আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯ - ০৫:৫০ | প্রকাশিত: রবিবার ০৭ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট সংস্করণ daily sangram
আবু রাওনাফ আলী নূর : টাকশাল নামেই পরিচিত। পোশাকি নাম দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দেশের টাকা ছাপানোর একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান গাজীপুরে। টাকশালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। এ বছর এসে পূর্ণ হলো ৩০ বছর। টাকশাল নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন। বিশ্বে স্বাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় ২০০। তবে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে নোট মুদ্রণের ছাপাখানা আছে মাত্র ৬৫; যার মধ্যে বাংলাদেশের টাকশাল একটি। নাগরিক হিসেবে ব্যাপারটা নিশ্চয় মর্যাদা ও গর্বের। দেশের মানুষের কাছে ‘টাকশাল’ নামে বেশি পরিচিত বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠানটির পোশাকি নাম ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড (The Security Printing Corporation (Bangladesh) Ltd. (SPCBL) হল বাংলাদেশে ব্যাংকনোট ও সরকারি ডাকটিকিটের প্রধান ছাপাখানা। ওয়েবসাইট http://www.spcbl.org.bd, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৯২ সালের এপ্রিল থেকে, এটি দেশের উপস্থিত আইনের আওতাধীন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। এটি আন্তর্জাতিক সরকারি ছাপাখানা সমিতির নিয়মিত সদস্য। নেপাল সহ আরও বহু দেশ এর চার রং বিশিষ্ট উন্নত ডাকটিকিটের ক্রেতা। ২০১৩ সালে এর রজত জয়ন্তী উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটি সীমিত পরিমাণে ২৫ টাকার স্মারক নোট অবমুক্ত করে।
টাকশালের অভ্যন্তরে : ইংরেজি শব্দ ‘মিন্ট’-এর বাংলা হচ্ছে টাকশাল যেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি ধাতব মুদ্রা বা কয়েন বানানো হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাপালেও বাংলাদেশের টাকশালে কোনো কয়েন তৈরি হয় না। আর্থিকভাবে লাভ-লোকসান বিশ্লেষণে দেশের জন্য কয়েন উৎপাদন লাভজনক বিবেচিত না হওয়ায় আমাদের টাকশালে এখনো কয়েন তৈরির কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি এবং এ জন্য কয়েন তৈরির কোনো মেশিনও সংস্থাপন করা হয়নি। তবে টাকশালে শুধু যে টাকাই ছাপা হয়, ব্যাপারটা এমন নয়। টাকা ছাপানোর উদ্দেশ্যে স্থাপিত হলেও সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তাসামগ্রী এখানে ছাপানো হয়, যেমন: অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সঞ্চয়পত্র, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রাজস্ব স্ট্যাম্প, আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক সামগ্রী, স্মারক ডাকটিকিট, খাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্যাক্স লেবেল, ব্যাংকের চেক বই, প্রাইজবন্ড, রপ্তানি উন্নয়ন বুুরোর জিএসপি ফরম, দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদ ইত্যাদি। এ ছাড়াও কোনো কোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তাদের শিক্ষা সনদও মুদ্রণ করা হয়ে থাকে। টাকা মুদ্রণের কারণে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ প্রচুর। প্রায় ৬৬ একর জায়গা নিয়ে দেশের টাকা তৈরির একমাত্র এই কারখানা বৃক্ষশোভিত। আর গাছগাছালিতে ভরা বলেই টাকশালের অভ্যন্তর সব সময় পাখির কলরবে মুখরিত থাকে। শুধু প্রাকৃতিক দিক থেকেই নয়, টাকা মুদ্রণের একক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে কিছুটা ভিন্নও। কিন্তু বিদ্যমান বহু স্তরে নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মী ও প্রতিষ্ঠানটিকে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। পুলিশের প্রায় ৮০ জন সদস্য প্রতিষ্ঠানের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। এই ছাপাখানায় প্রবেশ করতে হলে চারটি ফটকে নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করতে হয়। প্রেসের মূল ফটক ও ভেতরের ঘরগুলোতে কর্মচারী, কর্মকর্তাদের চলাচলে অ্যাকসেস কন্ট্রোল ছাড়াও সব কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং অনুমতি পাওয়া গ্রাহকদের