Tuesday 27 December 2016

অখন্ড ভারত বলতে কিছু নেই।


মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই  ব্রাহ্মণ্যবাদের দাসত্ব করতে চায় না।

যারা অখন্ড ভারতের কথা বলে তারা মুলত মুসলমানদেরকে ভারতীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের গোলাম বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ।

সূফি বরষণ ।

ভারত মূলত কোনো দেশের নাম নয়, এরা কোনো একক জাতিও নয়..।  ভারত হচ্ছে সিন্ধু ,গঙ্গা ও যমুনা  নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা একটি উপমহাদেশের নাম। নানান ধর্মের নানান জাতের নানা ভাষা-ভাষী মানুষের অঞ্চল, বৃটিশরাই সর্বপ্রথম ভারতীয় উপমহাদেশকে একসাথে করে, তবে সে সময়ও হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীরসহ অনেক স্বাধীন রাজ্য ছিল। অর্থাত আক্ষরিক অর্থে ব্রিটিশ ইন্ডিয়াও অখন্ড ছিল না। মুসলিম শাসনামলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাতে স্বাধীন সুলতানি শাসন ছিল। ভারত কোনো কালেই অখন্ড ছিলনা । তবে অধিকাংশ রাজ্য আকার ও আয়তনে ছোট হলেও হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর ছিল ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী।

মুঘলদের শাসনটা ছিল মূলত উত্তর ভারত ও পাকিস্তান কেন্দ্রিক। টিপু সুলতান দক্ষিন ভারত শাসন করেছে। গুজরাটে, আসামে আলাদা মুসলিম রাজ্য ছিল। মুসলমানদের আগমনের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশ নানা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল এবং আলাদা আলাদা রাজা দ্বারা শাসিত হত। মহারাষ্ট্র স্বাধীন দেশ ছিল তারা বাংলাতে লুটপাট করতে আসত। যেমন সেই লুটপাটের কাহিনী নিয়ে ছড়া আছে, খোকা ঘুমালো পাড়া জোরালো বর্গী এলো দেশে। এই বর্গী হলো অত্যাচারী হিন্দু ডাকাত মহারাষ্ট্র হিন্দুরা ।

 কেরালা-তামিল নাড়ু সবসময়ই স্বাধীন ছিল। মনিপুর-মিজোরাম এরাও স্বাধীন রাজ্য ছিল। মূলত অখন্ড ভারতের স্লোগান হচ্ছে প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশগুলোকে গ্রাস করার স্লোগান। আর ভারতের যেসব অঞ্চল স্বাধীন হতে চায় তাদেরকে ধরে রাখার একটা চেষ্টা। ঐতিহাসিকভাবে হাজার বছরের অখন্ড ভারত বলে কিছু নাই। ব্রিটিশদের অধীনস্ত ইন্ডিয়ার কথা বাদ দিলে অখন্ড ভারতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতেও অখন্ড ভারত বলে কিছু হবে না, মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় ব্রাহ্মণ্যবাদের দাসত্ব করতে চায় না।

অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছেন, “ভারত অবশ্যম্ভাবীভাবে তার আধিপত্য বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত হবে সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ছোট জাতি রাষ্ট্রগুলোর সর্বনাশ ঘটবে। তার সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকবে না।” থাকবে ভারত মাতার অধীনে।

মোটামুটি এটাই ছিল ভারতের স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর বহুল প্রচলিত ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’, যা নেহেরু ডকট্রিন নামেও পরিচিত।
Nehru’s India Doctrine says:

“India will inevitably exercise an important influence. India will also develop as the centre of economic and political activity in the Indian Ocean area. The small national state is doomed. It may survive as a culturally autonomous area but not as an independent political unit.” Now it makes sense of why and how Hydrabad, Kashmir, Goa, and Sikkim were made part of India. Why there has been deep Indian RAW involvement in Sri Lanka, Maldives, Nepal and in Bangladesh.?

 ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত তার ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইয়ে এর প্রথম আভাস পাওয়া যায়। মূলত ‘অখন্ড ভারত’ ধারণা থেকেই এর উদ্ভব, এবং একে একে কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, সিকিম এবং নেপালের মাওবাদ, শ্রীলংকার তামিল টাইগার বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের ১৯৭১ এর যুদ্ধ । এবং তার পর থেকে বাংলাদেশে অযাচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইন্ডিয়া ডকট্রিন তার স্বরূপ উন্মোচন করছে সবার সামনে; বছর কয়েক আগে নেপালের তরাই অঞ্চলের গণভোট এবং এর পরবর্তী জ্বালানী অবরোধও এর বাইরে নয়।

প্রাচীণ ভারতবর্ষের মহামতি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধাণ অমাত্য কৌটিল্য, যিনি চানক্য নামেই সুপরিচিত, তার একটি শিক্ষা ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের জন্য – “ক্ষমতা অর্জনের লোভ ও অন্য দেশ বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনও মন থেকে মুছে ফেল না। সব সীমান্তবর্তী রাজাকে শত্রু বলে মনে করবে।” হাজার বছর পর এসেও কি এই মূলনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত ? এখন সবার মনে একই প্রশ্ন?।

তার আগে আমাদেরকে জেনে নেয়া অতিজরুরী ব্রাহ্মণবাদকি? এরা নিজেদের পরিচয় দেয় সুপিরিয়র উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ? “শোষণের জন্যই শাসন-এই সনাতন মূলনীতির মূলাধার ব্রাহ্মণ্যবাদ । শোষণকে প্রচ্ছন্ন করতে হলে শাসনকে একটা আদর্শের নামে খাড়া করতে হয়”। –

এই শোষণের আদর্শের নামই ব্রাহ্মণধর্ম। তাই ব্রাহ্মণধর্ম কোন ধর্ম নয়, ব্রাহ্মণধর্ম হল আসলে একটি অপরাধের নাম, মানুষকে শোষণের হাতিয়ারের নাম। মানুষে মানুষে বিভাজন জাতপ্রথা বর্ণপ্রথা তৈরী করে মানুষদের শোষণের নাম, ব্রাহ্মণদের উচ্চ ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করার নাম। প্রশ্ন হলো যারা নিজের ধর্মের মানুষদেরকে জাতপ্রথা তৈরী করে শোষণ নির্যাতন অত্যাচার করে। তারা কিভাবে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ এবং জৈন ধর্মের মানুষকে আপন মনে করে বুকে জড়িয়ে নিবে? যারা নিজের ধর্মের মানুষকে ভাই হিসেবে বুকে জড়িয়ে নিতে পারে না?। ছুঁলেই যাদের জাত যায়!?

আমরা যে ভারতের কথা অহরহ উচ্চারণ করি সেই দেশটি সাংবিধানিকভাবে ভারত হিসাবে স্বীকৃত। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ইন্ডিয়া এলো কোথা থেকে। ইন্ডিয়া কখনো ভারতের নাম ছিল না। ইংরেজ আমলে দেশটির এ নাম দেয়া হয়। ইন্ডাস বা সিন্ধু থেকে ইন্ডিয়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। আবার সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দটি এসেছে। হিন্দুরা ইন্ডিয়া নামের কোনো দেশকে স্বীকার করে না। তাদেরকে এ নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্যদিকে মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ও বিষ্ণু পুরাণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত হওয়ায় ভারত বা ভারতবর্ষ নামটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আত্মার।

বর্তমান সময়ে ভারত বরবারই মতোই অখণ্ড ভারত কায়েম করতে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে । মৌর্য সম্রাট অশোক-পূর্ব ভারত কায়েম তাদের লক্ষ্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), বজরং, শিব সেনা এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো মূলস্রোতের ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে একটি অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করছে। অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অখণ্ড ভারতের ধারণা হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত আবেগময় এবং তাদের অস্তিত্বের অংশ। ভারত বিভক্তি তাদের কাছে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা।



নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে সংঘ পরিবারের ২০ হাজার স্কুলে পাঠ্য ভূগোল বইয়ের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয় এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।

শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে এক্সপ্লেইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে, "The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof."
অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে ততদিন শান্তি আসবে না।


অখণ্ড ভারত কায়েমের দূরভিসন্ধি থেকে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। অখন্ড ভারত গঠনের আদর্শ সাঙ্গাথান (হিন্দু ঐক্য) এবং শুদ্ধি (বিশুদ্ধিকরণ) ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। আরএসএস নেতা এইচভি সেশারদির দ্য ট্রাজিক স্টোরি অব পার্টিশন শিরোনামে গ্রন্থে অখন্ড ভারত গঠনের ধারণার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থে সে লিখেছে, “Whenthe new viceroy Lord Mountbatten announced on 3rd June, 1947 theplan of transfer of power, it came as a stunning blow to the people. For thatplan, approved by Nehru and Patel, had envisaged cutting up Bharat and creationof Pakistan.The great and trusted leaders of Congress had turned their back on the sacredoaths they had taken and the pledges they had administered to the people. Whattook place on August 15, 1947, was this gross betrayal of the nation’s faith,the betrayal of the dreams of countless fighters and martyrs who had plungedinto the fire of freedom struggle with the vision of Akhanda Bharat in theirhearts.”
অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৩ জুন নয়া ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। তার এ ঘোষণা জাতির কাছে একটি মারাত্মক আঘাত হিসাবে বিবেচিত হয়। নেহরু ও প্যাটেল অনুমোদিত এ পরিকল্পনায় ভারতকে দ্বিখন্ডিত এবং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব দেয়া হয়। কংগ্রেসের মহান ও বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ তাদের পবিত্র ওয়াদা এবং জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে পিঠটান দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনা ছিল জাতির বিশ্বাসের সঙ্গে একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং হৃদয়ে অখন্ড ভারত কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে যেসব অগণিত যোদ্ধা ও শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের স্বপ্নের সঙ্গে বেঈমানী।

এবার ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অখন্ড ভারত' প্রতিষ্ঠার লালসা নিয়ে কিছু কথা: আমরা যদি গত চার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব সব সময় ব্রাহ্মনরা বৌদ্ধদের জৈনদের নানা অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আর্য-ব্রাহ্মনরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসে এবং হিন্দুধর্ম চালু করে। হিন্দুধর্ম চালু করলেও কর্তিত্বটা আর্য-ব্রাহ্মণদের হাতে রেখে দেয়া হয়, নিয়ম করা হয় স্বর্গে যেতে হলে ব্রাহ্মণদের আনুগত্য করতে হবে। বৌদ্ধরা এবং জৈনরা আর্যদের তৈরী করা এই ধর্মের সমালোচনা শুরু করে, নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। শুরু হয় বৌদ্ধদের-জৈনদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন, লাখ লাখ বৌদ্ধ এবং জৈনকে হত্যা করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের ক্ষমতা গ্রহনের আগ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের লোকদের উপর জৈন ধর্মের লোকদের উপর এই অত্যাচার-নির্যাতন চলতে থাকে।
রাজা অশোক উড়িষ্যাতে এক লাখ (মিলিয়ন নয়) বৌদ্ধকে হত্যা করেছিল, পরবর্তিতে রাজা অশোক এই অনুশোচনায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। রাজা শশাঙ্ক তার শাসনামলে ঘোষণা করেছিল যেখানে বৌদ্ধ পাবে সেখানেই হত্যা করবে। সেন শাসনামলে বৌদ্ধদের উপর আবার অত্যাচার-নির্যাতন নেমে আসে।

সেন শাসনামলের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে বৌদ্ধরা মুসলমানদের সাহায্য চায় ফলে বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয়ে এগিয়ে আসে। উত্তর ভারতীয় অঞ্চল, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা যেখানেই মুসলমানরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছে বৌদ্ধরা এবং জৈনরা মুসলমানদেরকে সহযোগিতা করেছে। মুসলমানদের ক্ষমতা গ্রহনের মধ্য দিয়ে আর্য-ব্রাহ্মনদের অত্যাচার-নির্যাতন, জোর করে বৌদ্ধদেরকে হিন্দু বানানোর প্রচেষ্টা বন্ধ হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনে যেভাবে বৌদ্ধরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তেমনিভাবে ব্রিটিশদের আগমনে ব্রাহ্মণরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণদেব নবাব সিরাজ উদ দৌলা থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে সমগ্র ভারতবর্ষই মুসলমানদের থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। শুরু হয় গোলামির জীবন, বৌদ্ধদের মুক্তিদাতা মুসলমানরা এবার নির্যাতিত হতে থাকে। একদিকে ব্রিটিশ একদিকে ব্রাহ্মণ দুয়ে মিলে মুসলমানদের উপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন চলে সেটা থেকে আজাদী আসে ১৯৪৭ সালে।

কিন্তু মুসলমানরা বৌদ্ধদের মত হারিয়ে যায়নি, ধর্মও পরিবর্তন করেনি কিংবা অন্য দেশেও চলে যায়নি- বরং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, একশত বছর ভারতীয় উপমহাদের বীর মুসলিমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ১৯৪৭ আগে পাকিস্তান আন্দোলনের সফলতার মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয়। সেই পরাজয়ের ব্যাথায় আর মুসলমানদের শোষণ করা নেশায় এখনও শুকুনের বাংলাদেশের উপরে নজর দিয়ে রেখেছে।
 



দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো ভারতীয়দের চক্ষুশূল। ভারতের কংগ্রেস পার্টি কখনো দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন কংগ্রেস এক প্রস্তাবে বলেছিল, ”Geographyand mountains and sea fashioned India as she is and no human agency can changethat shape or come in the way of her final destiny. Once present passions hadsubsided the false doctrine of two nations will be discredited and discarded byall.”
অর্থাৎ ভূখন্ড, পর্বত ও সমুদ্র ভারতকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে এবং কোনো মানবীয় শক্তি ভারতের এ আকৃতি পরিবর্তন অথবা তার চূড়ান্ত ভাগ্যের পথে অন্তরায় হতে পারে না। বর্তমানে বিরাজিত মিথ্যা দ্বিজাতি তত্ত্বের আবেগ একদিন থিতিয়ে আসবে এবং সবাই তা পরিত্যাগ করবে।

কংগ্রেস ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা করেছে। মুসলিম লীগের মতো সংখ্যালঘু  মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করলে তারাও দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক হতো। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করার অর্থ ভারতে একটি মাত্র জাতি ছাড়া আর কোনো জাতির বসবাসের অধিকার নেই। এ ধরনের মানসিকতা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও অস্তিত্ব অস্বীকার করার শামিল।      
   
ভারতীয় উপমহাদেশ পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর বসতিস্থল হলেও এখানে একটি মাত্র জাতির শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্যণীয়। বিশুদ্ধ আর্য জাতির দাবিদার এ জাতি ভারতের তিন-চতুর্থাংশের ওপর নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং উপমহাদেশের বাদবাকি অংশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের অশুভ চক্রান্তে নিয়োজিত রয়েছে। ভারতীয়দের কাছে ভারত হলো মায়ের মতো অবিভাজ্য। ব্রিটিশদের বিদায় করার স্বার্থে তারা সাময়িকভাবে ভারত বিভক্তি মেনে নিয়েছিল। পরবর্তী কার্যকলাপে ধরা পড়ে যে, অখন্ড ভারত কায়েম করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে এক জাতিতে বিশ্বাসী এ শক্তি ধীরে ধীরে উপমহাদেশকে গ্রাস করছে। তাদের আগ্রাসী থাবায় দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর ভবিষ্যৎ বিপন্ন। সুদূর অতীতকাল থেকে তারা অখন্ড ভারত কায়েমের স্বপ্ন লালন করছে। বিগত ও চলতি শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার অশান্তির মূলে রয়েছে ভারত।

দেশটি প্রতিটি প্রতিবেশি বিশেষ করে ক্ষুদ্র প্রতিবেশিদের জন্য বরাবরই নিজেকে একটি হুমকি হিসাবে প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলেও বুঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই সব। অন্য দেশগুলো তার ইচ্ছার কাছে জিম্মি। দক্ষিণ এশিয়াকে পদানত করতে ভারত প্রাচীন চানক্য নীতি অনুসরণ করছে। ভৌগোলিক সম্প্রসারণ হচ্ছে চানক্য নীতির মূল লক্ষ্য। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিদায় লগ্ন থেকে অখন্ড ভারত কায়েমে ভারতের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ শুরু হয়। ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের। তাছাড়া উদ্ধৃতিতে তিনটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক, কেন কেবল উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করল? তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে কারণে হিন্দু শাসনামলের অবসান হয়ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্টিত হয়েছিল, সেই একই কারণে দেশ বিভক্তির সাথে সাথে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল।

,দেশ বিভক্তির ফলে ভারত হতে প্রচুর সংখ্যক মুসলমান পাকিস্তানে চলে এসেছিল, সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবার কারণ কী? তাতে কি এটা স্পষ্ট হয় না ব্রিটিশদের উস্কানীতে মুসলিম নিধনের যে বেগ হিন্দুদের মধ্যে তৈরী হয়েছিল সেখানে মুসলমনরা নিরাপদ নয়? কারণ অবিভক্ত ভারতে হিন্দুদের প্রাধান্য। ফলে মুসলমানরা কি সেখানে কখনো নিরাপদ হত? যেমন ১৯৮৪ সালে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ত্রাস; ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (প্রতিচিন্তা:১০৮) এবং ২০০৬ সালে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলিম হত্যা কি প্রমান করেনা ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তি ঠিক ছিল?

১৯৪৭ সালের ১১ জুলাই প্রণীত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি পায়নি বহু দেশীয় রাজ্য। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টে বলা হয়েছিল, দেশীয় রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো হয়তো ভারত নয়তো পাকিস্তানে যোগদান করতে পারবে। অথবা স্বাধীন থাকতে পারবে। কিন্তু এ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গোয়ালিয়রে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে নেহরু ঘোষণা করে যে, যেসব দেশীয় রাজ্য ভারতের গণপরিষদে যোগদানে অস্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে বৈরি হিসাবে ঘোষণা করা হবে। সে এ ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত একটির পর একটি দেশীয় রাজ্য গ্রাস করে। এসব দেশীয় রাজ্য গ্রাসে ভারত যখন যেমন তখন তেমন নীতি অনুসরণ করে নিজের সীমানা সম্প্রসারিত করেছে।

১৯৪৭ সালের ২৫ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশীয় রাজাদের এক সমাবেশে বলে, তাদের রাজ্যগুলো টেকনিক্যালি ও আইনগতভাবে স্বাধীন হলেও কিছু ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে রাজাদের নিজস্ব শাসন বজায় রাখতে ভারত ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষরে তাদের পরামর্শ দেয়। মাউন্টব্যাটেন ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা বলতে আসলে ভারত সংলগ্ন দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিল। সে দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতে যোগদানে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছিল। অধিকাংশ রাজ্য আকার ও আয়তনে ছোট হলেও হায়দরাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, যোধপুর, জয়পুর, গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদা, ত্রিবাঙ্কুর ও মহীশূর ছিল ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার উপযোগী।

শক্তিপ্রয়োগ করা না হলে কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতো। নয়তো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারতো। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭ সালে চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে এসব রাজ্য সফর করে পরিস্থিতিতে ঘৃতাহুতি দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ গোলযোগপূর্ণ রাজ্যগুলো সফর করা থেকে বিরত থেকে নিজেদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনে।

দুর্বল দেশীয় রাজ্যগুলো গ্রাসে ভারত কোনো ন্যায়নীতির তোয়াক্কা করেনি। শক্তি ও কূটকৌশল ছিল দেশটির বিজয়ের একমাত্র চাবিকাঠি। ভারত শুধু অন্যায়ভাবে দেশীয় রাজ্য গ্রাস করেছে তাই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোতেও দেশটি বারবার হস্তক্ষেপ করেছে এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে গলাটিপে হত্যা করেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ভারতকে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, পাকিস্তান একটি সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশদের সৃষ্ট কৃত্রিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান নয় বরং ভারতই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলে সে দেশে গুজরাট স্টাইলের দাঙ্গা হওয়ার কথা ছিল হাজারে হাজার। কিন্তু শিয়া-সুন্নিতে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হলেও আজ পর্যন্ত দেশটিতে হিন্দু বিরোধী একটি দাঙ্গাও হয়নি। ব্রিটিশরা পক্ষপাতিত্ব করে থাকলে করেছে ভারতের প্রতি। পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হলে জন্মু ও কাশ্মীর, পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতের ত্রিরঙ্গা পতাকা উড়তো না। তাছাড়া ৪৭ এ দেশ বিভক্তির সময় পশ্চিম ও পূর্ব বঙ্গের মানুষেরা নিজস্ব সং¯কৃতির জন্যই দেশ বিভক্তির পক্ষে রায় দিয়েছিল। এই দীর্ঘ দিন পরেও একত্র করার পক্ষে কোন প্রস্তাব উঠেনি জোরালো ভাবে। তাছাড়া পশ্চিম বঙ্গের মানুষ বাঙালি পরিচয় দিয়ে সুখ বোধ কওে না, ভারতীয় পরিচয়ে স্বাছন্দে বোধ করে। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা প্রতিবাদ করেনি কাটা তারের বেড়ার। প্রবেশ করতে দেয় নি বাংলাদেশী কোন টিভি চ্যানেল। একই হৃদয়ের মানুষ হলে প্রতিবাদ করত বিভিন্ন নদীতে যে বাঁধ নির্মিত হচ্ছে তার। কিন্তু কিছুই হয়নি। মনে রাখা ভাল সিংহ হয়ে জন্মে চিড়িয়াখানায় থাকার চেয়ে ইঁদুর হয়ে স্বার্ধীন ভাবে মাথা উচু করে আত্মমর্যদাশীল হয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভাল। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করেই নয় তা হচ্ছে ইতিহাস সংগ্রহের মাধ্যম দেখে। আমরা যদি পশ্চিমাদের লিখিত ইতিহাস পাঠ ও তাদের নির্দেশনায় লিখিত ইতিহাসের উপর নির্ভর করি, তবে আমরা কোন দিন নিজস্ব পরিচয় খুঁজে পাব না। পরিশেষে একথা বলতে চাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর, সংস্কৃতির, ঐতিহ্যের এবং শাসনামলের প্রকৃত ইতিহাস নিজেরাই রচনা করে স্বাধীন বাংলাদেশকে পরাধীন না করে সত্যিকারের স্বার্থক স্বাধীনতা অর্জন ও উপভোগের প্রয়াস চালাব। এই হউক আমাদের দ্বীপ্ত শপথ।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে আমার ভূমিকা: শেখ মুজিবুর রহমান।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে আমার ভূমিকা: শেখ মুজিবুর রহমান।

অখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সবাই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে। এসময় আমাদের বক্তৃতার ধারাও বদলে গেছে। অনেক সময় হিন্দু বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ নিয়ে আলোচনা হতো। কিছুতেই তারা বুঝতে চাইত না। ১৯৪৪-৪৫ সালে ট্রেনে, স্টিমারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হতো। সময় সময় এমন পর্যায়ে আসত যে, মুখ থেকে হাতের ব্যবহার হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠত। এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধে নেই। পাকিস্তান আনতে হবে এই একটাই স্লোগান সব জায়গায়।

