Wednesday 23 December 2015

বাজিরাও-মস্তানি মুভি রিভিউ



বাজিরাও-মস্তানি মুভি রিভিউ

সূফি বরষণ
সঞ্জয় লীলা বনশালীকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাজিরাও-মস্তানি মুভির জন্য সত্য সুন্দর প্রেমের ইতিহাস এই মুভি এই মুভিতে উঠে এসেছে ১৮ শতকে একজন হিন্দু প্রধান সেনাপতির মুসলিম স্ত্রী হিন্দুদের জাত প্রথার ব্রাহ্মণ পরোহিতদের গোড়ামির জন্য কিভাবে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয় আর সেনাপতির স্ত্রী কোনো সাধারণ নারী ছিলেন না ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা এবং রাজকুমারী এতে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে তখন ভারতে মুসলমানরা কি পরিমাণ বর্ণ প্রথা নির্যাতনের শিকার হয়েছে ??!!

তিনশো বছর আগে দিল্লি দখলের ইচ্ছে অধরাই থেকে যায় মারাঠা সেনাপতি বাজিরাওয়ের কিন্তু সেনাপতি হিসেবে অপরাজেয় ছিলেন তিনি তিনশো বছর পর বলিউড বক্স অফিসে দখলের লড়াইয়েও বোধহয় বলিউড বাদশার দিলওয়ালেকে কড়া টক্কর দিতে চলেছে বনশালির বাজিরাও কিন্তু চিত্রনাট্য, অভিনয়, সঙ্গীত ইত্যাদি সব মিলিয়ে দেখতে গেলে ছবির মান বেশ উত্কৃষ্ট সঞ্জয় লীলা বনশালীর এই ছবিতে উঠে এসেছে প্রায় তিনশো বছর আগে, ১৭২০ থেকে ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত (আমৃত্যু), মারাঠার চতুর্থ ছত্রপতি শাহুজি রাজে ভোঁসলের সেনাপতি ছিলেন বাজিরাও তাঁর জীবনের ৪১টি যুদ্ধে কখনও তাঁকে পরাজিত করা যায়নিইতিহাস - প্রথমেই বলে নিই মুভির সাথে একে মিলাবেন না মুভিতে মাত্রই ইতিহাস কিছুটা হলেও বদলে যায়
"বাজিরাও মাস্তানী" কোন একজনের নাম নয় দুজনের নাম সে প্রসঙ্গে পড়ে আসছি ইতিহাস অনুসারে, বাজিরাও বল্লাল ভাট ছিলেন একজন মারাঠা যোদ্ধা মারাঠা সাম্রাজ্যকে পুরো দক্ষিন ভারত থেকে ভারর্তবর্ষের উত্তর পূর্ব থেকে ছড়িয়ে দিতে উনার অন্যতম ভূমিকা আছে বাজিরাও বল্লাল ভাটকে পেশোয়া প্রথম বাজিরাও বলেও ডাকা হয় আর তিনি এই নামেই
 প্রসিদ্ধ মারাঠা বাজিরাও ছিলেন ব্রাহ্মণ ছোটবেলা থেকেই হিন্দুধর্ম তার নিয়মকানুন অন্ধভাবে মেনেই বড় হয়েছিলেন তিনি কিন্তু বাজিরাও বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ক্রমশ যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন বাজিরাও-এর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অসাধারণ বাজিরাও-এর বাবা মারা যাওয়ার পর মরাঠা সাম্রাজ্যর শাসনভার এসে পড়ে শত্রুপক্ষ সম্পর্কে সব খবরাখবর তিনি রাখতেন রাতে যখন সকলে ঘুমোত, তখনও তিনি তাঁর সাম্রাজ্য নিরাপদ রাখার কাজে নিযুক্ত থাকতেন বাজিরাও একবার তাঁর সেনাপতি বন্ধুকে বলেছিলেন যে, রাত ঘুমোনোর জন্য নয়, বরং রাত হচ্ছে আমাদের বর্ম এইসময়ই শত্রুপক্ষকে বোঝার সবচেয়ে বড় সময়
১৭০০ সালের ১৮ আগস্টে এই বীর জন্মগ্রহণ করেন ১৭২০ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত শাসন করেন তিনি এই বিশ বছরে ৪৩টি যুদ্ধ করেন এবং প্রতিবারই জয়ী হয় তথা অপরাজিত থাকেন সর্বশেষ ১৭৪০-এর ২৮ এপ্রিল তার ৪৪ তম যুদ্ধে তিনি নিহত হন মাস্তানি হলো তার ২য় স্ত্রী এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে বাজিরাও মাস্তানিকে অনেক ভালবাসতেন বাজিরাও এর সাথে তার আত্মার সম্পর্ক ছিল বাজিরাও এর যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যু হলে মাস্তানিও আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যা করা হয়
এখন আসি মাস্তানীকে নিয়ে - এক হিন্দু পেশোয়া/মারাঠা বিয়ে করছে এক মুসলিম কন্যাকে ! ইতিহাসে এটা একটা দুলর্ভ ঘটনা এর নজির তেমন একটা দেখা যায় না বরং উল্টোটাই আছে মাস্তানী কে ? এই প্রশ্নে কয়েকটি মত আছে জানা যায়, তিনি বুন্দেলখন্ডের রাজা ছত্রশলের কন্যা বাবা হিন্দু হলেও তার মা ছিলেন একজন মুসলিম তাই ছত্রশলের কন্যা হলেও তাকে আধা-মুসলিম বলা যায় হিন্দু-মুসলিম ধর্মের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যেপ্রণামী প্রচারক ছিলেন রাজা ছত্রশাল মেয়েও বড় হয়েছিল বাবার আদর্শে তাই মস্তানি একইসঙ্গে ব্রত পালন করতেন রোজা করতেন, অন্যদিকে কৃষ্ণের ভজনও গাইতেন আবার নামাজ পড়তেন মাস্তানি রূপে-গুণে ছিলেন অসাধারণ একদিকে মার্শাল আর্ট মূলক আত্মরক্ষা , ধনুর্বিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী, অন্যদিকে নাচে-গানেও অতুলনীয়া
