Sunday 27 November 2016

বার্মায় চলছে মুসলিম নিধন। মুসলমানদের কি মানবাধিকার থাকতে নেই????

রোহিঙ্গা সমস্যাটা ব্রিটিশদের তৈরী।
হিংস্র বুদ্ধরা বাঙালী ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের তুচ্ছার্থে কালা নামে ডাকে??!

মুহাম্মদ নূরে আলম  ।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক ।

বার্মায় চলছে মুসলিম নিধন, নিজ পৈত্রিক ভূমি থেকে বিতাড়িত বার্মার মুসলমানরা বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের প্রতিহিংসার শিকার। বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের আগ্রসী দমন নীতির ফলে আমার মুসলিম ভাইয়েরা আজ সর্বস্ব হারিয়ে পড়েছে উভয় সংকটে। যাকে বলে জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। তারা না পারছে থাকতে না পারছে নিজেদের বসত ভিটায় ফিরতে ?? আর না পারছে একজন মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকার নিজে বাঁচতে।  বার্মার মুসলমানরা গরীব বা অশিক্ষিত ছিল না। তারা শিক্ষা দীক্ষায় ব্যবসা বাণিজ্যে ছিল উন্নত । দেশের সামরিক সরকার আর হিংস্র সন্ত্রাসী বৌদ্ধরা কেড়ে নিয়েছে মুসলমানদের সব কিছুই। আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা মুসলিম।

দেশটিকে এক সময় আমরা বাংলায় বলতাম ব্রহ্মদেশ। আর ইংরেজিতে বলতাম বার্মা (Burma)। ফারসিতে বলা হতো বারহামা। এই বারহামা নাম থেকেই ইংরেজিতে উদ্ভব হতে পেরেছিল বার্মা নামটি। ‘ম্রনমা’ শব্দটার মানে হলো মানুষ, যাদের আমরা এক সময় বলতাম বর্মি, তারা নিজেদের বলেন ‘ম্রনমা’। মিয়ানমার নামটি এসেছে ম্রনমা নাম থেকে। ১৯৮৯ সালে ১৮ জুন থেকে বার্মার সরকারি নাম রাখা হয়েছে মিয়ানমার। ম্রনমা ভাষায় ‘র’-এর উচ্চারণ করা হয় না। যদিও তা লেখা হয়। তাই ম্রনমা ভাষায় দেশটির নাম দাঁড়ায় উচ্চারণগতভাবে মিয়ানমা।
রোহিঙ্গাদের সমস্যাটা ব্রিটিশরা তৈরী করে যায়, পরিকল্পনা করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে মানচিত্রের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করে যায়। যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানরা শক্তিশালী না হতে পারে। তাই কৌশলে কাশ্মীর সমস্যা,পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম এলাকা ভারতের ভিতরে রেখে দেয়ার মাধ্যমে সমস্যা, সিটমহল সমস্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়াদা করেও আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা না করে,  না বাংলাদেশ না বার্মা মাঝখানে রেখে যাওয়ার সমস্যা, অনির্ধারিত সীমান্ত রেখে যাওয়ার সমস্যা, এইরকম অসংখ্য সমস্যার মূলে ব্রিটিশরা।

জাতিতে জাতিতে বিভাজন ইংরেজরা তৈরী করে গেছে। আর ঐক্যবদ্ধ মুসলমানদেরকে করে গেছে বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন। ওয়াদা অনুযায়ী স্বাধীনতা তো দেয়নি বরং বার্মার নৃ গোষ্ঠীর তালিকা তৈরী করার সময়ে ইংরেজরা ১৩৯  জনগোষ্ঠীর তালিকা থেকে আরাকানের ( রোহিঙ্গা)  মুসলমানদের বাদ দেয়?!  আর এতে সুযোগ পেয়ে যায় অতি হিংস্র বর্ণবাদী বুদ্ধরা বাঙালী ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের তুচ্ছার্থে ঘৃণা বরে কালা নামে ডাকে। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন এই বুদ্ধরা কতো হিংস্র নরপশু।

ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। আমাদের 'প্রাক্তন ব্রিটিশ শাসকরা' মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের কত যে গোলমাল করে গেছে ব্রিটিশরা তার হিসেবে নেই !

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী 'কালা' নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা 'কালা' বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।

মুসলিম বসতি :
 আরাকান এখন মিয়ানমারের অংশ। কিন্তু আরাকান (যাকে এখন বলা হচ্ছে রাখাইন প্রদেশ) তা ছিল গৌড়ের সুলতানদের সামন্তরাজ্য। আরাকানের এক রাজা (মেং সোআম্উন) পালিয়ে আসেন গৌড়ে। কারণ দক্ষিণ বার্মার এক রাজা দখল করেন তার রাজত্ব। গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ্দীন মুহম্মদ শাহ তাকে তার রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সৈন্যসামন্ত দিয়ে সাহায্য করেন। এবং তিনি তার রাজত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারেন গৌড়ের প্রদত্ত সৈন্যসামন্ত দিয়ে, যাদের বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমান, তারা প্রধানত হলেন এদের বংশধর। আরাকানের রাজা গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যসামন্তকে তার রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য রেখে দেন আরাকানে। আরাকানের রাজা নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, যার নাম দেন রোহং। রোহংকে বাংলায় বলা হতে থাকে রোসঙ্গ নগর। এক সময় গোটা আরাকানকেই বাংলায় বলা হতো রোসাঙ্গ দেশ। আরাকানের সব মুসলমানই অবশ্য রোহিঙ্গা নন। যদিও আরাকানবাসী মুসলমানেরা সাধারণভাবে এখনো রোহিঙ্গা নামেই পরিচিত। কিন্তু পুরো উত্তর আরাকানে এক সময় চলেছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। আরাকানের উত্তরাঞ্চলে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বহু মুসলমান গিয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরাকানসহ পুরো বার্মা চলে যায় জাপানের দখলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আরাকানে মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ব্রিটেন বলে, আরাকান আবার তারা ফিরে পেলে উত্তর আরাকানকে পৃথক করে গড়া হবে একটি পৃথক প্রদেশ। এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবে। কিন্তু ইংরেজরা ওয়াদা ভঙ্গ করে।
আরাকানে মুসলমানদের বসতি হাজার বছরেরও বেশি পুরনো, তার পেছনে দলিল রয়েছে। সে দলিল রয়েছে খোদ মিয়ানমারে। সেখানে মুসলমান বসতির সূত্রপাত প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. মুহাম্মদ এনামুল হক আরাকানের জাতীয় ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ ‘রাজোয়াং’ থেকে নিম্নোক্ত বিবরণটি উদ্ধৃত করেছেন : “খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ পাদে যখন আরাকান রাজ মহতৈং চন্দয় (গধযধঃড়রহম ঞংধহফুধ- ৭৮৮-৮১০ অ.উ.) রাজত্ব করছিলেন, তখন কতকগুলো মুসলমান বণিক জাহাজ ভাঙিয়া যাওয়ার ফলে আরাকানের দক্ষিণ দিকস্থ ‘রনবী’ (আধুনিক রামরী) দ্বীপে উঠিয়া পড়েন। তাঁহারা আরাকানীগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া রাজার সম্মুখে নীত হয়েছিলেন। রাজা তাঁহাদের দুরবস্থা দেখিয়া দয়াপরবশ হইয়া তাঁহাদিগকে স্বীয় রাজ্যে গ্রামে গিয়া বসবাস করিতে আদেশ দিয়াছিলেন।” ড. এনামুল হক মনে করেন যে, “রাজোয়াংএ উল্লিখিত এ সব মুসলমান বণিক আরব দেশীয় ছিলেন এবং চাটগাঁ থেকে উপকূল বেয়ে দক্ষিণ মুখে যাবার পথে, কিংবা দক্ষিণ উপকূল হয়ে উত্তরে চাটগাঁর দিকে এগুবার সময়ই ঝঞ্ঝাতাড়িত হয়ে সম্ভবত তারা রামরী দ্বীপে গিয়ে আশ্র্য় নিয়েছিলেন।” সুপ্রাচীন আরবীয় ঐতিহ্য অনুসারে একই সাথে জীবিকা অর্জন ও ধর্ম প্রচারের সুমহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানেরা দলে দলে নৌ ও স্থলপথে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরই অংশ হিসেবে খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে বার্মায় মুসলিম উপনিবেশ গড়ে ওঠে। জীবন-জীবিকার অনিবার্য প্রয়োজনে স্থানীয় মহিলাদেরকে বিবাহ-শাদি করে তারা সেখানে ধনে-জনে বর্ধিত হতে থাকে।

মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ হামলার কথা নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী লেখা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক Time পত্রিকায় (১ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায়)। টাইম পত্রিকা মুসলিমদের দিয়ে কোনোভাবেই প্রভাবিত নয়। তার প্রতিবেদনকে তাই গ্রহণ করতে হয় যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ হিসেবে। শুধুমাত্র টাইম ম্যাগাজিন নয় বার্মার মুসলমানদের উপরে গণহত্যার চিত্র আল জাজিরাসহ সব মিডিয়া প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

মিয়ানমার (বার্মায়) রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনের ব্যাপারটিও রুয়ান্ডারই অনুরূপ এর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মুসলমানদের খতম করা। মুসলিম গণহত্যা দ্বারা মানুষরূপী এসব শয়তানের এজেন্টদের বাড়তি উদ্দেশ্য হলো, একদিকে মানুষের বংশ নিধন অপরদিকে আল্লাহর আনুগত্যকারীদের সংখ্যা হ্রাস করে শয়তানদের অধিক সন্তুষ্টি অর্জন করা।

বিশেষ করে বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যার প্রতি তাকালে যেসব প্রশ্ন জাগে তন্মধ্যে প্রথম প্রশ্ন হলো এই যে- বার্মার সামরিক এক নায়কত্বের ভেতর থেকে যেই গণতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়ালো সেখানে এই গণহত্যা সত্ত্বেও শান্তির নোবেল প্রাপ্ত বর্মী বিরোধী নেতৃত্বে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া নেই কেন? সারা দুনিয়ায় এই বেদনাদায়ক গণহত্যার বিষয়টিকে কেন ব্লেক আউট করে রেখেছে? মুসলিম বিশ্বের মিডিয়াগুলোর চোখ এ ব্যাপারে কেন বন্ধ হয়ে আছে? কোনো পক্ষ থেকেই ইসলাম দুনিয়ার চোখ খোলার কোনো প্রকার চেষ্টা হচ্ছে না। এ ঘটনাতো শুধু এটিই প্রথম নয়- এর আগে থেকেই রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন ও নিপীড়নের কাজ চলে আসছে।

বর্মী সামরিক সরকার কি এতই শক্তিশালী যে, তারা আন্তর্জাতিক নিয়ম-রীতি লঙ্ঘন করে মনে যা চাইবে তাই করতে থাকবে, কিন্তু জিজ্ঞাসা হলো, সকলের মধ্যে এই নীরবতা কেন? বিভিন্ন সরকারের চাপ ইসলামী সম্মেলন সংস্থা, সার্ক সম্মেলন এ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সকল ফোরাম থেকে নানানভাবে কার্যকর প্রেসার আসা কর্তব্য। অন্যথায় মানবতাবিরোধী গণহত্যায় সকলের এই নীরবতার ফলে মানুষ নামের দানবদের কর্মকান্ডের পরিণতি এক সময় অন্যদেরও ভোগ করতে হবে।

 মুসলিম বিশ্ব ইসলামী সম্মেলন সংস্থা এবং গণতন্ত্র প্রিয় দুনিয়াবাসী থেকে অনেক কিছু আশা করেছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দিনের দিন যেন সব আশা ভরসা নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। মানবসভ্যতা পশ্চাৎমুখী হতে চলেছে। মানবতাকে এই অন্যায় ও দুরবস্থার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে জাতিসংঘ সনদকে কার্যকর করার জন্য বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের অবশ্যই সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। অন্যথায়, বিশ্ব আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাবস্থার মতো অমানবিকতা ও বর্বরতার দিকে ধাবিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের নামে আবারো মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে আরাকানে। স্থানীয় মগজনগোষ্ঠী এবং প্রশাসনের প্রকাশ্য সহায়তায় আরাকানের মংডু এবং আকিয়াব এলাকায় চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বিরাণভূমিতে পরিণত করছে গ্রামের পর গ্রাম। রোহিঙ্গা যুবতি নারীদের অপহরণ করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক যুবতি নারীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। খাল, বিল এবং জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মহিলাদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদেরকে হত্যা করে তাদের দাড়ি গোঁফ মুড়িয়ে গেরুয়া পোশাক পরিয়ে বৌদ্ধলাশ সাজিয়ে মিডিয়ার সামনে মুসলমানদেরকেই দাঙ্গা সৃষ্টিকারী এবং ঘাতক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে সেখানে। মানবিক বিপর্যয়ের এক জলন্ত জাহান্নামে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতভিটে। এমন নির্মমতায় প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় নারী শিশু ও বৃদ্ধসহ সেখানকার খেটে খাওয়া অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সমগ্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। সর্বস্ব হারিয়ে নিজেদের প্রাণটুকু বাঁচানোর তাগিদে তারা পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিতে সক্ষম কিনা কিংবা আশ্রয় দিলেই এ সমস্যার সমাধান হবে কি না এসব বিতর্কের কারণে বাংলাদেশ সরকারও ভীষণভাবে কঠোরতা অবলস্বন করে তাদেরকে আশ্রয়ের কোনো সুযোগ দিচ্ছে না। বরং আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের দৃঢ়চেতা বক্তব্যে জাতি আশাহত হয়েছে। এমনকি যারা মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল, নদীর অথৈ জলে অসহায় মানুষদের খাবার পানীয় সরবরাহ করছিল তাদের দিকে জাতিগত দাঙ্গার মদতদাতার অভিযোগ তুলে বিবেকবান মানুষকে হতবাক করেছে।

নির্যাতিত নিষ্পেষিত অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করা তো দূরের কথা বরং যারা কিছু করার চেষ্টা করছেন তাদের দিকেও অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত সন্দেহের আঙ্গুল উচ্চকিত করা হচ্ছে। ফলে আহত ও নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে অবর্ণনীয় কষ্টের মাধ্যমে নদী আর সাগর জলেই মৃত্যুমুখে গমন করতে হচ্ছে।

বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবিক উৎকর্ষতার এ উন্নত যুগে সকলের চোখের সামনে এমন মানবিক বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে নির্বিঘে। কেউ যেন নেই দেখবার, সাহায্যের হাত বাড়াবার কিংবা ন্যূনতম সহানুভূতি প্রকাশ করবার। চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে রাখাইন রাজ্য নামে পরিচিত আরাকানরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী। অথচ তারা আরাকানেরই মূল জনগোষ্ঠী, জন্মগতভাবেই আরাকানের নাগরিক, তাদের হাতেই পরিপুষ্টি অর্জন করেছে আরাকানের ইতিহাস ঐতিহ্য। শুধুমাত্র মুসলিম হবার অপরাধেই তাদের উপর চলছে এ অমানবিক নির্যাতন।

অথচ রোহিঙ্গারাই আরাকানের প্রথম বসতি স্থাপনকারী মূল ধারার সুন্নী আরব মুসলমান। আরাকান রাজ্যের মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নৃতাত্বিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আরাকান অঞ্চল থেকে মুসলিম সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে নিজ দেশে নাগরিকত্বহীন অবস্থায় পরবাসী হয়ে জীবন যাপন করছে। অথচ রোহিঙ্গাদের কেউ হাজার বছর, কেউ পাঁচ শতাধিক বছর আর কেউবা কয়েকশত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। মূলত বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষত ব্রিটিশ বিদায়ের শেষপর্বে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে অমীমাংসিত ও প্রশ্নবোধক অধ্যায়ের সূচনা হয়; যার ফলে অদ্যাবধি রোহিঙ্গাদেরকে আরাকানের অভিবাসী আশ্রিত মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে এবং বারবার তাদেরকে স্বদেশভূমির ভিটেমাটি ত্যাগ করে বাংলাদেশে শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে হয়েছে।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষাপট:
আরাকান এককালে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও অধুনাকালে মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। অনুরূপভাবে রোহিঙ্গারাও এক সময় স্বাধীন আরাকানের অমাত্যসভা থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখলেও বর্তমানে তারা আরাকানের সবচেয়ে নিগৃহীত জাতিগোষ্ঠী। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজ বোধপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের মধ্যদিয়েই মূলত রোহিঙ্গাদের নিগৃহীত জীবনের সূচনা হয়। অতঃপর ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তিলগ্নে ব্রিটিশ কূটকৌশলের ফলে তাদের জীবনে দ্বিতীয়বারের মত অনিশ্চয়তা নেমে আসে। স্বাধীনতা-উত্তর বার্মায় ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা নে উইন কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর হতে রোহিঙ্গারা ক্রমশ নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনের নামে তাদেরকে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে কল্লা বা বিদেশী আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে। রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে আরাকানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের জীবনে এ দুর্ভোগের পিছনে নিম্নোক্ত কারণ উল্লেখ করা যায় -

