ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব নয়...
ব্রাহ্মণবাদী হিন্দু রাজা ষড়যন্ত্রকারী
গণেশের উত্থান এবং মুসলমানদের নির্মূলে পদক্ষেপ ॥
সূফি বরষণ
পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে বাংলায় হিন্দুজাতির পুনরুত্থান আন্দোলন শুরু হয়। মুহাম্মদ বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর হতে চতুর্দশ শতকের শেষ অবধি মুসলমান শাসকগণ কখনো দিল্লী সুলতাদের নিযুক্ত গভর্ণর হিসাবে, কখনো স্বাধীন সুলতান হিসাবে এবং কখনো উপঢৌকনাদির মাধ্যমে দিল্লী দরবারকে প্রীত ও সন্তুষ্ট রেখে বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ দুই শতকের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় –মুসলমানগণ নিশ্চিত মনে শান্তিতে রাজত্ব করতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে আত্মকলহ ও বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের প্রবল আকাংখাই ছিল সে শান্তি বিনষ্টের কারণ। কিন্তু তাই বলে মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক হিন্দুজাতি দলন ও প্রজাপীড়নের শিকার হয় কখনো। ফলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রজাগণ সুখ-শান্তি ও জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করেছিল। ব্রাহ্মণবাদী রাজা গণেশ সেনের মতো বর্তমান বাংলাদেশের উপরেও ভারতীয় ব্রাহ্মণবাদী হিন্দুদের কু দৃষ্টি পড়েছে যার ফলে আজকে দেশের আকাশে কালোমেঘ বিরাজ করছে॥ বখতিয়ার খিলজীর পূর্বে এদেশে বহু স্বাধীন হিন্দু রাজা বাস করতেন।
মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা তাঁরা মনে প্রাণে মেনে না নিলেও মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষে আসা সমীচীন মনে করেননি। তার দুটি মাত্র কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ এই যে, বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল মুসলমানদের হাতে এবং বখতিয়ারের পর থেকে ক্রমাগত বহির্দেশ থেকে অসংখ্য মুসলমান বাংলায় আসতে থাকে। মুসলমানরা ছিল হিন্দুদের থেকে জ্ঞান এবং শৌর্যে অনেক শক্তিশালী আর শারীরিক গঠন ছিল অনেক উন্নত ॥ মুসলিম ধর্ম প্রচারক অলী ও দরবেশগণ এদেশে আগমন করতঃ ইসলামের সুমহান বাণী, ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রচার করতে থাকেন।
ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা নিষ্পেষিত হিন্দু জনসাধারণ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। তখন বাংলার অসংখ্য বৌদ্ধ ও হিন্দু দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে ॥ কারণ ব্রাহ্মণবাদী হিন্দুদের বর্ণপ্রথায় সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধরা নির্যাতনের শিকার হতে হয়, ইসলামের সাম্যের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে এবং একজন মানুষ অপরজনকে ভাই ভাই হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার কথা ইসলাম বলে তাই॥ তথাপি এখানকার বর্ণহিন্দুরা মুসলমান শাসকদের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও আত্মকলহের সুযোগে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারতো। কিন্তু তা করেনি। তার কারণও আছে।
“দ্বিতীয় কারণ এই যে, তারা এক দীর্ঘ পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছিল। তা হলো মুসলিম শাসকদের বিরাগভাজন না হয়ে বরঞ্চ শাসন কার্যের বিভিন্ন স্তরে এরা নিজেদের স্থান করে নিয়ে কোন এক মুহূর্তে আত্মপ্রকাশ করবে। ঠিক এমনটাই করেছিলন পালবংশের শাসনকালে বহিরাগত ব্রাহ্মণবাদী হিন্দু সেনরা ॥
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তারা তাদের এ পরিকল্পনায় পূর্ণ সাফল্য লাভ করেছিল। তবে সে সময়ে নিজেরা ক্ষমতালাভ না করে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত করে ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করেছিল। পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে তাদের সাফল্য স্থায়ী না হলেও এ ছিল তাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার প্রথম প্রকাশ।
এ সময়ে বাংলার একজন হিন্দু জমিদার প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠেন। ফার্সি ভাষায় লিখিত ইতিহাসে তার নাম ‘কানস’ বলা হয়েছে। কানস প্রকৃতপক্ষে ‘কংস’ অথবা ‘গণেশ’ ছিল। তিনি গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে রাজস্ব ও শাসন বিভাগের অধিকর্তা হয়েছিলেন। ‘রিয়াযুস সালাতীনে’র বর্ণনা অনুসারে গণেশ শামসুদ্দীনের পৌত্র গিয়াসউদ্দীন আজম শাহকে হত্যা করেন। অতঃপর গিয়াসউদ্দীনের পৌত্র শামসুদ্দীনকেও তিনি হত্যা করে গৌড় ও বাংলার সিংহাসনে আরোহন করেন।
