মুসলমান নামধারী বকধার্মিক ফরহাদ মাজহার মুসলমান সমাজে বিভ্রান্তির বিষ ঢুকাচ্ছে?
মুসলমান নামধারী বাউল,মারফতী বা নেড়ার পীর-ফকীরদের সাধন পদ্ধতি বৈষ্ণবদের মতোই অশালীন । এ ফকীরের দল বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। যথা আউল, বাউল, কর্তাভজা, সহজিয়া প্রভৃতি। এগুলি হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব ও চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ যাতে করে সাধারণ অজ্ঞ মুসলমানদেরকে বিপথগামী করা যায়।
এদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। মদ্য পান, নারীপুরুষে অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়েরই সাধনপদ্ধতির মধ্যে অনিবার্যরূপে শামিল।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর রচিত মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে এসব বাউলদের সম্পর্কে বলেনঃ
“কোরআন মজিদের বিভিন্ন শব্দ ও মূলতত্বের যে ব্যাখ্যা এই সমস্ত শয়তান নেড়ার ফকীরের দল দিয়াছে, তাহাও অদ্ভুত। ‘হাওজে কাওসার’ বলিতে তারা বেহেশতী সঞ্জীবনী সুধার পরিবর্তে স্ত্রীলোকের রজঃ বা ঋতুশ্রাব বুঝে। যে পূজাপদ্ধতিতে এ ঘৃণ্য ফকীরের দল বীর্য পান করে, তাহার সূচনায় বীজ মে আল্লাহ (মায়াযাল্লাহ, মায়াযাল্লাহ) অর্থাৎ বীর্যে আল্লাহ অবস্থান করেন –এই অর্থে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করে থাকে।
“এই মুসলিম ভিক্ষোপবীজী নেড়ার ফকীর দলের পুরোহিত বা পীরেরা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপিনীদের বস্ত্র হরণের অনুরূপ এক অভিনয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে ।
(মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস-মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ । )
ড. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন,
“ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
বাউলরা ওহী বা ঐশী ভিত্তিক কোন ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থাকে স্বীকার করে না । তারা দেশ জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে কেবল মানুষকে জানতে,মানতে ও শ্রদ্ধা জানাতে চায় । মানুষের ভিতর মনের মানুষকে খুঁজে পেতে চায় ।
শ্রী চৈতন্যকে বৈষ্ণব সমাজ শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে, এমনকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণরূপে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। গোটা হিন্দু সমাজের মধ্যে শ্রীচৈতন্য এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন।
স্যার যদুনাথ সরকার বলেনঃ
“এ এমন এক সময় যখন প্রভু গৌরাংগের প্রতীক স্বরূপ বাংগালীর মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাঁর প্রেম ও ক্ষমার বাণী সমগ্র ভারতকে বিমোহিত করে। বাংগালীর হৃদয়মন সকল বন্ধন ছিন্ন করে রাধাকৃষ্ণের লীলা গীতিকার দ্বারা সম্মোহিত হয়। বৈষ্ণব ধর্মের আবেগ অনুভূতিতে, কাব্যে, গানে, সামাজিক সহনশীলতা এবং ধর্মীয় অনুরাগে মনের উচ্ছ্বাস পরবর্তী দেড় শতাব্দী যাবত অব্যাহত গতিতে চলে। এ হিন্দু রেনেসাঁ এবং হোসেন শাহী বংশ ওতপ্রোত জড়িত। এ যুগে বৈষ্ণব ধর্মের এবং বাংলা সাহিত্যের যে উন্নতি অগ্রততি হয়েছিল তা অনুধাবন করতে গেলে গৌড়ের মুসলমান প্রভুর উদার ও সংস্কৃতি সম্পন্ন শাসনের কথা অবশ্যই মনে পড়ে”।
‘যদুনাথ সরকার, দি হিষ্ট্রী অব বেঙল, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৪৭)
প্রকৃতপক্ষে চৈতণ্যের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য কি ছিল, তা তাঁর নিজের কথায় আমরা সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি। চৈতন্য চরিতামৃত আদি লীলা, ১২০ পৃষ্ঠায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন-
“পাষণ্ডি সংহারিতে মোর এই অবতার।
পাষণ্ডি সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার”।
এখন বুঝা গেল পাষণ্ডি সংহার করাই তাঁর জীবনের আসল লক্ষ্য। ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, মুসলমানগণ বাংলা অধিকার করার সময় বৌদ্ধ মতবাদ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের যে বিপুলসংখ্যক লোক এদেশে বাস করতো, ব্রাহ্মগণ তাদেঁরকে ধর্মের আশ্রয়ে আনতে অস্বীকার করেন। তার ফলে তারা বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশ করতে থাকে। তাহলে এদেশে হিন্দু, বৈষ্ণব সমাজ ও মুসলমান ব্যতীত সে সময়ে আর কোন ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে পাষণ্ডি ছিল কারা যাদের সংহারের জন্যে চৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল?
