Friday 12 April 2019

বাংলাদেশে টাকশালের গোড়ার কথা

আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯ - ০৫:৫০ | প্রকাশিত: রবিবার ০৭ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট সংস্করণ daily sangram 



আবু রাওনাফ আলী নূর : টাকশাল নামেই পরিচিত। পোশাকি নাম দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দেশের টাকা ছাপানোর একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান গাজীপুরে। টাকশালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। এ বছর এসে পূর্ণ হলো ৩০ বছর। টাকশাল নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন। বিশ্বে স্বাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় ২০০। তবে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে নোট মুদ্রণের ছাপাখানা আছে মাত্র ৬৫; যার মধ্যে বাংলাদেশের টাকশাল একটি। নাগরিক হিসেবে ব্যাপারটা নিশ্চয় মর্যাদা ও গর্বের। দেশের মানুষের কাছে ‘টাকশাল’ নামে বেশি পরিচিত বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠানটির পোশাকি নাম ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড (The Security Printing Corporation (Bangladesh) Ltd. (SPCBL) হল বাংলাদেশে ব্যাংকনোট ও সরকারি ডাকটিকিটের প্রধান ছাপাখানা। ওয়েবসাইট http://www.spcbl.org.bd, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৯২ সালের এপ্রিল থেকে, এটি দেশের উপস্থিত আইনের আওতাধীন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। এটি আন্তর্জাতিক সরকারি ছাপাখানা সমিতির নিয়মিত সদস্য। নেপাল সহ আরও বহু দেশ এর চার রং বিশিষ্ট উন্নত ডাকটিকিটের ক্রেতা। ২০১৩ সালে এর রজত জয়ন্তী উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটি সীমিত পরিমাণে ২৫ টাকার স্মারক নোট অবমুক্ত করে।
টাকশালের অভ্যন্তরে : ইংরেজি শব্দ ‘মিন্ট’-এর বাংলা হচ্ছে টাকশাল যেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি ধাতব মুদ্রা বা কয়েন বানানো হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাপালেও বাংলাদেশের টাকশালে কোনো কয়েন তৈরি হয় না। আর্থিকভাবে লাভ-লোকসান বিশ্লেষণে দেশের জন্য কয়েন উৎপাদন লাভজনক বিবেচিত না হওয়ায় আমাদের টাকশালে এখনো কয়েন তৈরির কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি এবং এ জন্য কয়েন তৈরির কোনো মেশিনও সংস্থাপন করা হয়নি। তবে টাকশালে শুধু যে টাকাই ছাপা হয়, ব্যাপারটা এমন নয়। টাকা ছাপানোর উদ্দেশ্যে স্থাপিত হলেও সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তাসামগ্রী এখানে ছাপানো হয়, যেমন: অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সঞ্চয়পত্র, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রাজস্ব স্ট্যাম্প, আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক সামগ্রী, স্মারক ডাকটিকিট, খাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্যাক্স লেবেল, ব্যাংকের চেক বই, প্রাইজবন্ড, রপ্তানি উন্নয়ন বুুরোর জিএসপি ফরম, দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদ ইত্যাদি। এ ছাড়াও কোনো কোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তাদের শিক্ষা সনদও মুদ্রণ করা হয়ে থাকে। টাকা মুদ্রণের কারণে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ প্রচুর। প্রায় ৬৬ একর জায়গা নিয়ে দেশের টাকা তৈরির একমাত্র এই কারখানা বৃক্ষশোভিত। আর গাছগাছালিতে ভরা বলেই টাকশালের অভ্যন্তর সব সময় পাখির কলরবে মুখরিত থাকে। শুধু প্রাকৃতিক দিক থেকেই নয়, টাকা মুদ্রণের একক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে কিছুটা ভিন্নও। কিন্তু বিদ্যমান বহু স্তরে নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মী ও প্রতিষ্ঠানটিকে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। পুলিশের প্রায় ৮০ জন সদস্য প্রতিষ্ঠানের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। এই ছাপাখানায় প্রবেশ করতে হলে চারটি ফটকে নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করতে হয়। প্রেসের মূল ফটক ও ভেতরের ঘরগুলোতে কর্মচারী, কর্মকর্তাদের চলাচলে অ্যাকসেস কন্ট্রোল ছাড়াও সব কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং অনুমতি পাওয়া গ্রাহকদের ছাপাখানায় প্রবেশের সময় দেহ তল্লাশি করা হয়। ব্যক্তি ও মালপত্রের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য লিখে রাখার জন্য করপোরেশনের শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেসের অভ্যন্তরে চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়ে থাকে। মুদ্রণসহ যেকোনো নিরাপত্তাসামগ্রী উৎপাদনে বেশ কিছু পর্যায়ে বিভিন্ন ঘরে (হল) কাজ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছাড়া এক হল থেকে অন্য হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারেন না। প্রতিটি হলের জন্য আলাদা এন্ট্রি পাস ছাড়াও দরজায় নিরাপত্তাকর্মীরা অন্যদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা রয়েছে। সংগৃহীত কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রীর মধ্যে সমন্বয়ন পদ্ধতি এই প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়েই পালন করা হয়। সমন্বয়ন বা রিকনসিলিয়েশনে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন বু্যুরো, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকে। যতক্ষণ সংগৃহীত কাঁচামালের সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য ও ওয়েস্টেজ বা অপচয়ের মিল হবে না, ততক্ষণ হিসাব করা হতে থাকবে। হিসাব মিলে গেলে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ওয়েস্টেজ ধ্বংস করা হয়। এমন নিরাপত্তা বিধান ও স্বচ্ছতার কারণে এই টাকশাল গ্রাহক প্রতিষ্ঠাগুলোর আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে।
গোড়াপত্তনের গল্প : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশে কিছুদিন পাকিস্তানী টাকার প্রচলন ছিল। তখন ওই টাকাগুলোতে ‘বাংলাদেশ’ লেখা স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো। পাকিস্তানী মুদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসেবে টাকার প্রচলন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। টাকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগ পর্যন্ত ভারত, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি থেকে বাংলাদেশের নোট ছেপে আনা হতো। সংগ্রহ নীতিমালা অনুসরণ করে একটি ভিন্ন দেশ থেকে নোট ছেপে সময়মতো আনা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বোধ করে আমাদের দেশেই নোট মুদ্রণের একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নোট ছাপার জন্য একটি প্রেস স্থাপনের ব্যাপারে ১৯৮৩ সালে একনেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তবে উদ্বোধনের আগে ১৯৮৮ সালেই পরীক্ষামূলকভাবে ১ টাকা ও ১০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল। প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবেই এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকের অনুমোদনের পর অর্থ মন্ত্রণালয় নোট মুদ্রণের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন করে। পরে যৌথ মূলধন কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার নামকরণ করা হয় ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন। শুনেছি, ‘দ্য’ নির্দেশকটি তৎকালীন অর্থসচিব ড. আকবর আলি খানের দেওয়া।
নোট ছাপানোর রীতিনীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন গ্রাহক প্রতিষ্ঠান সচরাচর বছরভিত্তিক তাদের প্রয়োজন মোতাবেক পণ্যের চাহিদা বা কার্যাদেশ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী নোটের উৎপাদন ও সরবরাহ করা টাকশালের পক্ষে এর আগে কখনো সম্ভব হয়নি। ৩০ বছর আগে বসানো স্বল্পসংখ্যক মেশিন দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো টাকশালের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সম্প্রতি আরেকটি উৎপাদন লাইনের মেশিন বসানোর পর উৎপাদনও শুরু হয়েছে। মেশিনের স্বল্পতার জন্য কয়েকটি মূল্যমানের নোট একই সময়ে মুদ্রণ করা সম্ভব হয় না; একটি নোট ছাপাতে প্রায় ৩০ পর্যায় পার করতে হয়। নোট উৎপাদনের পরিমাণ নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিভিন্ন অফিসের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন মূল্যমানের নোটের চাহিদা জানালে টাকশালের ভল্ট থেকে তা সরবরাহ করা হয়।
টাকশাল হলো কোম্পানি : ১৯৯২ সালে প্রকল্প থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব কিছুটা কমে এই প্রতিষ্ঠানের ওপর। কর্তৃত্ব চলে যায় পরিচালনা পর্ষদের হাতে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ টাকশাল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এই পরিচালনা পর্ষদ প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। টাকশালের পুরো মূলধন বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দিয়েছে।
৯ ধরনের নোট : বাংলাদেশে ৯টি মূল্যমানের কাগজি নোট রয়েছে; অবশ্য বর্তমানে ১ টাকা মূল্যমানের কাগজি নোট আর ছাপানো হয় না। বাকি নোটগুলো গাজীপুরে অবস্থিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে ছাপা হয়ে থাকে। এ ছাড়া সব স্মারক নোটও এই টাকশালেই মুদ্রিত। উচ্চ মূল্যমানের নোটগুলো জাল হয় বলে এগুলোর নকলরোধে বেশি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করা হয়ে থাকে। কম মূল্যমানের নোটগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি হাতবদল হয় এবং এই নোটগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলেও বদলে নেওয়ার জটিলতায় কেউ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় না। এসব বিবেচনায় কম মূল্যমানের কাগজি নোটের পরিবর্তে ধাতুর তৈরি কয়েন বিদেশ থেকে আমদানি করে ইস্যু করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের জনগণ কয়েন ব্যবহারে একেবারেই অভ্যস্ত নয় এবং কয়েন ব্যবহারের অপরিহার্যতা আমাদের দেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি। টাকশালের প্রায় ১ হাজার কর্মচারী-কর্মকর্তার পরিশ্রমে যে নতুন কচকচে নোট উৎপাদন হয়, সেই নতুন নোটে বেতন হয় না বলে একটু আক্ষেপ দেখেছি তাঁদের মধ্যে। যে টাকা তাঁরা তৈরি করেন, সেই টাকা ভুলক্রমে বাসা থেকে অফিসে প্রবেশের সময় সঙ্গে পাওয়া গেলে তার জন্যও তাঁদের শাস্তি ভোগ করতে হয়। অধিকাংশ কর্মচারী, কর্মকর্তাকে ওভার টাইম কাজসহ পুরো দিনটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়; কারণ উৎপাদন এলাকায় মুঠোফোন নেওয়া নিষিদ্ধ। 
দেশখ্যাত শিল্পীদের নকশায় টাকা ছাপা হয় গাজীপুরের টাকশালে: বিশাল এক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মানুষের হাতে কাগজের টাক বা ধাতব পয়সা আসে। কখন কী পরিমান মুদ্রা ছাড়া হবে তার আছে হিসাব পদ্ধতি। মুদ্রার নক্সা করতে যুক্ত করা হয় দেশের স্বনামখ্যাত শিল্পীদের। টাকশালের যাত্রা শুরুতে বিভিন্ন মানের ৩০ কোটি নোট ছাপানোর সক্ষমতা ছিল। বেড়ে এখন ১শ’ ২০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। কাগজের নোটের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার কথা বিবচেনা করে বদল করা হয় সময়ে সময়ে, যার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতি বছর ব্যয় করতে হয় ৫শ’ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে মুদ্রা ছাপার সকল সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকশাল প্রতিষ্ঠার পর বহু বছর এর সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্থবির ছিল, সংকটের ঝুঁকিও ছিল। এখন সব প্রযুক্তি সফটওয়্যার ভিত্তিক। 
টাকশালে কোন সমস্যা হলে জার্মানীতে বসে মেরামত সম্ভব। নোট ছাপানোর সক্ষমতাও বেড়েছে চারগুণ। দেশের বরেণ্য চিত্র শিল্পীরা মুদ্রার নক্সা করেন। সরকার পাল্টালে ক্ষমতাসীন  রাজনৈতিক দলের মতবাদ অনুসারে মুদ্রার নকশাও পাল্টায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ছবি বাদ দেবার মধ্য দিয়ে নক্সা পরিবর্তনে রাজনীতি শুরু হয়। তবে ছবি টাকার নকল  রোধে সহায়ক। মুদ্রা ছাপানো নিয়ে নিরীক্ষা চলে নিয়মিত। দু’দশক আগে প্লাস্টিকের তৈরি ১০ টাকার নোট ছাড়া হয়েছিল, নানা জটিলতায় তা ক’বছরেই বাতিল হয়। সেটাকে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখেন এই নোট প্রবর্তনকালীন গর্ভনর। কাগুজে মুদ্রা আবিষ্কারের অনেক আগে তৈরি করা হয়েছিল ধাতব মুদ্রা। তুরস্কের এশিয়া মহাদেশীয় অংশের লিডিয় জাতি সর্বপ্রথম মুদ্রা তৈরি করে। লিডিয়দের মুদ্রা তৈরির প্রায় কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন ভারতে মুদ্রা তৈরি এবং প্রচলন হয়। ধারণা করা হয় এখানে মুদ্রার প্রচলন হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নামটিই মুদ্রার সরকারি নাম হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ তারিখ থেকে ১ টাকার নোট প্রচলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব ব্যাংক নোট চালু করে। ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত চালু থাকা এই নোট ছাপা হয় ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে। পরে সুইজ্যারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ভারত, কোরিয়া, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের নোট ছাপা হয়। ১৯৮৯ সালে গাজীপুরে দেশের প্রথম ও একমাত্র আধুনিক টাকশাল স্থাপিত হয়। 
বাংলাদেশে মুদ্রার ইতিহাস : ভাষাবিদগণের মতানুসারে টাকা শব্দটি সংস্কৃত টঙ্ক শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। এক টাকার শতাংশকে পয়সা নামে অভিহিত করা হয়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বাংলাদেশ ব্যাংক নামে পরিচিত টাকার কাগুজে নোট মুদ্রণ এবং মুদ্রা প্রস্তুতকরণ এবং তা বাজারে প্রচলনের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের রাজত্ব ছিল। তবে সে সময়ের মুদ্রা পাওয়া না যাওয়ায় তাদের টাকশাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। দ্বাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী সেনরাজারা বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে রাজত্ব করে। সেনযুগে পালযুগের মতো মুদ্রার পরিবর্তে কড়ির প্রচলন ছিল। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত ২০০ বছর মুসলমান সুলতানরা বাংলাদেশে স্বাধীন রাজত্ব কায়েম করার ফলে বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার পুনরুজ্জীবন ঘটে। কাপড় ও চিনিসহ বাংলাদেশের বহু পণ্য বিদেশে রফতানি হয়। ফলে বাংলাদেশ তখন সম্পদশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। সে সময়ে বাংলাদেশের বাগেরহাট এলাকার খলিফাতাবাদ টাকশাল, রাজশাহীর মাহিসন্তোষের বারবাকাবাদ টাকশাল, সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী মুয়াজ্জমাবাদ টাকশাল, ফখরুদ্দিন মুবারক শাহরে রাজধানী সোনারগাঁওয়ের টাকশাল, চট্টগ্রাম টাকশালসহ প্রায় ৮০টি টাকশালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। স্বাধীন সুলতানি শাসন সময়ের পর মুঘল আমলেও বাংলাদেশে টাকশালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মুঘল যুগের জাহাঙ্গীরনগর টাকশালে তৈরি মুদ্রার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। যার পাশাপাশি কাগুজে নোটেরও প্রচলন হয়। তবে তা আধুনিক মানের ছিল না। ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নোটটি সবচেয়ে পুরনো হিসেবে ধরা হয়। এই উপমহাদেশে লখনৌতি গঙ্গানদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত বাংলার আদি টাকশাল শহর। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই লখনৌ রাজধানী শহর হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং প্রথম টাকশাল হওয়ারও গৌরব অর্জন করে। ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টাকশাল শহর হিসেবে এটি চালু ছিল।  ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ৭৪০ হিঃ থেকে ৭৫০ হিঃ পর্যন্ত রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়ে। তাঁর আমলের সব মুদ্রার সুস্পষ্টভাবে আঁকা হয়েছে, সোনারগাঁও টাকশালের কথা। সেখান থেকে সর্বশেষ মুদ্রা তৈরি হয় ১৪২১ সালে। সোনারগাঁও এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টাকশাল শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। 
উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুদ্রা আইন পাস হয় ১৮৩৫ সালে ও কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয় ১৮৫৭ সালে। কাগজের মুদ্রার প্রচলন করেন লর্ড ক্যানিং। সেই সময় যে অভিন্ন মুদ্রা ছিল তার নাম রুপি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ মুদ্রাকে টাকা বলতো। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুদ্রার নাম ছিল রুপি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তখনো মুদ্রাকে টাকা বলা হতো। টাকা শব্দটি সংস্কৃত ‘টঙ্কা’ শব্দ থেকে এসেছে। ১৯৮৯ সালে প্রিন্টিং প্রেসটি চালু হয় সর্বপ্রথম ১০ টাকার নোট ছাপার মাধ্যমে। টাকা ছাপানোর জন্য বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানি করা হয় সুইজারল্যান্ড থেকে। ৫০০ টাকার নোট ছাপানো হয় জার্মানি থেকে। এছাড়া ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম ১০ টাকা মূল্যমানের পলিমার নোট ছাপা হয়। ১০ টাকার পলিমার নোট তৈরি হয় অস্ট্রেলিয়ায়। ১ ও ৫ টাকা মূল্যমানের যে ধাতব মুদ্রা বাংলাদেশে প্রচলিত তা তৈরি করা হয় কানাডায়। বাংলাদেশে ১ টাকার ধাতব মুদ্রা চালু হয় ৯ মে ১৯৯৩ সালে এবং ৫ টাকার ধাতব মুদ্রা চালু হয় ১ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে। বাংলাদেশে নতুন নোট বাজারে চালু করার ক্ষমতা আছে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের। ১ ও ২ টাকার নোটের মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের। এগুলোতে স্বাক্ষর থাকে অর্থ সচিবের। ১ ও ২ টাকার নোট ছাড়া বাকি সব বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট, এগুলোতে স্বাক্ষর থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের। বাংলাদেশে জাল নোটের ইতিহাস খুবই পুরোনো। ১৯৭২ সালে ১০০ টাকার জাল নোট ব্যাপক হারে বিস্তার করে সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়। বর্তমানে ঈদ, পূজা, পার্বনকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠে জালিয়াত চক্র। বড় বড় মার্কেট থেকে শুরু করে ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও জাল নোট সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয় জাল নোট কারবারিরা। ৫০ টাকার নোট থেকে শুরু করে ১০০, ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট জাল করা হচ্ছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে জাল নোট সরবরাহ ও বাজারজাতকরণে জড়িতদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৫ হাজার ৮৪টি মামলা হয়েছে। এরপরও ঠেকানো যাচ্ছে না জাল নোট কারবারিদের। জাতিসংঘের সদস্য দেশ ১৯৩টি, প্রতিটি দেশই আঞ্চলিক মুদ্রা, জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণে পাসপোর্ট, ডাক টিকেট, ধন দৌলত হস্তান্তরে প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাপী ৩৭ হাজার ৩১৪টি সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ২০ লক্ষাধিক কর্মকর্তা/কর্মচারীর নিবিড় তত্ত্বাবধানে কারেন্সি পাসপোর্ট প্রিন্টিং হচ্ছে। তাদের বেতন হাজার ডলার থেকে লাখ ডলার পর্যন্ত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের কারেন্সী প্রিন্টিং প্রযুক্তিবিদ্যায় কোন ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট না থাকাতে লোভনীয় পদগুলোতে কোন বাংলাদেশীর চাকুরী হচ্ছে না। সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বাংলাদেশ লিঃ ৩৮ বছরে স্বাধীনদেশের আশা আকাক্সক্ষা পূরণে চরম ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণে স্বাধীনতার চার দশক পরও টাকা পাসপোর্ট, ডাকটিকেট, দলিলের স্টাম্প প্রিন্টিং সম্পূর্ণভাবে বিদেশের উপর নির্ভরশীল। বিদেশে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছাপাতে প্রতিবছর ৩/৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। জাতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন সম্প্রতি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মূল সনদপত্র ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করে। নিম্নমানের কাগজ ও প্রিন্টিংয়ের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মূল সনদপত্র অবমূল্যায়ন করা হয়। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় টাকশালে কর্মরত ৭১৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারী কারোরই কারেন্সী ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি/সিকিউরিটি প্রিন্টিং টেকনোলজিতে ন্যূনতম শিক্ষা প্রশিক্ষণ নেই। জাতীয় ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিতে কারেন্সী প্রযুক্তিবিদের নিয়োগ নিশ্চিত করে উন্নত বিশ্বের আবিস্কৃত মেশিনারি সংযুক্ত করা হলে দেশের প্রিন্টিং চাহিদা পূরণ হতো। প্রিন্টিং টেকনোলজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও টাকশালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উর্দু কবি নওশাদ নূরী