একদিন হক সাহেব আমাদের ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। দাওয়াত নিব কি নিব না এই দুই দল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, “কেন যাব না, নিশ্চয়ই যাব। হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগে ফিরে আসতে। আমাদের আদর্শ যদি এত হালকা হয় যে, তার কাছে গেলেই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাব, তাহলে সে পাকিস্তান আন্দোলন আমাদের না করাই উচিত।” আমি খুলনার একরামুল হককে সাথে নিলাম, যদিও সে ইসলামিয়ায় পড়ে না। তথাপি তার একটা প্রভাব আছে। আমাকে সে মিয়াভাই বলত। আমরা ৬/৭ জন গিয়েছিলাম। শেরে বাংলা আমাদের নিয়ে খেতে বসলেন এবং বললেন, “আমি কি লীগ ত্যাগ করেছি? না, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে? জিন্নাহ সাহেব আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেন না। আমি বাঙালি মুসলমানদের জন্য যা করেছি জিন্নাহ সাহেব সারা জীবনে তা করতে পারবেন না। বাঙালিদের স্থান কোথাও নেই, আমাকে বাদ দিয়ে নাজিমুদ্দীনকে নেতা করার ষড়যন্ত্র।” আমরাও আমাদের মতামত বললাম। একরামুল হক বলল, “স্যার, আপনি মুসলিম লীগে থাকলে আর পাকিস্তান সমর্থন করলে আমরা বাংলার ছাত্ররা আপনার সাথে না থেকে অন্য কারও সাথে থাকতে পারি না।

‘পাকিস্তান’ না হলে মুসলমানদের কি হবে?” শেরে বাংলা বলেছিলেন, “১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কে করেছিল, আমিই তো করেছিলাম! জিন্নাহকে চিনত কে?” আমরা তাকে আবার অনুরোধ করে সালাম করে চলে আসলাম। আরও অনেক আলাপ হয়েছিল, আমার ঠিক মনে নেই। তবে যেটুকু মনে আছে সেটুকু বললাম। তার সঙ্গে স্কুলজীবনে একবার ১৯৩৮ সালে দেখা হয়েছিল ও সামান্য কথা হয়েছিল গোপালগঞ্জে। আজ শেরে বাংলার সামনে বসে আলাপ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

এদিকে মুসলিম লীগ অফিসে ও শহীদ সাহেবের কানে পৌঁছে গিয়েছে আমরা শেরে বাংলার বাড়িতে যাওয়া-আসা করি। তার দলে চলে যেতে পারি। কয়েকদিন পরে যখন আমি শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “কি হে, আজকাল খুব হক সাহেবের বাড়িতে যাও, খানাপিনা কর? বললাম, “একবার গিয়েছি জীবনে।” তাকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, “ভালই করছ, তিনি যখন ডেকেছেন কেন যাবে না?” আরও বললাম, “আমরা তাকে অনুরোধ করেছি মুসলিম লীগে আসতে।” শহীদ সাহেব বললেন, “ভালই তো হতো যদি তিনি আসতেন। কিন্তু আসবেন না, আর আসতে দিবেও না। তার সাথে কয়েকজন লোক আছে, তিনি আসলে সেই লোকগুলোর জায়গা হবে না কোথাও। তাই তাকে মুসলিম লীগের বাইরে রাখতে চেষ্টা করছে।”

শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, কোনো সংকীর্ণতার স্থান ছিল না তার কাছে। কিন্তু অন্য নেতারা কয়েকদিন খুব হাসি-তামাশা করেছেন আমাদের সাথে। আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেয়া হতো আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেইজন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কি অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসত। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতই।

কারণ, সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম। একদিন বললাম, “স্যার, কোনো ছাত্র রোগগ্রস্ত হলে যে কামরায় থাকে, সেই কামরাটা আমাকে দিয়ে দেন। সেটা অনেক বড় কামরা দশ-পনেরজন লোক থাকতে পারে।” বড় কামরাটায় একটা বিজলি পাখাও ছিল। নিজের কামরাটা তো থাকলই। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, দখল করে নাও। কোনো ছাত্র যেন নালিশ না করে।” বললাম, “কেউই কিছু বলবে না। দু’একজন আমার বিরুদ্ধে থাকলেও সাহস পাবে না।”

এই সময় আমি বাধ্য হয়ে কিছুদিনের জন্য ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই। অনেক চেষ্টা করেও দুই গ্রুপের মধ্যে আপস করতে পারলাম না। দুই গ্রুপই অনুরোধ করল, আমাকে সাধারণ সম্পাদক হতে, নতুবা তাদের ইলেকশন করতে দেয়া হোক। পূর্বের দুই বৎসর নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করেছি। ইলেকশন আবার শুরু হলে আর বন্ধ করা যাবে না। মিছামিছি গোলমাল, লেখাপড়া নষ্ট, টাকা খরচ হতে থাকবে। আমি বাধ্য হয়ে রাজি হলাম এবং বলে দিলাম তিন মাসের বেশি আমি থাকব না। কারণ, পাকিস্তান ইস্যুর ওপর ইলেকশন আসছে, আমাকে বাইরে বাইরে কাজ করতে হবে। কলেজে আসতেও সময় পাব না। আমি তিন মাসের মধ্যেই পদত্যাগপত্র দিয়ে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদক করে দেই।

১৯৪৫ সালের গোড়া থেকেই ইলেকশনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ইলেকশন হবে, সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী মুসলমানরা ‘পাকিস্তান’ চায় কি চায় না তা নির্ধারণ করতে। কারণ, কংগ্রেস দাবি করে যে, তারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। নজির হিসেবে তারা বলে, মওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি। একথা সত্য যে, কয়েকজন খ্যাতনামা মুসলমান নেতা তখন পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল যে, ভারতবর্ষ এক থাকলে দশ কোটি মুসলমানদের ওপর হিন্দুরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। তাছাড়া কতগুলো প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগুরু আছে। আর যদি পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুইটি রাষ্ট্র হয়, তবে হিন্দুস্থানে যে সমস্ত মুসলমানরা থাকবে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। অন্যদিকে মুসলিম লীগের বক্তব্য পরিষ্কার, পাকিস্তানের হিন্দুরাও সমান নাগরিক অধিকার পাবে। আর হিন্দুস্থানের মুসলমানরা সমান নাগরিক অধিকার পাবে। লাহোর প্রস্তাবে একথা পরিষ্কার করে লেখা আছে।
দৈনিক আজাদই ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত। এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরাম খাঁ সাহেব ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশিম সাহেবকে শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন।

আমাদেরও ঐ একই দশা। তাই আমাষের কোনো সংবাদ সহজে ছাপা হতো না। মাঝে মাঝে মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। পরে সিরাজুদ্দিন হোসেন (বর্তমান দৈনিক ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক) এবং আরও দু’একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করত। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই-একটা সংবাদ ছাপাত। দৈনিক মর্নিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ঐ পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকে পুরাপুরি সমর্থন করত, তবুও ওটা একটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণী বলা যায়। আমাদের সংবাদ দিতেই চাইত না। ঐ পত্রিকা হাশিম সাহেবকে মোটেই পছন্দ করত না। ছাত্র ও লীগ কর্মীরা হাশিম সাহেবকে সর্মথন করত, তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে সংবাদ দিত। আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে, বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারার প্রচার করার জন্য। হাশিম সাহেবের পক্ষে কাগজ বের করা কষ্টকর। কারণ টাকা-পয়সার অভাব। শহীদ সাহেব হাইকোর্টে ওকালতি করতে শুরু করেছেন। তিনি যথেষ্ট উপার্জন করতেন, ভালো ব্যারিস্টার হিসেবে কলকাতায় নামও ছিল। কলকাতায় গরিবরাও যেমন শহীদ সাহেবকে ভালবাসতেন, মুসলমান ধনীক শ্রেণীকেও শহীদ সাহেব যা বলতেন, শুনত। টাকা-পয়সার দরকার হলে কোনো দিন অসুবিধা হতে দেখিনি। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে তা পেলে পরে আর জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এই দুইজনই শহীদ সাহেবকে রাজি করাতে পারব, এই ধারণা অনেকেরই ছিল।
আমরা দুইজন একদিন সময় ঠিক করে তার সাথে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভাল ভাল লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাত খরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে। আরও দু’-একবার দেখা করার পর শহীদ সাহেব রাজি হলেন।
মুসলিম লীগ অফিসের নিচতলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারী করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তার যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’।
হাশিম সাহেবের গ্রুপকে অন্য দল কমিউনিস্ট বলতে শুরু করল, কিন্তু হাশিম সাহেব ছিলেন মওলানা আজাদ সোবহানীর একজন ভক্ত। তিনি বিখ্যাত ফিলোসফার ছিলেন। মওলানা আজাদ সোবহানী সাহেবকে হাশিম সাহেব আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন কলকাতায়। আমাদের নিয়ে তিনি ক্লাস করেছিলেন। আমার সহকর্মীরা অধিক রাত পর্যন্ত তার আলোচনা শুনতেন। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। কিছু সময় যোগদান করেই ভাগতাম। আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, “তোমরা প-িত হও, আমার অনেক কাজ। আগে পাকিস্তান আনতে দাও, তারপর বসে বসে আলোচনা করা যাবে।” হাশিম সাহেব তখন চোখে খুব কম দেখতেন বলে রক্ষা। আমি পিছন থেকে ভাগতাম, তিনি কিন্তু বুঝতে পারতেন! পরের দিন দেখা করতে গেলেই জিজ্ঞাসা করতেন, “কি হে, তুমি তো গতরাতে চলে গিয়েছিলে।” আমি উত্তর দিতাম, “কি করব, অনেক কাজ ছিল।” কাজ তো থাকতই ছাত্রদের সাথে, দল তো ঠিক রাখতে হবে।

Saturday 24 December 2016

সুন্দর বলুন সুন্দর লিখুন লিখেছেন আবদুস শহীদ নাসিম




মন্দ কথা ছাড়ুন
সুন্দর কথা বলুন

১.একটি ভালো কথা একটি ভালো গাছের মতো !

A Goodly word like a goodly tree, whose root is firmaly fixed and branches ( reach) to sky . It brings forth its fruit at all times ” ( al Quraan : 14:24- 35)

“ একটি ভালো কথা একটি ভালো গাছের মতো , মাটিতে যার বদ্ধমূল শিকড়, আকাশে যার বিস্তৃত শাখা , সব সময় সে দিয়ে যার ফল আর ফল। ” ( আল কুরআন ১৪ : ২৪ - ২৫)

কী অনুপম উপমা ! এমন উপমা কি আপনার মনকে নাড়া দেয় না ? আপনার হৃদয়াবেগ জাগ্রত করেনা ? একটি ভালো কথা একটি ভালো গাছের মতো ! সেই ভালো গাছটির মতো , মাটির গভীরে যার শিকড় , হালকা বাতাসে তো দূরের কথা , তুফানেও সে টলেনা । শাখা বিস্তার করে দিয়ে সে মানুষের জন্য ছায়া ঘেরা নিসর্গ তৈরি করে রেখেছে। বারো মাস সে সরবরাহ করে যায় ফল আর ফল।

আপনার একটি সুন্দর কথা , একটি ভালো কথা ঐ গাছটির মতোই কল্যাণময়। আপনার একটি সুন্দর কথা ঐ গাছটির মতোই হতে পারে শান্তির বাহক , কল্যাণের কাসিদা , আনন্দের দূত আর অফূরন্ত সুফল দায়ক।

২. সুন্দর কথা মানে কি ?

‘কথা ’ বলতে কী বুঝায় ? আপনার মুখের ভাষা , উক্তি এবং বক্তব্যই আপনার কথা। কথা বুঝবার জন্যে আমরা অনেকগুলো প্রতিশব্দ ব্যবহার করি। যেমন : বচন, বাণী বাক্য , বয়ান , বিবৃতি , বিবরণ , বাক, ভাষণ, ভাষ , ভাষা, ভনিতি , বক্তব্য , বোল , বুলি , উক্তি , নিরুক্তি ,উচ্চারণ, যবান , লবজ , প্রবচন , প্রবাদ , সম্ভাব , সম্ভাষণ , সম্বোধন , সংলাপ ইত্যাদি।

কথার প্রধানত দু’টি দিক আছে : সুন্দর কথা , অসুন্দর কথা ; ভালো কথা - মন্দ কথা । এই সুন্দর কথা বা ভালো কথা বলতে কী বুঝায় , তা আমরা সবাই জানি , বুঝি ।

সুন্দর কথা মানে সুবচন , সুকথা , সুভাষ , সুভাষণ , সুবাক্য , সদালাপ , সদুক্তি , মিষ্টি কথা , মিষ্টি বাক্য , মিষ্টি ভাষণ , প্রিয়বচন , প্রিয়বাক্য , হিতবাক্য , হিতকথা , হিতোপদেশ , উপদেশবাণী , কাজের কথা , মুখে মধু ঝরা , কানে মধুঢালা , শ্রুতিমধুর কথা , শ্রুতিমধুর্য ধ্বনি মাধুর্য , মধুরবাণী , পূতকথা , মঞ্জুভাষ , স্বচ্ছকথা, স্পষ্ট ভাষা, অর্থবহ কথা ইত্যাদি।

আর যিনি সুন্দর কথা বলেন , আমরা তাকে বলি সুভাষী , মধুভাষী , মিষ্টিভাষী , প্রিয়ভাষী , সুবচনী , সুবক্তা , সুকথক , মৃদুভাষী ,অমৃতভাষী , হিতভাষী ,সুভাস , মজ্ঞুভাষ ,কোমলভাষী , স্বচ্ছভাষী,স্পষ্টভাষী, মিতভাষী, স্বল্পবাসী,সংযতবাক ।

শ্রেষ্ট মনীষীরা সুভাষী । তাঁরা সুন্দর কথা বলেন , সুন্দর করে বলেন । তাঁদের সুবচনে , সদালাপে , সুকথার শ্রুতিমাধূর্যে শ্রোতারা সদা সম্মোহিত। কার না ইচ্ছা হয় সুন্দর কথা বলতে ? সুবচন শুনতে ?

৩. অসুন্দর কথা তবু আছে

তবু অসুন্দর কথা আছে । মন্দকথা আছে । মানুষ অসুন্দর কথা বলে । মন্দ কথা শুনে ।আপনি কি জানেন অসুন্দর কথা কি ? হ্যাঁ জেনে রাখুন, অসুন্দর কথার সমার্থ শব্দগুলো বলে দিচ্ছি ।

অসুন্দর কথা মানে -কটুকথা , কটুক্তি, কটুবাক্য , কটুভাষা , কটুভাষণ , দুরুক্তি,দুর্বচন ,কড়াকথা , চড়াকথা , মুখছোটামি , দুর্মুখ , দুর্বাক , নিন্দাবাণী , নিন্দাবাদ,খোঁটা ,পরচর্চা ,মন্দকথা ,মন্দবাক ,কুকথা,বাজে কথা ,গালি ,অভিশাপ ,অপকথা ,অশ্লীল কথা ,বাঁকা কথা, কটাক্ষ, ঠাট্টা ,বিদ্রুপ ,শ্লেষ ,উপহাস ,তিরস্কার ,ব্যাঙ্গোক্তি ,অবজ্ঞা ,ধিক্কার, বকা , বকুনি ,ধাতানি ,বকাঝকা ,দাবড়ি ,র্ভৎসনা ,ভেটকি ,খ্যাকখ্যাক,গর্জন ,তর্জন গর্জন , হম্বি তম্বি , তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ,চোটপাট,অতিকথা অমিতভাষণ , বাগাড়ম্বর , বকবক ,ভ্যাদর ভ্যাদর , বকর বকর ,কথার শ্রাদ্ধ, কথার তুবড়ি ছুটানো , কথার খই ফুটানো , প্রগলভতা , প্রলাপ ,বাকসর্বস্বতা , আগড়বাগড় ,আবোল কাবোল , আগড়ম বাগড়ম ,ধানাইপানাই ,প্যানপ্যান ,ঘ্যানঘ্যান , তেগর তেগর ঘ্যান ঘ্যানানি ,প্যান প্যাননানি , চর্বিত চর্বন ,গ্যাক গ্যাক ,চেঁচানি ,চেঁচামেচি ,চেল্লাচেল্লি ,কোলাহল ,গন্ডগোল ,হৈহুল্লুড় ,শোরগোল ,হৈ হল্লা ,হৈ হট্টগোল ,হৈ-হররা,অট্টরোল ,অট্টরব ,হাঁকডাক ,হাঁকাহাকি ,হুংকার , ভীমনাদ ,জিগির ,কলোবর, গল ফাটানো ,অকথা ,আকথা,অপশব্দ ,ইতরভাষা ,অপভাষা অশিষ্ট্য বাক্য , কটুক্তি ,আশ্রাব্য কথা, দুরুচ্চার্য ,অভাষ্য ইত্যাদি। এসব হলো অসুন্দর কথা ,মন্দ কথার বৈশিষ্ট্য। এগুলো কথার কালিমা । তবু কি আপনি এসব অসুন্দর কথা বলবেন ? না -

৪, মন্দ কথা ছাড়ুন

না , মন্দ কথা বলবেন না। মন্দ কথা ছাড়ুন । মন্দ কথায় কোনো লাভ নেই। উপকার নেই । এতে ক্ষতি আছে । এতে ক্ষতি আছে।মন্দ কথা আপনার যবান নষ্ট করে ,আপনার ব্যক্তিত্ব বিলীন করে ,আপনার মন ও চরিত্রকে কলুষিত করে। মন্দ কথা বন্ধুতা নষ্ট করে সখ্যতা ছিন্ন করে মানুষের সাথে সম্পর্কেহানি করে। যে মন্দ কথা বলে , মানুষ তকে ঘৃণা করে তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে ,তার থেকে দূরে অবস্থান করে , এমনকি মানুষ তার শত্রু হয়ে যায়। জানেন মহান আল্লাহ মন্দ কথার উপমা কিভাবে দিয়েছেন ? দেখুন তাঁর বানী :

And the parable of an evil word is that of an evil tree , it torn up by the root from the surface of the earth , it has no stability . ” ( Al Quraan : 14:26)

“ আর একটি মন্দ কথা একটি মন্দ গাছের মতোই, সে গাছের মতো যাকে ভূমি থেকে উপড়ে ফেলা হয় , যার কোন স্থায়িত্ব নেই। ” ( আল কুরআন ১৪ : ২৬)

মন্দ কথা মানুষকে জহান্নামে নিয়ে যায়। প্রিয় রসূল সা .বলেছেন :“ ভাষার ফসলেই মানুষকে জাহান্নামে উপুড় করে নিক্ষেপ করবে।” (তিরমিযি ) তিনি আরো বলেছেন : “ মুসলিম সে , যার ভাষা ও কর্ম থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে ।” (সহীহ বুখারি )

প্রিয় নবী সা. আরো বলেছেন : “ মুসলমানের সুন্দর বৈশিষ্ট্যগুলো মধ্যে রয়েছে অর্থহীন কথা কাজ ত্যাগ করা।” (তিরমিযি )

৫. মন্দ কথা বলতে মানা

মন্দ কথা অনেক অনিষ্টের মূল । মন্দকথা ব্যক্তিকে ছন্নমূল করে , সমাজ থেকে উপড়ে ফেলে। মন্দ কথা সমাজে অস্তিরতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। মন্দ কথা মনোকষ্ট উপড়ে ফেলে। মন্দ কথা সমাজে অস্থিরতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। মন্দ কথা মনোকষ্ট , ঘৃণা , বিদ্বেষ , শত্রুতা ও হানাহানি সৃষ্টি করে। তাই মহান আল্লাহ এবং তাঁর রসূল মানুষকে মন্দ কথা বলতে মানা করেছেন। দেখুন , মহান আল্লাহ আল কুরআনে মন্দ কথার ব্যাপারে কী বলেছেন :

১. তোমরা কেউ কারো গীবত ( নিন্দা ) করোনা। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে ? ( ৪৯:১২)

২. তোমরা পরস্পরের বদনাম করোনা , বিকৃত উপাধিতে ডেকোনা। (৪৯ : ১১ )

৩. হে ঈমানদাররা ! তোমাদের পুরুষদের এবং নারীরা অপর নারীদের উপহাস করোনা , কারণ তারা উত্তম হতে পারে। (৪৯ ,১১ )

৪. যারা নিরপরাধ মুসলিম নারী ও পুরুষের ঘাড়ে মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে তাদের কষ্ট দেয় , তারা আসলে নিজেদের ঘাড়েই চাপিয়ে নেয় বিরাট বুহতান ( Slander ) ও পাপের বোঝা । (৩৩: ৫৮ )

৫. দান করার পর খোঁটা দিয়ে কষ্ট দেয়ার চাইতে কোমল কথা বলে ক্ষমা চেয়ে বিদায় দেয়া উত্তম ( ২:২৬৩ )

৬. মানুষ মন্দ কথা বলে বেড়াক ,তা আল্লাহ পছন্দ করেননা। (৪: ১৪৮ )

৭. তাদেরকে ‘উহ্‌’ পর্যন্ত বলোনা এবং ধমক দিয়ে কথা বলোনা। ( ১৭: ২৩ )

৮. হে ঈমানদারেরা! তোমরা এমন কথা কেন বলো ,যা করোনা। (৬১ :২ )

৯. মিথ্যা কথা বলা থেকে আত্মরক্ষা করো। (২২:৩০)

১০. এমন একটি কথাও নেই , যা ( বিচারার্থে ) সংরক্ষণ করার জন্যে একজন সদ্য প্রস্তুত রক্ষক উপস্থিত থাকেনা। (৫০:১৮ )

১১. হে নবী ! তুমি মিথ্যাবাদীদের কাছে নত হয়োনা। (৬৮ :৮)

১২. হে নবী ! তুমি নত হয়োনা তাদের কাছে ,যারা কথায় কথায় শপথ করে , যারা মর্যাদাহীন , যারা গীবত করে , যারা পরনিন্দা ও চোগলখুরী করে বেড়ায় ,ভালো কাজে বাধা দেয় .... যারা চরম ঝগড়াটে ও হিংস্র।” (৬৮: ১০ - ১৩)

১৩. ধবংস এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে যে, মানুষকে ধিক্কার দেয় এবং মানুষের নিন্দা করে বেড়ায়। ( ১০৪ :১ )

এইতো শুনলেন মহান আল্লাহর সতর্কবানী । এবার আসুন দেখি মহানবী সা. মন্দ কথা সম্পর্কে কী বলেন ? হ্যাঁ, তিনি বলেছেন :

১. মুমিন সে নয় ,যে উপহাস করে অভিশাপ দেয় , অশ্লীল ভাষায় কথা বলে এবং যে বাচাল। (তিরমিযি )

২. কোনো কটুভাষী জান্নাতে প্রবেশ করবেনা। (আবুদ দাউদ )

৩. মুসলমান গালি দেয়া ফাসেকী। (বুখারি ও মুসলিম )

৪. মুসলমান ভাইকে হেয় করাই পাপী হবার জন্যে যথেষ্ট। ( সহীহ মুসলিম )

৫. তোমরা অনুমান করে কথা বলোনা । কারণ অনুমান হচ্ছে জঘন্যতম মিথ্যা কথা। ( বুখারি ও মুসলিম )

৬. মুসলমান মুসলমানের ভাই । সে তার ভাইকে অপমানিত করেনা। (মুসলিম )

৭. তোমার ভাইয়ের বিপদে আনন্দ প্রকাশ করোনা। (তিরমিযি )

৮. মিথ্যা বলা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবীরা গুনাহ্‌ ।( বুখারি ও মুসলিম )

৯. যার মধ্যে চারটি স্বভাব আছে সে মুনাফিক : আমানত রাখলে খিয়ানত করে ,কথা বললে মিথ্যা বলে ,অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে এবং বিবাদ লাগলে গালাগালা করে। ( সহীহ বুখারি )

এছাড়াও আরো অনেক হাদীস আছে । সেগুলোতে বিভিন্ন রকম মন্দ কথায় উল্লেখ করে সেগুলো উচ্চারণ করতে বারণ করা হয়েছে। তাই যারা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান রাখেন ,মন্দ কথা থেকে বিরত থাকা তাদের কর্তব্য , তাদের ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ সুবহানাহু এবং তাঁর রসূল সা. মন্দ কথা বলতে মানা করেছেন।

