Saturday, 16 July 2016

বাংলাদেশ জঙ্গিদের টার্গেট হয়ে যাওয়ার বিপদ কি ভারত নেবে ।

লোককথা

মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর জেমস ক্যাপার এ বছর ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে ইউএস আর্মড সার্ভিসেস কমিটি ও সিনেট সিলেক্ট কমিটির কাছে একটি লিখিত প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। এ ধরনের প্রতিবেদনকে বলা হয় ‘ÔStatement for the RecordÕ’। অনেকটা ভবিষ্যতে রেফারেন্সের জন্য নথি করে রাখার মতো ব্যাপার। গুলশানে হোলি আর্টিজানের রক্তপাতের পরে এখন তা রেফারেন্স হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার লিখিত মন্তব্য ছিল ছোট এবং খুবই সংপ্তি। পুরোটাই এখানে তুলে দিচ্ছি :
ÒPrime Minister Sheikh HasinaÕs continuing efforts to undermine the political opposition in Bangladesh will probably provide openings for transnational terrorist groups to expand their presence in the country. Hasina and other government officials have insisted publicly that the killings of foreigners are the work of the Bangladesh Nationalist Party and the Bangladesh Jamaat-e Islami political parties and are intended to discredit the government. However, ISIL claimed responsibility for 11 high-profile attacks on foreigners and religious minorities. Other extremists in Bangladesh— including Ansarullah Bangla Team and Al-QaÕida in the Indian Subcontinent (AQIS)— have claimed responsibility for killing atleast 11 progressive writers and bloggers in Bangladesh since 2013Ó. (†`Lyb, Statement for the Record Worldwide Threat Assessment of the U.S Intelligence Community)
জেমস ক্যাপারের মূলকথা হচ্ছে, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপকে যেভাবে ক্রমাগত দমনপীড়ন করছেন, সম্ভবত সেটাই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর উপস্থিতি বাংলাদেশে সম্প্রসারিত করবে। শেখ হাসিনা এবং তার সরকারি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে জোর দিয়ে বলছেন, বিদেশীদের হত্যা করার যেসকল ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে সেটা মতাসীন সরকারকে বিব্রত করবার জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জামায়াতে ইসলামীর কাণ্ড। আইএসআইএল এই সকল হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করছে অথচ শেখ হাসিনা এবং তার কর্মকর্তারা দোষ চাপাচ্ছেন বিরোধী দলের ওপর। সারমর্মে বলা হোল, একদিকে দমনপীড়ন, অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপকে দোষারোপ এই দুটি কারণই বাংলাদেশে আইসিসের মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠির উপস্থিতি ও বিস্তৃতির কারণ ঘটাবে।
হোলি আর্টিজানের রক্তয়ী ঘটনা প্রমাণ করছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দাদের মূল্যায়ন কমবেশি সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। সেটা হোল মার্কিন গোয়েন্দাদের সঠিক পর্যবেণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র আইএস-এর হোলি আর্টিজানে সরব উপস্থিতি জানান দেবার ঘটনা রোধ করার েেত্র কোনো কার্যকর পদপে নিল না কিম্বা নিতে পারল না কেন? তারা আদৌ রোধ করতে পারত কি না, তার আলাদা মূল্যায়ন হতে পারে। কারণ সেটা সব সময় ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তবে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের য়, ভয়াবহ মাত্রায় মানবাধিকার লংঘন এবং বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন বন্ধ করবার েেত্র দুই-একবার মৌখিকভাবে কূটনৈতিক উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া সন্ত্রাস ও সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে দৃশ্যমান মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা নাই বললেই চলে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠিগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাবার যে আশংকা মার্কিন গোয়েন্দারা করেছে, তার রাজনৈতিক কারণ রয়েই গিয়েছে। বৈধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া ‘তিনি’ বহাল তবিয়তেই আছেন এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। পরিণতি হোলি আর্টিজানের রক্তপাত। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির েেত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণ কী?
