আমার কাছে চার্লস ডারউইন
সূফি বরষণ
তুমি যত বড় জ্ঞানীই হও না কেন, ওহীর জ্ঞান না থাকলে তুমি জিরো
Tuesday 7 February 2023
আমার কাছে চার্লস ডারউইন-এবনে গোলাম সামাদ
Saturday 12 March 2022
মুসলমান নামধারী বকধার্মিক ফরহাদ মাজহার মুসলমান সমাজে বিভ্রান্তির বিষ ঢুকাচ্ছে??
মুসলমান নামধারী বকধার্মিক ফরহাদ মাজহার মুসলমান সমাজে বিভ্রান্তির বিষ ঢুকাচ্ছে?
মুসলমান নামধারী বাউল,মারফতী বা নেড়ার পীর-ফকীরদের সাধন পদ্ধতি বৈষ্ণবদের মতোই অশালীন । এ ফকীরের দল বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। যথা আউল, বাউল, কর্তাভজা, সহজিয়া প্রভৃতি। এগুলি হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব ও চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ যাতে করে সাধারণ অজ্ঞ মুসলমানদেরকে বিপথগামী করা যায়।
এদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। মদ্য পান, নারীপুরুষে অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়েরই সাধনপদ্ধতির মধ্যে অনিবার্যরূপে শামিল।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর রচিত মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে এসব বাউলদের সম্পর্কে বলেনঃ
“কোরআন মজিদের বিভিন্ন শব্দ ও মূলতত্বের যে ব্যাখ্যা এই সমস্ত শয়তান নেড়ার ফকীরের দল দিয়াছে, তাহাও অদ্ভুত। ‘হাওজে কাওসার’ বলিতে তারা বেহেশতী সঞ্জীবনী সুধার পরিবর্তে স্ত্রীলোকের রজঃ বা ঋতুশ্রাব বুঝে। যে পূজাপদ্ধতিতে এ ঘৃণ্য ফকীরের দল বীর্য পান করে, তাহার সূচনায় বীজ মে আল্লাহ (মায়াযাল্লাহ, মায়াযাল্লাহ) অর্থাৎ বীর্যে আল্লাহ অবস্থান করেন –এই অর্থে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করে থাকে।
“এই মুসলিম ভিক্ষোপবীজী নেড়ার ফকীর দলের পুরোহিত বা পীরেরা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপিনীদের বস্ত্র হরণের অনুরূপ এক অভিনয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে ।
(মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস-মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ । )
ড. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন,
“ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
বাউলরা ওহী বা ঐশী ভিত্তিক কোন ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থাকে স্বীকার করে না । তারা দেশ জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে কেবল মানুষকে জানতে,মানতে ও শ্রদ্ধা জানাতে চায় । মানুষের ভিতর মনের মানুষকে খুঁজে পেতে চায় ।
শ্রী চৈতন্যকে বৈষ্ণব সমাজ শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে, এমনকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণরূপে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। গোটা হিন্দু সমাজের মধ্যে শ্রীচৈতন্য এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন।
স্যার যদুনাথ সরকার বলেনঃ
“এ এমন এক সময় যখন প্রভু গৌরাংগের প্রতীক স্বরূপ বাংগালীর মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাঁর প্রেম ও ক্ষমার বাণী সমগ্র ভারতকে বিমোহিত করে। বাংগালীর হৃদয়মন সকল বন্ধন ছিন্ন করে রাধাকৃষ্ণের লীলা গীতিকার দ্বারা সম্মোহিত হয়। বৈষ্ণব ধর্মের আবেগ অনুভূতিতে, কাব্যে, গানে, সামাজিক সহনশীলতা এবং ধর্মীয় অনুরাগে মনের উচ্ছ্বাস পরবর্তী দেড় শতাব্দী যাবত অব্যাহত গতিতে চলে। এ হিন্দু রেনেসাঁ এবং হোসেন শাহী বংশ ওতপ্রোত জড়িত। এ যুগে বৈষ্ণব ধর্মের এবং বাংলা সাহিত্যের যে উন্নতি অগ্রততি হয়েছিল তা অনুধাবন করতে গেলে গৌড়ের মুসলমান প্রভুর উদার ও সংস্কৃতি সম্পন্ন শাসনের কথা অবশ্যই মনে পড়ে”।
‘যদুনাথ সরকার, দি হিষ্ট্রী অব বেঙল, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৪৭)
প্রকৃতপক্ষে চৈতণ্যের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য কি ছিল, তা তাঁর নিজের কথায় আমরা সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি। চৈতন্য চরিতামৃত আদি লীলা, ১২০ পৃষ্ঠায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন-
“পাষণ্ডি সংহারিতে মোর এই অবতার।
পাষণ্ডি সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার”।
এখন বুঝা গেল পাষণ্ডি সংহার করাই তাঁর জীবনের আসল লক্ষ্য। ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, মুসলমানগণ বাংলা অধিকার করার সময় বৌদ্ধ মতবাদ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের যে বিপুলসংখ্যক লোক এদেশে বাস করতো, ব্রাহ্মগণ তাদেঁরকে ধর্মের আশ্রয়ে আনতে অস্বীকার করেন। তার ফলে তারা বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশ করতে থাকে। তাহলে এদেশে হিন্দু, বৈষ্ণব সমাজ ও মুসলমান ব্যতীত সে সময়ে আর কোন ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে পাষণ্ডি ছিল কারা যাদের সংহারের জন্যে চৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল?
মওলানা আকরাম খাঁ বলেনঃ
“মনুর মতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অহিন্দু মাত্রই এই পর্যায়ভুক্ত (সরল বাংলা অভিধান)। আভিধানিক সুবল চন্দ্র মিত্র তাঁহার Beng-Eng Dictionary তে পাষন্ডি শব্দের অর্তে বলিতেছেন- “Not conforming himself to the tenets Vedas: Atheistic. Jaina or Buddha. A non-Hindu –বেদ অমান্যকারী, অন্য বর্ণের চিহ্নধারী এবং অহিন্দু –পাষন্ডির এই তিনটি বিশ্লেষণ সর্বত্র প্রতত্ত হইয়াছে”।
এখন পাষন্ডি বলতে যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই বুঝায়, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, সত্য সত্যই কি চৈতন্য পাষন্ডি তথা মুসলমানদেরকে এদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন? আপাতঃদৃষ্টিতে দেখা যায়, চৈতন্যের সমসাময়িক সুলতান হোসেন শাহের পরেও এদেশে কয়েক শতাব্দী পর্যণ্ত মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হোসেন শাহ কর্তৃক চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও বৈষ্ণব সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য সহযোগিতার দ্বারা মুসলমানদের আকীদাহ বিশ্বাসের মধ্যে শির্ক বিদয়াতের যে আবর্জনা জমে উঠেছিল তা-ই পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কারণ হয়।
আজকে ফরহাদ মজহার একটি পোষ্ট দিয়েছেন ফেসবুকে । এর সাথে উপরে উল্লিখিত বক্তব্যের সাযুজ্য দেখুন । ফরহাদ মজহার আমাদের কোথায় নিতে চান?
"এবার ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়ায় ( বা নদিয়ায় ) গৌর পূর্ণিমার সাধুসঙ্গ ও উৎসব হবে। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি যথারীতি ফকির লালন শাহের প্রবর্তিত গৌরপূর্ণিমার তিথি মেনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এবারের বিষয়ঃ 'আপন ঘরের খবর নে না'।
ফকির লালন শাহ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবকে স্মরণীয় রাখার জন্য তাঁর জীবদ্দশায় ফাল্গুনি পূর্ণিমায় যে সাধুসঙ্গ প্রবর্তন করেছেন তার তাৎপর্য দুর্দান্ত।
কৃষ্ণ পুরাণে ভগবান, কিন্তু তিনি মানুষ লীলা করবার জন্য ভবে অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বয়ং ঈশ্বর এরপর থেকে আর পুরাণ, কল্পনা, বেদ, শাস্ত্র বা বুদ্ধির নির্মাণ হয়ে রইলেন না, রক্তমাংসের মানুষ হিশাবে 'অবতরণ' করলেন। চৈতন্য তাই 'অবতার'। একই কারণে 'কলিযুগে মানুষই অবতার'। কারন ঈশ্বর এখন মানুষের ইতিহাস হবেন এবং মানুষের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিজে 'আস্বাদন' করবেন। তিনি পুরাণের কেচ্ছা হয়ে থাকবেন না।
এরপর থেকে ঈশ্বরকে বুঝতে হলে 'মানুষ'কে বুঝতে হবে। মানুষের বিবর্তন ও ইতিহাস বুঝতে হবে। মানুষ ভজনাই তাই নদীয়ার ফকিরি ধ্যান ও চর্চার কেন্দ্রীয় বিষয়। হোসেন শাহের বাংলায় প্রথম ফকির হিশাবে চৈতন্য নদীয়ায় হাজির হলেন। ফাল্গুনি পূর্ণিমা চৈতন্যের কারণে 'গৌরপূর্ণিমা' নামে বাংলায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হোল। ফকির লালন শাহের বিখ্যাত সাধুসঙ্গও সেই জন্য গৌরপূর্ণিমার তিথি মেনে শুরু হয়, তিথি মেনে শেষ হয়।
পুরানে ভগবান ছিলেন 'কৃষ্ণ', অর্থাৎ ঘোর কালো। কিন্তু নদিয়ায় সাধন গুণে তিনি 'গৌর' বা ফর্শা হলেন। কি সাধনে কালো 'গোরা' হোল নদিয়ার ফকিরি তত্ত্বের এটাই গোড়ার জিজ্ঞাসা। অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ বহিরঙ্গে রাধার ভেদবিচারের মধ্য দিয়ে এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে হবে। ফকিরি ভাষায় তার আরেক নাম 'নিহেতু প্রেম'। যে ভালবাসার কোন হেতু নাই।
অপরের প্রতি নিঃশর্ত প্রেমের অপর নামই ফকিরি। কিন্তু ডুগি-তবলা বাজিয়ে নেচেকুঁদে গান করা, মাজার পূজা, গাঁজা-ভাঙ নেশাকে দম সাধনা বলা আর বড় বড় মালা পরে ফকির-সন্যাসীর বেশ ধরে ঘুরে বেড়ানোকে ফকিরি বলে না। নিহেতু প্রেমের সামাজিক-রাজনৈতিক চর্চার রূপ আছে। কিন্তু এক ধরণের মাজারি চর্চা ও বাউলগিরি নদীয়ার ফকির লালন শাহের ধারাকে অস্পষ্ট ও ম্লান করে দিচ্ছে। লালন নিজেকে কোত্থাও 'বাউল' বলেন নি। কিন্তু তাঁকে সুফি, বাউল ইত্যাদি বানিয়ে তিনি যা পরিহার ও বিরোধিতা করে গিয়েছেন সেটাই তার নামে চালানো হয়। মড়ার ওপর খাঁড়া হেনে কল্লা কাটার মতো লালনের ধাম এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যা কিছু রেশ অবশিষ্ট তাকে রক্ষা করা ভীষণ কঠিন হয়ে গিয়েছে।
তিনটি দিক মনে রাখলে নদিয়ার ভাবচর্চার সামাজিক-রাজনৈতিক রূপ আমরা মোটামুটি বুঝতে পারি। প্রথমত কঠোর ভাবে জাতপাতের বিরোধিতা, দ্বিতীয়ত ধনি গরিব ভেদের বিরোধিতা -- বিশেষত যে ব্যবস্থা মানুষকে ধনি গরিবে বিভক্ত করে সেই ব্যবস্থাকে মেনে না নেওয়া। এবং তৃতীয়ত নারী-পুরুষ ভেদ অস্বীকার করা।
নারী-পুরুষ ভেদ অস্বীকার করতে হবে কেন? কারণ লিঙ্গ দিয়ে 'মানুষ' চেনা যায় না, শুধু জীব কি করে নিজেকে নিজে জীব হিশাবে পয়দা করে কেবল সেটাই বোঝা যায়। এই জানাবোঝার মানে প্রকৃতিকে বোঝা। 'প্রকৃতি' নদীয়ার ধারণা অনুযায়ী স্থির বা অচল কোন বিষয় না, বরং চলমান প্রক্রিয়া, বিবর্তন বা প্রাকৃতিকতা। সব মানুষই প্রকৃতি কারণ তারা প্রাকৃতিক বিবর্তনের অন্তর্গত। জীবের জন্মমৃত্যু আছে। বায়লজিকাল পুরুষকে আলাদা ভাবে বুঝলে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বোঝা যায় না। তাই ভজনা করতে হবে বা বুঝতে হবে মাকে 'মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা'। মাকে চিনলে বাপকে চেনা যায়। নদীয়া এই দিক থেকে প্রকৃতিবাদী -- অর্থাৎ প্রক্রিয়াবাদিও বটে:
"পুরুষ পরওয়ারদিগার
অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার
প্রকৃতি প্রকৃত সংসার সৃষ্টি সবজনা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা।
তাহলে মনুষ্যকুলের চ্যালেঞ্জ কি? সেটা নিশ্চয়ই জীব হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া নয় জীবাবস্থা অতিক্রম করে মানুষের মধ্যে যে বিপুল সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে তার বিকাশ ঘটানো। সেই জন্য নদীয়ারা হাহাকার:
কতো কোটি লক্ষ যোনি
ভ্রমণ করেছ তুমি
মানব জন্মে মনরে তুমি
কি করিলে কি করিলে কি করিলে?
