Saturday 12 March 2022

আয়াতুস সাকিনাহ: অন্তরের প্রশান্তির আয়াত

 আয়াতুস সাকিনাহ: অন্তরের প্রশান্তির আয়াত 



আপনার মন অস্থির,  দুঃখ কষ্টে জীবন ভারাক্রান্ত,  আপনি জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত?  তবে আপনি মহা গ্রন্থ আল কুরআনের সাকিনাহ বা প্রশান্তির আয়াতগুলোর তেলাওয়াত শুনেন বা নিজে অর্থসহ তেলাওয়াত করুন অবশ্যই  মহান আল্লাহ আপনার অন্তরে প্রশান্তি দান করবেন। ইনশাআল্লাহ। এ ‘সাকিনাহ’ হচ্ছে এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি, স্বস্তি, সান্ত্বনা, স্থিরতা ও সহনশীলতা। যা আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তের ঢেলে দেন। ফলে যত ভয়-ভীতি ও বিপদাপদ আসুক না কেন সে হতাশ হবেন না, অস্থির হবেন না, ভেঙ্গে পড়বেন না বরং মানসিকভাবে শক্তি ও সাহস খুঁজে পাবেন। হে আল্লাহ আপনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি দান করুন।

কুরআনের ৬ টি বিশেষ আয়াত রয়েছে, যেগুলো ‘আয়াতুস সাকিনাহ’ (প্রশান্তির আয়াত) নামে পরিচিত। জীবনের যেকোনো কঠিন সময় ও পরিস্থিতিতে এগুলো পড়লে অন্তরে প্রশান্তি আসে। জীবনে যখন জটিলতা ও কাঠিন্য চেপে বসতো, তখন ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আয়াতুস সাকিনাহ’ তিলাওয়াত করতেন। একবার তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি তাঁর শারীরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এমন ক্রিটিক্যাল সময়েও তাঁর কিছু শত্রু নজিরবিহীনভাবে তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করে। সেই নাজুক অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখন আমার অবস্থা বেশ জটিল হয়ে পড়লো, তখন আত্মীয়-স্বজন এবং আমার আশেপাশের লোকদের বললাম—তোমরা ‘‘আয়াতুস সাকিনাহ’’ (প্রশান্তির আয়াতগুলো) তিলাওয়াত করো। ফলে, আমার কাছ থেকে সেই (জটিল) অবস্থা দূর হয়ে গেলো। আমি এমনভাবে (ওঠে) বসলাম, যেন আমার জীবনে কোনো অসুস্থতাই নেই।

ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি নিজেও পরে এই রোগে আক্রান্ত হলাম। তখন প্রশান্তি ও অন্তরের স্থিরতা আনয়নে এই আয়াতগুলোর চমৎকার প্রভাব লক্ষ করেছি। সাকিনাহ বলতে বুঝায় (অন্তরের) স্থিরতা ও ধৈর্য। সাকিনাহ এমন এক বিষয়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার অন্তরে অবতীর্ণ করেন, যখন বান্দা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। ফলে সে এই খারাপ অবস্থাতেও অস্বস্তিতে ভোগে না। এতে তাঁর ঈমান, বিশ্বাসের শক্তি এবং দৃঢ়তা বেড়ে যায়। [হাফিয ইবনুল কায়্যিম, মাদারিজুস সালিকিন: ২/৪৭৩] উল্লেখ্য, ‘সাকিনাহ’ শব্দটি একবচন, এর বহুবচন হলো ‘সুকুন’ (অনেকেই শব্দটির সাথে পরিচিত)।


ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, কুরআন মাজিদে ৬ টি স্থানে সাকিনাহর উল্লেখ এসেছে। আয়াতগুলো হলো:

১) সুরা বাকারাহ, আয়াত: ২৪৮;

২) সুরা তাওবাহ, আয়াত: ২৬;

৩) সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৪০;

৪) সুরা ফাতহ, আয়াত: ০৪;

