Friday 12 April 2019

বাংলাদেশে টাকশালের গোড়ার কথা

আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯ - ০৫:৫০ | প্রকাশিত: রবিবার ০৭ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট সংস্করণ daily sangram 



আবু রাওনাফ আলী নূর : টাকশাল নামেই পরিচিত। পোশাকি নাম দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দেশের টাকা ছাপানোর একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান গাজীপুরে। টাকশালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। এ বছর এসে পূর্ণ হলো ৩০ বছর। টাকশাল নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন। বিশ্বে স্বাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় ২০০। তবে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে নোট মুদ্রণের ছাপাখানা আছে মাত্র ৬৫; যার মধ্যে বাংলাদেশের টাকশাল একটি। নাগরিক হিসেবে ব্যাপারটা নিশ্চয় মর্যাদা ও গর্বের। দেশের মানুষের কাছে ‘টাকশাল’ নামে বেশি পরিচিত বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠানটির পোশাকি নাম ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড (The Security Printing Corporation (Bangladesh) Ltd. (SPCBL) হল বাংলাদেশে ব্যাংকনোট ও সরকারি ডাকটিকিটের প্রধান ছাপাখানা। ওয়েবসাইট http://www.spcbl.org.bd, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৯২ সালের এপ্রিল থেকে, এটি দেশের উপস্থিত আইনের আওতাধীন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। এটি আন্তর্জাতিক সরকারি ছাপাখানা সমিতির নিয়মিত সদস্য। নেপাল সহ আরও বহু দেশ এর চার রং বিশিষ্ট উন্নত ডাকটিকিটের ক্রেতা। ২০১৩ সালে এর রজত জয়ন্তী উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটি সীমিত পরিমাণে ২৫ টাকার স্মারক নোট অবমুক্ত করে।
টাকশালের অভ্যন্তরে : ইংরেজি শব্দ ‘মিন্ট’-এর বাংলা হচ্ছে টাকশাল যেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি ধাতব মুদ্রা বা কয়েন বানানো হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাপালেও বাংলাদেশের টাকশালে কোনো কয়েন তৈরি হয় না। আর্থিকভাবে লাভ-লোকসান বিশ্লেষণে দেশের জন্য কয়েন উৎপাদন লাভজনক বিবেচিত না হওয়ায় আমাদের টাকশালে এখনো কয়েন তৈরির কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি এবং এ জন্য কয়েন তৈরির কোনো মেশিনও সংস্থাপন করা হয়নি। তবে টাকশালে শুধু যে টাকাই ছাপা হয়, ব্যাপারটা এমন নয়। টাকা ছাপানোর উদ্দেশ্যে স্থাপিত হলেও সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তাসামগ্রী এখানে ছাপানো হয়, যেমন: অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সঞ্চয়পত্র, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রাজস্ব স্ট্যাম্প, আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক সামগ্রী, স্মারক ডাকটিকিট, খাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্যাক্স লেবেল, ব্যাংকের চেক বই, প্রাইজবন্ড, রপ্তানি উন্নয়ন বুুরোর জিএসপি ফরম, দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদ ইত্যাদি। এ ছাড়াও কোনো কোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তাদের শিক্ষা সনদও মুদ্রণ করা হয়ে থাকে। টাকা মুদ্রণের কারণে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ প্রচুর। প্রায় ৬৬ একর জায়গা নিয়ে দেশের টাকা তৈরির একমাত্র এই কারখানা বৃক্ষশোভিত। আর গাছগাছালিতে ভরা বলেই টাকশালের অভ্যন্তর সব সময় পাখির কলরবে মুখরিত থাকে। শুধু প্রাকৃতিক দিক থেকেই নয়, টাকা মুদ্রণের একক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে কিছুটা ভিন্নও। কিন্তু বিদ্যমান বহু স্তরে নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মী ও প্রতিষ্ঠানটিকে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। পুলিশের প্রায় ৮০ জন সদস্য প্রতিষ্ঠানের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। এই ছাপাখানায় প্রবেশ করতে হলে চারটি ফটকে নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করতে হয়। প্রেসের মূল ফটক ও ভেতরের ঘরগুলোতে কর্মচারী, কর্মকর্তাদের চলাচলে অ্যাকসেস কন্ট্রোল ছাড়াও সব কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং অনুমতি পাওয়া গ্রাহকদের ছাপাখানায় প্রবেশের সময় দেহ তল্লাশি করা হয়। ব্যক্তি ও মালপত্রের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য লিখে রাখার জন্য করপোরেশনের শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেসের অভ্যন্তরে চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়ে থাকে। মুদ্রণসহ যেকোনো নিরাপত্তাসামগ্রী উৎপাদনে বেশ কিছু পর্যায়ে বিভিন্ন ঘরে (হল) কাজ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছাড়া এক হল থেকে অন্য হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারেন না। প্রতিটি হলের জন্য আলাদা এন্ট্রি পাস ছাড়াও দরজায় নিরাপত্তাকর্মীরা অন্যদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা রয়েছে। সংগৃহীত কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রীর মধ্যে সমন্বয়ন পদ্ধতি এই প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়েই পালন করা হয়। সমন্বয়ন বা রিকনসিলিয়েশনে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন বু্যুরো, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকে। যতক্ষণ সংগৃহীত কাঁচামালের সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য ও ওয়েস্টেজ বা অপচয়ের মিল হবে না, ততক্ষণ হিসাব করা হতে থাকবে। হিসাব মিলে গেলে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ওয়েস্টেজ ধ্বংস করা হয়। এমন নিরাপত্তা বিধান ও স্বচ্ছতার কারণে এই টাকশাল গ্রাহক প্রতিষ্ঠাগুলোর আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে।