আর কি হবে এমন জনম বসব সাধুর মেলে!!
যারা এবার সাধুসঙ্গ ও উৎসবে আসবেন তার এই হাহাকার মনে রাখবেন। মানব জন্ম পেয়েছেন, কিন্তু করলেনটা কী? সাধুসঙ্গ জবাবাদিহির 'মেল' বা ক্ষেত্র। বুঝে শুনে আসবেন। সবাইকে স্বাগতম"।
আয়াতুস সাকিনাহ: অন্তরের প্রশান্তির আয়াত
আয়াতুস সাকিনাহ: অন্তরের প্রশান্তির আয়াত
আপনার মন অস্থির, দুঃখ কষ্টে জীবন ভারাক্রান্ত, আপনি জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত? তবে আপনি মহা গ্রন্থ আল কুরআনের সাকিনাহ বা প্রশান্তির আয়াতগুলোর তেলাওয়াত শুনেন বা নিজে অর্থসহ তেলাওয়াত করুন অবশ্যই মহান আল্লাহ আপনার অন্তরে প্রশান্তি দান করবেন। ইনশাআল্লাহ। এ ‘সাকিনাহ’ হচ্ছে এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি, স্বস্তি, সান্ত্বনা, স্থিরতা ও সহনশীলতা। যা আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তের ঢেলে দেন। ফলে যত ভয়-ভীতি ও বিপদাপদ আসুক না কেন সে হতাশ হবেন না, অস্থির হবেন না, ভেঙ্গে পড়বেন না বরং মানসিকভাবে শক্তি ও সাহস খুঁজে পাবেন। হে আল্লাহ আপনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি দান করুন।
কুরআনের ৬ টি বিশেষ আয়াত রয়েছে, যেগুলো ‘আয়াতুস সাকিনাহ’ (প্রশান্তির আয়াত) নামে পরিচিত। জীবনের যেকোনো কঠিন সময় ও পরিস্থিতিতে এগুলো পড়লে অন্তরে প্রশান্তি আসে। জীবনে যখন জটিলতা ও কাঠিন্য চেপে বসতো, তখন ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আয়াতুস সাকিনাহ’ তিলাওয়াত করতেন। একবার তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি তাঁর শারীরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এমন ক্রিটিক্যাল সময়েও তাঁর কিছু শত্রু নজিরবিহীনভাবে তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করে। সেই নাজুক অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখন আমার অবস্থা বেশ জটিল হয়ে পড়লো, তখন আত্মীয়-স্বজন এবং আমার আশেপাশের লোকদের বললাম—তোমরা ‘‘আয়াতুস সাকিনাহ’’ (প্রশান্তির আয়াতগুলো) তিলাওয়াত করো। ফলে, আমার কাছ থেকে সেই (জটিল) অবস্থা দূর হয়ে গেলো। আমি এমনভাবে (ওঠে) বসলাম, যেন আমার জীবনে কোনো অসুস্থতাই নেই।
ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি নিজেও পরে এই রোগে আক্রান্ত হলাম। তখন প্রশান্তি ও অন্তরের স্থিরতা আনয়নে এই আয়াতগুলোর চমৎকার প্রভাব লক্ষ করেছি। সাকিনাহ বলতে বুঝায় (অন্তরের) স্থিরতা ও ধৈর্য। সাকিনাহ এমন এক বিষয়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার অন্তরে অবতীর্ণ করেন, যখন বান্দা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। ফলে সে এই খারাপ অবস্থাতেও অস্বস্তিতে ভোগে না। এতে তাঁর ঈমান, বিশ্বাসের শক্তি এবং দৃঢ়তা বেড়ে যায়। [হাফিয ইবনুল কায়্যিম, মাদারিজুস সালিকিন: ২/৪৭৩] উল্লেখ্য, ‘সাকিনাহ’ শব্দটি একবচন, এর বহুবচন হলো ‘সুকুন’ (অনেকেই শব্দটির সাথে পরিচিত)।
ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, কুরআন মাজিদে ৬ টি স্থানে সাকিনাহর উল্লেখ এসেছে। আয়াতগুলো হলো:
১) সুরা বাকারাহ, আয়াত: ২৪৮;
২) সুরা তাওবাহ, আয়াত: ২৬;
৩) সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৪০;
৪) সুরা ফাতহ, আয়াত: ০৪;
৫) সুরা ফাতহ, আয়াত: ১৮ ও
৬) সুরা ফাতহ, আয়াত: ২৬
আহমাদ নুফাইসের কণ্ঠে আয়াতুস সাকিনাহ (প্রশান্তির আয়াতগুলো) শুনুন
https://youtu.be/lRWLYRS9zI
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। সেটি হলো: এই আয়াতগুলোকে ‘আয়াতুস সাকিনাহ’ বলার কারণ হলো, এগুলোতে ‘সাকিনাহ’ শব্দটি আছে এবং এইকেন্দ্রিক আলোচনা আছে। এটি কেবলই আলিমগণের নির্দেশিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ আমল। সরাসরি এই ছয়টি আয়াত প্রশান্তির জন্য পড়ার পক্ষে কুরআন বা হাদিসে কিছু বলা হয়নি। তাই, এই আমলটিকে সুন্নাহ মনে করা যাবে না। তবে, কুরআনের যেকোনো আয়াতের অর্থের দিকে লক্ষ রেখে আমল করা বৈধ, তাই এই আমলটি করতে অসুবিধা নেই। কারণ আল্লাহ কুরআনকে শেফা বা আরোগ্য বলেছেন। তিনি বলেন—
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ
‘‘আর আমরা অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য এবং রহমত।’’ [সুরা ইসরা (বনি ইসরাইল), আয়াত: ৮২]
কুরআনের শেফা বা আরোগ্য নিয়ে অন্য কোনো পোস্টে ডিটেইলস আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।
আর, এই ছয়টি আয়াত শুধু রোগের ক্ষেত্রেই নয়, বরং যেকোনো বিপদ-মুসিবত, কাঠিন্য, সংকীর্ণতা ও দুশ্চিন্তায় আমলযোগ্য। বিশেষ কোনো নিয়ম নেই, বরং যেকোনো সময় এগুলো পড়া যাবে। পাশাপাশি বিপদ-মুসিবত ও অসুস্থতার অন্যান্য আমলগুলোও করবেন।
সাকিনাহ কী?
সাকিনাহ’ হচ্ছে শান্তি, প্রশান্তি, স্বস্তি ও সান্ত্বনা। মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুমিনের জন্য প্রশান্তিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সাকিনাহ। কুরআন সুন্নাহর একাধিক স্থানে সাকিনাহ শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। এ ‘সাকিনাহ’ হচ্ছে এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি, স্বস্তি, সান্ত্বনা, স্থিরতা ও সহনশীলতা। যা আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তের ঢেলে দেন। ফলে যত ভয়-ভীতি ও বিপদাপদ আসুক না কেন সে হতাশ হবেন না, অস্থির হবেন না, ভেঙ্গে পড়বেন না বরং মানসিকভাবে শক্তি ও সাহস খুঁজে পাবেন। এ সাকিনাহ নাজিল করার মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তাআলা মুমিনের ঈমান আরও বাড়িয়ে দেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর প্রতি বান্দার আস্থা ও নির্ভরতা আরও বেশি সুদৃঢ় হয়।
সাকিনাহ বা প্রশান্তি মহান আল্লাহর তাআলা বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি মুমিন বান্দার প্রতি তা নাজিল করেন। এ সাকিনাহ বা প্রশান্তি অবতীর্ণ হওয়ার ফলে মুমিন বান্দার অন্তরে যেমন প্রশান্তি বেড়ে যায়, তেমনি ওইসব ঈমানদারদের সঙ্গে চলাফেরাকারী সঙ্গীদের ঈমানও বেড়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
هُوَ الَّذِي أَنزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَّعَ إِيمَانِهِمْ তিনি মুমিনদের অন্তরে সাকিনাহ (প্রশান্তি) অবতীর্ণ (দান) করেন; যাতে তাদের ঈমানের সঙ্গে আরও ঈমান বেড়ে যায়।’ (সুরা আল-ফাতহ : আয়াত ৪) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুরআন তেলাওয়াতকারীর প্রতি এ সাকিনাহ নাজিল হয়।’ হাদিসের বর্ণনায় তা প্রমাণিত- হজরত বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘একবার এক ব্যক্তি সুরা কাহফ তেলাওয়াত করছিল। তার পাশেই দুটি রশি দিয়ে একটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। ওই সময় এক খণ্ড মেঘ তাকে ঢেকে নিল। মেঘের খণ্ডটি যতই লোকটির কাছাকাছি হতে লাগলো; তা দেখে ঘোড়াটি চমকাতে আরম্ভ করল। অতপর যখন সকাল হল তখন লোকটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন এবং ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। ঘটনাটি (শুনে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘সেটি ছিল ‘সাকিনাহ বা প্রশান্তি’; যা তোমার কুরআন তেলাওয়াতের কারণে নাজিল হচ্ছিল।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সাকিনাহ লাভের উপায় ও দোয়া: আল্লাহর রহমত ছাড়া সাকিনাহ বা প্রশান্তি পাওয়ার কোনো উপায় নাই। সে কারণেই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা, কুরআন তেলাওয়াত করা কিংবা আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। তাই মুমিন মুসলমানের উচিত- - বেশি বেশি জিকির ও দোয়া করা।–
اَللَّهُمَّ أَنْزِل عَلَى قَلْبِىْ السَّكِيْنَة উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আংযিল আলা ক্বালবি সাকিনাহ’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে সাকিনাহ বা প্রশান্তি দান করুন।’
- কুরআন তেলাওয়াত করা।
- বেশি বেশি তওবা-ইসতেগফার করা।
- নিজের কাজের আত্মসমালোচনা করে সংশোধন হওয়ার প্রচেষ্টা করা।
- ভালো-মন্দ সব বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালার ওপর বিশ্বাস রাখা।
- কল্যাণ লাভে আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করা।
- গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা।
- আল্লাহর দেয়া ফরজ বিধান ঈমানি মজবুতির সঙ্গে আদায়, ফরজ নামাজে যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি বেশি বেশি নফল ইবাদত করা।
- সৎ লোকদের সংস্পর্শে থাকা।
- সব সময় অল্প প্রাপ্তিতেই সন্তুষ্ট থাকা এবং দুনিয়ার দিকে উচ্চভিলাষী দৃষ্টিতে তাকানো থেকে বিরত থাকা।
তবেই আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দার প্রতি নাজিল করবেন সাকিনাহ বা প্রশান্তি। দান করবেন ঈমানের মিষ্টতা, অনাবিল সুখ, শান্তি ও পরিতৃপ্তি। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমিন।
মনে রাখা জরুরি: সাকিনাহ যেহেতু বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহ। তাই আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপনের বিকল্প নেই। যখনই বান্দা মহান আল্লাহর রঙে নিজের জীবন রাঙিয়ে তুলবে তখনই তার ওপর নাজিল হতে থাকবে সাকিনাহ বা প্রশান্তি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবে বিজয় ও ক্ষমা এবং জীবন নেয়ামতে পরিপূর্ণ হবে। আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন-
‘(হে রাসুল!) নিশ্চয় আপনার জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট বিজয়। যাতে আল্লাহ তাআলা আপনার অতিত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আপনার প্রতি তার নেয়ামত পূর্ন করে দিয়েছেন। আর আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। আর আপনাকে দান করেছেন বলিষ্ট সাহায্য। তিনিই সেই মহান সত্তা; যিনি মুমিনের অন্তরে প্রশান্তি নাজিল করেন। যাতে তাদের ঈমানের সঙ্গে আরও ঈমান বেড়ে যায়। আসমান ও জমিনের সব বাহিনী মহান আল্লাহর জন্য। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ফাতহ : আয়াত ১-৪) আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে দান করুন তার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত সাকিনাহ। যে সাকিনাহ লাভে মুমিন হবে ধন্য। পাবে গোনাহমুক্ত নেয়ামতে পরিপূর্ণ জীবন। আমিন।
Sunday 27 February 2022
বাংলার আদি অধিবাসী সুসভ্য দ্রাবিড় জাতির উপরে আর্যরা চালিয়ে ছিল নির্মম বর্বর গণহত্যা
বাংলার আদি অধিবাসী সুসভ্য দ্রাবিড় জাতির উপরে আর্যরা চালিয়ে ছিল নির্মম বর্বর গণহত্যা
দ্রাবিড় নামক প্রধান সুসভ্য জাতি বাস করিত। এই দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের ভূমি সন্তান। এদেশে বহিরাগত আর্যদের আগমনের পর হতেই দ্রাবিড়দের সাথে আর্যদের সংঘাত শুরু হয়। পর দেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আর্যদের সংগ্রাম শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের সংঘাত অব্যাহত থাকে। আর্যরা বাংলাদেশ জয়ের জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। প্রতিবারই তারা পরাজিত হয় গাঙ্গেয় বদ্বীপের বীর জাতির কাছে। যে কারণে আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদে বাঙালি জাতি সম্পর্কে রয়েছে নানা ধরনের অবজ্ঞাপ্রসূত উক্তি॥ পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম গ্রন্থে এমন জঘন্য ভাষায় বর্ণনা করা হয় নাই কোনো সুসভ্য জাতির বিরুদ্ধে ?