৫) সুরা ফাতহ, আয়াত: ১৮ ও

৬) সুরা ফাতহ, আয়াত: ২৬

আহমাদ নুফাইসের কণ্ঠে আয়াতুস সাকিনাহ (প্রশান্তির আয়াতগুলো) শুনুন

https://youtu.be/lRWLYRS9zI 

এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। সেটি হলো: এই আয়াতগুলোকে ‘আয়াতুস সাকিনাহ’ বলার কারণ হলো, এগুলোতে ‘সাকিনাহ’ শব্দটি আছে এবং এইকেন্দ্রিক আলোচনা আছে। এটি কেবলই আলিমগণের নির্দেশিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ আমল। সরাসরি এই ছয়টি আয়াত প্রশান্তির জন্য পড়ার পক্ষে কুরআন বা হাদিসে কিছু বলা হয়নি। তাই, এই আমলটিকে সুন্নাহ মনে করা যাবে না। তবে, কুরআনের যেকোনো আয়াতের অর্থের দিকে লক্ষ রেখে আমল করা বৈধ, তাই এই আমলটি করতে অসুবিধা নেই। কারণ আল্লাহ কুরআনকে শেফা বা আরোগ্য বলেছেন। তিনি বলেন—

وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ

‘‘আর আমরা অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য এবং রহমত।’’ [সুরা ইসরা (বনি ইসরাইল), আয়াত: ৮২]

কুরআনের শেফা বা আরোগ্য নিয়ে অন্য কোনো পোস্টে ডিটেইলস আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।

আর, এই ছয়টি আয়াত শুধু রোগের ক্ষেত্রেই নয়, বরং যেকোনো বিপদ-মুসিবত, কাঠিন্য, সংকীর্ণতা ও দুশ্চিন্তায় আমলযোগ্য। বিশেষ কোনো নিয়ম নেই, বরং যেকোনো সময় এগুলো পড়া যাবে। পাশাপাশি বিপদ-মুসিবত ও অসুস্থতার অন্যান্য আমলগুলোও করবেন।

সাকিনাহ কী?

সাকিনাহ’ হচ্ছে শান্তি, প্রশান্তি, স্বস্তি ও সান্ত্বনা। মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুমিনের জন্য প্রশান্তিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সাকিনাহ। কুরআন সুন্নাহর একাধিক স্থানে সাকিনাহ শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। এ ‘সাকিনাহ’ হচ্ছে এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি, স্বস্তি, সান্ত্বনা, স্থিরতা ও সহনশীলতা। যা আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তের ঢেলে দেন। ফলে যত ভয়-ভীতি ও বিপদাপদ আসুক না কেন সে হতাশ হবেন না, অস্থির হবেন না, ভেঙ্গে পড়বেন না বরং মানসিকভাবে শক্তি ও সাহস খুঁজে পাবেন। এ সাকিনাহ নাজিল করার মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তাআলা মুমিনের ঈমান আরও বাড়িয়ে দেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর প্রতি বান্দার আস্থা ও নির্ভরতা আরও বেশি সুদৃঢ় হয়। 

সাকিনাহ বা প্রশান্তি মহান আল্লাহর তাআলা বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি মুমিন বান্দার প্রতি তা নাজিল করেন। এ সাকিনাহ বা প্রশান্তি অবতীর্ণ হওয়ার ফলে মুমিন বান্দার অন্তরে যেমন প্রশান্তি বেড়ে যায়, তেমনি ওইসব ঈমানদারদের সঙ্গে চলাফেরাকারী সঙ্গীদের ঈমানও বেড়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