ব্লকম্যান (Blockman) বলেন যে, গণেশ নিজে সিংহাসনে আরোহন করেননি। তবে তিনি শামসুদ্দীনকে হত্যা করে তাঁর ভ্রাতা শাহাবুদ্দীন বায়েজিদ শাহকে ক্রীড়াপুত্তলিকা স্বরূপ রেখে স্বয়ং রাজদন্ড পরিচালনা করতেন। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় তাঁর বাংলার ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ডে ১৪০৯-১৪১৪ খৃঃ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসনে দু’জন শাসনকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন। যথা, শাহাবুদ্দীন বায়েজীদ শাহ ও গণেশ।
রাজ গণেশ বাঙ্গাল বরেন্দ্র এলাকার একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন। উত্তর বংগের (দিনাজপুর) ভাটুরিয়া পরগণার শক্তিশালী রাজা গণেশ তাঁর নিজস্ব একটি সেনাবাহিনী রাখতেন। দুর্ধর্ষ সংগল গোত্র থেকে তিনি তাঁর সৈন্য সংগ্রহ করতেন। তাঁর প্রভাব পতিপত্তির কারণে তাঁকে বাংলার সুলতানের অধীনে চাকুরীতে নিযুক্ত করা হয় এবং ক্রমশঃ তিনি রাজ্যের খাজাঞ্চিখানার একচ্ছত্র মালিক মোখতার (সাহেব-ই-ইখতিয়ার-ই-মুলক ও মাল) হয়ে পড়েন। এ পদমর্যাদার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি প্রথমে গিয়াস উদ্দীন আজম শাহকে হত্যা করেন এবং কয়েক বৎসর পর শামসুদ্দীন শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
গণেশের বাংলার সিংহাসনে আরোহণ দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। গণেশ ও তাঁর সমমনা হিন্দু সামস্তবর্গ বাংলায় মুসলমানদের শাসন মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। যদিও বিগত দুই শতকের ইতিহাসে মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক অমুসলমানদের প্রতি কোনপ্রকার উৎপীড়নের নজীর পাওয়া যায়না, তথাপি মুসলিম শাসনকে তারা হিন্দুজাতির জন্যে চরম অবমাননাকর মনে করতেন। তাই গণেশ সিংহাসনে আরোহণ করার পর মুসলিম দলনে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে মুসলমানদের প্রতি তাঁর বহুদিনের পুঞ্জিভূত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
বুকানন হ্যামিল্টন কর্তৃক লিখিত দিনাজপুর বিবরণীতে আছে যে, জনৈক শায়খ বদরে ইসলাম এবং তদীয় পুত্র ফয়জে ইসলাম গণেশকে অবনত মস্তকে সালাম না করার কারণে তিনি উভয়কে হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, বহু মুসলমান অলী দরবেশ, মনীষী, পন্ডিত ও শাস্ত্রবিদকে গণেশ নির্মমভাবে হত্য করেন। একদা শায়খ মুঈনুদ্দীন আব্বাসের পিতা শায়খ বদরুল ইসলাম বিধর্মী রাজা গণেশকে সালাম না করার কারণে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। অতঃপর একদিন তিনি উক্ত শায়খকে দরবারে তলব করেন। তাঁর কামরায় প্রবেশের দরজা এমন সংকীণৃ ও খর্ব করে তৈরী করা হয় যে, প্রবেশকারীকে উপুড় হয়ে প্রবেশ করতে হয়। শায়খ রাজার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে প্রথমে তাঁর দু’খানি পা কামরার ভিতরে রাখেন এবং মস্তক অবনত না করেই প্রবেশ করেন। কারণ, ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী কোন মুসলমানই আল্লাহ ব্যতীত আর কারো সামনে মস্তক অবনত করতে পারেন না। রাজা গণেশ তাঁকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করেন এবং অন্যান্য আলেমগণকে একটি নৌকায় করে নদী-গর্ভে নিমজ্জিত করে মারেন।
মুসলিম নিধনের এ লোমহর্ষক কাহিনী শ্রবণ করে শায়খ নূরে কুতুবে আলম মর্মাহত হন এবং জৌনপুরের গভর্ণর সুলতান ইব্রাহীম শার্কীকে বাংলায় আগমন করতঃ ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্যে আবেদন জানান। সুলতান ইব্রাহীম বিরাট বাহিনীসহ বাংলা অভিমুখে যাত্রা করে সরাই ফিরোজপুরে শিবির স্থাপন করেন। রাজা গণেশ জানতে পেরে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কুতুবে আলমের শরণাপন্ন হন। কুতুববে আলম বলেন, তিনি এ শর্তে সুলতাম ইব্রাহীমকে প্রত্যাবর্তনের পরামর্শ দিতে পারেন, যদি গণেশ ইসলাম গ্রহণ করেন। গণেশ স্বীকৃত হলেও তার স্ত্রী তাঁকে বাধা দান করেন। অবশেষে তাঁর পুত্র যদুকে ইসলামে দীক্ষিত করে গণেশের স্থলে তাকে সিংহাসন ছেড়ে দেয়ার জন্যে বলা হয়। গণেশ এ কথায় স্বীকৃত হন। যদুর মুসলমানী নাম জালাল উদ্দীন রেখে তাঁকে বাংলার সুলতান বলে ঘোষণা করা হয়। সুলতান ইব্রাহিম অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ মনে প্রত্যাবর্তণ করেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পাওয়া মাত্র গণেশ জালালউদ্দীনের নিকট থেকে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। সরলচেতা কুতুবে আলম গণেশের ধূর্তুমি বুঝতে পারেনি। তাই পুত্রকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে চাইলে পিতার নরহত্যার অপরাধ ক্ষমা করেন।
গণেশ সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার পর সুবর্ণধেনু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মচ্যুত যদুর শুদ্ধিকরণ ক্রিয়া সম্পাদন করেন। অর্থাৎ একটি নির্মিত সুবর্ণধেনুর মুখের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে তার মল ত্যাগের দ্বার দিয়ে হিন্দু শাস্ত্রের বিশেষ ধর্মীয় পদ্ধতিতে বহির্গত হওয়াই হলো শুদ্ধিকরণ পদ্ধতি।