৬. কুবচনের কদর্যতা।

কবচন বা মন্দ কথার হাত- পা আছে। জীবন আছে। মন্দকথা রোগজীবাণুর মতন। ওরা রোগ ছড়ায়। সমাজকে ধবংস করে । আমাদের সামজে নারী পুরুষ অনেকেই মন্দ কথা বলে। কুবচনের অভ্যাস অনেকেরই আছে। অনেকেই অসুন্দর কথা বলে। কিন্তু মন্দকথা যে কতটা কদর্য , তা কি ভেবে দেখেছেন ? যে সমাজে বিভিন্ন রকম রোগজীবাণু কিলবিল করে , সেখানে যেমন মানুষ শতরকম রোগগ্রস্ত হয় , ঠিক তেমনি যে সমাজের মানুষ মন্দকথা বলে , সেখানেও শত রকম সামাজিক অনাচর সৃষ্টি হয়। মন্দ কথায় ---

১. মানুষ অসন্তুষ্ট হয় , বেজার হয় , মনোকষ্ট পায়।
২. পারস্পরিক ঘৃণা- বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
৩. সম্পর্ক বিনষ্ট হয়।
৪. আত্মীয়তা ছিন্ন হয়।
৫. বন্ধুতা বিনষ্ট হয়।
৬. শত্রুতা সৃষ্টি হয়।
৭. কলহ বিবাদ সৃষ্টি হয়।
৮. রাগারাগি , হানাহানি ও মারামারির সূত্রপাত হয়।
৯. মান ইজ্জত নষ্ট হয়।
১০. অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
দেখলেন তো , মন্দকথা কতো অনিষ্ট ঘটায়। মন্দকথা থেকে সাহবায়ে কিরাম কঠোরভাবে আত্মরক্ষা করতেন। উমর রা. বলেন : “ আমি একবার আবু বকরের রা. বাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি নিজের জিহ্বা ধরে টানাটানি করছেন। আমি বললাম , আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন , আপনার কী হয়েছে ? আবু বকর বললেন : এ জিহ্বা আমাকে ডুবিয়েছে ”। আবু বকর রা. হয়তো কাউকেই কোনো অসুন্দর কথা বলে ফেললেন । আর তারই জন্যে এতোটা কঠোর আত্মসমালোচনা তিনি করলেন । আসুন আমরা ও সবাই কুবচনের কদর্যতা থেকে আত্মরক্ষা করি।

৭. সুন্দর কথা বলার আসমানি তাকিদ

হ্যাঁ , মন্দ কথা ছাড়তে হবে , সুন্দর কথাই বলতে হবে। সুন্দর কথা , ভালো কথা ও সুবচন সকলের প্রিয়। আল কুরআনে বিভিন্নভাবে সুবচনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আসুন এবার দেখা যাক , সুন্দর কথা বলার তাকিদ আল্লাহ সুবহানাহু কিভাবে করেছেন ? দেখুন মহান আল্লাহর বাণী :

১. হে ঈমানদাররা ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। ( ৩৩ : ৭০)

২. মানুষের সাথে ভালো কথা বলো , সুন্দর কথা বলো। ( ২ : ৮৩ )

৩. তাদের সাথে দয়া , সহানুভূতি ও নম্রভাবে কথা বলো । ( ১৭ : ২৮ )

৪. তাদের সংগে সম্মানের সাথে কথা বলো (১৭:২৩ )

৫. স্পষ্ট সোজাসুজি ও সম্মানজনক কথা বলো। ( ৩৩:৩২ )

৬. তাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না। তাদের উপদেশ দাও এবং তাদের সাথে হৃদয়স্পর্শী কথা বলো। (৪:৬৩)

৭. কেউ যখন তোমাকে সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ ( সালাম ) জানাবে , প্রতি উত্তরে তুমি তাকে তার চাইতে উত্তম ধরনের সম্ভাষণ জানাও কিংবা অন্তত ততোটুকুই জানাও। ( ৪:৮৬)

৮. আবু দাউদের রাষ্ট্রক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছিলেন এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা আর স্পষ্ট ও অকাট্য কথা বলার যোগ্যতা। ( ৩৮: ২০)

৯. তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পূত - পরিচ্ছন্ন কথা বলবার । ( ২২ : ২৪ ) ১০. তখন আল্লাহ তাঁর রসূল ও মুমিনদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদের জন্যে ন্যায় ও বিবেকসম্মত কথা বলা কর্তব্য করে দিলেন , আর তারাই এ ধরনের কথা বলার অধিক উপযুক্ত।(৪৮ : ২৬)

১১. তোমরা দু’জন যাও ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। আর তার সাথে কোমলভাবে কথা বলবে , যাতে করে সে উপদেশ গ্রহণ করে , কিংবা ভীত হয়ে যায়। ( ২০: ৪৩-৪৪)

এগুলো তো সরাসরি আল কুরআনের বাণী । মহান আল্লাহর অমৃতবাণী । দেখলেন তো মহান আল্লাহ সুন্দর উত্তম ও পূত - পরিচ্ছন্ন কথা এবং সুবচনের প্রতি কতোটা গুরুত্বারোপ করেছেন। করবেন - ইতো , কারণ তিনি যে সুন্দর। প্রিয় নবী সা. বলেছেন : আল্লাহ সুন্দর , তিনি সৌন্দয্যকে ভালবাসেন -: Allah is beautiful and he loves beauty.

তিনি সুন্দর কথাকেই পছন্দ করেন আর অসুন্দর কথাকে করেন ঘৃণা। আসুন , আমরাও আল্লাহর রঙ ধারন করি ! সুন্দর কথা বলি ! সুভাষী হই।

৮. সুবচন শ্রেষ্ট মানবিক গুণ

মানুষের যতো সেরা গুণ আছে , তন্মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দর করে কথা বলার গুণ। শ্রেষ্ট মনীষীরা সুভাষী। তাঁরা সুন্দর করে কথা বলেন। তাঁরা সুবচনে সুভাষী । তাঁরা যেখানেই কথা বলেন , সেখানেই ফুটে উঠে রাশি রাশি ফুলের হাসি , স্নিগ্ধময় পরিবেশ । আমাদের প্রিয় নবী সা. ছিলেন শ্রেষ্ঠতম সুভাষী। তিনি সুন্দর করে কথা বলতেন। হৃদয়স্পর্শী কথা বলতেন। তাঁর কথা শুনলে শ্রোতার মনের কষ্ট দূর হয়ে যেতো , মুখে হাসি ফুটতো । তিনি কখনো মন্দে জবাবে মন্দ বলেননি। তিনি সব সময় মন্দ কথার জবাবে সুন্দর কথা বলতেন। তিনি ছিলেন সত্যভাষী , পূতভাষী , স্পষ্টভাষী , হিতভাষী , দৃঢ়ভাষী , শুদ্ধভাষী , সুভাষী। তাই তিনি ছিলেন সব মানুষের সেরা মানুষ।

সাহাবয়ে কিরাম সুভাষী ছিলেন। সুন্দর কথা দিয়ে তাঁরা বিশ্বজয় করেছিলেন।

যেসব মনীষী বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন , তাঁরা সবাই সুভাষী ; কিংবা সুলেখক। তাঁরা সুন্দর ভাষায় কথা বলেন কিংবা সুন্দর ভাষার কথা লিখেন।

৯. সুবচনের সুফল

পৃথিবীতে যতো আদর্শই প্রচারিত হয়েছে , তা হয়েছে সুন্দর কথা দিয়ে , সুবচন দিয়ে । অসুন্দর কথা ও কুবচন দিয়ে কখনো কোনো আদর্শ প্রচারিত হযনি , প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বের সব ভালো কাজই মানুষের মনজয় করে করতে হয়। আর সুন্দর কথার চেয়ে মানুষের মনজয় করার মোক্ষম কোনো উপায় নেই। সুন্দর কথার হাত পা আছে । জীবন আছে। সুন্দর কথায় শর্করার শক্তি আছে । ভিটামিনের মৃতসঞ্জীবনী আছে। আমিষের পুষ্টি গুণ আছে। সুন্দর কথায় রোগ জীবাণু ধ্বংসের ঔষধ আছে , এন্টিবায়োটিকের কার্যকরিতা আছে। ‘একটি ভালো কথা একটি ভালো গাছের মতো ’ যে গাছ অফুরন্ত ফল বিলিয়ে যায়। সুন্দর কথায় ----------

১. মানুষের মনোকষ্ট দূর হয়।
২. হতাশা , নিরাশা , দুশ্চিন্তা দূর হয়।
৩. মন খুশি হয় , সন্তুষ্ট হয় , তৃপ্ত হয়।
৪. মন সচেতন হয় , বিবেক জাগ্রত হয়।
৫. আবেগ , উৎসাহ , উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
৬. রাগ নিভে যায় , গোস্বা দমে যায়।
৭. শত্রুতা কেটে যায় , জিঘাংসা দূর হয়।
৮. বন্ধুতা গড়ে উঠে , শত্রু বন্ধু হয়ে যায়।
৯. সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয় , সৌহার্দ্য গড়ে উঠে।
১০. প্রভাব ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।
১১. ভক্তি, শ্রদ্ধা বিনয় ভাব সৃষ্টি হয়।
১২. স্নেহ , ভালবাসার সৃষ্টি হয়।
১৩. ঐক্য ও একতার বন্ধন গড়ে ওঠে।
১৪. রাগারাগি , হানাহানি মিটে যায়।
১৫. ইজ্জত আবরু নিরাপদ হয় , শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

১০.সুভাষী হোন

যারা সুভাষী , তারা সুভাষী হন তাদের ভাষা শৈলীতে , বাকশক্তিতে , বাচনক্ষমতায় , বাকবৈদগ্ধে , বাচনভংগিতে , শব্দ চয়নের দক্ষতায় ,উচ্চারণ ভংগির বিশুদ্ধতায়, কথার সহজতায় , ভাষার সরলতায় , যবানের স্বচ্ছতায় এবং মঞ্জুভাষের মধুরতায়। আপনি কি সুভাষী হতে চান ? হতে চান কি প্রিয়ভাষী ? তবে :

১. সোজা কথা বলুন। বাঁকা কথা বলবেন না। পেঁচালো কথা বলবেন না।
২. সহ্‌জ করে কথা বলুন। ভাষার ও কথার জটিলতা পরিহার করুন।
৩. সুন্দর করে কথা বলুন। সব রকমের অসুন্দর ও মন্দকথা পরিহার করুন।
৪. হাসি মুখে কথা বলুন। প্রিয় নবী বলেছেন : “ তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে কথা বলা একটি দান।”
৫. কোমল ভাষায় কথা বলুন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীকে বলেন : “ এটা আল্লাহরই দয়া যে , তুমি তাদের ( তোমার সাথীদের ) প্রতি কোমল। তা না হয়ে তুমি যদি তাদের প্রতি কঠোর হতে , তাহলে তারা তোমার নিকট থেকে সিটকে পড়তো। ” ( আল কুরআন ৩: ১৫৯)

৬. সুন্দর সুন্দর শব্দ চয়ন করুন। মাতৃভাষাকে ভালোভাবে জানুন। শব্দ ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ হোন। কথার মাঝে সুন্দর সুন্দর শব্দ প্রয়োগ করেন।
৭. হিতকথা বলুন। শ্রোতার কল্যাণের কথা বলুন , তার উপকারের কথা বলুন।
৮. স্পষ্ট ভাবে কথা বলুন। কথার জড়তা পরিহার করুন। মূসা আ. আল্লাহর কাছে দু’আ করেছিলেন : “প্রভু । আমার ভাষার জড়তা দুর করে দাও , যাতে তারা আমার কথা সুন্দরভাবে বুঝতে পারে। ” ( আল কুরআন ২০ : ২৫ - ২৮)

৯. বিশুদ্ধ কথা বলুন। অশুদ্ধ ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ করবেননা। ভাষার আঞ্চলিকতা পরিহার করুন।
১০. প্রশংসা করুন। লোকদের কৃতিত্ব ও অবদানের জন্যে তাদের প্রশংসা করুন। তোয়াজ ও চাটুকারিতা করবেন না।
১১. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। যে আপনার উপকার করেছে , তাকে কৃতজ্ঞতা জানান। প্রিয় নবী সা. বলেছেন : “ হে ব্যক্তি মানুষের কতৃজ্ঞতা প্রকাশ করে না সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞ হয় না।” ( আবু দাউদ )

১২. উপদেশ দিন। পরামর্শ দিন।
১৩. পরামর্শ নিন। আপনার ব্যাপারে শ্রোতার কোনো কথা , কোনো পরামর্শ আছে কিনা তা জানতে চান। পরামর্শ দানের জন্যে কৃতজ্ঞতা জানান।
১৪. শ্রোতার জন্যে দু’আ করুন। আপনার শুভ কামনার কথা তাকে বলুন।
১৫. সদালাপী ও মিষ্টভাষী হোন।
১৬. বিতর্ক পরিহার করুন। যুক্তি সংগত কথা বলূন।
১৭. বলুন কম , শুনুন বেশি।
১৮. অর্থবহ কথা বলুন , অর্থহীন বাজে কথা বলবেন না।
১৯. একজনের কাছে আরেকজনের নিন্দা করবেন না। পেছনে কেবল প্রশংসাই করবেন , নিন্দা নয়।
২০. শ্রোতাকে কখনো বিদ্রূপ , উপহাস , ঠাট্টা ও তিরস্কার করবেন না।
২১. কথার মাঝে কখনো কখনো বৈধ রসিকতা করবেন ।
২২. কখনো কটুকথা বলবেন না।
২৩. বেশী কথা অনর্গল কথা বলা ও কথার খৈ ফুটানো বর্জন করুন।
২৪. গালি দেবেন না , অশ্লীল কথা বলবেন না। ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করুন।
২৫. পজেটিভ কথা বলুন । নেগেটিভ কথা পরিহার করুন।
২৬. রুক্ষ্ম , কর্কশ ও কড়া কথা পরিহার করুন।
২৭. মিথ্যা বলবেন না , অপবাদ দেবেন না , বেশি বেশি শপথ করবেন না।
২৮. ছিদ্রান্বেষণ করবেন না , কারো দোষ খুঁজে বের করবেন না।
২৯. চেঁচামেচি , তর্জন গর্জন ও গলা ফাটানী বর্জন করুন।
৩০. ঘ্যান ঘ্যান , প্যান প্যান পরিত্যাগ করুন।
৩১. আপনি পুরুষ হয়ে থাকলে মেয়েলি ধরনের কথাবার্তা বর্জন করুন । আর মহিলা হয়ে থাকল পুরুষালি কথাবার্তা বলবেন না।

১১.ওরকম নয় , এরকম বলুন

আসুন , আমরা কথার ধরন পাল্টে ফেলি। কথাকে শুদ্ধ , সংস্কৃত ও মানানসই করি। কথাকে সুন্দর চমৎকার ও আকর্ষণীয় করি। ওভাবে নয় , এভাবে বলি :

এভাবে নয়

<>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২. আমি সবার চেয়ে বেশি জানি। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৩. আপনি মিথ্যা বলেছেন । <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৪. আপনি বাজে কথা বলছেন। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৫. আপনি কিছুই করেননি। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৬. এখন কথা বলার সময় নেই। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৭. আমাকে জায়গা দিন। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৮. তার কথা মিথ্যা। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৯. আসুন / আসবেন। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১০. আমি ভুল করিনি। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১১. আমাকে ছাড়া একাজ হতো না। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১২. এই যে কয়টা বাজে ? <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১৩. আমার সাথে দেখা করুন। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১৪. কাজটা খারাপ হয়েছে। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১৫. আমি যা বলছি , সেটাই ঠিক। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১৬. তোমার কাজ ভালো । <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১৭. তোমার কাজটা মন্দ নয়। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১৮. একাজ তুমি পারবেনা। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">১৯. তোমার নাম? <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২০. ভোলো তো ! <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২১. সেলাম ! <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২২. ওয়ালেকুম সালাম । <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২৩. হ্যালো! <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২৪. আমি অন্যদের চেয়ে খারাপ নই। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২৫. কেউই জানেনা। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২৬. আপনার বাড়ি কোথায় ? <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২৭. এ - তো কিছুই হয়নি। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২৮. আমার সাথে এসো। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">২৯. আমি করবো। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৩০. ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৩১. এতে অনেক সমস্যা আছে। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৩২. আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত । <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৩৩. আমার কাজ এরকমই। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৩৪. আমি কোনো সহানুভূতি পাইনি। <>< mce_serialized="14j71v7qg"><>< mce_serialized="1448hc87d">৩৫. এরকম ভুলচুক হয়ই।১. আপনি কিছুই জানেন না।১. আপনি অনেক কিছু জানেন।২. অনেকেই আমার চাইতে বেশী জানেন।৩. আপনার কথা ঠিক নয়।৪. আপনার কথা যুক্তি সংগত নয়।৫. আপনি আরো অনেক কিছু করতে পারতেন।৬. আপনার সাথে পরে কথা বলবো।৭. দয়া করে আমাকে একটু জায়গা দেবেন কি ?৮ তিনি ঠিক বলেননি ।৯. দয়া করে আসবেন কি ?১০. আমার ভুল হতে পারে।১১. একাজে আমরা চেষ্টা করেছি।১২. দয়া করে সময়টা বলবেন কি ?১৩. দয়া করে একটু আসবেন কি ?১৪. কাজটা আরো ভালো করা যেতো ।১৫. আপনার মত / পরামর্শ কি ?১৬. আমরা তোমাকে নিয়ে গর্বীত।১৭.তোমরা কাজটি প্রশংসনীয়।১৮ তোমার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব।১৯. তোমার সুন্দর নামটি কি ?২০ . আপনি ভালো আছেন।২১. আসসালামু আলাইকুম।২২. ওয়ালাইকুম সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।২৩. আসসালামু আলাইকুম।২৪ . আমাকে আরো ভালো হতে হবে।২৫. আসুন আমরা জানার চেষ্টা করি।২৬. আপনার পরিচয়টা জানতে পারি কি?২৭. আরো সুন্দর হতে পারতো ।২৮. আমার সাথে যাবে কি ?২৯.ইনশাল্লাহ আমি করবো।৩০. এটা একটা সুযোগ।৩১. এটা একটা চ্যালেঞ্জ।৩২. আমি এ ব্যাপারে আগ্রহী।৩৩. আমি আরো ভালো করার চেষ্টা করছি।৩৪. আমি আপনার সহানুভুতি কামনা করি।৩৫. এ ভুলের জন্য আমি দুঃখিত।১৩. সম্মান কারো সাথে কথা বলবেন , তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শ করে কথা বলুন। তাঁর গুণাবলী ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিন । আপনার উপকার করার জন্যে , সহযোগিতা করার জন্যে এবং আপনার কথা শুনার জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিন , কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। এভাবে বলুন :

১. আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ : Thank you a lot

২. দয়া করে বলবেন কি ! : Would you please tell me?

৩. আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ! : I am grateful to you.

৪. আমি দুঃখিত! : I am sorry .

৫. আমাকে একটু সাহায্য করবেন কি ? : Would you please help me ?

৬. আমি আপনার কাছে ঋণী । : I am grateful to you .

৭. আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। : I am highly obliged.

৮. আপনার মত কি ? : What is your opinion?

৯. আমি তোমার জন্য গর্বীত ! : I am proud of you .

১০. আমি আপনার প্রচেষ্টার প্রশংসা করি। : I am appeeciate your effort .

১১. আপনার সাহায্যে আমার প্রয়োজন ! : I need your help.

১২. তুমি খুব ভালো ছেলে ! : you are a nice boy.

১৩. তুমি খুব সুন্দর করেছো। : Well done.

১৪. আপনার সাফল্যের জন্য অভিনন্দন ! : Congratulations on your success.

১৫. আপনি চমৎকর রান্না করেছেন ! : you have cooked excellent .

১৬. আপনার পছন্দ খুব সুন্দর ! : your choice is excellent .

১৭. আপনি অনেক অবদান রাখতে পারেন ! : you can contribute a lot.

১৮. আপনি খুবই দয়ালু ! : So kind / nice of you .

১৯. আপনি দীর্ঘজীবি হোন ! : May you live long .

২০. তিনি সত্যি ভালো ! : : Really he is good / nice

২১. আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। : May Allah bless you.

১৩.সুন্দর কথা বলার জন্যে চাই সুন্দর মন

পরিশেষে মন সম্পর্ক ক’টি কথা বলি। ব্যাপারটা হলো , সুন্দর কথা এমনি এমনি বলা যায়না। সুন্দর কথা বলার জন্যে চাই সুন্দর মন। অসুন্দর মন থেকে সুন্দর কথা বেরোয় না। কারণ , কথা তো মনোভাবেরই প্রকাশ।

অনেকে তাদের বহিরাঙ্গকে সাজাতে সচেষ্ট থাকে , কিন্তু অন্তরঙ্গের সৌন্দর্যের কথা ভুলে থাকে। ফলে তাদের বাহ্যিক চাকচিক্যে মানুষ চকিত হয় বটে , কিন্তু তাদের অসুন্দর মন থেকে প্রকাশিত কদর্য কথার ক্রিয়ায় কোকিলও কপাল কুঞ্চিত করতে কুন্ঠিত হয়না।

তাই মনকে সুন্দর করতে হবে আগে । আর মনকে সুন্দর করতে হলে , প্রথমেই তাকে অসুন্দর থেকে মুক্ত করতে হবে। মন থেকে বহিস্কার করতে হবে সমস্ত অসুন্দরের বীজ। গোছা ধরে টেনে উপড়ে ফেলে দিতে হবে অসুন্দরের সমস্ত চারা। অসুন্দরের বীজ আর চারা আপনি চেনেন কি ? এই যে চিনে নিন :

অজ্ঞতা , অন্ধতা , অচৈতন্য , গোঁড়ামি , গোঁয়ার্তুমি , হিংসা , বিদ্বেষ, অহংকার , ঘৃণা , লোভ , লালসা , কৃপণতা , নির্দয়তা , নির্মমতা , নিষ্ঠুরতা , পাষন্ডতা ,কাঠিন্য , হতাশা , কুসংস্কার , কুচিন্তা , স্বার্থপরতা , ক্রোধ , কুরুচি, বক্রতা , নির্লজ্জতা , সংকীর্ণতা , নিবুদ্ধিতা , অসভ্যতা , অশিষ্টতা , , অভদ্রতা , অশ্রদ্ধাবোধ , আত্মকেন্দ্রিকতা , লাগামহীনতা , অসংযম, অসততা , মিথ্যাপ্রিয়তা , কুটিলতা , কুধারণা ইত্যাদি।

এগুলো মনকে কুলুষিত করে রাখে। যার মনের মধ্যে এগুলা দানা বেঁধে থাকে , তার মন হয়ে যায় অসুন্দর। ফলে তার পক্ষে সুন্দর কথা বলা সহজ হয় না। তাই আপনি আপনার মন থেকে এগুলো বের করে দূরে নিক্ষেপ করুন। এগুলো থেকে মনকে ধুয়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে ফেলুন।

এভাবে মনকে সুন্দর করুন। মনের মধ্যে সবরকম সুন্দরের বীজ বপন করুন। সহজেই পাবেন সুন্দরের বীজ , সুন্দর কথার বীজ । এই যে এখানে দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে কিছু সুন্দর কথার বীজ :

