Friday 22 July 2016

সূফি সাহেব কেন অস্থিরতার মধ্যে আছেন ।

সূফি সাহেব কেন অস্থিরতার মধ্যে আছেন ।
সূফি বরষণ

সূফি সাহেব আজকাল অস্থির সময় পার করছেন । অস্থির পৃথিবীর অস্থির রক্তপাত আর ক্রমাগত হত্যাযজ্ঞ দেখে সূফি অস্থির না হয়ে কি পারে?? সেটা জার্মান  ফ্রান্স কিংবা বাংলাদেশ হোক, কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনা । হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কারণ যার হারায় সেই জানে হারানোর কতো ব্যথা  বেদনার। এখন আর বৃষ্টিতে ধরিত্রী সিক্ত হওয়ার সুযোগ পাইনা কারণ তার আগেই মানুষের রক্তে ভিজিয়ে দেয় মাটিকে। এতো রক্ত এতো খুন ধরিত্রী আর নিতে পারছে না, নিশ্চয়ই একদিন রাগে ক্ষোভে অভিশাপ দিয়ে কেঁপে উঠবে।

 আজ রাতে পূর্ব লন্ডন থেকে দক্ষিণ লন্ডনে আমার বাসায় আসার সময় নির্ধারিত রেল মিস করায় অনেকটা পথ বাসে করে আসতে হয়। দেরি হওয়ার কারণ গুলেন আন্দোলনের উপরে পাঠচক্র শেষ করে আসা । তুর্কির গুলেন আন্দোলন সম্পর্কে আর একদিন একটি সম্পূর্ণ লেখা লিখবো ।  আসার সময় উইকেন্ড ফাইডে তরুণ তরুণীদের রক এন্ড রোল অর্ধ উলঙ্গ সফেদ বা  কালো হাতে পলিশ আপেল ভটকা এবং কারো হাতে টাকিলা চুমুক দেয়ার তালে তালে সঙ্গীকে আলিঙ্গন চুম্বন এইসব রাতের লন্ডনের স্বাভাবিক ঘটনা । আমি সূফি হলেও এইসব দৃশ্য দেখতে হয় কারণ চোখের সামনে ঘটে বলে।

এইবার আর এক দুনিয়ার কথা বলি। কামবার ওয়েল নামক স্থানে একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুককে দেখলাম  the dark side of love নামক একটি বিখ্যাত উপন্যাস পড়ছেন । উপন্যাসের পট ভূমি দুটো সিরিয়ার পরিবারের ভালোবাসার গল্প নিয়ে। বৃদ্ধ কায়েসের সাথে অনেক কথা জমে উঠলো। কায়েস বলেন আমি সিরিয়ার ধনী সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান । কিন্তু পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে একটি জাতিকে কবরস্থান বানিয়ে ফেলেছে । আমি পরিবার সম্পত্তি খ্যাতি সব কিছু ফেলে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি জীবন বিনাশী যুদ্ধ থেকে । কেউ বেঁচে নেই আমার পরিবারের বোমার আঘাতে কেড়ে নিয়েছে আমার সব কিছুই । সাগরের পানিতে ভাসতে ভাসতে কিভাবে লন্ডন চলে আসলাম কিছুই মনে নেই । এখন আমাকে রাস্তায় রাত্রিযাপন করতে হয় বলে বৃদ্ধ কায়েসের চোখ দিয়ে ক্রমাগত অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বৃদ্ধের কন্ঠ ভারী হয়ে উঠলো??

 বৃদ্ধ বলেন আমার চেয়েও সাত বছরের ফাতিমার গল্প আরও করুণ । ফাতিমা নামে এক সাত বছরের মেয়েকে দেখেছি তার ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে দীর্ঘ পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবা মাকে কিন্তু সে হয়তো জানেই না তাঁর বাবা মা আর বেঁচে নেই!? তাঁর খোঁজার পথ কোনো দিনই শেষ হবে না হয়তো ??  আজকের সময়ে বৃদ্ধ কায়েস আর শিশু ফাতেমার মতো প্রত্যেক সিরিয়ার মানুষের জীবন যুদ্ধের গল্পটা একই রকমের । সেটা ইরাক হোক ফিলিস্তিন হোক কিংবা লিবিয়া। কিন্তু এইসব মানুষের তো কোনো দোষ ছিল না কেন তাদের এমন কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে ?? যারা এইসবের জন্য দায়ী তারা কি আল্লাহ গজব থেকে বাঁচতে পারবে?? পৃথিবীর এইসব অস্থির ঘটনা দেখে সূফি সাহেব নিজেকে আর স্থির রাখতে পারছিনা  ।।

সামনে নেহরুর ভারত থেকে দেশটা নরেন্দ্র মোদীর ভারত হয়ে গেল



প্রবন্ধ ১

চোখের সামনে নেহরুর ভারত থেকে দেশটা নরেন্দ্র মোদীর ভারত হয়ে গেল

এক দিকে উন্নয়ন, অন্য দিকে ধর্মনিরপেক্ষতা— এই উভমুখী আধুনিকতা চরিত্রে ভারতীয় নয় কোনও মতেই। কিন্তু, নেহরুর মৃত্যুর পরও পঞ্চাশ বছর ভারতীয় রাষ্ট্র এই আধুনিকতার অভিজ্ঞান বজায় রেখে চলেছিল।

অমিতাভ গুপ্ত

২১ জুলাই, ২০১৬, আনন্দবাজার পত্রিকা http://www.anandabazar.com/editorial/from-nehru-to-modi-india-s-reformation-1.439002

এক জন পেরেছেন, অন্য জন চেষ্টাও করেননি। জওহরলাল নেহরু ও নরেন্দ্র মোদী।

স্বাধীন ভারতে যে মুসলমানরা থেকে গেলেন, এই দেশের প্রতি আনুগত্য প্রমাণের দায় তাঁদেরই।’ কথাটি যিনি বলেছিলেন, নর্মদা বাঁধের তীরে তাঁর প্রায় ৬০০ ফুট লম্বা মূর্তি তৈরি করছেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪ সালের আগে অবধি মুসলমানদের সেই দায় নিতে হয়নি— অন্তত রাষ্ট্র তাঁদের কাছে তেমন দাবি করেনি। জওহরলাল নেহরুর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে সংখ্যালঘুদের সেই দায় থেকে রক্ষা করে গিয়েছে। সর্দার পটেল যে সময় মুসলমানদের আনুগত্যের প্রমাণ দাবি করার কথা বলেছিলেন, ঠিক সেই সময়ই নেহরু বলেছিলেন, ‘সংখ্যালঘুদের প্রতি শুধু সমদর্শী হলেই চলবে না, তাঁরা যাতে সেটা অনুভব করতে পারেন, তা নিশ্চিত করাও সরকারেরই দায়িত্ব।’ অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবি ওঠার পর বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যা করতে পারে, সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে তা পারে না— তারা সংখ্যালঘু বলেই পারে না।’

যে সময় নেহরু সংখ্যালঘুদের প্রতি বিশেষ যত্নের কথা বলছেন, ঠিক তখন ভারত দাঁড়িয়ে ছিল এক বিচিত্র সন্ধিক্ষণে। পূর্ব-পশ্চিমে রক্তক্ষয়ী বাঁটোয়ারা পেরিয়ে যে দেশ তৈরি হল, তার ভূগোল র‌্যাডক্লিফের ছুরির ডগায় তৈরি। কিন্তু, শুধু ভূগোলই তো দেশ তৈরি করে না। তার জন্য গুজরাতের সঙ্গে অসমকে, পঞ্জাবের সঙ্গে তামিলনাড়ুকে কোনও একটা বিশেষ— একক— সুতোয় বাঁধতে হয়, একটা একক পরিচিতি তৈরি করতে হয়। ইতিহাসের এই মুহূর্তটায় সেই ভারতের সেই একক পরিচয়ের মধ্যে হিন্দুত্ব ঢুকে পড়তে পারত অবলীলায়।

ইতিহাসের আলোচনা কাউন্টারফ্যাকচুয়ালকে এড়িয়ে চলে— কী হলে কী ঘটতে পারত, সেই চর্চা তার স্বভাববিরুদ্ধ। খবরের কাগজের লেখায় সেই দায় নেই। অএতব, ভাবা যেতেই পারে, সর্দার পটেলের নরম হিন্দুত্ববাদের পথে যদি হাঁটতেন নেহরু, কী হত? ঘরে-বাইরে অনেক বাধা অনায়াসেই এড়িয়ে যেতে পারতেন তিনি। যে উন্নয়নের পথে ভারতকে চালাতে চেয়েছিলেন, তাতে হয়তো আরও বেশি সমর্থন পেতেন। পাকিস্তানের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ‘হিন্দুস্তান’ নির্মাণের প্রকল্পটি নেহরু নিলে হয়তো কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের পায়ের তলার জমিও কেড়ে নিতে পারতেন তিনি। শুধু যদি তাঁর হাত ধরে ভারতীয় রাষ্ট্রের পরিচয়ে হিন্দুত্ব ঢুকে পড়ত।

সেই ঢুকে পড়ার চেহারা আমরা আজ বিলক্ষণ জানি। গুজরাতের দলিতরা জানেন, রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে হিন্দুত্ব ঢুকে পড়লে ‘গোহত্যার অপরাধে’ কী ভাবে প্রহৃত হতে হয় গৌরক্ষা বাহিনীর লেঠেলদের হাতে। তারও আগে, দাদরিতে মহম্মদ আখলাক গণপিটুনিতে মারা গিয়ে, তামিলনাড়ুতে পেরুমল মুরুগান নিজের লেখকসত্তার মৃত্যু ঘোষণা করে, কর্নাটকে এম এম কালবুর্গি বুকে বুলেট নিয়ে নিহত হয়ে, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কানহাইয়া কুমার হাজতে দিন কাটিয়ে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করলে কী হয়, কী হতে পারে। আক্রান্ত চার্চগুলো জানে, মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়া সুধীন্দ্র কুলকার্নি জানেন, মুম্বইতে গান গাইতে না পারা গুলাম আলি জানেন, রাষ্ট্রীয় পরিচিতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নিলে দেশটার চেহারা ঠিক কেমন হতে পারে।

চোখের সামনে ভারত বদলে গেল। নেহরুর ভারত থেকে দেশটা নরেন্দ্র মোদীর ভারত হয়ে গেল।

ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে নেহরুর সামনে ভারতের সংজ্ঞা তৈরি করার কথা বলছিলাম। নেহরুরও একটা অভিন্ন সুতোর প্রয়োজন ছিল, গোটা দেশকে গেঁথে ফেলার জন্য। তাঁর রেটোরিকে— রাজনৈতিক বয়ানে— সেই সুতো ছিল উন্নয়ন। আধুনিকতা যাকে ‘উন্নয়ন’ বলে চিহ্নিত করে, সেই উন্নয়ন। আর, তার উল্টো পিঠে ছিল তাঁর অন্য কর্মসূচি— ধর্মনিরপেক্ষতা। বস্তুত, ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের পরিসরে কোথাও ধর্মকে সূচ্যগ্র জমিটুকু না ছাড়া। তাঁর বয়ানে উন্নয়ন যতখানি ছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা ততখানি নয়। কিন্তু, কর্মসূচিতে সম্ভবত অনুপাতটা উল্টো ছিল।

এক দিকে উন্নয়ন, আর অন্য দিকে ধর্মনিরপেক্ষতা— এই উভমুখী আধুনিকতা চরিত্রে ভারতীয় নয় কোনও মতেই। নেহরু নিজেও তো শিক্ষায়, মননে ভারতীয় ছিলেন না। কিন্তু, কী আশ্চর্য, ১৯৬৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পরও পঞ্চাশ বছর ভারতীয় রাষ্ট্র এই আধুনিকতার অভিজ্ঞান বজায় রেখে চলল। যিনিই প্রধানমন্ত্রী হোন, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, ভারতে নেহরু যুগের উত্তরাধিকার বজায় ছিল।

অটলবিহারী বাজপায়ীর আমলেও। ২০০২ সালে গুজরাতে গণহত্যা হয়েছিল, বাজপায়ী রাজধর্মের কথা বললেও নরেন্দ্র মোদীকে বরখাস্ত করতে পারেননি, সবই ঠিক— কিন্তু, সেই দাঙ্গা, অথবা ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়া, ভারতে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে গণ্য হয়নি। যেমন, ২০১৫ সালে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে পেরুমল মুরুগনের হেনস্থা হওয়া, প্রশাসন, রাজনীতি অথবা সমাজের তাঁর পাশে দাঁড়াতে অস্বীকার করা যেমন ‘স্বাভাবিক’ বোধ হয়, ২০০৬ সালে মকবুল ফিদা হুসেনের ভারত ছাড়তে বাধ্য হওয়া ততখানি ‘স্বাভাবিক’ ছিল না।

স্বাভাবিকতার বোধ বেমালুম বদলে গেল? নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন, আর দেশের একশো পঁচিশ কোটি মানুষ রাতারাতি ধর্মনিরপেক্ষ থেকে তীব্র সাম্প্রদায়িক হয়ে গেলেন? বাবরি মসজিদ সাক্ষী, দেশের সব প্রান্ত থেকে— পশ্চিমবঙ্গ থেকেও— রাজ্যের নাম লেখা ইঁট পৌঁছেছিল অযোধ্যায়, রাম মন্দির তৈরি করার জন্য। তখন নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের এক সামান্য সঙ্ঘসেবক। ভারতীয় হিন্দুরা নরেন্দ্র মোদীর কারণে সাম্প্রদায়িক হননি, সাম্প্রদায়িকতা তাঁদের মধ্যে ছিলই। শুধু, ২০১৪ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, তখন তাঁরা দেখলেন, এক বিপুল গণহত্যার দায় মাথায় নিয়েও প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়। ২০১৪ সালের মে মাসেই ভারত জানল, সাম্প্রদায়িক হওয়ার মধ্যে আর লজ্জা নেই। এই ভারত আর নেহরুর নয়। এই ভারত, অতঃপর, মোদীর।

নেহরুর রেটোরিকে যেমন উন্নয়ন ছিল, মোদীরও বিলক্ষণ আছে। নেহরুর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থাকলে মোদীর মেক ইন ইন্ডিয়া আছে। নেহরু নদীবাঁধকে আধুনিক ভারতের মন্দির হিসেবে দেখলে মোদীও স্মার্ট সিটি-র কথা বলেছেন। ফারাক রেটোরিকে নয়, ফারাক আজেন্ডায়— কর্মসূচিতে। কোন ভারতকে তাঁরা উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে চান, ফারাক সেই ভাবনায়। নেহরু যে ভারতকে উন্নয়নের সুতোয় বাঁধতে চেয়েছিলেন, তাকে ধর্মনিরপেক্ষ হতেই হত। মোদীর ভারত হিন্দু জাতীয়তাবাদের, যেখানে ‘ভারতমাতা’ আরাধ্যা, গো-মাতাও। সেখানে ভারতীয়ত্বের সঙ্গে হিন্দুত্বের সংযোগ অচ্ছেদ্য। নেহরু দেশের সংজ্ঞায় ধর্মকে তিলমাত্র জায়গা দেননি, আর মোদী দেশের ধারণাটিকেই মুড়ে দিয়েছেন গৈরিক পতাকায়।

আজীবন সঙ্ঘের পাঠশালার ছাত্রের পক্ষে নেহরুর আধুনিকতার মাপ বোঝা কার্যত অসম্ভব। নরেন্দ্র মোদীও পারেননি। চেষ্টাও করেননি। সঙ্ঘ যে ভাবে ভারতকে ভেবেছে, গোলওয়ালকর তাঁর ‘উই অ্যান্ড আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’-এ ভারতের যে ছবি এঁকেছেন, নরেন্দ্র মোদীর মনেও সেই ভারতেরই অধিষ্ঠান। সেই ছবিতে ভারতীয় মানে হিন্দু, বা অন্তত হিন্দুর আধিপত্য মেনে নেওয়া সংখ্যালঘু। হিন্দুত্বের আধিপত্যকে প্রশ্ন করা মানে, অথবা হিন্দু ভারতের চোখে যা না-হক, তার পক্ষে কথা বলা মানেই ভারত নামক রাষ্ট্রের বিরোধিতা। কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদরা যে অঙ্কে ভারত-বিদ্বেষী।

হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার এই চেষ্টা অবশ্য সহজে চোখে পড়ে। যা প্রায়শ চোখ এড়িয়ে যায়, তা হল, এই হিন্দুত্ববাদকেই ‘স্বাভাবিক’ করে তোলার চেষ্টা। মাসখানেক আগে মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফডণবীস একটা প্রশ্ন করেছিলেন— ‘ভারতে থাকলে ‘ভারতমাতার জয়’ বলতে আপত্তি কোথায়?’ আপত্তি ঠিক কোথায়, ভেঙে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। আদৌ কারও নামে জয়ধ্বনি দেব কেন, এই প্রশ্ন তুললেও বলতে হয় অনেক কিছু। তত কথা বলার সময় প্রশ্নকর্তারা দেন না। তার আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, যারা ভারতমাতার জয় বলতে পারে না, তারা নিতান্ত দেশদ্রোহী— যেন ভারতমাতার জয়ধ্বনি করাটাই ভারতীয়দের ‘স্বাভাবিক’ কাজ। দেশ জিনিসটা যে ভারতমাতার চেয়ে মাপে বড়, সে কথা বলার আর অবকাশই থাকে না।

বলতেই পারেন, এর কোনও কথাই নরেন্দ্র মোদীর নয়। কোনও কথা যোগী আদিত্যনাথের, কোনও কথা গিরিরাজ কিশোরের, কোনওটা স্মৃতি ইরানি, কোনওটা রাজনাথ সিংহ আর কোনওটা দিলীপ ঘোষের। তার দায় নরেন্দ্র মোদী নেবেন কেন? একটা বহু পুরনো ছবির কথা মনে করিয়ে দিই। ১৯৪৭ সালের অগস্ট-সেপ্টম্বর। দিল্লি ভরে উঠেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুতে, হাওয়ায় ভাসছে অজস্র হাড় হিম করা নৃশংসতার গল্প। এক দিন, নেহরুর বাসভবনের কাছেই, কয়েক জন মুসলমানকে ধরে ফেলল এক দল হিন্দু। হয়তো মেরেই ফেলত, কিন্তু তার আগেই খবর পেয়ে ছুটে এলেন জওহরলাল। তাড়া করলেন সেই হিন্দুদের। তারা পালাল। এই আখ্যানের পাশে দাদরি হত্যাকাণ্ডের পর মোদীর নিস্পৃহ নীরবতার কথা স্মরণ করুন। কেন মোদীকে দায় নিতেই হবে, বোঝা যাবে।

নেহরুর ভারতের মৃত্যুতে কেন আমাদের সবার শোকাহত হওয়া উচিত, সেটা বুঝতেও যেমন সমস্যা নেই।

The fall of the turkish model

পড়া শুরু করলাম এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি । আর সবাইকে পড়ার অনুরোধ করছি ।
 Description
Review
“A forensic analysis of the AKP-Erdoğan phenomenon.”
—Ece Temelkuran, New Left Review

“Tuğal’s book fills a critical gap in analysis on Turkey’s current political trajectory.”
—Claire Sadar, Muftah
Product Description
The brief rise and precipitous fall of “Islamic liberalism”

Just a few short years ago, the “Turkish Model” was being hailed across the world. The New York Times gushed that prime minister Recep Tayyip Erdogan and his Justice and Development Party (AKP) had “effectively integrated Islam, democracy, and vibrant economics,” making Turkey, according to the International Crisis Group, “the envy of the Arab world.” And yet, a more recent CNN headline wondered if Erdogan had become a "dictator.”

In this incisive analysis, Cihan Tugal argues that the problem with this model of Islamic liberalism is much broader and deeper than Erdogan’s increasing authoritarianism. The problems are inherent in the very model of Islamic liberalism that formed the basis of the AKP's ascendancy and rule since 2002—an intended marriage of neoliberalism and democracy. And this model can also only be understood as a response to regional politics—especially as a response to the “Iranian Model”—a marriage of corporatism and Islamic revolution.

The Turkish model was a failure in its home country, and the dynamics of the Arab world made it a tough commodity to export. Tugal’s masterful explication of the demise of Islamic liberalism brings in Egypt and Tunisia, once seen as the most likely followers of the Turkish model, and provides a path-breaking examination of their regimes and Islamist movements, as well as paradigm-shifting accounts of Turkey and Iran.
About the Author
Cihan Tugal is the author of Passive Revolution: Absorbing the Islamic Challenge to Capitalism. He is an associate professor of sociology at the University of California, Berkeley.

Monday 18 July 2016

বাংলাদেশের হিন্দুদের সাম্প্রদায়ীকতা...

বাংলাদেশের হিন্দুদের সাম্প্রদায়ীকতা...
-------------------------------------------------------------লিখেছেনঃ মুনশি বিশ্বজিৎ


সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা বাড়ছে, দেশজুড়ে হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা বাইড়া চলতেছে।

এই ধরনের হত্যাকান্ডে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বিচলিত। গত কয়েক দিনে,দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। এতে করে হিন্দুরা তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকন্ঠিত এবং শঙ্কিত। ফলে গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাড়াইছে-- এই ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধ আর সাধারন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হিন্দুদের করনীয় কি? সোজা কথায় বললে, বাংলাদেশে হিন্দুদের বাইচা থাকার উপায় নিয়া দেশের হিন্দুরা কি ভাবতেছে ?

বাংলাদেশের হিন্দুরা তাঁদের উপর নাইমা আসা সহিংসতা রুখতে কি কি পদক্ষেপ লইতে চান, নিজদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে, তাঁরা কিভাবে লড়তে চান... এইটা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কি কি কাজ, তাঁরা জীবনে কখনও করবেন না, কোন রাস্তায় তাঁরা কখনও হাটবেন না... বাংলাদেশের হিন্দুরা তা ইতিমধ্যেই সবার কাছে স্পষ্ট করছেন।

বাস্তবতা হইলো, বাংলাদেশে যদি সহিংসতা বাড়তে থাকে, মানুষ যদি প্রতিদিন গুম হয়া উধাও হয়া যাইতে থাকে, বিচারের আগেই বিচারাধীন যে কোন ব্যক্তি যদি আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে খুন হইতে থাকে--, বাংলাদেশের হিন্দুদের এতদিন তাইতে কোন ধরনের নুন্যতম দুশ্চিন্তা দেখা দেয় নাই। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দেশের বিরোধী রাজনীতির কর্মীদের এই বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড আর গুম হয়া যাওয়াতে তাঁদের মদদ যোগাইতে দেখা গেছে। ইন্ডিয়ার আশির্বাদপুষ্ট বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারের কোলে উইঠা বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজদের নিরাপদ ভাবতে চাইছেন,আর বর্তমান সরকারের বিরোধী যে কাউকে সরকারের বিনাবিচারে খুন করাকে সরবে উৎসাহ যুগায়ে গেছেন।

রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদের এক অংশের প্রতি এই ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ বিচার চালাইতে থাকে,তাতে রাষ্ট্রের সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার উপর তার খারাপ আছর পড়ে কিনা, বাংলাদেশের হিন্দুদের এই সব বিষয় নিয়া দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইতে দেখা যায় নাই। বরং অ-সেকুলার মুসলমান কুপানির উন্মত্ত উল্লাশে তাঁদের সাধারন বিচারবুদ্ধি ঝাপসা হয়া গেছে। রাষ্ট্রের এই সব গনবিরোধী আচরনকে তাঁরা বিচার করতে গেছেন, নিজদের স্বার্থের দাড়িপাল্লায়। তাঁদের ভাবখানা হইলো, রাষ্ট্রের এই ধরনের তুঘলঘিতে যদি আমার ফায়দা হয়, তবে আমি চুপ কইরা থাইকা বরং রাষ্ট্রকে এই সব তুঘলঘি কাজ করার জন্য আরও তাল দিব। এতে যদি রাষ্ট্র আর তার বিচার ব্যবস্থা জাহান্নামে যায়, তো তাতেই সই, আমার কি!

আসলেই তো, তাঁদের কী?