যারা যুগ যুগ ধরে অসভ্য আর্যদের দ্বারা অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে ॥ আর উল্টো ঐ সময়ে রচিত আর্যদের ধর্ম গ্রন্থ বেদ এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় দ্রাবিড় জাতির বিরুদ্ধে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা হেয় আর ছোট জাত হিসেবে বর্ণনা করে॥ কেউ বেদ পড়ে দেখতে পারেন দ্রাবিড় জাতিকে নিয়ে কেমন জঘন্য ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে ॥
রবীন্দ্রনাথের লেখা ভারতের জাতীয় সংগীতে দ্রাবিড় জাতির উল্লেখ আছে।
"দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা
উচ্ছল জলধি তরঙ্গ"
তথ্যের স্বল্পতার কারণে প্রাক-মুসলিম যুগের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠন করা শ্রমসাধ্য ও কষ্টকর। এ অসুবিধা আরও বেশি করে অনুভূত হয় প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনায়- অর্থাৎ প্রাচীনতমকাল থেকে খ্রিস্টীয় চার শতকে বাংলায় গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত। এ সময়ের ইতিহাসের উপাদানের জন্য নির্ভর করতে হয় বৈদিক, মহাকাব্যিক ও পৌরাণিক সাহিত্যের অপর্যাপ্ত তথ্য ও প্রাপ্তিসাধ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনাদির ওপর। গুপ্তযুগ থেকে পরবর্তী সময়ের জন্য আমরা প্রস্তরাদিতে উৎকীর্ণ লিপি ও সাহিত্যাকারে লিখিত তথ্যাদি পাই। এসব তথ্যে বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়।
ব্রাহ্মণজনগোষ্ঠী আর্যরা ভারতের ভূমি সন্তান নয়। এরা বহিরাগত। আর্যরা অভাব দারিদ্র্য খাদ্য সংকট প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা যুদ্ধজনিত কারণে বিতাড়িত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দিকে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে আসে।
পটভূমি জানা যায় যে, সর্বপ্রাচীনকালে বাংলায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোক বসবাস করত এবং যে অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করত সে অঞ্চল সেই জনগোষ্ঠীর নামে পরিচিত হতো। এভাবে বঙ্গ, পুন্ড্র,রাঢ় ও গৌড় নামক প্রাচীন জনপদসমূহ অনার্য জনগোষ্ঠীর দ্বারা এ সব নামের অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে মেঘনার ওপারে সমতট (কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল) ছিলো একটা গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। এ জনপদের নাম পুরোপুরি বর্ণনাত্মক এবং জনগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা বর্জিত। চট্টগ্রাম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলহরিকেল নামে পরিচিত ছিলো। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে অনার্য জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে এ সকল জনপদের কথা জানা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্যভাগে প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আর্য-প্রভাব অনুভূত হয়।
আর্যদের আগমনের পূর্বে এদেশে অনার্যদের বসবাস ছিল। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অষ্টিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয় এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল।
অষ্ট্রিক জাতির সমসাময়িক বা কিছু পরে আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে এবং দ্রাবিড় সভ্যতা উন্নত বলে অষ্ট্রিক জাতি এদের মধ্যে মিলে যায়। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রনেই সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী। এদের রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহমান। ভারত উপমহাদেশে আর্যকরণ শুরু হয় প্রায় ১৫০০ খ্রি. পূর্বাব্দ থেকে। ইউরোপ থেকে আগত আর্যরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত পারস্য পেরিয়ে ভারতে আগমন করে। এ ব্যাপারে শ্রী অমিত কুমার বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘খৃস্টের জন্মের দেড় বা দুই হাজার বৎসর পূর্বে অর্থাৎ আজ হইতে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে ভারত বর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কাছে আর্য জাতির এক শাখা পশ্চিম পাঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয়। তাহাদের পূর্বে এদেশে কোল ভিল সাওতাল প্রভৃতি অসভ্য জাতি এবং দ্রাবিড় নামক প্রধান সুসভ্য জাতি বাস করিত।
এই দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের ভূমি সন্তান। এদেশে আগমনের পর দ্রাবিড়দের সাথে আর্যদের সংঘাত শুরু হয়। পর দেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আর্যদের সংগ্রাম শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের সংঘাত অব্যাহত থাকে। দূর দেশ থেকে ভয়সংকুল পথ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে সংকটের মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখার কৌশল অর্জন করে আর্যরা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জাতিগত সংকটের কারণে তারা দক্ষতার সাথে দ্রাবিড়দের মুকাবিলা করতে সক্ষম হয়। এক পর্যায়ে তারা ভূমি সন্তান দ্রাবিড়দের উপর বিজয়ী হয়। কালক্রমে দ্রাবিড়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর্যরা রপ্ত করে নেয়। দুই সভ্যতার মিশ্রণে নতুন সাংস্কৃতিক ধারা এবং ধর্মীয় অনুভবের সূচনা হয়। ওদিকে পরাজিত দ্রাবিড়রা বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয় অথবা আর্যদের অধীনে লাঞ্ছিত হতে থাকে। আর্যরা পরাজিত দ্রাবিড়দের ওপর তাদের নির্দেশনা চাপিয়ে দেয়। আর্যদের প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ প্রথার সর্বনিম্ন স্তরে দ্রাবিড়দের স্থান দেয়া হয়। পিরামিডের শীর্ষে স্থান নেয় আর্যরা। সর্ব নিম্নে অবস্থান হয় দ্রাবিড়দের। পিরামিডের স্তর বিন্যাস হয় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ দিয়ে। পুরো পিরামিডের ভার বহন করতে হয়- দ্রাবিড়দের। পর্যায়ক্রমে দ্রাবিড়রা আর্যদের বিন্যস্ত সমাজে হারিয়ে যায়। রুশ ঐতিহাসিক এ জেড ম্যানফ্রেডের মতে, সে যুগে ব্রাহ্মণদের কোন কর দিতে হত না। ক্ষত্রিয় শুদ্র প্রভৃতি জাতিকে ছোট লোক শ্রেণীর ধরা হত। নব্বই বছরের বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়কে নয় বছরের ব্রাহ্মণের পদ সেবা করতে হতো। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতির কাছে তাদের উৎপাদনের ৫ অথবা ৬ ভাগের এক ভাগ কর আদায় করা হত। নর হত্যা করলে শিরোশেদ হতো বটে কিন্তু কোন ব্রাহ্মণ যদি শুদ্রকে হত্যা করতো তাহলে শুধু মাত্র সামান্য জরিমানা দিলেই চলতো। যেমন পোষা কুকুর মেরে ফেলার শাস্তিস্বরূপ কিছু জরিমানা হয়।
এইভাবে নিম্নস্তরে অবস্থানকারী সমগ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আর্যরা সমকালীন সমাজ বিন্যস্ত করে ধর্মীয় আবেশ সৃষ্টি করে। সে সময় বিবেক বহির্ভূত অন্ধ আবেগের দ্যোতনা সৃষ্টি করে নিত্য নবনব নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয় সাধারণ মানুষের ওপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাধারণ মানুষকে ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। অন্ধকারের পর যেমন আলো দেখা যায়, গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে অনুরূপ নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা সম্বলিত সমাজে নির্যাতন বিরোধী প্রতিরোধ শক্তির অভ্যুদয় হয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ধারক ব্রাহ্মণ্য সমাজে জন্ম নেয় গৌতম বুদ্ধ। রাজকীয় সুখ সাচ্ছন্দ এবং প্রভুত্বের ব্যঞ্জনা তাকে আটকে রাখতে পারল না। যুগ যুগান্তর ব্যাপী দক্ষিণ এশিয়ায় মানবতার লাঞ্ছনা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যকার পুঞ্জিভূত দুঃখ ক্লেশ অসম্মান ও অবমাননা তার মধ্যে ভাবান্তরের সূচনা করে। তিনি রাজকীয় সুখ সম্ভোগের মোহ পরিত্যাগ করে দেশান্তরিত হন এবং প্রচলিত নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন কোন ব্যবস্থার ছক অর্জন না হওয়া পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে চিন্তার গভীরে ডুব দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন নতুন ব্যবস্থার সূত্রসমূহের আবিষ্কার তার সন্তুষ্টির সীমায় এসে পড়ে তখন তিনি তার মত প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সমকালীন ঘুণে ধরা বির্তনমূলক সমাজ কাঠামোর বিপরীতে তার নতুন চিন্তা শোষিত বঞ্চিত নির্যাতীত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নবতর এক বিপ্লবের বার্তা হয়ে অনুরণিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে বৌদ্ধবাদ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে শোষণ ও বিবর্তনমূলক সমাজ কাঠামোর ধারক কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি তাদের প্রভুত্ব হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মানবিক বিপ্লব প্রতিহত করার জন্য বৌদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। বৌদ্ধদের ধর্মবিরোধী নাস্তিক এবং বিদ্রোহী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে বৌদ্ধ বিরোধী উম্মাদনা সৃষ্টি করে বৌদ্ধদের উৎখাতে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা।
ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক। বৌদ্ধগ্রন্থে এদের নাম আছে। মহাভারতে এদের নাম হেতুবাদী। তারা আসলে নাস্তিক। তারা বলতেন, পরকাল আত্মা ইত্যাদি বড় বড় কথা বেদে আছে কারণ ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোকরাই বেদ সৃষ্টি করেছে, ভগবান নয়। বেদের সার কথা হল পশুবলি। যজ্ঞের নিহত জীবন নাকি স্বর্গে যায়। চার্বাকরা বলেন, যদি তাই হয় তাহলে যজ্ঞকর্তা বা জজমান তার নিজের পিতাকে হত্যা করে স্বর্গে পাঠান না কেন...