ছাপাখানায় প্রবেশের সময় দেহ তল্লাশি করা হয়। ব্যক্তি ও মালপত্রের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য লিখে রাখার জন্য করপোরেশনের শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেসের অভ্যন্তরে চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়ে থাকে। মুদ্রণসহ যেকোনো নিরাপত্তাসামগ্রী উৎপাদনে বেশ কিছু পর্যায়ে বিভিন্ন ঘরে (হল) কাজ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছাড়া এক হল থেকে অন্য হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারেন না। প্রতিটি হলের জন্য আলাদা এন্ট্রি পাস ছাড়াও দরজায় নিরাপত্তাকর্মীরা অন্যদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা রয়েছে। সংগৃহীত কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রীর মধ্যে সমন্বয়ন পদ্ধতি এই প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়েই পালন করা হয়। সমন্বয়ন বা রিকনসিলিয়েশনে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন বু্যুরো, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকে। যতক্ষণ সংগৃহীত কাঁচামালের সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য ও ওয়েস্টেজ বা অপচয়ের মিল হবে না, ততক্ষণ হিসাব করা হতে থাকবে। হিসাব মিলে গেলে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ওয়েস্টেজ ধ্বংস করা হয়। এমন নিরাপত্তা বিধান ও স্বচ্ছতার কারণে এই টাকশাল গ্রাহক প্রতিষ্ঠাগুলোর আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে।
গোড়াপত্তনের গল্প : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশে কিছুদিন পাকিস্তানী টাকার প্রচলন ছিল। তখন ওই টাকাগুলোতে ‘বাংলাদেশ’ লেখা স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো। পাকিস্তানী মুদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসেবে টাকার প্রচলন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। টাকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগ পর্যন্ত ভারত, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি থেকে বাংলাদেশের নোট ছেপে আনা হতো। সংগ্রহ নীতিমালা অনুসরণ করে একটি ভিন্ন দেশ থেকে নোট ছেপে সময়মতো আনা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বোধ করে আমাদের দেশেই নোট মুদ্রণের একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নোট ছাপার জন্য একটি প্রেস স্থাপনের ব্যাপারে ১৯৮৩ সালে একনেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তবে উদ্বোধনের আগে ১৯৮৮ সালেই পরীক্ষামূলকভাবে ১ টাকা ও ১০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল। প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবেই এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকের অনুমোদনের পর অর্থ মন্ত্রণালয় নোট মুদ্রণের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন করে। পরে যৌথ মূলধন কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার নামকরণ করা হয় ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন। শুনেছি, ‘দ্য’ নির্দেশকটি তৎকালীন অর্থসচিব ড. আকবর আলি খানের দেওয়া।
নোট ছাপানোর রীতিনীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন গ্রাহক প্রতিষ্ঠান সচরাচর বছরভিত্তিক তাদের প্রয়োজন মোতাবেক পণ্যের চাহিদা বা কার্যাদেশ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী নোটের উৎপাদন ও সরবরাহ করা টাকশালের পক্ষে এর আগে কখনো সম্ভব হয়নি। ৩০ বছর আগে বসানো স্বল্পসংখ্যক মেশিন দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো টাকশালের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সম্প্রতি আরেকটি উৎপাদন লাইনের মেশিন বসানোর পর উৎপাদনও শুরু হয়েছে। মেশিনের স্বল্পতার জন্য কয়েকটি মূল্যমানের নোট একই সময়ে মুদ্রণ করা সম্ভব হয় না; একটি নোট ছাপাতে প্রায় ৩০ পর্যায় পার করতে হয়। নোট উৎপাদনের পরিমাণ নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিভিন্ন অফিসের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন মূল্যমানের নোটের চাহিদা জানালে টাকশালের ভল্ট থেকে তা সরবরাহ করা হয়।
