে গেছি।

পরদিন সকালে আমি সিঙ্ঘলকে আবার ফোন করলাম, এইবারে তিনি ফোন তুললেন, এবং, তিনি রাজি হলেন আমার সাথে দেখা করতে। আমার তদন্ত যে ভয়াবহ রাস্তার দিকে মোড় নিতে শুরু করল এর পরে, সেই রাস্তায় যাত্রা আমার অবশেষে শুরু হল। 

Tuesday 23 August 2016

গুজরাট ফাইলস ও গোপন বিশ্লেষণ। পর্ব এক

গুজরাট ফাইলস ও গোপন বিশ্লেষণ 

রানা আয়ুব।  লেখক ভারতীয় খ্যাতিমান নারী সাংবাদিক 
ভারতের বিখ্যাত বামঘনার সংবাদ মাধ্যম তেহেলকায় কর্মরত রানা আয়ুব।  
বইয়ের লেখা তিনি যেভাবে শুরু করেন ।। 
২০১০এর গরমকাল নাগাদ আমি সাংবাদিকতাকে নতুন করে চিনছিলাম। এমনিতে আমি নিজেকে একজন খুব সাধারণ, পরিশ্রমী, মাঝারি মানের রিপোর্টার মনে করতাম, যার কাছে থাকার মধ্যে ছিল পুরনো আমলের একজন জার্নালিস্ট বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কিছু মূল্যবোধের সমষ্টি। কিন্তু এই সময় নাগাদ, আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম এমন এক সন্ধিক্ষণের মধ্যে, আমি প্রার্থনা করি আর কাউকে সেই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়।
কিছুদিনের মেডিকেল লিভ নেবার পর আমি তখন সদ্য তেহেলকায় আবার কাজকর্ম শুরু করেছি। শহরের সেরা ডাক্তাররা আমার অসুখ ধরতে পারেন নি। আমি তখন সদ্য নক্সাল অধ্যুষিত গড়চিরোলি থেকে ফিরেছি। সেখানে এমন কিছু ঘটেছিল যা আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায়। আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু, শাহিদ আজমির হত্যা। অপরাধ আইনের একজন তুখোড় বিশেষজ্ঞ, আজমি, আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এসেছিল। যেদিন সে মারা যায়, সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আমার ওর সাথে দেখা করবার ছিল, কিছু উপজাতি এবং বুদ্ধিজীবিকে নকশাল বলে দাগিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্র এবং তাদের জেলে পচতে হচ্ছিল, সেই ব্যাপারে আলোচনা করতে যাবার জন্য।
কিন্তু ভাগ্যের লিখন অন্য রকমের ছিল। আমার ভাইঝির উপরোধে আমি সেদিন ঘরেই থেকে গিয়েছিলাম, তার সপ্তম জন্মদিন ছিল সেদিন। আমার ফোনে অনেকগুলো মিসড কল আর মেসেজ এসে পড়ে ছিল, “শাহিদের কী হয়েছে” আমি জানি কিনা জানতে চেয়ে, আমি সেগুলো অনেক পরে দেখেছিলাম। বাকি খবর আমি জানতে পারি উপর্যুপরি আসা বন্ধুদের ফোন কল আর নিউজ চ্যানেলের ব্রেকিং স্টোরির মাধ্যমে। শাহিদকে ওর অফিসে গুলি করে মারে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী, কারণ সে “অ্যান্টি ন্যাশনাল”দের হয়ে কেস লড়ছিল। শাহিদের সওয়ালেই সম্প্রতি ৭/১১-তে মুম্বাই ট্রেন ব্লাস্টের ঘটনায় আটক নিরপরাধ লোকেরা ছাড়া পায়। তার মৃত্যুর পরে মুম্বাই হাইকোর্ট ২৬/১-র মামলায় আটক থাকা দুজন আরোপীকেও মুক্তি দেয়। জনতার চোখে শাহিদের মৃত্যু আজ পর্যন্ত একটা রহস্য হয়েই আছে, যার জট খোলা যায় নি।


কাউকে হারানোর বেদনা সইয়ে নেবার অনেক রকমের রাস্তা হয়। হয় খুব কাঁদো, বিলাপ করো, তারপরে জীবনের পথে এগিয়ে যাও। অথবা পালাও, পালিয়ে সান্ত্বনা খোঁজো অন্যকিছুতে, নিজের কাজকর্মে। আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছিলাম। শাহিদের মৃত্যুর তিনদিন পরে, আমি নাগপুর যাচ্ছিলাম, তখনও জানতাম না যে জন্য যাচ্ছি তা আমার সাংবাদিকতার কেরিয়ারের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টোরির জন্ম দেবে। স্টোরিটা ছিল কয়েকজন অন্ত্যজ জাতের ছাত্রকে নকশাল সন্দেহে গ্রেফতার করা নিয়ে। তাদের বিরুদ্ধে যা সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করা হয়েছিল তা পড়লে হাসি পাবে। তাদের কাছে পাওয়া গেছিল ভগত সিং আর চন্দ্রশেখর আজাদের লেখা লিটারেচার। আমার মনে হচ্ছিল, বন্ধুর ঋণ শোধ করার এই হয় তো রাস্তা, কারণ শাহিদ মারা গেছিল ঠিক এই ধরণের কেস লড়তে গিয়েই, মনে হচ্ছিল, এই কেস লড়ার মধ্যে দিয়ে আমি ওর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে পারব। কিন্তু ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল আমার। আমাকে শিগগিরই বাড়ি ফিরে আসতে হল এক অবর্ণনীয় সমস্যা নিয়ে, যার নাম পরে জানা গেল, ডিপ্রেশন।
জানা গেল, আমার বাবা-মা পাগলের মত আমার বিভিন্ন রকমের টেস্ট করাবার পর – ব্রঙ্কোস্কোপি থেকে এমআরআই। আরেকজন ডাক্তার বললেন, যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু করতে – কিন্তু তখনই ভাগ্যক্রমে আমি সাউথ বম্বে হসপিটালের একজন নামকরা ফিজিসিস্টের কাছে গিয়ে পৌঁছই। ডক্টর চিটনিস আমার সমস্ত রিপোর্ট দেখে আমাকে কটা প্রশ্ন করেছিলেন। তার পরে, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী নিয়ে কষ্ট পাচ্ছো?” মনে হচ্ছিল যেন অনেকদিনের ঘুম ভেঙে আমি জেগে উঠলাম। “জানি না ডক্টর, সবসময়ে আমার নিজেকে খুব পরিশ্রান্ত আর দুর্বল লাগে, বুঝতে পারছি না আমার কী হয়েছে।”
মুখে একটা হালকা হাসি ঝুলিয়ে তিনি বলেছিলেন, “এই পুতু-পুতু ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে এসো, নিজের সমস্যাকে এই সব ব্লাড টেস্ট রিপোর্টের মধ্যে দিয়ে বিশাল করে দেখার চেষ্টাটা ছাড়ো, তুমি একদম ঠিক আছো। কাজে যোগ দাও, সেটাই তোমার ওষুধ। বাকি সব অসুখ তোমার মনে।”

“এটা কি হাইপোকন্ড্রিয়া?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। নিজেই নিজের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে এই টার্মটা আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে সদ্য শিখেছিলাম। ডক্টর চিটনিস সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “না, তুমি স্রেফ অলস হয়ে যাচ্ছো আর নিজের দায়িত্ব থেকে পালাবার চেষ্টা করছো।”
পরের কয়েকদিন ধরে আমি ডক্টর চিটনিসের উপদেশগুলো হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করতে থাকলাম। সেই সব অলস দিনগুলোতে মা আমার প্রধান সহায় হলেন। আম্মা, আমি মা-কে এই নামেই ডাকি, আমার এক বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠলেন। আম্মা কখনও আধুনিক স্কুলে যান নি, আব্বাই ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তিনি বললেন, তিনি আমার মধ্যে দিয়ে তাঁর বাস্তব-না-হয়ে-ওঠা স্বপ্নগুলোকে রূপ দিতে চান। আমি বিদ্রোহী হলে তিনি ঝগড়া করতেন, এবং ধীরে ধীরে বাড়ির সবাইকে এই বাদানুবাদে যুক্ত করে নিতেন। সেদিন আমায় কফি বানিয়ে দেবার সময়ে আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে তুই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিস?”
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম, যেন সেই মুহুর্তে কফির কাপটা ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আম্মাকে তো আমি চিনি – তিনি আমার পাশে বিছানায় এসে বসে ইনকিলাব (একটা নামকরা উর্দু খবরের কাগজ) পড়তে শুরু করলেন। দশ মিনিট পড়বার পর আম্মা আমায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, আমি তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আম্মা, যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু থেকে থাকে এই খবরের কাগজটায়, আমাকে বোলো না। আমি এসব ছাড়াই ভালো আছি।”
“আরে নেহি, তুই এই সোহরাবুদ্দিনের ঘটনাটা পড়েছিস?” আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আম্মা। কেন জানি না, নামটাতে আমি কান পাতলাম। অবশ্যই আমি সোহরাবুদ্দিনের ঘটনাটা জানি, আমি মনে মনে বললাম। এই লোকটির কারণেই আমাকে আমাদের এই সময়ের একজন সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রের সাথে বার্তালাপ করতে হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী।

২০০৭ সালে গুজরাতের তিনজন সিনিয়র পুলিশ অফিসারকে নিয়ে খবর তৈরি হয়েছিল, এঁদের গ্রেফতার করেছিলেন এঁদেরই একজন নিকটতম সহকর্মী, রজনীশ রাই, সোহরাবুদ্দিন নামক একটি ছোটোখাটো অপরাধীকে ফেক এনকাউন্টার ঘটিয়ে হত্যার অপরাধে।
ডি জি বানজারা আর রাজকুমার পাণ্ডিয়ানকে জেলে পাঠানো হয়। এই দুজন ছিলেন মোদীর নিজস্ব বৃত্তে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অফিসার, এবং ততদিন পর্যন্ত এঁরা বেশ একটা ঝলমলে জীবন যাপন করছিলেন, প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে এঁদের ছবি আর রিপোর্ট বেরোত কোনও না কোনও প্রেস কনফারেন্স থেকে। ২০০৪ সালের শুরুর দিকে এঁরাই সফলভাবে ট্র্যাক করে মেরেছিলেন কয়েকজন জিহাদীকে, যারা নাকি এসেছিল হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র মোদীকে খুন করবার চক্রান্ত নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই এঁদের গ্রেফতারের খবরে জাতীয় স্তরে আলোড়ন উঠেছিল।
একজন পলিটিকাল জার্নালিস্ট হিসেবে একটা টেলিভিশন চ্যানেলে জয়েন করে, আমার প্রথম টাস্ক ছিল ২০০৭এর গুজরাত নির্বাচন কভার করা। গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বেশির ভাগ অ্যানালিস্টদের ভবিষ্যদ্বাণীকে সফল করে আরেকবার বিশাল ব্যবধানে জয়ী হতে চলেছিলেন। তার কয়েক বছর আগেই ২০০২এর দাঙ্গা সমগ্র গুজরাতি সমাজকে রাতারাতি পোলারাইজড করে দিয়েছিল আর মোদীকে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের হিরো বানিয়ে দিয়েছিল। এই অবস্থান থেকে ২০০৭এ সুবিশাল বিজয় হাসিল করা তাঁর পক্ষে খুব দুরূহ ব্যাপার ছিল না।
একজন ক্যামেরাপার্সনকে সঙ্গে নিয়ে আমি মোদীর নির্বাচনী প্রচারসভায় উপস্থিত হলাম। খুব ভালো করে মনে নেই, কিন্তু যদ্দূর মনে পড়ছে সেই সভাটা আয়োজন করা হয়েছিল গুজরাত চেম্বার অফ কমার্সের তরফে। নরেন্দ্র মোদী, তাঁর ডানহাত অমিত শাহের পাশে বসেছিলেন মঞ্চে, অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে।
কাছাকাছি একই সময়ে আরও কএকটা রাজনৈতিক প্রচারসভা হচ্ছিল – আপাতভাবে মোদীর প্রচারসভার সঙ্গে সেগুলো খুব একটা আলাদা হবার কথা ছিল না। কিন্তু দিল্লিতে আমার প্রোডিউসাররা আমাকে জানিয়ে রেখেছিলেন, মোদীর একটা অভ্যেস আছে মঞ্চে দাঁড়িয়ে উস্কানিমূলক ভাষণ দেবার, এবং মোদী সেদিন আমায় হতাশ করেন নি। 