এর উত্তর আমরা উন্নাসিকভাবে দিতে পারি। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র এটাই তো করে, একনায়ক ও ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গেই তো তাদের সখ্য। কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয়। অতএব, উন্নাসিক না হয়ে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এশিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনকে মোকাবিলা করা, সমুদ্রে সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা, বাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ, সর্বোপরি চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার েেত্র অগ্রগামী থাকা ইত্যাদি এর কারণ। সে েেত্র দণি এশিয়া এবং বিশেষ ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিপ্রেেিত বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক তরুণকে আইসিস, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-জাতীয় রাজনৈতিক আদর্শ ও সামরিক তৎপরতার দিকে ঠেলে দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিচার উন্নাসিক কায়দায় দিলে চলছে না।
ব্যর্থতার প্রধান কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে আমেরিকার বর্তমান য়িষ্ণু অবস্থা; বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়িত হবার কারণে অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি। সাধারণভাবে বলা যায়, নিজের টাঁকশালে ডলার ছাপিয়ে বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল এখন আর প্রশ্নাতীত নয়। তদুপরি ওয়াল স্ট্রিট ও সমরাস্ত্র শিল্পের আঁতাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টার েেত্রও ফাটল দেখা যাচ্ছে। চীন ও ভারতের উত্থান বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমেরিকা অনেকটা য়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমেরিকা ভারতকে তোলা তোলা করে তোয়াজ করে চলবে, তাতে অবাক হবার কিছু নাই। তোয়াজ করে চলার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, চীনকে ঠেকানো। সে কারণে বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লির নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ওয়াশিংটন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত অথবা অম। ফলে বাংলাদেশের েেত্র দিল্লির নীতির বাইরে আর কোনো ভূমিকা রাখতে আমরা ওয়াশিংটনকে হোলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটা পর্যন্ত দেখিনি, কিম্বা দেখা যায়নি।
দিল্লি শেখ হাসিনাকেই মতায় রাখতে চেয়েছে, বাংলাদেশের মতাসীনদের নীতি আর দিল্লির নীতি অভিন্ন। সেটা হোল, শেখ হাসিনা মতায় থাকুন এবং তা দীর্ঘায়িত করতে রাজনৈতিক প্রতিপকে নির্মূল করা হোক। এই অবস্থায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি বদলাতে চাইলে বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির নীতি বদলানোর কাজ যুক্তরাষ্ট্রকে করতে হবে আগে। মূল অমতাটা এখানে। এই সত্য এখন আগের চেয়ে স্পষ্ট যে, নরেন্দ্র মোদি মতায় আসার পরও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সাউথ ব্লকের আমলারা বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির নীতিনির্ধারণে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। এর বাইরে, অর্থাৎ সাউথ ব্লকের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর নির্দেশিত পথ ছাড়া মোদির দিল্লি কোনো নতুন পথরেখার উদ্ভব ঘটাতে পারেনি। ‘সবাইকে নিয়ে উন্নয়ন’Ñ নরেন্দ্র মোদির এই বুলি নিছকই কথার কথা মাত্র, অকেজো। শেখ হাসিনাকে নির্বিচারের নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়ার বাইরে ভিন্ন বিশ্বপরিস্থিতিতে দিল্লি তার নিজের স্বার্থ নিয়ে নতুন করে ভাবতে অপারগতাই দেখিয়েছে। এর অর্থ, প্রকারান্তরে বাংলাদেশে আইএস-এর উপস্থিতি নিশ্চিত করবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখা এবং বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ও রাজনীতির শর্ত তৈরি করে যাওয়া। ভারতের জন্য সেটি তেমন সুখের না হলেও শেষ পর্যন্ত ভারত এটাই করে চলেছে। এটা জানবার, বুঝবার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির ভূমিকা বদলানোর আদৌ কোনো প্রচেষ্টা নিয়েছে বলে কোনো প্রমাণ দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র দণি এশিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চে পেছনের বেঞ্চে তার গোয়েন্দা ও বিশ্লেষণের দলিলদস্তাবেজ নিয়ে বসে থেকেছে কেবল।
দিল্লির নীতিকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত না করার পেছনে দ্বিতীয় আরেকটি কারণ থাকতে পারে। কারণ হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রার েেত্র বেশ ছাড় বাংলাদেশ থেকে এই অবস্থাতেও পাচ্ছে। জ্বালানি উত্তোলনের জন্য ব্লক পাওয়া, ব্লু ওয়াটারের ওপর আধিপত্য কায়েমের প্রক্রিয়া হিসাবে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, মনসান্তো-সিঞ্জেন্টার স্বার্থে বাংলাদেশের কৃষিতে বিকৃত বীজ বা জিএমও প্রবর্তন ইত্যাদি। এ সব কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে মতায় রাখার সুবিধার দিকটাকেও বিবেচনার মধ্যে রেখে থাকতে পারে।
দুই
বলা বাহুল্য, জেমস ক্যাপারের প্রতিবেদন ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাবিশ্লেষকরা ভালোভাবে নেননি। তার প্রমাণ সাউথ এশিয়া অ্যানালিসিস গ্রুপে প্রকাশিত ভাস্কর রায়ের লেখা থেকেই স্পষ্ট। এই ওয়েবসাইটটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওয়েবসাইট হিসাবে পরিচিত।
ক্যাপারের প্রতিবেদন ছাপা হবার এক সপ্তাহের মধ্যেই ১৬ জুলাই ভাস্কর রায় লিখলেন, বাংলাদেশ সংক্রান্ত মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ‘প্রশ্নাত্মক’, কোশ্চেনেবল। কেন? এর উদ্ধৃতি :
During this period when the BNP-JI alliance ran the country, Indian insurgent groups like the ULFA, NSCN(I/M) and others were given sanctuary in Bangladesh and actively assisted in procuring arms, ammunition and communication equipment which were smuggled into IndiaÕs North-East for waging war against the state. Bangladeshi intelligence organizations like the DGFI and NSI were assisting them. In fact, ULFA commander Paresh Barua and his family lived openly in Dhaka. (†`Lyb, Bangladesh Politics & US IntelÕs Questionable Position)
পুরনো যুক্তি। বিএনপি-জামায়াত আঁতাতের সরকারের সময় উলফা, এনএসসিএন এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপ বাংলাদেশে নির্ভয়ে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিল। তারা বাংলাদেশের ডিজিএফআই এবং এনএস আই-এর সহযোগিতায় বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে নিয়ে আসতে পেরেছিল ইত্যাদি। অতএব শেখ হাসিনাকেই সমর্থন করে যেতে হবে।’ বলা বাহুল্য, তার মানে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে দমনপীড়নের নীতিকেও সমর্থন দেয়া। যদি বিএনপি-জামায়াত এত অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাদের দমন করাই দিল্লির নীতি। সে েেত্র ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশের ভেতরে অপারেট করতেও দ্বিধা করেনি। গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে সীমান্তের ওপারে ভারতে পাওয়া ভারতীয় গোয়েন্দাদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্ক্যান্ডাল হয়ে আছে।
কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিপরীতে তোলা অভিযোগ পুরনো। এগুলো পুরনো তথ্য। ধরা যাক, এই তথ্যগুলো ঠিক; তাহলে কুকর্মের শাস্তি জামায়াত-বিএনপি পেয়েছে, তারা মতায় নাই। তাহলে ভারতের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উচিত সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবা; দণি এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন বিচণতা ও দূরদর্শিতার সাথে বিচার করা। কিন্তু দিল্লি ও ভারতীয় গোয়েন্দারা বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রতি যে নির্বিচার সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেটা আত্মঘাতী নীতি বলা যায়। এর ফল হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে দিল্লির বিরোধকে তীব্র করা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বদল ঘটেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বপরিস্থিতিও বদলে গিয়েছে। আলকায়েদার পরে আইসিস এসেছে। যুদ্ধের চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে নতুন বাস্তবতা ও সমস্যাকে আড়াল করেছেন বারবার। এর মূল্য হোলি আর্টিজানে দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে আর কী ঘটতে যাচ্ছে, আমরা জানি না। বাংলাদেশের শিতি এলিট শ্রেণীর ছেলেরা সিরিয়ায় গিয়ে আইসিসে যোগ দিচ্ছে। তারা গুলশানে ডিপ্লোমেটিক জোনের গহিনে হোলি আর্টিজানে সফল অপারেশন চালিয়ে গর্বের সঙ্গে ভিডিও প্রচার করছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে নির্মূল করে এবং গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটার কোনো অস্তিত্ব না রেখে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ক্রমাগত দমনপীড়ন চালিয়ে গেলে যে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়, সেই শূন্যতার মধ্যে যা হবার তাই হয়েছে।
নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হবার প্রধান কারণ ক্ষমতাসীনদের গণবিচ্ছিন্নতা। যেমন, এক কথায় বললে, জনগণ বর্তমান সরকারকে মতায় রেখেই আইএস পরিস্থিতি মোকাবিলা দেখতে চায় কি না। এ নিয়ে জনগণ ঠিক কী ভাবছে তা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। এ ব্যাপারে সন্দেহ করা যায়। জনগণ কি আস্থা রাখে যে, সরকার ও তার প্রধান কার্যকরভাবে বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন? জবাব হলো, না। আর্টিজানে হামলার সময় থেকে প্রতিটি ঘটনায় জনগণ সন্দেহ করছে, সরকার বুঝি কিছু লুকাচ্ছে, এর পেছনে সরকারেরই হাত রয়েছে কি না। প্রকৃত অপরাধীকে পরিচ্ছন্ন তদন্তে শনাক্ত করার চেয়ে চোখ বন্ধ করে ‘বিএনপি-জামায়াত এটা করেছে’ বলে আর্টিজানের ঘটনাকে নিজেদের মতা টিকানোর পে ব্যবহার করা সরকারের প্রতি সন্দেহ আরো বৃদ্ধি করেছে। ‘করবে কি না’Ñ জনগণের এই প্রবল সন্দেহ শেখ হাসিনা ও তার দলের পে মোকাবিলা করা এখন প্রায় অসম্ভব। তাকে সামনে রেখে পরিস্থিত মোকাবিলার নীতি ও কৌশল গ্রহণের েেত্র জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলাও কঠিন। অথচ এ সময় দরকার ছিল জনগণের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগকে যথাযথ মূল্য দিয়ে জনগণকে নিয়েই পরিস্থিতির মোকাবিলা।
তবে ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উৎকণ্ঠার বিষয়গুলো বোঝা কঠিন নয়। যা একইভাবে, বলা বাহুল্য দিল্লিরও উৎকণ্ঠা বটে। বাংলাদেশকে তা আমলে নিতে হবে। বাংলাদেশ আমলে নিয়েছেও বটে। অভিযোগ মূলত ভারতের বিদ্রোহী দলগুলোর বিরুদ্ধে। ভারতের ইনসারজেন্সির সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকট, কিন্তু এর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো সশস্ত্র হামলা পরিচালিত হয়েছে, এর কোনো প্রমাণ আজ অবধি দিল্লি দিতে পারেনি। প্রমাণের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় কথিত উলফার ঘাঁটি আবিষ্কার করতে হয়েছে তাদের। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাবার দাবি করা হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর থেকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, এর কোনো প্রমাণ নাই। তার মানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিধিবিধান লংঘন করেছে, তেমন কোনো অভিযোগ দিল্লি আন্তর্জাতিক কোনো মঞ্চে হাজির করেছে বলে জানা নাই।