১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’
প্রকাশিত: শুক্রবার ১২ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট সংস্করণ daily sangram
মুহাম্মদ নূরে আলম: ১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’ কবি, বাংলাদেশের ধ্রুপদী ও প্রগতিশীল ঘরানার কবি। কবি নওশাদ নূরী একজন অবাঙালি উর্দুভাষী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার স্পষ্ট সমর্থন ও ‘মহেঞ্জাদারো’ নামে এক সুন্দর কবিতা রচনা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা নওশাদ নূরীর ‘মহেঞ্জোদারো’। এ কবিতা ছাপা হওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে দেশ ছাড়ার হুকুম দেন। কবি দেশ ছেড়ে যান। ১৯৬০ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা ফিরে আসেন। (বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী) তাজউদ্দিন আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় উর্দু সাপ্তাহিক ‘জারিদা’; ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নওশাদ নূরী।
তাঁর কাব্য রচনার ভাষা উর্দু। ষাটের দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যের জগতে তাঁর উপস্থিতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতার অনুপম বুননশৈলী, ভাবপ্রকাশের ধারা চিরায়ত উর্দু কাব্যের আধুনিক উত্তরাধিকার বহন করে। শব্দের গভীর দ্যোতনা, পরিমিত উপমা, ছন্দময় চিত্রকল্প এসব কবিতাকে অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছে। একজন উর্দুভাষী কবি হিসেবে বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপকল্প, রাজনীতি-সমাজজীবন উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সীয়ানা মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু ভাষাগত ভিন্নতার কারণে তিনি বাঙালি পাঠকদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি ও সমাদর পাননি। উর্দু-ফার্সির পা-িত্য, পরোপকারী হৃদয় ও খোলামেলা স্বভাবের জন্যে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে তাঁর অসম্ভব গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাঙালি জাতির অহংকার ভাষা আন্দোলন, মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় এবং দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর করালগ্রাস থেকে একটি স্বাধীন ভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে মুক্ত করবার আন্দোলনে একজন উর্দুভাষী মানুষ কবি নওশাদ নূরীর ত্যাগ সত্যিই আমাকে বিমোহিত করে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল একজন মানুষ নওশাদ নূরীকে নিয়ে তার সমসাময়িক, অনুজ এবং বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিকের কলম থেকে যে নির্যাস চিত্রায়িত হয়েছে তা বাঙালির ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে।
বোহেমিয়ান ও জাত কবি নওশাদ নূরী ১৯২৬ সালের ২১ অক্টোবর বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার বসন্তপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নওশাদ নূরী কবির ছদ্মনাম। তার আসল নাম মোহাম্মদ মোস্তফা মাসুম হাশমী। তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতীম কবি ও গীতিকার ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রতিষ্ঠিত প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের বিহার শাখার সেক্রেটারি। ১৯৫১ সাল। নওশাদ নূরী বিএন কলেজ, পাটনা থেকে স্নাতক সম্পন্ন ও প্রগতিশীল লেখক সমিতিতে যোগদান করেন। যেখানে উর্দু কবি ও সোহেল আজিমাবাদী, আখতার ওরায়নভি, মুখতার উদ্দিন আরজু ও কালাম হায়দারির মতো লেখকদের তার সংশ্রব ঘটে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হন।