“সোহরাবুদ্দিন, ওরা আমাকে প্রশ্ন করে সোহরাবুদ্দিনের মত সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে কী করা হয়”, ভিড় গর্জন করে ওঠে উল্লাসে। সামনের সারিতে মহিলার দল হাততালি দেন; সামনের সারিগুলো সবসময়েই মহিলাদের জন্য রিজার্ভড থাকত কারণ এটা বিশ্বাস করা হত যে মোদীর জনপ্রিয়তা গুজরাতের মহিলাদের মধ্যে বেশি। কলামনিস্ট আকর প্যাটেল একবার একটা নিবন্ধে লিখেছিলেন যে গুজরাতি মহিলাদের কাছে মোদী একজন সেক্স সিম্বল।
ভিড়ের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিতই ছিল, “মার ডালো, মার ডালো”। আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে বসে আছি। ভাষণ চলতে লাগল টুকরো টাকরা “মিয়াঁ মুশারফ” আর “দিল্লি সুলতানত”-এর উদ্ধৃতিকে সঙ্গে নিয়ে। ভাষণ শেষ হবার পরে, মোদী ডায়াস থেকে নেমে এলেন এবং গুজরাত চেম্বার অফ কমার্সের সদস্যরা তাঁকে মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁর চারপাশে ভিড় জমে গেল। সিকিওরিটির কর্ডন ঠেলে আমি কোনওরকমে ভিড়ের মধ্যে ঢুকলাম আমার ক্যামেরাপার্সনকে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে – সে তখনও ভিড়ের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

“মোদীজি, মোদীজি, এক সওয়াল”। আমার ভাগ্য ভালো ছিল, অত ভক্ত এবং নিরাপত্তাবলয়ের ভিড়ের মধ্যে থেকেও তিনি আমার কথা শুনতে পেয়ে ফিরলেন এবং প্রশ্ন করার অনুমতি দিলেন। “মোদীজি, তিনজন অফিসার গ্রেফতার হয়েছেন সোহরাবুদ্দিনের ফেক এনকাউন্টারের ঘটনায়। আপনি কি এখনও আপনার ভাষণে যা বলেছেন, সেটাই বলতে চাইবেন?” উত্তরের আশায় আমি তাঁর দিকে মাইক এগিয়ে দিলাম। কিন্তু এবারে ভাগ্য বোধ হয় ভালো ছিল ক্যামেরাপার্সনের। টানা দশ সেকেন্ড নরেন্দ্র মোদী আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এবং তার পরে উত্তর না দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গের মন্ত্রীরা আমার দিকে একটা ঘেন্না আর অবজ্ঞা মেশানো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন। এটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি এখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

সোহরাবুদ্দিনের গল্পটা বলবার দরকার হয়ে উঠেছিল। আর সেই প্রয়োজনীয়তাটা আমি অনুভব করলাম আমার আম্মা যখন ইনকিলাবের পাতায় সোহরাবুদ্দিনের খবরটা পড়ছিলেন। সময় নষ্ট না করে আমি স্থানীয় সাইবারক্যাফেতে গেলাম।
যতগুলো লিঙ্ক পেলাম, সবই জানাচ্ছে একটা সিবিআই তদন্তের কথা, আর গুজরাতের একজন শীর্ষস্তরের আইপিএস অফিসার অভয় চুড়াসমার গ্রেফতারির কথা। আমি চুড়াসমাকে চিনতাম, বছরখানেক আগে উনি আমাকে ফোনে হুমকি দিয়েছিলেন, কারণ আমি তাঁর মামলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর জবানবন্দী পাবলিশ করেছিলাম। চুড়াসমা গুজরাত বিস্ফোরণ কাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন, যে ঘটনার সাথে পরে ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন নামে একটা দলের যোগসূত্র পাওয়া যায়। একজন নিখুঁত মিডিয়া-স্যাভি রাজ্যস্তরের অফিসার হিসেবে চুড়াসমা তৎকালীন গুজরাতের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহর খুব কাছের লোক ছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু সেই সময়ে যে যে শীর্ষ অফিসাররা খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন, তাদের সবার থেকে চুড়াসমা ছিলেন আলাদা। 

পরে জানা গেছিল ওঁর মুখ্য পছন্দের বিষয় ছিল ছোটখাটো অপরাধী আর হাওয়ালা অ্যাকাউন্ট। সোহরাবুদ্দিন ছিল এই দুটো ব্যাপারেই পারদর্শী, ফলে চুড়াসমার চোখে পড়তে সোহরাবুদ্দিনের দেরি হয় নি।
আমার প্রিন্ট আউট আর নোটস রেডি করে আমি আমার দিল্লির এডিটর সোমা চৌধুরি আর তরুণ তেজপালকে একটা নোট লিখলাম, কেন এই কেসটা রিপোর্ট হওয়া উচিত। মাথার মধ্যে আরেকটা চিন্তাও খেলা করছিল, এই কেসটা হয় তো আমার ডিপ্রেশন আর একাকীত্ব থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র রাস্তা হবে। আমার দুই এডিটরই খুবই উৎসাহ দিলেন, এবং আমি তৈরি হলাম আহমেদাবাদ যাবার জন্য। এবারের যাত্রা আমার জীবনের গতি বদলে দিল।

আহমেদাবাদ যাবার এক মাসের মধ্যেই আমি কল রেকর্ডস ঘেঁটে এবং কিছু অফিসারের সহায়তায়, যাদের নাম গোপন রাখতে চাই, কিছু ইন্টার্নাল নোটস পেয়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ এক্সপোজ ঘটালাম। খুব সাবধানতার সঙ্গে তাদের সাথে দেখা করতে হয়েছিল, কারণ আমি জানতাম, এরাই আমার একমাত্র আশা। কিন্তু গুজরাতের মত রাজ্যে বিশ্বাস জন্মানো এত সহজ কাজ নয়, বিশেষত সেইসব অফিসারদের কাছে যাঁরা নিজেদের সার্ভিসের প্রতিদায়বদ্ধ এবং কোনওভাবেই সরকারের কুনজরে পড়তে চান না। এঁদের বেশির ভাগের সাথেই আমার প্রথম বার সাক্ষাৎ হচ্ছিল। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো ছিল কারণ, যেহেতু আমি তেহেলকার একজন সাংবাদিক, তাই এটা ধরে নেওয়াই যায় যে যে কোনও সময়ে আমার সাথে সাথে থাকত গোপন স্টিং ক্যামেরা।
অবশ্য গুজরাতে আমি যা নিয়ে কাজ করছিলাম তা ঠিক গুজরাত ভিত্তিক ইস্যু ছিল না।

 সৎ পুলিশ অফিসারদের ফাঁসানোর সংস্কৃতি উত্তর প্রদেশ আর মণিপুরেও আছে, আমি দু জায়গা থেকেই প্রচুর রিপোর্ট করেছি এর ওপরে। আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে এই প্রসিকিউশন ফ্যাক্টরটা ঘুরপথে আমার পক্ষে কাজ করে ফেলতে পারে। এবং যেমনটি ভেবেছিলাম, এ রকম একজন অফিসার যিনি আমাকে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ নথি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তিনি ছিলেন এই রকম একজন সৎ পুলিশ অফিসারের ব্যাচমেট যাঁকে নিয়ে আমি একসময়ে রিপোর্ট করেছিলাম। আলাপ জমাতে সেইটা সাহায্য করল। হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টদের সাহায্যে এবং এইসব অফিসারদের সাহায্যে আমি সে বছর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক্সপোজ ঘটালাম। আমি সেইসমস্ত কল রেকর্ড হাতে পেয়েছিলাম যেগুলোতে ছিল তৎকালীন গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ আর শীর্ষ অফিসারদের মধ্যে কথোপকথন, এনকাউন্টারের সময়ে। এর সঙ্গে ছিল একটা আভ্যন্তরীণ সিক্রেট অ্যাক্টস নোট। গৃহমন্ত্রীর সমস্ত চালচলন রাজ্য সিআইডি খুব মন দিয়ে মনিটর করছিল এবং এই নোট অনুযায়ী এই এনকাউন্টার একজন সাধারণ মানুষকে খুন করে তাকে টেররিস্ট বলে চালানোর প্ল্যান করে ঘটানো হয়েছিল।

এক্সপোজটি ঘটবার সাথে সাথে রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে গেল। সিবিআই থেকে তেহেলকার দপ্তরে পরের পর ফোন আসতে লাগল সেই কল রেকর্ডগুলো চেয়ে, যেগুলো পরে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছিল। আমি থাকতাম আহমেদাবাদের হোটেল অ্যাম্বাসাডরে, যা ততদিনে আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছিল। হোটেলটা ছিল খানপুর নামে একটা মুসলিম মহল্লাতে, যেখানে আমার থাকবার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। আমি পরে আবিষ্কার করেছিলাম যে ঐ হোটেল থেকে রাজ্য বিজেপির অফিস মাত্রই কয়েকটা ব্লক দূরে। আমার হঠাত করে খুব নাম হয়ে গেল। বিজেপি নেতারা আয়ুব নামে একটা ছোকরার ব্যাপারে খুব আলোচনা করতে লাগলেন, যে নাকি এই এক্সপোজটা ঘটিয়েছে। যে কারণেই হোক তারা এই নামে কোনও মেয়ে ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিস্টকে আশা করে নি। অবশ্য তাই নিয়ে আমার কোনও অভিযোগও নেই, আমি খুব গোপনেই চলাফেরা করতে পারছিলাম এই কারণে। এক্সপোজটি ঘটাবার কিছুদিন পর আমার ফোনে একটা টেক্সট মেসেজ এল, “আমরা জানি তুমি কোথায় আছো”।
জীবন বদলে গেল। সেদিন থেকে প্রতি তিন দিনে আমি আমার বাসস্থান বদলাতাম। আইআইএম ক্যাম্পাস থেকে গেস্টহাউস, হস্টেল, জিমখানা। আমি একজন আন্ডারকভার এজেন্টের মত জীবন কাটাতে লাগলাম। এই সময়ে ল্যান্ডলাইনের বদলে মোবাইল ফোন আমার কাছে যোগাযোগের মুখ্য মাধ্যম হয়ে উঠল। অবশেষে, সমস্ত তথ্যপ্রমাণ একত্র করে, সিবিআইয়ের হাতে জমা করে, ফলো-আপ রিপোর্ট তৈরি করে আমি মুম্বাইতে পৌঁছলাম, আর জীবনের স্বাভাবিক রুটিনে ফিরলাম।
কিন্তু আমার গল্প অন্যদিকে গড়াচ্ছিল। এক্সপোজটি ঘটাবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সিবিআই অমিত শাহকে গ্রেফতার করল, স্বাধীন ভারতের প্রথম গৃহমন্ত্রী যিনি মন্ত্রী থাকাকালীন গ্রেফতার হলেন। রাতারাতি খবর ছড়িয়ে পড়ল। গান্ধীনগরের সিবিআই হেডকোয়ার্টারের সামনে মিডিয়ার গাড়িদের লাইন লেগে গেল। প্রত্যাশামতই আমাকে আবার গুজরাত ফিরতে হল এই পুরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ডেভেলপমেন্টের রিপোর্ট জোগাড় করার জন্য।