১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’





মুহাম্মদ নূরে আলম: ১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’ কবি, বাংলাদেশের ধ্রুপদী ও প্রগতিশীল ঘরানার কবি। কবি নওশাদ নূরী একজন অবাঙালি উর্দুভাষী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার স্পষ্ট সমর্থন ও ‘মহেঞ্জাদারো’ নামে এক সুন্দর কবিতা রচনা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা নওশাদ নূরীর ‘মহেঞ্জোদারো’। এ কবিতা ছাপা হওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে দেশ ছাড়ার হুকুম দেন। কবি দেশ ছেড়ে যান। ১৯৬০ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা ফিরে আসেন। (বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী) তাজউদ্দিন আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় উর্দু সাপ্তাহিক ‘জারিদা’; ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নওশাদ নূরী।
তাঁর কাব্য রচনার ভাষা উর্দু। ষাটের দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যের জগতে তাঁর উপস্থিতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতার অনুপম বুননশৈলী, ভাবপ্রকাশের ধারা চিরায়ত উর্দু কাব্যের আধুনিক উত্তরাধিকার বহন করে। শব্দের গভীর দ্যোতনা, পরিমিত উপমা, ছন্দময় চিত্রকল্প এসব কবিতাকে অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছে। একজন উর্দুভাষী কবি হিসেবে বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপকল্প, রাজনীতি-সমাজজীবন উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সীয়ানা মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু ভাষাগত ভিন্নতার কারণে তিনি বাঙালি পাঠকদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি ও সমাদর পাননি। উর্দু-ফার্সির পা-িত্য, পরোপকারী হৃদয় ও খোলামেলা স্বভাবের জন্যে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে তাঁর অসম্ভব গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাঙালি জাতির অহংকার ভাষা আন্দোলন, মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় এবং দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর করালগ্রাস থেকে একটি স্বাধীন ভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে মুক্ত করবার আন্দোলনে একজন উর্দুভাষী মানুষ কবি নওশাদ নূরীর ত্যাগ সত্যিই আমাকে বিমোহিত করে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল একজন মানুষ নওশাদ নূরীকে নিয়ে তার সমসাময়িক, অনুজ এবং বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিকের কলম থেকে যে নির্যাস চিত্রায়িত হয়েছে তা বাঙালির ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে।
বোহেমিয়ান ও জাত কবি নওশাদ নূরী ১৯২৬ সালের ২১ অক্টোবর বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার বসন্তপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নওশাদ নূরী কবির ছদ্মনাম। তার আসল নাম মোহাম্মদ মোস্তফা মাসুম হাশমী। তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতীম কবি ও গীতিকার ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রতিষ্ঠিত প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের বিহার শাখার সেক্রেটারি। ১৯৫১ সাল। নওশাদ নূরী  বিএন কলেজ, পাটনা থেকে স্নাতক সম্পন্ন ও প্রগতিশীল লেখক সমিতিতে  যোগদান করেন। যেখানে উর্দু কবি ও সোহেল আজিমাবাদী, আখতার ওরায়নভি, মুখতার উদ্দিন আরজু ও কালাম হায়দারির মতো লেখকদের তার সংশ্রব ঘটে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হন।
নবীন ভারত তাদের নব্য স্বাধীনতাকে ‘ঐশ্বর্যম-িত’ করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দান-ভা-ারের দুয়ারে। সে সময় প-িত জওহরলাল নেহেরুকে মার্কিন সাহায্য নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্যই লিখলেন কবিতা দে দে রাম ফেলাদে রাম, দেনে ওয়ালা সীতারাম’। কবিতাটি প্রকাশের পরপরই সারাদেশে আলোড়ন তোলে। জওহরলাল নেহেরু কবি নওশাদ নূরীর নামে হুলিয়া জারি করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। প্রতিবাদী এই কবিতা লেখার দায়ে গ্রেফতারের এড়াতে ১৯৫১ সালে  ঢাকা (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন । তিনি সামরিক অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের চাকরি  পান। পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় তাঁর পোস্টিং হয়। তারপর আপন করে নিলেন বাংলাদেশটাকে। জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার ওপরে উঠে অবাঙালি উর্দুভাষী কবি হয়েও ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার সপক্ষে অবস্থান নিলেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামে লিখলেন কবিতা।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে উর্দু সাপ্তাহিক জারিদায় বাঙালি জনতার ছয় দফা আন্দোলনেও সমর্থন জানালেন। লিখলেন, ‘তেরি নাজাত মেরি নাজাত, ছে নুকাত ছে নুকাত’ (তোমার মুক্তি আমার মুক্তি, ৬ দফা ৬ দফা)। বস্তুত ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ারদির নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন করা, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলন, সে সময়ের পাকিস্তানি তথ্যমন্ত্রীর রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী উক্তির প্রতিবাদ, ইয়াহিয়া তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা ও লোমহর্ষক মর্মান্তিক নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন। ১৯৫২ সালে তিনি "মনেজোদারো " শিরোনামে  আরেকটি কবিতা লিখেন। এ কবিতাটির অনুপম কাব্যশৈলীর মাধ্যমে তিনি কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (পাকিস্তান এর প্রতিষ্ঠাতা) দ্বারা বাঙালিদের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানান। এ কবিতাটির জন্য নওশাদ নূরীকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করা হয়। তিনি চাকরি ছেড়ে ১৯৬০ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন।
ঢাকায় ফিরে নওশাদ নূরী একটি বই দোকান খুলেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ১৯৬৪-৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট -এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত উর্দু সাপ্তাহিক "রুদাদ"-এর  সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ এবং ৮৮ সালে এশীয় কবিতা উৎসবে তিনি লিঁয়াজো অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পারন করেন। তাঁর দক্ষতা ও তৎপরতার ফলে আহমদ ফারাজ, হেমায়েত আলী শায়ের, জমির হাসান জাফরি, কিশওয়ার নাহিদ -এর ও পারভীন শাকির মত পাকিস্তানী কবি এশীয় কবিতা উৎসব অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে আসার কিছু সময়ের মধ্যেই কবি নওশাদ নূরী রাজনৈতিক মতাদর্শে মওলানা ভাসানী, কমরেড আবদুল হকসহ খ্যাতিমান রাজনৈতকি ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে ভীষণ পছন্দ করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কবি নওশাদ নূরীর অনেক আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে গেলেও তিনি থেকে গেলেন ঢাকার মায়ায়।
কবি নওশাদ নূরী একজন আপাদমস্তক কবি ছিলেন। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ষান্মাসিক ‘মনন রেখা’র বর্তমান (৪র্থ) সংখ্যাটিতে খ্যাতিমান লেখকদের স্মৃতিচারণ পড়ে আপনাদের তাই মনে হবে। প্রকৃতির কবিরা কখনো কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না। আপোস করেন না। কবি নওশাদ নূরীও তাই সময়ের প্রয়োজনে জ্বলে উঠেছেন বারবার। কবি আসাদ চৌধুরী তার মন্তব্যে বলেছে ‘কবিতায় নওশাদের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, তাঁর চিত্রকল্প অসাধারণ, তুলনাহীন। কোথাও বাড়াবাড়ি নেই।’
নওশাদ নূরী ছিলেন বাংলাদেশের উর্দু লেখকদের অভিভাবক। ভারত-পাকিস্তানের যে কোনো উর্দু কথাশিল্পী ঢাকায় এলে প্রথমে তাঁর সাথেই যোগাযোগ করতেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের নামকরণের পরামর্শটাও কবি নওশাদ নূরী দিয়েছিলেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক কবি। তার বিবরণ পাই ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীর বর্ণনায়। সময়ে সময়ে কলম ধরতেন জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আক্রমণ করে বসে ফিলিস্তিন। তখন তিনি আক্রমণের প্রতিবাদে কবিতা লিখে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। ১৯৮২ সালে ইসরাইল আবার আক্রমণ করে বসে লেবাননের উপর। তখন তিনি প্রতিবাদে ‘রাহগুজার আশনাই’ কবিতা লিখেন। ইরাকের উপর আমেরিকার আক্রমণের প্রতিবাদে লিখেন ‘তুফান সাহারা’। এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোক্তা এবং সমন্বয়কারী হিসেবেও ভূমিকা রাখেন যা একজন আন্তর্জাতিক চিন্তা ও চেতনার কবির পক্ষেই সম্ভব। যে মানুষটির এমন জীবন-ধারা তাঁর লেখা পাঠ যে সচেতন পাঠকের আরাধ্য হয়ে ওঠে। পাঠকের সেই তৃষ্ণা মেটাতেই লেখক ও গবেষক আইয়ুব হোসেন এবং শামীম জামানভি তাঁদের সুসম্পাদনে সংকলিত করে পরিবেশন করেছেন ‘নওশাদ নূরীর কবিতা’ গ্রন্থটি। এতে রয়েছে কবি নওশাদ নূরীর ৩০টি কবিতা ও ৫টি গজল। অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত লেখক ও কবি আসাদ চৌধুরী, ইনায়াতুল্লাহ সিদ্দিকী, বশীর আল্ হেলাল, মোহাম্মদ হাসান, জাফর আলম, আল মুজাহিদী, মিজারুল কায়েস, সৈকত রুশদী এবং হাইকেল হাশমী।
সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবর্তনের পরিক্রমায় কবি নওশাদ নূরীর অবদান ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে মনে হয়। কারণ অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে একই সূত্রে গাঁথা এই মানুষটি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়নি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কীর্তিমান কবি নওশাদ নূরীকে তুলে ধরা জরুরী হয়ে পরেছে। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ লোক উর্দু ভাষায় কথা বলেন। এখানে বসবাসরত বিহারি কবি-লেখকেরা উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। অগ্রগণ্য উর্দু কবি নওশাদ নূরী আমৃত্যু ঢাকায় বাস করেছেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে  ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামের সেই কবিতায় তিনি লেখেন: ‘বাংলা সাহিত্যের দৌলত আজ বিপন্ন/ হানাদারেরা এগিয়ে আসছে/ পত্র, প্রস্তর, চর্ম, প্যাপিরাস, তাম্র ও কাংসপত্রে সংরক্ষণ করো/ বাংলার মূল্য ও চেতনাকে।/ কারণ সেই অশুভ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।/ যা এক নগরকে উল্টে-পাল্টে দেয়/ এক মৃতের স্তুপে।’
এখানকার উর্দু-ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে ঢাকার নবাব খাজা পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। উনিশ ও বিশ শতকে এই পরিবারের যাঁরা উর্দুতে সাহিত্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে খাজা হায়দার জান, খাজা আসাদউদ্দীন কাওকাব, খাজা আবদুর রহিম সাবা, খাজা আহসানুল্লাহ শাহীন, খাজা নাজিমউদ্দীনের নাম করা যায়। বাঙালি বিস্মৃতি বিলাসী। সে যেমন তার শত্রুর মুখ ভুলে তাকে রাজাসনে বসায় তেমনি বন্ধুকৃত্যও ভুলে যায় অবলীলায়। উর্দু কবি হিসেবে বাংলাদেশে নওশাদ নূরীর ঠাঁই বন্ধুর কাতারে হবে, না কি শত্রু শিবিরে সে বিচারের ভার ইতিহাসের। উল্লেখ্য, মনন রেখ। বর্ষ-২ সংখ্যা : ৪। সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০১৮। প্রচ্ছদ : মামুন হোসাইন, মূল্য ১০০ টাকা, উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীকে নিয়ে একটি সুন্দর প্রবন্ধ প্রকাশ করে। উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীর কবিতার বাংলা অনুবাদ সঙ্কলন: নওশাদ নূরীর কবিতা সম্পাদনা: আইয়ুব হোসেন ও শামীম জামানভি, প্রচ্ছদ: ম্যাস্-লাইন প্রিন্টার্স, প্রকাশনা হাক্কানী পাবলিশার্স, দাম: ১২৫ টাকা। 

Thursday 11 April 2019

জিন্নাহ না নেহরু : কে ভাঙলেন ভারতবর্ষ



  • অধ্যাপক সারওয়ার মো: সাইফুল্লাহ খালেদ
  • ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:২১




