Sunday 6 November 2016

আজ ঐতিহাসিকআজ ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর যেদিন বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছিল ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে।

আজ ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর যেদিন বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছিল ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে।


মুহাম্মদ নূরে আলম। 
লেখক লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক।

আজ ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর যেদিন বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছিল ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে। আজও বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে আরও একটি ৭ নভেম্বর দরকার। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির জন্য এই দিনটি “ জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস” নামে পরিচিত। বিএনপি যখন ক্ষমতায় থাকে এই দিনটিকে মর্যাদা দেবার জন্য রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে থাকে। আমার আজকের লেখার প্রধান উদ্দেশ্য ইতিহাসের আলোকে এই দিনটিকে স্বল্প পরিসরে মূল্যায়ন করা। সেই দিন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর  রহমানের হাতে বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছিল ভারতীয়  ষড়যন্ত্রের কবল হতে।

৭ নভেম্বর আলোচনা করার পূর্বে আমরা একটু পিছনের ইতিহাসে যাই। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ তার কাংখিত স্বাধীনতা লাভ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশু দেশটির লালল পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। সাধারণ জনগণের চোখে তখন কষ্টার্জিত দেশ নিয়ে গড়া আকাশচুম্বী স্বপ্ন। কিন্তু জনগণের সে স্বপ্ন চুরমার হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের একনায়কতন্ত্র, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির ভারে জনগণের জীবন পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে, বলতে গেলে মুজিব সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। দুঃশাসনের প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি অর্ধবেলা হরতাল ডাকে। সাধারণ জনগণ সে হরতালের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী একটি দেশের সরকারের জন্য এই হরতাল হতে পারতো একটি সতর্কবার্তা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি আওয়ামীলীগের কতিপয় ব্যক্তি তখনও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

১৯৭৩ সালের মার্চের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত ইলেকশন ইতিহাসের পাতায় একটি বিতর্কিত ইলেকশন বলে চিহ্নিত। ভোট চুরি, স্বজনপ্রীতি, পেশী শক্তি এবং কালো টাকায় মোড়ানো একটি ইলেকশন। ৭৩ এর নির্বাচন ছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতোই বিতর্কিত। আসলে আওয়ামী লীগের ইতিহাস ভোট চুরির ইতিহাস, এর পর ১৯৭৪ সালে আসে ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে খাদ্যমূল্যের সীমাহীন মূল্যস্ফীতি এবং অনাহারে মানুষের মৃত্যু সাধারণ জনগণের মাঝে তত্‍কালীন সরকারের উপর চরম অসন্তোষ বয়ে আনে।

আওয়ামী লীগের মাঝেই তৈরি হয় বিভিন্ন গ্রুপ। ধারনা করা হয়, সেসময় সরকারের কাছের লোকেরাই ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে। পরিণতিতে সংঘটিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে কলংকিত হত্যাকান্ড  ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে  শেখ মুজিবুর রহমানকে  নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। কাপুরুষদের ঘৃণার ছোবল থেকে শেখ পরিবারের কেউ রেহাই পাননি। নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিন বাহিনীর প্রধান তাঁর কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেন। খন্দকার মোশতাক যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তার বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগের। খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদ সিভিল সামরিক শাসন জারী করে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদ নিজে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ উল্যাহ উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মন্ত্রী সভার সদস্য হন উপাচার্য আবু সাইদ চৌধুরী, শ্রী মনোরঞ্জন ধর, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান, শ্রী ফনিভূষণ মজুমদার, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে.এম ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জু, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, প্রেসিডেন্টর সামরিক উপদেষ্টা হন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী।

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শফিউল্যা সহ নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী, রক্ষিবাহিনী, পুলিশ বাহিনীর প্রধানগণ খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদের সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের রক্ত পদদলিত করে তার সহকর্মীরা সরকার গঠন করেন। শেখ মজিবুর রহমানকে দাফন করা হয় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া মধুমতির পাড়ে। পরবর্তী পর্যায়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জেনারেল সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। খন্দকার মোশতাকের সরকার প্রায় আড়াই মাস স্থায়ী ছিল।