অমিত শাহর গ্রেফতারিতে আশার আলো দেখলেন সেই সমস্ত পুলিশ অফিসাররা, যাঁদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল তাঁর জমানায়। অফিসাররা আমার কাছে নোট পাঠাতে লাগলেন আমার সাথে কথা বলবার জন্য। যাঁরা আগে সাংবাদিকদের অ্যাভয়েড করতেন, তাঁদের অনেকেই এখন প্রকাশ্যে কথা বলবার সাহস সঞ্চয় করলেন। বেশির ভাগ কথোপকথনই ছিল অফ-দ্য-রেকর্ড, কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে এই এনকাউন্টারের ঘটনা আসলে হিমশৈলের চূড়া মাত্র। গুজরাতের বিভিন্ন কেস ফাইলে এর থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা কেউই সত্যের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারি নি। অনুমান করা গেছিল গত প্রায় এক দশক ধরে বিচারপদ্ধতির একটা বড় রকমের অবনমন ঘটানো হয়েছিল। জনগণের রক্ষার দায়িত্বে যাদের থাকার কথা, তাদের কিনে নেওয়া হয়েছিল। দাঙ্গা থেকে এনকাউন্টার থেকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড – প্রচুর অপ্রিয় সত্য লুকিয়ে রয়েছিল ওই সব ফাইলের মধ্যে। কিন্তু কীভাবে সেগুলো প্রমাণ করা যাবে?
জার্নালিজমের প্রধান শক্তি হচ্ছে প্রমাণ – এভিডেন্স, আর আমার কাছে কোনও তথ্যপ্রমাণ ছিল না। ছিল শুধুই কথোপকথন, অফলাইন স্বীকারোক্তি আর শোনা-কথার সম্ভার। আমি এ সমস্ত প্রমাণ কীভাবে করব? তখন আমার মাথায় এমন একটা চিন্তা এল যেটা আমার জীবনকে আমূল বদলে দিল, ব্যক্তিগত স্তরে এবং প্রফেশনাল স্তরে। রাণা আয়ুবের বদলে জন্ম নেবে মৈথিলী ত্যাগী, কানপুরের একটি কায়স্থ মেয়ে, আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিট্যুট কনসার্ভেটরির ছাত্রী যে গুজরাতে এসেছে এখানকার ডেভেলপমেন্ট মডেল আর বিশ্বজুড়ে এনআরআইদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার ওপর একটা ফিল্ম বানাতে।

Sunday 21 August 2016

পর্ব আট দ্বিতীয় অংশ ।। কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে।


জমিদার রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন?

সূফি বরষণ

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর কার্যকরী হওয়ার দিন থেকে কলকাতায় হিন্দু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই সময়ে এই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তখন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক মর্যাদায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার কলকাতা তথা বাংলার হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির জগতের প্রধান পাদপীঠ। অর্থনৈতিকভাবে এই পরিবার জমিদারকুলের শিরোমণি। ফলে খুবই স্বাভাবিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান ছিল কলকাতা কেন্দ্রীক হিন্দু সংস্কৃতির নেতৃত্বের আসনে। সামাজিক শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তথা বাঙালি মুসলিম বিরোধী আন্দোলনে। এরই চরম বহি:প্রকাশ "শিবাজী উৎসব" কবিতা রচনা ও প্রকাশ। এই ইংরেজদের দালালদেরই একজন রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই দালাল শ্রেণীর কাছে ইংরেজ শাসন ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। অন্যদিকে বাংলার মুসলমান সমাজ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালনা করে একটানা আন্দোলন সংগ্রাম। আঠারো ও উনিশ শতকের বাংলার কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল বাংলার মুসলমান সমাজ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে বাংলার মুসলমান সমাজ কখনোই মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজের বেলায় পরিস্থিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু জমিদার, মহাজন, বেনিয়া আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী শক্তি। ঐতিহাসিকভাবে এটা বলা যায় বাংলার তথা ভারতীয় মুসলমান সমাজকে যুগপৎ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের সহযোগী হিন্দু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। আর এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম স্থায়ী বিভাজন রেখা।

....মুঘল তথা মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে গুপ্ত হামলা পরিচালনা, হত্যা, খুন এবং গোপন আস্তানায় থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লুন্ঠন পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শিবাজী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি আরও বলেন যে শিবাজীর ইতিহাস চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শিবাজীর তপস্যা সত্য ছিল বলে তাকে ইতিহাসে চাপা দেয়া যায়নি। মুসলিম ও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে শিবাজী একজন লুন্ঠনকারী, হত্যাকারী, আত্মগোপনকারী, সন্ত্রাসী মারাঠা দলনেতা। তার কার্যক্রম সীমিত ছিল বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অঞ্চলে। সতেরো শতকের ভারতীয় ইতিহাসে একটি প্রমাণিত ও সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থান প্রমাণ করে তিনি মুসলিম বিরোধী হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ও আর্য সংস্কৃৃতির ডামাডোলে কতটা নিমজ্জিত ছিলেন। সামাজিক ও শ্রেণীগত অবস্থানে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসনের মহিমায় মুখর। তিনিই পরবর্তীকালে সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লি আগমন উপলক্ষ্যে রচনা করেন 'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা' সঙ্গীত। এটা এখন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের এই ভাগ্যবিধাতা আল্লাহ বা ঈশ্বর নয়, খোদ বৃৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ।

... রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, মুঘলবিরোধী, লুন্ঠনকারী আর সন্ত্রাসী শিবাজী কর্মকান্ড ভারতের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আর এই ঐতিহ্য হলো মুসলিম বিরোধীতা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস পরিচালনা এবং মুসলমানদেরকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার সঙ্কল্প। বাঙালি হিন্দুদের মাঝে বিশেষত: ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধোত্তরকালে নব উত্থিত হিন্দু বেনিয়া, দালাল, মহাজন, জমিদার শ্রেণী বাংলা ও ভারতের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। উনিশ শতকের বিকশিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বড় অংশই ছিল মুসলিম বিদ্বেষী এবং বাংলার মুসলমান সমাজ সম্পর্কে উন্নাসিক মনোভাবাপন্ন। বিশ শতকের হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের প্রধান অংশই হলো এই ধারার বাহক। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, দুই সম্প্রদায়ের মাঝে দাঙ্গা হানাহানি এবং পরিশেষে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবে বর্তায় এই হিন্দু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের উপর।

... বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে বাঙালি শিবাজীকে নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়। শিবাজীর মহৎ নাম বাঙালি আর মারাঠা জাতিকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়। রবীন্দ্রনাথের এই এক সূত্রে গাঁথার মূল সূত্রটি হলো মুসলিম বিরোধীতা। শিবাজী মুসলিম বিদ্বেষী তাই আসন্ন বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে মুসলমানদের উপর সামাজিক প্রভাব বহাল রাখা এবং সামাজিক শোষণ করার পথ বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্ত সমাজ মুসলিম বিরোধীতায় অবতীর্ণ। এখানেই মুসলিম বিরোধীতার হাতিয়ার হিসেবে মুসলিম বিদ্বেষী মারাঠী সন্ত্রাসী শিবাজীকে বাঙালি হিন্দু সমাজ বরণ করে নিয়েছে, আপন করে নিয়েছে। মুসলিম বিরোধী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে শিবাজী বাঙালি হিন্দুদের কাছে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শিবাজীর পথ ধরেই এগিয়ে যাওয়ার পথের সন্ধান পেয়েছিল বাঙালি হিন্দু সমাজ। শিবাজী মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে আর বাঙালি হিন্দু সমাজ প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। এখানেই শিবাজীর সাথে বাঙালি হিন্দুদের আদর্শিক ও স্বার্থগত সম্পর্কের মিল॥ ড. নুরুল ইসলাম মনজুর / শতবর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস : বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগ ॥ [ গতিধারা - জুলাই, ২০১০ । পৃ: ৫২-৮৬ ]�।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)-এর বিপুল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। রক্ষা পেয়েছিল শুধু ওড়িশা এবং পূর্ববঙ্গের সাজাদপুর, পতিসর ও শিলাইদহের জমিদারি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) শেষ উইল করেন ১৮৯৯ সালের ৮ই সেপটেম্বর। সে অনুযায়ী ওড়িশার জমিদারি পান তাঁর তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৪-১৮৮৪); দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ পান শিলাইদহ (প্রাচীন নাম খোরশেদপুর), সাজাদপুর ও পতিসরের জমিদারি। উইলে জমিদারির আয় থেকে ব্যয় বরাদ্দ করা হয় এভাবে - ছোটভাই নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৯-১৮৫৮)-এর স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীকে মাসে ১০০০ টাকা, পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১২৫০ টাকা, সোমেন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা, রবীন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা, বীরেন্দ্রনাথকে ১০০ টাকা, তাঁর স্ত্রী প্রফুল্লময়ীকে ১০০ টাকা, তাঁর পুত্রবধূ সাহানা দেবীকে ১০০ টাকা, কন্যা সৌদামিনী দেবীকে ২৫ টাকা, তাঁর জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে ৫০ টাকা, কন্যা শরৎকুমারী দেবীকে ২০০ টাকা, স্বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা, বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা, আদি ব্রাহ্মসমাজকে ২০০ টাকা, শান্তিনিকেতন ট্রাস্টকে ৩০০ টাকা, দেবসেবার জন্য ২০০ টাকা, পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথকে ৫০০ টাকা।

 মাসে এই বিপুল অর্থ যোগানোর জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ। ১৯১২ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর হিস্যার এক-তৃতীয়াংশ বছরে ৪৪,০০০ টাকার বিনিময়ে ইজারা পাট্টা দেন সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের কাছে। সিভিল সারভিসের চাকরিসূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ থাকতেন বাংলার বাইরে। কাজেই বছরে ৯৭, ৪০০ টাকার জন্য দায়ী রইলেন রবীন্দ্রনাথই। এছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ব্যয় ও জমিদারি পরিচালনার জন্য বছরে কমপক্ষে খরচ হতো কমপক্ষে দুই লাখ টাকা। আর তিন জমিদারির সদর খাজনা দিতে হতো ৫০,০০০ টাকা। শিলাইদহের সদর খাজনা ছিল ১৬,৯০২ টাকা।
রবীন্দ্রনাথকে জমিদারের চরিত্রে কেমন ছিলেন তার স্বরূপ যতদূর পারি উল্লেখ করতে চাই। তাঁকে নিয়ে ভারত বাংলাদেশ দু’দেশেই আবেগ-উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি বাংলাদেশে সর্বাধিক আলোচিত। আমাদের দেশের চ্যানেল ও সংবাদপত্র যেভাবে তুলে ধরেন কিন্তু ভারতে তা দেখা যায় না। এদেশের চ্যানেলগুলো রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে যে হুজুগ দেখা যায় তা ভারতে বিরল। আপনি আমার লেখা বিশ্বাস না করলে হাজার হাজার চ্যানেল আছে ইন্ডিয়ার একটু রির্মোটটা প্রেস করুন। তাতে রবীন্দ্রনাথের অস্তি¡ত্ব খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। তিনি তো ভারতীয়দের নমস্য, কিন্তু আমাদের দেশে কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে এক শ্রেণীর দাসানুদাস! সেটাই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন?