জ্ঞান , বুঝ , বুদ্ধি , বিবেক , বিবেচনা , আদব , লেহায , মনন , মনীষা , মাধুর্য , মহত্ত্ব , মনোযোগ , মনোচক্ষু , মহব্বত , মমত্ব , অনুভূতি , ঔদার্য , আশা , অভিলাষ , অভিপ্রায় , অমায়িকতা , অভিরুচি , অন্তরংগতা , প্রসন্নতা , প্রাণাবেগ , প্রাণবন্ততা , সৌজন্য , সুরুচি , সুধারণা , সুবাসনা , শিষ্টতা , শালীনতা , সদিচ্ছা , সংযম , সহানুভূতি , শ্রদ্ধাবোধ ,সহজতা , সজীবতা , সরলতা , সচেতনতা , সমঝোতা , সহমর্মিতা , সত্যপ্রিয়তা , সংবেদনশীলতা , সজীবতা, সহৃদয়তা , স্বত :স্বফুর্ততা , সততা , সভ্যতা , স্বকীয়তা , সক্রীয়তা , শুভেচ্ছা , শ্লীলতাবোধ , দয়া , মায়া , মানবিকতা , বদান্যতা , মহানুভবতা , উদারতা , বন্ধু সুলভতা , হৃদ্যতা , মনোজ্ঞতা , মংগলাকাংখা , তুষ্টি , কৃতজ্ঞতা , সহনশীলতা , স্নেহপরায়ণতা , ভদ্রতা , নম্রতা , কল্যাণকামিতা , হিতাকংখা ইত্যাদি।

এগুলো সুন্দর কথার বীজ । এগুলো যদি আপনার মনের মধ্যে বপন করতে পারেন , আপনার মন হয়ে উঠবে সুন্দর , স্বচ্ছ , তরতাজা , অনাবিল। তখন সহজেই আপনি বলতে পারবেন সুন্দর কথা । শুধু তাই নয় , আপনার মনের মধ্যে এই বীজগুলো শিকড় গেড়ে গজিয়ে উছলে আপনার মুখ দিয়ে আর মন্দ কথা বেরুবেইনা । এগুলো সুন্দর কথার চাবিকাঠি। হয়তো বা জাদুকাঠি।

এ যাবত আমরা সুন্দর কথা সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। অবশ্য সব কথাই হয়নি। তবে , যে কথাগুলো বলা হলো , সেগুলোকে ভিত্তি করে আপনি নিজেই সুন্দর কথার বাগানের আরো অনেক ফুলের চাষ করতে পারেন।

এতোক্ষণ যা কিছু বলা হলো , এগুলোই সুভাষীর জন্যে নির্দেশিকা । এগুলো অনুশীলন করুন , অচিরেই আপনি সুভাষী হয়ে উঠবেন। আপনার শ্রোতাদের কাছে আপনি হয়ে উঠবেন প্রিয়ভাষী । আপনার কথার আকর্ষণ , আপনার আহবানের প্রভাব শ্রোতাদের মনমগজকে সম্মোহিত করে তুলবে। আপনার আদর্শকে প্রচার , প্রসার ও বিজয়ী করার জন্যে আপনাকে অবশ্যি সুভাষী হতে হবে। প্রিয়ভাষী হতে হবে। আসুন আমরার সবাই সুভাষী হই।

সুবক্তা হোন
সত্যের আলো ছড়িয়ে দিন

১. বক্তৃতার ক্রিয়াশক্তি

সব মানুষই বক্তৃতা করেন। তবু বক্তৃতা মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমাজে কিছু লোক বক্তৃতা করেন , বাকীরা বক্তৃতা শুনেন। শ্রোতার তুলনায় বক্তার সংখ্যা অবশ্যি কম। অনেক কম। অনেক বক্তা আছেন , যাদের বক্তৃতায় যাদুশক্তি আছে। তারাঁ বক্তৃতা শুরু করলে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে। বহু দূর দূরান্ত তেকে মানুষ তাদের বক্তৃতা শুনার জন্যে সমবেত হয়। কারো করো বক্তৃতা অগ্নিবর্ষী। তাদের বক্তৃতা শ্রোতারা উন্মক্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠে। কারো কারো বক্তৃতা উদ্দীপনাময় । তাদের বক্তৃতায় শ্রোতারা উচ্ছসিত ও উদ্বেলিত হয়ে উঠে। কারো বক্তৃতা মর্মস্পর্শী , তাদের বক্তৃতার শ্রোতারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে , এমনকি অশ্রুপাত পর্যন্ত করে। কারো বক্তৃতা শানিত যুক্তির ধারালো অস্ত্রের মতো , তাতে শ্রোতাদের বুদ্ধি বিবেক জাগ্রত হয়ে উঠে , চিন্তার রাজ্যে আন্দোলন সৃষ্টি হয়। আবার কিছু বক্তা শিল্প সৌন্দর্যে , কেউবা রস - মাধুর্যে ,কেউবা মনোহরী চাতুর্যে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেন।

এভাবে বক্তারা শ্রোতাদের প্রভাবিত করেন। কোণ ব্যক্তি , দল বা আদর্শের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। কোন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করেন । সম্মোহিত করে স্বমতে আনেন । কিংবা কারো বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন। আবার কারো প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলেন। অথবা উদ্দীপ্ত করেন কোনা ভালো বাগ্মিদের ভক্তের ভীড়ে সভাস্থল ভরে যায়। আপনার অবস্থা ? আপনি কি বক্তা ? নাকি শুধুই শ্রোতা ?

২. আপনিও বক্তৃতা করুন

আপনিও বক্তৃতা করুন। আপনি কেন সবসময় শ্রোতা থাকবেন ? আপনার কি কোন আদর্শ নেই ? আপনার কি কোন মিশন নেই ? আপনি কি চান না মানুষের মধ্যে বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভংগি ও চিন্তা - চেতনা সৃষ্টি হোক ? মানুষ আপনার পছন্দের জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করুক ? মানুষ আপনার দল বা আপনার পছন্দের দলকে সমর্থন করুক , তা কি আপনার কাম্য নয় ? আপনি কি চান না সমাজ থেকে অন্যায় , অনাচার , সন্ত্রাস , দুর্নীতি এবং যাবতীয় অশান্তি ও দুষ্কৃতি দূর হোক ? আপনি কি চান না সমাজে সত্য , ন্যায় , সততা , সুকৃতি , সেবা ও যাবতীয় কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হোক ? আপনি কি চান না মানুষ সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হোক এবং অসত্য ও মন্দের বিরুদ্ধে হোক বিক্ষুব্ধ ? এসব ব্যাপারে আপনি কি আপনার কোনো দায়িত্ব অনুভব করেন না ? যদি এসব ব্যাপারে আপনার জবাব পজেটিভ হয় ,তবে অবশ্যি আপনি বক্তৃতা করুন। কারণ -

১. বক্তৃতাতে আছে যাদুশক্তি ।
২. বক্তৃতা আদর্শ প্রচারের বলিষ্ঠ হাতিয়ার।
৩. বক্তৃতা শ্রোতার বিবেককে নাড়া দেয় ,সচেতন করে তোলে।
৪. বক্তৃতা জ্ঞান দান করে , বুঝ সৃষ্টি করে।
৫. বক্তৃতা শ্রোতার ভুল ধারণা দুর করে ।
৬. বক্তৃতা শ্রোতার মনে ভৃক্তি ও ভালবাসা সৃষ্টি করে।
৭. বক্তৃতা শ্রোতাদের মনে মতামত সৃষ্টি করে , সিদ্ধান্ত শক্তি যোগায়।
৮. বক্তৃতা শ্রোতাদের সমর্থন আদায় করে , জনমত সৃষ্টি করে ।
৯. বক্তৃতা বক্তার জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করে।
১০. বক্তৃতা বক্তার ব্যক্তিত্ব তৈরি করে।
১১. বক্তৃতা শ্রোতাদের আবেগাপ্লুত করে।
১২. বক্তৃতা শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ ও উদ্বেলিত করে ।
১৩. বক্তৃতা উত্তেজিত করে ,ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
১৪. বক্তৃতা শ্রোতাদের স্বমতে আনার সম্মোহনী শক্তি।
১৫. বক্তৃতা ঐক্যমতে আনার এবং ঐক্যবদ্ধ করার মোক্ষম হাতিয়ার।
১৬. বক্তৃতা মানুষের কাজে লাগাবার সুনিপুণ কৌশল।
১৭. বক্তৃতা মানুসের মনের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে , মানষিকতা তৈরি করে।
১৮. বক্তৃতা শ্রেষ্ঠ যোগাযোগ প্রক্রিয়া , বাস্তব গণমাধ্যম।
১৯. বক্তৃতা সমাজ গড়ার এবং সমাজ ভাঙ্গার হাতিয়ার।
২০. বক্তৃতা আছে চুম্বকের শক্তি।
২১. বক্তৃতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার যুদ্ধ জয়ের শানিত অস্ত্র।
তাই আপনিও বক্তৃতা করুণ দেখছেন না , বক্তৃতা কতো কাজ করে দিতে পারে , আপনিও বক্তৃতার সাহায্যে কাজ আদায় করুন , উদ্দেশ্য হাসিল করুন এবং নিজের মিশন সফল করুন।

৩. বক্তৃতা কী ?

হ্যাঁ , বক্তৃতা একটি শক্তিশালী কৌশল। আপনি এ মূল্যবান কৌশল আয়ত্ব করুন। বক্তৃতা মানে বক্তব্য , অর্থাৎ যা বলা বা ব্যক্ত করা হয়। মূলত বক্তৃতা হলো , সমবেত জনমন্ডলীর সম্মুখে বা অডিও কিংবা ভিজুয়াল প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যমের সাহয্যে বিশেষ উদ্দেশ্য , বিশেষ বিষয়ে এবং বিশেষ বা নির্বিশেষ জনমন্ডলীকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিশেষ ভংগিতে উপস্থাপিত সুবিন্যস্ত উক্তি , কথা , বক্তব্য ও আলোচনা।

এটি একটি জটিল ও লম্বা সংজ্ঞা হলেও আমরা যদি এর থেকে বক্তৃতার উপাদানগুলো আলাদাভাবে সাজিয়ে নিই , তবে নিশ্চয়ই বক্তৃতা আমাদের কাঝে সহজ হয়ে ধরা দেবে । জী - হ্যাঁ , এ সংজ্ঞা থেকে আমরা জানতে পেলুম , বক্তৃতার মৌলিক উপাদনগুলো হল :

১. বক্তা ।
২. বক্তৃতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
৩. বক্তৃতার বিষয়।
৪. বক্তৃতা উপস্থাপনার ভংগি।
৫. কথা বা ভাষার বিন্যাস।
৬. উপস্থাপনার সময় - কাল ।
৭. শ্রোতৃমন্ডলী।
৮. বক্তা ও শ্রোতৃমন্ডলীর মধ্যে সংযোগ মাধ্যম।
এগুলো বক্তৃতার মৌলিক উপাদান। এছাড়াও আছে কিছু আনুষঙ্গিক উপাদান।উপাদানগুলোর দক্ষ ও সফল প্রয়োগরে উপরই নির্ভর করে বক্তৃতার সাফল্য। উপাদনগুলো সম্পর্কে আমরা সামনে আলোচনা করবো।

৪. বক্তৃতা কতো রকম ?

বক্তৃতা যে কতো রকম , কতো বিচিত্র তার ধরণ - প্রকৃতি , সে হিসেব কষা বড়ো কঠিন। আমাদের দেশে এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই বক্তৃতার বৈচিত্র্য ব্যাকরণ বিচারে বর্ণনা করা ভারী আয়াসসাধ্য । তবে কতিপয় প্রকার প্রকরণ তো প্রথায় পরিণত হয়েছে। উদ্দেশ্য , আয়োজন ও কাঠামোগত দিক থেকে বক্তৃতার ধরণ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করুন :

১. জনসভা বা সমাবেশে নেতা বা কর্তা ব্যক্তিদের বক্তৃতা।
২. অডিও বা অডিও ভিজুয়াল যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তৃতা।
৩. পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যদের বক্তৃতা ।
৪. দলীর কর্মী সভায় বক্তৃতা।
৫. দলীয় পরামর্শ ও নির্বাহী পরিষদের সভায় বক্তৃতা ।
৬. অধ:স্তন নির্বাহী ও কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা ।
৭. আর্দশ প্রচারের উদ্দেশ্য সুদী সমাবেশে বক্তৃতা ।
৮. সেমিনারে বক্তৃতা ।
৯. সিম্পোজিয়াম বা আলোচনা সভার বক্তৃতা।
১০. বিতর্ক অনুষ্ঠানের বক্তৃতা ।
১১. কনফারেন্স বা সিন্ডিকেট বক্তৃতা ।
১২. ছাত্রদের উদ্দেশ্যে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের বক্তৃতা।
১৩. প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষকের বক্তৃতা।
১৪. ধর্মীয় গ্রন্থের ব্যাখ্যা বিশ্লষণ - উপস্থাপনা করে দেয়া বক্তব্য।
১৫. বিশেষ উদ্দেশ্যে জনতাকে উত্তেজিত করার জন্যে বক্তৃতা।
১৬. উত্তেজিত ও বিশৃংখল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে বক্তৃতা ।
১৭. শান্তি স্থাপন এবংউন্নয়ন ও সেবা কাজে উদ্বুদ্ধ করণমূলক বক্তৃতা।
১৮. পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্যানভাসারের বক্তৃতা।
আমাদের দেশে শ্রেণী , ক্ষেত্র ও পরিবেশ ভেদে উপরোক্ত বিভিন্ন ধরনের বক্তৃতা চালু রয়েছে। নিজ নিজ অবস্থানে প্রত্যেক বক্তৃতারই বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আজকের এ ক্ষুদ পরিসরে প্রত্যেক প্রকার বক্তৃতার বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদা বর্ণনা করার সুযোগ নেই আমরা এখানে সামগ্রিকভাবে কিছু দিক নির্দেশনা গ্রন্থস্থ করবো। তবে এতোটুকু কথা মনে রাখা দরকার , বক্তৃতার যেসব উপাদান রয়েছে , বিভিন্ন প্রকার বক্তৃতায় সেগুলোর বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য সৃষ্টি হয়।

উপরে আমরা বক্তৃতার যেসব প্রকার প্রকরণের কথা বললাম , এর মধ্যে আপনি কোন প্রকারে বক্তা ? এতো প্রকারের মধ্যে আপনি কি শুধু এক প্রকারে বক্তা ? নাকি কয়েক প্রকারের বক্তা ? নাকি আপনি সর্বপ্রকার বক্তা ? তবে আপনার প্রকার যা-ই হোক , আপনি দক্ষ , প্রভাব বিস্তারকারী ও জনপ্রিয় বক্তা হোন । এ জন্যে কৌশল আয়ত্ত করুন।

সময় ও প্রস্তুতির দিক থেকে আপনাকে দুই ধরনের বক্তৃতা করতে হতে পারে :

১. পূর্ব নির্ধারিত বক্তৃতা [set speech]
২. উপস্থাপিত বক্তৃতা । [Extempore Speeech]
নির্ধারিত বক্তৃতার ক্ষেত্রে তো আপনি প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পাবেন। কিন্তু উপস্থিত বক্তৃতার ক্ষেত্রে তো সে সুযোগ পাওয়া যায় না। আপনি হঠাৎ বক্তৃতা দানের জন্যে আদিষ্ট বা অনুরোধপ্রাপ্ত হলেন । তখন আপনাকে উপস্থিত ক্ষেত্রেই বক্তৃতা কতে হবে । তাই বক্তৃতার মৌলিক কৌশলগুলো আপনার আয়ত্তে থাকা বাঞ্ছনীয়।

৫. উপস্থিত বক্তার পূর্ব প্রস্তুতি

ধরে নিন , ঠিক হলো , এখনই আপনাকে বক্তৃতা করতে হবে। তাহরে আপনি এখন কি করবেন ? যদি উপস্থিত ক্ষেত্রে আপনাকে বক্তৃতা করতে বলা হয়। তবু আপনি বক্তৃতা করতে পিছপা হবেন না। আপনি রাজি হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে যদি আপনি একটি সফল বক্তৃতা করতে পারেন , তাহলে আপনার ব্যক্তিত্বের প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা দারুণভাবে বেড়ে যাবে । ভবিষ্যতে মানুষ আপনার বক্তৃতা শুনতে থাকবে। উপস্থিত বক্তার পূর্বে আপনি যতোটুকু সময় পান , মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিন। আপনি এমনটি করুন :

১. নিজের মধ্যে মজবুত আস্থা , সাহস ও আত্মবল সৃষ্টি করুন।
২. বিষয়বস্তু আগাগোড়া একবার চিন্তা করে নিন।
৩. ভেবে নিন , আপনি এ বক্তব্যের মাধ্যমে কি লক্ষ্য অর্জন করতে চান ?
৪. বিষয়ের প্রধান প্রধান পয়েন্টগুলো মনে মনে বিন্যস্ত করুন।
৫. কোন বিশেষ পয়েন্ট , যুক্তি , ভাষা , ভঙ্গি , উপমা ও আবেদন পেশ করে আপনি অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়ে অনন্যতা অর্জন করতে পারেন , সেটা খানিকটা ভেবে নিয়ে বক্তৃতা শুরু করুন।

এভাবে উপস্থিত বক্তৃতা করে আপনি সফল হতে পারেন । আপনি চমকে দিতে পারেন শ্রোতা - দর্শকদের । আপনার মিশন এবং লক্ষ্যকে কার্যকরভাবে ছড়িয়ে দিতে পারেন জনগণের মাঝে। আমার মনে পড়ে , ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্কের প্রতিষ্ঠা শীর্ষ সম্মেলনে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনে (Extempore) বক্তৃতা করে চমকে সৃষ্টি করেছিলেন । অন্য সকলের মধ্যে তাঁর বক্তৃতার কথা এখনো আমার মনে পড়ে।

৬. নির্ধারিত বক্তার পূর্ব প্রস্তুতি

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বক্তৃতা সম্পর্কে বক্তা আগে থেকেই অবহিত থাকেন । বক্তৃতার উদ্দেশ্য , বিষয় এবং সময় পূর্বেই নির্ধারিত হয়। আপনি যখন এ রকম নির্ধারিত বক্তৃতা দেবেন , তার আগে আপনি প্রস্তুতি নেবার সময় পাচ্ছেন। আপনি একটি চমৎকার বক্তৃতা করবার প্রস্তুতি নিয়ে নিন। কিভাবে নেবেন প্রস্তুতি ?

১. সর্বপ্রথম আপনি মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নিন, আপনি একটি অনন্য, সমৃদ্ধ (Resourceful) , আকর্ষণীয় ও চমৎকার বক্তৃতা দেবেন।
২. বক্তৃতার বিষয় , শ্রোতা , পরিবেশ ও প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবে চিন্তা করে নিন।
৩. এই বক্তৃতার মাধ্যমে আপনি শ্রোতাদের কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান এবং কী ধারণা দিতে চান ? তা ভালভাবে উপলব্ধি করুন।
৪. পড়ালেখা করুন , প্রয়োজনীয় তথ্য , রেফারেন্স ও দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করুন।
৫. গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নোট করে নিন। ( লিখিত বক্তৃতা পেশ করতে হলে পাণ্ডুলিপি তৈরি করুন। )
৬. আপনি বক্তা হিসেবে নতুন হয়ে থাকলে অনুশীলন করুন। প্রয়োজনে প্রচুর অনুশীলন করুন। ঘরে বক্তৃতা দিন।
এভাবে মজবুত মানসিক দৃঢ়তা , প্রবল ইচ্ছাশক্তি , পূর্ণাংগ প্রস্তুতি এবং চমৎকার আয়োজন নিয়ে আত্মবিশ্বাসী প্রফুল্ল মনে মঞ্চে গিয়ে উপস্থিত হোন । আপনার মঞ্চে উপস্থিতিকেও অনুপম এবং আকর্ষণীয় করে তুলুন।

৭. আকর্ষণীয় উপস্থিতি

আপনি নিশ্চয়ই মানসিক ও বিষয়গত পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই মঞ্চে উপস্থিত হয়েছে। এখন যে কোন সময় কিংবা নির্ধারিত সময়েরই আপনাকে অনুরোধ করা হবে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। কিন্তু উপস্থাপন সম্পর্কে বলার আগে আপনার উপস্থিতির বিষয়েও দুয়েকটি কথা বলা দরকার । আপনার উপস্থিতির ভংগি কেমন ?

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রোতা দর্শকদের মনোযোগ কিন্তু বক্তা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। তাই বক্তার সুন্দর উপস্থিতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আপনি ----

(ক) ঠিক সময়মতো উপস্থিত হোন।

(খ) সভার শুরুতে উপস্থিত হতে না পারলে ঠিক কখন এবং ক’টায় উপস্থিত হবেন , তা পূবেই সভাকে অবহিত করার ব্যবস্থা করুন। আপনার উপস্থিতির বিষয়ে আয়োজক এবং শ্রোতা - দর্শকদের নিশ্চিত করুন।

(গ) সভাকক্ষে কিংবা মঞ্চে আগমনকালে যদি অপর কেউ বক্তৃতারত না থাকেন , তবে উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের সাথে সালাম বিনিময় করুন। হাসিমুখে প্রবেশ করুন। হাত নেড়ে তাদের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করুন।

(ঘ) পরিবেশ ও অবকাশ থাকলে তাদের বলুন : আপনারা কেমন আছেন ?