‘... এই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে বেদ ভক্তদের সংগে বৌদ্ধদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঝাপ দিতে হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে নাস্তিক, চার্বাকদের উক্তিতেই প্রমাণ রয়েছে। অতএব বৌদ্ধরা মূর্তিপূজা যজ্ঞবলি বা ধর্মাচার নিষিদ্ধ করে প্রচার করছিল পরকাল নেই, জীব হত্যা মহাপাপ প্রভৃতি। মোটকথা হিন্দু ধর্ম বা বৈদিক ধর্মের বিপরীতে জাতি ভেদ ছিল না।
রাইন নদী থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে আর্যজাতির বাস ছিল।অনেকে মনে করেন হিন্দুকুশ পর্বত বেয়ে যারা উপমহাদেশে আগমণ করে তারাই ভারতীয় আর্য। ইরানী প্রাচীণ শাসকরাও নিজেদেরকে আর্যবংশ সম্ভূত বলে দাবী করতেন। আর্যরা ছিল সভ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতির দিক দিয়ে যতটা না উন্নত তার চেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল যোদ্ধা বা যুদ্ধবাজ হিসেবে॥ ঋগবেদ আর্যজাতির সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ। খ্রীস্টপূর্ব ১৭০০ থেকে খ্রীস্টপূর্ব ১১০০ সালের মধ্যে ঋগবেদ রচিত হয।ঋগবেদ মূলত দেবতাদের উদ্দ্যেশ্যে লিখিত। ঋগবেদের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবতা ইন্দ্র আর ইন্দ্রের প্রধান শত্র 'বৃত্তাসুর॥৭ম শতকে আর্যরা বঙ্গ সহ উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। পর্যায়ক্রমে অত্যাচারি আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক। দ্রাবিড়দের নগরগুলো ধ্বংস সাধনের সময় আর্যরা যে গণহত্যার আশ্রয় নেয় তা, ঐসব নগর সমুহের গণকবর বা বৈধ্যভূমি আবিস্কারের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন॥ আর্যরা যাযাবর হওয়ায় তাদের কাছে নগর জীবন উপেক্ষিত ছিল। গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবপূর্ব কালে উপমহাদেশে আর্যজাতি বিভিন্ন জন বা উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। এসব জনদের বসতিকে জনপদ বলা হত। এসব জনপদ গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পুবের্বই রাজ্যে পরিণত হয়। মুঘলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিলো না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠি ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও চালিয়েছিলো ব্যাপক আক্রমণ। আর্যদের ধর্মই বৈদিক ধর্ম যা কালক্রমে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিতি পায়। প্রাচীন কালে চীনা পরিব্রাজক যখন বাংলাদেশ ভ্রমন করেন তখন সারা বাংলায় আর্য ভাষার প্রচলন হয়। সিংহলী ও বেদিয়া মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা হতে উৎপন্ন হয়েছে। আর্যদের আগমনের পর বাংলা ও বিহার অঞ্চল জুড়ে মগধ রাজ্য সংগঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে। বাংলায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে। বৈদিক ধর্মের ধারক-বাহকদের বলে আর্য জাতি। বাংলায় এ আর্য জাতির আগমন মূলত খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত॥ বাংলার আর্যদের আগমন হয়েছিল প্রাচীন পারস্য থেকে। সে সময় পারস্যে বৈদিক ধর্ম চালু ছিল। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে মূলত আর্য-পূর্ব বাঙালি জনগোষ্ঠীর।
ভারতীয় এই আর্য জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে যা জানা যায় তার অধিকাংশ তাদের শাস্ত্র বেদ (Vedas) এর মাধ্যমে, যার মানে জ্ঞানশাস্ত্র (Books of Knowledge)। এটি স্বর্গীয় প্রশংসাগাঁথা (hymns), মন্ত্র (spells) ও ধর্মাচারের (rituals) সমাহার, বিভক্ত চারটি উপভেদে:
১। রিগবেদ (Rig Veda), যাতে আছে স্বর্গীয় প্রশংসাগাঁথা, আবৃত্তি করবেন প্রধান পুরোহিত।
২। যজুর্বেদ (Yajur Veda), যাতে আছে উৎসর্গ বা যজ্ঞনীতি, পাঠ করবেন তদারককারী পুরোহিত।
৩। সামবেদ (Sama Veda), যাতে আছে মন্ত্রপুত সূত্র, গাইবেন মন্ত্রোচ্চারক পুরোহিত।
চতুর্থটি হচ্ছে অথর্ববেদ (Atharva Veda), যা মূলত বিভিন্ন যাদু-মন্ত্র, গাঁথা, ভবিষ্যতবাণী ও বিপদতাড়িণী মন্ত্রের সমাহার।
বেদ প্রথমে মৌখিকভাবে (oral tradition) সংরক্ষিত ছিল, পরে ১৫০০ থেকে ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে সংস্কৃতের একটি প্রাচীনরূপে এটি লিখিত হয়। বেদের নাম থেকেই নামকরণ হয় ভারতীয় ইতিহাসের বৈদিক যুগ (Vedic Age), বিস্তারকাল আনুমানিক ১৫০০-২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ।
আগন্তুকরা নিয়ে আসে যুদ্ধরথ (war chariots), লৌহাস্ত্র (iron weapons) এবং গরুর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যা তার লালন পালন করত; আর নিয়ে আসে তাদের বিভিন্ন প্রকৃতি দেব-দেবী (pantheon of gods), যেমন বজ্র ও তুফানদেবতা ইন্দ্র (Indra), ভোরের দেবী ঊষা (Usha)। ইন্দ্রের পিতা আকাশ দেবতা দ্যায়ুস পিতার (Dyaus Pitar) ও মনুষ্য মাতা পৃথিবী (Mata Prithivi)। দ্যায়ুসের উৎপত্তি প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান আকাশ দেবতা *Dyeus এর সাথে সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা যায়, গ্রীসে যার পরিচিতি Zeus patēr (কর্মকারকে Día, সম্মন্ধ পদে Diós), রোমে Jupiter (প্রাচীন লাতিন Iove pater বা 'Sky father' থেকে উদ্ভূত), স্লাভিক (Slavic) পুরাণে Div, এবং জার্মানিক ও স্ক্যান্ডিনেভীয় (Norse) পুরাণে Thor, Tyr বা Ziu.
ভারতীয় আর্যরা প্রথমদিকে পিতৃতান্ত্রিক বিভিন্ন গোত্র-পরিবারে একজন যুদ্ধনেতার (warrior-chieftain, সংস্কৃতে রাজাচ) অধীনে বসবাস করত; গোত্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হত সভার মাধ্যমে। পুরোহিতগন (priest) দেবতাদের সম্মানার্থে, সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে এবং গোত্রনেতাদের শাসনের বৈধতা দিতে পালন করতেন উৎসর্গ বা যজ্ঞ (yajna, yagya)। ধীরে ধীরে গড়ে উঠে একটি কঠোর সামজিক বিভাজন রেখা যা পরে জন্ম দেয় দীর্ঘমেয়াদি বর্ণপ্রথার (caste system)।
আর্যদের আগে এ দেশে অন্যান্য জাতির ধর্ম পালনের নজির রয়েছে। তবে আর্যদের মাধ্যমে বৈদিক ধর্ম এ দেশের জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। আর্যদের ধর্মগ্রন্থ- বেদ বেদের অংশ- ৪টি (ঋক, সাম, যজু, অথর্ব) বেদের রচয়িতা- ঈশ্বর মহাভারতের রচয়িতা- দেবব্যাস রামায়ণের রচয়িতা- বাল্মিকী আর্যসাহিত্যকে বলা হয়- বৈদিক সাহিত্য আর্যসমাজ- ৪ ভাগে বিভক্ত (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য, শূদ্র) আর্য বিশ্বাস অনুযায়ী যুগ ৪টি- সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা, কলি (এখন কলিকাল) আর্যগণ প্রথমে পশু পালন করে জীবিকানির্বাহ করতেন। প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড়রা ধান চাষ করত। ধান ছাড়াও দ্রাবিড়রা গম ও যবের আবাদও করত। দ্রাবিড়রা অস্ট্রিকভাষী আদি অস্ট্রেলীয়দের মতোই মাছ খেত। মাছ ধরা ছাড়াও তারা নদীতে কিংবা সমুদ্রের ধারে মুক্তা ও প্রবাল আহরণ করত। সংস্কৃত ভাষায় মুক্তা, নীর (পানি), মীন (মাছ) এসব শব্দের মূলে রয়েছে দ্রাবিড় শব্দ। আর্যরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে হানা দেয়, তখন তাদের হাতে পতন হয় একের পর এক জনপদের। সুসভ্য সিন্ধু উপত্যকার মানুষ যাযাবর যুদ্ধবাজ আর্যদের সঙ্গে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। শুধু ভারতবর্ষ নয়, শ্রীলঙ্কায়ও আগ্রাসন চালায় তারা। আর্যরা বাংলাদেশ জয়ের জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। প্রতিবারই তারা পরাজিত হয় গাঙ্গেয় বদ্বীপের বীর জাতির কাছে। যে কারণে আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদে বাঙালি জাতি সম্পর্কে রয়েছে নানা ধরনের অবজ্ঞাপ্রসূত উক্তি। অনেকেই মনে করেন আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণকর্তা । সিন্ধুবাসীরা শিব ও মাতৃকা দেবীর আরাধনা করলেও আর্যদের প্রধান দেবতা ছিল পুরুষ (ইন্দ্র) । আর্যরা মৃতদেহ দাহ করত । সিন্ধুবাসীরা কবর দিত । বিদেশ থেকে আগত বহিরাগত আর্যরাই ভারতকে অনার্য মুক্ত করেছে, মানে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংস লীলা চালায় দ্রাবিড় জাতির উপরে । শিব, মহাদেব, রাবণ ও মহীষাসুর ছিলেন অনার্য দেবতা ও রাজা মহারাজা। কিছুটা সমঝোতা, কিছুটা দমন করেই আর্যরা সারা ভারত দখল করে নেয়। আর্যরা ভারতে প্রবেশের পর ব্রহ্মাবর্ত নামক একটি স্থানে প্রথম বসতী স্থাপন করেছিলেন। সেই স্থানের একটি নদীকে আর্যরা সরস্বতী নামে আখ্যায়িত করেন। এই নদীটি ক্রমে ক্রমে পবিত্র নদী হিসাবে আর্যদের কাছে সম্মানিতা হয়ে উঠে। বেদে সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে।
দ্রাবিড় অধ্যুষিত সিন্ধু, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারত আর্যদের দখলে চলে যাওয়ার পর এই যাযাবরদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে অধিকাংশ দ্রাবিড় দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর্যরা তাদের দখল বাড়াতে আরো পুবদিকে অগ্রসর হয়। সামরিক বিজয়ের সাথে সাথে বৈদিক আর্যরা তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির বিজয় অর্জনেও সকল শক্তি নিয়োগ করে। প্রায় সম্পর্ণ উত্তর ভারত আর্যদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। কিন্তু স্বাধীন মনোভাব ও নিজ কৃষ্টির গর্বে গর্বিত বঙ্গবাসীরা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুকে দাঁড়ায়। ফলে করতোয়ার তীর পর্যন্ত এসে আর্যদের সামরিক অভিযান থমকে দাঁড়ায়।
আমাদের সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের এই প্রতিরোধ-যুদ্ধ সম্পর্কে অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু লিখেনঃ
“প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত যখন বিজয়ী আর্য জাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াচিল, বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়াছিল। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই”। (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ২১)
