ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব পাঁচ...
দ্রাবিড় জাতি বাংলার ভূমি পুত্র এবং বাংলার মুসলমানরা বহিরাগত নয়॥
বাংলাদেশের মুসলমানদের ও ইসলামের ইতিহাস ॥
সূফি বরষণ
ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকেই আরব বণিকগণ বাণিজ্যের জন্য ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী বন্দরগুলোতে যাতায়াত করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি এ উপমহাদেশের আদি নাম সিন্দ ও হিন্দ পর্যন্ত আরবদের দেওয়া। আরব বণিকরা মালাবার হয়ে চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেন। চট্টগ্রাম ও মেঘনা তীরের চাঁদপুর ছিল নদীবন্দর। এখান থেকে তারা চন্দন কাঠ, মসলা, সূতী কাপড় ইত্যাদি ক্রয় করে নিয়ে যেতেন। ইতিহাসে এসেছে হজরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেও দক্ষিণ আরবের সাবা কওমের ব্যবসায়ীরা পালতোলা জাহাজে করে এদেশে আসত। ওই সাবা কওমের নামানুসারে নামকরণকৃত শহর সাবাউর (উর অর্থ শহর) সাবাউর অর্থাত্ সাবাদের শহর আজও ঢাকার অদূরে সাভার নামে পরিচিত হয়ে এদেশে সাবা কওমের আগমন স্মৃতি বহন করছে।এছাড়া বাররুল হিন্দ (ইন্ডিয়ার ভূখন্ড) বা বরেন্দ্র ভূমির কথা তো সর্বজনবিদিত। ঈসায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাক-ভারত ও বাংলাদেশ উপমহাদেশের ব্যাপকভাবে প্রথম ইতিহাস লেখন মওলানা মিনহাজুদ্দীন সিরাজ উত্তর বাংলাদেশকে ‘বাররিন্দ’ বলেছেন। যা পরে ‘বরেন্দ্র’ নামে পরিচিত হয়েছে। এ অঞ্চলকে ‘বাররিন্দ্র’ বলার কারণ ছিল এই যে, আরবরা বিশাল সমুদ্র, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জহাজে ভেসে ভেসে বহুদিন পর বঙ্গদেশে তদানীন্তন হিন্দের মাটি বা স্থল দেখে আনন্দে নেচে উঠে চিৎকার করে বলত ‘বাররি হিন্দ’ অর্থাত্ হিন্দের মাটি, যা পরবর্তীকাল বাররিন্দ বা বরেন্দ্রতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
তরুণ গবেষক ও সাংবাদিক নুরুনবী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে অধিকাংশই দ্রাবিড় জাতির বংশধর, আর দ্রাবিড়রাই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্র॥ দ্রাবিড়রাই সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে॥ যদিও পরবর্তিতে আরো নানা জাতির আগমন ঘটেছে তবে সেটা সংখ্যায় অনেক কম॥ দ্রাবিড় জাতির বসবাস শুরুর প্রায় ২ হাজার বছর পর ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য জাতির আগমন ঘটে॥ আর এই আর্য জাতিই ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ধর্ম নিয়ে আসে॥ তবে আর্য জাতির প্রভাব-প্রতিপত্তি-বংশ বিস্তার মূলত উত্তর ভারত কেন্দ্রিক ছিল॥ আর্যদের মাধ্যমে যেমন হিন্দু ধর্মের আগমন ঘটে তেমনি আরব, পারস্য আর মুঘলদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার এবং প্রসার ঘটে॥ তবে বৌদ্ধ ধর্মের জন্ম ভারতীয় উপমহাদেশেই॥
দ্রাবিড় জাতির বংশধর বাংলাদেশী জনগনের মধ্যে ইসলামের প্রচার এবং প্রসার হয় দুইভাবে ১. সমুদ্র পথে: আরব দেশের সাথে বাংলাদেশের চিটাগাং অঞ্চলের ব্যবসায়িক যোগাযোগ হাজার হাজার বছরের পুরানো ,আর এই পথ দিয়েই আরব ব্যবসায়ী, সূফি সাধক এবং ইসলামের দা'য়ী দের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার এবং প্রসার ঘটে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের অনেক আগেই চিটাগাং দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে॥ মূলত বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এই তিন দেশের মধ্যে তুলনা করলে বাংলাদেশেই ইসলামের আগমন ঘটে প্রথমে॥ দক্ষিন এশিয়ার প্রথম মসজিদটিও নির্মিত হয় বাংলাদেশেই॥ সাহাবীদের যামানাতেই হিজরী ৬৯ সালে বাংলাদেশে একটি মসজিদ নির্মিত হয়॥ বাংলাদেশে যারা প্রথমদিকে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা:) সহ রাসুল (সা:) এর চারজন সাহাবী, বায়েজিদ বোস্তামী (মৃত্যু ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ), মাহমুদ শাহ মাহীসোওয়ার (মৃত্যু ১০৪৭ খ্রিস্টাব্দ), শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমি (মৃত্যু ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দ), বাবা আদম শহিদ (মৃত্যু ১১১৯ খ্রিস্টাব্দ), শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশিকান. ২, স্থলপথে ইসলামের আগমন: স্থলপথে যারা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন তারা দিল্লি-উত্তর প্রদেশ এবং বিহার হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন॥ আব্বাসীয় শাসনামলে মুসলমানদের একটা গ্রুপ স্থলপথে বাংলাদেশে আসেন, এছাড়া বাংলার প্রথম মুসলিম শাসক বখতিয়ার খিলজিও স্থলপথেই বাংলাদেশে আসেন॥ তবে সমুদ্র পথে আগতরাই মূলত বাংলাদেশে ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছেন॥ ইসলামের আগমনে নৃতাত্তিকভাবে দ্রাবিড় জাতি, ধর্ম বিশ্বাসে বৌদ্ধ, অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী এবং হিন্দুরা ক্রমান্বয়ে ইসলামে আসতে থাকে এবং এক পর্যায়ে মুসলমানরা বাংলায় মেজরিটি হয়ে উঠে॥ বাংলার মুসলিম মেজরিটি অংশ নিয়েই আজকের বাংলাদেশ, অপরদিকে হিন্দু মেজরিটি অংশ স্বেচ্ছায় বাংলার মায়া ত্যগ করে আর্য-ভারতীয় জাতীয়তাবাদে নিজেদেরকে বিলীন করে দেয়॥ তারা বাংলাদেশের কেউ নয় এরা ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সাথে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ॥ এবং এরাই যুগে যুগে বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস বিকৃত করেছে এবং প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে ॥
এই
বিষয়ে একটু পরিষ্কার করে বলি , বাংলাদেশের ইতিহাসকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় অষ্টম শতক থেকে। এর পূর্বের ইতিহাস আছে, কিন্তু তা সুস্পষ্ট নয়। তখন সুস্পষ্টভাবে এবং বিশেষ ধারাক্রম অনুসারে এ অঞ্চলের কর্মকাণ্ড প্রবাহিত হয়নি। সুতরাং সে সময়কার কথা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার কোন প্রয়োজন হয় না। অষ্টম শতক থেকে পাল রাজত্বের আরম্ভ। তারা এ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজ্য শাসন করতেন। তাদের আমলে সুস্পষ্ট এবং শৃঙ্খলিত কোন নগরজীবন গড়ে ওঠেনি। এর ফলে সে সময়কার সংস্কৃতি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়েছিল। নৃত্য, গীত এবং লোকরঞ্জনের বহুবিধ উপকরণ সকল মানুষের আচরণবিধি এবং জীবনযাপনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। পালরা যেহেতু বৌদ্ধ ছিল, সুতরাং তারা মানুষে মানুষে বিভাজনমানত না॥এসব ইতিহাস রচনা শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স পর হতে॥ বর্তমানে আমরা বাংলার ইতিহাস এবং বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস যতটুকু জানতে পারি তার বড় অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ॥ এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা রবীন্দ্র ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং হিন্দু ঐতিহাসিক ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ইতিহাস বা মুসলমানদের ইতিহাস লেখেনি বা উদ্যোগ গ্রহণ করেনি॥?
