ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব চার.....
বাংলার জনগনের উপরে ব্রাহ্মণবাদী বহিরাগত অত্যাচারী সেনদের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে মুসলমানদের সাহায্য চেয়েছিল বৌদ্ধরা
সূফি বরষণ
বাংলাদেশের ইতিহাসকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় অষ্টম শতক থেকে। এর পূর্বের ইতিহাস আছে, কিন্তু তা সুস্পষ্ট নয়। তখন সুস্পষ্টভাবে এবং বিশেষ ধারাক্রম অনুসারে এ অঞ্চলের কর্মকাণ্ড প্রবাহিত হয়নি। সুতরাং সে সময়কার কথা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার কোন প্রয়োজন হয় না। অষ্টম শতক থেকে পাল রাজত্বের আরম্ভ। তারা এ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজ্য শাসন করতেন। তাদের আমলে সুস্পষ্ট এবং শৃঙ্খলিত কোন নগর-জীবন গড়ে ওঠেনি। এর ফলে সে সময়কার সংস্কৃতি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। নৃত্য, গীত এবং লোকরঞ্জনের বহুবিধ উপকরণ সকল মানুষের আচরণবিধি এবং জীবন যাপনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। পালরা যেহেতু বৌদ্ধ ছিল, সুতরাং তারা মানুষে মানুষে বিভাজন মানত না। ।
এসব ইতিহাস রচনা শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স পর হতে॥ বর্তমানে আমরা বাংলার ইতিহাস এবং বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস যতটুকু জানতে পারি তার বড় অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ॥ এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা রবীন্দ্র ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বংকিম ও রবীন্দ্রনাথ বাংলার ইতিহাস বা মুসলমানদের ইতিহাস লেখেনি বা উদ্যোগ গ্রহণ করেনিকরেনি॥??॥ তারা যা করেছে কিছু তা প্রকৃত সত্য ইতিহাসকে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে !??॥ তেমনিই উদাহরণ নালন্দা বিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সাথে কৌশলে মুসলমানদের নাম জুড়ে দিয়েছে কিন্তু আসল সত্য হলে এই বিহার সেন রাজারা ধ্বংস
করেছে ॥
এই
বিষয়ে একটু সংক্ষেপে বিস্তারিত পরিস্কার করে বলি॥ বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে যারা লেখালেখি করেছেন তাদের মধ্যে ড. নীহার রঞ্জন রায় বেশ আলোচিত হয়েছেন। রায় সাহেবের আদি নিবাস ছিল আমাদের ময়মনসিংহ জেলায়। আমাদের এখানে যারা প্রগতিশীল ও আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, তাদের কাছে রায় সাহেবের লেখা বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব বেশ নির্ভরযোগ্য হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই বই বাঙালির কোনো সামগ্রিক ইতিহাস নয়। এখানে কেবল আলোচিত হয়েছে প্রাচীন হিন্দু যুগের কথা, যে যুগে বাংলা ভাষার সত্যিকারের কোনো বিকাশ ঘটেনি। নীহার রঞ্জনের ইতিহাস পড়ে মনে হয় না, বাংলাভাষী মুসলমানরাও হলেন বাঙালি। বাঙালি বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাভাষী হিন্দুদেরকে, বাংলাভাষী মুসলমানকে নয়। অথচ আজকের বাংলাদেশ হলো বাংলাভাষী মুসলমানদের রাজনীতির ফল। বাংলাভাষী হিন্দুরা কখনও চাননি বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাসচর্চা করতে হবে, শিকড়ের সন্ধান করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু ইতিহাসচর্চায় বাংলাদেশের আদি পাঠের ওপর যে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে, তার দ্বারা বাংলাদেশের উদ্ভব ও ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা যায় না॥
নীহার রঞ্জনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি মুসলিম আমলের ইতিহাস লেখেননি কেন? উত্তরে ঐতিহাসিকে পরিণত অনুশীলন সমিতির এই সাবেক কর্মী বলেছিলেন, ‘বাঙ্গালীর হৃদয়ের কথা, সমগ্র সংস্কৃতির কথা এই প্রাচীন বাঙ্গালীর ইতিহাসেই বিধৃত। একালের বাঙ্গালী, সেকালের বাঙ্গালী হইতে জাগিয়া উঠিয়াছে। (নীহার রঞ্জন রায়, ব্যক্তি ও কৃতি, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, চতুরঙ্গ, সংখ্যা ১-২, ১৪১০)।