৩ রা নবেম্বরের খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান: 
১৯৭৫ সালের ২রা নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের
হত্যার প্রতিবাদে মধুর কেন্টিনে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক মহলে পরিলক্ষিত হয় কিছু একটা হতে যাচ্ছে। অবশেষে ৩রা নবেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, সাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে খন্দকার মোস্তাক সরকারের পতন তরান্বিত করা হয়। খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদের ৮৪ দিন শাসন কালের মধ্যে সেনা বাহিনীর সাবেক প্রধানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় এবং শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সেনা বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। খালেদ মেশারফ সহ সাফায়েত জামিলরা খন্দকার মোস্তাকের সরকারের পতন তরান্বিত করার পাশা-পাশি সেনাবাহিনী প্রধান শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকেও গৃহবন্দি করেন। ৪ঠা নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খালেদ মোশাররফের মায়ের নেতৃত্বে ৩২নং ধানমন্ডি অভিমুখে শোক মিছিল পরিচালিত হয়। জনমত সম্পূর্ণভাবে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চলে যায়। এইভাবেই ৭ই নবেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। পরিশেষে দেশ প্রেমিক সেনা সদস্যদের নেতৃত্বে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে সিপাহী জনতা রাজপথে নেমে আসে। মুক্ত করা হয় বন্দি শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে।

না..এখানেই ইতিহাসের শেষ নয়.. ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তাঁর পরিবারের সদস্যসহ গৃহবন্দি করেন। এরপর ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমাদের প্ররোচনায় এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাসী মধ্যম সারির জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা জাতীয় চার নেতা শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আ.হ.ম কামরুজ্জামান এবং মনসুর আলীকে জেলের ভিতরেই নির্মমভাবে হত্যা করে। ইতিহাসের কলংকময় কালো দিন বলে বিবেচিত জেলহত্যা দিবসের এই দিনে খন্দকার মোশতাক আহমদ অপসারিত হন এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। আওয়ামীলীগের মাঝে আশা ছিল যে খালেদ মোশাররফ  শেখ মুজিবুর রহমানের স্বীকৃত খুনিদের বিচার করবে। কিন্তু দেখা যায় যে, কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ার পরে খালেদ মোশাররফ শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীদের সাথে আপোষরফায় আসেন এবং খুনীদের নির্বিঘ্নে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন।

সেনা অভ্যুত্থানের: 
সেনা উত্থানের স্বপক্ষের যুক্তি অনুযায়ী, খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নেয়ার পর সেনাবাহিনীতে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ অরাজক পরিস্থিতি। এমতাবস্থায়, ইতোপূর্বে অবসর নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়।কথিত আছে যে, কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিকেরা একত্রিত হয়ে ৭ নভেম্বর এই দিনে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরী করে। তাদের প্রচেষ্টায় অস্থিতিশীল সেনাবাহিনীর মধ্যে চেইন অব কমান্ড ফিরে আসে। তাই স্বপক্ষের শক্তি এই দিনকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালের ৭ই নবেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দিনটি একটি অনুসরণযোগ্য দিন। এদিন ভোর রাতে ঢাকা মহানগরীর সকল মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলেন। তারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত সিপাহীদের সাথে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ মিছিল শুধু বড় বড় রাজপথেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছোট ছোট অলি-গলিতেও এ মিছিলের বিস্তার ঘটেছিল।

যদিও উকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যনুসারে বলা হয় যে, ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতান্তর আছে। অনেকের মতে মেজর জেনারেল আমিনুল হকের নেত্রীত্বে সেনাবিহিনীর জওয়ানরা জিয়াকে মুক্ত করেন। আর জিয়ার মুক্তির খবর কর্নেল তাহের বাংলাদেশ বেতার ভবনে বসে জেনেছিলেন (সুত্র: বিচিত্রা ও ১৯৭৫ এর পরে পরে প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন )। পরবর্তীতে ক্ষমতাসিন জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থানকারী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করেন এবং সেনাবাহিনীর নিজস্ব বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেনাবিহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কর্ণেল তাহেরর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