  • জওয়াহেরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ - ছবি : সংগৃহীত
    ‘পুঁজি’ কী? ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রবীণতম শিক্ষক ড. এ এন আবু মাহমুদের জবানিতে বলি- ‘কার্ল মার্কস তিন খণ্ডে (দুই হাজার ২৬৬ পৃষ্ঠা) ‘ক্যাপিট্যাল’ গ্রন্থ লিখে সুস্পষ্ট করে বলতে পারেননি ‘পুঁজি’ বলতে আসলে কী বুঝায়। তবে সে জটিলতায় না গিয়ে আমাদের ছাত্রদের সরলীকরণ করে শিখিয়েছি- ক্যাপিটাল ইজ অ্যা মিনস অব প্রোডাকশন উইথ অ্যা ফ্লো অব ইনকাম। ‘ক্যাপিট্যাল’ পড়ে শিখেছি আসলেও ব্যাপারটি তত সরল নয়।
    তেমনি ভারত যে ভাগ হলো তার জন্য দায়ী কে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়েও দেখছি, চৌদ্দ-পনের শ’ শব্দের একটি লেখায় এর মীমাংসা করা দুরাশা মাত্র। যদিও চোখ বুজে অনেকেই মুখস্থ বলে ফেলেন- দায়ী হলেন জিন্নাহ। নিচের উদ্ধৃতিগুলো বিবেচনাসাপেক্ষে এ বিষয়ে বিচারের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম।

    সম্প্রতি ভারতের জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ভারত ভাগের বিষয়টি সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতকে বিভক্ত করতে চাননি। ভারত ভাগের জন্য পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের মতো শীর্ষ রাজনীতিকেরাই দায়ী’ (সূত্র : ফেসবুক, ০৪ মার্চ ২০১৮)। এই চারজনেরই অবস্থানের বিষয়টি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ (যা ভারতীয় প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলায় ‘ভারত স্বাধীন হলো’ শিরোনামে তরজমা করেছেন) গ্রন্থে পরিষ্কার করেছেন।
    কংগ্রেস দলের সভাপতি হিসেবে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা প্রশ্নে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, মাত্র তিনটি বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন থাকবে। তিনটি বিষয় বলতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রীয় বিষয় এবং যোগাযোগ- যা আমার পরিকল্পনায় বাতলানো হয়েছিল। মিশন অবশ্য পরিকল্পনায় একটি নতুন জিনিস যোগ করে। এতে পুরো দেশকে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’- তিনটি মণ্ডলে ভাগ করা হয় এ কারণে যে, মিশনের সদস্যরা মনে করেছিলেন, তাতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঢের বেশি ভরসার ভাব আসবে। ‘ক’ অংশের মধ্যে পড়বে মাদ্রাজ, বোম্বাই, যুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যা; ‘খ’ অংশের মধ্যে পড়বে পাঞ্জাব, সিন্ধু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর ব্রিটিশ বেলুচিস্তান। ‘গ’ অংশের মধ্যে পড়বে বাংলা আর আসাম। বাকি সবার চেয়ে মুসলমানদের সংখ্যা হবে সামান্য বেশি। ক্যাবিনেট মিশন ভেবেছিল, এ ব্যবস্থায় মুসলিম সংখ্যালঘুরা পুরোপুরি ভরসা লাভ করবে এবং মুসলিম লীগের যেসব ন্যায্য ভয়ভীতি, তা দূর হবে। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার সাথে আমার প্রস্তাবের আত্মিক মিল ছিল এবং তাতে একমাত্র সংযোজন ছিল তিনটি অংশের প্রবর্তন- সে কারণে মনে করেছিলাম, প্রস্তাবটি আমাদের গ্রহণ করা উচিত।
    আজাদের ভাষায়, গোড়ায় জিন্না ওই পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন। স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে মুসলিম লীগ এতদূর এগিয়ে গিয়েছিল যে, সেখান থেকে পিছিয়ে আসা তার পক্ষে কঠিন হয়ে গেল। মিশন থেকে সুস্পষ্টভাবে ও দ্বিধাহীন ভাষায় জানানো হয়েছিল, দেশ বিভাগ এবং একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন কোনোক্রমেই তারা অনুমোদন করবেন না...। ক্যাবিনেট মিশন ভেবেছিল এতে কোনো অন্যায় নেই। প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রে, ক’টি এবং কী ধরনের বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করা হবে, প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের তা ঠিক করার স্বাধীনতা থাকবে (ভারত স্বাধীন হলো, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৪)।
    এরপর মাওলানা আজাদ লিখছেন, ‘১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬ একটানা সাত বছর (কংগ্রেসের) সভাপতি থাকার পর এবার আমার বিদায় নেয়া উচিত। সুতরাং আমি ঠিক করলাম, কাউকে আমার নাম প্রস্তাব করার অনুমতি দেবো না...। সব দিক বিচার-বিবেচনা করে আমার মনে হলো, জওয়াহেরলালের হওয়া উচিত নতুন সভাপতি...। যতটা যা সম্ভব ঠিক বুঝেই তা করেছিলাম। তারপর ঘটনা যেভাবে গড়াল, তাতে আমার যথেষ্ট আক্কেল হয়েছে। বুঝেছি, এটা ছিল বোধহয় আমার রাজনৈতিক জীবনের মারাত্মক ভুল। এ রকম সঙ্কটপূর্ণ সময়ে কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে যা পস্তানো পস্তায়েছি, তা আর বলার নয়। গান্ধীজীর ভাষায়, আমার এই ভুল ছিল হিমালয় প্রমাণ। যখন আমি ঠিক করলাম নিজে দাঁড়াব না, তখন সর্দার প্যাটেলকে সমর্থন না করাটা ছিল আমার দ্বিতীয় ভুল...। এই পরিকল্পনা পয়মাল করার সুযোগ জিন্নাহ পেতে জওয়াহের লাল যে গলদযুক্ত কাজ করেছিল, প্যাটেল তা কখনোই করতেন না...। যখন ভাবি, এ ভুলগুলো যদি আমি না করতাম, তাহলে হয়তো গত ১০ বছরেই ইতিহাস পাল্টে যেত, তখন নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারি না’ (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৭-১৪৮)।
    মুসলিম লীগ কাউন্সিল আগেই ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। জাতীয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিও তাই করেছিল। অবশ্য তখনো বাকি ছিল (অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কাউন্সিল) এআইসিসির অনুমোদন (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৯)। সেটাও মাওলানা আজাদ দক্ষতার সাথে করে নেন। এবারই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটল, যে রকম ঘটনা ইতিহাসের মোড় ফিরিয়ে দেয়। ১৯৪৭-এর ১০ জুলাই জওয়াহেরলাল বোম্বাইতে একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। তাতে তিনি এক আজব বিবৃতি দিলেন। সংবাদপত্রের কিছু প্রতিনিধি তাকে জিজ্ঞেস করেন, এআইসিসি যখন প্রস্তাব পাস করেছে, তখন কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনসমেত পরিকল্পনাটি সর্বাংশে গ্রহণ করেছে কিনা।
    উত্তরে জওয়াহেরলাল নেহরু বলেন, কংগ্রেস বোঝাপড়ার কোনোরকম বাঁধন না মেনে এবং সব সময় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণের স্বাধীন মনোভাব নিয়ে গণপরিষদে প্রবেশ করবে। সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা আরো জিজ্ঞেস করেন, এর মানে এটা কি যে, ক্যাবিনেট কমিশনের রিপোর্ট হেরফের করা যাবে। উত্তরে তিনি জোর দিয়ে বলেন, কংগ্রেস রাজি হয়েছে শুধু গণপরিষদে যোগ দিতে এবং মনে করে, তেমন বুঝলে কংগ্রেস অবাধে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা রদবদল বা ইতরবিশেষ করতে পারে (ভারত স্বাধীন হলো, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫০)...। জানতে পারলাম, গোটা ব্যাপারটার পেছনে নাটের গুরু ছিলেন পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন। তার চিন্তাভাবনার ওপর আমার তেমন শ্রদ্ধা ছিল না; তবে জওয়াহেরলালকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যাতে তিনি মত পরিবর্তন করেন...। জওয়াহেরলাল আমার সাথে একমত হলেন না এবং তার নিজের বিচার ঠিক বলে আঁকড়ে রইলেন (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫৬-১৫৭)।
    এতে আজাদ হতাশ হয়ে লিখেছেন, ‘ধরে বেঁধে মুসলিম লীগকে দিয়ে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মানিয়ে নেয়া হয়েছিল...। কাজেই মিশনের সাথে আলোচনায় যে ফলাফল হয় তাতে জিন্নাহ মোটেই খুশি হননি। জওয়াহেরলালের বিবৃতি দেখে তার আক্কেলগুড়ম হলো। তৎক্ষণাৎ তিনি এই মর্মে বিবৃতি দিলেন যে, কংগ্রেস সভাপতির এই ঘোষণার ফলে গোটা অবস্থার পুনর্বিবেচনা দরকার...। তার মতে, জওয়াহের লালের ঘোষণার মানে, কংগ্রেস ক্যাবিনেট কমিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করছে। ২৭ জুলাই বোম্বাইতে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের বৈঠক বসে। জিন্নাহ এর উদ্বোধনী বক্তৃতায় পাকিস্তান দাবির পুনরাবৃত্তি করে বলেন, মুসলিম লীগের পক্ষে এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিন দিন ধরে আলোচনার পর ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে কাউন্সিল থেকে প্রস্তাব পাস করা হয়। তাতে এটাও ঠিক হলো, পাকিস্তান অর্জনের জন্য লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে যাবে (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫০-১৫৮)। এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়েও জিন্নাহ এবং লীগকে আর ফেরানো যায়নি, কারণ জিন্নাহ কংগ্রেসকে আর বিশ্বাস করলেন না।
    জওয়াহেরলাল নেহরু একসময় জিন্নাহ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ‘কিছু পুরাতন নেতা কলকাতা কংগ্রেসের পর কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং তাদের মধ্যে জিন্নাহ ছিলেন এক জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তি। সরোজিনী নাইডু তাকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের রাজদূত’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অতীতে মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের কাছাকাছি আনার কৃতিত্ব ছিল তারই।... পরে ১১ আগস্ট ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমানদের উত্তাল ক্রন্দন-কোলাহলের মধ্যে স্থায়ীভাবে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার চতুর্থ দিনে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের সামনে জিন্নাহ... বলেছিলেন, ‘আপনারা স্বাধীন। এই পাকিস্তান রাষ্ট্রে আপনাদের ইচ্ছামতো মন্দির-মসজিদ অথবা অপর যেকোনো উপাসনাস্থলে যাওয়ার অধিকার আপনাদের আছে। আপনাদের ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায় যাই হোক না কেন, তার সাথে এই মূল নীতির কোনো সম্পর্ক নেই যে, আমরা একই রাষ্ট্রের অধিবাসী।
    আমার মতে, এই নীতিকে আমাদের আদর্শরূপে সদা জাগরুক রাখতে হবে। তা হলে আপনারা দেখবেন যে, হিন্দুরা আর হিন্দু এবং মুসলমানেরা আর মুসলমান থাকবে না- ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে নয়, কারণ সেটা হলো প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রশ্ন। এটা হলো রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে।’... জিন্নার বক্তৃতার ওই অংশ আমি অন্তত যেসব বহুল প্রচারিত জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র পড়তাম, তাতে প্রকাশিত হয়নি। আর তা হলেও আমার নজরে পড়েনি। তাই হাসু কেবল রমানীর রচনায় ওই উদ্ধৃতি পড়ে চমকিত হলাম। এ তো কোনো সাম্প্রদায়িকতাবাদীর উক্তি হতে পারে না (শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, জিন্নাহ-পাকিস্তান/নতুন ভাবনা, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ১-২)।
    যা হোক, কাশ্মিরের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা ফারুক আবদুল্লাহ বলেন, ‘ভারত বিভক্ত না হলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেরও জন্ম হতো না। (ভারতীয় রাজনীতিকেরা) মুসলিম ও শিখদের সংখ্যালঘু হিসেবে কখনোই মেনে নিতে পারেননি। জিন্নাহ কখনোই দেশ ভাগের পক্ষে ছিলেন না। ভারতকে বিভক্ত করতে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব উঠেছিল। কমিশন সেই সময় জানায়, তারা সংখ্যালঘু ও শিখদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেবে। মুসলিমদের জন্য বিশেষ প্রতিনিধিত্ব রাখবে, কিন্তু দেশ ভাগ করবে না। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিকেরা মুসলমান ও শিখদের জন্য সংখ্যালঘু কমিশন চাননি। জিন্নাহ এতে রাজি হলেও জওয়াহেরলাল নেহরু, মাওলানা আজাদ ও সরদার প্যাটেল দ্বিমত পোষণ করেন। যখন এটি ঘটল না, তখন জিন্নাহ পাকিস্তানের দাবি তুললেন। না হলে কোনো বিভক্তি ঘটত না। তা হলে বাংলাদেশ, পাকিস্তানের জন্ম হতো না। এক ভারত থাকত। তাই জিন্নাহ নয়, নেহরুর কারণেই দেশ ভাগ ঘটেছিল। (সূত্র : ফেসবুক ০৪ মার্চ ২০১৮)।
    দেশ ভাগ ও ভারতে তার জের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ভারতের এককালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী যশোবন্ত সিং লিখেছেন, ‘প্রথমে দু’টি ভাগ এবং পরে পাকিস্তান বাংলাদেশে ভেঙে যাওয়ায়, তিনটি ভাগে উপমহাদেশে বিভাজনের জের চলতে থাকে। অচিরেই বিভাজিত দেশগুলো বিভাজনের আবশ্যকতা নিয়ে পুনর্বিবেচনা শুরু করে দেয়। দেশ ভাগের অন্যতম প্রধান কারিগর, বস্তুত ওই বিভাজনের খসড়া-রচনাকারী নেহরু অচিরেই নিজের ভাবনা ও কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন’ (যশোবন্ত সিং, জিন্নাহ ভারত দেশ ভাগ স্বাধীনতা, ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৩০-৪৩১)।
    জম্মু-কাশ্মিরের স্বাধীনতার প্রশ্ন, ফারুক আবদুল্লাহর মতে, ‘তিন পারমাণবিক ক্ষমতাধর ভারত, চীন ও পাকিস্তান এই (জম্মু-কাশ্মির) উপত্যকার পাশে অবস্থান করায় স্বাধীন কাশ্মিরের আলোচনা নিরর্থক (সূত্র : ফেসবুক ০৪ মার্চ ২০১৮)। যা হোক, বিগত সত্তরোর্ধ্ব বছর ধরে জম্মু-কাশ্মির উপত্যকার স্বাধীনতাকামী জনগণ ভারতীয় বাহিনীর হাতে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে আসছে। তাদের জন্য স্বাধীনতা অবিলম্বে জরুরি বলেই শান্তিকামী বিশ্ব মনে করে।
    লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা কাডার।

    Friday 15 March 2019

    এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ ও তাঁর ওরিয়েন্টালিজমের সহজপাঠ