গোড়াপত্তনের গল্প : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশে কিছুদিন পাকিস্তানী টাকার প্রচলন ছিল। তখন ওই টাকাগুলোতে ‘বাংলাদেশ’ লেখা স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো। পাকিস্তানী মুদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসেবে টাকার প্রচলন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। টাকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগ পর্যন্ত ভারত, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি থেকে বাংলাদেশের নোট ছেপে আনা হতো। সংগ্রহ নীতিমালা অনুসরণ করে একটি ভিন্ন দেশ থেকে নোট ছেপে সময়মতো আনা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বোধ করে আমাদের দেশেই নোট মুদ্রণের একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নোট ছাপার জন্য একটি প্রেস স্থাপনের ব্যাপারে ১৯৮৩ সালে একনেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তবে উদ্বোধনের আগে ১৯৮৮ সালেই পরীক্ষামূলকভাবে ১ টাকা ও ১০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল। প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবেই এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকের অনুমোদনের পর অর্থ মন্ত্রণালয় নোট মুদ্রণের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন করে। পরে যৌথ মূলধন কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার নামকরণ করা হয় ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন। শুনেছি, ‘দ্য’ নির্দেশকটি তৎকালীন অর্থসচিব ড. আকবর আলি খানের দেওয়া।
নোট ছাপানোর রীতিনীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন গ্রাহক প্রতিষ্ঠান সচরাচর বছরভিত্তিক তাদের প্রয়োজন মোতাবেক পণ্যের চাহিদা বা কার্যাদেশ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী নোটের উৎপাদন ও সরবরাহ করা টাকশালের পক্ষে এর আগে কখনো সম্ভব হয়নি। ৩০ বছর আগে বসানো স্বল্পসংখ্যক মেশিন দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো টাকশালের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সম্প্রতি আরেকটি উৎপাদন লাইনের মেশিন বসানোর পর উৎপাদনও শুরু হয়েছে। মেশিনের স্বল্পতার জন্য কয়েকটি মূল্যমানের নোট একই সময়ে মুদ্রণ করা সম্ভব হয় না; একটি নোট ছাপাতে প্রায় ৩০ পর্যায় পার করতে হয়। নোট উৎপাদনের পরিমাণ নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিভিন্ন অফিসের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন মূল্যমানের নোটের চাহিদা জানালে টাকশালের ভল্ট থেকে তা সরবরাহ করা হয়।
টাকশাল হলো কোম্পানি : ১৯৯২ সালে প্রকল্প থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব কিছুটা কমে এই প্রতিষ্ঠানের ওপর। কর্তৃত্ব চলে যায় পরিচালনা পর্ষদের হাতে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ টাকশাল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এই পরিচালনা পর্ষদ প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। টাকশালের পুরো মূলধন বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দিয়েছে।
৯ ধরনের নোট : বাংলাদেশে ৯টি মূল্যমানের কাগজি নোট রয়েছে; অবশ্য বর্তমানে ১ টাকা মূল্যমানের কাগজি নোট আর ছাপানো হয় না। বাকি নোটগুলো গাজীপুরে অবস্থিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে ছাপা হয়ে থাকে। এ ছাড়া সব স্মারক নোটও এই টাকশালেই মুদ্রিত। উচ্চ মূল্যমানের নোটগুলো জাল হয় বলে এগুলোর নকলরোধে বেশি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করা হয়ে থাকে। কম মূল্যমানের নোটগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি হাতবদল হয় এবং এই নোটগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলেও বদলে নেওয়ার জটিলতায় কেউ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় না। এসব বিবেচনায় কম মূল্যমানের কাগজি নোটের পরিবর্তে ধাতুর তৈরি কয়েন বিদেশ থেকে আমদানি করে ইস্যু করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের জনগণ কয়েন ব্যবহারে একেবারেই অভ্যস্ত নয় এবং কয়েন ব্যবহারের অপরিহার্যতা আমাদের দেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি। টাকশালের প্রায় ১ হাজার কর্মচারী-কর্মকর্তার পরিশ্রমে যে নতুন কচকচে নোট উৎপাদন হয়, সেই নতুন নোটে বেতন হয় না বলে একটু আক্ষেপ দেখেছি তাঁদের মধ্যে। যে টাকা তাঁরা তৈরি করেন, সেই টাকা ভুলক্রমে বাসা থেকে অফিসে প্রবেশের সময় সঙ্গে পাওয়া গেলে তার জন্যও তাঁদের শাস্তি ভোগ করতে হয়। অধিকাংশ কর্মচারী, কর্মকর্তাকে ওভার টাইম কাজসহ পুরো দিনটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়; কারণ উৎপাদন এলাকায় মুঠোফোন নেওয়া নিষিদ্ধ। 
দেশখ্যাত শিল্পীদের নকশায় টাকা ছাপা হয় গাজীপুরের টাকশালে: বিশাল এক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মানুষের হাতে কাগজের টাক বা ধাতব পয়সা আসে। কখন কী পরিমান মুদ্রা ছাড়া হবে তার আছে হিসাব পদ্ধতি। মুদ্রার নক্সা করতে যুক্ত করা হয় দেশের স্বনামখ্যাত শিল্পীদের। টাকশালের যাত্রা শুরুতে বিভিন্ন মানের ৩০ কোটি নোট ছাপানোর সক্ষমতা ছিল। বেড়ে এখন ১শ’ ২০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। কাগজের নোটের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার কথা বিবচেনা করে বদল করা হয় সময়ে সময়ে, যার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতি বছর ব্যয় করতে হয় ৫শ’ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে মুদ্রা ছাপার সকল সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকশাল প্রতিষ্ঠার পর বহু বছর এর সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্থবির ছিল, সংকটের ঝুঁকিও ছিল। এখন সব প্রযুক্তি সফটওয়্যার ভিত্তিক। 