৭ নবেম্বর জাতীয় জীবনের মৌলিক পরিবর্তন: 
১৯৭৫ সালের ৭ই নবেম্বর সিপাহী জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জনমনে আস্থার সৃষ্টি হয়। একদলীয় বিভীষিকা ও বিরোধীদলীয় নেতা কর্মীদের হত্যা নির্যাতনের অক্টোপাস থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন মুক্তি লাভ করে।

জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তনের সুবাতাস বইতে থাকে। একদলীয় স্বৈরশাসনের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনঃপতিষ্ঠা লাভ করে। রাষ্ট্রনীতিতেও ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা স্থাপিত হয় ৭ই নবেম্বরের আলোকে। ৭ই নবেম্বর ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিবেচিত হন জাতীয় চেতনা ও আত্ম-মর্যাদার প্রতীক হিসেবে।

যে মৌলিক আদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল আজ তার প্রতিটি স্তম্ভকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। ৭ই নবেম্বরের চেতনার মূল নায়ক জাতীয় ঐক্যের প্রতীক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। মহান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জাতীয় মর্যাদার প্রতিষ্ঠাতাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে দেশকে করদ রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে। এরই বিরুদ্ধে ৭ই নবেম্বরের চেতনায় জাতীয়তাবাদী ইসলামিক মূল্যবোধের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে শপথ নিতে হবে ২০১৬ সালের ৭ই নবেম্বর।

৭ই নভেম্বর যতই ঘনিয়ে আসে ততই এই ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডায় মুখর হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ, লেজুড় বামপন্থি ও তার সমমনারা। গত ৩৬ বছর ধরেই তারা ক্রমাগত রোটোরিক পৌনঃপুনিক প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন এই বলে যে, ৭ই নবেম্বর হচ্ছে কর্নেল তাহেরের একক প্রচেষ্টার (!) ফসল ৭ই নবেম্বর নাকি কর্নেল তাহেরের দয়ার দান, আর জিয়াউর রহমান নাকি সেই দাতাবশ, দাতা হাতেম তাঈকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মহাপাপ করে ফেলেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে কে এই কর্নেল তাহের? কিভাবে তিনি ৭ই নবেম্বরের দিনে উদয় হলেন? সেদিন ও তার আগে পরে কি ছিল তার ভূমিকা? ৭ই নবেম্বরের ঐতিহাসিক বিপ্লব সিপাহী জনতার স্বতঃস্ফুর্ত হলেও তৎকালিন বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে প্রধানতম দল ছিল তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ।

কর্নেল তাহের এই সংগঠনের কোনো বড় নেতাতো দূরের কথা-মাঝারি নেতাও ছিলেন না। জাসদের সভা-সমাবেশেও তাকে খুব একটা দেখা যেত না। অথচ নেপথ্যচারী হওয়া সত্ত্বেও জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের নাম সাধারণ মানুষের কাছে অজানা ছিল না। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা সত্ত্বেও সিরাজ সিকদার প্রমুখ বামপন্থি নেতাদের নাম সাধারণ মানুষের কাছে অজানা ছিল না। অথচ কর্নেল তাহের যে জাসদের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তা জাসদেরও কর্মী-সমর্থকদের জানা ছিল না। তার ‘৭৫ পরবর্তী কর্মকান্ডও সন্তোষজনক ছিল না। মুজিব সরকারের আমলে সরকার বিরোধী প্রবন্ধ লেখার দায়ে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত হয়েছিলেন। এটিও তার কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় বহন করে। কেননা সেনাবাহিনীর মত একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় কেউ এ ধরনের রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখতে পারেন না। তাও যদি তখন সামরিক শাসন জারী থাকতো তাহলেও না হয় একটা কথা ছিল। আর তিনি যদি এতই বিপ্লবী হতেন তা হলেতো সেনাবাহিনী থেকে তার পদত্যাগ করার কথা ছিল। প্রকৃতপক্ষে সিপাহী জনতার এই স্বতঃস্ফুর্ত অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাসদের নেতারা। কর্নেল তাহেরকে এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভিতরে তারা সুঁই হিসাবে ব্যবহার করেছেন। সিপাহী বিপ্লবের সুযোগে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড নিয়ে রীতিমত পুরো একটি মহাভারত রচনা করা যায়।

