Wednesday 27 February 2019

পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত আর্মেনিয়ান গির্জা: এক ঔপনিবেশিক স্মৃতি

পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত আর্মেনিয়ান গির্জা: এক ঔপনিবেশিক স্মৃতি


মুহাম্মদ নূরে আলম : সাদা-সোনালি রঙের মূল ফটকটির আকার-নকশা এই দেশি চোখে ঠিক পরিচিত ঠেকে না। বাঁ দিকের দেয়ালে নামফলকে ইংরেজিতে লেখা: আর্মেনিয়ান চার্চ, ১৭৮১। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা একজন মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন। ইনিই শংকর ঘোষ। আর্মেনীয় গির্জা ও কবরস্থানের দেখভালকারী। ৩২ বছর ধরে এ দায়িত্বে আছেন। গির্জা-পালক (ওয়ার্ডেন) আর্মেন আর্সেলিয়ানের অনুপস্থিতিতে শংকর একাই পুরোটা আগলে রাখেন।
ঐতিহ্যবাহী এই গীর্জার সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। আর্মেনীটোলা বা আর্মানিটোলা নামটিও এসেছে আর্মেনীয়দের কারণে। ধারণা করা হয় এই গীর্জা নির্মাণের আগে তাদের ছোট একটি উপাসনাগার ছিলো। আর্মনিয়ান গির্জার প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৮১ সালে। এর আগে এখানে ছিলো শুধু কবরস্থান। ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়দের মৃত্য হলে এখানে কবর দেয়া হতো। অন্য সব গির্জা থেকে এইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই গির্জার আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য সমাধিসৌধ। ১৭৮১ সালে নির্মিত চার্চটি ঢাকায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। অন্য সব ক্যাথলিক/ব্যাপ্টিস্ট চার্চ থেকে এই চার্চ সম্পূর্ণ আলাদা। এখনও আর্মেনীয়দের অবশিষ্ট বংশধর এই চার্চের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। ঐতিহ্যবাহী এই চার্চের সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। আনুমানিক সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে দুই একজন করে আর্মেনীয় বনিক ঢাকায় আশা শুরু করে। ধারনা করা হয় তাদের নাম অনুসারে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নামকরণ করা হয়। ৭০০ ফুট লম্বা গির্জাটির রয়েছে ৪টি দরজা আর ২৭টি জানালা। ভেতরে সারি সারি চেয়ার সাজানো রয়েছে আর রয়েছে পাদ্রি বসার জন্য একটি বেদি। গির্জার আশেপাশে রয়েছে প্রায় শ’'খানেক আর্মেনিয়ানের কবর। গির্জাটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। সারা বছরই তালা মারা থাকে। অনুমতি সাপেক্ষে ভিতরে ঢুকা যায়। আশে পাশের ছবি তোলার অনুমতি দিলেও গির্জার ছবি তোলার অনুমতি দিবে না। এই গির্জা এখনও পরিচালনা করছে আর্মেনিয়ানদের শেষ বংশধররা।
আরমানিটোলার এই গির্জাটি ঢাকার একমাত্র আর্মেনীয় স্থাপনা। মুনতাসীর মামুন ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরীতে বলেছেন, গির্জা তৈরির আগে এখানে একটা ছোট উপাসনালয় ছিল। আর এর চারপাশে ছিল আর্মেনীয়দের সমাধিস্থল। পরে ১৭৮১ সালে বড় করে গির্জা তৈরির সময় ছয়টি কবরও উপাসনাঘরের ভেতরে পড়ে যায়। আর্মেনীয় গির্জায় এখন আর প্রার্থনাসভা বসে না।