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের কোন মানুষ আজ নিজকে নিরাপদ ভাবতে পারে না। এই মুহুর্তে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সারা দেশের প্রত্যেকটা মানুষ রইছে অত্যাচারিত হওয়ার, গুম হওয়ার, কিংবা খুন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে। অথচ যখনই যে অবস্থায় বাংলাদেশের কোন হিন্দু নাগরিক যদি কোন ধরনের সহিংসতার শিকার হইছেন, তাহলে এইটাকে  বাংলাদেশের হিন্দুরা বিনা বাক্য ব্যয়ে সাম্প্রদায়ীকতা হিসাবে চিহ্নিত করছেন। মজার ব্যাপার হইলো, অন্য আর কোন ধরনের সহিংসতাকে তাঁরা সাম্প্রদায়ীকতা হিসাবে বিবেচনা করেন না। সাম্প্রদায়ীকতা নিয়া  তাঁদের বক্তব্য এবং ভাষ্য খুব পরিস্কার-- বাংলাদেশে যখনই কোন হিন্দু, যে কোন ধরনের ক্ষতিগ্রস্ততার মুখে পড়ুক, এইটা অবশ্যই বিবেচ্য হবে সাম্প্রদায়ীক আক্রমন হিসাবে। আর তার জন্য দায়ী থাকবে বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, মানে মুসলমান মাত্রই সব নাগরিককে।  তাঁদের বয়ান  সোজা বাংলায় বলতে গেলে, এ দেশের একশভাগ মুসলমানরাই, বাংলাদেশের হিন্দুদের যাবতীয় দুর্ভোগের জন্য দায়ী। আর বাংলাদেশের মুসলমানরাও কেন অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, গুম খুন হচ্ছে- এটার পিছনে সাম্প্রদায়ীকতা নাই, কিন্তু অন্য কি কারন আছে-- সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দুদের চিন্তা অতদুর পর্যন্ত্য আর যাইতে চায় না। হাজার হাজার বিরোধী দলের কর্মী খুন হইলে, সেইটা তাঁদের কাছে হইলো চেতনার বাস্তবায়ন। বস্তুতঃ জনগনের মানবাধিকার আর জান-মালের নিরাপত্তা নিয়া বাংলাদেশের হিন্দুদের এতদিন কোন ন্যুনতম মাথাব্যাথাও কিন্তু দেখা যায় নাই। এখন নিজদের ঘাড়ে যখন দুই চারটা কোপ আইসা পড়ছে, শুধু মাত্র তখনই তাঁরা চিৎকার শুরু করছে বটে, তবে তাও এই রাষ্ট্রে কেবল হিন্দুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কথা তুইলা। এতদিন পরে আইসা এইটুকুতে তাঁদের মুখ খুলছে। সাধারণভাবে জনগনের অধিকার নিয়া তাঁদের কোন মাথাব্যাথা নাই, এই বিষয়ে সোচ্চার হওয়াটা তাঁরা এখনও জরুরত মনে করে না।  

কথা এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের হিন্দুরা তাঁদের দুর্ভোগের প্রতিকারের জন্য কোন মুসলমানের সাথে মিইলা কথা বলতে, তাঁদের কাছে যাইতেও রাজী না। ক্যান? কারণ আসল কথা হইলো, তাঁরা মুসলমানদের সাথে একত্রে কোন সমাজ কম্যুনিটিও বানাইতে রাজী না। কারন বাংলাদেশের একশভাগ মুসলমানদের সে দেখে শক্র হিসাবে। এদেশের হিন্দুদের দুর্ভোগের কারন হিসাবে, সে মুসলমানদের একক ভাবে দায়ী করে, ফলে তার সাথে মিলে মিশে কোন সমাজ বানানো আর সেখানে মুসলমানদের সাথে একত্রে কোন সক্রিয়তায় অংশ নেওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না। যদি প্রেজেন্ট রেজিম তাকে হতাশ করে, তাকে সুরক্ষা না দিতে পারে, সে বরং খুঁজতে চাইবে বিজেপি কিংবা ইন্ডিয়ান সরকারের আশির্বাদ। তবুও সে মুসলমানদের কাছে তার ভরসার জন্য যাইতে রাজী না।

ফলে তার সংগঠন হইলো হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। খেয়াল করেন, এইখানে মুসলমানদের আপনি পাইবেন না। কারন সে মনে প্রানে বিশ্বাস করে, তার লড়াইটা বাংলাদেশের শতভাগ মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ফলে তার সংগঠনে কোন মুসলমান থাকতে পারে না। এই 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ' সংগঠন বানানোর ভিতর দিয়া, বাংলাদেশের হিন্দুরা প্রমান করছে, সে এমন কোন সমাজ কিংবা কম্যুনিটিতে বিশ্বাস করে না, যেইটা কোন ধর্মীয় পরিচয়ের উপর দাড়ায়া নাই। অর্থাৎ বাংলাদেশের হিন্দুরা বাংলাদেশে এমন একটা সমাজে বসবাস করতে চায়, যেইটা পরিস্কারভাবে একটা ধর্মীয় আইডেন্টিটির উপর দাড়ায়া আছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের কাছে তাই, সেইটাই হলো সমাজ, যেখানে হিন্দু মুসলমান সুস্পষ্ট আলাদা আলাদা পরিচয়ে বসবাস করে। হিন্দু মুসলমান ধর্ম বর্ন নির্বিশেষ সব পরিচয়ের মানুষ, এক সাথে একত্রে যে সমাজে বাস করে, বাংলাদেশের হিন্দুরা সেই সমাজ তাদের কোন কাজে আসবে বইলা বিশ্বাস করে না।  তাঁরা যেই  সমাজ চায় সেখান থিকা মুসলমানদের বাদ দিতেই হবে। তাই মুসলমানদের  এক্সক্লুড কইরা তাঁরা এক খন্ডিত পরিচয় নিয়া সমাজে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ হিসাবে থাকতে চান। অথচ তামাশা এখন দ্যাখেন, উনারা দাবী করেন, এই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ সংগঠন উনারা বানাইছেন, এইটা নাকি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। উনারা মুখে বলেন, উনারা নাকি লড়তে চান সাম্প্রদায়ীকতার বিরুদ্ধে, অথচ একটা অল ইনক্লুসিভ সমাজ, যেখানে হিন্দু মুসলমান সবাই একত্রে বসবাস করে, কমন দাবী আদায়ের পক্ষে লড়ে, একটা গনতান্ত্রিক সমাজ, রাজনৈতিক পরিসর  বিনির্মানের কথা বলে--- সেই সমাজ বাংলাদেশের হিন্দুরা চান না।  তাঁরা মুসলমানদের সাথে একত্রে পথ চলতে সমাজ কমিউনিটি গড়তে অপছন্দ করেন, বেঠিক মনে করেন!!!

মুসলমানদের সাথে মিইলা এদেশের হিন্দুরা যে একত্রে কোন সমাজ কিংবা কম্যুনিটিও বানাইতে রাজী হইলো না, তার নীট ফলাফলটা হইলো-- হিন্দুদের উপর যে সহিংসতা হইছে, যেইটার বিরুদ্ধে জনগনের একটা সংগঠিত লড়াই, যাবতীয় সাম্প্রদায়ীকতা আর অগনতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ হিসাবে দাঁড়াইতে পারলো না। হিন্দু মুসলমান সকলের মিলিত এই প্রতিরোধ লড়াই দিয়েই এই রাষ্ট্রের সব গাফিলতি,নষ্টামি তার বেইনসাফি আর তার গনবিরোধী ভুমিকার বিরুদ্ধে একটা সম্মিলিত প্রতিবাদ সুসংগঠিত হইতে পারতো। অথচ বিগত কয়েক বছরের বাংলাদেশের হিন্দুদের রাজনৈতিক পরিসরের ভুমিকার কথা যদি ধরেন-- একটা গণতান্ত্রিক শক্তিশালী রাষ্ট্র যা সংখ্যালঘুদের প্রটেক্ট করতে পারে, সেই গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই দূরে থাক-- বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক কাঠামো তার লিবারেল ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চাম্পিয়ন যে বর্তমান রেজিম, বাংলাদেশের হিন্দুরা হইলো সেই গনবিরোধী সরকারের সব চাইতে বড় আর প্রধান পার্টনার। ডাকাতের সবচেয়ে বড় স্যঙাৎ।

বাংলাদেশের মুসলমানরা তাঁদের মতো কইরা লড়তেছে,এই অবৈধ সরকার, তাঁদের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় অনাচার আর গুম খুনের নির্মমতার বিরুদ্ধে। জনগন তাঁদের টিইকা থাকার স্বার্থে, তাঁদের লড়াই এর একটা পথ নিজের মত কইরা তাঁরা বার কইরা নিতেছে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুরা এই গনদুষমন হিসাবে চিহ্নিত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হওয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্বটাই বুঝতে অক্ষম। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের হিন্দুদের মুক্তিদাতা নন, একটা অল ইনক্লুসিভ, মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান, পাহাড়ি, সমতলী, সব আদিবাসী-- সবাইকে নিয়ে গঠিত পলিটিক্যাল কম্যুনিটি যখন একটা শক্তিশালি গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাঁড়ায়-- ক্ষমতা দখল করে, একমাত্র সেই লিবারাল শাসন ব্যবস্থাই সংখ্যালঘুদের জান মালের গ্যারান্টি দিতে পারে। বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য সেইটাই সব চাইতে সম্মানের আর গর্বের ঘটনা হবে। বাংলাদেশের মাটিতে তাঁদের নিরাপত্তা দেয়া এইটা ইণ্ডিয়ান হাইকমিশনের কর্মচারীদের  কিংবা তাঁদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে ক্ষমতায় টিকা থাকা কোন সরকারের কাম না।

এই সত্য বাংলাদেশের হিন্দুরা কবে বুঝবেন...?লেখক কানাডা প্রবাসী  চিন্তক, লেখাটি তার ফেইসবুক থেকে নেয়া। বিশ্বজিৎ কে ফেইসবুকে ফলো করতে ক্লিক 

বাংলাদেশের “হিন্দু মন” ও তার বিবর্তন

বাংলাদেশের “হিন্দু মন” ও তার বিবর্তন
লেখাটি তার ফেইসবুক পোস্ট থেকে নেয়া। 

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় নানা ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে গেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা কষ্ট বঞ্চনা, অভিমান আর দুঃখের ইতিহাস ছাড়াও তার সাথে আছে অনেক ভুল-শুদ্ধ সিদ্ধান্ত এমনকি রাজনৈতিক বোকামি। আর এসব কিছুর উপরে আছে নানা রাজনৈতিক অভিঘাত যা বর্তমানের হিন্দু মানসকে তৈরি করেছে। তাই এই হিন্দু মানস সবসময় একই রকম ছিলনা। এর নানান চড়াই উতরাই আছে, বাঁক আছে। এইসব ঘিরেই আজকের হিন্দু মানস তৈরি হয়েছে। তাই হিন্দু মানসের একটা নির্মোহ আলোচনায় এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলির অভিঘাত বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই আলোচনা শুরু করার কোন বিকল্প নাই। এই আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। এই গুরুত্তপুর্ণ রাজনৈতিক পর্যালোচনা থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের উত্তরণের পথ।
হিন্দু মানস পরিবর্তনের প্রথম গুরুত্বপুর্ণ এবং নতুন আকার নেয়ার ঘটনাটা ঘটে ৪৭ এর দেশ ভাগের সময়। দেশভাগের সাথে সাথে পুর্ব বঙ্গে জমিদারি শাসন কার্যত উচ্ছেদ হয়ে যায়। হিন্দু সম্প্রদায় হারায় তাঁর একচেটিয়া রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি। ব্যাপক হারে দেশ ত্যাগের ঘটনা ঘটে। থেকে যায় যারা তারাই আজকের বাংলাদেশী হিন্দুদের পুর্বসুরী; হিন্দু মানস সম্পর্কে আমার প্রসঙ্গ এই থেকে যাওয়া হিন্দুদের বিষয়ে। ‘৪৭ কে ঘিরে দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের দাঙ্গা কেন হয়েছিল? তা যে কারণেই হোক, এই বিষয়টা যে কোন রাজনৈতিক দল, বা ধর্মের অনুসারি সবার কাছেই এক অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ হয়ে আছে। বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যে যেভাবে লড়েছিল কেউই অন্তত আশংকা করে নাই যে একটা পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। ফলে বাইরে বলার জন্য দুপক্ষের আলাদা বয়ানে যাই থাক না কেন; যে কোন রাজনৈতিক পক্ষই একান্তে নিজের কাছে বলবার মত এর কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির করাতে পারেনি।
হিন্দু সম্প্রদায়ও হয়ে পরেছিল বিহ্বল; সামাজিক সন্মান, সম্পদ, জমিদারি, দেশ হারিয়ে সব দায় চাপিয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর এবং তার আচরিত ইসলাম ধর্মের উপর। আর সবার উপরে মনের গভীরে লালন করেছিল এক অনুমান যে, “ধর্মই তার দেশ বিভাগ ঘটিত সব দুর্দশার মূল”। কিন্তু শুধু “মুসলমানের ধর্মটা সমস্যা” একথা বলা যায় না বলে বলবার সময় সাধারণভাবে ধর্মবিহীন বা নিধর্মী এক সমাজের অনুমান সে হাজির করেছিল।
দেশভাগের পরে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির হারানোর মানে সাথে সাথে হিন্দুদের সব পুরান বয়ানও হারিয়ে অকেজো হয়ে যায়। তাই নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য সে নতুন বয়ান গঠনের সন্ধানে নামে। আর নিধর্মী এক সমাজের অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে সেই নতুন বয়ানটা সে হাজির করেছিল যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সে হল কমিউনিস্ট পার্টি বা এর নাম আজকের সিপিবি। বিহ্বল অবস্থা কাটানোর জন্য সে আশ্রয় করেছিল কমিউনিস্ট পার্টিকে। পুর্ব বঙ্গে থেকে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জমিদারি হারানো পুরনো জমিদার বংশের ছেলেরা ও অভিজাত হিন্দু মধ্যবিত্তরা এই পার্টিতে দলে দলে ঢুকতে থাকে। কমিউনিস্ট রাজনীতির কয়েকজন আইকনকে দেখলেই এই কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। কমরেড মনি সিংহ, বরুন রায়, ইলা মিত্র, রবি নিয়োগী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অমল সেন, গুরুদাশ তালুকদার, ধীরেন শীল সহ আরো অসংখ্য নেতার নাম করা যায়, যারা সকলেই প্রত্যক্ষ ভাবে জমিদার এবং একজন নায়েব পরিবারের সন্তান।
পরবর্তিতে ১৯৫১ সাল থেকে পাকিস্তানে ঘটা ব্যর্থ সামরিক ক্যু এর পরিকল্পনার কারণে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হিন্দু মধ্যবিত্তের এক বড় প্রভাব ছেয়ে বসতে থাকে কমিউনিস্ট পার্টিতে। সে সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপক ভাবে সিপিবি করার করার পিছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণ এটাই। সারকথায় বললে, সেই থেকে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় ভেবে এসেছে যে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে তার পোষা বিদ্বেষ বিরাগ সেটার একটা ফয়সালা হতে পারে এভাবে যে, “আমরাও দরকার হলে নাস্তিক হয়ে যাই তবুও যদি কমিউনিস্ট হওয়ার বদৌলতে মুসলমান সম্প্রদায় নাস্তিক হয়েও তার ধর্ম থেকে দূরে সরে তাহলে তো লাভই”। পুর্ববঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিতে নাস্তিকতার ব্যাপক চর্চার এটাও একটা সাম্ভব্য কারণ।
এই ধারা চলে ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার সময় পর্যন্ত। ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক ভাঙ্গনে ও ১৯৯২ সালের সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পরে দুবারই বাংলাদেশের হিন্দুদের বড় অংশই পুনর্গঠিত সিপিবি ঘরানার পক্ষেই থেকে যায়। যদিও পরেরটার ক্ষেত্রে সক্রিয়তার দিক থেকে ব্যাপক হিন্দু হতাশ হয়ে দূরে চলে যায়। তাই এরপরের সময়, ১৯৯২-২০০১ সাল পর্যন্ত এই কয়েকটা বছর ছিল সিপিবির ক্রমাগত ক্ষয়ের যুগ। আর হিন্দু সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে এতদিন যেভাবে সিপিবির মাধ্যমে বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত থাকত সেটা থেকে হতাশা ও ক্রম প্রস্থানের যুগ। যদিও অসাম্প্রদায়িকতার নামে তার ইসলাম –বিদ্বেষী অবস্থান সব খানেই ছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়াতে গ্লোবাল কমিউনিজমের আড়ালে ধর্মবিদ্বেষ বা ইসলামবিদ্বেষ চালানোর সুযোগ আর থাকেনা।
তারপর আসলো ২০০১ সালের নাইন ইলেভেন। শুরু হল বুশ ব্লেয়ারের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ এর কাল। এইবার হিন্দু সম্প্রদায় যেন ফেটে পড়ার সুযোগ নিল। ইসলাম সম্পর্কে তার মনের গহীনে পুষে রাখা বয়ানের সাথে তারা বুশের বক্তব্যের মিল খুঁজে পেল। বাংলাদেশের হিন্দুরা ব্যাপারটাকে দেখলো এভাবে যে; সে যাদের হাতে মার খেয়েছে এতদিন, এইবার আমেরিকার মত পরাশক্তি নেতৃত্বে সেই ইসলামের বিরুদ্ধে এক বৈশ্বিক লড়াই শুরু হয়েছে। সে আকাঙ্খা করলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ছাপ বা আঁচ নিশ্চয় এদেশেও এসে পড়বে। সে আমেরিকাকে বুঝাতে চাইল যে; এই কস্ট তো আমারও, এই আমরাই তো এই সম্প্রদায়ের হাতে সেই ৪৭ সাল থেকে মার খেয়ে আসছি। বৈশ্বিক ভাবে এরা যদি শায়েস্তা হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই হয়, ফলে বুশের পক্ষে তার ঝাপিয়ে পড়ে সমর্থন দেয়া উচিত। হিন্দুরা হয়ে উঠলো “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের” প্রজেক্টের একনিষ্ঠ সমর্থক। এজন্য এই পর্যায়টাকে বলা যেতে পারে আমেরিকার কোলে চড়ে হিন্দুদের সিপিবি থেকেও দূরে চলে যাওয়া, বা অনাস্থার প্রস্থান।
এর মাঝে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক রাজনীতির উত্থান ঘটলো। ততদিনে বুশের বদলে ওবামা আসে অ্যামেরিকায়, অকেজো হয়ে পরা ওয়ার অন টেররের সংশোধনও আসে র‍্যান্ড প্রজেক্টের মাধ্যমে। কিন্তু শেখ হাসিনার ওয়ার অন টেররের নীতি চলতেই থাকার কারণে বাংলাদেশের হিন্দুরাও এর মধ্যে নতুন আলো সঞ্চারিত হয়েছে দেখে সদলবলে আরো বেশি করে নব উদ্যমে আওয়ামী লীগের একনিষ্ট সমর্থক হয়ে উঠে। নতুন আশায় তারা বুক বাধে। যদিও এর ফলাফলে ইসলাম বিদ্বেষ আরও সবল হওয়া ছাড়া কোন ফল নাই।
ওদিকে ২০১৪ সালে ভারতে ক্ষমতায় উত্থান ঘটলো বিজেপির। এছাড়া এবছর কলকাতাতেও প্রাদেশিক নির্বাচন হয়ে গেল। আর শুরু হল বিজেপির আগামি কলকাতা দখলের পরিকল্পনা। আগামিতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে জিততে হবে সেই কৌশলের অংশ হিসাবে (মুসলমানের) বাংলাদেশকেও ব্যবহার করা , বা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাই এবার বিজেপির রাজনীতির প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের একাংশের মধ্যে এই প্রথম প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে বিজেপি ও তার মতাদর্শ। ইসলামের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ সাথে এবার “হিন্দুত্তবাদ” যোগ ঘটলো বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। একদা প্রগতিশীলতার সাথে থাকা একটি সম্প্রদায় ক্রমশই হয়ে উঠেছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি।
কিন্তু এই একাট্টা বিভেদকামী বিদ্বেষ হিন্দু সম্প্রদায় পুষে রেখে কি আদৌ সে নিজ সম্প্রদায়ের উপকার করছে? নাকি এই বিদ্বেষ আরো এক দীর্ঘমেয়াদী যন্ত্রণার উন্মেষের পথ করে দিচ্ছে ও দিবে? এই দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্মোহ দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