    মুহাম্মদ নূরে আলম: 
    উপনিবেশের শোষণ আর পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন এ দুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রাচ্যের মানুষের মনের অনেক না বলা কথার প্রকাশ পেয়েছে এডওয়ার্ড সাইদের চিন্তায়। পশ্চিমের সা¤্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী তৎপরতা, তাদের আধিপত্য আর দমন নীতির সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে রচিত ওরিয়েন্টালিজম সাইদকে কালজয়ী লেখকের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পশ্চিমের আধিপত্য বেশ দক্ষতার সাথে শনাক্ত করেছেন। সাঈদ যুক্তিসংগতভাবে পুঁজিবাদের এমন কিছু কলাকৌশল চিহ্নিত করেছেন, যা তৃতীয় বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের আদলে ছড়িয়ে দেওয়া স্বাভাবিক একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সা¤্রাজ্যবাদী উপনিবেশ ফিরিয়ে আনার এটি একটি অসঙ্গত প্রচেষ্টা এবং এক্ষেত্রে ইসলাম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তাতে সন্দেহ নেই। আর এ জন্যই ইসলামকে মুক্তচিন্তা ও সভ্যতার ¯্রােতবিমুখী বলে প্রচারণা চালানো হয়। সৃষ্টি করা হয় ধু¤্রজাল। ঘোলা জলে মাছ শিকারের আদিম কৌশলও বলা যায় একে।
    প্রাচ্যের অতীত পশ্চিমের নিজের মতো করে নির্মাণের মাধ্যমে পাশ্চাত্যকে হেয় করার অপচেষ্টা রুখে দিতেও চেষ্টা করেছেন সাইদ। পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন আর সাংস্কৃতিক নির্মাণের পাশাপাশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্মাণের মতো গোলক ধাঁধা থেকে প্রাচ্যকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। ইতিহাস রচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ করে একুশ শতকে এসে ইতিহাস চর্চা করতে গেলে প্রায় সকল শ্রেণির গবেষককে নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন পশ্চিমা সূত্রের উপর। এক্ষেত্রে সাইদের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানা থাকলে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। প্রখ্যাত গবেষক এডওয়ার্ড সাইদের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১ নভেম্বর জেরুজালেমে। তাঁর বাবা ও মা উভয়েই ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট খৃস্টান ধর্মের মতাবলম্বী। শ্বেতবর্ণের এই লোকটি পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষক, দার্শনিক, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। সাইদ কায়রো আর জেরুজালেমে বার বার স্থানান্তরের কারণে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি সাইদ। এরপর তিনি ১৯৪৭ সালে জেরুজালেমের সেন্ট জর্জেস একাডেমীতে ভর্তি হন। এরপর আরব ইসরাঈল যুদ্ধ শুরু হলে সাইদের পরিবার আবার জেরুজালেম থেকে কায়রো চলে যান।
    তাঁর নামের প্রারম্ভে এডওয়ার্ড আর শেষে আরবি সাইদ নাম থাকার কারণে শিক্ষাগত ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কায়রোতে গিয়ে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। এই ভিক্টোরিয়া কলেজে থাকাকালীন সময়েই ভবিষ্যত দুরদর্শী সাইদের পরিচয় মেলে। ১৯৫১ সালে তিনি কলেজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচ্যুসেটস অঙ্গরাজ্যের নর্থফিল্ড মাউন্ট হারমন স্কুলে ভর্তি হন। এখানে শিক্ষালাভের সময় ধীরে ধীরে সাইদের চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি ক্লাসেও অনেক ভাল ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হন।
    ১৯৬৩ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে সাইদের কর্মজীবন শুরু হয়। ২০০৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি হার্ভাডে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের খ-কালীন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। এর পাশাপাশি ১৯৭৫-৭৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে সাইদ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে খ-কালীন অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৩ সালে রেইথ বক্তৃতামালায় অংশ নেয়ার সময় তাঁর দার্শনিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত বই ওরিয়েন্টালিজম সাইদকে একজন জগৎবিখ্যাত তাত্ত্বিকের স্থানে আসীন করে। এর পাশাপাশি সাইদের কয়েকটি রচনা প্রাচ্য ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়।
    অন্যদিকে রচিত ইতিহাসের উপনিবেশিক প্রভাব ও বস্তুনিষ্ঠতা শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে এডওয়ার্ড সাইদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ফিলিস্তিনী মুক্তি আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সাইদ। ১৯৭৭ সালের দিকে নিজ যোগ্যতায় ফিলিস্তিনী পার্লামেন্টের প্রবাসী সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে ইসরাঈল-ফিলিস্তিন চুক্তির শর্ত পছন্দ না হওয়াতে ১৪ বছরের এই দায়িত্বে ইস্তফা দেন। কর্মময় জীবনে অবসর খুব কমই পেয়েছে সাইদের। জীবনের শেষভাগে এসে মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখতে পেয়েছেন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। তারপর ২০০৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মারা যান নির্যাতিত মানুষকে মুক্তির পথ দেখানো এই মহান দার্শনিক।
    পশ্চিমাদের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রাচ্য কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু ১৯৮০ সালে প্রকাশিত সাইদের ‘দা কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন’ মধ্যপ্রাচ্যের তীব্র রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের প্রতি আলোকপাত করে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমির দাবিকে ন্যায্য বলে প্রমাণ করেন। ‘আফটার দা লাস্ট স্কাই’-এর মধ্যে তিনি এই চিন্তাধারাকে আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখেছেন কিভাবে একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে জন্ম নিয়ে আজন্ম পাপের দায়ভার বহন করতে হয়। পশ্চিমের উপস্থাপনায় একজন ফিলিস্তিনির রূপ কখনও সর্বহারা শরণার্থী, কখনও খুনী-সন্ত্রাসী কিংবা একজন অপহরণকারী। সাইদ দেখিয়েছেন মাতৃভূমির ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে ফিলিস্তিনীরা কিভাবে পশ্চিমা মিডিয়া আর উপস্থাপনার রাজনীতির শিকার হয়ে একটি নেতিবাচক রাজনৈতিক ইমেজে বন্দী হয়ে আছে। যার ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে ‘দা পলিটিক্স অব ডিসপজিশন’ এবং ‘কাভারিং ইসলামে’ও।
    তবে সাইদ ঐপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে বিদ্যমান জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনকে অনেক সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচ্যুয়াল’ বইটিতে। এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস কিভাবে পুরো বিশ্বকে ত্রাস সৃষ্টির সাথে গ্রাস করে নিচ্ছে তা প্রতিফলিত হয়েছে। বিপ্লবী এই লেখকের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ফ্রম অসলো টু ইরাক অ্যান্ড দি রোড ম্যাপ বইটিতেও পশ্চিমা আগ্রাসনের চুলচেরা বিশ্লেষণ লক্ষ্য করা গেছে। এই বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ সাপেক্ষে সাইদ উত্তর-ঔপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্সকে বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। ইতিহাস-প্রতœতত্ত্ব-সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়ের সাথে আলোকময়তার দর্শন তথা ঔপনিবেশিকতার সম্পর্ক অনেক গভীর। এই দিক থেকে বিচার করা হলে ইতিহাসতত্ত্বে সাইদের উত্তর-ঔপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্স আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে। বিশেষ করে প্রচার মাধ্যম প্রচারের আলোয় আনতে সক্ষম হলে মিথ্যা কিভাবে সত্যে পরিণত হয়, আর সত্য কিভাবে অন্ধকারে হারিয়ে যায় তা প্রথম স্পষ্ট হয়েছে সাইদের বিশ্লেষণে। এই বিষয়গুলো ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আলোচিত হওয়া জরুরী।
    ওরিয়েন্টালিজম রচনার পরপর সাইদের সৃষ্টিশীলতাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার সুযোগ হয় বিশ্বের অন্যান্য তাত্ত্বিকের। বিশেষ করে পশ্চিমা আধিপত্যে নাস্তানাবুদ বুদ্ধিবৃত্তিক পরিম-লে সাইদ পাঠককে একটি নতুন স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সাইদের আবির্ভাব পশ্চিমা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক পরিম-লের আধিপত্যবাদী ধারাকে অনেকটাই নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। মিশেল ফুকোর দর্শনে জ্ঞান ও ক্ষমতার যে দ্বান্দ্বিক অবস্থানের কথা উল্লেখ ছিল তাকে অনেকটাই বাস্তবে ফুটিয়ে তুলে পাঠকের দৃষ্টিগোচর করাতে সক্ষম হয়েছিলেন সাইদ। সাইদের গবেষণা দীর্ঘদিন উপনিবেশের আগ্রাসনে জীর্ণপ্রায় অঞ্চলগুলোর মানুষের অবমুক্তির তীব্র বাসনা, সংস্কৃতি বিকাশের রুদ্ধ সম্ভাবনা ও পশ্চিমা নির্মাণে ফুটে ওঠা অলীক জ্ঞানপ্রকল্পে সেগুলোর ভিন্ন উপস্থাপনার মুখোশ মানুষের সামনে খুলে দিতে সক্ষম হয়।
    কর্মজীবনে সাইদ একজন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও বেশ দক্ষতার সাথে পশ্চিমা আধিপত্যবাদী নীতি ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন। পশ্চিমা জ্ঞানপ্রকল্পে একটি নির্দিষ্ট দার্শনিক অবস্থান বার বার কানাগলিতে ঘুরে ফিরে গুমরে মরতে বসলে তখন অনেকটাই আলোর পথ দেখান সাইদ। একটি বিষয় ঘিরে প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাসের আঙ্গিনা ছেড়ে বেরিয়ে এসে সাইদ কিছুটা ভিন্ন পথে যাত্রা করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তথাকথিত অনুন্নত বিশ্বের মানুষের মনোজাগতিক ক্ষেত্রে সাইদের আবেদন হয়ে ওঠে এক অন্যরকম প্রতিবিম্ব হিসেবে। তিনি একই সাথে পশ্চিমা শিল্প-সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদের কথা তুলে ধরে তা থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের ইতিহাস উপনিবেশ সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করে রচিত হওয়াও সেই ইতিহাস সাইদের রোষানল থেকে মুক্তি পায়নি।
    সাইদের দর্শন বোঝার পর সহজেই মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় সেই মিশনারী প্রকল্পের উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক সংগঠনের ধারণা কিংবা গ্যালিভার ট্রাভেলস এর মতো বিদঘুঁটে কল্পকাহিনীর মূল শেকড়টা কোথায়। তত্ত্বকাঠামো জটিল বিন্যাসের সাথে কোথায় প্রাচ্যতত্ত্বের মূল সুর নিহিত আছে তা বোঝার চেষ্টা করেছেন সাইদ। এই ধরণের বিশ্লেষণ উত্তর-আধুনিক চিন্তা কাঠামোতে সাইদকে বিশেষ একটি স্থান করে দিতে সক্ষম হয়েছে। উপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তির পর জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে তাদের আজন্ম আধিপত্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে নতুন করে আগামীর চিন্তা করার সুযোগ ঘটে সাইদের চিন্তাধারার আলোকে।
    প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা উপনিবেশের প্রয়োজনে জাতি তত্ত্ব ও জাতি-ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যে বিশেষ ধারার প্রবর্তন করেছেন তা থেকে বেরিয়ে জাতীয়তা ও আত্মপরিচয় অন্বেষণের যাত্রা মূলত সাইদের দর্শন থেকেই শুরু হয়েছিল। ওরিয়েন্টালিজম সাইদকে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত করতে সক্ষম হয়েছিল। সত্য উচ্চারণে নির্ভীক সাঈদ ছিলেন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কর্ম হচ্ছে, ওরিয়েন্টালিজম। চিন্তার জগতে বিপ্লব সৃষ্টিকারী এই গ্রন্থটি রচিত হয় ১৯৭৮ সালে। প্রাচ্য নিয়ে পাশ্চাত্যের সুদূরপ্রসারী ও সুগভীর কলাকৌশলগুলো তিনি চিত্রিত করেছেন এই বইয়ের পৃষ্ঠাজুড়ে। ওরিয়েন্টালিজম সারা দুনিয়ার বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওরিয়েন্টালিজমের মাধ্যমে সাঈদ প্রাচ্যতন্ত্রের স্বরূপ উদঘাটন করে এ বিষয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় ৩০টির মতো ভাষায় এর অনুবাদ করা হয়। বিশেষ করে উপনিবেশিত অঞ্চলের নিষ্পেষিত মানুষের কাছে ওরিয়েন্টালিজম ছিল অনেকটাই মুক্তির পথ প্রদর্শক। ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে সাইদ বর্ণনা করেছেন‘ ইতিহাস, প্রতœতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো সবই উপনিবেশের নির্মাণ। তাঁর গভীর অনুসন্ধান পাশ্চাত্যে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে পূর্ব থেকে চলে আসা অনৈতিক অথচ জোরালো প্রচারণার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করেছে। মার্কিন বিশেষায়িত মিডিয়ার সংকীর্ণ অভিব্যক্তির বাদানুবাদ করে সাঈদ শক্তিশালীভাবে ইসলামের অবস্থান তুলে ধরেছেন। সাঈদ দেখিয়েছেন, পশ্চিমের তাঁবেদার গোষ্ঠী যাদের মাঝে আবার অনেক মুসলিমও রয়েছেন, মূলত তারা ওরিয়েন্টালিস্ট [প্রাচ্যবিদ] বলেই খ্যাত, এরা ভিন্নধারার ইসলামি দৈত্যের উপকথা হাজির করেন।
    পশ্চিম ইতিহাসকে তার প্রয়োজনে, তার মতো করে, তাদের প্রতিপালিত ইতিহাসবিদদের মাধ্যমে নির্মাণ করেছে। সাইদের দৃষ্টিতে এই ইতিহাস উপনিবেশিত অঞ্চলের নিষ্পেষিত মানুষের কণ্ঠরোধকল্পে নির্মিত একটি প্যারাডাইম। সাইদ একে আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক ও জাতিগত পরিসর থেকে একটি অঞ্চলের উপর পশ্চিমের কর্তৃত্বের বৈধতা দিয়ে থাকে। এই আধিপত্যবাদী নীতির পেছনে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার কঠোর সমালোচনা করেছেন সাইদ।
    সাইদ বস্তুত ইতিহাসবিদ ছিলেন না। তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের কঠোর সমালোচনা করে তাদের একরৈখিক ইতিহাস নির্মাণের প্রবণতা সুস্পষ্ট করেছেন। এই বিশ্লেষণ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের ইতিহাস দর্শনে যুক্ত হওয়ার ফলে ঐ অঞ্চলসমূহের সুযোগ হয়েছে তাদের ইতিহাস বাস্তবতার নিরিখে পর্যবেক্ষণ করা। আর অতীত গবেষণার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে তথ্যসূত্র নির্ভর গবেষণা করে নিজ জাতিসত্ত্বার পরিচয় নির্মাণের কাজ করা। সাইদ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন প্রাচ্য পশ্চিমের কাছে অজানা। এই পরিসর থেকে পশ্চিম প্রাচ্য সম্পর্কে একটি রোমান্টিকতায় ভুগে কিছু অলীক কল্পনার জাল বিস্তার করতে পারে। প্রাচ্যের বাস্তবতা তাদের কাছে অজ্ঞাত হওয়াতে প্রাচ্য নিয়ে গবেষণা করে এ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ কোনো ধারণা প্রতিষ্ঠা করা পশ্চিমের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রাচ্য নিয়ে পশ্চিমের অধ্যয়ন ও গবেষণা কেবলমাত্র কিছু পূর্ব নির্ধারিত চিন্তাধারার সারবত্তায়ন ও আরোপকরণ মাত্র।
    পশ্চিম তাদের গবেষণা বা আলোচনার শুরুতেই পশ্চিমকে মানদ- বিবেচনা করে থাকে। আর প্রাচ্যকে তারা বোঝায় ভিন্ন স্থান হিসেবে যেখানে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব নয়, একমাত্র সম্পদ ও ঐশ্বর্য ছাড়া যেগুলো দখল করতে চায় পশ্চিম। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে পাশ্চাত্যের মানুষেরা ঔপনিবেশিক শাসনে বন্দি প্রাচ্যে এসে তাদের পূর্ব অনুমিত জ্ঞান প্রকল্পের সংশোধন না করে তা প্রাচ্যের উপর জোরপূর্বক আরোপ করার চেষ্টায় সদা সচেষ্ট থেকেছে। পশ্চিম প্রাচ্যতত্ত্বের নামে বিশেষ ডিসকোর্স বা আখ্যান তৈরি করেছে তার আলোকে ‘পশ্চিমের মানুষ প্রাচ্যের উপর আধিপত্য করবে আর প্রাচ্য আধিপত্যের শিকার হবে। এসব ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা প্রমাণিত। তাই পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করার সুযোগ প্রাচ্যের নেই।
    ব্রিটিশ বা ফরাসি প্রচারমাধ্যম থেকে মার্কিন প্রচারমাধ্যম একটু ভিন্নধর্মী। পশ্চিমাসমাজ, ভোক্তাগোষ্ঠী, সংগঠন ও তাদের স্বার্থও ভিন্নধরনের। প্রত্যেক মার্কিন সাংবাদিকের মাথায় একটা কথা সবসময় উপস্থিত থাকে, তার দেশ পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি, যার নির্দিষ্ট স্বার্থ রয়েছে এবং সেই স্বার্থ হাসিলের দায়িত্ব তার আছে; অন্য দেশের লোক ও সাংবাদিকের মাথায় এসব চিন্তা থাকে না। প্রত্যেক মার্কিন সাংবাদিক বিশ্ব সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করার সময় এ ব্যাপারে সচেতন থাকেন, তার চাকরিদাতা কর্পোরেশনটিও মার্কিন ক্ষমতার অংশীদার। সাঈদ নিউইয়র্ক পোস্ট, নিউ রিপাবলিক, নিউইয়র্ক টাইমস, কমেন্টারি, দি আটলান্টিক, টাইম ম্যাগাজিন ইত্যাদি নামিদামি পত্রিকা ঘেঁটে জন ফিকনার, মার্শাল হাডসন, ফ্রিৎস স্টার্ন, রবার্ট থুকার, দানিয়েল প্যাট্রিক, এন্থনি হার্ট, ওয়ালজারের মতো বিখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্টের সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন, সা¤্রাজ্যবাদের এ সব লিখিয়ে প্রাচ্যকে কী বীভৎসরূপে উপস্থাপন করেছেন পশ্চিমাদের কাছে!
    দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যেসব গ্রন্থকার [প্রাচ্যবিদগণ] যেমন ধরুন বার্নাড লিউস, যিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন পাবলিশারদের একজন, তিনি আবার Atlantic Monthly[আটলান্টিক মানথলি]-র প্রকাশকও, তিনি ইসলামকে উপস্থাপন করেন, Irrational [পশ্চাদপদ] ও পশ্চিমাবিরোধী  [Anti-Western] হিসেবে। জ্ঞান ও সাহিত্যের সব কলাকৌশল প্রয়োগ করেই এমনটি করা হয়। এ সব পাবলিকেশন্স এতো বিস্তৃত ও শক্তিশালীভাবে কৌশলপ্রণয়ন করে এবং এমন প্রচারকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে তা করা হয়, যা মানুষের মনের ওপর প্রবল প্রভাব সৃষ্টি করে এবং তাদের প্রবণতাকে নির্দিষ্ট বৃত্তে চালিত করে। এটি পশ্চিমের সরকার ও মিডিয়ার এক বিস্ময়কর গ্রন্থি, জনমতকে রাজনৈতিক স্বার্থে চালিত করতে যা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে চলেছে। সাঈদ দেখাচ্ছেন, পশ্চিমের কর্পোরেশনগুলো বিশেষভাবে এমন কতগুলো দুর্র্ধর্ষ হাইপ্রোফাইলার সাংবাদিককে প্রশিক্ষিত করেছে, যারা মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে থেকে তাদের স্বার্থ হাসিল করবে।
    এই দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত প্রাচ্যতাত্ত্বিক জ্ঞানপ্রকল্পে প্রাচ্যের মানুষকে নিজেদের শাসন করার ক্ষেত্রে অযোগ্য ও অক্ষম বলে প্রমাণ করা হয়েছে। তাই তাদেরকে তাদের অতীত জানতে গেলে পশ্চিমের মাধ্যমে পশ্চিমের মতো করে জানতে হবে। তাদের নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে হলে আশ্রয় নিতে হবে কোনো এক পশ্চিমা আয়নায়’। এই ধরনের চিন্তাধারা ঔপনিবেশিক দেশসমূহে পশ্চিমের প্রভাবমুক্ত ইতিহাস চর্চার দ্বার অনেকটাই রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
    প্রতিবাদী লেখার ভাষায় সাইদের অনুসৃত নীতি উত্তর-ঔপনিবেশিক কাউন্টার- ডিসকোর্সকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। কালের আবর্তে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে এই কাউন্টার-ডিসকোর্স একটি জনপ্রিয় চিন্তামাধ্যমে পরিণত হয়। অন্যদিকে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব পোষণকারী সাইদ সা¤্রাজ্যিক ও অগণতান্ত্রিক আরব শাসকদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পাননি। সাইদের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত কাউন্টার ডিসকোর্সকে নিচের কয়েকটি ধারার মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে। ১. প্রতিবাদী লেখনী ও বাস্তবজীবনে তার অনুশীলন ২.পশ্চিমা ক্ষমতাচক্র আর জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ৩.পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রচার-প্রপাগ-ার বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন ৪. ঔপনিবেশিকতা ও পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ মানুষকে মুক্তির চেতনায় উদ্দীপ্ত করা ৫. লেখনীর মাধ্যমে পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন, ক্ষমতা, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের মধ্যকার অন্তর্নিহিত সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করা। ৬. জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিম-লে একটি নতুন চিন্তাকাঠামোর সংযুক্তি। ৭. ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র এবং কসমোপলিটন-এর পক্ষে আমৃত্যু কাজ করে যাওয়া। ৮. জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক পরিম-লে নির্যাতিত মানুষকে মুক্তির আহবানে জাগিয়ে তোলা। ‘‘দি ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেসনস্ এ্যান্ড দ্যা রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’’ (স্যামুয়েল পি হানটিংটন, ১৯৯৬), ‘‘দ্যা এন্ড অব হিস্ট্রি এ্যান্ড দি লাস্টম্যান” ( ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা, ১৯৯২) বা এই শ্রেণীর উদ্দেশ্যমূলক গ্রন্থে সভ্যতা, সমাজ ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণে সচেতন মানসিকতার গভীরে লেখকদের যে অবচেতন মানসিকতা কাজ করে, তা অনুধাবনের জন্য এডওয়ার্ড সাঈদের চিন্তাধারার পুনঃপাঠের প্রয়োজনীয়তা একবিংশ শতাব্দীতে বিশেষভাবে দেখা দিয়েছে। হানটিংটন তাঁর গ্রন্থের প্রতিপাদ্য সম্পর্কে বলেন: ‘‘It is my hypothesis that the fundamental source of conflict in this nwe world will not be primarily ideological or primarily economic. The great divisions among mankind and the dominating source of conflict will be cultural” (দি ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেসনস্, প্রবন্ধ, ভল.৭২, নং ৩, ফরেন এ্যাফেয়ার্স পত্রিকা, ১৯৯৩। এই প্রবন্ধটির বক্তব্যই হানটিংটন ১৯৯৬ সালে বই আকারে প্রকাশিত করেন) আর সভ্যতার বর্তমান পর্যায়কে ফুকুইয়ামা তাঁর গ্রন্থে এভাবে দেখেন : পশ্চিমা বিশ্বে স্থাপিত সরকার ব্যবস্থাই হচ্ছে ‘‘The end point of mankindÕs ideological evolution and the universali æation of Western liberal democracy as the final form of human government। এই গ্রন্থ দুটিতে আরব সমাজে বর্তমান সংঘর্ষের অনিবার্যতা ও সেখানে ‘‘লিবারাল গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বিষয়ে পশ্চিমা সরকারের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। ক্যান্সারে আক্রান্ত সাঈদ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে পরলোকগমন করেন। লেবাননের পোটাস্ট্যান্ট সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়।