সামরিক অভিযান ব্যাহত হওয়ার পর আর্যরা অগ্রসর হয় ঘোর পথে। তারা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিযান পরিচালনা করে। তাই দেখা যায়, আর্য সামাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা এ দেশে প্রথম আসেনি, আগে এসেছে ব্রাহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। কেননা, ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতার বিজয় সম্পন্ন হয়ে গেলে সামরিক বিজয় সহজেই হয়ে যাবে। এ এলাকার জনগণ ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম পরিচালনা করেন, তা ছিল মূলত তাদের ধর্ম-কৃষ্টি-সভ্যতা হেফাযত করার লড়াই। তাদের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম শত শত বছর স্থায়ী হয়। ‘স্বর্গ রাজ্যে’ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রামের যে অসংখ্য কাহিনী ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ প্রভৃতি আর্য সাহিত্যে ছড়িযে আছে, সেগুলো আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রামেরই কাহিনী। আমাদের পূর্ব পুরুষদের গৌরবদীপ্ত সংগ্রামের কাহিনীকে এসব আর্য সাহিত্যে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ধর্মশাস্ত্রে কোন মানবগোষ্ঠীকে এমন নোংরা ভাষায় চিহ্নিত করার নযীর পাওয়া যাবে না। উইলিয়াম হান্টার তার ‘এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ বইয়ে ও প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
“সংস্কৃত সাহিত্যে বিবৃত প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা হলো আদিম অধিবাসীদের সাথে আর্যদের বিরোধ। এই বিরোধজনিত আবেগ সমানভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঋষিদের স্তবগানে, ধর্মগুরুদের অনুশাসনে এবং মহাকবিদের কিংবদন্তীতে। ……… যুগ যুগ ধরে সংস্কৃত প্রবক্তারা আদিবাসীদেরকে প্রতিটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার হতে বঞ্চিত করে তাদের থেকে ঘৃণাভরে দূরে থেকেছে”।
সাংস্কৃতিক সংঘাত কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ‘এর সোশ্যাল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ বইয়ে দেখিয়েছেনঃ তিন স্তরে বিভক্ত আর্য সমাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা প্রথমে বাংলায় আসেনি। এদেশে প্রথমে এসেছে ব্রহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। বাংলা ও বিহারের জনগণ আর্য-অধিকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালনা করেন, তাও ছিল ধর্মভিত্তিক তথা সাংস্কৃতিক।
আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ধর্ম তথা সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে জেগে ওঠা এই এলাকার সেমিটিক ঐতিহ্যের অধিকারী জনগণের সংক্ষোভের তোড়ে উত্তরাপথের পূর্বপ্রান্তবর্তী প্রদেশগুলোর আর্য রাজত্ব ভেসে গিয়েছিল।
বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব চার শতক পর্যন্ত এদেশে আর্য-প্রভাব রুখে দেওয়া সম্ভব হয়। খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে মৌর্য এবং তার পর গুপ্ত রাজবংশ প্রতিষ্ঠার আগে বাংলায় আর্য ধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হয়নি। মৌর্যদের বিজয়কাল থেকেই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বাড়তে থাকে। তারপর চার ও পাঁচ খ্রিস্টাব্দের গুপ্ত শাসনামলে আর্য ধম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে।
মৌর্য বংশের শাসনকাল পর্যন্ত বৌদ্ধ-ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। আশোকের যুগ পর্যন্ত এই ধর্মে মূর্তির প্রচলন ছিল না। কিন্তু তারপর তথাকথিত সমন্বয়ের নামে বৌদ্ধ ধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু তান্ত্রিকতার প্রবেশ ঘটে। হিন্দু দেব-দেবীরা বৌদ্ধ মূর্তির রূপ ধারণ করে বৌদ্ধদের পূজা লাভ করতে শুরু করে। বৌদ্ধ ধর্মের এই বিকৃতি সম্পর্কে মাইকেল এডওয়ার্ডট ‘এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেনঃ
“Buddhism had, for a variety of reasons, declined and many of its ideas and forms had been absorbed into Hinduism. The Hinduization of the simple teachings of Gautama was reflected in the elevation of th Buddha into a Divine being surrounded, in sculptural representations, by the gods of the Hindu partheon. The Buddha later came to be shown as an incarnation of Vishnu.”
সতিশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্হে লিখেছেনঃ
“যোগীরা এখন হিন্দুর মত শবদেহ পোড়াইয়া থাকেন, পূর্বে ইহা পুঁতিয়া রাখিতেন। …….. উপবিষ্ট অবস্থায় পুঁতিয়া রাখা হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগিত, তাঁহারা মনে করিতেন, উহাতে যেন শবদেহ কষ্ট পায়”।
অর্থাৎ হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগার কারণে এভাবে বৌদ্ধদেরকে পর্যায়ক্রমে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি তথা জীবনাচরণের অনেক বৈশিষ্ট্যই মুছে ফেলতে হয়েছিল। অশোকের সময় পর্যন্ত বুদ্ধের প্রতিমা-পূজা চালু ছিল না। পরে বুদ্ধের শূন্য আসনে শোভা পেল নিলোফার বা পদ্ম ফুল। তারপর বুদ্ধের চরণ দেখা গেল। শেষে বুদ্ধের গোটা দেহটাই পূজার মণ্ডপে জেঁকে বসল। এভাবে ধীরে ধীরে এমন সময় আসল, যখন বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ লোপ পেতে থাকল।
গুপ্ত আমলে বাংলাদেশে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দোর্দন্ড প্রতাপ শুরু হয়। আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোত প্রবল আছড়ে পড়ে এখানে। এর মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালিত হয় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মকে আশ্রয় করে। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি বাংলা ও বিহারের জনগণের আত্মরক্ষার সংগ্রামে এ সময় প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর জনগণের আর্য-আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ শক্তিকে অবলম্বন করেই বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিন এ এলাকার প্রধান ধর্ম ও সংস্কৃতিরূপে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতে ঐতিহাসিকও স্বীকার করেছেনঃ
“আর্যরাজগণের অধঃপতনের পূর্বে উত্তরাপথের পূর্বাঞ্চলে আর্য ধর্মের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন উপি্থি হইয়াছিল। জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম এই আন্দোলনের ফলাফল”।(বাঙ্গালার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৭-২৮)
এ আন্দোলনের তোড়ে বাংলা ও বিহারে আর্য রাজত্ব ভেসে গিয়েছিল। আর্য-দখল থেকে এ সময় উত্তরাপথের পুব-সীমানার রাজ্যগুলো শুধু মুক্তই হয়নি, শতদ্র নদী পর্যন্ত সমস্ত এলাকা অনার্য রাজাদরে অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ও সংস্কৃতির অনাচারের বিরুদ্ধে সমুত্থিত জনজাগরণের শক্তিতেই শিশুনাগবাংশীয় মহানন্দের শূদ্র-পুত্র মাহপদ্মনন্দ ভারত-ভূমিকে নিঃক্ষত্রিয় করার শপথ নিয়েছিলেন এবং ক্ষত্রিয় রাজকুল নির্মূল করে সমগ্র আর্যবার্ত অনার্য অধিকারে এনে ‘একরাট’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।
বাংলাদেশেই আর্যবিরোধী সংগ্রাম সবচে প্রবল হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে আবদুল মান্নান তালিব লিখিছেনঃ
“সেমিটিক ধর্ম অনুসারীদের উত্তর পুরুষ হিসেবে এ এলাকার মানুষের তৌহিদবাদ ও আসমানী কিতাব সম্পর্কে ধারণা থাকাই স্বাভাবিক এবং সম্ভাবত তাদের একটি অংশ আর্য আগমনকালে তৌহীদবাদের সাথে জাড়িত ছিল। এ কারণেই শের্কবাদী ও পৌত্তলিক আর্যদের সাথে তাদের বিরোধ চলতে থাকে”। (বাংলাদেশে ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৪)
জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতমের জীবনধারা এবং তাদের সত্য-সন্ধানের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করে মওলানা আবুল কালাম আযাদসহ অনেক গবেষক মনে করেন যে, তারা হয়তো বিশুদ্ধ সত্য ধর্মই প্রচার করেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ও বিকৃতি তাদের সে সত্য ধর্মকে পৃথিবীর বুক থেকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে যে, তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া আজ অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে মান্নান তালিব লিখেছেনঃ
“জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করলে এ ষড়যন্ত্রের বহু ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। এ উভয় ধর্মই আর্যদের ধর্মীয় গ্রন্হ বেদকে ঐশী গ্রন্হ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তপস্যা, যাগযজ্ঞ ও পশুবলিকে অর্থহীন গণ্য করে। ব্রাহ্মণদের পবিত্রাত্মা ও নরশ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণাকে সমাজ থেকে নির্মূল করে দেয়। ফলে বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি নড়ে উঠে। স্বাভাবিকভাবে জনসাধারণ এ ধর্মদ্বয়ের আহ্বানে বিপুলভাবে সাড়া দেয়। দ্রাবিড় ও অন্যান্য অনার্য ছাড়া বিপুল সংখ্যক আর্যও এ ধর্ম গ্রহণ করে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মদ্বয়কে প্রথমে নাস্তিক্যবাদের অন্তর্ভুক্ত করে। নাস্তিক্যবাদের সংজ্ঞা তারা এভাবেই নিরুপণ করে যে, বেদবিরোধী মাত্রই নাস্তিক। কাজেই জৈন ও বৌদ্ধরাও নাস্তিক। অতঃপর উভয় ধর্মীয়দের নিরীশ্বরবাদী প্রবণতা প্রমাণ করার চেষ্টা চলে”। (বাংলাদেশে ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)।
মওলানা আবুল কালাম আযাদ দেখিয়েছেন যে, বুদ্ধ কখনো নিজেকে ভগবাদ দাবি করেননি। অশোকের যুগ পর্যন্ত বুদ্ধ-মূর্তির প্রচলনও কোথাও ছিল না। প্রতিমা পূজাকে সত্যের পথে এক বিরাট বাধা গণ্য করে সেই অজস্র খোদার খপ্পর থেকে বুদ্ধ মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি ব্রাহ্মণ্য খোদাকে অস্বীকার করে দিব্যজ্ঞানলাভ ও সত্য-সাধনায় মুক্তি নিহিত বলে ঘোষণা করেছিলেন।
বাংলায় দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে দীর্ঘ দিন আর্য-প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এরপর খ্রিস্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্ত শাসনে আর্য ধর্ম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্য বৈদিক হিন্দু ধর্মের কিছুই প্রসার হয়নি। ষষ্ঠ শতকের আগে বঙ্গ বা বাংলার পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ঢুকতেই পারেনি। উত্তর-পূর্ববাংলায় ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে ওঠে। পঞ্চম ও অষ্টম শতকের মধ্যে ব্যক্তি ও জায়াগার সংস্কৃতি নাম পাওয়া যায়। তা থেকে ড. নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, তখন বাংলার আর্যয়করণ দ্রুত এগিয়ে চলছিল। বাঙালি সমাজ উত্তর ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হচ্ছিল। অযোধ্যাবাসী ভিণ প্রদেশী বাহ্মণ, শর্মা বা স্বামী, বন্দ্য, চট্ট, ভট্ট, গাঙি নামে ব্রাহ্মণেরা জেঁকে বসেছিলঃ