Saturday 16 July 2016

বাংলাদেশ জঙ্গিদের টার্গেট হয়ে যাওয়ার বিপদ কি ভারত নেবে ।

লোককথা

মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর জেমস ক্যাপার এ বছর ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে ইউএস আর্মড সার্ভিসেস কমিটি ও সিনেট সিলেক্ট কমিটির কাছে একটি লিখিত প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। এ ধরনের প্রতিবেদনকে বলা হয় ‘ÔStatement for the RecordÕ’। অনেকটা ভবিষ্যতে রেফারেন্সের জন্য নথি করে রাখার মতো ব্যাপার। গুলশানে হোলি আর্টিজানের রক্তপাতের পরে এখন তা রেফারেন্স হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার লিখিত মন্তব্য ছিল ছোট এবং খুবই সংপ্তি। পুরোটাই এখানে তুলে দিচ্ছি :
ÒPrime Minister Sheikh HasinaÕs continuing efforts to undermine the political opposition in Bangladesh will probably provide openings for transnational terrorist groups to expand their presence in the country. Hasina and other government officials have insisted publicly that the killings of foreigners are the work of the Bangladesh Nationalist Party and the Bangladesh Jamaat-e Islami political parties and are intended to discredit the government. However, ISIL claimed responsibility for 11 high-profile attacks on foreigners and religious minorities. Other extremists in Bangladesh— including Ansarullah Bangla Team and Al-QaÕida in the Indian Subcontinent (AQIS)— have claimed responsibility for killing atleast 11 progressive writers and bloggers in Bangladesh since 2013Ó. (†`Lyb, Statement for the Record Worldwide Threat Assessment of the U.S Intelligence Community)
জেমস ক্যাপারের মূলকথা হচ্ছে, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপকে যেভাবে ক্রমাগত দমনপীড়ন করছেন, সম্ভবত সেটাই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর উপস্থিতি বাংলাদেশে সম্প্রসারিত করবে। শেখ হাসিনা এবং তার সরকারি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে জোর দিয়ে বলছেন, বিদেশীদের হত্যা করার যেসকল ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে সেটা মতাসীন সরকারকে বিব্রত করবার জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জামায়াতে ইসলামীর কাণ্ড। আইএসআইএল এই সকল হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করছে অথচ শেখ হাসিনা এবং তার কর্মকর্তারা দোষ চাপাচ্ছেন বিরোধী দলের ওপর। সারমর্মে বলা হোল, একদিকে দমনপীড়ন, অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপকে দোষারোপ এই দুটি কারণই বাংলাদেশে আইসিসের মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠির উপস্থিতি ও বিস্তৃতির কারণ ঘটাবে।
হোলি আর্টিজানের রক্তয়ী ঘটনা প্রমাণ করছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দাদের মূল্যায়ন কমবেশি সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। সেটা হোল মার্কিন গোয়েন্দাদের সঠিক পর্যবেণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র আইএস-এর হোলি আর্টিজানে সরব উপস্থিতি জানান দেবার ঘটনা রোধ করার েেত্র কোনো কার্যকর পদপে নিল না কিম্বা নিতে পারল না কেন? তারা আদৌ রোধ করতে পারত কি না, তার আলাদা মূল্যায়ন হতে পারে। কারণ সেটা সব সময় ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তবে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের য়, ভয়াবহ মাত্রায় মানবাধিকার লংঘন এবং বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন বন্ধ করবার েেত্র দুই-একবার মৌখিকভাবে কূটনৈতিক উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া সন্ত্রাস ও সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে দৃশ্যমান মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা নাই বললেই চলে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠিগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাবার যে আশংকা মার্কিন গোয়েন্দারা করেছে, তার রাজনৈতিক কারণ রয়েই গিয়েছে। বৈধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া ‘তিনি’ বহাল তবিয়তেই আছেন এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। পরিণতি হোলি আর্টিজানের রক্তপাত। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির েেত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণ কী?
এর উত্তর আমরা উন্নাসিকভাবে দিতে পারি। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র এটাই তো করে, একনায়ক ও ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গেই তো তাদের সখ্য। কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয়। অতএব, উন্নাসিক না হয়ে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এশিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনকে মোকাবিলা করা, সমুদ্রে সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা, বাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ, সর্বোপরি চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার েেত্র অগ্রগামী থাকা ইত্যাদি এর কারণ। সে েেত্র দণি এশিয়া এবং বিশেষ ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিপ্রেেিত বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক তরুণকে আইসিস, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-জাতীয় রাজনৈতিক আদর্শ ও সামরিক তৎপরতার দিকে ঠেলে দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিচার উন্নাসিক কায়দায় দিলে চলছে না।
ব্যর্থতার প্রধান কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে আমেরিকার বর্তমান য়িষ্ণু অবস্থা; বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়িত হবার কারণে অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি। সাধারণভাবে বলা যায়, নিজের টাঁকশালে ডলার ছাপিয়ে বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল এখন আর প্রশ্নাতীত নয়। তদুপরি ওয়াল স্ট্রিট ও সমরাস্ত্র শিল্পের আঁতাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টার েেত্রও ফাটল দেখা যাচ্ছে। চীন ও ভারতের উত্থান বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমেরিকা অনেকটা য়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমেরিকা ভারতকে তোলা তোলা করে তোয়াজ করে চলবে, তাতে অবাক হবার কিছু নাই। তোয়াজ করে চলার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, চীনকে ঠেকানো। সে কারণে বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লির নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ওয়াশিংটন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত অথবা অম। ফলে বাংলাদেশের েেত্র দিল্লির নীতির বাইরে আর কোনো ভূমিকা রাখতে আমরা ওয়াশিংটনকে হোলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটা পর্যন্ত দেখিনি, কিম্বা দেখা যায়নি।
দিল্লি শেখ হাসিনাকেই মতায় রাখতে চেয়েছে, বাংলাদেশের মতাসীনদের নীতি আর দিল্লির নীতি অভিন্ন। সেটা হোল, শেখ হাসিনা মতায় থাকুন এবং তা দীর্ঘায়িত করতে রাজনৈতিক প্রতিপকে নির্মূল করা হোক। এই অবস্থায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি বদলাতে চাইলে বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির নীতি বদলানোর কাজ যুক্তরাষ্ট্রকে করতে হবে আগে। মূল অমতাটা এখানে। এই সত্য এখন আগের চেয়ে স্পষ্ট যে, নরেন্দ্র মোদি মতায় আসার পরও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সাউথ ব্লকের আমলারা বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির নীতিনির্ধারণে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। এর বাইরে, অর্থাৎ সাউথ ব্লকের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর নির্দেশিত পথ ছাড়া মোদির দিল্লি কোনো নতুন পথরেখার উদ্ভব ঘটাতে পারেনি। ‘সবাইকে নিয়ে উন্নয়ন’Ñ নরেন্দ্র মোদির এই বুলি নিছকই কথার কথা মাত্র, অকেজো। শেখ হাসিনাকে নির্বিচারের নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়ার বাইরে ভিন্ন বিশ্বপরিস্থিতিতে দিল্লি তার নিজের স্বার্থ নিয়ে নতুন করে ভাবতে অপারগতাই দেখিয়েছে। এর অর্থ, প্রকারান্তরে বাংলাদেশে আইএস-এর উপস্থিতি নিশ্চিত করবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখা এবং বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ও রাজনীতির শর্ত তৈরি করে যাওয়া। ভারতের জন্য সেটি তেমন সুখের না হলেও শেষ পর্যন্ত ভারত এটাই করে চলেছে। এটা জানবার, বুঝবার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির ভূমিকা বদলানোর আদৌ কোনো প্রচেষ্টা নিয়েছে বলে কোনো প্রমাণ দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র দণি এশিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চে পেছনের বেঞ্চে তার গোয়েন্দা ও বিশ্লেষণের দলিলদস্তাবেজ নিয়ে বসে থেকেছে কেবল।
দিল্লির নীতিকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত না করার পেছনে দ্বিতীয় আরেকটি কারণ থাকতে পারে। কারণ হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রার েেত্র বেশ ছাড় বাংলাদেশ থেকে এই অবস্থাতেও পাচ্ছে। জ্বালানি উত্তোলনের জন্য ব্লক পাওয়া, ব্লু ওয়াটারের ওপর আধিপত্য কায়েমের প্রক্রিয়া হিসাবে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, মনসান্তো-সিঞ্জেন্টার স্বার্থে বাংলাদেশের কৃষিতে বিকৃত বীজ বা জিএমও প্রবর্তন ইত্যাদি। এ সব কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে মতায় রাখার সুবিধার দিকটাকেও বিবেচনার মধ্যে রেখে থাকতে পারে।
দুই
বলা বাহুল্য, জেমস ক্যাপারের প্রতিবেদন ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাবিশ্লেষকরা ভালোভাবে নেননি। তার প্রমাণ সাউথ এশিয়া অ্যানালিসিস গ্রুপে প্রকাশিত ভাস্কর রায়ের লেখা থেকেই স্পষ্ট। এই ওয়েবসাইটটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওয়েবসাইট হিসাবে পরিচিত।
ক্যাপারের প্রতিবেদন ছাপা হবার এক সপ্তাহের মধ্যেই ১৬ জুলাই ভাস্কর রায় লিখলেন, বাংলাদেশ সংক্রান্ত মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ‘প্রশ্নাত্মক’, কোশ্চেনেবল। কেন? এর উদ্ধৃতি :
During this period when the BNP-JI alliance ran the country, Indian insurgent groups like the ULFA, NSCN(I/M) and others were given sanctuary in Bangladesh and actively assisted in procuring arms, ammunition and communication equipment which were smuggled into IndiaÕs North-East for waging war against the state. Bangladeshi intelligence organizations like the DGFI and NSI were assisting them. In fact, ULFA commander Paresh Barua and his family lived openly in Dhaka. (†`Lyb, Bangladesh Politics & US IntelÕs Questionable Position)
পুরনো যুক্তি। বিএনপি-জামায়াত আঁতাতের সরকারের সময় উলফা, এনএসসিএন এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপ বাংলাদেশে নির্ভয়ে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিল। তারা বাংলাদেশের ডিজিএফআই এবং এনএস আই-এর সহযোগিতায় বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে নিয়ে আসতে পেরেছিল ইত্যাদি। অতএব শেখ হাসিনাকেই সমর্থন করে যেতে হবে।’ বলা বাহুল্য, তার মানে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে দমনপীড়নের নীতিকেও সমর্থন দেয়া। যদি বিএনপি-জামায়াত এত অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাদের দমন করাই দিল্লির নীতি। সে েেত্র ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশের ভেতরে অপারেট করতেও দ্বিধা করেনি। গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে সীমান্তের ওপারে ভারতে পাওয়া ভারতীয় গোয়েন্দাদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্ক্যান্ডাল হয়ে আছে।
কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিপরীতে তোলা অভিযোগ পুরনো। এগুলো পুরনো তথ্য। ধরা যাক, এই তথ্যগুলো ঠিক; তাহলে কুকর্মের শাস্তি জামায়াত-বিএনপি পেয়েছে, তারা মতায় নাই। তাহলে ভারতের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উচিত সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবা; দণি এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন বিচণতা ও দূরদর্শিতার সাথে বিচার করা। কিন্তু দিল্লি ও ভারতীয় গোয়েন্দারা বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রতি যে নির্বিচার সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেটা আত্মঘাতী নীতি বলা যায়। এর ফল হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে দিল্লির বিরোধকে তীব্র করা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বদল ঘটেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বপরিস্থিতিও বদলে গিয়েছে। আলকায়েদার পরে আইসিস এসেছে। যুদ্ধের চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে নতুন বাস্তবতা ও সমস্যাকে আড়াল করেছেন বারবার। এর মূল্য হোলি আর্টিজানে দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে আর কী ঘটতে যাচ্ছে, আমরা জানি না। বাংলাদেশের শিতি এলিট শ্রেণীর ছেলেরা সিরিয়ায় গিয়ে আইসিসে যোগ দিচ্ছে। তারা গুলশানে ডিপ্লোমেটিক জোনের গহিনে হোলি আর্টিজানে সফল অপারেশন চালিয়ে গর্বের সঙ্গে ভিডিও প্রচার করছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে নির্মূল করে এবং গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটার কোনো অস্তিত্ব না রেখে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ক্রমাগত দমনপীড়ন চালিয়ে গেলে যে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়, সেই শূন্যতার মধ্যে যা হবার তাই হয়েছে।
নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হবার প্রধান কারণ ক্ষমতাসীনদের গণবিচ্ছিন্নতা। যেমন, এক কথায় বললে, জনগণ বর্তমান সরকারকে মতায় রেখেই আইএস পরিস্থিতি মোকাবিলা দেখতে চায় কি না। এ নিয়ে জনগণ ঠিক কী ভাবছে তা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। এ ব্যাপারে সন্দেহ করা যায়। জনগণ কি আস্থা রাখে যে, সরকার ও তার প্রধান কার্যকরভাবে বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন? জবাব হলো, না। আর্টিজানে হামলার সময় থেকে প্রতিটি ঘটনায় জনগণ সন্দেহ করছে, সরকার বুঝি কিছু লুকাচ্ছে, এর পেছনে সরকারেরই হাত রয়েছে কি না। প্রকৃত অপরাধীকে পরিচ্ছন্ন তদন্তে শনাক্ত করার চেয়ে চোখ বন্ধ করে ‘বিএনপি-জামায়াত এটা করেছে’ বলে আর্টিজানের ঘটনাকে নিজেদের মতা টিকানোর পে ব্যবহার করা সরকারের প্রতি সন্দেহ আরো বৃদ্ধি করেছে। ‘করবে কি না’Ñ জনগণের এই প্রবল সন্দেহ শেখ হাসিনা ও তার দলের পে মোকাবিলা করা এখন প্রায় অসম্ভব। তাকে সামনে রেখে পরিস্থিত মোকাবিলার নীতি ও কৌশল গ্রহণের েেত্র জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলাও কঠিন। অথচ এ সময় দরকার ছিল জনগণের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগকে যথাযথ মূল্য দিয়ে জনগণকে নিয়েই পরিস্থিতির মোকাবিলা।
তবে ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উৎকণ্ঠার বিষয়গুলো বোঝা কঠিন নয়। যা একইভাবে, বলা বাহুল্য দিল্লিরও উৎকণ্ঠা বটে। বাংলাদেশকে তা আমলে নিতে হবে। বাংলাদেশ আমলে নিয়েছেও বটে। অভিযোগ মূলত ভারতের বিদ্রোহী দলগুলোর বিরুদ্ধে। ভারতের ইনসারজেন্সির সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকট, কিন্তু এর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো সশস্ত্র হামলা পরিচালিত হয়েছে, এর কোনো প্রমাণ আজ অবধি দিল্লি দিতে পারেনি। প্রমাণের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় কথিত উলফার ঘাঁটি আবিষ্কার করতে হয়েছে তাদের। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাবার দাবি করা হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর থেকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, এর কোনো প্রমাণ নাই। তার মানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিধিবিধান লংঘন করেছে, তেমন কোনো অভিযোগ দিল্লি আন্তর্জাতিক কোনো মঞ্চে হাজির করেছে বলে জানা নাই।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। তাহলে কাশ্মিরসহ ভারতের দণি-পূর্বাঞ্চলের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের দুর্বলতা ও সমর্থন থাকা অন্যায় কিছু নয়। এ কারণে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরা বাংলাদেশে থেকেছে। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। অথচ ভারত তার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের রাজনৈতিক সমাধানে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশকে ক্রমাগত দোষারোপ করেছে, যা মেনে নেবার কোনো যুক্তি নাই।
তবে এই বিতর্কগুলো আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে আপাতত দূরবর্তী প্রসঙ্গ। এটা মিটে গিয়েছে বলা যাবে না, তবে কিভাবে আগামি দিনে প্রত্যাবর্তন করবে, তা আমরা জানি না। ভাস্কর রায় ও ভারতের অপরাপর নিরাপত্তা বিশ্লেষকের লেখা পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায়, ভারতীয় গোয়েন্দাদের দূরদৃষ্টির অভাব খুবই প্রকট। ভাস্কর রায় তার লেখার কোথাও জেমস ক্যাপারের বিশ্লেষণ কিম্বা বাংলাদেশে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সম্পর্কে ভবিষ্যৎ দূরদৃষ্টির বিপরীতে কিছুই বলতে পারলেন না। ক্যাপারের মূল যুক্তি ছিল খুবই সোজা। বিরোধী রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ প্রতিপরে বিরুদ্ধে যদি এ সরকার দমনপীড়ন অব্যাহত রাখে, তাহলে আন্তর্জাতিক টেররিস্ট গ্রুপগুলো বাংলাদেশে হাজির হয়ে যাবে। তাদের উপস্থিতির বিস্তৃতি ঘটবে।
ভাস্কর রায়ের বক্তব্য শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও দলীয় কর্মকর্তাদের মতোই। ‘আইএস মানেÑ বাংলাদেশে জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আর এদের মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত, অতএব সন্ত্রাস দমন করতে হলে বিএনপি-জামায়াত দমন করতে হবে।’ ভারতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দাদের চিন্তার দৌড় সম্পর্কে এখান থেকে আমরা কিছুটা ধারণা করতে পারি।
তিন
কিন্তু আবারো বলি, গুলশানের ঘটনা মার্কিন গোয়েন্দাদের অনুমানই সত্য প্রমাণ করেছে এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দাদের পরিণত করেছে বেকুবে। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দাদের বেকুব ভাববার কোনো কারণ নাই, কিম্বা মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মহা বুদ্ধিমান গণ্য করাও অর্থহীন। ক্যাপার যা বলেছেন তা একদমই কাণ্ডজ্ঞান থেকে বলা, তার বক্তব্যের পে কোনো কংক্রিট তথ্যপ্রমাণ তিনি দেননি। এতে অবশ্য আমাদের লাভতির কিছুই নাই। তবে প্রশ্ন হোল, দিল্লি আন্তর্জাতিক টেররিস্ট গ্রুপের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চায় কেন?
বিভিন্ন দিক থেকে বিষয়টির বিবেচনা দরকার। তবে এটা বোঝা যায়, বাংলাদেশে আইএস, আলকায়েদার উপস্থিতি স্বীকার করার অর্থ আদতে দণি এশিয়ায় আইএস, আলকায়েদা বা এ ধরণের সংগঠনের উপস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া। সমস্যার আন্তর্জাতিক চরিত্র স্বীকার করে নিলে এটা কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করা কঠিন হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক ভূমিকার কথা ওঠে। দিল্লি সেটা চায় না। বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনের বিষয়টি দিল্লি তার নিজের অধীনস্থ বিষয় হিসাবেই মীমাংসা করতে চায়। আন্তর্জাতিক সমস্যাকে দিল্লি বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাকি সমস্যা হিসাবে সংকীর্ণ করে রাখার সুবিধা হচ্ছে, বাংলাদেশের পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা কার্যক্রম সব কিছুর ওপর দিল্লির আধিপত্য বহাল রাখা। দিল্লি বাংলাদেশকে কার্যত যেন তার এক ধরনের উপনিবেশের অধিক কিছু গণ্য করে না। বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান দিল্লিরই এখতিয়ার মনে করা হচ্ছে। এই েেত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের হস্তপে দিল্লি চায় না।
মুশকিল হচ্ছে, দিল্লি মোটেও সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যার কারণ। দ্বিতীয়ত সীমান্তে হত্যা, পানি না দেয়া, জবরদস্তি করিডোর আদায় করে নেয়া এবং শেখ হাসিনাকে নিঃশর্তে সমর্থন করে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে প্রবল দিল্লিবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে, দিল্লির পে যার মোকাবিলা এখন অসম্ভবই বলতে হয়। এর পাশাপাশি প্রবল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ও মোদির মতারোহণ বাংলাদেশের জনগণের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। দমনপীড়ন দিয়ে জনগণের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার নিরসন এখন একদমই অসম্ভব। হোলি আর্টিজানের ঘটনা বিপুলসংখ্যক তরুণকে রাজনৈতিক পথ ও পন্থায় উজ্জীবিত করবে তা মোকাবিলার মতা ও বিচণতা দিল্লির রয়েছে, এটা বিশ্বাস করা এখন কঠিন। অনেকেই মনে করছেন, দিল্লির বাংলাদেশ নীতির কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক প্রান্তে এসে ঠেকেছে। এর মূল্য তাদেরও আজ হোক কি কাল হোক, দিতে হবে।
অবস্থা এখনই এমন হয়েছে যে, সরকারের প্রবল আগ্রহ ভারতের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও কর্মকর্তাদের ঘাড়ে ভর করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায় পালন, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজটি করা। আর ভারত একবার লোভে পড়ে প্রায় রাজি হয়ে যাচ্ছিল বটে, তবে পরণেই হুঁশ হওয়ায় মনে পড়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে জঙ্গিদের টার্গেট হয়ে যাওয়ার বিপদ অনেক গভীর। এই দোনামোনার প্রকাশ আমরা দেখেছি ভারতীয় বোমা বিশেষজ্ঞ আসা না আসার খবরে। খবরটা এসেই আবার মিলিয়ে গেল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন, সহিংসতা বিস্তৃতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পেছনে দিল্লির মদদ, সমর্থন ও সক্রিয় অবস্থানই হতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান সন্ত্রাস ও সহিংসতার প্রধান কারণ। নিরাপত্তা পরিস্থিতির সংকট আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহণ করবার েেত্রও এটাই হতে পারে মূল কারণ। বাংলাদেশ ও ভারতের শান্তিপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক জনগণকে এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। আলকায়েদা, আইসিস ও অন্যান্য সংগঠনের জন্য বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই উর্বর ত্রে হয়ে উঠেছে। ভারতের জনগণকে এই েেত্র বিশেষভাবে বুঝতে হবে, নিজেদের ভূমিকা পর্যালোচনা না করে ক্রমাগত ইসলাম ও বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের চর্চা আগুনে ঘি দেয়ার অধিক কিছু করবে না। এই সময় দরকার চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও দূরদৃষ্টি। দরকার পরস্পরকে বোঝা এবং জনগণের পর্যায়ে সহযোগিতার ত্রেগুলোকে চিহ্নিত করা।
যদি ক্যাপারের যুক্তি মানি, তাহলে দিল্লির ভূমিকাই প্রকারান্তরে বাংলাদেশে আলকায়েদা, আইএস ধরনের সংগঠনের উপস্থিতি ও সক্রিয়তা অনিবার্য করে তুলেছে। দিল্লি বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে নিজের স্বার্থে আরো জটিল করে তুলবে, নাকি দণি এশিয়ায় গণতন্ত্র ও শান্তির স্বার্থে বিচণ ভূমিকা গ্রহণ করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এতটুকুই শুধু বলা যায়, প্রতিবেশীর চালে আগুন লাগলে নিজের ঘরের চালে আগুন ধরা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু দিল্লিকে কে বোঝাবে?
৬ জুলাই ২০১৬। ২২ আষাঢ় ১৪২৩।
বুধবার। শ্যামলী।
- See more at: http://m.dailynayadiganta.com/detail/news/134265#sthash.G0hAbcJR.dpuf

সুন্দরবনের রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে।

পর্ব এক। ভারতীয় আগ্রাসন
মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ_ লেখক লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও পরিবেশ কর্মী ।

রামপালে বর্তমান সরকার দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। এই সংক্রান্ত  সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি প্ল্যান ক্রাশ, সুনামি এবং ভূমিকম্পসহ সকল ঝূঁকি প্রতিরোধের বিষয় মাথায় রেখে রাশিয়ার আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপদনের ক্ষমতার আরো ৫ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের অনুমোদন করে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে । যার মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপের পাওয়া তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে ঢাকা এলাকায় ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট ও ১০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি এবং চট্টগ্রাম এলাকায় ১০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কেন্দ্র রয়েছে । আর এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রাম এলাকায় ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট এবং বরিশালে ১০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র করবে। এই সব প্রকল্পের মধ্যে এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকায় ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলছে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এলাকার সাধারণ জনগণ আন্দোলন করতে গিয়ে ৮ জন আন্দোলনকারী নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়। গার্ডিয়ান পত্রিকা লিংক https://www.theguardian.com/environment/2016/apr/06/bangladesh-coal-plant-protests-continue-after-demonstrators-killed

যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা হয় তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশ্নই আসে না । কেননা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন এই প্রকল্পের বিপজ্জনক সীমার মধ্যেই অবস্থিত। সুন্দরবন বিশ্বব্যাপী রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃত এবং ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চলেরও একটি অংশ। তাই বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অঞ্চল হিসেবে এই এলাকায় এধরণের প্রকল্প হতে পারে না। ভারত বলছেন যে এখানে সুপার ক্রিটিকাল পদ্ধতিতে কোল বেজড পাওয়ার প্ল্যান্ট করবেন কিন্তু যেই পদ্ধতিটি ভারত আমাদের দেশে করতে চাচ্ছেন, সেটি ভারত তাদের নিজেদের দেশেই করতে পারেননি । ভারত পরীক্ষামূলকভাবে গুজরাট ও মধ্য প্রদেশের কয়েকটি রাজ্যে এটি শুরু করলেও তা স্থায়ী হয়নি। স্থানীয় লোকজনের আপত্তির মুখে সেটি বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং ইন্ডিয়ান এটমিক কমিশনের চেয়ারম্যান এই ধরণের প্রকল্পকে অতি উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ বলা যায় একটা এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্টের জন্যে আমরা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাকে বেছে নিয়েছি। এছাড়াও এই রিপোর্টে বহু অসংগতি রয়েছে যার কিছু উদাহরণ ইতোপূর্বে আমি দিয়েছি। ভারত যদি পরীক্ষা মূলক ভাবে এই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের সুন্দর বনে করতে চাই তবে তা তারা তাদের সুন্দরবনের অংশে করে না কেন??? গার্ডিয়ান পত্রিকা লিংক https://www.theguardian.com/environment/2016/mar/02/thousands-to-march-protest-coal-plant-threat-bangladeshs-sundarbans-forest

বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে রামপালের স্থাপিত হতে যাওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অন্যদিকে সদ্য শেষ হওয়া রামপাল লংমার্চ থেকে সমমনা বাম রাজনৈতিক দলগুলো তা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং বিরোধী দল বিএনপি। সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রক্ষা দেয়াল। সুন্দরবনের  আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশী। এ-বনভূমির দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে, বাকীটুকু ভারতে। বাংলাদেশ অংশে মানুষের আগ্রাসনে সুন্দরবন ক্রমাগত সংকুচিত হলেও শত শত বছর ধরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের মানুষ, প্রাণী এবং প্রকৃতিকে ঘূর্ণিঝড় সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মায়ের মতো রক্ষা করছে। https://bifpcl.com/

জীববৈচিত্রের এক বিপুল সম্ভার সুন্দরবন ৪৫৩টি প্রজাতির প্রাণীসহ নানা বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল এবং একইসাথে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুন্দরবনকে সুরক্ষা প্রদানকারী রয়েল বেঙ্গল টাইগার’র সংখ্যা একসময় ৪০০-৪৫০টি হলেও চোরাকারবারিদের মাধ্যমে বর্তমানে তা ১০০-এর কাছাকাছি সংখ্যায় দাড়িয়েছে।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সুন্দরবনের অংশ বিশেষকে ১৯৯২ সালের ২১ মে ‘রামসার এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের বেশ কিছুটা অংশ ইউনেস্কো’র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ডেইলি মেইল পত্রিকা লিংক http://www.dailymail.co.uk/wires/afp/article-3485682/Long-march-Bangladesh-against-Sundarbans-power-plant.html

সুন্দরবন রক্ষায় ভারত ও বাংলাদেশ সরকারও যৌথ উদ্যোগে ২০১২-এর ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও ভারত এক সমঝেতা স্মারক স্বাক্ষর করে। অথচ চুক্তির বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে বিতর্কিত, একপেশে, অস্বচ্ছ এবং ত্রুটিপূর্ণ পরিবেশগত সমীক্ষার ভিত্তিতে সুন্দরবনের কাছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার সব উদ্যোগ সম্পন্ন।

সুন্দরবন-সংলগ্ন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ১৬০ কোটি ডলারের কাজ পায়। অথচ ২০১৫ এর ১৩ মার্চ ভারতের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল তথ্য বিকৃতি ও জালিয়াতি এবং প্রতারণার দায়ে কর্ণাটক রাজ্যে এনটিপিসি’র প্রস্তাবিত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ ছাড়পত্র স্থগিত করে দেয়।

কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কীভাবে কাজ করে: খুব সহজে যদি মূল বিষয়টা দেখি তা অনেকটা এইরকম- কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রথমে পাউডারে বিচূর্ণ করা হয় চক্রের (চিত্রে দ্রষ্টব্য!) কনভেয়র যা পরবর্তীতে বয়লারে যাওয়ার আগে পালভারাইজড হয়। পিসিসি (PCC= Pulverized Coal Combustion) সিস্টেমের কম্বাশন চেম্বার হয়ে বয়লারে উচ্চতাপে পুড়ানো হয়। এইখানে চিনমি (Stack) হয়ে কয়লা পুড়া ধূয়া বের হবে আর ভস্মীভূত ছাই নিজ দিয়ে নির্গত হয়। অন্যদিকে পানি থেকে রূপান্তরিত বাষ্প টার্বাইনে উচ্চ চাপে প্রবেশ করে যেখানে হাজার প্রোপেলারকে সে হাইস্পীডে ঘুরাতে থাকে যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এই বাষ্প টার্বাইন থেকে আবার কনডেনসারে কন্ডেন্সড হয়ে পুনরায় বয়লারে যায় আরেকবার ব্যবহৃত হতে। এই সহজ চক্রে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তার উৎপাদন চক্র শেষ করে। এইখানে পরিবেশ দূষণের উপাদান নির্গত হয় চিমনি দিয়ে, নির্গত পানির সাথে এবং ভস্মীভূত ছাই হিসেবে। এইখানে উল্লখ্য পানি বিশুদ্ধিকরণের জন্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো হলেও আমার জানামতে দুনিয়াজুড়ে চিমনী দিয়ে নির্গত বিষাক্ত ধুঁয়ার কোন প্রকার ট্রিটমেন্ট করা হয় না। আর কিছু নিউজ লিংক  http://opinion.bdnews24.com/2013/09/19/rampal-power-plant-a-project-of-deception-and-mass-destruction/

২০১৬’র ফেব্রুয়ারিতেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও সুন্দরবনের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিবেচনা করে ইতিমধ্যে রামসার কর্তৃপক্ষ, ইউনেস্কো এবং আই.ইউ.সি.এন ২০১২ সাল থেকে সরকারের কাছে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। উদ্বেগ আমলে তো নেয়া হয়ই-নি, এমনকি রামসার কনভেনশন সচিবালয় এবং ইউনেস্কো একাধিকবার সরকারের কাছে ইআইএ প্রতিবেদন চাইলেও সরকার তা দিতে অপারগতা জানায়। এ প্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ ২০১৬ ইউনেস্কো কার্যালয় থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে সুন্দরবন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

সুন্দরবন ও পরিবেশ সংক্রান্ত জরিপ রিপোর্টটি প্রতারণা মূলক:
সিইজিআইএস এর ইআইএ রিপোর্টটার মধ্যে যে বিভিন্ন কারিগরি বিষয়গুলি থাকা উচিৎ সে জিনিসগুলি সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ইআইএ রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে পার্শ্ববর্তী যে পশুর নদীতে জাহাজগুলি ল্যান্ড করবে বা ছোট ছোট কার্গো যেগুলো কয়লা নিয়ে আসবে বড় জাহাজ থেকে, এগুলি যেখানে অবস্থান করবে সেই পুরো এলাকাটি হচ্ছে ডলফিনের জন্যে একটি অভয়াশ্রম বা ব্রিডিং গ্রাউন্ড। এই ডলফিনগুলি বিশেষ ধরণের ডলফিন যারা মিষ্টি এবং লবণ পানির সংযোগস্থলে অবস্থান করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা এই অভয়াশ্রমের কথা উল্লেখ করে সতর্কতার কথা বলেছেন কিন্তু এ ধরণের অভয়াশ্রম সংরক্ষণের জন্য কি ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হবে সে ব্যাপারে কোন দিকনির্দেশনা দেন নি। এই রিপোর্টের বহু জায়গায়, বহুক্ষেত্রে যেমন সুন্দরবনের ক্ষেত্রে কি ধরণের ক্ষতি হবে হবে এই ব্যাপারে চতুরতার সাথে একটা বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে।  http://www.reuters.com/article/us-bangladesh-power-coal-idUSKCN0XB1QD

বক্তব্যটি অনেকটা এরকম, যেহেতু কোস্টাল বেল্ট এবং এই অঞ্চলটি ঝড়-ঝঞ্জা ,ঘূর্ণিঝড় এবং সর্বোপরি একটি দুর্যোগপূর্ণ এলাকা সে কারনে এই প্রকল্পে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে বায়ু দূষণ সহ অন্যান্য দূষণ হবে তা সুন্দরবনের দিকে না গিয়ে মূল ভূখণ্ডের দিকে চলে আসবে বা প্রশমন হয়ে যাবে। যার ফলে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে তারা মন্তব্য করেছেন। এটা যেকোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হাস্যকর বলে মনে করবে। তাহলে সাইক্লোন বা ক্লাইমেট চেঞ্জের যে ব্যপারগুলি সেগুলি তো পরিবেশ দূষণের জন্যেই ঘটছে , পক্ষান্তরে আমরা বলছি এটি একটি ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগপূর্ণ এলাকা , তাহলে আমরা কি কামনা করি যে ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় হবে শুধুমাত্র এই কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারনে যেসকল দূষণ হবে সেগুলিকে শুধুমাত্র প্রশমন করার জন্যে ? যেকোনো একটি ইআইএ রিপোর্ট করতে গেলে তার একটা বেজ লাইন সার্ভে প্রয়োজন হয়, পূর্বে কি ছিল , পরবর্তী পাঁচ বা দশ বছর পর কি হবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেখানকার ভূমি এবং পারিপার্শ্বিক যে বিষয়গুলি উল্লেখ করা প্রয়োজন তার কিছুই এই রিপোর্টে করা হয়নি। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rampal_Power_Station_(Proposed)

