Thursday 10 February 2022

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা সূচনা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মাধ্যমে

 বাংলা সাহিত্যে মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা সূচনা   ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মাধ্যমে 



ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮২১-৫৯) ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-৮৭) প্রমুখের বিভিন্ন কাব্যে-লেখনীতে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ও জাতি বিদ্বেষ বারবার এসেছে। তাদের রচনায় মুসলিমরা হীনভাবে চিত্রিত ও উপস্থাপিত। সাহিত্যে জাতি দ্বেষণায় সূত্রপাত হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হাত ধরে। কবির লেখনীতে মুসলমানরা হয় ‘যবন’, নয় ‘নেড়ে’। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময় মুসলমানদের ভূমিকায় কবি ক্ষুব্ধ। সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদকীয়তে লিখলেন, “অবােধ যবনেরা উপস্থিত বিদ্রোহের সময়ে গভর্ণমেন্টের সাহায্যার্থে কোন প্রকার সদানুষ্ঠান না করাতে তাহারদিগের রাজভক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতাচরণ প্রচার হইয়াছে এবং বিজ্ঞ লােকেরা তাহারদিগকে নিতান্ত অকৃতজ্ঞ জানিয়াছেন…।”১০ কবির চোখে বিদ্রোহী মাত্রেই ক্ষমার অযােগ্য অপরাধী। তাই মহাবিদ্রোহের অন্যতম নেতা নানাসাহেব তার কাছে ‘পুষ্যি এঁড়ে দস্যি ভেড়ে’। অবশ্য কবির মতে, আসল ‘নরাধম’ হচ্ছে নেড়েরা। ১৮৫৭-এ ‘কানপুরের যুদ্ধে জয়’ কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখলেন,


“মর্জি তেড়া কাজে ভেড়া


নেড়া মাথা যত।।


নরাধম নীচ নাই নেড়েদের মত।”


ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যেভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রচার করেছিলেন তা ‘উদার মধ্যপন্থী’ সাংবাদিকের পরিচয় নয়, “…যখন দাড়ধারী নাড়ুর পােলা আসিয়া ‘ইয়া হুসেন’, ‘ইয়া হুসেন’ বলিয়া বুক চাপড়াইয়া দুপুরে মাতন করিতেছে, তখন হিন্দু কলেজের হিন্দুত্বনাশের আর কি অপেক্ষা রহিল?”


তিনি এই কলেজে ভরতি হওয়া খ্রীষ্টান ও মুসলিম ছাত্রদের যথাক্রমে ‘ঈশুর খােকা’ ও ‘মহম্মদের খােকা’ বলে কটুক্তিও করেন। তিনি চাইতেন, হিন্দু কলেজে (১৮১৭) কেবল হিন্দুরাই পড়ুক, অন্যেরা নয়।১১


সাহিত্যে জাতিবিদ্বেষ, ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা / ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

চিত্রঃ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, Image Source: ekhonkhobor

বিশেষ করে ‘যবন’, ‘নেড়ে’-রাই যে ইংরেজ রাজত্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রধান কারণ এ তথ্যও তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন। তাঁর কাছে বিদ্রোহী সিপাহীদের কার্যাবলি কিছুতেই অনুমােদনযােগ্য নয়। সুতরাং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাঙালি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বললেন, তাদের যুদ্ধে যেতে হবে না, কেবল ‘রাজপুরুষগণের মঙ্গলার্থে স্বস্ত্যয়ন করতে হবে,


“জগদীধর আপন ইচ্ছায় বিদ্রোহীদিগ্যে শাসন করুন, যাহারা বিদ্রোহী হয় নাই, তাহারদিগের মঙ্গল করুন, কোন কালে যেন তাহারদিগের মনে রাজভক্তির ব্যতিক্রম না হয়। হে ভাই, আমারদিগের শরীরে বল নাই, মনে সাহস নাই, যুদ্ধ করিতে জানি না, অতএব প্রার্থনাই আমারদিগের দুর্গ, ভক্তি আমারদিগের অস্ত্র এবং নাম জপ আমারদিগের বল, এতদ্বারাই আমরা রাজ-সাহায্য করিয়া কৃতকার্য হইব।”


সাম্প্রদায়িক চেতনা ব্রিটিশদের অলিখিত ‘সভাকবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনাতে স্পষ্ট। গুপ্তকবি ‘সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদকীয়তে জানিয়েছেন,


