Monday 30 May 2016

কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে। পর্ব তিন ।।

 নীল চাষে অনিচ্ছুক কৃষকদের ধরে আগুন লাগিয়ে দিত। নতুন জমিদারগণ দস্যু-তষ্করদেরকে প্রতিপালন করতো ধন অর্জনের উদ্দেশ্যে।
অনাবৃষ্টি হইয়া সমুদয় শস্য শুষ্ক হউক, জল প্লাবন হইয়া দেশ উচ্ছিন্ন যাউক, রাজস্বদানে অক্ষম হইয়া প্রজারা পলায়ন করুক, তথাপি নির্দিষ্ট দিবসে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তাঁহাকে সমস্ত রাজস্ব নিঃশেষ পরিশোধ করিতে হইবে।

হতভাগ্য অসহায় কৃষকগণ ম্যজিস্ট্রেটের নিকট থেকে কোন প্রকারের প্রতিকার ও ন্যায় বিচারের আশা করতে পারতো না। সরকারের ঘরে যে রাজস্ব যেতো, তার চতুর্গুণ –দশগুণ প্রজাদের নিকটে জোর-জবরদস্তি করে আদায় করতো। তেইশ প্রকার ‘অন্যায় ও অবৈধ’ আবওয়াব রায়তদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করা হতো। বুকানন বলেন, “রায়তদেরকে বাড়ী থেকে ধরে এনে কয়েকদিন পর্যন্ত আবদ্ধ রেথে মারপিট করে খাজনা আদায় করা তো এক সাধারণ ব্যাপার ছিল। উপরন্তু নিরক্ষর প্রজাদের নিকট থেকে জাল রসিদ দিয়ে জমিদারের খাজনা আদায় করে আত্মসাৎ করতো”।

সূফি বরষণ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলাদেশের কৃষক বইয়ের লেখক বিখ্যাত বামধারার গবেষক বদরুদ্দীন উমর তাঁর বইয়ের ভূমিকায় বলেন, বাংলাদেশের কৃষকদের মধ্যে সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরাই ছিলেন অনেক সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের ওপর জোতদার মহাজনদের নির্যাতন ও ছিলো নিদারুণ। ...............তাঁর কারণ বাংলাদেশের জমিদার জোতদার মহাজনদের মধ্যে বর্ণ হিন্দুদের ছিল ব্যাপক প্রাধান্য। এই বর্ণ হিন্দুরাই ছিলেন কংগ্রেসের নেতৃত্বে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলাদেশের কৃষক, বদরুদ্দীন উমর, মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশনী, সপ্তম মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৩।

বর্ণ হিন্দু জমিদার ও জোতদার মহাজনদের দ্বারা কৃষকদের উপর নির্যাতনের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করার সম্পর্কে একই বইয়ের ১৪ পৃষ্ঠায় গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, এই নতুন রাজস্ব ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাপ্য ভূমি রাজস্ব নির্ধারিত হয় দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকা অর্থাৎ ৩৪ লাখ পাউন্ড।

এই প্রসঙ্গে ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জয়া চ্যাটার্জীর কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেন: অধীন প্রজা ( কোর্ফা) ছিল সবচেয়ে বেশি গরীব; জমিদারদের চেয়ে তাদের ওপর বেশি অত্যাচার করত রায়তি স্বত্বের অধিকারী বা পতনিদার_  কারণ তাদের কাছ থেকেই তারা জমি গ্রহণ করত। রায়তি স্বত্বের অধিকারী বা পতনিদার জমিদারকে যে খাজনা দিত তার চেয়ে বেশি তারা আদায় করত অধীন প্রজাদের কাছ থেকে । বাঙলা ভাগ হল( হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ বিভাগ ১৯৩২- ১৯৪৭ ) জয়া চ্যাটার্জী, এল অ্যালমা পাবলিকেশনস, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৯।

কোম্পানীর হিন্দু কর্মচারীগণ গ্রামবাংলার ধ্বংস সাধনে কেন সর্বনাশা ভূমিকা পালন করেছিল। জনৈক ইংরেজ মন্তব্য করেন, ইংরেজ ও তাদের আইন-কানুন যে একটি মাত্র শ্রেণীকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করেছিল তা হলো, তাদের অধীনে নিযুক্ত এতদ্দেশীয় গোমস্তা-দালাল প্রতিনিধিগণ। এসব লোক পংগপালের মতো যেভাবে দ্রুতগতিতে গ্রামবাংলাকে গ্রাস করতে থাকে তাতে করে তারা ভারতের অস্তিত্বের মূলেই আঘাত করছিল। -(Muinuddin Ahmad Khan, Muslim Struggle for Freedom in Bengal, pp. 8)।

ইংরেজদের পলিসি ছিল, যাদের সাহায্যে তারা এ দেশের স্বাধীনতা হরণ ক’রে এখানে রাজনৈতিক প্রভুত্ব লাভ করেছে, তাদেরকে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত ক’রে মুসলমানদেরকে একেবারে উৎখাত করা, যাতে ক’রে ভবিষ্যতে তারা আর কখনো স্বাধীনতা ফিরে পাবার কোন শক্তি অর্জন করতে না পারে। হ্যাস্টিংসের ভূমি ইজারাদান নীতি ও কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা মুসলমান জমিদারদের স্থান দখল করে। নগদ সর্বোচ্চ মূল্যদাতার নিকটে ভূমি ইজারাদানের নীতি কার্যকর হওয়ার কারণে প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদারগণ হঠাৎ সর্বোচ্চ মূল্য নগদ পরিশোধ করতে অপারগ হয়। পক্ষান্তরে হিন্দু বেনিয়অ শ্রেণী, সুদী মহাজন, ব্যাংকার ও হিন্দু ধনিক-বণিক শ্রেণী এ সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। প্রাচীন জমিদারীর অধিকাংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এসব ধনিক-বণিকদের কাছে অচিরেই হস্তান্তরিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান জমিদারদের অধীনে নিযুক্ত হিন্দু নায়েব-ম্যানেজার প্রভৃতির স্বীকৃতি দান।

উপরের কথার সূত্র ধরে বলতে হয় যে,  জমিদার এবং ইংরেজরা প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণ ফসল কম হলে বা না হলেও খাজনা মওকুফ করতো না।
সেই কথাই উঠে এসেছে ডাব্লিউ হান্টারের লেখা পল্লী বাংলার ইতিহাস বইয়ের( দিব্য প্রকাশ সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০২ ) ২৪ পৃষ্ঠায়। ডাব্লিউ হান্টার লেখেন, ১৭৬৮ সালে আংশিকভাবে ফসল বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৬৯ সালের প্রথম দিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তবে এই অভাব অনটনের ফলে সরকারের আদায়কৃত খাজনার পরিমাণ তেমন হ্রাস পায়নি। স্থানীয় অফিসারদের অভিযোগ আপত্তি সত্ত্বেও সদর দফতরের কর্তৃপক্ষ জানান যে, কড়াকড়ি ভাবে খাজনা আদায় করা হয়েছে।

১৮৪৪ সালের Calcutta Review-তে যে তথ্য প্রকাশিত হয় তাতে বলা হয়। এক ডজন জমিদারীর মধ্যে, যাদের জমিদারীর পরিধি ছিল একটি ক’রে জেলার সমান, মাত্র দু’টি পূর্বতন জমিদারদের দখলে রয়ে যায় এবং অবশিষ্ট হস্তগত হয় প্রাচীন জমিদারদের নিম্নকর্মচারীর বংশধরদের। এভাবে বাংলার সর্বত্র এক নতুন জমিদার শ্রেণীর পত্তন হয়, যারা হয়ে পড়েছিল নতুন বিদেশী প্রভুদের একান্ত অনুগত ও বিশ্বাসভাজন।
হান্টার তাঁর The Indian Mussalmans গ্রন্থে বলেন, যেসব হিন্দু কর আদায়কারীগণ ঐ সময় পর্যণ্ত নিম্নপদের চাকুরীতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়। নয়া ব্যবস্থা তাদেরকে জমির উপর মালিকানা অধিকার এবং সম্পদ আহরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। অথচ মুসলমানেরা নিজেদের শাসনামলে এ সুযোগ সুবিধাগুলো একচেটিয়াভাবে ভোগ করেছে। -(Hunter, The Indian Mussalmans: অনুবাদ আনিসুজ্জামান, পৃঃ ১৪১)।

মুসলিম শাসনামলে আইন ছিল যে, জমিদারগণ সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতিকারী ও দস্যু-তস্করের প্রতি কড়া নজর রাখবে। ধরা পড়লে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদিসহ তাদেরকে সরকারের নিকটে সমর্পণ করবে। ১৭৭২ সালে কোম্পানী এ আইন রহিত করে। ফলে, নতুন জমিদারগণ দস্যু-তষ্করকে ধীরয়ে দেয়ার পরিবর্তে তাদের প্রতিপালন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির অংশীদার হতে থাকে। এটা অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, এসব দস্যু-তষ্কর কারা ছিল, এবং কারা ছিল গ্রামবাংলার লুণ্ঠিত হতভাগ্যের দল। ১৯৪৪ সালে Calcutta Review-প্রকাশিত তথ্যে বলা হয় যে, এসব নতুন জমিদারগণ দস্যু-তষ্করদেরকে প্রতিপালন করতো ধন অর্জনের উদ্দেশ্যে। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত ঢাকা-জালালপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্টেও এসব দুষ্কৃতি সত্য বলে স্বীকার করা হয়।
-(Muinuddin Ahmad Khan –Muslim Struggle for freedom in India –oo.10)।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মুসলমান জমিদারদের উৎখাত ক’রে শুধুমাত্র এক নতুন জমিদার শ্রেণীরই পত্তন করেনি, নতুনভাবে জমির খাজনা নির্ধারণেরও পূর্ণ অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে তারা চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দেয়। এসব জমিদার সরকারী রাজস্বের আকারে অতি উচ্চহারে ঠিকাদার তথা পত্তনীদারদের নিকটে তাদের জমিদারীর ভারার্পণ করতো। তারা আবার চড়া খাজনার বিনিময়ে নিম্নপত্তনীদারদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করতো। অতএব সরকারের ঘরে যে রাজস্ব যেতো, তার চতুর্গুণ –দশগুণ প্রজাদের নিকটে জোর-জবরদস্তি করে আদায় করতো। বলতে গেলে, এ নতুন জমিদার শ্রেণী রায়তদের জীবন-মরণের মালিক-মোখতার হয়ে পড়েছিল।

ফরিদপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আপিস থেকে এমন কিছু সরকারী নথিপত্র পাওয়া যায়, যার থেকে এ তথ্য প্রকাশিত হয় যে, অন্ততঃপক্ষে তেইশ প্রকার ‘অন্যায় ও অবৈধ’ আবওয়াব রায়তদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করা হতো। বুকানন বলেন, “রায়তদেরকে বাড়ী থেকে ধরে এনে কয়েকদিন পর্যন্ত আবদ্ধ রেথে মারপিট করে খাজনা আদায় করা তো এক সাধারণ ব্যাপার ছিল। উপরন্তু নিরক্ষর প্রজাদের নিকট থেকে জাল রসিদ দিয়ে জমিদারের খাজনা আদায় করে আত্মসাৎ করতো”। (M. Martin –The History, Antiquities, Topography & Statistics of Eastern India, London-1838, Vol. 2).।

এই প্রসঙ্গে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (১৮০০-১৯০০) বইয়ের লেখক বিনয় ঘোষ ( বুক ক্লব প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০০০)২৪-২৫ পৃষ্ঠায়  বলেন, রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফ ও আরও ২০ জন মিশনারি বলেন, (এপ্রিল ১৮৭৫ ) জমিদাররা চাষীদের সঙ্গে ব্যবহার করেন ঠিক প্রজাদের মতো নয়, কতকটা ক্রীতদাসের মতো। তাঁরা নিজেদের রাজা মহারাজাদের মতো মনে করেন। প্রজাদের কাছে খাজনাদি যা তাঁদের ন্যায্য পাওনা, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁরা নানা কৌশলে আদায় করেন এবং বিনা পারিশ্রমিককে, নিজের নানারকমের কাজে প্রজাদের খাটিয়ে নেন। তাছাড়া অত্যাচার যে কতরকমের করেন তা বলে শেষ করা যায় না।।

এইরকম আরও অনেকের উক্তি উদ্ধৃতি করা যায়, বক্তব্য সকলেরই এক- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে চাষীর সর্বনাশ হয়েছে, চাষের অবনতি হয়েছে, গ্রাম ও গ্রাম সমাজ ধ্বংসের পথে এগিয়ে গিয়েছে। .....উনিশ শতকের সাময়িকপত্রের আলোচনা থেকেও বাংলাদেশের এই জমিদারদের সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়। কয়েকটি আলোচনার কথা আমরা এখানে উল্লেখ করছি। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা জমিদারদের রাজস্ব সংগ্রহ প্রসঙ্গে লিখেছেন শ্রাবণ ১৩৭২ বাংলা " রাজস্ব সংগ্রহার্থে কি অপূর্ব কৌশল, কি পরিপাটি নিয়ম, কি অদ্ভুত নৈপুণ্যই প্রকাশ করিয়াছেন! প্রজারা নিঃস্ব ও নিরন্ন হউক, তথাপি তাহারদিগকে নিরূপিত রাজস্ব দিতেই হইবে, ভূস্বামির সর্ব্বস্বান্ত হউক, তথাপি তিনি ত্রি মাসের পর কপর্দ্দক মাত্র রাজস্বও অনাদায়ী রাখিতে পারেন না। অনাবৃষ্টি হইয়া সমুদয় শস্য শুষ্ক হউক, জল প্লাবন হইয়া দেশ উচ্ছিন্ন যাউক, রাজস্বদানে অক্ষম হইয়া প্রজারা পলায়ন করুক, তথাপি নির্দিষ্ট দিবসে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তাঁহাকে সমস্ত রাজস্ব নিঃশেষ পরিশোধ করিতে হইবে।

সামগ্রিকভাবে বাংলার মুসলিম সমাজের অবস্থা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কেমন ছিল, তার একটা নিখুঁত চিত্র অংকন করতে হলে জানতে হবে এ সমাজের তিনটি প্রধান উপাদান বা অংগ অংশে কোন অবস্থা বিরাজ করছিল। সমাজের সে তিনটি অংগ অংশ হলো –নবাব, উচ্চশ্রেণী ও কৃষক সম্প্রদায়। হান্টার বলেন, জীবিকার্জনের সূত্রগুলির প্রথমটি হচ্ছে, সেনাবাহিনী। সেকানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হ’য়ে যায়। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আর আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে পারে না। যদিও কদাচিৎ আমাদের সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাদেরকে কোন স্থান দেয়া হতো, তার দ্বারা তার অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই থাকতো না।

তাদের  অর্থোপার্জনের দ্বিতীয় সূত্র ছিল –রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিন্তু উপরে বর্ণিত হ’য়েছে কিভাবে নিম্নপদস্থ হিন্দু রাজস্ব আদায়কারীগণ কোম্পানীর অনুগ্রহে এক লাফে মুসলমানদের জমিদারীর মালিক হ’য়ে বসে। লর্ড মেটকাফ ১৮২০ সালে মন্তব্য করেন, দেশের জমি-জমা প্রকৃত মালিকের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে একশ্রেণীর বাবুদের নিকটে হস্তান্তরিত করা হয় –যারা উৎকোচ ও চরম দুর্নীতির মাধ্যমে ধনশালী হয়ে পড়েছিল। এ এমন এক ভয়াবহ নির্যাতনমূলক নীতির ভিত্তিতে করা হয় যার দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।
-(E. Thompson The life of Charls Lord Metcalfe; A.R. Mallick : British Policy and the Muslims of Bengal)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেই রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত মুসলমান কর্মচারী ও ভুমির প্রকৃত মালিকের স্থান অধিকার করে বসে ইংরেজ ও হিন্দুগণ। আবহমান কাল থেকে ভারতের মুসলমান শাসকগণ জনগণের শিক্ষা বিস্তারকল্পে মুসলিম মনীষীদেরকে জায়গীর, তমঘা, আয়মা, মদদে-মায়াশ প্রভৃতি নামে লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি দান করতেন। বুকাননের
মতে একমাত্র বিহার ও পাটনা জেলার একুশ প্রকারের লাখেরাজ ভূমি দান করা হয়েছিল বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। ইংরেজ আমলে নানান অজুহাত এসব লাখেরাজদারকে তাদের মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বর্ধমারে স্পেশাল ডিপুটি কলেক্টর মিঃ টেইলার একদিনে ৪২৯ জন লাখেরাজদারের বিরুদ্ধে তাদের অনুপস্থিতিতে রায় দান করেন।