তারা শুধুমাত্র একটি জিনিস করেছে আর তা হচ্ছে প্রকল্পের জন্য দুটি সম্ভাব্য স্থানের তুলনা, যার একটি লবণছড়া এবং আরেকটি রামপাল। লবণছড়ার চাইতে রামপালকে প্রকল্পের জন্য বেশী উপযোগী দেখানো হয়েছে কেননা লবণছড়ার আশেপাশে আবাসন,শিল্পায়ন, নগরায়ন আছে কিন্তু পক্ষান্তরে রামপালে তা কম। কিন্তু তারা এটি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন যে এটি একটি জলাভূমি অঞ্চল যেখানে মানুষ মাছ চাষ করে, ধান, শাক সবজিসহ চাষ করে, সর্বোপরি পুরো এলাকাটি কৃষি জমি। যেখানে জনসংখ্যার চাপে কৃষিজমি এমনিতেই কমে যাচ্ছে সেখানে ১৮০০ একরের বেশী কৃষিজমি তারা অধিগ্রহণ করেছেন এবং ভবিষ্যতে তাদের আরও জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা আছে কয়লা নিয়ে এসে রাখার জন্যে এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনার জন্যে । কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হচ্ছে এর ফলে ভূ-প্রাকৃতিক যে পরিবর্তন হবে সেটি প্রশমনের ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেওয়া হবে তার কোন দিকনির্দেশনার উল্লেখ এই রিপোর্টে নেই।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২০১৫ এর ১২ ডিসেম্বর যে প্যারিস চুক্তিতে বিশ্ববাসী ঐকমত্য হয়, ২০৩০ সাল পর্যন্ত ব্যাপক ভিত্তিক কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে বিশ্বের প্রধান চারটি কার্বন নিঃসরনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং ভারত সহ শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করে। অথচ সুন্দরবনের কাছে ভারত-বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে এবং ওরিয়ন গ্রুপ বেসরকারিভাবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে শুধুমাত্র সুন্দরবনকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে না, আখেরে কোটি কোটি মানুষের জীবন এবং জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকির অন্যতম শিকার বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা প্রদানকারী সুন্দরবনের অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অবদানের মূল্য লাভ-ক্ষতির হিসেবে ধরা হয়নি। ১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের আইলা পর্যন্ত সময়ে ৪৭৮টি মাঝারি ও বড় জলোচ্ছাস এবং ঘূর্ণিঝড় তোমেন, গোর্কি, সিডর, নার্গিস বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৭৯৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে ৩২৯টি প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে এবং স্বাধীনতার পর ১৪৯টি ঝড় বা জলোচ্ছাস হয়েছে।

সুন্দরবন না থাকলে জাতীয় অর্থনীতির জন্য কত ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতির কারণ হতো এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার হিসাব নীতি নির্ধারকরা করেনি অর্থাৎ তাগিদ অনুভব করতেও দেয়া হয়নি। পরিবেশ আইন ১৯৯৫ এর ধারা ৫-এর অধীনে সরকারি প্রজ্ঞাপনমুলে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্ট ও এর চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন বা ‘লাল চিহ্নিত এলাকা’ এলাকা ঘোষণা করায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৭ এর ৭(৪) ধারা মতে সুন্দরবন এলাকায় কোন শিল্প স্থাপনে পূর্ণ পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) সাপেক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘লোকেশন ছাড়পত্র’ এবং ‘পরিবেশ ছাড়পত্র’ নেয়ার বাধ্যতা রয়েছে। কিন্তু পূর্ণ ইআইএ ছাড়াই পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১১ এর ২৩ মে এ প্রকল্পকে শর্তসাপেক্ষে প্রাথমিক ছাড়পত্র দেয়া হয়।  অথচ প্রস্তাবিত প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১২-এ বলেছিল যে, ওই অধিদফতর সুন্দরবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ জীব বৈচিত্র্যের উপরে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। https://www.thethirdpole.net/2016/03/31/unesco-investigates-environmental-impact-of-sundarbans-coal-plant/

এ ক্ষতির ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীও সম্প্রতি স্বীকার করেন। অথচ ২০১৫ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ৫৯টি শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে ফরমায়েসি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা- ‘ইআইএ’ অনুমোদন করে প্রকল্প কাজ শুরু করতে চাচ্ছে। কি কারণে বা কার চাপে পরিবেশ অধিদপ্তর তার এ অবস্থান পরিবর্তন করলো তার জবাব এখন পর্যন্ত মেলেনি। এসব শর্ত প্রতিপালিত হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে বলে জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ এসব অনেক শর্তই পরে আর মানা হবেনা।

উল্লেখ্য, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক এক পত্রে উল্লেখ করেন যে, ‘সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সমগ্র জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে’। উল্লেখিত পত্রে প্রধান বন সংরক্ষক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রামপালে স্থাপনের সিদ্ধান্ত পুন:বিবেচনার আহবান জানান। অথচ সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসাবে সুন্দরবনের আইনগত অভিভাবক বন বিভাগের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে বিতর্কিত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা বা ইআইএ’র ভিত্তিতে এগিয়ে চলছে সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলা রামপালের সরকারি- বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যে শর্তে প্রাথমিক ছাড়পত্র দিয়েছিলো পরিবেশ অধিদপ্তর সে শর্ত ভঙ্গ করা হলেও, পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। http://www.livemint.com/Industry/B1nAcv17KlG2KC56mKfTKM/India-plans-to-thwart-China-get-Bhel-to-bid-for-168-billi.html

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই থেকে সালফার-ডাই-অক্সাইড ছড়ানোর কারণে বন্য-গাছপালা ধীরে ধীরে মারা যাবে। ইআইএ অনুযায়ী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭.২০ লক্ষ টন কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পরিবহণের ফলে সুন্দরবন ও এই বনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর কী ক্ষতি হবে সমীক্ষায় বলা হয়নি। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূত ছাই বা স্লারি ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে কারণ এতে ক্ষতিকর সালফার এবং কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদি মিশে থাকে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করা হবে। এর ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নি:সরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নি:সরণ ইত্যাদি পরিবেশ আইন অনুসারে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে ।

বায়ূ দূষনের ক্ষতিকারক উপাদানগুলি মেঘমালার মাধ্যমে ছাড়াবে। রাতে জাহাজ চলাচল এবং মালামালা খালাসের ফলে সৃষ্ট শব্দ ও আলোর দূষণে সুন্দরবনে যে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে তাও ইআইএ প্রতিবেদনে বিবেচনায় রাখা হয়নি। নাব্যতা হ্রাস পাওয়া পশুর নদীর সংকট বাড়বে। কয়লা পরিবহনের সময় জাহাজ ডুবি হয়ে প্রতিবেশ এবং পানি দূষণ যে নিয়মিত ঘটবে তা সর্বশেষ শ্যালা নদীতে লঞ্চ ডুবিতে আবারো স্পষ্ট হয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য একেকটি কার্গোতে ৮-১০ হাজার টন কয়লা পরিবহণ করা হবে-যা ডুবলে দূষণের ঝুঁকি অনেক বেশি।

ইআইএ সম্পাদনের আগেই মাটি ভরাট করাসহ অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু; এমনকি ইআইএ সম্পাদনে কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ, শুনানি ও জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি। আর প্রকল্পের ইআইএ চূড়ান্ত করার সময় নিয়ম রক্ষার জন্য যে গণশুনানি করা হয় যেখানে বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরলেও সেগুলো অগ্রাহ্য করে ইআইএ চূড়ান্ত করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে নির্মোহভাবে ইআইএ সম্পাদনের নিয়ম থাকলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান সিআইজিআইএস কর্তৃক সম্পাদনের ফলে স্বার্থের সংঘাত থাকায় এটি নিরপেক্ষতার মানদন্ড অর্জন করতে পারে নি।

শুধু তাই নয়, প্রকল্প প্রণয়ণ এবং অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকারের অস্বচ্ছতা স্পষ্ট, এমনকি যৌথ অংশিদারিত্ব বা ঋণ চুক্তি জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রচার করা হয়নি। প্রকল্প বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টে করা একাধিক রিট আবেদনের নিষ্পত্তি না করেই ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়; আবার ভূমি অধিগ্রহণের আগেই স্থানীয় জনগণের সম্পত্তি এবং চিংড়ি ঘের ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা দখল করে নেয়। কারন, ইআইএ প্রতিবেদনে সুন্দরবনের সকল এলাকা বিবেচনায় নেয়া হয়নি, যেমন রামপাল প্রকল্প এলাকা থেকে সুন্দরবন (ডাংগামারী) এলাকার দূরত্ব ৯.৬ কিলোমিটার যা বাফার জোনের ভেতর।

উল্লেখ্য, ভারতেরই ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান এ্যাক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোন ধরণের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। এ প্রেক্ষিতে ভারতের মধ্যপ্রদেশে জনবসতি সম্পন্ন এলাকায় কৃষি জমির উপর এনটিপিসি’র কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে ভারতের কেন্দ্রিয় গ্রীণ প্যানেল এনটিপিসি’র ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি। সুতরাং, সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা যৌক্তিক হয় কিভাবে? http://www.thedailystar.net/business/indian-firm-wins-contract-build-rampal-power-plant-576454

রামপালে প্রকল্প পরিচালনাসহ অন্যান্য কাজে পশুর নদী থেকে ঘন্টায় ৯,১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে, যেটিকে নদীর মোট পানি প্রবাহের ১% এরও কম দেখানো হলেও তথ্যদাতাদের মতে, পানি প্রবাহের যে তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে তা ২০০৫ সালের। তথ্যদাতাদের মতে পরিশোধন করা হলেও পানির তাপমাত্রা, পানি নির্গমনের গতি, দ্রবীভূত নানা উপাদান পশুর নদী, সমগ্র সুন্দরবন তথা বঙ্গোপসাগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ২০১০ সালে সরকার সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন পশুর নদীকে অন্তর্ভুক্ত করে ৩৪০ হেক্টর, ৫৬০ হেক্টর ও ১৭০ হেক্টর নদী ও খালের জলাভূমি জলজ প্রাণী বিশেষত ‘বিরল প্রজাতির গাঙ্গেয় ডলফিন ও ইরাবতী ডলফিন’ সংরক্ষণের স্বার্থে ‘‘বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য” ঘোষণা করেছে।

ইআইএ প্রতিবেদনে প্রকল্প এলাকায় কোন কোন ধরণের উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে তার কোনো তালিকা দেওয়া হয়নি। প্রকল্পের ফলে এসব উদ্ভিদ ও প্রাণী কোন ক্ষতির সম্মুখীন হবে কি না, তাও উল্লেখ করা হয়নি। ইআইএ প্রতিবেদনে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উঠে আসেনি।

ইআইএ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-বছরের এই ৪ মাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবে (ইআইএ, পৃষ্ঠা-২৭৫)। এখন বলা হচ্ছে, বছরে কখনো সুন্দরবনের দিকে বাতাস প্রবাহিত হবে না। তাছাড়া ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি নানা কারণেই এই চারমাস ছাড়াও বছরের অন্য সময়েও বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানিদূষণ, শব্দদূষণ, ছাইয়ের দূষণ সারা বছর ধরেই ঘটবে যার সঙ্গে বাতাসের দিকের কোনো সম্পর্ক নেই।

ইআইএ প্রতিবেদনে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে প্রতারণা করা হয়েছে। সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করলে দুষণের পরিমাণ সর্বমোট মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ হ্রাস পায়- যা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়াবহ দূষণ সামান্যই কমাতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে টেকনোলজিই ব্যবহার করা হোক না কেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে শব্দ দূষণ হবে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র শীতল রাখার জন্য পশুর নদী থেকে পানি গ্রহণ-বর্জন করতে হবে, ফলে সুন্দরনের পশুর নদী দূষণের ঝুকি থাকবেই, সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে দিনে-রাতে কয়লার জাহাজ চলাচলের ফলে শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, আলো দূষণ ইত্যাদি ঘটবেই। http://thebangladeshtoday.com/2015/06/hasina-modi-urged-to-roll-back-rampal-power-plant/

উভয় ইআইএ প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ প্রকল্পে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে। ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পর্যায়ে মাটি কাটা, মালামাল পরিবহণ, নির্মাণ কাজের শ্রমিক ইত্যাদি ৪ হাজার অস্থায়ী কর্মসংস্থান এবং পরিচালনা পর্যায়ে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬০০ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। বরং উল্টো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে মাটি পানি বাতাস দূষিত হয়ে সুন্দরবন ও তার চারপাশের নদী, খাল ও জলাভূমির উপর নির্ভরশীল জেলে, কৃষক, বাওয়ালী, মউয়ালসহ কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। পাঁচ লক্ষ এর অধিক মানুষ জীবন-জীবিকা আর আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবন ধ্বংস হলে তাই তাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিঃসৃত কঠিন এবং তরল বর্জ্য বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারী, ক্যাডমিয়াম এবং ক্রোমিয়াম বহন করে। এই বিষাক্ত উপাদানগুলো খাবার পানিকে দূষিত করে ফেলতে পারে এবং সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকায় বসবাসকারী লোকজনের গুরূত্বপূর্ণ মানব অঙ্গ ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং ডেঙ্গু , ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন পরজীবী বাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশীয় কয়লার অপর্যাপ্ততার কারণে এ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ভারতীয় অংশের বিবেচনায় আমদানীকৃত কয়লার পরামর্শ এসেছে। এই সুযোগে ভারত থেকে নিম্ন মানের কয়লা আমদানি হতে পারে যা দূষণের মাত্রাকে আরও কয়েক গুণ বারিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে মামলায় আসামী করাসহ বিভিন্ন প্রকার আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি প্রদান ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে ইতোমধ্যেই এবং ভূমি অধিগ্রহণের ফলে অধিক সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুতিও হয়েছে। এর পাশাপাশি সুন্দরবনের গাছ কাটা, বনের জমি দখল, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, বন্যপ্রাণী শিকার কিংবা বিষ দিয়ে মাছ মারার মতো ক্ষতিকর কর্মকান্ড সাধারণ জনগণ নয় ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট জলদস্যু ও প্রভাবশালীরা জড়িত।

শুধু তাই নয়, তহবিল পাওয়ার আগেই প্রকল্প কার্যক্রম শুরু হলেও ইউনেস্কো’র উদ্বেগ প্রকাশ করায় ২০১৪’র ডিসেম্বরে নরওয়ের দুটি পেনশন ফান্ড রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রে বিনিয়োগে সাড়ে ৫ কোটি ডলার প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। শুধু তাই নয়,  সুন্দরবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় ফ্রান্সের বৃহৎ তিন ব্যাংক বিএনপি পারিবাস, সোষিতে জেনারেলি ও ক্রেডিট এগ্রিকোলও অর্থায়নে অসম্মতি জানালেও সরকার ভারতীয় কোম্পানিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে কি কারণে নিযুক্ত করেছে তা বোধগম্য নয়।

বিএনপি পারিবাস ২০১৫ এর ডিসেম্বরে মন্তব্য করে, ‘’The analysis shows that serious deficiencies in project design, planning, and implementation and due diligence obligations render the project non-compliant with the minimum social and environmental standards established by the Equator Principles, as well as the International Finance Corporation’s Performance Standards”.

ইআইএ প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকাকে গ্রাম হিসাবে দেখানো হয়েছে প্রকল্পের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ এশীয় মানবাধিকার (এসএএইচআর) প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রকল্প স্থান পরিদর্শন এবং ইআইএ পর্যালোচনা করে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘এ-প্রকল্পের ‘ইআইএ’ নানা দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ। স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে এ-‘ইআইএ’ করা হয়নি।

ভারতের সাথে নৌসহ সব ধরনের ট্রানজিট চুক্তির পর পরই শুধু কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়, সুন্দরবনকে ঘিরে বিভিন্ন কলকারখানা স্থাপনে দেশি বিদেশি কোম্পানি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে’। অথচ সুন্দরবন সুরক্ষায় ভারত সরকার কি করছে তা জানতে সে দেশের জাতীয় পরিবেশ আদালত স্বঃপ্রণোদিত আদেশে বলেছে, “সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ নষ্ট হতে বসেছে। এই পরিস্থিতিতে ম্যানগ্রোভের বর্তমান চেহারা কেমন, নদী বা খাঁড়িতে দুষিত ডিজেল ব্যবহার হয় কি-না, সেখানে বেআইনী ইট-ভাটা চলছে কি-না, বন এলাকায় অবৈধ হোটেল রেস্তোরা বন্ধ করা হয়েছে কি-না, ইত্যাদি বিষয়ে রাজ্যের অবস্থান জানানো হোক।

একই সাথে আদালত সরকারের বক্তব্যের সমর্থনে অবশ্যই স্যাটেলাইট ছবি থাকতে হবে”। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতও এ ধরনের স্বঃপ্রণোদিত উদ্যোগ নিয়ে প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রদানকারী সুন্দরবনকে রক্ষায়ও উদ্যোগী হবেন। জনপ্রতি মাত্র ৮ওয়াট বিদ্যুত যা একটি এনার্জি সেভিং বাল্ব জ্বালানোর জন্যও যথেষ্ট নয়,  সেজন্য দেশের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ সুন্দরবন ধ্বংস অর্থাৎ দেশের স্বার্থ বিসর্জন কখনোই মেনে নেওয়া যায়না, যাবে না। http://www.indiaenvironmentportal.org.in/category/38866/thesaurus/rampal-power-station/

আমি বলব যে অবশ্যই সুন্দরবনকে বাঁচাতে গেলে রামপাল প্রজেক্ট করা যাবে না। কিন্তু যেহেতু আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন সেক্ষেত্রে আমরা ছোট ছোট টাইডাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করতে পারি। যেহেতু এই এলাকাটি একটি টাইডাল জোন,আমরা উপকূলীয় উপজেলাগুলিতে ১০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াটের মত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি টাইডাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এর মাধ্যমে। যদিও এই ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে কিছু দূষণের আশঙ্কা থেকে যায় কিন্তু তার মাত্রা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় খুবই কম। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে এবং এক্ষেত্রে আমরা এটাকে গ্রহণ করতে পারি। আর সরকার যদি কয়লা বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট করতেই চাই তবে সেটা অন্য কোন জায়গায় করতে পারে যেমন শরীয়তপুর ,মাদারীপুর, বরিশাল, মুন্সিগঞ্জ ইত্যাদি কিন্তু সুন্দরবনের আশেপাশে নয়।

Friday 15 July 2016

পর্ব আট।। কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে।


জমিদার রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন?

সূফি বরষণ
আপনি বাঙালী না, মুসলমান’ এটা কলকাতা ভিত্তিক তৎকালীন হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের একটা কমন ডায়লগ। বাংলাদেশে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে বাঙালী কবি ভাবলেও, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাদের বাঙালী ভাবতেন না, ভাবতেন- ‘মুসলমান’ ও ‘প্রজা’। তাদের চোখে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাই ছিলো প্রকৃত ‘বাঙালী’।

কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথের দাদা নীলমণি ঠাকুর। তিনি প্রমে ইংরেজদের অধীনে চাকুরী করে সাহেবদের সুনজরে পড়েন এবং উন্নতির দরজা খুলতে থাকে শো শো করে। ...... পূর্বপুরুষ ... যখন শ্রমিকের কাজ করতেন তখন তাকে নিমড়ব শ্রেণীর লোকেরা ঠাকুর মশাই বলতেন। ঐ ঠাকুর মশাই থেকে ঠাকুর পদবীর সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন নীলমণির জ্যেষ্ঠ পুত্র রামলোচন এর দত্তক পুত্র (এ-এক অন্য ইতিহাস, গোলাম আহমাদ মোর্তজা, পৃ. ১৪২)।

দ্বারকানাথের পিতা ইংরেজদের সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। তবুও ইতিহাসে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ। আর একজন ইংরেজ দালাল রামমোহন ছিল দ্বারকানাথের দীক্ষাগুরু। উভয় গুরু-শিষ্য মিলে এদেশে ইংরেজদের শাসন-শোষণে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে অঢেল অর্থের মালিক হয়েছিলেন তথাকথিত রাজা রামমোহন ও প্রিন্স দ্বারকানাথ।

সংক্ষেপে দ্বারকানাথের বিত্তশালী হওয়ার তথ্য ও উৎসসমূহ নিমড়বরূপ: নীতি ও বুদ্ধি বিচারের দিক দিয়ে রামমোহন ছিলেন তাঁর গুরু। গরীবের রক্ত শোষণ করা অর্থে প্রিন্সের এই প্রাচুর্যের পূর্বে তিনি ছিলেন মাত্র দেড়শ’ টাকা বেতনের সাহেব ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর মাত্র (তথ্য:  ড. কুমুদ ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন : বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি, পৃ. ৮২)।

এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগমনের সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির সৌভাগ্যের সূত্রপাত। শুরু থেকেই তা যুক্ত হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শক্তির আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে (কৃষ্ণ কৃপালিনী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিস্মৃত পথিকৃৎ, পৃ. ১৭)।

রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলিকাতাতেই।” এছাড়া ছিল মদের ব্যবসা, আফিমের ব্যবসা, ঘোড়ার রেস খেলা, বিপদগ্রস্ত লোকের বন্ধু সেজে মামলার তদ্বির করা এবং ২৪ পরগনার সল্ট এজেন্ট ও সেরেস্তাদার (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ কার্তিক, ১৪০৬)।

১৮২৪ সালে লুণ্ঠনকারী ব্রিটিশদের যেখানে ২৭১টি নীল কারখানা ছিল সেখানে প্রিন্স ও তার দোসরদের নীল কারখানা ছিল ১৪০টি (প্রমোদ সেনগুপ্ত, নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৬)।

এভাবেই ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর দ্বারকানাথ প্রিন্স দ্বারকানাথ হলেন এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অবদান রাখলেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ইনি রবীন্দ্রনাথের পিতা। বাংলার শ্রেষ্ঠ জমিদার। জন্মসূত্রে পিতার চরিত্র, ব্যবসা_ বাণিজ্য ইংরেজ দালালী ও জমিদারী প্রাপ্ত হয়ে মহান ঋষি বা মহর্ষি হলেন। তাহার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজাকূল বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তিনি নির্মম হাতে উক্ত প্রজা বিদ্রোহ দমন করে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা তথাকথিত বাঙালী হিন্দু রেনেসাঁর মধ্যমণি ছিলেন।

তাঁর জমিদারীর দু-একটি নমুনা উলে-খ করা হলো:
ইত্যাদি নানা প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইল পুষ্করিণী প্রভৃতি জলাশয়স্থ মৎস্যের যেমন মা-বাপ নাই, পশুপক্ষী ও মানুষ, যে জন্তু যে প্রকারে পারে মৎস্য ধরিয়া ভক্ষণ করে, তদ্রƒপ প্রজার স্বত্ব হরণ করিতে সাধারণ মনুষ্য দূরে থাকুক, যাহারা যোগী-ঋষি ও মহাবৈষ্ণব বলিয়া সংবাদপত্র ও সভা-সমিতিতে প্রসিদ্ধ, তাহারাও ক্ষুৎক্ষামোদর।” (কাঙাল হরিনাথের ‘অপ্রকাশিত ডায়েরী’, চতুষ্কোণ, আষাঢ়, ১৩৭১)।

প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ঠাকুরবাড়ির অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয়। ঠাকুরবাড়ি থেকে ব্রিটিশ সরকারকে জানানো হলো যে, একদল শিখ বা পাঞ্জাবী প্রহরী পাঠাবার ব্যবস্থা করা হোক। মঞ্জুর হলো সঙ্গে সঙ্গে। সশস্ত্র শিখ প্রহরী দিয়ে ঠাকুরবাড়ি রক্ষা করা হলো আর কঠিন হাতে নির্মম পদ্ধতিতে বর্ধিত কর আদায় করাও সম্ভব হলো। ঠাকুরবাড়ির জন্য শ্রী অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “অথচ এরাও কৃষকদের উপর থার্ড ডিগ্রী (প্রচণ্ড প্রহার) প্রয়োগ করতে পিছপা হননি, কর ভার চাপানোর প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন, পরন্তু ভয় দেখিয়ে কর আদায়ের জন্য এবং বিদ্রোহীদের মোকাবেলার জন্য একদল শিখ প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন (প্রাকবৃটিশ ভারতীয় সমাজ, পৃ: ১৩২)।

নীরদ চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের জীবিত থাকার সময়ে তাঁর গুণমুগ্ধ স্তাবকের তুলনায় বিরূপ সমালোচকের সংখ্যাই অনেক বেশি ছিল। প্রায় সব রবীন্দ্র গবেষকই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে রবীন্দ্রনাথের আঁধার অংশগুলোকে অপসারিত করে দিয়েছেন। ধর্ম অনুসারীরা যেরকম করে তাঁদের ধর্মীয় নেতাকে মহামানব তৈরি করে তাঁর মহৎ গুণগুলোকে শুধুমাত্র উল্লেখ করে, ঠিক সেরকম করেই রবীন্দ্র ভক্তরাও রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত পুরুষ বা অবতার বানানোর আয়োজন প্রায় সুসম্পন্ন করে ফেলেছে। কেউ রবীন্দ্রনাথের সামান্যতম সমালোচনা করলেই লাঠিসোঠা হাতে হা-রে-রে-রে বলে তেড়ে এসেছেন তাঁরা। আহমদ শরীফ তাঁর রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধে লিখেছেন :