টাকশাল হলো কোম্পানি : ১৯৯২ সালে প্রকল্প থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব কিছুটা কমে এই প্রতিষ্ঠানের ওপর। কর্তৃত্ব চলে যায় পরিচালনা পর্ষদের হাতে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ টাকশাল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এই পরিচালনা পর্ষদ প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। টাকশালের পুরো মূলধন বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দিয়েছে।
৯ ধরনের নোট : বাংলাদেশে ৯টি মূল্যমানের কাগজি নোট রয়েছে; অবশ্য বর্তমানে ১ টাকা মূল্যমানের কাগজি নোট আর ছাপানো হয় না। বাকি নোটগুলো গাজীপুরে অবস্থিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে ছাপা হয়ে থাকে। এ ছাড়া সব স্মারক নোটও এই টাকশালেই মুদ্রিত। উচ্চ মূল্যমানের নোটগুলো জাল হয় বলে এগুলোর নকলরোধে বেশি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করা হয়ে থাকে। কম মূল্যমানের নোটগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি হাতবদল হয় এবং এই নোটগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলেও বদলে নেওয়ার জটিলতায় কেউ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় না। এসব বিবেচনায় কম মূল্যমানের কাগজি নোটের পরিবর্তে ধাতুর তৈরি কয়েন বিদেশ থেকে আমদানি করে ইস্যু করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের জনগণ কয়েন ব্যবহারে একেবারেই অভ্যস্ত নয় এবং কয়েন ব্যবহারের অপরিহার্যতা আমাদের দেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি। টাকশালের প্রায় ১ হাজার কর্মচারী-কর্মকর্তার পরিশ্রমে যে নতুন কচকচে নোট উৎপাদন হয়, সেই নতুন নোটে বেতন হয় না বলে একটু আক্ষেপ দেখেছি তাঁদের মধ্যে। যে টাকা তাঁরা তৈরি করেন, সেই টাকা ভুলক্রমে বাসা থেকে অফিসে প্রবেশের সময় সঙ্গে পাওয়া গেলে তার জন্যও তাঁদের শাস্তি ভোগ করতে হয়। অধিকাংশ কর্মচারী, কর্মকর্তাকে ওভার টাইম কাজসহ পুরো দিনটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়; কারণ উৎপাদন এলাকায় মুঠোফোন নেওয়া নিষিদ্ধ।
দেশখ্যাত শিল্পীদের নকশায় টাকা ছাপা হয় গাজীপুরের টাকশালে: বিশাল এক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মানুষের হাতে কাগজের টাক বা ধাতব পয়সা আসে। কখন কী পরিমান মুদ্রা ছাড়া হবে তার আছে হিসাব পদ্ধতি। মুদ্রার নক্সা করতে যুক্ত করা হয় দেশের স্বনামখ্যাত শিল্পীদের। টাকশালের যাত্রা শুরুতে বিভিন্ন মানের ৩০ কোটি নোট ছাপানোর সক্ষমতা ছিল। বেড়ে এখন ১শ’ ২০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। কাগজের নোটের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার কথা বিবচেনা করে বদল করা হয় সময়ে সময়ে, যার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতি বছর ব্যয় করতে হয় ৫শ’ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে মুদ্রা ছাপার সকল সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকশাল প্রতিষ্ঠার পর বহু বছর এর সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্থবির ছিল, সংকটের ঝুঁকিও ছিল। এখন সব প্রযুক্তি সফটওয়্যার ভিত্তিক।
টাকশালে কোন সমস্যা হলে জার্মানীতে বসে মেরামত সম্ভব। নোট ছাপানোর সক্ষমতাও বেড়েছে চারগুণ। দেশের বরেণ্য চিত্র শিল্পীরা মুদ্রার নক্সা করেন। সরকার পাল্টালে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতবাদ অনুসারে মুদ্রার নকশাও পাল্টায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ছবি বাদ দেবার মধ্য দিয়ে নক্সা পরিবর্তনে রাজনীতি শুরু হয়। তবে ছবি টাকার নকল রোধে সহায়ক। মুদ্রা ছাপানো নিয়ে নিরীক্ষা চলে নিয়মিত। দু’দশক আগে প্লাস্টিকের তৈরি ১০ টাকার নোট ছাড়া হয়েছিল, নানা জটিলতায় তা ক’বছরেই বাতিল হয়। সেটাকে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখেন এই নোট প্রবর্তনকালীন গর্ভনর। কাগুজে মুদ্রা আবিষ্কারের অনেক আগে তৈরি করা হয়েছিল ধাতব মুদ্রা। তুরস্কের এশিয়া মহাদেশীয় অংশের লিডিয় জাতি সর্বপ্রথম মুদ্রা তৈরি করে। লিডিয়দের মুদ্রা তৈরির প্রায় কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন ভারতে মুদ্রা তৈরি এবং প্রচলন হয়। ধারণা করা হয় এখানে মুদ্রার প্রচলন হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নামটিই মুদ্রার সরকারি নাম হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ তারিখ থেকে ১ টাকার নোট প্রচলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব ব্যাংক নোট চালু করে। ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত চালু থাকা এই নোট ছাপা হয় ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে। পরে সুইজ্যারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ভারত, কোরিয়া, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের নোট ছাপা হয়। ১৯৮৯ সালে গাজীপুরে দেশের প্রথম ও একমাত্র আধুনিক টাকশাল স্থাপিত হয়।
বাংলাদেশে মুদ্রার ইতিহাস : ভাষাবিদগণের মতানুসারে টাকা শব্দটি সংস্কৃত টঙ্ক শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। এক টাকার শতাংশকে পয়সা নামে অভিহিত করা হয়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বাংলাদেশ ব্যাংক নামে পরিচিত টাকার কাগুজে নোট মুদ্রণ এবং মুদ্রা প্রস্তুতকরণ এবং তা বাজারে প্রচলনের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের রাজত্ব ছিল। তবে সে সময়ের মুদ্রা পাওয়া না যাওয়ায় তাদের টাকশাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। দ্বাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী সেনরাজারা বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে রাজত্ব করে। সেনযুগে পালযুগের মতো মুদ্রার পরিবর্তে কড়ির প্রচলন ছিল। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত ২০০ বছর মুসলমান সুলতানরা বাংলাদেশে স্বাধীন রাজত্ব কায়েম করার ফলে বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার পুনরুজ্জীবন ঘটে। কাপড় ও চিনিসহ বাংলাদেশের বহু পণ্য বিদেশে রফতানি হয়। ফলে বাংলাদেশ তখন সম্পদশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। সে সময়ে বাংলাদেশের বাগেরহাট এলাকার খলিফাতাবাদ টাকশাল, রাজশাহীর মাহিসন্তোষের বারবাকাবাদ টাকশাল, সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী মুয়াজ্জমাবাদ টাকশাল, ফখরুদ্দিন মুবারক শাহরে রাজধানী সোনারগাঁওয়ের টাকশাল, চট্টগ্রাম টাকশালসহ প্রায় ৮০টি টাকশালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। স্বাধীন সুলতানি শাসন সময়ের পর মুঘল আমলেও বাংলাদেশে টাকশালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মুঘল যুগের জাহাঙ্গীরনগর টাকশালে তৈরি মুদ্রার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। যার পাশাপাশি কাগুজে নোটেরও প্রচলন হয়। তবে তা আধুনিক মানের ছিল না। ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নোটটি সবচেয়ে পুরনো হিসেবে ধরা হয়। এই উপমহাদেশে লখনৌতি গঙ্গানদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত বাংলার আদি টাকশাল শহর। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই লখনৌ রাজধানী শহর হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং প্রথম টাকশাল হওয়ারও গৌরব অর্জন করে। ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টাকশাল শহর হিসেবে এটি চালু ছিল। ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ৭৪০ হিঃ থেকে ৭৫০ হিঃ পর্যন্ত রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়ে। তাঁর আমলের সব মুদ্রার সুস্পষ্টভাবে আঁকা হয়েছে, সোনারগাঁও টাকশালের কথা। সেখান থেকে সর্বশেষ মুদ্রা তৈরি হয় ১৪২১ সালে। সোনারগাঁও এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টাকশাল শহর হিসেবে পরিচিত ছিল।
উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুদ্রা আইন পাস হয় ১৮৩৫ সালে ও কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয় ১৮৫৭ সালে। কাগজের মুদ্রার প্রচলন করেন লর্ড ক্যানিং। সেই সময় যে অভিন্ন মুদ্রা ছিল তার নাম রুপি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ মুদ্রাকে টাকা বলতো। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুদ্রার নাম ছিল রুপি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তখনো মুদ্রাকে টাকা বলা হতো। টাকা শব্দটি সংস্কৃত ‘টঙ্কা’ শব্দ থেকে এসেছে। ১৯৮৯ সালে প্রিন্টিং প্রেসটি চালু হয় সর্বপ্রথম ১০ টাকার নোট ছাপার মাধ্যমে। টাকা ছাপানোর জন্য বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানি করা হয় সুইজারল্যান্ড থেকে। ৫০০ টাকার নোট ছাপানো হয় জার্মানি থেকে। এছাড়া ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম ১০ টাকা মূল্যমানের পলিমার নোট ছাপা হয়। ১০ টাকার পলিমার নোট তৈরি হয় অস্ট্রেলিয়ায়। ১ ও ৫ টাকা মূল্যমানের যে ধাতব মুদ্রা বাংলাদেশে প্রচলিত তা তৈরি করা হয় কানাডায়। বাংলাদেশে ১ টাকার ধাতব মুদ্রা চালু হয় ৯ মে ১৯৯৩ সালে এবং ৫ টাকার ধাতব মুদ্রা চালু হয় ১ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে। বাংলাদেশে নতুন নোট বাজারে চালু করার ক্ষমতা আছে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের। ১ ও ২ টাকার নোটের মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের। এগুলোতে স্বাক্ষর থাকে অর্থ সচিবের। ১ ও ২ টাকার নোট ছাড়া বাকি সব বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট, এগুলোতে স্বাক্ষর থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের। বাংলাদেশে জাল নোটের ইতিহাস খুবই পুরোনো। ১৯৭২ সালে ১০০ টাকার জাল নোট ব্যাপক হারে বিস্তার করে সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়। বর্তমানে ঈদ, পূজা, পার্বনকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠে জালিয়াত চক্র। বড় বড় মার্কেট থেকে শুরু করে ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও জাল নোট সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয় জাল নোট কারবারিরা। ৫০ টাকার নোট থেকে শুরু করে ১০০, ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট জাল করা হচ্ছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে জাল নোট সরবরাহ ও বাজারজাতকরণে জড়িতদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৫ হাজার ৮৪টি মামলা হয়েছে। এরপরও ঠেকানো যাচ্ছে না জাল নোট কারবারিদের। জাতিসংঘের সদস্য দেশ ১৯৩টি, প্রতিটি দেশই আঞ্চলিক মুদ্রা, জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণে পাসপোর্ট, ডাক টিকেট, ধন দৌলত হস্তান্তরে প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাপী ৩৭ হাজার ৩১৪টি সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ২০ লক্ষাধিক কর্মকর্তা/কর্মচারীর নিবিড় তত্ত্বাবধানে কারেন্সি পাসপোর্ট প্রিন্টিং হচ্ছে। তাদের বেতন হাজার ডলার থেকে লাখ ডলার পর্যন্ত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের কারেন্সী প্রিন্টিং প্রযুক্তিবিদ্যায় কোন ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট না থাকাতে লোভনীয় পদগুলোতে কোন বাংলাদেশীর চাকুরী হচ্ছে না। সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বাংলাদেশ লিঃ ৩৮ বছরে স্বাধীনদেশের আশা আকাক্সক্ষা পূরণে চরম ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণে স্বাধীনতার চার দশক পরও টাকা পাসপোর্ট, ডাকটিকেট, দলিলের স্টাম্প প্রিন্টিং সম্পূর্ণভাবে বিদেশের উপর নির্ভরশীল। বিদেশে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছাপাতে প্রতিবছর ৩/৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। জাতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন সম্প্রতি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মূল সনদপত্র ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করে। নিম্নমানের কাগজ ও প্রিন্টিংয়ের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মূল সনদপত্র অবমূল্যায়ন করা হয়। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় টাকশালে কর্মরত ৭১৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারী কারোরই কারেন্সী ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি/সিকিউরিটি প্রিন্টিং টেকনোলজিতে ন্যূনতম শিক্ষা প্রশিক্ষণ নেই। জাতীয় ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিতে কারেন্সী প্রযুক্তিবিদের নিয়োগ নিশ্চিত করে উন্নত বিশ্বের আবিস্কৃত মেশিনারি সংযুক্ত করা হলে দেশের প্রিন্টিং চাহিদা পূরণ হতো। প্রিন্টিং টেকনোলজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও টাকশালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো বাংলাদেশ।