ইংরেজ সরকারের Tribunals of Resumption-এর অধীনে লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের পুনর্দখলে নেয়া হয়। চট্টগ্রাম বোর্ড অব রেভেনিউ-এর জনৈক অফিসার নিম্নোক্ত মন্তব্য করেনঃ সরকারের নিয়তের প্রতি লাখেরাজদারগণ সন্দিগ্ধ হ’য়ে পড়লে তাতে বিস্ময়ের কিছুই থাকবে না। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৪৬৩টি মামলার মধ্যে সব কয়টিতেই লাখেরাজদারদের অনুপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ তিক্ত অভিজ্ঞতার পর Tribunals of Resumption-এর প্রতি তাদের আস্থাহীন হবারই কথা (Comment by Smith in Harvey’s Report of 19th June 1840; A.R. Mallick British Policy and the Muslims of Bengal).।

মুসলমান লাখেরাজদারদের ন্যায্যা ভূমির মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে নানাবিধ হীনপস্থা অবলম্বন করা হতো এবং ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে এক বিদ্বেষদুষ্ট মানসিকতা বিরাজ করতো। লাখেরাজদারদের সনদ রেজেষ্টী নাক রার কারণে বহু লাখরাজ বাজেয়াপ্ত করা হয়। জেলার কালেকটরগণ ইচ্ছা করেই সময় মতো সনদ রেজেষ্ট্রী করতে গড়িমসি করতো। তার জণ্যে চেষ্টা করেও লাখেরাজদারগণ সনদ রেজেষ্ট্রী করাতে পারতেন না। চট্টগ্রামে লাখেরাজদারদের কোর্টে হাজির হবার জন্যে কোন নোটিশই দেয়া হতো না। অনেকক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, মামলার ডিক্রী জারী হবার বুহ পূর্বেই সম্পত্তি অন্যত্র পত্তন করা হয়েছে। ১৮২৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সমগ্র বাংলা বিহারে লাখেরাজদারদের মিথ্যা তথ্য সংগ্রহের জন্যে চর, ভূমা সাক্ষী ও রিজাম্পশন অফিসার পংগপালের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলমানদেরকে মামলায় জড়িত করে। এসব মামলায় সরকার ছাড়াও তৃতীয় একটি পক্ষ বিরাট লাভবান হয়। যারা মিথ্যা সাক্ষদান করে এবং যারা সরকারী কর্মচারীদের কাছে কাল্পনিক তথ্য সরবরাহ করে –তারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। পক্ষান্তরে, মুসলিম উচ্চম্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হ’য়ে যায়।

পন্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেন: ইংরেজরা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে বহু ‘মুয়াফী’ অর্থাৎ লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তির অস্তিত্ব ছিল। তাদের অনেক ছিল ব্যক্তিগত, কিন্তু অধিকাংশই ছিল শিক্ষায়তনগুলির ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে ওয়াকফকৃত। প্রায় সকল প্রাইমারী স্কুল, মকতব এবং বহু উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান এসব ‘মুয়াফীর’ আয় নির্ভর ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিলাতে তাদের অংশীদাগণকে মুনাফা দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি টাকা তোলার প্রয়োজনবোধ করে। কারণ কোম্পানী ডিরেক্টরগণ এজন্যে খুব চাপ দিচ্ছিল। তখন এক সুপরিকল্পিত উপায়ে ‘মুয়াফী’র ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নীতি গৃহীত হয়। এসব ভূ-সম্পত্তির সপক্ষে কঠিন সাক্ষ্যপ্রমাণ পেম করার হুকুম জারী করা হয়।
কিন্তু পুরানো সনদগুলি ও সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র ইতিমধ্যে হয় কোথাও হারিয়ে গেছে, নয় পোকায় খেয়ে ফেলেছে। অতএব প্রায় সকল ‘মুয়াফী’ বা লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো। বহু বনেদী ভূম্যাধিকারী স্বত্বচ্যুত হলেন। বহু স্কুলে কলেজের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে বহু জমি সরকারের খাস দখলে আসে আর বহু বনেদী বংশ উৎখান হয়ে যায়। এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপরোক্ত ‘মুয়াফী’র আয় নির্ভর ছিল, সেগুলি বন্ধ হয়ে গেল। বহু সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগীয় কর্মচারী বেকার হ’য়ে পড়লেন। -(Pandit Jawhellal Nehru: The Discovery of India, pp. 376-77)।

উচ্চ ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মুসলমানদের জীবিকার্জনের তৃতীয় অবলম্বন ছিল সরকারের অধীনে চাকুরী –বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে। কোম্পানী দেওয়ানী লাভের পরও প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবত তাঁরা চাকুরীতে বহাল ছিলেন। কারণ তখন পর্যন্ত সরকারী ভাষা ছিল ফারসী। কিন্তু হঠাৎ আকস্মিকভাবে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজীকে সরকারী ভাষা করা হয়। মুসলমানগণ তার জন্যে পূর্ব থেকে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। ১৮৩২ সালে সিলেক্ট কমিটির সামনে ক্যাপ্টেন টি ম্যাকাম প্রস্তাব পেশ করেন যে, ক্রমশঃ ইংরেজী ভাষার প্রচলন করা হোক এবং মুস্যলমান কর্মচারীদেরকে অন্ততঃ পাঁচ/ছ’বছরের অবকাশ দিয়ে নোটিশ দেয়া হোক। হন্ট ম্যাকেঞ্জীও অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বলেন, জেলাগুলিতে ক্রমশঃ এবং পর পর ইংরেজীর প্রচলন করা হোক। কিন্তু সহসা সর্বত্র ও পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে হাজার হাজার মুসলমান কর্মচারী চাকুরী থেকে অপসারিত হন যাদের জীবিকা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতো একমাত্র চাকুরীর উপর। ১৮২৯ সালে সবরকম শিক্সার বাহন হিসাবে স্কুল-কলেজে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়া শুরু হয়। ১৮৩৭ সালের ১লা এপ্রিল থেকে (তৎকালীন আর্থিক বৎসরের প্রথম দিন) সহসা সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজীর প্রবর্তন হয়।

হান্টার সাহেবও এসব সত্য স্বীকার করে বিদ্রুপ করে বলেছেনঃ
“এখন কেবলমাত্র জেলখানায় দু’একটা অধঃস্তন চাকুরী ছাড়া আর কোথাও ভারতের এই সাবেক প্রভুরা ঠাঁই পাচ্ছে না। বিভিন্ন অফিসে কেরানীর চাকুরীতে, আদালতের দায়িত্বশীল পদে, এমনটি পুলিশ সার্ভিসের উর্ধ্বতন পদগুলিতে সরকারী স্কুলের উৎসাহী হিন্দু যুবকদেরকে নিযুক্ত করা হচ্ছে”।
এ পরিবর্তনের ফলে হিন্দু সম্প্রদায় পূর্ণ সুফল ভোগ করে। বিভিন্ন কলেজ থেকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করে তারা সর্বথ্র সরকারী চাকুরীতে একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক অগনে পট পরিবর্তনের ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারসমূহ জীবিকার্জনের সকল সুযোগ-সুবিধা তেকে বঞ্চিত হ’য়ে দারিদ্র্য, অনাহার ও ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষককুলের যে চরম দুর্দশা হ’য়েছিল তার কিঞ্চিত আভাস উপরে দেয়া হয়েছে।
একথারও উল্লেখ করা হয়েছে যে, জমিদার এবং প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে আরও দুটি স্তর বিরাজ করতো। যথা পত্তনীদার ও উপপত্তনীদার। জমিদারের প্রাপ্য খাজনার কয়েকগুণ বেশী এ দুই শ্রেণীর মাধ্যমে রায়তদের কাছ থেকে আদায় করা হতো এবং তাতে করে রায়ত বা কৃষকদের শোষণ-নিষ্পেষণের কোন সীমা থাকতো না। জমিদার-পত্তনীদারদের উৎপীড়নে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়তো। বাধ্য হয়ে তাদেরকে হিন্দু মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হতো। শতকরা ৩৭ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হারে সুদে তাদেরকে টাকা কর্জ করতে হতো। উপরন্তু তাদের গরু/মহিষ মহাজনের কাছে বন্ধক রাখতে হতো। অভাবের দরুন মহাজরেন কাছে অগ্রিম কোন শস্য গ্রহণ করতে হলে তার দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হতো। আবার উৎপন্ন ফসল যেতেতু মহাজনের বাড়ীতেই তুলতে হতো, এখানেও তাদেরকে প্রতারিত করা হতো। মোটকথা হতভাগ্য কৃষকদের জীবন নিয়ে এসব জমিদার মহজনরা ছিনিমিনি খেলে আনন্দ উপভোগ করতো।

কৃষকদের এহেন দুঃখ-দুর্দশার কোন প্রতিকারের উপায়ও ছিল না। কারণ তা ছিল অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। উপরন্তু জমিদার ও তাদের দালালগণ উৎকোচ ও নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে খরচ কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিত। পরিণাম ফল এই হতো যে, জমিদার মহাজন তাদেরকে ভিটেমাটি ও জমিজমা থেকে উচ্ছেদ করে পতের বিভারীতে পরিণত করতো।
কৃষক সম্প্রদায় ধান ও অন্যান্য শস্যাদি উৎপন্নের সাথে সাথে নীলচাষও করতো। এই নীলচাষের প্রচলন এদেশে বহু আগে থেকেই ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারত থেকে নীল রং সর্বপ্রথম ইউরোপে রপ্তানী হয়। ব্রিটিশ তাদের আমেরিকান ও পশ্চিম ভারতীয় উপনিবেশগুলিতে নীলচাষের ব্যবস্থা করে। এগুলি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবার পর বাংলা প্রধান নীল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়। ১৮০৫ সালে বাংলায় নীলচাষের পরিমাণ ছিল ৬৪,৮০৩ মণ এবং ১৮৪৩ সালে তার পরিমাণ হ’য়ে পড়ে দ্বিগুণ। বাংলা, বিহার এবং বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নদিয়া, মুশিদাবাদ প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত জেলগুলিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশের তত্বাবধানে ব্যাপক আকারে নীলচাষ করা হয়। কিন্তু বিদেশী শাসকগণ নীলের এমন নিম্নমূল্য বেঁধে দেয় যে, চাষীদের বিঘাপ্রতি সাত টাকা ক’রে লোকসান হয় যা ছিল বিঘাপ্রতি খাজনার সাতগুণ। তথাপি চাষীদেরকে নীলচাষে বাধ্য করা হতো। বাংলার নীলচাষীদের উপরে শাসকদের অমানুষিক অত্যাচার উৎপীড়নের মর্মন্তুদ ও লোমহর্ষক কাহিনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ক্ষমতা মদমত্ত শাসক ও তাদের দালালদের মানবতাবোদ সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিল। নতুবা তাদের নিষ্পেষণের দরুন কৃষক সমাজের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মর্মন্তুদ হাহাকারে বাংলার আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হতো না।

দরিদ্র ও দুঃস্থ কৃষকগণ বেঁচে থাকার জন্যে নীলচাষের মাধ্যমে কিছু অর্থ উপার্জনের আশা করতো। তাদের দারিদ্র্য ও অসহায়তার সুযোগে ইংরেজ নীলকরগণ কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হ’তে তাদেরকে বাধ্য করতো। অনেক সময় অনিচ্ছুক কৃষকদের ধরে আগুন লাগিয়ে দিত। এতেও সম্মত করতে না পারলে জাল চুক্তিনামার বলে তাদের জমাজমি জবরদখল ক’রে নীলকরগণ তাদের কর্মচারীদের দ্বারা সেসব জমিতে নীলচাষ করাতো। কখনো কখনো অত্যাচারী জমিদার তার প্রজাকে শাস্তি দেবার জন্যে তার কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে নীলকরদেরকে দিয়ে দিত। একবার অ্যাশলী ইডেন নীল কমিশনের সামনে ১৮৬০ সালে সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, বিভিন্ন ফৌজদারী রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ঊনপঞ্চাশটি ঘটনা এমন ঘটেছে, যেখানে নীলকরগণ দাংগা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি, লুটতরাজ এবং বলপূর্বক অপহরণ প্রভৃতি গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকে। তার বহু বৎসর পূর্বে জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট একজন খৃষ্টান মিশনারীর সামনে মন্তব্য করেন যে, মানুষের রক্তে রঞ্জিত হওয়া ব্যতীত একবাক্স নীলও ইংলন্ডে প্রেরিত হয় না। (১৮৬১ সালের নীল কমিশন রিপোর্ট এবং ক্যালকাটা খৃষ্টান অবজার্ভার, নভেম্বর, ১৮৫৫ সাল)।

নীল চাষীদের দুঃখ-দুর্দশার কোন প্রতিকারের উপায় ছিল না। চৌকিদার-দফাদারের সামনে চাষীদের উপর নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হলেও চৌকিদারদের ঘৃণাক্ষরেও সেকথা প্রকাশ করার সাধ্য ছিল না। একবার নিষ্ঠুর নীলকরগণ একটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করলে তা নির্বাপিত করার জন্যে এক ব্যক্তি চীৎকার ক’রে লোকজন জড়ো করে। তার জন্যে তাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করে আহত অবস্থায় একটি অন্ধকার কামরায় চার মাস আটক রাখা হয়। ও দিকে আবার নীলকরগণ পুলিশকে মোটা ঘুষ দিয়ে বশ করে রাখতো। (নীল কমিশন রিপোর্ট ১৮৬১)।
হতভাগ্য অসহায় কৃষকগণ ম্যজিস্ট্রেটের নিকট থেকে কোন প্রকারের প্রতিকার ও ন্যায় বিচারের আশা করতে পারতো না। উক্ত নীল কমিশন রিপোর্টে বলা হয়ে ছে যে, সাদা চামড়ার ম্যাজিস্ট্রেটগণ আপন দেশবাসীদের পক্ষই অবলম্বন করতো। ফৌজদারী আইন-কানুন এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল যে, ইংরেজ প্রজাকে শাস্তি দেয়া ছিল অসম্বব ব্যাপার। একজন দরিদ্র প্রজা সূদুর প্রত্যন্ত এলকার তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে ফেলে কোলকাতায় গিয়ে মামলা দায়ের করার সাহস রাখনো না। কারণ তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের জানমাল ইয্যৎ-আবরু নীলকরদের দ্বারা বিনষ্ট হতো। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে অধিক পরিমানে নীলচাষ করা হতো। ফলে নিম্নশ্রেণীর মুসলমান নীলকরদের চরম নির্যাতন-নিপীড়নের সার্বক্ষণিক শিকারে পরিণত ছিল।

Sunday 29 May 2016

জাতির এই ক্লান্তিলগ্নে শহীদ জিয়ার মতো মহান রাষ্ট্রনায়কের আদর্শই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারে ।

জাতির এই ক্লান্তিলগ্নে শহীদ জিয়ার মতো মহান রাষ্ট্রনায়কের আদর্শই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারে  ।

মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ ( সূফি বরষণ )
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
৩০ মে সোমবার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৩৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন।শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

ঐতিহাসিকভাবেই তাকে সামনে রেখে তার দেখানো পথে নতুন উদ্যমে শুরু করতে হবে আগামীর উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজ । কারণ তিনি আমাদের অগ্রগতির আলোকবর্তিকা হয়ে রয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য ও প্রগতির মধ্যে এক ধরনের ঐকতানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে কিছুসংখ্যক কর্মীর মধ্যে যে ভীতি এবং ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা বিএনপির ঐতিহ্য ও আদর্শের বিপরীতে তাড়িত করেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্বের ওপর দুটি বড় দায়িত্ব। ১. দলকে সাংগঠনিকভাবে মজবুত করে গড়ে তোলা ২. দেশের জনগণকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করা।