নবীন ভারত তাদের নব্য স্বাধীনতাকে ‘ঐশ্বর্যম-িত’ করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দান-ভা-ারের দুয়ারে। সে সময় প-িত জওহরলাল নেহেরুকে মার্কিন সাহায্য নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্যই লিখলেন কবিতা দে দে রাম ফেলাদে রাম, দেনে ওয়ালা সীতারাম’। কবিতাটি প্রকাশের পরপরই সারাদেশে আলোড়ন তোলে। জওহরলাল নেহেরু কবি নওশাদ নূরীর নামে হুলিয়া জারি করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। প্রতিবাদী এই কবিতা লেখার দায়ে গ্রেফতারের এড়াতে ১৯৫১ সালে ঢাকা (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন । তিনি সামরিক অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের চাকরি পান। পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় তাঁর পোস্টিং হয়। তারপর আপন করে নিলেন বাংলাদেশটাকে। জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার ওপরে উঠে অবাঙালি উর্দুভাষী কবি হয়েও ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার সপক্ষে অবস্থান নিলেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামে লিখলেন কবিতা।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে উর্দু সাপ্তাহিক জারিদায় বাঙালি জনতার ছয় দফা আন্দোলনেও সমর্থন জানালেন। লিখলেন, ‘তেরি নাজাত মেরি নাজাত, ছে নুকাত ছে নুকাত’ (তোমার মুক্তি আমার মুক্তি, ৬ দফা ৬ দফা)। বস্তুত ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ারদির নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন করা, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলন, সে সময়ের পাকিস্তানি তথ্যমন্ত্রীর রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী উক্তির প্রতিবাদ, ইয়াহিয়া তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা ও লোমহর্ষক মর্মান্তিক নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন। ১৯৫২ সালে তিনি "মনেজোদারো " শিরোনামে আরেকটি কবিতা লিখেন। এ কবিতাটির অনুপম কাব্যশৈলীর মাধ্যমে তিনি কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (পাকিস্তান এর প্রতিষ্ঠাতা) দ্বারা বাঙালিদের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানান। এ কবিতাটির জন্য নওশাদ নূরীকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করা হয়। তিনি চাকরি ছেড়ে ১৯৬০ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন।
ঢাকায় ফিরে নওশাদ নূরী একটি বই দোকান খুলেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ১৯৬৪-৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট -এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত উর্দু সাপ্তাহিক "রুদাদ"-এর সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ এবং ৮৮ সালে এশীয় কবিতা উৎসবে তিনি লিঁয়াজো অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পারন করেন। তাঁর দক্ষতা ও তৎপরতার ফলে আহমদ ফারাজ, হেমায়েত আলী শায়ের, জমির হাসান জাফরি, কিশওয়ার নাহিদ -এর ও পারভীন শাকির মত পাকিস্তানী কবি এশীয় কবিতা উৎসব অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে আসার কিছু সময়ের মধ্যেই কবি নওশাদ নূরী রাজনৈতিক মতাদর্শে মওলানা ভাসানী, কমরেড আবদুল হকসহ খ্যাতিমান রাজনৈতকি ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে ভীষণ পছন্দ করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কবি নওশাদ নূরীর অনেক আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে গেলেও তিনি থেকে গেলেন ঢাকার মায়ায়।