টাকশালে কোন সমস্যা হলে জার্মানীতে বসে মেরামত সম্ভব। নোট ছাপানোর সক্ষমতাও বেড়েছে চারগুণ। দেশের বরেণ্য চিত্র শিল্পীরা মুদ্রার নক্সা করেন। সরকার পাল্টালে ক্ষমতাসীন  রাজনৈতিক দলের মতবাদ অনুসারে মুদ্রার নকশাও পাল্টায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ছবি বাদ দেবার মধ্য দিয়ে নক্সা পরিবর্তনে রাজনীতি শুরু হয়। তবে ছবি টাকার নকল  রোধে সহায়ক। মুদ্রা ছাপানো নিয়ে নিরীক্ষা চলে নিয়মিত। দু’দশক আগে প্লাস্টিকের তৈরি ১০ টাকার নোট ছাড়া হয়েছিল, নানা জটিলতায় তা ক’বছরেই বাতিল হয়। সেটাকে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখেন এই নোট প্রবর্তনকালীন গর্ভনর। কাগুজে মুদ্রা আবিষ্কারের অনেক আগে তৈরি করা হয়েছিল ধাতব মুদ্রা। তুরস্কের এশিয়া মহাদেশীয় অংশের লিডিয় জাতি সর্বপ্রথম মুদ্রা তৈরি করে। লিডিয়দের মুদ্রা তৈরির প্রায় কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন ভারতে মুদ্রা তৈরি এবং প্রচলন হয়। ধারণা করা হয় এখানে মুদ্রার প্রচলন হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নামটিই মুদ্রার সরকারি নাম হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ তারিখ থেকে ১ টাকার নোট প্রচলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব ব্যাংক নোট চালু করে। ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত চালু থাকা এই নোট ছাপা হয় ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে। পরে সুইজ্যারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ভারত, কোরিয়া, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের নোট ছাপা হয়। ১৯৮৯ সালে গাজীপুরে দেশের প্রথম ও একমাত্র আধুনিক টাকশাল স্থাপিত হয়। 
বাংলাদেশে মুদ্রার ইতিহাস : ভাষাবিদগণের মতানুসারে টাকা শব্দটি সংস্কৃত টঙ্ক শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। এক টাকার শতাংশকে পয়সা নামে অভিহিত করা হয়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বাংলাদেশ ব্যাংক নামে পরিচিত টাকার কাগুজে নোট মুদ্রণ এবং মুদ্রা প্রস্তুতকরণ এবং তা বাজারে প্রচলনের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের রাজত্ব ছিল। তবে সে সময়ের মুদ্রা পাওয়া না যাওয়ায় তাদের টাকশাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। দ্বাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী সেনরাজারা বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে রাজত্ব করে। সেনযুগে পালযুগের মতো মুদ্রার পরিবর্তে কড়ির প্রচলন ছিল। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত ২০০ বছর মুসলমান সুলতানরা বাংলাদেশে স্বাধীন রাজত্ব কায়েম করার ফলে বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার পুনরুজ্জীবন ঘটে। কাপড় ও চিনিসহ বাংলাদেশের বহু পণ্য বিদেশে রফতানি হয়। ফলে বাংলাদেশ তখন সম্পদশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। সে সময়ে বাংলাদেশের বাগেরহাট এলাকার খলিফাতাবাদ টাকশাল, রাজশাহীর মাহিসন্তোষের বারবাকাবাদ টাকশাল, সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী মুয়াজ্জমাবাদ টাকশাল, ফখরুদ্দিন মুবারক শাহরে রাজধানী সোনারগাঁওয়ের টাকশাল, চট্টগ্রাম টাকশালসহ প্রায় ৮০টি টাকশালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। স্বাধীন সুলতানি শাসন সময়ের পর মুঘল আমলেও বাংলাদেশে টাকশালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মুঘল যুগের জাহাঙ্গীরনগর টাকশালে তৈরি মুদ্রার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। যার পাশাপাশি কাগুজে নোটেরও প্রচলন হয়। তবে তা আধুনিক মানের ছিল না। ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নোটটি সবচেয়ে পুরনো হিসেবে ধরা হয়। এই উপমহাদেশে লখনৌতি গঙ্গানদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত বাংলার আদি টাকশাল শহর। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই লখনৌ রাজধানী শহর হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং প্রথম টাকশাল হওয়ারও গৌরব অর্জন করে। ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টাকশাল শহর হিসেবে এটি চালু ছিল।  ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ৭৪০ হিঃ থেকে ৭৫০ হিঃ পর্যন্ত রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়ে। তাঁর আমলের সব মুদ্রার সুস্পষ্টভাবে আঁকা হয়েছে, সোনারগাঁও টাকশালের কথা। সেখান থেকে সর্বশেষ মুদ্রা তৈরি হয় ১৪২১ সালে। সোনারগাঁও এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টাকশাল শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। 
উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুদ্রা আইন পাস হয় ১৮৩৫ সালে ও কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয় ১৮৫৭ সালে। কাগজের মুদ্রার প্রচলন করেন লর্ড ক্যানিং। সেই সময় যে অভিন্ন মুদ্রা ছিল তার নাম রুপি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ মুদ্রাকে টাকা বলতো। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুদ্রার নাম ছিল রুপি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তখনো মুদ্রাকে টাকা বলা হতো। টাকা শব্দটি সংস্কৃত ‘টঙ্কা’ শব্দ থেকে এসেছে। ১৯৮৯ সালে প্রিন্টিং প্রেসটি চালু হয় সর্বপ্রথম ১০ টাকার নোট ছাপার মাধ্যমে। টাকা ছাপানোর জন্য বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানি করা হয় সুইজারল্যান্ড থেকে। ৫০০ টাকার নোট ছাপানো হয় জার্মানি থেকে। এছাড়া ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম ১০ টাকা মূল্যমানের পলিমার নোট ছাপা হয়। ১০ টাকার পলিমার নোট তৈরি হয় অস্ট্রেলিয়ায়। ১ ও ৫ টাকা মূল্যমানের যে ধাতব মুদ্রা বাংলাদেশে প্রচলিত তা তৈরি করা হয় কানাডায়। বাংলাদেশে ১ টাকার ধাতব মুদ্রা চালু হয় ৯ মে ১৯৯৩ সালে এবং ৫ টাকার ধাতব মুদ্রা চালু হয় ১ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে। বাংলাদেশে নতুন নোট বাজারে চালু করার ক্ষমতা আছে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের। ১ ও ২ টাকার নোটের মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের। এগুলোতে স্বাক্ষর থাকে অর্থ সচিবের। ১ ও ২ টাকার নোট ছাড়া বাকি সব বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট, এগুলোতে স্বাক্ষর থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের। বাংলাদেশে জাল নোটের ইতিহাস খুবই পুরোনো। ১৯৭২ সালে ১০০ টাকার জাল নোট ব্যাপক হারে বিস্তার করে সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়। বর্তমানে ঈদ, পূজা, পার্বনকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠে জালিয়াত চক্র। বড় বড় মার্কেট থেকে শুরু করে ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও জাল নোট সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয় জাল নোট কারবারিরা। ৫০ টাকার নোট থেকে শুরু করে ১০০, ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট জাল করা হচ্ছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে জাল নোট সরবরাহ ও বাজারজাতকরণে জড়িতদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৫ হাজার ৮৪টি মামলা হয়েছে। এরপরও ঠেকানো যাচ্ছে না জাল নোট কারবারিদের। জাতিসংঘের সদস্য দেশ ১৯৩টি, প্রতিটি দেশই আঞ্চলিক মুদ্রা, জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণে পাসপোর্ট, ডাক টিকেট, ধন দৌলত হস্তান্তরে প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাপী ৩৭ হাজার ৩১৪টি সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ২০ লক্ষাধিক কর্মকর্তা/কর্মচারীর নিবিড় তত্ত্বাবধানে কারেন্সি পাসপোর্ট প্রিন্টিং হচ্ছে। তাদের বেতন হাজার ডলার থেকে লাখ ডলার পর্যন্ত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের কারেন্সী প্রিন্টিং প্রযুক্তিবিদ্যায় কোন ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট না থাকাতে লোভনীয় পদগুলোতে কোন বাংলাদেশীর চাকুরী হচ্ছে না। সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বাংলাদেশ লিঃ ৩৮ বছরে স্বাধীনদেশের আশা আকাক্সক্ষা পূরণে চরম ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণে স্বাধীনতার চার দশক পরও টাকা পাসপোর্ট, ডাকটিকেট, দলিলের স্টাম্প প্রিন্টিং সম্পূর্ণভাবে বিদেশের উপর নির্ভরশীল। বিদেশে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছাপাতে প্রতিবছর ৩/৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। জাতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন সম্প্রতি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মূল সনদপত্র ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করে। নিম্নমানের কাগজ ও প্রিন্টিংয়ের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মূল সনদপত্র অবমূল্যায়ন করা হয়। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় টাকশালে কর্মরত ৭১৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারী কারোরই কারেন্সী ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি/সিকিউরিটি প্রিন্টিং টেকনোলজিতে ন্যূনতম শিক্ষা প্রশিক্ষণ নেই। জাতীয় ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিতে কারেন্সী প্রযুক্তিবিদের নিয়োগ নিশ্চিত করে উন্নত বিশ্বের আবিস্কৃত মেশিনারি সংযুক্ত করা হলে দেশের প্রিন্টিং চাহিদা পূরণ হতো। প্রিন্টিং টেকনোলজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও টাকশালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উর্দু কবি নওশাদ নূরী

১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’





মুহাম্মদ নূরে আলম: ১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’ কবি, বাংলাদেশের ধ্রুপদী ও প্রগতিশীল ঘরানার কবি। কবি নওশাদ নূরী একজন অবাঙালি উর্দুভাষী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার স্পষ্ট সমর্থন ও ‘মহেঞ্জাদারো’ নামে এক সুন্দর কবিতা রচনা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা প্রথম উর্দু কবিতা নওশাদ নূরীর ‘মহেঞ্জোদারো’। এ কবিতা ছাপা হওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে দেশ ছাড়ার হুকুম দেন। কবি দেশ ছেড়ে যান। ১৯৬০ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা ফিরে আসেন। (বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী) তাজউদ্দিন আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় উর্দু সাপ্তাহিক ‘জারিদা’; ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নওশাদ নূরী।
তাঁর কাব্য রচনার ভাষা উর্দু। ষাটের দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যের জগতে তাঁর উপস্থিতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতার অনুপম বুননশৈলী, ভাবপ্রকাশের ধারা চিরায়ত উর্দু কাব্যের আধুনিক উত্তরাধিকার বহন করে। শব্দের গভীর দ্যোতনা, পরিমিত উপমা, ছন্দময় চিত্রকল্প এসব কবিতাকে অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছে। একজন উর্দুভাষী কবি হিসেবে বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপকল্প, রাজনীতি-সমাজজীবন উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সীয়ানা মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু ভাষাগত ভিন্নতার কারণে তিনি বাঙালি পাঠকদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি ও সমাদর পাননি। উর্দু-ফার্সির পা-িত্য, পরোপকারী হৃদয় ও খোলামেলা স্বভাবের জন্যে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে তাঁর অসম্ভব গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাঙালি জাতির অহংকার ভাষা আন্দোলন, মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় এবং দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর করালগ্রাস থেকে একটি স্বাধীন ভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে মুক্ত করবার আন্দোলনে একজন উর্দুভাষী মানুষ কবি নওশাদ নূরীর ত্যাগ সত্যিই আমাকে বিমোহিত করে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল একজন মানুষ নওশাদ নূরীকে নিয়ে তার সমসাময়িক, অনুজ এবং বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিকের কলম থেকে যে নির্যাস চিত্রায়িত হয়েছে তা বাঙালির ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে।