ঐতিহাসিকদের মতে উপরোক্ত প্রেক্ষিতে ইসলামের শুরুর দিকেই আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমেই এদেশে প্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। বাণিজ্যের পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে তারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন। যার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সঃ এর জীবদ্দশায় হজরতের চাচাত মামা হজরত আবু ওক্কাস উহাইদ বিন মালেকসহ ৪জন সাহাবা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মিয়ানমারের আরাকান এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তাঁরা এখান থেকে চীন পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেছিলেন। চীনের ক্যান্টন সমুদ্রতীরে অবস্থিত সাহাবী আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের মসজিদ ও কবর সে সাক্ষ্যই দেয়। অষ্টম-নবম শতাব্দীতে সন্দীপ, রামুসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বণিক ও মুবাল্লিগরা ইসলাম প্রচার করেছিলেন বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
তৎকালীন আরব লেখকদের বর্ণনায় সামরূপ (কামরূপ-আসাম) ও রাহমি রাজ্যের কথা এসেছে, যা ৮ম-১২শ শতাব্দীর পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজশাহী পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও কুমিল্লার ময়নামতিতে প্রাথমিক আব্বাসীয় যুগের মুদ্রা পাওয়া গেছে। সম্প্রতি লালমণিরহাটে (সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের মজদের আড়া গ্রামে) ৬৯ হিজরীতে নির্মিত একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। উপকূলীয় চট্টগ্রাম ( شاطئ الغنغ-গঙ্গা উপকূল) ও নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানের নাম ও ভাষায় আরবী অপভ্রংশের প্রচুর উপস্থিতি এসব নিদর্শনকে আরো সপ্রমাণিত করে। ইসলাম প্রচারের কাজে এদেশে প্রচুরসংখ্যক আরব, ইরানি ও তুর্কি মুসলমান ও সুফি দরবেশের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা ব্যাপকভাবে এদেশে বসতি স্থাপন করেন। তাদের বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। সুতরাং এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, এদেশের মুসলমানরা সবাই তফসিলি হিন্দু বংশধর নয়। হিন্দুদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদেরও অনেকইে ছিলেন রাজ পরিবারের সদস্য। অন্যদিকে, আরবরা এদেশে এসেছেন ব্যবসায়ী হিসেবে আর সে সময় ব্যবসায়ী অর্থাত্ সাওদাগররা ছিলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্মানিত ব্যক্তি। চট্টগ্রামে ঐ সময় একটি মুসলিম রাজ্যও স্থাপিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এদিকে ভারত থেকে বাবা রতন আল-হিন্দ অথবা রতন আবদুল্লাহ আল-হিন্দ মদিনায় গিয়ে রাসুল সা. এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বলে জানা যায়। শুধু তাই নয়, মালাবারের অনুগত চেরদেশের রাজা চেরম রাসুল সাঃ এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলেও জানা যায়।
সুতরাং বলা যায় যে, হিজরী প্রথম দিকেই বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটেছিল। তবে ঐ সময় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এতদঞ্চলে যারা আগমন করেন তাদের বিস্তারিত বর্ননার ক্ষেত্রে ইতিহাস নীরব। পরবর্তীকালে আগতদের মাত্র কয়েকজনের নাম জানা যায় যারা মূলতঃ মধ্যএশিয়া ও পারস্য থেকে এ দেশে আগমন করেন। শাহ মুহাম্মাদ সুলতান বলখী (১০৪৭খৃ.-বগুড়ার মহাস্থান), শাহ মুহাম্মাদ সুলতান রূমী (১০৫৩ খৃ-নেত্রকোনা), বাবা আদম শহীদ (১১১৯খৃ-মুন্সীগঞ্জ), শাহ মখদুম রুপোশ (১২৮৯খৃ.-রাজশাহী), শাহ নিয়ামত উল্লাহ বুতশিকন (১১২০ খৃ. ঢাকা), জালালুদ্দীন তাবরীযী (১২০৫খৃঃ), তাকীউদ্দীন আল-আরাবী (১২৫০খৃঃ-ধামুরাইরহাট,নওগাঁ), শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (১৩০০ খৃঃ- সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ), শাহজালাল (১৩০৩-সিলেট) প্রমুখ মুবাল্লিগের নাম ইতিহাসে এসেছে যাদের দা‘ওয়াতী তৎপরতায় বর্ণবৈষম্যে অত্যাচারিত ও শাসক নিপীড়নে বিপর্যস্ত হিন্দু ও বৌদ্ধরা ব্যাপকহারে দলে দলে ইসলামের শান্তি ও ন্যাবোর্তা গ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয় এ সময় অনেক শাসক ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলাম প্রচারে ব্যাপক সহযোগিতা করেন। আবার অনেকে ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ করে মুবাল্লিগদের বিতাড়িত করার জন্য অস্ত্রধারণ করেন। অনেক মুবাল্লিগ এ সময় তাদের হাতে প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে বাবা আদম শহীদের নাম উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় মুবাল্লিগ ও নওমুসলিমরাও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে এসব রাজাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। ১৩০৩ সালে বিখ্যাত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহঃ) ৩৬০ জন সঙ্গীসহ রণপ্রস্ত্ততি নিয়েই দিল্লি থেকে সিলেটে আগমন করেছিলেন এবং অত্যাচারী রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করেন। তাঁর উন্নত চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে বাংলার হাজার হাজার হিন্দু-বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
সুফী সাধকদের আগমনঃ
ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনাকালে তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের আগেই অর্থাৎ ১১৭১-৭২ সালের দিক থেকে বাংলার মুসলামানরা ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐ সময় সিংহলের প্রধান সেনাপতি বাংলার পান্ডুয়া আক্রমণ করলে তার কাছে উপহার সামগ্রী আনয়নকারীদের মধ্যে মুসলমানরাও ছিল। তদানীন্তন বাংলার একটি অঞ্চল বিক্রমপুরে এক সময় (১১৬০-১১৭৮) সাল পর্যাপ্ত রাজত্ব করতো রাজা বল্লাল সেন। তার অত্যাচার ও ইসলাম বিরোধিতা বন্ধ করার জন্য বিক্রমপুরের মুসলিম অধিবাসীদের আমন্ত্রণে বাবা আদম শহীদ নামের একজন সুফী সাধক সাড়ে সাত হাজার শিষ্য নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে সমুদ্র পথে বিক্রমপুরে আগমন করেন এবং বল্লাল সেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে বাবা আদম শাহাদত বরণ করেন। তাঁর শাহাদতের পরপরই অবশ্য বল্লাল সেনের মৃত্যু হয়। বাবা আদম শহীদের প্রকৃত নাম ছিল শেখ মহিউদ্দীন আবু ছালেহ আরাবী। বিক্রমপুরের রামপালে আজও তাঁর মাজার বিদ্যমান।