কবি নওশাদ নূরী একজন আপাদমস্তক কবি ছিলেন। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ষান্মাসিক ‘মনন রেখা’র বর্তমান (৪র্থ) সংখ্যাটিতে খ্যাতিমান লেখকদের স্মৃতিচারণ পড়ে আপনাদের তাই মনে হবে। প্রকৃতির কবিরা কখনো কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না। আপোস করেন না। কবি নওশাদ নূরীও তাই সময়ের প্রয়োজনে জ্বলে উঠেছেন বারবার। কবি আসাদ চৌধুরী তার মন্তব্যে বলেছে ‘কবিতায় নওশাদের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, তাঁর চিত্রকল্প অসাধারণ, তুলনাহীন। কোথাও বাড়াবাড়ি নেই।’
নওশাদ নূরী ছিলেন বাংলাদেশের উর্দু লেখকদের অভিভাবক। ভারত-পাকিস্তানের যে কোনো উর্দু কথাশিল্পী ঢাকায় এলে প্রথমে তাঁর সাথেই যোগাযোগ করতেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের নামকরণের পরামর্শটাও কবি নওশাদ নূরী দিয়েছিলেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক কবি। তার বিবরণ পাই ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীর বর্ণনায়। সময়ে সময়ে কলম ধরতেন জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আক্রমণ করে বসে ফিলিস্তিন। তখন তিনি আক্রমণের প্রতিবাদে কবিতা লিখে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। ১৯৮২ সালে ইসরাইল আবার আক্রমণ করে বসে লেবাননের উপর। তখন তিনি প্রতিবাদে ‘রাহগুজার আশনাই’ কবিতা লিখেন। ইরাকের উপর আমেরিকার আক্রমণের প্রতিবাদে লিখেন ‘তুফান সাহারা’। এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোক্তা এবং সমন্বয়কারী হিসেবেও ভূমিকা রাখেন যা একজন আন্তর্জাতিক চিন্তা ও চেতনার কবির পক্ষেই সম্ভব। যে মানুষটির এমন জীবন-ধারা তাঁর লেখা পাঠ যে সচেতন পাঠকের আরাধ্য হয়ে ওঠে। পাঠকের সেই তৃষ্ণা মেটাতেই লেখক ও গবেষক আইয়ুব হোসেন এবং শামীম জামানভি তাঁদের সুসম্পাদনে সংকলিত করে পরিবেশন করেছেন ‘নওশাদ নূরীর কবিতা’ গ্রন্থটি। এতে রয়েছে কবি নওশাদ নূরীর ৩০টি কবিতা ও ৫টি গজল। অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত লেখক ও কবি আসাদ চৌধুরী, ইনায়াতুল্লাহ সিদ্দিকী, বশীর আল্ হেলাল, মোহাম্মদ হাসান, জাফর আলম, আল মুজাহিদী, মিজারুল কায়েস, সৈকত রুশদী এবং হাইকেল হাশমী।
সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবর্তনের পরিক্রমায় কবি নওশাদ নূরীর অবদান ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে মনে হয়। কারণ অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে একই সূত্রে গাঁথা এই মানুষটি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়নি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কীর্তিমান কবি নওশাদ নূরীকে তুলে ধরা জরুরী হয়ে পরেছে। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ লোক উর্দু ভাষায় কথা বলেন। এখানে বসবাসরত বিহারি কবি-লেখকেরা উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। অগ্রগণ্য উর্দু কবি নওশাদ নূরী আমৃত্যু ঢাকায় বাস করেছেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামের সেই কবিতায় তিনি লেখেন: ‘বাংলা সাহিত্যের দৌলত আজ বিপন্ন/ হানাদারেরা এগিয়ে আসছে/ পত্র, প্রস্তর, চর্ম, প্যাপিরাস, তাম্র ও কাংসপত্রে সংরক্ষণ করো/ বাংলার মূল্য ও চেতনাকে।/ কারণ সেই অশুভ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।/ যা এক নগরকে উল্টে-পাল্টে দেয়/ এক মৃতের স্তুপে।’
এখানকার উর্দু-ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে ঢাকার নবাব খাজা পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। উনিশ ও বিশ শতকে এই পরিবারের যাঁরা উর্দুতে সাহিত্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে খাজা হায়দার জান, খাজা আসাদউদ্দীন কাওকাব, খাজা আবদুর রহিম সাবা, খাজা আহসানুল্লাহ শাহীন, খাজা নাজিমউদ্দীনের নাম করা যায়। বাঙালি বিস্মৃতি বিলাসী। সে যেমন তার শত্রুর মুখ ভুলে তাকে রাজাসনে বসায় তেমনি বন্ধুকৃত্যও ভুলে যায় অবলীলায়। উর্দু কবি হিসেবে বাংলাদেশে নওশাদ নূরীর ঠাঁই বন্ধুর কাতারে হবে, না কি শত্রু শিবিরে সে বিচারের ভার ইতিহাসের। উল্লেখ্য, মনন রেখ। বর্ষ-২ সংখ্যা : ৪। সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০১৮। প্রচ্ছদ : মামুন হোসাইন, মূল্য ১০০ টাকা, উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীকে নিয়ে একটি সুন্দর প্রবন্ধ প্রকাশ করে। উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীর কবিতার বাংলা অনুবাদ সঙ্কলন: নওশাদ নূরীর কবিতা সম্পাদনা: আইয়ুব হোসেন ও শামীম জামানভি, প্রচ্ছদ: ম্যাস্-লাইন প্রিন্টার্স, প্রকাশনা হাক্কানী পাবলিশার্স, দাম: ১২৫ টাকা।