এবার ৭ই নবেম্বরের পরিস্থিতি অনুসরণ করা যাক, সময় সকালে ৮টা, টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অফিস ব্যারাকে অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তার সাথে কর্নেল তাহেরও উপস্থিত। উপস্থিত সবার ধারণা ছিল যে, কর্নেল তাহের বুঝি জিয়াউর রহমানকে অভিনন্দন জানাতে এসেছেন। কিন্তু একটু পরেই তাদের ভুল ভাঙলো। তিনি এখানে শুরু করলেন তার নিজস্ব বক্তৃতা। উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে গেল যে কীভাবে পলিসি নির্ধারণ মিটিং-এ একজন রাজনৈতিক বিপ্লবী বাহিনী নেতা উপস্থিত হলেন। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, তিনি এই সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দিকে না গিয়ে অযৌক্তিকভাবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি উপস্থাপন করে বসলেন। স্বভাবতই উপস্থিত কেউই তার ১২ দফা দাবির প্রতি কোন সমর্থন দেয় নি। ইতোমধ্যে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দু’টি স্লোগান ‘‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই/ অফিসারদের রক্ত চাই এবং সুবেদারের উপর কোন অফিসার নাই’’ চারদিকে আতংকের সৃষ্টি করে। সেদিন সন্ধ্যায় রেডিও স্টেশনে জিয়াউর রহমান উপস্থিত হলে তাহেরের গ্রুপের উত্তেজিত সৈনিকরা ঐ সময় তাদের ১২ দফা দাবির সমর্থনে প্রায় জোর করে কাগজের উপর তারা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সই নেয়।

বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় জিয়াকে। সেদিনই বিকাল চারটা। স্থান আবার টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তৎকালীন স্টেশন কমান্ডার লেঃ কর্নেল এম.এ. হামিদ: জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করার জন্য সেখানে উপস্থিত হলেন। বারান্দায় উঠতেই তিনি দেখলেন একটি কক্ষে বসে কর্নেল তাহের। মুখ তার কালো, গম্ভীর ও ভারী। তিন-চারজন কর্নেল- মাহতাব, আবদুল্লাহ, আমিন তার সাথে বসে। এরপর কর্নেল হামিদ মূল কক্ষে গিয়ে দেখতে পেলেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান বসে বসে সৈনিকদের দাবি-দাওয়ার কাগজ পড়ছেন। তাদের হাস্যকর সব দাবি-দাওয়ার বহর দেখে তিনি স্বভাবতই বিরক্ত। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলতে বাধ্য হলেন, ‘‘ব্যাটারা কি পাইছে।’’ সেদিন সন্ধ্যা থেকেই সারা ক্যান্টনমেন্টে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। বিক্ষুব্ধ সৈনিক সংস্থার প্রোপাগান্ডা, লিফলেট প্রভৃতি বিতরণ প্রক্রিয়ায় কিছু সৈনিক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। ৭ই নবেম্বর সকাল বেলা ক্যান্টনমেন্টে যে পরিবেশ ছিল বিকেলে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন আকার ধারণ করল।