    Wednesday 27 February 2019

    পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত আর্মেনিয়ান গির্জা: এক ঔপনিবেশিক স্মৃতি

    পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত আর্মেনিয়ান গির্জা: এক ঔপনিবেশিক স্মৃতি


    মুহাম্মদ নূরে আলম : সাদা-সোনালি রঙের মূল ফটকটির আকার-নকশা এই দেশি চোখে ঠিক পরিচিত ঠেকে না। বাঁ দিকের দেয়ালে নামফলকে ইংরেজিতে লেখা: আর্মেনিয়ান চার্চ, ১৭৮১। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা একজন মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন। ইনিই শংকর ঘোষ। আর্মেনীয় গির্জা ও কবরস্থানের দেখভালকারী। ৩২ বছর ধরে এ দায়িত্বে আছেন। গির্জা-পালক (ওয়ার্ডেন) আর্মেন আর্সেলিয়ানের অনুপস্থিতিতে শংকর একাই পুরোটা আগলে রাখেন।
    ঐতিহ্যবাহী এই গীর্জার সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। আর্মেনীটোলা বা আর্মানিটোলা নামটিও এসেছে আর্মেনীয়দের কারণে। ধারণা করা হয় এই গীর্জা নির্মাণের আগে তাদের ছোট একটি উপাসনাগার ছিলো। আর্মনিয়ান গির্জার প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৮১ সালে। এর আগে এখানে ছিলো শুধু কবরস্থান। ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়দের মৃত্য হলে এখানে কবর দেয়া হতো। অন্য সব গির্জা থেকে এইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই গির্জার আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য সমাধিসৌধ। ১৭৮১ সালে নির্মিত চার্চটি ঢাকায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। অন্য সব ক্যাথলিক/ব্যাপ্টিস্ট চার্চ থেকে এই চার্চ সম্পূর্ণ আলাদা। এখনও আর্মেনীয়দের অবশিষ্ট বংশধর এই চার্চের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। ঐতিহ্যবাহী এই চার্চের সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। আনুমানিক সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে দুই একজন করে আর্মেনীয় বনিক ঢাকায় আশা শুরু করে। ধারনা করা হয় তাদের নাম অনুসারে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নামকরণ করা হয়। ৭০০ ফুট লম্বা গির্জাটির রয়েছে ৪টি দরজা আর ২৭টি জানালা। ভেতরে সারি সারি চেয়ার সাজানো রয়েছে আর রয়েছে পাদ্রি বসার জন্য একটি বেদি। গির্জার আশেপাশে রয়েছে প্রায় শ’'খানেক আর্মেনিয়ানের কবর। গির্জাটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। সারা বছরই তালা মারা থাকে। অনুমতি সাপেক্ষে ভিতরে ঢুকা যায়। আশে পাশের ছবি তোলার অনুমতি দিলেও গির্জার ছবি তোলার অনুমতি দিবে না। এই গির্জা এখনও পরিচালনা করছে আর্মেনিয়ানদের শেষ বংশধররা।
    আরমানিটোলার এই গির্জাটি ঢাকার একমাত্র আর্মেনীয় স্থাপনা। মুনতাসীর মামুন ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরীতে বলেছেন, গির্জা তৈরির আগে এখানে একটা ছোট উপাসনালয় ছিল। আর এর চারপাশে ছিল আর্মেনীয়দের সমাধিস্থল। পরে ১৭৮১ সালে বড় করে গির্জা তৈরির সময় ছয়টি কবরও উপাসনাঘরের ভেতরে পড়ে যায়। আর্মেনীয় গির্জায় এখন আর প্রার্থনাসভা বসে না।
    আর্মেনীয় চার্চের ভেতরের সমাধি: কেয়ারটেকার শংকর ঘুরিয়ে দেখান পুরো সমাধিভূমি। এটা পোগজ স্কুলের পোগজ সাহেবের কবর। ওইটা গ্রেগরি সাহেবের কবর। উনি ওই সময়ে ঢাকার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ ছিলেন। এই পোগজ সাহেবের পুরো নাম এন পি পোগজ। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটির এ কমিশনার ১৮৪৮ সালে পোগজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আর এভিয়েটর গ্রেগরির সমাধির এপিটাফে লেখা আছে, ১০৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। পুরোনো কবরের এপিটাফগুলো সব মেঝেতে বিছানো। নতুন কিছু সমাধি মাটি থেকে ৬-৭ ইঞ্চি উঁচুতে। সমাধিগুলোর এপিটাফের ভাষা আর্মেনীয় ও ইংরেজি।
    দেখতে দেখতে কিছু এপিটাফের লেখায় চোখ আটকে যায়। ১৯২৯ সালে ২৪ বছর বয়সে মারা যাওয়া ম্যাক এস ম্যাকারটিকের এপিটাফে তাঁর বাগদত্তার পক্ষ থেকে লেখা আছে, ‘খুব ভালোবাসতাম বলেই তাকে এতটা মনে পড়ে। আমার স্মৃতিতে সে খুব দূরের কেউ নয়। অজস্র বোবা কান্নায় এখনো তাকে ভালোবাসি, মনে করি, কাছে পেতে চাই। ১৮৭৪ সালে মাত্র তিন বছর বয়সে মারা গেছে কন্সট্যান্স পিটারস। তাঁর এপিটাফের ভাষাও কেমন নাড়া দিয়ে যায়, আমার জন্য কেঁদো না তোমরা, কেন শোক করো আর/আমিতো হারিয়ে যাইনি, শুধু একটু আগে চলে গেছি।
    সামাজিক-ইতিহাসবিদ ও স্থপতি শামীম আমিনুর রহমানের ঢাকায় ইউরোপীয়দের সমাধিভূমি: জানা-অজানা নিবন্ধ থেকে জানা যায়, আর্মেনীয়রা ব্যবসার উদ্দেশে আঠারো শতকের দিকে ঢাকায় আসতে শুরু করে। লবণ-চামড়া-কাপড় আর পাটের ব্যবসা করে আর জমিদারি কিনে অল্প সময়েই তারা ঢাকার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। যে অঞ্চলে আর্মেনীয়রা বসবাস করতে শুরু করে তার নাম হয়ে যায় আর্মানিটোলা। তারপর কোম্পানি আমলের শেষ দিকে এসে ব্যবসা পড়তে শুরু করে। আর পাকিস্তান আমলে ঢাকায় আর্মেনীয়দের বাস প্রায় উঠে যায়। ১৯৯১ সালে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা নেফিয়েট স্টেফানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে আর্মেনীয়দের সম্পর্কের শেষ সূত্রটিও হারিয়ে যায়। শামীম আমিনুর রহমান বলেন, অন্য বিদেশি বণিক গোষ্ঠীর মতো আর্মেনীয়রা নিজেদের আলাদা করে রাখেনি। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশার চল ছিল আর্মেনীয়দের মধ্যে।
    গীর্জার বিবরণঃ ঐতিহ্যবাহী এই গীর্জার সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। গীর্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশে যে বিস্তৃত জমি তা দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক নামের এক আর্মেনীয়। আর লোকশ্রুতি অনুযায়ী গীর্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন আর্মেনীয়। এরা হলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ। গীর্জাটি লম্বায় সাড়ে সাতশো ফুট, দরজা চারটি, জানালা সাতটি। এর পাশেই ছিলো একটি ঘড়িঘর। এটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ঘড়িঘরটি ভেঙে গিয়েছিলো বলে জানা যায়। গীর্জায় বৃহৎ আকারের একটি ঘণ্টা ছিলো। এই ঘণ্টা বাজার শব্দ নগরের প্রায় সব স্থান থেকে শুনা যেত বলে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই ঘণ্টার শব্দ শুনেই নাকি অধিকাংশ ঢাকাবাসী নিজ নিজ সময়ঘড়ি ঠিক করে নিতেন। ১৮৮০ সালের দিকে আর্মেনী গীর্জার এই বিখ্যাত ঘণ্টাটি স্তব্ধ হয়ে যায়, যা আর কখনো বাজেনি।
    আর্মেনীয়দের বিবরণঃ ঠিক কবে আর্মেনীয়রা এ দেশে এসেছিলো তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ফার্মগেটে অবস্থিত গির্জার প্রাঙ্গনে কয়েকজন আর্মেনীয়র কবর আছে। তাদের মৃত্যু হয়েছিলো ১৭১৪-৯৫ সালের মধ্যে। ফলে আন্দাজ করা যায়, মোগল আমলেই তারা এ দেশে আসতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ভাগ্যান্বেষণ করা। সেসময় সেটা তারা বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছিলো।
    বর্তমানে ঢাকায় আঠারোটি আর্মেনী বংশদ্ভূত পরিবার রয়েছে বলে শোনা যায়। তবে কোন কালেই ঢাকায় আর্মেনীয়দের সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিলো না। আর্মেনীয়রা কবে ঢাকায় এসেছিলেন তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় মুঘল আমলে ভাগ্য বদলাতে দেশ-বিদেশ থেকে যখন অনেকেই এসেছিলেন ঢাকায়, সম্ভাব্য সপ্তদশ শতকে আর্মেনীয়রাও তখন দু’-একজন করে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে। পূর্ববঙ্গে লবণের ঠিকাদারদের অধিকাংশই ছিলেন আর্মেনীয়। ঠিকাদারি ছাড়াও পান, পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় ছিলো তাদের কর্তৃত্ব। জমিদারীও ছিলো অনেকের। উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে কয়েকটি আর্মেনীয় পরিবারের নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো- পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস। এদের বিত্তের ভিত্তি ছিলো জমিদারি ও ব্যবসা। বিদেশি হয়েও জমিদারি কেনার কারণ হতে পারে- আভিজাত্য অর্জন এবং সমাজের শীর্ষে থাকা। এসব ধনী আর্মেনীয়নরা ঢাকায় নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি।
     যেমন ফরাসগঞ্জের বর্তমান রূপলাল হাউস ছিলো আরাতুনের। মানুক থাকতেন সদরঘাটে। বর্তমানে ‘বাফা’ যে বাড়িতে, সেটি ছিলো নিকি পোগজের। পরে আর্মেনীটোলায় নির্মিত হয়েছিলো ‘নিকি সাহেবের কুঠি’। আনন্দরায় স্ট্রিটে ছিলো স্টিফানের বাড়ি। যেখানে তাজমহল সিনেমা রয়েছে সেখানে ছিলো পানিয়াটির অট্টালিকা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি অনেক আর্মেনীয় ঝুঁকে পড়েন ব্যবসার দিকে। চা, মদ, ইউরোপীয় জিনিসপত্র, ব্যাংক ইত্যাদি। ১৮৫৬ সালে সিরকোরই ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, যা পরিচিত ছিলো ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে। কিছুদিনের মধ্যেই এই ব্যবসা বেশ জমে উঠে এবং কালক্রমে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ঢাকার প্রধান যানবাহন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর্মেনীয়দের অনেকের জমিদারি হাতছাড়া হতে থাকে। এমনিতে আর্মেনীয়রা খুব রক্ষণশীল, কিন্তু ঐ সময় চলছিলো একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এরা তখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অনেকে জমিদারি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য কলকাতায় চলে যান। ফলে উনিশ শতকের শেষার্ধে ষাট-সত্তরের দশক থেকে সম্প্রদায়গতভাবে আর্মেনীয়দের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে। তখন ঢাকা শহরের বিভিন্ন কাজকর্মে, সভাসমিতিতে আর্মেনীয়রা নিজেদের যুক্ত করে নেন। নিকি পোগজ প্রতিষ্ঠা করেন পোগজ স্কুল। আরাতুন ছিলেন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার নয়জন কমিশনারের মধ্যে দুইজন ছিলেন আর্মেনীয়- জে.জি. এন পোগজ এবং এন.পি. পোগজ।
    কিভাবে যাবেন
    ঢাকার যে কোন প্রান্ত থেকে গুলিস্তান আসার পর রিক্সা যোগে আর্মেনিয়ান চার্চ যাওয়া যায়। ঢাকার যে কোন প্রান্ত থেকে বাবু বাজার ব্রিজ এরপর রিক্সায় আর্মেনিয়ান চার্চ। ঢাকার শাহবাগ বা আজিমপুর থেকে রিকশায় বলতে হবে আরমানিটোলা গীর্জা।