বোহেমিয়ান ও জাত কবি নওশাদ নূরী ১৯২৬ সালের ২১ অক্টোবর বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার বসন্তপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নওশাদ নূরী কবির ছদ্মনাম। তার আসল নাম মোহাম্মদ মোস্তফা মাসুম হাশমী। তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতীম কবি ও গীতিকার ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রতিষ্ঠিত প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের বিহার শাখার সেক্রেটারি। ১৯৫১ সাল। নওশাদ নূরী  বিএন কলেজ, পাটনা থেকে স্নাতক সম্পন্ন ও প্রগতিশীল লেখক সমিতিতে  যোগদান করেন। যেখানে উর্দু কবি ও সোহেল আজিমাবাদী, আখতার ওরায়নভি, মুখতার উদ্দিন আরজু ও কালাম হায়দারির মতো লেখকদের তার সংশ্রব ঘটে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হন।
নবীন ভারত তাদের নব্য স্বাধীনতাকে ‘ঐশ্বর্যম-িত’ করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দান-ভা-ারের দুয়ারে। সে সময় প-িত জওহরলাল নেহেরুকে মার্কিন সাহায্য নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্যই লিখলেন কবিতা দে দে রাম ফেলাদে রাম, দেনে ওয়ালা সীতারাম’। কবিতাটি প্রকাশের পরপরই সারাদেশে আলোড়ন তোলে। জওহরলাল নেহেরু কবি নওশাদ নূরীর নামে হুলিয়া জারি করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। প্রতিবাদী এই কবিতা লেখার দায়ে গ্রেফতারের এড়াতে ১৯৫১ সালে  ঢাকা (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন । তিনি সামরিক অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের চাকরি  পান। পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় তাঁর পোস্টিং হয়। তারপর আপন করে নিলেন বাংলাদেশটাকে। জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার ওপরে উঠে অবাঙালি উর্দুভাষী কবি হয়েও ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার সপক্ষে অবস্থান নিলেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামে লিখলেন কবিতা।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে উর্দু সাপ্তাহিক জারিদায় বাঙালি জনতার ছয় দফা আন্দোলনেও সমর্থন জানালেন। লিখলেন, ‘তেরি নাজাত মেরি নাজাত, ছে নুকাত ছে নুকাত’ (তোমার মুক্তি আমার মুক্তি, ৬ দফা ৬ দফা)। বস্তুত ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ারদির নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন করা, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলন, সে সময়ের পাকিস্তানি তথ্যমন্ত্রীর রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী উক্তির প্রতিবাদ, ইয়াহিয়া তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা ও লোমহর্ষক মর্মান্তিক নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন। ১৯৫২ সালে তিনি "মনেজোদারো " শিরোনামে  আরেকটি কবিতা লিখেন। এ কবিতাটির অনুপম কাব্যশৈলীর মাধ্যমে তিনি কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (পাকিস্তান এর প্রতিষ্ঠাতা) দ্বারা বাঙালিদের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানান। এ কবিতাটির জন্য নওশাদ নূরীকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করা হয়। তিনি চাকরি ছেড়ে ১৯৬০ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন।
ঢাকায় ফিরে নওশাদ নূরী একটি বই দোকান খুলেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ১৯৬৪-৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট -এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত উর্দু সাপ্তাহিক "রুদাদ"-এর  সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ এবং ৮৮ সালে এশীয় কবিতা উৎসবে তিনি লিঁয়াজো অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পারন করেন। তাঁর দক্ষতা ও তৎপরতার ফলে আহমদ ফারাজ, হেমায়েত আলী শায়ের, জমির হাসান জাফরি, কিশওয়ার নাহিদ -এর ও পারভীন শাকির মত পাকিস্তানী কবি এশীয় কবিতা উৎসব অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে আসার কিছু সময়ের মধ্যেই কবি নওশাদ নূরী রাজনৈতিক মতাদর্শে মওলানা ভাসানী, কমরেড আবদুল হকসহ খ্যাতিমান রাজনৈতকি ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে ভীষণ পছন্দ করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কবি নওশাদ নূরীর অনেক আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে গেলেও তিনি থেকে গেলেন ঢাকার মায়ায়।
কবি নওশাদ নূরী একজন আপাদমস্তক কবি ছিলেন। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ষান্মাসিক ‘মনন রেখা’র বর্তমান (৪র্থ) সংখ্যাটিতে খ্যাতিমান লেখকদের স্মৃতিচারণ পড়ে আপনাদের তাই মনে হবে। প্রকৃতির কবিরা কখনো কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না। আপোস করেন না। কবি নওশাদ নূরীও তাই সময়ের প্রয়োজনে জ্বলে উঠেছেন বারবার। কবি আসাদ চৌধুরী তার মন্তব্যে বলেছে ‘কবিতায় নওশাদের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, তাঁর চিত্রকল্প অসাধারণ, তুলনাহীন। কোথাও বাড়াবাড়ি নেই।’