যার মধ্য দিয়ে এই কর্মকাণ্ড দীর্ঘমেয়াদি অব্যাহত থাকবে। ত্যাগী নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে তাদের সহযোগিতা করা, যেন তারা তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে। সুষম বণ্টনের মধ্য দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। গত কয়েক বছরে বিএনপির ওপর দিয়ে একাধিক ঝড় বয়ে গেছে। আর তা এখনও অব্যাহত আছে আর চলছে নানাবিধ ষড়যন্ত্র ।।  যে ঝড়ে গাছটি উপড়ে পড়ে যাওয়ার কথা কিন্তু পড়েনি, কারণ 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' বিএনপির আদর্শিক জায়গাটি অনেক মজবুত কারণ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মিশে আছে এদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে । ২০০৭-এর এক-এগারোতে মইন-ফখরুদ্দীন বিএনপি এবং জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করতে প্রচণ্ড আঘাতের মধ্য দিয়ে যে পরিকল্পনা করেছিল সেই পরিকল্পনা এখনো অব্যাহত আছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আগামীর কাণ্ডারী তারেক রহমান, জননেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সারা দেশে লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা, হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য জিয়ার আদর্শের সৈনিককে, আজীবনের জন্যে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে,   আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ক্রমাগত নিপীড়নের মধ্যে আমরা আমাদের আদর্শের নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিখ্যাত উক্তি 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস' মনে করে শক্তির সঙ্গে জ্ঞানের বৃদ্ধি করি এবং যত কম শক্তি প্রয়োগ করব আমাদের শক্তি তত বৃদ্ধি পাবে।

দমনমূলক ব্যবস্থা কখনোই সৎ চিন্তাধারাকে তাড়িয়ে দিতে সফল হয় না। ক্ষমতায় থেকে নির্মমভাবে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করবেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে ক্ষমতা বজায় রাখবেন। সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার চেতনা বাদ দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারগুলোকে অসম্মান করবেন। আইনের শাসনকে ভূলুণ্ঠিত করে ভোটের অধিকার হরণ করে একতরফা প্রহসনমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে, পাল্টাতে হবে গতানুগতিক চিন্তাধারা।
সর্বাধিক কাঙ্ক্ষিত সুশাসন, যা আমাদের সমাজ, পরিবার, ঐতিহ্য ও ধর্মবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সমাজের অগ্রগতি সাধিত হয়।

দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রেখেই অর্থনীতির প্রভূত উন্নয়ন সাধন করছে। আমরা পিছিয়ে আছি সুশাসনের অভাবে। তাই আমাদের এই শতকের স্লোগান 'পরিবর্তনের জন্য সুশাসন-সুশাসনের জন্য পরিবর্তন' সুশাসন ফিরে এলে তবেই দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সুবিচার ও সমৃদ্ধির নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে।
লেখক । 

তিনি কতখানি পেশাদার সৈনিক ছিলেন, তা তার সতীর্থদের দেয়া ভাষ্য থেকে জানা যায়। ২৬ মার্চ রাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ভাষণ দেয়ার পর ব্যাটালিয়নের অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রামের সেনা ছাউনি ত্যাগ করে ষোলশহর দিয়ে যাওয়ার পথে মেজর জিয়ার বাসার কাছে এলে একজন সৈনিক বললেন—স্যার, ম্যাডামের সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন কি? জবাবে মেজর জিয়া বললেন, তোমরা কি তোমাদের স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে পারবে? আমরা এখন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নেমেছি। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই। সামনে এগিয়ে যাও। রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছেন তা এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি কুমিল্লার একটি ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার লাল সূর্য দেখতে পায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সঠিকভাবে দেশ চালাতে পারেনি তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার। গণতন্ত্র নির্বাসন দিয়ে একদলীয় বাকশাল প্রবর্তন করে স্বাধীন বাংলাদেশের অনন্য সংবিধানে প্রথম কাটাছেঁড়া করেন তত্কালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অগোছালো প্রশাসন, খাদ্যাভাব, স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র, সেনাবাহিনীর ভেতরে অসন্তোষ ইত্যাদি কারণে একদলীয় বাকশালকে স্থায়ী রূপ দিতে তিনি ব্যর্থ হন। ১৯৭৫ সালের শেষদিকে রক্তাক্ত রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা দেশে একটি চূড়ান্ত বিপর্যয় সৃষ্টি করে। অবশেষে ৭ নভেম্বর তত্কালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশ এবং বাকস্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল এই দিনটিতে। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চার এবং রাজনীতিকে গণমুখী ও অর্থনৈতিক মুক্তির অভিসারী করে তোলার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরই ১ সেপ্টেম্বর গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। নতুন দলের আত্মপ্রকাশের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

তার নেতৃত্বে কর্মের সুযোগ সৃষ্টি ও উত্পাদনে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। শুরু হয় স্বনির্ভর, আধুনিক এক বাংলাদেশের যাত্রা। ফিরিয়ে আনেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের নতুন ধারা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ড. হেনরি কিসিঞ্জার আখ্যায়িত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ ক্রমেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। তিনি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনেছিলেন অল্প সময়ের মধ্যে। তিনি গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন। দ্রুততম সময়ে সারাদেশে তিনি একটি কর্ম ও সুশাসনের সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। সত্যি কথা বলতে কী, দেশের ভেতর তখন কোনো বিভাজন ছিল না। এমনভাবে তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে চলে গিয়েছিলে যে, তাকে বলা হতো সাধারণ মানুষের নেতা।
 
এত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিপুল সফলতার পেছনে জিয়াউর রহমানের যেসব চারিত্রিক গুণাবলী ও আদর্শ গুরুত্ব পেয়েছিল তা অল্প সময়ে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে ফুটে উঠেছে তার চারিত্রিক গুণাবলী ও দেশপ্রেমের আদর্শ। তার মূলমন্ত্র ছিল ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। মোটা দাগে বলতে হলে তার ছিল— ১. সত্যোজ্জ্বল অতীত, যোগ্য নেতৃত্ব, সততা ও স্বচ্ছতা ২. অসহায়, দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা, তার নেতৃত্বে খুঁজে পায় তাদের স্বপ্নের ভবিষ্যত্ ৩. তার যোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-বাকশালের একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে রক্ষা পায় দেশের মানুষ ৪. তিনি উপহার দিয়েছিলেন জাতিসত্তার নতুন এক বিনির্মাণ— বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, যা ছিল আধুনিক ও হাজার বছরের ইতিহাস নির্ভর ৫. জাতীয় জীবনে যে হতাশা ও নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছিল তা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে দেশবাসীকে তিনি নতুন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে জাগিয়ে তুলেছিলেন উন্নয়নের রাজনীতিতে ৬. প্রতিটি ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ খুঁজে পেয়েছিল তাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ। ফলে কর্ম ও উত্পাদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল ৭. তার নেতৃত্বে ফিরে আসে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার ৮. সর্বোপরি শহীদ জিয়ার যোগ্যতা, দেশপ্রেম, সততা ও স্বচ্ছতায় আকৃষ্ট হয়ে দেশের মেধাসম্পন্ন গুণী মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে। তারই আদর্শ ও অনুপ্রেরণা লালন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বার বার দেশ পরিচালনা করে এসেছে। এখনো বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে তার প্রতিষ্ঠিত দল বহুদলীয় গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সব সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক চেতনার মাঝে এক অভূতপূর্ব সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরি করে তিনি একদা বলেছিলেন, ‘এক দেশ নানা মত, দেশ বাঁচাতে ঐক্যমত’।

যে ব্যক্তিটি রাজনীতিকে চারদেয়াল থেকে মুক্ত করে নিয়ে গিয়েছিলেন মাঠে-ময়দানে, যাদের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্ক, সেই শত্রুদের নির্মম বুলেট তার প্রাণ কেড়ে নেয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে। মাত্র ৪৫ বছরে শাহাদত বরণ করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আমাদের জন্য তিনি রেখে গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শিক, প্রিয় দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের আপামর জনগণ স্মরণ করেছে এই মহামানবকে। আজ যখন মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও গণতন্ত্র নিহত, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম আহত, ভোটের অধিকার ভূলুণ্ঠিত, সে সময়ে তার জীবন ও কর্ম বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ এরকমই একটি পরিবেশ রচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। বাকশক্তি রহিত একটি জাতি তখন রুদ্ধ হয়েছিল একদলীয় শাসনের রুদ্ধশ্বাসে। আজও সেই পঁচাত্তরের মতো গণতন্ত্র রুদ্ধ হয়েছে সেই একই দল আওয়ামী লীগের হাতে। টিভি চ্যানেল বন্ধ, পত্রিকা নিষিদ্ধ। মানুষ তার স্বাভাবিক মত প্রকাশ করতে পারছে না, স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারছে না। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। হত্যা গুম ভীতি তৈরি করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুল পথে পরিচালিত করে দেশকে একটি খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িকতার নামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা হচ্ছে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পথে ফিরিয়ে আনতে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শই হতে পারে দেশ পরিচালনার মূলমন্ত্র।

Thursday 26 May 2016

লন্ডন প্রবাসী এক সাংবাদিকের মায়ের ভাষার জন্য ভালোবাসা এবং একজন বিপ্লবী সত্যেন সেনের গল্প।

লন্ডন প্রবাসী এক  সাংবাদিকের মায়ের ভাষার জন্য ভালোবাসা এবং একজন বিপ্লবী সত্যেন সেনের গল্প।

মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ ( সূফি বরষণ )
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজ আলমগীর কবির মুসলিম কমিউনিস্ট আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বড় ভাই। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন বিপ্লবী সত্যেন সেন সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য,  কিন্তু আমি তো এই মহান বিপ্লবীর সম্পর্কে কিছুই জানিনা বলার পরও তার চাপাচাপিতেই এই লেখার প্রয়াস ।
আজ সকাল থেকেই ভাবছিলাম আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখবো আমি কেন পাকিস্তান,পাকিস্তানী ও উর্দ্দু  ভাষা কে ঘৃণা করি॥ কারণ নিজে শতভাগ বিশুদ্ধ ভাবে উর্দ্দু পড়তে ও লিখতে পারি এবং বলতেও পারি॥ তারপরও কেন আমি উর্দ্দু  ভাষায় কোনো পাকিস্তানীর সাথে কথা বলি না!?? সেই কথাই আজ আমি আপনাদেরকে বলবো।
কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই এক প্রকার  ঘৃণা থেকে কোনো পাকিস্তানীর সাথে উর্দ্দুতে কথা বলি না॥ কারণ সেটা মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অনেক বেশি  আবেগ জড়িত বলে এবং অনেক বেশি বাংলাকে ভালোবাসি বলে,  বুকের মধ্যে লালন করি বলে।
কোনো পাকিস্তানী যদি আমাকে বলতো উর্দ্দু আতা হে তখন আমি বুঝে ও  বলতাম বুঝি নাই !? তখন কষ্ট করে সে বলতো ইউ স্পিক উর্দ্দু ? তখন আমি বলতাম না !? এবং উল্টো আমি তাদের মুখের উপরে বলতাম ইউ স্পিক বেঙ্গলি? প্রত্যেক বারই আলাপের সময় আমি পাকিস্তানীকে বলতাম বাংলা শিখে ফেল অনেক সহজ॥ আর তখন অনেক পাকিস্তানীই বলতো বাঙালীকে তো উর্দ্দু আতা হে ?! কিন্তু আমি বলতাম না আমি পারিনা উর্দ্দু বলতে যেমন তুমি পারনা বাংলা বলতে॥ লন্ডনে যখন একজন বাঙালীকে কোনো পাকিস্তানীর সাথে উর্দ্দুতে কথা বলতে দেখতাম তখন আমার অনেক বেশি রাগ হতো ॥ সামান্য পরিচয় থাকলেই প্রতিবাদ করতাম এবং এখনও করি, কেন উর্দ্দুতে কথা বলছেন বাংলাদেশী হয়ে আর বুঝিয়ে দিতাম যে, আর কোনো সময় কোনো পাকিস্তানীর সাথে উর্দ্দুতে কথা বলবেন না॥ আর এটা এখনও করছি কড়া ভাষায় প্রতিবাদের মাধ্যমে যে কোনো দিন কোনো পাকিস্তানীর সাথে উর্দ্দুতে কথা বলবেন না প্লীজ। বুকের মধ্যে রক্তের দামে কেনা মায়ের ভাষা বাংলাকে ভালোবাসতে শিখুন।
এবার আমার লন্ডনের বাসার কথা বলি, আমি যে বাসায় থাকি সেই বাসায় একজন পাকিস্তানী থাকে॥ সে শতবার চেষ্টা করেছে আমার সাথে উর্দ্দুতে কথা বলতে কিন্তু আমি বলি নাই ?! সাফ বলে নিয়েছি আমার সাথে যদি কথা বলতে চাও তবে ইংরেজি বা বাংলাতে বলতে পার॥ আমি উর্দ্দু বলতে পারিনা !? ঐ পাকিস্তানী কিভাবে যেন জেনেছে যে আমি অনেক বিশুদ্ধ ভাবে উর্দ্দু বলতে পারি॥ তাই সে বেচারা পাকিস্তানী আমার সাথে কথা বলায় বন্ধ করে দিয়েছে ॥বন্ধ করার আরও একটি বড় কারণ সে আমার মতো পরিস্কার ভাবে ভালো ইংরেজি বলতে পারে না?
আর আমি এই সবই করছি বিলেতের মাটিতে মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি অনেক বেশি ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও গভীর আবেগ থেকে এবং পাকিস্তানের প্রতি অনেক বেশি ঘৃণা থেকে। এবার আসি বিপ্লবী সত্যেন সেনের ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রামী’ গল্পের সম্পর্কে। যে গল্প আমাকে প্রতিদিন বিলেতের মাটিতে বাংলা ভাষার প্রতি অনুপ্রেরণা জোগায়। আর আবেগে শ্রদ্ধায় চোখ দিয়ে মায়ের ভাষার জন্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ।
বিপ্লবী সত্যেন সেনের ‘ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রামী’ গল্প অবলম্বনে একটি নাটক প্রচারিত হয়েছে বাংলাদেশের টিভিতে । নাটকটিতে অভিনয় করছেন রওনক হাসান, তিশা ও ইশরাত নিশাত। নাটকের গল্পে ফুটে উঠেছে ভাষা আন্দোলনের পূর্ব প্রেক্ষাপট। 
বাঙালিদের বাঙালি হওয়ার পেছনে অনেক আন্দোলনের জোরালো ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেটা শুরু হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আর উচ্চ বর্ণের নব্য হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে শুরু হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ হওয়ার পেছনে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ’৬৯-এর গণআন্দোলন এবং একই পথে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকেই প্রধান হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো অকুতোভয় ভাষাসৈনিকের প্রাণ উৎসর্গ না হলে আমরা স্বাধীনতা পেতাম কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বাংলায় স্বাধীনতার বীজ রোপণ হয়েছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেই। পৃথিবীতে ভাষার জন্য জীবন দেয়ার ইতিহাস একমাত্র বাঙালিরাই সৃষ্টি করেছে। তাই তো একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সারা বিশ্বে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।এ মহান ভাষা দিবসের তাৎপর্য, ভাষাসৈনিকদের আত্মত্যাগ আমাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খুব একটা না ফুটে উঠলেও নাটক এবং সঙ্গীতে সেটি ভালোভাবেই ফুঠে উঠেছে।
তারমধ্যে বিপ্লবী সত্যেন সেনের ‘ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রামী’ গল্প অবলম্বনে ভাষার সন্তান নাটকটি অন্যতম।
বিপ্লবী সত্যেন সেন:
বাড়ির নাম ‘শান্তি কুটির’। ছোটবেলায় তার ডাক নাম ছিল লস্কর। তার পিতা ধরনীমোহন সেন এবং মা মৃণালিনি সেন। চার সন্তানের মধ্যে সত্যেন কনিষ্ঠ। ইন্দুবালা সেন, প্রতিভা সেন, জিতেন্দ্র মোহন সেন (শঙ্কর) ও সত্যেন সেন (লঙ্কর)। শিল্প-সাহিত্যে আগ্রসর এই পরিবারে ছিল কয়েকজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। সত্যেনের পিতৃব্য ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তাঁর কাকা মদনমোহন সেন ছিলেন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক। খুড়তুতো ভাই মুরারীমোহন সেন ও সত্যেনের দুই বোন ইন্দুবালা এবং প্রতিভা সেন সাহিত্যচর্চায় নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন।
১৯২৪ সালে সত্যেন সেন মাধ্যমিক পাস করেন সোনারঙ স্কুল থেকে। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য চলে যান কলকাতায়। সেখানে যাওয়ার পর তিনি যুক্ত হয়েছিলেন বিপ্লবী দল যুগান্তরের সঙ্গে। ওই দলের সংগঠক ছিলেন জীবন চ্যাটার্জি। ছাত্রাবস্থায় বোনের উৎসাহে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন স্বদেশী বিপ্লবী কাজে। তখন থেকে সত্যেনের সাহিত্য চর্চার শুরু। তাঁর কবিতা ছাপা হতো ‘নবশক্তি’ পত্রিকায়। কলেজের ছাত্রাবস্থায় সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য ১৯৩১ সালে গ্রেফতার হয়ে বহরামপুর কারাগারে একটানা পাঁচ বছর বন্দী থাকেন। জেলে বসেই তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৩৮-এ বহরামপুর কারাগার থেকে মুক্তির পর গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য। তিনি গবেষণায় প্রবেশ না করে মার্কসবাদী রাজনীতি চর্চায় মগ্ন থাকেন। আসলে জেল জীবনই তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা আমূল পাল্টে দিয়েছিল।
তিনি তারুণ্যের শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইতেন সমাজ পরিবর্তনের কাজে। কখনও সাহিত্যসংগঠন গড়ে, কখনও গানের দল গড়ে। আর এজন্য তিনি কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়া ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারত সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মিলের শ্রমিকদের নিয়ে কবিগানের দল গঠন করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে আত্মগোপনে ছিলেন প্রতিভা সেনের বাড়িতে। তারপর সমাজতন্ত্রের পক্ষে মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য ফিরে আসেন সোনারঙ গ্রামে। পুনরায় কৃষক আন্দোলনে যোগদান। প্রখ্যাত কৃষক নেতা জীতেন ঘোষের সাথে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরমধ্যে সত্যেনের মা বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। মায়ের অসুখের চিঠি গিয়ে পড়ে পুলিশের হাতে। পুলিশ তাকে বিপ্লবী কর্মকা- পরিচালনা করার দায়ে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করে। ১৯৪৯ সালে জেলে থাকাকালে তাঁর মা মারা যান। সত্যেন বন্দী ছিলেন ঢাকা ও রাজশাহী জেলে। ওই সময় কারাগারে বসে তিনি অনশন করেন একাধারে ৪০ দিন। দীর্ঘ কারাভোগ ও নির্যাতনে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। প্রায় চার বছর কারানির্যাতন ভোগের পর ১৯৫৩-তে মুক্তি লাভ। আবারও ফিরে আসেন সোনারঙ গ্রামে। তখন নানা প্রতিকূল পরিবেশের জন্য তাঁদের পরিবার কলকাতায় চলে যায়।
১৯৫৪ সালের ৩০ মে পূর্ব বাংলায় ৯২-ক ধারা জারি হলে আবার গ্রেফতার হন তিনি। কিছুকাল পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। শুরু হয় সাংবাদিকতা জীবনের নতুন পথচলা। ১৯৫৮-এর ৭ আগস্ট দেশে সামরিক আইন জারি হলে পুনরায় গ্রেফতার। দীর্ঘ পাঁচ বছর জেলে থাকার পর ১৯৬৩-এর শেষ দিকে মুক্তিলাভ। পুনরায় দৈনিক সংবাদে যোগদান। ১৯৬৫-র আগস্ট থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ফের কারাবাস। মুক্তি পাওয়ার পর আবার যুক্ত হন ‘দৈনিক সংবাদ’-এ। তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে সাংবাদিকতায়। সেখানে তিনি নিয়মিত কলাম ও অনুসন্ধানী নিবন্ধ লিখতেন। এ পত্রিকায় যুক্ত থাকাকালেই তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে কৃষক আন্দোলনের অনেক তথ্য সমৃদ্ধ কাহিনী জানতে পারেন। যা পরে তার বিভিন্ন বইতে স্থান পেয়েছে।
সত্যেন সেন রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধঘোষিত তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কৃষক সংগঠন গড়লেও সে পরিচয় তার মুখ্য হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৮ সালের ২৯ আগস্ট তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’। শিল্পী সাইদুল ইসলামের নারিন্দার বাসায় সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, কামরুল আহসান, মোস্তফা ওয়াহিদ খানকে নিয়ে গঠিত হয় উদীচী। সত্যেন সেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ সংগঠনের উদ্দেশ্য মেহনতি মানুষকে গানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করা। ১৯৭১ সালে বাঙালীর সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে উদীচী গড়ে তোলে এক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। এ সংগ্রাম বাংলার পথে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের পর থেকে উদীচী স্বয়ং দেশব্যাপী এক দুর্বার আন্দোলন হিসেবে দেখা দেয়। ’৭২-এর আগে উদীচী তার একটি গণসঙ্গীতের স্কোয়াড নিয়ে গর্ব করত। বর্তমানে ৩১৫টি শাখা সংগঠন এবং দেশের বাইরে ৫টি শাখা রয়েছে। প্রতিটি শাখায় গানের দল রয়েছে। রয়েছে সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা, পাঠাগার ও সাহিত্য বিভাগ। ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘একুশে পদক’ লাভ করেছে।
সত্যেন সেন সাহিত্যচর্চা শুরু করেন পরিণত বয়সে। তখন তিনি পঞ্চাশ অতিক্রান্ত। তাঁর কাছে সাহিত্যই ছিল সংস্কৃতির প্রাণ। তাঁর ভাষায় ‘মানুষের কাছে যে কথা বলতে চাই, সে কথা অন্যভাবে বলতে পারব না, সে জন্যই সাহিত্যের আশ্রয়।’ বাংলা কথাসাহিত্যের জনজীবনমুখী, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাহিত্য নির্মাণের পথিকৃৎ লেখক তিনি। তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে সমাজ, রাজনীতি, সমকালীন ও অতীত ইতিহাস। সত্যেন সেন রচিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় চল্লিশ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : উপন্যাস : ভোরের বিহঙ্গী (১৯৫৯), রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ (১৯৬৩), অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৯), পাপের সন্তান (১৯৬৯), সেয়ান (১৯৬৯), পদচিহ্ন (১৯৬৯), পুরুষমেধ (১৯৬৯), আলবেরুনী (১৯৭০), সাত নম্বর ওয়ার্ড (১৯৭০), বিদ্রোহী কৈবর্ত্য (১৯৭০), বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম (১৯৭৬), জীববিজ্ঞানের নানা কথা (১৯৭৭), ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা (১৯৮৬) ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখিত গল্প : পাতাবাহার (১৯৬৮), অভিযাত্রী (১৯৬৯) অন্যতম। তার সাহিত্য সাধনার উৎস প্রগতিশীল ও গণমুখী চেতনা। ১৯৬৯ সালে ‘পাপের সন্তান’ উপন্যাসের জন্য তিনি ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ ও ১৯৭০-এ ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ পান। ১৯৮৬-তে তাকে ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) দেয়া হয়। চিরকুমার সত্যেন সেন আজীবন জড়িত ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। জন্ম শতবর্ষ পার করার পরও কীর্তিমান এই মানুষটিকে আমরা যথার্থ খুঁজে পাইনি। যুগে যুগে সত্যেন সেনরা আসে জাতিকে জাগানোর জন্যে কিন্তু জাতি জাগে না আর সত্যেন সেনরা নিরবে হাসে জাতির বোকামী আর নির্বুদ্ধিতা দেখে।

Wednesday 25 May 2016

কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে। পর্ব দুই।।



জমিদার কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস?

হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো।

সূফি বরষণ

অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গোটা মুসলমান সমাজকে নিষ্পেষিত ও নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেছিল ইংরেজ শাসকগণ। মুসলমান আমলে সকল প্রকার সরকারী চাকুরীতে সিংহভাগ ছিল মুসলমানদের। ইংরেজ এদেশের মালিক মোখতার হওয়ার পর ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সকল বিভাগের চাকুরী থেকে বিতাড়িত হতে লাগলো। শেষে সরকারের বিঘোষিত নীতিই এই হ’য়ে দাঁড়ালো যে, কোনও বিভাগে চাকুরী খালি হ’লেই বিজ্ঞাপনে এ কথার বিশেষভাবে উল্রেখ থাকতো যে মুসলমান ব্যতীত অন্য কেউ প্রার্থী হ’তে পারে। ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত আইন পাশ করে মুসলমান বাদশাহগণ কর্তৃক প্রদত্ত সকলপ্রকার জায়গীর, আয়মা, লাখেরাজ, আলতমগা, মদদে মায়াশ প্রভৃতি ভূসম্পদ মুসলশানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পথের ভিখারীতে পরিণত করে। একমাত্র বাংলাদেশেই অন্যূন পঞ্চাশ হাজার ও ইনাম কমিশন দ্বারা দাক্ষিণাত্যের বিশ হাজার লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের বহু লক্ষ টাকা আয়ের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি সরকার অন্যায়ভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রকৃত হকদারকে বঞ্চিত করে। সরকারের এসব দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেল ফলে বহু প্রাচীন মুসলিম পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষঅ ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যান্ত আইন দ্বারা মুসলমানদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেল। বাংলার কৃষকদের মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ছিল মুসলমান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণী হলো হিন্দু এবং জমির একচ্ছত্র মালিক। কৃষককুল হলো তাদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল। তাদের শুধু জমি চাষের অনুমতি রইলো, জমির উপর কোন অধিকার বা স্বত্ব রইলো না। হিন্দু জমিদারগণ প্রজাদের নানাভাবে রক্ত শোষণ করতে লাগলো। জমির উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধি, আবহাওয়া, সেলামী, নজরানা, বিভিন্ন প্রকারের কর প্রভৃতির দ্বারা কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো। যেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর প্রমুখ মনীষীগণ।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার অংগন থেকেও মুসলমানদেরকে বহু দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ব্যবসা ও শিল্পবাণিজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবদুল মওদূদ বলেণ, “দেশীয় কারিগর শ্রেণীকে নির্মমভাবে পেষণ করে দেশীয় শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়া হয়। তার দরুন শ্রমজীবীদের জীবিকার পথ একমাত্র ভূমি কর্ষণ ব্যতীত আর কিছুই খোলা রইলোনা। আর ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বণিক-রাজের কুঠিরগুলিতে আশ্রয়ে নতুন দালাল শ্রেণীর ব্যবসায়ীও জন্মলাভ করলো বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, মুন্সী, দেওয়ান উপাধিতে। বহির্বাণিজ্যে ও অন্তর্বাণিজ্যে সবদিক দখল করে যে দালাল শ্রেণীর জন্মদান করলো, তারাও হয়ে উঠলো স্বার্থ ভোগের লোভে দেশীয় শিল্প ও কারিগরির প্রতি বিরূপ। এই নতুন আর্থিক বিন্যাসের ফলে যে নতুন ভূস্বামী ও দালাল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো, তাদের একজনও মুসলমান নয় –মুসলমানদের সে সমাজে প্রবেশাধিকারও ছিলনা এবং এই সম্প্রদায়ই ছিল বিস্তৃত গণবিক্ষোভ বা জাতীয় জাগরণের প্রধান শত্রু। এ কথা লর্ড বেন্টিংকও স্বীকার করে গেছেন-

“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে সত্য, তবে এর দ্বারা জনগণের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশালী বড়ো একদল ধনী ভূস্বামী সম্পদায়ের সৃষ্টি হয়। তার একটি বড়ো সুবিধা এই যে, যদি ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লবের ফলে শাসনকার্যের নির্বিঘ্নতা ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এই সম্প্রদায়ই নিজেদের স্বার্থে সর্বদাই ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখার জন্যে প্রস্তুত থাকবে”। [সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ (শতাব্দী পরিক্রমা), পৃঃ ৬২]।

এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ আরও একটু পরিষ্কার করে বলেন- “এ মতবাদের সমর্থক এ দেশীয় লোকেরও অভাব নেই। এই সেদিনও বিশ্বভারতীতে বাংলার জনগণ সম্বদ্ধে বক্তৃতাকালে কাজী আবদুল ওদুদ সাহেব বলেছেনঃ সেদিনে বাংলাদেশে অন্ততঃ বাংলার প্রাণকেন্দ্রে কোলকাতায় সিপাহী বিদ্রোহের কোন প্রভাব অনুভূত হয়তি। হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখার্জি এই বিদ্রোহ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, সিপাহী বিদ্রোহ কেবলমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিপাহীদের কর্মমাত্র, দেশের প্রজাবর্গের সহিত তাহার কোনও সম্পর্ক নাই। প্রজাকুল ইংরেজ গভর্ণমেন্টের প্রতি অনুরক্ত ও কৃতজ্ঞ এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে”।

কাজী সাহেব আরও বলেন হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদকের মত যে মোটের উপর সেদিনের বাংলাদেশের মত ছিল, তার একটি ভালো প্রমাণ –বিদ্যাসাগর ও দেবেন্দ্রনাথের মতো স্বাধীনচেতা বাঙালীরাও সেদিন সিপাহী বিদ্রোহ সম্বন্ধে কোন রকম কৌতুহল দেখাননি। …সিপাহী বিদ্রোহ সেদিন শিক্ষিত বাঙালীকে সাড়া দেয়নি, অশিক্ষিত, হিন্দু বাঙালীকে নাড়া দেয়নি”। (সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ৫৮)।
করছি।

বাংলার নতুন হিন্দু জমিদারগণ হয়ে পড়েছিল ইংরেজদের বড়োই প্রিয়পাত্র। একদিকে তাদেরকে সকল দিক দিয়ে তুষ্ট রাখা এবং মুসলমানদিগকে দাবিয়ে রাখার উপরেই এ দেশে তাদের কায়েমী শাসন সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানদের উপর হিন্দু জমিদারগণ ন্যায় অন্যায় আদেশ জারী করার সাহস পেতো।

নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদেরকে যেমন ব্রাহ্মণেরা ধর্মকর্মে স্বাধীনতা ও মন্দিরে প্রবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল, অনুরূপভাবে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমাদেরকেও নানান ভাবে করতো জুলুম অত্যাচার নির্যাতন ।
আবদুল গফুর সিদ্দিকী তাঁর গ্রন্থে বলেনঃ- পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জমিদার ও উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিরক্ষর মুসলমানদেরকে বুঝাইলঃ তোরা গরীব। কৃষিকার্য ও দিনমজুরী না করলে তোদের সংসার চলে না। এমতাবস্তায় তোদের প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক ও বার্ষিক নামাজ এবং রোজ, হজ্জ, জাকাত, জানাজা, প্রার্থনা, মৃতদেহ স্নান করানো প্রভৃতি ধর্মকর্ম করিবার সময় কোথায়? আর ঐ সকল কার্য করিয়া তোর অর্থোপার্জন করিবার সময় পাইবি কখন এবং সংসার –যাত্রাই বা করিবি কি প্রকারে? সুতরাং তোরাও ধর্মকার্যগুলি করিয়া দিবে, তোদেরও সময় নষ্ট হইবেনা।