বোঝা যাচ্ছে, নীহার রঞ্জনও বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে বাঙালি বলতে শরমিন্দা হয়েছেন। বাঙালি আর হিন্দু যে—এই চিন্তা কলকাতার বাবুদের আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
নীহার রঞ্জনের আগে বাংলাদেশের ইতিহাস লেখার উদ্যোগ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার এ এফ রহমান ১৯৩৪ সালে বাংলার ইতিহাস লেখার জন্য টাকা বরাদ্দ করেন। ঠিক হয় দুই খণ্ডে বাংলার ইতিহাস লেখা হবে। প্রথম খণ্ডে থাকবে হিন্দু যুগের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ডে মুসলিম যুগের। হিন্দু যুগের ইতিহাস সম্পাদনা করবেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার। মুসলিম যুগের ইতিহাস সম্পাদনা করবেন স্যার যদুনাথ সরকার। ১৯৪৩ সালে রমেশচন্দ্রের সম্পাদনায় বের হয় ঞযব ঐরংঃড়ত্ু ড়ভ ইবহমধষ-ঠড়ষ ও। ১৯৪৮ সালে স্যার যদুনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় The History of Bengal-Vol II। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরনো হলেও বাংলার ইতিহাস সেভাবে জানানোর উদ্যোগ নেয়নি, যেভাবে নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত বাংলার ইতিহাস যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ। কিন্তু মুসলিম আমলের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের অন্তত আরও তিনটি ইতিহাস গ্রন্থ পড়তে হবে, যেগুলো ছাড়া রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিবর্তনকে বোঝা যাবে না। বইগুলো হচ্ছে ড. আবদুল করিমের ঝড়পরধষ ঐরংঃড়ত্ু ড়ভ ঃযব গঁংষরসং রহ ইবহমধষ, ড. আবদুর রহীমের Social and Cultural History of
Bengal Ges ড.
মোহর আলীর History of the Muslims of Bengal।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলায় মুসলিম যুগের শুরু হয় বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের ভেতর দিয়ে। কিন্তু আরব বণিক ও মুসলিম সুফিরা এর অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং নীরবে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। বিখ্যাত বিপ্লবী ও ভাবুক এম এন রায় বলেছিলেন, ইসলাম ভারতে ব্রাহ্মণ ও শ্রেণিশাসিত মানুষের কাছে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও লিখেছেন, হিন্দু সেন রাজাদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে দলে দলে বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করে।
সেনদের পূর্ব পুরুষ সামন্ত সেন দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট থেকে এসে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন রাঢ় অঞ্চলে একটি ছোট্ট রাজ্য গড়ে তোলেন। হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন রাঢ় রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন এই রাজ্য আরো সুসংহত করেন। বল্লাল সেনের পুত্র ছিলেন লক্ষণ সেন।
সেনগণ ছিলেন উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী, সাম্প্রদায়িক, পরমত বিদ্বেষী ও অত্যাচারী। তাঁরা বৌদ্ধ ও মুসলিম প্রজাদের উপর সীমাহীন নির্যাতন চালান। লক্ষণ সেন শাসিত গৌড় বা লক্ষণাবতী রাজ্যের রাজধানী ছিলো নদীয়া ও লক্ষণাবতী।
দ্বাদশ শতকে কর্ণাটক থেকে বহিরাগত সেনরা এসে যখন এদেশকে অধিকার করল পাল রাজাদের হত্যা করে , তখন তারা একটি নিষ্ঠুর শোষন-কার্যের মধ্য দিয়ে এদেশবাসীকে নির্যাতন করতে লাগল। তারা সংস্কৃতিকে নিয়ে এল রাজসভার মধ্যে এবং মন্দিরের অভ্যন্তরে। পাল আমলে বাংলা ভাষা ক্রমশ রূপলাভ করছিল। সরহপা পুরবী অপভ্রংশে তাঁর দোঁহাকোষ রচনা করেছিলেন। এই সব কিছুই অত্যাচারি সেনরা ধ্বংস করে দেয়॥ ফলে স্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলার উপরে নেমে আছে বিরাট এক দূর্যোগ ॥ সেনরা এসে সংস্কৃতকে প্রশাসনিক ভাষা হিসাবে গ্রহন করেন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাষা হিসেবেও সংস্কৃতকে গ্রহণ করেন। তার ফলে এদেশের মানুষের নিজস্ব উচ্চারণের ভাষা সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা লক্ষ্য করি যে, সেনদের আমলে দেশীয় ভাষায় চর্চা সম্পূণরূপে বন্ধ ছিল। সেনরা যে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে এলো, এই সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ছিল হিন্দুদের এবং তাও সকল শ্রেণীর হিন্দুদের নয়, তা ছিল কৌলিন্যবাদী ব্রাহ্মণদের এবং অংশত ক্ষত্রিয়দের। সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষণ সেনের রাজদরবারে যে সমস্তু কবি-সাহিত্যিক ছিলেন, তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে জয়দেব রাধা-কৃষ্ণ উপাখ্যানকে কাব্যে রূপান্তরিত করে একটি বিশেষ কাব্যধারার জন্ম দিলেন। এর ফলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি পরিপূর্ণভাবে বর্ণহিন্দুদের অধিকারে চলে গেল।
বিদেশি আক্রমণে পালদের পরাজয় ঘটে এগারো শতকে। সেন বংশের এই আক্রমণকারীরা এসেছিলেন দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে। যোদ্ধা সেনরা একসময় পালরাজাদের সৈন্যবাহিনীতে চাকরি করার জন্য বাংলায় এসেছিল। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের শক্তি বাড়াতে থাকে। পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে তারা পাল সিংহাসন দখল করে নেয়। এভাবে বাংলা বিদেশি শাসকদের অধিকারে চলে যায়। পাল এবং চন্দ্র রাজাদের স্বাধীন রাজ্যের অবসান ঘটে দক্ষিণ ভারতের এই সেনদের হাতে।
সেনগণ বাংলায় একশ বছরেরও বেশিকাল ধরে (আনু. ১০৯৭-১২২৩ খ্রি.) কর্তৃত্ব করেন।
সেন শাসিত গৌড় রাজ্যের তিনটি রাজধানী ছিলোঃ নদীয়া (নবদ্বীপ), গৌড় ও বিক্রমপুর। এ বংশের পাঁচজন নৃপতি (বিজয়সেন, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন, বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন) এ সময়ে রাজত্ব করেন। এটা লক্ষণীয় যে, মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর আক্রমণ পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অংশবিশেষে সেন শাসনের অবসান ঘটায় (১২০৪ খ্রি.)। লক্ষ্মণসেন পিছু হটে এ সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় তাদের অধিকৃত অঞ্চলে চলে আসেন।
অল্প কিছু সময় বাদ দিলে পাল ও চন্দ্র রাজারা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সকল শ্রেণির ও ধর্মের মানুষ এসময় মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতো। কিন্তু মানুষের এই শান্তির দিন শেষ হয়ে গেল। যখন বিদেশি শাসক বহিরাগত সেনরা এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করলো॥
আর
এই শুরুটা হয় পাল রাজাদের হত্যা করে ক্ষমতা দখলের মধ্যদিয়ে॥ । সেন রাজাদের মনে একটা ভয় ছিল। তারা দেখেছেন বাংলার মানুষ স্বাধীনতা প্রিয়। বিদেশি শাসনকে তারা সহজে মেনে নেয়নি। সুযোগ পেলেই প্রতিবাদ করেছে। বিদেশি আক্রমণকারীদের ওপর অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সেনরা তো নিয়ম মতো সিংহাসনে বসেনি। যে পাল রাজারা তাদের সেনাবাহিনীতে চাকরি দিয়েছে সুযোগ মতো তাদের হটিয়ে দিয়ে,— হত্যা করে দখল করেছে সিংহাসন। এদেশের বিপ্লবী মানুষরা তা মেনে নেবে কেন?— এভাবে না ভেবে সিংহাসনে বসে সেন রাজারা যদি নিজেদের পেছনের কথা ভুলে গিয়ে এদেশের মানুষের যাতে ভাল হয়, অর্থাত্ সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়ে দেশ শাসন করতো, তবে বাঙালিরা সহজেই গ্রহণ করতে পারতো সেন রাজাদের। কিন্তু অত্যাচারি বহিরাগত ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরা তা করেনি বরং বৌদ্ধ ও মুসলিম প্রজাদের উপরে চালিয়েছে ব্যাপক জুলুম নির্যাতন ॥ সৃষ্টি করেছে জাত প্রথার, এই জাত প্রথার সর্ব নিম্ন স্তরে স্থান দিয়েছে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের কে??!! শুধু তাই নয় জোর করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের কে এই নব্য শ্রেণিকে সেনদের জাত প্রথার সর্ নিম্ন স্তরে স্থান দিয়েছে ॥ এই অত্যাচারি সেন রাজাদের জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক বৌদ্ধ ও মুসলিম শ্রীলঙ্কা বার্মা এবং বিভিন্ন স্থানে চলে যায়॥ আর যারা ছিল তারা সেনদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য মুক্তির প্রহর গুনছিল॥