তাঁর লঘু-গুরু ত্রুটি-বিচ্যুতি, মন-মননের সীমাবদ্ধতা বিমুগ্ধ-বিমূঢ় ভক্ত-অনুরক্তেরা এতো কাল চেপে রেখেছেন, অন্য কেউ উচ্চারণ করতে চাইলেও মারমুখো হয়ে উঠেছেন। প্রমাণ ষাটের দশকে বুদ্ধদেব বসুকে এবং ইদানীং সুশোভন সরকারকে ও সুভোঠাকুরকে গালমন্দ শুনতে হয়েছে। আর পঞ্চাশের দশকে কম্যুনিস্টরাও হয়েছিল নিন্দিত রবীন্দ্র বিরোধিতার জন্যে।

এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিরুপ আলোচনা একটু বিপদজনকই বটে। তবুও কিছুটা ভরসা কিছুটা সাহস নিয়ে এই লেখার অবতারণা ।

রবীন্দ্রনাথ যে দোষেগুণে মিলিয়ে আমাদের মতো এক রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন তার প্রমাণ আছে তাঁর নিজের জীবনেই। তাঁর ভক্তদের মত রবীন্দ্রনাথ নিজেও নিজের বিরূপ সমালোচনা সইতে পারতেন না। সমালোচনায় উদ্বেলিত হয়ে, উৎকণ্ঠিত হয়ে তা খণ্ডনের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তেন তিনি। তাঁর হয়ে কেউ প্রতিবাদ করুক, সেই আশায় বসে থাকতেন তিনি। সেরকম কাউকে পাওয়া না গেলে নিজেই ছদ্ম কোনো নাম নিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিকারে নেমে পড়তেন। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ বলেন :

রবীন্দ্রনাথ বিরূপ সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না, প্রতিবাদ করার লোক পাওয়া না গেলে বেনামে লিখে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতেন। রবীন্দ্রানুরাগী ও রবীন্দ্রস্নেহভাজন অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ত্রুটি-নিন্দা-কলঙ্কের সাক্ষ্য প্রমাণ সতর্ক প্রয়াসে অপসারিত বা বিনষ্ট করতেন। তা সত্ত্বেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সুশোভন সরকার তাঁর প্রণাম-প্রীতিরূপ দুর্বলতার কথা বলে গেছেন। তাঁর সেজো ভাইয়ের পৌত্র সুভোঠাকুর [সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর] জমিদার পরিচালনায় তাঁর স্বার্থবুদ্ধির কথা বর্ণনা করেছেন।

রবি ঠাকুরের ভাষাতেই, সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনরে ভালবাসিলাম। আর রবীন্দ্রনাথের এই কথার প্রসঙ্গে প্রয়াত ভাষা বিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ বলেন, আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে-

আজকাল অনেকেই প্রচার করে জমিদার রবীন্দ্রনাথ অনেক উদার ও প্রজাদরদী ছিলো। ক্ষুদ্র ঋৃণের জনক ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কিছু  অথচ ইতিহাস তার সম্পূর্ণ বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। আসুন দেখি ইতিহাস কি বলে জমিদার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। তার দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর-জবরদস্তি করে তা আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোল্লার নেতৃত্বে শিলাইদহে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল। (সূত্র: অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ ১৪৮২ শারদীয় সংখ্যা)।

গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ গ্রন্হের লেখক: স্বপন বসু আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ বিরোধীতার মূল কারণ ছিলো এ অঞ্চলে ছিলো তার বেশিরভাগ জমিদারি। বঙ্গভঙ্গ হলে ঠাকুর পরিবারে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। যেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সে। এ অঞ্চলের মানুষের রক্তচুষে খেয়ে বেচে থাকতো ঠাকুরপরিবারের মত জমিদাররা। তারা নানান ছুঁতোয় প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করতেন।

যেমন: গরুর গাড়ি করে মাল নিলে ধূলো উড়তো, তখন ‘ধূলট’ নামক কর দিতে হতো।

প্রজারা নিজের যায়গায় গাছ লাগলেও এক প্রকার কর দিয়ে গাছ লাগাতে হতো। সেই করের নাম ‘চৌথ’।

গরীব প্রজারা আখের গুড় বানালে এক প্রকার কর দিতে হতো। তার নাম ‘ইক্ষুগাছ কর’।

প্রজাদের গরু-মহিষ মরে গেলে ভাগাড়ে ফেলতে হলে কর দিতে হতো। তার নাম ‘ভাগাড় কর’।

নৌকায় মাল উঠালে বা নামালে দিতে হতো ‘কয়ালী’ নামক কর।

ঘাটে নৌকা ভিড়লে যে কর দিতে হতো তার নাম ‘খোটাগাড়ি কর।

জমিদার সাথে দেখা করলে দিতে হতো ‘নজরানা’।

জমিদার কখন জেলে গেলে তাকে ছাড়িয়ে আনতে উল্টো প্রজাদের দিতে হতো ‘গারদ সেলামি’। (সূত্র: বই-গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, লেখক: স্বপন বসু) ।

রবীন্দ্রনাথ রতনে রতন চিনে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও রতন চিনতে ভুল করেননি। দাদা দ্বারকানাথ ও পিতা দেবেন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। এ বিষয়ে স্বপন বসু লিখেছেন : “মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে জমিদার হিসেবে তিনি নির্বাচন করলেন চৌদ্দ নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথকে। এও এক বিস্ময়! অত্যাচার, শোষণ, শাসন, চাবুক, চাতুরী, প্রতারণা ও কলাকৌশলে রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তাঁর পিতার বিবেচনায়? অনেকের মতে, পিতৃদেব ভুল করেননি। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা বহু বিষয়েই অনস্বীকার্য (ঐ, স্বপন বসু)।

রবীন্দ্র মানস গঠন বৈষয়িক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ, ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ও বাঙালী বাবু সমাজের পথিকৃৎ তথাকথিত রাজা রামমোহনের যোগ্য উত্তরসূরি।

চারিদিকে নিষ্ঠুরতা ও দুর্নামের প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূল করতে “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাইভেট সেক্রেটারী অমিয় চক্রবর্তী একবার বিশাল জমিদারীর একটি ক্ষুদ্র অংশ দরিদ্র প্রজাসাধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেন। ঠাকুরমশাই ইজিচেয়ারে আধাশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বলেছিলেন, “বল কিহে অমিয়। আমার রথীন (কবির একমাত্র পুত্রের নাম) তাহলে খাবে কী? (দ্রষ্টব্য: অন্নদাশঙ্কর রায়ের রচনা থেকে উদ্ধৃত পুস্তক ‘রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা: আবু জাফর)।

 জমিদার রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলো  এ সম্পর্কে অধ্যাপক অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছে, “জমিদার জমিদারই। রাজস্ব আদায় ও বৃদ্ধি, প্রজা নির্যাতন ও যথেচ্ছ আচরণের যে সব অস্ত্র, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার জমিদার শ্রেণীর হাতে তুলে দিয়েছিল, ঠাকুর পরিবার তার সদব্যবহারে কোন দ্বিধা করেনি। এমনকি জাতীয়তাবাদী হৃদয়াবেগ ঔপনিষদিক ঋষিমন্ত্রের পুনরাবৃত্তি এবং হিন্দুমেলার উদাত্ত আহবানও জমিদার রবীন্দ্রনাথকে তার শ্রেণীস্বার্থ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। (দ্রষ্টব্য অরবিন্দ পোদ্দার: রবীন্দ্রনাথ ও রাজনৈতিক প্রবন্ধ)।

সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ও বলেছে, “শান্তিনিকেতনে একটি চাকরি পেয়ে তার আধা-সরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হলেন জমিদার মর্জির, ঠিক নেই, কখনো আবার চাকরি নষ্ট করে দিলে তার খাবার অভাব হবে। রবীন্দ্রনাথ ইন্টরালেন্ট (অসহিষ্ণু) ছিলেন। যে মাস্টার রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিবাদ করতেন তার চাকরি থাকতো না।”

অন্নদাশঙ্কর রায় আরও বলে, “জমিদার হিসেবে ঠাকুর পরিবার ছিল অত্যাচারী। গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল, বুট পরে প্রজাকে লাথি মেরেছেন, পায়ে দলেছেন দেবেন ঠাকুর। এটাই রেকর্ড করেছিল হরিনাথ মজুমদার। যিনি মহর্ষি বলে পরিচিত, তিনি একইরকমভাবে মানুষকে পদাঘাতে দলিত করেন। গ্রাম জ্বালাবার কথাও আছে। আবুল আহসান চৌধুরীর কাছে এর সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। সমগ্র ঠাকুর পরিবার কখনো প্রজার কোন উপকার করে নাই। স্কুল করা, দীঘি কাটানো এসব কখনো করে নাই। মুসলমান প্রজাদের টিট করার জন্য নমশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই এসেছিল। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার ‘গ্রাম্যবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় ঠাকুর পরিবারের প্রজাপীড়নের কথা লিখে ঠাকুর পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।” (দ্রষ্টব্য দৈনিক বাংলাবাজার, ১৪.০৪.১৯৯৭ এবং ১.৫.১৯৯৭ সংখ্যা)

স্বামী বিবেকানন্দের ঘনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তার জন্য লিখেছে, “রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক।” জমিদারদের বড়দেবতা হলো অর্থ আর স্বার্থ। অর্থ আর স্বার্থলাভ করতে ঠাকুর পরিবারের জমিদার হিসেবে দুর্নামের কালো দিক আড়াল করে রাখলেও প্রকৃত ইতিহাসের পাতা থেকে তা মোছা যাবে না। “ঠাকুর পরিবারের এই মহর্ষি জমিদারদের প্রতি কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন, “ধর্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্যশরীরে পাদুকাপ্রহার, একথা আর গোপন করিতে পারি না।” (অশোক চট্টোপাধ্যায়: প্রাক বৃটিশ ভারতীয় সমাজ, পৃষ্ঠা ১২৭, ১৯৮৮)।

সিরাজগঞ্জে প্রজা নির্যাতনের দলিলও ইতিহাসে পাওয়া যায়। “এর প্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বদলির আদেশ হয়েছিল এবং যে যে জমিদার উপরের আবরণের গুণে তপস্বী বলিয়া গভর্নমেন্টে পরিচিত ছিলেন, তাহারা যে বিড়াল তপস্বী তা প্রমাণিত হয়েছিল। এসবের ফলশ্রুতিতে হরিনাথকে ঐ জমিদারের বিষনজনে পড়তে হয়েছিল।” (অশোক চট্টোপাধ্যায়, ঐ, পৃ ১২৮)।

কয়েক পুরুষ ধরে প্রজাদের উপর পীড়ন চালিয়েছে জোড়াসাকোর এই ঠাকুর পরিবারটি। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলো না। "১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলো,খাজনা আদায়ও করেছিলো [ তথ্যসূত্র: শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ ১৮, ১১৭]।

“সব জমিদারা খাজনা আদায় করত একবার,কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এলাকার কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করত দুইবার। একবার জমির খাজনা দ্বিতীয় বার কালী পূজার সময় চাদার নামে খাজনা।” (তথ্যসূত্র: ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, লেখক - সরকার শাহাবুদ্দীন আহমেদ )।


আজকে সেই প্রজানিপীড়ক জমিদার রবীন্দ্রনাথকে বানানো হয়েছে প্রজাপ্রেমী জমিদার। ইতিহাসকে যে কতোটা বিকৃত করা হয়েছ।


Tuesday 12 July 2016

আল মাহমুদের জলবেশ্যা আর বর্তমান বুদ্ধিবেশ্যাদের মাঝে প্রার্থক্য আছে কি?



সূফি বরষণ
আধুনিক বাংলা গদ্যকবিতার জনক কবি আল মাহমুদের লেখা একটা গল্প আছে জলবেশ্যা নামে। ঐ গল্প অবলম্বনে কলকাতার পরিচালক  মুকুল রায় চৌধুরী টান নামে একটি বাংলা ছায়াছবিও বানায়। গল্পে জলবেশ্যারা সুন্দরবনের ভিতরে নৌকায় থেকে পতিতাবৃত্তি করে।

আর অপরদিকে তথাকথিত ধর্ম বিদ্বেষী বুদ্ধির বেশ্যারা কি করছে, তা হয়তো আমরা জেনেও না জানার বান করছি!! আমাগো নাহিদ মিয়ারে দিয়া( শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস) জলবেশ্যাদের সাথে কিভাবে লং ড্রাইভ বা নৌ বিহারে গিয়া যৌনকর্ম করা যাবে!?

তার কলাকৌশল শিক্ষা দিতে ইতিমধ্যে দেশের পাঠ্যপুস্তুকে বাধ্যতামূলক ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যৌন শিক্ষা সাথে আছে ব্রাহ্মণ্য দর্শনের দেব দেবীদের অশ্লীল যৌন কাহিনী? আর সাথে আছে ইয়াবা কিং বদী ও চ্যানেল আইয়ের গাজাঁর গাড়ী, আর এই মহাআয়োজনের মধ্যে যদি রাধা থাকে তবে তো প্রতি রাতেই মধুচন্দ্রিমা।
বুদ্ধিবেশ্যারা তাদের পতিতাবৃত্তিকে জায়েয করতে প্রচারযন্ত্র দিয়ে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এতে অগ্রগণী ভূমিকা রাখছেন, শায়েখে সিরাজ মিয়া, সাগর মিয়া, মতি মিয়া, আনিস মিয়া, শ্যামল দত্ত মিয়া, সারোয়ার মিয়া, আবেদ মিয়া , ম হামিদ মিয়া , বুলবুল মিয়া, নাঈমুল মিয়ারা। আর আমদানী করা বিদেশী অপসাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকগণ আমাগো কে শেখাচ্ছেন কি ভাবে রেডওয়াইন পানের তালে তালে বাহু দুলিয়ে ব্লাউজের ভিতর দিয়ে শাড়ি পড়ে বাংলিশ নৃত্য করতে হয়! আর যদি হয় উম্মে কুলসুমের সুরে হাবিবি ইয়া হাবিবি অথবা সানি লিওনের গানের নাচের তালে তালে বেবী ডল কিংবা পানিওয়ালা ড্যান্স আযা শাথ লাগালে দো টাকি শর্ট।

আর তরুণ তরুণীদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে বার্থডে পার্টি ,বল পার্টি , ডিজে পার্টি , ড্যানস পার্টি , ইউকেন্ড পার্টি আছে সিসা বার জুস বার নাইট ক্লাব আর হোটেল রিসোর্ট। এই অশুভ পরিকল্পনা ক্রমাগত ছড়িয়ে দিচ্ছে মহামারি রূপে। এই মহা শয়তানরা হলো, হাসান ইমাম,  আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল,  কাজী আরেফ, নাসিরদ্দীন বাচ্চু। এই সংখ্যা অনেক বড়।

আর এই বুদ্ধিবেশ্যাদের যৌন কর্মকে
আনন্দময় করতে এগিয়ে এসেছে সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্ত পতিতা শমী কায়সার,  তারানা হালিম,  মুন্নী সাহা, সুলতানা কামাল,  খুশী কবির,  ফারাহ কবিরের মতো আরও কত রমণী রাতের আধাঁরে ক্লাবে হোটেলে বুদ্ধি বেশ্যাদের কাছে খ্যাতির জন্যে নিজের
দেহ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। তার হিসেব আমারা কজনই বা রাখি।

আর এই সব বিষয়ে তত্ত্ব জ্ঞান দিয়ে প্রতিষ্ঠার জন্যে তো আছেই প্রথম আলো, চ্যানেল আই, গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মীর জাফর ইক বাল,  মুনতাসির মামুন,  মেসবাহ কামাল,  আ আ আরেফিন সিদ্দীকি, আরও আছে কালা হারুন ধলা হারুনরা আর আনোয়ার ছাগলকে বাদ দেয় কি ভাবে শত হলেও আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে কথা।

আল মাহমুদ বর্তমান অবস্হা আগে বুঝতে পারলে হয়তো জলবেশ্যা গল্প না লিখে লিখতেন বুদ্ধিবেশ্যাদের গল্প। কবি আজ এদের দলে নাই বলে, এইসব শিয়ালরা তার নাম শুনলে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া শব্দ করে নাক ছিটঁকায় ॥ কবি এদের সাথে আজ থাকলে তবে বাংলার মাঠ ঘাট পথে পান্তরে শুধু আল মাহমুদের নামেই এরা হুক্কা হুয়া বলে ধ্বনি তুলতো। তাই এবারও আল মাহমুদের জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান প্রচারে কৃপণতা।

 আল্লাহ আল মাহমুদকে বুদ্ধি বেশ্যা হতে রক্ষা করেছেন। কবির কদর রাত্রির প্রার্থনা কবিতার অনুরূপ বলছি , হে আল্লাহ এই বাংলার প্রবিত্র ভূমিকে কি তুমি বুদ্ধি বেশ্যাদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলবে নাকি তোমার ধর্মের বিশ্বাসীদের সাহস আর শক্তি দিবে তোমার নাম এক আল্লাহ জিন্দাবাদ প্রচার করার জন্যে রহমাত দান করবে? আর যদি একটু ভারিয়ে বলি স্বাধীনতা একি হবে নষ্ট জন্ম একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন। আজ সবাইকে ভাবার সময় এসেছে ঐ শকুন কি রাজাকার গোলাম আযমরা না ঐ ধর্ম বিদ্বেষী বুদ্ধির বেশ্যারা? আজ সবাই না বললেও আমি সূফি বরষণ চিৎকার করে বলছি এই বুদ্ধি বেশ্যারা ভয়ংকর নব্য রাজাকার যারা আমাদের হাজার বছরের পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রী জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে ধর্ম ও পারিবারিক জীবন বিদ্বেষী করে তুলছে। যার কারণে সমাজে আজ জঙ্গীবাদ তরুণদের মধ্যদিয়ে মাথাচারা দিয়ে উঠছে । এরজন্য দায়ী সমাজের তথাকথিত নাস্তিক ও ধর্ম নিরপেক্ষতার নামদারি মুসলিম বিদ্বেষী কিছু জ্ঞানপাপী বুদ্ধিবেশ্যা ।

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ

Saturday 9 July 2016

পর্ব সাত।। দুই । কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে।



বাংলায় কৃষকদের নীল বিদ্রোহ। 

সূফি বরষণ
কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি বইয়ে আরও বলা হয়েছে, ১৭৭৮ থেকে চাষিদের প্রতিরোধ সংগ্রাম প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের নীল চাষিদের কোন সময়েই ইংরেজ কুঠিয়ালদের এসব নৃশংস অত্যাচার নীরবে সহ্য করেনি। চাষিদের প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয় ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এবং তা নীল চাষ উঠে যাওয়া পযন্ত অব্যাহত থাকে। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ –এর সংখ্যায় এ সম্পর্কে জনৈক ইংরেজের লেখা এক চাঞ্চল্যকর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। “প্ল্যান্টার্স: সাম হার্টি ইয়ার্স এগো” প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, “অসংখ্য ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা আমরা জানি। মাত্র দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি যেখানে দুজন তিনজন এমনকি দুশ’জনও নিহত হয়েছে এবং আহতও হয়েছে সেই অনুপাতে। অসংখ্য খন্ডযুদ্ধে ‘ব্রজ’ ভাষাভাষী অবাঙ্গালী ভাড়াটে সৈন্যরা এমন দৃঢতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে যে, তা যে কোনও যুদ্ধে কোম্পানির সৈনিকদের পক্ষে গৌরবজনক হতো। বহু ক্ষেত্রে নীলকর সাহেব কৃষক লাঠিয়ালদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাদের তেজস্বী ঘোড়ার পিঠে চেপে অতি দক্ষতার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরা সশস্ত্র আক্রমনের দ্বারা নীলকুঠি ধূলিষ্যাৎ করে দিয়েছে, অনেক জায়গায় এক পক্ষ বাজার লুট করেছে, তার পরক্ষণেই অপর পক্ষ এসে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে।” (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক: ড. প্রভাত কুমার গোস্বামী)।

সমসাময়িককালের ঐতিহাসিক তথ্যাদি থেকে এ কথা নি:সন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে (বিদ্রোহ) সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা পৈশাচিক হত্যাকান্ড ও ভয়াবহ অত্যাচারের মাধ্যমে দমন করলেও সে সময় বাংলাদেশে নীল চাষিদের প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে এই সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমশ তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বাংলার নীল চাষিদের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে শাসকগোষ্টী দারুনভাবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে তদানীন্তন লে: গভর্ণর গ্রান্ট –এর বক্তব্য বিশেষ তাৎপযপূর্ণ। “শত সহস্র মানুষের বিক্ষোভের এই প্রকাশ, যা আমার বঙ্গদেশে প্রত্যক্ষ করছি, তাকে কেবল রং সংক্রান্ত অতি সাধারণ বাণিজ্যিক প্রশ্ন না ভেবে গভীরতর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বলে যিনি ভাবতে পারছেন না, তিনি আমার মতে সময়ের ইঙ্গিত অনুধাবন করতে মারাত্মক ভুল করছেন। “……. আর সেই কৃষক অভ্যুত্থান ভারতের ইউরোপীয় ও অন্যান্য মূলধনের পক্ষে যে সাংঘাতিক ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে তা যে কোনও লোকের চিন্তার বাইরে।”

নীল চাষের পটভূমি: প্রাচীন ও আধুনিক নীলচাষ
অতি প্রাচীন কালেও এদেশে নীল চাষ প্রচলিত ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে, অঙ্কিত পট ও চিত্রে। ইংরেজিতে নীল indigo নামে আর গ্রিক ও রোমান ভাষায় indicum নামে পরিচিত। উভয় শব্দই india শব্দের সমার্থবোধক। আবার প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তারা বাস করত সিন্ধু নদের (the indus) তীরে এবং তাই ধারণা করা হয় এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি। ( মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ১৭)।

এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলনের কৃতিত্ব একজন ফরাসি বণিক লুই বন্ড এর। তিনি ১৭৭৭ সালে আমেরিকা থেকে নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। একই বছরে সর্বপ্রথম তিনি হুগলী নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে নীলকুঠি স্থাপন করেন(৪. C.E. Buckland: Bengal under the Lieutenant Governors)।

কয়েক বছরের ভেতরে মালদহে, ১৮১৪ সালে বাকিপুরে, এবং তারপরে যশোরের ন'হাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা স্থাপন করেন। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করে বন্ড উপমহাদেশ ও ব্রিটেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৮২০ সালে তার মৃত্যু হয়। (৫. Major Smith: Report on the Maldah)।

বাংলায় নীলচাষের প্রসার:
লুই বন্ডের এক বছর পর ক্যারল ব্লুম নামের একজন ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন( ৬. শ ম শওকত আলিঃ কুষ্টিয়ার ইতিহাস)। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান ও ১৭৭৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে সপারিষদ একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন( ৭. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) ।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে। কোম্পানি লাভের সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই সমস্ত কারবার হস্তগত করে নেয় এবং অত্যন্ত লাভবান হয়। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষে যে খরচ হত, তার সবটাই কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম প্রদান করত। এতে যে নীল উৎপাদিত হত, তার সবটাই যেত ইংল্যান্ডে এবং কোম্পানি বহুগুণ বেশি লাভ করত। এই ব্যবসা এতই লাভজনক প্রমানিত হয় যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি ও রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করে। বহু দেশীয় জমিদার ও মহাজন ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথ মালিকানায় কারবার খোলে এবং দেখতে না দেখতে ১৮১৫ সালের মাঝে নদীয়া, যশোর, খুলনা, চব্বিশ পরগনা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এসব এলাকার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হবার কাহিনি সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।(৮)

নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণী নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অয্যোধ্যা দখল করে।(৯)

বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ ৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল।(১০)

নীল কুঠি ও কারবার পরিচালনা:
কোম্পানি গুলো একাধিক কুঠি স্থাপন করে ব্যবসা চালাত। তার মাঝে একটি কুঠিতে সমগ্র কারবার পরিচালনা করার জন্য একটি বোর্ড থাকত, এই কুঠিটিকে বলা হত সদর কুঠি বা কনসার্ণ। সদর কুঠিতে অবস্থিত পরিচালনা বোর্ড প্রতি কুঠিতে একজন ম্যানেজার বা অধ্যক্ষ নিয়োগ করত। তাঁকে বলা হত বড় সাহেব এবং তার সহকারিকে বলা হত ছোট সাহেব। এই পদ দুইটি সর্বদা শ্বেতকায় লোকদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বাকি পদগুলো ছিল দেশীয় লোকদের জন্য। ছোট সাহেবের পর যার সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ছিল, তাঁকে বলা হত দেওয়ান বা নায়েব। অনেক ক্ষেত্রে এই পদটিও একজন ইংরেজ বা শ্বেতকায় ব্যক্তি দখল করত। দেওয়ানের একাধিক সহযোগী থাকত। এসব সহযোগী প্রজা ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীর সাথে সাহেবদের যোগাযোগ রক্ষা করত। তাদের প্রধান কাজ ছিল হিসাবপত্রের নানা কাজ করা। দেশীয় কর্মচারীদের মাঝে এরাই সর্বাপেক্ষা লাভবান হত। কারণ হিসাবে গরমিল, সই জালকরণ, ঘুষ গ্রহণ ও সুদের কারবারি করে এরা প্রজাদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থোপার্জন করত।(১১)।