(ঙ) সুযোগ থাকেল মঞ্চে উপবিষ্ট অন্যদের সাথে হাত মিলিয়ে নিন এবং হাসিমুখে কুশল বিনিময় করুন।

(চ) এবার আসুন। আপনার জন্যে নির্ধারিত আসনে বসুন। এমন আসনে বসবেন না , যেখান থেকে স্থান বদলের প্রয়োজন পড়তে পারে।

(ছ) বসার পরও কিছুক্ষণ হাসিমুখে বর্জন করুন।

(জ) গুরু গম্ভীর এবং অহংকারী উপস্থিতি বর্জন করুন।

৮. চমৎকার উপস্থাপন করুন

বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে এইমাত্র আপনার প্রতি অনুরোধ জ্ঞাপন করা হলো। আপনি উঠে আসুন বক্তব্য রাখার জন্যে। কিন্তু কিভাবে আসবেন আর কিভাবে রাখবেন বক্তব্য ? হ্যাঁ , এমনটি করুন :

১. হাসিমুখে প্রফুল্ল বদনে এগিয়ে আসুন । দেখবেন , আপনার হাসিমূখ ও প্রফুল্লতা শ্রোতা দর্শকদেরও প্রফুল্ল করে তুলবে। তারা আপনার প্রতি পূর্ণ মনোযোগী এমন কি উদগ্রীব হয়ে উঠবে।

২. দাঁড়িয়েই বক্তব্য শুরু না করে কিছুক্ষন দর্শক - শ্রোতাদের দেখে নিন। হাসিমুখে তাদের প্রতি তাকান। পূর্বে সালাম দেবার সুযোগ পেয়ে না থাকলে এ সুযোগ সালাম দিয়ে নিন।

৩. এভাবে ৫/১০ সেকেন্ডের মধ্যে দর্শক শ্রোতাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে শুরু করুন আপনার বক্তৃতা ।

৪. শুরুতে একটু নাটকীয় ভংগি , একটি আকর্ষণীয় ঘটনার অবতারণা , কিংবা কয়েকটি শিক্ষণীয় সরল কথা আপনার পুরো বক্তৃতাকে গো গ্রাসে গেলার পরিবেশ তৈরি করবে।

৫. শ্রোতা - দর্শকদের যদি আপনার পরিচয় দেয়া না হয়ে থাকে , তবে আপনার পরিচয় দিয়ে বা সঠিক পরিচয় দিয়ে বক্তব্য শুরু করুন। অনেক সময় এমন হয় , ঘোষক- বক্তার পরিচয় দিতে ভুলে গেছেন , কিংবা সঠিক পরিচয় দিতে পারেননি , এমতাবস্থায় আপনি নিজের সঠিক পরিচয় দিন। শুরুতেই বক্তার পরিচয় জানা না থাকলে শ্রোতা - দর্শকরা সাধারণত বক্তার প্রতি মনোযোগী হয় না। তবে পরিচয় দিতে গিয়ে আপনি নিজের সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করবেন না , নিজেকে বড় করে জাহির করতে যাবেন না। এটা শ্রুতিকটু। শুধু বিনয়ের সাথে ছোট করে নিজের মূল পরিচয়টা বলে নিন।

৬. কণ্ঠস্বর : পুরো বক্তব্যের সময়টাতে আপনি আপনার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখুন। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখা মনে পরিবেশ ও প্রয়োজনের চাইতে অধিক উচ্চস্বরে বক্তব্য না রাখা। অযথা চিৎকার করবেন না। মাইক্রোফোনের ভলিউম দেখে নিন। ভদ্র শ্রোতমন্ডলীর উপযোগী আওয়াজে বক্তব্য রাখুন। এতটা নিচু স্বরেও বক্তব্য রাখবেন না যাতে শ্রোতাদের কান বাড়িয়ে আপনার বক্তব্য শুনতে হয়। তবে বক্তব্য বিষয়ের বলিষ্ঠতা ও স্বাভাবিকতার ভিত্তিতে কন্ঠস্বরের কিছুটা উঠানামা হতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখার বিষয় হলো :

ক . কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখুন।
খ. বক্তব্য বিষয়ের ভিত্তিতে কিছুটা উঠানামা করুন।
গ. কর্কশ কণ্ঠস্বর পরিহার করুন।
ঘ. অযথা চিৎকার পরিহার করুন।
ঙ. প্রয়োজনের চেয়ে নিম্নস্বরে বলবেন না।
চ. কণ্ঠস্বরকে শ্রোতাদের উপযোগী করুন।
৭. ভাষা ও উচ্চারণ : শুব্ধ ও চলতি ভাষায় বক্তব্য রাখুন। বক্তব্যে সাধু ও চলতি ভাষা একাকার করবেন না। আঞ্চলিকতা পরিহার করুন। শব্দ উচ্চারণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা ও ধ্বনিতত্ত্বের রীতি অনুযায়ী উচ্চারণ করুন। মোটকথা , আপনার শব্দ চয়ন , বাক্য বিনির্মাণ এবং উচ্চারনের উপরই আকর্ষণীয় উপস্থাপনের অনেক কিছু নির্ভর করে।

৮. স্পষ্ট ও সাবলীল ভাষায় বক্তব্য রাখুন। বক্তব্যের জড়তা পরিহার করুন। নোট ব্যবহার করতে গিয়ে এতোটা থামবেন না , যাতে শ্রোতাদের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক হতে পারে , অথবা তাদের দৃষ্টিকটু হতে পারে। নতুন বক্তা হবার কারণে আপনার বক্তৃতা করার ভীতি থাকলে বাম হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে বক্তৃতা শুরু করুন , সব ভয় দূর হয়ে যাবে।

৯. গুরুত্বপর্ণ পয়েন্টগুলো রিপিট করুন।
১০. মাঝে মধ্যে চুটকি , খন্ড গল্প বা কবিতার পরণ কিংবা কোনো পরিচিত ক্ষুদ্র ঘটনা বলে কিছুটা রস পরিবেশন করুন।

১১. পুরো সময় দর্শক শ্রোতাদের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রাখুন। সবার প্রতি দৃষ্টি বুলান। শ্রোতাদের সচেতন রাখুন।

১২. মাঝে মধ্যে উপমা উদাহরণ দিয়ে কথা খোলাসা করুন।

১৩. এমন ভাব প্রকাশ করুন , যাতে শ্রোতারা বুঝতে পারে , আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন । তবে কোনো কৃত্রিম ভাব - ভংগি প্রকাশ করবেন না।

১৪. আন্তরিকতার সাথে বক্তব্য রাখুন ,যেনো দর্শক শ্রোতাগণ মনে করেন , আপনি সত্যিই তাদের কল্যাণ চান এবং তাদের কল্যাণের কথাই আপনি বলছেন। পুরো সময়টাকে আন্তরিকতা ও খোশমেজাজ দিয়ে উষ্ণ রাখুন। এমনভাবে শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখুন , যোনো আপনার বক্তৃতা শেষ হলেও শ্রোতাদের শুনার আগ্রহ শেষ না হয়। এভাবেই আপনি উপস্থাপন করতে পারেন একটি সুন্দর , চমৎকার , হৃদয়গ্রাহী ও স্মৃতিতে অম্লান থাকা বক্তৃতা ।

৯. সুবিন্যস্ত বক্তব্য রাখুন

এমন কিছু বক্তা আছেন , যাদের বক্তৃতার আগাগোড়া নেই। তাদের বক্তৃতার বিষয়বস্তু কি ? শুরু কোথায় ? শেষ কোথায় ? তা শ্রোতাদের বুঝবার উপায় নেই। তাদের পুরো বক্তৃতাই এলোমেলো । আপনি এমনটি করবেন না। আপনি বক্তৃতাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুবিন্যস্ত করে নিন। এভাবে বিন্যাস করুন :

ক . সম্বোধন , খ. ভূমিকা , গ. মূল বক্তব্য, ঘ. উপসংহার. ঙ. আবেদন ।

সম্বোধন :

বক্তৃতার দাঁড়িয়েই কয়েক সেকেন্ড দর্শক শ্রোতাদের সাথে দৃষ্টি সংযোগ করে নিন। তারপর প্রথমেই সম্বোধন করুন। সাধারণত তিনটি সম্বোধন করতে হয়। এভাবে সম্বোধন করুন :

(ক) শ্রদ্ধেয় সভাপতি !

(খ) শ্রদ্ধেয়/ মাননীয় প্রধান অতিথি !( যদি প্রধান অতিথি থাকেন )

(গ) সম্মানিত / প্রিয় দর্শক শ্রোতা / সুধীমন্ডলী / ভদ্রমহোদয় / ও মহিলাগণ!

বক্তৃতা যদি অডিও ভিডিও রেকর্ড না হয়। তবে ‘দর্শক’ সম্বোধনের প্রয়োজন নেই। প্রতিটি সম্বোধনই বাস্তব প্রেক্ষিতে হওয়া চাই।

ভূমিকা :

সম্বোধনের পর একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা রাখুন। এক্ষেত্রে সম্ভব হলে নাটকীয় সূচনা করুন। কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে আকর্ষণীয় ভংগিতে পেশ করুন। এর ফলে শ্রোতাদের মনোযোগ ও একাগ্রতা আপনার প্রতি নিবদ্ধ হবে । ভূমিকায় শ্রোতাদের বলুন , আপনি তাদের কি বিষয়ে বলতে চান ? আপনার মূল বক্তব্য সম্পর্কে একটি সহজ সংক্ষিপ্ত ধারণা আকর্ষণীয়ভাবে পেশ করে শ্রোতাদের আপনার বক্তৃতার প্রতি কৌতূহলী করে তুলুন।

মূলবক্তব্য :

এবার মূল বক্তব্য রাখুন মূল বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এ পরামর্শগুলো গ্রহণ করলে উপকৃত হবেন। :

১. আপনার বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ্য রাখুন। ঘোষিত বিষয়ের সাথে আপনার বক্তব্য যেনো অবশ্যি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। মূল বিষয়ের মাঝখান দিয়ে চলুন , আশেপাশে ঘুরবেন না। (Go through , do not go around .) । অর্থাৎ আপনি বিষয়বস্তু কেন্দিক কথা বলুন।

২. বক্তব্য বিষয়ে আপনি যেসব পয়েন্ট বলতে চান , সেগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে বলুন। একটির পর একটি বলুন। খাপ খাইয়ে বলুন।

৩. বক্তব্য বিষয়কে বিভিন্ন উপস্তরে সাজিয়ে নিন। সিঁড়ির পর সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠার মতো শ্রোতাদের মনোযোগকে ধারণ করে একটির পর্‌ একটি স্তর পার হয়ে এগিয়ে যান।

৪. যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখুন। কারো মত , বক্তব্য বা যুক্তি খন্ডন করতে হলে যুক্তি দিয়ে তা খন্ডন করুন।

৫. তথ্যবহুল (Informative) বক্তব্য রাখুন। প্রমাণিত তথ্য পেশ করুন। সর্বশেষে তথ্য পেশ করুন।

৬. বিভিন্ন তথ্য ও যুক্তি পেশ করার সময় উপমা উদাহরণ পেশ করুন। শ্রোতাদের জ্ঞাত বিষয়ের উপমা আকর্ষণীয় হবে।

৭. সামজে বিরাজমান বাস্তব সমস্যাবলী তুলে ধরুন এবং সমাধান পেশ করুন ।

৮. অনন্যতা সৃষ্টি করুন। শব্দ চয়ন , উপস্থাপন , রসবত্ত্বা , চমৎকারিত্ব ও কৌশলগত অভিনবত্বের দিক থেকে অনন্যতা সৃষ্টি করুন। অন্যদের চাইতে ভিন্নতর স্বাদের সমাহার রূপ, রস, গন্ধ ইত্যাদি সৃষ্টি করে চমৎকার স্টাইলে বক্তব্য রাখুন।

৯. কখনো কিছুটা আবেগ , কিছুটা উষ্ণতা , হাসি মুখ , ঐকান্তিকতা , বৈচিত্র্য , সাবলীলতা , আকর্ষণীয় , ভাবভংগি ও সহজ স্বাভাবিক মেজাজে বক্তব্য পেশ করুন।

উপসংহার ও আবেদন :

মূল বক্তব্য পেশ করার পর এবার আপনি উপসংহারে আসুন। দীর্ঘ উপসংহার টানবেন না। উপসংহারে আপনার মূল বক্তব্যের সার সংক্ষেপ বা নির্যাসটুকু বলে দিন। অতি সংক্ষেপে মূল বক্তব্যের মূল কথাটা বলে দিন । এমন কয়েকটি পয়েন্ট রিপিট করুন , যেগুলো আপনার বক্তৃতার আসল কথা । অর্থাৎ শ্রোতাদের সামনে গোটা বক্তৃতার একটি সংক্ষিপ্ত যোগসূত্র স্থাপনকারী স্বচ্ছ ছবি তুলে ধরুন।

এরপর এক দু’কথার বক্তবব্যের গুরুত্বের প্রতি শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন এবং বক্তৃতা কেন্দ্রিক একটি আবেগোদ্দীপক আবেদন রাখুন। আপনার বক্তৃতা শুনার জন্যে শ্রোতাদের অবশ্যি ধন্যবাদ জানাবেন।

এবার সমাপ্ত করুন আপনার বক্তৃতা । আপনি সমাপ্ত করতে পারেন উপরোল্লিখিত আবেদনের মাধ্যমেই। অথবা এরপর দু’একটি হাস্য উদ্দীপক বাক্য বা সম্বোধন দিয়ে সমাপ্ত করতে পারেন। অথবা করতে পারেন কোনো আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয় উদ্ধৃতি দিয়ে ।

আকর্ষণীয় সূচনা , প্রভাবশালী মূল বক্তব্য , অবিচ্ছিন্ন ছন্দময় গতিশীল উপস্থাপনা , অনুপম উপসংহার এবং কাম্য সময়সীমার অনুসৃতির মাধ্যমেই আপনি হতে পারেন শ্রেষ্ঠ বক্তা।

জরুরি কথা :

বক্তৃতা বিন্যাসের ক্ষেত্রে কয়েকটি জরুরি কথা মনে রাখুন। কথাগুলো হলো : ১. শ্রোতাদের বলুন , আপনি তাদের কি বলতে চান ?
২. তাদেরকে আপনার বক্তব্য বলুন।
৩. তাদেরকে বলুন , আপনি তাদের কি বলেছেন ?
৪. এবং আপনি তাদের বলুন , আপনি বলা শেষ করেছেন।
একথাগুলো খুবই জরুরি। কারণ , কিছু কিছু বক্তা এমন আছেন , যাদের বক্তৃতার শুরু কোনখান থেকে , শ্রোতারা তা বুঝতে পারেন না। তাঁর কি বিষয়ে বলছেন , তাও শ্রোতারা আঁচ করতে পারেন না। গোটা বক্তব্য তাঁরা শ্রোতাদের কি বলেছেন , শ্রোতারা সেটাও বুঝে উঠতে পারেন না , তারা কি বক্তৃতা শেষ করে বন্ধ করলেন নাকি মাঝখান থেকেই বন্ধ করে দিলেন ।

১০.পোশাক ও অংগভংগি

বক্তৃতার সময় স্থান কাল পাত্র ও সামর্থের ভিত্তিতে পোশাক পরুন। পবিত্র পরিচ্ছন্ন পোশাক পরুন। মানানসই পোশক পরুন। জামার বোতাম লাগিয়ে নিন। কলার ঠিক করে নিন।

বক্তৃতার সময় দৃষ্টিকটু হয় এমনভাবে হাত নাড়াচাড়া করবেন না। হাত ছুঁড়ে মারবেন না। কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার মতো লাফালাফি করবেন না। স্বাভাবিক দাঁড়িয়ে কক্তৃতা করুন। প্রয়োজনে শালীন ও আকর্ষণীয় ভংগিমায় হাত ব্যবহার করুন। জামার হাত গুটাবেন না। মাথা নাচাবেন না। শান্ত ধীর ভংগিতে ভংগিতে বক্তব্য রাখুন । মনে রাখবেন , পোশাক ও অংগভংগি হওয়া চাই মার্জিত ও রুচিসম্মত। সবসময় আত্মসম্মান বোধের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন।

১১. সময় জ্ঞান

বক্তৃতা করতে উঠলে অনেকেই সময় জ্ঞান থাকে না। সভাপতি , পরবর্তী বক্তা , শ্রোতা এবং আয়েজকদের প্রতি তারা কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ করেন না। ঘোষক বক্তার জামা টেনে বসাবার চেষ্টা করেছেন , এমন অবস্থা নিজ চোখে আমরা কয়েকবার দেখেছি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে এক সেমিনারে বক্তৃতা শেষ করার জন্য আমরা সাতবার স্লিপ দিয়েছি। এ ধরনের অনেক বক্তাই সাজিয়ে গুছিয়ে বক্তৃতা করেন না। তাঁরা বক্তৃতা করতে উঠলেই আলোচ্য বিষয়কে উপেক্ষা করে সময়ের তোয়াক্কা না করে বিষয়ের চারপাশে ঘুরতে থাকেন।

আপনি এমনটি করবেন না। আপনি আপনার জন্যে নির্ধারিত সময়ের সাথে মিল করে নিজের বক্তৃতা সাজিয়ে নিন। সময়কে ভাগ করে ফেলুন ভূমিকা , মূল বক্তব্য এবং উপসংহারের মধ্যে । আপনি-

১. বক্তৃতাকে আপনার নিয়ন্ত্রণে রাখুন ।
২. বক্তৃতার প্রতিটি অংশকে তার জন্যে নির্ধারিত সময়টুকুই দিন ।
৩. নির্ধারিত সময়ের বেশি বক্তৃতা করাকে অন্যায় মনে করুন।
৪. নির্ধারিত সময়ের বেশি বক্তৃতা করে আপনি অন্যদের বিরক্তির কারণ হবেন না। শ্রোতাদের শুনার আগ্রহ শেষ করে দেবেন না।
৫. সময়মতো বক্তৃতা করলে শ্রোতারা আবার আপনার বক্তৃতা শুনতে চাইব।

১২. বর্জনীয় কিছু জিনিস

আসুন , এবার এক জায়গায় বলে দিচ্ছি , সুবক্তা হবার জন্যে বক্তৃতার সময় কি কি জিনিস পরিহার করা উচিত ? আপনি নিশ্চয়ই আমাদের সাথে একমত হবেন যে , একজন ভালো বক্তার নিম্নোক্ত জিনিসগুলো পরিহার করা উচিত :

১. ভাবগম্ভীর , ভ্যাবাচেকা , কিংবা এলামেলোভাবে মঞ্চে উপবেশন।
২. দৃষ্টিকটু অংগভংগি।
৩. বক্র হয়ে দাঁড়ানো ।
৪. প্রয়োজনের তুলনায় নিম্ন বা উচ্চকন্ঠে বক্তৃতা করা।
৫. অন্যদের গালাগাল করা , কটাক্ষ করা।
৬. নেগেটিভ বক্তব্য।
৭. আঞ্চলিক ভাষা। অশুদ্ধ ভাষা । শংকর ভাষা।
৮. জড়তা , ভয় , উত্তেজনা , বিষণ্ণতা ।
৯. একই কথা বার বার বলা। যেমন দু’একজন বক্তা এমন আছেন যারা একই বক্তৃতায় কিছুক্ষণ পরপরই বলেন : ‘ সর্বশেষ কথা হলো’ . শেষ কথা হলো ‘ আমি বেশি সময় নেবো না। একই বক্তৃতায় একথাগুলো একাধিকবার বলার ফলে শ্রোতারা তাদের একথাগুলো সঠিক মনে করেন না। এর ফলে শ্রোতাদের কাছে বক্তার গুরুত্ব কমে যায়।

১০. একথা বলা যে , আমি প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাইনে , ‘ আমাকে আগে থেকে বক্তৃতা করার কথা বলা হয়নি’ , ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই’।

১১. নির্ধারিত সময়ের প্রতি লক্ষ্য না রাখা।
১২. অসত্য অংগীকার করা।
১৩. অবাস্তব কথা বলা ।
১৪. অসত্য তথ্য প্রদান করা।
১৫. দুর্বল বাক্য প্রয়োগ করা।

১৩.রসূলুল্লাহ সা. - এর বক্তৃতা কেমন ছিলো ?

মানব জাতির শ্রেষ্ঠ বক্তা ছিলেন নবীগন। মানুষকে সত্যের জ্ঞানদান , সঠিক পথ প্রদর্শন এবং আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে আর্দশ সমাজ গড়ার জন্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন তাঁরা । একাজ তাঁরা করেছিলেন মানুষকে বুঝাবার মাধ্যমে। তাই তাঁদের সবাইকে সারা জীবন বক্তৃতা করতে হয়েছে । তাঁদের বক্তৃতা ছিলো সবচেয়ে সুন্দর , চমৎকার ও আকর্ষণীয় ।

আল- কুরআনে বহু নবীর বক্তৃতা বা বক্তৃতার অংশ উল্লেখ করা হয়েছে । এগুলো এতোই মর্মস্পর্শী ও প্রভবশালী যে , নবী ছাড়া অন্য কারো বক্তৃতা এগুলোর সাথে তুলনা করা সম্ভব নয়। এগুলো সর্বদিক থেকে অতুলনীয় , অনুপম ।

আখেরি রসূল হযরত মুহাম্মদ সা. এর জীবনের সব ঘটনাবলী সুসংরক্ষিত রয়েছে। তাঁর বক্তৃতাসমূহ এবং বক্তৃতার ধরণ পদ্ধতি সবই হাদীস ও সীরাত গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর বক্তব্য ছিলো সকল দিক থেকেই অনন্য। রসূলের অনুসারীদের উচিত জীবনের সকল ক্ষেত্রের ন্যায় বক্তৃতা করার ক্ষেত্রে ও তাঁকে অনুসরণ করা। এখানে রসূলূল্লাহ সা. - এর বক্তৃতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি :

১. মঞ্চ :

রসূল সা. কখনো সহাবাগণের সাথে একই সমতলে বসে বক্তব্য রাখতেন। কখনো তাঁর জন্যে মাটি দিয়ে তৈরি করা মোড়ার মতো একটু উঁচু আসনে বসে বক্তব্য রাখতেন। কখনো সমতলে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা রাখতেন। কখনো মিম্বর থেকে বক্তৃতা করতেন। কখনো বক্তৃতা করেছেন উটের পিঠে থেকে। কখনো করেছেন পাহাড়ের উপর থেকে। এসবই তিনি করেছেন স্থান কালের প্রেক্ষাপটে এবং

জনসমাগমের প্রেক্ষাপটে। লোকেরা যাতে সহজেই তাঁর বক্তব্য শুনতে পায় এবং তাঁকে দেখতে পায় , তিনি সে দিকে লক্ষ্য রাখতেন।

২. সহজ ও সাবলীল ভাষা :

প্রিয় নবী সা. সব সময় সহজ- সাবলীল ভাষায় বক্তব্য রাখতেন , যেনো লোকেরা আনায়াসেই তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারে। তিনি নিজ সাথীদেরকেও বলতেন : ‘মানুষকে শিক্ষা দাও এবং সহজ করো। ’

৩. স্পষ্ট ভাষা :

রসূলুল্লাহ সা. যখনই কোনো বক্তব্য রাখতেন , তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য সুস্পষ্ট হতো। তিনি প্রতিটি শব্দের উচ্চারণগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতেন। একটি শব্দ যথার্থভাবে উচ্চারণ করার পরই আরেকটি শব্দ বলতেন। প্রতিটি শব্দের পৃথক উচ্চারণ তাঁর বক্তব্যকে করতো স্বচ্ছ - পরিচ্ছন্ন । যেনো শীতের ভোরের গাছের পাতা থেকে একটির পর একটি স্বচ্ছ শিশির ফোটা ঝরে পড়ছে। হযরত আয়শা রা. বলেন : রসূলুল্লাহর সা. এর বক্তব্য এতাই স্পষ্ট হতো যে, কেউ ইচ্ছা করলে তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ গুণে রাখতে পারতো।

৪. বিশুদ্ধ উচ্চারণ :

প্রিয় রসুল সা. আরবী ভাষার সবচে’ বিশুদ্ধ পদ্ধতির উচ্চারণ করতেন। তিনি বলেছেন : ‘ আমি সর্বাপেক্ষা শুদ্ধভাষী। আরবী ভাষার সকল মাধুর্যদান করে আমাকে পাঠানো হয়েছে।

৫. ব্যাপক অর্থবহ শব্দ প্রয়োগ :

প্রিয় রসূল সা. এর রীতি ছিলো , তিনি সহজ সরল ভাষায় কথা বলতেন , তবে তাঁর বক্তব্যের শব্দও বাক্যগুলো হতো ব্যাপক অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর বক্তব্য শুনে বুদ্ধি- বিবেকের দুয়ার খুলে যেতো । তিনি বলতেন : ‘ আমাকে ব্যাপক অর্থবহ কথা বলার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে। ’

৬. মর্মস্পর্শী বক্তব্য :

রসূলূল্লাহ সা. এর বক্তব্য ছিলো খুবই আকর্ষণীয় , মর্মস্পশীর্ ও প্রভাব বিস্তারকারী । লোকেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর বক্তব্য শুনতো। তাঁর বক্তব্যের সময় লোকেরা নীরবতা অবলম্বন করতো , মনোযোগী ও একাগ্রচিত্ত হতো। তাঁদের হৃদয়াবেগ সৃষ্টি হতো। হৃদয় প্রকম্পিত হতো। ফলে তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হতো মানসিক বিপ্লব । আর এরি ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে সংগঠিত হয় চরিত্র বিপ্লব সমাজ বিপ্লব।

৭. রিপিটেশন :

রসূলে করীম সা. তাঁর বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো রিপিট করতেন । যে কথাটিই শ্রোতাদের হৃদয়ে বিশেষভাবে গেঁথে দেযার প্রয়োজন মনে করতেন , সেটি কখনো দুইবার , কখনো তিনবার উচ্চারণ করতেন। এতে শ্রোতারা কথাটির প্রতি বিশেষ ভাবে মনোযোগী হতেন এবং গুরুত্ব অনুধাবন করতেন।

৮. প্রশ্ন :

প্রিয়নবী সা . বক্তৃতার মধ্যে প্রায়ই শ্রোতাদের প্রশ্ন করতেন। এতে শ্রোতারা সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠতো । তাঁর প্রশ্নের জবাবে সাহাবাগণ অধিকাংশ সময়ই বলতেন : [ এর জবাব ] ‘ আল্লাহ ও তাঁর রসূলই অধিক জানেন। কখনো কোনো পরিচিত বিষয়ে প্রশ্ন করলে তাঁরা জবাব দিতেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে রসূল সা. জিজ্ঞসা করেন : আমি কি বক্তব্য পৌঁছে দিয়েছি ? আমি কি আমার দায়িত্ব পালন করেছি ? উপস্থিত জনমন্ডলী সমস্বরে জবাব দেন : আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি , আপনি বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন , আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন । ’