هُوَ الَّذِي أَنزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَّعَ إِيمَانِهِمْ তিনি মুমিনদের অন্তরে সাকিনাহ (প্রশান্তি) অবতীর্ণ (দান) করেন; যাতে তাদের ঈমানের সঙ্গে আরও ঈমান বেড়ে যায়।’ (সুরা আল-ফাতহ : আয়াত ৪) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুরআন তেলাওয়াতকারীর প্রতি এ সাকিনাহ নাজিল হয়।’ হাদিসের বর্ণনায় তা প্রমাণিত- হজরত বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘একবার এক ব্যক্তি সুরা কাহফ তেলাওয়াত করছিল। তার পাশেই দুটি রশি দিয়ে একটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। ওই সময় এক খণ্ড মেঘ তাকে ঢেকে নিল। মেঘের খণ্ডটি যতই লোকটির কাছাকাছি হতে লাগলো; তা দেখে ঘোড়াটি চমকাতে আরম্ভ করল। অতপর যখন সকাল হল তখন লোকটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন এবং ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। ঘটনাটি (শুনে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘সেটি ছিল ‘সাকিনাহ বা প্রশান্তি’; যা তোমার কুরআন তেলাওয়াতের কারণে নাজিল হচ্ছিল।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সাকিনাহ লাভের উপায় ও দোয়া: আল্লাহর রহমত ছাড়া সাকিনাহ বা প্রশান্তি পাওয়ার কোনো উপায় নাই। সে কারণেই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা, কুরআন তেলাওয়াত করা কিংবা আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। তাই মুমিন মুসলমানের উচিত- - বেশি বেশি জিকির ও দোয়া করা।–

اَللَّهُمَّ أَنْزِل عَلَى قَلْبِىْ السَّكِيْنَة উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আংযিল আলা ক্বালবি সাকিনাহ’

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে সাকিনাহ বা প্রশান্তি দান করুন।’


- কুরআন তেলাওয়াত করা।


- বেশি বেশি তওবা-ইসতেগফার করা।


- নিজের কাজের আত্মসমালোচনা করে সংশোধন হওয়ার প্রচেষ্টা করা।


- ভালো-মন্দ সব বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালার ওপর বিশ্বাস রাখা।


- কল্যাণ লাভে আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করা।


- গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা।


- আল্লাহর দেয়া ফরজ বিধান ঈমানি মজবুতির সঙ্গে আদায়, ফরজ নামাজে যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি বেশি বেশি নফল ইবাদত করা।


- সৎ লোকদের সংস্পর্শে থাকা।


- সব সময় অল্প প্রাপ্তিতেই সন্তুষ্ট থাকা এবং দুনিয়ার দিকে উচ্চভিলাষী দৃষ্টিতে তাকানো থেকে বিরত থাকা।


তবেই আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দার প্রতি নাজিল করবেন সাকিনাহ বা প্রশান্তি। দান করবেন ঈমানের মিষ্টতা, অনাবিল সুখ, শান্তি ও পরিতৃপ্তি। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমিন।


মনে রাখা জরুরি: সাকিনাহ যেহেতু বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহ। তাই আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপনের বিকল্প নেই। যখনই বান্দা মহান আল্লাহর রঙে নিজের জীবন রাঙিয়ে তুলবে তখনই তার ওপর নাজিল হতে থাকবে সাকিনাহ বা প্রশান্তি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবে বিজয় ও ক্ষমা এবং জীবন নেয়ামতে পরিপূর্ণ হবে। আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন-


‘(হে রাসুল!) নিশ্চয় আপনার জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট বিজয়। যাতে আল্লাহ তাআলা আপনার অতিত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আপনার প্রতি তার নেয়ামত পূর্ন করে দিয়েছেন। আর আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। আর আপনাকে দান করেছেন বলিষ্ট সাহায্য। তিনিই সেই মহান সত্তা; যিনি মুমিনের অন্তরে প্রশান্তি নাজিল করেন। যাতে তাদের ঈমানের সঙ্গে আরও ঈমান বেড়ে যায়। আসমান ও জমিনের সব বাহিনী মহান আল্লাহর জন্য। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ফাতহ : আয়াত ১-৪) আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে দান করুন তার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত সাকিনাহ। যে সাকিনাহ লাভে মুমিন হবে ধন্য। পাবে গোনাহমুক্ত নেয়ামতে পরিপূর্ণ জীবন। আমিন।


No comments:

Post a Comment