“এমন একটি দিন অতিবাহিত হয় না যেদিন বাংলার কোথাও না কোথাও তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয় না। প্রতিনিয়তই তার গান, কবিতা ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে। রেডিও-টেলিভিশনেও প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো চ্যানেলে প্রচারিত হয় তাঁর গান কবিতা ও সাহিত্যনির্ভর নাটক সিনেমা। বাঙালির জীবনে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন।...... তিনি জমিদার ছিলেন, ব্যবসা করেছেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছেন, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল পেয়েছেন, এমনকি তিনি ধর্মগুরুও ছিলেন। ”(১) রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা-লেখক : রফিক হাসান-নয়া দিগন্ত, ৭মে ২০১৬।

উনিশ শতকের আশির দশকে হিন্দুদের গো-রক্ষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর 'গোকরুণানিধি' প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। ১৮৮২ সালে এই সংগঠনের জন্য কলকাতা থেকে সংগৃহীত হয় ছয়-সাত লক্ষ টাকা। এটা বলাই বাহুল্য যে কলকাতা থেকে এই বিপুল অর্থের যোগান দিয়েছিল হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। দয়ানন্দ স্বরস্বতীর আর্য সমাজ ও গো-রক্ষা আন্দোলন বাংলা এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলেও সে সময়ে দেশে কয়েকটি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠে। এইরূপ একটি সংগঠন হলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠিত 'সঞ্জীবনী সভা'। ১৮৮৬ সালে রাজনারায়ণ বসুর প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনরুদ্ধারে নিবেদিত ছিল। এই সংগঠনের কর্মকান্ডে বাংলার মুসলিম সমাজ সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক বক্তব্য স্থান পায়নি। বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান এবং সমাজে তাদের বাস্তব উপস্থিতি এই সংগঠন উপলব্ধি করতে পারেনি। এই সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত উনিশ শতকের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনে আন্দোলিত ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার।

হেমলতা দেবী প্রণীত গ্রন্থ 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেন বাংলা ১৩০৫ সালের ভারতী পত্রিকার জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়। এই গ্রন্থ সমালোচনার অনুষঙ্গে ভারতে মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে জমিদার রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। লেখিকা হেমলতা দেবী সম্ভবত তার ইতিহাস গ্রন্থে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে বিচার করেছেন। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, "মোঘল রাজত্বের পূর্বে তিনশত বছরব্যাপী কালরাত্রে ভারত সিংহাসনে দাস বংশ থেকে লোদী বংশ পর্যন্ত পাঠান রাজণ্যবর্গের যে রক্তবর্ণ উল্কা বৃষ্টি হয়েছে গ্রন্থে তার একটা বিবরণ থাকলে ভাল হতো।"

 মুসলিম রাজনৈতিক পতাকাতলে ভারতবর্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সতেরো শতকের ভারত ইতিহাসে শিবাজী একজন মুসলিল বিরোধী, সন্ত্রাসী, লুন্ঠনকারী ও বিশ্বাসভঙ্গকারী আঞ্চলিক দলনেতা। শিবাজীর আদর্শ হলো একমাত্র মুসলিম শাসনের বিরোধিতা। এখানে রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর হিন্দুধর্ম আর সন্ত্রাসের আদর্শে ভারতকে এক করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। শিবাজীর আদর্শে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক, মুসলিম বিদ্বেষী এবং আবহমানকাল ধরে চলে আসা বাংলা ও ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতি ধারার বিরোধী।

... ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পটভূমিতে একদিকে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় এবং অন্যদিকে বাংলায় সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। যেহেতু রাজশক্তি মুসলমানদের কাছ থেকে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল তাই তাদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বাংলার মুসলমান সমাজ। ইংরেজ শক্তি বাংলার মুসলমান সমাজের উপর শুরু করে শোষণ, নিপীড়ন আর নির্যাতন। অন্যদিকে বাংলার হিন্দু সমাজ শুরু করে বৃটিশ শক্তির পদলেহন ও দালালী। তারা ইংরেজ কোম্পানির দালালী, মুৎসুদ্দী আর বেনিয়াগিরী করে প্রভুত অর্থের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাকে গ্রহণ করে। অন্যদিকে মুসলমান সমাজ তাদের ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার ভয়ে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। ক্রমে রাজক্ষমতা, প্রশাসনিক কর্তৃৃত্ব মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উপরন্তু রাজভাষা ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজি চালু হলে মুসলমান সমাজ যুগপৎ ভূমি ও সরকারী চাকুরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে একটি দরিদ্র শ্রেণীতে পরিণত হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আর্থিক সামর্থ্য মুসলমানদের ছিল না। এই পটভূমিতে ইংরেজদের পদলেহী হিন্দু সমাজের একাংশ দালালী আর বেনিয়াগিরী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পটভূমিতে এই সকল দালাল-বেনিয়ারা অর্থ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে জমিদার শ্রেণীতে পরিণত হয়।
তিনি বাঙালীর প্রাণ। তাকে ছাড়া নাকি বাঙালীর অস্তি¡ত্ব অকল্পনীয়। আবার অনেকের কাছেই তিনি দেবতুল্য। (২) ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত-লেখক : সরকার সাহাবুদ্দীন আহমদ।

রফিক হাসান তার লেখায় রবীন্দ্রনাথকে অনেক গুণে গুণান্বিত করে বলেছেন জমিদার-ব্যবসায়ী-নোবেল জয়ী এবং ধর্মগুরু। কিন্তু এর অভ্যন্তরে যাননি। বৃটিশদের শাসনকে ১৯০ বৎসর দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথের পরিবারকে জমিদার বানিয়েছিলেন, বৃটিশ বন্দনা করে তিনি নোবেল হাতিয়ে নিয়েছেন, আর ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ছিল তার মজ্জাগত এদিকটার স্বরূপ তিনি ধরতে পারেন নি-পারলেও এড়িয়ে গেছেন। আর বাঙালীর জীবন নাকি আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে আছেন। ভাল কথা, রবীন্দ্রনাথ কি মুসলমানদের বাঙালী ভাবতেন? আমাদের বিশ্বকবি কুষ্টিয়াসহ বিরাট অঞ্চলের জমিদার ছিলেন, ইতিহাস থেকে জানি। দেখুন ইতিহাস কী বলে, “কলকাতা ভিত্তিক তৎকালীন হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের একটা কমন ডায়লগ ছিল ‘আপনি বাঙালী না, মুসলমান’। পূর্ব বাংলার মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাঙালী কবি ভাবলেও, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাদের বাঙালী ভাবতেন না, ভাবতেন- ‘মুসলমান’ ও ‘প্রজা’। তাদের চোখে উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই ছিলো প্রকৃত ‘বাঙালী’। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন, কারন বাংলা ভাগ হয়ে গেলে পূর্ব বাংলার প্রজাদেরকে জমিদারীর মাধ্যমে শোষনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং পূর্ব বাংলার প্রজাগণ আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল হয়ে উঠবে! এ ভয়ে দেশপ্রেমের ধোঁয়া তুলেছিল রবীন্দ্রনাথ সহ কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু সমাজ। বাংলাদেশীদের অতি প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুষ্টিয়ায় দীর্ঘদিন জমিদারী করলেও সেখানে একটি প্রাথমিক স্কুলও সে কোনোদিন প্রতিষ্ঠা করেনি, শান্তি নিকেতন করেছে কলকাতায়, এমনকি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বিরোধিতা করেছিলেন। ‘রীতিমত নভেল’ নামক ছোটগল্পে তিনি মুসলমান শব্দের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘যবন’ (অসভ্য) ও ‘ম্লেচ্ছ’ (অপবিত্র) প্রভৃতি শব্দ।(৩) হিন্দুরা ছিল ব্রিটিশদের সহচর ভারতীয় রাজাকার-লেখক : ফারুক সালাউদ্দিন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারীতে পদার্পণ করার চমকপ্রদ কাহিনী শুনুন। “তার পিতা বুড়ো বয়সে জমিদারীর বিশাল ভার কোন ছেলের হাতে অর্পণ করবেন তা নিয়ে মহাভাবনায় পড়ে যান পিতা। তিনি কবে মারা যান কে জানে? তিনি ভাবলেন, রবিকে জমিদারী কাজের মধ্যে টানতে না পারলে তার চলবে না। এতো বড়ো জমিদারী সব ছারখার হয়ে যাবে। বড়ো ছেলো দ্বিজেন্দ্রনাথ দার্শনিক মানুষ, বিষয়-কর্ম বুঝেও বুঝে না, দেখেও দেখে না। কোনো দিকে খেয়াল নেই তার। হয়তো বলা হলো, জমিদারিতে গিয়ে খাজনা আদায় করে আনো। তিনি গিয়ে প্রজাদের দু:খে ব্যথিত হয়ে খাজনা মওকুফ করে তো লিনেই, এমনকি নিজের পকেট থেকে টাকা-পয়সা দিয়ে এলেন তাদের। সত্যেন্দ্রনাথ সরকারি কাজে আজ এখানে কাল ওখানে, হয়তো ছুটিতে কেবল দিন কয়েক বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের সাথে কাটিয়ে যান। তার পক্ষে জমিদারি দেখা মোটেই সম্ভব নয়। জ্যোতিন্দ¿নাথের সংসারের কাজে টান কম। হেমেন্দ্র মারা গেছেন;অন্য দুই ছেলে অসুস্থ। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত জমিদারি দেখবার উপযুক্ত আর কোনো ছেলেই তো তার নেই। পাক্কা জহুরীর যেমন খাঁটি স্বর্ণ-হীরে চিনতে কষ্ট হয়না, ঠিক তেমনি পাক্কা জহুরীর ন্যায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জমিদারী চালানোর জন্য বেছে নেন।

আমরা জানি, কবিদের হৃদয় অত্যন্ত কোমল ও আকাশের ন্যায় উদার থাকে। কিন্তু জমিদারদের হৃদয় অত্যন্ত কঠিন ও সংকীর্ণ মনা হয়। হয়তো ব্যতিক্রম কিছু থাকে। কিন্তু ইতিহাসে এদের সংখ্যা খুবই কম। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংকীর্ণমনা ছিলেন কিনা জানি না; কিন্তু তিনি যে কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন-মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক তাকে জমিদারী তদারকি করার মনোননয়নই তা প্রমাণ করে।” (৪) ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত-লেখক : সরকার সাহাবুদ্দীন আহমদ-পৃষ্টা-২৭০-২৭১।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণ জমিদারের জমিদারী বন্ধ হয়ে যাবে তাই। অন্য কোন কারণ হয়ত গৌণ। “বঙ্গভঙ্গ হলে তাঁদের জমিদারীর ক্ষতি হয়ে যাবে। যেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সে। এ অঞ্চলের মানুষের রক্তচুষে খেয়ে বেঁচে থাকতো ঠাকুর পরিবারের মত জমিদাররা। তারা নানান অজুহাতে প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করতেন। যেমন: গরুর গাড়ি করে মাল নিলে ধূলো উড়তো, তখন ‘ধূলট’ নামক কর দিতে হতো