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। তাহলে কাশ্মিরসহ ভারতের দণি-পূর্বাঞ্চলের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের দুর্বলতা ও সমর্থন থাকা অন্যায় কিছু নয়। এ কারণে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরা বাংলাদেশে থেকেছে। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। অথচ ভারত তার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের রাজনৈতিক সমাধানে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশকে ক্রমাগত দোষারোপ করেছে, যা মেনে নেবার কোনো যুক্তি নাই।
তবে এই বিতর্কগুলো আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে আপাতত দূরবর্তী প্রসঙ্গ। এটা মিটে গিয়েছে বলা যাবে না, তবে কিভাবে আগামি দিনে প্রত্যাবর্তন করবে, তা আমরা জানি না। ভাস্কর রায় ও ভারতের অপরাপর নিরাপত্তা বিশ্লেষকের লেখা পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায়, ভারতীয় গোয়েন্দাদের দূরদৃষ্টির অভাব খুবই প্রকট। ভাস্কর রায় তার লেখার কোথাও জেমস ক্যাপারের বিশ্লেষণ কিম্বা বাংলাদেশে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সম্পর্কে ভবিষ্যৎ দূরদৃষ্টির বিপরীতে কিছুই বলতে পারলেন না। ক্যাপারের মূল যুক্তি ছিল খুবই সোজা। বিরোধী রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ প্রতিপরে বিরুদ্ধে যদি এ সরকার দমনপীড়ন অব্যাহত রাখে, তাহলে আন্তর্জাতিক টেররিস্ট গ্রুপগুলো বাংলাদেশে হাজির হয়ে যাবে। তাদের উপস্থিতির বিস্তৃতি ঘটবে।
ভাস্কর রায়ের বক্তব্য শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও দলীয় কর্মকর্তাদের মতোই। ‘আইএস মানেÑ বাংলাদেশে জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আর এদের মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত, অতএব সন্ত্রাস দমন করতে হলে বিএনপি-জামায়াত দমন করতে হবে।’ ভারতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দাদের চিন্তার দৌড় সম্পর্কে এখান থেকে আমরা কিছুটা ধারণা করতে পারি।
তিন
কিন্তু আবারো বলি, গুলশানের ঘটনা মার্কিন গোয়েন্দাদের অনুমানই সত্য প্রমাণ করেছে এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দাদের পরিণত করেছে বেকুবে। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দাদের বেকুব ভাববার কোনো কারণ নাই, কিম্বা মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মহা বুদ্ধিমান গণ্য করাও অর্থহীন। ক্যাপার যা বলেছেন তা একদমই কাণ্ডজ্ঞান থেকে বলা, তার বক্তব্যের পে কোনো কংক্রিট তথ্যপ্রমাণ তিনি দেননি। এতে অবশ্য আমাদের লাভতির কিছুই নাই। তবে প্রশ্ন হোল, দিল্লি আন্তর্জাতিক টেররিস্ট গ্রুপের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চায় কেন?
বিভিন্ন দিক থেকে বিষয়টির বিবেচনা দরকার। তবে এটা বোঝা যায়, বাংলাদেশে আইএস, আলকায়েদার উপস্থিতি স্বীকার করার অর্থ আদতে দণি এশিয়ায় আইএস, আলকায়েদা বা এ ধরণের সংগঠনের উপস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া। সমস্যার আন্তর্জাতিক চরিত্র স্বীকার করে নিলে এটা কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করা কঠিন হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক ভূমিকার কথা ওঠে। দিল্লি সেটা চায় না। বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনের বিষয়টি দিল্লি তার নিজের অধীনস্থ বিষয় হিসাবেই মীমাংসা করতে চায়। আন্তর্জাতিক সমস্যাকে দিল্লি বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাকি সমস্যা হিসাবে সংকীর্ণ করে রাখার সুবিধা হচ্ছে, বাংলাদেশের পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা কার্যক্রম সব কিছুর ওপর দিল্লির আধিপত্য বহাল রাখা। দিল্লি বাংলাদেশকে কার্যত যেন তার এক ধরনের উপনিবেশের অধিক কিছু গণ্য করে না। বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান দিল্লিরই এখতিয়ার মনে করা হচ্ছে। এই েেত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের হস্তপে দিল্লি চায় না।