৯. শ্রোতাদের প্রশ্নের জবাব দান :

কখনো কখনো এমন হতো যে , রসূল সা. কোনো বিষয়ে বক্তব্য রাখলে , সে বিষয়ে শ্রোতাদের মনে কোনেপা প্রশ্ন সৃষ্টি হতো। তাঁরা বিষয়টি সর্ম্পকে খটকা দূর করার জন্যে কিংবা স্পষ্ট হবার জন্যে রসূলকে প্রশ্ন করতেন। রসূল সা. সহজ সরল জবাব দিয়ে বিষয়টি পরিস্কার করে দিতেন।

১০. কৌতূহল সৃষ্টি :

কখনো কখনো শ্রোতাদের মনে কৌতূহল সৃষ্টির মাধ্যমে , কোনো বিষয়ে জানার জন্যে তাদেরকে উদগ্রীব করে তুললেন। যেমন , একবার তিনি মিম্বরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিনবার বললেন : ঐ ব্যক্তির মুখমন্ডল ধূলোমলিন হোক , ঐ ব্যক্তির মুখে ছাই পড়ুক , ঐ ব্যক্তির মুখ মলিন হোক ! এতে লোকেরা দারুণ কৌতূহল বোধ করলো এবং জিজ্ঞসা করলো : কে সে ব্যক্তি হে আল্লাহর রসূল ? তখন জবাবে তিনি বললেন : যে ব্যক্তি নিজের বাব মা দু’জনকে অথবা তাদের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও জান্নাতে যেতে পারল না।

১১. সতর্ক ভংগি :

অনেক সময় রসূলে করীম সা. এমন সতর্ক ভংগিতে বক্তব্য রাখতেন যেনো শত্রুবাহিনী এগিয়ে আসছে তার তিনি শত্রুবাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্যে নিজ সাথীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন , সতর্ক করছেন , যুদ্ধের কৌশল নির্দেশ করছেন , তাদেরকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে উদ্দীপ্ত করছেন। এভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়গুলো তিনি সহাবায়ে কিরামের সামনে পেশ করতেন।

১২. ঐকান্তিকতা ও কল্যাণ-কামিতা :

প্রিয় নবী সা. যখন বক্তব্য রাখতেন , তখন প্রতিটি শ্রোতাই হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভব করতেন , তিনি তাদের কল্যাণ , সাফল্য এবং মুক্তি ও উন্নতির জন্যে পেরেশান। তিনি নি:স্বার্থভাবে তাদের কল্যাণ চান। তাঁর প্রতিটি কথাই হতো আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। ফলে তাঁর বক্তব্য তাঁদের হৃদয় বিগলতি হয়ে যেতো , নিজেদের জানমাল ও সন্তান - সন্ততি সবকিছুর চেয়ে তারা তাঁর কথাকে বেশি প্রিয় মনে করতো এবং তাঁর নির্দেশে সবকিছু কুরবাণী করতে প্রস্তুত হয়ে যেতো।

১৩. সংক্ষিপ্ত বক্তব্য :

অল্প ক’টি দীর্ঘ বক্তৃতা ছাড়া রসূলে করীম সা . এর গোটা জীবনের সবগুলো বক্তৃতাই ছিলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও স্বল্প সময়ের। বিদায় হজ্জের ভাষণসহ যে ক’টি দীর্ঘ বক্তৃতা তিনি করেছেন , সেগুলোও ততো দীর্ঘ নয়। সব সূত্র থেকে তাঁর বিদায় হজ্জের সময়কার আরাফাতের বক্তৃতাকে একত্র সংকলন করলে দেখা যায় , সে বক্তৃতায় তিনি সম্ভবত ত্রিশ মিনিট সময় ও ব্যয় করেননি। আর সাধারণভাবে তাঁর বক্তৃতাগুলো ৫, ১০, বা ১৫ মিনিট এর বেশি সময় নিয়ে হতো না। প্রিয় রসূল সা. বলেছেন : আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে , আমি যেনো সংক্ষিপ্ত কথা বলি। আর মূলত : সংক্ষেপ কথাই উত্তম। ’ [ আবু দাউদ ]

রসূলুল্লাহ সা. - এর বক্তব্য খুবই সংক্ষিপ্ত হতো আর সে কথাগুলো সাথে সাথেই ক্ষুদিত হয়ে যেতো শ্রোতাদের হৃদয়।

১৪.অংগ-ভংগি

রসূলে করীম সা. মসজিদে ভাষণ দেয়ার সময় তাঁর হাতে একটি ছড়ি থাকতো , তাতে তিনি ভর করতেন। যুদ্ধের ময়দানে ভাষণ দেয়ার সময় ধনুকের উপর ভর দিয়ে দাড়াতেন । কখনো আবেগময় ভাষণ দেয়ার সময় তাঁর দু'চোখ লাল হয়ে উঠতো। কখনো মুখমন্ডলে লালিমা ফুটে উঠতো। কখনো শরীর শিউরে উঠতো । কখনো হাত মুষ্টিবদ্ধ করতেন এবং খুলতেন। কখনো হাতে আংগুল উপরের দিকে উঠাতেন।

১৫.অনন্যতা :

রসূলে করীম সা. এর বক্তৃতা ভাষণ ছিলো সর্বদিক থেকেই অনন্য। তাঁর সমস্ত বক্তৃতাই ছিলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যানুসারী । মানুষের মনোদৈহিক সৌন্দর্য্য সৃষ্টি , উন্নত আচার - আচরনের অধিকারী করা , বিশ্বাস ও দৃষ্টি। ভংগির বিশুদ্ধতা সৃষ্টি , আল্লাহমুখী জীবন যাপন এবং পারলৌকিক সাফল্যের দিকে ধাবিত করাই ছিলো তাঁর সমস্ত ভাষণের মূল লক্ষ্য । এজন্যে তিনি সবসময় সহজ , সরল , সাবলীল , অর্থবহ স্পষ্ট ভাষার বক্তব্য রাখতেন। তাঁর প্রতিটি কথায় থাকতো হৃদয় নিংড়ানো মহববত। তিনি বক্তৃতায় কখনো কউকেও গালি দিতেন না। কাউকে ও উপহাস করতেন না। কারো নিন্দা করতেন না। হৃদয়গ্রাহী শালীন সুভাষণই ছিলো তাঁর বৈশিষ্ট্য। বিশাল সমাবেশ না হলে তিনি প্রত্যেক শ্রোতার প্রতিই লক্ষ্য রাখতেন । একদিন বক্তৃতার সময় তিনি লক্ষ্য করলেন , একজন লোক এসে রোদে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনছে। তিনি তাকে ইশারা করে ছায়ায় আসতে বললেন । তিনি যখন বক্তৃতা করতেন , শ্রোতারা একদৃষ্টিতে তাঁর বক্তৃতা শুনতো । অন্য কোনো দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ হতো না। শ্রোতারা প্রায়ই তাঁর বক্তৃতা শুনে কাঁদতেন। তাঁর বক্তৃতায় প্রায়ই তাদের হৃদয় মন প্রকম্পিত হতো। তিনি বক্তৃতায় প্রধানত উপদেশ দিতেন , সতর্ক করতেন এবং সুসংবাদ দিতেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো , সে সময় বক্তৃতা সাথে সাথে লিখে নেয়া বা রেকর্ড করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না , কিন্তু শ্রোতারা তাঁর প্রতিটি বক্তব্য মনে রেখেছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এমনি অনন্য ছিলো তাঁর ভাষণ। (রসূলুল্লাহ সা. - এ বক্তৃতার বৈশিষ্টগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে সিহাহ সিত্তার হাদীস গ্রন্থবলী , মিশকাত শরীফ এবং বিশেষ করে শামায়েলে তিরমিযি ও শিবলী উ’মানীর সীরাতুন্নবী গ্রন্থ থেকে। )

১৪.আল কুরআনের বক্তৃতা নির্দেশিকা

আল- কুরআনে অনেক সুন্দর সুন্দর বক্তৃতার উদ্ধৃতি রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে উত্তম বক্তৃতার গাইড লাইন। আসুন দেখি , বক্তৃতার ব্যাপারে কি নির্দেশিকা পাওয়া যায় আল কুরআনে ?

১. অসীম দয়াবান আল্লাহ । তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টি করেছেন । তাকে কথা বলতে শিখিয়েছেন। ( আল কুরআন ৫৫ : ১-৪)

২. মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলো । ( আল কুরআন ২: ৮৩)

৩. হে ঈমানদার লোকেরা ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর কথা বলো সরল ও সঠিক। ( আল কুরআন ৩৩: ৭০)

৪. হে নবী ! আমি তোমকে পাঠিয়েছি সাক্ষী , সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে । আর পাঠিয়েছি আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। ( আল কুরআন ৩৩: ৪৫-৪৬)

৫. কার কথা ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে উত্তম যে আল্লাহর দিকে ডাকে , শুদ্ধ সংস্কৃত কাজ করে আর বলে আম অনুগত - মুসলিম। (৪১ : ৩৩ )

৬. বুদ্ধি-প্রজ্ঞা এবং মর্মস্পশী উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে তোমার প্রভুর পথে ডাকা। ( আল কুরআন ১৬ : ১২৫)

৭. আমি দাউদের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে মজবুত করে দিয়েছিলাম আর তাকে দান করেছিলাম প্রজ্ঞা এবং যোগ্যতা দিয়েছিলাম স্পষ্ট ও অকাট্য বক্তব্য রাখার। ( আল কু‌রআন ৩৮ : ২০)

৮. ফেরাউনের কাছে যাও , সে বিদ্রোহী হয়েছে। তার কাছে বক্তব্য রাখবে কোমলভাবে ? এতে করে সে হয়তো উপদেশ গ্রহণ করবে , নয়তো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। ( আল কুরআন ২০ : ৪৩-৪৪)

৯. মূসা বলল : প্রভু! আমার বুক প্রশস্ত করে দাও। আমার কাজ আমার জন্যে সহজ করে দাও । আর আমার যবানের জড়তা দূর করে দাও , যাতে করে লোকেরা সহজেই আমার বক্তব্য বুঝতে পারে। ( ২০ : ২৫-২৮)

১০.উপদেশ গ্রহণ করার জন্যে আমি কুরআনকে সহজ করে পেশ করেছি। ( আল কুরআন ৫৪ : ১৭)

১১.আমি যখনই কোনো রসূল পাঠিয়েছি , সে নিজের জাতীয় ভাষায় জনগণকে আমার আহবান পৌঁছিয়েছে। এ ব্যবস্থা আমি এ জন্যে করেছি , যাতে করে সে খুব সুন্দর করে পরিস্কারভাবে তাদের বুঝতে পারে। ( ১৪ : ৪)

সহজেই বুঝা গেলো , কুরআন সুন্দর বক্তব্য রাখার ব্যাপারে কতোটা গুরুত্বরোপ করেছে ? আসুন , বক্তৃতার ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশিকাগুলো আমরা পয়েন্ট আকারে সাজাই :

১. বক্তব্য হতে হবে সুন্দ , উত্তম ও কল্যাণকর। অসুন্দর কথা কাম্য নয়।
২. সরল বক্তব্য রাখতে হবে এবং সত্য ,সঠিক ও যথার্থ কথা বলতে হবে।
৩. বক্তৃতার মূল লক্ষ্য হবে আল্লাহর দিকে আহ্বান , আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে চেষ্টা করার আহবান । বক্তৃতা হবে আল্লাহমুখী।
৪. সত্যকে গ্রহণ করার শুভ পরিণতির সুসংবাদ দিতে হবে।
৫. মিথ্যা ও ভ্রান্তনীতি গ্রহণ করার অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে।
৬. বক্তার নিজের জীবন হওয়া চাই তার বক্তৃতার বাস্তব রূপ , উজ্জ্বল প্রদীপ।
৭. বক্তা দৃঢ় ও বলিষ্ঠভাবে সত্যের সাক্ষ্য দেবেন।
৮. বক্তা যে আদর্শ প্রচার করবেন , তার নিজেকে সে আদর্শের মডেল এবং অনুগত অনুসারী হতে হবে।
৯. বক্তৃতায় বুদ্ধি , বিবেক , প্রজ্ঞা , কৌশল ও বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটতে হবে।
১০. বক্তৃতা হওয়া চাই মর্মস্পশী , হৃদয়গ্রাহী ও প্রভাব বিস্তারকারী।
১১. বক্তব্য হওয়া চাই স্পষ্ট , অকাট্য ও সিদ্ধান্তকর।
১২. বক্তব্য বলিষ্ঠ হতে হবে , তবে অবশ্যি তা হওয়া চাই কোমল ভাষায়।
১৩. বক্তব্যের ভাষা হওয়া চাই সহজ ও বোধগম্য।
১৪. বক্তাকে অবশ্যি জনগণের মাতৃভাষা তথা জাতীয় ভাষায় বক্তব্য রাখা চাই। এটা আল্লাহ প্রদত্ত সার্বজনীন ও জনপ্রিয় পদ্ধতি।

১৫. সহজ সরল ও জড়তামুক্ত সাবলীল বক্তব্য রাখতে পারার তৌফিক চেয়ে মহান প্রভু আল্লাহর কাছে তৌফিক চাওয়া উচিত।

এ পদ্ধতিতেই নবীগণ বক্তৃতা করেছেণ। মুহাম্মদ সা. এর সমস্ত বক্তৃতাই ছিলো এই কুরআনী নির্দেশিকার বাস্তব রূপ। আবু বকর , উমর , আলী রা. এবং অন্যান্য শ্রেষ্ট সাহাবীগণ নিজেদের বক্তৃতায় এ পদ্ধতিই অনুসরণ করতেন।

উমর ইবনুল আবদুল আযীয , ইমাম ইবনে তাইমিয়া , মুজাদ্দিদে আলফে সানী , সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী , শহীদ হাসানুল বান্না , সাইয়েদ মওদূদী , জামালুদ্দীন নূরসী , ইমাম খোমেনী প্রমুখ মনিষীগণ তাঁদের বক্তৃতায় এ নির্দেশিকাগুলো অনুসরণ করতেন। আসুন , আমরা কুরআনী নির্দেশিকার আলোকে বক্তৃতা করি এবং সত্যের আলো ছড়িয়ে দিই সব মানুষরে কাছে।

লিখুন সুন্দর লিখুন
সুসমাজ গড়ুন

একা তিনি । তাঁর হাতে একটিই ছিলো অস্ত্র। সেটি একটি কলম। ১৯৩২ থেকে ১৯৪১ সাল। এ দশ বছর কলম চালান তিনি একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। এ সময় তাঁর লেখা পড়ে সারা ভারত উপমহাদেশের প্রায় সবগুলো অঞ্চলে বিরাট সংখ্যক লোক মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায় একটি আদর্শিক সমাজ বিপ্লব ঘটাবার জন্যে। তারা গঠন করে একটি দল। গোটা দল সেই এক ব্যক্তির লেখা বই পুস্তক পৌঁছে দেয় মানুষের ঘরে ঘরে। মানুষ সচকিত হয়ে উঠে তাঁর বই পড়তে । শুরু করে আত্মবিশ্লেষণ , হয়ে পড়ে ত্বরিত কর্মা । এখন শুধু ভারত উপমহাদেশে নয় , গোটা বিশ্বের শত ভাষায় মানুষ পড়ছে তাঁর লেখা , তাঁর বই । মানুষ জেগে উঠছে তাঁর আহবানে । দৈহিক মৃত্যু তাঁর হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে তিনি দীপ্ত তাজা প্রাণ। মানুষ বইয়ের পাতায় গোগ্রাসে পড়ছে তাঁর আহ্বান। তিনি আর কেউ নন , তিনি সাইয়েদ মওদূদী রহ. । তাঁর লেখা আদর্শ প্রচারে কার্যকর অস্ত্র। আপনিও লিখুন। আপনার লেখাও হতে পারে আদর্শ প্রচার এবং সুসমাজ গড়ার শানিত অস্ত্র। হতে পারে মানুষকে আপনার স্বমতে আনার সম্মোহনী শক্তি। লিখতে বসুন। লেখাকে অস্ত্র বানান এবং সেই অস্ত্রে ধার দিতে থাকুন আপনার লেখাকে সম্মোহনী শক্তির পরিণত করুন।

১.কেন লিখবেন ?

লেখা অন্যদের কাছে আপনার বার্তা পৌঁছাবার মাধ্যমে । লেখা অন্যদের কাছে আপনার উপদশে , আপনার আহবান , আপনার মনের আকুতি অবিকল পৌঁছে দেয়। আপনার মৌখিক উপদেশ ক’জনে মনে রাখে ? কিছু লোক মনে রাখলেও তাদের ক’জনেই বা তা অন্যদের কাছে পৌঁছায় ? কিন্তু লেখার ব্যাপারটাই ভিন্ন। তা সব সময় অবিকল মওজুদ থাকে। যে কেউ যেকোনো সময় তা পড়ে নিতে পারে। আপনার লেখার কোনো তত্ত্ব , কোনো তথ্য , কোনো সুখপাঠ্য বাক্য যে কেউ যেকোনো সময় দেখে নিতে পারে।

আপনার যদি সমাজ সংস্কার করতে চান , আপনি যদি মানুষকে আপনার আদর্শের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে চান , তবে লিখুন । আপনি যদি মানুষকে আপনার পক্ষে আনতে চান , কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে , তবে লিখুন। আপনার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে লেখা দারুণ কার্যকর শক্তি। সুতরাং আসুন আমরা লেখি । কারণ --

১. লেখা জ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠ জীবিকা।
২. লেখা মনের খোরাক , লেখা মানুষের মনকে সজীব রাখে।
৩. লেখা মানুষের মনকে আনন্দ দেয়।
৪. লেখা নি:সংগীর সাথী।
৫. লেখা মানুষের মন - মানসিকতা ও চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
৬. লেখা উপদেশ প্রধানের উত্তম উপায়।
৭. লেখা দাওয়াত প্রদানের্‌ মোক্ষাম হাতিয়ার ।
৮. লেখা সত্য ও উত্তম আদর্শের প্রতি উদ্বদ্ধ করবার অসীম শক্তিধর উপায়।
৯. লেখা অন্যায় অবিচার , অশ্লীলতা , অনাচার , বেহায়াপনা , নোংরামী , পাপ পংকিলতা , দুষ্কর্ম ও যাবতীয় মন্দ কাজের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ঘৃনা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করার শানিত হাতিয়ার ।
১০. লেখা যুলম , দু:শাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির বলিষ্ঠ উপায়।
১১. লেখা বিশেষ লক্ষ্যে মানুষের ঐক্যবদ্ধ করবার মোক্ষম রশি।
১২. লেখা আপনার আদর্শের পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করবার কার্যকর শক্তি।
১৩. লেখা আদর্শ জীবন গঠন ও সুন্দর সমাজ গড়ার বলিষ্ঠ হাতিয়ার।
১৪. লেখা আপনার যুক্তি বিশ্লেষণের যথার্থ মাধ্যম।
১৫. লেখা আপনার মত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের উত্তম উপায়।
১৬. লেখা শ্রেষ্ঠ যোগাযোগ মাধ্যম। লেখা লেখক ও পাঠকের মনের সংযোগ।
১৭. লেখা , জাতি , সম্প্রদায় , এমনকি বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।
১৮. লেখা প্রতিপক্ষ ও প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিকে কুপোকাত করার কার্যকর শক্তি।
১৯. লেখা স্থায়ী উপদেশনামা।
২০. লেখা মানুষের কাছে আপনার সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিনিধি।
২১. ভালো লেখককে পাঠকরা বন্ধু , প্রিয়জন , শিক্ষক , সজন , পথ প্রদর্শক ও মনের মানুষ মনে করে।
২২. সত্য ও ন্যায়ের জন্যে লেখা একটি ইবাদাত।
২৩. যে লেখা মানুষকে সঠিক পথ দেখায় , সে লেখা দ্বারা লেখক মৃত্যুর পরও সওয়াব , কল্যাণ ও নেকী লাভ করতে থাকবেন।
২৪. তাই লেখা শুধু পাঠকের নয় , লেখকেরও অফুরন্ত পুঁজি।
আপনি কি দেখেননি , ইমাম গাজ্জালি , ইবনে তাইমিয়া , ইবনুল কাইয়্যেম , ইবনে হাযম , শাহ ওলীউল্লাহ , মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব , সাইয়েদ মওদূদী , সাইয়েদ কুতুব , ইসমাঈল আল ফারুকীর লেখা মানুষকে কী চমৎকার পরিবর্তন করে দিয়েছে। এঁরা মরেও জীবন্ত পথ প্রদর্শক । আসুন , আমরা এঁদের পথ ধরি । আমরাও লেখি।

আমরা প্রতিপক্ষরা তো লেখছে ! তারা তো বসে নেই । তারা প্রচার করছে তাদের মতাদর্শ । মানুষকে টানবার চেষ্টা করছে নিজেদের স্বমতে। আপনি কি দেখেননি , কার্লামার্ক্সের ‘দাস কাপিট্যাল ’ কী কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল ? লেনিনের আগুনঝরা রচনাবলি মানুষকে পতঙ্গের মতো কোন গহ্বরে নিক্ষেপ করেছিল ? তাই আসুন , কলম ধরুন। অসত্যের বিরুদ্ধে চালান শানিত অস্ত্র।

২.কী লিখবেন ? কিভাবে শুরু করবেন ?

এমন অনেকে আছেন , যাদের লেখার সখ আছে , কিন্তু কী লিখবেন , তা খুঁজে পান না। অনেক জ্ঞানী লোকও এমন আছেন যারা লিখতে অভ্যস্ত নন। লেখার পরামর্শ্ দিলে তাঁরা কী লিখবেন , কিভাবে লিখবেন কিভাবে শুরু করবেন ? তা খুঁজে পাননা। সাহস করে লিখতে বসুন এবং ধৈর্য ধরে লিখে যান।

লেখার আছে বিচিত্র ধরণ। এ যেনো খাবার টেবিলে সাজানো রকমারি খাবার। কোনটি দিয়ে শুরু করবেন , তা নিজেই ঠিক করুন। তবে প্রতিটি পাত্র থেকেই কিছু কিছু খেয়ে দেখুন। তারপর মন আর রুচি যেটির দিকে ছুটে যায় , সেটিকে নিয়েই জেঁকে বসুন।

পত্রিকায় পত্র লিখুন , সংবাদ তৈরি করে পাঠান , কোনো বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করে লিখে পাঠান। তথ্য সমৃদ্ধ ফিচার লিখুন। প্রবন্ধ লিখুন। কোনো পুস্তকের সমালোচনা লিখুন। অন্য ভাষা থেকে কিছু অনুবাদ করুন। স্মৃতি কথা লিখুন। ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখুন। কবিতা লিখুন। এভাবে হাত পাকা করুন।

তারপর আরো এগিয়ে চলুন । কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে নিবন্ধ রচনা করুন। পুস্তিকা লেখুন। সামাজিক সমস্যার বিবরণ ও তা সমাধানের জন্যে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বই লিখুন। আপনার আদর্শ ও মতবাদকে কেন্দ্র কর লিখুন। অন্যদের মতবাদকে সমালোচনা করে লিখুন। সেরা মানুষদের জীবনী লিখুন। আত্মচিন্তা ও সমাজ ভাবনাকে পুঁজি করে গল্প লিখুন। উপন্যাস লিখুন , নাটক লিখুন।

প্রবন্ধ লিখুন , নিবন্ধ লিখুন এবং বই রচনা করুন- সমাজ , অর্থনীতি , রাজনীতি , ভূগোল , ইতিহাস , বিজ্ঞান ইত্যাদি শত বিষয়ের মধ্যে আপনার যেটা পছন্দ , আপনার জন্যে যেটা সুবিধে , সেটাকে নিয়ে।

এভাবে সব পাত্র থেকেই কিছু কিছু খেয়ে দেখুন , চেঁটে দেখুন। আপনার রুচিই বলে দেবে , কোন খাবারটি আপনার আসল পছন্দের । কোনটি আপনার জন্যে অধিকতর যুৎসই।

হ্যাঁ , লিখতে থাকুন। আস্তে আস্তে লেখা আপনার ভালো লাগবে। তখন আপনার কলমই বলে দেবে , আপনি কী লিখবেন ?