“বাংলাদেশের নানা জায়গায় ব্রাহ্মণেরা এসে স্থায়ী বাসিন্দা হতে লাগলেন, এরা কেই ঋগ্বেদীয়, কেই বাজসনেয়ী, কেউ শাখাব্যয়ী, যাজুর্বেদীয়, কেই বা সামবেদীয়, কারও গোত্র কান্ব বা ভার্গব, বা কাশ্বপ, কারও ভরদ্বাজ বা অগস্ত্য বা বাৎসা বা কৌন্ডিন্য। এমনি করে ষষ্ঠ শতকে আর্যদের বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার পূর্বতম প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল”। (ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ঃ বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব, পৃষ্ঠা ১৩২)।
সাত শতকের একেবারে শুরুতে গুপ্ত রাজাদের মহাসামন্ত ব্রাহ্মণ্য-শৈবধর্মের অনুসারী শশাংক রাঢ়ের রাজা হয়ে পুন্ড্রবর্ধন অধিকার করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে রাজধানী স্থাপন করে তিনি বৌদ্ধ নির্মূলের নিষ্ঠুর অভিযান পরিচালনা করেন। রাজা শশাংক গয়ায় বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন। তিনি আদেশ জারি করেনঃ
“সেতুবন্ধ হইতে হিমালয় পর্যন্ত যেখানে যত বৌদ্ধ আছে, তাহাদের বুদ্ধ হইতে বালক পর্যন্ত যে না হত্যা করিবে, সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইবে”। (রামাই পণ্ডিতের শূন্য পুরাণ, পৃষ্ঠা ১২৪)
এই দীর্ঘ আলোচনা হতে পরিষ্কার বুঝা যায় দ্রাবিড় জাতি আমাদের পূর্ব পুরুষ। এবং বহিরাগত আর্যদের দ্বারা অত্যাচারি দ্রাবিড় জাতি ইসলামের সাম্যের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মুসলিম হয়। এরাই আমাদের পূর্ব পুরুষ ঐ বহিরাগত আর্যারা নয়।
তথ্য সূত্র:
মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস- মাওলানা আকরম খাঁ।
বাংলাদেশে ইসলাম- আব্দুল মান্নান তালিব।
বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা- কে.এম. রইসউদ্দীন খান।
ফিনিসিয়া থেকে ফিলিপাইন- মোহাম্মাদ কাসেম।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা (মুসলিম বিশ্ব সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৮৪)।
ভারতবর্ষের ইতিহাস- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান।
ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমদ মর্তুজা।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ- আই. এইচ. কোরেশী।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব- ড. তারা চাঁদ।
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস- ড. আব্দুল করীম।
বরেন্দ্র অঞ্চলে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য- ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী।
Tuesday 22 February 2022
দারসুল কোরআনঃ সূরা: আত্ তাওবা। আয়াত:১১১-১১২
দারসুল কোরআন
বিষয়: ইসলামী আন্দোলন তথা, বায়আতের গুরুত্ব
সূরা: আত্ তাওবা। আয়াত:১১১-১১২
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّلَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَۖ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ ۚ وَمَنْأَوْفَىٰ بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ ۚ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِيبَايَعْتُم بِهِ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
﴿التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَالسَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِوَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ﴾(১১২)
আয়াতের অনুবাদ:
(১১১) প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই কর এবং মারে ও মরে । তাদের প্রতি তাওরাত, ইন্জিল ও কুরআনে (জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়্দাা বিশেষ। আর আল্লাহর চাইতে বেশী ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে ? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনা বেছা করছো সে জন্য আনন্দ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।
(১১২) আল্লাহর দিকে বার বার প্রত্যাগমনকারী, তার ইবাদত কারী,তার প্রশংসা বাণী উচ্চারণ কারী, তার সামনে রুকু কারী ও সেজদা কারী, সৎ কাজের আদেশ কারী, অসৎ কাজ থেকে বিরতকারী এবং আল্লাহর সীমা সংরক্ষনকারী (সেই সব মুমিন হয়ে থাকে যারা আল্লাহর সাথে কেনা বেচার সওদা করে)। আর হে নবী! এ মুমিনদেরকে সুখবর দাও!
সূরা আত্ তাওবার নাম করন:
এ সূরাটির দু’টি নামে পরিচিত: আত্ তাওবাহ ও আল বারাআতু। তাওবা নাম করনের কারণ, এ সূরার ১১৮ নং আয়াতে কতিপয় ঈমানদারের গোনাহ মাফ করে তাওবা বতবুল করার কথ বলা হয়েছে। আর এর শুরুতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষনা করা হয়েছে বলে একে বারায়াত (অর্থাৎ সম্পর্কচ্ছেদ) নামে অভিহিত করা হয়েছে।
সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ না লেখার কারণ:
১.এটা যখন সংকলন করা হয় তখন সাহাবীদের মধ্যে মতা নৈক্য দেখা দেয়- কেহ কেহ বলেন এই সূরা আনফালের অংশ অথবা কেহ কেহ বলেন- আলাদা সূরা।
২.বিসমিল্লাহ্ হলো রহমত কামনা ও নিরাপত্তার জন্য, আর এ সূরার মধ্যে কাফের মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা হয়েছে, তাই বিসমিল্লাহ্ লেখা হয়নি।
৩.ইমাম কায়েশী বলেণ- জিব্রাঈল(আ.) এই সূরা নাযিলের সময় বিসমিল্লাহ নিয়ে আসেন নাই তাই।
৪.ইমাম রাযী বলেন- নবী করিম (স:) নিজেই এর শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখেন নি, কাজেই সাহাবা কেরাম ও লেখেন নি এবং পরবর্তী লোকেরা ও এ রীতি অনুসরণ অব্যাহত রেখেছেন। পবিত্র কুরআন যে নবী (স:) থেকে হুবুহু ও সামান্যতম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই গ্রহন করা হয়েছিল এবং যে ভাবে তিনি দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই তাকে সংরক্ষন করার জন্য যে সর্বোচ্ছ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে এটি তার একটি প্রমাণ।
সূরা আত্ তাওবা নাযিলের সময়কাল: এ সূরা ৩টি ভাষনে নাযিল হয়।-
প্রথম ভাষণ: ১ম হতে ৫ম রুকুর শেষ পযর্ন্ত। এ অংশ ৯ম হিজরীর যিলক্বদ মাসে নাযিল হয়।
২য় ভাষণ: ৬ষ্ঠ রুকু থেকে ৯ম রুকুর শেষ পযর্ন্ত , ৯ম হিজরীর রজব মাসে নাযিল হয়।
তৃতীয় ভাষণ:১০ম রুকু থেকে সূরার শেষ পযর্ন্ত তাবুক যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন কালে অবতীর্ণ হয়।
সূরা আত্ তাওবার বিষয় বস্তু:
* বিধর্মীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে (১ম রুকু)।
* তাবুক যুদ্ধের অভিযান (৬ষ্ঠ-১০ম রুকু)।
* মুনাফিকদের পরিণাম ও পরলৌকিক শাস্তি।(৪২-৪৩,৪৭-৫৯,৬১-৬৮,৭৪-৯০,৯৩-৯৮,১০১,১০৭-১১০,১২৪ ও ১২৭ আয়াত)
* মসজিদে জেরার নির্মাণের পরিণাম ও উহা ধ্বংস করার নির্দেশ ( ১০৮ নং আয়াত)।
ক্স শহীদের মর্যাদা, মাহাত্ম সৎপথে অর্থ ব্যয় এর পরিণাম (১৪তম রুকু)।
আলোচ্য আয়াতগুলোর শানে নুযুল: অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে ‘বায়আতে আকাবায়’ অংশগ্রহনকারী লোকদের ব্যাপারে।এ বায়’আত নেয়া হয়েছিল মক্কায় মদীনার আনসারদের থেকে। তাই এই সূরাটি মাদানী হওয়া সত্ত্বে ও এ আয়াতগুলোকে মাক্কী বলা হয়েছে।
আকাবা: “এখানে আকাবা বলতে বোঝায় মিনার জমরায়ে আকাবার সাথে মিলিত পর্বতাংশকে”। এখানে মদীনা থেকে আগত আনসারগণের তিন দফায় বায়আত নেয়া হয়।
* ১ম দফা নেয়া হয় নবুয়তের একাদশ বছরে, তখন মোট ৬ জন লোক ইসলাম গ্রহন করে মদীনায় ফিরে যায়। এত মদীনার ঘরে ঘরে ইসলাম ও নবী করীম (স.) -এর চর্চা শুরু হয়।
* ২য় দফায় পরবর্তী বছর হজ্জ্বের মৌসুমে পূর্বের ৫ জন সহ মোট ১২ জন নবী করিম (স.) এর হাতে বায়আত গ্রহন করে। আর এভাবে মদীনায় মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে (৪০ জনের ও বেশী)। ফলে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে নবী করিম (স.) হযরত মোসআব বিন উমাইর (রা:) কে কোরআন তালিমের জন্য প্রেরণ করেন।
ক্স ৩য় দফায় নবুয়তের ত্রয়োদশ বছর ৭০ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সহ ৩য় ও সর্বশেষ বায়আত এ আকাবায় অনুষ্ঠিত হয়। ‘সাধারণত একেই বায়’আতে আকাবা বলা হয়।
আয়াতের ব্যাখ্যা : ১১১ নং আয়াত-
* ১১১ নং আয়াতটি-ই জিহাদ সংক্রান্ত ১ম আয়াত। কারন মুহাম্মদ (স.) মক্কায় অবস্থান কালে এ পযর্ন্ত জিহাদ সংক্রান্ত কোন হুকুম নাযিল হয়নি।
* জিহাদ অর্থ :-
* জিহাদের সংজ্ঞা:-
* জিহাদের স্তর : ৫ টি-
১. দাওয়াত ইলাল্লাহ।
২. শাহাদাৎ আলান্ নাস।
৩. কিতাল ফি-সাবিলিল্লাহ।
৪. আমল বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার।
৫. ইক্বামতে দ্বীন।
যেমন- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-﴿تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِبِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْتَعْلَمُونَ﴾
“তোমরা আল্লাহ ও রাসুল (স.) এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবন বাজি রেখে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম; যদি তোমরা বুঝতে পার”। (আস্ সফ-১১)
জিহাদের সফলতা:
* আখেরাতের সফলতা: আল্লাহ বলেন-﴿فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَابِالْآخِرَةِ ۚ وَمَن يُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْفَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا﴾
“(এ সব লোকদের জেনে রাখা উচিত যে) আল্লাহর পথে লড়াই করা সে সব লোকদেরই কর্তব্য, যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রি করে দেয়। যারা আল্লাহর পথে লড়াই করবে ও নিহত হবে কিংবা বিজয়ী হবে, অচিরেই তাকে আমি বিরাট পুরষ্কার দান করব”।(সূরানিসা: ৭৪)
ক্স ﴿يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَاالْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُالْعَظِيمُ﴾
“আল্লাহ তোমাদেও সব গুণাহ মাফ কওে দিবেন এবং তোমাদের এমন বাগানে প্রবেশ করাবেন যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাদ্বারা বহে চলবে।আর চির স্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন। এটাই বড় সফলতা”। ( আছ্ ছফ-১২)
* তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করা হবে যার নেয়ামত সমূহ অশেষ ও চিরন্তন। (আছ্ ছফ:১২-১৩)
শহীদের মর্যাদা:
* প্রথম রক্তপাতেই তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
* জান্নাতে তার স্থান তাকে দেখানো হবে (কবরে)।
* কবরের আযাব থেকে তাকে রক্ষা করা হবে।
* ‘কবরে’ বড় বিপদ আপদ থেকে নিরাপদ থাকবে।
* হাশরের ময়দানে তার মাথায় একটা আকর্ষনীয় মূকুট পড়ানো হবে।
* তাকে তার ৭০ জন আত্মীয়ের শাফায়াতের অনুমতি দেয়া হবে।
বাইয়াত: আভিধানিক অর্থ- ক্রয়- বিক্রয়, লেন-দেন, চুক্তি, আনুগত্যের শপথ, অঙ্গীকার, নেতৃত্ব মেনে নেয়া। একে ইংরেজীতে বলা হয়- ঞড় ংবষষ, ঞড় নুঁ, ঞড় সধশব ধ পড়হঃৎধপঃ, অমৎববসবহঃ, অৎৎধহমবহসবহঃ, ইঁংরহবংং ফবধষ.