দ্বীন ইসলামের শিক্ষা হইতে বঞ্চিত পশ্চিবঙ্গের কৃষক ও কৃষিমজুর শ্রেণীর মুসলমানেরা বাবুদিদের এই পরামর্শ আন্তরিকতার সহিত গ্রহণ করিল। ক্রমে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজেও এই ব্যাধি ছড়াইয়া পড়িল। এই সঙ্গে আজাজিল শয়তান এবং নফস আম্মারা তাহাদিগকে প্ররোচনা দান করিল। তাহারা বাবুদিগের কথার জবাবে বলিল, বাবু আপনি ঠিকই বলিয়াছেন। এতদিন আমাদিগকে এই প্রকার হিতোপদেশ আর কেহ দেন নাই। আমরা নির্বোধ, কিছু বুঝি না। আপনি আমাদের যাহা বিবেচনা করেন তাহা করুন। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৫-৬)।

জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মতিকে বললো, তিতু ওহাবী ধর্মাবলস্বী। ওহাবীরা তোমাদের হযরত মুহাম্মদের ধর্মমতের পরম শত্রু। কিন্তু তারা এমন চালাক যে, কথার মধ্যে তাদেরকে ওহাবী বলে ধরা যাবে না। সুতরাং আমার মুসলমান প্রজাদেরকে বিপথগামী হতে দিতে পারি না। আজ থেকে তিতুর গতিবিধির দিকে নজর রাখবে এবং সব কথা আমাকে জানাবে।

অতঃপর কৃষ্ণদেব রায় গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এবং গোবরডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিতুমীরের বিরুদ্ধে শাস্তিভংগের নালিশ করার জন্যে কিছু প্রজাকে বাধ্য করল। তারপর জমিদারের আদেশে মতিউল্লাহ, তার চাচা গোপাল, জ্ঞাতিভাই নেপাল ও গোবর্ধনকে দনিয়ে জমিদারের কাচারীতে উপস্থিত হয়ে নালিশ পেশ করলো। তার সারমর্ম নিম্নরূপ-

চাঁদপুর নিবাসী তিতুমীর তার ওহাবী ধর্ম প্রচারের জন্যে আমাদের সর্পরাজপুর (মুসলমানী নাম সরফরাজপুর) গ্রামে এসে আখড়া গেড়েছে এবং আমাদেরকে ওহাবী ধর্মমতে দীক্ষিত করার জন্যে নানারূপ জুলুম জবরস্তি করছে। আমরা বংশানুক্রমে যেভাবে বাপদাদার ধর্ম পালন করে আসছি, তিতুমীর তাদে বাধা দান করছে। তিতুমীর ও তার দলের লোকেরা যাতে সর্পরাজপুরের জনগণের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে না পারে, জোর করে আমাদের দাড়ি রাখতে, গোঁফ ছাঁটতে, গোহত্যা করতে, আরব দেশের নাম রাখতে বাধ্য করতে না পারে, হিন্দু-মুসলমানে দাংরগা বাধানে না পারে, হুজুরের দরবারে তার বিহিত ব্যবস্থার জন্যে আমাদের নালিশ। হুজুর আমাদের মনিব। হুজুর আমাদের বাপ-মা।

গোপাল, নেপাল, গোবর্ধনের টিপসইযুক্ত উক্ত দরখাস্ত পাওয়ার পর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় হুকুম জারী করলো।

১। যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ওহাবী হবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ ছাঁটবে তাদেরকে ফি দাড়ির জন্যে আড়াই টাকা ও ফি গোঁফের জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে।

২। মসজিদ তৈরী করলে প্রথ্যেক কাঁচা মসজিদের জন্যে পাঁচশ’ টাকা এবং প্রতি পাকা মসজিদের জন্যে এক হাজার টাকা করে জমিদার সরকারে নজন দিতে হবে।

৩। বাপদাদা সন্তানদের যে নাম রাখবে তা পরিবর্তন করে ওহাবী মতে আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্যে খারিজানা ফিস পঞ্চাম টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।

৪। গোহত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে –যাতে আর কোনদিন গোহত্যা করতে না পারে।

৫। যে ওহাবী তিতুমীরকে বাড়ীতে স্থান দিবে তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

(শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী পৃঃ ৪৮, ৪৯; স্বাধীনতা সংগ্রাসের ইতিহাস, আবু জাফর পৃঃ ১১৯; Bengal Criminal Judicial Consultation, 3 April 1832, No. 5 and 6)।

মুসলমান প্রজাদের উপরে উপরোক্ত ধরনের জরিমানা ও উৎপীড়নের ব্যাপারে তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ণ, কুরগাছির জমিদারের নায়েব নাগরপুর নিবাসী গৌড় প্রসাদ চৌধুরী এবং পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নাম পাওয়া যায় –Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5 রেকর্ডে। (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।

বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে জমিদার রাম নারায়ণের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল যাতে জনৈক সাক্ষী একথা বলে যে –উক্ত জমিদার দাড়ি রাখার জন্যে তার পঁচিশ টাকা জরিমানা করে এবং দাড়ি উপড়ে ফেলার আদেশ দেয়। Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5; (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।

তিতুমীর কৃষ্ণদেব রায়কে একখানা পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোন অন্যায় কাজ করেননি, মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন। এ কাজে হস্তক্ষেপ করা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা প্রভৃতি মুসলমানের জন্যে ধর্মীয় নির্দেশ। এ কাজে বাধা দান করা অপর ধর্মে হস্তক্ষেপেরই শামিল।

তিতুমীরের জনৈক পত্রবাহক কৃষ্ণদেব রায়ের হাতে পত্রখানা দেয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তাও পাঠক সমাজের জেনে রাখা প্রয়োজন আছে –তা এখানে উল্লেখ করছি।

পত্রখানা কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে পত্রবাহক চাঁদপুরের তিতুমীর সাহেবের নাম করে। তিতুমীরের নাম শুনতেই জমিদার মশাইয়ের গায়ে আগুন লাগে। রাগে গর গর করতে করতে সে বল্লো, কে সেই ওহাবী তিতু? আর তুই ব্যাটা কে?

নিকটে জনৈ মুচিরাম ভান্ডারী উপস্থিত ছিল। সে বল্লো, ওর নাম আমন মন্ডল। বাপের নাম কামন মন্ডল। ও হুজুরের প্রজা। আগে দাড়ি কামাতো, আর এখন দাড়ি রেখেছে বলে হুজুর চিনতে পারছেন না।

পত্রবাহক বল্লো, হুজুর আমার নাম আমিনুল্লাহ, বাপের নাম কামালউদ্দীন, লোকে আমাদেরকে আমন-কামন বলে ডাকে। আর দাড়ি রাখা আমাদের ধর্মের আদেশ। তাই পালন করেছি।

কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস? আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা। ব্যাটা আমার সাথে তর্ক করিস, এত বড়ো তোর স্পর্ধা? এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হলো তাকে গারদে বন্ধ করে উচিত শাস্তির। বলা বাহুল্য, অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলো আমিনুল্লাহ। সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মুসলমানরা মর্মাহত হলো, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে প্রবল শক্তিশালী জমিদারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে না পেরে তারা নীরব রইলো।

১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম হিসাব করে বের করে যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য (অর্থাৎ হিন্দুদেরকে দিয়ে লাভবান হওয়ার জন্য) এক ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখে।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এমআর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮)।

মুসলমানদের শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত জমি-সম্পত্তির উপর ব্রিটিশ আর হিন্দুদের শকুনি দৃষ্টি পতিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতেই ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ছূফী-দরবেশ, আলিম-উলামা উনাদের নিকট থেকে এসব লাখেরাজ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়।
তৎকালীন ভারত সরকারেরই একজন ইংরেজ সদস্য চার্লস মেটকাফ ব্রিটিশদের এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সম্পর্কে ১৮২০ সালে মন্তব্য করেছিল যে, “এ নীতি হচ্ছে অন্যায় অবিচারের চূড়ান্ত; কোনো দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠীর হিন্দু বাবুদের হাতে তুলে দেয়া হলো যারা নানা দুর্নীতি ও উৎকোচের আশ্রয় নিয়ে দেশের ধনসম্পত্তি চুষে খেতে চায়।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃষ্ঠা ৭৯)। 

Saturday 21 May 2016

কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে।

পর্ব এক।

সূফি বরষণ
১৭৯৩ সালে ভূমি-ব্যবস্থার সংস্কারের নামে বাংলার মুসলিম কৃষকদেরকে  শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ব্যবহার করে কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের নব্য হিন্দু জমিদাররা। ব্রিটিশরা আসার আগে জমিদাররা জমির মালিক ছিল না, শুধু খাজনা তুলে সরকারী কোষাগারে জমা দিত। তারপর ১৭৯৩সালে ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলো, জমিদারদের জমির মালিকানা দেয়া হলো, জমিদাররা জমির চিরস্থায়ী মালিক হলো, জমিদারদের বলা হলো তারা সরকারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমান খাজনা আদায় ছাড়াও আরো যতভাবে খুশি টাকা আদায় করতে পারবে। তবে কোনো কৃষক ও সাধারণ নাগরিক যেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে না পারে। অর্থাত জমিদাররা হয়ে গেল ব্রিটিশ সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী ও কৃষক নির্যাতন অত্যাচারকারী বর্ণ হিন্দু নব্য জমিদাররা গড়ে তুললে সম্পদের পাহাড়।

১৭৯৩ সালে লর্ড  কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার জমি মালিকদের (সকল শ্রেণীর জমিদার ও স্বতন্ত্র তালুকদারদের) মধ্যে সম্পাদিত একটি যুগান্তকারী চুক্তির নাম। এই চুক্তির আওতায় জমিদার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বে জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন। চুক্তির আওতায় জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্ব-দাবি বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও জমিদারদের তরফ থেকে প্রজাদের ওপর রাজস্বের দাবি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। জমিদারদের জমি বিক্রয়, বন্ধক, দান ইত্যাদি উপায়ে অবাধে হস্তান্তরের অধিকার থাকলেও তাদের প্রজা বা রায়তদের সে অধিকার দেওয়া হয়নি। নিয়মিত খাজনা পরিশোধ সাপেক্ষে উত্তরাধিকারক্রমে জমির মালিক থাকার প্রথাগত অধিকার রায়তদের বা কৃষকদের থাকলেও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিল না। সরকারের বেলায় জমিদারদের অবশ্য একটি দায়দায়িত্ব কঠোরভাবে পালনীয় ছিল। সেটি হচ্ছে নিয়মিত সরকারের রাজস্ব দাবি পরিশোধ করা।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে উচ্চ বর্ণ হিন্দু জমিদার ও ইংরেজদের লুণ্ঠন সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ “নবাবের সিংহাসন নিয়ে চক্রান্ত করে, জমিদারী বন্দোবস্ত ও রাজস্ব আদায়ের নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, ব্যক্তিগত ও অবৈধ বাণিজ্য থেকে প্রচুর মুনাফা লুণ্ঠন করে এবং আরও নানা উপায়ে উৎকোচ-উপঢৌকন নিয়ে চার্ণক-হেজেস-ক্লাইভ-হেষ্টিংস-কর্নওয়ালিসের আমলের কোম্পানির কর্মচারীরা যে কি পরিমাণ বিত্ত সঞ্চায় করেছিলেন তা কল্পনা করা যায় না। …. দেখতে দেখতে প্রচুর অর্থ ও নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে কোম্পানি সাহেবরা সত্যি সত্যি নবাব বনে গেলেন। তাদের মেজাজ ও চালচলন সবই দিন দিন নবাবের মতো হয়ে উঠতে লাগল”। ( বিনয় ঘোষ_কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, পৃষ্ঠা ৪৪৫)।

আর ইংরেজদের কাছ থেকে উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের হঠাৎ করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদারির মালিক হওয়ার প্রসঙ্গে ডক্টর আহমদ শরীফ বলেন,
 স্বল্প বেতনভূক’ বণিক নাবিক আর লোফার’ ইংরেজ কর্মচারীরা’ বেঙ্গল নেবুব’- এ পরিণত হলো। আর তাদের এ দেশীয় লুণ্ঠন-সহচর দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দীরা দালালীর মাহত্ম্যে রাতারাতি পরিণত হলো রাজা-মহারাজারয়। এই সম্মিলিত লুটেরা চক্রটি সম্পর্কেই ডক্টর আহমদ শরীফ লিখেছেনঃ “প্রথমে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে কতগুলো ভাগ্যবিতাড়িত, চরিত্রভ্রষ্ট, ধুর্ত, পলাতক, অল্প শিক্ষিত লোক বেনিয়া-মুৎসুদ্দী-গোমস্তা-কেরানী-ফড়িয়া দালালরূপে অবাধে অঢেল অজস্র কাঁচা টাকা অর্জন ও সঞ্চয়ের দেদার সুযোগ পেয়ে ইংরেজদের এ দেশে উপস্থিতিকে ভগবানের আশীর্বাদরূপে জানল ও মানল”। ( ডক্টর আহমদ শরীফ_বঙ্কিম বীক্ষা-অন্য নিরিখে, ভাষা-সাহিত্যপত্র,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী সংখ্যা, ১৩৮২)।

এ প্রসঙ্গে আবদুল মওদুদ লিখেছেন: “আঠার শতকের মধ্যভাগে কলকাতা ছিল নিঃসন্দেহে বেনিয়ানের শহর-যতো দালাল, মুৎসুদ্দী, বেনিয়ান ও দেওয়ান ইংরেজদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যবর্তীর দল। এই শ্রেণীর লোকেরাই কলকাতাতে সংগঠিত হয়েছিল ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট ও বশংবদ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে”। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৮২, পৃষ্ঠা ২৮২)।

আর এইসব উচ্চ বর্ণ হিন্দু দালাল, মুৎসুদ্দী, বেনিয়ান ও দেওয়ান সম্পর্কে কলকাতা মার্কসবাদী গবেষক বিনয় ঘোষ দেখিয়েছেন, কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল ‘নাবিক, সৈনিক ও লোফার’- এই তিন শ্রেণীর ইংরেজের হাতে। তাদের দেওয়ান, বেনিয়ান ও দালালরূপে এদেশীয় একটি নতুন শ্রেণী রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়ে ইংরেজদের জুনিয়র পার্টনাররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

টাউন কলকাতার কড়টা’ বইয়ে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ“………. ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠার শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতি ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে।…… এক পুরুষের দেওয়ানি করে তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক যুগিয়ে এসেছে………। বেনিয়ানরা ……. ছিলেন বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা।…….. আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা এ দেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ত করেন, তখন দেশ ও দেশের মানুষ সম্বন্ধে তাদেঁর কোন ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তাঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ-প্রায় সমস্ত ব্যপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হতো তাঁরাই হলে বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথম যুগের ইংরজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন,হিসেব রক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে”। (টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)।

এখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পিছনে ইতিহাস সম্পর্কে একটু বলা যাক। এই বাঙালি বেনিয়ানরা প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ,বাণিজ্য প্রতিনিধি আর মহাজন শুধু ছিল না, তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও সহচর। ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক হুগলী নদীর উজান বেয়ে যখন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তখন থেকেই এই শ্রেণীর সাথে তাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগর সুবাদে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের রাজনৈতিক গাঁটছাড়া। আঠার শতকের শুরু থেকে সে সম্পর্কে আরো জোদার হয়। এ জন্যই দেখা যায় ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় যে ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করে, তারা সকলেই ছিল একটি বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোক। ১৭৩৯ সালে কোম্পানি কাসিমবাজারে যে পঁচিশ জন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে তাদেরও অভিন্ন পরিচয়। এভাবেই গড়ে ওঠে ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্রমূলক মৈত্রী। মুসলিম শাসনের অবসানই ছিল এই মৈত্রীজোটের উদ্দেশ্য। (এস. সি. হিল তাঁর গ্রন্হ ‘বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-১৭৫৭’-এর ২৩, ১০২, ১১৬ ও ১৫৯ পৃষ্ঠায় প্রমাণপঞ্জীসহ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।)