তাঁর কাব্য রচনার ভাষা উর্দু। ষাটের দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যের জগতে তাঁর উপস্থিতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতার অনুপম বুননশৈলী, ভাবপ্রকাশের ধারা চিরায়ত উর্দু কাব্যের আধুনিক উত্তরাধিকার বহন করে। শব্দের গভীর দ্যোতনা, পরিমিত উপমা, ছন্দময় চিত্রকল্প এসব কবিতাকে অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছে। একজন উর্দুভাষী কবি হিসেবে বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপকল্প, রাজনীতি-সমাজজীবন উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সীয়ানা মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু ভাষাগত ভিন্নতার কারণে তিনি বাঙালি পাঠকদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি ও সমাদর পাননি। উর্দু-ফার্সির পা-িত্য, পরোপকারী হৃদয় ও খোলামেলা স্বভাবের জন্যে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে তাঁর অসম্ভব গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাঙালি জাতির অহংকার ভাষা আন্দোলন, মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় এবং দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর করালগ্রাস থেকে একটি স্বাধীন ভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে মুক্ত করবার আন্দোলনে একজন উর্দুভাষী মানুষ কবি নওশাদ নূরীর ত্যাগ সত্যিই আমাকে বিমোহিত করে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল একজন মানুষ নওশাদ নূরীকে নিয়ে তার সমসাময়িক, অনুজ এবং বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিকের কলম থেকে যে নির্যাস চিত্রায়িত হয়েছে তা বাঙালির ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে।
বোহেমিয়ান ও জাত কবি নওশাদ নূরী ১৯২৬ সালের ২১ অক্টোবর বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার বসন্তপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নওশাদ নূরী কবির ছদ্মনাম। তার আসল নাম মোহাম্মদ মোস্তফা মাসুম হাশমী। তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতীম কবি ও গীতিকার ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রতিষ্ঠিত প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের বিহার শাখার সেক্রেটারি। ১৯৫১ সাল। নওশাদ নূরী বিএন কলেজ, পাটনা থেকে স্নাতক সম্পন্ন ও প্রগতিশীল লেখক সমিতিতে যোগদান করেন। যেখানে উর্দু কবি ও সোহেল আজিমাবাদী, আখতার ওরায়নভি, মুখতার উদ্দিন আরজু ও কালাম হায়দারির মতো লেখকদের তার সংশ্রব ঘটে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হন।
নবীন ভারত তাদের নব্য স্বাধীনতাকে ‘ঐশ্বর্যম-িত’ করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দান-ভা-ারের দুয়ারে। সে সময় প-িত জওহরলাল নেহেরুকে মার্কিন সাহায্য নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্যই লিখলেন কবিতা দে দে রাম ফেলাদে রাম, দেনে ওয়ালা সীতারাম’। কবিতাটি প্রকাশের পরপরই সারাদেশে আলোড়ন তোলে। জওহরলাল নেহেরু কবি নওশাদ নূরীর নামে হুলিয়া জারি করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। প্রতিবাদী এই কবিতা লেখার দায়ে গ্রেফতারের এড়াতে ১৯৫১ সালে ঢাকা (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন । তিনি সামরিক অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের চাকরি পান। পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় তাঁর পোস্টিং হয়। তারপর আপন করে নিলেন বাংলাদেশটাকে। জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার ওপরে উঠে অবাঙালি উর্দুভাষী কবি হয়েও ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার সপক্ষে অবস্থান নিলেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামে লিখলেন কবিতা।