প্রথমত, রোহিঙ্গারা দীর্ঘ হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় আরাকানের অমাত্যসভাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন থাকলেও তারা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কোনো ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্মীরাজ বোধপায়া কর্তৃক ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকান দখলের পর আরাকানের সর্বময় ক্ষমতা বর্মীদের হাতে চলে যায়। তারা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাসহ আরাকানি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে। অবশিষ্টদের অনেকেই প্রাণ ভয়ে বাংলায় পালিয়ে আসে এবং ১৮২৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে আরাকান দখল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে অবস্থান করে। এ সময়ে সিন পিয়ানসহ অনেক আরাকানি নেতা স্বদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করলেও বিভিন্ন কারণে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা নেতৃত্বের দিক থেকে আরো পিছিয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত, ১৮২৬ সালে আরাকানে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা রোহিঙ্গাদেরকে বাহ্যিক কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করে। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজনেই আরাকানের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ছাড়াও কৃষি, ব্যবসায় প্রভৃতি কাজের জন্য বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানিদেরকে স্বদেশে বসবাসের সুযোগ প্রদান করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত শ্রেণীর অনেকেই আরাকানে ফিরে না গিয়ে বাংলার কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীসহ কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেলেও নেতেৃত্বের ক্ষেত্রে নতুন করে কোনো অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। পক্ষান্তরে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা ব্রিটিশের কর্তৃত্বকে সহজে মেনে না নেবার কারণে বরাবরই তারা মুসলমানদেরকে শক্র মনে করতো। ফলে বার্মায় পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর রোহিঙ্গারা যাতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে না পারে সেজন্য তাদেরকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত না করে স্থানীয় মগদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এমনকি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বার্মাকে স্বাধীনতা প্রদানের পূর্বে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মগদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা উত্তর মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন বর্মী ও স্থানীয় মগরা সে ইস্যুকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তোলে; যার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে রোহিঙ্গারা কল্লা বা ভিনদেশী চিহ্নিত হয়ে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়।

ব্রিটিশ শাসিত বার্মাকে মুক্ত করার আন্দোলনে রোহিঙ্গারা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানকে সমর্থন দিয়ে বার্মাকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করলেও তারা তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। স্বাধীনতাউত্তর বার্মার শাসক গোষ্ঠী বিভিন্ন অজুহাতে তাদেরকে মিয়ানমার বা আরাকানের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ না করে শুধুমাত্র আরাকানের বাসিন্দা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে।

রোহিঙ্গারা আরাকানের স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করলে রাজনৈতিক কৌশলে তাদের এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অতঃপর তাদের উপর চালানো হয় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বালাদেশে আশ্রয় গ্রহণ  করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের চাপ ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক তৎপরতায় বিষয়টির বাহ্যিক সমাধান নিশ্চিত হয়। তাই রোহিঙ্গাদের নিঃশেষ করে দেবার জন্য কৌশল অবলম্বন করে ১৯৮২ সালে বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইন ঘোষণা করেন।

 এ আইনে নাগরিকদের Citizen, Associate এবং Naturalized শ্রেণীতে ভাগ করে ১৮২৩ সালের পরে আগত বলে Associate কিংবা ১৯৮২ সালে নতুনভাবে দরখাস্ত করে Naturalized Citizen ঘোষণা করার ব্যবস্থা করে। উক্ত আইনের ৪নং প্রভিশনে আরো শর্ত দেয়া হয়, কোনো জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নাগরিক কিনা তা নির্ধারণ করবে আইন-আদালত নয়; সরকারের নীতি-নির্ধারণী সংস্থা Council of State. এ আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের কাছে কালো আইন হিসেবে বিবেচিত এ আইন তাদের সহায়-সম্পত্তি অর্জন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সার্ভিসে যোগদান, নির্বাচনে অংশ গ্রহণ কিংবা সভা-সমিতির অধিকারসহ সার্বিক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাসহ প্রচার মাধ্যমগুলো তাদেরকে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হিসেবে সম্বোধন করে।

১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মিয়ানমার সরকার বিভিন্ন অপারেশনের নামে আরাকানে এক অমানবিক নির্যাতন চালায়। তবে তাদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ অপারেশনে তারা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং দুইপর্বে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রতিবেশী বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকার সীমিত সামর্থ নিয়েই অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ত্রাণ কার্যক্রমসহ আশ্রায়ন ক্যাম্প তৈরি করে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতায় বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তথাপিও রোগ-শোক, অনাহার-অর্ধাহারে নাফ নদী পেরিয়ে আসা অসংখ্য লোক প্রাণ হারায়; যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশল অবলম্বন করে দ্বি-পক্ষীয় ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করেন।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে কাজ করলেও রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে শধুমাত্র শরণার্থীদের অস্থায়ী পুনর্বাসন, ভরণ-পোষণ তথা শরণার্থী জীবন যাপনে সার্বিক সহযোগিতা করছে কিন্তু নাগরিক অধিকার দেবার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করছে না। তাছাড়া মিয়ানমারের মিলিটারি শাসকরা বিশ্ব মতামতের খুব একটা ধার ধারে বলে মনে হয় না। সে দেশের বিরোধী নেত্রী, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত অংসান সুকি দীর্ঘদিন যাবৎ বন্দী অবস্থায় জীবন যাপন করেছেন। তাকে বন্দী রাখার প্রতিবাদে বিশ্বের সর্বত্র তীব্র প্রতিক্রিয়া হলেও State Law And Order Restoration Council (SLORC) তার প্রতি কর্ণপাত না করে তাদের ইচ্ছামত পদ্ধতিতে নামে মাত্র মুক্তির পথ উন্মুক্ত করছে।

যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আরাকানি মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের সহস্র বছরের বন্ধন ও ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয়সহ বহুমাত্রিক বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দেশের স্বার্থে; মানবতার জন্য বাংলাদেশেরই এগিয়ে আসা উচিৎ। রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিকট গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে; এক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহিত করে ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থাগুলো মিলে জাতিসংঘের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সেইসাথে মিয়ানমার সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ। ১৯৭১ সালে যদি ভারত সরকার বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে না আসতো তবে এদেশবাসীকেও বিপাকে পড়তে হত।

মূলত আরাকানে মুসলিম জাতিস্বত্ত্বা বিনাশ করে এককভাবে মগ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়েই রোহিঙ্গাদেরকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেশের বিভন্ন স্থান থেকে মগদের এনে প্রত্যাবাসন করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে স্বাধীন আবাসভূমি ছাড়া রোহিঙ্গাদের মুক্তির বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই বলে অনেকে মনে করেন।

কিন্তু স্বাধীকার আন্দোলনের নিমিত্তে কিছু কিছু সংগঠন কাজ করলেও মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মত সাংগঠনিক ও বৈপ্লবিক শক্তি কোনোটিই তাদের নেই। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের নিয়মিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিন লক্ষাধিক সেনাসদস্য ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের মুখে তাদের মুক্তি বাহিনী বা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা যেমন কঠিন তার চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া আরো কঠিনতর হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষিতে অসহনীয় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে মানবাধিকারের মমত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

মিয়ানমারে ১৯৬২ সাল থেকে চলেছে সামরিক শাসন। সেখানে নেই কোনো গণতন্ত্র। মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা বৌদ্ধ পুরোহিতদের সমর্থনে চালাতে চেয়েছেন দেশকে। উগ্র বৌদ্ধবাদীদের এরা দিয়েছেন আশকারা। যার ফলে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পেরেছে। এতে মিয়ানমারের হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছেন না। কারণ তাহলে তাদের পড়তে হবে ভারতের আক্রোশে। কিন্তু মুসলমানদের হত্যাসহ বৌদ্ধ ধর্মের জয়গান করে বার্মার সামরিক জান্তা যেন পেতে চাচ্ছে সে দেশের বিরাট জনসমর্থন। মুসলমানেরা সে দেশে হয়ে উঠেছেন বিশেষ ঘৃণাবস্তু। রাজনৈতিক পরিভাষায় ইংরেজিতে যাকে বলে Hate-object এমন ঘৃণাবস্তু সৃষ্টি করে রাজনীতি করার ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোটেও বিরল নয়। বলা হয়, বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা হলো, অহিংসা পরম ধর্ম। কিন্তু ধর্মের নামে বৌদ্ধরা হয়ে উঠছেন যথেষ্ট হিংস্র। বৌদ্ধ ধর্মের মর্মবাণী বৌদ্ধদের হাতে হতে পারছে অস্বীকৃত।

Monday 21 November 2016

কেউ মুসলমানদের প্রতি সুবিচার করেনি


আনন্দবাজার পত্রিকা http://www.anandabazar.com/editorial/সম-প-দক-সম-প-ষ-1.40974

সম্পাদক সমীপেষু
১৬ জুন, ২০১৪, ০০:১৩:০০
 
 

অভিরূপ সরকারের রচনাটি (‘আমাদের মুসলিম, ওঁদের মুসলিম’, ১৩-৫) গুজরাত রাজ্যের প্রেক্ষাপটে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের আলোচনা হলে, সমগ্র দেশে মুসলমানদের উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকার প্রসঙ্গ অবহিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

ভারতের মুসলমান সমাজের সামাজিক অবস্থান এবং জীবন ও জীবিকার প্রসঙ্গটি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ জরুরি। ১৮৮৮ সালে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার লিখেছিলেন, ‘অতীতে একজন উচ্চকুলের মুসলমানের গরিব হওয়া ছিল অসম্ভব। এখন ধনী থাকা প্রায় অসম্ভব’। সাচার কমিটির রিপোর্টে (২০০৫) ১১৭ বছর পরেও সেই তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বরং সামগ্রিক ভাবে দেশের মুসলমান সমাজ সারা দেশে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও আরও দরিদ্র হয়েছে।

স্বীকার করা ভাল যে, বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ শাসনেও সংখ্যালঘুদের জীবন ও জীবিকার মৌলিক সমস্যাগুলি ঠিক ভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলেও ভোটের প্রয়োজনে মুসলিমদের ব্যবহার করা হচ্ছে দাবার বোড়ের মতো। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণেই বি জে পি-র কাছে মুসলমান সমাজ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করে না। সাচার কমিটির রিপোর্টকে বি জে পি বিশেষ কোনও গুরুত্ব দেয়নি।
দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলি প্রকাশ্যে দু’ভাবে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করে থাকে। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য মুসলমান ভোট যেখানে সংখ্যায় বেশি, সেখানেই মুসলমান প্রার্থী দেওয়া হয়। সাধারণ ভাবে হিন্দুপ্রধান এলাকায় মুসলমান প্রার্থী দেওয়া হয় না। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলিও সাধারণ ভাবে মুসলমান প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। সেই কারণেই পঞ্চদশ লোকসভায় মুসলমান সাংসদ সংখ্যা মাত্র ৩০ (৬ শতাংশ)। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে ২০টি রাজ্য থেকে এক জন মুসলমানও সংসদে নির্বাচিত হননি। ভারতীয় সংসদে মুসলমানদের সংখ্যা তাঁদের মোট জনসংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক নয়। জনসংখ্যা ১৩.৪ শতাংশ হলেও লোকসভায় ১৯৮০ সালে এক বারই মুসলমান সদস্য ছিলেন ৪৯ জন (প্রায় ১০ শতাংশ)। এটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মুসলমান সাংসদ সংখ্যা।

সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে নানা উপলক্ষে দেশের মধ্যে কোথাও না কোথাও দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে হতদরিদ্র মুসলমানদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফয়দা তোলা।
ভারতের মুসলমান সমাজ স্বাধীনতার পর থেকেই ধারাবাহিক ভাবে কংগ্রেসকে সমথর্র্ন করে এসেছে। দেশভাগের কারণে উদ্ভূত দাঙ্গাহাঙ্গামার পরিস্থিতিতে এক জন মুসলমান মনে করতেন, তাঁর ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনের নিরাপত্তাই প্রধান। তাঁরা মনে করতেন, কংগ্রেসকে ভোট দিলে নিরাপত্তা থাকবে। একই মানসিকতা থেকে পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা বামফ্রন্টকে সমর্থন করতেন। কিন্তু মুসলমান সমাজের প্রাপ্য আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কংগ্রেস-সহ কোনও রাজনৈতিক দলই পালন করেনি। তার আরও একটি কারণ হতে পারে যে, রাজনৈতিক দলগুলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাটি মুখ্যত হিন্দু নেতৃত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমনকী প্রধান দলগুলির নেতৃত্বেও মুসলমানদের অনুপস্থিতি নজরে পড়ার মতো।

ভারতে ৫৯৩টি জেলার মধ্যে (২০০৯) মোটামুটি ১০০টি জেলার মুসলমান জনসংখ্যা বেশি। এই জেলাগুলি নিয়ে সাচার কমিটি যে আলোচনা করেছে, তার মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গের ১৩টি জেলা। এই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, গুজরাতে মুসলমান জনসংখ্যা সেই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৫.৪ শতাংশ হলেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলিম কর্মচারী ৯.১ শতাংশ। তামিলনাড়ুর মুসলিম জনসংখ্যা সেই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩.২ শতাংশ, সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ৫.৬ শতাংশ। অসমে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ, সরকারি কর্মচারী ১১.২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা ২৫ শতাংশের বেশি হলেও সরকারি ক্ষেত্রে ৪.২ শতাংশ মুসলমান। কেরল রাজ্যে বাম শাসন চলাকালীন সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের মংখ্যা ১০.৪ শতাংশ (তথ্যসূত্র: ২০১১ ও সরকারি দফতরের তথ্যের বিশ্লেষণ)।

১৯৬০ সালে আই এ এস এবং আই পি এস কর্মক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৪.৫ ও ৪.০৪ শতাংশ। ২০০৬ সালে সেই অনুপাত হ্রাস পেয়ে হয়েছে যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশ। আই এফ এস কর্মক্ষেত্রে এই অনুপাত মাত্র ১.৮ শতাংশ। দেশের অসামরিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান রেলে হয়েছে। সেখানে মুসলমান কর্মচারীর সখ্যা ৪.৫ শতাংশ। কমবেশি একই ধরনের চিত্র দেখা যাবে ব্যাঙ্ক ও ডাক-তার বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম কর্মচারীর হার ৪.৭ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকেই মুসলমানদের অনুন্নয়নের চিত্রটি বোঝা যায়। ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, তা অনস্বীকার্য।

 লেখক
অশোক ঘোষ।
 সাধারণ সম্পাদক, ইউনাইটেড ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেস (ইউ টি ইউ সি)।

আমাদের মুসলিম, ওঁদের মুসলিম

প্রবন্ধ ১

আমাদের মুসলিম, ওঁদের মুসলিম

মোদী যদি বলেন, গুজরাতের মুসলমানদের সচ্ছলতার পিছনে তাঁর মস্ত ভূমিকা রয়েছে, সেটা মানা শক্ত। দ্বিতীয়ত, সচ্ছল হলেই যে ভাল থাকা যায় না, গুজরাতের মুসলমান তার উদাহরণ।

অভিরূপ সরকার
১৩ মে, ২০১৪, ০০:১৪:০০ আনন্দবাজার পত্রিকা
 
 
নাগরিক। বারো বছর আগে উৎখাত হয়েছিলেন। ওঁদের ঠিকানা আমদাবাদের উদ্বাস্তু কলোনি। সেই কলোনির নাম: সিটিজেন নগর! এপ্রিল ২০১৪। ছবি: এএফপি

নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি বলেছেন, গুজরাতের মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের তুলনায় ঢের ভাল আছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি নানা তথ্য দিয়েছেন, যার মূল সূত্র সাচার কমিটির রিপোর্ট। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাতি মুসলমানদের গড় আয় বেশি, সঞ্চয়ও বেশি। গুজরাতি মুসলিমদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা যতটা ছড়িয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের মধ্যে ততটা নয়। সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের উপস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাতে অনেক বেশি, যদিও  গুজরাতের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত এ রাজ্যের তুলনায় অনেক কম।
মোদীর তথ্য ও পরিসংখ্যানে দু’একটা ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি আছে। যেমন, আমাদের দেশে আয়ের কোনও নির্ভরযোগ্য হিসেব পাওয়া যায় না বলে মাথাপিছু ব্যয় দিয়েই একটি পরিবারের বা সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা বিচার করতে হয়। মোদী হয়তো আয় বলতে ব্যয়কেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু আয়ের বদলে ব্যয়ের দিকে তাকালেও দেখব, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের তুলনায় গুজরাতি মুসলিমরা অনেকটাই সচ্ছল, অর্থাৎ তাঁদের তুলনামূলক মাথাপিছু ব্যয় অনেকটাই বেশি। তেমনই, মোদীর দেওয়া অন্যান্য পরিসংখ্যানগুলিতে যে অল্পবিস্তর গাণিতিক ত্রুটিবিচ্যুতি আছে সেগুলো শুধরে নিলেও দেখা যাবে, তাঁর মূল প্রতিপাদ্যটি কিছু ধসে পড়ছে না, বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও জোরদার হচ্ছে। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় যে গুজরাতের মুসলিমরা অর্থনৈতিক ভাবে সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছেন, মোদীর এই দাবি মেনে নিতেই হবে।
কিন্তু এ ব্যাপারে দু’টি বক্তব্য আছে। প্রথমত, মোদী যদি আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চান যে, গুজরাতের মুসলমানদের আর্থিক সচ্ছলতার পিছনে তাঁর নিজের একটা মস্ত ভূমিকা রয়েছে, সেটা মেনে নেওয়া শক্ত। দ্বিতীয়ত, সচ্ছল হলেই যে ভাল থাকা যায় না, গুজরাতের মুসলমান সমাজ তার মস্ত উদাহরণ। আমাদের বক্তব্য দুটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার।
তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক উতোর-চাপানের বাইরে গিয়ে যদি একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই, তা হলে গুজরাতি-বাঙালি মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক তফাতের রহস্য অনেকটা বোঝা যাবে। আসল কথাটা খুব সহজ। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত মুসলমানদের প্রায় সকলেই সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এর একটা কারণ অবশ্যই ভাষার সুবিধে, আর একটা কারণ ভৌগোলিক নৈকট্য। এ ছাড়াও তৃতীয় একটা কারণ আছে। পুব বাংলা থেকে হিন্দু মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা দলে দলে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার ফলে পুব বাংলায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, উচ্চ পদগুলি ভরাট করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, কাজেই সচ্ছল ও শিক্ষিত মুসলমানদের সামনে বহু নতুন সুযোগ এসে পড়েছিল। এত দিন হিন্দু প্রতিযোগিতার চাপে পুব বাংলায় সচ্ছল ও শিক্ষিত মুসলমানরা খানিকটা দমে ছিলেন, হিন্দুরা চলে যাবার ফলে তাঁদের উন্নতিতে আর কোনও বাধা রইল না। এ-পার বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা ও-পার বাংলায় নতুন সুযোগের সন্ধান পেলেন।
পশ্চিমবঙ্গের গরিব মুসলমানদের কাছে ও-পার বাংলায় চলে যাওয়াটা কিন্তু ততটা আকর্ষণীয় ছিল না। একে তাঁদের টাকার জোর নেই, তার ওপর শিক্ষাদীক্ষাও তেমন নেই যে নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে নতুন করে জীবন শুরু করার ঝুঁকি নিতে পারবেন। সব থেকে বড় কথা, তাঁদের জীবিকার মূলে যে কৃষিক্ষেত্র, পুব বাংলায় সেটা তখনই যথেষ্ট ভিড়াক্রান্ত, নতুন করে আসা পরিযায়ীদের চাপ নিতে সে অক্ষম। কাজেই, এ দেশের গরিব মুসলমানেরা মোটের ওপর এ দেশেই রয়ে গেলেন। কিন্তু এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের চেহারাটা একেবারে হতশ্রী হয়ে পড়ল, সে সমাজে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত তেমন করে আর রইলেন না, কেবল পড়ে রইলেন অসংখ্য গরিব মানুষ।
গুজরাতের ব্যাপারটা অন্য রকম। দেশভাগের পর পুব কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে পাকাপাকি ভাবে চলে যাওয়ার উৎসাহ সেখানকার সচ্ছল মুসলিমদের ছিল না। ছিল ভাষার ব্যবধান এবং ভৌগোলিক দূরত্ব। তা ছাড়া, সেখানে বোহরা-খোজা-মেমন সম্প্রদায়ের মতো উচ্চবিত্ত মুসলমানরা পুরুষানুক্রমে ব্যবসাবাণিজ্য করে অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছিলেন, যথেষ্ট সুবিধেজনক অবস্থায় ছিলেন। তাঁরা নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করার ঝুঁকি নিতে যাবেন কেন? এর ফলে গুজরাতি মুসলমান সমাজের চেহারাটা তেমন একটা বদলাল না, যেমন পশ্চিমবঙ্গে বদলেছিল। গুজরাত ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ইতিহাস নির্ধারিত সেই তফাতটা এখনও পুরো মাত্রায় বজায় রয়েছে, এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদীর কোনও ভূমিকা বা কৃতিত্ব নেই।
আমাদের অনুমান ঠিক হলে দেখা যাবে, গুজরাতের মতো অন্যান্য রাজ্য, যেখান থেকে দেশভাগের পর অবস্থাপন্ন মুসলমানরা ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে পাকিস্তানে চলে যেতে উৎসাহ বোধ করেননি, সেখানকার মুসলিমদের অবস্থাও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের তুলনায় ভাল। তুলনার জন্য দক্ষিণের রাজ্যগুলির দিকে তাকানো যেতে পারে। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৪-০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে মুসলমানদের মাথাপিছু মাসিক খরচ ছিল এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মাথাপিছু মাসিক খরচের ৬২%। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে এই অনুপাত বেশি: তামিলনাড়ুতে ৮৭%, অন্ধ্রপ্রদেশে ৭১%, কেরলে ৭৯%, কর্নাটকে ৭০%। গুজরাতে এ অনুপাত ৭১%-এর কাছাকাছি। এই সংখ্যাগুলি আমাদের তত্ত্বকে সমর্থন করে।
এ বার আমাদের দ্বিতীয় বক্তব্যে আসি। হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদী আসল কথাটা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। তিনি এক বারও বলেননি যে, গুজরাতের মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের তুলনায় অবস্থাপন্ন হলেও তাঁরা সতত নিরপত্তাহীনতায় ভোগেন। কারণ, সেখানে ঘন ঘন দাঙ্গা বাধে, সেই সব দাঙ্গায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের ক্ষতি হয় বেশি। অর্থনীতিবিদ অনির্বাণ মিত্র এবং দেবরাজ রায়ের একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধ (‘ইমপ্লিকেশনস অব অ্যান ইকনমিক থিয়োরি অব কনফ্লিক্ট: হিন্দু-মুসলিম ভায়োলেন্স ইন ইন্ডিয়া, প্রকাশিতব্য, জার্নাল অব পলিটিকাল ইকনমি) থেকে জানতে পারছি, ১৯৮৪-৯৮— এই চোদ্দো বছরে সারা ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বলি হন ১৫২২৪ জন। এর মধ্যে ৪৪৯৯ জন, অর্থাৎ প্রায় ৩০% গুজরাতের; ৪০৩৩ জন অর্থাৎ ২৬%-এর কিছু বেশি মহারাষ্ট্রের। এখানে ‘বলি’ অর্থে দাঙ্গায় হত ও আহত দুইই ধরা হয়েছে।
উক্ত প্রবন্ধের লেখকদের প্রতিপাদ্য হল, দাঙ্গার মূল উদ্দেশ্য লুটতরাজ, এবং যেহেতু ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, লুটতরাজে তাঁরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। প্রবন্ধটিতে দেখানো হয়েছে, যখনই মুসলিমদের ধনসম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, তখনই দাঙ্গার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাৎ, আহত-নিহত সহ দাঙ্গার ক্ষয়ক্ষতি এবং মুসলিমদের ধন-সম্পত্তি বৃদ্ধি, এই দুই-এর মধ্যে একটা সরাসরি সংখ্যাতাত্ত্বিক সম্পর্ক আছে। হিন্দুদের সম্পত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে কিন্তু দাঙ্গার কোনও যোগাযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই বিশ্লেষণ বলে যে, গুজরাতি মুসলমানদের সচ্ছলতাই তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা ও দুঃখদুর্দশার কারণ। এর পরও গুজরাতি মুসলমানের সচ্ছলতা নিয়ে বড়াই করা চলে কি?
মূল সমস্যাটা অবশ্য আরও গভীরে। অর্থনৈতিক স্বার্থের ঘেরাটোপ দিয়ে তাকে পুরোটা ধরা যাবে না। দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৪-৯৮ সময়ের মধ্যে দক্ষিণের চারটি রাজ্যের সম্মিলিত দাঙ্গা-আক্রান্তের সংখ্যা ১৯২৪, অর্থাৎ মোট আক্রান্তের মাত্র ১২.৬%। অথচ আমরা আগেই দেখেছি, দক্ষিণে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা গুজরাতি মুসলমানদের তুলনামূলক অবস্থার থেকে কিছু খারাপ ছিল না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, দাঙ্গার উদ্দেশ্য যদি লুটতরাজই হয়, তা হলে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ততটা দাঙ্গা হয়নি কেন?
আসলে সব দাঙ্গার পিছনেই একটা দীর্ঘ সাম্প্রদায়িক বৈরিতার ইতিহাস থাকে, যে ইতিহাস দক্ষিণে ততটা ছিল না, যতটা গুজরাত-মহারাষ্ট্রে ছিল। উপরি-উক্ত প্রবন্ধের লেখকরাও এখানে ইতিহাসের ভূমিকা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁরা এই অবস্থার নাম দিয়েছেন প্রাইমরডিয়াল হেট্রেড বা আদিম ঘৃণা। গুজরাত-মহারাষ্ট্রে মুসলমানদের সচ্ছলতা দাঙ্গাবাজদের প্রলুব্ধ করেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেখানে সর্বব্যাপী ঘৃণার বাতাবরণ না থাকলে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গাগুলো ঘটত না। মনে রাখতে হবে, গুজরাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই নিয়মিত দাঙ্গা হয়ে আসছে, ১৯৬৯ কিংবা ২০০২-এর দাঙ্গা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। বস্তুত, এই বৈরিতার পরিব্যাপ্ত জমিতেই জন্ম নিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, জনসঙ্ঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি। নরেন্দ্র মোদীও এই দীর্ঘ ঘৃণা ও বৈরিতাকে অতিক্রম করতে পারেননি, সম্ভবত কখনও চেষ্টাও করেননি। উল্টো দিকে, এ কথাও জোর দিয়ে বলা দরকার যে, যে-সব সংখ্যালঘু উগ্রপন্থীরা দেশ জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে, তারাও এই সাম্প্রদায়িক ঘৃণার ঔরসে জাত।
এখানে বলে রাখি, ২০০২-এর পরেও কিন্তু গুজরাতে দাঙ্গার প্রবণতা কমেনি। যেমন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১৩ সময়ের মধ্যে গুজরাতে দাঙ্গার বলি হয়েছেন প্রতি দশ লক্ষ মানুষে তেরো জন। ওই সময়ে এর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দেখা গেছে একমাত্র কর্নাটকে, প্রতি দশ লক্ষে ১৪.৩ জন। কর্নাটক ওই সময় বিজেপি’র শাসনেই ছিল।
একটা ঘৃণা থেকে জন্ম নেয় আর একটা ঘৃণা, তা থেকে আরও একটা। এর কোনও অন্ত নেই। শেষ বিচারে, অর্থ নয়, সচ্ছলতা নয়, শান্তিটাই আসল কথা। কিন্তু এই সরল সত্যটা নরেন্দ্র মোদী বুঝতে চাইবেন কি?

কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক

Sunday 20 November 2016

India’s Muslims An uncertain community



India’s biggest minority grows anxious about its future
Oct 29th 2016 | DELHI | From the print edition।।।
Timekeeper ।।।http://www.economist.com/news/asia/21709341-indias-biggest-minority-grows-anxious-about-its-future-uncertain-community

FOR a community of 172m, almost 15% of the population, Muslims at first glance appear oddly absent from the pages of India’s newspapers. In fact, they crop up a lot, but not by name. Instead, reporters coyly refer to “a certain community”. The clumsy circumlocution is a way of avoiding any hint of stoking sectarian unrest. The aim is understandable in a country that was born amid ferocious communal clashes and which has suffered all too many reprises. But the dainty phrase also hints at something else. Since India’s independence in 1947, the estrangement of Muslims has slowly grown.

India’s Muslims have not, it is true, been officially persecuted, hounded into exile or systematically targeted by terrorists, as have minorities in other parts of the subcontinent, such as the Ahmadi sect in Pakistan. But although violence against them has been only sporadic, they have struggled in other ways. In 2006 a hefty report detailed Muslims’ growing disadvantages. It found that very few army officers were Muslim; their share in the higher ranks of the police was “minuscule”. Muslims were in general poorer, more prone to sex discrimination and less literate than the general population (see chart). At postgraduate level in elite universities, Muslims were a scant 2% of students.



A decade later, with most of the committee’s recommendations quietly shelved, those numbers are unlikely to have improved. Indeed, since the landslide election win by the Hindu-nationalist Bharatiya Janata Party (BJP) in 2014, some gaps have widened. There are fewer Muslim ministers now in the national government—just two out of 75—than at any time since independence, even though the Muslim share of the population has grown.

India remains a secular country, yet some laws proposed by the BJP bear a disturbingly sectarian tint. One bill would allow immigrants from nearby countries who happen to be Hindu, Sikh, Christian or Buddhist to apply for citizenship, while specifically barring Muslims. Another would retroactively block any legal challenge to past seizures of property from people deemed Pakistani “enemies”, even if their descendants have nothing to do with Pakistan and are Indian citizens. Courts have repeatedly ruled in favour of such claimants—all of them Muslim—but their families could now be stripped of any rights in perpetuity.

Far more than such legislative slights, what frightens ordinary Muslims is the government’s silence in the face of starker assaults. A year ago many were shocked when a mob in a village near Delhi, the capital, beat to death a Muslim father of three on mere suspicion that he had eaten beef. Earlier this month, after one of his alleged killers died of disease while in police custody, a BJP minister attended the suspect’s funeral, at which the casket was draped, like a hero’s, with the Indian flag.

Earlier this month, too, newspapers reported a disturbing discrepancy between the fates of two men arrested for allegedly spreading religiously insulting material via social media. One of the men, a member of a right-wing Hindu group in the BJP-run state of Madhya Pradesh, was quickly released from custody after the customary beating. The arresting officers have been charged with assault; their superiors up to the district level transferred. In the other case, in the state of Jharkhand, a Muslim villager was arrested for posting pictures implying he had slaughtered a cow. Police claimed he died of encephalitis following his arrest. A court-ordered autopsy revealed he had been beaten to death. To date, no police officers have been charged.

The BJP’s handling of a popular uprising in India’s only Muslim-majority state, Jammu and Kashmir, has also raised Muslim concern. Four months into the unrest, in which dozens of civilians have been killed and hundreds injured, with continuous curfews and strikes keeping schools and shops closed, the government still refuses to talk to any but the most supine local politicians. “You don’t understand,” snaps a cabinet minister, “It’s a violent movement to build an Islamic theocracy. No democracy can tolerate that.”


Omair Ahmad, a writer on Muslim affairs, scoffs at this. The problem, he says, is that Indian governments insist on treating Kashmir as a “Muslim issue” when the real question is one of democratic representation. Yet most Indian Muslims tend to toe the official line, either from a desire to appear loyal or because they genuinely feel only a faint bond with Kashmir.

The fact is that India’s Muslims are divided, not only between dominant Sunnis and a large Shia minority but also between starkly different social classes and regions: a Muslim in Bengal is likely to share no language and few traditions with a co-religionist far to the south in steamy Kerala. The divisions may soon get deeper. Both India’s supreme court and the national law commission, a state body charged with legal reform, are deliberating whether laws governing such things as divorce and inheritance should remain different for different religious groups, or should be harmonised in a uniform national code, as the constitution urges. Spotting another “Muslim issue”, past governments have let conservative clerics control family law. As a result India, unlike most Muslim-majority countries, still allows men to divorce simply by pronouncing the word three times.

The BJP, however, is calling for sweeping reform, with Narendra Modi, the prime minister, painting the issue as a straightforward question of women’s rights. Much as many Muslims heartily agree that change is long overdue, suspicions linger that the BJP’s aim is less to generate reform than to spark inevitable protests by Muslim conservatives, so uniting Hindus in opposition to Muslim “backwardness”.

This question may play out in elections this winter in Uttar Pradesh, India’s most populous state, nearly 40m of whose 200m people are Muslim. The state has witnessed repeated communal clashes since the destruction by Hindu activists, in 1992, of a medieval mosque said to have been built over an ancient temple marking the birthplace of Rama, a Hindu deity. Many expect the BJP to play the “Muslim card” in an effort to rally Hindu votes.