এরপর ছিল পর্যায়ক্রমে গোমস্তা, আমিন, সরকার, তহসিলদার, মাহুত, সহিস, বরকন্দাজ, ওজনদার, পেয়াদা, জমাদার, তাগিদগীর, চৌকিদার, মালি প্রভৃতি অসংখ্য নিম্নপদের কর্মচারী।
বেতনের ক্ষেত্রে, দেশি দেওয়ানের বেতন ছিল মাসে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ১৭ টাকা পেত গোমস্তা। আমিনের কাজ ছিল জমির সীমানা বের করা ও মাপজোক করা। সে বেতন পেত ১৪ টাকা। সরকার ও তহসিলদারের বেতন ছিল ১১ টাকা। মাহুত ও সহিস পেত ৭ টাকা। বাকি কর্মচারীরা কোন বেতন পেত না, তবু তারা চাকরি করত কারণ তারা সাধারণ মানুষকে শোষণ করত। নীল পরিমাপের জন্য ওজনদার এবং রায়তদের কাজে তাগিদ দেবার জন্য তাগিদগীর ছিল। তাগিদগীর যথাসময়ে নীলবীজ ও দাদন গ্রহনের জন্য কৃষক প্রজাদের সংবাদ পৌঁছে দিত এবং বৃষ্টির পর কোন জমিতে নীল বুনতে হবে, তা জমিতে 'দাগ' মেরে নির্দিষ্ট করে দিত(১২)।

পুলিশের কাজ করত পেয়াদা। কাউকে ধরে আনা এবং শাস্তি প্রদান করা তার কাজ ছিল। সম্ভবত গোমস্তার পর পেয়াদাই সবচেয়ে জুলুমবাজ কর্মচারী ছিল(১৩)।

কুলি ও মজুরদের কাজ দেখাশোনা করত জমাদার। সহরত ও ইস্তেহার ইত্যাদি জারি করত চৌকিদার। বরকন্দাজ ছিল কুঠির লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান (১৪)(১৫)।

এসব কর্মচারির অধিকাংশই মুসলিম সমাজ থেকে আগত ছিল, যদিও তুলনামূলক উচ্চ পদগুলো ছিল হিন্দুদের দখলে।

নীলচাষের প্রাথমিক অসুবিধা ও প্রতিকার:
 লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক করে দেন। এরা নিজ জমিদারি সীমার মাঝে ছোটখাটো রাজা-বাদশার মত ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই, প্রজার জানমাল, এমনকি তাঁদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের মালিকও ছিল(১৬)।

ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণীটিকে তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখতে পেল। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত, তবুও প্রজারা ওই ভূস্বামীদের অধীনে থাকত। ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তার করে ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন(Eighth regulation of 1819) বলবৎ করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর 'পত্তনি তালুক' দেবার সুযোগ পায়। অধিক মুনাফার আশায়, আবার কোথাও অত্যাচার বা জুলুমের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। এদের মাঝে প্রসন্নকুমার ঘোষণা করেন, 'আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগন জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন। এবং ইহাই রায়তদের জন্যে কল্যাণকর'(১৭)।

পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত, বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য। তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, ধানভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে। ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইনের(fourth regulation of 1833) দ্বারা বাংলাদেশে ইংরেজদের জমি ও জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয়। অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে, কেউবা দুর্ধর্ষ নীলকর বা ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল, তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায়নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে জব্দ করার জন্য নীলকরদের ডেকে আনত। কিন্তু পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি' কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনেদা, রানাঘাট ও যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এই বিশাল জমিদারি থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দিত মাত্র ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, যেখানে কেবল চুয়াডাঙ্গা ও রানাঘাট এলাকায় এরা ১৮ লক্ষ মূলধন খাটাত। মূলতঃ এই ভাবে ইংরেজগণ অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় জেঁকে বসে ও নীল চাষ শুরু করে।(১৮)

কুঠি স্থাপন ও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীলকুঠি:
১৮১৫ সালের মাঝে সারা বাংলাদেশে প্রায় সমস্ত অঞ্চলে নীল ব্যবসা প্রসার লাভ করে ও নীলকুঠি স্থাপিত হয়। ১৭৯৫ সাল থেকে যেসব নীল কারবারি ও ব্যবসায়ী এদেশে কুঠি স্থাপন করে কারবারি শুরু করেন, তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন -

১৭৯৫ সালে মিঃ সি. ডব্লিউ. শেরিফ জোড়াদহে
১৭৯৬ সালে মিঃ জন রিভস ও শেরিফ যৌথ মালিকানায় সিন্দুরিয়ায়
১৭৯৬ সালে মিঃ টাপট মহম্মদশাহীতে
১৮০০ সালে মিঃ ফারগুসন ও মে সাহেব যৌথ মালিকানায় যথাক্রমে দহকোলা ও আলমপুরে
১৮০০ সালে মিঃ টেলর মহেশপুরে
১৮০১ সালে মিঃ বার্কার সাহেব চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুরে
১৮০১ সালে মিঃ অ্যান্ডারসন যশোরের বারিন্দি ও বারুই পাড়ায়(১৯)

১৮০৫ থেকে ১৮১৫ সালের মাঝে যারা নীল কুঠি স্থাপন করেন-
মিঃ টেলর ও ন্যুডশন - মিরপুরে
মিঃ রিজেট - ন'হাটায়
মার্টিন কোম্পানির ম্যানেজার মিঃ স্টিভেনসন - কুষ্টিয়ার আমবাগানে
মিঃ জেনকিনস ও ম্যাকেঞ্জি - ঝিকরগাছায়
মিঃ ওয়াটস - গোস্বামী দুর্গায়
মিঃ ডেভরেল - ঝিনেদার পার্শ্ববর্তি হাজরাপুরে(২০)

দেশি জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের মাঝে অনেকেই ইংরেজ কুঠিয়ালদের দেখাদেখি নিজ এলাকায় নীল ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ক'জন হলেন -
জমিদার অবনীমোহন বসুঃ ইনি প্রজা পীড়নের জন্য কুখ্যাত ছিলেন। তার সদর কুঠি ঘোড়াখালিতে অবস্থিত ছিল। তিনিই দেশীয় জমিদারদের মাঝে সর্বপ্রথম ইংরেজ ম্যানেজার রাখেন।
হরিচরণ সাহাঃ চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী শ্রীকোল বোয়ালিয়ার মহাজন। ইনি একটি ছোটখাটো নীলকুঠি স্থাপন করে নীলের ব্যবসা শুরু করেন এবং সেই বছরই একটি কুঠি থেকে সর্বোচ্চ নীল উৎপাদনের রেকর্ড করেন।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালিপ্রসন্ন সরকারঃ ইনি চাকরি ছেড়ে আর. এস. পাউরান-এর কাছ থেকে মদনধারী সদর কুঠি কিনে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
রাজা প্রমথভূষণঃ নলডাঙ্গার রাজা। এদেশীয় রাজাদের মাঝে সর্বপ্রথম নীলচাষ শুরু করেন তিনি। তার অত্যাচার এতই জঘন্য ছিল যে কৃষকেরা সেটা নিয়ে গানও বেঁধেছিল-

'আহা একটুখানি চাঁদেরে ভাই মাঠ করেছে আলো,
বেলে দাড়ি নীল বুনিলাম নীল হল না ভাল।
বাবুর ঘোড়া জোড়া জোড়া নীল দেখিতে যায়,
নীল দেখিতে পেয়ে বাবুর ব্যর্থ হাসি পায়।
ব্যর্থ হাসি, মুখে বাঁশি, চাঁদ খাঁর বাড়ি
চাঁদ খাঁ চাঁদ খাঁ বসে কর কি?
তোমার পুত্র মার খাচ্ছে নলডাঙ্গার কাছারি।
আর মেরো না আর মেরো না ফুলো বেতের বাড়ি,
কাল পরশু দিয়ে যাব দাদনের কড়ি,
নীল বুনিব নলে গাবো আসবো তাড়াতাড়ি।'(২১)

এছাড়া আচার্য মথুরনাথ(সাধুহাটির জমিদার), রঘুপতি মজুমদার(পথহাটির দিকপতি), শ্রীহরি রায়(চণ্ডীপুরের জমিদার), আশুতোষ গাঙ্গুলি(পোতাহাটির নায়েব) প্রভৃতি নীল চাষ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন।
নীল বিদ্রোহের শুরু হয় চুয়াডাঙ্গার চূর্ণী বা মাথাভাঙ্গার তীরবর্তী কতগুলো গ্রাম থেকে। কারণ এসব এলাকায় সর্বোচ্চ মানের নীল উৎপন্ন হত, তাই বেশি বেশি উৎপাদনের আশায় নীলকরেরা অত্যাচারও বেশি করত।
এখানকার প্রধান একটি কুঠির বর্ণনা দেয়া হল।
সিন্দুরিয়া সদর কুঠিঃ সাবেক চুয়াডাঙ্গা মহকুমাকে নীলকররা ৬টি সদর কুঠিতে ভাগ করে -

১.সিন্দুরিয়া সদর কুঠি
২.নিশ্চিন্তপুর সদর কুঠি
৩.চণ্ডীপুর সদর কুঠি
৪.খাল বোয়ালিয়া সদর কুঠি
৫.লোকনাথপুর সদর কুঠি
৬.কাঁচিকাটা সদর কুঠি

এদের মাঝে সিন্দুরিয়া সদর কুঠি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও উৎপাদনশীল ছিল। মোট ১৬ হাজার ৬শ ৫২ বিঘা জমিতে বছরে ১০০০ মণ নীল উৎপাদিত হত। চাষি ও কর্মচারীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৩শ ৬৮ জন।
সিন্দুরিয়া নীলকুঠির প্রথম মালিক ছিলেন জেমস আইভান মে। ১৭৯৩ সালে তিনি কুঠি নির্মাণে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণে তাঁকে ফিরে যেতে হয়(২২)।

এর পরে মিঃ জন রিভস দায়িত্ব নেন, কিন্তু তিনিও কুঠি নির্মাণে ব্যর্থ হন(২৩)।

তিনি স্থান পরিবর্তন করে কুঠিটি মর্তুজাপুর এবং হিঙ্গের পাড়া গ্রামের মাঝে নিয়ে আসেন। মিঃ শেরিফ কুঠির মালিকানার অংশীদার হন। কুঠির ম্যানেজার হিসেবে মিঃ জর্জ ম্যাকনেয়ার দায়িত্ব পান। কুঠির দক্ষিণাংশ তখন সম্পূর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ ছিল(২৪)।

 পরে এখানে কর্মচারীদের জন্য একটি দালানবাড়ি স্থাপন করা হয়।
সিন্দুরিয়া সদর কুঠিতে একেবারে শুরুতেই প্রজা বিদ্রোহ দেখা দেয়। উৎপাদন বন্ধ হবার উপক্রম হয়। ক্ষতির আশঙ্কা দেখে রিভস কারবার ম্যাকনেয়ার ও শেরিফের কাছে বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান।  তখন থেকেই ম্যাকনেয়ার কারবারে লাভ করতে থাকেন। অনেকে বলেন, শেরিফ ও ম্যাকনেয়ারের ষড়যন্ত্র করে এই কুঠিতে বিদ্রোহ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ম্যাকনেয়ার বহুসংখ্যক কর্মচারী ছাঁটাই করেন, চাষিদের নতুন চুক্তির আওতায় আনেন, সেই সাথে পেয়াদার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। ফলে ১৮৫৮-৫৯ সালে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে তার কুঠি সর্বোচ্চ নীল উৎপাদন করে। কুঠিতে পূর্বেই ৮ কক্ষবিশিষ্ট সুরম্য প্রাসাদ, নীল হাউস, সেরেস্তার কাজ চালানোর জন্য কাছারি, নাচমহল, গোরস্থান, মৃত্যুকূপ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ এবং কর্মচারীদের বাসস্থান তৈরি করা ছিল। তিনি নতুন করে সচিবালয়(২৫),

পিলখানা, গুটিপোকা চাষের জন্য দালান, হাতিশাল তৈরি করেন এবং ১৮৬৩ সালে কুঠিতে পুকুর খনন করেন।
তিনি চাষিদের কাছারি ঘরে এনে নির্যাতন চালাতেন। প্রায়ই চাষির মেয়ে বা স্ত্রীকে ডেকে নেওয়া হত সাহেবের গুপ্তকক্ষে(২৬)।

চাষি ভাগ্যবান হলে জীবন্ত অবস্থায় তার স্ত্রীকে, তার মেয়েকে ফেরত পেত। নইলে পুরো পরিবারকে খুন করে ফেলে দেওয়া হত মৃত্যুকূপে। ম্যাকনেয়ারের মানসিকতায় বিকৃতি ছিল প্রচণ্ড(২৭)।

তিনি ১৮৫২ সালে দুর্গাপুর, আটলে, খাড়াগোদা ও সিন্দুরিয়া অঞ্চলের সমস্ত খেজুর গাছ ও বাগান উৎপাটিত করে নীল আবাদের জন্য জোরপূর্বক জমি তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পাশবিক আচরণ এই অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রভাবক হয়ে ওঠে।

পীড়ন ও বিদ্রোহের সূচনাঃ নীলচাষে শোষণ:
এক সরকারি হিসাব মতে দেখা যায় যে, ১৮৪৯-১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সারাদেশে গড়পড়তা নীল উৎপাদিত হয়েছিল ১০ হাজার৭৯১ মণ। নীল চাষ করে কৃষকদের লাভ হতো না। তারা নীল চাষ করে যে টাকা পেতেন তাতে দাদনের টাকা পরিশোধ হতো না।
এক বিঘা জমিতে নীল উৎপাদন হতো ৮ থেকে ১২ বান্ডিল। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে হিলস নামক এক ইংরেজ সাহেব সর্বপ্রথম নীলেরদর ধার্য করেন ১০ বান্ডিলের স্থলে ৪ বান্ডিল। তার আগে ১০ বান্ডিলের মূল্য ছিল ১ টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী বিচার করলেকৃষকদের হাতে নীল উৎপাদন করার দরুন যে টাকা আসত, তা লোকসানের নামান্তর। ১০০০ বান্ডিল নীল গাছে ৬ মণ নীল প্রস্তুতহতো। ১ বিঘায় যদি ৭ বান্ডিল গাছ হয় তাহলে নীলের পরিমাণ হয় ২ সের। এক মণ উৎকৃষ্ট নীলের মূল্য ছিল ২৩০ টাকা।সবচেয়ে খারাপ নীল এক মণ বিক্রি হতো ১০৯ টাকা। অর্থাৎ হিসাবে দেখা যায়, প্রতি বিঘায় ১১ টাকার নীল উৎপাদন হতো।কৃষকরা পেতেন নামমাত্র মূল।

১৮৩৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে আইনবলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যে সব কর্মচারী সেখানে রবার চাষে ক্রীতদাসদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালাতে অভ্যস্ত ছিল, তাঁদের বঙ্গদেশে এনে নীলকর বানিয়ে দেওয়া হয়। তারা এখানে এসে নীল ব্যবসায়ী, মহাজন, জমিদার এমনকি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ দখল করে। তাই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি হয়ে তারা এদেশের সাধারণ কৃষকের ওপর যে সীমাহীন অত্যাচার চালায়, তার সমতুল্য মর্মান্তিক ঘটনা আজো বিরল।

নীলকরদের সামনে প্রজারা ছিল অসহায়। আইন-আদালত তো দূরের কথা, তাঁদের সাথে নবাব-বাদশাদেরই সংস্রব ছিল না। এমতাবস্থায় তারা নিরুপায় হয়ে দাদনী চুক্তিপত্রে টিপসই দিত এবং নীল চাষ করতে বাধ্য হত। দাদনী চুক্তিপত্র বা একরারনামা ছিল একটুকরা সাদা কাগজ, যার ওপরে প্রথমে কৃষকের টিপসই নেওয়া হত, তারপর গোমস্তাকে দিয়ে ইচ্ছেমত শর্তাদি লিখিয়ে নেয়া হত। এসম্পর্কে এক ইংরেজ লেখক বলেন,
'The cold, hard and sorbid who can plough up grain fields, kidnap recusant rayets, confine them in dark holes, beat and starve them into submission, which things have sometimes been done, can give no moral guarantee of his capability of filling up a blank paper and turning it to his precuniary profit.'(২৮)।

এই চুক্তিপত্রে কৃষকের সকল উৎকৃষ্ট জমির কথা লেখা থাকত, কিন্তু সে তা জানতে পারত না। সারা বছর সার-মাটি দিয়ে, লাঙল চষে, বৈশাখ মাসে মাঠে ধানের বীজ নিয়ে গিয়ে কৃষক দেখত তার জমিতে খুঁটি গেঁড়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই জমিতে নীল চাষ করতে হবে। সন্ধ্যাবেলা তাগিদগীর এসে জানিয়ে যেত কৃষক যেন ভোরে গিয়ে নীলের বীজ ও দাদনের টাকা নিয়ে আসে। অন্যথা হলে তাঁকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে দাদনের টাকা ও বীজ দেওয়া হত, সেখানে নীল চাষে ক্ষতি কোথায়?
প্রথমতঃ, নীল ছাড়া অন্য কোন শস্য চাষ করার জন্য জমি চাষির হাতে থাকত না। দ্বিতীয়তঃ, সোজা কথায় বলা যায়, ৩৩ শতাংশ বা এক বিঘা নীল চাষ করে চাষির খরচ হত ৩ টাকা। আর আয় হত ১ টাকা। ফলাফল? প্রতি বিঘায় ক্ষতি ২ টাকা। অন্য কোন জমিতে ধান পাট চাষের জন্য অনুমতি না থাকায় কৃষক এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করতে পারত না। তাঁকে টাকা ধার করতে হত। এভাবে কৃষকের পিঠে ঋণের বোঝা ক্রমে ক্রমে আরও বাড়ত।

নীলকরের হিসাব করলে দেখা যায়, ১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রতি টাকায় ১০ আঁটি নীলের দর ছিল। ১০ বাণ্ডিলে নীল থাকত আড়াই সের। ২৩০ টাকা মণ দরে আড়াই সের নীলের দাম ছিল ১৩ টাকা ৬ আনা। চাষিকে ১ টাকা দিয়ে নীলকরের লাভ হত ১২ টাকা ৬ আনা! ১৮৪০ সালের পর তীব্র আন্দোলনের মুখে টাকায় ৪ বাণ্ডিল মূল্য নির্ধারিত হয়। এতে চাষি পেত ২ টাকা আর নীলকরের লাভ থাকত ১১ টাকা ৬ আনা, বা মণে ১৯৪ টাকা। জেমস ওয়াটস তার বইয়ে নীল ব্যবসার মুনাফা দেখিয়েছেন পুরো ১০০ শতাংশ(২৯)।

 'Indian Field' পত্রিকায় প্রকাশিত এক হিসাবে দেখানো হয়, যে পরিমান নীলের জন্য চাষি পায় ২০০ টাকা, তা থেকে নীলকর পায় ১৯৫০ টাকার রং। যদি রং প্রস্তুতের জন্য আরও ২০০ টাকা খরচ হয়, তবু তার লাভ থাকে ১৭৫০ টাকা(৩০)।

বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাশলি ইডেন নীল কমিশনের কাছে তামাক ও নীলচাষের তুলনামূলক একটা হিসাব দাখিল করেন। তা থেকে দেখা যায়ঃ
নীল উৎপাদনে ব্যয়
খাজনা ০৩ টাকা
৮ মাসে লাঙলের খরচ ০৮ টাকা
সার ০১ টাকা
বীজ ১০ আনা
নিড়ানি ০৪ আনা
গাছ কাটা ০৮ আনা
----------------------------------------------
মোট খরচ ১৩ টাকা ৬ আনা
উৎপন্ন নীলের বিক্রয়মূল্য ০৪ টাকা
---------------------------------------------
অতএব, ক্ষতি ৯ টাকা ৬ আনা

একই জমিতে তামাক উৎপাদনের ব্যয়
খাজনা ০৩ টাকা
লাঙল ০৮ টাকা
নিড়ানি ০৬ টাকা
সার ০১ টাকা
সেচ ০১ টাকা
অন্যান্য ০৫ টাকা
----------------------------------------------
মোট খরচ ২৪ টাকা
উৎপন্ন তামাকের বিক্রয়মূল্য ৩৫ টাকা
----------------------------------------------
অতএব, লাভ ১১ টাকা

অ্যাশলি ইডেন তার মন্তব্যে লিখেছেন, 'রায়েত নিজের জমিতে স্বাধীনভাবে তামাক চাষ করতে পারলে সে যা লাভ করতে পারত তার সাথে নীলচাষের জন্য তার যা ক্ষতি হয়েছে, তা যদি যোগ করা হয়, তাহলেও রায়তের ক্ষতি থাকে ২০ টাকা ৬ আনা। ১৮৫৮ সালে তামাকের মূল্য ছিল ১৮ টাকা। এই মূল্য ধরলে তামাক চাষে প্রজার লাভ হতে পারত ১০১ টাকা ১৪ আনা'(৩১)।

নীলকররা কৃষকের জমি মেপে সে অনুযায়ী দাদনের টাকা দিত। কিন্তু যে মাপদণ্ড দিয়ে মাপা হত, তা প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিল। চাষির ১১ বিঘা মাপদণ্ডে দেখাত ৭ বিঘা(৩২)।

 চুক্তিপত্রের স্ট্যাম্পের দাম দিত কৃষক। নীলগাছ কুঠিতে পৌঁছে দেবার ভাড়া দিত কৃষক। দেরি হলে পেয়াদার দল এসে কৃষকের খাসি-মুর্গি-ছাগল ধরে নিয়ে যেত, আম, কাঁঠাল, লিচুর গাছ কেটে তছনছ করে দিত। নীলক্ষেতে যে ঘাস জন্মাত, তার ওপরেও কৃষকের কোন অধিকার ছিল না। ভুলে গরু ছাগল ছুটে ক্ষেতে গেলে পাহারাদার সেগুলো ধরে জব্দ করে ফেলত(৩৩)।

 সরকারও এই অত্যাচারে মদদ দেয়। ১৮৩০ সালে আইন জারি হয়, যারা নীলচুক্তি ভঙ্গ করবে, তাঁদের ফৌজদারি আইনে সোপর্দ করা যাবে ও সম্পত্তি ক্রোক করা যাবে। এভাবে নীলচাষে লোকসান দিয়ে, অর্থকারী ফসল-গবাদিপশু-গাছপালা হারিয়ে নিরন্ন, বিবস্ত্র ও অসহায় হয়ে যেত মহাজনের কাছে। কিন্তু মহাজনের পুরো ঋণ শোধান তো দূরের কথা, সুদের টাকাও তাঁর দেবার সামর্থ্য হত না। একদিন দেখা যেত আদালতের ডিক্রিবলে মহাজন তার ভিটেমাটি, পৈতৃক জমি দখল করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পথে। আর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাই একদিন রুখে দাঁড়ালো কৃষকেরা।

নীল বিদ্রোহের শুরু ও কয়েকটি ঘটনা :

দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ১৮৫৮ সালে অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত হয় এবং ১৮৫৯ সালে বিদ্রোহ হয়ে বেরিয়ে আসে। এর আগেও চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার। যেমন Calcutta Review পত্রিকায় বলা হয়েছে, সর্বপ্রথম ১৮৪৪ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারি নীলকুঠিতে মানুষ খেপে ওঠে এবং আগুনে কুঠিটিকে ভস্মীভূত করে(৩৪)।

এভাবে যেখানেই নেতৃত্ব ও সংগঠন গড়ে ওঠে, সেখানেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বিদ্রোহ।
 এ সময়ের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনাকালে ভারতের নয়া গভর্ণর জেনারেল লর্ড ক্যানিং নিজেই লিখেছেন, নীল চাষিদের বর্তমান বিদ্রোহ আমার মনে এমন উৎকন্ঠা জাগিয়েছিল যে, দিল্লীর ঘটনার (১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ) সময়েও আমার মনে ততটা উৎকন্ঠা জাগেনি। আমি সব সময়েই ভেবেছি যে, কোনও নির্বোধ নীলকর যদি ভয়ে বা রাগান্বিত হয়ে একটিও গুলি ছোড়ে তা হলে সেই মুহুর্তে দক্ষিণ বাংলার সব কুঠিতে আগুন জ্বলে উঠবে।” (বেঙ্গল আন্ডার লে. গভর্নরস : ই. বাকল্যান্ড ১ম খন্ড)।

হ্যালিডে যখন বাংলায় ছোট লাট হয়ে আসেন, তখন তিনি নীল কুঠিয়ালদের নীল উৎপাদনের প্রধান জেলাগুলোয় সহকারীঅবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট পদে বহাল করেছিলেন। নীল কুঠিয়ালরা ম্যাজিস্ট্রেট পদে বহাল হওয়ায় রাইয়তদের ওপর অত্যাচারআরও বেড়ে গিয়েছিল। কৃষকদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হতো। খেজুর বাগান কেটে বাধ্য করা হতো নীল চাষকরতে। যেসব কৃষক অত্যাচারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতেন তাদের ভিটেমাটিতে লাঙল দিয়ে নীলের আবাদ করানোহতো। কারও কারও গৃহবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হতো আগুনে। ঘটি, বাটি, থালা, গরু, ছাগল ইত্যাদি লুটপাট করে নিয়ে যাওয়াহতো। কোনো কিছুই তাদের হাত থেকে রেহাই পেত না। প্রতিটি নীলকুঠিতে ছিল কয়েদখানা। অবাধ্য প্রজাকে ধরে উত্তমমধ্যমদিয়ে আটকে রাখা হতো তার মধ্যে। কোনো কোনো গ্রামে নীল চাষ না করার অপরাধে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এরপরওছিল স্ত্রী লোকের ওপর অত্যাচার।
নীল বিদ্রোহের পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো হলঃ
ক. নীলকরদের নির্দিষ্ট উচ্চহার বা বর্ধিত খাজনা দিতে এবং জমি বন্দোবস্ত গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ
খ. সাদা কাগজের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি
গ. নীলবীজ ও দাদনের টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি
ঘ. অত্যাচার থামাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ
ঙ. সংবাদপত্র, নাটক, লোকগান, ছড়া ইত্যাদির মাধ্যমে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা ও প্রচার করা
চ. দলবেঁধে নীলচাষ বন্ধ করা
ছ. নীলগাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলে অন্য ফসল বোনা
জ. লাঠিয়াল বাহিনী সংগঠন এবং নীলকরদের পেয়াদা ও পাহারাদারদের পর্যুদস্তকরণ
ঝ. সশস্ত্র অভ্যুত্থান
ঞ. সবশেষে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই এবং নীলকরদের উচ্ছেদ