পরিভাষায়- “আল্লাহর সন্তুষ্টি অজর্নের লক্ষ্যে নিজের জান ও মালকে ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলের নিকট আনুগত্যের শপথের মাধ্যমে আল্লাহর পথে সপে দেয়ার ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতির নাম বাইয়াত”।
( ফাতহ-১০, ১৮)
إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِفَوْقَ أَيْدِيهِمْ ۚ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنكُثُ عَلَىٰ نَفْسِهِ ۖ وَمَنْأَوْفَىٰ بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ فَسَيُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا(১০)
لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَالشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْوَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا(১৮)
বাইয়াতের ব্যাপক অর্থ-
* আল্লাহর সাথে জান মালেন চুক্তি। -আত্ তাওবা:১১
* আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশে শপথ। -
সকল ধরনের হারাম বা নিষেধকৃত কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখার চুক্তি। - মুমতাহিন: ১২﴿يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُيُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍيَفْتَرِينَهُ بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِيمَعْرُوفٍ ۙ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌرَّحِيمٌ﴾
১২) হে নবী, ঈমানদার নারীগণ যখন তোমার কাছে বাইয়াত গ্রহণরে জন্য আসে এবং এ র্মমে প্রতশ্রিুতি দয়ে য,ে তারা আল্লাহর সাথে কোন কছিুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, যনিা করবে না, নজিদেরে সন্তানদরে হত্যা করবে না৷ সন্তান সর্ম্পকে কোন অপবাদ তরৈী করে আনবে না৷ এবং কোন ভাল কাজে তোমার অবাধ্য হবে না৷ তাহলে তাদরে থকেে বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাদরে মাগফরিাতরে জন্য দোয়া করো৷ নশ্চিয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মহেরেবান৷
বাইয়াতের গুরুত্ব:
* নফ্স বা প্রবৃত্তি।
* ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।
* ইবলিশ।
রাসূল (স.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি বাইয়াত ছাড়া মারা যাবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)
বাইয়াতের ফজিলত:
ক্স আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা বাস্তবায়ন এবং দুনিয়ার জীবনের চেয়ে পরকালের জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য। (আন্ নিসা-৭৪)
* আল্লাহর মাগফিরাত। ( আল ইমরান- ১৩৩, হাদীদ-১১৬)
* সর্বোচ্চ ঈমানের অধিকারী হওয়া। (আল ইমরান-১০২)
* পরকালীন নিশ্চিত সফলতার গ্যারান্টি। (আলা- ১৪, শামস্-৯)
* জাহান্নামের আগুন থেকে বাচার জন্য। ( আস্ সফ-৯, শামস্-৯)
বাইয়াত কার নিকট করতে হবে:
* আল্লাহর নিককট।
* রাসূল (স.) এর নিকট।
* রাসূলের (স.) এর অবর্তমানে ইসলামী সংগঠনের নিকট।
বাইয়াতের অবস্থা:
* ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়া নামক স্থানে সাহাবীরা রাসূল (স.) এর হাতে বাবলা গাছের নীচে হযরত ওসমান (রা:) হত্যার সংবাদে যে বাইয়াত গ্রহন করেন, তাকে বাইয়াতুল রিদওয়ান বলে।
* রাসূল (স.) এর ইন্তেকালের পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের হাতে মুসলিম মিল্লাতের বাইয়াত গ্রহন মুসলিম জাতির জন্য বাস্তব দৃষ্টান্ত।
বাইয়াত পরিহার করার পরিণাম:
* পরকালে পীড়াদায়ক শাস্তি। (বনী ইসরাঈল-৩৪, আন্ নাহল-৯১)
* জাহেলিয়াতের মৃত্যু।
* কিয়ামতের ময়দানে অপমান জনক চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করবেন।
সূরা আত্ তাওবার ১১১ নং আয়াতে মৌলিকভাবে তিনটি কথা উল্লেখ যোগ্য। সেগুলো হল-
প্রথমত: আল্লাহর সাথে মুমিনদের ক্রয়-ব্ক্রিয়ের চুক্তি।
দ্বিতীয়ত: চুক্তি সম্পাদক করা মুমিনদের কাজ। আর সেটা হচ্ছে- জিহাদ ফি-সাবিলিল্লাহ। যার ধরন হলো মরবে ও মারবে।
(সূরা তাওবা-৪১, আন নিসা-৭১ নং আয়াত)
তৃতীয়ত: মুমিনগণ আল্লাহর সাথে যে বাইয়াত বা চুক্তি সম্পাদন করেছে তাদের জন্য সুসংবাদ এজন্যই যে, আল্লাহর এ জান্নাতের ওয়াদা সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত। আর আল্লাহর চাইতে অধিক প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী কেউ নেই।
১১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১১২ নং আয়াতে বাইয়াত গ্রহনকারী মুমিনদের ৮ টি গুনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ১ম সাতটি গুণের সংক্ষিপ্ত সার হলো ৮ম গুণ।
* আত্ তা‘য়িবুনা - তাওবাকারীগণ। অর্থাৎ যারা অপরাধ করার পর অনুতপ্ত হয়ে কৃত অপরাদের ক্ষমা চেয়ে তা আর না করার ওয়াদা করে। (সূরা আল ইমরান- ৯০,১৩৫; নিসা- ১৭,১১০; আন আম- ৫৪; আরাফ-১৫৩;মুমিন-৩; আস্শুরা- ২৫; নাহল-১১৯;)
* আল আবিদুনা - ইবাদতকারীগণ।
* আল হামিদুনা - প্রশংসাকারীগণ, শুকরিয়াকারীগণ। অর্থাৎ যারা বিপদে-মুসিবতে, সুখে-দুখে, সবসময় আল্লাহর পশংসা করে। সূরা নসর-৩
* আছ্ ছা‘য়িহুনা - পরিভ্রমণকারীগণ। কারো কারো মতে রোজা পালনকারীগণ। এখানে ইসলামের জন্য, জিহাদের জন্য ও হালাল রুজির জন্য ভ্রমন ও হতে পারে। ইসলাম পূর্ব যুগে খ্রীস্ট ধর্মে দেশ ভ্রমণকে ইবাদত মনে করা হতো। ইসলাম ধর্মে একে বৈরাগ্যবাদ বলে অভিহিত করে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে এবং এর পরিবর্তে রোযা পালনকে এর স্থলাভিসিক্ত করা হয়েছে। কারন দেশ ভ্রমনের উদ্দেশ্য সংসার ত্যাগ। অথচ রোযা এমন এক এবাদত, যা পালন করতে গিয়ে যাবতীয় পার্থিব বাসনা ত্যাগ করতে হয় এর ভিত্তিতে কতিপয় বণর্নাকরী জিহাদকে ও দেশ ভ্রমনের অনুরুপ বলা হয়। রাসূল (স.) বলেছেন- আমার উম্মতের দেশ ভ্রমণ হলো জিহাদ ফি-সাবিলিল্লাহ। (ইবনে মাজা ও বায়হাকী)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, কুরআন মাজীদে ব্যবহ্নত ‘সা‘য়িহুন’ অর্থ রোযাদার। হযরত ইকরামা (রা:) এ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন যে, এরা হলো দ্বীনের শিক্ষার্থী, যারা এলম হাসিলের জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে বের পয়ে পড়ে।
* র্আ রা‘কিয়ূনাস্ সাজিদুনা - রুকুকারী ও সিজদাকারীগণ। অর্থাৎ যারা নামাজ কায়েম করে। যেমন- সূরা হজ্জ: ৭৭, লোকমান: ১৭, আন কাবুত: ৪৫।
* আল আ‘মীরুনা বিল মা‘রুফ - সৎ কাজের আদেশ দানকারী এবং ভালো কাজের নির্দেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ কারী।
* আন্ নাহু না আনীল মুনকার - মন্দ ও খারাপ কাজের বাধাদান কারী।
* আল হাফিজুনা লি-হুদুদিল্লাহ - আল্লাহর সীমা হিফাজত কারী, সংরক্ষনকারীগণ, আল্লাহর নিষেধ যথাযথভাবে পালনকারীগণ।
---- প্রথম সাতটি গুণের মধ্যে যে তফসিল রয়েছে , তার সংক্ষিপ্ত সার কথা হলো এ যে - এরা নিজেদের প্রতিটি কর্ম ও কথায় আল্লাহর নির্ধারিত তথা শরীয়তর হুকুমের অনুগত ও হেফাজতকারী।
শিক্ষনীয় দিকঃ
১. আল্লাহর তায়ালা মুমিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন।
২. আল্লাহর পথে জিহাদ করতে হবে, মরলে শহীদ বাচলে গাজী।
৩. জিহাদের বিনিময়ে জান্নাত এটা আল্লাহর পাকাপোক্ত ওয়াদা।
৪. আল্লাহর পথে জিহাদ করলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গায় সফলতা লাভ করা যায়।
৫. মুমিনদের জীবনের একমাত্র কামনা হওয়া উচিত আল্লাহর পথে জিহাদ।
৬. মুমিনের যে গুণগুলোর কথা বলা হয়েছে এগুলো পুরোপুরি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা।
Thursday 10 February 2022
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা সূচনা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মাধ্যমে
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা সূচনা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মাধ্যমে
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮২১-৫৯) ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-৮৭) প্রমুখের বিভিন্ন কাব্যে-লেখনীতে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ও জাতি বিদ্বেষ বারবার এসেছে। তাদের রচনায় মুসলিমরা হীনভাবে চিত্রিত ও উপস্থাপিত। সাহিত্যে জাতি দ্বেষণায় সূত্রপাত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হাত ধরে। কবির লেখনীতে মুসলমানরা হয় ‘যবন’, নয় ‘নেড়ে’। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময় মুসলমানদের ভূমিকায় কবি ক্ষুব্ধ। সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদকীয়তে লিখলেন, “অবােধ যবনেরা উপস্থিত বিদ্রোহের সময়ে গভর্ণমেন্টের সাহায্যার্থে কোন প্রকার সদানুষ্ঠান না করাতে তাহারদিগের রাজভক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতাচরণ প্রচার হইয়াছে এবং বিজ্ঞ লােকেরা তাহারদিগকে নিতান্ত অকৃতজ্ঞ জানিয়াছেন…।”১০ কবির চোখে বিদ্রোহী মাত্রেই ক্ষমার অযােগ্য অপরাধী। তাই মহাবিদ্রোহের অন্যতম নেতা নানাসাহেব তার কাছে ‘পুষ্যি এঁড়ে দস্যি ভেড়ে’। অবশ্য কবির মতে, আসল ‘নরাধম’ হচ্ছে নেড়েরা। ১৮৫৭-এ ‘কানপুরের যুদ্ধে জয়’ কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখলেন,
“মর্জি তেড়া কাজে ভেড়া
নেড়া মাথা যত।।
নরাধম নীচ নাই নেড়েদের মত।”
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যেভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রচার করেছিলেন তা ‘উদার মধ্যপন্থী’ সাংবাদিকের পরিচয় নয়, “…যখন দাড়ধারী নাড়ুর পােলা আসিয়া ‘ইয়া হুসেন’, ‘ইয়া হুসেন’ বলিয়া বুক চাপড়াইয়া দুপুরে মাতন করিতেছে, তখন হিন্দু কলেজের হিন্দুত্বনাশের আর কি অপেক্ষা রহিল?”