There is hope: a similar ploy flopped last year in the neighbouring state of Bihar. Whatever the outcome, India’s Muslims feel increasingly like spectators in their own land. “They called it a secular state, which is why many who had a choice at partition wanted to stay here,” says Saeed Naqvi, a journalist whose recent book, “Being the Other”, chronicles the growing alienation of India’s Muslims. “But what really happened was that we seamlessly glided from British Raj to Hindu Raj.”

From the print edition: Asia

Thursday 17 November 2016

ইতিহাসের কুখ্যাত স্বৈরাচার শেখ মুজিবের রক্ষী বাহিনীর বর্বর নির্যাতন।


কোনো কালেই আওয়ামীদের বর্বর নির্যাতন অত্যাচার থেকে দেশের জনগণ রক্ষা পাইনি । একাত্তরে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানীদের বর্বরতা ও নৃশংসতার কাহিনী শুনলে গা শিউরে ওঠে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভের পরও বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত থাকে। বাহাত্তর থেকে পচাত্তর এ কয়েক বছরে ২৫ হাজার বিরোধী বামপন্থী রাজনীতিক, পরাজিত বিহারী, রাজাকার ও শান্তি কমিটি, ইসলামপন্থী এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদেরকেও পাকিস্তানীদের মতোই পাশবিক কায়দায় হত্যা করে রক্ষী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের খবর ব্যাপকভাবে জাতির সামনে আসেনি। কেউ ভোলে কেউ ভোলে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মতপার্থক্যজনিত বিরোধের ফল হিসেবেই আওয়ামী লীগ বিরোধী মুক্তিযোদ্ধা ও বামপন্থীরা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হত্যার শিকারে পরিণত হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রশক্তি এবং আওয়ামী লীগের দলীয় শক্তি ব্যবহার করা হয়।

আহমদ মুসা তার ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ বইয়ে লিখেছেন, “আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, সেসব দলের মতে, সে আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে- যে নৃশংসতা অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানী সৈন্যদেরও ছাড়িয়ে গেছে। খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, হয়রানি, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন কোনো কিছুই বাদ রাখা হয়নি।”

বামপন্থীদের ওপর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাওলানা ভাসানীর হক কথা লিখে, “একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ প্রোগ্রামে এ দেশে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের হিসেব হলো, বাংলাদেশে সোয়া লক্ষ বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করতে হবে। তা না হলে শোষণের হাতিয়ার মজবুত করা যাবে না।” (২৬ মে-১৯৭২ : সাপ্তাহিক হক কথা)

স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞে শেখ মুজিবের ভূমিকার এক ভয়ঙ্কর তথ্য জানা যায় মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং সিআইএ' গ্রন্থে। ঐ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে,‘১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন। শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।

সুতরাং মুজিব আমলে এসব হত্যাকাণ্ড যে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার আমরা আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনীর নির্মমতার কিছু কাহিনী তুলে ধরবো।

মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর: ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকর্তার দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়েছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করিয়া নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলে জনৈক এমসিএ হস্তক্ষেপ করিয়া এই নরঘাতকটিকে মুক্ত করিয়াছেন।(২ জুন-১৯৭২ : সাপ্তাহিক হক কথা )।

তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে’। আহমেদ মুসা তার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ' গ্রন্থের উৎসর্গনামায় আওয়ামী ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার বাজিতপুরের ইকুরটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আব্দুল আলীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘....ঐখানে আমাকে (আব্দুল আলী) ও আমার ছেলে রশিদকে হাত-পা বেঁধে তারা খুব মারলো। রশিদকে আমার চোখের সামনে গুলী করলো। ঢলে পড়লো বাপ আমার। একটা কসাই আমার হাতে একটা কুঠার দিয়ে বলল, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বলল তারা, তোরও রেহাই নেই। কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরল। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করবে?"

ময়মনসিংহে এক হাজার ৫শ' কিশোরকে হত্যা: “....রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারীতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ' কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক বাঙ্গালী যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন... বস্তুত বাংলাদেশে বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতার অভাব নেই।”(ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ :আহমেদ মুসা, পৃষ্ঠা-১৩৬)

রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া

‘মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুন্ডামি এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়-যেখানে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনীর উপর নির্বিচারে গুলী চালানো হলো। শতাধিক নিহত হলেন। হাজার হাজার শ্রমিক বিশ মাইল হেঁটে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হল এবং তারা তিনদিন তিনরাত পল্টন ময়দানের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অবস্থান করতে বাধ্য হল।' (বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা' -হায়দার আকবার খান রনো)।

বাংলাদেশী পত্রিকায় বাকশালী স্বৈরাচার শেখ মুজিবের দুঃশাসন ১৯৭২_ ৭৫

বাংলাদেশী পত্রিকায় বাকশালী স্বৈরাচার শেখ  মুজিবের দুঃশাসন ১৯৭২_ ৭৫


ইতিহাস রচনার নামে বাংলাদেশের ইতিহাসে শুধু যে মিথ্যাচার ঢুকানো হয়েছে তা নয়, মুজিব ও তার দলের দুঃশাসনের বিবরণগুলো ইতিহাসের গ্রন্থ থেকে অতি সতর্কতার সাথে বাদ দেওয়া হয়েছে। এবং তা ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির স্বার্থে। তবে কোন অপরাধী তার অপরাধ কর্মগুলো লুকানোর যত চেষ্টাই করুক না কেন, সম্পূর্ণ লুকাতে পারে না। সাক্ষী রেখে যায়। শেখ মুজিবও তার সহচরগণও অসংখ্য সাক্ষী রেখে গেছে। আর সেগুলি হল, সে সময়ের দেশী ও বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মুজিব আমলের বিবরণ। আগামী দিনের ইতিহাস রচনায় এবিবরণগুলোই গণ্য হবে গুরুত্বপূর্ণ দলীল রূপে। শেখ মুজিব ও তার দল বাংলাদেশকে যে কতটা বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছিল সে পরিচয় পাওয়া যাবে সে আমলের ঢাকার পত্রিকাগুলো পড়লে। নিজ ঘরে নিরপত্তা না পেয়ে বহু মানুষ তখন বনেজঙ্গলে লুকিয়েছে। ১৯৭৩ সালের ১৭ আগষ্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল,“নিরাপত্তার আকুতি গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘর”। মূল খবরটি ছিল এরূপঃ “সমগ্র দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির ফলে এবং মানুষের জান-মাল ও ইজ্জতের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে গ্রাম-গঞ্জ ও শহরবাসীর মনে হতাশার মাত্রা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে এবং আইন রক্ষাকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা লোপ পাইতেছে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে,চুরি-ডাকাতি, লুঠ-তরাজ তো আছেই, রাজনৈতিক, সামাজিক ও বৈষয়িক কারণে শত্রুতামূলক হত্যাকান্ডের ভয়ে মানুষ বাড়ীঘর ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লইতেছে। যাহারা বিত্তশালী তাহারা শহরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে এমনকি শহরের আবাসিক হোটেগুলিতে পর্যন্ত আসিয়া উঠিতেছেন। যাঁহাদের শহরে বাস করিবার সঙ্গতি নাই,তাহার বনে-জঙ্গলে অথবা এখানে-ওখানে রাত্রি কাটাইতেছেন”।

১৯৭৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের কিছু খবরের শিরোনাম ছিলঃ “ঝিনাইদহে এক সপ্তাহে আটটি গুপ্তহত্যা”(০১/০৭/৭৩); “ঢাকা-আরিচা সড়কঃ সূর্য ডুবিলেই ডাকাতের ভয়” (০২/০৭/৭৩) “বরিশালে থানা অস্ত্রশালা লুটঃ ৪ ব্যক্তি নিহত” (৪/০৭/৭৩); “পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্তঃ সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র লুট” (১২/০৭/৭৩); “লৌহজং থানা ও ব্যাঙ্ক লুট”(২৮/০৭/৭৩); “দুর্বৃত্তের ফ্রি স্টাইল” (০১/০৮/৭৩); “পুলিশ ফাঁড়ি ও বাজার লুটঃ লঞ্চ ও ট্রেনে ডাকাতি”(৩/০৮/৭৩); “এবার পাইকারীহারে ছিনতাইঃ সন্ধা হইলেই শ্মশান”(১১/০৮/৭৩);“চট্টগ্রামে ব্যাংক ডাকাতি,লালদীঘিতে গ্রেনেড চার্জে ১৮ জন আহত, পাথরঘাটায় রেঞ্জার অফিসের অস্ত্র লুট” (১৫/০৮/৭৩); “খুন ডাকাতি রাহাজানিঃ নোয়াখালীর নিত্যকার ঘটনা,জনমনে ভীতি” (১৬/০৮/৭৩); “২০ মাসে জামালপুরে ১৬১৮টি ডাকাতি ও হত্যাকান্ড” (১৭/১১/৭৩); “আরও একটি পুলিশক্যাম্প লুটঃ সুবেদরসহ ৩ জন পুলিশ অপহৃত” (১৩/০৭/৭৩);“যশোরে বাজার লুটঃ দুর্বৃত্তের গুলীতে ২০ জন আহত” (১৮/০৪/৭৪); “রাজশাহীতে ব্যাংক লুট” (২১/৪/৭৪) মুজিব আমলের পত্রিকাগুলো পড়লে চোখে পড়বে এরূপ হাজার হাজার ঘটনা ও বহু হাজার বিয়োগান্ত খবর। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে দুর্বৃত্তির যত না ঘটনা ঘটেছে মুজিবের ৪ বছরে তার চেয়ে বহু গুণ বেশী ঘটেছে। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে “ভিক্ষার ঝুলী”-এ খেতাব জুটিনি, কিন্তু মুজিব সেটি অর্জন করেছে। অথচ কিছু কাল আগেও গ্রামবাংলার অধিকাংশ মানুষের গৃহে কাঠের দরজা-জানালা ছিল না। ঘরের দরজায় চট বা চাটাই টানিয়ে অধিকাংশ মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে রাত কাটাতো। কিন্তু মুজিব শুধু খাদ্যই নয়,সে নিরাপত্তাটুকুও কেড়ে নেয়। নিরাপত্তার খোঁজে তাদেরকে ঘর ছেড়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় খুঁজতে হয়। থানা পুলিশ কি নিরাপত্তা দিবে? তারা নিজেরাই সেদিন ভুগেছিল চরম নিরাপত্তাহীনতায়। দুর্বত্তদের হাতে তখন বহু থানা লুট হয়েছিল। বহু পুলিশ অপহৃত এবং নিহতও হয়েছিল। মুজিবের নিজের দলীয় কর্মীদের সাথে তার নিজের পুত্রও নেমেছিল দুর্বৃত্তিতে। সে সময় দৈনিক পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিলঃ “স্পেশাল পুলিশের সাথে গুলী বিনিময়ঃ প্রধানমন্ত্রীর তনয়সহ ৫ জন আহত”। মূল খবরটির ছাপা হয়েছিল এভাবেঃ “গত শনিবার রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকার কমলাপুর স্পেশাল পুলিশের সাথে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রধানমন্ত্রী তনয় শেখ কামাল,তার ৫ জন সাঙ্গপাঙ্গ ও একজন পুলিশ সার্জেন্ট গুলীবিদ্ধ হয়েছে। শেখ কামাল ও তার সঙ্গীদেরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নয়,দশ ও তেত্রিশনম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে। আহত পুলিশ সার্জেন্ট জনাব শামীম কিবরিয়াকে ভর্তি করা হয় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে।” -(গণকন্ঠ ১৯/১২/৭৩)।

ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ প্রকাশ্য মানুষ খুন করত -সে বিবরণ বহু পত্রিকায় বহু ভাবে এসেছে। যাদেরকে আওয়ামী লীগ বাঙালীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে তুলে ধরছে এ ছিল তাদের আসল চরিত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর এসেছে তিনবার। এর মধ্যে দুই বার এসেছে ব্রিটিশ আমলে। এবং তা ১৭৬১ সালে এবং ১৯৪৩ সালে। তৃতীয়বার এসেছে মুজিব আমলে। পাকিস্তানী আমলে একবারও আসেনি। অথচ এ পাকিস্তান আমলটিকেই আওয়ামী-বাকশালী বুদ্ধিজীবী ও নেতা-কর্মীগণ চিত্রিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপনিবেশিক শোষনের আমল রূপে। অথচ ১৯৪৭-এ পাকিস্তান আমলের শুরুটি হয়েছিল অনেকটা শূন্য থেকে। তখন অফিস আদালত ছিল না,কলকারখানা ছিল না। সহযোগী প্রতিবেশীও ছিল না। বরং ছিল ভারত থেকে তাড়া খাওয়া লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের ভিড়। মুজিবামলের ন্যায় সেসময় বিদেশ বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকার সাহায্যও আসেনি। কিন্তু সে দিন কোন দুর্ভিক্ষ আসেনি।অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশী সাহায্য সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ এসেছিল মুজিবামলে। দুর্ভিক্ষ এসেছিল শেখ মুজিবের দূর্নীতি পরায়ন প্রশাসন এবং দলীয় ও ভারতীয় লুটপাটের কারণে। সে সময়ে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবরের দিকে নজর দেওয়া যাক। বাংদেশের ৭০ জন বিশিষ্ঠ সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে দেশের পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেনঃ বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যাভাব ও অর্থনৈতিক সঙ্কট অতীতের সর্বাপেক্ষা জরুরী সঙ্কটকেও দ্রুতগতিতে ছাড়াইয়া যাইতেছে এবং ১৯৪৩ সনের সর্বগ্রাসী মন্বন্তর পর্যায়ে পৌঁছাইয়া গিয়াছে।তাঁহারা সরকারের লঙ্গরখানার পরিবেশকে নির্যাতন কেন্দ্রের পরিবেশের শামিল বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেনঃ “দুর্ভিক্ষ মানুষ দ্বারা সৃষ্ট এবং একটি বিশেষ শ্রেণীর অবাধ লুন্ঠন ও সম্পদ-পাচারের পরিণতি”। তাঁরা বলেনঃ “খাদ্য ঘাটতি কখনও দুর্ভিক্ষের মূল কারণ হইতে পারে না। সামান্যতম খাদ্য ঘাটতির ক্ষেত্রেও শুধু বন্টন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা যায়। যদি দেশের উৎপাদন ও বন্টন-ব্যবস্থা নিম্নতম ন্যায়নীতি উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিত,দেশের প্রশাসন,ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিচারকে নিশ্চিত করার সামান্যতম আন্তরিক চেষ্টাও থাকিত তাহা হইলে যুদ্ধের তিন বছর পর এবং দুই হাজার কোটি টাকারও বেশী বৈদেশিক সাহায্যের পর ১৯৭৪ সনের শেষার্ধে আজ বাংলাদেশে অন্ততঃ অনাহারে মৃত্যুর পরিস্থিতি সৃষ্টি হইত না।” (ইত্তেফাক,অক্টোবর ১,১৯৭৪) সে সময়ের পত্রিকার কিছু শিরোনাম ছিলঃ “চালের অভাবঃ পেটের জ্বালায় ছেলেমেয়ে বিক্রি”-(গণকন্ঠ আগষ্ট ২৩,১৯৭২) “লাইসেন্স-পারমিটের জমজমাট ব্যবসা; যাঁতাকলে পড়ে মানুষ খাবি খাচ্ছে; সিরাজগঞ্জ, ফেণী, ভৈরব, ইশ্বরগঞ্জ ও নাচোলে তীব্র খাদ্যাভাব,অনাহারী মানুষের আহাজারীঃ শুধু একটি কথা, খাবার দাও”- (গণকণ্ঠ আগস্ট ২৯,১৯৭২) “গরীব মানুষ খাদ্য পায় নাঃ টাউটরা মজা লুটছে; গুণবতীতে চাল আটা নিয়ে হরিলুটের কারবার”-(গণকন্ঠ সেপ্টেম্বর ১৯,১৯৭২) “একদিকে মানুষ অনাহারে দিন যাপন করিতেছেঃ অপরদিকে সরকারি গুদামের গম কালোবাজারে বিক্রয় হইতেছে”-(ইত্তেফাক এপ্রিল ৭,১৯৭৩); “এখানে ওখানে ডোবায় পুকুরে লাশ।”(সোনার বাংলা এপ্রিল ১৫,১৯৭৩); “চালের অভাবঃ পেটের জ্বালায় ছেলেমেয়ে বিক্রি; হবিগঞ্জে হাহাকারঃ অনাহারে এ পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ মে ৩,১৯৭৩); “কোন এলাকায় মানুষ আটা গুলিয়া ও শাক-পাতা সিদ্ধ করিয়া জঠর জ্বালা নিবারণ করিতেছে”-(ইত্তেফাক মে ৩,১৯৭৩); “অনাহারে দশজনের মৃত্যুঃ বিভিন্নস্থানে আর্ত মানবতার হাহাকার; শুধু একটি ধ্বনিঃ ভাত দাও”-(গণকন্ঠ মে ১০,১৯৭৩); “লতাপতা, গাছের শিকড়, বাঁশ ও বেতের কচি ডগা, শামুক, ব্যাঙার ছাতা, কচু-ঘেচু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যে পরিণতঃ গ্রামাঞ্চলে লেংটা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি”-(ইত্তফাক মে ১০,১৯৭৩); “পটুয়াখালীর চিঠিঃ অনাহারে একজনের মৃত্যু;সংসার চালাতে না পেরে আত্মহত্যা”-(গণকন্ঠ মে ১০, ১৯৭৩); “ওরা খাদ্যভাবে জর্জরিতঃ বস্ত্রাভাবে বাহির হইতে পারে না”-(ইত্তেফাক মে ৩০,১৯৭৩) “আত্মহত্যা ও ইজ্জত বিক্রির করুণ কাহিনী”-(গণকন্ঠ জুন ১,১৯৭৩) “স্বাধীন বাংলার আরেক রূপঃ জামাই বেড়াতে এলে অর্ধ-উলঙ্গ শ্বাশুরী দরজা বন্ধ করে দেয়”- (সোনার বাংলা জুলাই ১৫,১৯৭৩) “গ্রামবাংলায় হাহাকার, কচু-ঘেচুই বর্তমানে প্রধান খাদ্য”-(ইত্তেফাক এপ্রিল,১৯৭৪); “দুঃখিনী বাংলাকে বাঁচাও”-(ইত্তেফাক আগষ্ট ৪,১৯৭৪); “জামালপুরে অনাহারে ১৫০ জনের মৃত্যুর খবর”-(ইত্তেফাক আগষ্ট ১৩,১৯৭৪) “১০দিনে জামালপুর ও ঈশ্বরদীতে অনাহার ও অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে ৭১ জনের মৃত্যু”-(গণকন্ঠ আগস্ট ২৭, ১৯৭৪)