কোন কোন পন্ডিত ‘মাকাতুল হোসেইন’ নামক একটি গ্রন্থের লেখক সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত বাংলা কবি মোহাম্মাদ খানের বরাত দিয়ে লিখেছেন, ‘কয়েকজন মুসলিম মাহীসওয়ার দরবেশ তুর্কী বিজয়ীদের আগেই বাংলায় আগমন করেন। মাহীসওয়ারদের মধ্যে আবর থেকে চট্টগ্রাম আগমনকারী একজন ছিলেন প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এর পরিবারের সদস্য। মাহীসওয়ারদের সঙ্গী হয়ে জনৈক পীর হাজী খলিল বিশ্ব ভ্রমণে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি সিংহের চামড়া পরিধান করে একটি মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করে চট্টগ্রাম পৌঁছেন। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ অবশ্য মাহীসওয়ারদেরকে মৎস্য সদৃশ বিশেষ যানবাহী বলে উল্লেখ করেছেন। চট্টগ্রাম অবস্থানকালে মাহীসওয়ারদের একজন এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পর তিনি ফিরে যান বটে তবে তার স্ত্রী ও পোষ্যরা চট্টগ্রামে থেকে যায়।
এ
জাতীয় ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, আরবদের সাথে বাংলার মুসলমানদের যোগাযোগ বাংলায় মুসলামানদের রাজনৈতিক বিজয়ের বহু পূর্ব থেকে এবং তা আধ্যাত্মিক ও বাণিজ্যিক উভয় কর্মধারায়। বলা বাহুল্য, মুসলিম সুফী, সাধকদের এ অঞ্চলে পদচারণা ও কর্ম তৎপরতাই দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয়াভিযানে সাফল্যের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। ইতিহাসে এরকম তথ্যও পাওয়া যায় যে, বাংলার সাথে আরব-ইরানের সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় একেবারে প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে। পর্তুগীজ লেখকরা উল্লেখ করেছেন যে, এ ব্যাপারে আরব ও পারসিক বণিকদের সাথে পর্তুগীজ বণিকদের রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
এবার আসি এই দীর্ঘ আলোচনার আদি পর্বে, যে ইতিহাস আমাদের জানা অতি জরুরি ॥ এই পর্বে আপনারা জনতে পারবেন আমাদের আদি পূর্ব পুরুষ দ্রাবিড় জাতি কথা॥
যারা বাঙালীকে তার বাঙালীত্ব নিয়ে আলোচনা করে তা কেবল খ্রিষ্টিয় দশম শতাব্দীর অনেক পরে এসে চৈতন্য দেবের নিশ্বাসকে অনুকরণ করেছে মাত্র। আর যারা বাঙালী জাতীয়তাবাদকে নিয়ে আলোচনা করে তাদের একটি বড় অংশ বঙ্কিম-বিবেকানন্দ নিয়ে শুরু করে শেষ করে রবীন্দ্র-সুনিতিকুমারের হাত ধরে। ফলে বাঙালী আলোচনার স্তরে স্তরে জুড়ে বসে ভিত্তিহীন যুক্তি। বহু এবং অনেক মুন্যবান সংস্কৃতির ধারক ও বাহক লোকজ ব্যক্তির দেহকে বাদ দিয়ে তার ভাষাকে ভিত করে তৈরি করতে চায় গোটা মানব জাতি। তাই হাজার বছরের বাঙলীর ইতিহাসই মানুষ লিখে গেছে কিন্তু হাজার হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাস কেউ লিখতে সাহস পায় নি॥ আর এদিকে বাঙালীর জাতীয়তাবাদের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে আমাদের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম স্যার কেবল ১৮৮৫ সালের পরবর্তি বাঙলার ইতিহাসকেই পূঁজি করতে পেরেছেন॥ ভাগ্যিস অলপীয়-বেদবাদী-ব্রাহ্মণ্য-উচ্চ শ্রেণীর বাঙালীরা আমাদের আধ্যাপক স্যারকে আশীর্বাদ করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি মাত্র ১৫০ শ বছরের পুরনো বাঙালী জাতীয়তাবাদ ধারনাকে অনেক বড় আকারে লিখতে পেরেছিলেন॥ অধ্যাপক স্যার একটি বারের মত চিন্তা করলেন না, গঙ্গা যদি পদ্মাকে না পেতো, ব্রহ্মপুত্র যদি শান-পো কে না পেতো তাহলে সে আসাম হয়ে যমুনাকে পেতো না। এতে হাজার হাজার টন পলি-বালি উপর থেকে এসে নিম্নাঞ্চল ভরাট হয়ে আজকের বাঙালীও হতো না এবং তার জাতীয়তাবাদও হতো না। হতো কেবল চর্য্যাপদ ভাষার জনগোষ্টী অহমীয়া-উডিয়া মিলে প্রাচীন আসুরের দেশ। এখন হাজার হাজার টন পলি-বালি দিয়ে ভরাট হওয়া নতুন স্থানটিতে একটি নয়া রাষ্ট্র হয়॥
প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়,, প্রায় চারহাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গেছে । ইন্দো-আর্যদের আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকে । এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল । অঙ্গ বঙ্গ এবং মগধ রাজ্যের বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় অথর্ব বেদে প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল । মগধ ছিল একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য । মগধের কথা রামায়ন এবং মহাভারতে পাওয়া যায় । বুদ্ধের সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি । মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার ছেলে অজাতশত্রুর(রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে॥ বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ জায়গাই মগধের ভিতরে ছিল॥
একটু তত্ত্বগত বিশ্লেষণ ,, বাংলা বা বেঙ্গল শব্দগুলির অবিকল আদি হচ্ছে অজ্ঞাত, কিন্তু বিশ্বাস করা হয় যে শব্দটিBang, একটি দ্রাবিড়ীয়-ভাষী উপজাতি (tribe) থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। Bang গড়পড়তা ১০০০ খ্রিস্টপুর্বে ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত করেছিলেন।অন্য তত্ত্ব বলছে যে শব্দটি ভাঙ্গা (বঙ্গ) থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে, যেটি অস্ট্রীয় শব্দ "বঙ্গা" থেকে এসেছিল, অর্থাৎ অংশুমালী। শব্দটি ভাঙ্গা এবং অন্য শব্দ যে বঙ্গ কথাটি অভিহিত করতে জল্পিত (যেমন অঙ্গ) প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়, যেমনঃ বেদ,জৈন গ্রন্থে, মহাভারত এবং পুরাণে । "ভাঙ্গালা" (বঙ্গাল/বঙ্গল)-এর সবচেয়ে পুরনো উল্লেখ রাষ্ট্রকূট গোবিন্দ ৩-এর নেসারি প্লেট্সে উদ্দিষ্ট (৮০৫ খ্রিস্ট-আগে) যেখানে ভাঙ্গালার রাজা ধর্মপালের বৃত্তান্ত লেখা আছে। প্রাচীনকালে বাংলা ভূখন্ডে চারটি জাতি চার দিক দিয়ে প্রবেশ করে॥
১.
আদ্য অস্ট্রালয়ডেরা একটি বঙ্গের সবচেয়ে প্রথম অধিবাসী। ২.দ্রাবিড়ীয় জাতি দক্ষিণ ভারত থেকে বঙ্গে প্রবেশ করেছিলেন,॥ ৩. যখনতিব্বতী বার্মিজ জাতি হিমালয় থেকে প্রবেশ করেছিলেন,॥
৪.
