Thursday 15 September 2016

একটি উচ্চতর গরু বিষয়ক রচনা ।


দুই যুগে গুজরাটে ৫৩৬ দলিত হত্যা ও ৭৫০ দলিত নারী ধর্ষণের শিকার।

বেদজ্ঞান লাভ করতে হলে, স্বাস্থ্যবান সন্তান লাভ করতে হলে ষাঁড়ের মাংস খাওয়া জরুরি। সূত্র: বেদ; ২য় প্রকাশ, পৃ: ১৩, ৬৭; হরফ প্রকাশনী , কলিকাতা।

ভারতে গরু নিয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের হিংস্রতা দিন দিন বেড়েই চলছে।

সূফি বরষণ
এক.
ভারতে চরম সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল বিজেপি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বিজেপির মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমান ও দলিত সম্প্রদায়ের উপরে আক্রমণ হামলার প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। এখন ভারতে সব রকম ধর্মীয় কুসংস্কার শুধু জিইয়ে রাখা নয় আরো বিস্তৃত ও শক্তিশালী করার নীতিই কার্যকর করছে বিজেপির সন্ত্রাসী সংগঠন আরএসএস ও শিব সেনা । মুসলমান, খ্রিস্টান, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের গো-মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে ধর্মের জিগির তোলা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের হীন প্রচেষ্টারই অন্যতম দৃষ্টান্ত। সাম্প্রতিক কালে গো-রক্ষা সমিতির তৎপরতা, হামলা, সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনেও রাজনীতিটাই রয়েছে মুখ্য ভূমিকায়।

বিজেপি যেমন আরএসএসের ভাবধারাপুষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন তেমনি গো-রক্ষা সমিতিও। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গো-রক্ষা সমিতি নতুন করে গো-রক্ষা আন্দোলন জোরদার করেছে। গো-রক্ষা সমিতির আন্দোলনের মুখেই বিজেপি প্রভাবিত বা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিজেপি যে এই আন্দোলনের পেছনে আছে এবং প্রবলভাবে সমর্থন করছে তা বিশদ তথ্য-প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সরকারি দল ও সরকারের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই গো-রক্ষা সমিতি আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং ক্রমাগত তার সন্ত্রাসী চরিত্রের উন্মোচন ঘটাচ্ছে। শুরুতে গো-রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল মুসলমানরা, এখন তা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় এমনকি স্ব-ধর্মীয় দলিতদের ওপরও সম্প্রসারিত হয়ে পড়েছে।

দুই.
আর্য ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা হিন্দু ধর্মে গরুর গোশত খাওয়া বৈধ।
বহিরাগত আর্যরা কৃষিজীবী ছিলো। কৃষির হালচাষের জন্য অন্যতম উপকরণ ছিলো গরু। এ জন্য আর্য সাহিত্যে গরুকে গো ধন বলা হয়েছে। গো-সম্পদের যত্ন নেওয়ারও তাগিদ রয়েছে আর্য সাহিত্যে। ভারতের গো-বলয়ে আর্যদেরই প্রাধান্য বেশি।

আর্য-সমাজে  চারস্তরে বিভাজন মূলত এই আর্যরা বা ব্রাহ্মণ্য দর্শনের অনুসরণকারীই সমগ্র ভারতে জাত প্রথা ও সমাজে শ্রেণি বৈষম্য তৈরী করে । ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। আর্যরা বহিরাগত। মধ্য-এশিয়া থেকে তারা ভারত বর্ষে এসেছিলো। পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র হরিয়ানা, দিল্লি ও বিহার এ এলাকাটাই গো-বলয়। এখানেই আর্যরা বসতিস্থাপন করেছিলো।

আর্য হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থগুলোর মধ্যে বেদ হচ্ছে প্রধান ধর্ম গ্রন্থ আসুন দেখি আর্য সাহিত্যের প্রধান গ্রন্থ কি বলে: হিন্দুদের ধর্মে  গরুর মাংস খাওয়ার বৈধ বলা হয়েছে ।  এ বিষয়ে প্রমাণ এখানে তুলে ধরা হলো..
ক . মনুষমৃত্রী অধ্যায় ৫ শ্লোক নম্বর যথাক্রমে ৩০; ৩১; ৩৯; ৪০
খ. ঋগ্ববেদ অধ্যায় ৮৫ শ্লোক নম্বর ১৩
গ. মহাভারত আনুষাণ পর্ব শ্লোক নম্বর ৮৮
ঘ. ---গরু-বৃষের মাংস [বেদ:১/১৬৪/৪৩],
ঙ. ---মহিষের মাংস [বেদ: ৫/২৯/৮],
চ. ---অজের মাংস [বেদ:১/১৬২/৩] খাওয়া হত।
আরও বলা হয়েছে পরস্বিনী গাভী মানুষের ভজনীয় [বেদ:৪/১/৬]।
---গো-হত্যা স্থানে গাভীগণ হত্যা হত [বেদ:১০/৮৯/১৪]।
---ইন্দ্রের জন্য গোবৎস উৎসর্গ করা হয়েছে।
[ঋগ্ববেদ: ১০: ৮৬: ১৪]।
---এমনকি উপনিষদ বলছে: ‘বেদজ্ঞান লাভ করতে হলে, স্বাস্থ্যবান সন্তান লাভ করতে হলে ষাঁড়ের মাংস খাওয়া জরুরি।” [সূত্র: বেদ; ২য় প্রকাশ, পৃ: ১৩, ৬৭; হরফ প্রকাশনী , কলিকাতা]