১৯৭২ সনের ২১ অক্টোবর তারিখে দৈনিক গণকন্ঠে একটি খবর ছিলঃ “পেটের দায়ে কন্যা বিক্রি”। ভিতরে সংবাদটি ছিল এরকমঃ “কিছুদিন পূর্বে কুড়িগ্রাম পৌরসভার সন্নিকটস্থ মন্ডলের হাটনিবাসী রোস্তম উল্লাহর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন তার আদরের দুলালী ফাতেমা খাতুনকে (৭ বছর) পৌরসভার জনৈক পিয়ন জমির উদ্দীনের কাছে মাত্র ছয় টাকায় বিক্রি করে দেয়”।১৯৭৩ সালে ৮ই জুলাই সোনার বাংলা “ফেন চুরি” শিরোনামায় এ খবরটি ছাপেঃ “বাঁচার তাগিদে এক মালসা ফেন। দু’দিন না খেয়ে থাকার পর এক বাড়ীর রান্না ঘর থেকে ফেন চুরি করলো সে। চুরি করে ধরা পড়লো। শুকনো মুখো হাড্ডীসার ছেলেটির গালে ঠাশ ঠাশ পড়লো সজোরে থাপ্পর। চোখে অন্ধকার দেখলো সে এবং মাথা ঘুরে পড়ে গেল। গ্রামের নাম দরগাপুর,থানা আশাশুনি,জেলা খুলনা। গাজী বাড়ির বাচ্চা। বয়স সাত-আট বছর। গুটি বসন্তে পিতা মারা গেছে। মা কাজ করে যা পায় তাতে কোলের ভাই-বোন দুটোর হলেও বাকী দুই বোন আর বাচ্চার হয় না। বাচ্চা তাই প্রতিদিন একটা ভাড়া নিয়ে বের হয়। দ্বারে দ্বারে ফেন মাগে, এই ভাবেই তিন ভাই বোন চলে”। ১৯৭৪ সনের ২৩শে মার্চ ইত্তেফাক খবর ছাপে,“মরা গরুর গোশত খাইয়া ভোলা মহকুমার বোরহানু্‌দ্দিন থানার ১০ ব্যক্তি মারা গিয়াছে এবং ৬০ জন অসুস্থ্য হইয়া পড়িয়াছে, -এই খবরে বিস্মিত হইবার না ইহাতে বিশ্বাস স্থাপন না করিবার কিছূ নাই। স্বয়ং সরকারদলীয় স্থানীয় এম. পি.সাংবাদিকদের এই খবর দিয়াছেন। জান বাঁচানোর জন্য মানুষ মরা গরু খাইতে আরম্ভ করিয়াছে,তবু বাঁচিতে পারিতেছে না, বরং মরা গরুর গোশত খাইয়া আরও আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িতেছে। এ খবর বড় মর্মান্তিক, বড় সাংঘাতিক”। ১৯৭৪ সালের ৪ আগষ্ট সোনার বাংলায় ছাপা হয়, “ঢোল পিটিয়ে মানুষ বিক্রিঃ মানবশিশু আজ নিত্য দিনের কেনা-বেচার পণ্য”। মূল খবরটা ছিল এরূপঃ “হাটের নাম মাদারীগঞ্জ। মহকুমার নাম গাইবান্ধা। সেই মাদারীগঞ্জ হাটে ঘটেছে একটা ঘটনা। একদিন নয়, দু'দিন। ১০ই এবং ১৩ই জুলাই। ১০ই জুলাই এক হাটে এক ব্যক্তি মাত্র একশ টাকার বিণিময়ে তার ৬/৭ বছরের শিশু পুত্রকে বিক্রি করে। দ্বিতীয় দিনে ১৩ জুলাই একই হাটে ৫-৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৮ টাকায়। প্রথমে বাজারে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয় মেয়ে বিক্রি করার ঘোষণা। ঢোল পিটানোর মেয়ে কিনতে ও দেখতে অনেক লোক জমা হয়। অবশেষে আটাশ টাকা দামে মেয়েটি বিক্রি হয়”।

সে সময়ে প্রকাশিত বহু খবরের মধ্যে এ খবরগুলিও ছাপা হয়ঃ ঈশ্বরদীতে ৬ কোটি টাকার তামার তার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দু'চার জন যারা ধরা পড়েছে, এবং তারা সবাই মুজিব বাহিনীর লোক। তারা পুলিশ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ( পূর্বদেশ: ১১ মে, ১৯৭২) পটুয়াখালী থানার বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির হিড়িক পড়ে গেছে। কোন গ্রাম-বন্দরে দিনের বেলা ডাকাতি হয়। পুলিশকে খবর দিলে শেষ করে দেব বলে ভয় দেখায়। ফলে থানায় খবু কমই এজাহার হয়। ডাকাতদের দু'একজন এলএমজি হাতে থানার গেটে মোতায়েন থাকে যাতে দারগা-পুলিশ ডাকাতদের জারিক্রিত কারফিউ লংঘন করতে না পারে। -(পূর্বদেশ : ৩১ মে '১৯৭২) সম্প্রতি পাবনার সুজানগর থানাধীন ছয়টি গ্রামের ১১৮টি বাড়িতে ডাকাতি সংঘটিত হয়। পাবনার পল্লীর লোকগুলো বাড়ি-ঘর ছেড়ে জঙ্গলে রাত কাটায়। (দৈনিক বাংলা : ৩০ আগষ্ট ১৯৭২) দিনমজুর ছাবেদ আলীর স্ত্রী মাত্র ৫ টাকা দামে পেটের দায়ে তার সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। (সাপ্তাহিক বিচিত্রা: ২০ জুলাই '১৯৭৩) শেষ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলের হেদায়েত উল্লাহকে কাফন ছাড়াই কলাপাতার কাফনে কবরখানায় যেতে হল (বঙ্গবার্তা: ৪ অক্টোবর ১৯৭৩) দেশের ঘরে ঘরে যখন বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার তখন বৈদেশিক মুদ্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের তাস আমদানি করা হয়েছে। (বঙ্গবার্তা: ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭৩) স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই ১৪ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভারতে পাচার হয়ে গেছে। -(জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানের বক্তৃতা: ২৭ জানুয়ারি '১৯৭৪) কয়েকদনি আগে জয়পুরহাটের মাংলীপাড়া গ্রামের আব্দুল কাদেরের কবর থেকে কাফন চুরি হয়ে গেছে। -(সাপ্তাহিক অভিমত : ২৭ মে ১৯৭৪) আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের সচিব বলেছেন, ১৯৭৩ সালের জুন থেকে ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ঢাকা শহরে তারা ১৪০০ বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। আর ১৯৭৪ এর জুলাই হতে১৯৭৫ এর জুলাই পর্যন্ত দাফন করেছে ৬২৮১টি বেওয়ারিশ লাশ। -(ইত্তেফাক: ২১ অক্টোবর ১৯৭৫) সারা দেশে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রতি ৪৮ ঘন্টায় একজনের আত্মহ্ত্যা। -(হক কথা : ১৯ মে ১৯৭৪) গাইবা্ন্ধায় ওয়াগন ভর্তি ৬শ' মণ চাল লুট। রংপুরে ভুখা মিছিল।-(আমাদের কথা : ১৯ এপ্রিল ১৯৭৪) ক্ষুধার্ত মানুষের ঢলে ঢাকার রাজপথ নরকতুল্য। -(হলিডে: ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

১৯৭৪ সালে ৮ই সেপ্টম্বর সোনার বাংলা আরেকটি ভয়ানক খবর ছাপে। খবরের শিরোনাম ছিলঃ“রেকর্ড সৃষ্টিকারী খবরঃ “জঠর জ্বালায় বমি ভক্ষণ”। খবরে বলা হয়,একজন অসুস্থ্য ব্যক্তি গাইবান্ধার রেলওয়ে প্রচুর পরিমাণে বমি করে। বমির মধ্যে ছিল ভাত ও গোশত। দু’জন ক্ষুধার্থ মানুষ জঠর জ্বালা সংবরণ করতে না পেয়ে সেগুলো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলেছে। ১৯৭৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম ছিলঃ “রাজধানীর পথে পথে জীবিত কংকাল।” উক্ত শিরোনামে ভিতরের বর্ননা ছিলঃ “শীর্নকায় কঙ্কালসার আদম সন্তান। মৃত না জীবিত বুঝিয়া ওঠা দুস্কর। পড়িয়া আছে রাজধানী ঢাকা নগরীর গলি হইতে রাজপথের এখানে সেখানে। হাড় জিরজিরে বক্ষে হাত রাখিয়াই কেবল অনুভব করা যায় ইহারা জীবিত না মৃত।”১৯৭৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক খবরের শিরোনাম দেয়,“ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তচীৎকারে ঘুম ভাংগে”।খবরটি ছিল,“নিরন্ন, অভুক্ত,অর্ধভুক্ত,অর্ধনগ্ন ও কঙ্কালসার অসহায় মানুষের আহাজারি ও ক্ষুধার্ত শিশুর আর্তচীৎকারে এখন রাজধানীর সমস্যা পীড়িত মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। অতি প্রত্যুষে হইতে গভীর রাত্রি পর্যন্ত দ্বারে দ্বারে করুণ আর্তিঃ “আম্মা! একখানা রুটি দ্যান। গৃহিনীর কখনো বিরক্ত হন,আবার কখনও আদম সন্তানের এহেন দুর্দশা দেখিয়া অশ্রুসজল হইয়া ওঠেন”। এ এক হৃদয়বিদারক চিত্র!বাংলাদেশের হাজারো বছরের ইতিহাসে বহু শাসক,বহু রাজা-বাদশাহ ক্ষমতায় বসেছে। সুলতানী আমল এসেছে,মোঘল আমল এসেছে,এসেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল। কিন্তু কোন আমলেও কি মানুষকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এতটা নীচে নামতে হয়েছে যা হয়েছে মুজিব আমলে? বাংলা এক কালে সোনার বাংলা রূপে পরিচিত ছিল। দেশটিতে এক সময় প্রচুর প্রাচুর্য ছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলে প্রশ্ন তুলেছেন, “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?”পাকিস্তানী শাসকবর্গ সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে -এ অভিযোগ এনে লাখো লাখো পোস্টার ছেপে ১৯৭০-এর নির্বাচন কালে দেশ জুড়ে বিতর করা হয়েছিল।আর এভাবে পরিকল্পিত ভাবে মানুষকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপানো হয়েছিল। প্রশ্ন হল,পাকিস্তান আমলে অভাবের তাড়নায় কোন মহিলাকে কি মাছধরা ঝাল পড়তে হয়েছে? কাউকে কি ক্ষুধার তাড়নায় বমি খেতে হয়েছে? কাউকে কি নিজ সন্তান বিক্রি করতে হয়েছে? এরূপ কোন ঘটনা পাকিস্তান আমলে হয়নি। সে সময় দেশ শ্মশান ছিল না,বরং সে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে খোদ মুজিবের শাসনামলে।এজন্যই মুজিবের মৃত্যূতে ঢাকায় শোক মিছল হয়নি।সেদিন কেউ কোন কালো ব্যাজও ধারণ করেনি।বরং তার নিজের দলের লোকেরা পর্যন্ত মুজিবের লাশ সিড়িঁর নীচে ফেলে মন্ত্রীত্বের শপথ নিয়েছেন।
  স

Wednesday 16 November 2016

বিদেশি পত্রিকায় বাকশালী স্বৈরাচার শেখ মুজিবের দুঃশাসন ১৯৭২_ ৭৫



বাংলাদেশের নিজস্ব ইতিহাসে মুজিবের আসল পরিচয় পাওয়া মুশকিল। আওয়ামী বাকশালীদের রচিত ইতিহাসে রয়েছে নিছক মুজিবের বন্দনা। তাই তার এবং তার শাসনামলের প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে পড়তে হবে সে আমলের বিদেশি পত্র-পত্রিকা। বাংলাদেশ সে সময় কোন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান বা খেলাধুলায় চমক সৃষ্টি করতে না পারলেও বিশ্বব্যাপী খবরের শিরোনাম হয়েছিল দুর্ভিক্ষ, দূর্নীতি, হত্যা, সন্ত্রাস, ব্যর্থ প্রশাসন ও স্বৈরাচারের দেশ হিসাবে। ১৯৭৪ সালের ৩০ শে মার্চ গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছিল, “আলীমুদ্দিন ক্ষুধার্ত। সে ছেঁড়া ছাতা মেরামত করে। বলল, যেদিন বেশী কাজ মেলে, সেদিন এক বেলা ভাত খাই। যেদিন তেমন কাজ পাই না সেদিন ভাতের বদলে চাপাতি খাই। আর এমন অনেক দিন যায় যেদিন কিছুই খেতে পাই না।” তার দিকে এক নজর তাকালে বুঝা যায় সে সত্য কথাই বলছে। সবুজ লুঙ্গির নীচে তার পা দু'টিতে মাংস আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার ৪০ মাইল উত্তরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জ। ১৫ হাজার লোকের বসতি। তাদের মধ্যে আলীমুদ্দিনের মত আরো অনেকে আছে। কোথাও একজন মোটা মানুষ চোখে পড়ে না। কালু বিশ্বাস বলল, “আমাদের মেয়েরা লজ্জায় বের হয় না-তারা নগ্ন।” আলীমুদ্দিনের কাহিনী গোটা মানিকগঞ্জের কাহিনী। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাহিনী,শত শত শহর বন্দরের কাহিনী। এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে ৫০ লাখ টনেরও বেশী খাদ্যশস্য বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য পাঠানো হয়েছে তারা পায়নি।”

১৯৭৪ সালের ২৭ সেপ্টম্বর তারিখে লন্ডনের নিউ স্টেট্সম্যান লিখেছিল,

“বাংলাদেশ আজ বিপদজনক ভাবে অরাজকতার মুখোমুখি। লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত। অনেকে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। .. ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে।.. বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া। গত আঠার মাসে চালের দাম চারগুণ বেড়েছে। সরকারি কর্মচারিদের মাইনের সবটুকু চলে যায় খাদ্য-সামগ্রী কিনতে। আর গরীবরা থাকে অনাহারে। কিন্তু বিপদ যতই ঘনিয়ে আসছে শেখ মুজিব ততই মনগড়া জগতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাবছেন, দেশের লোক এখনও তাঁকে ভালবাসে;সমস্ত মুসিবতের জন্য পাকিস্তানই দায়ী। আরো ভাবছেন, বাইরের দুনিয়ী তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশ উদ্ধার পাবে। নিছক দিবাস্বপ্ন.. দেশ যখন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে,তখনও তিনি দিনের অর্ধেক ভাগ আওয়ামী লীগের চাঁইদের সাথে ঘরোয়া আলাপে কাটাচ্ছেন। .. তিনি আজ আত্মম্ভরিতার মধ্যে কয়েদী হয়ে চাটুকার ও পরগাছা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন।.. সদ্য ফুলে-ফেঁপে ওঠা তরুণ বাঙালীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শরাবখানায় ভীড় জমায়। তারা বেশ ভালই আছে। এরাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা- বাংলাদেশের বীর বাহিনী। .. এরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাছাই করা পোষ্য। আওয়ামী লীগের ওপর তলায় যারা আছেন তারা আরো জঘন্য। .. শুনতে রূঢ় হলেও কিসিঞ্জার ঠিকই বলেছেনঃ “বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি।”