আপনি কী লিখবেন ? এ জন্যে আপনার কলমের পরামর্শই যথেষ্ট। পরামর্শ আদায়ের জন্যে কলমের পিছে লাগুন।

৩.কত যে বাধা !

তবে কলমের পেছনে লাগলেই লেখক হওয়া যায়না। লেখক হবার পথে আছে অনেক বাধা। অনেক সমস্যা । অনেক জটিলতা। আছে অনেক দু:খ , অনেক মুসিবত। এসব কিছু ডিঙ্গিয়েই হতে হয় লেখক। এগুলো ডিঙ্গাবার দু:সাহস কি আপনার আছে ?

লেখক হবার পথে কি কি আছে জানেন ? আছে অন্ধকার পথ , ঢাকনাহীন ম্যানহোল , উদ্যত জগদ্দল। আছে কাঁটাবন , বিষাক্ত ফনিনী। আছে নিবীড় বন , হিংস্র , নেকড়ে। আছে রাহজন। আছে খরা , দারিদ্র , তৃষ্ণা , ক্ষুধা ।

ম্যানহোলে পড়ে যেতে পারেন। জগদ্দলে হোঁচট খেয়ে রক্তাক্ত হতে পারেন। বিদ্ধ হতে পারে কাঁটা , দংশন করতে পারে ফনিনী । নেকড়ে করতে পারে তাড়া , সর্বস্ব লুটে নিতে পারে রাহাজন। তপ্ত হতে পারেন খরায় , নিষ্পিষ্ট হতে পারেন দারিদ্রে। তৃষ্ণায় ফাটতে পারে ছাতি , ক্ষধায় জ্বলতে পারে নাড়ি ? তারপরেও এ পথে জমাতে চান পাড়ি ? তবে নিশ্চয়ই বাহাদুর ব্যক্তি আপনি। আসুন আমরা করি কোলাকুলি। তারপর কথাটা বলি খোলাখুলি।

হয়তো অনেক খাঠখড়ি পুড়িয়ে একটি লেখা তৈরি করেছিন। ছাপানোর জন্যে পত্রিকায় পাঠিয়েছেন । কিন্তু লেখাটি ছাপার জন্যে মনোনীত হয়নি , এমনকি লেখাটি আপনাকে ফেরতও দেয়নি। এরকম অনেকবারই হতে পারে।

অনেক চেষ্টা সাধনা করে হয়তো আপনার দৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা তৈরি করেছেন। কাউকে লেখাটি দেখতে দিয়েছেন। তিনি দেখে বললেন , এটা কোনো লেখাই হয়নি। অথবা বলবেন রেখে যান , আমি দেখাবো। ক’দিন পরে আপনি লেখাটি ফেরত আনতে গেলে হয়তো শুনবেন , তিনি লেখাটি খুঁজে পাচ্ছেন না। লেখাটি হারিয়ে গেছে।

অনেক সাধনা করে আপনি একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করলেন। এটি প্রকাশ করার জন্যে আনার মন আনচান করছে। এটি নিয়ে :

১. আপনি একজন , দুইজন , পাঁচজন , দশজন প্রকাশেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন , কিন্তু কেউই এটি প্রকাশ করার জন্যে পছন্দ করলেন না। অথবা , দুই/ একজন পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করবেন বলে রেখেছিলেন। বছর খানেক পরে খোঁজ নিয়ে দেখলেন, লা-পাত্তা। অথবা এক/ দুই বছর পর প্রকাশক পাণ্ডুলিপিটি আপনাকে ফেরত দিলেন । কিংবা ,

২. প্রকাশক আপনার পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করলো , কিন্তু তাতে আপনার নাম নেই , আছে অন্যকারো নাম। অথবা ,

৩. বইটি প্রকাশ করা হয়েছে , চলছেও হরদম , প্রকাশক লাভবানও হচ্ছেন , কিন্তু আপনি হচ্ছেন বঞ্চিত ।

৪. অথবা কোনো প্রকাশক না পেয়ে আপনি নিজেই বইটি প্রকাশ করলেন। কিন্তু ব্যবসা না জানার কারণে বিক্রি করতে পারলেন না। অথবা বিক্রয়ের জন্যে দোকানে দোকানে দিয়েছেন , কিন্তু টাকা আদায় করা আপনার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

৫. হয়তো আপনার একটা লেখা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে , তা সরকারে বিপক্ষে যাওয়ায় আপনাকে কারাদণ্ড দেয়া হলো ।

এভাবে একজন লেখকের চলার পথে আসতে পারে হাজারো বাধা । এতে কি আপনি দমে যাবেন ? না , কোনো বাহাদুর লেখক কখনো দমতে পারে না , নেতিয়ে পড়তে পারে না , পারেনা পিছপা হতে ।

আপনি কি জানেন না , বহু বড় বড় লেখকের লেখা প্রথম দিকে পত্রিকায় ছাপা হতো না ? রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা সংশোধন করতেন ? ইংরেজদের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক জর্জ বার্নাড শো’র পাণ্ডুলিপি প্রথমদিকে কোনো প্রকাশকই ছাপতে রাজি হয়নি ? আপনি কি জানেন না , বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল ফররুখ আহমদ অনাহারে মৃত্যুবরণ করছেন ? মিশরের জননন্দিত লেখক সাইয়েদ কুতুবকে একটি বই লেখার জন্যে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলানো হয়েছে ? আপনি কি জানেন না , বিশ্বনন্দিত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ মওদূদীকে একটি বই লেখার জন্যে ফাঁসির হুকুম দেয়া হয়েছিল ? কিন্তু বহু আগে মনের যাবার পরেও এঁরা সবাই বেঁচে আছেন লেখার মধ্যে। এরা বিশ্ববাসীর প্রিয় লেখক। বহুকাল তাঁরা বেচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে । মানুষ উদ্বদ্ধ হবে তাদের লেখা পড়ে। বিশ্ববাসী এঁদের ভক্ত অনুরক্ত ।

ভয় পাবেন না , চিন্তিত হবেন না , থেমে যাবেন না , এগিয়ে চলুন। অটল হোন , সহিষ্ণ হোন , নির্ভীক হোন , ইচ্ছা শক্তিতে প্রবল করুন , সব বাধা ডিঙ্গিয়ে চলুন। হয়তো একদিন আপনিও হতে পারেন বার্নাড শো , এলিয়ট, ইয়েটস , ইকবাল , ফররীখ , শাহ ওলীউল্লাহ , সাইয়েদ কুতুব , সাইয়েদ মওদূদী , ইসমাঈল আল ফারুকী , ইউসুফ আল কারদাভী , আবুল হাসান নদভী প্রমূখের মতো লেখক । কে জানে , কী সম্পদ লুকিয়ে আছে আপনার মাঝে ?

৪. কিভাবে হবেন ভালো লেখক ?

এবার আসেন , আলাচনা করে দেখি , কিভাবে আমরা হতে পারি ভালো লেখক। অধিকাংশ বড় লেখকই সহজাত প্রতিভা দ্বারা বড় লেখক হয়েছেন। আর অনেকে হয়েছেন কঠোর সাধনা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে। প্রতিভাকে কাজে লাগাতে হলেও প্রয়োজন সাধনা ও প্রচেষ্টা । কাজী নজরুল ইসলামের প্রচুর প্রতিভা ছিলো। প্রতিভার জোরেই তিনি বড় কবি হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ও ছিলো প্রতিভা , সেই সাথে যুক্ত হয়েছে তার অগাধ সাধনা । এ দু’য়ের সমন্বয়ে লেখাতে চরম উন্নতি করেছেন তিনি। সাইয়েদ মওদূদীকেও আল্লাহ তা’আলা দিয়েছিলেন অন্যান্য প্রতিভা । সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁর পরিকল্পিত বিরল সাধনা। এ দু’য়ের সমন্বয়ে তিনি তিনি প্রতিষ্ঠিত হন কালের সেরা লেখক হিসেবে । পৃথিবীর হাজার হাজার লেখক ভালো লেখক হয়েছেন সাধনা করে। আসুন , আমরাও সাধনা করি। কি নিয়মে করবেন সাধনা ? মহান স্রষ্টা অন্যদের মতো আপনাকেও কিছু না কিছু প্রতিভা দিয়েছেন। সেই সাথে আপনি নিম্নোক্ত চেষ্টা সাধনা এবং কলাকৌশল যুক্ত করুন :

১. লক্ষ্য স্থির করুন :

কোন লক্ষ্যে নিবেদিত হবে আপনার লেখা , তা স্থির করে নিন। কিছু লোক নিজেদের লেখার লক্ষ্যহীন রস ও আনন্দ পরিবেশন করেন পয়সা রোজগার করার জন্যে। কিছু লোক পয়সার জন্যে অনৈতিকতা , অপসংস্কৃতি ও নোংরামিকে লেখার উপজীব্য বানায় । অন্যরা নিজেদের ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রচার প্রতিষ্ঠার জন্যে লেখে। সুকান্ত ভট্টাচার্য সমাজতন্ত্রের জন্যে লিখে লিখে কম বয়সেই মারা গেছেন। সেক্যুরারিজম , নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহীতার জন্যে লিখে চলেছেন অনেকেই মরণ শপথ করে । আর আপনি ?

আপনিও ঠিক করে নিন , কোন লক্ষ্যে আপনি লিখবেন ? ইসলাম যদি আপনার জীবনাদর্শ হয়ে থাকে , তবে এর চাইতে সুন্দর চমৎকার লেখার উপকরণ আর কিছু হতে পারে না। ইসলামের প্রচার এবং ইসলামের দাওয়াত ও আহ্বানকে মানুষের সত্য সুন্দর ও কল্যাণময় জীবন ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করতে , ইসলামকে ইহকাল ও পরকালের মুক্তিদসনদ হিসেবে পেশ করতে এবং শত্রুরা ইসলামের গায়ে যেসব কালিমা লেপন করছে আর আরোপ করছে যেসব ভ্রান্তি , সেগুলো সাফ করতে আপনি কলম ধরুন। সেজন্যেই শানিত করুন আপনার কলমকে। সেজন্যেই নিবেদিত করুন আপনার সমস্ত লেখা। আপনি যা- ই লিখুন , এই মহত লক্ষ্যকে সামনে রেখেই লিখুন। লেখাকে আপনার জীবনের মিশন সফল করার কার্যকর অস্ত্রে পরিণত করুন। ভালো লেখক হবার জন্যে অবশ্যি লক্ষ্য স্থির করে নিন। নিজের সমস্ত প্রতিভা সাধনাকে সে লক্ষ্যে নিবেদিত করুন।

২. বিষয় নির্বাচন করুন :

কি কি বিষয় নিয়ে আপনি লিখতে চান , তা ঠিক করুন। একেকটি বিষয় চিন্তা করুন। যখনই কোনো বিষয়ে লেখা প্রয়োজন বলে অনুভব করবেন , সেটি ডাইরি বা নোট খাতায় নোট করুন। যে বিষয়ে লিখতে বসবেন , তার উপ -শিরোনামগুলো নোট করুন।

তার পক্ষে কি কি যুক্তি আছে নোট করুন। উদাহরণ উপমা চিন্তা করুন। যথাসাধ্য তথ্য সংগ্রহ করুন। তারপর লেখা শুরু করুন।

৩. বক্তব্য সুবিন্যস্ত করুন :

কোথা থেকে শুরু করবেন , কোথায় শেষ করবেন , সেটা আগেই চিন্তা কের নিন। ভূমিকা , মূল বক্তব্য , উপসংহার , আহ্বান , বিন্যাস করুন। কোন বাক্যের পর কোন বাক্য , কোন কথার পর কোন কথা , কোন যুক্তির পর কোন যুক্তি , কোন তথ্যের পর কোন তথ্য এবং কোন জায়গাটায় কোন উদাহরণ যথার্থ হবে তা সঠিকভাবে সাজিয়ে নিন। শিরোনাম উপ-শিরোনাম বিন্যাস করুন। আকর্ষণীয় সূচনা এবং আবেদনশীল সমাপ্তি ঘটান। এভাবে সঠিক বিন্যাসের উপরই নির্ভর করে আপনার লেখার সৌন্দর্য। সুবিন্যাসের অভাবে অনেক বড় পন্ডিতের লেখাও মার খেয়ে যায়।

৪. সাবলীল ভাষায় লিখুন :

আপনি যাই লিখুন , সহজ ভাষায় লিখুন , সাবলীল ভাষায় লিখুন । আপনার বক্তব্য যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন ভাষা অশুদ্ধ হলে তার গুরুত্ব কমে যাবে। উদ্ধৃতি ছাড়া ভাষার আঞ্চলিকতা পরিহার করুন। সহজ , সাবলীল ও ঝরঝরে শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করুন। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘ উপদেশ গ্রহণের জন্যে আমি আল কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি। [ আল কুরআন ৫৪ : ৪০ ] রসূল সা. তো মু’মিনদের নির্দেশই দিয়ে দিয়েছেন ‘ তোমরা মানুষকে সহজ করে শিখাও, কঠিন করোনা। পরিচিত , অর্থবহ ও সহজ শব্দ ব্যবহার করুন। ছোট ছোট চমৎকার বাক্য লিখুন। মনে দাগ কাটার মতো বাক্য ব্যবহার করুন।

৫. তথ্যবহুল লিখুন :

আপনার লেখা যাতো তথ্যবহুল হবে , ততোই তা হবে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য সংগ্রহ করুন। তথ্য যাচাই বাছাই করুন । অনুসন্ধান করুন। সঠিক ও নির্ভুল তথ্য দিয়ে , সরসভাবে সাজিয়ে লিখুন। লেখায় থাকবে যাতে বেশি তথ্য ,লেখা হবে ততো মূল্যবান , ততো দামি। তথ্যবিহীন রসাত্মক লেখা একবার পড়লেই পড়া শেষ হয়ে যায়। আর তথ্যবহুল লেখা মানুষ বারবার পড়ে সযত্নে লালন করে। নোট করে , উদ্ধৃত করে প্রচার করে।

৬. পাঠক উপযোগী লিখুন :

আপনি যখনই কোনো বিষয়ে লিখতে বসবেন , লেখার পরিকল্পনা করবেন , লেখার চিন্তা করবেন , তখন সেই সাথে আপনার চোখের সামনে ভাসতে হবে , আপনার সেই লেখাটি যারা পড়বে , তাদের ছবি। আপনি যা ই লিখুন , অবশ্যি চিন্তা করে নিন , কাদের জন্যে লিখছেন ? করার পড়বে আপনার এই লেখা ? তারা কী কী করে ? তাদের সমস্যা কী ? তাদের যোগ্যতা কী ? তাদের শিক্ষা দীক্ষা কী ? তাদের মানসিকতা ? তারা কি চায় ? কী চায় না ? কেন চায়না ? তাদের জন্যে আপনার পরামর্শ কী ? আপনার উপদেশ কী কিভাবে লিখলে তারা পড়তে আগ্রহী হবে ? লেখায় কি কি উপকরণ ও মালমসলা থাকলে তারা খুশি হবে ? তাদের সমস্যার সমাধান কী ? আপনার পরামর্শ ও উপদেশের কথা কী পন্থায় পেশ করলে সহজেজই তাদের মন গলাতে পাবেন ? কী ধরনের ভাষা তাদের উপযোগী ? কী কথা , কী ভাষা , কি বক্তব্য তাদের উপর প্রভাব ফেলবে ? লেখার সময় একথাগুলো সামনে রেখেই লিখুন। সহজেই আপনি পাঠকদেরর প্রিয় লেখকে পরিণত হবেন। মনে রাখবেন , আপনি নিজের জন্যে নয় , পাঠকদের জন্যে লিখছেন। যাই লিখুন , পাঠকদের উপযোগী করে এবং পাঠকদের কথা মনে রেখে লিখুন।

৭. অনন্যতা অর্জন করুন :

আপনি লিখুন এবং লেখাতে অনন্যতা অর্জন করুন। অনন্যতা হলো, অন্যদের চেয়ে আপনার লেখার স্বাতন্ত্র্য , আপনার লেখাতে আপনার নিজস্বতা , আপনার স্বকীয়তা , নিজস্বতা ,ও স্বাতন্ত্র্যই একজন লেখকের স্টাইল। যতোদিন আপনি নিজস্ব স্টাইল নিয়ে অন্যদের অতিক্রম করতে না পারেন , ততোদিন পাঠকদের সৃষ্টি কেড়ে নিতে কষ্ট হবে আপনার।

আপনি লেখক হিসেবে নিজের ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুটনে , বিষয়বস্তু চয়নে ও বাচনভঙ্গিতে অনন্যতা অর্জন করুন। বিশেষ করে আপনার বাচনভঙ্গিকে নিচের সবগুলো বা অধিকাংশ অথবা অন্তত কিছু সংখ্যক পয়েন্ট স্বকীয়তা প্রদান করুন। সেগুলো হলোঃ প্রাঞ্জলতা ,শুদ্ধতা , আবেগধর্মিতা , যুক্তিসিদ্ধতা , বর্ণনাত্মক , চিত্রাত্মক , বক্তৃতাত্মক , কাব্যদর্শীতা , উপমার অজস্রতা , শব্দলংকার , রসব্যঞ্জনা , জ্ঞানঘন , বিজ্ঞান ধর্মিতা , তথ্য সমৃদ্ধতা , বচনের সাথে বিষয় ও ভাবের সুসংবদ্ধতা , ছন্দাত্মক ও প্রত্যয়দীপ্ততা।

এগুলোর মধ্যে যেগুলোকে সম্ভব ধারণা করুন এবং সেগুলোর মধ্যে নিজের স্টাইল ও অনন্যতার কলা কৌশল দেখান। এতে আপনার পাঠক মহল সৃষ্টি হবে , আপনার লেখা পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করবে , গ্রহণ যোগ্য হবে , প্রভাব সৃষ্টি করবে ।Lucas বলেছেন : ‘Style is means by which a human being gains contact with others. ’

. দেখুন না , সাইয়েদ কুতুব যুক্তিসিদ্ধ আবেগ ধর্মিত , সাইয়েদ মওদূদীর বিজ্ঞনধর্মী যুক্তিবাদিতা , রবীন্দ্রনাথের ভাবব্যঞ্জনা ও প্রাঞ্জলতা , নজরুলের আবেগধর্মীতা , সুকুমার রায়ের রসব্যঞ্জনা , গোলাম মোস্তফার শব্দালংকার এবং জীবনানন্দ দাশের রূপ চিত্রময়তা পাঠকদের কী রকম সম্মোহিত করেছে।

৮. সার্বজনীনতা অর্জন করুন :

আপনি কী আপনার লেখার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিকে চান সত্যাদর্শ ? মানুষকে চিনিয়ে দিতে চান সত্য , সুন্দর কল্যাণের রাজপথ ? জানিয়ে দিতে চান শান্তি মুক্তি ও সাফল্যের ঠিকানা ? তবে আপনার লেখা হতে হবে সার্বজনীন। আপনার একার কথা হওয়া চাই সর্বজনের কথা।

মানব সমাজে বিরাজমান বাস্তবতাকে আপনার চিন্তা ও ভাবের সংমিশ্রণে জীবন্ত করে তুলুন । মানুষের ভালো মন্দের কথা , কল্যাণ অকল্যাণের কথা , সুখ দুঃখের কথা , আশা নিরাশার কথা , চাওয়া পাওয়ার কথা , আনন্দ বেদনার কথা , বিরহ মিলনের কথা , জৈবিক ও আত্মিক চাহিদার কথা , বাসনা ও বঞ্ছনার কথা , সমস্যা ও সমাধানের কথা , বন্ধন ও মুক্তির কথা , রুদ্ধতা ও স্বাধীনতার কথা , অন্যায় ও ন্যায়ের কথা , পরাজয় ও জয়ের কথা , ধন ও দারিদ্রের কথা , পাপ ও পূণ্যের কথা , অশুদ্ধতা ও শুদ্ধতার কথা , সত্য ও মিথ্যার কথা , স্বচ্ছতা ও কপটতার কথা , জ্ঞান ও অজ্ঞানতার কথা , দয়া ও নির্দয়তার কথা , সুবিচার ও অবিচারে কথা , সৃষ্টি ও স্রষ্টার কথা জীবন ও মরণের কথা, ইহকাল ও পরকালের কথা , এবং জীবনের প্রকৃত সাফল্য ও ব্যর্থতার কথাকে হৃদয় উজাড় করে লিখুন আপনার কলমের কলা নৈপুণ্যে।

এভাবে মানুষের হৃদয়ের কথাকে আপনার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করুন , তারপর আপনার হৃদয়ের কথাকে মানুষের হৃদয় স্পর্শী করে মানুষের কাছে সঁপে দিন। মানুষের হৃদয়ের কথাকে যখন লেখক নিজের উপলব্ধি দিয়ে ভাষার শিল্পরস যুক্ত করে পরিবেশন করেন , তখনই তা হয় সার্বজনীন লেখা। সর্বজনের কথা।

আপনার লেখাকে সার্বজনীন করুন। জনপ্রিয় লেখক হোন । আপনাকে এই সার্বজনীনতা অর্জন করতে হবে আপনার নীতি ও আর্দশকে ধারণ করেই আপনার লেখনীর সার্বজনীনতার ভেতরে দিয়েই মানুষের কাছে তুলে ধরা চাই আপনার মত , দৃষ্টিভংগি ও আদর্শকে । তবেই হবেন আপনি সার্থক লেখক।

৯.পড়ুন এবং পড়ুন :

লিখতে হলে পড়তে হয় প্রচুর । সাধারণ পাঠক এবং অধ্যাপকদের চেয়ে এখন লেখককে পড়তে হয় অনেক বেশি। আপনি যদি লিখতে চান তবে অবশ্যি আপনাকে একজন সেরা পাঠক হতে হবে। ভালো খেলোয়াড় হতে চাইলে যেমন অন্য খেলোয়াড়দের খেলার কৌশল মনোযোগ দিয়ে দেখতে হয় , তেমনি ভালো লেখক হতে চাইলে ভালো লেখকদের বই মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়। তাঁদের লেখার কৌশল পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সাইয়েদ মওদূদী , কাজী নজরুল ইসলাম , বুদ্ধদেব বসু , জীবনানন্দ দাশ . আবুল মনসুর আহমদ , সৈয়দ মুজতবা আলী , ইকবাল , মির্জা গালিব , ফররুখ আহমদ , যাযাবর , গোলাম মোস্তফা , সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আলী আহসান , শরৎচন্দ্র সুকুমার রায় . ,মানিক বন্দোপাধ্যায় ,মুহাম্মদ আবদুর রহীম , মুহাম্মদ আবদুল হাই , জসীমুদ্দীন , আল মাহমুদ প্রমুখ শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবি সাহিত্যিকদের লেখা আমাকেও লেখার প্রতি প্রলুব্ধ করে তুলেছিল। তাঁদের ভাষার প্রাঞ্জলতা , বাচনভঙ্গি , ভাবে চমৎকারিত্ব , অলংকার , শিল্পরস , শুদ্ধতা , নিপুণতা , কলাকৌশল এবং মোহনীয়তা আমাকে মোহবিষ্ট করে।