তিন.
কেন আর্যরা ভারতে আসে।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন এক ঈশ্বরবাদী ধর্ম প্রচার করছিলেন মধ্য পশ্চিম এশিয়ায় তখনই সম্ভবতো ইব্রাহিমের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে বা বিতাড়িত হয়ে দীর্ঘ দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আর্যরা ভারতের দিকে চলে এসেছিলো। ইব্রাহিমের কাবার মতো তারাও একটা মন্দির তৈরী করেছিলো। নাম দিয়েছিলো ‘বিশ্বকর্মার মন্দির’। গোবলয়ে যারা আদিবাসী ছিলো তাদেরকে আর্যরা বিভাজনের বাইরে রেখেছিলো মূলত তারাই দলিত সম্প্রদায়। হাজার হাজার বছর ধরে দলিতরা আর্যদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে এখনও তারা নিগ্রহের পাত্র। তাদের কোনও জোত জমি নেই, জনপথের কোনও একপার্শ্বে তারা দলবদ্ধভাবে থাকে- এটাকে দলিত বস্তি বলে।

ইংরেজ শাসনের সময়ে শহরে শহরে এদের জন্য কলোনি তৈরী করে দিয়েছিল এটাই ছিলো দলিত কলোনি। এখনও প্রতিটি শহরে দলিত কলোনি আছে। তাদের কাজ হলো মলমূত্র পরিস্কার করা আর শহর পরিচ্ছন্ন রাখা।

দক্ষিণ ভারতের লোকেরা দ্রাবিড় সম্প্রদায়। দ্রাবিড়ই ভারতের আদিবাসী। আর্যরা দ্রাবিড়দেরকে মর্যদার চোখে দেখে না। একবার তামিলনাড়ুর আন্নাদুরাই আর রামস্বামী আয়েঙ্গার রামায়ণ মহাভারতের বহ্নি উৎসব করতে চেয়েছিলেন। তা নিয়ে উত্তর-দক্ষিণে উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়েছিল। নেহরুর হস্তক্ষেপ দক্ষিণের বহ্নি উৎসব বন্ধ হয়েছিল।

দক্ষিণের লোকেরা মনে করে রাময়ণ মহাভারত আর্যদের সৃষ্ট। যে কারণে মহাভারতে উত্তরের মানুষ দেবপুত্র আর দক্ষিণের মানুষ অশুর। ভারতে দলিতেরাই একবিংশ শতাব্দীতেও নিগৃহীত। উপজাতিরাও দলিত। এদেরকে বলা হয় সিডিউল কাষ্ট অ্যান্ড সিডিউল ট্রাইব। সিডিউল কাষ্ট বা ট্রাইব চার সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত নয়। এরা অচ্ছ্যুত। সিডিউল কাষ্ট অ্যান্ড সিডিউল ট্রাইব ভারতের সর্বমোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ।

চার.
গোবলয়ের সর্বত্র গো-রক্ষা সমিতি রয়েছে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গো-রক্ষা সমিতি খুবই তৎপর। গত ১০ই জুলাই গুজরাটের সোমনাথ জেলায় সিংহের আক্রমণে এক গৃহস্থের চারটি গরু মারা যায়। গৃহস্থ মৃত গরুর চামড়া খসানোর জন্য দলিতদের খবর দেয়। মৃত গরুর চামড়া খসানোর কাজ দলিতেরা বহু প্রাচীন কাল থেকে করে আসছে।

উনায় হিন্দু সমাজের নিচু জাত বলে পরিচিত দলিতরা বিক্ষোভ থেকে সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করেন। মোদির রাজ্য গুজরাটের সমাবেশে দলিতরা স্লোগান দিয়ে বলেন, সরকারের এমন গালভরা কথা শুনে শুনে আমরা ক্লান্ত। এ সময় তারা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন, ‘আমরা আর কখনো মরা গরু টানব না। গরুর চামড়াও ছাড়াব না।’ সমাবেশে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারও উপস্থিত ছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আটক হন কানহাইয়া।

ভারতে মরা গরু টানা ও চামড়া ছাড়ানোর দুরুহ কাজটি করেন দলিতরা। এজন্য তাদের খুব সামান্য পারিশ্রমিক দেয়া হয়। দেশটির ২০ কোটি দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে গুজরাটে বাস করে ২.৩ শতাংশ। কেবল গত বছরই দলিত নির্যাতনের এক হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে। ১৯৯০-২০১৫ সাল সময়ে গুজরাটে ৫৩৬ দলিত হত্যা এবং ৭৫০ দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