অফিসাররা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তারা ধীরে ধীরে সরে পড়তে লাগল। এ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী লেঃ কর্নেল এম.এ. হামিদ বলেছেন, ‘‘বাসায় ফিরে দেখি আমার স্ত্রী দারুণ উদ্বিগ্ন। মালপত্র বেঁধে তৈরি হয়ে বসে আছে। সে বলল, অনেক অফিসার টেলিফোন করেছেন, তারা পরিবার নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছেন। আমরাও আপার বাসায় শহরে চলে যাব। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে আমাকে ছেড়ে যেতে রাজি হল না। বলল, ঠিক আছে মরলে সবাই এক সাথেই মরি। এমন সময় নিচে কারা যেন কড়া নাড়লো। ভেতরে এসে ঢুকল সুবেদার কাজী ও হাবিলদার সিদ্দিক। ‘সর্বনাশ হয়েছে স্যার। টু-ফিল্ড লাইনে বিপ্লবীদের মিটিং হয়েছে। আজ রাতে সব অফিসার মেরে ফেলা হবে।’ সন্ধ্যার পরপরই শুরু হয়ে গেল তাদের গ্রুপের হত্যাযজ্ঞ। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনে পৌঁছে মেজর নাসের ও মেজর গাফফারকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল আমিন, মেজর মুনীর অফিসারদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানালো। কিছুক্ষণ জোর কথা কাটাকাটির পর ট্যাংকাররা ফিরে গেল। বেঁচে গেলেন অফিসারদ্বয়। রাত আনুমানিক ১২টা, চারদিকে অজানা আতঙ্কের ছায়া। মাঝে মাঝে গুলীর শব্দ। কর্নেল হামিদের বাসার নীচ তলায় থাকতেন সিগনাল রেজিমেন্টের কর্নেল শামস। হঠাৎ দরজায় তুমুল চিৎকার, দরজা ভেঙে ঢুকল ১০/১২ জন সিপাই। কিন্তু তারা ঘরের দরজা খুলতে ব্যর্থ হল। এই সুযোগে তিনি ও তার পরিবার পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। তাকে না পেয়ে তারা এবার সিঁড়ি বেয়ে কর্নেল হামিদের বাসার দিকে ধাওয়া করল।

বারান্দায় তার ব্যাটম্যান সমুজ আলী ও অন্য চারজন সিপাই প্রবলভাবে তাদের বাধা দিতে লাগল। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের জোরে তারা ঘরে ঢুকে পড়লে তার স্ত্রী তখন আক্রমণকারীদের সামনে দাঁড়ালো। মহিলা দেখে সিপাহীরা প্রথমে থতমত খেয়ে গেলো পর মুহূর্তে সামনে গিয়ে বললো, ‘আমরা আপনাকে চাই না। অফিসারকে চাই। রক্তপাগল সিপাইরা তার স্ত্রীকে গুলী করতে পারে ভেবে পেছন থেকে বেরিয়ে এলেন কর্নেল হামিদ। বললেন, ‘আমি কর্নেল হামিদ, তোমরা কি চাও? একজন সিপাই গুলী করার জন্য রাইফেল তুলতেই সমুজ আলী ও তার অনুগত সিপাইরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জাপটে ধরলো। তার সিপাইদের দৃঢ়তা দেখে তারা পিছু হটে গেলো। রাগে গর গর করতে করতে তারা ফিরে চলল। একজন বলল, দাবি না মানলে আমরা কোন অফিসারকে জিন্দা রাখবো না। সত্যিই তাই। ৭-৮ নবেম্বরের ঐ বিভীষিকাময় গভীর রাতে উন্মাদ তাহেরপন্থী সিপাইরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠলো। বহু বাসায় হামলা হলো। মেজর করিমকে এয়ারপোর্টে পাকড়াও করে গুলী করে হত্যা করা হলো। কর্নেল ওসমানের বাড়িতে গিয়ে তাকে না পেয়ে তার স্ত্রীকে খুন করলো। অর্ডিন্যান্স অফিসারদের মেসে হামলা করে তিনজন তরুণ অফিসারদের হত্যা করা হলো।