এই শ্রেণীর লোকেরাই বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ব্যক্তিস্বার্থ ও সংকীর্ণ মোহাচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবশত এই শ্রেণীর লোকেরাই স্বাধীনতার পরিবর্তে পরাধীনতাকে স্বাগত জানিয়েছিল।আর যার ফলাফলচিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
 বিষয়টি খোলামেলা তুলে ধরে এম. এন. রায় লিখেছেনঃ “It is historical fact that a large section of Hindu community welcomed the advent of the English power.” (India In Transition)

আার রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেনঃ “British could winover political authority without any opposition from the Hindus.” (British Paramountcy and Indian Renaissance. Part-II, P-4)

ইংরেজরা বাংলার সাবেক শাসক জাতির ব্যাপারে একদিনের জন্যও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। লর্ড ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “মুসলমানরা সব সময়ই বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত। সাফল্যের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে জানলেই তারা সাথে সাথে তা সংঘটিত করবে”। (Selections from Unpublished Reords of Govt……1784-67; James Long, 1973, P-202)

বিদ্রোহের এ আশঙ্কার কারণেই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা হয়।, তা কর্ণওয়ালিসের যবানি থেকেই খোলাসাভাবে জানা যায়। তার ভাষায়ঃ
“আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ভূস্বামীদেরকের আমাদের সহযোগী করে নিতে হবে। যে ভূস্বাশী একটি লাভজনক ভূসম্পত্তি নিশ্চিন্তে ও সুখে-শান্তিতে ভোগ করতে পারে তার মনে তার কোনরূপ পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগতেই পারে না”। ( বদরুদ্দীন উমর : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংলাদেশের কৃষক, পৃষ্ঠা ২২)


চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজদের জন্য ধারণাতীত সাফল্য বয়ে এনেছিল। তাই, ইংরেজদের ওপর চরম আক্রোশ নিয়ে বাংলাদেশের নির্যাতিত কৃষকরা যখন যুদ্ধরত, ‘মুসলমান মাত্রই রাণীর বিদ্রোহী প্রজা’- রূপে  চিহ্নিত করা হতো। আর অপরদিকে কলকাতার সদ্য বিকশিত উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের এই শ্রেণীটি প্রকাশ্যে ইংরেজদের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণার মাধ্যমে প্রভূর শক্তি বৃদ্ধি করেছিলঃ

ইংরেজদের চরম দুর্দিনে ১৮৯৮ সালের ২১ আগস্ট বাংলার জমিদারগোষ্ঠীর প্রতিভূরূপে কলকাতার সেরা ধনী গৌরচণ মল্লিখ, নিমাইচরণ মল্লিক, গোপিমোহন ঠাকুর, কালীচরণ হালদার, রসিকলাল দত্ত, গোকুলচন্দ্র দত্ত প্রভৃতিরা এক সভা অনুষ্ঠান করে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতি তাঁদের আনুগত্যের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। (সিলেকশন ফ্রম ক্যালকাটা গেজেটস, ভল্যুম-৩, ডব্লিউ এস সিটনকার, পৃষ্ঠা ৫২৫, উদ্ধৃত স্বপন বসু : বাংলার নব চেতনার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৮৩)।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে কলকাতার বর্ণহিন্দু অভিজাত শ্রেণীটির আত্মপ্রতিষ্ঠার সে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীকে পাওয়া যায় তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিৎপুর-বিরাজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলির ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে টাউন কলকাতার দ্রুত বেড়ে ওঠার কারণ এবং ইংরেজদের দ্বারা নব্য-সৃষ্ঠ শ্রেণীটির অবাক উত্থানর কারণ সম্পর্কে এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়।

সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন: “বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকগণের মুৎসদ্দিগিরি, লবণের ইজারা, প্রভৃতির মারফত যাহারা প্রভূত ধন-সম্পদ আহরণ করিয়াছিল, তাহারা এবং মার্ক্সের ভাষায় ‘শহরের চুতর ফড়িয়া ব্যবসায়ীগণ’ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে….. নতুন জমিদার শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হইয়াছিল। এই নতুন জমিদার শ্রেণীটির বৈশিষ্ট্য ছিল- ইংরেজ শাসকগণের প্রতি অচলা ভক্তি…. এবং কৃষির ক্ষেত্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া শহরের অবস্থিত, গ্রামাঞ্চলের ভূসম্পত্তি হইতে ইজারা মারফত অনায়াস-লব্ধ অর্থবিলাস-ব্যসনে জীবন যাপন এবং ‘বেনিয়ান’ লবণের ইজারাদার প্রভৃতি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বগ্রাসী ব্যবসায়ের সহিত ঘনিষ্ট সহযোগিতা। ইংরেজ-সৃষ্ট এই নতুন বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীটি আবির্ভূত হয়। দ্বারাকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রভৃতি ছিলেন এই অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগণ্য।….. সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেছিল, তখন ……. (এই শ্রেণীটি) সংগ্রামরত কৃষকের সহিত যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য কৃষকের সহিত ধনবল ও জনবল নিয়োগ করিয়াছিল”। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯)।

১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ভূমি পরিণত হলো পণ্যে। বহু বনেদী পরিবার রাতারাতি হলো পথের ভিখারী। অন্যদিকে ইংরেজ দেবতার পূজা-আর্চনা করে দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দী গোমস্তা শ্রেণীর লোকেরা জমিদারী কিনে হলো সামন্ত-অভিজাত। ১৮২৯ সালে বাজেয়াফত হলো লাখোরাজ সম্পত্তি। এই সব নিষ্কর জমির আয়ে পরিচালিত মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো। সব দিক থেকেই নেমে এলো অন্ধকার। এরপর এলা রাজ-ভাষার ওপর আঘাত। ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি হলো অফিস-আদালতের ভাষা।হিন্দুরা নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিল পুরোনো নিয়মে। কিন্তু লুণ্ঠিত, বঞ্চিত, অবদমিত, ক্ষুব্ধ, হাতাশা-বিহ্বল, অভিমানাহত মুসলমানরা তখন সারা দেশে সুযোগ পেলেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। বাঙালি হিন্দুঘরের ছেলেরা যখন ইংরেজি শেখার জন্য হেয়ার সাহেবের পাল্কির সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। তখনকার মুসলমান মাত্রই ছিল লর্ড ক্যানিং-এর ভাষায়- ‘মহারানীর বিদ্রোহী প্রজা’। কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু নব্য বিকশিত বাবুশ্রেণী যখন লর্ড ক্লাইভকে দেবতা-জ্ঞানে পূজা করছে, পল্লী বাংলায় জনগণের মধ্যে তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্রমে পুঞ্জিভূত হচ্ছিল চাপা ক্ষোভ আর ঘৃণাৰ। রামেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেনঃ “সারা বাংলায় ইংরেজদের অখ্যাতি এমন রটেছিল যে, একজন ইংরেজ কোন গ্রামে এলে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত, জনসাধারণও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পালিয়ে বাঁচত”। (দি ইকনোমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ১১২)।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও  বাঙালি মুসলমানদের দু:সময়ের চাঞ্চল্যকর আরও অনেক তথ্য দিয়েছেন কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি বইয়ের পৃষ্ঠা ২৭ লেখক এম আর আখতার মুকুল বলেন," চিরস্থায়ী হিসেবে জমিদারির বন্দোবস্ত দেওয়ার প্রস্তাব করে ১৭৯৩ সালের ৬ই মার্চ লর্ড কর্ণওয়ালিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনস্থ ডিরেক্টরদের কাছে লেখা চিঠিতে বললেন, “বেশ কিছু সংখ্যক নেটিভদের হাতে যে বিপুল পরিমাণে মূলধন রয়েছে, তা বিনিয়োগ করার আর কোনও পথ নেই। ….. তাই জমিদারির বন্দোবস্ত নিশ্চিত (চিরস্থায়ী) করা হলে শিগগির উল্লেখিত সঞ্চিত মূলধন জমিদারি ক্রয়ে বিনিয়োগ হবে।”

লর্ড কর্ণওয়ালিস –এর চিন্তাধারা ইংরেজদের দৃষ্টিকোন থেকে সময়োপযোগী ও সঠিক ছিল। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ানী, মুৎসুদ্দিগিরি, বেনিয়ানি এবং ব্যবসার মাধ্যমে কোলকাতার সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে যে বিপুল পরিমাণ মূলধন সঞ্চিত হয়েছিল, অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তা জমিদারি ক্রয়ে বিনিয়োগ হতে শুরু করল। এই নব্য ধনীরা দলে দলে নতুন জমিদার শ্রেণীতে পরিনত হলো।

লর্ড কর্নওয়ালিস এ সময় আর একটা অর্থসহ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তিনি জানতেন যে, প্রাচীন বনেদী জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রাজকোষে প্রাপ্য টাকা জমা দিতে অভ্যস্ত নয়। তাই সামান্যতম গাফিলতির দরুন এবং নতুন বন্দোবস্তের কড়া আইনের দরুন এসব জমিদারি একে একে নীলামে উঠতে লাগল। আর কোলকাতার নব্য ধনী মুৎসুদ্দি বেনিয়ানরা নীলাম থেকে এসব জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হলেন।," চলবে



Sunday 15 May 2016

বাংলাদেশের ৫৪ নদ-নদীতে পানি নেই ৪০ বছর ধরে ভারতীয় পানি আগ্রাস অব্যাহত ।

ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস আজ।

মুহাম্মদ নূরে আলম বরষণ
লেখক লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক গবেষক।

আজ সোমবার  ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়। আজ থেকে ৪০  বছর ও মৃত্যুর ছয় মাস আগে ৯৬ বছর বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ হয়। সারাদেশের লাখ লাখ জনতা রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে সে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে মারণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো মানুষের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে দিনটি ফারাক্কা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। http://en.prothom-alo.com/opinion/news/74091/Water-issues-must-be-resolved-politically

ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিল ঐ লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন ভারতীয় সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধটির নির্মাণকাজ। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত কিছু পানি ছাড়ে। আর ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয় দেশটি, সেবারই মূলত চাহিদা অনুযায়ী পানি পেয়েছিল বাংলাদেশ। তারপর ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে বাংলাদেশ। অথচ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শীতকালের শুষ্ক মৌসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ। ক্ষতি নিয়ে আর্টিকেল http://bandungjournal.springeropen.com/articles/10.1186/s40728-015-0027-5

ফারাক্কার অভিশাপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। এতে অগভীর নলকূপ থেকে বর্তমানে কোন পানি উঠছে না। সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে ১-২ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে।

চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রদান করবে। শুষ্ক মৌসুমের সময়ে ভারত বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী পানি প্রদান করলে পদ্মায় অন্তত পানি প্রবাহ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ তার নায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। http://www.futuredirections.org.au/publication/india-bangladesh-farakka-barrage/

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত গঙ্গা তথা পদ্মায় যে অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে, ওই বাঁধ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য আজও মরণফাঁদ হিসেবেই রয়ে গেছে। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এবং গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে এদিন সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠে গোটা দেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায় বাংলাদেশের মানুষের এ ধ্বনি। তাই দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণার উত্স হয়ে আছে। দিবসটি উপলক্ষে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে প্রতি বছর সারাদেশে সেমিনার, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। তবে এ বছর এমন এক সময় দিবসটি পালিত হচ্ছে, যখন দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনে নিষ্পেষিত হয়ে এ দুঃশাসন থেকে মুক্তির প্রহর গুনছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশকে গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ । এখন দেশে অবৈধ অগণতান্ত্রিক সরকার ভারতের মদদতে ক্ষমতায় তাই এরা ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না। রাজনৈতিক সহিংসতায় গোটা দেশ আজ মহাসঙ্কটে নিমজ্জিত। দেশ মহাক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করায় দেশের মানুষ অনেকটা ভুলতেই বসেছে মওলানা ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের গুরুত্ব। http://www.thedailystar.net/op-ed/politics/why-does-bangladesh-need-the-ganges-barrage-104290

ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মায় আজ পানি নেই। ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধশত নদী বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে স্থানভেদে ২৫ ফুট থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তির প্রায় ১৯ বছর হতে চলল তবু পানি চুক্তি রিভিউ করা হয়নি। চুক্তি মতে ফারাক্কায় যে পানি জমছে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগাভাগির প্রসঙ্গ চুক্তিতে উল্লেখ নেই। তাই পদ্মা নদীতে চুক্তির পানি দিয়ে চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না।

যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দীর্ঘ দিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রপে নেই। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না। পালাক্রমে উভয় দেশের মধ্যে পানির ভাগ হয়ে থাকে। ১০ দিনের যেকোনো পালায় পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলে দুই দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে পানিবণ্টনে একটি সামঞ্জস্য বিধান করে থাকেন। ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক পায়। প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক হলে বা তার কম হলে উভয় দেশ সমান সমান ভাগে পানি পায়। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগ দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য মাসে সমস্যা না হলেও মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পানিসমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। পানির দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ হতে পারে এই নিউজ তাই বলছে। http://uk.reuters.com/article/uk-water-southasia-idUKBRE86M0CC20120723

তাই বর্তমান সরকারের কাছে পানি চুক্তি রিভিউ করার দাবি তুলছেন ভুক্তভোগী মানুষ। শুকনো মওসুমে হার্ড্রঞ্জি সেতুর উজান ও ভাটিতে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পদ্মা ও সব শাখা নদীর কঙ্কাল বেরিয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জেলে। বিঘ্ন ঘটেছে সেচকাজে। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে নৌপথ। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ আর্সেনিকসহ অজানা রোগে ভুগছেন। জলবায়ুতে সূচিত হয়েছে বড় ধরনের পরিবর্তন। বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা, বাড়ছে খরার আবহ। থেকে থেকে রাজশাহী ও পাবনায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। লাখ লাখ মানুষ বহুমুখী সঙ্কটে ডুবে যাচ্ছে। আর প্রতি বছর এই অবস্থায় কর্মহীন মানুষ ঢাকা মুখী হচ্ছে।

পদ্মা নদী তার স্বয়ংক্রিয় পরিশোধনমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফারাক্কার প্রভাবে শুধু পাবনা জেলাতেই ২০ নদীতে পানি নেই। এর মধ্যে বেশ কিছু নদী এখন বিলীন হয়ে গেছে। এসব বিলীন হওয়া নদীতে বিভিন্ন মওসুমি ফসল উৎপাদন হচ্ছে। অনেকে জবর দখল করে বাড়ি নির্মাণ করছেন।
পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বিশাল বালুচর পড়েছে। সেখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে, গরু-মহিষের গাড়ি চলছে। হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে। পদ্মার সেই অপরূপ যৌবন ও সৌন্দর্য আর নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মরুকরণ দেখা দেবে। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

চলনবিল অঞ্চলের প্রবীণ লোকেরা জানান, চলনবিলসংলগ্ন ১৬টি ছোট নদী, ৩৯টি ছোট বিল ও ৩২টি খাল ছিল। এসব নদী ও খাল এখন শুধু প্রবীণ লোকদের স্মৃতিতে আছে। বাস্তবে এর বেশির ভাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফারাক্কা বাঁধের পর এসব নদী ও খাল শুকিয়ে গেছে। এখন এখানে হচ্ছে বিভিন্ন মওসুমি ফসলের চাষাবাদ। এসব নদী খাল শুকিয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার জেলে তাদের পেশা ছেড়েছেন। এদের কেউ রাজমিস্ত্রি হয়েছেন, কেউ সবজি বিক্রি করছেন আবার কেউবা রিকশা চালাচ্ছেন। আর যুগ যুগ ধরে সংসার চালানো এই পেশায় এখনো যারা রয়ে গেছেন, তাদের দিন কাটছে একবেলা খেয়ে না খেয়ে। পদ্মায় পানি না থাকায় কৃষিপ্রধান পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলে কৃষি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প নামে পরিচিত গঙ্গা-কপোতা (জি-কে) প্রজেক্টের সম্প্রসারণই শুধু বন্ধ হয়নি, যতটুকু চালু রয়েছে পানির অভাবে তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফারাক্কা করালগ্রাসের আরেক রূপ হলো নদীভাঙন। বছরের বেশির ভাগ সময় চর থাকায় পদ্মা ইতোমধ্যেই হারিয়েছে তার নাব্যতা। তাই শুকনো মওসুম শেষে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ার পর হঠাৎ নদীর প্রবাহ তীব্র হওয়ায় পুরো পদ্মাপাড়জুড়ে শুরু হয় নদীভাঙন। এর ফলে নদীতে হারিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। https://bn.m.wikipedia.org/wiki/ফারাক্কা_বাঁধ