এ শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠানের পর গণেশ দেশ থেকে মুসলমানদের মূলোৎপাটনের কাজ শুরু করেন। তিনি পূর্বের চেয়ে অধিকরত হিংস্রতার সাথে মুসলিম নিধনকার্য চালাতে থাকেন। তিনি কুতুবে আলমের পুত্র শায়খ আনওয়ার ও পৌত্র শায়খ জাহিদকে বন্দী অবস্থায় সোনারগাঁও পাঠিয়ে দেন। অতঃপর তাঁদের পিতা-পিতামহের ধনসম্পদের সন্ধান দেয়ার জন্যে তাঁদেরকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার করা হয়। পরে শায়খ আনওয়ারকে হত্যা করা হয়। এমনিভাবে গণেশ সাত বৎসর যাবৎ বাংলায় এক বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম
করেন এবং মুসলমানদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন। গণেশের মৃত্যুর পর পুনরায় জালালউদ্দীন (যদু) সিংহাসনে আরোহণ করেন।
গণেশের রাজনৈতিক ‘অভ্যুত্থান’:
১২০৬ সালে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ইনতিকালের পর থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত ১৩২ বছরে অন্তত ২৩ জন মুসলিম শাসনকর্তা বাংলাদেশ শাসন করেন। স্বাধীন সুলতানী শাসনামলের মধ্যভাগে দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশের নেতৃত্বে হিন্দু অমাত্যদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলার ইতিহিাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ শাহাদাতবরণ করেন। এরপর ১৪১০ থেকে ১৪১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ইলিয়াশাহী বংশের সাইফউদ্দীন হামজা শাহ, শিহাবউদ্দীন বায়েজিদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরূজ শাহ একের পর এক বাংলার শাসনমঞ্চে আবির্ভূত হন। গণেশের চক্রান্তে তারা সকলেই নিহত হন। শিহাবউদ্দীনকে হত্যা করার পর গণেশ তাঁর বালকপুত্র আলাউদ্দীন ফিরূপ শাহকে রাজা হিসেবে খাড়া করে এ সময় নিজেই কার্যত রাজা হয়ে বসেন। এরপর যখন বুঝতে পারেন, কাউকে আর শিখণ্ডী না রাখলেও চলবে, তখন ফিরুজকে হত্যা করে গণেশ ১৪১৫ সালে সিংহাসন দখল করেন।
রাজা গণেশের সিংহাসন দখলের মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের অবসানকামী ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুদের দু’শতাধিক বছরের পুঞ্জীভূত আক্রোশ উচ্ছাসিত হয়ে ওঠে। গণেশ মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প করেন। বাংলাদেশ থেকে ইসলামের মূলোচ্ছেদ করাই হয়ে দাড়ায় তার প্রধান লক্ষ্য। রমেশচন্দ্র মজুমদার গণেশের স্বল্পকাল-স্থায়ী শাসনামলকে ‘হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা ও হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য স্থাপনের প্রচেষ্ঠা’ বলে উল্লেখ করেন। সে সময়ের বহু ইসলাম প্রচারক আলিম ও দরবেশকে গণেশ পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন। বিখ্যাত আদিনা মসজিদকে তিনি পরিণত করেন কাচারি বাড়িতে।
রাজা গণেশের নেতৃত্বে বর্ণহিন্দুদের এই রাজনৈতিক অভ্যূত্থানের মোকাবিলায় তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলিমগণ মৃত্যু-ভয় তুচ্ছ করে জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করেন। বাংলার এই ভয়াবহ দুর্দিনে শায়খ আলাইল হকের পুত্র সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ আলিম নূর কুতুব-উল-আলম মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেন। তাঁর আহ্বানে জৌনপুরের সুলতান ইবরাহীম শর্কী এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে গণেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। বিপদ বুঝে গণেশ বিনা যুদ্দে আত্মসমর্পন করেন। গণেশের পুত্র যদু নূর কুতুব- এর কাছে ইসলাম কবুল করেন এবং জালালউদ্দীন মুহাম্মদ শাহ নাম ধারণ করে বাংলার শাসক হন।
হিন্দুজাতির পুনরুত্থান:
রাখালদাস বন্দোপাধ্যয় তাঁর বাংলার ইতিহাস ২য় খন্ডে লিখেছেন, “গণেশ নব প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। সুবর্ণধেনু ব্রত দ্বারা যদুর প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা তাহার কিঞ্চিৎ প্রমাণাবাস মাত্র। রাজা গণেশের সময় হইতে গৌড়ে ও বংগে সংস্কৃত চর্চা আরম্ভ হইয়াছিল। সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ রচনাও আরম্ভ হইয়াছিল এবং উন্নতির সূচনা হইয়াছিল। এই সকল কারণের জন্য গণেশ বাংলার ইতিহাসে, ভারতের ইতিহাসে ও ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে উচ্চাসন লাভ করিয়াছিলেন”। (উক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৩৫-৩৬)
গণেশের জ্যেষ্ঠ পুত্র মুসলমান হয়েছিলেন তাঁর মুসলমান হওয়ার প্রকৃত কারণ কি ছিল তা অবশ্য বলা কঠিন। তবে একজন প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রাহ্মণ হিন্দুজাতির পক্ষে চরম অবমাননাকর মনে করে অনেক কল্পিত কাহিনী রচনা করেছেন।