মওলানা আকরাম খাঁ বলেনঃ
“মনুর মতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অহিন্দু মাত্রই এই পর্যায়ভুক্ত (সরল বাংলা অভিধান)। আভিধানিক সুবল চন্দ্র মিত্র তাঁহার Beng-Eng Dictionary তে পাষন্ডি শব্দের অর্তে বলিতেছেন- “Not conforming himself to the tenets Vedas: Atheistic. Jaina or Buddha. A non-Hindu –বেদ অমান্যকারী, অন্য বর্ণের চিহ্নধারী এবং অহিন্দু –পাষন্ডির এই তিনটি বিশ্লেষণ সর্বত্র প্রতত্ত হইয়াছে”।
এখন পাষন্ডি বলতে যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই বুঝায়, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, সত্য সত্যই কি চৈতন্য পাষন্ডি তথা মুসলমানদেরকে এদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন? আপাতঃদৃষ্টিতে দেখা যায়, চৈতন্যের সমসাময়িক সুলতান হোসেন শাহের পরেও এদেশে কয়েক শতাব্দী পর্যণ্ত মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হোসেন শাহ কর্তৃক চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও বৈষ্ণব সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য সহযোগিতার দ্বারা মুসলমানদের আকীদাহ বিশ্বাসের মধ্যে শির্ক বিদয়াতের যে আবর্জনা জমে উঠেছিল তা-ই পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কারণ হয়।
আজকে ফরহাদ মজহার একটি পোষ্ট দিয়েছেন ফেসবুকে । এর সাথে উপরে উল্লিখিত বক্তব্যের সাযুজ্য দেখুন । ফরহাদ মজহার আমাদের কোথায় নিতে চান?
"এবার ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়ায় ( বা নদিয়ায় ) গৌর পূর্ণিমার সাধুসঙ্গ ও উৎসব হবে। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি যথারীতি ফকির লালন শাহের প্রবর্তিত গৌরপূর্ণিমার তিথি মেনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এবারের বিষয়ঃ 'আপন ঘরের খবর নে না'।
ফকির লালন শাহ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবকে স্মরণীয় রাখার জন্য তাঁর জীবদ্দশায় ফাল্গুনি পূর্ণিমায় যে সাধুসঙ্গ প্রবর্তন করেছেন তার তাৎপর্য দুর্দান্ত।
কৃষ্ণ পুরাণে ভগবান, কিন্তু তিনি মানুষ লীলা করবার জন্য ভবে অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বয়ং ঈশ্বর এরপর থেকে আর পুরাণ, কল্পনা, বেদ, শাস্ত্র বা বুদ্ধির নির্মাণ হয়ে রইলেন না, রক্তমাংসের মানুষ হিশাবে 'অবতরণ' করলেন। চৈতন্য তাই 'অবতার'। একই কারণে 'কলিযুগে মানুষই অবতার'। কারন ঈশ্বর এখন মানুষের ইতিহাস হবেন এবং মানুষের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিজে 'আস্বাদন' করবেন। তিনি পুরাণের কেচ্ছা হয়ে থাকবেন না।
এরপর থেকে ঈশ্বরকে বুঝতে হলে 'মানুষ'কে বুঝতে হবে। মানুষের বিবর্তন ও ইতিহাস বুঝতে হবে। মানুষ ভজনাই তাই নদীয়ার ফকিরি ধ্যান ও চর্চার কেন্দ্রীয় বিষয়। হোসেন শাহের বাংলায় প্রথম ফকির হিশাবে চৈতন্য নদীয়ায় হাজির হলেন। ফাল্গুনি পূর্ণিমা চৈতন্যের কারণে 'গৌরপূর্ণিমা' নামে বাংলায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হোল। ফকির লালন শাহের বিখ্যাত সাধুসঙ্গও সেই জন্য গৌরপূর্ণিমার তিথি মেনে শুরু হয়, তিথি মেনে শেষ হয়।