ইন্দো-আর্য জাতি প্রবেশ করেছিলেন উত্তরপশ্চিম ভারত থেকে।
হাজার হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় এই চারটি জাতির সংযোজনের ফলে আজকের বাঙালী জাতির গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় ॥ অখন্ড বঙ্গদেশ পরিচিত ছিল গৌড়, বরেন্দ্রী, রাঢ়, সমতট, বঙ্গ ইত্যাদি জনপদের নিজস্ব নামে। অনার্যদের এ দেশে আর্যরা প্রথমে রাঢ়ে এবং পরে বরেন্দ্রীতে এসে বসতি স্থাপন করে খৃষ্টের জন্মের পূর্বে। যে বিস্তীর্ণ জনপদের সমষ্টিকে বঙ্গদেশ বলা হত তা ছিল এক বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের পরিচিতি।
পণ্ডিতরা ‘জাতি’ কে নিয়ে এখনো কেউ কোন বিশিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারে নি। তাহলে জাতির উপর ভিত করে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাও তেমনটি একটি বিশিষ্টহীন চিন্তার মতন আরেকটি চিন্তা। তবে নৃতাত্বিক পর্যায় আলোচনায় আমরা এমন এক জনসমষ্টিকে বুঝি যাদের সকলের মধ্যে একটি অভিন্ন শারীরিক মিল বা অবয়বগত বিশিষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। তাহলেই আমরা জাতির বিমুর্ত সংজ্ঞাকে মুর্ত করে তুলতে একটি চেষ্টা চালাতে পারি। তাহলেই আমরা কিছুটা হলেও জাতীয়তার বিচার ও বিশ্লেষণ করতে পারবো।
নৃতাত্বিক পর্যায়গত বিশ্লেষণের মাধ্যমে জাতীয়তার নির্মান কি পদ্ধতিতে হয় তা এখানেই কিছু প্রশ্নের মধ্যদিয়ে এগোতে পারি। সেটা হলো, বাঙালী জাতির অবয়বগত বিশিষ্ট সাদৃশ্য কেমন?
নৃতাত্বিকরা গোটা মানবজাতিকে ভাগ করেছেন বিভিন্ন উপায়ে। তার মুধ্যে মূল ভাগটি হলো[15] জাতির চুল, চোখ এবং তার দেহ কাঠামো ও রং। চুল যদি স্ট্রেইট হয় তাহলে নৃতাত্বিকরা তাদেরকে মঙ্গোলিয়ান জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কোঁকড়ান চুলকে চিহ্নিত করেছেন আফ্রো জাতি হিসেবে। সে হিসেবে বাঙালীদের চুল কেমন, দেহের রং এবং গড়ন কেমন? বাজারে গেলেই বুঝা যায়। এরা বাঙালী নাকি তুর্কি-পাঠান,ইরান-তুরানী, মুঘল-মোঙ্গল, হাফসী-আফ্রো বামন শেখ রক্তের মিশ্রণ!
ভারতে প্রথম নৃতাত্বিক জরীপ হয় ১৯০১ সালে। এই কাজে কর্তা স্যার হারবার্ট রীজলিকে সহযোগিতা করেন ভারতীয় নৃতত্ব-বিভাগ। জরিপটি প্রকাশের পর ভারতীয়দের জাতি উৎস নিয়ে বেশ গাত্রে লাগে এবং দাবীর মুখে ব্রিটিশ-ভারত পুনঃ জরীপের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে চিপ কমিশনার মিস্টার হাট্টন এবং ভারতীয় নৃতত্ববিদ ড বিরজাশঙ্কর গুহ মিলে একটি সংশধনী রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এটাই এখন বহুল প্রচলিত এবং ব্যবহৃত ভারতের নৃতত্ব বিষয়ক রিপোর্ট।
সেই পরিশোধিত রিপোর্টের সিদ্ধান্তসমূহ ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতির উপর যে নতুন আলোকপাত করেছে, তার ফলে কেবল ভারতের সীমান্তবর্তি উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যেই বেশ জোরালো কয়েকটি বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক পর্যায় বিদ্যমান আছে। তাদেরকে ইউজেন ফিশারের ভাষায় “নিকট-প্রাচ্যের” বা “নিয়ার ইস্টার্ন রেস” বলা যায়। রীজলি তাদেরকে আদিম আগন্তুক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আরও উত্তরে, আফগান জনগণদেরকে চিহ্নিত করেছে “প্রাচ্য জাতি” বা “ওরিয়েন্টাল রেস” হিসেবে। এবং লাদাক অঞ্চল সহ দক্ষিণ-পুর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের জনগণদের চিহ্নিত করেছেন মঙ্গোলীয় হিসেবে। দাক্ষিনাত্যের দ্রাবিড়দেরকে চিহ্নিত করেছেন ভারতের আগন্তুক হিসেবে।
এদিকে নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে প্রাচ্য ভারত তিন ভাগে বিভক্ত। বিহার, বাঙলা এবং উড়িষ্যা। এবং নিম্নশ্রেণীর বাঙ্গালীর মধ্যে রয়েছে প্রাক দ্রাবিড়ের মিশ্রণ। এরা যে বাঙ্গালার আদি বহিরাগত তা ভারতীয় নৃতাত্বিকরা মেনে নিয়েছেন। উচ্চ শ্রেণীর বাঙ্গালীরা হলো অ্যালপাইন পর্যায়ভুক্ত। পামির ও চৈনিক নৃতাত্ত্বিক বিষয়ে নৃতাত্ত্বিক টি এস জয়েস এই অভিমত দিলে অনেক ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক তা মেনে নেয়। সে অভিমত মেনে নিলে বাঙ্গালার উচ্চ শ্রেণির বাঙালীদের নৃ উৎসের মিশ্রণ বা সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে ইন্দো-আফগান অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে। নৃতাত্ত্বিক টি এস জয়েস অ্যালপাইন নৃপর্যায়ভুক্তদের সন্ধান দিয়েছেন পামির এবং তকলামকান মরুদেশের পাশে। এদিকে অ্যালপাইন একেবারে বিশুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থায় পাওয়া গেছে কেবল ওয়াখিস জনগোষ্টিদের মধ্যে।
এর
আগে রীজলির ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক বিষয়ক সমস্ত অভিমত বাঙালী নৃতাত্ত্বিকরা গ্রহণ করলেও একমাত্র বাঙালীদের নৃতত্ত্ব সিদ্ধান্ত মেনে নেয় নি। স্যার রীজলি বাঙালীদের উৎস সম্পর্কে বলেছেন যে, বাঙ্গালীরা হলো, মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় রক্তের মিশ্রণ। এরা ঐতিহাসিককালে বাঙলার বহিরাগত। তবে এখনো কোন বাঙালী নৃতত্ত্ববিদ রীজলির বাঙালী নৃতত্ত্ব বিষয়ক অভিমতকে বৈজ্ঞানিক ভাবে খারিজ করতে পারে নি। কেবল ভাষাকে ভিত করে ভাসা ভাসা ধারণা দিয়ে গেছেন। এই ধরেনর নৃতাত্ত্বিক বনাম ভাষার জটিলতা আমরা কেবল চাকমাদের মাঝেই দেখতে পাই। তবে এখনো নৃতাত্ত্বিকরা বাঙলার অধিবাসির সংখ্যাঘরিষ্টতার জাতিপর্যায়ভুক্ত সিদ্ধান্তে রীজলির অভিমত থেকে দূরে সরে যায় নি।
এদিকে বাঙলার সংখ্যালঘিষ্ট উচ্চ শ্রেণীর বাঙালী হয়ে উঠার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের খুঁজে-কলকাতা কেন্দ্রিক-ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা যে তত্ব ও উপাত্ব কুঁড়ে বের করেছেন তার মধ্যে বাঙালী জাতি “অ্যালপাইন গোত্রের” বা আলপীয় পর্যায়ভুক্ত॥ প্রশ্ন হলো এই উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ্যবাদী আলপীয় পর্যায়ভুক্ত বাঙালী নিয়ে বাঙলার নৃতাত্ত্বিক স্বত্বা তৈরি হয়েছে কিন? যেহেতু এই আলপীয় জাতি বাঙলার অগন্তুক জাতি॥