“..যবনের মধ্যে যে সকল বিবেচক লােক আছেন তাঁহারা আমারদিগের এই লেখাতে ক্রোধ করিবেন না, অবশ্য দুঃখিত হইবেন, তাঁহারা আমারদিগের এই লেখার লক্ষ্যস্থল নহেন, তাহারদিগের সংখ্যা অধিক নহে, সুতরাং তাহারা এ বিষয়ে কিছুই করিতে পারেন না। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের যে সকল স্থানে বিদ্রোহানল প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। তাবত স্থানেই যবনেরা অস্ত্র ধারণপূর্বক নিরাশ্রয় সাহেব বিবি বালক বালিকা এবং প্রজাদিগের প্রতি হৃদয় বিদীর্ণকর নিষ্ঠুরাচরণ করিয়াছে, সাহেবের মধ্যে অনেকে আপনাপন বহুকালের যবন ভৃত্যের দ্বারা হত হইয়াছেন, অধুনা যবন প্রজাদিগের গবর্ণমেন্টের এমত অবিশ্বাস জন্মিয়াছে যে এই নগরে যে স্থানে অধিক যবনের বাস সেই স্থানেই অধিক রাজপ্রহরী নিযুক্ত হইয়াছে, নাগর্য বলন্টিয়ার সেনাগণ অতি সতর্কভাবে মাদরাসা কলেজ রক্ষা করিতেছেন, যবনদিগের অন্তঃকরণে কি কারণে গবর্ণমেন্টের প্রতি বিরূপ ভাবের আবির্ভাব হইয়াছে তাহা আমরা কিছুই নিরূপণ করিতে পারিলাম না।”১২


বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভিন্ন সামরিক পদ এবং বিভিন্ন এলাকা শাসনে বহু বেসামরিক পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘গুপ্ত কবি’ সাম্প্রদায়িকতার বিষ উদ্‌গিরণ করলেন,


“…বাবাজীদের রাজ্য তাে পাঁচপােয়া কিন্তু কালেক্টর, মেজিষ্ট্রেট, জজ, দেওয়ান, খাজাঞ্চি সঙ্গে সঙ্গেই রহিয়াছে, আহা! নেড়ে চরিত্র বিচিত্র, ইহারা অদ্য জুতা গড়িতে গড়িতে কল্য ‘সাহাজাদ’ ‘পিরজাদা’ ‘খানজাদা’ ‘নবাবজাদ’ হইয়া উঠে, রাতারাতি একে আর এক হইয়া বসে, যাহা হউক বাবাজীদের মুখের মতন হইয়াছে, জঙ্গের রঙ্গ দেখিয়া অন্তরঙ্গভাবে গদগদ হইয়াছিলেন, এদিকে জানেন না, যে ‘বাঙ্গাল’ বড় হেঁয়াল…।”১৩


ধর্মাচার সম্পর্কিত কবিতায় প্রাচীন রক্ষণশীল সনাতন হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের তীব্র উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বক্তব্য যায় যায় ‘হিন্দুয়ানি আর নাহি থাক’। এখানে মুসলিমদের প্রতি কটাক্ষর ইঙ্গিত স্পষ্ট। ‘আচার ভ্রংশ’ কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন,


“কালগুণে এই দেশে বিপরীত সব।


দেখে শুনে মুখে আর নাহি সরে রব।।


এক দিকে দ্বিজ তুষ্ট গােল্লাভােগ দিয়া।


আর দিকে মােল্লা বসে মুর্গি মাস নিয়া।।


এক দিকে কোশাকুশি আয়ােজন নানা।


এক দিকে টেবিল ডেবিল খায় খানা।।”


মুসলিমদের হেয় করতে কবি ঈশ্বরচন্দ্র নিজে বা কারাের গােপন ইঙ্গিতে লিখলেন,


“একেবারে মারা যায় যত চাপদেড়ে (দাড়িওয়ালা) ।


হাসফাঁস করে যত প্যাজখাের নেড়ে।।


বিশেষতঃ পাকা দাড়ি পেট মােটা ডুড়ে।


রৌদ্র গিয়া পেটে ঢােকে নেড়া মাথা ছুঁড়ে।


কাজি কোল্লা মিয়া মােল্লা দাড়ি পাল্লা ধরি।


কাছা খােল্লা তােবাতাল্লা বলে আল্লা মরি।।


দাড়ি বয়ে ঘাম পড়ে বুক যায় ভেসে।


বৃষ্টি জল পেয়ে যেন ফুটিয়াছে কেশে।।


বদনে ভরিছে শুধু বদনার নল।


দে জল দে জল বাবা দে জল দে জল।।” (ঋতুবর্ণন’)