মুশকিল হচ্ছে, দিল্লি মোটেও সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যার কারণ। দ্বিতীয়ত সীমান্তে হত্যা, পানি না দেয়া, জবরদস্তি করিডোর আদায় করে নেয়া এবং শেখ হাসিনাকে নিঃশর্তে সমর্থন করে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে প্রবল দিল্লিবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে, দিল্লির পে যার মোকাবিলা এখন অসম্ভবই বলতে হয়। এর পাশাপাশি প্রবল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ও মোদির মতারোহণ বাংলাদেশের জনগণের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। দমনপীড়ন দিয়ে জনগণের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার নিরসন এখন একদমই অসম্ভব। হোলি আর্টিজানের ঘটনা বিপুলসংখ্যক তরুণকে রাজনৈতিক পথ ও পন্থায় উজ্জীবিত করবে তা মোকাবিলার মতা ও বিচণতা দিল্লির রয়েছে, এটা বিশ্বাস করা এখন কঠিন। অনেকেই মনে করছেন, দিল্লির বাংলাদেশ নীতির কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক প্রান্তে এসে ঠেকেছে। এর মূল্য তাদেরও আজ হোক কি কাল হোক, দিতে হবে।
অবস্থা এখনই এমন হয়েছে যে, সরকারের প্রবল আগ্রহ ভারতের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও কর্মকর্তাদের ঘাড়ে ভর করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায় পালন, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজটি করা। আর ভারত একবার লোভে পড়ে প্রায় রাজি হয়ে যাচ্ছিল বটে, তবে পরণেই হুঁশ হওয়ায় মনে পড়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে জঙ্গিদের টার্গেট হয়ে যাওয়ার বিপদ অনেক গভীর। এই দোনামোনার প্রকাশ আমরা দেখেছি ভারতীয় বোমা বিশেষজ্ঞ আসা না আসার খবরে। খবরটা এসেই আবার মিলিয়ে গেল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন, সহিংসতা বিস্তৃতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পেছনে দিল্লির মদদ, সমর্থন ও সক্রিয় অবস্থানই হতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান সন্ত্রাস ও সহিংসতার প্রধান কারণ। নিরাপত্তা পরিস্থিতির সংকট আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহণ করবার েেত্রও এটাই হতে পারে মূল কারণ। বাংলাদেশ ও ভারতের শান্তিপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক জনগণকে এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। আলকায়েদা, আইসিস ও অন্যান্য সংগঠনের জন্য বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই উর্বর ত্রে হয়ে উঠেছে। ভারতের জনগণকে এই েেত্র বিশেষভাবে বুঝতে হবে, নিজেদের ভূমিকা পর্যালোচনা না করে ক্রমাগত ইসলাম ও বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের চর্চা আগুনে ঘি দেয়ার অধিক কিছু করবে না। এই সময় দরকার চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও দূরদৃষ্টি। দরকার পরস্পরকে বোঝা এবং জনগণের পর্যায়ে সহযোগিতার ত্রেগুলোকে চিহ্নিত করা।
যদি ক্যাপারের যুক্তি মানি, তাহলে দিল্লির ভূমিকাই প্রকারান্তরে বাংলাদেশে আলকায়েদা, আইএস ধরনের সংগঠনের উপস্থিতি ও সক্রিয়তা অনিবার্য করে তুলেছে। দিল্লি বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে নিজের স্বার্থে আরো জটিল করে তুলবে, নাকি দণি এশিয়ায় গণতন্ত্র ও শান্তির স্বার্থে বিচণ ভূমিকা গ্রহণ করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এতটুকুই শুধু বলা যায়, প্রতিবেশীর চালে আগুন লাগলে নিজের ঘরের চালে আগুন ধরা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু দিল্লিকে কে বোঝাবে?
৬ জুলাই ২০১৬। ২২ আষাঢ় ১৪২৩।
বুধবার। শ্যামলী।
- See more at: http://m.dailynayadiganta.com/detail/news/134265#sthash.G0hAbcJR.dpuf

No comments:

Post a Comment