.
কোনও কোনও ইতিহাসবিদ এইও বলেন যে, বাজিরাওয়ের সাহায্যে রাজা ছত্রসল যুদ্ধ জিতলে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাজ্যের একাংশ মেয়ে মাস্তানিকে বাজিরাওয়ের হাতে তুলে দেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাজিরাওয়ের যুদ্ধ হলেও, মাস্তানির রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হন হয়ে তাকে বিয়ে করেন কিন্তু বিয়ে সুখের হয়নি বাজিরাওয়ের ১ম স্ত্রী কাশীবাই খুব অল্প বয়সেই আর্থারাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন জীবনের বেশিরভাগই তাকে বিছানায় থাকতে হতো তবে তিনি অকমর্ণ্য ছিলেন না তিনি ছিলেন খুবই বিদূষী তাঁর একটি বিশাল নিজস্ব গ্রন্থাগার ছিল তবে তিনি হাঁটুর ব্যাথায় তিনি খুবই কাবু থাকতেন কাশীবাঈ এবং বাজিরাওয়ের পরিবার ঈর্ষা সংস্কারের বশে মাস্তানিকে মেনে নিতে পারেননি কিন্তু বাজিরাও তাকে পাগলের মতো ভালবাসতেন৷ ইতিহাস বলে মাস্তানী যুদ্ধে পারদর্শী হওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে বাজিরাও তাকে সবসময় নিজের পাশে রাখতেন
মাস্তানির গর্ভে বাজিরাওয়ের এক ছেলে হয় বাজিরাও তার নাম রাখেন শামসের বাহাদুর৷ কিন্তু তাতে তার উত্তারাধিকার করতে পারেনি আনুষ্ঠানিক রীতি পালন করতে অস্বীকার করেন তার পরিবার পুরোহিতরা
কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে বাজিরাও এর মৃত্যুর পর মাস্তানি সতীদাহ প্রথা পালন করে সতী হয়েছিলেন !
অফ টপিক বলে রাখি এই মারাঠারা আমরা বাংলার মানুষদের কাছে চিরকালই বিভীষিকাময় দস্যু ছাড়া আর কিছু নয় তাদের অত্যাচারে আমরা এতটাই অতিষ্ট ছিলাম যে ছেলেভুলানো ছড়াতেও তাদের অস্তিত্ব মিলে "ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে" "বর্গী" মারাঠাদের আরেক নাম?
এখন আসি মুভিতে - প্রায় ১৩০ কোটি রুপীতে নির্মিত এই মুভি প্রতিবারের মত এই মুভিতেও বানশালী খরচে কার্পন্য করেনি ঘরের সাজসজ্জা থেকে শুরু নায়িকাদের কাপড়ে পিছে প্রচুর টাকা ঢেলেছেন সঞ্জয় এই মুভি নিয়ে এতটাই সিরিয়াস ছিলেন যে তার মনমত না হলে উনি দীপিকা প্রিয়াংকা কাউকে ছাড়েনি মুখ দিয়ে যা এসেছ তাই বলেছেন আরো বকা খেতে হবে দেখে প্রিয়াংকা মুভিটা ছেড়েই দিতে চেয়ে ছিলো এছাড়াও মুভিটিতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ আছে
১৭৪০- অসুস্থ হয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে হঠাত্ তাঁর মৃত্যু হয় এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মারাঠা সেনাপতি বাজিরাও এক বার বুন্দেলখণ্ড রাজ্যকে মুঘল আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন আক্রমণকারী পাঠান মহম্মদ খান বাঙ্গাশ বাজিরাও এবং বুন্দেলখণ্ডের বীরাঙ্গনা রাজকুমারী মস্তানির যৌথ আক্রমণে পরাজিত হন আর এই সূত্রেই বাজিরাও বল্লালের সঙ্গে পরিচয় হয় রাজকুমারী মস্তানীর আর পরিচয় থেকেই প্রেম এই মস্তানি বাজিরাওয়ের দ্বিতীয় পত্নী যদিও মারাঠা সেনাপতির পরিবার তাঁকে কোনও দিনই বাজিরাওয়ের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়নি কারণ তিনি বুন্দেলখণ্ডের রাজপুত রাজা ছত্রসাল-এর পার্শি মুসলিম পত্নী রুহানি বাঈের মেয়ে

ধর্ম, সামাজিক পারিবারিক চক্রান্তের বাধা পেরিয়ে বাজিরাও-মস্তানির প্রেম বাঁচিয়ে রাখার লড়াই ফুটে উঠেছে এই ছবিতে যার উল্লেখ ইতিহাসেও রয়েছে এর আগে আশুতোষ গোয়ারিকরের জোধা আকবরের মাধ্যমে মানুষ দেখেছিল হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ পেরিয়ে জোধা আকবরের প্রেম গাথা বনশালী বাজিরাও মস্তানির প্রেম কাহিনীর মাধ্যমে দেখালেন, ভালোবাসা কোনও ধর্ম হয় না বা বলা যেতে পারে সব ধর্মই মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় যদিও এই ছবিতে এবং বাস্তব ইতিহাসে একজন মুসলিম রাজকুমারীর পবিত্র প্রেম হিন্দুদের বর্ণ জাতপ্রথার কারণে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়

No comments:

Post a Comment