প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ক’টি গুরুত্বপূর্ণ ও দিকনির্ধারণী হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে, তার মধ্যে মওলানা ভাসানীর ফারাক্ক মিছিল অন্যতম। ফারাক্কা মিছিল সে সময় জাতীয় স্বার্থে খুবই ফলপ্রসূ অবদান রেখেছিল। এখনও মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলের তাত্পর্য অনেক বেশি। কেননা যেসব কারণে তিনি এ প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিলেন, সে পানি আগ্রাসন এখনও অব্যাহত থাকার পাশাপাশি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারতীয় আগ্রাসন বর্তমানে ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

৪০ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একটি অংশকে মরুভূমিকরণের যে প্রচেষ্টা ভারত করেছিল, মওলানা ভাসানী তা অনুধাবন করে ফারাক্কা মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। তার ৩৪ বছর পর ভারতের মদতপুষ্ট ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থনে ভারত ফের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করে আরেক অংশকে মরুকরণের যে অপপ্রয়াস শুরু করেছিল, তার প্রতিবাদে মওলানা ভাসানীর পর ২০১০ সালে রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবসেই বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে হুঙ্কার দিয়েছিলেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ওই সমাবেশের পরই গ্রেফতার করা হয়েছিল তাকে।

পানিসঙ্কট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে রাজশাহীসহ সারা দেশের পানিসঙ্কট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সুপেয় ও সেচকাজে ব্যবহৃত পানির গভীর সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সঙ্কট আরো চরম আকার ধারণ করবে।

মরণ বাঁধ ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগুচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাঁধের কারণে একদিকে প্রমত্তা পদ্মা যেমন নাব্যতা হারিয়েছে তেমনি দেড় যুগ ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক নদীভাঙন চলছে। এক সময়ের ভয়াল পদ্মা এখন পানিশূন্য। এসব কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। বাংলাদেশ যে একদিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে ৪০ বছর আগেই তা উপলব্ধি করেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ফারাক্কার ক্ষতির কথা চিন্তা করেই ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধবিরোধী লংমার্চ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে এসেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের ঠুঠাপাড়া গ্রাম। এই এলাকা দিয়েই প্রমত্তা পদ্মা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ওপাড়ে ভারতের মালদহ জেলার আড়ঙ্গাবাদ ও শোভাপুর এলাকা। বাংলাদেশের ঠুঠাপাড়া পয়েন্ট থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সন্ধ্যার পর নদীপাড়ে দাঁড়ালে ফারাক্কা বাঁধের ঝলমলে আলো অনায়াসেই দেখা যায় বলে জানান স্থানীয়রা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের এতো কাছাকাছি এসেও পদ্মা নদীতে তেমন একটা পানি দেখা গেল না। নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বালুচর। অনেকটা দূরে জীর্ণশীর্ণ পদ্মার স্রোতহীন পানিপ্রবাহ দেখা যায়।

শুধু ঠুঠাপাড়ায় নয় ফরাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার চিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অঞ্চলজুড়ে। গত দেড় যুগ ধরে সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে ভয়াবহ নদী ভাঙন। এই দুই উপজেলার নারায়নপুর, সুন্দরপুর, পাঁকা ও উজির পুর এই চার ইউনিয়ন প্রায় পুরোটায় বিলীন হয়ে গেছে নদী গর্ভে। এছাড়াও দেবীনগর, আলাতুলি, শাহজাহানপুর, ইসলামপুর, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নেও অব্যাহত রয়েছে নদী ভাঙন। এসব ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ভূমিহীন এ মানুষগুলোর করুণ আর্তনাতে প্রায় প্রতিদিনই শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয় পদ্মাপাড়ের গ্রামগুলোতে। ফারাক্কার কারণে পরিবেশের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য মতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ২৫ হাজার হস্ত চলিত নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরের তথ্য থেকে জানান, ফারাক্কার কারণে অতিরিক্ত খরা প্রবণ হয়ে উঠেছে জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। নদীগুলোতে শুকিয়ে যাওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে ক্ষতির মুখের পড়েছে কৃষি।

ভারতের পানি রাজনীতির কাছে বাংলাদেশ অসহায় হয়ে পড়েছে। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, চিকনাই, মরাপদ্মাসহ প্রায় ৫৪ নদ-নদীতে পানি নেই। যে টুকু পানির প্রবাহ ছিল তাও চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের এই সময় পর্যন্ত টানা তাপদাহে শুকিয়ে গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বহুস্থানে হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে অগভীর নলকূপ দিয়ে সেচ কার্য ব্যাহত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি শূন্যতার কারণে কোন স্থানে মাটি ফেটে চৌঁচিড় হয়ে গেছে। পানির জন্য উত্তরের জেলাসমূহে এখন হাহাকার শুরু হয়েছে। গঙ্গার পানি ৩০ সাল মেয়াদি পানি চুক্তির ২০ বছর চলছে।

চলতি বছর জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বাস্তবে চুক্তি মাফিক পানির প্রবাহ আসেনি। নদীপাড়ের মানুষ চোখে পানি প্রবাহ দেখছেন না। পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় এর মূল শাখা নদী গড়াই, আত্রাই এবং এই সকল নদীর সম্পর্কিত অন্যান্য নদীতেও পানির প্রবাহ কমে যায়। তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রক্ষপুত্র নদে পানির প্রবাহ থেমে গেছে। ফলে যমুনা নদীও শুকিয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া গরমের বৃদ্ধি মেয়ে এপ্রিল মাসে প্রায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পৌঁছে গেছে। জেলার ঈশ্বরদী, পাবনা, রাজশাহীতে গড়ে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা চলছে। এই তাপদাহ আরও বাড়তে পারে। নদ-নদীতে পানি না থাকার কারণে তাপদাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। প্রবীণ লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিগত সময়ে এই রকম তাপদাহ এপ্রিল মাসে তারা অনুভব করেননি।

দেশের নদ-নদী বাঁচাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে ৩০ সাল মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি করেন। চুক্তি মাফিক এপ্রিল-মে মাসকে চুক্তির শর্তে পিক শুষ্ক মওসুম ধরে ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ যাই থাক তা কোনভাবেই বাংলাদেশের পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩৪ হাজার কিউসেকের নিচে নামবে না। বাস্তবচিত্র ভিন্ন। ২০ বছরে পদ্মা নদীর এই পয়েন্টে ১৮ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়েছে কি না তা এক বড় প্রশ্ন। এখনও পদ্মায় যে পানি আছে সেটা নালার মত প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে আর বেশী দিন লাগবে না। জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পতিত হয়েছে অনেক আগেই। পদ্মা পাড়ে এখন দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। মাঝে মধ্যে কবতুর দেখা যায়। আর কোন পাখি নেই। পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এই নদীসহ অন্যান্য নদীতে মাছের টান পড়েছে।

আন্তর্জাতিক নদী পদ্মা (গঙ্গা) উজানে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশ ক্রমেই তীব্র পানি সংকটে নিপতিত হয়। কালক্রমে প্রমত্তা পদ্মা নদীর সাথে প্রধান শাখা নদী আত্রাই, গড়াইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে পানির টান পড়তে শুরু করে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। ফলে নদী ও ভূ-গর্ভের পানি দিয়ে সেচ কার্যব্যাহত হয়ে পড়ে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পদ্মা নদীর বুকে চুক্তি মাফিক পানি আসেনি। এখনও পানি পাওয়া যায় না। যদিও হাইড্রোলজি (বর্তমান নাম ভূ-পরিস্থি পানি জরিপ দপ্তর যা উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন) পাবনার অফিস চুক্তি পর থেকে পানি প্রবাহের কোন তথ্য সাংবাদিকদের প্রদান করা হয় না। জিজ্ঞেস করলে সাংবাদিকদের বলা হয় যৌথ নদী কমিশন দিতে পারবে।

পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী গড়াই ও আত্রাইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে এখন পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে। গড়াই নদীর কুষ্টিয়া কয়ারা ব্রিজের নীচেও বালু চর। জিকে প্রজেক্ট কার্যত: অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাইসহ পদ্মার ৫৪টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। কোন কোন স্থানে বালু স্থায়ী মুত্তিকায় রূপ নেয়ায় নদী বক্ষে ফসলের চাষ করে আসছেন কৃষক বহুদিন ধরে। কিন্তু যে ফসলের জন্য সেচের প্রয়োজন সেই ফসল বুনন করে সেচ নদীর পানি দিয়ে সেচ কার্য করতে পারছেন না। পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে সেতু (ব্রিটিশ আমলে নির্মিত) আর লালন শাহ সড়ক সেতু স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের সময় চালু হয়েছে।  তিস্তায় পানির প্রবাহ না থাকা আর বর্ষা মওসুমে ফারাক্কার গেট খুলে দিলে দেশে মানুষ ভাসে বানের জলে। নদীতে ড্রেজিং করে গভীরত্ব বাড়িয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হলে বর্ষা মওসুমে আসা পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে সমস্যা হলো নদী ড্রেজিং-এর ফলে উত্তোলিত বালুর স্তূপ কোথায় রাখা যাবে? সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইউরেনিয়াম চুল্লি চালু হলে শুধু এর তাপমাত্রা ঠা-া করতে বার্ষিক ৮১ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানির প্রয়োজন হবে। পানির অর্ধেক রিসাইক্লিং মাধ্যমে পুনরায় ব্যহহৃত হবে। পানির উৎস হিসেবে পদ্মা নদী আর প্রকল্প এলাকায় পাম্প হাউজের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ হবে। যদি পদ্মা নদী থেকে পানির সরবরাহ নেয়া হয় তাহলে এই নদীর দশা আরও করুণ হবে কি? সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।

আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ফারাক্কার বিষয়টি তুলে ধরেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণা হয়ে কাজ করে।

Friday 6 May 2016

বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার জনক বঙ্কিম ও তাঁর সাহিত্য নিয়ে কিছু পর্যালোচনা। শেষ পর্ব:

উপনিবেশিক শাসনামলে কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়।



সূফি বরষণ
শেষ পর্ব ক:

কারও অজানা নয়, বঙ্কিম সাহিত্য হিন্দুদের হিংস্র জাতীয়তাবাদ এবং খুনে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মূল উৎস। [অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন লিখিত ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’, গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকার ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়’ শীর্ষক নিবন্ধ দ্রষ্টব্য।]
বঙ্কিম “রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মনের প্রতিভূ হিসাবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদগাতা ঋষি হিসাবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবহ্নি তিনি ছড়িয়েছিলেন লেখনি মুখে, জগতের ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নজীর নেই। তিনি মানবতার যে অকল্যাণ ও অসম্মান করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তারও তুলনা নেই। ‘রাজ সিংহ’ ও ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস দুটিতে তিনি মুসলিম বিদ্বেষের যে বিষবহ্নি উদগীরণ করেছেন, সে বিষ জ্বালায় এই বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল, তা নিঃশেষ শুষ্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র অস্বীকার করে তাদের বিতাড়িত করে সদাশয় বৃটিশ জাতির আবাহনে ও প্রতিষ্ঠায় বার বার মুখর হয়ে উঠেছিলেন”। [‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ’, সংস্কৃতির রূপান্তর’, আবদুল মওদুদ, পৃষ্ঠা ৩৩৯।]

বঙ্কিমের এই সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং একে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলে অভিহিত করে মুসলমানদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা”। [‘মুসলিম জননেতা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী একটি বক্তৃতায় মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য বন্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করলে, “ভারতী পত্রিকা’য় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন।]

খ.
এইবার আসুন আমরা জেনে সাম্প্রদায়িকতা কি? সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। যেসময় থেকে মানুষ জাতি-গোষ্ঠীতে এবং ধর্মীয় কারনে ধর্মে ধর্মে বিভক্ত হয়েছে সেই থেকে সম্প্রদায় , সাম্প্রদায়িক, সাম্প্রদায়িকতা শব্দগুলো এসেছে। একেবারে আদিতে মানুষ যখন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল না, তখন সাম্প্রদায়িকতাও ছিল না।

সাম্প্রদায়িকতাঃমুক্ত নন রবীন্দ্রনাথও নামক এক প্রবন্ধে বামপন্থী গবেষক সলিমুল্লাহ খান বলেন, "সংখ্যাগুরু মুসলমান সবাই সাম্প্রদায়িক নহে, সাম্রাজ্যবাদীও নহে। নিজের বাসভূমে নিজের অধিকার দাবি করা সাম্প্রদায়িকতা নহে, অন্যের অধিকার অস্বীকার করাই সাম্প্রদায়িকতা।"

১৫ মার্চ রোববার ২০১৫ সালে দৈনিক আজাদী পত্রিকায় সাম্প্রদায়িকতা কি ও কেন এক প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সাম্প্রদায়িকতা কি সে তো আমরা অবশ্যই জানি। দেখিও। আমরা ভুক্তভোগীও বটে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে আমাদের এই দেশে দাঙ্গা হয়েছে। দাঙ্গার পরিণতিতে এক সময়ে অবিভক্ত বঙ্গ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, এক খণ্ড যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্যখণ্ড ভারতের। কিন্তু তারপরেও দাঙ্গা থেমেছে কি? দুই বঙ্গের কোনো বঙ্গেই থামেনি। সাম্প্রদায়িকতারও অবসান হয়নি। ....... কেবল যে মানসিক সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে তা নয়, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনও ঘটেছে।

দৈনিক যুগান্তর ১৮ মে ২০১৪ সালে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার জয়জয়কার এক প্রবন্ধে বামপন্থী গবেষক বরুদ্দীন উমর বলেন, অখণ্ড ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের আড়ালে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে এগিয়ে নেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়েছিল। কিন্তু তিরিশের দশকে সেই আড়াল বজায় রাখা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
দশকের প্রথমদিকে জাতীয় আন্দোলনের নামে অনেক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি কংগ্রেসের কাঠামোর অন্তর্গত হয়েছিল। ...... অবশ্য এখানে বলা দরকার যে, মুহম্মদ আলী জিন্নাহর মতো একজন প্রসিদ্ধ অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসির সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া এবং মুসলিম লীগের মতো একটি সাম্প্রদায়িক দলের নেতৃত্বে আসার মূল কারণ ছিল ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের পতন ঘটতে থাকার প্রক্রিয়া। ....................শুধু তাই নয়, সেখানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুসলমানসহ অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের উদ্ধার করার বিন্দুমাত্র কোনো চেষ্টা তারাও করেনি।

এ কারণে দেখা যাবে যে, পশ্চিমবঙ্গে এখন মুসলমান জনসংখ্যা ৩০ শতাংশের ওপর হলেও চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অংশ ২ শতাংশেরও কম! সেই ভারত সরকারের দ্বারা গঠিত সাচার কমিশন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মুসলমানদের অবস্থা দলিতদের অবস্থা থেকে খারাপ। মুসলমানদের এ অবস্থার উন্নতির জন্য সাচার কমিশন রিপোর্টে অনেক সুপারিশ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার কিছুই কার্যকর করা হয়নি। .....এসবের দিকে তাকিয়ে কেউ যদি বলে, জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বই সঠিক ছিল, তাহলে তাকে কি দোষ দেয়া যায়? অন্তত কংগ্রেসিরা কি দোষ দিতে পারে?