দলিতেরা মুচির কাজ করে। গৃহস্তকে কিছু টাকা দিয়ে খসানো চামড়া নিয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং করে তারা এ চামড়া মুচির কাজে ব্যবহার করে। চার যুবক যখন মৃত গরুর থেকে চামড়া খসানোর কাজ করছিলো তখন গো-রক্ষা সমিতির লোকজন এসে চার দলিত যুবককে ধরে নিয়ে যায় সোমনাথ জেলার উনা শহরে।

এখানে গোরক্ষা সমিতির লোকেরা চার যুবকের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। অনেক লোক এ নির্যাতনের দৃশ্য দেখে এবং মোবাইল ফোনে ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। এ নিয়ে সারা গুজরাটে এখন দলিতেরা ঐক্যবদ্ধ।

আহমদাবাদ এবং উনা শহরে এখন নিত্য বিক্ষোভ। ১৯ই জুলাই রাজকোটের প্রতিবাদ সভায় ২৩ বছরের এক যুবক দলিত নির্যাতনের প্রতিবাদে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার হুমকি দেয় আরো ৭ যুবক। সুরাটে দলিতেরা সমাবেশ করে এবং তারা প্রতিজ্ঞা করে আর কখনও তারা চামড়া খসানোর কাজ করবে না এবং ম্যানহোল পরিস্কার করার কাজও তারা করবে না।

উত্তর প্রদেশে দলিত কন্যা মায়াবতির দল বহুজন সমাজ পার্টি পূর্বেও দু’দুবার ক্ষমতায় ছিলো। এবার এ ঘটনার পর দলিতের ভোট বিভাজন হবে না। বিজেপির জন্য এ হবে কঠিন অবস্থা। গত লোক সভা নির্বাচনে বিজেপি দলিত ভোট নিজেদের ভাগে টানতে পেরেছিল যে কারণে তারা ৮০ সিটের মাঝে ৭৩ সিট পেয়েছিল।

কয়দিন আগে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়ায় ২৫০ দলিত উত্তর প্রদেশে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো। অথচ মুসলমান হওয়ার ব্যাপারে আইনী জটিলতা রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন উত্তর ভারতে তবলিগ জামাতের প্রচারণায় বহু দলিত মুসলমান হয়েছিলো তখন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা দাবী তুলেছিলো ভারতকে হিন্দু মাইনরিটি স্টেট করার জন্য সৌদি আরব কোটি কোটি টাকা দলিতদের মাঝে বিতরণ করছে।

পাঁচ.
আইন করে তা প্রতিহত করা দরকার। ইন্দিরা সরকার দলিতরা মুসলমান হতে পারবে না এমত একটা আইনের খসড়াও তৈরী করেছিলেন। এটার প্রতিবাদে দলিতরা রামলীলা ময়দানে প্রতিবাদ সভা করেছিল। মূখ্য বক্তা ছিলেন জগজবীন রাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা দলিতরা মুসলমান হতে পারব না রাষ্ট্র আইন করে বাধা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু আমরা দলিতরা হিন্দু নই এ কথা যদি বলি তবে কোন আইন তা বাধা দিতে পারবে।

জগজীবন রাম এবং বি আর অম্বেদকরের পর আর কোনও শক্তিশালী দলিতপুত্র ভারতের উচ্চস্থানীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। গান্ধীর পরে আর কোনও হিন্দু নেতাও দলিতদের উন্নয়নের কোনও চেষ্টা করেননি। মহাত্মা গান্ধীই চেষ্টা করেছিলেন দলিতদের মাঝে ভয় ভাঙ্গিয়ে জাগরণ সৃষ্টির। তিনি দিল্লির ভাঙ্গি মহল্লায় নিজের বাসস্থান হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন।

ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও গান্ধী কখনও কোনও মন্দিরে যাননি কারণ দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ ছিল। ঈশ্বরের কাছে গান্ধীর প্রার্থনা ছিলো পুনর্জন্মে তিনি যেন মেথরের ঘরে জন্মে তাদের দুঃখ কষ্টের ভাগীদার হতে পারেন।

উনার ঘটনার পর এখন ধীরে ধীরে দলিতেরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এখন তাদের দাবী দলিতদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা। দলিতদের যদি হিন্দুদের মাঝে ধরে রাখতে চায় তবে ভারত সরকারের উচিৎ তাদের সঙ্গে মানবিক আরচণ করা এবং তাদের টেনে তোলার ব্যবস্থা করা।

ভারতে এক তৃতীয়াংশ লোক যদি অন্ধকারে থেকে যায় তবে তার সর্বাঙ্গীন উন্নতি হবে কিভাবে! গান্ধী বলতেন অস্পৃশ্যতা বা ছুঁৎমার্গ, হিন্দুধর্মের অঙ্গতো নয়ই উপরন্তু হিন্দুধর্মে প্রবিষ্ট একটা পচনশীল পদার্থ। একটা ভ্রম, একটা পাপ। এর থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করা প্রত্যেক হিন্দুর পরম ধর্ম, পরম কর্তব্য। গান্ধী দলিতদের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন বা ভগবানের সন্তান।’

No comments:

Post a Comment