১৯৭৪ সালে ২রা অক্টোবর,লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় জেকুইস লেসলী লিখেছিলেন,

“একজন মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আর অসহায় দুষ্টিতে তার মরণ-যন্ত্রণাকাতর চর্মসার শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হতে চায় না, তাই কথাটি বোঝাবার জন্য জোর দিয়ে মাথা নেড়ে একজন ইউরোপীয়ান বললেন, সকালে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন,এমন সময় এক ভিখারি এসে হাজির। কোলে তার মৃত শিশু। ..বহু বিদেশি পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান দুর্ভিক্ষের জন্য বর্তমান সরকারই দায়ী। “দুর্ভিক্ষ বন্যার ফল ততটা নয়,যতটা মজুতদারী চোরাচালানের ফল”-বললেন স্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদ।.. প্রতি বছর যে চাউল চোরাচালন হয়ে (ভারতে) যায় তার পরিমাণ ১০ লাখ টন।”

১৯৭৪ সালের ২৫ অক্টোবর হংকং থেকে প্রকাশিত ফার ইষ্টার্ণ ইকনমিক রিভিয়্যূ পত্রিকায় লরেন্স লিফঅসুলজ লিখেছিলেন,

সেপ্টেম্বর তৃতীয় সপ্তাহে হঠাৎ করে চাউলের দাম মণ প্রতি ৪০০ টাকায় উঠে গেল। অর্থাৎ তিন বছরে আগে -স্বাধীনতার পূর্বে যে দাম ছিল - এই দাম তার দশ গুণ। এই মূল্যবৃদ্ধিকে এভাবে তুলনা করা যায় যে, এক মার্কিন পরিবার তিন বছর আগে যে রুটি ৪০ সেন্ট দিয়ে কিনেছে,তা আজ কিনছে ৪ পাউন্ড দিয়ে। কালোবাজারী অর্থনীতির কারসাজিতেই এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।.. ২৩শে সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন, “প্রতি ইউনিয়নে একটি করে মোট ৪,৩০০ লঙ্গরখানা খোলা হবে।" প্রতি ইউনিয়নের জন্য রোজ বরাদ্দ হল মাত্র দুমন ময়দা। যা এক হাজার লোকের প্রতিদিনের জন্য মাথাপিছু একটি রুটির জন্যও যথেষ্ট নয়।”

নিউয়র্ক টাইমস পত্রিকা ১৯৭৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর তারিখে লিখেছিলঃ

জনৈক কেবিনেট মন্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে একজন বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ বললেন,“যুদ্ধের পর তাঁকে (ঐ মন্ত্রীকে) মাত্র দুই বাক্স বিদেশি সিগারেট দিলেই কাজ হাসিল হয়ে যেত, এখন দিতে হয় অন্ততঃ এক লাখ টাকা।” ব্যবসার পারমিট ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য আওয়ামী লীগারদের ঘুষ দিতে হয়। সম্প্রতি জনৈক অবাঙ্গালী শিল্পপতী ভারত থেকে ফিরে আসেন এবং শেখ মুজিবের কাছ থেকে তার পরিত্যক্ত ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানাটি পুরনরায় চাল করার অনুমোদন লাভ করেন। শেখ মুজিবের ভাগিনা শেখ মনি -যিনি ঐ কারখানাটি দখল করে আছেন-হুকুম জারি করলেন যে তাকে ৩০ হাজার ডলার দিতে হবে। শেখ মুজিবকে ভাল করে জানেন এমন একজন বাংলাদেশী আমাকে বললেন, “লোকজন তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করুক, এটা তিনি পছন্দ করেন। তাঁর আনুগত্য নিজের পরিবার ও আওয়ামী লীগের প্রতি। তিনি বিশ্বাসই করেন না যে, তারা দুর্নীতিবাজ হতে পারে কিংবা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।”

দেখা যাক, প্রখ্যাত তথ্য-অনুসন্ধানী সাংবাদিক জন পিলজার ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সম্পর্কে কি বলেছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বর লন্ডনের ডেইলী মিরর পত্রিকায় লিখেছেনঃ

“একটি তিন বছরের শিশু -এত শুকনো যে মনে হল যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম। মনে হল তার চামড়া আমার আঙ্গুলে মোমের মত লেগে গেছে। এই দুর্ভিক্ষের আর একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্বস্বাস্থ্ সংস্থার মতে ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহ। পরিধেয় বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে।”

পিলজারের সে বক্তব্য এবং বিশ্বস্বাস্থ সংস্থার সে অভিমতের প্রমাণ মেলে ইত্তেফাকের একটি রিপোর্টে। উত্তর বংগের এক জেলেপাড়ার বস্ত্রহীন বাসন্তি জাল পড়ে লজ্জা ঢেকেছিল। সে ছবি ইত্তেফাক ছেপেছিল। পিলজার আরো লিখেছেন,

“সন্ধা ঘনিয়ে আসছে এবং গাড়ী আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম-এর লরীর পিছনে পিছনে চলেছে। এই সমিতি ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন,“স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়ত কয়েক জন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি। কিন্তু এখন মাসে অন্ততঃ ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি- সবই অনাহার জনিত মৃত্যু।”

লন্ডনের “ডেইলী টেলিগ্রাফ” ১৯৭৫ সালের ৬ই জানুয়ারী ছেপেছিল,

“গ্রাম বাংলায় প্রচুর ফসল হওয়া সত্ত্বেও একটি ইসলামিক কল্যাণ সমিতি (আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম) গত মাসে ঢাকার রাস্তা,রেল স্টেশন ও হাসাপাতালগুলোর মর্গ থেকে মোট ৮৭৯টি মৃতদেহ কুড়িয়ে দাফন করেছে। এরা সবাই অনাহারে মরেছে। সমিতিটি ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে ২৫৪৩টি লাশ কুড়িয়েছে- সবগুলি বেওয়ারিশ। এগুলোর মধ্যে দেড় হাজারেরও বেশী রাস্তা থেকে কুড়ানো। ডিসেম্বরের মৃতের সংখ্যা জুলাইয়ের সংখ্যার সাতগুণ।.. শেখ মুজিবকে আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বোঝা বলে আখ্যায়ীত হচ্ছে। ছোট-খাটো স্বজনপ্রাতির ব্যাপারে তিনি ভারী আসক্তি দেখান। ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বাকী পড়ে থাকে।.. অধিকাংশ পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস, আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট রোধ করার কোন সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম এ সরকারের নেই। রাজনৈতিক মহল মনে করেন, মুজিব খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বুনিয়াদ আরো নষ্ট করে দেবেন। তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার পরিকল্পনা করছেন। ডেইলী টেলিগ্রাফের আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। জরুরী অবস্থা জারি করেছেন, আরো বেশী ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। অবশেষে তাতেও খুশি হননি, সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে তিনি একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আওয়ামী লীগ যাকে নিয়ে গর্ব করে, এ হল তার অবদান।

১৯৭৫ সালের ২১শে মার্চ বিলেতের ব্রাডফোর্ডশায়র লিখেছিল,

“বাংলাদেশ যেন বিরাট ভূল। একে যদি ভেঙ্গে-চুরে আবার ঠিক করা যেত। জাতিসংঘের তালিকায় বাংলাদেশ অতি গরীব দেশ। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে যখন বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে দেশের দক্ষিণ অঞ্চল ডুবে যায় তখন দুনিয়ার দৃষ্টি এ দেশের দিকে - অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নিবদ্ধ হয়। রিলিফের বিরাট কাজ সবে শুরু হয়েছিল। এমনি সময়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুণ জ্বলে উঠল। --কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ যখন শুরু হল, তখন জয়ের কোন সম্ভাবনাই ছিল না। একমাত্র ভারতের সাগ্রহ সামরিক হস্তক্ষেপের ফলেই স্বল্পস্থায়ী-কিন্তু ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী- যুদ্ধের পর পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।” পত্রিকাটি লিখেছে, “উড়োজাহাজ থেকে মনে হয়, যে কোন প্রধান শহরের ন্যায় রাজধানী ঢাকাতেও বহু আধুনিক অট্রালিকা আছে। কিন্তু বিমান বন্দরে অবতরণ করা মাত্রই সে ধারণা চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। টার্মিনাল বিল্ডিং-এর রেলিং ঘেঁষে শত শত লোক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে,কেননা তাদের অন্য কিছু করার নাই। আর যেহেতু বিমান বন্দর ভিক্ষা করবার জন্য বরাবরই উত্তম জায়গা।”

পত্রিকাটি আরো লিখেছে,“আমাকে বলা হয়েছে,অমুক গ্রামে কেউ গান গায়না। কেননা তারা কি গাইবে? আমি দেখেছি, একটি শিশু তার চোখে আগ্রহ নেই,গায়ে মাংস নেই। মাথায় চুল নাই। পায়ে জোর নাই। অতীতে তার আনন্দ ছিল না, বর্তমান সম্পর্কে তার সচেতনতা নাই এবং ভবিষ্যতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না সে।”

দেশে তখন প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ চলছিল। হাজার হাজার মানুষ তখন খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছিল। মেক্সিকোর “একসেলসিয়র” পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবকে যখন প্রশ্ন করা হল, খাদ্যশস্যের অভাবের ফলে দেশে মৃত্যুর হার ভয়াবহ হতে পারে কিনা,শেখ মুজিব জবাব দিলেন,

“এমন কোন আশংকা নেই।”
প্রশ্ন করা হল, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্টে বিরোধীদল বলেন যে, ইতিমধ্যেই ১৫ হাজার মানুষ মারা গেছে।”
তিনি জবাব দিলেন, “তারা মিথ্যা বলেন।”
তাঁকে বলা হল,“ঢাকার বিদেশি মহল মৃত্যু সংখ্যা আরও বেশী বলে উল্লেখ করেন।” শেখ মুজিব জবাব দিলেন,
“তারা মিথ্যা বলেন।”
প্রশ্ন করা হল, দূর্নীতির কথা কি সত্য নয়? ভূখাদের জন্য প্রেরিত খাদ্য কি কালোবাজারে বিক্রী হয় না..?
শেখ বললেন, “না। এর কোনটাই সত্য নয়।”(এন্টার প্রাইজ,রিভার সাইড,ক্যালিফোর্নিয়া, ২৯/০১/৭৫)

বাংলাদেশ যে কতবড় মিথ্যাবাদী ও নিষ্ঠুর ব্যক্তির কবলে পড়েছিল এ হল তার নমুনা। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে,সে দুর্ভিক্ষে হাজার মানুষ মরছে সেটি তিনি মানতে রাজী নন। দেশে কালোবাজারী চলছে, বিদেশ থেকে পাওয়া রিলিফের মাল সীমান্ত পথে ভারতে পাড়ী জমাচ্ছে এবং সীমাহীন দূর্নীতি চলছে সেটি বিশ্ববাসী মানলেও তিনি মানতে চাননি। অবশেষে পত্রিকাটি লিখেছে,

"যে সব সমস্যা তার দেশকে বিপর্যস্ত করত সে সবের কোন জবাব না থাকায় শেখের একমাত্র জবাব হচ্ছে তাঁর নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা বৃদ্ধি। জনসাধারণের জন্য খাদ্য না হোক,তার অহমিকার খোরাক চাই।" (এন্টার প্রাইজ,রিভার সাইড, ক্যালিফোর্নিয়া, ২৯/০১/৭৫)

শেখ মুজিব যখন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন তখন লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফে পীটার গীল লিখেছিলেন,

“বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দেশ থেকে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। গত শনিবার ঢাকার পার্লামেন্টের (মাত্র) এক ঘন্টা স্থায়ী অধিবেশনে ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে ক্ষমতা অর্পণ করেছে। অনেকটা নিঃশব্দে গণতন্ত্রের কবর দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদল দাবী করেছিল,এ ধরণের ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য তিন দিন সময় দেওয়া উচিত। জবাবে সরকার এক প্রস্তাব পাশ করলেন যে,এ ব্যাপারের কোন বিতর্ক চলবে না। .. শেখ মুজিব এম.পি.দের বললেন, পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র ছিল “ঔপনিবেশিক শাসনের অবদান”। তিনি দেশের স্বাধীন আদালতকে “ঔপনিবেশিক ও দ্রুত বিচার ব্যহতকারী” বলে অভিযুক্ত করলেন।”

অথচ পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব ও তাঁর আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পদ্ধতির গণতন্ত্রের জন্য কতই না চিৎকার করেছেন। তখন পাকিস্তানে আইউবের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গনতন্ত্রই তো ছিল। গণতন্ত্রের নামে আওয়ামী লীগের পতাকা তলে যে কতটা মেরুদন্ডহীন ও নীতিহীন মানুষের ভীড় জমেছিল সেটিও সেদিন প্রমাণিত হয়েছিল। এত দিন যারা গণতন্ত্রের জন্য মাঠঘাট প্রকম্পিত করত তারা সেদিন একদলীয় স্বৈরাচারি শাসন প্রবর্তনের কোন রূপ বিরোধীতাই করল না। বরং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এতবড় গুরুতর বিষয়ে যখন সামান্য তিন দিনের আলোচনার দাবী উঠল তখন সেটিরও তারা বিরোধীতা করল। সামান্য এক ঘন্টার মধ্যে এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিল। অথচ গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে এক টাকা ট্যাক্স বৃদ্ধি হলে সে প্রসঙ্গেও বহু ঘন্টা আলোচনা হয়। ভেড়ার পালের সব ভেড়া যেমন দল বেঁধে এবং কোন রুপ বিচার বিবেচনা না করে প্রথম ভেড়াটির অনুসরণ করে তারাও সেদিন তাই করেছিল। আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রের দাবী যে কতটা মেকী,সেটির প্রমাণ তারা এভাবেই সেদিন দিয়েছিল। দলটির নেতাকর্মীরা সেদিন দলে দলে বাকশালে যোগ দিয়েছিল,এরকম একদলীয় স্বৈরচারি শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের বিবেকে সামান্যতম দংশনও হয়নি।

১৯৭৪ সালে ১৮ অক্টোবর বোষ্টনের ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে ডানিয়েল সাদারল্যান্ড লিখেছিলেন,

“গত দুই মাসে যে ক্ষুধার্ত জনতা স্রোতের মত ঢাকায় প্রবেশ করেছে,তাদের মধ্যে সরকারের সমর্থক একজনও নেই। বন্যা আর খাদ্যাভাবের জন্য গ্রামাঞ্চল ছেড়ে এরা ক্রমেই রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার এদেরকে রাজপথের ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে না দিতে বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যককে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সারাদিন দুই এক টুকরা রুটি খেতে পাওয়া যায, মাঝে মাঝে দুই-একটা পিঁয়াজ ও একটু-আধটু দুধ মেলে। ক্যাম্পে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। “যে দেশে মানুষকে এমন খাঁচাবদ্ধ করে রাখা হয় সেটা কি ধরনের স্বাধীন দেশ”- ক্রোধের সাথে বলল ক্যাম্পবাসীদেরই একজন। ক্যাম্পের ব্লাকবোর্ডে খড়িমাটি দিয়ে জনৈক কর্মকর্তা আমার সুবিধার্থে প্রত্যেকের রুটি খাওয়ার সময়সূচীর তালিকা লিখে রেখেছেন। “তালিকায় বিশ্বাস করবেন না”-ক্যাম্পের অনেকেই বলল। তারা অভিযোগ করল যে, রোজ তারা এক বেলা খেতে পায়- এক কি দুই টুকরা রুটি। কোন এক ক্যাম্পের জনৈক স্বেচ্ছাসেবক রিলিফকর্মী জানাল যে, “সরকারী কর্মচারীরা জনসাধারণের কোন তোয়াক্কা করে না। তারা বাইরের জগতে সরকারের মান বজায় রাখতে ব্যস্ত। এ কারণেই তারা লোকদেরকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাচেছ। বিদেশিরা ভূখা-জনতাকে রাস্তায় দেখুক এটা তারা চায় না।”