পরবর্তী সময় দেখা যায় বিদেশি শাসক মুসলমানরা এদেশে এসে প্রজাদের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করলে এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলে বাঙালি তাদের আপন করে নিয়েছে।
সেনরাজারা ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। নিজেদের খুব উঁচু গোত্রের মনে করতেন। এই ব্রাহ্মণ রাজারা নানাভাবে শোষণ করতে থাকেন বাংলার সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের। বৌদ্ধপণ্ডিত এবং বিহারগুলোর শিক্ষকদের অনেকে সেন শাসকদের অত্যাচারের ভয়ে বইপত্র নিয়ে বাংলা ছেড়ে নেপাল, তিব্বত ও চীন দেশে চলে যান। সাধারণ বৌদ্ধদের অনেকেই হিন্দু ধর্মের সাথে মিশে যেতে থাকে। সেনরা বাংলাদেশের মানুষের উপরে ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি এবং ধর্মের উপরে ব্যাপক আঘাত হানে ॥
সাধারণ বাঙালি যাতে সেন রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে না পারে তাই শাসকরা একই ধর্মের মানুষদের চারটি বর্ণে ভাগ করে দিলেন। সবচেয়ে উঁচু বর্ণের হিন্দুদের বলা হতো ব্রাহ্মণ। এরা ছিলেন রাজা এবং পুরোহিত। ব্রাহ্মণদের প্রায় সবাই কর্ণাটক এবং উত্তর ভারত থেকে আসা। এরপরের উঁচু শ্রেণিতে ছিলেন যারা তাদের বলা হতো ক্ষত্রিয়। সাধারণত যোদ্ধারাই ছিলেন ক্ষত্রিয়। এদের বেশিরভাগই বাঙালি ছিলেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য করা বা বড় বড় জমির মালিক যারা তাদের তৃতীয় শ্রেণিতে ফেলা হতো। এই বর্ণের নাম বৈশ্য। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এদের কিছু অধিকার দেয়া হতো। এর বাইরে থাকা বেশির ভাগ বাঙালি বৌদ্ধ, মুসলিম ও হিন্দুকে ফেলা হতো চতুর্থ স্তরে। এই বর্ণের নাম শূদ্র। এই সাধারণ বাঙালিরাই সকল সময় স্বাধীনতা আর অধিকারের জন্য প্রতিবাদ করে বলে তাদের দমন করার জন্য কঠিন কঠিন নিয়ম বেঁধে দেয়া হলো। বলা হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শূদ্রদের কোনো অধিকার থাকবে না। এরা শুধু উপরের তিন শ্রেণির মানুষের সেবা করবে। হিন্দু হলেও নিম্নবর্ণের বলে তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়া নিষেধ ছিল। লেখাপড়া করার অধিকারও ছিল না শূদ্রদের। সেন রাজারা সতর্ক ছিল যাতে সাধারণ বাঙালি মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে।
খানে উল্লেখ যে, খিলজীর বাংলা বিজয়ের আগেই অর্থাৎ ১১৭১-৭২ সালের দিক থেকে বাংলার মুসলামানরা ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐ সময় সিংহলের প্রধান সেনাপতি বাংলার পান্ডুয়া আক্রমণ করলে তার কাছে উপহার সামগ্রী আনয়নকারীদের মধ্যে মুসলমানরাও ছিল। তদানীন্তন বাংলার একটি অঞ্চল বিক্রমপুরে এক সময় (১১৬০-১১৭৮) সাল পর্যাপ্ত রাজত্ব করতো রাজা বল্লাল সেন। তার অত্যাচার ও ইসলাম বিরোধিতা বন্ধ করার জন্য বিক্রমপুরের মুসলিম অধিবাসীদের আমন্ত্রণে বাবা আদম শহীদ নামের একজন সুফী সাধক সাড়ে সাত হাজার শিষ্য নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে সমুদ্র পথে বিক্রমপুরে আগমন করেন এবং বল্লাল সেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে বাবা আদম শাহাদত বরণ করেন। তাঁর শাহাদতের পরপরই অবশ্য বল্লাল সেনের মৃত্যু হয়। বাবা আদম শহীদের প্রকৃত নাম ছিল শেখ মহিউদ্দীন আবু ছালেহ আরাবী। বিক্রমপুরের রামপালে আজও তাঁর মাজার বিদ্যমান।
মূলত হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার খলজি বাংলার মানুষকে মুক্তি দান করেন১২০৪ সালে।অত্যাচারিতনির্যাতিত বৌদ্ধরা দুবাহু বাড়িয়ে বখতিয়ার খলজিদের স্বাগত জানালো। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়-‘বৌদ্ধ ওনিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্য ও নির্মূলঅভিযানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলার মুসলিম বিজয়কে দু'বাহু বাড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
ড.