রাখালদাস তাঁর উক্ত ইতিহাসে বলেন, “বরেন্দ্রভূমিতে প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে যদু ইলিয়াস শাহের বংশজাতা কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান রমণীর রূপে মোহিত হইয়া স্বধর্ম বিসর্জন দিয়াছিলেন”।
রাখালদাস স্বজাতির গ্লানি অপর ধর্মাবলম্বীর উপর চাপিয়ে বলেন-
“ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ট (Stewart) অনুমান করেন যে, যদু বা জালালউদ্দীন গণেমের মুসলমান উপপত্মীর গর্ভজাত পুত্র”।
মুসলিম শাসনের ইতিহাসকে কলংকিত করা হয় যেভাবে:
কিভাবে মুসলিম জাতির ইতিহাস কলংকিত করা হয়েছে, উপরের বর্ণনা তাঁর এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
এ এক অনস্বীকার্য সত্য যে, তৎকালে মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতন এতখানি হয়নি যে, মুসলমান রমণীগণ তখন বেশ্যাবৃত্তি শুরু করেছে অথবা কোন অমুসলমানের স্বামীত্ব গ্রহণ করেছে। অথবা বর্তমান কালের মতো মুসলমান রমণীগণ বেপর্দায় পর-পুরুষের সামনে চলাফেরা করতো যার ফলে গণেশপুত্র যদু কোন সুন্দরী মুসলমান যুবতীর প্রেমাসক্ত হয়ে তাঁর পাণি গ্রহণের জন্যে মুসলমান হয়েছে। ইতিহাস একথার সাক্ষ্যদান করে যে, সে সময়ে দলে দলে মুসলমান ফকীর দরবেশ এদেশে ইসলামের মহান বাণী প্রচার করতেন এবং তাঁদের অনেকে শাসনকার্যেও অংশগ্রহণ করেছেন। শাসকগণের উপর ছিল তাঁদের বিরাট প্রভাব।
গণেশের আমলের কথাই ধরা যাক। বিখ্যাত অলী নূরে কুতুবে আলম, তাঁর পুত্র শায়খ আনওয়ার গণেশের সমসাময়িক লোক। তাঁদের প্রভাব শুধু বাংলার মুসলমান ও শাসকদের উপরেই ছিলনা, বরঞ্চ অযোধ্যার গভর্ণর সুলতান ইব্রাহীম শার্কীর উপরেও ছিল। যার উল্লেখ উপরে করা হয়েছে। তাঁদের আচার আচরণ, নির্মল চরিত্র ও তাঁদের মুখনিঃসৃত ইসলামের অমিয় বাণী শ্রবণ করে বহু হিন্দু স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টচিত্তে ইসলাম গ্রহণ করে –যাদের মধ্যে গণেশপুত্র যদু একজন। সমাজে তাঁদের এতখানি প্রভাব বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মুসলমান নারী বেশ্যাবৃত্তি করবে অর্থাৎ কোন পুরুসের অপপত্মী হবে, অথবা বল্গাহীনভাবে চলাফেরার করণে কোন হিন্দু প্রেমাসক্ত হবে; এ একেবারে কল্পনার অতীত। অতএব গণেশের মুসলিম উপপত্নী রাখা এবং যদুর মুসলিম রমণীর প্রেমাসক্ত হওয়া একেবারে স্বকপোলকল্পিত এবং দুরভিসন্ধিমূলক। নিজের গ্লানি অপরের ঘাড়ে চাপাবার হাস্যকর প্রয়াস মাত্র। এভাবেই যুগে যুগে মুসলমানদের গৌরব উজ্জ্বল সোনালী ইতিহাসকে মিথ্যাচার করেছে ॥বাংলায় মুসলমানদের
শাসনকে মধ্যযুগীয় শাসন বলে সাড়ে পাঁচশো বছরের মুসলিম শাসনকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে ॥ সেটা রাখালদাস বন্দোপাধ্যয়ের মতো হিন্দু স্বার্থপর ঐতিহাসিকগণও করেছেন !!??
আর একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তা হলো এই যে, মুসলমান এদেশে এসেছিল বিজয়ীর বেশে। এবং অত্যাচারিত হিন্দুদের হাত হতে বাঁচার জন্য বাংলার সাধারণ বৌদ্ধরা মুসলমানদের সাথে দেখা করে সাহায্যে জন্য আবেদন করে॥ স্বভাবতঃই বহিরাগত বিজয়ী মুসলমানদের মধ্যে ছিল শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি (Superiority Complex)। সম্ভ্রান্ত মুসলমান বলতে বহিরাগত মুসলমানকেই বুঝাত। তাঁদের কোন রমণী হিন্দুর স্বামীত্ব গ্রহণ করবে –এ চিন্তার অতীত।
তারপর কথা থাকে এই যে, নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুজাতির ইসলাম গ্রহণের পর তাদের কোন রমণী গণেশকে স্বামীত্ব বরণ করেছে, এটাও ছিল অবাস্তব। কারণ গণেশ ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারক-বাহক। যে হিন্দু ইসলাম গ্রহণের পর যবন ও স্লেচ্ছ হয়েছে তাঁদের ঘরে বিবাহ করা গণেশের পক্ষে ছিল এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। অতএব এসব কাহিনী- যে অলীক কল্পনাপ্রসূত মাত্র, তাতে সন্দেহ নেই।
কেউ কেউ বলেন, যদু রাজ্যলোভে মুসলমান হয়েছিলেন। আমাদের একথাও সত্য নয়। অবশ্য সুলতান ইব্রাহীম শার্কীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে গণেশ তদীয় পুত্রকে নূরে কুতুবে আলমের হস্তে ইসলাম গ্রহণের জন্যে সমর্পণ করেন। যদুর ইসলাম গ্রহণ এবং তাঁকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করার পর সুলতান ইব্রাহীম শার্কী বাংলা আক্রমণ না করে প্রত্যাবর্তণ করেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই গণেশ পুনরায় যদুকে অসারিত করে নিজে সিংহাসনে পুনঃ আরোহণ করেন। তারপর হিন্দুমতে যদুর প্রায়শ্চিত্ত করা হয়। গণেশ প্রবল পরাক্রমসহ সাত বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁকে কোনক্রমেই সিংহাসনচ্যুত করা যায়নি। যদু যদি শুধুমাত্র রাজ্যলোভেই ইসলাম গ্রহণ করে থাকতেন, তাহলে তাঁর প্রায়শ্চিত্ত ও সুবর্ণধেনুর শুদ্ধিকরণের পরনির্বিঘ্নে হিন্দু হিসাবে পিতার সিংহাসনে আরোহণ করতে পারতেন। কিন্তু যদু ইসলাম ত্যাগ করেননি।