গ.
এইবার আসি মূল আলোচনায় বঙ্কিমের সাহিত্য পর্যালোচনায়। মৃণালিনী উপন্যাসে ব্রাক্ষ্মণ মাধবাচার্য হেমচন্দ্রকে ডেকে বলছেন , "তুমি দেবকার্য না সাধিলে কে সাধিবে ? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে ? যবন নিপাত তোমার একমাত্র ধ্যান হওয়া উচিত্‍ ।"

মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিম লিখেছেন, হেমচন্দ্র বিনীতভাবে কহিলেন, “অপরাধ গ্রহণ করিবেন না, দিল্লীতে কার্য হয় নাই। পরন্তু যবন আমার পশ্চাদগামী হইয়াছিল; এই জন্য কিছু সতর্ক হইয়া আসিতে হইয়াছিল। তদ্ধেতু বিলম্ব হইয়াছে |” ব্রাহ্মণ কহিলেন, “দিল্লীর সংবাদ আমি সকল শুনিয়াছি। বখ্ই‍তিয়ার খিলিজিকে হাতীতে মারিত, ভালই হইত, দেবতার শত্রু পশুহস্তে নিপাত হইত। তুমি কেন তার প্রাণ বাঁচাইতে গেলে!”
হে। তাহাকে স্বহস্তে যুদ্ধে মারিব বলিয়া। সে আমার পিতৃশত্রু, আমার পিতার রাজ্যচোর। আমারই সে বধ্য। ” মৃণালিনী, প্রথম খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ ,‍ ২, পৃষ্ঠা ৮৯  | বঙ্কিম রচনাবলী।

মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিম আরও লিখেছেন, এই দেশে যবনের পরম শত্রু হেমচন্দ্র বাস করিতেছে। আজ রাত্রেই তাহার মুণ্ড যবন-শিবিরে প্রেরণ করিতে হইবে। মৃণালিনী: দ্বিতীয় খণ্ড। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : পশুপতি।

হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমি যে হই না কেন?” শা। আপনি এখানে কি করিতেছেন? হে। আমি এখানে যবনানুসন্ধান করিতেছি। শান্তশীল চমকিত হইয়া কহিল, “যবন কোথায়?” হে। এই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। শান্তশীল ভীত ব্যক্তির ন্যায় স্বরে কহিল, “এ গৃহে কেন?” হে। তাহা আমি জানি না। শা। এ গৃহ কাহার? হে। তাহা জানি না। শা। তবে আপনি কি প্রকারে জানিলেন যে, এই গৃহে যবন প্রবেশ করিয়াছে? হে। তা তোমার শুনিয়া কি হইবে?

শা। এই গৃহ আমার। যদি যবন হইতে প্রবেশ করিয়া থাকে, তবে কোন অনিষ্টকামনা করিয়া গিয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনি যোদ্ধা এবং যবনদ্বেষী দেখিতেছি। যদি ইচ্ছা থাকে তবে আমার সঙ্গে আসুন-উভয়ে চোরকে ধৃত করিব। মৃণালিনী: দ্বিতীয় খণ্ড। দশম পরিচ্ছেদ।

মৃণালিনী  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় উপন্যাস। প্রকাশকাল ১৮৬৯। তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা আক্রমণ ও বিজয়ের পটভূমিতে রচিত। যেখানে বখতিয়ার খলজীকে এবং মুসলমানদের গালাগালি মূলক শব্দ যবন, বানর, অরন্যনর ও চোর হিসেবে উল্লেখ করে লিখেন।  এই অভিযানের প্রাক্কালে, বখতিয়ার খলজী সে সময়ের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুরক্ষিত দূর্গ মনে করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় এবং ভিক্ষু বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে হত্যা করে বলে মৃণালিনী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন  ৷ মৃণালিনী একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।  এই দুটি লিংকে আপনি জানতে পারবেন যে, বখতিয়ার খলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করেননি বরং বঙ্কিম তাঁর সাহিত্যে ঐতিহাসিক সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন।  http://sufiborshan.blogspot.co.uk/2015/12/blog-post.html
এবং http://www.muldharabd.com/?p=698

মৃণালিনী\’ উপন্যাসে বখতিয়ার খিলজীকে বলেছেন \’বানর\’,\’অরন্যনর\’ ইত্যাদি। তিনি স্পষ্টতই বলতেন,\”পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া সাত্বমঙ্গল সাধিত হয় তাহাও করিব।\”এভাবে তিনি কেবল \’করিব\’ বলে ক্ষান্ত হন নি। সুযোগ পেলে করেছেনও। তাইতো তার বিশ্বাস থেকেই তিনি লিখেছেন,\”আসে আসুক না আরবী বানর/আসে আসুক না পারসী পামর।\”আমদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যখন শুনি একজন সাহিত্য সম্রাট কত নগ্নভাবে বলেছেন,\”ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকের নয়ন পথের পথিক হইবে, কাক, কুকুর ও মুসলমান। এই তিনটি সমানভাবেই কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়।\” এরপর আর বঙ্কিমবাবু সম্পর্কে বলার কিছু থাকে না। (আনন্দমঠ,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ,তৃতীয় মুদ্রণ ১৩৬৪,পৃ ২৩)। (সংক্ষিপ্ত সংকলন)।

দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে বঙ্কিম লিখেছেন, তথায় অবস্থিতিকালে লোকমুখে রাজা সংবাদ পাইলেন যে, কতলু খাঁ তাঁহার আলস্য দেখিয়া সাহসিক হইয়াছে, সেই সাহসে মান্দারণের অনতিদূর মধ্যে সসৈন্য আসিয়া দেশ লুঠ করিতেছে। রাজা উদ্বিগ্নচিত্ত হইয়া, শত্রুবল কোথায়, কি অভিপ্রায়ে আসিয়াছে, কি করিতেছে, এই সকল সংবাদ নিশ্চয় জানিবার জন্য তাঁহার একজন প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষকে প্রেরণ করা উচিত বিবেচনা করিলেন। দূর্গেশনন্দিনী : প্রথম খণ্ড। তৃতীয় পরিচ্ছেদ : মোগল পাঠান।

দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে বঙ্কিম আরও লিখেন, মহারাজ মানসিংহ পুত্রমুখাৎ অবগত হইলেন যে, প্রায় পঞ্চাশৎ সহস্র পাঠান সেনা ধরপুর গ্রামের নিকট শিবির সংস্থাপন করিয়া নিকটস্থ গ্রামসকল লুঠ করিতেছে, এবং স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ বা অধিকার করিয়া তদাশ্রয়ে এক প্রকার নির্বিঘ্নে আছে। মানসিংহ দেখিলেন যে, পাঠানদিগের দুবৃত্তির আশু দমন নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে, কিন্তু এ কার্য অতি দুঃসাধ্য। কর্তব্যাকর্তব্য নিরুপণ জন্য সমভিব্যাহারী সেনাপতিকে একত্র করিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিবৃত করিলেন এবং কহিলেন, “দিনে দিনে গ্রাম গ্রাম, পরগণা পরগণা দিল্লীশ্বরের হস্তস্খলিত হইতেছে, এক্ষণে পাঠানদিগকে শাসিত না করিলেই নয়, । দূর্গেশনন্দিনী : প্রথম খণ্ড। চতুর্থ পরিচ্ছেদ : নবীন সেনাপতি। এখানের পাঠান বলতে মুসলমানদের বুঝানো হয়েছে আর মুসলমানদের দেখানো হয়েছে ডাকাত ও অত্যাচারি হিসেবে । এখানে ইতিহাসের মিথ্যাচার করেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায তাঁর দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে। আসলে ইতিহাসের সত্য হলো বাংলায় বর্গীদের লুটপাট ডাকাতি কথা সবাই জানে আর বর্গীরা ছিল হিন্দু ধর্মের অনুসরণকারী।

দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস। ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্রের চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সের রচনা। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মোঘল ও পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত হয়। তবে এটিকে সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক উপন্যাস মনে করা হয় না। কোনো কোনো সমালোচক এই উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো উপন্যাসের ছায়া লক্ষ্য করেছেন।

‘সীতারাম’ উপন্যাস শুরু করেন হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাড়িয়ে দিতে। তিনি  লিখন, লঙ্ঘন করিবার সময় গঙ্গারামের পা ফকিরের গায়ে ঠেকিয়াছিল; বোধ হয়, সেটুকু ফকিরের নষ্টামি। গঙ্গারাম বড় ব্যস্ত, কিছু না বলিয়া কবিরাজের বাড়ীর দিকে চলিয়া গেল। ......সৎকার করিয়া অপরাহ্নে শ্রীনাম্নী ভগিনী এবং প্রতিবাসিগণ সঙ্গে গঙ্গারাম বাটী ফিরিয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে দুই জন পাইক, ঢাল-সড়কি-বাঁধা-আসিয়া গঙ্গারামকে ধরিল। পাইকেরা জাতিতে ডোম, গঙ্গারাম তাহাদিগের স্পর্শে বিষণ্ণ হইল। সভয়ে দেখিল, পাইকদিগের সঙ্গে সেই শাহ সাহেব। গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাইতে হইবে? কেন ধর?-আমি কি করিয়াছি? শাহ সাহেব বলিলেন, “কাফের! বদ্ ‍বখ‍‍ত! বেত্স‍‍মিজ! চল্৷”
পাইকেরা বলিল, “চল্৷”

একজন পাইক ধাক্কা মারিয়া গঙ্গারামকে ফেলিয়া দিল। আর একজন তাহাকে দুই চারিটা লাথি মারিল। একজন গঙ্গারামকে বাঁধিতে লাগিল, আর একজন তাহার ভগিনীকে ধরিতে গেল। সে ঊর্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। যে প্রতিবাসীরা সঙ্গে ছিল, তাহারা কে কোথা পলাইল, কেহ দেখিতে পাইল না। পাইকেরা গঙ্গারামকে বাঁধিয়া মারিতে মারিতে কাজির কাছে লইয়া গেল। ফকির মহাশয় দাড়ি নাড়িতে নাড়িতে হিন্দুদিগের দুর্নীতি সম্বন্ধে অতি দুর্বোধ্য ফারসী ও আরবী শব্দ সকল সংযুক্ত নানাবিধ বক্তৃতা করিতে করিতে সঙ্গে গেলেন।

গঙ্গারাম কাজি সাহেবের কাছে আনীত হইলে, তাহার বিচার আরম্ভ হইল। ফরিয়াদী শাহ সাহেব–সাক্ষীও শাহ এবং বিচারকর্তাও শাহ সাহেব। কাজি মহাশয় তাঁহাকে আসন ছাড়িয়া দিয়া দাঁড়াইলেন, এবং ফকিরের বক্তৃতা সমাপ্ত হইলে, কোরাণ ও নিজের চশমা এবং শাহ সাহেবের দীর্ঘবিলম্বিত শুভ্র শ্মশ্রুর সম্যক সমালোচনা করিয়া, পরিশেষে আজ্ঞা প্রচার করিলেন যে, ইহাকে জীয়ন্ত পুঁতিয়া ফেল। যে যে হুকুম শুনিল, সকলেই শিহরিয়া উঠিল। গঙ্গারাম বলিল, “যা হইবার তা ত হইল, তবে আর মনের আক্ষেপ রাখি কেন?”

এই বলিয়া গঙ্গারাম শাহ সাহেবের মুখে এক লাথি মারিল। তোবা তোবা বলিতে বলিতে শাহ সাহেব মুখে হাত দিয়া ধরাশায়ী হইলেন। এ বয়সে তাঁর যে দুই চারিটি দাঁত অবশিষ্ট ছিল, গঙ্গারামের পাদস্পর্শে তাহার মধ্যে অনেকগুলিই মুক্তিলাভ করিল। তখন হামরাহি পাইকেরা ছুটিয়া আসিয়া গঙ্গারামকে ধরিল এবং কাজি সাহেবের আজ্ঞানুসারে তাহার হাতে হাতকড়ি ও পায়ে বেড়ি দিল এবং যে সকল কথার অর্থ হয় না, এরূপ শব্দ প্রয়োগপূর্বক তাহাকে গালি দিতে দিতে এবং ঘুষি, কিল ও লাথি মারিতে মারিতে কারাগারে লইয়া গেল। সে দিন সন্ধ্যা হইয়াছিল; সে দিন আর কিছু হয় না–পরদিন তাহার জীয়ন্তে কবর হইবে। সীতারাম : প্রথম খণ্ড : দিবা-গৃহিণী। প্রথম পরিচ্ছেদ। “সীতারাম’-এর ক্ষমতা ছিল, হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা বঙ্কিমের প্রিয় স্বপ্ন। সীতারাম তাতে সমর্থও ছিল। উপরে উপন্যাসের ঘটনাটা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মিথ্যা ঘটনার মাধ্যমে যেভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছেন তা এক বিরল ঘটনা বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে। আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে ওস্তাদজী দানেশ খাঁ কে দিয়ে মুসলমানদের \’শুয়োর\’ বলে গালি দিয়েছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস গুলো হলো, দূর্গেশনন্দিনী, কপাল কুণ্ডলা,  মৃণালিনী,  বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়,  চন্দ্রশেখর,  রাধারাণী, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী, সীতারাম। এই সবগুলো উপন্যাস ছাড়াও বঙ্কিমের অন্যান্য রচনায় সাম্প্রদায়িকতা তথা মুসলিম বিদ্বেষে ভরপুর।

ঘ.
ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় কারনে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপকতা লক্ষনীয়। সুচতুর  বৃটিশরা এর বীজ বপন করে যায় । বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমান বড় দুই ধর্মের  মানুষের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে দিয়ে কলহের পথ তৈরি  করে দিয়ে যায় । ভারতীয় উপমহাদেশে বৃহৎ হিন্দু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক লোকজন  কারনে অকারনে সংখ্যালঘু মুসলমান এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার নির্যাতন  করেছে এখনো।

কাজেই সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা যে কেমন নির্মম, কদর্য ও ক্ষতিকারক সেটা আমরা অবশ্যই জানি। না-জানবার কারণ নেই।  কিন্তু আমাদের দেশে তো বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে একত্রে বসবাস করেও এসেছে। হিন্দু কৃষক ও মুসলমান কৃষকের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে নি। তারা একে অপরকে উৎখাত করতে চায় নি। নদীতে হিন্দু জেলে ও মুসলমান জেলে এক সাথে মাছ ধরেছে। তাঁতিরা তাঁত বুনেছে। সাধারণ মানুষ একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি ও মসজিদের আজান এক সাথে মিশে গেছে। মানুষ একই পথ ধরে হেঁটেছে, একই বাজার হাটে গিয়ে কেনাবেচা করেছে, থেকেছে একই আকাশের নিচে। কে হিন্দু কে মুসলমান তা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করেনি, নাক সিঁটকায়নি। তাহলে? সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করলো কারা? তৈরি হলো কি ভাবে? কেন? আসলে এই মুসলিম বিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িকতা তৈরী করেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো চরম উগ্র সাম্প্রদায়িক উচ্চ বর্ণের হিন্দু লেখক সাহিত্যিকরা গত আড়াই শতো বছর ধরে।

শুধু করলো দুই দিকের দুই মধ্যবিত্ত? হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত। ব্রিটিশ যুগেই এই ঘটনার সূচনা। তার আগে সম্প্রদায় ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। আর সাম্প্রদায়িকতা বাড়লে ব্রিটিশের সুবিধা, কেন না ঝগড়াটা তখন শাসক-শাসিতের থাকবে না, হয়ে দাঁড়াবে হিন্দু-মুসলমানের।

ভারতে এখন মুসলিম বিদ্বেষী উৎকট সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস তাণ্ডব। কংগ্রেসি আমলে সরকার উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ অপশক্তিকে প্রশ্রয় দিত অনেক ক্ষেত্রে। এখনকার বিজেপি সরকার আরো আগবাড়িয়ে তাদের দিচ্ছে আশ্রয়। এমনকি সেই সঙ্ঘবদ্ধ মৌলবাদী, সঙ্ঘ পরিবারের বিশেষ করে স্বয়ংসেবকেরা (আরএসএস) বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের চালিকাশক্তির কেন্দ্র বলে ব্যাপক ও প্রামাণ্য অভিযোগ উঠেছে।

মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