আপনি অন্যদের ভঙ্গি দেখে স্বকীয় : ভঙ্গি সৃষ্টি করুন। নিজস্বতা অর্জন করুন। এজন্যেই আপনাকে বেশি বেশি পড়তে হবে। অন্যদের বুঝতে হবে এবং নিজের জন্যে পথ তৈরি করে নিতে হবে।

১০. উপমা উদাহরণ দিয়ে লিখুন :

আপনার লেখার মধ্যে প্রচুর উদাহরণ , উপমা সন্নিবেশিত করুন। একজন বিখ্যাত কবি বলেছেন , ‘ উপমাই কবিতা ।’ কথাটা সঠিক। তবে কথাটা শুধুমাত্র কবিতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় , বরং লেখার সব সরণিতেই প্রযোজ্য। আপনি যা - ই লিখুন তাতে উপমা উদাহরণ পেশ করনি। উপমা উদাহরণ বক্তব্যকে স্পষ্ট করে , সহজ করে এবং আকর্ষণীয় করে তোলে।

১১. নোট ও খসড়া তৈরি করুন :

আপনি যখন কোনো বিষয়ে লিখতে মনস্থির করবেন , তা আজ লিখুন , কাল লিখুন , কিংবা লিখুন ক’দিন পরে , তবে সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করুন আজই । আপনি যেসব বিষয়ে লিখতে চান , যেসব বিষয়ের তথ্য নোট করার জন্যে খাতা বা ডাইরি ব্যবহার করুন। কল্পিত বা পরিকল্পিত বিষয়ে তথ্য নোট করুন , তথ্য সূত্র নোট করুন। স্থান , কাল , পাত্র ও ঘটনার ইঙ্গিত নোট করুন। নোট কিন্তু লেখা তৈরিতে বন্ধুর মতো সাহায্য করে। যারা নিজেদের লেখাকে উন্নত করতে চান , তাদের উচিত প্রথমে লেখার খসড়া তৈরি করা , লেখাকে বিন্যস্ত করা । ভূমিকা , আখ্যানভাগ বা মূল বক্তব্য , সমস্যা , সমাধান , উপসংহার ইত্যাদি যথাযথভাবে সাজিয়ে নেয়া উচিত। উদাহরণ , উপমা , তথ্য ইত্যাদির সঠিক স্থাপনা ঠিক করে নেয়া উচিত। এবার খসড়ার ভিত্তিতে লেখাকে চূড়ান্ত করুন। লেখা চূড়ান্ত করার সময় খসড়ার সাথে নতুন তথ্য যোগ করতে পারেন । বক্তব্য কমবেশি করতে পারেন। ভাষাকে প্রাঞ্জলতা দান করতে পারেন। সর্বোপরি গোটা লেখায় আপনার শিল্প নৈপূন্য প্রয়োগ করতে পারেন। মনে রাখবেন , নতুন লেখকদের জন্যে খসড়া তৈরির মূল্য অনেক বেশি। প্রবীণ ও পাকা লেখকদের বেলায় খসড়া তৈরির বিষয়টি তাদের নিজস্ব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত।

১২. শুদ্ধ বানান ও শুদ্ধ যতিচিহ্ন ব্যবহার করুন :

আপনি যাই লিখুন , যে শব্দই ব্যবহার করুন , অবশ্যি শুদ্ধ বানানে লিখুন। যথাস্থানে যথাচিহ্ন ব্যবহার করুন। অনেক সময় দেখা যায় , মস্তবড় শিক্ষিত লোকেরাও এ দুটি ক্ষেত্রে ভুল করেন। কিন্তু আপনি ভুল করবেন কেন ? আপনি তো লেখক। এ ময়দানে দক্ষতা প্রদর্শনই আপনার কাজ।

বিশুদ্ধ ও সর্বধুনিক বানান রীতি অনুসরণ করুন। অভিধান কাছে রাখুন। যেখানেই সন্দেহ হবে , সেখানেই অভিধান দেখে নিন। তবে , মনে রাখবেন , আপনি অভিধানের অধীন নন। অভিধান আপনার অধীন। আপনার দক্ষতা এতোটা উন্নত করতে হবে , যেনো আপনার দক্ষতার বিশুদ্ধতা ও নিপুণতা অভিধানে স্থান পায়।

একথাও মনে রাখবেন , আপনি যুগের স্রষ্টা আর অভিধান যুগের ধারক । তাই একদিকে নিজের লেখাকে যুগোপোযুগী করার জন্যে আপনাকে অভিধান অনুসরণ করতে হবে , অন্যদিকে যুগসৃষ্টি করার জন্যে আপনাকে ছাড়িয়ে দিতে হবে অভিধান। এটাই সৃজনশীল লেখকের বৈশিষ্ট্য।

বাংলা একাডেমীর ‘ বাংলা বানান অভিধান ’ এবং সাহিত্য সংসদের ‘ সমার্থ শব্দকোষ’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলো আপনার লেখার টেবিলে থাকা চাই। সেই সাথে শ্রেষ্ঠ লেখকদের বানানরীতিও পর্যবেক্ষণ করুন। নিজেও চিন্তা গবেষণা করুন । বাংলা বানানরীতি এখনো তার গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে। আপনিও এগুন। অশুদ্ধ এবং প্রাচীন বানান রীতি আপনার লেখার মান ক্ষুণ্ণ করবে।

সতর্ক ও সচেতনভাবে যথাস্থানে যথাচিহ্ন ব্যবহার করুন। দাড়ি (।) , কমা (,) কোলন (:) , সেমিকোলন (;) প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?) , সাম্বোধন চিহ্ন (!) ইত্যাদি সঠিক স্থানে ব্যবহার করুন। এতে আপনার বক্তব্যের ভাব পরিস্কার হবে , লেখা প্রাঞ্জল হবে । লেখার শ্রীবৃদ্ধি পাবে । লেখা শুদ্ধ হবে।

১৩. পূন পড়ুন এবং প্রুফ দেখুন :

লেখা শেষ হবার পর পুরা লেখার উপর একবার নজর বলিয়ে নিন। নতুন ও উদীয়মান লেখকদের জন্যে এটা খুবই উপকারী। পাকা লেখকদের জন্যেও কম উপকারী নয়। এর ফলে কোনো কিছু বাদ পড়ে গেলো কিনা তা দেখে নিতে পারেন। কোনো ভুল হয়ে থাকলে শুদ্ধ করে নিতে পারেন। প্রয়োজনে কিছু ঘসামাজা করতে পারে। লেখা নিভুল হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। লেখার সৌন্দর্য ও কিছুটা বৃদ্ধি করতে পারেন। সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো , আপনার লেখার প্রুফ রিডিং এ কাজটা যদি আপনি নিজেই করেন। পাঠকদের সামনে নির্ভুল লেখা পৌঁছাবার এটাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি । প্রুফ রিডিং এর কাজ নিজে করলে ---------

ক. এর ফলে পাণ্ডুলিপি পুনরায় পড়ার কাজ হয়ে যায়।
খ. প্রয়োজনে কোনো শব্দ রদবদল ও ঘসামাজা করা যায়।
গ. প্রয়োজনে নতুন বাক্য গঠন ও বাক্য বিন্যাস করা যায়।
ঘ. প্রয়োজনে লেখার মধ্যে কোনো তথ্য যোগ করা যায়।
ঙ. প্রয়োজনে লেখা থেকে কিছু বাদ দেয়া যায় বা শুদ্ধ করা যায়।
চ. ছাপা নির্ভুল হবার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায়।
তাই সময় বের করে প্রুফ দেখার কাজটি আপনি নিজেই করুন। অন্তত , শেষ প্রুফটি আপনি নিজে দেখুন এবং নিজে প্রিন্ট অর্ডার দিন। মনে রাখবেন , নিজের লেখা নির্ভুল ও হুবুহু পাঠকদের কাছে পৌঁছাবার এটা কার্যকর উপায় । প্রুফ দেখার পর তা ঠিক মতো কারেকশন হলো কিনা , সেদিকেও লক্ষ্য রাখবেন । লেখা প্রকাশকের কাছে হস্তান্তর করলেই লেখকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। লেখককে তার লেখার নির্ভুল ছাপা ও প্রকাশনার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া চাই।

৫ . Writer হোন

ইংরেজীতে আমরা সরলার্থে লেখকে Writer বলতে পারি । এ শব্দটির বর্ণমালা গুলোকে যদি আমরা Vertically সাজাই , তবে তার আলোকে আমরা একজন ভালো লেখকের তার লেখার গুণাবলী সহজেই মনে রাখতে পারি। দেখুন :

W : Wit , Wisdom, Warm , Wonderful , Will , Worthy, Wary.

R : Research, Resourceful , Responsibility, Reform , Rouse.

I : Independence, Influence. Informative , Ideological , Intend .

T: Ractics , Tolerance , Truthfulness , Trustworthy, Topical.

E: Excellence , Exact , Ethical , Efficiency , Effective .

R: Rightful , Relevent , Revision , Revival , Reason , Real.

আপনি যদি ভালো লেখক হতে চান , তবে Writer এর এসব গুণাবলী অর্জন করুন। এ জিনিসগুলো নিজের মধ্যে সৃষ্টি করুন। ব্যক্তি হিসেবে এরকম হোন। এইসব মনোবৃত্তি নিজের মধ্যে সৃষ্টি করুন। নিজের লেখাকে এরকম করুন।

আপনি Writer হিসেবে নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করাবার চেষ্টা করুন। অর্থাৎ নিজর বোধশক্তিতে , বুদ্ধিমত্তায় , রসিকতায় , উষ্ণতায় আন্তরিকতায় , ইচ্ছাশক্তিতে জ্ঞানে , প্রজ্ঞায় , চমৎকারিত্বে ,অনুসন্ধানে গবেষণায় সমৃদ্ধতায় , উদ্ভাবনে , দায়িত্বশীলতায় , সংস্কার সাধনে , স্বাধীনচেতনায় , প্রভাব বিস্তারে , মুগ্ধকরণে তথ্য সমৃদ্ধতায় , আদর্শবাদিতায় , কৌশলে নৈপুন্যে , পারংগমতায় , সহনশীলতায় , সত্যপ্রিয়তায় , বিশ্বস্ততায় , সততায় , প্রাসংগিকতায় , যুক্তিসিদ্ধতায় , জাগরণ সৃষ্টিতে , সংশোধনে ও পূনরুজ্জীবনে আপনি সবাইকে ছাড়িয়ে যান।

আপনার লেখার মধ্যে এই জিনিসগুলো প্রস্ফুটিত হোক ফুলের মতো। এগুলোর সুবাসে সৌরভ ছড়াক আপনার লেখা থেকে। এগুলোর কারণে আপনার লেখা পাঠককে খুশি করবে ফুলের মতো। সুরুভিত করবে পরিবেশকে। বদলে দেবে সামাজের চিন্তাধারাকে । এগুণ বৈশিষ্টগুলোকে আপনি আরো সুন্দর করে সাজান। এগুলো অর্জনের জন্যে সাধনা করুন। এর প্রতিটিকে আলাদা আলাদা ফুলের মর্যাদা দিন। কোনোটি গোলাপ , কোনোটি রজনীগন্ধা , কোনোটি বেল ফুল , কোনোটি হাসনাহেনা , কোনোটি পলাশ , কোনোটি গন্ধরাজ এভাবে প্রতিটি গুণ বৈশিষ্টের পৃথক পৃথক নাম রাখুন আর আপনার নিজেকে বানান মালঞ্চ । আপনার মধ্যে ও গুলোকেই সুসজ্জিত করুন বরুণ মালীর মতো।

৬. কিভাবে লিখবেন ?

আপনি কিভাবে লিখবেন ? আপনার লেখার ধরণ আপনিই ভালো জানেন। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে , কোনো কিছু লিখতে হলে তিন প্রকারে লেখা যায়। যেমন :

১. নিজের হাতে লেখা।
২. ডিকটেট করা বা অন্যকে দিয়ে লেখানো ।
৩. সরাসরি কম্পিউটারে কস্পোজ করা।
নিজের হাতে লেখা সাধারণ রীতি। সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নিজের লেখা নিজেই লিখে আসছে । নিজের লেখা নিজে লেখার মধ্যেই থাকে মনের প্রশান্তি নিজের কথা হুবুহু লিপিবদ্ধ করার জন্যে , নিজের বানানরীতি ও বিশুদ্ধতার বিষয়ে নিশ্চিত থাকার জন্যে এবং নিজের কল্পিত যতিচিহ্ন যথাস্থানে বসানোর জন্যে নিজের হাতে লেখাই উত্তম।

বিভিন্ন কারণে কেউ কেউ অন্যকে দিয়ে লেখান। মহানবী সা. সাক্ষর ছিলেন না , তাই অন্যদের দিয়ে লেখাতেন । মহাকবি মিণ্টন অন্ধ ছিলেন , তাই অন্যকে দিয়ে লেখাতেন। কবি মুধুসুদন দত্ত একই সাথে একাধিক কাব্য গ্রন্থ লেখার জন্যে অন্যদের ডিকটেট করেছেন।

যাকে বা যাদের দিয়ে লেখান , তাদের যোগ্যতা , বিশ্বস্ততা , নির্ভরযোগ্যতা , বিশুদ্ধতা ও রীতি সম্পর্কে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে। লেখা হবার পর পড়িয়ে শুনে নেয়া উচিত । বানান সম্পর্কে ও নিশ্চিত হওয়া উচিত।

সময় পাল্টে যাচ্ছে। লেখকদের হাতে লিখে তারপর কম্পোজ করার দিন ফুরিয়ে আসছে । এসেছে কম্পিউটারের যুগ । ঘরে ঘরে , অফিসে আদালতে এখন কম্পিউটার। কম্পিউটার ছাড়া এখন আর কিছুই চলেনা। পুরানোরা অনেকেই এখন সেকেলে হয়ে গেছেন । নতুনরা কম্পিউটারে পোকা। এখন লেখকরা কাগজে পাণ্ডলিপি তৈরি না করে সরাসরি কম্পিউটারেই লেখেন । আগের তুলনায় এখন কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। আপনিও কম্পিউটার শিখুন। সরাসরি কম্পিউটারে কম্পোজ করুন। লেখার ঝামেলা শেষ । কম্পিউটারের সুবিধা হলো :

১. কাগজে লিখে পাণ্ডুলিপি তৈরিতে যে সময় ব্যয় হয় , এতে তা হয়না।
২. আলাদা প্রুফ দেখে সময় নষ্ট করতে হয়না।
৩. কম্পিউটারেই সংশোধন , সংযোজন , রদবদল করা যায়। বিশুদ্ধ প্রকাশনার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
৪. নিজের ইচ্ছে মতো ইম্পোজ দেয়া যায়।
৫. কম্পোজকৃত লেখা ডিস্কে সংরক্ষণ করা যায় এবং যতোদিন পরে ইচ্ছা সংশোধন ও রদবদল করা যায়।
৬. লেখার কাগজ কলমের পয়সা সেভ করা যায়।
৭. নিজেই কম্পোজ করায় কম্পোজের পয়সা বাঁচানো বা আয় করা যায়।

৭.লেখার টেবিল ও কক্ষ সাজান

আপনি যদি সত্যিই ভালো লেখক হতে চান , তবে আপনার একটি টেবিল এবং একটি কক্ষ থাকা চাই। অবশ্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের সব লেখকের পক্ষে একটি কক্ষ যোগড় করা কঠিন। লেখার জন্যে যদি আপনার আলাদা কক্ষ না থাকে তবে আপনি যেখানেই অবস্থান করেন , যেখানেই বসবাস করেন , সে ঘর বা কক্ষকেই আপনার লেখার কক্ষ বানান।

আপনার কক্ষকে সাজান। লেখার উপাযোগী করে সজ্জিত করুন। আপনার লেখার কক্ষে যথাক্রমে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো থাকা প্রয়োজন :

১. একটি টেবিল
২. একরটি চেয়ার।
৩. এব বা একাধিক বইয়ের আলমিরা / বুকশেলফ।
৪. একটি ক্যালেন্ডার ।
৫. একটি দেয়াল ঘড়ি।
লেখকের সামর্থে কুলালে আরো কতিপয় জিনিস :
৬. কম্পিউটার , প্রিন্টান ও আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র ।
৭. টেলিফোন ।
৮. ওয়েভ সাইট , ইন্টানেট / ফ্যাক্স সংযোগ।
৯. একটি টেলিভিশন। এতে আপনি শিক্ষনীয় প্রোগ্রাম দেখতে পারেন।
১০. অডি-ভিডিও রেকর্ড প্লেয়ার ।
আপনার টেবিলটি সেক্রেটারিয়েল টেবিল হলে ভালো হয়। তাতে যেনো কয়েকটি ড্রয়ার থাকে , অন্তত একটি । আপনার টেবিলের উপরে এবং ড্রয়ারে নিম্নোক্ত জিনিসগুলো রাখুন :

১. লেখার কলম : একাধিক কলম রাখুন। কালো এবং লাল কলম রাখুন । কালো কলম দিয়ে লিখুন। লাল কলম দিয়ে প্রয়োজনীয় চিহ্ন দিন।
২. লেখার কাগজ।
৩. নোট বই / ডায়েরি।
৪. প্রয়োজনীয় অভিধান , শব্দকোষ , পরিভাষা কোষ , বিভিন্ন ধরণের কোষ।
৫. পান্ডুলিপি ফাইল।
৬. স্টাপলার , পাঞ্চ মেশিন , পেন্সিল , ক্লিপ , পিন , কাগজ কাটার ছুরি, মার্কার , স্কেল , কাটার, কাঁচি , গাম , কস্টেপ ইত্যাদি।
৭. টেলিফোন , ফ্যাক্স , ইন্টারনেট ইনডেক্স।
৮. স্কেপ ফাইল।
৯. অন্যান্য
আপনার বইয়ের আলমারীরেক যথাসাধ্য সাজান। সামর্থানুযায়ী রেফারেন্স গ্রন্থাবলী সংগ্রহ করুন। শ্রেষ্ঠ লেখকদের বই দিয়ে আলমারী ও শেলফকে সমৃদ্ধ করুন।

৮. লেখকের সময় স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

একজন লেখককে তার লেখা ও পড়ার জন্যে প্রচুর ব্যয় করতে হয়। সময় ব্যয় করা ছাড়া লেখা সম্ভব নয়। লেখার জন্য পড়া , লেখার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং লেখার কাজে যে সময় দরকার , লেখক যদি সে সময় দিতে না পারেন , তবে তার পক্ষে ভালো লেখক হয়ে উঠা কঠিন। আপনি পরিকল্পিতভাবে সময় বের করুন। সময় আপনাকে দিতে হবে।

একজন লেখককে দীর্ঘ সময় ধরে চেয়ারে বসে পড়তে হয় , লিখতে হয় , চিন্তা ভাবনা করতে হয়। ফলে এই দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকাটা তার স্বাস্যেহয়র জন্যে ক্ষতিকর। এতে শরীর আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। রক্ত চলাচলের গতি শ্লথ হয়ে যায়। তার চোখে , মস্তিষ্কে , হার্টে , রক্তে , গিটায় গিটায় বিভিন্ন রোগ দিখা দিতে পারে। কোষ্ট কাঠিন্য হতে পারে। শুধুমাত্র বসে বসে পড়ালেখা করার কারণে যেনো এসব রোগ না হয় , সে জন্যে একজন লেখককে নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত । সকালে বা সন্ধ্যায় কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করা উচিত। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে আপনি নিজেকে সুস্থ রাখার ব্যবস্থা করুন।

একজন লেখকের লেখার পরিবেশ হওয়া চাই শান্ত , সুন্দর , পরিচ্ছন্ন , সুশৃংখল ও নিরিবিলি। আপনি লেখক হিসেবে :

১. নিজেকে টেনসন মুক্ত রাখুন।
২. পরিবারে শান্তি ও সুখময় পরিবেশ সৃষ্টি করুন।
৩. আত্মীয়-স্বজন , বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্যদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখুন।
৪. আপনার ঘর দোর ও কক্ষ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
৫. আপনার টেবিল ও কক্ষ সাজিয়ে রাখুন , সুশৃংখল রাখুন , সুবিন্যাস্ত রাখুন।
৬. লেখার সময়টা নিরিবিলি থাকার চেষ্টা করুন।
৭. অন্যদের জন্যেও কিছু সময় রাখুন , মিশুন , হাসি খুশি থাকুন।

৯. শেষের ক’লাইন

কথা আর বেশি বাড়িয়ে লাভ কি ? তবে শেষের ক’ লাইন না লিখলেই নয় । সে ক’লাইন হলো :

১. লক্ষে পৌঁছার জন্যে লিখুন। লেখাকে সুনিশ্চিত লক্ষ্যগামী করুন। লক্ষ্যহীন হবার কারণে আপনার কোনো লেখাই যেনো ব্যর্থ হয়ে না যায়। লেখার ফল নির্ভর করে লক্ষ্যের উপর।

২. আল্লাহর খলিফা হিসেবে লিখুন। পৃথিবীতে আল্লাহ আপনাকে তাঁর প্রতিনিধি বানিয়েছেন। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আপনার দায়িত্ব হলো , মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা এবং আল্লাহর বিধান ও তাঁর পছন্দ মাফিক সুসমাজ গড়ার চেষ্টা করা। আপনার কলমকে একাজে নিয়োজত করুন।

৩. আপনি কলম দিয়ে মানুষকে শুদ্ধ ও সংশোধন করার কাজ করুন। মানুষের ভালো প্রবণতাগুলোকে জাগ্রত করুন। কল্যাণের প্রতি উদ্ধুদ্ধ করুন। মন্দ ও অন্যায়ের ব্যাপারে মানুষকে নিস্পৃহ করে তুলুন।

৪. কলমের সাহায্যে মানুষের মনে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা জাগিয়ে তুলুন।

৫. লেখার সাহায্যে মানুষের মাঝে মানবতাবোধ ও ভ্রাতৃবোধ জাগিয়ে তুলুন। মনুষত্বকে চাঙ্গা করে তুলুন। পশুত্বকে ম্রীয়মান করে দিন।

৬. মানুষের অন্তরে একটি ভালো কথার আবেদন সৃষ্টি করা একটি বিরাট দান। এ জন্য আপনি পাবেন অফুরন্ত প্রতিদান।

৭. কলমকে শানিত করুন। ধারালো অস্ত্র বানান একে। ক্ষুরধার করুন। এর দ্বারা মন্দের বিনাশ আর কল্যাণের নির্মাণ কাজ করুন।

৮. প্রিয় নবী সা. বিশুদ্ধ ও ব্যাপক অর্থবহ কথা বলার প্রতি তাকিদ করেছেন। আপনার লেখাকে বিশুদ্ধ করুন , ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করুন।

৯. মহান আল্লাহ বলেছেন , তিনি মানুষকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। আপনিও আপনার কলমের সাহায্যে শিক্ষা বিস্তারের অঙ্গিকার করুন।

১০. মনে রাখবেন আপনি মরে যাবেন , কিন্তু আপনার লেখা বেঁচে থাকবে । লেখা মৃত্যুর পরও আপনাকে যাতনার কারণ হতে পারে , কিংবা হতে পারে আপনার অনন্ত কল্যাণের কারণ। তাই ভেবে চিন্তে লিখুন । সিদ্ধান্ত নিন , আপনার লেখাকে আপনি নিজের জন্যে কিসের কারণ বানাতে চান ?

১১. আমি , আপনি , আমরা সবাই আল্লাহর দয়া ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী । আমরা যা লিখতে চাই তো যেনো লিখতে পারি , আমরা লেখা দিয়ে যা করতে চাই তা যেনো করতে পারে , এবং আমরা লেখার মাধ্যম যে প্রতিফল পেতে চাই , তা যেনো পেয়ে যাই , সেজন্যে আসুন আমরা ধরণা দিই দয়াময়ের দরবারে।

*********সমাপ্ত ************