পুরানে ভগবান ছিলেন 'কৃষ্ণ', অর্থাৎ ঘোর কালো। কিন্তু নদিয়ায় সাধন গুণে তিনি 'গৌর' বা ফর্শা হলেন। কি সাধনে কালো 'গোরা' হোল নদিয়ার ফকিরি তত্ত্বের এটাই গোড়ার জিজ্ঞাসা। অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ বহিরঙ্গে রাধার ভেদবিচারের মধ্য দিয়ে এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে হবে। ফকিরি ভাষায় তার আরেক নাম 'নিহেতু প্রেম'। যে ভালবাসার কোন হেতু নাই।
অপরের প্রতি নিঃশর্ত প্রেমের অপর নামই ফকিরি। কিন্তু ডুগি-তবলা বাজিয়ে নেচেকুঁদে গান করা, মাজার পূজা, গাঁজা-ভাঙ নেশাকে দম সাধনা বলা আর বড় বড় মালা পরে ফকির-সন্যাসীর বেশ ধরে ঘুরে বেড়ানোকে ফকিরি বলে না। নিহেতু প্রেমের সামাজিক-রাজনৈতিক চর্চার রূপ আছে। কিন্তু এক ধরণের মাজারি চর্চা ও বাউলগিরি নদীয়ার ফকির লালন শাহের ধারাকে অস্পষ্ট ও ম্লান করে দিচ্ছে। লালন নিজেকে কোত্থাও 'বাউল' বলেন নি। কিন্তু তাঁকে সুফি, বাউল ইত্যাদি বানিয়ে তিনি যা পরিহার ও বিরোধিতা করে গিয়েছেন সেটাই তার নামে চালানো হয়। মড়ার ওপর খাঁড়া হেনে কল্লা কাটার মতো লালনের ধাম এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যা কিছু রেশ অবশিষ্ট তাকে রক্ষা করা ভীষণ কঠিন হয়ে গিয়েছে।
তিনটি দিক মনে রাখলে নদিয়ার ভাবচর্চার সামাজিক-রাজনৈতিক রূপ আমরা মোটামুটি বুঝতে পারি। প্রথমত কঠোর ভাবে জাতপাতের বিরোধিতা, দ্বিতীয়ত ধনি গরিব ভেদের বিরোধিতা -- বিশেষত যে ব্যবস্থা মানুষকে ধনি গরিবে বিভক্ত করে সেই ব্যবস্থাকে মেনে না নেওয়া। এবং তৃতীয়ত নারী-পুরুষ ভেদ অস্বীকার করা।
নারী-পুরুষ ভেদ অস্বীকার করতে হবে কেন? কারণ লিঙ্গ দিয়ে 'মানুষ' চেনা যায় না, শুধু জীব কি করে নিজেকে নিজে জীব হিশাবে পয়দা করে কেবল সেটাই বোঝা যায়। এই জানাবোঝার মানে প্রকৃতিকে বোঝা। 'প্রকৃতি' নদীয়ার ধারণা অনুযায়ী স্থির বা অচল কোন বিষয় না, বরং চলমান প্রক্রিয়া, বিবর্তন বা প্রাকৃতিকতা। সব মানুষই প্রকৃতি কারণ তারা প্রাকৃতিক বিবর্তনের অন্তর্গত। জীবের জন্মমৃত্যু আছে। বায়লজিকাল পুরুষকে আলাদা ভাবে বুঝলে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বোঝা যায় না। তাই ভজনা করতে হবে বা বুঝতে হবে মাকে 'মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা'। মাকে চিনলে বাপকে চেনা যায়। নদীয়া এই দিক থেকে প্রকৃতিবাদী -- অর্থাৎ প্রক্রিয়াবাদিও বটে:
"পুরুষ পরওয়ারদিগার
অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার
প্রকৃতি প্রকৃত সংসার সৃষ্টি সবজনা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা।
তাহলে মনুষ্যকুলের চ্যালেঞ্জ কি? সেটা নিশ্চয়ই জীব হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া নয় জীবাবস্থা অতিক্রম করে মানুষের মধ্যে যে বিপুল সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে তার বিকাশ ঘটানো। সেই জন্য নদীয়ারা হাহাকার:
কতো কোটি লক্ষ যোনি
ভ্রমণ করেছ তুমি
মানব জন্মে মনরে তুমি
কি করিলে কি করিলে কি করিলে?
আর কি হবে এমন জনম বসব সাধুর মেলে!!
যারা এবার সাধুসঙ্গ ও উৎসবে আসবেন তার এই হাহাকার মনে রাখবেন। মানব জন্ম পেয়েছেন, কিন্তু করলেনটা কী? সাধুসঙ্গ জবাবাদিহির 'মেল' বা ক্ষেত্র। বুঝে শুনে আসবেন। সবাইকে স্বাগতম"।