প্রজারা নিজের জায়গায় গাছ লাগলেও একপ্রকার কর দিয়ে গাছ লাগাতে হতো। সেই করের নাম ‘চৌথ’। গরীব প্রজারা আখের গুড় বানালে এক প্রকার কর দিতে হতো। তার নাম ‘ইক্ষুগাছ কর’। প্রজাদের গরু-মহিষ মরে গেলে ভাগাড়ে ফেলতে হলে কর দিতে হতো। তার নাম ‘ভাগাড় কর’। নৌকায় মাল উঠালে বা নামালে দিতে হতো ‘কয়ালী’ নামক কর। ঘাটে নৌকা ভিড়লে যে কর দিতে হতো তার নাম ‘খোটাগাড়ি কর’ জমিদারদের সাথে দেখা করলে দিতে হতো ‘নজরানা’। জমিদার কখন জেলে গেলে তাকে ছাড়িয়ে আনতে উল্টো প্রজাদের দিতে হতো ‘গারদ সেলামি’। (৫) গণঅসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ-লেখক : ড. স্বপন বসু।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারি সম্পর্কে অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন: “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। তার দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর জবরদস্তি করে আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোল্যার নেতৃত্বে শিলাইদহে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিলো।(৬) জমিদার রবীন্দ্রনাথ- দেশ ১৪৮২ শারদীয় সংখ্যা, লেখক : অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী।

১৭৫৭ সালে পলাশীতে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর ইংরেজরা মুসলমানদের উপর বর্ণবাদী হিন্দুদের সহযোগিতায় দমন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের স্টীম রোলার চালায়। জমিদার বাবুদের প্রভু ভক্তির কারণে তাদের জমিদাররিত্ব দিয়েই বৃটিশ শাসন দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়। প্রজাদের উপর কত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছিলেন ঐতিহাসিকরা চেষ্টা করেছেন তার কিঞ্চিত মাত্র তুলে ধরতে।

খাজনা অনাদায়ে প্রজাদের উপর জমিদাররা কিভাবে শারীরিক নির্যাতন চালাত তার কয়েকটি ভয়ানক তথ্য তৎকালীন “তত্ত্ববোধিনী” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটি লিখেছেন : “১। দন্ডাঘাত বা বেত্রাঘাত ২। কর্মপাদুকা প্রহার বা জুতাপেটা ৩। বংশ কাঠাদি দ্বারা বক্ষস্থল দলন ৪। খাপরা দিয়ে কর্ণ-নাসিকা দলন ৫। ভুমিতে নাসিকা ঘর্ষণ ৬। পিঠে দুই হাত মোড় দিয়ে বেঁধে বংশ দন্ড দিয়ে মোড় দেয়া ৭। গায়ে বিছুটি দেয়া ৮। হাত-পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা ৯। কান ধরে দৌড় করা ১০। কাঁটা দিয়ে দলন করা ১১। গ্রীষ্মকালে প্রখর রোদে ইটের উপর পা ফাঁক করে দু’হাত ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা ১২। গোনীবন্ধ করে জলমগ্ন করা ১৩। গাছে বা অন্যত্র বেঁধে টান দেওয়া ১৪। ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুরে রাখা ১৫। চুনের ঘরে বন্ধ করে রাখা ১৬। কারারুদ্ধ করে উপবাসী রাখা ১৮। ঘরের মধ্যে বদ্ধ করে লঙ্কা মরিচের ধোঁয়া দেওয়া। ইত্যাদি”(৭) বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা(১৯৬৮), পৃষ্টা : ২৩-২৪ লেখক : বিনয় ঘোষ।

রবীন্দ্রযুগে প্রজা নিপীড়নের ঘটনা উনিশ শতকেও বিদ্যমান ছিলো। ঘন ঘন খাজনা বৃদ্ধি, হিন্দুদের বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পূজা-পার্বণ ও পূণ্যাহের ইত্যাদি সম্পর্কিত খরচ আদায়ে সাধারণ জনগণ সাংঘাতিকভাবে অতীষ্ঠ হয়েছিলো। এদের নির্মমতা দেখে লেখক মুন্সী রিয়াজ উদ্দিনের কলম গর্জে উঠে। তিনি লিখেছেন :

“নির্দয় জমিদার পীড়ন করিয়া

খাজনা ছাড়াও অর্থ লইছে কাড়িয়া।।

পিতৃমাতৃ শ্রাদ্ধ বলি করিছে শোষণ

যে শোষণ তাদের পক্ষে চিরন্তন।।

পূজা-পার্ব্বনের নামে টংকা আদায়

করিছে নায়েবগণ বিষম আদায়

গোমস্তা পেয়াদা মৃধা তহশীলদার

সবাই নবাবজাদা জুলুম সবার।।” (৮) ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত-লেখক : সরকার সাহাবুদ্দীন আহমদ পৃষ্টা ।

ঠাকুর পরিবার প্রজা নিপীড়নের অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়, বৃটিশ পত্রিকা লিখেছে: “পৃথিবীর অন্য কোন দেশে কৃষকরা জমিদারদের দ্বারা এ দেশের মত নির্যাতিত হয় না। এইসব জমিদারেরা অনেকেই দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছে, এদের নীতি লুটে নাও যা পারো। (৯) তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের জমিদারীতেও অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন-জুলুম, শঠতা, প্রতারণা ও ব্যবসায়িক হীন মনোবৃত্তি সবই পুরো মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো-এতে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই বলে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।

তথ্যসূত্র :

১। রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা-লেখক : রফিক হাসান-নয়া দিগন্ত, ৭মে ২০১৬

২। ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত-লেখক : সরকার সাহাবুদ্দীন আহমদ

৩। হিন্দুরা ছিল ব্রিটিশদের সহচর ভারতীয় রাজাকার-লেখক : ফারুক সালাউদ্দিন

৪। ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত-লেখক : সরকার সাহাবুদ্দীন আহমদ-পৃষ্টা-২৭০-২৭১

৫। গণঅসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ-লেখক : ড. স্বপন বসু

৬। জমিদার রবীন্দ্রনাথ- দেশ ১৪৮২ শারদীয় সংখ্যা, লেখক : অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী

৭। বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা(১৯৬৮), পৃষ্টা : ২৩-২৪ লেখক : বিনয় ঘোষ

৮। ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত-লেখক : সরকার সাহাবুদ্দীন আহমদ পৃষ্টা_ ২৫৯

9| The morning chronicle-26th September 1850

Saturday 20 August 2016

আর্য বা ব্রাহ্মণ্য দর্শন একটি নষ্টা দর্শনের নাম। সেখানে নারী ভোগপণ্য হিসেবে হিন্দু দর্শন: পতিতা তৈরী করে অথবা দেবদাসী বানায় ।


# নারীদের সাথে কোনো স্থায়ী বন্ধুত্ব হতে পারে না। নারীদের হৃদয় হচ্ছে হায়েনাদের হৃদয়। (ঋগবেদ ১০:৯৫:১৫)। 
# বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না। তাদেরকে বরং নিরামিষভোজী ও অত্যন্ত দ্বীনহীনভাবে বাকি জীবন কাটাতে হবে। (মনুসংহিতা ৫)।

 # একজন স্বামী যতই খারাপ হোক না কেন, তথাপি একজন কর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী সেই স্বামীকে দেবতা হিসেবে ক্রমাগত পূজা করবে। (মনুসংহিতা ৫:১৫৪)। 


সূফি বরষণ 
নারী কখনো জননী, কখনো কন্যা অথবা স্ত্রী। এই সবই নারীর অবস্থান। হিন্দু ধর্মে  নারী কি শুধুমাত্র ভোগপণ্য, সন্তান উৎপাদন ছাড়া তার কি কোন নিজস্ব সত্তা নেই? আর্য দর্শন বা ব্রাহ্মণ্য দর্শন একটি নষ্টা দর্শনের নাম। সেখানে নারীকে ভোগপণ্য হিসেবে হিন্দু দর্শন: পতিতা তৈরী করে অথবা দেবদাসী বানায়। যে দর্শনে নারী সাধারণ সম্মান টুকুও নেই। আসলে ভারতীয় উপমহাদেশে যতসব অশান্তি দাঙ্গা হিংসা বিদ্বেষের মূলে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্ম ব্রাহ্মণ্য দর্শন।   এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে প্রায় ৪২০০ ধর্ম এবং প্রায় ২৮৭০ টা গডের উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন একেশ্বরবাদী এবং বহুঈশ্বরবাদীদের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে(কোন এক *Ricky Gervais* দার্শনিকের মতে)।কিন্তু প্রতিটা ধর্মই নারীদের কম বেশী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে করে রেখেছে পুরুষের ভোগ্যপণ্য কিংবা দাসী করে।আসুন এবার দেখা যাক,হিন্দু ধর্মে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে জেনে নিই।

হিন্দু শাস্ত্রমতে স্ত্রীলোক অত্যান্ত ঘৃন্য জীব। মনু সংহিতার ৯ম অধ্যায় ১৪নং শ্লোকে বলা হয়েছে "স্ত্রীরা পুরুষের সৌন্দর্য বিচার করে না, যুবা কি বৃদ্ধ তাও দেখে না । সুরুপ হোক বা কুরুপ হোক পুরুষ পেলই তার সাখে সম্ভোগের জন্য লালায়িত হয়।" আবার স্কন্ধ পুরানের নাগর খন্ডে ৬০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে " নারী জাতির অধরে পিযুষ এবং হৃদয়ে হলাহল পুর্ণ। সুতরাং তাদের অধর আস্বাদন করা এবং হৃদয় পীড়ন করা কর্তব্য।"

উক্ত ধর্মীয় কিধানের কারনেই কুমারী হিন্দু মেয়েদের মন্দিরে সেবাদাসী বা দেবদাসী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়ে থাকে এবং তারা শেষ পযর্ন্ত সেবায়েত, মোহন্ত , পুরোহিতদের লালসার বস্তুতে পরিনত হয়। সতীদাহ প্রথা অনুযায়ী বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় তোলা হয়, তখন তার মর্মন্তুদ আর্তচিৎকার যাতে বাইরে শোনা না যায়, তজ্জন্য জোরে জোরে বাদ্য বাজানো হতো। ঠিক তেমনি মন্দিরে কুমারী সেবাদাসীদের উপর সেবায়েৎরা বলৎকার করার সময় মেয়েটির আর্তনাদ বাইরে শোনা না যায় তার জন্য মন্দিরে জোরে জোরে কাসর ঘন্টা বাজানো হতো। এখনও ভারতের কোন কোন অঞ্চলে এ সেবাদাসী বা দেবদাসী প্রথা প্রচলিত আছে এবং মন্দিরে কাসর ঘন্টা বাজানো পুজার অপরিহায্য অঙ্গ। বৈদিক সংস্কৃতিতে ঐ ধরনের যৌন নিষ্টুরতার এবং অশ্লীলতার বহু ইতিহাস রয়েছে। পাঠক চাইলে সবগুলো পোস্ট করা হবে।