    Friday 22 February 2019

    লন্ডনে ড. হাসান তুরাবির জীবন দর্শন নিয়ে সেমিনার

    লন্ডনে ড. হাসান তুরাবির জীবন দর্শন নিয়ে সেমিনার


    মুহাম্মদ নূরে আলম: সমকালীন মুসলিম বিশ্বে তুরাবি মেধাবী ও সৃজনশীল চিন্তাবিদ ছিলেন ।প্রগ্রেসিভ ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট ইউকের উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে সমকালীন ব্রিটিশ বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. মুহম্মদ কামরুল হাসান বলেন, সুদানের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ড. হাসান তুরাবি ছিলেন সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের একজন মেধাবী ও সৃজনশীল চিন্তাবিদ। সুদানের মূল ধারার ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, বহু ভাষাবিদ ও ইসলামী আন্দোলনের পাওয়ার শেয়ারিং থিউরির জনক।

    গতকাল রোববার রাতে লন্ডন মুসলিম সেন্টারের সেমিনার হলে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে সদ্য প্রয়াত মুসলিম চিন্তাবিদ ড. হাসান তোরাবির জীবন ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র দর্শনের উপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন ।

    প্রগ্রেসিভ ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট ইউকের সম্বনয়কারী সাংবাদিক নূরে আলম বরষণের পরিচালনায় গবেষণা প্রবন্ধের উপরে আলোচনা করেন, মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার বদরে আলম দিদার, এডভোকেট আব্দুর রউফ রুবেল, দ্যা গ্লোবাল নিউজের সম্পাদক নাজমুল হোসাইন, চ্যানেল এস এর হেড অব চ্যারিটির সাংবাদিক তৌহিদুল করিম মুজাহিদ, সাংবাদিক আমিন রশীদ, মানবাধিকার কর্মী মনিরুল হক, জামিল ভূঁইয়া, আল আমিন, সাইদ মুহম্মদ বাকী, ব্যারিস্টার সাজ্জাদুল ইসলাম প্রমুখ।

    অধ্যাপক ড. মুহম্মদ কামরুল হাসান বলেন, মুসলিম বিশ্বের অবিসাংবাদিত নেতা এবং সুদানের বিরোধীদলীয় “পপুলার কংগ্রেস পার্টির” প্রধান হাসান আত-তুরাবি ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কল্যাণের কথা চিন্তা করে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার থিউরি আবিষ্কার করেন। এই থিউরির আলোকে মুসলিম বিশ্বের অনেক ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দীর্ঘকাল এর কিছু সুফল ভোগ করে।
    এক সময় সুদানের সামরিক প্রেসিডেন্ট বশিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন বশির। এরপর থেকেই তিনি বশির সরকারের বিরোধিতা শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট বশিরের দীর্ঘ শাসনামলে তিনিই ছিলেন তার প্রধান সমালোচক। তিউনিশিয়ার আদলে দেশে একটি রাজনৈতিক বিপ্লবেরও স্বপ্ন দেখেছিলেন এই নেতা। তুরাবি ছিলেন একজন উদারপন্থী মুসলিম চিন্তাবিদ।
    তিনি ইসলামের অনেক বিষয়েই বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। এবং অনেক কঠোর ইসলামী বিধানের ব্যাপারে উদরতার পরিচয় দেন।ড. কামরুল হাসান আরও বলেন, তুরাবি মনে করতেন মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার প্রধান একজন নারীও হতে পারে।
    এমনকি অন্য যেকোনো ধর্মের নারী হলেও তিনি এতে কোনো সমস্যা আছে বলে বলে মনে করেন। তুরাবি নারী অধিকারের ব্যাপারে একজন সোচ্চার মুসলিম নেতা ছিলেন ।তিনি একাধারে মুফাসসির, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অসংখ্য বইয়ের লেখক। তার বই পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।

    ড. কামরুল হাসান বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত। দারফুরে গণহত্যার ঘটনায় বশিরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল আদালত। ড. তুরাবি ছিলেন সুদানের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি ওই গ্রেফতারি পরোয়ানাকে সমর্থন করেছিলেন। অবশ্য নিজের ওই কর্মকান্ডের জন্য তাকে মাসুল দিতে হয়েছে। এ ঘটনার দুদিন পরই ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তাকে গ্রেফতার করেছিল সরকার।

    এক সময়ের বন্ধু সামরিক শাসক বশিরের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি নিজের দল ‘পপুলার কংগ্রেস পার্টি’ গড়ে তুলেছিলেন। উচ্চশিক্ষিত তুরাবির ইংরেজি, ফারসি, জার্মান ও আরবি ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল। ভাষাগত পান্ডিত্যের কারণেই বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তার কদর ছিল। খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তিনি ব্রাদারহুডের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের ন্যাশনাল এসেম্বলি’র স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
    ড. কামরুল হাসান বলেন, সুদানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হাসান তুরাবী ১৯৩২ সালে সুদানের কাসালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সুদানের খারতুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর ইংল্যান্ডের কিংস কলেজ থেকে আইনের উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। অতপর ফ্রান্সের প্যারিসে সারবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তুরাবি ১৯৬৪ সালে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন হন। সুদানে নির্বাচনের পরপরই ২০১০ সালের মে মাসে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
    নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে তাকে আটক করেছিল সুদান সরকার। সামরিক অভ্যুত্থানের দীর্ঘ দুই যুগ পর দেশে প্রথমবারের মতো ওই নির্বাচন হয়। নিজের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আরো বেশ কয়েকবার কারাবন্দী হতে হয়েছিল তুরাবিকে। সুদানের এ বিরোধীদলীয় নেতা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড সরকারের নেতিবাচক কাজের সমালোচনা এবং ইসলামের প্রতি অনড় অবস্থানের কারণে সামরিক সরকার তাঁকে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি রাখেন। ২০০৯ সালেও একবার তাকে আটক করা হয়েছিল।চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ইন্তিকাল করেন।

    সেমিনারে উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, বর্তমান সময়ে প্রয়োজনের আলোকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ থিউরি গুলোকে সম্বনয় করা অতি জরুরি । ইসলামের নিয়ম গুলোকে বর্তমান সময়ের আলোকে ইন্টারপেইট করতে হবে বলে মনে করতেন তুরাবি। পশ্চিমা বিশ্বের হলেই গ্রহণ করা যাবেনা এমন ধারণা করা ঠিক বলে মনে করতেন না তুরাবি। ভালো কিছু গুলো গ্রহণ করার পক্ষে সব সময় তুরাবি ছিলেন ।
    বক্তারা আরও বলেন, তুরাবি একজন গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের চেয়ে ইসলাম আরও ভালো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে।