১৯৭৪ সালে ৩০ অক্টোবর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় পিটার প্রেসটন লিখেছিলেন,

“এই সেদিনের একটি ছবি বাংলাদেশের দৃশ্যপট তুলে ধরেছে। এক যুবতি মা -তার স্তন শুকিয়ে হাঁড়ে গিয়ে লেগেছে,ক্ষুধায় চোখ জ্বলছে - অনড় হয়ে পড়ে আছে ঢাকার কোন একটি শেডের নীচে,কচি মেয়েটি তার দেহের উপর বসে আছে গভীর নৈরাশ্যে। দু’জনাই মৃত্যুর পথযাত্রী। ছবিটি নতুন,কিন্তু চিরন্তন। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা দুনিয়ার সবচেয়ে -কলিকাতার চেয়েও -বীভৎস শহরে পরিণত হয়েছে। সমস্ত বীভৎসতা সত্ত্বেও কোলকাতায় ভীড় করা মানুষের যেন প্রাণ আছে, ঢাকায় তার কিছুই নাই। ঢাকা নগরী যেন একটি বিরাট শরাণার্থী-ক্যাম্প। একটি প্রাদেশিক শহর ঢাকা লাখ লাখ জীর্ণ কুটীর, নির্জীব মানুষ আর লঙ্গরখানায় মানুষের সারিতে ছেয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে যখন খাদ্যাভাব দেখা দেয়, ভূখা মানুষ ঢাকার দিকে ছুটে আসে। ঢাকায় তাদের জন্য খাদ্য নেই। তারা খাদ্যের জন্য হাতড়ে বেড়ায়, অবশেষে মিলিয়ে যায়। গেল সপ্তাহে একটি মহলের মতে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই মাসে ৫০০ লোক অনাহারে মারা যাচ্ছে। এর বেশীও হতে পারে, কমও হতে পারে। নিশ্চিত করে বলার মত প্রশাসনিক যন্ত্র নাই।.. জন্মের পর পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সাহায্যের এক অভূতপূর্ব ফসল কুড়িয়েছিলঃ ৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড। আজ সবই ফুরিয়ে গেছে। কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। রাজনীতিবিদ, পর্যবেক্ষক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান -সবাই একই যুক্তি পেশ করছে যা অপরাধকে নিরাপদ করছে, দায়িত্বকে করছে অকেজো। তাদের মোদ্দা যুক্তি হল এই যে, বাংলাদেশের ঝুলিতে মারাত্মক ফুটো আছে। যত সাহায্য দেওয়া হোক না কেন, দূর্নীতি, আলসেমী ও সরকারী আমলাদের আত্মঅহমিকার ফলে অপচয়ে ফুরিয়ে যাবে। বেশী দেওয়া মানেই বেশী লোকসান।”

পাত্রের তলায় ফুটো থাকলে পাত্রের মালামাল বেড়িয়ে যায়,তবে তা বেশী দূর যায় না। আশে পাশের জায়গায় গিয়ে পড়ে। তেমনি বাংলাদেশের তলা দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া সম্পদ হাজার মাইল দূরের কোন দেশে গিয়ে উঠেনি,উঠেছিল প্রতিবেশী ভারতে। আর এ ফুটোগুলো গড়ায় ভারতীয় পরিকল্পনার কথা কি অস্বীকার করা যায়? পাকিস্তান আমলে ২৩ বছরে পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ ছিল, সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারী বন্ধ করা। এ কাজে প্রয়োজনে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বসানো হত। অথচ শেখ মুজিব সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারি বন্ধ না করে ভারতের সাথে চুক্তি করে সীমান্ত জুড়ে বাণিজ্য শুরু করেন। এভাবে সীমান্ত বাণিজ্যের নামে দেশের তলায় শুধু ফুটো নয়, সে তলাটিই ধ্বসিয়ে দিলেন। তলা দিয়ে হারিয়ে যাওয়া সম্পদ তখন ভারতে গিয়ে উঠল। ভারত বস্তুতঃ তেমন একটি লক্ষ্য হাছিলের কথা ভেবেই সীমান্ত বাণিজ্যের প্রস্তাব করেছিল। অথচ পাকিস্তান আমলে ভারত এ সুবিধার কথা ভাবতেই পারেনি। অথচ মুজিব সেটাই বিনা দ্বিধায় ভারতের হাতে তুলে দিলেন। বাংলাদেশের বাজারে তখন আর রাতের আঁধারে চোরাচলানকারী পাঠানোর প্রয়োজন পড়েনি। দিনদুপুরে ট্রাক-ভর্তি করে বাংলাদেশের বাজার থেকে সম্পদ তুলে নিয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা তখন পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত কলকারখানার যন্ত্রাংশ খুলে নামে মাত্র মূল্যে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়। তলাহীন পাত্র থেকে পানি বেরুতে সময় লাগে না, তেমনি দেশের তলা ধ্বসে গেলে সময় লাগে না সে দেশকে সম্পদহীন হতে। ভারতের সাথে সীমান্ত বাণিজ্যের দাড়িয়েছিল,ত্বরিৎ বেগে দূর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল বাংলাদেশে।

প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানী ফালাচীর সাথে শেখ মুজিবের সাক্ষাতকারটি ছিল ঐতিহাসিক। শেখ মুজিবের চরিত্র, আত্ম-অহংকার, যোগ্যতা ও মানবতার মান বুঝবার জন্য আর কোন গবেষণার প্রয়োজন নেই, সে জন্য এই একটি মাত্র সাক্ষাতকারই যথেষ্ট। এখানে সে বিখ্যাত সাক্ষাতাকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হলঃ

রোববার সন্ধাঃ আমি কোলকাতা হয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করেছি। সত্যি বলতে কি, ১৮ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী তাদের বেয়োনেট দিয়ে যে যজ্ঞ চালিয়েছে তা প্রত্যক্ষ করার পর এ পৃথিবীতে আমার অন্তিম ইচ্ছা ছিল যে, এই ঘৃণ্য নগরীতে আমি আর পা রাখবো না- এ রকম সিদ্ধান্ত আমি নিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার সম্পাদকের ইচ্ছা যে, আমি মুজিবের সাক্ষাতকার গ্রহণ করি। (এখানে তিনি এক বীভৎস বর্বর ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করছেন। সেটি হলঃ ঢাকা স্টেডিয়াম কাদের সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে কিছু হাতপা বাধা রাজকারকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। আন্তর্জাতিক আইনে কোন বন্দীকে হত্যা করা গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। আর সেটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রকাশ্যে,ঢাকা স্টেডিয়াম হাজার হাজার মানুষের সামনে। এবং যে ব্যক্তিটি এ নৃশংস যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত তাকে জাতীয় বীর হিসাবে মুজিব সরকার স্বীকৃতি দেয়। হত্যারত কাদের সিদ্দিকীর ছবি বিদেশি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে, কিন্তু মুজিব তাকে ছাড়িয়ে নেন।)

আমার স্মরণ হল, ১৮ই ডিসেম্বর যখন আমি ঢাকায় ছিলাম,তখন লোকজন বলছিল,“মুজিব থাকলে সেই নির্মম,ভয়ংকর ঘটনা কখনোই ঘটতো না”। কিন্তু গতকাল (মুজিবের বাংলাদেশে ফিরে আসার পর) মুক্তিবাহিনী কেন আরো ৫০ জন নিরীহ বিহারীকে হত্যা করেছে?..আমি বিস্মিত হয়েছি যে, এই ব্যক্তিটি ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে সাংবাদিক অ্যালডো শানতিনিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমার দেশে আমি সবচেয়ে সাহসী্ এবং নির্ভীক মানুষ, আমি বাংলার বাঘ, দিকপাল।..এখানে যুক্তির স্থান নেই।..আমি বুঝতে পারিনি আমার কি ভাবা উচিত।

সোমবার সন্ধাঃ ..তার মানসিক যোগ্যতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল।..তার ভারসাম্যহীনতাকে আমি আর কোন ভাবেই ব্যাখা করতে পারি না।..আমি যত তাকে পর্যবেক্ষণ করেছি, তত মনে হয়েছে তিনি কিছু একটা লুকাচ্ছেন। এমন কি তার মধ্যে যে সার্বক্ষণিক আক্রমণাত্মক ভাব, সেটাকে আমার মনে হয়েছে আত্মরক্ষার কৌশল বলে। ঠিক চারটায় আমি সেখানে ছিলাম। ভাইস সেক্রেটারী আমাকে করিডোরে বসতে বললেন, যেখানে কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোকে ঠাসাঠাসি ছিল। তিনি অফিসে প্রবেশ করে মুজিবকে আমার উপস্থিতি সম্পর্কে জানালেন।আমি একটা ভয়ংকর গর্জন শুনলাম এবং নিরীহ লোকটি কম্পিতভাবে পুনরায় আবির্ভূত হয়ে আমাকে প্রতীক্ষা করতে বললেন। আমি প্রতীক্ষা করলাম-এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, তিন ঘন্টা, চার ঘন্টা –রাত আটটা যখন বাজলো তখনো আমি সেই অপিসর করিডোরে অপেক্ষামান। রাত সাড়ে আটটায় আমাকে প্রবেশ করতে বলা হল।আমি বিশাল এক কক্ষে প্রবেশ করলাম। একটি সোফা ও দুটো চেয়ার সে কক্ষে। মুজিব সোফার পুরোটায় নিজেকে বিস্তার করেছেন এবং দুইজন মোটা মন্ত্রী চেয়ার দু'টো দখল করে বসে আছেন। কেউ দাঁড়ালো না। কেই আমাকে অভ্যার্থনা জানালো না। কেউ আমার উপস্থিতিকে গ্রাহ্য করলো না। মুজিব আমাকে বসতে বলার সৌজন্য প্রদর্শন না করা পর্যন্ত সুদীর্ঘক্ষণ নীরবতা বিরাজ করছিল। আমি সোফার ক্ষুদ্র প্রান্তে বসে টেপ রেকর্ডার খুলে প্রথম প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু আমার সে সময়ও ছিল না। মুজিব চিৎকার শুরু করে দিলেন,

“হ্যারি আপ, কুইক, আন্ডারষ্টান্ড? ওয়েষ্ট করার মত সময় আমার নাই। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?..পাকিস্তানীরা ত্রিশ লক্ষ লোক হত্যা করেছে, ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?

আমি বললাম,

মি. প্রাইম মিনিস্টার..। “মি. প্রাইম মিনিস্টার, গ্রেফতারের সময় কি আপনার উপর নির্যাতন করা হয়েছিল?”

“ম্যাডাম নো। তারা জানতো,ওতে কিছূ হবে না। তারা আমার বৈশিষ্ট্য,আমার শক্তি,আমার সম্মান,আমার মূল্য, বীরত্ব সম্পর্কে জানতো, আন্ডারস্টান্ড?”

“তা বুঝলাম। কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন যে তারা আপনাকে ফাঁসীতে ঝুলাবে? ফাঁসীতে ঝুঁলিয়ে কি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়?”

“নো নো ডেথ সেন্টেন্স?” এই পর্যায়ে তাকে দ্বিদাগ্রস্ত মনে হল। এবং তিনি গল্প শুরু করলেন,

“আমি এটা জানতাম। কারণ ১৫ই ডিসেম্বর ওরা আমাকে কবর দেওয়ার জন্য একটা গর্ত খনন করে”।

“কোথায় খনন করা হয়েছিল সেটা?”

“আমার সেলের ভিতর।”

“আপনার প্রতি কেমন আচরণ করা হয়েছে মি. প্রাইম মিনিস্টার?”

“আমাকে একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছিল। এমনকি আমাকে সাক্ষাৎকারের অনুমতি দেয়া হতো না। সংবাদপত্র পাঠ করতে বা চিঠিপত্রও দেয়া হতো না, আন্ডারস্টান্ড?”

“তাহলে আপনি কি করেছেন?”

“আমি অনেক চিন্তা করেছি।”

“আপনি কি পড়েছেন?”

“বই ও অন্যান্য জিনিস।”

“তাহলে আপনি কিছু পড়েছেন।”

“হ্যা কিছু পড়েছি।”

“কিন্তু আমার ধারণা হয়েছিল,আপনাকে কিছুই পড়তে দেয়া হয়নি। ”

“ইউ মিস আন্ডারস্টুড।”

“..কি হলো যে শেষ পর্যন্ত ওরা আপনাকে ফাঁসীতে ঝুলানো না।”

“জেলার আমাকে সেল থেকে পলাতে সহায়তা করেছেন এবং তার বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছেন।”

“কেন, তিনি কি কোন নির্দেশ পেয়েছিলেন?

“আমি জানি না। এ ব্যাপারে তার সাথে আমি কোন কথা বলিনি এবং তিনিও আমার সাথে কথা কিছু বলেননি।”

“নীরবতা সত্ত্বেও কি আপনারা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন।”

‘হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, আমাকে সাহায্য করতে চান।”

“তাহলে আপনি তার সাথে কথা বলেছেন।”

“হ্যাঁ, আমি তার সাথে কথা বলেছি।”

“আমি ভেবেছিলাম, আপনি কারোই সাথে কথা বলেননি।”

“ইউ মিস আন্ডারস্টুড।”

.. এরপর ১৮ই ডিসেম্বর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি রাগে ফেটে পড়েন। নিচের অংশটি আমার টেপ থেকে নেয়া।

“ম্যাসাকার? হোয়াট ম্যাসাকার?”

“ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাটি?”

“ঢাকা স্টেডিয়ামে কোন ম্যাসাকার হয়নি। তুমি মিথ্যে বলছ।”

“মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি মিথ্যাবাদী নই। সেখানে আরো সাংবাদিক ও পনের হাজার লোকের সাথে আমি হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছি। আমি চাইলে আমি আপনাকে তার ছবিও দেখাবো। আমার পত্রিকায় সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।”

“মিথ্যাবাদী,ওরা মুক্তিবাহিনী নয়।”

“মি. প্রাইম মিনিস্টার,দয়া করে মিথ্যাবাদী শব্দটি আর উচ্চারণ করবেন না। তারা মুক্তিবাহিনী। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আব্দুল কাদের সিদ্দিকী এবং তারা ইউনিফর্ম পরা ছিল।”

“তাহলে হয়তো ওরা রাজাকার ছিল যারা প্রতিরোধের বিরোধীতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল করতে বাধ্য হয়েছে।”

“মি. প্রাইম মিনিস্টার, ..কেউই প্রতিরোধের বিরোধীতা করেনি। তারা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। হাত পা বাঁধা থাকায় তারা নড়াচড়াও করতে পারছিল না।”

“মিথ্যেবাদী।”

“শেষ বারের মতো বলছি, আমাকে মিথ্যেবাদী বলার অনুমতি আপনাকে দেবো না।” (ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরী, ওরিয়ানী ফালাসী অনুবাদে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু)