তাহলে বাঙালায় ছিলো কারা? ভূমিপুত্র কি ছিলো না? এই প্রশ্ন খোদ বাঙলীকে জাতি হিসেবে খোঁজা নৃবিদের। এদিকে ভূমিপুত্র হিসেবে পার্বত্যচট্টগ্রামের পাহাড়িরা হাস্যকরভাবে যে দাবী তুলেছে তাতে টিবেতো-মঙ্গোলয়েড এবং ভোট-বার্মিজ এবং সিনো-টিবেটিয়ানরা এই বাঙালাদেশের আদিম অগন্তুক অধিবাসী ধরে নিতে হয়। তাহলে তো ধরে নিতে হয় রীজলি এবং তার নৃতাত্ত্বিক মতামত একেবারে নির্ভুল। এদিকে প্রাক-দ্রাবিড়রা যেমন কোল, মুন্ডা, সাঁওতাল, ওঁরাও, পাণী এবং দাসদেরকে বাঙালাদেশের আদিম অগন্তুক অধিবাসী হিসেবেও মেনে নিতে হবে। আবার ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা প্রাক-দ্রাবিড় এবং মোঙ্গলয়েডদেরকে নিছু শ্রেণীর বাঙালী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটা অনবেকেই মেনেও নিয়েছেন। প্রাক-দ্রাবিড়দেরকে ওরা এককথায় বাংলাদেশের আদিম অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের আরেকটি নাম হচ্ছে আদি-অস্ট্রাল। অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সাথে আমাদের এই প্রাক-দ্রাবিড়দের রক্ত-দেহ-গঠনে বেশ মিল পাওয়া যায়। এই প্রাক-দ্রাবিড় পর্যায়ভুক জাতির বসবাস বা ব্যপ্তি সেই উত্তর ভারত থেকে শুরু করে একেবারে প্রশান্ত মাহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত ছিল। দক্ষিণ ভারত ছেড়ে সম্ভত কলিঙ্গ, উৎকল-বিহার-মগধ, প্রাকজৌতিষপুর-আসাম, সমতট-হরিকেল হয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া পথ ধরে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছেছেন। এবং বাঙলার আদি অধিবাসীরা এই একই পরিবারভুক্ত। আবার তাদের সাথে মিশে গিয়েছিলো দ্রাবিড়দের রক্ত। আবার এই দ্রাবিড়রা এই অঞ্চলে এসেছিল অলপিয়দেরও বহু আগে। অনেক নৃত্বাত্ত্বিকরা মনে করেন দ্রাবিড়রা ভারতের বহিরাগত। তারা উত্তর ভারত হয়ে প্রবেশ করেছিলো। তাদের সাথে নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত মিল আছে ভূমধ্য অঞ্চলের জনবসতির সাথে। আবার এই “ভুমধ্য” বা “মেডিটেরেনিয়ানদের” সাথে খুব বেশি মিল রয়েছে আদি মিশরীয়দের সাথে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, যেটা এখন বাঙালীর আবাসভূমি হিসেবে “বঙ্গদেশ” নামে অভিহিত হত সেটা প্রাচীন কালে বহু জাতির আবাসস্থল হয়ে বহু জনপদে বিভক্ত ছিল এমন দাবী ঐতিহাসিকদের॥ এখন কথা হচ্ছে বাঙালায় আগন্তুক উচ্চ বর্ণের অধিবাসীরা যদি বাঙালী হয় তাহলে তাদের আগে আসা আদিম আগন্তুকরা কারা? তারাও যদি বাঙালী দাবী করে তাহলে উচ্চ বর্ণের বাঙালীরা তাহলে কারা? দুই আগন্তুক বাসিন্দারা যদি বাঙালী হয় তাহলে এখন যে লড়াইটা সেটা তাহলে কিসের জন্যে? এটা কি আসলে ভুমির লড়াই? নাকি সংস্কৃতির লড়াই। এমনকি আধুনিক কালে এসেও আমরা একই লড়াই দেখতে পাই বাঙালী বনাম বাংলাদেশীদের মধ্যে। আর, লড়াইটা আসলে ভাষার ছিলো নাকি অর্থনৈতিক মুক্তির ছিলো?
উত্তরের মোঙ্গল জাতিরা যখন আসাম-সিলেটে আগমন করে তারও আগে কুমিল্লায় ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-নিষাদ জাতিরা। বাঙলায় যাদের প্রথম বসতি বলে নৃতত্ত্বিকরা অভিমত দেন। গাঙ্গেয় উপত্যকায় যখন পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত বহেমিয়ান শক, হুনরা আক্রমণ চালায় তখন উচ্চ শ্রেণীর বাঙালীরা এই ময়নামতি-লালমাই তথা সমতট অঞ্চলে বসবাস করে বা ছড়িয়ে পড়ে। সময়টা হচ্ছে আড়াই হাজার বছর আগে। তারও আগে অর্থাৎ ১০ হাজার বছর আগে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-নিষাদ জাতিরা এসেছিলো এই ময়নামতি-লালমাই অঞ্চলে। আজকের যে বাঙালী জাতি তা গৌড়ের উত্তর-পশ্চিম থেকে অলপীয়দের বয়ে আনা একটি চিন্তা। সমতটি আদিম জাতির কাঠামোতেই ভর করেছে সংখ্যাগড়িষ্ট আগন্তুক সাংস্কৃতিক ধারা। কিন্তু রক্তে তার এখনো রয়ে গেছে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-নিষাদ চরিত্র। এখানেই উত্তর ভারতের অলপীয় জাতিদের মধ্যে সমতটের অলপীয় জাতির মধ্যে পার্থক্য। আরেকটি পার্থক্য দাঁড়ালো কপালের গড়নে।
ইতিহাস থেক আমরা জানতে পারি যে, এই ময়নামতি-লালমাই অঞ্চলই মূল সমতট। একমাত্র নিম্নগাঙ্গেয় ভূমি এবং পুর্ব ও পুর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলের বেলায় এই সমতট নামটি যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ পুণ্ড্রবর্ধনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পুর্ব অঞ্চল।
রক্তের বিশুদ্ধতাবাদী উচ্চ শ্রেণীর বাঙালী এবং ভারতীয়দের সহি সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্যের ভিতর দিয়ে এই প্রাক-দ্রাবিড়দের জাতিগত পর্যায় থেকে নিষাদ হিসেবে দেখেছেন। তাদেরকে অদ্ভুত আচার-ভাষার জাতি হিসেবে দেখেছেন। অচ্চ্যুত হিসেবে এবং পরে ম্লেচ্য হিসেবে শ্লেষাত্বক দৃষ্টে দেখেছেন। এসব আলামত আমরা তাদের রচিত কাব্য-উপাখ্যানে খুঁজে পাই।
চর্যাপদও তাদের একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। কিন্তু আজ চর্যাপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে হাজার বছরের বাঙ্গালা ভাষার পুরাণ। এই চর্যাপদ নাকি এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বাঙলা ভাষার প্রাচীনতম নিদের্শন। ফলে চারিদিকে কলরব-সোরগোল উঠে পড়ে একটি মাত্র আপ্ত বাক্য “হাজার বছরের বাঙালী” নিয়ে। কম করে হলেও নাকি বাঙালী হাজার বছর আগে থেকে বাঙলা ভাষায় কথা বলে আসছে। কিন্তু চর্যাপদ রচনাকাল বা লিপিকাল বা অনুলিপিকাল বা প্রতিলিপিকাল এবং তার ভাষা নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো অমীমাংসিত। অনেকে বলছেন চর্যাপদ হিন্দি ভাষারও আদিরূপ। আবার অহমীয়া (আসামীদের বা অহমীয়াদের ভাষা হচ্ছে কাছারি, এই ভাষা আবার তিব্বতি ভাষার পরিবারভুক্ত। কিন্তু বর্তমানে অহমীয়া ভাষা ইন্দো- এ্যরিয়ান পরিবারভুক্ত) এবং ওড়িয়ারা দাবী করছে চর্যাপদ তাদেরও ভাষার আদি ভাষা। কিন্তু চর্যাপদের অধিকাংশ ভাষা সংস্কৃত এবং অহমীয়া এমন দাবী পণ্ডিতদের।
