ব্রিটিশ ভারতে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক
কোরবানি হলো আল্লাহ’র পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষা হযরত আদম আ.-এর যুগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। তবে তাদের পদ্ধতিটা ছিলো ভিন্ন। বর্তমান কোরবানি করা হয় নির্দিষ্ট পশু দ্বারা। এটি শুরু হয় হযরত ইবরাহিম আ.-এর যুগ থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের পর্যন্ত চলে এসেছে। কোরবানির নির্দিষ্ট পশুর একটি হলো গরু। ভারতীয় উপমহাদেশে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক! বর্তমান আমরা তো অনায়েসে গরু দ্বারা কোরবানি করে ফেলি। কোনপ্রকার বাঁধা আসে না। কিন্তু এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের পক্ষে অতটা সহজ ছিলো না। বহু কষ্টে এটি সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের অভিনবত্ব সম্ভবত একটা জায়গাতেই, গরুর মাংস। গরুর মাংসের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন এবং রক্ত দিতে হয়েছে, এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা সন্দেহ। বনী ইসরাইলের সামেরির পরে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গরু হল পূর্ব বাংলার গরু।
সিলেটের রাজা গৌড় গৌবিন্দ সম্পর্কে কম বেশি সবারই জানার কথা। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে একজন ব্যক্তি উনার শিশুপুত্রের আকিকার জন্য গরু কুরবানী করেছিলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে গৌড় গোবিন্দ শেখ বোরহানউদ্দিনের হাত কেটে দেয় এবং শিশু পুত্রকে হত্যা করেন। বোরহানউদ্দিন বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের কাছে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করেন। ফিরোজ শাহ উনার ভাতিজা সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে একটা সেনাবাহিনী পাঠান। গৌড় গোবিন্দের শক্তিশালী বাহিনীর কাছে সিকান্দার গাজী দুইবার পরাজিত হন। তৃতীয়বার প্রধান সেনাপতি নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে আবারও অভিযান প্রেরণ করা হয়। এই জিহাদে ৩৬০ জন দরবেশকে নিয়ে হযরত শাহজালাল (র.) নাসিরুদ্দিনের বাহিনীর সাথে যোগ দেন। এবার গৌড় গোবিন্দ পরাজিত হয় এবং সিলেট বাংলা সালতানাতের সাথে যুক্ত হয়। সময়টা ছিল ১৩০৩ সাল।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে মুন্সিগঞ্জে। ১১৭৮ সালে এখানে ইসলাম প্রচার করতে আরব থেকে আসেন হযরত আদম (র.)। তিনি একটি গরু কোরবানি করেন। এতে রাজা বল্লাল সেন ক্রুদ্ধ হয়ে স্বসৈন্যে হযরত আদম (র.) এর বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। বল্লাল সেন আদম (র.)কে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করেন। এর প্রতিক্রিয়াতে মুন্সিগঞ্জও বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়। ব্রিটিশ ফিরিঙ্গিদের আমলে সূর্যাস্ত আইন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন আইনের কারনে প্রায় সব মুসলিম জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের স্থানে বসানো হয় হিন্দুদের। হিন্দু জমিদাররা পুনরায় তাদের পূর্বোক্ত গৌড় গৌবিন্দ, বল্লাল সেনদের মত গরু কোরবানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়। মুসলমানরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সংগ্রাম করে, ব্রিটিশ সরকারকে একাধিকবার স্মারকলিপি দেয়। তবে হিন্দু জমিদাররা চরমতম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে তা দমন করে।
ঢাকায় নবাব পরিবারের প্রভাব ছিল, একমাত্র এই ঢাকা ছাড়া সারাদেশে কোথাও মুসলমানরা গরু কোরবানি দিতে পারতো না। সবাই ছাগল(বকরি) কোরবানি দিতো। তাই কালক্রমে ঈদুল আজহা 'বকরির ঈদ' নামে পরিচিতি লাভ করে। এভাবেই চলে শত বছর। এরপর খাজা সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম লীগ। তারপর শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তারপর ১৯৪৭। পূর্ব বাংলা মুক্ত হয় ব্রিটিশ বেনিয়া এবং হিন্দু জমিদারদের কালো হাত থেকে।
এ সম্পর্কে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, “আজকে আমরা ইদ-উল-আজাহায় কোরবানির জন্য অনায়সে গরু কিনে এনে সহজেই কোরবানি দিয়ে ফেলি। কিন্তু আশি-একশো দুরে থাকুক পঞ্চশ বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না৷ আজকের প্রজন্ম হয়তো অবাক হবে যে, এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে৷ এবং কোরবানি (বিশেষ করে গরু কোরবানি) দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ-দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে ৷”
( বাংলাদেশের উৎসব, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৩২)
তিনি আরও লিখেছেন, “১৯০৫ সালে চাঁদপুরে কয়েকজন কোরবানি উপলক্ষে গরু কোরবানি দিয়েছিল ৷ এর ফলে জৈনক গোপাল চন্দ্র মজুমদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷ অভিযোগ ছিলো মুসলমানরা প্রকাশ্য রাস্তায় গরু জবেহ করেছে এবং বদ্ধজলে গোসত ধুয়ে জল অপবিত্র করেছে৷ জেলা হাকিম ছিলো জগদীশচন্দ্র সেন ৷ সে তিনজন মুসলিমকে অভিযুক্ত করে একজনকে এক মাসের জেল এবং অপর দুজনকে যথাক্রমে পঞ্চাশ ও পনের টাকা জরিমানা করেছিল৷”
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ৩৪ )
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক মীর মোশারেফ হোসেন মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করে গরু কোরবানীর বিরোধীতা করেন৷ এবং এ নিয়ে তিনি “গো জীবন” নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন ৷ এ জন্য তিনি প্রতিবেশি হিন্দু সমাজের সমর্থনও পান৷ তার গো-জীবন গ্রন্থের মুখবন্ধ দেন এলাহাবাদের গো রক্ষিনী সভার শ্রী শ্রীমান স্বামী৷ গরু কুরবানির বিরোধীতা করার জন্য টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত “মাসিক আখবারে এসলামীয়া” এর সম্পাদক মৌলবী নঈমুদ্দীন কর্তৃক এক জনসভায় মীর মোশারেফ হোসেনকে কাফেরও
ঘোষণা করা হয়েছিল৷ ফলে কবি মীর মোশারেফ হোসেন তার বিরুদ্ধে…
মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)
উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।
মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)
উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।
মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)
উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।
সুবাতাস বইতে শুরু করে। তবে তা একদিনে হয়নি। প্রাক্তন আমলা পি.এ নজির "স্মৃতির পাতা থেকে" শীর্ষক বইয়ে চাকুরী জীবনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন (এই বইটা সম্ভবত এখন নিষিদ্ধ)। ১৯৫৬ সালেও নাটোরের মানুষ গরু কোরবানি দেবার কথা ভাবতেও পারতো না। উনার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে নাটোর শহরে প্রথমবারের মত গরু কোরবানি দেওয়া হয় তাও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। একের পর এক বাঁধা আসে। একই অবস্থা ছিলো ময়মনসিংহ, যশোরে। গরুর মাংস নেহাৎ একটা খাবার না। গরুর মাংস পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শত বছরের সংগ্রামের একটা চিহ্ন। এজন্য সম্ভবত নজরুল কোরবানি কবিতায় বলেছিলেন,
"ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্বোধন।
ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্বোধন।