শিবপুজা:
শিব পুরাণ, মার্কন্ডেয় পুরাণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, একদা দূর্গার সাথে সঙ্গমকালে শিব এত বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাতে দুর্গার প্রাননাশের উপক্রম হয়। দুর্গা মনে মনে শ্রীকৃষ্ণকে স্বরন করতে থাকেন, এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ আর্ভিভূত হয়ে নিজ হস্তস্থিত সুদর্শন চক্রধারা আঘাত করল উভয়ের সংযুক্ত যৌনাংঙ্গ কেটে আসে। ঐ সংযুক্ত যৌনাঙ্গের মিলিত সংস্করনের নাম বানলিঙ্গ বা শিবলিঙ্গ যা হিন্দু সমাজের একটি প্রধান পূজ্য বস্তু এবং ঐ শিবলিঙ্গের পুজার জন্য বহু বড় বড় শিব মন্দির গড়ে উঠেছে। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে কাসর ঘন্টা বাজিয়ে হিন্দু সমাজ মহাসমারোহে ঐ শিবলিঙ্গ পুজা করে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণশ্বরে শিবের সঙ্গমের অবস্থান প্রদর্শনের জন্য পর পর বারটি মন্দির রয়েছে। ঐ মন্দিরগুলিতে সঙ্গমকালীন সময়ের বাররকমের প্রমত্তাবস্থা প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার মহিলা দর্শনার্থীর সমাগম হয়। সেখানে পুরুষ খুবই কম যেতে দেখেছি।

বালখিল্য মুনি:
প্রজাপতি দক্ষের একশত পাঁচটি কন্যার মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠা সতীর বিয়ে হয়েছিল মহাদেবের সাথে। ব্রক্ষ্মা-বিষ্ণু সহ সকল দেবতাই এই বিয়েতে উপস্থিত ছিলে। দক্ষের অনুরোধে ব্রক্ষ্মাকে এই বিয়েতে পৌরহিত্যের ভার নিতে হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানকালে বেদীতে উপবিষ্টা ঘোমটায় ঢাকা সতীর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চতুরানন অর্থাৎ, চার মুখবিশিষ্ট ব্রক্ষ্মা উপস্থিত সকলের অজান্তে সতীর সর্বশরীর দর্শন করে কামতাড়িত হয়ে পড়েন। কিন্তু ঘোমটার কারনে সতীর মুখ দেখা যাচ্ছিল না । কৌশলে সতীর মুখ দেখার জন্য ব্রক্ষ্মা তখন যজ্ঞকুন্ডে কাঁচা কাঠ নিক্ষেপ করেন। ফলে প্রচন্ড ধোঁয়া চারিদিকে ছেয়ে যায় এবং বেদীতে উপবিষ্ট সকলের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে ব্রক্ষ্মা ঘোমটা সরিয়ে সতীর মুখ দর্শন করেন।

এমনিতেই সতীর সর্বাঙ্গ দর্শন করে ব্রক্ষ্মা কামাতুর হয়ে পড়েছিলেন এখন মুখ দর্শন করে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না, ঐ বেদীর উপরই ব্রক্ষ্মার বীর্য স্খলিত হয়ে পড়ে। কেউ দেখে ফেলবে ভয়ে ব্রক্ষ্মা সেই বীর্যকে বালি চাপা দিয়ে ফেলেন। পরে ঐ বীর্য হতে ৮৮ হাজার মুনির জন্ম হয়, যাদের বলা হয় বালখিল্য মুন। সুত্র : স্কন্ধ পুরানর, নাগর খন্ড, ৭৭ অধ্যায়

রাধা কৃষ্ণ, দোল পুজা এবং হোলি খেলা:
রাধা কৃষ্ণ লীলা সম্পর্কে ব্রক্ষ্ম বৈবর্ত পুরানে বর্নিত আছে ব্রক্ষ্মা বলছেন " হে বৎস! আমার আজ্ঞানুসারে আমার নিয়োজিত কার্য করিতে উদযুক্ত হও।" জগদ্বিধাতা ঈশ্বরের বাক্য শ্রবন করিয়া রাধা কৃষ্ণকে প্রণাম করত: নিজ মন্দিরে গমন করিলেন। ব্রক্ষ্মা প্রস্থান করিলে দেবী রাধিকা সহাস্যবদনে সকটাক্ষ নেত্রে কৃষ্ণের রদনমন্ডল বারংবার দর্শন করত: লজ্জায় মুখ আচ্ছাদন করিলেন। অত্যান্ত কামবানে পীড়িত হওয়াতে রাধিকার সর্বাঙ্গ পুলকিত হইল। তখন তিনি ভক্তিপূর্বক কৃষ্ণকে প্রণাম করত: তাহার শয়নাগারে গমন করিয়া কস্তুরী কুম্কুম মিশ্রিত চন্দন ও অগুরুর পন্ক কৃষ্ণের বক্ষে বিলেপন করিলেন এবং স্বয়ং কপালে তিলক ধারন করিলেন।

তৎপর কৃষ্ণ রাধিকার কর ধারন করিয়া স্বীয় বক্ষে স্থাপন করত: চতুর্বিধ চুম্বনপূর্বক তাহার বস্ত্র শিথিল করিলেন। হে সুমে । রতি যুদ্ধে ক্ষুদ্র ঘন্টিকা সমস্ত বিচ্ছিন্ন হইল, চুম্বনে ওষ্ঠরাগ, আলিঙ্গনে চিত্রিত পত্রাবলী, শৃঙ্গারে করবী ও সিন্দুর তিলক এবং বিপরীত বিহারে অলন্কাঙ্গুর প্রভৃতি দূরীভুত হইল। রাধিকার সরসঙ্গম বশে পুলকিত হইল। তিনি মুর্ছিতা প্রায় হইলেন। তার দিবা-রাত্রি জ্ঞান থাকিল না। কামশাস্ত্র পারদর্শী কৃষ্ণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ দ্বারা রাধিকার অঙ্গ-প্রতঙ্গ আলিঙ্গন করত: অষ্টবিধ শৃঙ্গার করিলেন, পুর্নবার সেই বক্রলোচনা রাধিকাকে করিয়া হস্ত ও নখ দ্বারা সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত করিলেন।

শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক নিষ্টুরভাবে শরীর ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় এবং সারা রাতভর যৌন নিপীড়নের কারণে প্রভাতকালে দেখা গেল রাধিকার পরিহিত বস্ত্র এত বেশী রক্ত রঞ্জিত হয়ে পড়েছে যে, লোক লজ্জায় রাধিকা ঘরের বাইরে আসতে পারছেন না। তখন শ্রীকৃষ্ণ দোল পুজার ঘোষনা দিয়ে হোলি খেলার আদেশ দেন। সবাই সবাইকে রঙ দ্বারা রঞ্জিত করতে শুরু করে। তাতে রাধিকার বস্ত্রে রক্তের দাগ রঙের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। সেই থেকে হোলি খেলার প্রচলন শুরু হয়।

এই নারী একেক সময়ে এক এক জায়গায় স্থান পায়। বিয়ের আগে বাবার বাড়ীর অধীনে কন্যার অবস্থান হয়। বিয়ের পর সেই কন্যা স্বামীর অধীনে চলে আসে। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলের সংসারে জায়গা পায় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। এই ভাবেই নারী একেক জায়গায় ঘুরতে থাকে। কিন্তু আদৌ তার কোন স্থায়ী ঠিকানা জুটে না তার কপালে।তাহলে নারী কি শুধুমাত্র ভোগপণ্য,নারী কি কেবল সন্তান উৎপাদনকারী আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্ত্রী নামের দাসী?

আসুন এবার তাহলে জানা যাক হিন্দু/সনাতন ধর্মে নারীর অবস্থান সম্পর্কে কি বলে- হিন্দু ধর্ম বড় ধরণের আঘাত হেনেছে নারী সমাজের প্রতি। "নারী নরকের দ্বার" কথার মধ্যেই হিন্দু ধর্মের মনোভাব পরিষ্কার ফুটে ওঠে। হিন্দু সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা একেবারেই বিপরীতধর্মী। ধরে নেওয়া হয় নারী সংসারের ভেতরের কাজ সারবে আর পুরুষ করবে বাইরের কাজ। স্বভূমিতে দুজনকেই ক্ষমতাশীল মনে করা হলেও প্রকৃতক্ষেত্রে মেয়েদের স্থান হয় পুরুষের নিচে। তার পর বিবাহকে নারীর জীবনে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে হিন্দু ধর্ম নারী নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিয়েছে বলা যায়। কারণ মনে রাখতে হবে হিন্দু ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদের স্বীকৃতি নেই।

স্বামী মারা গেলে বিধবা নারীর বাঁচার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এই সতীদাহ প্রথা ভারতীয় সমাজে বহুদিন যাবত প্রচলন ছিল। রাজা রাম মোহন রায় বৃটিশ সাহায্যে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে হিন্দু ধর্মের সংস্কার করেন। এখনো বিধবা হলেই সেই নারীকে সাদা কাপড় পরিয়ে নিরামিষ ভোজী রাখার প্রচলন রয়েছে। হিন্দু ধর্মে বিধবা বিয়ে চালু করেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আসুন এবারে দেখা যাক প্রাচীন ধর্মে নারীর স্থান কি রকম ছিল। হিন্দুধর্মের মূল গ্রন্থ চারটি বেদ। শুক্লযজুর্বেদের অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে তুলনা করে বলা হয়েছে যে - “সে ব্যক্তিই ভাগ্যবান, যার পশুসংখ্যা স্ত্রীর সংখ্যারচেয়ে বেশি” (২/৩/২/৮)। শতপথ ব্রাহ্মণের এই বক্তব্যের হয়তো অধুনা বিভিন্ন দরদী ধর্মবাদীরা ভিন্ন ব্যাখ্যা ভিন্ন যুক্তি দিতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু পরবর্তী আরেকটি শ্লোকে আরও স্পষ্টভাবে হিন্দু ধর্মে নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারনা করা যায় - “বজ্র বা লাঠি দিয়ে নারীকে দুর্বল করা উচিৎ, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার না থাকতে পারে” (৪/৪/২/১৩) ।

অপরপক্ষে যে নারীরা বেদ-উপনিষদের শ্লোক-মন্ত্র রচনা করেছেন, সেই নারীদেরই উত্তরসূরীদের জন্য মনু বেদসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। “নারীরা ধর্মাজ্ঞ নয়, এরা মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় অশুভ” (মনুসংহিতা, ৯/১৮)।

সনাতন ধর্মের মণিষী মনু বলেছেন ‘নারী শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধ্যকে পুত্রের অধিন থাকবে’। এই উক্তি নারীর চিরকালের বন্দিত্বের কথাকেই স্মরণ করে দেয়। নারীর আজকের যে বন্দি দশা তা মানুষের সামগ্রীক মনুষত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। শাস্ত্রীয় প্রবঞ্চনার প্রধান শিকার নারী।
স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে বা কোন ধর্মানুষ্ঠানে শূদ্রকে যেমন কোন অধিকার দেয়া হয়নি, নারীকেও তেমনি স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাতে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে সুস্পষ্ট বিধান জুড়ে দেয়া হয়েছে-