বাঙলা ভাষার যে নমুনা আমাদের ভাষাতাত্ত্বিকরা পাচ্ছেন তাতে ব্যপক আলোচনা এবং বিশ্লেষণ বাদ পড়ে গেছে। হয়তো বৈজ্ঞানিক ভাষাতাত্ত্বিকের অভাবে এমনটিই হয়েছে। এদিকে ভাষাত্বাত্ত্বিক সুনীতিকুমার স্বীকার করেছেন তখনকার প্রচলিত সাহিত্যের ভাষা শৌরসেনি প্রচুর অপভ্রংশের প্রভাব ছিলো। ফলে ওড়িয়া এবং অন্যান্য শব্দাবলী চর্যাপদে প্রবেশ করেছে। মধ্যযুগ পুর্বে চর্যাপদের ভাষ্য অনুসারে পদ্মাখালের পাড়ের জনগণদের বলতো বঙ্গাল॥ তারা লুটতে আসতো বঙ্গাল পাড়ায়। বঙ্গাল নারী নাকি সে সময় বেশ লোভনীয় ছিল।
১৪
শতকের দ্বিতীয় ভাগে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এই বিভক্ত জনপদগুলোকে একত্রিত করেন। অঞ্চলগুলোর মধ্যে ছিল গৌড়, বঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্রী, পুন্ড্র, হরিকেল, সমতট, ইত্যাদি। এর মধ্যে গৌড়, বরেন্দ্রী ও বঙ্গ শব্দ তিনটি সর্বাধিক পুরনো। স্থানীয়ভাবে এ অঞ্চলের নাম মুখে মুখে বঙ্গ (বাঙ্গালা) নামে চালু থাকলেও লিখিত রূপে পাওয়া যায় গৌড়ের নাম। নামের ইতিহাসে প্রসঙ্গত, বিখ্যাত নাবিক মার্কো পোলো ভারতবর্ষ ঘুরে গিয়ে তাঁর লেখায় বাঙ্গালা নামটি উল্লেখ করেছেন। আবার বখতিয়ার খিলজী যে মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন তাতে ‘গৌড় বিজয়’ শব্দ দুটি পাওয়া গেছে। আর স্থানীয় ভাষা (বাংলা) সম্পর্কে ইতিহাসবেত্তাদের মত, ‘চর্যাপদে বাংলা ভাষার পুরনো যে নমুনা পাওয়া গেছে তার বয়স এক হাজার বছরের কিছু কম।
১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ জয় করে ‘সুলতান’ উপাধী গ্রহণ করেন। ১৩ শতকের গোড়া থেকে শুরু করে সাড়ে পাঁচশ বছর বঙ্গদেশ মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। অন্যদিকে ১৩/১৪ শতকের আগে বাংলা ভাষা তেমনভাবে বিকাশ লাভ করতে পারেনি। তাই ভাষাস্বত্ত্বায় পরিচিত হতে এ অঞ্চলের লোক বাঙালি বলে ১৮ শতকের পূর্ব পর্যন্ত পরিচিতি লাভ করেনি। যেহেতু জনগোষ্ঠীর গোড়াপত্তনের আপেক্ষিক ক্রম এখন জিন-তত্ত্ববিদগনের গবেষণাধীন, তাই এই বিষয় এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুমান সাপেক্ষ। অতএব আমাদের মানুষের নৃ তাত্ত্বিক পরিচয় বা জন্ম পরিচয় জানতে হলে জিন ডিএনএ পরীক্ষা অতিজরুরী ॥ কারণ ধারণা করা হয় অধুনাতন বাঙালীরা এই জাতিগুলির সংমিশ্রণ। তাই আমাদের গায়ের রং এতো বিভিন্ন বিভিন্ন ধরনের ॥ কেউ সাদা কেউ কালো আবার কেউ সাদা কালোর মিশ্র ???!!! বঙ্গ বলতে যা বোঝায় তা ছিল হাজার হাজার অনুচ্চ টিলার সমন্বয়ে গঠিত জলাভূমি। দেশীয় উচ্চারণে যা ছিল বং। এখানে আল তৈরির মাধ্যমে জোয়ার ভাটার পানি আটকানো হতো বলে সারা জনপদ বং আ
যদিও বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। পাশতুনেরা, এবং তুর্কীরাদেরও সংমিশ্রণ, যাঁরা এইখানে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক ওর তত্-পরবর্তীকালে প্রবেশ করেন। ইরানিরা ও আরবরা মূলতঃ নৌপথে ব্যবসায়িক কারণে উপকূল-সংলগ্ন অঞ্চলে (যেমন চট্টগ্রাম) বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত হন মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে॥
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
তথ্যসূত্র:
[1] ভারতবর্ষ আর বঙ্গালারদেশ কোন অর্থে’ই কোনকালেই এক ছিলোনা, কেননা বাঙ্গালারদেশ বরাবরের মত বাঙ্গালারদেশ’ই, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মত নয় । সম্ভবত সে কারনেই রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও বাঙ্গালার সাথে ভারতবর্ষের কোন মিল নেই। তাই বাঙলার ইতিহাস নিয়ে আমরা যে সব আলোচনা পাই তারমধ্যে একমাত্র নীহাররঞ্জন রায়ের গ্রন্থটিকেই তুলনামূলক ভাবে কম বিতর্কমূলক দলিল হিসেবে পেলেও তবুও অসম্পুর্ন। বাকি গ্রন্থগুলো সেই কলকাতা ঘরানা থেকে মুক্ত হতে পারে নি। তাই বাঙলার ইতিহাসে পুর্ববঙ্গের ইতিহাসকে নিয়ে যে ভাবে অবহেলা আমরা দেখতে পাই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের পরম নমস্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তাই বাঙলার ইতিহাস আজোঅবধি বিতর্কিতভাবে অসম্পুর্ন। এই ইতিহাস এখন নতুন করে লেখার ভার আমাদের নয়া প্রজন্মের।
[2] নির্মলকুমার বসু, “বঙ্গদেশের জাতি ব্যবস্থাঃ কয়েকটি প্রসঙ্গ,” জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ, আইসিবিএস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮,পৃষ্টাঃ ১০৫।
[3] এই আলোচনায় হিন্দু কে ধর্ম হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়নি তাই এই হিন্দু কে একটি সমাজ হিসেবে দেখা হয়েছে। এই আলোচনায় আমরা হিন্দুসমাজ হিসেবে গ্রহণ করবো।
[4] বিবেকান্দের এই বক্তব্যটি সিরাজুল ইসলামের “বাঙালীর জাতীয়তাবাদ” গ্রন্থের পৃষ্টা ১৯ থেকে সংকলিত হয়েছে।
[5] যদিও আওয়ামীলীগ ঘরানার বুদ্ধিজিবিদের অনেকের মতে বাঙ্গালার সুলতানি শাসনামলেই বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিকাশ আর অন্যদিকে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজিবিদের দাবি মধ্যযুগের শেষভাগের আরকান রাজার সভাকবি আলাওল’ই প্রথম বাঙ্গালারদেশি জাতিসত্তার আবিষ্কারক। তবে আরকান রাজার পৃষ্টপোষকতার বদৌলতে আজ বাঙ্গালা ভাষা এবং তার সাহিত্যে যে ব্যপকতা আসে সে সম্পর্কে বললে বেশী বলা হবে না।
[6] সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ-পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্কণ, ভাষার দায় ও দায়িত্ব, পৃঃ ২।