    ব্যক্তিত্ব -হাসান আল তুরাবী

    এক
    সুদানের বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক ড. হাসান আল তুরাবীর গুরুত্ব ও মর্যাদা মুসলিম বিশ্ব ও পশ্চিমী দুনিয়ায় তাঁর জাতীয় পরিচিতিকে ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত। তিনি সুদান সংসদের স্পিকার, সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, এটর্নি জেনারেল প্রভৃতি নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। তার চেয়ে বড় কথা লন্ডন ও সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তুরাবী একই সঙ্গে ইসলামী ঐতিহ্য ও আইন বিশেষজ্ঞ, পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে সমসাময়িক ইসলামী ভাবনার অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার এবং ইসলামী জগতের অগ্রণী তাত্ত্বিক নেতা।
    সোরবোর্নে তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত ক্ষমতার প্রয়োগ কতটা গ্রহণযোগ্য। পিএইচডি শেষে ১৯৬৪ সালে দেশে ফেরার পর সবাই মনে করেছিল তুরাবী হবেন সুদানের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে তিনি হয়ে যান বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী মুসলিম  নেতা ও তাত্ত্বিক। আজকে ইসলামী ও পশ্চিমা সভ্যতার ঠানাপোড়ন থেকে উঠে আসা সামাজিক রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে তুরাবীর নজির টানা জরুরী হয়ে পড়ে। এ কারণেই তাকে আধুনিক ইসলামী মননের অন্যতম সংকট বিশ্লেষক হিসেবে গণ্য করা হয়।
    দেশে ফেরার পর তুরাবী খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন পান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আহবান উপেক্ষা করে তৎকালীন সুদানী সামরিক শাসক ইব্রাহিম আবুদের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে এক তীব্র ও ঝাঁঝালো বক্তৃতা দেন। সেই থেকে তুরাবী সুদানী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে হাজির হন এবং আজও তিনি সেখানে অবস্থান করছেন। অনেকের ধারণা ১৯৮৯ সালে সুদানে ইসলামী শক্তির মদদে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে যে উমর আল বশিরের সরকার ক্ষমতায় আসে তার প্রধান তাত্ত্বিক ও নেপথ্যের নায়ক আসলে তিনি। তুরাবীর সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কয়েক দশকের মধ্যে সুদানী সমাজ ও রাষ্ট্রের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইসলামের অন্তর্মুখিতা কাটিয়ে তিনি এটিকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রোগ্রাম হিসেবে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন যা অনেকের কাছে চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
    দুই
    হাসান আল তুরাবী হচ্ছেন সুদানের এক দীর্ঘ ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী পরিবারে সন্তান। এই পরিবারের সদস্যরা তাঁদের ধার্মিকতা, বিদ্যাবুদ্ধি ও সামাজিক কাজ-কর্মের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তুরাবীর পরিবারের পূর্বপুরুষ ছিলেন আঠারো শতকের আলেম ও ফকীহ ওয়াদ আল তুরাব, খার্তুমের দক্ষিণে যার বিখ্যাত দরগাহ রয়েছে। হাসান আল তু্রাবীর ভাষায় তিনি হলেন সুদানের প্রথম মাহদী, যিনি ছিলেন একই সাথে বুদ্ধিজীবী, সংস্কারপন্থী ও একজন সুফী। হাসান আল তুরাবীর জীবনে আমরা এই ত্রিগুণের এক অপূর্ব সমাবেশ দেখি।
    তুরাবীর পিতা ছিলেন সেকালের সুদানের ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীন শরীয়াহ্‌ আদালতের একজন বিচারক। তিনি ওমদুর মানের বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আল মাহাদ আল ইলমি থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছিলেন। তুরাবী জানিয়েছেন সরকারি চাকরির বদলির সূত্রে তাঁর বিচারক পিতাকে সুদানের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। সেই সাথে তাঁর পরিবারকেও ঘুরতে হয়েছে। এছাড়া ব্রিটিশ প্রশাসকদের হাত থেকে তুরবীর পিতা তাঁর কর্তৃত্ব রক্ষার সবসময় একটা চেষ্টা করেছেন। এ কারণেও তাকে বারংবার বদলি করা হয়েছে।
    হাসান আল তুরাবির জন্ম সুদানের কাসসালায়, ১৯৩২ সালে। তুরাবী ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ এবং তাঁর জন্মের অল্প কিছুদিন পরেই তাঁর মা মারা যান। ফলে তাঁকে বিচারক পিতার তত্ত্বাবধানেই কাটাতে হয় এবং সুদানের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হয়। পিতার সাথে তুরাবীর ঘুরে বেড়ানো ও পড়াশোনা নিয়ে পরবর্তীকালে এক হৃদয়গ্রাহী মন্তব্য করেছেন তিনিঃ I went to school in each of the local places, but I look forward after vacations to going back to school.[১]
    পিতার কাছেই তুরাবীর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বিচারক পিতা সন্ধ্যার পর এবং ছুটির সময় তুরাবীকে নিজে পড়াতেন যাতে তার পুত্র সত্যিকারের শিক্ষাটা পায়। পিতার তত্ত্বাবধানে অল্প বয়সে তুরাবী ইবনে মালিকের আলফিয়া ও লামিয়াত আফাল পড়ে মুখস্থ করেন। এ দু’টো ব্যাকরণ বই ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষার জন্য ছিল, কারণ এটি কুরআনের ভাষা ব্যাখ্যায় সাহায্য করতো। ১৯৫০ সালের মধ্যে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন এবং বিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রস্তুতি নেন। খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি এখানকার ছাত্র সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সংস্পর্শে আসেন। ব্রাদারহুড তাঁর চিন্তা ভাবনার মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দেয়। তিনি সেদিনকার অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বলেছেনঃ
    …the Islamic movement which I met at the university was quite an experience for me. All of the dead literature that I had learned by heart became alive. I saw everything in a different light.[২]
    বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি বিলাত যান এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন এবং প্যারিসের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের উপর পিএইচডি অর্জন করেন।
    ১৯৬৪ সালে দেশে ফিরে তিনি প্রথম কাজ করেন খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নীতি-নির্ধারণী বিতর্কে সুদানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইব্রাহীম আবুদকে আক্রমন করেন। এটি চলমান আবুদবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি দেয় এবং বিরোধী দলের এই আন্দোলনে মুসলিম ব্রাদারহুডের অবস্থানকে আরো মজবুত করে। এর ফলে ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে আবুদ সরকারের পতন ঘটে।
    এই আন্দোলনের সফলতা এবং তুরাবী ও মুসলিম ব্রাদারহুডের অভিজ্ঞতা তুরাবীর রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রমাণ। তুরাবীর এই সাফল্য ঠিক সরাসরি ইসলামী কোন অবস্থান থেকে আসেনি বরং একটি সামগ্রিক সমস্যার তিনি একটি ইসলামী অভিব্যক্তি ঘটিয়েছিলেন। তুরাবীর নেতৃত্বের এই বিশেষ কৌশলই তাঁকে সুদানী রাজনীতি ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যমণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
    হাসান আল তুরাবী রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও আলোচিত হলেও মূলত তিনি একজন বুদ্ধিজীবী। তাঁর সমসাময়িক সুদানী রাজনীতিবিদদের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক দিয়ে তিনি অনেক অগ্রসর। একই সাথে সুদানের ব্রাদারহুডের নেতৃত্বও তিনি দিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে যেয়ে অন্যান্য রাজনীতিবিদদের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বি্তায় নামতে হয়েছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি অন্য সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন এবং ব্রাদারহুডের মতো একটি এলিটিস্ট প্রতিষ্ঠানকে রীতিমত জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেছন।
    তিন
    হাসান আল তুরাবীর চিন্তাভাবনার মূলে আছে তাঁর ইসলামকে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। কিন্তু সেই রকম সামর্থ্য অর্জন করতে হলে তুরাবী মনে করেন আধুনিককালে ইসলামের তাজদীদ বা পুনরুজ্জীবন দরকার। এই কাজ করতে হলে প্রথমে চাই একালে মুসলিম সমাজের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সকল বিশ্বাসীকে এই পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া।
    তুরাবীর মুসলিম ইতিহাস চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে তাজদীদ। কারণ প্রতি যুগেই ইসলামের তাজদীদ প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত না থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে যায় এবং ইসলাম পরিণত হয় একটি আচারসর্বস্ব জীবনীশক্তিহীন ধর্মে। অবশেষে দেখা যায় ইসলাম বিশ্বাসীরা এমন রীতিনীতি নিয়ে বসবাস করছে যাকে আর কোনভাবেই ইসলামসম্মত বলা চলে না।
    তুরাবী তাই মনে করেন ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে এই তাজদীদ ও তাকলীদের (অতীতের অন্ধ অনুকরণ) পারস্পারিক উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বমানতা বরাবর ছিল। তুরাবী অবশ্য এটা মনে করেন না তাজদীদ মানে হচ্ছে ইসলামের মৌলিক নীতিকে পাল্টে দেয়া কিংবা নতুন পরিস্থিতির সাপেক্ষে কুরআন শরীফের পরিবর্তন ঘটানো। তুরাবীর কাছে তাজদীদ মানে হচ্ছেঃ
    The revelation in the Qur’an is the comprehensive revelation of God’s eternal truth. However, the implications of that Qur’anic message for specific peoples, times and places do change.[৩]
    সুতরাং প্রত্যেক বিশ্বাসী মুসলমানকে যুগের রূপান্তরকে, ইতিহাসের রূপান্তরকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সেই সময় নির্ধারিত রূপান্তরকে মেনে ইসলামী নীতির ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হবে। এর মানে হচ্ছে পরিবর্তনে সাড়া দেয়াই ইসলামের নীতি। পরিবর্তনের এই নীতিকে ইসলামের পরিভাষায় বলে ইজতিহাদ। কিন্তু তুরাবী তার সমসাময়িকদের থেকে ইজতিহাদকে মূল্যায়ন করেছেন ভিন্নভাবে।
    তাঁর মতে ইজতিহাদ এমন কিছু নয় যা শুধুঃ
    …to go to old books to dig out bits and pieces that we hope will help us solve today’s problems. What we need is to go back to the roots and create a revolution at the level of principles.[৪]
    তুরাবীর এই চিন্তাভাবনা তাঁর পূর্ববর্তী মুজতাহিদ ও ভাবুকদের থেকে অনেকখানি ব্যতিক্রমী ও স্বাতন্ত্র্যধর্মী। তিনি পূর্ববর্তীচিন্তা থেকে অনেকখানি সরে এসেছেন। যেমন মুসলমানরা রাসূল (সঃ) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজকে আজও মডেল মনে করে এবং সেটির আদলে নতুন সমাজ তৈরির কথা ভাবে। কিন্তু তুরাবী বলেছেন আজকের যুগ ও বাস্তবতা সাপেক্ষে রাসূলের (সঃ) নীতির সমন্বয় করতে হবে। তাঁর ভাষায়ঃ
    …although the prototype community of the Prophet offers us an ideal standard, when we use that prototype as a basis we may feel obliged to build a new model which unites the eternal principles with the changing reality.[৫]
    তুরাবী পূর্ববর্তীদের থেকে সরে এসে ইজতিহাদ সম্পর্কে বলেছেন এটি এতকাল ধরে একটি বিশেষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও উলামারাই করে এসেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে আজকের দিনে বুদ্ধিজীবীতার এই সংজ্ঞার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং তাদের শ্রেণী ও পেশার মধ্যেও রূপান্তর ঘটেছে। তুরাবী উলা্মার সংজ্ঞাকে অনেক বিস্তৃত করে দিয়েছেনঃ
    What do I mean by ulama? The word historically has come to mean those versed in the legacy of religious (revealed) knowledge (ilm). However, ilm does not mean that alone. It means anyone who knows anything well enough to relate it to God. Because all knowledge is divine and religious, a chemist, an engineer, an economist, or a jurist are all ulama. So the ulama in this broad sense, whether they are social or natural scientists, public opinion leaders or philosophers, should enlighten society.[৬]
    ইজতিহাদ চর্চায় তুরাবীর এই গণতন্ত্রায়নের দাবি একালে একটা খুব উল্লেখযোগ্য বিষয়। এর মানে হচ্ছে জ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় প্রবুদ্ধ মুসলমানরা ইসলামী পুনর্জীবনের লক্ষ্যে তাঁদের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও মতামতের ব্যবহার করতে পারবেন। আজকের দিনে এই ধরনের পুনর্জীবন ভাবনা হতে হবে সামগ্রিক। শুধু অতীত চিন্তার পুনঃবিকরণ ও পারলৌকিক ভাবনার মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ করা চলবে না। এটিকে জীবনের প্রতিটি স্তরে এবং দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলোর সাথে যুক্ত করে মূল্যায়ন করতে হবে। তুরাবী মনে করেন এই প্রক্রিয়া ইসলামী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তির অংশ এবং মুসলমানকেও আজ সেই প্রয়োজনের দায় মেটাতে হবে।
    চার
    তাজদীদের কথা বিবেচনা করলে হাসান আল তুরাবী ইসলামী আইন ব্যবস্থার পুনর্জীবনের দিকটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন বেশি। এর কারণ বোধহয় তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন আইনের ছাত্র এবং পরবর্তীকালে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টির ডীন। রাজনীতিক হিসেবে তিনি যখন সরকারে এসেছেন তখনও তিনি আইন সম্পর্কিত পদগুলোতেই অবস্থান করেছেন বেশি। প্রেসিডেন্ট নিমেরীর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত হবার পর তিনি সুদানের এটর্নি জেনারেল, পরে প্রেসিডেন্টের আইন ও পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হন। পরবর্তীতে সংসদীয় গণতন্ত্রের সময় তাঁর ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিলে তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি সরকারের অনেক আইন ও সংবিধান বিষয়ক কমিটিতে কাজ করেছেন। এসব জায়গায় কাজ করার সময় তাঁর লেখালেখি ও রিপোর্টের মধ্যে আইনী ব্যবস্থার পুনর্জীবন ভাবনা বেশ স্পষ্ট। পরিবর্তনশীল সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি যেহেতু আইনী পুনর্জীবন চান, তাই তিনি মনে করেন কোনো বিদেশী ব্যবস্থা থেকে ধার করে নয় ইসলামের ভিতরকার শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করেই এটা করতে হবে।
    ১৯৬৫ সালে সুদান কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর সেখানকার সাংবিধানিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গঠিত কমিটির সদস্য হিসেবে তুরাবী যে মতামত দেন তার মধ্যে এরকম অভিব্যক্তি দেখা যায়। সুদান কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৪ সালে আবুদ সরকারের পতনে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রাখা এবং পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের সংসদ নির্বাচনে বেশ কয়েকটি সিট পায়। কিন্তু ব্রাদারহুডের চাপে পার্লামেন্টে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে বিল পাস হয়। এ ঘটনাকে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করলে সেখানকার সুপ্রিম কাউন্সিল তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সার্বিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে রিপোর্ট দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন, যার সদস্য হিসেবে তুরাবী কাজ করেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যের মতো তুরাবীও আইন প্রণয়নে সংসদের চূড়ান্ত ক্ষমতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং একই সাথে তিনি রিপোর্টের সাথে যোগ করে দেনঃ
    The Constituent Assembly is the agency entrusted with the exercise of the highest constitutional authority and it is an expression of the sovereignty which the constitutions establish for the Ummah after God.[৭]
    এখানে তুরাবীর ‘খোদার পরে’ শব্দটার ব্যবহার লক্ষণীয়। পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বকে তিনি খোদায়ী কর্তৃত্বের আয়ত্তাধীন রেখেছেন যা তাঁর ইসলামী প্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ। তুরাবী শুধুরিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, এই সাংবিধানিক সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি লেখেনঃ …the Sudanese constitution is simply a collection of limbs amputated from foreign constitutions and imposed on the Sudanese people.[৮]
    সুতরাং ধার করা ব্যবস্থা নয়; কার্যকর সংস্কার ও পুনর্জীবনের কাজ করতে হলে ইসলামের ভিত্তিতেই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তুরাবী পুনর্জীবনের জন্য দু’টি বিষয় চিহ্নিত করেছেন। একটি ফিকাহ্‌র পুনঃনির্মাণ, অপরটি শরীয়াহ্‌র বাস্তবায়ন। মুসলিম চিন্তার জগতে শরীয়াহ বিবেচিত হয় ইসলামী আইন হিসেবে যার উৎস হলো পবিত্র কুরআন ও রাসূলের (সঃ) সুন্নাত। অন্যদিকে ফিকাহ্‌ হচ্ছে শরীয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, বিশ্লেষণ ও তার ফলাফল। তার মানে ফিকাহ্‌ হচ্ছে মানবীয় চিন্তাপ্রসূত, শরীয়াহ ঐশী জ্ঞানলব্ধ। ফিকাহ্‌ হচ্ছে শরীয়াহ্‌র উপর ভিত্তি করে মানবীয় সমস্যার সমাধান বের করার পদ্ধতি।
    তুরাবী মনে করেন প্রথম যুগের মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা শরীয়াহ্‌র আলোচনার জন্য ফিকাহ্‌ শাস্ত্রের বিকাশ ঘটিয়ে ইসলামী জ্ঞান জগতে এক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাই বলেতো এক যুগের ফিকাহ্‌ দিয়ে অন্য যুগের প্রয়োজন মিটতে পারে না। তাই আজকের যুগের প্রয়োজনে শরীয়াহ্‌কে ভিত্তি করে নতুন ফিকাহ্‌র বিকাশ ঘটাতে হবে। তাছাড়া পুরানো ফিকাহ্‌ শাস্ত্রগুলোর অনেক সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জটিলতা ও মতবিরোধের কারণ হয়ে উঠেছে। তুরাবীর ভাষায়ঃ
    …the issues of the fundamental sources in the fiqh literature were considered abstractly, so that they became sterile speculative discussions which produced absolutely no fiqh at all. Even worse, it produced never ending controversy.[৯]
    সুতরাং সমকালীন ইসলামী আন্দোলনের জন্য এই ফিকাহ্‌ কোন কাজে আসবে নাঃ
    It is clear to the movement that fiqh which it has in its possession – however specialized its load of deductions and inferences, and however careful in its explorations and consultations – will never be adequate for the needs of the Islamic mission.[১০]
    আজকের যুগের জন্য তুরাবী যে নতুন ফিকাহ্‌র কথা বলেছেন তা যেমন পুরনো ফিকাহ্‌র সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করবে তেমনি তা হবে সমস্যার সুনির্দিষ্ট উত্তর। তুরাবীর প্রস্তাবিত নতুন ফিকাহ্‌র কর্মপদ্ধতি কেমন হবে দেখা যাকঃ
    Human knowledge has expanded greatly, while the old fiqh was based on knowledge that was restricted [by the conditions of its historical era] … it becomes imperative for us to adopt a new position in the fiqh of Islam so that we can utilize all knowledge for the service of God. This is a new construction which unites what exists in the transmitted traditional disciplines … with the rational sciences which are renewed every day and which are completed knowledge, we can renew our fiqh for the faith and what challenges it time after time in our contemporary life.[১১]
    এই পরিপ্রেক্ষিতে তুরাবী উলামার যে নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন তাকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয়। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রবুদ্ধ ব্যক্তিরা এই নতুন ও সমন্বিত ফিকাহ্‌ তৈরিতে এগিয়ে আসবে বলে তিনি আশা করেন। এর পাশাপাশি ফিকাহ্‌ বিকাশের স্বার্থে তিনি কিয়াসের ধারণাকে সহজীকরণের কথা বলেছেন। ইসলামের প্রথম যুগেই স্বীকৃত হয়েছিল ইসলামের মৌল পুস্তক কুরআন শরীফে নীতির কথা বলা হয়েছে কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতিকে মুসলমানরা কিভাবে মোকাবিলা করবে তার সুনির্দিষ্ট উত্তর এখানে নেই। এই জন্যই ইসলামী আইনশাস্ত্রে কিয়াসের উদ্ভব হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে উলামারা কিয়াসকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন যা তুরাবী প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এমন পরিস্থিতিতে কিয়াসের সীমানা প্রসারিত করার কথা বলেছেন এবং এই সূত্রে আধুনিককালে ইসলামের শুরা ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়নের কথাও বলেছেন।
    ইসলামী আইনের ব্যাপারগুলো নিয়ে তুরাবীকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ভাবতে হয়েছে কেননা ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে সমকালীন মুসলিম সমাজে ইসলামী আইন কিভাবে প্রয়োগ করা যাবে এবং ফিকাহ্‌র কোন অংশের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনঃবিকরণ করা দরকার এটা তাঁর কাছে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। যদিও উনিশশো ষাটের দশকে তুরাবী যখন সুদানের রাজনীতিতে পা রাখেন তখন তাঁর মুসলিম ব্রাদারহুড ও এর রাজনৈতিক শাখা ইসলামিক চার্টার ফ্রন্টকে ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সংবিধানের ধারণাগুলোকে লোক সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে খাটতে হয়েছে বেশি। পরে অবশ্য তুরাবী ও তাঁর দলের প্রচেষ্টায় ইসলামী সংবিধানের ধারণা সুদানী রাজনীতির প্রধান এজেন্ডায় পরিণত হয়। এর ফলে পার্লামেন্টের সংবিধান কমিটি ইসলামের নীতেকে সুদানী সংবিধানের মূল উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির ফলে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় এমন নয় কিন্তু সুদানের রাজনৈতিক লড়াইয়ে ইসলামের অবস্থানকে এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