তিনি এই কলেজে ভরতি হওয়া খ্রীষ্টান ও মুসলিম ছাত্রদের যথাক্রমে ‘ঈশুর খােকা’ ও ‘মহম্মদের খােকা’ বলে কটুক্তিও করেন। তিনি চাইতেন, হিন্দু কলেজে (১৮১৭) কেবল হিন্দুরাই পড়ুক, অন্যেরা নয়।১১
সাহিত্যে জাতিবিদ্বেষ, ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা / ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
চিত্রঃ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, Image Source: ekhonkhobor
বিশেষ করে ‘যবন’, ‘নেড়ে’-রাই যে ইংরেজ রাজত্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রধান কারণ এ তথ্যও তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন। তাঁর কাছে বিদ্রোহী সিপাহীদের কার্যাবলি কিছুতেই অনুমােদনযােগ্য নয়। সুতরাং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাঙালি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বললেন, তাদের যুদ্ধে যেতে হবে না, কেবল ‘রাজপুরুষগণের মঙ্গলার্থে স্বস্ত্যয়ন করতে হবে,
“জগদীধর আপন ইচ্ছায় বিদ্রোহীদিগ্যে শাসন করুন, যাহারা বিদ্রোহী হয় নাই, তাহারদিগের মঙ্গল করুন, কোন কালে যেন তাহারদিগের মনে রাজভক্তির ব্যতিক্রম না হয়। হে ভাই, আমারদিগের শরীরে বল নাই, মনে সাহস নাই, যুদ্ধ করিতে জানি না, অতএব প্রার্থনাই আমারদিগের দুর্গ, ভক্তি আমারদিগের অস্ত্র এবং নাম জপ আমারদিগের বল, এতদ্বারাই আমরা রাজ-সাহায্য করিয়া কৃতকার্য হইব।”
সাম্প্রদায়িক চেতনা ব্রিটিশদের অলিখিত ‘সভাকবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনাতে স্পষ্ট। গুপ্তকবি ‘সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদকীয়তে জানিয়েছেন,
“..যবনের মধ্যে যে সকল বিবেচক লােক আছেন তাঁহারা আমারদিগের এই লেখাতে ক্রোধ করিবেন না, অবশ্য দুঃখিত হইবেন, তাঁহারা আমারদিগের এই লেখার লক্ষ্যস্থল নহেন, তাহারদিগের সংখ্যা অধিক নহে, সুতরাং তাহারা এ বিষয়ে কিছুই করিতে পারেন না। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের যে সকল স্থানে বিদ্রোহানল প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। তাবত স্থানেই যবনেরা অস্ত্র ধারণপূর্বক নিরাশ্রয় সাহেব বিবি বালক বালিকা এবং প্রজাদিগের প্রতি হৃদয় বিদীর্ণকর নিষ্ঠুরাচরণ করিয়াছে, সাহেবের মধ্যে অনেকে আপনাপন বহুকালের যবন ভৃত্যের দ্বারা হত হইয়াছেন, অধুনা যবন প্রজাদিগের গবর্ণমেন্টের এমত অবিশ্বাস জন্মিয়াছে যে এই নগরে যে স্থানে অধিক যবনের বাস সেই স্থানেই অধিক রাজপ্রহরী নিযুক্ত হইয়াছে, নাগর্য বলন্টিয়ার সেনাগণ অতি সতর্কভাবে মাদরাসা কলেজ রক্ষা করিতেছেন, যবনদিগের অন্তঃকরণে কি কারণে গবর্ণমেন্টের প্রতি বিরূপ ভাবের আবির্ভাব হইয়াছে তাহা আমরা কিছুই নিরূপণ করিতে পারিলাম না।”১২
বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভিন্ন সামরিক পদ এবং বিভিন্ন এলাকা শাসনে বহু বেসামরিক পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘গুপ্ত কবি’ সাম্প্রদায়িকতার বিষ উদ্গিরণ করলেন,
“…বাবাজীদের রাজ্য তাে পাঁচপােয়া কিন্তু কালেক্টর, মেজিষ্ট্রেট, জজ, দেওয়ান, খাজাঞ্চি সঙ্গে সঙ্গেই রহিয়াছে, আহা! নেড়ে চরিত্র বিচিত্র, ইহারা অদ্য জুতা গড়িতে গড়িতে কল্য ‘সাহাজাদ’ ‘পিরজাদা’ ‘খানজাদা’ ‘নবাবজাদ’ হইয়া উঠে, রাতারাতি একে আর এক হইয়া বসে, যাহা হউক বাবাজীদের মুখের মতন হইয়াছে, জঙ্গের রঙ্গ দেখিয়া অন্তরঙ্গভাবে গদগদ হইয়াছিলেন, এদিকে জানেন না, যে ‘বাঙ্গাল’ বড় হেঁয়াল…।”১৩
ধর্মাচার সম্পর্কিত কবিতায় প্রাচীন রক্ষণশীল সনাতন হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের তীব্র উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বক্তব্য যায় যায় ‘হিন্দুয়ানি আর নাহি থাক’। এখানে মুসলিমদের প্রতি কটাক্ষর ইঙ্গিত স্পষ্ট। ‘আচার ভ্রংশ’ কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন,
“কালগুণে এই দেশে বিপরীত সব।
দেখে শুনে মুখে আর নাহি সরে রব।।
এক দিকে দ্বিজ তুষ্ট গােল্লাভােগ দিয়া।
আর দিকে মােল্লা বসে মুর্গি মাস নিয়া।।
এক দিকে কোশাকুশি আয়ােজন নানা।
এক দিকে টেবিল ডেবিল খায় খানা।।”
মুসলিমদের হেয় করতে কবি ঈশ্বরচন্দ্র নিজে বা কারাের গােপন ইঙ্গিতে লিখলেন,
“একেবারে মারা যায় যত চাপদেড়ে (দাড়িওয়ালা) ।
হাসফাঁস করে যত প্যাজখাের নেড়ে।।
বিশেষতঃ পাকা দাড়ি পেট মােটা ডুড়ে।
রৌদ্র গিয়া পেটে ঢােকে নেড়া মাথা ছুঁড়ে।
কাজি কোল্লা মিয়া মােল্লা দাড়ি পাল্লা ধরি।
কাছা খােল্লা তােবাতাল্লা বলে আল্লা মরি।।
দাড়ি বয়ে ঘাম পড়ে বুক যায় ভেসে।
বৃষ্টি জল পেয়ে যেন ফুটিয়াছে কেশে।।
বদনে ভরিছে শুধু বদনার নল।
দে জল দে জল বাবা দে জল দে জল।।” (ঋতুবর্ণন’)
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ যখন ব্রিটিশ সরকার দমনে সমর্থ হতে লাগল তখন ইংরেজদের যুদ্ধ জয়ে রাজভক্ত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সানন্দে পদ্য রচনা করলেন মুসলিম বিদ্রোহীদের প্রতি তীব্রভাবে বিদ্রুপ করে,
“হেল্লা করে কেল্লা লুঠে দিল্লীর ভিতরে।
জেল্লা মেরে বেড়াইত অহঙ্কার ভবে।।
এখন সে কেল্লা কোথা হেল্লা কোথা আর!
জেল্লা মেরে কেবা দেয় দাড়ির বাহাব ছড়ে
পাল্লা বলে আল্লা পড়েছি বিপাকে।
কাছাখােল্লা যত মােল্লা তােবা তাল্লা ডাকে।।
সবার প্রধান হয়ে যে তুলেছে খড়ি।
দিল্লীর দুর্গেতে থেকে গুণিয়াছে কড়ি।।
হইয়া হুজুর আলি হাতে নিয়ে ছড়ি।।
করেছে হুকুম জারি তাজি ঘােড়া চড়ি।…
ধরিয়াছে রাজবেশ পরে টুপী জামা।
কোথা সেই কালনিমে রাবণের মামা।।”
(আগ্রার যুদ্ধ’)।
মুসলিমদের প্রতি কটুক্তি করে ঈশ্বরচন্দ্র আরও লিখলেন,
“দিশি পাতি নেড়ে যারা, তাতে পুড়ে হয় সারা।
মলাম মলাম মামু কয়।
হ্যাঁদুবাড়ি খেনু ব্যাল,
প্যাটেতে মাখিনু ত্যাল
নাতি তবু নিদ নাহি হয়।।” (ঋতুবর্ণন’)
এক সময় অত্যাচারী ইংরেজরা যখন মুসলমানদের হাতে মার খাচ্ছিল তখন বেদনায় ব্যথিত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখলেন
“দুর্জয় যবন নষ্ট,
করিলেক মান ভ্রষ্ট
সব গেল ব্রিটিশের ফেম।…
শুকাইল রাঙা মুখ
ইংরাজের এত দুখ,
ফাটে বুক হায় হায় হায়।”
(‘কাবুলের যুদ্ধ’)
‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদকের কামনা ছিল মুসলমানরা পরাজিত হয়ে ইংরেজরা যেন জয়ী হয়, তাই লিখলেন
“যবনের যত বংশ,
একেবারে হবে ধ্বংস
সাজিয়াছে কোম্পানীর সেনা।
গরু জরু লবে কেড়ে
চাঁপদেড়ে যত নেড়ে
এই বেলা সামাল সামাল।”
(কাবুলের যুদ্ধ’)
‘হেমন্তে বিবিধ খাদ্য’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর একটি দীর্ঘ কবিতা। এই কবিতায় সকল খাদ্যের গুণাগুণের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এর মধ্যে গম ও পেঁয়াজ প্রসঙ্গে যবনের কথা এসেছে। গম সকলের প্রিয় খাদ্য,
“হিন্দু ম্লেচ্ছ যবনাদিযত জাতি আছে।
এ যবন প্রিয়তম সকলের কাছে।।
ভূমিতলে না হইলে যবনের চারা।
যবনের দেশে নরে প্রাণে যেত মারা।।”
এই কবিতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় চরণে ‘যবন’-র অর্থ ‘গম’—‘যবনের’ পাদটীকায় ঈশ্বরচন্দ্র একথা বলেছেন। ‘যবনের দেশ’ বলতে কবি বিদেশকে বুঝিয়েছেন। পেঁয়াজ প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিশেষভাবে মুসলিমদের প্রতি কটাক্ষ করেছেন,
“যবনে ভবনে আনে যত্ন করি নানা।
তাহার সংযােগ বিনা জাঁকে নাক খানা।।
লুকোচুরী খেলা তার হিন্দুর নিকটে।
গােপনে করেন বাস বাবুদের পেটে।।…
পাজখাের যারা তারা আহারে সন্তোষ।
লােম কুঁড়ে গন্ধ ছুটে এই বড় দোষ।।”