নওশাদ নূরী ছিলেন বাংলাদেশের উর্দু লেখকদের অভিভাবক। ভারত-পাকিস্তানের যে কোনো উর্দু কথাশিল্পী ঢাকায় এলে প্রথমে তাঁর সাথেই যোগাযোগ করতেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের নামকরণের পরামর্শটাও কবি নওশাদ নূরী দিয়েছিলেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক কবি। তার বিবরণ পাই ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীর বর্ণনায়। সময়ে সময়ে কলম ধরতেন জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আক্রমণ করে বসে ফিলিস্তিন। তখন তিনি আক্রমণের প্রতিবাদে কবিতা লিখে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। ১৯৮২ সালে ইসরাইল আবার আক্রমণ করে বসে লেবাননের উপর। তখন তিনি প্রতিবাদে ‘রাহগুজার আশনাই’ কবিতা লিখেন। ইরাকের উপর আমেরিকার আক্রমণের প্রতিবাদে লিখেন ‘তুফান সাহারা’। এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোক্তা এবং সমন্বয়কারী হিসেবেও ভূমিকা রাখেন যা একজন আন্তর্জাতিক চিন্তা ও চেতনার কবির পক্ষেই সম্ভব। যে মানুষটির এমন জীবন-ধারা তাঁর লেখা পাঠ যে সচেতন পাঠকের আরাধ্য হয়ে ওঠে। পাঠকের সেই তৃষ্ণা মেটাতেই লেখক ও গবেষক আইয়ুব হোসেন এবং শামীম জামানভি তাঁদের সুসম্পাদনে সংকলিত করে পরিবেশন করেছেন ‘নওশাদ নূরীর কবিতা’ গ্রন্থটি। এতে রয়েছে কবি নওশাদ নূরীর ৩০টি কবিতা ও ৫টি গজল। অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত লেখক ও কবি আসাদ চৌধুরী, ইনায়াতুল্লাহ সিদ্দিকী, বশীর আল্ হেলাল, মোহাম্মদ হাসান, জাফর আলম, আল মুজাহিদী, মিজারুল কায়েস, সৈকত রুশদী এবং হাইকেল হাশমী।
সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবর্তনের পরিক্রমায় কবি নওশাদ নূরীর অবদান ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে মনে হয়। কারণ অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে একই সূত্রে গাঁথা এই মানুষটি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়নি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কীর্তিমান কবি নওশাদ নূরীকে তুলে ধরা জরুরী হয়ে পরেছে। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ লোক উর্দু ভাষায় কথা বলেন। এখানে বসবাসরত বিহারি কবি-লেখকেরা উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। অগ্রগণ্য উর্দু কবি নওশাদ নূরী আমৃত্যু ঢাকায় বাস করেছেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে  ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামের সেই কবিতায় তিনি লেখেন: ‘বাংলা সাহিত্যের দৌলত আজ বিপন্ন/ হানাদারেরা এগিয়ে আসছে/ পত্র, প্রস্তর, চর্ম, প্যাপিরাস, তাম্র ও কাংসপত্রে সংরক্ষণ করো/ বাংলার মূল্য ও চেতনাকে।/ কারণ সেই অশুভ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।/ যা এক নগরকে উল্টে-পাল্টে দেয়/ এক মৃতের স্তুপে।’
এখানকার উর্দু-ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে ঢাকার নবাব খাজা পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। উনিশ ও বিশ শতকে এই পরিবারের যাঁরা উর্দুতে সাহিত্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে খাজা হায়দার জান, খাজা আসাদউদ্দীন কাওকাব, খাজা আবদুর রহিম সাবা, খাজা আহসানুল্লাহ শাহীন, খাজা নাজিমউদ্দীনের নাম করা যায়। বাঙালি বিস্মৃতি বিলাসী। সে যেমন তার শত্রুর মুখ ভুলে তাকে রাজাসনে বসায় তেমনি বন্ধুকৃত্যও ভুলে যায় অবলীলায়। উর্দু কবি হিসেবে বাংলাদেশে নওশাদ নূরীর ঠাঁই বন্ধুর কাতারে হবে, না কি শত্রু শিবিরে সে বিচারের ভার ইতিহাসের। উল্লেখ্য, মনন রেখ। বর্ষ-২ সংখ্যা : ৪। সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিম। প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০১৮। প্রচ্ছদ : মামুন হোসাইন, মূল্য ১০০ টাকা, উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীকে নিয়ে একটি সুন্দর প্রবন্ধ প্রকাশ করে। উর্দুভাষী কবি নওশাদ নূরীর কবিতার বাংলা অনুবাদ সঙ্কলন: নওশাদ নূরীর কবিতা সম্পাদনা: আইয়ুব হোসেন ও শামীম জামানভি, প্রচ্ছদ: ম্যাস্-লাইন প্রিন্টার্স, প্রকাশনা হাক্কানী পাবলিশার্স, দাম: ১২৫ টাকা। 

Thursday 11 April 2019

জিন্নাহ না নেহরু : কে ভাঙলেন ভারতবর্ষ



  • অধ্যাপক সারওয়ার মো: সাইফুল্লাহ খালেদ
  • ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:২১




  • জওয়াহেরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ - ছবি : সংগৃহীত
    ‘পুঁজি’ কী? ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রবীণতম শিক্ষক ড. এ এন আবু মাহমুদের জবানিতে বলি- ‘কার্ল মার্কস তিন খণ্ডে (দুই হাজার ২৬৬ পৃষ্ঠা) ‘ক্যাপিট্যাল’ গ্রন্থ লিখে সুস্পষ্ট করে বলতে পারেননি ‘পুঁজি’ বলতে আসলে কী বুঝায়। তবে সে জটিলতায় না গিয়ে আমাদের ছাত্রদের সরলীকরণ করে শিখিয়েছি- ক্যাপিটাল ইজ অ্যা মিনস অব প্রোডাকশন উইথ অ্যা ফ্লো অব ইনকাম। ‘ক্যাপিট্যাল’ পড়ে শিখেছি আসলেও ব্যাপারটি তত সরল নয়।
    তেমনি ভারত যে ভাগ হলো তার জন্য দায়ী কে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়েও দেখছি, চৌদ্দ-পনের শ’ শব্দের একটি লেখায় এর মীমাংসা করা দুরাশা মাত্র। যদিও চোখ বুজে অনেকেই মুখস্থ বলে ফেলেন- দায়ী হলেন জিন্নাহ। নিচের উদ্ধৃতিগুলো বিবেচনাসাপেক্ষে এ বিষয়ে বিচারের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম।

    সম্প্রতি ভারতের জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ভারত ভাগের বিষয়টি সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতকে বিভক্ত করতে চাননি। ভারত ভাগের জন্য পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের মতো শীর্ষ রাজনীতিকেরাই দায়ী’ (সূত্র : ফেসবুক, ০৪ মার্চ ২০১৮)। এই চারজনেরই অবস্থানের বিষয়টি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ (যা ভারতীয় প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলায় ‘ভারত স্বাধীন হলো’ শিরোনামে তরজমা করেছেন) গ্রন্থে পরিষ্কার করেছেন।