    তুরাবী ও তাঁর ব্রাদারহুড প্রথম দিকে ধীরগতিতে অগ্রসর হওয়ার নীতি অনুসরণ করে এবং ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার আগে ব্যক্তি ও সমাজের ইসলামীকরণের উপর জোর দেয়। কারণ ব্যক্তি ও সমাজের ইসলামীকরণ ছাড়া রাষ্ট্র কর্তৃক উপর থেকে চাপানো ইসলামীকরণের বুনিয়াদ দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক। তুরাবী ও ব্রাদারহুডের এই ‘ধীরে চলো’ নীতি সুদানী রাজনীতির দু’টি ঘটনায় বড় রকমের ধাক্কা খায়। একটি হচ্ছে সামরিক শাসক উমর হাসান আল বশীরের ১৯৮৯ এর অভ্যুত্থান। তুরাবী, ব্রাদারহুড ও এর রাজনৈতিক শাখা ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট যেমন নিমেরীর ইসলামীকরণ প্রক্রিয়াকে সমর্থন দেয় তেমনি পরবর্তীতে উমর আল বশীরের সরকারের সাথেও কাজ করে। সামরিক একনাকয়দের সাথে তুরাবীর এই কাজকর্ম তাকে কিছুটা বিতর্কিত করে। তবে তুরাবীর যুক্তি ছিল। এর ফলে সুদানে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে সুবিধা হয়। অন্যদিকে নিমেরীর ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার ফলে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার সামাজিক ভিত্তি অনেক মজবুত হয়। এমনকি নিমেরীর পতনের পরও সুদানী সমাজে ইসলামী আইনের ভূমিকাকে বাতিল বলা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং সেই থেকে সুদানী রাজনীতিতে ইসলামী আইনের বাস্তবায়নের ধারণা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে তুরাবী ও তাঁর ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টের জন্য ইসলামী আইনের পক্ষে লড়াই সহজ হয়।
    পাঁচ
    ষাটের দশকে তুরাবী যখন সুদানের রাজনীতিতে পা রাখেন তখন সেখানকার মেয়েরা জেনানা মহল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে এবং তাদের সমানাধিকার অর্জনের প্রক্রিয়াটিও জোরদার হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি জীবনে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। কমিউনিস্টরা এইসব শিক্ষিত মেয়েদের কাছে টানতে থাকে এবং তাদের ভোট পেতে থাকে।
    তুরাবী ইসলামপন্থীদের সংকট মোচনে এগিয়ে আসেন। তাঁর প্রভাবে নারীদের অধিকার বিষয়ক সুদানী মুসলিম সমাজের ঐতিহ্যবাহী ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে ব্রাদারহুড ইসলামের উদারনৈতিক শিক্ষার আলোকে নারী অধিকারের প্রতি সচেতন হয়। তুরাবীর কথা হচ্ছে ইসলামে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত। একই সঙ্গে তিনি আধুনিকীকরণের চ্যালেঞ্জ থেকে ইসলামপন্থীদের পিছিয়ে আসার প্রবণতার তীব্র নিন্দা জানান। তুরাবী বলেন আজকের মুসলিম সমাজ নারীদের লাঞ্ছনা ও অবমাননার উৎস হচ্ছে অনৈসলামিক ও সামাজিক প্রভাব। এ প্রসঙ্গে সুদানে মহিলা ভোটারদের মন জয় করতে তখনকার ইসলামিক চার্টার ফ্রন্টের মহাসচিব তুরাবী ইসলামের উষালগ্নে উদীয়মান মুসলিম সমাজের অগ্রণী নারীদের ঐতিহ্য পুনরাবিষ্কারের উপর জোর দেন। ইসলামী মর্মবস্তুকে বজায় রেখে নারী মুক্তি আন্দোলনের এই শ্লোগান ইসলামী নারীবাদী ধারাকে পুষ্ট করে তোলে।
    তুরাবী জোর দিয়ে বলেন ইসলামে নারী ও পুরুষে কোন মৌলিক তফাৎ নেই। তাঁর এই অবস্থানের পক্ষে তিনি জোরালো মতামত দেন তাঁর লেখা Women between the Teachings of Religion and the Customs of Society শীর্ষক বইয়ে। তুরাবী যেসব শক্তিশালী লেখা লিখেছেন এটা তাঁর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট এমন মতামত অনেকের। এ বইয়ে ইসলামে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে তুরাবী যে বিপ্লবী ভাষ্য দিয়েছেন তা রীতিমত মৌলবাদী, নারীবাদী, মার্কসবাদী সব তরফের কাছেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তুরাবীর এই ভূমিকার ফলেই সুদানে মহিলা ভোটের হাওয়া ঘুরে যায় ইসলামী শক্তির পক্ষে এবং ইসলামিক আইডেন্টিটি ও নারীবাদী চেতনায় বিশ্বাসীরা সুদানে মার্কসবাদীদের ছাড়িয়ে যায়।
    তুরাবী এ বইয়ে প্রথমে যুগের মুসলিম সমাজে নারীদের ভূমিকার নজির দিয়েছেন এবং এই ভূমিকাকে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশের সাথে সমন্বয়  করে বলতে চেয়েছেনঃ
    … in the religion of Islam, a women is and independent entity, and thus a fully responsible human being. Islam addresses her directly and does not approach her through the agency of Muslim males.[১২]
    এর মানে হচ্ছে নারীর অধিকার ও দায়িত্বের সাথে পুরুষের অধিকার ও দায়িত্বের কোন তফাৎ নেইঃ
    The verdict of Islamic jurisprudence is just the practical expression of the dictates of faith. Women, according to Shariah, are counterparts of men. And in Islamic jurisprudence, there is no separate order of regulations for them … The underlying presumption in the Shariah is that sex is immaterial.[১৩]
    তুরাবী উল্লেখ করেছেন ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্বে ইসলাম কবুল করেছেন, এমনকি বাড়ির পুরুষদেরও আগে। তারা সেদিন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কখনো যুদ্ধের ময়দানে, কখনো রাজনীতির অঙ্গনে। তুরাবী মনে করেন সমাজের মুক্ত অঙ্গনে শুধু পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট হয়নি, এখানে লৈঙ্গিক পার্থক্য টানা মূর্খতা। ইসলামের প্রথম যুগের এসব মুসলিম মহিলারাই কার্যত ইসলামী আচরণ করেছেন। সমাজ জীবনে যেরকম, তেমনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কেও একই কথা। নারী এককভাবে যে কোনো বিয়ের  প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তার নিজের সম্পত্তির পুরোপুরি দেখভাল করার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে পূর্ণভাবে।
    তাহলে ইসলাম যদি নারীর সমানাধিকার দিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে নারীর বর্তমান লাঞ্ছনা, অবমাননার কারণ কি? তুরাবী বলেছেন মুসলমানের বিশ্বাসে যখন অবক্ষয় শুরু হলো তখনই তারা তাদের নারীদের উপর জুলুম শুরু করলো। ইসলামের প্রতি দুর্বল আনুগত্যই তাদেরকে নারীদের প্রতি অসহিষ্ণু, বেইনসাফী আচরণ করতে প্রণোদিত করলো। পরিণতিতে যা দাঁড়ালো তা হলো নারীর মৌলিক ধর্মীয় দায়িত্ব ও অধিকারকে অস্বীকার করা হলো এবং মুসলিম সমাজের মধ্যকার সমতা ও ইনসাফের ধারণা যা কিনা শরীয়াহ্‌ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তাকে উপেক্ষা করা হলো। এর ফলে জন্ম হলো তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজের। ঐতিহাসিক অবক্ষয়ের ধাক্কায় যে তথাকথিত মুসলিম সমাজ তৈরি হয়েছে তুরাবী মনে করেন এটিকে আজ বদলে ফেলা দরকার এবং ইসলামপন্থীদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই সংগ্রামে এগিয়ে আসা। তার কথা শোনা যাকঃ
    … a revolution against the condition of women in the traditional Muslim societies is inevitable and that is the task of Islamists to close the gap between the fallen historical reality and the desired model of ideal Islam.[১৪]
    তুরাবী অবশ্য সতর্ক এই কারণে যে সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি একটি জটিল বিষয় বিশেষ করে এই যুগে যেখানে পশ্চিমী নীতি ও মূল্যবোধ মুসলিম সমাজের উপর আছড়ে পড়ছে এবং নির্যাতিত মুসলিম নারীদের কাছে তা একধরনের প্রলোভন ও মুক্তির উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পশ্চিমী মূল্যবোধ আত্তীকৃত হওয়ার আগেই ইসলামী সংস্কারকে এগিয়ে নেয়া চাই। সেজন্য নিছক পশ্চিমী মূল্যবোধের সমালোচনা করে লাভ হবে না। অতীতকে ধরে রেখার চেষ্টা শক্তির অপব্যয় মাত্র। ইসলামবাদীরাই নারীমুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারেন। আদর্শ ইসলামের দিকে যাত্রার শর্ত হচ্ছে এই প্রচেষ্টা। পশ্চিমী মতে আধুনিকতার প্রবক্তারা যাতে পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে না পারে সেদিকে নজর দেয়াই আমাদের কর্তব্য।
    মুসলিম নারীদের নিয়ে তুরাবীর বিপ্লবী চিন্তাভাবনা এবং ইসলামী আন্দোলনে তুরাবীর প্রেরণায় আরো অধিক নারীর অংশগ্রহণ তার রাজনৈতিক সাফল্যের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়ায় তুরাবীর নারী সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার বিপুল প্রভাব পড়েছে এবং বিভিন্ন দেশের ইসলামবাদীরা তাদের আন্দোলনে নারীর অধিক অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততার ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছে। ১৯৯২ সালে তুরাবী তাঁর নিজের সূচনা করা কর্মসূচীর মূল্যায়ন করেছেন এভাবেঃ
    …in the Islamic movement I would say that women have played a more important role of late than men. They came with a vengeance because they had been deprived, and so when we allowed them in the movement, more women voted for us than men because we were the ones who gave them more recognition and a message and placed in society. They were definitely more active on our election campaigns than men. Most of our social work and charitable work was done by women. They are now even in the popular defense forces, and nobody raises questions about that … of course. I don’t claim that women have achieved parity … but there is no bar to women anywhere, and there is no complex about women being present anywhere.[১৫]
    ছয়
    তুরাবীর রাজনৈতিক জীবনের সাথে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। যদিও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ ও পদ্ধতি নিয়ে ইসলামবাদীদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। একদল মনে করেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমাজ ও আইনের ইসলামীকরণ করতে হবে। অন্য দলের মতামত হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজের ইসলামীকরণের পরিণত রূপ হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র। তুরাবী মোটামুটি দ্বিতীয় দলের পক্ষপাতী এবং নীতি ও তত্ত্বের দিক দিয়ে মোটামুটি একই চিন্তায় তিনি স্থিতিশীল। তাঁর অবস্থান হচ্ছেঃ
    An Islamic state can not be isolated from society, because Islam is a comprehensive, integrated way of life. The division between private and public, the state and society, which is familiar in western culture, has not been known in Islam. The state is only the political expression of an Islamic society. You can not have an Islamic state except in so far as you have an Islamic society. Any attempt at establishing a political order for the establishment of a genuine Islamic society would be superimposition of laws over a reluctant society.[১৬]
    তুরাবীর কথা হচ্ছে এই ইসলামীকরণকে এগিয়ে নিতে হলে সুদানের বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সু্যোগ নিতে হবে এবং তিনি তা করেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের কালে তিনি সে প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়েছেন এবং সংসদের ভিতরে সুদানের সাংবিধানিক ও আইনী ইসলামীকরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে ইসলামীকরণের স্বার্থে তিনি সমারিক শাসকদেরও সহযোগিতা করেছেন। যদিও এই সহযোগিতাকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেছেন এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারকে বৈধতা দেয়ার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত হতে হয়েছে।
    তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে ইসলামী রাষ্ট্র বা সরকার বলতে কি বোঝায়? তুরাবী একটা মডেল খাড়া করেছেন, যদিও এ মডেল প্রশ্নোর্ধ্ব নয়। তবুও বলতে হবে ইসলামী দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল একালে তাঁর মত দু’ একজনই সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এখানেই তুরাবীর সাফল্য। ইসলামবাদীরা এ মডেল থেকে অনুপ্রেরণা পাবেন। ভবিষ্যতের ইসলামবাদীরা এ মডেলের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো অতিক্রম করে নতুন মডেল উপস্থাপন করবেন এ আশা করা যায়।
    তুরাবী বলেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল হবে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক। কোনভাবেই এটা স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা নয়। এখানে সরকারের ভূমিকা অনেকখানি সীমিত। আইন সামাজিক নিয়ন্ত্রনের একমাত্র চাবিকাঠি নয়। নৈতিক বিধি, ব্যক্তির বিবেকবোধ – এসবেরও গুরুত্ব রয়েছে এবং এসবই স্বাধীন মতামতের ব্যাপার। ইসলামের প্রতি মননশীল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে তা মোটেই নিয়ন্ত্রিত বা বিধিবদ্ধ হবে না। মূল ধারণাটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রে স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অমুসলিমের স্বাধীনতা নয়, মুসলমানদের মধ্যে চিন্তার বহুত্বকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
    ইসলামের মূল তত্ত্বটা তৌহিদবাদী। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সেকুলার রাষ্ট্রের মতো নয়। ইসলামী রাষ্ট্রও সেকুলার নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। ধর্মহীনতা আত্মবিভাজন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পথ পরিষ্কার করে। সুদানে তুরাবীর ইসলামী রাষ্ট্রের পরীক্ষা-নিরিক্ষার সুযোগ আসে ১৯৮৯ সালে উমর আল বশীরের নেতৃত্বে তুরাবীর অনুগত একদল সামরিক অফিসারের অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে। উমর আল বশীরের সরকারে তুরাবীর ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট প্রধান ভুমিকা রাখে এবং তুরাবী এই সরকারের প্রধান তাত্ত্বিক ও থিংক ট্যাংক হিসেবে আবির্ভূত হন।
    ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর তুরাবী সুদান পার্লামেন্টের স্পীকার হন এবং ১৯৯৮ সালে প্রণীত সুদানী সংবিধানে তুরাবীর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটে। বিশেষ করে তাঁর প্রিয় তাজদীদ বা ইসলামী পুনর্জীবনের ভাবনা এখানে স্পষ্ট। তাছাড়া এ যাবৎকাল তাঁর লেখালেখি ও বক্তৃতায় যেসব বিষয় উঠে আসতো তাও এ সংবিধানে কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন তিনি মুসলিম দুনিয়ার জনপ্রিয় ধারণা খেলাফতকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ ও ঐশী সার্বভৌমত্বের একটি সমন্বিত রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সংবিধানের ভাষাটা পরীক্ষা করা যাকঃ
    Supremacy in the state is to God, the Creator of human beings and sovereignty is to the divergent people of the Sudan who practice it as worship of God, bearing the trust, building up the country and spreading justice, freedom and public consultation.[১৭]
    অথবা ইসলামের ইজমার ধরণাকে তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জনগণের ঐকমত্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন – The consensus of the nation by referendum এবং এই প্রক্রিয়াকে তিনি আইনের উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
    এই সংবিধানে ইসলামী আইনের সুনির্দিষ্ট ধারাগুলোও সন্নিবেশিত হয়েছে যেমন সুদ, এলকোহল ও জুয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা, রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাতের নীতি প্রবর্তনের মতো বিষয়গুলো। সাংবিধানিকভাবে এইসব নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তুরাবী তাঁর লক্ষ্যের কথা খোলামেলা প্রকাশ করেছেন।
    Those in service in the state and public life shall envisage the dedication thereof for the worship of God, wherein Muslims stick to the scripture and tradition, and all shall maintain religious motivation and give due regard to such spirit in plans, laws, politics and official business in the political, economic, social and cultural fields in order to promote public life towards its objectives, and adjust them towards justice and uprightedness to be directed towards the grace of God in the hereafter.[১৮]
    এটা হচ্ছে সেকুলারিজমকে প্রত্যাখ্যান করার সাংবিধানিক ভাষা। কিন্তু এই সংবিধানের ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে একটি প্রশ্ন বরাবর ছিল। কারণ সুদান মূলত ইসলামিক ও খ্রিষ্টিয় ধারায় বিভক্ত একটি জাতি রাষ্ট্র। সার্বিকভাবে সুদানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এর দক্ষিণাংশে বিপুলসংখ্যক খ্রিষ্টান ও আদিবাসীদের বাস। সুতরাং সংবিধানের ইসলামী ধারাগুলোকে অমুসলিমদের উপর ব্যবহার করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। সংবিধানের ধারাটা পরীক্ষা করা যাকঃ
    The effectiveness of some laws shall be subject to territorial limitations, considering the prevalence of certain religions or cultures in the areas at variance with the religion dominant in the country at large … In there matters exclusive local rules can be established in the area based on the local majority mandate … Thus the legislative authority of any region predominantly inhabited by non-Muslims can take exception to the general operation of the national law, with respect to any rule of a criminal or penal nature derived directly and solely from a text in the Shariah contrary to the local culture.[১৯]
    সুতরাং একটা ইসলামী রাষ্ট্রেও অমুসলমানদের মূলস্রোতের সাথে আত্তীকরণ করা যেতে পারে বলেই তুরাবী মনে করেন।
     সাত
    উমর আল বশীরের সাথে দীর্ঘ এক দশক ধরে তুরাবীর এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল কি তা একটু বিবেচনা করা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে তুরাবীর ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বে তেমন কোনো জোরালো প্রভাব ফেলতে পারেনি বলে মনে হয়। এর কারণ তুরাবীর রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সময় বিশ্বপরিস্থিতি মোটেই তাঁর অনুকূলে ছিল না। পশ্চিমী রাষ্ট্রসমূহ একযোগে তুরাবীর সাথে শত্রুতা শুরু করে পাশাপাশি তারাই সুদানের দক্ষিণাঞ্চেলের খ্রিষ্টানদের মুসলিম প্রধান উত্তরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়। মুসলমান-খ্রিষ্টান দাঙ্গা ও গৃহযুদ্ধ সুদানের ঐক্য ও সংহতি একেবারে ঝাঁঝড়া করে দেয়। এ ছাড়া সুদানের প্রধান বিরোধী দলগুলোও তুরাবীর ইসলামীকরণের ধারণায় কখনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। উল্টো নানা ইস্যুতে তারা তুরাবীর বিরোধিতা করতে ছাড়েনি। এসব কারণে তুরাবীর বিকশিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা বিচার করা বেশ কঠিন এবং শেষমেষ কার্যত আমেরিকার চাপে প্রেসিডেন্ট উমর আল বশীর তুরাবীকে তাঁর পদ থেকে ১৯৯৯ সালে সরিয়ে দেন। একালে ইসলামী নবচেতনাবাহীদের অন্যতম পুরোধা তুরাবীর নেতৃত্বে সুদানে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল তাঁর জন্য এটা একটি বড় বিপর্যয় বটে। অনেকের মতে তুরাবীর সামরিক গণতান্ত্রিকভাবে তাঁর লক্ষ্য পূরণের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। তাহলে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন হতো না।
    তারপরেও বলা হয় তুরাবী আজীবন একজন সৃষ্টিশীল ও মননশীল মানুষ। মুসলিম বিশ্বে তাঁর সুগভীর মনীষা ও মননসমৃদ্ধ ধ্যান-ধারণার একটা বড় প্রভাব পড়েছে এবং তাঁর লেখালেখি ও চিন্তাভাবনার অনুসারী একদল মানুষও তৈরি হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পথ চলায় এটা একটি ইতিবাচক সংযোজন বলে ধরে নেওয়া যায়।
    গ্রন্থঋণঃ
    [১]  John L. Esposito and John O. Voll, Makers of Contemporary Islam. New York; Oxford University Press, 2001.
    [২]  প্রাগুক্ত।
    [৩] প্রাগুক্ত।
    [৪]  Abdel Wahab El-Affendi, Turabi’s Revolution: Islam and Power in Sudan. London: Grey Seal, 1991.
    [৫]  প্রাগুক্ত।
    [৬]  Hasan Turabi, “The Islamic State”, in Voices of Resurgent Islam. Ed, John L. Esposito. New York: Oxford University Press, 1983.
    [৭] Quoted in John L. Esposito and John O. Voll, Makers of Contemporary Islam.
    [৮]  প্রাগুক্ত।
    [৯]  প্রাগুক্ত।
    [১০] প্রাগুক্ত।
    [১১] প্রাগুক্ত।
    [১২] Hasan Turabi, Women in Islam and Muslim Society. London: Mile Stones, 1991.
    [১৩]  প্রাগুক্ত।
    [১৪]  প্রাগুক্ত।
    [১৫] In Arthur L. Lowrie, ed., Islam, Democracy, the State and the West : A Roundtable with Dr. Hasan Turabi. Tampa, FL : World and Islam Studies Enterprise, 1993.
    [১৬] Hasan Turabi, “Principles of Governance, Freedom, and Responsibility in Islam”, American Journal of Islamic Social Sciences 4,1 (1987):1.
    [১৭] Quoted in John L. Esposito and John O. Voll, Makers of Contemporary Islam.
    [১৮] প্রাগুক্ত।
    [১৯] প্রাগুক্ত।
    সূত্রঃ বাংলা সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত “উত্তর আধুনিক মুসলিম মন” গ্রন্থ