[7] ভারতে কোম্পানি আমলে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বাঙলায় হিন্দু-মুসলিম জাতি ব্যবস্থা শিতিল হয়েছে তা ঠিক নয়, বরং এই জাতিব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্টানগুলির প্রকৃতি নির্ধারনে এক তাৎপর্যপুর্ন ভুমিকাও পালন করেছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, হিন্দুবাদীতামনা বলে অভিযুক্ত করে কংগ্রেস থেকে মুসলিম সামাজ বের হয়ে এসে একটি মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ।
[8] এবনে গোলাম সামাদ, হাজার বছরের বাঙালী, অন্য এক দিগন্ত, জুন সংখ্যা-২০১৫, পৃষ্টাঃ ৫।
[9] ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরুধী আন্দোলন যখন স্বদেশী আনদলনে রূপ নেয় তখন কেবল মাত্র কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু সমাজ এর পেছনে নেতৃত্ব দেয়। পুর্ব বাঙলার কোন হিন্দু সমাজ এই স্বদেশী আনলনে যোগ দেয় নি। বরং পুর্ব বাঙলার হিন্দু সমাজ বাঙলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে ব্রিটিশ গভর্মেন্টের চিরস্থায়ীত্বের জন্যে পার্থনা করেন। এমনকি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেয়ার জন্যে দাক্ষিণ্য প্রাথনা করেন। (দেখুনঃ নির্মলকুমার বসু, “বঙ্গদেশের জাতি ব্যবস্থাঃ কয়েকটি প্রসঙ্গ,” জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ, আই, সি, বি, এস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮, পৃষ্টাঃ ১১৮)
[10] এই দুইজন মারা যায় ১৯০৮ সালে। তারা আসলে বাঙলা রক্ষার নামে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের স্বপক্ষে ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। যা আজ তাদেরকে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মী হিসেবে প্রতিষ্টা দিতে চাচ্ছে। এরা সবাই বঙ্কিমের বান্দেমাতারাম স্বদেশী আন্দোলন করেছিলেন। এরা এখন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের ভাষায় বাঙলা ভাষার জন্যে লড়াইয়ের সেনানী। এদিকে ভারতীয়রা দাবী করছে তারা নাকি ভারতের ফ্রিডম ফাইটার। তাহলে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মূল নায়করা সন্ত্রাসী হিসেবেই ইতিহাসে প্রতিষ্টা পায়। স্বদেশীআন্দোলনের বীজ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনেই নিহিত। তাই এই স্বদেশীআন্দোনের কর্মকাণ্ড ১৯১১ সালের পর সিতিল হয়ে যেতে দেখতে পাই।
[11] বঙ্গভঙ্গ, প্রমথনাথ বিশী, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শতবার্ষিকী সংস্করণ, ব্যাখ্য
[12] নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসঃ রাজন্য কাণ্ড, সম্পাদনাঃ কমল চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম দে’জ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃষ্টাঃ ২৬৮-২৭০।
[13] দেখুন রমাই পণ্ডিতের রচিত শূন্যপুরাণ। এটি একটি পুরাণ ইতিহাসের গুরুত্বপুর্ন দলিল।
[14] হিতেশরঞ্জন সান্যাল, “বাংলায় জাতি’র উতপত্তি”, জাতি, বর্ন ও বাঙালী সমাজ, শেখর বন্দোপাধ্যায় ও অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, “জাতি, বর্ন ও বাঙালি সমাজ,” আইসিবিএস, দিল্লী, জানুয়ারি, ১৯৯৮,পৃষ্টাঃ ২২-২৩।
[15] হাল বা লাঙ্গলের আদি শব্দ হলো ‘হল’, তাই এই প্রবন্ধে ‘হল’ এর স্থলে ‘হলো’ শব্দটি অধিক যুক্তিযুক্ত বলে গৃহীত হয়েছে।
[16] অনেক সময় অনেক পুরুষের রক্তের সংমিশ্রনে চুলের বাহ্যরূপ এবং বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে খণ্ডিত চুলের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা এই আলোচনায় সম্ভব নয়। উৎসাহীরা সাঁ-মার্তার (সেইন্ট মার্টিন) বই পড়ে নিতে পারেন।
[17] পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের অধিকাংশ জনবাসিগনের মধ্যে এই বিশিষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
[18] বৈদিক সাবল্টার্ন বা নিম্নবর্গ তত্বের বিবেচনায় এরা নিচু শ্রেণির।
[19] আল্পস পর্বতমালা বিষয়ক।
[20] বৈদিক সাবল্টার্ন বা নিম্নবর্গ তত্বের বিবেচনায় এরা উচু শ্রেণির বা ব্রাহ্মণ। এরা উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণদের নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত।
[21] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২২, ২৪ এবং ২৫।
[22] ডঃ অতুল সুর তার গ্রন্থ “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” এবং “বাঙালীর নৃতত্বে” কেবল কিছু সাহিত্যিক এবং ইতিহাসগত পুরাতাত্ত্বিক আলোচনা ছাড়া খুব বেশি বৈজ্ঞানিক আলোচনা করেন নি। বাঙালীর ডিএনএ টেস্ট নিয়ে অনলাইন এ বিস্তর বৈজ্ঞানিক জার্নাল আছে। পাঠক চাইলে পড়ে নিতে পারেন। ডিএনএ টেস্ট দাবী করছে অধিকাংশ বাঙালীর নৃতত্ত্ব বিশিষ্টটা পায় টিবেতো- মোঙ্গলয়েড পর্যায়ভুক্ত। তবে ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা রীজলির নিম্ন শ্রেণির বাঙালীদের প্রাক দ্রাবিড়-মোঙ্গলয়েড অভিমতকে গ্রহণ করেছেন।
[23] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২৫।
[24] অতুল সুর, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বিচিত্র বিদ্যা গ্রন্থমালা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭, পৃষ্টাঃ ২৫।
[25] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ২।
[26] ড অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, সাহিত্যলোক, কলকাতা, এপ্রিল ২০১২, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৯। ভারতে আর্য-ভাষাভাষীর দুই বিভিন্ন নরগোষ্টিতে বিভক্ত-(১) অলপীয়, (২) নর্ডিক। তাদের পার্থক্য কেবল মাথার আঁকার এবং কপালে। দেখুনঃ ড অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, সাহিত্যলোক, কলকাতা, এপ্রিল ২০১২, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৪২।
[27] বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, রাঙামাটি, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০১৮, ঢাকা পৃষ্টাঃ ৪৩।
[28] পবিত্র সরকার, ভূমিকা আলোচনা, হরপ্রশাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত “বৌদ্ধ গান ও দোহা”,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, পুনঃমুদ্রণ, মাঘ ১৮১৯।