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে উর্দু সাপ্তাহিক জারিদায় বাঙালি জনতার ছয় দফা আন্দোলনেও সমর্থন জানালেন। লিখলেন, ‘তেরি নাজাত মেরি নাজাত, ছে নুকাত ছে নুকাত’ (তোমার মুক্তি আমার মুক্তি, ৬ দফা ৬ দফা)। বস্তুত ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ারদির নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন করা, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলন, সে সময়ের পাকিস্তানি তথ্যমন্ত্রীর রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী উক্তির প্রতিবাদ, ইয়াহিয়া তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা ও লোমহর্ষক মর্মান্তিক নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন। ১৯৫২ সালে তিনি "মনেজোদারো " শিরোনামে আরেকটি কবিতা লিখেন। এ কবিতাটির অনুপম কাব্যশৈলীর মাধ্যমে তিনি কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (পাকিস্তান এর প্রতিষ্ঠাতা) দ্বারা বাঙালিদের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানান। এ কবিতাটির জন্য নওশাদ নূরীকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করা হয়। তিনি চাকরি ছেড়ে ১৯৬০ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন।
ঢাকায় ফিরে নওশাদ নূরী একটি বই দোকান খুলেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ১৯৬৪-৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট -এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত উর্দু সাপ্তাহিক "রুদাদ"-এর সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ এবং ৮৮ সালে এশীয় কবিতা উৎসবে তিনি লিঁয়াজো অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পারন করেন। তাঁর দক্ষতা ও তৎপরতার ফলে আহমদ ফারাজ, হেমায়েত আলী শায়ের, জমির হাসান জাফরি, কিশওয়ার নাহিদ -এর ও পারভীন শাকির মত পাকিস্তানী কবি এশীয় কবিতা উৎসব অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে আসার কিছু সময়ের মধ্যেই কবি নওশাদ নূরী রাজনৈতিক মতাদর্শে মওলানা ভাসানী, কমরেড আবদুল হকসহ খ্যাতিমান রাজনৈতকি ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে ভীষণ পছন্দ করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কবি নওশাদ নূরীর অনেক আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে গেলেও তিনি থেকে গেলেন ঢাকার মায়ায়।
কবি নওশাদ নূরী একজন আপাদমস্তক কবি ছিলেন। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ষান্মাসিক ‘মনন রেখা’র বর্তমান (৪র্থ) সংখ্যাটিতে খ্যাতিমান লেখকদের স্মৃতিচারণ পড়ে আপনাদের তাই মনে হবে। প্রকৃতির কবিরা কখনো কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না। আপোস করেন না। কবি নওশাদ নূরীও তাই সময়ের প্রয়োজনে জ্বলে উঠেছেন বারবার। কবি আসাদ চৌধুরী তার মন্তব্যে বলেছে ‘কবিতায় নওশাদের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, তাঁর চিত্রকল্প অসাধারণ, তুলনাহীন। কোথাও বাড়াবাড়ি নেই।’