    কংগ্রেস দলের সভাপতি হিসেবে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা প্রশ্নে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, মাত্র তিনটি বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন থাকবে। তিনটি বিষয় বলতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রীয় বিষয় এবং যোগাযোগ- যা আমার পরিকল্পনায় বাতলানো হয়েছিল। মিশন অবশ্য পরিকল্পনায় একটি নতুন জিনিস যোগ করে। এতে পুরো দেশকে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’- তিনটি মণ্ডলে ভাগ করা হয় এ কারণে যে, মিশনের সদস্যরা মনে করেছিলেন, তাতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঢের বেশি ভরসার ভাব আসবে। ‘ক’ অংশের মধ্যে পড়বে মাদ্রাজ, বোম্বাই, যুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যা; ‘খ’ অংশের মধ্যে পড়বে পাঞ্জাব, সিন্ধু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর ব্রিটিশ বেলুচিস্তান। ‘গ’ অংশের মধ্যে পড়বে বাংলা আর আসাম। বাকি সবার চেয়ে মুসলমানদের সংখ্যা হবে সামান্য বেশি। ক্যাবিনেট মিশন ভেবেছিল, এ ব্যবস্থায় মুসলিম সংখ্যালঘুরা পুরোপুরি ভরসা লাভ করবে এবং মুসলিম লীগের যেসব ন্যায্য ভয়ভীতি, তা দূর হবে। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার সাথে আমার প্রস্তাবের আত্মিক মিল ছিল এবং তাতে একমাত্র সংযোজন ছিল তিনটি অংশের প্রবর্তন- সে কারণে মনে করেছিলাম, প্রস্তাবটি আমাদের গ্রহণ করা উচিত।
    আজাদের ভাষায়, গোড়ায় জিন্না ওই পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন। স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে মুসলিম লীগ এতদূর এগিয়ে গিয়েছিল যে, সেখান থেকে পিছিয়ে আসা তার পক্ষে কঠিন হয়ে গেল। মিশন থেকে সুস্পষ্টভাবে ও দ্বিধাহীন ভাষায় জানানো হয়েছিল, দেশ বিভাগ এবং একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন কোনোক্রমেই তারা অনুমোদন করবেন না...। ক্যাবিনেট মিশন ভেবেছিল এতে কোনো অন্যায় নেই। প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রে, ক’টি এবং কী ধরনের বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করা হবে, প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের তা ঠিক করার স্বাধীনতা থাকবে (ভারত স্বাধীন হলো, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৪)।
    এরপর মাওলানা আজাদ লিখছেন, ‘১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬ একটানা সাত বছর (কংগ্রেসের) সভাপতি থাকার পর এবার আমার বিদায় নেয়া উচিত। সুতরাং আমি ঠিক করলাম, কাউকে আমার নাম প্রস্তাব করার অনুমতি দেবো না...। সব দিক বিচার-বিবেচনা করে আমার মনে হলো, জওয়াহেরলালের হওয়া উচিত নতুন সভাপতি...। যতটা যা সম্ভব ঠিক বুঝেই তা করেছিলাম। তারপর ঘটনা যেভাবে গড়াল, তাতে আমার যথেষ্ট আক্কেল হয়েছে। বুঝেছি, এটা ছিল বোধহয় আমার রাজনৈতিক জীবনের মারাত্মক ভুল। এ রকম সঙ্কটপূর্ণ সময়ে কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে যা পস্তানো পস্তায়েছি, তা আর বলার নয়। গান্ধীজীর ভাষায়, আমার এই ভুল ছিল হিমালয় প্রমাণ। যখন আমি ঠিক করলাম নিজে দাঁড়াব না, তখন সর্দার প্যাটেলকে সমর্থন না করাটা ছিল আমার দ্বিতীয় ভুল...। এই পরিকল্পনা পয়মাল করার সুযোগ জিন্নাহ পেতে জওয়াহের লাল যে গলদযুক্ত কাজ করেছিল, প্যাটেল তা কখনোই করতেন না...। যখন ভাবি, এ ভুলগুলো যদি আমি না করতাম, তাহলে হয়তো গত ১০ বছরেই ইতিহাস পাল্টে যেত, তখন নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারি না’ (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৭-১৪৮)।
    মুসলিম লীগ কাউন্সিল আগেই ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। জাতীয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিও তাই করেছিল। অবশ্য তখনো বাকি ছিল (অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কাউন্সিল) এআইসিসির অনুমোদন (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৯)। সেটাও মাওলানা আজাদ দক্ষতার সাথে করে নেন। এবারই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটল, যে রকম ঘটনা ইতিহাসের মোড় ফিরিয়ে দেয়। ১৯৪৭-এর ১০ জুলাই জওয়াহেরলাল বোম্বাইতে একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। তাতে তিনি এক আজব বিবৃতি দিলেন। সংবাদপত্রের কিছু প্রতিনিধি তাকে জিজ্ঞেস করেন, এআইসিসি যখন প্রস্তাব পাস করেছে, তখন কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনসমেত পরিকল্পনাটি সর্বাংশে গ্রহণ করেছে কিনা।
    উত্তরে জওয়াহেরলাল নেহরু বলেন, কংগ্রেস বোঝাপড়ার কোনোরকম বাঁধন না মেনে এবং সব সময় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণের স্বাধীন মনোভাব নিয়ে গণপরিষদে প্রবেশ করবে। সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা আরো জিজ্ঞেস করেন, এর মানে এটা কি যে, ক্যাবিনেট কমিশনের রিপোর্ট হেরফের করা যাবে। উত্তরে তিনি জোর দিয়ে বলেন, কংগ্রেস রাজি হয়েছে শুধু গণপরিষদে যোগ দিতে এবং মনে করে, তেমন বুঝলে কংগ্রেস অবাধে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা রদবদল বা ইতরবিশেষ করতে পারে (ভারত স্বাধীন হলো, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫০)...। জানতে পারলাম, গোটা ব্যাপারটার পেছনে নাটের গুরু ছিলেন পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন। তার চিন্তাভাবনার ওপর আমার তেমন শ্রদ্ধা ছিল না; তবে জওয়াহেরলালকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যাতে তিনি মত পরিবর্তন করেন...। জওয়াহেরলাল আমার সাথে একমত হলেন না এবং তার নিজের বিচার ঠিক বলে আঁকড়ে রইলেন (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫৬-১৫৭)।