ঠিক কোথায় প্রথম বিদ্রোহের সূচনা তা নিয়ে নানা মত বিদ্যমান। অধিকাংশই মনে করেন যে, চূর্ণী নদীর তীরবর্তী চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের খাল বোয়ালিয়া ও আসাননগর কুঠিতে সর্বপ্রথম এই বিদ্রোহ শুরু হয়। কারো মতে চৌগাছা কুঠিতে এর সূত্রপাত। বাকল্যান্ড সাহেবের মতে, উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। তার মতে, আওরঙ্গবাদ মহকুমার এন্ড্রোজ কোম্পানির আঙকারা নীলকুঠির ওপরে সর্বপ্রথম আক্রমণ করার মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে বিদ্রোহ যে বাংলাদেশে শুরু হয়, তা সম্পর্কে সবাই একমত। সাধারনতঃ বলা হয় যে, অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন মালদহ জেলার কৃষকগণ এবং তার পূর্ণতা সাধন করেন উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা। আর সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারির কৃষকেরা এবং পূর্ণতা সাধন করেন চুয়াডাঙ্গা এলাকার কৃষকগণ(৩৫)।

দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডলের রসিক প্রতিবাদ(৩৬), সিন্দুরিয়া নীলকুঠির গোমস্তা শীতল বিশ্বাসের হত্যা(৩৭), রব্বানি মণ্ডলের ওপরে অত্যাচার(৩৮) -এর মত ঘটনা নীল বিদ্রোহের অসহযোগ পর্যায়কে আরও বেগবান করে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই বিদ্রোহ মূলত শুরু হয় ১৮৫৯ সালে, বাস্তব রূপ পরিগ্রহন করে ১৮৬০ সালে এবং ১৮৬১ সালে প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। অসহযোগ এই আন্দোলন ঠেকাতে কুঠিয়াল ও জোতদাররা লাঠিয়াল বাহিনী নামায় ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, ফলে ১৮৫৯ সালের শেষে বা ১৮৬০ সালের শুরুতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহের কেন্দ্রে ছিল কৃষকদের লাঠিয়াল বাহিনী।

বাহিনী গঠন ও রণকৌশল
১৮৬০ সালের এপ্রিলে 'ইন্ডিয়ান ফিল্ড' নামক মাসিক পত্রিকায় দু'জন জার্মান পাদ্রি চুয়াডাঙ্গার বিপ্লবীদের লাঠিয়াল বাহিনী সম্পর্কে লেখেন,
'অপটু কৃষক যোদ্ধাগণ নিজেদের ৬টি কোম্পানিতে বিভক্ত করেছে। ১ম কোম্পানি তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত। ২য় কোম্পানি গঠন করা হয় প্রাচীনকালের ডেভিডের মত ফিঙা দিয়ে গোলোক নিক্ষেপকারীদের নিয়ে। ইটওয়ালাদের নিয়ে ৩য় কোম্পানি। এরা পরিধেয় লুঙ্গিতে মাটির বড় বড় ঢেলা, ইট-পাটকেল বহন করে এবং ছুঁড়ে মারে। ৪র্থ কোম্পানি গঠিত বেলওয়ালাদের নিয়ে, যাদের কাজ হল নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনির মস্তক লক্ষ করে শক্ত কাঁচা বেল ছুঁড়ে মারা। থালা-ওয়ালাদের নিয়ে ৫ম কোম্পানি। তারা ভাত খাবার কাঁসা ও পিতলের থালাগুলো আনুভূমিকভাবে চালাতে থাকে। এতে শত্রু নিধন যে ভালভাবেই হয় তাতে সন্দেহ নেই। ৬ষ্ঠ কোম্পানি মহিলাদের নিয়ে গঠিত হয়। তারা হাতে মাটির পোড়ান খণ্ড, মাটির বাসন ও রুটি বেলার বেলন নিয়ে আক্রমণ করে থাকে। প্রথমে তারা লাঠিয়ালদের দিকে মাটির খণ্ড ও বাসনকোসন ছুঁড়ে মারে। এতে লাঠিয়াল যদি ভূপাতিত হয়, তখন তাঁকে বেলনপেটা করা হয়।'
'আর যারা যুদ্ধে পটু, তাদের নিয়ে মূল কোম্পানি গঠিত। এরাই কৃষক লাঠিয়াল, এরা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়। এই কোম্পানির অর্ধেক বল্লমধারী, অর্ধেক লাঠিধারী। সবার সামনে থাকে বল্লমধারি, তাঁদের পর লাঠিয়ালরা, এবং তারপর বাকি পাঁচ কোম্পানি। এদের বীরত্ব কিংবদন্তিসম। একজন বল্লমধারি নাকি ১০০ জন শত্রুপক্ষীয় যোদ্ধাকে পরাজিত করতে পারে। সংখ্যায় এরা কম হলেও এতটাই দুর্ধর্ষ যে, তাঁদের ভয়ে নীলকরের লাঠিয়ালগণ পুনরায় আক্রমণ করতে সাহস করছে না'(৩৯)।

তখন কৃষকদের মূল শক্তি ছিল এই লাঠিয়াল-বল্লম বাহিনী। লাঠি চালনা শিক্ষার জন্য প্রধান ঘাঁটি ছিল বরিশাল, রংপুর ও টাঙ্গাইল। এখানকার ওস্তাদেরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং জায়গায় জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। তখন লাঠি চালনা শেখাটা ছিল গৌরবের বিষয় ও পৌরুষের প্রমাণ। কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে লাঠিয়ালরা তখন বীরদর্পে সুসজ্জিত শত্রুবাহিনীর আক্রমণ ঠেকিয়েছে এবং তাঁদের ঠেঙিয়েছে। তবে কৃষকদের অস্ত্র অঞ্চলভেদে ও বাহিনীভেদে কমত-বাড়ত। অনেক অঞ্চলে 'পলো বাহিনী' ছিল। তারা পলো ও ঝাঁকজাল কাঁধে নিয়ে এবং হাতে জুতি ও কোঁচ নিয়ে অগ্রসর হত। প্রমোদ সেনগুপ্ত বলেন, 'নানা অঞ্চলে নানা বাহিনী চালু ছিল। কোন কোন অঞ্চলে তীর, ধনুক, বন্দুক ও আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত বাহিনী ছিল। এদের মাঝে পাবনার নীল বিদ্রোহীরা সর্বপ্রথম বন্দুক ব্যবহার করে।'
এছাড়া ছিল তিতুমিরের 'হামকল বাহিনী' এবং ফরায়েজি আন্দোলনের অনুসারীদের 'দুন্দুভি বাহিনী'-র কথাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুইটি বাহিনী ও কৃষক বাহিনির বিদ্রোহের এজেন্ডা ভিন্ন হলেও এই বাহিনীত্রয়ের লক্ষ ছিল একটাই- অত্যাচারি নীলকর ও জমিদারদের ধ্বংস। তিতুমিরের হামকল বাহিনির ব্যারাক ছিল হুলিয়ামারিতে। এই হামকল বাহিনী ভারি কাঠের মুগুর ব্যবহার করত ও বাঁশ দিয়ে তৈরি নানা ধরনের যন্ত্র তৈরি করত- যা নীলকরদের কুঠি ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যেখানেই গোলাবাড়ি ও নীলকুঠি ছিল, সেখানেই এই বাহিনী তাঁদের কর্মতৎপরতা বজায় রাখত। নীল বিদ্রোহে এমন কোন লড়াই হয় নি, যেখানে হামকল বাহিনী অংশগ্রহণ করেনি(৪০)।

আর দুন্দুভি বাহিনী সম্পর্কে অনাথনাথ বসু লিখেছেন, 'নীলকরের লাঠিয়াল হইতে আত্মরক্ষার এক অপূর্ব কৌশল কৃষকগণ আবিস্কার করেন। প্রত্যেক পল্লীর প্রান্তে একটি করিয়া দুন্দুভি রাখিয়াছিল। যখন কুঠিয়ালগণের লাঠিয়ালরা গ্রাম আক্রমনের উপক্রম করিত, কৃষকগণ তখন দুন্দুভি ধ্বনি দ্বারা পরবর্তী গ্রামের রায়তগণকে বিপদের সংবাদ জ্ঞাপন করিলেই সকলে আসিয়া দলবদ্ধ হইত(৪১)।

সতীশচন্দ্র লিখেছেন, 'গ্রামের সীমানায় এক স্থানে একটি ঢাক থাকিত। নীলকরের লোক অত্যাচার করিতে আসিলে কেহ সেই ঢাক বাজাইয়া দিত। অমনি শত শত গ্রাম্য কৃষক লাঠিসোঁটা লইয়া দৌড়াইয়া আসিত। নীলকরের লোকেরা প্রায়ই অক্ষত দেহে পলাইতে পারিত না। সম্মিলিত প্রজা শক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া সহজ ব্যাপার নহে'(৪২)।

সশস্ত্র বিদ্রোহের শুরু ও কিছু ঘটনা: অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নীল চাষের বিরুদ্ধে চাষিরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে এবং চারদিকে দেখা দিয়েছিল বিদ্রোহেরধুয়া। যশোর, নদীয়া, পাবনা প্রভৃতি যেসব জেলায় নীল চাষ বেশি হতো, সেসব অঞ্চলেই বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে।যশোর জেলায় সর্বপ্রথম বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্ভর বিশ্বাসের নেতৃত্বে চৌগাছায়। তারপর মহেশপুরেরইলিশমারীর কুঠিরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নারায়ণপুর ও বড়খানপুরের চাষিরা সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দেবনগাঁর জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের এক সাক্ষ্যে জানা যায়, নীল বুনা নিয়ে কুঠিয়ালদের সঙ্গে কৃষকদের একটা বিবাদ বেঁধেছিল।কৃষকরা উত্তেজিত হয়ে বাগদা থানা আক্রমণ করেছিল। ঝিকরগাছার বেনেয়ালী গ্রামেও একই ধরনের একটা সশস্ত্র হামলাসংগঠিত হয়। কৃষকদের নেতৃত্বে বহু নীলকুঠি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। নীলকরদের মাল বহনের যোগাযোগেররাস্তা কৃষকদের বিদ্রোহের ফলে বন্ধ হয়ে যায়। যেসব জমিতে নীলের গাছ ছিল, চাষিরা অস্ত্র দিয়ে কেটে নষ্ট করে দেয়। কুঠিরেরপর কুঠি লুটতরাজ করে সব রকমের হিসাবের খাতা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়।
 ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে যশোর জেলায় আবার কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই দ্বিতীয় বিদ্রোহটি সংঘটিত হয়যশোরের উত্তরাঞ্চলের বিজলীয়া বিভাগের মধ্যে। বিজলীয়া কুঠির অধ্যক্ষ ডম্বল ছিলেন ভয়ানক অত্যাচারী। তার অকথ্যনির্যাতনের ফলে ৪৮টি গ্রামের কৃষকরা একত্র হয়ে ষষ্ঠীবরের জমিদার বঙ্কু বিহারি ও তার কনিষ্ঠপুত্র বসন্ত কুমার মিত্রের নেতৃত্বেবিদ্রোহ করে। উডুবারের কেদার নাথ ঘোষ, ঘুলি্লয়ার প্রিয়নাথ মুখার্জি, আশুতোষ গাঙ্গুলী ও উকিল পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবংনারায়ণপুরের বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় বিদ্রোহী কৃষকদের পক্ষ নেন। কেদারনাথ ঘোষ পরবর্তীকালে কেশবানন্দ ভারতী নাম ধারণকরে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় নড়াইল থেকে প্রকাশিত 'কল্যাণী' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তৎকালেকল্যাণীতে নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। লাহোর 'ট্রিবিউন' পত্রের সাবেক সম্পাদক যদুনাথ মজুমদারপ্রজার পক্ষ হয়ে বিদ্রোহের সময় অসীম সাহসের পরিচয় দেন। তিনি ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে আইন পরীক্ষায় পাস করে ঐকান্তিকভাবেকৃষকের পক্ষে এসে আন্দোলনে যোগ দেন। তৎকালীন ঝিনাইদহের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনসন মুরের আদালতে অসংখ্যকৃষকের নামে নীলকর সাহেবরা মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় নিঃস্বার্থভাবে প্রজাদের পক্ষে ওকালতি করেন যদুনাথমজুমদার। এ সময় প্রজাদের জন্য যদুনাথ মজুমদার অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। মাগুরার উকিল পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং যদুনাথমজুমদার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় বিলাতে কৃষকদের পক্ষে এক আবেদনপত্র পাঠান। ব্রাডলসাহেব সেই আবেদনপত্র পার্লামেন্টে তুলে ধরেছিলেন। বিষয়টি পার্লামেন্টে প্রকাশিত হওয়ায় সেখানে এক দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টিহয়েছিল। বিলাতের পার্লামেন্টে বাংলার তৎকালীন কৃষকরা দুরবস্থার বিষয় নিয়ে এ দেশের ইংরেজ শাসকদের কাছে কৈফিয়ততলব করে। বাংলার ছোট লাট এ বিষয়ে ফয়সালার জন্য যদুনাথ মজুমদারকে ডাকেন। অবশেষে একটি সালিশি কমিটি গঠনকরে কৃষকদের বিদ্রোহ ও অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধান করা হয়। কমিটি সবকিছু তদন্ত করে নীল গাছের দাম বাড়িয়ে দিলেনীলকরদের ব্যবসা অচল হয়ে পড়ে। নীলকররা ব্যবসায়ে আগের মতো প্রসার না করতে পেরে নিজেদের কারখানাগুলো বিক্রয়করতে বাধ্য হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নীলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় নীলকরদের এ ব্যবসা তুলে নিতে হয়েছিল।

কৃষকেরা অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে নীলচাষে অস্বীকৃতি জানিয়ে হাজার হাজার চুক্তিপত্র পুড়িয়ে ফেলে ও নীলবীজ নদীতে নিক্ষেপ করে। এতে নীলকরদের কুঠিয়ালরা শক্ত অবস্থানে চলে যায়। তারা পুলিশের সাহায্যে হাজার হাজার কৃষককে গ্রেফতার করে, তাঁদের বাড়িঘর ক্রোক করে নেয়, ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে এবং শত শত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকাল ধরে তাঁদের ওপর অত্যাচার চালান হয়। আর এটাই ছিল নীলকরদের বড় ভুল। এই অত্যাচারে কৃষক শ্রেণী ফুঁসে ওঠে, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে শীতের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয় নীলকরদের ওপর সশস্ত্র পাল্টা আক্রমণ(৪৩)।
কতগুলো আলোচিত ঘটনার বর্ণনা দেয়া হল:

পিয়ারি সুন্দরী: বাংলার জোয়ান অব আর্ক
টমাস আইভান কেনি তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে সবচে বড় নীল কারবারের অধিকারি ছিল। কেনি ছিল অত্যন্ত জুলুমবাজ, হত্যা-ধর্ষণ এগুলো তার কাছে সামান্য ব্যাপার ছিল। তার কয়েকটি কুঠি ছিল আমলা সদরপুরের পিয়ারি সুন্দরীর জমিদারির ভেতরে। তার বিরুদ্ধে ১৮৫০ সালে রায়েতগন বিদ্রোহ করে। কিন্তু কেনি শক্তহাতে তা দমন করে এবং সকল রায়েতকে উচ্ছেদ করে নতুন রায়েত বসায়। পিয়ারি এতে অসন্তুষ্ট হন। তিনি কেনিকে প্রজাদের উচ্ছেদ করার কাজে নিষেধ করেন। এতে কেনি তাঁকে গালিগালাজ করে এবং জমিদারি কেড়ে নেবার ভয় দেখায়। পিয়ারি অনন্যোপায় হয়ে মৌনব্রত পালন করেন। কিন্তু ১৮৬০ সালে ওই উচ্ছেদকৃত রায়েতগন সংগঠিত হয়ে ফিরে আসে এবং পিয়ারি সুন্দরী তাঁদের সাথে যোগ দেন। ওই বছরই এপ্রিল মাসে তারা কেনিকে হত্যা এবং তার কুঠি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে কুঠিতে হামলা করেন। কেনি বেঁচে যায়, কিন্তু তার কারবার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই হামলা করার কারণে পিয়ারি সুন্দরী ও তার রায়েতদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করা হয়। পিয়ারি সুন্দরী সকল মামলার ব্যয়ভার নিজে বহন করেন, এতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। তার পক্ষের প্রজাদের দ্বীপান্তর, জেল, জরিমানা হয় ও পিয়ারি সহ সকলের ভূসম্পত্তি বাতিল করা হয়। পিয়ারি তার পাঁচ বছর পর যশোরের এক মুচির বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় পরিজনহীন অবস্থায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পিয়ারির কথা আমরা ভুলে গেছি, কিন্তু কেনিকে আমরা ভুলিনি। কুষ্টিয়ার কেনি রোডের নামকরন এই নরপশুর নামে করা(৪৪)।

শ্রেণী সংগ্রামের যোদ্ধাঃ বিশে ডাকাত ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে, এবং সম্ভবত সর্বপ্রথম, ১৮০১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে স্যামুয়েল ফেডির নীলকুঠি লুণ্ঠন করেন বিশ্বনাথ সরদার ওরফে বিশে ডাকাত। বিশ্বনাথ জাতিতে ডোম বা বাগদী ছিলেন। তিনি তিতুমিরের হামকল বাহিনীতে কিশোর বয়সে যোগ দেন। পাঁচ বছর প্রশিক্ষনের পরে তিনি নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামের একদল যুবককে তিনি নীলকুঠি দখল ও ধ্বংসের প্রশিক্ষণ দেন এবং নদীয়া জেলার কুনিয়ার জঙ্গলে ঘাঁটি স্থাপন করেন। সেখানে তার সাথে কাহাররা ও অন্যান্য ডাকাতের দল যোগ দেয়। তিনি নদীয়ার আশেপাশের বহু নীলকুঠি ও নীলের কারবার ধ্বংস করে দেন। তার এরূপ কর্মকান্ডে জেলা প্রশাসক ইলিয়ট এবং নীলকর ফেডি ভীত হয়ে পড়েন। সরকার ও নীলকরেরা তার নাম তৎকালিন ব্রিটিশ ওয়ান্টেড লিস্টে 'বিশে ডাকাত' হিসেবে উঠায়। বিশ্বনাথের মাথার জন্য হাজার টাকা পুরস্কার করা হয়।

১৮০৭ সালে, দীপাবলির রাতে বিশ্বনাথ কুঠিয়াল ফেডির বাসভবন ও কুঠি আক্রমণ করেন। ফেডির দলের প্রায় সবাই এই অকস্মাৎ আক্রমনে মৃত্যুবরণ করে বা পালায়। বিশ্বনাথের প্রধান সেনাপতি মেঘাই সরকার ফেডিকে বন্দি করে বাগদেবী খালের তীরে নিয়ে আসে। ফেডি বিশ্বনাথের কাছে প্রাণভিক্ষা চায়, এবং যিশুর নামে প্রতিজ্ঞা করে যে সে ব্যবসা উঠিয়ে ব্রিটেনে চলে যাবে। বিশ্বনাথ তাঁকে ছেড়ে দেন। ফেডি ছাড়া পেয়ে সেদিন দুপুরেই বিশ্বনাথকে ধরিয়ে দেয়। বিশ্বনাথ দিনাজপুর জেলে আটক হন। কিন্তু বিশ্বনাথ ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জেল থেকে পালান এবং পালানোর চারদিন পর তিনি আবার ফেডির ঘরে হানা দেন। তার কোষাগার লুণ্ঠন করে ও তার পাইক বাহিনীকে শেষ করে দিয়ে বিশ্বনাথ আবার ফেডির সামনে হাজির হন। কিন্তু এবারো ফেডি নীলচাষ তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন এবং বিশ্বনাথের ইষ্টদেবতার দোহাই দিয়ে ক্ষমা চান। বিশ্বনাথ এবারো তাঁকে খুন না করেই পালিয়ে আসেন।

ফেডি এবার বিশ্বনাথের ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লাগে। সরকারের কাছে আবেদন করে সে সেনাপতি ব্ল্যাকওয়ার ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি দলকে বিশ্বনাথের খোঁজে লাগায়। শুরু হয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম ম্যানহান্ট। তারা বিশ্বনাথের পালক পুত্র পঞ্চাননকে ধরতে সক্ষম হন। পঞ্চানন পুরস্কারের লোভে বিশ্বনাথের ঘাঁটির কথা ফাঁস করে দেয়। পরের দিন ব্ল্যাকওয়ারের সেনাবাহিনি কুনিয়ার জঙ্গল ঘিরে ফেলে, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বনাথ তার অনুচরদের বাঁচাতে নিজে ধরা দেন ও সমস্ত কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিজের ওপরে নিয়ে নেন। ফেডির মুখোমুখি হয়ে বিশ্বনাথ বলেন, 'গোরা সাহেব, আমি তোমার জুলুম থামিয়ে দিয়ে সংসারজীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি বাধ সাধলে। কিন্তু মনে রেখ, যে জীবন তুমি ভোগ করছ, তা আমার দান। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।'(৪৫)।

গঙ্গার তীরভূমিতে বিশ্বনাথকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার মৃতদেহ সবাইকে দেখানোর উদ্দেশ্যে লোহার খাঁচায় ঢুকিয়ে একটা অশ্বত্থ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়(৪৫)।

নীলকর শিবনাথঃ নায়ক, না খলনায়ক?
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিক রেনি খুলনা জেলার ইলাইপুর তালুক পত্তনি নিয়ে নীলের কারবার শুরু করেন। রেনি তার ভয়ঙ্কর অত্যাচারের কারণে কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার পেয়াদা বাহিনির ভয়ে কুঠির সামনে দিয়ে দিনের বেলায়ও লোক চলাচল করত না। খুলনায় এমন প্রবাদও প্রচলিত ছিল,
শ্বশুর বাড়ি যাবার আগে
রেনি সায়েবের গাঁতা পাবে,
খড় কাটিতে হবে মাঠে
জাল হাতে দাঁড়াও ঘাটে।

রেনি পথচারীদের ধরে কুঠির কাজ করিয়ে নিত, আর এই 'কাজ করিয়ে নেবার' সময়কাল কখনও কখনও সাত-আট দিন স্থায়ী হত। রেনির কুঠির পাশে আরেক নব্য দেশি নীলকর শিবনাথ কুঠি স্থাপন করেন। ইনিও একজন অত্যাচারী নীলকর ছিলেন। রেনি পাইক পেয়াদা বাহিনী পাঠিয়ে দেন শিবনাথের কুঠি পুড়িয়ে দিতে। শিবনাথ তার নিজের পাইকদের নিয়ে সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। শুরু হয় দুপক্ষের মাঝে মারামারি। রেনির পক্ষে ছিল প্রাক্তন 'গোরা' সৈনিক এবং দেশি পেয়াদা নিয়ে পাঁচ হাজারের বেশি যোদ্ধা নিয়ে গঠিত বাহিনী। আর শিবনাথকে মানুষ প্রথমে সমর্থন করেনি, কিন্তু সময়ের সাথে মন্দের ভাল হিসেবে তাকেই মানুষ সমর্থন করা শুরু করে। তার পক্ষে আসে বিখ্যাত সব লাঠিয়াল- সরদার সাদেক মোল্লা, গহরতুল্লাহ, খান মাহমুদ, ফকির মাহমুদ, আফাজুদ্দিন, তিলকের রামচন্দ্র মিত্র, বাহিরদিয়ার চন্দ্রকান্ত দত্ত, পানিঘাটের ভৈরবচন্দ্র মিত্র ও গৌরচন্দ্র ধোপা ইত্যাদি। সাধারণ চাষি ও সহায়-সম্বলহীন কৃষকেরা তাঁকে সমর্থন করতে থাকে। শিবনাথ ও রেনির মাঝে খণ্ডযুদ্ধ লেগেই থাকত। তাঁদের যুদ্ধ নিয়ে জারিগানও গাওয়া হয়-
চন্দ্র দত্ত রণে মত্ত, শিব সেনাপতি
গহরতুল্লাহ গেলে গোলা, ছুঁড়ে মারে হাতি।
সাদেক মোল্লা লাঠিয়ে গোলা রেনির দর্প করলে চুর
বাজিল শিবনাথের ডঙ্কা ধন্য বাঙালি বাহাদুর।
খান মাহমুদ সরকি চালে যেন কামানের গুলি
দিশেহারা রেনির গোরা চক্ষুভরা ধূলি।

দুই প্রতিপক্ষের কুঠিই বারবার লুণ্ঠিত হয়, কুঠি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। রাতের বেলা রেনি শিবনাথের কুঠির গোলা ও নীলগুদাম ধ্বংস করে দিল তো পরের দিন সকালেই শিবনাথ রেনির নীলবোঝাই নৌকাবহর ডুবিয়ে দিল। এদের মারামারি থামাতে সরকার নয়াবাদ থানা ও খুলনা মহকুমা স্থাপন করে, সরকারি সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কিন্তু দুই দলের দাঙ্গাবাজি ও লাঠিবাজির মাঝে পড়ে সরকারি বাহিনী দুই মাসও টিকতে পারেনি। ১৮৫৫ সালে শিবনাথের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। শিবনাথ মারা যাবার পর তার বাহিনী শেষ মরণকামড় দেয়। এই আঘাত রেনির বাহিনী ঠেকাতে পারেনি, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই নিয়েও প্রবাদ চালু হয় - 'দেখিয়া শিবের ভঙ্গি, পলাইল দীনেশ সিঙ্গি।' আর সেই সাথে নীল চাষও খুলনা থেকে উঠে যায়(৪৭)।