আর্মেনীয় চার্চের ভেতরের সমাধি: কেয়ারটেকার শংকর ঘুরিয়ে দেখান পুরো সমাধিভূমি। এটা পোগজ স্কুলের পোগজ সাহেবের কবর। ওইটা গ্রেগরি সাহেবের কবর। উনি ওই সময়ে ঢাকার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ ছিলেন। এই পোগজ সাহেবের পুরো নাম এন পি পোগজ। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটির এ কমিশনার ১৮৪৮ সালে পোগজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আর এভিয়েটর গ্রেগরির সমাধির এপিটাফে লেখা আছে, ১০৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। পুরোনো কবরের এপিটাফগুলো সব মেঝেতে বিছানো। নতুন কিছু সমাধি মাটি থেকে ৬-৭ ইঞ্চি উঁচুতে। সমাধিগুলোর এপিটাফের ভাষা আর্মেনীয় ও ইংরেজি।
দেখতে দেখতে কিছু এপিটাফের লেখায় চোখ আটকে যায়। ১৯২৯ সালে ২৪ বছর বয়সে মারা যাওয়া ম্যাক এস ম্যাকারটিকের এপিটাফে তাঁর বাগদত্তার পক্ষ থেকে লেখা আছে, ‘খুব ভালোবাসতাম বলেই তাকে এতটা মনে পড়ে। আমার স্মৃতিতে সে খুব দূরের কেউ নয়। অজস্র বোবা কান্নায় এখনো তাকে ভালোবাসি, মনে করি, কাছে পেতে চাই। ১৮৭৪ সালে মাত্র তিন বছর বয়সে মারা গেছে কন্সট্যান্স পিটারস। তাঁর এপিটাফের ভাষাও কেমন নাড়া দিয়ে যায়, আমার জন্য কেঁদো না তোমরা, কেন শোক করো আর/আমিতো হারিয়ে যাইনি, শুধু একটু আগে চলে গেছি।
সামাজিক-ইতিহাসবিদ ও স্থপতি শামীম আমিনুর রহমানের ঢাকায় ইউরোপীয়দের সমাধিভূমি: জানা-অজানা নিবন্ধ থেকে জানা যায়, আর্মেনীয়রা ব্যবসার উদ্দেশে আঠারো শতকের দিকে ঢাকায় আসতে শুরু করে। লবণ-চামড়া-কাপড় আর পাটের ব্যবসা করে আর জমিদারি কিনে অল্প সময়েই তারা ঢাকার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। যে অঞ্চলে আর্মেনীয়রা বসবাস করতে শুরু করে তার নাম হয়ে যায় আর্মানিটোলা। তারপর কোম্পানি আমলের শেষ দিকে এসে ব্যবসা পড়তে শুরু করে। আর পাকিস্তান আমলে ঢাকায় আর্মেনীয়দের বাস প্রায় উঠে যায়। ১৯৯১ সালে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা নেফিয়েট স্টেফানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে আর্মেনীয়দের সম্পর্কের শেষ সূত্রটিও হারিয়ে যায়। শামীম আমিনুর রহমান বলেন, অন্য বিদেশি বণিক গোষ্ঠীর মতো আর্মেনীয়রা নিজেদের আলাদা করে রাখেনি। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশার চল ছিল আর্মেনীয়দের মধ্যে।
গীর্জার বিবরণঃ ঐতিহ্যবাহী এই গীর্জার সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। গীর্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশে যে বিস্তৃত জমি তা দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক নামের এক আর্মেনীয়। আর লোকশ্রুতি অনুযায়ী গীর্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন আর্মেনীয়। এরা হলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ। গীর্জাটি লম্বায় সাড়ে সাতশো ফুট, দরজা চারটি, জানালা সাতটি। এর পাশেই ছিলো একটি ঘড়িঘর। এটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ঘড়িঘরটি ভেঙে গিয়েছিলো বলে জানা যায়। গীর্জায় বৃহৎ আকারের একটি ঘণ্টা ছিলো। এই ঘণ্টা বাজার শব্দ নগরের প্রায় সব স্থান থেকে শুনা যেত বলে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই ঘণ্টার শব্দ শুনেই নাকি অধিকাংশ ঢাকাবাসী নিজ নিজ সময়ঘড়ি ঠিক করে নিতেন। ১৮৮০ সালের দিকে আর্মেনী গীর্জার এই বিখ্যাত ঘণ্টাটি স্তব্ধ হয়ে যায়, যা আর কখনো বাজেনি।
আর্মেনীয়দের বিবরণঃ ঠিক কবে আর্মেনীয়রা এ দেশে এসেছিলো তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ফার্মগেটে অবস্থিত গির্জার প্রাঙ্গনে কয়েকজন আর্মেনীয়র কবর আছে। তাদের মৃত্যু হয়েছিলো ১৭১৪-৯৫ সালের মধ্যে। ফলে আন্দাজ করা যায়, মোগল আমলেই তারা এ দেশে আসতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ভাগ্যান্বেষণ করা। সেসময় সেটা তারা বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছিলো।