    এতে আজাদ হতাশ হয়ে লিখেছেন, ‘ধরে বেঁধে মুসলিম লীগকে দিয়ে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মানিয়ে নেয়া হয়েছিল...। কাজেই মিশনের সাথে আলোচনায় যে ফলাফল হয় তাতে জিন্নাহ মোটেই খুশি হননি। জওয়াহেরলালের বিবৃতি দেখে তার আক্কেলগুড়ম হলো। তৎক্ষণাৎ তিনি এই মর্মে বিবৃতি দিলেন যে, কংগ্রেস সভাপতির এই ঘোষণার ফলে গোটা অবস্থার পুনর্বিবেচনা দরকার...। তার মতে, জওয়াহের লালের ঘোষণার মানে, কংগ্রেস ক্যাবিনেট কমিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করছে। ২৭ জুলাই বোম্বাইতে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের বৈঠক বসে। জিন্নাহ এর উদ্বোধনী বক্তৃতায় পাকিস্তান দাবির পুনরাবৃত্তি করে বলেন, মুসলিম লীগের পক্ষে এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিন দিন ধরে আলোচনার পর ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে কাউন্সিল থেকে প্রস্তাব পাস করা হয়। তাতে এটাও ঠিক হলো, পাকিস্তান অর্জনের জন্য লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে যাবে (ভারত স্বাধীন হলো ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫০-১৫৮)। এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়েও জিন্নাহ এবং লীগকে আর ফেরানো যায়নি, কারণ জিন্নাহ কংগ্রেসকে আর বিশ্বাস করলেন না।
    জওয়াহেরলাল নেহরু একসময় জিন্নাহ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ‘কিছু পুরাতন নেতা কলকাতা কংগ্রেসের পর কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন এবং তাদের মধ্যে জিন্নাহ ছিলেন এক জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তি। সরোজিনী নাইডু তাকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের রাজদূত’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অতীতে মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের কাছাকাছি আনার কৃতিত্ব ছিল তারই।... পরে ১১ আগস্ট ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমানদের উত্তাল ক্রন্দন-কোলাহলের মধ্যে স্থায়ীভাবে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার চতুর্থ দিনে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের সামনে জিন্নাহ... বলেছিলেন, ‘আপনারা স্বাধীন। এই পাকিস্তান রাষ্ট্রে আপনাদের ইচ্ছামতো মন্দির-মসজিদ অথবা অপর যেকোনো উপাসনাস্থলে যাওয়ার অধিকার আপনাদের আছে। আপনাদের ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায় যাই হোক না কেন, তার সাথে এই মূল নীতির কোনো সম্পর্ক নেই যে, আমরা একই রাষ্ট্রের অধিবাসী।
    আমার মতে, এই নীতিকে আমাদের আদর্শরূপে সদা জাগরুক রাখতে হবে। তা হলে আপনারা দেখবেন যে, হিন্দুরা আর হিন্দু এবং মুসলমানেরা আর মুসলমান থাকবে না- ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে নয়, কারণ সেটা হলো প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রশ্ন। এটা হলো রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে।’... জিন্নার বক্তৃতার ওই অংশ আমি অন্তত যেসব বহুল প্রচারিত জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র পড়তাম, তাতে প্রকাশিত হয়নি। আর তা হলেও আমার নজরে পড়েনি। তাই হাসু কেবল রমানীর রচনায় ওই উদ্ধৃতি পড়ে চমকিত হলাম। এ তো কোনো সাম্প্রদায়িকতাবাদীর উক্তি হতে পারে না (শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, জিন্নাহ-পাকিস্তান/নতুন ভাবনা, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ১-২)।
    যা হোক, কাশ্মিরের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা ফারুক আবদুল্লাহ বলেন, ‘ভারত বিভক্ত না হলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেরও জন্ম হতো না। (ভারতীয় রাজনীতিকেরা) মুসলিম ও শিখদের সংখ্যালঘু হিসেবে কখনোই মেনে নিতে পারেননি। জিন্নাহ কখনোই দেশ ভাগের পক্ষে ছিলেন না। ভারতকে বিভক্ত করতে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব উঠেছিল। কমিশন সেই সময় জানায়, তারা সংখ্যালঘু ও শিখদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেবে। মুসলিমদের জন্য বিশেষ প্রতিনিধিত্ব রাখবে, কিন্তু দেশ ভাগ করবে না। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিকেরা মুসলমান ও শিখদের জন্য সংখ্যালঘু কমিশন চাননি। জিন্নাহ এতে রাজি হলেও জওয়াহেরলাল নেহরু, মাওলানা আজাদ ও সরদার প্যাটেল দ্বিমত পোষণ করেন। যখন এটি ঘটল না, তখন জিন্নাহ পাকিস্তানের দাবি তুললেন। না হলে কোনো বিভক্তি ঘটত না। তা হলে বাংলাদেশ, পাকিস্তানের জন্ম হতো না। এক ভারত থাকত। তাই জিন্নাহ নয়, নেহরুর কারণেই দেশ ভাগ ঘটেছিল। (সূত্র : ফেসবুক ০৪ মার্চ ২০১৮)।
    দেশ ভাগ ও ভারতে তার জের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ভারতের এককালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী যশোবন্ত সিং লিখেছেন, ‘প্রথমে দু’টি ভাগ এবং পরে পাকিস্তান বাংলাদেশে ভেঙে যাওয়ায়, তিনটি ভাগে উপমহাদেশে বিভাজনের জের চলতে থাকে। অচিরেই বিভাজিত দেশগুলো বিভাজনের আবশ্যকতা নিয়ে পুনর্বিবেচনা শুরু করে দেয়। দেশ ভাগের অন্যতম প্রধান কারিগর, বস্তুত ওই বিভাজনের খসড়া-রচনাকারী নেহরু অচিরেই নিজের ভাবনা ও কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন’ (যশোবন্ত সিং, জিন্নাহ ভারত দেশ ভাগ স্বাধীনতা, ২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৩০-৪৩১)।
    জম্মু-কাশ্মিরের স্বাধীনতার প্রশ্ন, ফারুক আবদুল্লাহর মতে, ‘তিন পারমাণবিক ক্ষমতাধর ভারত, চীন ও পাকিস্তান এই (জম্মু-কাশ্মির) উপত্যকার পাশে অবস্থান করায় স্বাধীন কাশ্মিরের আলোচনা নিরর্থক (সূত্র : ফেসবুক ০৪ মার্চ ২০১৮)। যা হোক, বিগত সত্তরোর্ধ্ব বছর ধরে জম্মু-কাশ্মির উপত্যকার স্বাধীনতাকামী জনগণ ভারতীয় বাহিনীর হাতে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে আসছে। তাদের জন্য স্বাধীনতা অবিলম্বে জরুরি বলেই শান্তিকামী বিশ্ব মনে করে।
    লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা কাডার।