সতী আরতি দেবীঃ সতীর অভিশাপ
সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য ছিলেন নীল চাষের ঘোর বিরোধী এবং এই কারণে সিন্দুরিয়া কুঠির জমিদার ম্যাকনেয়ারের পরম শত্রু। ম্যাকনেয়ার কিছুতেই আচার্যকে বাগে আনতে না পেরে তার পরিবারের ওপর শোধ তুলবার পরিকল্পনা করে। জমিদার পুত্রবধূ আরতি দেবী স্বামী অমরনাথের সাথে জমিদারি নৌকা 'ময়ূরপঙ্খি' করে বাড়ি ফিরছিলেন। অকস্মাৎ ম্যাকনেয়ার তার বাহিনী নিয়ে তাঁদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ম্যাকনেয়ারের বন্দুকের গুলিতে অমরনাথ মারা যান। আরতি দেবীকে ম্যাকনেয়ার ধর্ষণ করে; তার নাক, কান ও স্তন কেটে নেয়। এই ঘটনার পর মথুরানাথ সর্বসমক্ষে বিপ্লবীদের সাথে একাত্মতাবোধ প্রকাশ করেন ও সরাসরি নীলচাষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার সাথে রইস খান, জমিদার শ্রীহরি রায় সহ আরও অনেকে যোগ দেন। ছয় মাস পরে, তারা একজোট হয়ে ম্যাকনেয়ারের কুঠিতে হামলা চালান। ম্যাকনেয়ার পালিয়ে যায়, কিন্তু কুঠিতে তার একমাত্র মেয়ে ইভা আগুনে পুড়ে মারা যায়। বারো দিন পরে, বিপ্লবী দল ম্যাকনেয়ারকে ধরতে সক্ষম হয়। মথুরানাথ ম্যাকের ঘাড়ে গুলি করেন। গুরুতর আহত ম্যাক মথুরানাথের সেই 'ময়ূরপঙ্খি' নৌকায় উঠে পালাতে চেষ্টা করে। মথুরানাথের আদেশে নৌকাসহ ম্যাকনেয়ারকে পুড়িয়ে মারা হয়(৪৮)।

এরকম হাজার হাজার ঘটনা পুরো বাংলা জুড়েই ঘটতে থাকে। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন পিটার গ্রান্ট লেখেন,
'শত সহস্র মানুষের বিক্ষোভের এই প্রকাশ যা আমরা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করছি, তাঁকে কেবল একটা রং সংক্রান্ত অতি সাধারণ বাণিজ্য-প্রশ্ন না ভেবে গভীরতম সমস্যা বলেই ভাবা উচিৎ। যারা এটি করতে ব্যর্থ, তারা সময়ের ইঙ্গিত ধরতে পারছেন না বলে আমার ধারণা।'(৪৯)

ব্রিটিশ জমিদার ও বণিক সমিতির সভাপতি ম্যাকিন্টশ ১৮৬০ সালের জুলাই মাসে ভারত সচিব চার্লস উডকে এক চিঠিতে লেখেন,
'গ্রামাঞ্চলে অবস্থা বর্তমানে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল। কৃষকেরা তাঁদের ঋণ ও চুক্তিপত্র অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মহাজন ও মালিক ইংরেজদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন করে হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার এবং সকল ঋণ রদ করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।'(৫০)

বড়লাট লর্ড ক্যানিং নীল বিদ্রোহের দুই মাস পরে ইংল্যান্ডে চিঠি লিখেন,
'নীল চাষিদের বর্তমান বিদ্রোহের ব্যাপারে প্রায় এক সপ্তাহকাল আমার এতই উৎকণ্ঠা হয়েছিল যে, দিল্লির ঘটনার (১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ) সময়ও আমি এতটা চিন্তিত হই নি। আমি সব সময় চিন্তা করেছি যে যদি কোন নির্বোধ নীলকর ভয়ে বা ক্রোধে একটি গুলিও ছোঁড়ে, তাহলে সেই মুহূর্তেই দক্ষিনবঙ্গের সমস্ত কুঠিতে আগুন জ্বলে উঠবে।'(৫১)

নিজেরা রক্ষা পেতে নীলকরেরা ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে স্মারকপত্র দেয়। সেখানে তারা জানায়,
'কৃষককুল সংগঠিতভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তাঁদের দিয়ে আর নীলের আবাদ করান সম্ভবপর হচ্ছে না। আদালতে কোন মামলা দায়ের করা যাচ্ছে না, কারণ আমাদের অভিযোগ প্রমাণের জন্য কোন সাক্ষি পাওয়া যাবে না। এমনকি আমাদের কর্মচারীরাও আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে সাহস পাচ্ছে না......রায়েতরা বর্তমানে খুবই মারমুখি। তারা ভয়ঙ্করভাবে খেপে গেছে। তারা বর্বরের মত যেকোনো দুষ্কার্য করতে এখন প্রস্তুত। প্রতিদিন তারা আমাদের কুঠি এবং বীজের গোলায় আগুন দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের প্রায় সকল কর্মচারী ও চাকরেরা কুঠি ত্যাগ করে চলে গেছে। কারণ প্রজারা তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া বা খুন করার ভয় দেখাচ্ছে। যে দুই একজন আছে, তারাও খুব শীঘ্র চলে যেতে বাধ্য হবে। কারণ পার্শ্ববর্তী বাজারেও তারা খাদ্যদ্রব্য কিনতে যেতে পারছে না। সকল জেলাতেই বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে।'(৫২)

নীলচাষের অন্তিমকালঃ ইন্ডিগো কমিশন গঠন:

সশস্ত্র কৃষকরা সরকারি অফিস, স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি প্রভৃতির ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের অস্ত্র ছিল বর্শা, তরবারি,বাঁশের লাঠি আর ঢাল। এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে যোগ দিয়েছিলেন। সিন্দুরিয়াকানসারণের কুঠিয়াল জর্জ ম্যাকনেয়ারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সিন্দুরিয়া ও জোড়াদহের কৃষকরা সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথআচার্য ও তার অন্যতম অংশীদার দিকপতির বাবুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিলেন।

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রজারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নীলের চাষ বন্ধ করে দেবে_ এই সংবাদ শুনে সরকার যশোর জেলায় একদল পদাতিকসৈন্য পাঠায়। শুধু পদাতিক বাহিনী নয়, নদীপথে রণতরী টহল দেওয়ার ব্যবস্থা করাও হয়েছিল। প্রজারা শেষ পর্যন্ত নীল চাষকরা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে বন্ধ করেছিল তালুকদার ও নীলকরদের খাজনাও। অবস্থার বিপাকে পড়ে নীলকর সাহেবরালাটের খাজনা সরকারের তহশিলে সময়মতো জমা দিতে ব্যর্থ হয়। তার জন্য সরকার তাদের খাজনা দেওয়ার সময় বাড়িয়েদেয়। নীলকরদের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য যেসব মণীষী কলম ধরেছিলেন, তাদের মধ্যে প্রখ্যাত নাট্যকারদীনবন্ধু মিত্র ও খ্যাতনামা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত অন্যতম। দীন বন্ধু মিত্র 'নীলদর্পন' লিখে দেশবাসীর সামনে নীলকরদেরঅত্যাচারের সঠিক চিত্র তুলে ধরেন। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাদরী লঙের তত্ত্বাবধানে নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদকরেন।

১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ নীল কমিশন বা ইন্ডিগো কমিশন গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন বঙ্গীয় সরকারের সেক্রেটারি M.W.S. Seaton Carr। কমিশনের একজন বাদে সবাই ছিলেন ইংরেজ। বাকি ওই একজন ছিলেন জমিদার সমিতির এক সদস্য। কমিশনের প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৬০ সালের ১৮ মে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। কমিশন তিন মাসে ১৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। সাক্ষীদের মাঝে ১৫ জন সরকারি কর্মচারী, ২১ জন নীলকর, ৮ জন মিশনারি, ১৩ জন জমিদার ও ৭৯ জন নীলচাষি(৫৩)। দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে কমিশন রিপোর্ট দেয়, 'The whole system is vicious in theory, injurious in practice and radically unsound.'(৫৪)

কমিশনের রিপোর্ট ও ছোটলাটের স্বীকৃতি সত্ত্বেও সরকার রায় দেয় নীলকরদের দিকেই। সরকার নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে, কিন্তু নীলকরদের নিরাপত্তার জন্য পূর্বের সকল দমনমূলক আইন বজায় রাখা হয়; নতুন নতুন থানা ও মহকুমা স্থাপন করে পুলিশের শক্তি বাড়ানো হয়, যাতে সহজে বিদ্রোহ দমন করা যায়(৫৫)। সেই সাথে কৃষকদের সান্ত্বনা দিতে কয়েকটি অর্থহীন ইশতেহার জারি করা হয়-
১. সরকার নীলচাষ করার বিষয়ে নিরপেক্ষ।
২. আইন অমান্য করলে বিদ্রোহী প্রজা বা নীলকর কেউই শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।
৩. অন্য শস্যের মত নীল চাষ করা বা না করা প্রজার ইচ্ছাধীন।

সরকারের এ প্রতারণা কৃষকেরা বুঝতে পারে। নদীয়া ও যশোরের কৃষকেরা হেমন্তকালীন নীলচাষ করা এবং জমিদার ও নীলকরদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ধ্বংসাত্মক কর্মতৎপরতা থামাতে সরকার দুই জেলায় দুই দল সৈন্য রণতরী যোগে পাঠায়। দুই দলের অধিনায়কদের সাথে কৃষক জনতা আলোচনায় বসে। প্রজারা বলে, 'খাজনা দিতে আপত্তি নেই, তবে নীলকর ও জমিদারদের নির্যাতন হতে প্রজাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে(৫৬)'। অধিনায়ক দুজন ফিরে গিয়ে এই বিষয়ে রিপোর্ট দাখিল করেন।

রিপোর্ট পেয়ে বাংলার ছোটলাট গ্রান্ট স্বচক্ষে অবস্থা দেখতে স্টিমারে করে গোপনে ১৮৬০ সালের অগাস্ট মাসে ৭০ মাইল দীর্ঘ জলপথ পরিভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর পর কোনভাবে প্রজারা জেনে ফেলে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ স্টিমার তীরে ভেড়াবার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁদের হাতে ঝাঁকিজাল ও কোঁচ। গ্রান্ট ভীত-সন্ত্রন্ত হয়ে নদীর মাঝ দিয়ে স্টিমার চালাবার আদেশ দেন। কিন্তু পথ কোথায়? নদী মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ। গ্রান্ট ভয় পেয়ে যান। কিন্তু জনতা তাঁকে অভয় দেয়, তিনি অতিথি, তার জীবনের কোন ভয় নাই। স্টিমার তীরে ভেড়ান হল। গ্রান্ট সবাইকে পাবনা যেতে বললেন। বললেন, সেখানে জনসভায় তিনি নীল চাষ তুলে দেবার ঘোষণা দেবেন। এবারে স্টিমার চলল পাবনা। জন পিটার গ্রান্ট নিজেই এ অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। বলেছেন, প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে ৬০-৭০ মাইল পথ ভ্রমণকালে তিনি নদীর উভয় পার্শ্বে লক্ষ লক্ষ জনতার ভিড় দেখেছেন। এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আর কোন রাজকর্মচারীর হয়নি(৫৭)।

পাবনায় গিয়ে জনসভায় গ্রান্ট বলেন, 'অতি শীঘ্রই নীল চাষ বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাষির ইচ্ছা ব্যতীত, কাউকে জোর করে নীল চাষ করান যাবে না। কেউ জোর করে নীল চাষ করালে আইন কঠোর হাতে তাঁকে দমন করবে'। কিন্তু গ্রান্ট তার কথা রাখতে পারেননি। নীলকররা তাঁদের সমিতি Indigo Planters Association এর ক্ষমতার জোর খাটিয়ে নীল চাষ বন্ধের যে আইন প্রণীত হবার কথা ছিল, তা রদ করে দেয়। এমনকি নীলকর সমিতি তাঁকে কঠোর অবস্থানের জন্য গালাগালি করতে থাকে। বিক্ষুব্ধ গ্রান্ট বিবৃতি দেন, 'আইনের বিপক্ষে, নীলচাষের সপক্ষে পৃথিবীর কোন শক্তিই আর বেশিদিন এ ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে পারবে না। ন্যায়ের পথ উপেক্ষা করে যদি সরকার চলতে থাকে, তবে আরও বিপুল কৃষক অভ্যুত্থান ও বিপ্লব সরকারের শাস্তি বিধান করবে। সেই অভ্যুত্থান ভারতে ইউরোপীয় ও অন্যান্য মূলধনের পক্ষে যে সাংঘাতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে তা সাধারণ মানুষের হিসাবের বাইরে।'(৫৮)

ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম পরবর্তীতে লিখেছিলেন, 'বিভিন্ন তথ্য থেকে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা ভয়ঙ্কর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি...আমাকে বিভিন্ন জেলা-মহকুমার রিপোর্ট দেখানো হয়, সেগুলোতে বারবার বিপ্লবের কথা, দরিদ্র মানুষের কথা এসেছে...তারা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে, অত্যাচারে-অনাচারে তাঁদের মৃত্যু অনিবার্য। মরবার পূর্বে তাই তারা একটা কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।...এ একটা কিছুর অর্থ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটা ব্যাপক অভ্যুত্থান শুরু হবে, এবং সেটা কৃষকদের মাঝে থেমে থাকবে না(৫৯)।'

এদের কথা সত্যি হয়ে দেখা দেয় ক'বছরের মাঝেই। যারা জুলুমবাজ নীলকর ছিল, বিপ্লবের মুখে তারা ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়, নইলে কৃষকদের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারায়। শুধুমাত্র যারা প্রজাদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে শিখেছিল, তাঁদের কুঠিই টিকে থাকে। এসব কুঠিয়াল টিকে থাকার জন্য নানা জনহিতকর কাজ করতে শুরু করে। নতুন রাস্তাঘাট করে দেয়, মজা পুকুর সংস্কার করতে সাহায্য করে। নতুন মন্দির বানিয়ে দেয়। আবার এদের মাঝে ব্যতিক্রম ছিল সিন্দুরিয়া কুঠির ম্যানেজার ড্যাম্বেল পিটারস। সে এই বিদ্রোহে খেপে গিয়ে আরও বেশি অত্যাচার চালাতে শুরু করে। ওই স্থানে পুলিশের সংখ্যা বেশি ছিল বলে কৃষকদের প্রতিবাদ করতে গেলেই বিপদে পড়তে হত। এরই ফল হিসাবে ১৮৮৯ সালে সিন্দুরিয়ায় সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ হয়। ফলস্বরূপ নীল চাষ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে যায়। এই বিদ্রোহে সর্বপ্রথম অভিজাত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কৃষকদের সমর্থন করেন।
সিন্দুরিয়ার বিদ্রোহ ছিল সর্বশেষ নীল বিদ্রোহ। এর পরে বাংলায় আর বিদ্রোহ হয়নি, করার দরকারও হয়নি। কারণ কৃষকদের এমন বিদ্রোহে প্রাণ বাজি রেখে নীল চাষ করতে নীলকররা আর আগ্রহী হতে পারেনি। তাছাড়া জার্মানিতে কৃত্রিম রং আবিষ্কৃত হয়, এতে নীলকরদের লাভ পঞ্চাশ ভাগ কমে যায়। ফলে সব মিলিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে নীল চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার কৃষক মুক্তি পায় ঘৃণ্য নীলকরদের হাত থেকে।

নীল বিদ্রোহের সাফল্যের পেছনে কারণ তিনটি।
প্রথমতঃ, নীল বিদ্রোহের সম্পূর্ণ উৎপত্তি কৃষক অর্থাৎ উৎপাদক শ্রেণীর হাতে। এই বিদ্রোহে গ্রাম সমবায় আরও মহৎ হয়ে শ্রেণী সমবায়ে পরিণত হয়। একজন নেতা হারালে আক্ষরিক অর্থেই একশ জন এসে সে খালি স্থান পূরণে সক্ষম ছিল। সুতরাং নেতৃত্ব পরিচালনায় কখনো ছেদ পড়ে নি।
দ্বিতীয়তঃ, তখন নব্বই শতাংশ লোক কৃষিকাজ করত। এরা যেকোনো বিদ্রোহের বেস হিসেবে কাজ করে। বেস-ই যখন বিদ্রোহ করে, সে বিদ্রোহ থামানোর সাধ্য কার?
তৃতীয়তঃ, কৃষকদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে কোন বিভ্রান্তি ছিল না। রুখে দাঁড়াতে হবে, নইলে না খেয়ে মরব - এতটাই সরল ছিল তাঁদের ভাবনা।
আর এই কারনেই বাংলার সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ - নীল বিদ্রোহ।
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায় যে, ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নীল চাষিদের বিদ্রোহ রক্তাক্ত আকার ধারণ করে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এই কৃষক বিদ্রোহের দুটি স্তর ছিল। প্রথমদিকে অত্যাচারিত কৃষকরা ইংরেজ শাসক গোষ্টীর মানবিকতা এবং ন্যায়বোধের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছিল। এতে কোনও ফল না পাওয়ায় দ্বিতীয় স্তরে কৃষকরা নীল চাষে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করল। ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজস্ব গুন্ডাবাহিনী ছাড়াও পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাহায্যে কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করার প্রচেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান শুরু হয়।
টীকা
১. মাধ্যমিক সামাজিক বিজ্ঞান (শিক্ষাবর্ষ ২০১০), পৃঃ ৪৭-৪৮
২. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৯৩
৩. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ১৭
৪. C.E. Buckland: Bengal under the Lieutenant Governors
৫. Major Smith: Report on the Maldah
৬. শ ম শওকত আলিঃ কুষ্টিয়ার ইতিহাস
৭. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
৮. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ১৯
৯. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
১০. W.W. Hunter: Imperial Gazetteer of India
১১. প্রমোদ সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাঙ্গালি সমাজ
১২. তৎকালীন সময়ে কোন জমিতে যদি তাগিদগীর প্রায় একহাত লম্বা একটি খুঁটি গেড়ে তার মাথায় দড়ি বেঁধে দিত, তাহলে কৃষক বুঝতে পারত যে এই জমিতে নীল চাষ করতে হবে। এটাই 'দাগ মারা'।
১৩. যার জন্য পেয়াদার নামের সাথে ব্যঙ্গার্থে 'সম্বুন্ধি' শব্দটি যোগ করা হত এবং তখন থেকে এটি গালি হিসেবে প্রচলিত হয়।
১৪. এজন্য সমাজে তাদের নাম বিকৃতভাবে ধরা হত - রামা ভেড়ি, জমরে মাহুত, আহাদে মালি, বিশে মুর্গি, স্যাকরা বরকন্দাজ, হরে পেয়াদা ইত্যাদি।
১৫. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'ভুলে যাওয়া নীলঃ রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব', পৃঃ ২৯
১৬. ব্রিটিশ সরকার এই ভূস্বামীদের এক থেকে সাতটি খুন করার অধিকার পর্যন্ত দিয়েছিল। এই বিষয় থেকেই 'সাতখুন মাপ' কথার উৎপত্তি।
১৭. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ২৪
১৮. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'ভুলে যাওয়া নীলঃ রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব', পৃঃ ৪২
১৯. বারুই পাড়া থেকে এত বেশি নীল রপ্তানি হত যে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হয় নীলগঞ্জ।
২০. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ২৫
২১. তাজুল ইসলামঃ 'চুয়াডাঙ্গার করুণ কথা'
২২. সিন্দুরিয়া কুঠি স্থাপনের জন্য মে সাহেব প্রথমে মরতুজাপুর গ্রামের কাছে পাঁচপীরতলায় আসেন। সেখানে এক বিরাট শ্যাওড়া গাছ ছিল। তার সংলগ্ন দুইটি উঁচু ঢিবি-ও ছিল। কিংবদন্তিতে আছে, এই স্থানে কুতুব উদ্দিন শাহ এবং হজরত অলি নেয়ামত শাহ নামক দুই ইসলাম প্রচারক বুজুর্গের সমাধি ছিল এবং আরেক বিখ্যাত পীর ওলি দেওয়ান শাহ এখানেই শিক্ষা প্রদান করতেন। মে সাহেব সে গাছ কেটে কুঠি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলে গ্রামবাসী তার প্রতিবাদ করে এবং সকল কুলি মজুর কাজে অনীহা জানায়। এমনকি সাহেবের প্রধান কাঠুরিয়া কালিচরণ সরকার সরদার বাগদীও সরাসরি হুকুম অমান্য করে। এতে সাহেবের পুত্র, টমাস আইজ্যাক মে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেই কুঠার হাতে সরাসরি গাছের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্ত মাত্রের ঘটনা! উত্তেজনা কাটতেই দেখা গেল তার কুঠারাঘাত গাছে না লেগে তার তলপেটের বাম পাশ ভেদ করে গেছে! কলকাতায় নিয়ে যাবার পথে তার মৃত্যু হয়। মে সাহেব পরের সপ্তাহেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
২৩. রিভস সেই শ্যাওড়া গাছ এবং তার সংলগ্ন উঁচু ঢিবি বাইরে রেখে নতুন দালানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু এবার নতুন উৎপাত শুরু হয়। সারাদিন সে দেয়াল এবং দালান স্থাপিত হত, রাতে কে বা কারা এসে তা নিকটাবর্তী নবগঙ্গার জলে নিক্ষেপ করত। প্রথমে পাহারাদার এবং পরে হিন্দু পেয়াদা রেখেও এই ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে রিভস তার অংশীদারদের পরামর্শে এখানকার অর্ধনির্মিত কুঠি ত্যাগ করে দোলাই খালের একাংশ মাটি ভর্তি করে সেখানে কুঠি নির্মাণ করেন।
২৪. ইঞ্জিনিয়ার মিঃ বোরিক কুঠির নির্মাণকালে এখানে তাবু খাটিয়ে বাস করতেন বলে স্থানটি আজ অবধি 'বোরিক পোল' নামে অভিহিত।
২৫. সিন্দুরিয়া নীলকুঠির সচিবালয় বাংলাদেশের মাঝে সর্ববৃহৎ ছিল।
২৬. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৩১
২৭. কথিত আছে, ম্যাকনেয়ার সারাদিন যাদের ওপর অত্যাচার চালাতেন, তাঁদেরকে রাতে নাচমহলে ডেকে সারারাত ভাল ভাল খাবার খাওয়াতেন, আপ্যায়ন করতেন। বেচারা কৃষক খুশি হত, ভাবত সাহেব আর মারবেন না। কিন্তু সকাল হলেই কাছারি ঘরে ডেকে আবার তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়ে যেত।
২৮. Calcutta review. Vol. 36, p. 40
২৯. James Watts: Dictionary of Economy Products of India.
৩০. প্রমোদ সেনগুপ্তঃ নীল বিদ্রোহ ও বাঙ্গালি সমাজ
৩১. Indigo Comission Report, Evidence, p. 32
৩২. সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
৩৩. নীল কমিশনের সামনে তারাচাঁদ মণ্ডলের স্বীকারোক্তি
৩৪. Calcutta Review, Nov. 1860
৩৫. মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৪৮
৩৬. দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডল অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন। তিনি নীলবীজ বাড়িতে এনে বপন না করে নষ্ট করে ফেলেন। কুঠিয়াল তাঁকে তলব করে এর কারণ জানতে চায়। তিনি উত্তর দেন, 'হুজুর, ভুলক্রমে ছেলেপিলে নীলবীজকে তিল ভেবে ভেজে খেয়ে ফেলেছে। এবারের মত মাফ চাই।' কুঠিয়াল তার কথা শুনে আবার তাঁকে নীলবীজ দেন। এবারে তিনি বীজগুলো ভেজে তারপর বপন করেন, যাতে নীলের উৎপাদন না হয়। তার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে হাজার হাজার বিঘার নীল আবাদ নষ্ট করে ফেলে।
৩৭. কুঠির প্রজাদেরকে দুই আনা বৃদ্ধি করে কবুলিয়াতি দেয়ার আদেশ করা হয়। প্রজারা প্রতিবাদ করলে শীতল বিশ্বাস উৎপীড়ন শুরু করে। প্রজারা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার কাছারিঘর লুটপাট ও ভস্মীভূত করে এবং নিকটাবর্তী বিলের কাছে তাঁকে ঘেরাও করে। তর্ক বিতর্কের সময় প্রজাদের একজন বলে, নাক কান কেটে দাও, হত্যা কর না। এই কথা শুনে গোমস্তা রেগে গিয়ে বলে, 'নাক-কান কেটে দিয়ে ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে দোব।' ফলে উত্তেজিত জনতা তাঁকে সেখানেই হত্যা করে বিলের পাড়ে পুঁতে রাখে।
৩৮. ঘোলদাড়ি গ্রামের কৃষক রব্বানি চুক্তিপত্রে কখনো টিপসই দেননি। কুঠিয়াল ব্রুমফিল্ড তাঁকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেন, এমনকি এক পর্যায়ে রব্বানির বামহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ নেবার জন্য আঙ্গুলটি কেটে নেয়। তবু তিনি হার মানেন নি, বরঞ্চ পালিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী বাহিনিতে যোগ দেন।
৩৯. Indian Field, April, 1860
৪০. Hindu Patriot, February, 1860
৪১. অনাথনাথ বসুঃ 'মহাত্মা শিশিরকুমার'
৪২. সতীশচন্দ্র মিত্রঃ 'যশোর খুলনার ইতিহাস'
৪৩. সুপ্রকাশ রায়ঃ প্রাগূক্ত
৪৪. শ.ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৪৫. শ্রী মোহিত রায়ঃ কুখ্যাত ডাকাত বিশ্বনাথ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩/১০/৬১
৪৬. শ্রী বিমলেন্দু করনিঃ 'বিশে ডাকাত' প্রবন্ধ
৪৭. শ. ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৪৮. যোগেশচন্দ্র বাগলঃ Peasant revolution in Bengal.
৪৯. Parliamentary Papers, Vol.45, p. 75
৫০. Hindu Patriot, August, 1860
৫১. Buckland: Bengal under the Lt. Governors
৫২. Hindu Patriot: 17th march, 1860
৫৩. Indigo Comission Report, Evidence, p. 13
৫৪. Indigo Comission Report, Evidence, p. 03
৫৫. শ.ম. শওকত আলিঃ প্রাগূক্ত
৫৬. এম. এ. বারিঃ চুয়াডাঙ্গা গ্যাজেটিয়ার
৫৭. Buckland: Bengal under the Lt. Governors, Vol.1, p. 96
৫৮. Parliamentary Papers, Vol. 45, p. 96
৫৯. Sir William Wedderburn: Allan Octovian Hume, Father of Indian National Congress