বর্তমানে ঢাকায় আঠারোটি আর্মেনী বংশদ্ভূত পরিবার রয়েছে বলে শোনা যায়। তবে কোন কালেই ঢাকায় আর্মেনীয়দের সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিলো না। আর্মেনীয়রা কবে ঢাকায় এসেছিলেন তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় মুঘল আমলে ভাগ্য বদলাতে দেশ-বিদেশ থেকে যখন অনেকেই এসেছিলেন ঢাকায়, সম্ভাব্য সপ্তদশ শতকে আর্মেনীয়রাও তখন দু’-একজন করে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে। পূর্ববঙ্গে লবণের ঠিকাদারদের অধিকাংশই ছিলেন আর্মেনীয়। ঠিকাদারি ছাড়াও পান, পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় ছিলো তাদের কর্তৃত্ব। জমিদারীও ছিলো অনেকের। উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে কয়েকটি আর্মেনীয় পরিবারের নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো- পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস। এদের বিত্তের ভিত্তি ছিলো জমিদারি ও ব্যবসা। বিদেশি হয়েও জমিদারি কেনার কারণ হতে পারে- আভিজাত্য অর্জন এবং সমাজের শীর্ষে থাকা। এসব ধনী আর্মেনীয়নরা ঢাকায় নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি।
 যেমন ফরাসগঞ্জের বর্তমান রূপলাল হাউস ছিলো আরাতুনের। মানুক থাকতেন সদরঘাটে। বর্তমানে ‘বাফা’ যে বাড়িতে, সেটি ছিলো নিকি পোগজের। পরে আর্মেনীটোলায় নির্মিত হয়েছিলো ‘নিকি সাহেবের কুঠি’। আনন্দরায় স্ট্রিটে ছিলো স্টিফানের বাড়ি। যেখানে তাজমহল সিনেমা রয়েছে সেখানে ছিলো পানিয়াটির অট্টালিকা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি অনেক আর্মেনীয় ঝুঁকে পড়েন ব্যবসার দিকে। চা, মদ, ইউরোপীয় জিনিসপত্র, ব্যাংক ইত্যাদি। ১৮৫৬ সালে সিরকোরই ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, যা পরিচিত ছিলো ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে। কিছুদিনের মধ্যেই এই ব্যবসা বেশ জমে উঠে এবং কালক্রমে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ঢাকার প্রধান যানবাহন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর্মেনীয়দের অনেকের জমিদারি হাতছাড়া হতে থাকে। এমনিতে আর্মেনীয়রা খুব রক্ষণশীল, কিন্তু ঐ সময় চলছিলো একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এরা তখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অনেকে জমিদারি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য কলকাতায় চলে যান। ফলে উনিশ শতকের শেষার্ধে ষাট-সত্তরের দশক থেকে সম্প্রদায়গতভাবে আর্মেনীয়দের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে। তখন ঢাকা শহরের বিভিন্ন কাজকর্মে, সভাসমিতিতে আর্মেনীয়রা নিজেদের যুক্ত করে নেন। নিকি পোগজ প্রতিষ্ঠা করেন পোগজ স্কুল। আরাতুন ছিলেন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার নয়জন কমিশনারের মধ্যে দুইজন ছিলেন আর্মেনীয়- জে.জি. এন পোগজ এবং এন.পি. পোগজ।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার যে কোন প্রান্ত থেকে গুলিস্তান আসার পর রিক্সা যোগে আর্মেনিয়ান চার্চ যাওয়া যায়। ঢাকার যে কোন প্রান্ত থেকে বাবু বাজার ব্রিজ এরপর রিক্সায় আর্মেনিয়ান চার্চ। ঢাকার শাহবাগ বা আজিমপুর থেকে রিকশায় বলতে হবে আরমানিটোলা গীর্জা।

No comments:

Post a Comment