নওশাদ নূরী ছিলেন বাংলাদেশের উর্দু লেখকদের অভিভাবক। ভারত-পাকিস্তানের যে কোনো উর্দু কথাশিল্পী ঢাকায় এলে প্রথমে তাঁর সাথেই যোগাযোগ করতেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের নামকরণের পরামর্শটাও কবি নওশাদ নূরী দিয়েছিলেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক কবি। তার বিবরণ পাই ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীর বর্ণনায়। সময়ে সময়ে কলম ধরতেন জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আক্রমণ করে বসে ফিলিস্তিন। তখন তিনি আক্রমণের প্রতিবাদে কবিতা লিখে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। ১৯৮২ সালে ইসরাইল আবার আক্রমণ করে বসে লেবাননের উপর। তখন তিনি প্রতিবাদে ‘রাহগুজার আশনাই’ কবিতা লিখেন। ইরাকের উপর আমেরিকার আক্রমণের প্রতিবাদে লিখেন ‘তুফান সাহারা’। এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোক্তা এবং সমন্বয়কারী হিসেবেও ভূমিকা রাখেন যা একজন আন্তর্জাতিক চিন্তা ও চেতনার কবির পক্ষেই সম্ভব। যে মানুষটির এমন জীবন-ধারা তাঁর লেখা পাঠ যে সচেতন পাঠকের আরাধ্য হয়ে ওঠে। পাঠকের সেই তৃষ্ণা মেটাতেই লেখক ও গবেষক আইয়ুব হোসেন এবং শামীম জামানভি তাঁদের সুসম্পাদনে সংকলিত করে পরিবেশন করেছেন ‘নওশাদ নূরীর কবিতা’ গ্রন্থটি। এতে রয়েছে কবি নওশাদ নূরীর ৩০টি কবিতা ও ৫টি গজল। অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত লেখক ও কবি আসাদ চৌধুরী, ইনায়াতুল্লাহ সিদ্দিকী, বশীর আল্ হেলাল, মোহাম্মদ হাসান, জাফর আলম, আল মুজাহিদী, মিজারুল কায়েস, সৈকত রুশদী এবং হাইকেল হাশমী।
সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবর্তনের পরিক্রমায় কবি নওশাদ নূরীর অবদান ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে মনে হয়। কারণ অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে একই সূত্রে গাঁথা এই মানুষটি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়নি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কীর্তিমান কবি নওশাদ নূরীকে তুলে ধরা জরুরী হয়ে পরেছে। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ লোক উর্দু ভাষায় কথা বলেন। এখানে বসবাসরত বিহারি কবি-লেখকেরা উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। অগ্রগণ্য উর্দু কবি নওশাদ নূরী আমৃত্যু ঢাকায় বাস করেছেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামের সেই কবিতায় তিনি লেখেন: ‘বাংলা সাহিত্যের দৌলত আজ বিপন্ন/ হানাদারেরা এগিয়ে আসছে/ পত্র, প্রস্তর, চর্ম, প্যাপিরাস, তাম্র ও কাংসপত্রে সংরক্ষণ করো/ বাংলার মূল্য ও চেতনাকে।/ কারণ সেই অশুভ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।/ যা এক নগরকে উল্টে-পাল্টে দেয়/ এক মৃতের স্তুপে।’
এখানকার উর্দু-ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে ঢাকার নবাব খাজা পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। উনিশ ও বিশ শতকে এই পরিবারের যাঁরা উর্দুতে সাহিত্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে খাজা হায়দার জান, খাজা আসাদউদ্দীন কাওকাব, খাজা আবদুর রহিম সাবা, খাজা আহসানুল্লাহ শাহীন, খাজা নাজিমউদ্দীনের নাম করা যায়। বাঙালি বিস্মৃতি বিলাসী। সে যেমন তার শত্রুর মুখ ভুলে তাকে রাজাসনে বসায় তেমনি বন্ধুকৃত্যও ভুলে যায় অবলীলায়। উর্দু কবি হিসেবে বাংলাদেশে নওশাদ নূরীর ঠাঁই বন্ধুর কাতারে হবে, না কি শত্রু শিবিরে সে বিচারের ভার ইতিহাসের। উল্লেখ্য, মনন রেখ। বর্ষ-২ সংখ্যা : ৪। সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০১৮। প্রচ্ছদ : মামুন হোসাইন, মূল্য ১০০ টাকা, উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীকে নিয়ে একটি সুন্দর প্রবন্ধ প্রকাশ করে। উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীর কবিতার বাংলা অনুবাদ সঙ্কলন: নওশাদ নূরীর কবিতা সম্পাদনা: আইয়ুব হোসেন ও শামীম জামানভি, প্রচ্ছদ: ম্যাস্-লাইন প্রিন্টার্স, প্রকাশনা হাক্কানী পাবলিশার্স, দাম: ১২৫ টাকা।
No comments:
Post a Comment