এই হল মুজিবের আসল চরিত্র। ঢাকা স্টেডিয়ামে হাতপা বাঁধা রাজাকারদের কাদের সিদ্দীকী ও তার সাথীরা হত্যা করল, বিদেশী পত্রিকায় সে খবর ছাপা হল, বহু সাংবাদিকসহ বহু হাজার বাংলাদেশী সেটি দেখল, অথচ শেখ মুজিব সেটি বিশ্বাসই করতে চান না। এতবড় যুদ্ধাপরাধের ন্যায় সত্য ঘটনাকে তিনি মিথ্যা বলেছেন। অপর দিকে যে পাকিস্তান সরকার তার গায়ে একটি আঁচড়ও না দিয়ে জেল থেকে ছেড়ে দিল তাদের বিরুদ্ধে বলছেন, তাকে নাকি তারা হত্যা ও হত্যা শেষে দাফন করার জন্য তারই জেলের প্রকোষ্টে একটি কবর খোদাই করেছিল! অথচ তার কোন প্রমাণই নেই। কিন্তু সমস্যা হল, সাধারণ বাংলাদেশীদের জন্য ইতিহাসের এ সত্য বিষয়গুলো জানার কোন পথ খোলা রাখা হয়নি। ইতিহাসের বই থেকে এসব সত্যগুলোকে পরিকল্পিত ভাবে লুকানো হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না। যে কোন ফসলের ক্ষেতে গাছের পাশে বহু আগাছাও থাকে। জীবনটা সুখের করতে হলে কোনটি গাছ আর কোনটি আগাছা এটি জানা জরুরী। নইলে আগাছার বদলে ফসলের গাছকে আবর্জনার স্তুপে যেতে হয়। আর তখন পানি ও সার গিয়ে পড়ে আগাছার গোড়ায়। যে কোন জাতির জীবনে শুধু মহৎ মানুষই জন্ম নেয় না। চরিত্রহীন দুর্বৃত্তরাও জন্মায়। শিক্ষক ও পাঠ্য বইয়ের কাজ হল,মহৎ মানুষের পাশাপাশী দুর্বৃত্তদের চিত্রগুলোও তুলে ধরা। এটি না হলে ফিরাউন, নমরুদ, আবু জেহলের মত দুর্বৃত্তরা বীরের মর্যাদা পায়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হয়নি। হয়নি বলেই কে সৎ আর কে দুর্বৃত্ত সেটি চিনতেই ভূল করে। সবচেয়ে বেশী ভূল করে তারা যারা এ শিক্ষা ব্যবস্থায় জীবনের দশ-বিশটি বছর কাটায়। এজন্যই বাংলাদেশে যখন একমাত্র দল বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হল তখন এ সব শিক্ষিতরা দল বেধে লাইন ধরেছিল। বাকশালে যোগদানের সে মিছিলে শামিল হয়েছে বিপুল সংখ্যক পুরোন রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রবীণ সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধে যে তারা কত নিম্ন মানের ছিলেন সেদিন সে প্রমাণও তারা রেখেছিলেন। এমন চেতনার ধারকেরা দেশের আইন-আদালতকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে গণ-আদালত বসিয়েছিল। বাংলাদেশে দুর্বৃত্তরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়, নেতা হয়, মন্ত্রী হয় এমনকি প্রেসিডেন্টও হয়-মূলতঃ এমন চেতনার মানুষদের কারেণেই। এদের কারণেই দেশ দূর্নীতিতে বিশ্বে বার বার প্রথম হওয়ার কলংক অর্জন করে। জাতীয় জীবনে এ এক চরম ব্যর্থতা। বিদেশ থেকে শত শত কোটি লোন নিয়ে কলকারখানা ও রাস্তাঘাট নির্মান করে কি জাতি এ ব্যর্থতার কলংক থেকে মূক্তি পায়? আসে কি অর্থনৈতিক উন্নয়ন? বরং যা বাড়ে তা হল লোনের দায়ভার। এবং বাড়ে ব্যর্থতার কলংক। বাংলাদেশে এ দুটিই সমানে বেড়েছে। এ ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থা ভারি হয় দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক দল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন পরিণত হয় তাদের রিক্রটমেন্ট ক্ষেত্রে। এখান থেকেই তারা পায় দলীয় ক্যডার।

যে মহল্লায় দুর্বৃত্ত মানুষের সংখ্যা বেশী সে গ্রামে সহজেই ডাকাত দল গড়ে উঠে। বাংলাদেশে একই কারণে প্রবলভাবে শক্তিশালী হয়েছে দুর্বৃত্ত নেতাদের রাজনৈতিক দল। জমিতে ফসলের আবাদ না হলে সে জমিতে যা বেড়ে উঠে তা হল আগাছা। তেমনি সত্যের প্রচার না হলে প্রতিষ্ঠা পায় মিথ্যা ও দুর্বৃত্তি। অথচ মুজিবামলে বাংলাদেশে সত্যের প্রচার গায়ের জোর বন্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সকল বিরোধী মতের পত্রিকা। ফলে বাজার পেয়েছিল মিথ্যা-প্রচার। এরা এ প্রচারও বাজারে ছেড়েছে যে,শেখ মুজিবই হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বাঙালী। কথা হল,সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালীটি যদি এরূপ মিথ্যাচারি ও স্বৈরাচারি হয় তবে সাধারণ বাঙালীদের জন্য মর্যাদাকর কোন গুণ অবশিষ্ঠ থাকে কি? আবর্জনার স্তুপ মাথায় চাপিয়ে রাস্তায় নামা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এমন নির্বুদ্ধিতায় ইজ্জত বাড়ে না। বুদ্ধিমানেরা সেগুলিকে আবর্জনার স্তুপে ফেলে পথ চলে। অথচ বাংলাদেশে সেগুলোকে অনেকে মাথায় তুলেছে। বিষয়টি ঘটেছে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে। স্বৈরাচারি, বিদেশি চর ও মিথ্যবাদী রাজনীতিবিদদের কোন জাতিই মাথায় তুলে না। কারণ এতে বিশ্ব মাঝে শুধু অসম্মান বাড়ে। অথচ বাংলাদেশ তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়েছে। বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা নিছক এ নয় যে তারা আবিস্কারক বা নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক তৈরীতে ব্যর্থ হয়েছে,বরং সবচেয়ে ব্যর্থতা হল বীর ও দুর্বৃত্তের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়েই ব্যর্থ হয়েছে। দুর্বৃত্তরা এজন্যই জনগণের ভোটে বার বার এমপি হয়,মন্ত্রী হয় এবং নেতা হয়। একই ব্যর্থতার কারণে মাথায় উঠেছে শেখ মুজিব ও তার অনুসারিরা। তাকে জাতির পিতা বানানোর আব্দার উঠেছে। কথা হল, যে ব্যক্তিটি গণতন্ত্র-হত্যা করলেন, হরণ করলেন ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ভারতের বেদীমূলে বিসর্জন দিলেন বাংলাদেশের বেরুবারী, দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে মৃত্যু ঘটালেন বহুলক্ষ মানুষের,আন্তুর্জাতিক মহলে দেশকে পরিচিত করলেন “ভিক্ষার ঝুলি” রূপে এবং মিথ্যা কথা ও মিথ্যা ওয়াদাকে যিনি নিজ চরিত্রের অলংকারে পরিণত করলেন, সর্বপরি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটির ধ্বংসে যিনি এক রক্তক্ষয়ী ও ভাতৃঘাতি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করলেন এবং চিহ্নিত শত্রুশক্তি ভারতকে মুসলিম ভূমিতে ডেকে আনলেন -তাকে জাতির পিতা রূপে মাথায় তুললে কি বিশ্বমাঝে ইজ্জত বাড়ে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মই বা কি বলবে?

সূত্র :
Www.thestoryofbangladesh.com 

Sunday 13 November 2016

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥

আমি সাম্প্রদায়িকতা ও সংখ্যালঘু নামক বিভাজন মূলক শব্দে বিশ্বাসী নয়, সাঁওতালরা  আমার ভাই

মুহাম্মদ নূরে আলম ।
লেখক লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি বিখ্যাত গানের দুটি লাইন দিয়ে এই লেখা শুরু করছি। "বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥ বাংলার ঘর, বাংলার হাট,   বাংলার বন, বাংলার মাঠ--পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান"॥ যে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেছে তার পরিচয় তিনি বাংলাদেশী। কোনো বিভাজন মূলক শব্দ চয়ন করে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবেনা । কারণ বাংলা আলো বাতাস পানি মাটি সবাই সমান ভাবে ভোগ করার অধিকার রয়েছে । সবাই এই শ্যামল সুন্দর সবুজ বাংলা মায়ের সন্তান । যেখানে বাংলা মা তার সন্তানদের মাটি বাতাস পানি বন্টনে বিভাজন করছে না সেখানে আপনি কে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা বলে সমাজে ধর্ম ও বর্ণ বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছেন !?? যারা এইসব করছে তারা পরিস্কার ভাষায় দুর্বৃত্ত এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্টু ।  এবার বলি সাঁওতালদের পরিচয় ।

সাঁওতাল:
সাঁওতাল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী। তাদের বাসস্থান মূলত রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায়। প্রধান নিবাস রাঢ়বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার অরণ্য অঞ্চল এবং ছোটনাগপুর; পরে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সাঁওতাল পরগনায়। তবে ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে পাবনা, যশোর, খুলনা, এমনকি চট্টগ্রাম জেলায়ও অল্প সংখ্যায় সাঁওতালদের বসতি ছিল। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সাঁওতাল জনসংখ্যা দুই লক্ষের বেশি। ২০০১ সালের জরিপে এদের মোট সংখ্যা জানা যায় নি। সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড) জনগোষ্ঠীর বংশধর। এদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও কোনো বর্ণমালা নেই এবং ধর্ম থাকলেও কোনো ধর্ম গ্রন্হ নেই। সাঁওতাল সমাজ চলে কিছু সামাজিক প্রথার মাধ্যমে। সাঁওতালরা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কৃষিসংস্কৃতির জনক ও ধারক হিসেবে স্বীকৃত।সাঁওতালদের প্রধান উপাস্য যদিও সূর্য (তাদের ভাষায় সিং বোঙ্গা) তবু পর্বত দেবতাও (মারাং বুরু) তাদের জন্য যথেষ্ট মর্যাদাব্যঞ্জক হয়ে গ্রামদেবতায় পরিণত হয়েছে। সাঁওতালদের বিশ্বাস আত্মা অমর এবং সেই অনৈসর্গিক আত্মাই (বোঙ্গা) সব ঐহিক ভালমন্দ নির্ধারণ করে থাকে।  সাঁওতাল নর-নারী আসলে ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে সর্বপ্রাণবাদী ও প্রকৃতি উপাসক, আবার তারা ‘ঠাকুরজিউ’-কে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মান্য করে। তাদের ধর্মাচরণে মূর্তিপূজার প্রচলন নেই।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। ইংরেজ আমলে স্থানীয় উচ্চ বর্ণের হিন্দু ব্রাহ্মণ জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী  সশস্ত্র গণসংগ্রাম। তাদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সিধু, কানু, চাঁদ প্রমুখ। প্রতিরোধ সংগ্রাম সত্ত্বেও জোতদার-মহাজনদের শাসন-শোষণ থেকে সাঁওতাল সমাজ মুক্ত হতে পারে নি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল অবধি বাংলাদেশে তেভাগা আন্দোলনে সাঁওতালদের ব্যাপক অংশগ্রহণের কথা এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। ১৮৫২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের ফলে তাদের উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা সোচ্চার হয়েছিল।

সম্প্রতি সাঁওতালদের দেড় হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধায় নৃ-গোষ্ঠী সাঁওতালদের দেড় হাজারের মতো বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের প্রতিবাদে কয়েকশ সাঁওতাল কয়েকদিন আগে দিনাজপুরে বিক্ষোভ করেছে। সাঁওতালদের অভিযোগ, গাইবান্ধার একটি চিনিকল এলাকা থেকে তাদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং এ সময় পুলিশের গুলিতে দু'জন নিহত হয়েছে।স্থানীয় সাঁওতালরা দাবী করছে, পুলিশের উপস্থিতিতে তাদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালানো হয়েছে। এসব বাড়ি-ঘর ছন, খড়ি, খড় এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি। ১৯৫৬ গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ চিনি কলের জন্য প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। সেখানে তখন ২০টি গ্রামের মধ্যে ১৫টিতে সাঁওতালদের বসবাস ছিল। বাকি পাঁচটি গ্রামে বাঙালীদের বসবাস ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে গেলে সাঁওতালরা সে জমিতে আবারো ফেরত আসার চেষ্টা করে।

১৯৫৬ সালের জমি অধিগ্রহণের কাগজ-পত্র দেখেছেন দিনাজপুরের আইনজীবি মাইকেল মালো। তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণের চুক্তিতে কিছু শর্ত অন্তর্ভূক্ত ছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, অধিগ্রহণ করা জমিতে আখ চাষ ছাড়া অন্য কোন কিছু করা যাবেনা । যদি এখানে আখ চাষ ব্যতীত অন্য কিছু করা হয় তাহলে সে জমি পূর্বের অবস্থায় ফেরত নেবার শর্ত অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে উল্লেখ করছেন মাইকেল মালো। সে যুক্তির ভিত্তিতেই সাঁওতালরা তাদের পূর্ব-পুরুষের জমিতে ফিরে আসার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসের দিকে তারা সেখানে বসতি গড়ে তোলে। জানা গেছে, যে জমি নিয়ে সংঘর্ষের শুরু, সেখানে আখের খামার তৈরির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই। চুক্তির ৪ নং শর্তে বলা হয়, যে উদ্দেশ্যে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ সম্পত্তি ব্যবহার করা যাবে না।

সাঁওতালদের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলছেন, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগের পর সাঁওতাল পরিবারগুলো এখন দুর্ভোগে আছে।
কতগুলো বাড়িতে ভাংচুর এবং অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে সেটি নিয়ে প্রশাসন এবং সাঁওতালদের মাঝে পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য রয়েছে। সাঁওতালরা যদিও বলছে প্রায় দেড় হাজার কিন্তু প্রশাসন বলছে এ সংখ্যা কয়েক'শ। সংঘর্ষের সূত্রপাত কেন হয়েছিল সেটি নিয়েও রয়েছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। পুলিশ বলছে, সাঁওতালরা আখ কাটতে বাধা দিয়ে পুলিশের উপর তীর-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করেছে। অন্যদিকে সাঁওতালরা বলছে, সে জমি থেকে তাদের উচ্ছেদের জন্য প্রশাসন অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে। সূত্র : বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার খবর ।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে বিভিন্ন মহলের রাজনীতির স্বার্থ কাজ করে। ব্রিটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। যার পরিণতিতে সংঘটিত হয়েছিল কতিপয় রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভারতের উগ্র হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী  শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে জনগণের আন্দোলন বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছিল একাধিকবার। আর ভোটের রাজনীতিতে বারবার পাল্লা ভারি হয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির। যে কারণে ভারতে আজ পর্যন্ত ১৭ হাজার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে । স্বৈরাচারী এরশাদকে আমরা এমন কৌশল নিতে দেখেছি। ‘৮৯ ও ‘৯০ সালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে সরকারের মদদ ছিল।

এমন ঘৃণ্য পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আর বর্তমান সরকারও এখন সেই পথেই হাঁটছে!? ব্রিটিশ আমলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত মুসলিম লীগ,  আওয়ামী মুসলিম লীগ, ন্যাপসহ প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীরা। আজ সেই প্রতিরোধ শক্তি দেখছি না। বাম সংগঠনগুলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে অগ্রণী থাকত। তারা এখন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। শুধুমাত্র হিন্দুদের বিষয় হলে দাদাজি থেকে হালুয়া রুটি পাওয়ার আশা কিছু সভা সমাবেশ করে। যে কারণে সাঁওতালরা হিন্দু নয় বলে তাদের উপরে আওয়ামী সরকারের বর্বর নির্মম হামলার পর কেউ কিছুই বলছে না।

 আওয়ামী লীগের কর্মীরা দোদুল্যমান। কারণ বাংলাদেশে এরাই বেশি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছে হিন্দুদের নিয়ে এবং এরাই বেশি নির্যাতন অত্যাচার করেছে হিন্দুদের ।  তারা ভোটের রাজনীতির কারণে মুসলিম সেন্টিমেন্ট ধারণ করতে গিয়ে কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় শরিক হচ্ছে, কখনও সংখ্যালঘু ভোটের কথা চিন্তা করে দূরে থাকছে। কিন্তু প্রতিরোধ করছে না। আওয়ামী লীগের এই দ্বৈতনীতির সমালোচনা শুনেছি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতার মুখে। তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের নিয়ে দুই রকম হিসাব করে। দেশে থাকলে ভোট পাবে, আর তারা দেশছাড়া হলে ভোট কমবে, কিন্তু জমি মিলবে।’ একদিকে তারা পুলিশ-প্রশাসনের ওপর হামলা করছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হচ্ছে।

রাজনৈতিক দল ক্ষমতাভিমুখী হবে তা নিয়ে কথা নেই। কিন্তু সেই ক্ষমতা দখল হবে জনকল্যাণে_ জনস্বার্থ বিলিয়ে দিয়ে নয়, আদর্শের বিনিময়ে নয়। কেউ সংখ্যালঘুদের অধিকার পদদলিত করে কিংবা কেউ এ ব্যাপারে নিস্পৃহ থেকে ক্ষমতার খেলা খেলবে_ তা সমর্থন করা যায় না। একাত্তরে কেবল বাঙালি মুসলমান কিংবা বাংলাদেশি মুসলমানের দেশ কায়েমের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সব ধর্মের সব জাতির সব মানুষের সমঅধিকারের বাংলাদেশের জন্য। এখানে সব ধর্মের সব জাতির অধিকার রক্ষা করাই হবে সরকারের কাজ, বিরোধী দলের অঙ্গীকার।

বলা আবশ্যক, সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল তৈরি করা যায়, তবে তা স্থায়ী হয় না। ধর্মীয় জিকির তুলে ভারতের শাসকরা শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ইতিহাসের এই শিক্ষা নিয়ে সরকার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে, ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বর্জন করবে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে_ সেটিই আজ প্রত্যাশিত। দেশের স্বাধীনতা, মর্যাদা, উন্নতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষিত ও সুন্দরভাবে বজায় থাকুক এবং সকল কালো মেঘ সরে যাক; দয়াময়ের কাছে এই ফরিয়াদ। শেষ করছি রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই_ বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা--সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান ॥ বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,   বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন--এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান ॥Borshan.du204@gamil.com