নিহার রঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাসআধিপূর্বে উল্লেখ
করেছেন-‘যে বঙ্গ ছিলো আর্য সভ্যতা ও
সংস্কৃতির দিক দিয়ে কম গৌরবের ও কম আদরের সেইবঙ্গ
নামেই শেষ পর্যন্ত তথাকথিত পাঠান মুসলিম আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হলো।'
সবচাইতে মজার যে ব্যাপার সেটা হচ্ছে বখতিয়ারখলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১২০৪সালের ১০মে, স্যারযদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কালবলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। অন্যদিকে অধিকাংশঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ধ্বংস করা হয় ১১৯৩খৃস্টাব্দে। যে লোকটি১২০৪খৃস্টাব্দে বঙ্গে প্রবেশ করেন সে কিভাবে ১১৯৩খৃস্টাব্দে নালন্দা ধ্বংস করেন এটা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে
পারবেন॥
সেন রাজাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করার মতো শক্তি তখন বাঙালির ছিল না। তাদের ক্ষোভ মনের ভেতর জমা হতে থাকে। অনেককাল পরে এর প্রকাশ ঘটেছিল। সাধারণ মানুষ নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছিল তেরো শতকের শুরুতে। এসময় মুসলমান সেনাপতি আক্রমণ করেছিলেন বাংলার পশ্চিম ও উত্তর সীমানায়। দেখা গেছে বাঙালি যুগে যুগে বিদেশি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কিন্তু বখতিয়ার খলজির আক্রমণের সময় তারা নিশ্চুপ হয়ে যায়। বাংলার পশ্চিম সীমান্তে বখতিয়ার খলজি যখন সেন রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করলেন তখন সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিবাদ করেনি। এসময়ে বিপন্ন মানুষ সেন রাজাদের দুঃশাসন থেকে মুক্তি খুঁজছিল। তাই সেন রাজাদের পরাজিত করতে আসা বখতিয়ার খলজিকে তাদের কাছে শত্রু মনে হয়নি।
১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজীর আগমনে এদেশের সাধারণ মানুষ নতুন করে চেতনা পেল। সুকুমার সেন তাঁর একটি রচনায় স্বীকার করেছেন যে, অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা বখতিয়ারের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিল, এমনকি কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণও বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনকে বিভ্রান্ত করে দেশত্যাগ করতে সহায়তা করেছিল। মানুষে মানুষে বিভাজন মুসলমান আমলে আর রইল না, পাল আমলেও এটা ছিল না। মুসলমানরা একটি নতুন বিশ্বাসকে আনলেন, এদেশের সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন এবং একটি বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটালেন।
আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষ এবং বিকাশকে আলোচনা করতে গেলে পাল আমলের বিস্তৃত পরীক্ষা করা প্রয়োজন এং সেনরা যে অসৌজন্যের জন্ম দিয়েছিল, তারও সুস্পষ্ট পরিচিতি উপস্থিত করা প্রয়োজন। অবশেষে মুসলমান আমলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি যে নতুন মানবিক রূপ পরিগ্রহ করল তারও বিস্তৃত সমীক্ষার প্রয়োজন। এ নিয়ে অল্পস্বল্প লিখিত হলেও বিস্তৃতভাবে এ নিয়ে কেউ গবেষণা করেননি।
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
সূত্র :
১.বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)। নীহাররঞ্জন রায়।
২.
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড-১। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
৩.
বাংলাদেশের ইতিহাস। রমেশচন্দ্র মজুমদার ।
৪.
বাঙ্গালা দেশের নামের পুরাতত্ত্ব। সুকুমার সেন।
৫.
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
৬.
অতুল সুর: বাংলার সামাজিক ইতিহাস। পৃষ্ঠা ২০১
৭.
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড সুনীল চট্টোপাধ্যায়
৮.
বাংলাদেশের ইতিহাস, ডঃ মুহাম্মদ আবদুর রহীম প্রমুখ
৯.
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ড. এম. রহীম
১০.
হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসরিম অব বেংগল, ড. মুহাম্মদ মোহর আলী
১১.
ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, এ.কে.এম. আবদুল আলীম।
No comments:
Post a Comment