অতঃপর মানুষের মধ্যে থাকে একটি বিবেক যার দ্বারা সত্য ও মিথ্যাকে উপলব্ধি করতে পারা যায়। তার সাথে মানুষের মধ্যে থাকে একটা নৈতিক অনুভূতি। গণেশের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা দেখে বাংলার সুলতান তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে নিযুক্ত করেন।
কিন্তু ষড়যন্ত্র ও হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তিনি বাংলার সিংহাসন দখল করেন। প্রথমতঃ তিনি প্রভুম প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা প্রদর্শন করেন এবং অতঃপর নিরীহ মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন। কিন্তু তথাপি তাঁর পুত্র ইসলাম গ্রহণের কারণে তাঁর সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করেন নূরে কুতুবে আলম। শায়খ নূরে কুতুবে আলমের আচরণ, ইসলামের সহনশীলতা ও উদারতার প্রতি অবশ্য যদু মুগ্ধ হয়ে থাকবেন। পিতার বিশ্বাঘাতকতা, কৃতঘ্নতা ও নিষ্ঠুরতা অবশ্য অবশ্যই যদুসেনের মনের গভীরে দাগ কেটে থাকবে। উপরন্তু, কামেল অলীর সংস্পর্শে যদুর অত্যন্ত সত্য সত্যই ইসলামের নূরে উদ্ভাসিত হয়েছিল। এটাই আমাদের ধারণা। তা মোটেই অযৌক্তিকও নয় এবং অসম্ভবও নয়।
এখন মুসলিম বিদ্বেষী ঐতিহাসিকগণের মতে, যদু যখন ইসলামে অবিচললিত ছিলেন, তখন তাঁকে নানাভাবে কলংকিত করতেই হবে। প্রথমতঃ তাঁকে একজন মুসলমান উপপত্মীর সন্তান বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের বক্তব্য এই যে, আসলে তিনি হিন্দুই ছিলেন না জারজ (?) সন্তান।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ইতিহাসে এ সময়ের একটি চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর ইতিহাসের (বাংলার ইতিহাস ২য় খণ্ড) ১৩৭ পৃষ্ঠায় বলেন- “গণেশ অথবা যদু যাহা করিতে পারেন নাই, অথবা করিতে ভরসা করেন নাই আর একজন বাঙ্গালী হিন্দুরাজা কর্তৃক তাহা স্বচ্ছন্দে সম্পাদিত হইয়াছিল।
তাহার নাম দনুজমর্দন দেব”।
অতঃপর তিনি উক্ত গ্রন্থের ১৩৯ পৃষ্ঠায় কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন- “গণেশ অথবা যদু যাহা করিতে পারেন নাই, আর্যাবর্তে কোনও হিন্দু রাজা যাহা করিতে পারেন নাই, তাহাই সাধন করিয়াছিলেন বলিয়া দনুজমর্দন দেব ও মহেন্দ্র দেবের নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় থাকিবে”।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, গণেশ-যদু কি করতে পারেননি, আর দনুজমর্দন দেব কি করেছেন তার কোন উল্লেখই তাঁর গ্রন্থে নেই।
এ সম্পর্কে স্যার যদুনাথ সরকার বলেন-
“In this very year we find coins with Bengali lettering issued
from Pandua and Chatgaon by a king named Mahendra Dev- exactly resembling those
of Danujmardan Dev. He was most probabely the younger son of Ganesh, who has
remained a Hindu and to whome his elder brother Jadusen Jalaluddin had offered
to leave the patemal throne on case he was not permitted of embrace Islam.
Mahendra was evidently set up on the throne by Hindu ministers just after the
death of Ganesh. I believe that Mahendra (then not more than 12 years old) was
a mere puppet in the hands of a selfish ministerial foaction… The attempt of
the Kingmakaers was shortlived and ended on their speedy defeat, as no coin was
struck in Mahendra’s name after that one year 1418 A.D
“ঠিক এ বৎসরেই পান্ডুয়া ও চাটগাঁও থেকে বাংলা অক্ষরে মহেন্দ্র দেবের নামাংকিত মুদ্রা আমরা দেখতে পাই। এগুলো দেখতে অবিকল দনুজমর্দন দেবের মুদ্রার ন্যায়। খুব সম্ভব তিনি ছিলেন গণেশের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি হিন্দুই রয়ে গিয়েছিলেন এবং যদুসেন জালাজউদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন, যদি তাঁকে মুসলমান হতে দেয়া না হয় তাহলে যেন পিতার সিংহাসন ছেড়ে দেন। গণেশের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু মন্ত্রীবর্গ মহেন্দ্রকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমার বিশ্বাস মহেন্দ্র (যার বয়স বার বছরের বেশী ছিলনা) একটা স্বার্থান্ধ মন্ত্রীচক্রের কাষ্ঠপুত্তলিকা ছিলেন মাত্র। এ সকল মন্ত্রীবর্গের রাজা বানাবার প্রচেষ্টা বেশীদিন চলতে পারেনি এবং অচিরেই তাঁদের পরাজয় ঘটেছে। কারণ এই একটি বছর ১৪১৮ খৃষ্টাব্দের পর মহেন্দ্রের নামে আর কোন মুদ্রা অংকিত হয়নি”।
যদুনাথ সরকার আরও বলেন-
“Hanesh placed his son, a led of twelve only, under protective
watch in his harem and ruled in his iwn account under the proud title of
Danujmaradan Dev.”