[29] খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশশ্তিতে সমতট নামটি প্রথম জানা যায়। নামটির মাজেজা হচ্ছে ভুভাগে সমতল নদীতট, উচু নিচু নয়। ফলে নিম্ন গঙ্গেয় ভূমি এবং তার পুর্ব ও দক্ষিণ ভূমিকে বিবেচনা করলে সমতটের সংলগ্ন ভূমিকে বঙ্গাল (প্রচুর জলাভুমি অথবা তুলা উৎপাদনকারী অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পরে এই বঙ্গাল থেকেই বাঙ্গাল, বাঙ্গালা শব্দ এসেছে।
[30] পদ্মা আদিতে কোন নদী ছিলো না। এমনকি সে সময় তার কোন অস্থিত্ব ছিল কিনা ইতিহাসে পাওয়া যায় নি। ডঃ ওল্ডহ্যাম ১৮৭০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে উল্লেখ করেন যে, গঙ্গা নদীর মূলশ্রোত রাজমহলের পাহাড়ে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে গতি পরিবর্তন করে প্রথমে ছোট খনন করা খাল ভগীরথী হয়ে এবং পরে হুগলী নামে কলকাতার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। অনেক পরে ভু-আন্দোলন (সম্ভত বখতিয়ারের দিনাজপুর অবস্থানের ২০০ বছর আগে।) এবং ভগীরথীর তলদেশ পলিবালিতে ভরাট হয়ে পদ্মাদিয়ে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়। সুতরাং পদ্মা নদী হিসেবে তার রূপ আমরা দেখি না। বরং খাল হিসেবেই আমরা ইতিহাসে উল্লেখ পাই।
[31] চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়, পত্রাঙ্ক ৭৩। হরপ্রশাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত বৌদ্ধ গান ও দোহা থেকে সঙ্কলিত।
[32] অশোক বিশ্বাস,বাংলাদেশের রাজবংশীঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠাঃ ১৫-১৭।
[33] অশোক বিশ্বাস,বাংলাদেশের রাজবংশীঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠাঃ ১৯।
[34] পুর্নচন্দ্রদেব বর্মা চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত, প্রথম সংস্করণ-১৯২০, পৃষ্টাঃ ২১৩।
[35] বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন, টি এইচ লিউইন, উয়িলিয়াম হান্টার এবং পিইয়ারের বার্মা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক ইতিহাস গ্রন্থসমূহ।
[36] চট্টগ্রামের মানুষদেরকে চাটগাইয়া বলে।
[37] খন্দকার মুজাম্মিল হক সম্পাদিত সৈয়দ নুরুদ্দিনঃ জীবন ও গ্রন্থাবলী, বাঙলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, ভূমিকা পৃষ্টাঃ ৭। সৈয়দ নুরুদ্দিন চকরিয়া বাসী মধ্যযুগের কবি (১৭২৫-১৮০০)। তার লেখা ‘রাহাতুল কুলুব’ গ্রন্থের বংশলতিকায় উল্লেখ করেন তার পুর্ব পুরুষ গৌড়ের মহামারীতে জীবীকার খোঁজে চট্টগ্রামে চলে আসেন। মধ্যযুগের অনেক কবিদের বংশলতিকায় এ ধরণের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
[38] যে সমস্ত পূজা-পার্বন এখন আমরা রূপান্তরিত ব্রাহ্মণ্য হিন্দু বাঙালীদের পালন করতে দেখি তা মধ্যযুগের শুরুতেও প্রাক-দ্রাবিড়ীয়-আদি-অস্ট্রিক জনগোষ্টির গৃহের অভ্যন্তরে অন্ধকারে পড়ে ছিলো। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বাঙ্গালার পূজা পার্বন নিয়ে লেখা অনেক বিখ্যাত গবেষকদের বই বাজারে পাওয়া যায়। বিনয় ঘোষ, রেবতী বর্মন, ওয়াকিল আহমেদ, কাজী আব্দুল অদুদের অনেক বই এখনো পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষে স্থানীয় অনার্যদের দেবীদের (যেমন দুর্গা,কালি) সাথে আর্যদের দেবতার (শিব) বিয়ে-সংসারের (মনসা,কারতিক,গনেশ) মধ্য দিয়েই মূলত আর্যদের ভারতবাসস্থায়ীকরন এবং সম্ভত এখান থেকেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শুরু বলে অনেক ঐতিহাসিকদের অভিমত।
[39] অতুল সুর, বাঙালার সমাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮২, পৃষ্টাঃ ১।
[40] গঙ্গা শব্দ থেকে গাং শব্দটি উতগত হয়েছে। এই গাং ইউরুপে পৌঁছে হয়ে গেলো বণিক পথ। সুতরাং নদী বিজ্ঞানের কাছে গঙ্গা একটি বণিক পথ মাত্র। প্রাচীন কালে বণিকদের যাতায়াত সুবিধার জন্যেই এই নদীকে খনন করা হয়েছিলো।
[41] পুরাণ মতে, রাজা সাগরের ৬০ হাজার পুত্র ছিল। রাজা সাগরের যজ্ঞের ঘোড়া ইন্দ্র চুরি করে পালিয়ে গিয়ে কলকাতার দক্ষিণে এসে পড়ে। এদিকে রাজা তার ৬০ হাজার পুত্রদেরকে ঘোড়া উদ্ধারের জন্যে মাটি কুঁড়ার নির্দেশ দেন। পুত্ররা মাটি খুঁড়ে কলকাতার দক্ষিণে কপিলমুনির আস্তানায় এসে ঘোড়া খুঁজে পান। মুনিকে চোর মনে করলে কপিলমুনি হুঙ্কার দিয়ে সকলে আগুনে দগ্ধ করেন। এরপর সাগর রাজা ভগিরথ সাগরদ্বীপের দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এসে সাগর রাজার ছেলেদের উদ্ধার করেন।
[42] পুরাণের যুগ যখন শুরু হয় তখন, এক দল দেব-উপাসনা শুরু করে এবং আরেক দল অসুর-উপাসনা শুরু করে। এর পর এই ভুখণ্ডে দুই গোষ্টিতে বিভক্ত হয়ে পড়লো অসুর আর দেব উপাসনার মধ্য দিয়ে।
[43] কৃত্তিবাস, লাইনগুলো কলিম খানের “ঝর্নাধারা থেকে সৃষ্টিধারা” প্রবন্ধ থেকে সংকলিত হয়েছে।
[44] The
colonial British surveyors in India from the late 1700’s, in their quest for
the origin of the Ganga River, have done extensive survey of the Himalayan
region. Some of the illustrious surveyors were Captain Herbert, Rennel and Sir
William Willcocks.
They and the
other surveyors have recorded their findings in journals and book of their
times. In these records, they emphatically and unambiguously state that the
Ganga is not a natural river, but a man made river by the ancients of India. It
started as a canal along with many other canals dug by the ancients.
(See-Ganga: The Sign of Great Endeavour by Parvathy Menon)
[45] The
Asiatic Annual Register: Or, a View of the History of Hindustan, and of the
Politics, Commerce and Literature of Asia, Volume 3. Page 26-27, edited by
Lawrence Dundas Campbell, E. Samuel.
No comments:
Post a Comment