হকি খেলতে এসেছিলেন দু’জন তরুণ লেফটেন্যান্ট। তাদের স্টেডিয়ামের পাশে হত্যা করা হলো। অর্ডিন্যান্স স্টেট ইএমই-এর এক ক্যাপ্টেনকে পেটে গুলী করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে মারা গেল। টেলিভিশনের একজন অফিসার মনিরুজ্জামান। বঙ্গভবনে খালেদ মোশাররফের সময় খুবই তৎপর ছিলেন। তাকে ধরে গুলী করা হয়। তার লাশ পাওয়া যায় মতিঝিল কলোনীর ডোবায়। অল্পের জন্য বেঁচে যান মেডিকেল কোরের কর্নেল খুরশিদ। রাস্তার ওপারে অর্ডিন্যান্স স্টেটের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। উচ্ছৃংখল সৈনিকরা দল বেঁধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। ১২ জন অফিসার মারা পড়েন ঐ রাতে। মেজর আনোয়ার, লেঃ সিকান্দার, লেঃ মুস্তাফিজ প্রমুখ। ৮ই নবেম্বর সকাল ৮টায়ও কয়েকজন অফিসারের উপর গুলীবর্ষণ করা হলো। ১০টার দিকে সৈনিক একটা মিটিং হলো ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ময়দানে। ঐ সভায় তাহেরপন্থীরা আবারও হৈ চৈ করতে থাকে। সভাতেই একজনের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে আপনাআপনি গুলী বেরিয়ে গেল। দু’জন সৈনিক ঘটনাস্থলেই নিহত এবং কয়েকজন আহত হলো। এবার জিয়াউর রহমান বলতে বাধ্য হলেন, ‘‘আপনারাই দেখুন ডিসিপ্লিন না থাকলে কি অবস্থা হয়।’’ ওদিকে খবর পাওয়া গেল যে শহরেও বেশ কিছু বাড়িতে তাহেরপন্থীরা হামলা করেছে। ১১ই নবেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে তাহেরপন্থীদের এই উন্মুক্ত হত্যাযজ্ঞ। এ নিয়ে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও অসন্তোষ দেখা দেয়। মেজর জলিলের মতো নেতারা প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এবার শুরু হলো আর এক ভয়াবহ চক্রান্তের জাল বোনা।

২৩শে নবেম্বর সঙ্গত কারণেই কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করা হলে এর দুই দিন পরেই তার গ্রুপের কিছু লোক তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণের নাটক মঞ্চস্থ করে। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। যাতে ভারত সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত পেয়ে যায়। ঐ সময়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কর্নেল তাহেরের এক ভাইসহ চারজন নিহত হয়। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে ঐ ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ সাজানো। এই হলো ৭ই নবেম্বরের তথাকথিত নায়ক কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিকদের বিপ্লবী কর্মকান্ডের ফিরিস্তি। তার মাথায় একবার কোন ভূত চাপলে তা থেকে তাকে নিবৃত্ত করা ছিল প্রায় অসম্ভব। আর যদি মুক্তিযুদ্ধে তার কৃতিত্বের কথা বলা হয় তাহলেও বলতে হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা, কর্নেল হায়দারের কৃতিত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি। তাদেরকে খুন করতে তো তার বিপ্লবী (!) সৈনিকদের এতটুকু বাঁধেনি। ৭ই নবেম্বর যদি কর্নেল তাহেরের দয়ার দান হয়ে থাকে তাহলে খালেদ মোশাররফসহ সমস্ত অফিসারদের খুনের জন্যেও তারাই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। এদের এইসব অপকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি ধারার সবারই আবশ্য কর্তব্য।

এখন প্রশ্ন জাগে, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর বা ৭ নভেম্বর সংঘটিত ঘটনার পিছনে জিয়াউর রহমানের আদৌ কোনো ভূমিকা ছিল কী না? কেন এই দিনটিকে নিয়ে প্রধান দু দলের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরিত্ধর্মী ইতিহাস লেখা হয়েছে? আমরা যারা ৭৫ এর অনেক পরে জন্মেছি, আমরা এখনো দ্বিধান্বিত। আসলে সত্যি কী? নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদের দ্বারা সত্য উদঘাটন দরকার। সে সত্য যতই কঠিন ও তেতো হোক না কেন, আমাদের জানা দরকার সে সত্য। ৭ নভেম্বরের এই দিবসে সত্যের জয় হোক। জাতি জানুক প্রকৃত সত্য। মনে আশা যে অপ্রকাশিত সত্য একদিন উদঘাটিত হবেই হবে। নির্ভেজাল নির্মোহ সত্য। আমরা অধীর অপেক্ষায় আছি সে সত্যকে আলিঙ্গন করে সামনে এগিয়ে যেতে। সত্যের জয় হোক। নিপাত যাক যত ভ্রান্ত ইতিহাস।

No comments:

Post a Comment