“গণেশ তাঁর বার বৎসর বয়স্ক পুত্রকে হারেমের মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক পাহারায় রেখে স্বয়ং গৌরবজনক ‘দনুজমর্দন দেব’ উপাধি ধারণ করে ইচ্ছামতো শাসক চালান”।
এর থেকে বুঝা গেল গণেশই আষেল ছিলেন দনুজমর্দন দেব। অথবা দনুজমর্দন ছিল তাঁর উপাধি যা তিনি তাঁর জন্যে এবং গোটা হিন্দুজাতির জন্যে গৌরবজনক মনে করতেন। রাখালদাস এখানেই ভুল করেছেন। তিনি দনুজমর্দনকে ভিন্ন ব্যক্তি মনে করে তাঁর অসীম গুণগান গেয়েছেন।
এখন আসুন, আমরা দেখি দনুজমর্দন শব্দের অর্থ কি। দনুজমর্দন শব্দের অর্থ ‘দৈত্যদলন’। উগ্র হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠাকামী গণেশ মুসলশান ও মুসলিম শাসন কিছুতেই বরদাশত করতে পারেননি। তাঁর একান্ত বাসনা ছিল মুসলমানদেরকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে উগ্র হিন্দুরাজ কায়েম করা। বহিরাগত মুসলমানদেরকে গণেশের ন্যায় হিন্দুগণ ‘যবন-স্লেচ্ছা’ মনে করতেন। কিন্তু মুসলমানগণ হিন্দুদের তুলনায় শারীরিক গঠন ও শৌর্যবীর্যে বলিষ্ঠতর ছিলেন। তাই তাঁদেরকে যবন ও স্লেচ্ছ দৈত্যের মতো মনে করা হতো। এই দৈত্য স্বরূপ যবন ও স্লেচ্ছদের দলন ও নিধনই ছিল গণেশের ব্রত। ইব্রাহিম শার্কীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর গণেশ পূর্ব থেকে শতগুণে এ দলন ও নিধন কার্য চালিয়েছেন। দনুজমর্দনের মুসলিম নিধন কার্যকলাপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রাখালদাস বলেছেন, “আর্যাবর্তে কোনও হিন্দু রাজা যাহা করিতে পারেন নাই তাহাই সাধন করিয়াছিলেন বলিয়া দনুজমর্দন দেব ও মহেন্দ্র দেবের নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় থাকিবে”।
গণেশের মৃত্যুর পর পরই তাঁর নিযুক্ত হিন্দু মন্ত্রীবর্গ তাঁর বর বৎসর বয়স্ক পুত্র মহেন্দ্রকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে গণেশেরই পদাংক অনুসরণে মুসলিম-দলন কার্য অব্যাহত রাখেন। তাই দনুজমর্দন গণেশ ও তদীয় পুক্র মহেন্দ্রের ক্রিয়াকলাপে আনন্দে গদগদ হয়ে রাখালবাবু তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মহেন্দ্রের শাসন ছিল অল্প দিনের জন্য।
যদুসেন ওরফে জালালউদ্দীন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৪-৩১ খৃঃ) মনেন্দ্র॥ শাসসুদ্দীন আহমদ শাহ (১৪১৩-৪২ খৃঃ)
ব্রাহ্মণবাদী হিন্দুরা যেভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করে:
উপমহাদেশের বৌদ্ধবাদের উৎখাতের পর বহিরাগত আর্য অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এখানকার মূল অধিবাসীদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হলেও অপরাজেয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের উপস্থিতি তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। মুসলমানরা বহিরাগত ব্রাহ্মণ সৃষ্ট বর্ণবাদের শিকার এদেশের সাধারণ মানুষকে মুক্তির নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ করে দেয়। বিধ্বস্ত অবস্থায় ছোট ছোট অবস্থানে হিন্দু শক্তি তার বিক্ষত অস্তিত্ব কোন মতে ধরে রাখলেও বৃহত্তর পরিসরে শেষ পর্যন্ত বাংলাই ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির দৃশ্যমান সর্বশেষ দুর্গ। সব শেষে বাংলা থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি উৎখাতের পর তাদের প্রাধান্য বিস্তারে রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
এতদসত্ত্বেও তাদের পুনরুত্থানের আকাঙ্খা চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত হয়নি। সংগ্রাম সংঘাতের মধ্য দিয়ে আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারে কয়েক সহস্রাব্দের অভিজ্ঞতা ও কৌশল পূঁজি করে দুর্দমনীয় মুসলিম শক্তি বিনাশের জন্য সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে। সেই সুযোগটা এসে যায় ইলিয়াস শাহী সালতানাতের মুসলিম শক্তি কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতার মধ্য দিয়ে। মোহাম্মদ তুগলকের শাসনামলের শেষ পর্যায়ে উপমহাদেশের মুসলিম শক্তি কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে বাংলার ইলিয়াস শাহী সালতানাতকে ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। যুদ্ধ ও অবরোধের মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ইলিয়াস শাহকে বিপর্যস্ত হতে হয়। এই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে নিজস্ব শক্তি পুনর্গঠন ও সুসংহত করার জন্য সুলতানকে স্থানীয়ভাবে সৈন্য সংগ্রহ করতে হয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে। এ কারণে হিন্দু প্রধানদের সদিচ্ছা ও সমর্থনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রীয় নীতি কৌশল পুনর্বিন্যাসে হিন্দু প্রধানদের স্বার্থ বিবেচনায় আনতে হয়।
আর এ সময়ই রাজা গনেশ সুলতানের দরবারে স্থান করে নেয়। শুধু গনেশই নয়, এই সাথে আরো কতিপয় প্রভাবশালী হিন্দু ইলিয়াস শাহের দরবারে সংশ্লিষ্ট হয়। মুহাম্মাদ শাহের পুত্র ফিরোজশাহ তুগলক বাংলা পুনরুদ্ধার প্রয়াসে বিহার আক্রমণ করার ফলে ইলিয়াস শাহ এবং তার পুত্র সিকান্দার শাহ যে করুণ অবস্থার সম্মুখীন হন সেটা অবলোকন করে রাজা গনেশ তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেন এবং গভীর মনোযোগী হয়ে উপমহাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। ফিরোজ শাহ তুগলকের মৃত্যুরপর দিল্লীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বেশ কটি স্বাধীন সালতানাতের অভ্যুদয় এবং তৈমুর লং কর্তৃক দিল্লী লুণ্ঠনসহ বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহ বাংলায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুপ্ত আকাঙ্খা ব্রাহ্মণ্যবাদী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহমান হয়ে উঠে। সালতানাতের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে রাজা গনেশের নেতৃত্বে হিন্দু রাজন্যবর্গ তাদের কূট কৌশল প্রয়োগ করে শাহী দরবারের সভাসদদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়।
গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের শাসনামলের ঔদার্যের ফলে রাজা গণেশ প্রাধান্যে এসে যায়। সুলতানের মৃত্যু অথবা অপমৃত্যুর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সালতানাতের সবচেয়ে বিচক্ষণ মন্ত্রী খানজাহান ইয়াহিয়ার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর ১৪১১-১২ সাল নাগাদ রাজা গনেশ সালতানাতের রাজনীতির পুরো ভাগে এসে পড়ে। ধারণা করা হয় যে, এসব অপমৃত্যু ও হত্যাকাণ্ডের অন্তরালে রাজা গনেশের চক্রান্ত বিদ্যমান ছিল। সাইফ আল দ্বীন হামযার স্বল্পকালীন শাসনামলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। হামযা শাহকে কোন এক পর্যায়ে রাজা গনেশ ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যা করেন। ইতিপূর্বে রাজা গণেশ হামযা শাহকে নামে মাত্র ক্ষমতাসীন রেখে সমস্ত ক্ষমতা নিজে কুক্ষিগত করে রাখেন।
এমন অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে হামযা শাহ এর গোলাম শিহাব সাইফুদ্দিন রাজা গনেশের গভীর ষড়যন্ত্র অনুধাবন করেন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন। শিহাব সাইফুদ্দিন রাজা গনেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং রাজাকে সাময়িকভাবে স্তব্দ করে দিতে সক্ষম হন। অতঃপর শিহাব সাইফুদ্দিন বায়জিদ শাহ নাম ধারণ করে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বৈদিক চক্রের কাছে অবশেষে তাকে পরাজিত হতে হয়। রাজা গনেশ তাকে ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যা করেন। বাইজীদ-এর সন্তান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ গনেশের অপকর্মের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ক্ষমতার এই টানাপোড়ন ৪ বছর স্থায়ী হয়। রাজা গনেশের কূট চক্রের কাছে অবশেষে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ পরাস্ত হন এবং রক্তাক্ত পরিণতি তার ভাগ্যে জুটে।
ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে রাজা গনেশ মুসলমানদের উচ্ছেদ করার মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি তাদের প্রতি খড়গ হস্ত হয়ে উঠেন যারা মোটামুটি জনগণের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অতি ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে মুসলিম নিধন শুরু করা হয় এবং বহু জ্ঞানী-গুণী হত্যা করা হয়। সমকালীন প্রভাবশালী মাশায়েখ শেখ বদরুল ইসলাম এবং তার পুত্র ফাইজুল ইসলাম রাজাকে অভিনন্দন জানাতে অস্বীকার করলে তাদেরকে দরবারে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। রাজা গনেশ তার শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করার অপরাধে পিতা পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। একই দিনে রাজার নির্দেশে অসংখ্য গুণী জ্ঞানী মানুষকে নৌকা ভর্তি করে মাঝ দরিয়ার ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
হেমিলটন বুকানন লিখেছেন, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলার নেতৃস্থানীয়রা শেখের চত্তরে ভিড় জমায়। নূর কুতুবুল আলম দ্বিরুক্তি না করে জৌনপুরের সুলতানের প্রতি বিপর্যস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের আমন্ত্রণ জানান। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম সসৈন্যে ফিরোজপুর উপকণ্ঠে এসে ডেরা গাড়লেন। রাজা গনেশ মুসলিম সৈন্যদের প্রতিরোধের দুঃসাহস করলেন না। রাজা গনেশ নূর কুতুবুল আলমের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। শেখ বললেন, রাজা গনেশের ইসলাম গ্রহণ ছাড়া জৌনপুরের সেনাবাহিনী প্রত্যাহত হবে না। প্রথমত রাজা গনেশ সম্মত হলেও তার স্ত্রীর প্ররোচনায় ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে পিছিয়ে গেলেন।
বিনিময়ে তার পুত্র যদুকে ইসলামে দাখিল করলেন। শায়েখ যদুকে ইসলামে দীক্ষিত করে নতুন নাম দিলেন জালাল উদ্দিন। জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে জৌনপুরের সৈন্যরা বাংলা ত্যাগ করে। বাংলা থেকে জৌনপুরের সৈন্য প্রত্যাহারের পর রাজা গনেশ পুনরায় স্বরূপে আবির্ভূত হলেন, নতুন করে শুরু হল মুসলিম নিপীড়ন। রাজা গনেশ তার ধর্মান্তরিত সন্তান যদুকে ব্রাহ্মণদের পরামর্শে প্রায়শ্চিত্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করানোর উদ্যোগ নেন। তার মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ড এমনই ভয়ংকর হয়ে উঠে যে নূর কতুবুল আলমের পুত্র শেখ আনোয়ারকে ফাঁসীতে ঝুলানো হয়। এই একই দিনে গনেশ বিরোধী ক্ষোভ তীব্র হয়ে এমন ভয়াবহ রূপ নেয় যে, তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে গনেশ উল্টে যায়। রাজা গনেশ শুধু উৎখাতই হলেন না তাকে হত্যা করা হল এবং জালাল উদ্দিন মুহাম্মদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া হল। রাজা গনেশের পুত্র নব দিক্ষীত মুসলমান জালাল উদ্দিন দক্ষ সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তিনি পুনরায় বাংলার সালতানাতকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করালেন। বাংলার ভিন্নমুখী স্রোত আগের মতই প্রবাহিত হতে শুরু করে।
শ্রীচৈতন্যের সাংস্কৃতিক আন্দোলন
গণেশের রাজনৈতিক অভ্যূত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর বর্ণহিন্দুরা সাংস্কৃতিত পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করে। সুলতানী আমলের শেষদিককার বিদ্যাৎসাহী মুসলিম সুলতানগণ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্হাদি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ প্রদান করেন। শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্হ মুসলিম শাসকদের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত থেকে ভাষান্তর ও বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা হয়।