‘নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।’

স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা। অর্থাৎ স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ (৯/১৮) ।

# নারীদের সাথে কোনো স্থায়ী বন্ধুত্ব হতে পারে না। নারীদের হৃদয় হচ্ছে হায়েনাদের হৃদয়। (ঋগবেদ ১০:৯৫:১৫)

# নারীরা কোনো নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলে না। তাদের বুদ্ধিমত্তা নাই বললেই চলে। (ঋগবেদ ৮:৩৩:১৭)

# নারীরা শক্তিহীন বা কর্তৃত্বহীন। তারা পৈত্রিক সম্পত্তির কোনো অংশ পাবে না। (যজুর্বেদ ৬:৫:৮:২)

# নারীরা দৃষ্টিকে নত করে চলবে, সামনের দিকে তাকাবে না। (ঋগবেদ ৮:৩৩:১৯)

# বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না। তাদেরকে বরং নিরামিষভোজী ও অত্যন্ত দ্বীনহীনভাবে বাকি জীবন কাটাতে হবে। (মনুসংহিতা ৫)

# নারীদেরকে অবশ্যই দিন-রাত নিজ পরিবারের পুরুষদের অধীনে থাকতে হবে। তারা যদি কোনো রকম ইন্দ্রিয়াসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তাদেরকে অবশ্যই কারো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। (মনুসংহিতা ৯:২)

# শৈশবকালে একজন নারী তার পিতার অধীনে থাকবে, যৌবনে তার স্বামীর অধীনে থাকবে, স্বামী/লর্ড মারা গেলে তার পুত্রদের অধীনে থাকবে। নারীরা কখনোই স্বাধীন হতে পারবে না। এমনকি তারা স্বাধীন হওয়ার যোগ্যই না। (মনুসংহিতা ৫:১৪৮, ৯:৩)

# একজন স্বামী যতই খারাপ হোক না কেন, তথাপি একজন কর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী সেই স্বামীকে দেবতা হিসেবে ক্রমাগত পূজা করবে। (মনুসংহিতা ৫:১৫৪)

# একজন নারীর স্বামী মারা যাওয়ার পর সেই নারী কখনোই অন্য কোনো পুরুষের নাম মুখে নিতে পারবে না। (মনুসংহিতা ৫:১৫৭)

# স্বামীর প্রতি দায়িত্ব লঙ্ঘনের দ্বারা একজন স্ত্রী এই পৃথিবীতে অসম্মানিত হবে, মৃত্যুর পর তার এই পাপের শাস্তিস্বরূপ একটি শৃগালের গর্ভে বিভিন্ন রোগ দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকবে। (মনুসংহিতা ৫:১৬৪)

# নারীদের মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ সৎকারের সময় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু পাঠ করা যাবে না। (মনুসংহিতা ২:৬৬)

# পুরুষের উচিত নয় তার মা, বোন, অথবা কন্যার সাথে একাকী বসা, পাছে কী হতে কী হয়। (মনুসংহিতা ২:২১৫)

# নারীরা পুরুষের সৌন্দর্য বা বয়স কোনোটাই বিচার না করে সুদর্শন বা কুৎসিত যা-ই হোক না কেন, পুরুষ হলেই তার প্রতি নিজেকে সঁপে দেয়।(মনুসংহিতা ৯:১৪)

# নারী ও শূদ্ররা বেদ পড়া বা শোনার উপযুক্ত নয়। (সূত্র)

# নদী যেমন সমুদ্রের সাথে মিশে লবনাক্ত সমুদ্রের গুণপ্রাপ্ত হয়, তেমনই নারী বিয়ের পর স্বামীর গুণযুক্ত হন । (মনুসংহিতা ৯:২২)

#স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম তাদের হোমরূপ অগ্নিপরিচর্যা। (মনুসংহিতা ২:৬৭)

#আবার গৃহকর্ম এবং সন্তান উৎপাদন সম্পর্কে বলা হয়েছে - সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই নারী এবং সন্তান উৎপাদনার্থে পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে। (মনুসংহিতা ৯:৯৬)


বিশ্বের সবচেয়ে বড় পতিতালয়গুলোর একটি কলকাতার সোনাগাছির একটি ছবি(সূত্র: উইকিপিডিয়া)।

পতিতা, শব্দটির অর্থ যেসব নারী সমাজচ্যুত, বা সমাজ থেকে পতিত হয়েছে। এ ঝরে পড়ার প্রক্রিয়াটিও অনেক ক্ষেত্রে হৃদয়বিদারক, কারণ অধিকাংশ সময় পুরুষরা ফুসলিয়ে নারীটিকে নিষিদ্ধপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু কয়েক দশক আগেও যখন এর প্রচলন ছিল না, কিংবা ব্রিটিশ আমলে, যখন নারীরা ছিল আওরত বা গোপনীয় বিষয়, তখন কোন প্রতিষ্ঠান ,কোন গোষ্ঠী মানবইতিহাসের প্রায় সমান বয়সী এ পেশায় লোক যুগিয়ে এসেছে?

শরৎচন্দ্রের ইন্টারমিডিয়েটে পাঠ্য গল্প বিলাসিনী, এতে লেখা আছে মেজোবাবুর বউ বিধবা হওয়ার পর মনের দুঃখে কাশী গমন করে। পরে তাকে যেখান থেকে জমিদার পরিবার নিজেদের মানসম্মান রক্ষার তাগিদে উদ্ধার করে, তা কাশীই বটে! অর্থাৎ খদ্দেরদের কাশী বা খুশির জায়গা। এ কর্ম ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণদের বিশেষ উৎকোচ প্রদানের কাহিনীও গল্পে রয়েছে। ওই সময়কার সাহিত্যে বৈধব্যের ফাঁদে পড়ে হিন্দু মেয়েদের পতিতা হবার প্রচুর কাহিনী রয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা, প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে পতিতাবৃত্তিকে সম্মান করা হয়েছে, ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি যে গণিকা সরবরাহের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র, এত সন্দেহ নেই।

দূর্গা পুজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয় । তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য । বলা হয় বেশ্যারা নাকি পুরুষদের কাম (যৌনতা) নীলকন্ঠের মতো ধারন করে সমাজকে নির্মল রাখে বলে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা অবশ্য প্রয়োজনীয়।" এ তথ্যের উৎস হল : সানন্দা ১৮ এপ্রিল ১৯৯১ দেহোপজীবিনী সংখ্যা, শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "গণিকাবৃত্তি : সমাজ, সংস্কার এবং সমীক্ষা" প্রচ্ছদ প্রতিবেদন , পৃস্ঠা: ১৯, হাতের ডান দিকের কলাম ।

অর্থাৎ বেশ্যার অনুপস্থিতিতে দুর্গাপুজা সম্ভব নয়। অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা মাত্রই জানে, ওই দিন মন্ডপে মন্ডপে মদ্যপান এবং অশ্লীল গানবাজনা কি পরিমাণে হয়ে থাকে। কারণ দুর্গাপুজা হল ব্রিটিশআমলের সংস্কৃতি। এ পূজা আগে হতো বসন্তকালে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলাকে হটানোর হিন্দু ষড়যন্ত্র যখন সফল হয়, হিন্দুরা তাদের প্রভু ব্রিটিশদের সাথে তাদের বিজয় উদযাপনের জন্য পুজাকে শরৎকালে এগিয়ে নিয়ে আসে।
আর ব্রিটিশরা জাত জলদস্যু। পতিতা ছাড়া তাদের উৎসব অচল। ফলে পতিতাগমন আজও দুর্গাপুজার একটি আবশ্যিক বিষয়।

হিন্দুসমাজ একজন নারীকে সমাজচ্যুত করার, বাজে কাগজের মতো ছুড়েঁ ফেলে দেয়ার এতসব উপায় উদ্ভব করেছে যা বিস্তারিত লিখতে গেলে লেখার পরিসর বেড়েই চলবে। তবু আরেকটি অজানা কিন্তু ভয়ানক নিয়ম সম্পর্কে আমাদের জানা জরুরী। অনেকে শুনেছেন এ প্রবাদ, মেয়েদের জীবনে লগন একবারই আসে। লগন হলো হিন্দুধর্মের পরিভাষা অনুযায়ী, বিবাহের নির্দিষ্ট সময় বা লগ্ন, ঠাকুর ডেকে গণনা করে বের করা হয় বিবাহের লগ্ন। এ পার হয়ে গেলে একজন মেয়ের জীবনে আর লগ্ন আসবে না, অর্থাৎ তাকে অবিবাহিতই থাকতে হবে। অর্থাৎ কোন কারণে যদি বর লগনের সময় না পৌছতে পারে, তখন শুরু হয়ে যেত হুড়োহুড়ি। হিন্দু লেখক সাহিত্যিকদের লেখাতেই এর যথেষ্ট প্রমাণ আছে , বিশেষ করে রম্যলেখকদের মধ্যে। কিন্তু এর ফলে দেখা যেত, আঠারো বছরের মেয়ের বিয়ে হয়েছে আশি বছরের বুড়োর সাথে, কারণ বিয়ের আসরে জাতের কেউ আর পাওয়া যায় নি। আব্বার মুখে শুনেছিলাম, জমিদারের মেয়ের পাত্র যদি পৌঁছতে না পারত তবে কাজের লোকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেয়া হতো, কিন্তু অনাকাঙ্খিত বিয়ে রূপ নেয় ভাঙনে, আর ভাঙনের ফলে ওই মেয়ের ঠাঁই হতো পতিতালয়ে।

এক হিন্দু মহিলার মুখে শুনেছিলাম, হিন্দু মেয়ের বিয়ের আগের দুইদিন টানা, মেয়ে এবং বাবাকে না খেয়ে থাকতে হবে,ধর্মের নিয়ম। কিন্তু সে আর তার বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়েছিল।


ভারতীয় সিরিয়ালের আগ্রাসনে সামাজিক অবক্ষয় চরমে পৌঁছেছে





মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ

বাংলাদেশের কৃষ্টি  ও সামাজিক ঐতিহ্য আজ চরম ভাবে হুমকির মুখে পড়েছে ভারতীয় অশ্লীল টিভি সিরিয়ালের কারণে । আর কত সমাজের অবক্ষয় হওয়ার পরে ভারতের নষ্ট সিরিয়াল, ভারতীয় চ্যানেল গুলো বন্ধ হবে বাংলাদেশে সম্প্রচার ? চরম মস্তিষ্ক বিকৃতি মূলক সিরিয়ালের একটি উদাহরণ দিচ্ছি এখানে , স্টার প্লাস সিরিয়াল,গোপি বাহূ নামক নাটক,সাথ নিভানা সাথীয়া,বিদ্যা মীরা,বিয়ে করলো,একই পরিবারের দুজনকে,নিজের বোনের শ্বশুরকে বিয়ে করলো মীরা যা দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী।  সিরিয়ালের পরিচালকের কি জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক লোপ পেয়েছে,এধরনের দৃশ্য আমাদের সমাজের কি ক্ষতি করবে তাঁর কোনো ধারণা আছে? মানে আপন দুই বোন একজন বিয়ে করেছে ছেলেকে আর অন্য বোন বিয়ে করেছে নিজের আপন বোনের স্বামীর পিতাকে!?? একই সংসারে এক বোন অপর বোনের শ্বাশুরি!?? এইসব সিরিয়ালের কারণে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ, সিরিয়ালের কারণে শিশু পানিতে পড়ে মৃত্যু বা ঘরে আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই, সিরিয়ালের পোশাকের জন্য আত্মহত্যা ইত্যকার ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে।

 আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টিতে যেভাবে বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় অশ্লীল বিকৃত সংস্কৃতির মোড়কে বাস্তবতা বিবর্জিত কাল্পনিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টিকারী সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় বাকী আছে বলে মনে হয়না । বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ সংস্কৃতি বলতে শুধু টেলিভিশন ইঙ্গিত করে এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বলতে ভারতীয় সিরিয়াল ছাড়া অন্য কিছু নয় । দেশের মোট টিভি দর্শনার্থীর ৮০ ভাগ নারী এবং নারীদের ৯০ ভাগেরও বেশি টিভি অনুষ্ঠান বলতে কেবল ভারতীয় সিরিয়ালে সীমাবদ্ধ । ভারতীয় এসব সিরিয়াল থেকে তবুও যদি ইতিবাচক কিছু শেখা যেত ! এসকল ভারতীয় সিরিয়াল যেমন পারিবারিক শান্তি কেড়ে নিয়ে কুটনামি, পরকীয়া তথা নষ্ট সংস্কৃতির চর্চায় উদ্ভূদ্ধ করছে তেমনি খুঁটিনাটি কারনে ডিভোর্সের মত সর্বনিম্ন বৈধতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে । সিরিয়ালের নেতিবাচক প্রভাব সমাজের সর্বত্র । দেশীয় ঐতিহ্যের ধারক যৌথ পরিবারগুলোকে ভেঙ্গে একক ও অনু পরিবারের রূপ নিচ্ছে । নষ্ট সংস্কৃতির চর্চায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার অমূল্য সম্পর্কে দিন দিন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে । মা-মেয়ে এবং বাবা-ছেলেদের মধ্যে টিভি-রিমোট দখলের প্রতিযোগীতায় সাংসারিক অশান্তি নিত্যকার ব্যাপার । পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের অন্তরায় হিসেবে পারিবারিক কলহ নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে ।

 হিন্দী সিরিয়াল বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। হিন্দি সিরিয়ালের শিক্ষনীয় কোন বিষয় না থাকলেও এর দর্শক দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাবারের মতো টেনে-হিঁচড়ে এসব সিরিয়াল এমনভাবে লম্বা করা হয় যে, এর শেষ পর্ব কবে প্রচারিত হবে তা কেউ যেমন জানে না তেমনি আন্দাজও করতে পারে না। হিন্দি সিরিয়ালের মধ্যে যে সব ম্যাসেজ বা বার্তা থাকে তা একটি পরিবার তথা সমাজ কে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। হিন্দি সিরিয়াল দেখার ফলে সমাজ থেকে যেমন সামাজিক মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে তেমনি সামাজিক, মানসিক সবক্ষেত্রেই দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা। অনৈতিক ও ঘৃণ্য অশ্লীলতা ছাড়া শিক্ষণীয় তেমন কিছুই পাওয়া যায় না বলেই এমনটি হচ্ছে। ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালে যে সব দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-অসম প্রেম, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া, পারিবারিক ভাঙ্গন, বহু বিবাহ, বউ-শ্বাশুড়ীর ঝগড়া, সম্পত্তির কারণে ভাই-ভাই ঝগড়া, স্ত্রীর কূটনৈতিক চাল, ভুল বোঝাবুঝি, হিংসা, সন্দেহ, অশ্লীলতা, আত্মীয়দের ছোট করা, অন্যকে বিপদে ফেলা, চুরি শিক্ষা, অপরাধ শিক্ষা এসব বিষয়ই হিন্দি সিরিয়ালের মূল বিষয়বস্তু।

 শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ণের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে । আত্মহত্যার মত ঘৃণিত ঘটনার সূত্রপাতেও ভারতীয় সিরিয়াগুলো সরাসরি প্রভাব ফেলছে । বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম আলোচিত নক্ষত্র, জনপ্রিয় বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপস্থাপক ও পরিচালক হানিফ সংকেত আমাদের জীবনে ভারতীয় সিরিয়ালের কূফল উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘হিন্দি টিভি সিরিয়াল দেখছি আর শিখছি কুটনামির কুট সম্ভ্রম লুট কলহ-দাঙ্গা সংসার ভাঙ্গা পরকীয়া প্রীতি নষ্ট সংস্কৃতি’ । সংস্কৃতিমনা জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে । তবে সে সুনাম হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই দুর্নামে রূপ লাভ করবে । কেননা প্রতিটি জাতির জাতীয় সংস্কৃতি সে জাতির মানসিকতা ও ভৌগলিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উদ্ভব হয় ।

 ভারতীয় সংস্কৃতির যে আগ্রাসন আমাদের সমাজের ওপর চলছে সে সংস্কৃতি ভারতীয় জাতিসত্ত্বার জন্য মানানসই কিন্তু বাংলাদেশের মত স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার ধারকদেরকে কেন ভিন্ন জাতির সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে তা সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখা আবশ্যক । বিশ্বয়ানের প্রভাবে আকাশ সংস্কৃতির দ্বার উম্মুক্ত হওয়ায় যে কোন দেশের সংস্কৃতি দেশের ভৌগলিক সীমা পাড়ি দিয়ে নিমিষেই অন্য ভূখন্ডে বসবাসরত জাতির কাছে পৌঁছে যায় । তাই বলে সে সংস্কৃতি গ্রহনের পূর্বে আমদের বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত নয় ? যে সংস্কৃতি সামাজিক পেক্ষাপটে বাঙালি মনন ধ্বংস করছে এবং বাংলাদেশীদের মাঝে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় তৈরি করছে তা গ্রহনের পূর্বে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা অত্যাবশ্যক ।

এ দাবী শুধু পুরুষের জন্য বরং সচেতন নারীদের একাংশের । এদেশের নারীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, কোন জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্থাণ-পতনে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য । যারা বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে সামান্য চিন্তা করে, যারা চায় আমাদের প্রজন্ম বিকৃত মানসিকতার পরিবর্তে সুস্থ মানসিকতায় গড়ে উঠুক, যারা বাংলাদেশে সুস্থ ভাবধারার দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতে বদ্ধপরিকর তাদের সকলের দাবী; অবিলম্বে যেন আমাদের সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরুপ ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধের মাধ্যমে আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে রক্ষা করা হয় এবং নতুন প্রজন্মের জন্য সুস্থ-স্বাভাবিক মানবিক গুনাবলী বিকাশের পথ উম্মুক্ত রাখা হয় । যে অধিক সংখ্যক সাধারণ মানুষ, মিডিয়াকর্মী এবং সচেতন মহলের গুনীজন এ সকল ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের দাবীতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক মানুষের আন্দোলনে সরকার অসংখ্য দাবী পূরণ করেছে অথচ কোন এক রহস্যজনক কারনে সরকার দেশের জন্য অমঙ্গলজনক এ চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি অথচ অত্যাবশ্যকভাবে করা উচিত
ছিল ।

সরকারের সামন্য কিছু দোষ-ত্রুটি প্রকাশের কারনে কিংবা সরকারের বিরোধিতা করায় দেশীয় অনেক জনপ্রিয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল অথচ দেশের সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ ভারতীয় যে চ্যানেলগুলো প্রত্যহ দেশের মানুষের শান্তি গ্রাস করছে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক তা নতুন করে ভেবে দেখা উচিত । দেশীয় যে চ্যানেগুলোর সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে সেগুলো সরকার ও সরকার সমর্থক শ্রেণীর জন্য হুমকি হলেও সেগুলো রাষ্ট্রের অস্থায়ী ক্ষতি করছিল কিন্তু ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘকালীন ক্ষতির কারণ হবে । যে ক্ষতির মাত্রা এখনও সম্পূর্নভাবে অনুমিত না হলেও নিকট ভবিষ্যতে বর্তমান প্রজন্ম যখন জাতির নেতৃত্ব দিবে তখন পুরোপুরিভাবে মাত্রা টের পাওয়া যাবে । সুতরাং সাবধান হওয়ার এটাই বোধহয় সর্বোত্তম সময় । তথ্যমন্ত্রী বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোকে ধারাবাহিকভাবে প্রথম রেখে অন্য দেশের চ্যানেলগুলোকে শেষে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো খুঁজে পেতে রিমোটের সবগুলো বাটন চাপতে হয় ! সরকারের দায়িত্বশীলরা এসব ক্ষতিকর চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করলেও অন্তত জাতীয় স্বার্থে আমাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে ।

অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপণ প্রচারের জন্য নীতিমালা থাকা আবশ্যক । বিরামহীন বিজ্ঞাপন প্রচারের কারনে উচ্চমানের অনুষ্ঠানও নিম্নমানে পরিণত করে । দেশীয় চ্যানেলগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বেশি বেশি খবর প্রচার । এত খবর যে তারা কোথায় পায় তা তারাই জানে ! বিশ্বের সকল দেশের খবর প্রচারের জন্য আলাদা চ্যানেল রয়েছে এবং তারা তাদের বিনোদেনের চ্যানেলে ক্ষুদ্র পরিসরে খবর পরিবেশন করে কিংবা কোথাও কোথাও খবর প্রচার থেকে বিরত থাকে । অথব বাংলাদেশের বিনোদনমূলক চ্যানেলগুলোতে বিদেশী রাষ্ট্রের সংবাদ প্রধান্য চ্যানেলগুলোর চেয়েও বেশি খবর প্রচার করে । যা দেশের টিভি দর্শক বিশেষ করে নারী দর্শকদের জন্য বিরক্তির অন্যতম কারণ । সুতরাং প্রতিদিন সর্বোচ্চ তিনবার খবর প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা-তা টিভিগুলোর ভেবে দেখা উচিত । ভারতীয় সিরিয়াল আসক্তদের মনে রাখা উচিত, ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত ১২টি সিরিয়াল আমাদের জাতীয় জীবনের ৬টি মূল্যবান ঘন্টা নষ্ট করে । কোন জাতির যদি উন্নতির স্বপ্ন থাকে তবে তারা ৬ ঘন্টা সময় অর্থহীনভাবে নষ্ট করার মত বোকামী করতে পারে না ।

বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ঘরের ভিতর যেমন বন্দি হয়ে থাকতে চাই না তেমনি চাই না অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধ আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক। ভারতীয় চ্যানেল, সিনেমার অবাধ বিচরণ আমাদের দেশে। আর তাই ইচ্ছে করলেও এই অবাধ বিচরণ থামাতে পারবো না। আমাদের সবকিছু্র সানিদ্ধ্যে আসতে হয়। কিন্তু এখান থেকেই আমাদের বুদ্ধি-বিবেক আর শক্তি দিয়ে খারাপ সংষ্কতি বর্জন করতে হবে। আমরা বাঙ্গালী। আর বাঙ্গালীদের রয়েছে গর্ব করার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংষ্কতি। আমাদের সাহিত্য- সংষ্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। তাই এ সমৃদ্ধ সংষ্কৃতির চর্চা করলে, বাংলা নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা দেখলে নিঃসন্দেহে কমে আসবে হিন্দি সিরিয়াল দেখার প্রবণতা। হিন্দি সিরিয়ালের এই অপসংষ্কৃতি রোধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি তরুণদেরকেও এই সংষ্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত করতে হবে।