১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ যখন ব্রিটিশ সরকার দমনে সমর্থ হতে লাগল তখন ইংরেজদের যুদ্ধ জয়ে রাজভক্ত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সানন্দে পদ্য রচনা করলেন মুসলিম বিদ্রোহীদের প্রতি তীব্রভাবে বিদ্রুপ করে,


“হেল্লা করে কেল্লা লুঠে দিল্লীর ভিতরে।


জেল্লা মেরে বেড়াইত অহঙ্কার ভবে।।


এখন সে কেল্লা কোথা হেল্লা কোথা আর!


জেল্লা মেরে কেবা দেয় দাড়ির বাহাব ছড়ে


পাল্লা বলে আল্লা পড়েছি বিপাকে।


কাছাখােল্লা যত মােল্লা তােবা তাল্লা ডাকে।।


সবার প্রধান হয়ে যে তুলেছে খড়ি।


দিল্লীর দুর্গেতে থেকে গুণিয়াছে কড়ি।।


হইয়া হুজুর আলি হাতে নিয়ে ছড়ি।।


করেছে হুকুম জারি তাজি ঘােড়া চড়ি।…


ধরিয়াছে রাজবেশ পরে টুপী জামা।


কোথা সেই কালনিমে রাবণের মামা।।”


(আগ্রার যুদ্ধ’)।


মুসলিমদের প্রতি কটুক্তি করে ঈশ্বরচন্দ্র আরও লিখলেন,


“দিশি পাতি নেড়ে যারা, তাতে পুড়ে হয় সারা।


মলাম মলাম মামু কয়।


হ্যাঁদুবাড়ি খেনু ব্যাল,


প্যাটেতে মাখিনু ত্যাল


নাতি তবু নিদ নাহি হয়।।” (ঋতুবর্ণন’)


এক সময় অত্যাচারী ইংরেজরা যখন মুসলমানদের হাতে মার খাচ্ছিল তখন বেদনায় ব্যথিত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখলেন


“দুর্জয় যবন নষ্ট,


করিলেক মান ভ্রষ্ট


সব গেল ব্রিটিশের ফেম।…


শুকাইল রাঙা মুখ


ইংরাজের এত দুখ,


ফাটে বুক হায় হায় হায়।”


(‘কাবুলের যুদ্ধ’)


‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদকের কামনা ছিল মুসলমানরা পরাজিত হয়ে ইংরেজরা যেন জয়ী হয়, তাই লিখলেন


“যবনের যত বংশ,


একেবারে হবে ধ্বংস


সাজিয়াছে কোম্পানীর সেনা।


গরু জরু লবে কেড়ে


চাঁপদেড়ে যত নেড়ে


এই বেলা সামাল সামাল।”


(কাবুলের যুদ্ধ’)


‘হেমন্তে বিবিধ খাদ্য’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর একটি দীর্ঘ কবিতা। এই কবিতায় সকল খাদ্যের গুণাগুণের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এর মধ্যে গম ও পেঁয়াজ প্রসঙ্গে যবনের কথা এসেছে। গম সকলের প্রিয় খাদ্য,


“হিন্দু ম্লেচ্ছ যবনাদিযত জাতি আছে।


এ যবন প্রিয়তম সকলের কাছে।।


ভূমিতলে না হইলে যবনের চারা।


যবনের দেশে নরে প্রাণে যেত মারা।।”


এই কবিতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় চরণে ‘যবন’-র অর্থ ‘গম’—‘যবনের’ পাদটীকায় ঈশ্বরচন্দ্র একথা বলেছেন। ‘যবনের দেশ’ বলতে কবি বিদেশকে বুঝিয়েছেন। পেঁয়াজ প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিশেষভাবে মুসলিমদের প্রতি কটাক্ষ করেছেন,


“যবনে ভবনে আনে যত্ন করি নানা।


তাহার সংযােগ বিনা জাঁকে নাক খানা।।


লুকোচুরী খেলা তার হিন্দুর নিকটে।


গােপনে করেন বাস বাবুদের পেটে।।…


পাজখাের যারা তারা আহারে সন্তোষ।


লােম কুঁড়ে গন্ধ ছুটে এই বড় দোষ।।”

No comments:

Post a Comment