সমসাময়িক দুনিয়ার সবচে’ সমৃদ্ধ ভাষা আরবীতে তখন তাফসীর, হাদীস. উসুল, তর্কবিদ্যা, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থণীতি, কাব্য সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিপুল গ্রন্হরাজি মজুত ছিল। মুসলমানদের সুষ্ঠু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠনের উপযোগী এই বিশাল জ্ঞান-ভাণ্ডার জনগণের সামলে তুলে ধরার কোন ব্যবস্থাই এ সময় করা হয়নি। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের মুখের ভাষা বাংলা যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করে। কিন্তু তাদের তৈরি বাংলা সাহিত্য এমন একটি রূপ লাভ করল, যেখানে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের যথার্থ প্রতিফলন ছিল না।
সুলতানদরে পৃস্ঠপোষকতায় সৃষ্ট মঙ্গল-কাব্যের প্লাবনে সাধারণ মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়। রাষ্ট্রকে নির্মাণ করার পাশাপাশি জাতি গঠনের কাজে শাসকদের সম্যক সচেতনতার অভাবে এবং তাদের সাংস্কৃতিক অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে স্বাধীন সুলতানী আমলের শেষভাগে হিন্দুদের সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনে প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়।
শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণববাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন এমনি পটভূমিতে পরিচালিত হয়েছিল। চৈতন্য সম্পর্কে রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর গ্রন্হ ‘বাংলাদেশের ইতিহাস: মধ্যযুগ’-এর লিখেছেনঃ
“তিন শত বছরের মধ্যে বাঙালি ধর্ম রক্ষার্তে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই- মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংসের অসংখ্য লাঞ্ছনা ও অকথ্য অত্যাচার নীরবে সহ্য করিয়াছে। চৈতন্যের নেতৃত্বে অসম্ভব সম্ভব হইল”। (পৃষ্ঠা ২৬১)
চৈতন্যের আবির্ভাবে বাংলার হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। তাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ সময় যুগান্তাকারী বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। বহু হিন্দু লেখক চৈতন্যের জীবন ও দর্শন নিয়ে সাহিত্য রচনা করেন। বৈষ্ণব-চিন্তা ও ভাবধারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমগ্র অঙ্গনকে প্লাবিত করে।
এই হিন্দু পনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের মোকাবিলায় কোন কর্মপন্হা সে সময় মুসলিম সমাজে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। এ শূণ্যতার কারণে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতাবোধেরও জন্ম হয়। এ কারণে বৈষ্ণব কবি-সাহিত্যিকদের বিরাট মিছিলে এক শ্রেণীর মুসলমান কবিও গা ভাসিয়েছিলেন। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ভাষায় এরা ছিলেন “বাঙ্গালার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি”।
প্রেম ও ভক্তির ধর্ম প্রচারের নামে চৈতন্যের নেতৃত্বে ‘পাষাণ্ডি’ বা মুসলমান সংহারের আওয়াজ তোলা হয়। এ ছাড়া চৈতন্যের ধর্মাদর্শের আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল আদিরস। স্বকীয়া প্রেমের তুলনায় পরকীয়া প্রেমকেই চৈতন্য বেশি ঝাঁঝালো মনে করতেন। হিংসা ও সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি এবং রজকিনী প্রেমের আদিরস সঞ্চার করে চৈতন্য নিম্নবর্ণ হিন্দুদের একটি বড় অংশকে ইসলামের প্রভাব-সীমা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হন। এ সাফল্য প্রসঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মন্তব্য করেছেনঃ
“শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব না হলে জাতিভেদের জন্যই কিছু উঁচু-বর্ণের হিন্দু ব্যতীত সকলেই মুসলমান হয়ে যেত”।
হিন্দু সাংস্কৃতিক পনরুজ্জীবন আন্দোলনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলমানদের বিরুদ্দে চরম ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচার। শ্রী চৈতন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসার বাণী প্রচার করেন। তা তাঁর শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার জন্ম দেয়। বাংলায় সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির এটি ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। শ্রীচৈতন্যের বড় হাতিয়ার ছিল হিংসা ও সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি, আর পরকীয়ার রজকিনী প্রেমের আদিরস সঞ্চার। চৈতন্যের হিংসানীতির শিকার হয়েছিলেন নবদ্বীপের কাজী। কাজীর বাড়িতে হামলা চালানোর মিছিলে চৈতন্য নিজেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এ হামলা হলো ‘উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রথম ঘটনা’।
চৈতন্য তার শিষ্য রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী নামক দুই ভাইয়ের সাহায্যে সুলতাতন হোসেন শাহের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র করেন। এ ষড়যন্ত্র ধরা পড়ার পূর্ব পর্যন্ত হোসেন শাহও চৈতন্যের আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
চৈতন্যপন্হিদের সাংস্কতিক আন্দোলনের প্রকৃতি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে চৈতন্যের ব্যর্থতার ওপর আলোকপাত করে মওলানা আকরাম খাঁ লিখেছেনঃ
“ছোলতান হোসেনের প্রাথমিক দোষ-দুর্বলতার সুযোগ লইয়া, গৌড় রাজ্যের সাধু-সন্যাসীরূপী বৈষ্ণব জনতা বাংলাদেশ হইতে ইসলাম ধর্ম ও মোছলেম শাসনকে সমূলে উৎখাত করিয়া ফেলিবার জন্য যে গভীর ও ব্যাপক ষড়যন্ত্রে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, ছোলতান ও স্থানীয় মোছলেম নেতাদের যথাসময়ে সতর্ক হওয়ার ফলে তাহার অবসান ঘটিয়া যায়।……….. চৈতন্যের দেব এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বিফল মনোরথ হইয়াই বিদেশ যাত্রা করিয়াছিলেন এবং তাহার পরে এমন আশ্চার্যরূপে উধাও হইয়া গিয়াছেন যে, ভক্তরাও তাহার শেষ জীবনের ইতিহাস সম্বন্ধে কোন সংবাদই দিতে পারেন নাই। কেহ বলিতেছেন অন্তর্ধান, কেহ বলিতেছেন সমুদ্রে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া মৃত্যুবরণ ইত্যাদি”। (মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস , পৃষ্ঠা ১১০)
মুক্ত বুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
No comments:
Post a Comment